ইয়োবের গল্প এমন অনেক লোকের কাছে পরিচিত যারা বাইবেল তেমন পড়ে না। কিভাবে ইয়োব জীবনের সঙ্গে, ঈশ্বরের সঙ্গে ও ন্যায্যতার প্রশ্নের সঙ্গে সংগ্রাম করেছিলেন এই বিষয়ে অনেকের ধারণা আছে। যদিও ইয়োব পুস্তক বুঝা সহজ নয় এবং ইয়োবের গল্প অনেক ধরণের কঠিন প্রশ্ন উঠায়, তবুও এই গল্পের একটি বিশ্বব্যাপী আকর্ষণ আছে। পুস্তকটিতে কষ্টভোগের বাস্তবতা অনেক সৎভাবে দেখানো হয়, হয়তো ঠিক এই কারণে ইয়োবের গল্প এত আকর্ষণীয়।
ইয়োব কখন এই পৃথিবীতে বাস করেছিলেন? ইয়োব পুস্তক কখন লেখা হয়েছে? উভয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয় কারণ ইয়োব পুস্তকটি ইতিহাসের কোন নির্দিষ্ট একটি যুগের বা ঘটনার সাথে যুক্ত করা কঠিন। এই পুস্তক থেকে ইয়োব সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যায়: যেমন তার দেশের নাম হল ‘উষ’। যদিও জায়গাটি অজানা তবে বেশ নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায় যে উষ হল ইস্রায়েলের বাইরে একটি স্থান। তাই চিন্তা করা যায় যে ইয়োব অব্রাহামের পরিবারের সদস্য নন, তিনি অযিহূদী। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ইয়োবের যে বন্ধুরা আসেন তাদের নাম ও দেশের বিষয় দেখে বুঝা যায় যে সম্ভবত তারাও অযিহূদী। পুস্তকে ইয়োবকে তার পরিবারের প্রধান হিসাবে বর্ণনা করা হয়, তিনি পরিবারের জন্য পুরোহিত ভূমিকা পালন করেন এবং উৎসর্গ দান করেন। মোশির আইন-কানুন অনুসারে শুধু হারোণের বংশের পুরোহিতদেরই উৎসর্গ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাই চিন্তা করা যায় যে ইয়োবের গল্পটি মোশির যুগের আগে ঘটেছিল। অব্রাহামের যুগে আমরা দেখি যে পরিবারের প্রধান ব্যক্তি উৎসর্গ দান করতেন। একারণে অনেকে মনে করে যে ইয়োব সম্ভবত অব্রাহামের যুগের একজন লোক ছিলেন।
আর একটি বিষয় বিবেচনা করুন: ইয়োব পুস্তক অতি উচ্চ মানের ইব্রীয় সাহিত্যিক ভাষায় লেখা। একজন হতাশা-গ্রস্ত আঘাত-প্রাপ্ত দুঃখী মানুষের কাছ থেকে আমরা কি এই ধরণের উচ্চ ভাষা প্রত্যাশা করি? এর চেয়ে সম্ভাবনা বেশি যে ইয়োবের ঘটনা ঘটার পরে কোন সময় একজন কবি ঘটনাটি সাজিয়ে একটি সুন্দর কবিতায় পরিণত করেছেন – এবং এভাবে আমরা ইয়োব পুস্তকটি পেয়েছি। কিন্তু কখন তা করা হয়েছে? আবারও উত্তর দেওয়া সহজ না। সব কষ্টভোগ শেষ হওয়ার পরে ইয়োব কি নিজের হাতে তা সুন্দরভাবে লিখিত রেখেছিলেন? অথবা ইয়োবের গল্প একটি মৌখিক ঐতিহ্য হিসাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলছিল এবং তা কি পরবর্তীতে লিখিত রাখা হয়েছে? ইব্রীয় শাস্ত্রে শলোমনের প্রজ্ঞার পুস্তকের সাথে ইয়োব পুস্তকটি পাওয়া যায়। একারণে অনেকে মনে করে যে শলোমনের সময়ে একজন কবি ইয়োবের গল্পটি সুন্দরভাবে সাজিয়েছিলেন এবং সেই আকারে আমরা পুস্তকটি বাইবেলে পাই।
