ইষ্রা ও নহিমিয় এই দুইটি পুস্তক একসাথে যিহূদীদের একশো বছরের ইতিহাস বর্ণনা করে (৫৩৯-৪৩২ খ্রীঃপূঃ)। কিভাবে তারা বাবিলে নির্বাসন থেকে যিহূদায় ফিরে যায় এবং যিরূশালেমে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর তৈরি করে, আরাধনা ও আইন-শিক্ষা উন্নত করে এবং যিরূশালেমের দেওয়াল পুনরায় নির্মাণ করে। ইব্রীয় পবিত্র শাস্ত্রে ইষ্রা ও নহিমিয় হল একটি যুগল পুস্তক, ‘ইষ্রা ১’ ও ‘ইষ্রা ২’। প্রকৃতভাবে দুইটি পুস্তক অনেক বিষয়ে সম্পর্কিত এবং দুইটি পুস্তক একজনই লেখক দ্বারা লিখিত বা প্রকাশিত: ধর্ম-শিক্ষক ইষ্রা।
৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদীদের বাবিলে নির্বাসনে নেওয়া হয়েছিল যেখানে তারা মোটামুটি ভাল অবস্থায় জীবন-যাপন করতে পেরেছিল। ভাববাদী যিরমিয় একটি অবিশ্বাস্য ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিলেন যে, সত্তর বছরের মধ্যে শক্তিশালী বাবিল সাম্রাজ্যকে পরাজিত করা হবে এবং এভাবে যিহূদীদের নির্বাসনও শেষ হয়ে যাবে (যির ২৯:১১)। যখন ৫৩৯ খ্রীষ্টপূর্বে রাজা কোরসের নেতৃত্বে মাদিয়-পারস্যরা বাবিল সাম্রাজ্য দখল করে তখন বড় একটি পরিবর্তন ঘটে। বাবিলীয়দের চেয়ে মাদিয়-পারস্যদের নিয়ম সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল: তারা ৫৩৮ খ্রীষ্টপূর্বে বাবিলীয়দের দ্বারা দখল ও নির্বাসিত জাতিদের নিজেদের দেশে ফেরার ও সেখানে তাদের জীবন পুনরায় গঠনের অনুমতি দেয়। যিহূদীরাও ফেরার এবং ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর পুনরায় নির্মাণের অনুমতি পায়। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ দিয়ে ইষ্রা তার পুস্তকটি শুরু করেন। এই ঘটনার উল্লেখের মধ্য দিয়ে তিনি ইতিহাসের উপরে ঈশ্বরের ক্ষমতা এবং পূর্বে ঘোষিত ভাববাণীর প্রতি তাঁর বিশ্বস্ততা দেখান।
৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে রাজা যিহোয়াখীনের নাতী সরুব্বাবিলের নেতৃত্বে কমবেশি পঞ্চাশ হাজার যিহূদী যিহূদায় ফিরে যায় (ইষ্রা ১)। সরুব্বাবিলের আরেক নাম হল শেশবসর। ইষ্রা পুস্তকটিতে ফিরে আসা যিহূদীদের নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে, পরিবার অনুসারে অথবা বাসস্থান অনুসারে তাদের নামগুলো উল্লেখ করা হয় (ইষ্রা ২)। এই নামের তালিকা দ্বারা ইষ্রা দেখাতে চান যে, ঈশ্বরের আহ্বানের প্রতি বাধ্য প্রত্যেক ব্যক্তি ঈশ্বরের দৃষ্টিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ!
যিহূদায় পৌঁছানোর সাথে সাথে যিহূদীরা ব্রোঞ্জের বেদী তৈরি করে এবং তা সঠিক স্থানে বসিয়ে নিয়মিত উৎসর্গগুলো দান করতে শুরু করে। এভাবে তারা তাদের আত্মিক কেন্দ্র পুনরায় স্থাপন করে, ঈশ্বরের আরাধনা করতে এবং মোশির আইন-কানুন অনুসারে ঈশ্বরের সম্মুখে আসতে শুরু করে (ইষ্রা ৩:১-৬)। এছাড়া তারা বিভিন্ন গ্রামে জমির অধিকার নিয়ে সেখানে বাস করতে এবং ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর পুনরায় নির্মাণ করতে শুরু করে (৫৩৬ খ্রীঃপূঃ)। কিন্তু বেশ তাড়াতাড়ি শমরীয়েরা বাধা দিতে আরম্ভ করে। শমরীয়েরা ছিল একটি মিশানো জাতি (ইস্রায়েল ও পরজাতি) যারা একটি মিশানো ধর্মও পালন করত (সদাপ্রভুর আরাধনা ও দেবতাপূজা)। তারা প্রথমে উপাসনা-ঘর নির্মাণ কাজে সাহায্য করতে চায় কিন্তু সরুব্বাবিল (সম্ভবত ধর্ম মিশানোর ভয়ে) তাদের অংশ গ্রহণে রাজি হন না। অনুমতি না পেয়ে শমরীয়েরা যিহূদীদের হুমকি দিতে শুরু করে এবং বিভিন্ন কর্মচারীদের ঘুষ দেওয়া দ্বারা নির্মাণের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে প্রায় ১৫ বছর পর্যন্ত উপাসনা-ঘরের নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায় (ইষ্রা ৪)।