বাইবেলে যে সাধারণ শিক্ষাগুলো পাওয়া যায়, অনেক ক্ষেত্রে মনে হতে পারে যে ইয়োব পুস্তক সেই শিক্ষাগুলোর বিপরীত বলে, যেমন: ইয়োবের গল্পে মনে হয় যে ঈশ্বর বিনাকারণে একজন “নির্দোষ ও সৎ” লোককে কষ্টভোগে ফেলেন, মনে হয় যে শয়তান ঈশ্বরকে চালাচ্ছে এবং সাধারণভাবে যে শিক্ষা গ্রহণযোগ্য মনে হয় ইয়োবের বন্ধুরা সেই অনুসারে কথা বলেন, কিন্তু পরবর্তীতে সেই কথার জন্যই তাদেরকে ধমক দেওয়া হয়। এছাড়া ইয়োব কষ্টে ও রাগে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মন্তব্য করে ফেলেন যা অনেকে মনে করে বাইবেল থেকে বাদ দেওয়া ভাল – কিন্তু ইয়োব সম্বন্ধে পুস্তকের শেষে বলা হয় যে তিনি ”ঈশ্বরের বিষয়ে ঠিক কথা” বলেছেন! ‘ঈশ্বর ভালদের আশীর্বাদ করেন এবং মন্দদের কষ্ট দেন’ বাইবেলের ইয়োব পুস্তক এই ধরণের প্রচলিত মতবাদকে ইচ্ছাকৃতভাবে চ্যালেঞ্জ করে। পুস্তকটি পাঠকের আগের ধারণা নিয়ে প্রশ্ন উঠাতে এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করে।
বন্ধুদের পরামর্শ বা তর্কের সারাংশ এই: ঈশ্বর ন্যায্য। ইয়োব যেহেতু কষ্টভোগে আছেন তাই অবশ্যই তিনি কোনো পাপ করেছেন। কিন্তু বন্ধুদের এই কথায় তিনি রাজি নন। ইয়োব ও বন্ধুদের মধ্যে তর্ক যত আগায় তা তত আবেগপ্রবণ, বেদনাদায়ক ও আক্রমণাত্মক হতে থাকে। যদিও বন্ধুরা সান্ত্বনা দেওয়ার ও মঙ্গল করার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তাদের ভাল উদ্দেশ্য থেকে সরে যায় এবং ইয়োবকে নির্যাতন পর্যন্ত করেন। তারা নিজেদের দুর্বলতা ও সীমিত জ্ঞান অস্বীকার করেন এবং নিজস্ব সরু ও কঠোর মতবাদ রক্ষার জন্য ইয়োবকে আক্রমণ করেন। এভাবে তারা ঈশ্বরের চোখে দোষী হন।
ইয়োব ভয়ংকর কষ্টভোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বলে ঈশ্বর তাকে খুব দয়ার চোখে দেখেন। ইয়োবের মধ্যে যদিও হতাশা, রাগ, বিদ্রোহ, ক্ষোভ, সন্দেহ, নিজেকে প্রমাণিত করা, আত্ম-হত্যা ইত্যাদি চিন্তা ছিল এবং এগুলো নিয়ে তিনি ঈশ্বরকে দোষারোপও করছিলেন কিন্তু এই কঠোর কষ্টের সময়েও তিনি ঈশ্বর-কেন্দ্রিক হতে থাকেন। যখন ইয়োব মনে করেন যে আশা আর নেই, বলার মত কিছু নেই, জীবনে আর ভাল কিছু হবে না, তখনই ঈশ্বর ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে দেখা করেন। তার সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় থেকে সরাসরি কথা বলেন (৩৭-৪১ অধ্যায় ধরে!)। একজন মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের এমন বিস্তারিত ও সরাসরি কথা বাইবেলে অদ্বিতীয়। ঈশ্বর যে ভালবেসে ইয়োবের কাছে আসেন, তার অভিযোগ গ্রহণ করেন, তাকে গুরুত্ব দেন, তার সঙ্গে কথা বলে যত্ন নেন – এই বিষয়টিই হল তার জন্য সুস্থতাকারী মলমের মত। তবে লক্ষণীয় বিষয় হল, ঈশ্বর সুস্থতাকারী হিসাবে কাছে আসলেও তিনি ইয়োবের কোন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেন না বরং তিনিই এখন উল্টোভাবে সৃষ্টির বিষয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকেন। প্রশ্নগুলোর মধ্য দিয়ে ঈশ্বর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও অসীম জ্ঞান, ক্ষমতা ও মঙ্গলময়তা প্রকাশ করেন। ঈশ্বর ইয়োবকে দেখান যে মানুষ হিসাবে তার দৃষ্টি, চিন্তা এবং যুক্তি-তর্ক অতি সীমিত, আর একারণে ঈশ্বরকে বিচার করার অধিকার তার নেই। কষ্টভোগের কারণে ইয়োব মনে মনে সব কিছু হ্যাঁ অথবা না, এই ধরণের উত্তরে আনার চেষ্টা করছেন (“যদি ঈশ্বর কষ্ট থামান তবে তিনি ন্যায্য, যদি ঈশ্বর না থামান তবে তিনি ন্যায্য নন”)। কিন্তু বাস্তবতা এই ধরণের চিন্তার চেয়ে অনেক জটিল এবং ঈশ্বরের দৃষ্টি এর চেয়ে অনেক বড়। একটি সাধারণ ঘটনার পিছনে অনেক ভিন্ন ভিন্ন কারণ, বিষয় ও উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
ঈশ্বরের কথা শুনে ও তাঁর উপস্থিতি উপলব্ধি করে ইয়োব সান্ত্বনা পান এবং ইচ্ছুক মনে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের ও মহত্বের সামনে উবুর হন। ঈশ্বর সম্বন্ধীয় বড় একটি প্রকাশ ও দর্শন পেয়ে তিনি এই চরম কষ্টের সময় থেকে বের হয়ে আসেন। ঈশ্বর সম্বন্ধে তিনি এমন গভীর প্রকাশ ও দৃষ্টি পান যা কষ্টভোগ ছাড়া কখনও অর্জন করা যায় না (ইয়োব ৪২:৫)। ঈশ্বর ইয়োবের বন্ধুদের বেশ ধমক দেন কিন্তু তারাও এই অভিজ্ঞতা থেকে যথেষ্ট প্রকাশ লাভ করেন। ইয়োব তাদের জন্য ক্ষমাশীল হৃদয়ে বিনতি করেন। ঈশ্বর ইয়োবের জীবন আগা-গোড়া পরিবর্তন করেন এবং তাকে সুস্থতা, নতুন পরিবার ও আরো ধন-সম্পত্তি দান করেন। শুরুর দিকে মনে হতে পারে যে শয়তান চালাকি করে ঈশ্বরকে পরিচালিত করেছে, কিন্তু পুস্তকের শেষে ভিন্ন একটি ছবি প্রকাশিত হয়। শয়তান যে ঘটনাটি মন্দ কিছুর জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিল, সেই ঘটনাটি ঈশ্বর ভক্তিপূর্ণ ভয় বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছেন। এই একই ঘটনা তিনি নিজের চরিত্র সম্বন্ধে গভীর প্রকাশ দানের জন্যও ব্যবহার করেছেন। এখানে শয়তান আসলে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত।
আর একটি লক্ষণীয় বিষয়: এই পুস্তকে ইয়োব ঈশ্বরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করেন, রাগ ও ক্ষোভ দেখান। সাধারণ দৃষ্টিতে আমরা মনে করি ঈশ্বরকে দোষারোপ করলে ঈশ্বরের অগৌরব হয়। কিন্তু বাইবেলে ইয়োবের মত পুস্তক আছে, এটা দেখায় যে ঈশ্বর চান ইয়োবের সংগ্রাম ও দোষারোপ লিখিত রাখা হোক, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ পড়ুক এবং তা ‘ঈশ্বরের অনন্ত ও অধিকারগত বাক্যের’ অংশ হয়ে যাক। এইসব ঈশ্বরের চরিত্র সম্বন্ধে কি প্রকাশ করে? ঈশ্বর নিজের বিরুদ্ধে কথা বাতিল করেন না, তা নিয়ে ভয়ও পান না। মানুষ অনেক সময় অভিযোগ করে বলে যে ‘ঈশ্বর অন্যায্য’, তিনি এই ধরণের দোষারোপের কথা শুনতে রাজি আছেন যদি এতে একজন মানুষও সান্ত্বনা পায় এবং তাঁর সম্বন্ধে গভীর প্রকাশ লাভ করে!