৫২০ খ্রীষ্টপূর্বে ঈশ্বর ভাববাদী হগয় ও সখরিয়ের মধ্য দিয়ে যিহূদীদেরকে উপাসনা-ঘর নির্মাণ পুনরায় হাতে নিতে চ্যালেঞ্জ করেন। তারা বাধ্য হয়ে কাজ আবার শুরু করে এবং সাথে সাথে বিরোধিতা ও বাধাও আসতে থাকে, এইবার শাসনকর্তা তত্তনয় এবং শথরবোষণয় নামে একজন নেতার মধ্য দিয়ে। তারা মাদিয়-পারস্য রাজা দারিয়াবসকে নির্মাণের বিষয় জানান এবং তার কাছ থেকে এই বিষয়ে পরামর্শ চান (ইষ্রা ৫)। কিন্তু এবার যিহূদীরা নির্মাণ কাজ বন্ধ হতে দেয় না। রাজা দারিয়াবস সরকারি সংরক্ষণাগারে যিহূদীদের উপাসনা-ঘর নির্মাণের অনুমতি দলিল খোঁজার আদেশ দেন এবং তারা সেই দলিল খুঁজে পায়। তাতে দারিয়াবস তত্তনয়কে আদেশ দেন যেন তিনি যিহূদীদের নির্মাণে বাধা না দিয়ে বরং সমর্থন করেন। উপাসনা-ঘর নির্মাণ কাজ ৫১৬ খ্রীষ্টপূর্বে সমাপ্ত হয়, অর্থাৎ উপসনা-ঘরের ধ্বংসের (৫৮৬ খ্রীঃপূঃ) ঠিক সত্তর বছর পরে।
৪৫৮ খ্রীষ্টপূর্বে পণ্ডিত ইষ্রা আরো কমবেশি পাঁচ হাজার যিহূদী নিয়ে বাবিল ত্যাগ করে যিহূদায় ফিরে আসেন। এই দলের বেশিরভাগ লোক ছিল লেবীয় বংশের ও পুরোহিত পরিবারের। ইষ্রা মাদিয়-পারস্য রাজা অর্তক্ষস্তের কাছ থেকে একটি চিঠি নিয়ে আসেন যাতে তিনি যিরূশালেমের উপাসনা-ঘরের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যোগানের ব্যবস্থা করেন এবং লেবীয়দেরকে কর্ দেওয়ার দায়িত্ব থেকে মুক্ত করেন (ইষ্রা ৭-৮)।
ইষ্রা যখন যিরূশালেমে পৌঁছান তখন তিনি হতভম্ব হন এই কথা শুনে যে, যিহূদীরা আবার দেবতাপূজারী মহিলাদের বিয়ে করতে শুরু করেছে। এটা ঠিক সেই পাপ, যার কারণে ইতিহাসে ইস্রায়েলের পতন শুরু হয়েছিল (বিচার ২, ১ রাজা ১১)। ইষ্রা ঘন্টার পর ঘন্টা হতভম্ব অবস্থায় বসে থেকে শেষে অনুতাপের প্রার্থনা করেন। ধীরে ধীরে যিহূদীরা চেতনা পেয়ে সাড়া দিতে শুরু করে। তারা একটি চুক্তি করার প্রস্তাব দেয় যাতে তারা নিজেদেরকে দেবতাপূজারী স্ত্রীদের ছেড়ে দিতে সমর্পিত করে। প্রকৃতপক্ষে তারা তা খুব গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করে (ইষ্রা ১০)। মোট একশো দশটি বিবাহ বাতিল করা হয়। অনুমান করে বলা যায় যে, এই একশো দশটি বিবাহ ছিল ঐসময়ের সব বিবাহের মধ্যে এক শতাংশের চেয়েও কম। হতে পারে, সমস্যাটি মাত্র শুরু হয়েছিল এবং ইষ্রা তা তাড়াতাড়ি ও কার্যকারীভাবে সমাধান করতে সক্ষম হন।
ইষ্রা তার পুস্তক লেখেন যেন ফিরে আসা যিহূদীরা সান্ত্বনা ও উৎসাহ পায় যে, যদিও তারা ছোট দল এবং অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল তবুও ঈশ্বরের আহ্বান বাস্তবে তাদেরই উপরে আছে। তারা যেমন আশা করেছিল যদিও ঠিক তেমনি হয় নি (লোকসংখ্যা কম, চারিদিকে দেবতাপূজারী জাতি, মাত্র অল্প জমি এবং দায়ূদ বংশের কোন রাজা নেই) তবুও ঈশ্বর তাদের সঙ্গে আছেন, তাদের রক্ষা করতে থাকেন এবং বিদেশী সরকারের অধীনে থাকলেও সরকারের চোখে তাদেরকে অনুগ্রহ দিতে থাকেন। তিনি তাদের নিশ্চয়তা দেন যে, ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা তাদেরই উপর আছে। তিনি তাদের চ্যালেঞ্জও করেন যে, কেবল আইন-কানুনের প্রতি বাধ্য থাকলেই তারা প্রকৃতভাবে ঈশ্বরের মনোনীত জাতি হয়ে টিকতে পারবে।
ইষ্রা পুস্তক এবং তার লেখক
ইষ্রা ও নহিমিয় এই দু’টি পুস্তক একসাথে যিহূদীদের একশো বছরের ইতিহাস বর্ণনা করে (৫৩৯-৪৩২ খ্রীঃপূঃ)। কিভাবে তারা বাবিলে নির্বাসন থেকে যিহূদায় ফিরে যায় এবং যিরূশালেমে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর তৈরি করে, আরাধনা ও আইন-শিক্ষা উন্নত করে এবং যিরূশালেমের দেওয়াল পুনরায় নির্মাণ করে। ইব্রীয় পবিত্র শাস্ত্রে ইষ্রা ও নহিমিয় হল একটি যুগল পুস্তক, ‘ইষ্রা ১’ ও ‘ইষ্রা ২’। প্রকৃতভাবে দুইটি পুস্তক অনেক বিষয়ে সম্পর্কিত এবং দুইটি পুস্তক একজনই লেখক দ্বারা লিখিত বা প্রকাশিত: ধর্ম-শিক্ষক ইষ্রা।
পুস্তকে বর্ণিত যত ঘটনাতে ইষ্রা নিজেই উপস্থিত ছিলেন, সেই ঘটনাগুলো তিনি “আমি” দ্বারা বর্ণনা করেন (যেমন ইষ্রা ৭:২৮, ৮:১৫)। এভাবে তিনি লেখক হিসাবে তার পরিচয় বেশ পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেন। যিহূদী ঐতিহ্য অনুসারে ধর্ম-শিক্ষক ইষ্রা হলেন ৩টি পুস্তকের লেখক: ইষ্রা, নহিমিয় ও বংশাবলি পুস্তক। প্রকৃতভাবে বংশাবলি ও ইষ্রা পুস্তক শক্তিশালীভাবে সংযুক্ত: বংশাবলি পুস্তকের শেষ অনুচ্ছেদ (২ বংশা ৩৬:২২-২৩) এবং ইষ্রার পুস্তকের প্রথম অনু্চ্ছেদ (ইষ্রা ১:১-৪) হল একই ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা (কোরসের অনুমতি) এবং বর্ণনাতে প্রায় হুবহু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
ইষ্রা একটি পুরোহিত পরিবারের সন্তান। তিনি ইলিয়াসরের মধ্য দিয়ে হারোণের বংশধর এবং একজন ধর্ম-শিক্ষক, অর্থাৎ মোশির আইন-কানুনের পণ্ডিত। তার সম্বন্ধে এই বর্ণনা দেওয়া হয়েছে: “ইষ্রা সদাপ্রভুর আইন-কানুন পড়বার, তা পালন করবার এবং তার নিয়ম ও নির্দেশ ইস্রায়েল দেশে শিক্ষা দেবার জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন” (ইষ্রা ৭:১০)। এই ত্রিপদী থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আসে: প্রথমত নিজেই আইন জানার জন্য আগ্রহ প্রয়োজন, দ্বিতীয়ত আইন পালন করতে সমর্পিত হতে হবে (বাধ্য না হলে আইন প্রকৃতভাবে জানা যায় না) এবং তৃতীয়ত আইন অন্যদের শেখানোর আগ্রহ থাকা দরকার।
ঈশ্বরের দেওয়া ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পূর্ণ হয়
৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদীদের বাবিলে নির্বাসনে নেওয়া হয়েছিল যেখানে তারা মোটামুটি ভাল অবস্থায় জীবন-যাপন করতে পেরেছিল। ভাববাদী যিরমিয় সাহসের সাথে একটি অবিশ্বাস্য ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিলেন যে, সত্তর বছরের মধ্যে শক্তিশালী বাবিল সাম্রাজ্যকে পরাজিত করা হবে (যির ৫০-৫১) এবং এভাবে ৭০ বছরের মধ্যে যিহূদীদের নির্বাসনও শেষ হয়ে যাবে (যির ২৯:১১)। যখন ৫৩৯ খ্রীষ্টপূর্বে রাজা কোরসের নেতৃত্বে মাদিয়-পারস্যরা বাবিল সাম্রাজ্য দখল করে তখন বড় একটি পরিবর্তন ঘটে। আশ্চর্য বিষয় যে, ভাববাদী যিশাইয় ঘটনাটির ১০০ বছর আগে সেই রাজা কোরসের নাম উল্লেখ করে একটি ভবিষদ্বাণী দিয়েছিলেন যে, তিনি এসে ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করবেন (যিশাইয় ৪৪:২৮-৪৫:১-৬)।
বাবিলীয়দের চেয়ে মাদিয়-পারস্যদের নিয়ম সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল: তারা ৫৩৮ খ্রীষ্টপূর্বে বাবিলীয়দের দ্বারা দখল ও নির্বাসিত জাতিদের নিজেদের দেশে ফেরার ও সেখানে তাদের জীবন পুনরায় গঠনের অনুমতি দেয়। যিহূদীরাও ফেরার এবং ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর পুনরায় নির্মাণের অনুমতি পায় (ইষ্রা ১:১-৪)। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ দিয়ে ইষ্রা তার পুস্তকটি শুরু করেন। এই ঘটনার উল্লেখের মধ্য দিয়ে তিনি ইতিহাসের উপরে ঈশ্বরের ক্ষমতা এবং পূর্বে ঘোষিত ভাববাণীর প্রতি তাঁর বিশ্বস্ততা দেখান।
ঐতিহাসিক পরিস্থিতি – মাদিয়-পারস্য সাম্রাজ্য
মাদীয়রা ও পারস্যরা ছিল আজকের ইরান দেশে অবস্থিত দুইটি জাতি। কোরস-২ (Cyrus II)-এর মা ছিলেন একজন মাদিয় রাজকন্যা এবং তার বাবা ছিলেন পারস্যদের রাজা কাম্বিস্-১ (Cambyses I), যিনি বাবিল ও পারস্য মিশানো রক্তের ছিলেন। এই কোরস-২ মাদিয়দের ও পারস্যদের এক করে মাদিয়-পারস্য সাম্রাজ্যের প্রথম নেতা হয়ে যান। তিনি ৫৪৫ খ্রীষ্টপূর্বে লুদিয় রাজ্য দখল করেন এবং ৫৩৯ খ্রীষ্টপূর্বে রাজা বেল্শৎসরের অধীনে বাবিল সাম্রাজ্যকে আক্রমণ করেন। যদিও বাবিল শহর ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ও সুরক্ষিত দুর্গ তবুও কোরস শহরটি এক রাতেই দখল করেন। এই একই ঘটনা দানিয়েল ৫ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে, যখন ভোজে মাতাল বাবিল রাজা বেলশৎসর দেওয়ালে লেখার একটি হাতের অদ্ভুত দর্শন দেখেন। কোরস একটি চমৎকার কৌশলে বাবিল শহর দখল করতে সক্ষম হন: তিনি ইউফ্রেটিস নদীর স্রোত অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেন এবং দেওয়ালের নিচের যে গর্ত দিয়ে পানি শহরে ঢুকত, সেই গর্ত দিয়ে তার সৈন্যদলকে শহরে প্রবেশ করান। এভাবে ৫৩৯ খ্রীষ্টপূর্বে শক্তিশালী বাবিল সাম্রাজ্য পরাজিত হয় এবং মাদিয়-পারস্য সাম্রাজ্য ক্ষমতায় আসে।