ইয়োবের গল্প এমন অনেক লোকের কাছে পরিচিত যারা বাইবেল তেমন পড়ে না। কিভাবে ইয়োব জীবনের সঙ্গে, ঈশ্বরের সঙ্গে ও ন্যায্যতার প্রশ্নের সঙ্গে সংগ্রাম করেছিলেন এই বিষয়ে অনেকের ধারণা আছে। যদিও ইয়োব পুস্তক বুঝা সহজ নয় এবং ইয়োবের গল্প অনেক ধরণের কঠিন প্রশ্ন উঠায়, তবুও এই গল্পের একটি বিশ্বব্যাপী আকর্ষণ আছে। পুস্তকটিতে কষ্টভোগের বাস্তবতা অনেক সৎভাবে দেখানো হয়, হয়তো ঠিক এই কারণে ইয়োবের গল্প এত আকর্ষণীয়।
ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
ইয়োব কখন এই পৃথিবীতে বাস করেছিলেন? ইয়োব পুস্তক কখন লেখা হয়েছে? উভয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয় কারণ ইয়োব পুস্তকটি ইতিহাসের কোন নির্দিষ্ট একটি যুগের বা ঘটনার সাথে যুক্ত করা কঠিন। এই পুস্তক থেকে ইয়োব সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যায়:
ভৌগলিক বিষয়: ইয়োবের দেশের নাম হল “উষ” (ইয়োব ১:১)। উষ শহর কোথায়? বাইবেলের বেশ কিছু পদে উষ শহরের নাম উল্লিখিত আছে। সেখানে দেখা যায় যে এটি হল ইস্রায়েল থেকে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি এলাকা, অর্থাৎ ইদোম বা মিদিয়নের কাছাকাছি একটি এলাকা। তাই অনেকে মনে করে যে ইয়োব অব্রাহামের পরিবারের সদস্য নন, তিনি অযিহূদী। ইয়োবের বন্ধু ইলীফসের নাম হল ইদোমীয় একটি নাম, তার শহর “তৈমন” হল ইদোম দেশের একটি প্রধান শহর। ইয়োবের অন্য দু’জন বন্ধু – শূহীয় বিলদদ ও নামাথীয় সোফর – তাদের নাম বা বাসস্থান সম্বন্ধে নির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ইয়োবের পরে আসা বন্ধুর নাম ইলীহূ। বন্ধুদের মধ্যে শুধু তার নামই হল ইব্রীয় ভাষার একটি নাম। প্রথম অধ্যায়ে যারা ইয়োবকে আক্রমণ করেছিল সেই দলগুলোকে “শীবায়ীয়” ও “কলদীয়” হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। শীবায়ীয়েরা ছিল আরব দেশের মরুভূমিতে বাসকারী একটি যাযাবর গোষ্ঠি এবং কলদীয়েরা ছিল আজকের ইরাক দেশে বাসকারী একটি জাতি।
এইসব তথ্য দেখে কিছু প্রশ্ন চলে আসতে পারে: যদি ইয়োব যিহূদী না হন, তার তিনজন বন্ধুও যিহূদী না হন তাহলে ঈশ্বর সম্বন্ধীয় জ্ঞান তারা কিভাবে পেয়েছেন? পুস্তকটি কিভাবে লেখা হয়েছে? পুস্তকটি কিভাবে ইব্রীয় শাস্ত্রের একটি পুস্তক হয়ে গেল?