আসিরিয়া ও বাবিল সাম্রাজ্য তাদের দ্বারা দখল করা জাতিদের প্রতি অত্যন্ত হিংস্র ব্যবহার করত এবং যারা বেঁচে থাকত তাদেরকে জোর করে নির্বাসিত করত এবং অন্য জাতিদের সাথে মিশাত। কিন্তু মাদিয়-পারস্যদের চিন্তা বেশ ভিন্ন ছিল: যে জাতিরা মাদিয়-পারস্যদের অধীনতা মেনে নিত এবং কর দিত, তারা সেই জাতিদেরকে নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার এবং সেখানে শান্তিতে নিজের ধর্ম পালন করার অনুমতি দিত। বাইবেলের বাইরের লেখাগুলোতেও তাদের এই আরো উদার চিন্তা ও সরকারের নীতি বর্ণিত, যেমন বিখ্যাত ‘কোরসের বেলন’-এ, যা আজ পর্যন্ত যাদুঘরে দেখা যায় (‘Cyrus cylinder’, ছবি দেখুন)।
নিচে মাদিয়-পারস্য সম্রাটদের এবং বাইবেলে তাদের উল্লেখের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে:
সাল | সম্রাটের নাম | বাইবেলের সাথে সম্পর্কিত ঘটনা | বাইবেলে তার বর্ণনা |
৫৫০–৫৩০ খ্রীঃপূঃ | কোরস–২ (Cyrus II) | ফিরে যাওয়ার অনুমতি, শেশবসরকে যিহূদীদের শাসনকর্তা হিসাবে দায়িত্ব দান | ইষ্রা ১:১–৪:৬, ৪:২৪–৬:২২ |
৫৩০–৫২২ খ্রীঃপূঃ | কাম্বিস্–২ (Cambyses II) | ||
৫২২ খ্রীঃপূঃ | স্মের্দিস্ (Smerdis) | ||
৫২২–৪৮৬ খ্রীঃপূঃ | দারিয়াবস–১ (Darius I) | যিহূদীদের উপসনা–ঘর নির্মাণ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন | ইষ্রা ৫–৬ |
৪৮৬–৪৬৫ খ্রীঃপূঃ | অহশ্বেরশ (Xerxes I/Ahasuerus) | ইষ্টেরের স্বামী | ইষ্টের |
৪৬৫–৪২৪ খ্রীঃপূঃ | অর্তক্ষস্ত–১ (Artaxerxes I) | ইষ্রার মাধ্যমে উপাসনার জন্য যোগান, শাসনকর্তা নহিমিয় নিযুক্ত ও তার কাজের জন্য যোগান | ইষ্রা ৪:৭–২৩, ৭:১–১০:৪৪ |
কোরসের অনুমতির গুরুত্ব ইষ্রা ১:১-৪
ইষ্রা তার পুস্তকের শুরুতে একটি অতি গুরুত্ব ও অর্থপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা দেন (ইষ্রা ১:১-৪): কোরসের দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি। এই অনুমতি দ্বারা প্রমাণ পায় যে, ইতিহাসের উপর ঈশ্বরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে এবং তিনি জাতিদের পরিচালনা করেন। তিনি ভবিষ্যৎ জানেন এবং তা ভাববাদীদের দ্বারা অগ্রিম ঘোষণা করেন। ঈশ্বর তাঁর বাণীর প্রতি বিশ্বস্ত, তিনি তাঁর জাতির কাছে যে উদ্ধারের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন (যখন ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে দেশের ধ্বংস হয়), তা এখন ঘটে যাচ্ছে। যেমন ঈশ্বরের বিচারবাণী ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে পূর্ণ হয়েছিল, ঠিক তেমনি তাদের চোখের সামনে তাঁর আশাবাণীগুলোও পূর্ণ হতে যাচ্ছে – এবং এখন ঈশ্বর বাবিলে নির্বাসিত যিহূদীদের ডাকেন, যেন তারা আবার ঈশ্বরের জাতি হিসাবে প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে গিয়ে সেখানে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর তৈরি করে এবং তাঁকে আরাধনা করে। ঈশ্বরের এই ডাকে সাড়া দেওয়া মানে হচ্ছে, যিহূদীরা বাবিলে যা অর্জন করেছে এবং সেখানে যে নিরাপত্তা পেয়েছে তা সব ত্যাগ করে যুদ্ধবিদ্ধস্থ যিহূদা দেশে ফিরে যাওয়া। কে সাড়া দেবে? শুধু এমন যিহূদীরা সাড়া দেবে যারা দেবতাপূজা অগ্রাহ্য করে ঈশ্বর ভক্ত, যারা তাঁর বাক্য ও যিরমিয় দ্বারা দেওয়া প্রতিজ্ঞা বিশ্বাস করে এবং যারা এই আশার জন্য অনেক কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি। নির্বাসনে থাকা যিহূদীদের উপর নয় বরং প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে আসা যিহূদীদের উপরেই এখন ঈশ্বরের আহ্বান ও প্রতিজ্ঞা রয়েছে।