ঘটনার তারিখ: পুস্তকটিতে ইয়োবকে তার পরিবারের প্রধান ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করা হয়, এছাড়া তিনি পরিবারের জন্য উৎসর্গ দান করে পুরোহিত ভূমিকাও পালন করেন। উৎসর্গ দানের ক্ষেত্রে মোশির আইন-কানুন বলে: যিনি উৎসর্গ দেবেন তাকে অবশ্যই হারোণের বংশের পুরোহিত হতে হবে এবং তাকে অবশ্যই আবাস-তাম্বুর ব্রোঞ্জ বেদীতে উৎসর্গ দিতে হবে (লেবীয় ১৭:৯, লেবীয় ১-৯)। কিন্তু ইয়োব নিজের উঠানে উৎসর্গ দান করেন এবং এরপরেও তাকে ধার্মিক বলা হয়। তাই চিন্তা করা যায় যে ইয়োবের গল্পটি মোশির যুগের আগেই ঘটেছিল। অব্রাহামের যুগে আমরা দেখি যে পরিবারের পিতারা উৎসর্গ দান করেন। একারণে অনেকে মনে করে যে ইয়োব সম্ভবত অব্রাহামের যুগের একজন লোক। এই চিন্তার সমর্থনে আর একটি বিষয় আছে: ইয়োব পুস্তকে ঈশ্বরের নাম বা টাইটেল হিসাবে ইব্রীয় শব্দ ‘এল শাদ্দাই’ ব্যবহৃত হয়েছে। এই একই নাম বা টাইটেল আদিপুস্তকেও পাওয়া যায় যা ঈশ্বরকে বুঝানোর জন্য সেই পুস্তকের সবচেয়ে প্রচলিত নাম।
আরেকটি বিষয় বিবেচনা করুন: ইয়োব পুস্তক অতি উচ্চ মানের ইব্রীয় সাহিত্যিক ভাষায় লেখা। একজন হতাশা-গ্রস্ত আঘাত-প্রাপ্ত দুঃখী মানুষের কাছ থেকে আমরা কি এই ধরণের উচ্চ ভাষা প্রত্যাশা করি? প্রকৃতপক্ষে ইয়োব পুস্তক এত যত্নের সঙ্গে সাজানো হয়েছে যে, কোন পরিবর্তন ছাড়াই পুস্তকটি মঞ্চ নাটক হিসাবে উপস্থাপন করা যায়। একারণে অনেকে মনে করে যে ইয়োবের ঘটনা ঘটার পরে কোন সময় একজন কবি ঘটনাটি সাজিয়ে একটি সুন্দর কবিতায় পরিণত করেছেন – এবং এভাবে আমরা ইয়োব পুস্তকটি পেয়েছি। কিন্তু কখন তা করা হয়েছে? আবারও উত্তর দেওয়া সহজ না। সব কষ্টভোগ শেষ হওয়ার পরে ইয়োব কি নিজের হাতে তা সুন্দরভাবে লিখিত রেখেছিলেন? অথবা ইয়োবের গল্প একটি মৌখিক ঐতিহ্য হিসাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলছিল এবং তা কি পরবর্তীতে লিখিত রাখা হয়েছে? ইব্রীয় শাস্ত্রে শলোমনের প্রজ্ঞার সাহিত্য, অর্থাৎ হিতোপদেশ ও উপদেশকের সাথে ইয়োব পুস্তকটি পাওয়া যায়। একারণে অনেকে মনে করে যে শলোমনের সময়ে (৯৭১-৯৩১ খ্রীঃপূঃ) একজন কবি ইয়োবের গল্পটি সুন্দরভাবে সাজিয়েছিলেন এবং সেই আকারে আমরা পুস্তকটি বাইবেলে পাই।
যদিও পুস্তকটির ঘটনা ও লেখার তারিখ এবং ঘটনাটি কোথায় ঘটেছে সেই বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না, তবুও ইয়োব পুস্তকের একটি বিশ্বব্যাপী আকর্ষণ আছে: হয়তো পুস্তকটিতে কষ্টভোগের বাস্তবতা অনেক সৎভাবে দেখানো হয় বলেই এই আকর্ষণ। প্রত্যেক যুগে অনেক স্থানে বিভিন্ন ধরণের মানুষ এই ধরণের কষ্টভোগের সম্মুখীন হয়। কষ্টভোগী মানুষের জীবনের সাথে ইয়োবের গল্পের মিল পাওয়া যায়। একারণে গল্পটিকে সময় ও পরিস্থিতির উর্ধ্বে একটি গল্প বলা যায়।