সরুব্বাবিলের নেতৃত্বে প্রথম দলে ফিরে যায় ইষ্রা ১
৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদীদের প্রথম দল (প্রায় ৫০ হাজার লোক) সরুব্বাবিলের নেতৃত্বে যিহূদায় ফিরে যায়। সরুব্বাবিল হলেন শল্টীয়েলের ছেলে এবং নির্বাসিত যিহূদা রাজা যিহোয়াখীনের নাতী (ইষ্রা ৩:২, হগয় ১:১)। সরুব্বাবিলের নাম যীশুর বংশ তালিকায়ও আসে (মথি ১:১২-১৩)। হগয় তাকে “শাসনকর্তা” বলেন (হগয় ১:১) এবং সম্ভাবনা বেশি যে তিনিইও সেই উল্লিখিত “যিহূদার শাসনকর্তা” শেশবসর (একটি অরামীয় নাম), যাকে রাজা কোরস যিহূদার শাসনকর্তা হিসাবে নিযুক্ত করেন (ইষ্রা ১:৮)।এই সরুব্বাবিলকে ভাববাদী হগয়ের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের অনুমোদন, অধিকার ও দয়া দান করা হয় “আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি” (হগয় ২:২৩)। তাছাড়া বাবিলীয়দের দ্বারা ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে লুট করা উপাসনা-ঘরের জিনিস-পত্র যিরূশালেমে ফিরে নেওয়ার জন্য এই সরুব্বাবিলের হাতেই সমর্পিত করা হয় (ইষ্রা ১:৭-১১)।
ফিরে আসা যিহূদীদের তালিকা ইষ্রা ২
লেখক ইষ্রা খুব মনোযোগ সহকারে যিহূদায় ফিরে আসা যিহূদীদের নেতাদের নাম এবং সেই সঙ্গে লোকদের সংখ্যা (পরিবার অনুসারে বা বাসস্থান অনুসারে) লিপিবদ্ধ করেন। পুরোহিত, লেবীয় (গায়ক, পাহারাদার ও উপসনা-ঘরের সেবাকারী দল) এবং শলোমনের চাকরদের বংশ তিনি আলাদা করে উল্লেখ করেন। ফিরে যাওয়া যিহূদীদের মোট ৩টি তালিকা পাওয়া যায় (ইষ্রা ২:১-৭০ ও নহিমিয় ৭:৫-৭৩ প্রথম দলকে নিয়ে এবং ইষ্রা ৮:১-১৪ দ্বিতীয় দলকে নিয়ে)। প্রথম দল সম্বন্ধীয় ২টি তালিকায় সংখ্যাগুলোর একটু কমবেশি আছে। দ্বিতীয় তালিকা হল প্রথম তালিকার সংশোধন, কারণ হতে পারে আরো যিহূদী চলে এসেছিল অথবা আবারও চলে গিয়েছিল।
যদিও আমরা নামের ও সংখ্যার তালিকা পড়া বেশি মজা পাই না তবুও তালিকাগুলোর গুরুত্ব অবশ্যই আছে। তালিকাগুলো আমাদের দেখায় যে, ঐতিহাসিক ঘটনার নথি, তথ্য যত্ন সহকারে লিপিবদ্ধ করা এবং কার্যকারী ব্যবস্থাপনা সবই প্রয়োজন। আরো দেখায় যে, প্রত্যেকটি মানুষের সাড়া, ত্যাগ-স্বীকার ও বাধ্যতা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। আগের যুগে একজন ব্যক্তি ইস্রায়েল জাতিতে জন্য নিলেই সে ঈশ্বরের জাতির সদস্য হত। কিন্তু বর্তমানে শুধু যারা ঈশ্বরের প্রতি সাড়া দেয়, অর্থাৎ যিহূদায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারাই ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞার মধ্যে থাকবে। তালিকাগুলো তাই ইচ্ছুকদেরই তালিকা। নতুন নিয়মের দিকে আগালে জাতিগত পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তির সিদ্ধান্তের গুরুত্ব বাড়তে থাকে।
বেদী ও উৎসর্গ পদ্ধতি পুনরায় স্থাপন ইষ্রা ৩
যিহূদায় পৌঁছানোর সাথে সাথে যিহূদীরা ব্রোঞ্জের বেদী তৈরি করে এবং তা সঠিক স্থানে বসিয়ে নিয়মিত উৎসর্গগুলো দান করতে শুরু করে। তারা এভাবে তাদের আত্মিক কেন্দ্র পুনরায় স্থাপন করে, ঈশ্বরের আরাধনা করে এবং আইন-কানুন যেমন বলে, তেমনি আবার ঈশ্বরের সম্মুখে আসতে শুরু করে (ইষ্রা ৩:১-৬)।
এছাড়া তারা বিভিন্ন গ্রামে জমির অধিকার নিয়ে সেখানে বাস করতে এবং মহাপুরোহিত যিহোশূয়ের পরিচালনায় ৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে সঠিক স্থানে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘরের নির্মাণ পুনরায় শুরু করে। তারা উপাসনা-ঘরের ভিত্তির স্থাপন আনুষ্ঠানিকভাবে এবং আনন্দের সঙ্গে উৎযাপন করে। কিন্তু বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা, যারা নির্বাসনের আগে ছোটবেলায় শলোমনের উপসনা-ঘর নিজের চোখে দেখেছিলেন তারা কান্না করে (ইষ্রা ৩:৬-১৩)। ভাববাদী হগয় নিরাশিতদের উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের একটি চমৎকার ভবিষ্যদ্বাণী দেন: ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা করেন যে, এই সামান্য উপসনা-ঘর শলোমনের ঘরের চেয়েও ঈশ্বরের মহিমায় পূর্ণ হবে “আগেকার ঘরের জাঁকজমকের চেয়ে এখনকার ঘরের জাঁকজমক আরও বেশী হবে। এই জায়গায় আমি মংগল নিয়ে আসব” (হগয় ২:৯)।
উপাসনা-ঘর নির্মাণে বিরোধিতা ইষ্রা ৪
কিন্তু বেশ তাড়াতাড়ি শমরীয়েরা নির্মাণে বাধা দিতে শুরু করে। শমরীয়েরা ছিল একটি মিশানো জাতি (ইস্রায়েল ও পরজাতি) যারা একটি মিশানো ধর্মও পালন করত (সদাপ্রভুর আরাধনা ও দেবতাপূজা)। তারা প্রথমে উপাসনা-ঘর নির্মাণে সাহায্য করতে চায় কিন্তু সরুব্বাবিল (সম্ভবত ধর্ম মিশানোর ভয়ে) তাদের অংশ গ্রহণে রাজি হন না। পরবর্তীতে শমরীয়েরা যিহূদীদেরকে হুমকি এবং বিভিন্ন কর্মচারীদের ঘুষ দেওয়া দ্বারা নির্মাণের কাজে বাধা সৃষ্ট করে। প্রায় ১৫ বছর উপাসনা-ঘরের নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায় (ইষ্রা ৪:১-৫,২৪)।
ইষ্রা ৪ অধ্যায়ে কালানুক্রমিক ঘটনার বর্ণনা থেকে কিছুটা সরে গিয়ে পরবর্তীতে যিহূদীদের বিভিন্ন বিরোধিতার সম্মুখীন হওয়ার ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়, এমন কি ৪৪৪ খ্রীষ্টপূর্বে দেওয়াল নির্মাণের সময়ে বিরোধিতাও উল্লিখিত (ইষ্রা ৪:৭-২৩)। বামে দেওয়া চার্টে সময়ের ধারাবিহিকতার বাইরে পদগুলো দেখানো হয়েছে, সাথে ইষ্রা ও নহিমায় পুস্তকের সংযোগও দেখানো হয়েছে।
উপাসনা-ঘরের নির্মাণ পুনরায় হাতে নেওয়া ইষ্রা ৫
৫২০ খ্রীষ্টপূর্বে ভাববাদী হগয় ও সখরিয় যিহূদীদের চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা ঈশ্বরের উপসনা-ঘরের নির্মাণ আবার হাতে নেয় (হগয় ১:২-৬, সখরিয় ১:১৬)। তারা বাধ্য হয়ে নির্মাণ কাজ আবার শুরু করে এবং সাথে সাথে আবার বিরোধিতা ও বাধা আসে, এইবার শাসনকর্তা তত্তনয় এবং শথরবোষণয় নামে একজন নেতার মধ্য দিয়ে। তারা মাদিয়-পারস্য রাজা দারিয়াবসকে নির্মাণের বিষয় জানান এবং তার কাছ থেকে পরামর্শ চান (ইষ্রা ৫)। এবার যিহূদীরা নির্মাণ বন্ধ হতে দেয় না।
উপসনা-ঘরের নির্মাণ সমাপ্ত ইষ্রা ৬
রাজা দারিয়াবস সরকারি সংরক্ষণাগারে খোঁজার আদেশ দেন এবং অক্মথা শহরে রাজ-সরকারের নথিপত্র রাখার জায়গায় যিহূদীদের অনুমতি দেওয়ার কোরসের দলিল খুঁজে পাওয়া যায় (ইষ্রা ৬:১-২)। তাতে দারিয়াবস শাসন-কর্তা তত্তনয়কে আদেশ দেন যেন তিনি যিহূদীদের নির্মাণে বাধা না দিয়ে বরং সমর্থন করেন (ইষ্রা ৬:৬-১২)। তত্তনয় তা-ই করেন এবং উপাসনা-ঘর নির্মাণ কাজ ৫১৬ খ্রীষ্টপূর্বে সমাপ্ত হয়ে যায়, তার ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে ধ্বংসের ঠিক সত্তর বছর পরে (যির ২৯:১০)। যিহূদীরা তা অনেক আনন্দ ও উৎসর্গ দানের মধ্য দিয়ে দিনটি উৎযাপন করে (ইষ্রা ৬:১৩-১৮)। আইন-কানুন অনুসারে তারা সঠিক সময়ে নিস্তার পর্বও পালন করে (ইষ্রা ৬:১৯-২২)।
উপাসনা-ঘরের পুনরায় নির্মাণ অবশ্যই যিহূদীদের জন্য একটি আনন্দের মুহূর্ত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সরুব্বাবিলের এই দ্বিতীয় উপসনা-ঘর শলোমন দ্বারা নির্মিত প্রথম উপাসনা-ঘরের তুলনায় ছায়া মাত্র (আকারের ও সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে)। এছাড়া এবার ঈশ্বরের উপস্থিতির কোন দৃশ্যমান প্রমাণ পাওয়া যায় নি যেমন ছিল যখন মোশি আবাস-তাম্বু উৎসর্গ করেছিলেন (যাত্রা ৪০:৩৪) অথবা শলোমন যখন উপাসনা-ঘর উৎসর্গ করেছিলেন (১ রাজা ৮:১০)। তা ছাড়া সরুব্বাবিলের উপাসনা-ঘর প্রায় খালি, কারণ ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে নিয়ম-সিন্দুক ধ্বংস হয়েছিল। সোনার ধূপ বেদীও হারিয়ে গেছে বলে সরুব্বাবিলের সময়ে একটি পাথরের বেদী রাখা হয়।