উষ্কানোমূলক একটি গল্প
বাইবেলে যে সাধারণ শিক্ষাগুলো পাওয়া যায়, অনেক ক্ষেত্রে মনে হতে পারে যে ইয়োব পুস্তক সেই শিক্ষাগুলোর বিপরীত বলে, বাইবেলে যে মতবাদ আমরা পাই ও যে মতবাদ আমরা গ্রহণযোগ্য মনে করি, ইয়োবের গল্প দ্বারা তা অনেক ক্ষেত্রে উল্টানো হয়। প্রকৃতপক্ষে পুস্তকটি বাইবেলের প্রচলিত শিক্ষাগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে চ্যালেঞ্জ করে। প্রথম অধ্যায়ে আমরা অদৃশ্য জগতের একটি ছবি পাই, যেখানে ঈশ্বরের সামনে শয়তান উপস্থিত। কিন্তু শয়তান কিভাবে পবিত্র ঈশ্বরের সামনে উপস্থিত হতে পারে? তাকে কি স্বর্গ থেকে বের করা হয় নি? এছাড়া ঈশ্বর ইয়োবকে নিয়ে গর্ব করেন বলে শয়তানের মনোযোগ ইয়োবের দিকে আকৃষ্ট হয়। পরবর্তীতে শয়তান ঈশ্বরকে এই বলে চ্যালেঞ্জ করে যে ইয়োবের কাছ থেকে আশীর্বাদ তুলে নিলে সে ঈশ্বরকে অভিশাপ দেবে। এখানে শয়তান কি ঈশ্বরকে চালায়? ঈশ্বর কেন শয়তানের মনোযোগ ইয়োবের দিকে নিয়ে যান? তিনি কি জানতেন না যে শয়তান বিষয়টি নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করবে? ইয়োব কি ঈশ্বর ও শয়তানের আত্মিক যুদ্ধের শিকার? ইয়োবকে কি ঈশ্বরের অহংকারের কারণে কষ্টভোগ করতে হয়?
পরিবার ও সম্পত্তি হারানোর পরেও যখন ইয়োব ঈশ্বরকে অভিশাপ না দিয়ে বরং তাঁর আরাধনা করেন, তখন যুদ্ধটি দ্বিতীয় পর্যায়ে চলে যায়। এই পর্যায় ঈশ্বর শয়তানকে ইয়োবের গায়ে হাত দেওয়ার অনুমতি দেন। ঈশ্বর পরিষ্কারভাবে বলেন যে সব কিছু বিনাকারণে হচ্ছে “সে নির্দোষ ও সৎ। সে আমাকে ভক্তিপূর্ণ ভয় করে ও মন্দতা থেকে দূরে থাকে। যদিও তুমি বিনা কারণে তার সর্বনাশ করবার জন্য আমাকে খুঁচিয়ে তুলেছ” (ইয়োব ২:৩)। এই ধরণের কথার সাথে আমরা ঈশ্বরের ন্যায্যতা ও মঙ্গলময়তা কিভাবে মিলাব? ‘ধার্মিকেরা আশীর্বাদ পাবে এবং মন্দরা কষ্ট পাবে’, ইয়োবের ক্ষেত্রে বাইবেলের এই নীতি কোথায় গেল?
ইয়োবের সান্ত্বনাদানকারী বন্ধুরা যে ধরণের মতবাদ থেকে পরামর্শ দেন তা আমরা সাধারণত গ্রহণযোগ্য মনে করি – কিন্তু পরবর্তীতে একারণেই ঈশ্বর তাদেরকে ধমক দেন (ইয়োব ৪২:৭-৮)। অন্য দিকে ইয়োব কষ্টে ও রাগে অনেক কিছু বলে ফেলেন যা আমরা মনে করি বাইবেল থেকে বাতিল করা ভাল – কিন্তু এত কিছুর পরেও ঈশ্বর শেষে ইয়োব সম্বন্ধে বলেন যে তিনি ‘ঈশ্বরের বিষয়ে ঠিক কথা’ বলেছেন (ইয়োব ৪২:৭)!