ইষ্রার নেতৃত্বে যিহূদীদের দ্বিতীয় দল ফিরে আসে ইষ্রা ৭-৮
৪৫৮ খ্রীষ্টপূর্বে ধর্ম-শিক্ষক ইষ্রা যিহূদীদের একটি দ্বিতীয় দল নিয়ে যিহূদায় ফিরে আসেন। এই দ্বিতীয় দলে প্রায় দেড় হাজার লোক আছে, তাদের মধ্যে অধিকাংশ লোক লেবীয় ও পুরোহিত। ইষ্রা মাদিয়-পারস্য রাজা অর্তক্ষস্তের কাছ থেকে সরকারি চিঠি নিয়ে আসেন যেখানে উপাসনা-ঘরের জন্য যোগানের নির্দেশনা (ইষ্রা ৭:২১-২৩) এবং লেবীয়দের কর-আদায় থেকে মুক্তির ঘোষণা আছে (ইষ্রা ৭:২৪)। চিঠিতে ইষ্রাকে অধিকার দেওয়া হয়েছে এমন স্থানীয় বিচারকদের নিযুক্ত করতে যারা ঈশ্বরের আইন-কানুন জানেন, যারা লোকদেরকে আইন-শিক্ষা দিতে পারেন এবং লোকদের আইনের প্রতি দায়বদ্ধ রাখার অধিকার আছে (ইষ্রা ৭:২৫-২৬)। কিভাবে ইষ্রা রাজা অর্তক্ষস্তের কাছ থেকে এই ধরণের অনুগ্রহ পেয়েছেন, তার কোন খুঁটিনাটি বর্ণনা নেই। ইষ্রা কয়েকবার স্বীকার করেন যে, “আমার উপর আমার ঈশ্বর সদাপ্রভুর হাত ছিল বলেই আমি সাহস পেলাম” (ইষ্রা ৭:২৮)। একটি চিন্তার বিষয় হল যে, রাজা অর্তক্ষস্ত হলেন ইষ্টেরের স্বামী রাজা অহশ্বেরশের ছেলে। যদিও বেশি নিশ্চিত বলা যায় যে, অর্তক্ষস্ত ইষ্টেরের ছেলে নন, ইষ্টের ও মর্দখয়ের উপস্থিতি পারস্য রাজবাড়ীতে অবশ্যই যিহূদীদের পক্ষে একটি প্রভাব ফেলেছিল।
লেখক ইষ্রা যিহূদীদের এই দ্বিতীয় দলের নেতাদের নাম ও সঙ্গে লোকদের সংখ্যার একটি তালিকা দেন। প্রায় দেড় হাজার পুরুষদের উল্লেখ করা হয়েছে, তাই সব মিলিয়ে সম্ভবত ইষ্রার সঙ্গে তিন-চার হাজার যিহূদীরা ফিরে আসে। ইষ্রা বিশেষভাবে উদ্যোগ নেন যেন তার সঙ্গে যথেষ্ট লেবীয় বা উপসনা-ঘরের সেবাকারীরা ফিরে আসে (ইষ্রা ৮:১৫-২০)। তিনি উপাসনা-ঘরের জন্য আরো দানও নিয়ে আসেন (ইষ্রা ৮:২৪-৩০)।
মিশানো বিবাহ নিয়ে ইষ্রার দুঃখ ও প্রার্থনা ইষ্রা ৯
ইষ্রা যখন যিরূশালেমে পৌঁছান তখন তিনি হতভম্ব হন এই কথা শুনে যে, যিহূদীরা আবার দেবতাপূজারী মহিলাদের বিয়ে করতে শুরু করেছে। এটা ঠিক সেই পাপ, যার কারণে ইতিহাসে ইস্রায়েলের পতন শুরু হয়েছিল (বিচার ২, ১ রাজা ১১)। যিহূদীদের কিছু নেতারা বিষয়টি ইষ্রার মনোযোগে নিয়ে আসেন, কিন্তু দেখা যায় যে, যারা মিশানো বিবাহ করেছে তাদের মধ্যেও বেশ কিছু নেতাদের নাম আছে (ইষ্রা ৯:২)। যদিও কিছু নেতারা খারাপ কাজে লিপ্ত ছিলেন তবুও কিছু নেতাদের কাছে বিষয়টি খারাপ লেগেছিল এবং তারা তা প্রতিরোধ করার উপায় খুঁজেছিলেন।
ইষ্রা বিষয়টি শুনে শোক প্রকাশের চিহ্ন হিসাবে নিজের কাপড় ছিড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা হতভম্ব অবস্থায় নিরবে বসে থাকেন। শেষে তিনি আবেগীয় একটি পাপ স্বীকার ও অনুতাপের প্রার্থনা করেন। তিনি নিজেকে অন্তর্ভুক্ত রেখে “আমরা” দিয়ে বলেন: “তোমার সামনে আমরা সকলে পাপী, আর সেইজন্য আমাদের মধ্যে কেউই তোমার সামনে দাঁড়াবার উপযুক্ত নই” (ইষ্রা ৯:৫-১৫)। তার প্রার্থনায় প্রকাশ পায় যে, তিনি এই মিশানো বিবাহগুলো ঈশ্বরকে অগ্রাহ্য করা হিসাবে দেখেন। ঈশ্বর তাঁর অনুগ্রহে যিহূদীদের দেশে ফেরার সুযোগ দিয়েছেন কিন্তু এখন ফিরে আসা যিহূদীরা ঈশ্বরের অনুগ্রহ তুচ্ছ করছে।
অনুতাপ করার ক্ষেত্রে পরিচালনা দান ইষ্রা ১০
ইষ্রা উপবাস প্রার্থনা করার সময়ে ধীরে ধীরে যিহূদীরা চেতনা পেয়ে সাড়া দেয়। তার চারিদিকে লোকদের ভিড় জমে যায় – পুরুষ, মহিলা ও ছেলেমেয়ে এবং তারাও ইষ্রার মত কান্না করতে শুরু করে। সখনিয় নামে একজন ব্যক্তি অন্যদের প্রতিনিধি হিসাবে ইষ্রার সাথে কথা বলেন। তিনিও যিহূদীদের দোষ স্বীকার করেন কিন্তু – লোকেরা যদি অনুতপ্ত হয় – তবে আশার কথাও প্রকাশ করেন। তিনি ইষ্রার কাছে একটি চুক্তি স্থাপন করার প্রস্তাব রাখেন, যেন যিহূদীরা নিজেকে নতুনভাবে ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত করে এবং সেই সাথে দেবতাপূজারী স্ত্রী ও সন্তানদের ছেড়ে দেয়। এভাবে তিনি অনুতাপের গভীরতা ও জীবনের আসল পরিবর্তন নিশ্চিত করতে চান (ইষ্রা ১০:২-৪)। তিনি বলেন, যেন তারা তা “আইন-কানুন অনুসারেই” করে (ইষ্রা ১০:৩) – এর অর্থ কি হতে পারে? হয়তো তা আইন-কানুনে দেবতাপূজারীদের বিয়ে করার নিষেধাজ্ঞা বুঝায় (দ্বিতীয় বিবরণ ৭:৪)। অথবা তা হয়তো স্ত্রীদের দলিল দিয়ে ত্যাগ করার আদেশ বুঝায় (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১), যেন সেই মহিলারা আইনগতভাবে নতুন একটি বিবাহ করতে পারে। যেহেতু এখানে বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্ত্রীদের কোন দোষ নেই (স্বামীরা তাদেরকে গ্রহণ করা ঠিক হয় নি), সেহেতু এখানে স্বামীদের অর্থনৈতিক লোকসান মেনে নিয়ে স্ত্রীদের দেনমোহরও দিতে হবে (বিবাহ রক্ষা করার টাকা)। এভাবে তালাক প্রাপ্ত মহিলা ও তার সন্তানদের জীবন-যাপন করার জন্য কিছুটা হাতে থাকে।
যিহূদীরা সখনিয়ের প্রস্তাব অনুসারে বিবাহগুলো বিচ্ছেদ দিয়ে ভাঙ্গতে রাজি হয়। আমাদের আধুনিক কানে এই বিবাহ বিচ্ছেদগুলো খুব কঠোর একটি সমাধান মনে হয়। তবুও তারা যদি কিছু না করে তবে আগের খারাপ ইতিহাস পুনরায় ঘটবে। বহুদিনের খারাপ ফলাফলের চেয়ে এখানে সেই কঠোর অথচ সীমিত সংশোধন মেনে নেওয়াই ভাল।
এসব শুনে ইষ্রা তার প্রার্থনা থেকে ওঠেন এবং পুরোহিত, লেবীয়দের এবং সমস্ত যিহূদীদের একটি শপথে বাধ্য করেন, যেন তারা প্রকৃতপক্ষে এই প্রস্তাব অনুসারে আগায় (ইষ্রা ১০:৫)। পরবর্তীতে তিনি সম্পূর্ণ যিহূদা এলাকায় তিন দিনের মধ্যে একটি বাধ্যতামূলক সভা ঘোষণা করেন (ইষ্রা ১০:৬-৮)। এই সভায় অধিকাংশ যিহূদীরা এভাবে দেবতাপূজারী স্ত্রীদের বিচ্ছেদ দিতে রাজি হয় কিন্তু তা বাস্তবায়ন করার জন্য আরো সময় চায় (ইষ্রা ১০:৯-১৫)। এমন পুরুষ যারা দেবতাপূজারী স্ত্রীকে বিবাহ করেছে, ইষ্রা তাদের নাম উল্লেখ করে একটি তালিকা দেন (ইষ্রা ১০:১৮-৪৪)। ১১০টি বিবাহ এভাবে বিচ্ছেদ করা হয় যা আনুমানিক সব বিবাহগুলোর মধ্যে শতকরা ০.৫ ভাগ বিবাহ। হতে পারে, ইষ্রা সমস্যাটি একেবারে শুরুতে ধরতে এবং কার্যকারীভাবে সংশোধন করতে সক্ষম হন।
পুস্তকের পাঠকদের জন্য ইষ্রার উদ্দেশ্য কি
সারাংশে বলা যায় যে, ইষ্রা তার পুস্তকটি তার সময়ে ফিরে আসা যিহূদীদের জন্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের জন্যও লেখেন। তিনি তাদের সান্ত্বনা ও উৎসাহ দান করেন যে, যদিও তারা ছোট দল এবং অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল তবুও ঈশ্বরের আহ্বান বাস্তবে তাদেরই উপর আছে। যেমন তারা আশা করেছিল যদিও ঠিক তেমনি হয় নি (অল্প লোক মাত্র, চারিদিকে দেবতাপূজারী জাতি, অল্প জমি মাত্র এবং দায়ূদ বংশের রাজা নেই) তবুও ঈশ্বর তাদের সঙ্গে আছেন, তাদের রক্ষা করতে থাকেন এবং বিদেশী সরকারের অধীনে থাকা সত্ত্বেও সরকারের চোখে তাদের অনুগ্রহ দিতে থাকেন। তিনি তাদের নিশ্চয়তা দেন যে, ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা তাদেরই উপর আছে। তিনি তাদের চ্যালেঞ্জও করেন যে, শুধুমাত্র আইন-কানুনের প্রতি বাধ্য থাকলেই তারা প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের জাতি হিসাবে টিকতে পারবে।
যিহূদী ঐতিহ্য অনুসারে ইষ্রা হলেন ইব্রীয় শাস্ত্রের সংকলনকারী, আদি থেকে সখরিয় পুস্তক পর্যন্ত – যাকে আমরা খ্রিষ্টানরা ‘পুরাতন নিয়ম’ বলি। শুধুমাত্র মালাখি পুস্তক ইষ্রার পরে সংগ্রহে যোগ দেওয়া হয়। ইষ্রা অবশ্যই যথেষ্ট কষ্ট করেছিলেন, যেন যিহূদীরা ঈশ্বরের পুস্তকগুলো, মোশির আইন-কানুন, তাদের ইতিহাস, পরিচয় ও উত্তরাধিকার জানে এবং ঈশ্বরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও বাধ্য ও বিশ্বস্ত থাকে। ঈশ্বর নিজেই পরবর্তী শতাব্দগুলোতে তাদের দেখাশোনা করবেন।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।