যখন ইয়োব মনে করেন যে আশা আর নেই, বলার মত কিছু নেই, জীবনে আর ভাল কিছু হবে না, তখনই ঈশ্বর ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে দেখা করেন। তার সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় থেকে সরাসরি কথা বলেন (৩৭-৪১ অধ্যায় ধরে!)। প্রকৃতপক্ষে ইয়োব পুস্তকটি জীবন, ঈশ্বর ও ন্যয্যতা সম্পর্কে এমন অনেক প্রশ্ন তৈরি করে যাতে পাঠকরা নিজেদের মতবাদ ও চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করতে বাধ্য হয়। পুস্তকটি মানুষের অতি কঠোর মতবাদ নিয়ে সাবধান করে।
গল্পের কাঠামো
ইয়োবের গল্প এমন একটি নাটক যেখানে দু’টি স্তর আছে: নিচু স্তর হল দৃশ্যমান জগত যেখানে ইয়োব, তার পরিবার ও তার বন্ধুরা বাস করেন। উপরের স্তর হল অদৃশ্য জগত যেখানে ঈশ্বর ও শয়তান উপস্থিত। নাটকের দর্শক হিসাবে আমরা বুঝতে পারি যে উপরের স্তরে কি চলছে। আমরা জানি ইয়োব “সৎ ও নির্দোষ”, ইয়োবের জীবনে যে দুর্দশা ঘটে তা পাপের শাস্তি নয় বরং তা সম্পূর্ণ বিনাকারণে ঘটে। কিন্তু যারা নিচের স্তরে আছেন, তাদের জানা নেই যে অদৃশ্য স্তরে কি ঘটল অথবা কি কথা হল।
মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে – ইয়োব পুস্তকের লেখক কিভাবে ঈশ্বর ও শয়তানের কথাবার্তা সম্বন্ধে জানেন? সম্পূর্ণ ঘটনা শেষ হওয়ার পরে ঈশ্বর কি ইয়োবের কাছে ১ম ও ২য় অধ্যায়ের ঘটনা প্রকাশিত করেছেন? অথবা এইটা কি একটি নাটকীয় কৌশল যার মাধ্যমে লেখক একটি সাধারণ সত্য প্রকাশিত করেছেন?
ইয়োবের চরিত্র ও মনোভাব সম্বন্ধে পাঠকদের অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হয় যে “তিনি একজন নির্দোষ ও সৎ লোক ছিলেন। তিনি ঈশ্বরকে ভক্তিপূর্ণ ভয় করতেন এবং মন্দতা থেকে দূরে থাকতেন” (ইয়োব ১:১)। ঈশ্বর তাকে নিয়ে গর্ব করেন “পৃথিবীতে তার মত আর কেউ নেই” (ইয়োব ১:৮)। পুস্তকের ৩১তম অধ্যায়ে ইয়োব যা বলেন তা থেকে তার চরিত্র আরো স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়। যে সমস্ত আচরণ বা মনোভাব ইয়োব পাপ বলে মনে করেন, সেগুলো তিনি এই অধ্যায়ে বর্ণনা করেন। শুধু বাহ্যিক ব্যবহারে নয় বরং তার অন্তরেও তিনি চেতনায় সাড়া দেন এবং ঈশ্বরের ভক্তিপূর্ণ ভয়ে চলেন। এছাড়া সামাজিক ন্যায্যতার বিষয়ে তার সততা প্রকাশ পায় (ইয়োব ৩১:৫-৩৩)। পরিবার ও ধনসম্পত্তি হারানোর পরে ইয়োবের প্রাথমিক সাড়া এই: “মায়ের পেট থেকে আমি উলংগ এসেছি আর উলংগই চলে যাব। সদাপ্রভুই দিয়েছিলেন আর সদাপ্রভুই নিয়ে গেছেন; সদাপ্রভুর গৌরব হোক” (ইয়োব ১:২১)। এখানে ঈশ্বরের চরিত্র নিয়ে তার বিশ্বাস এবং ঈশ্বরের পথ মেনে নেওয়ার বিষয় অনেক সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। লেখক সারাংশ করে বলেন, “এই সব হলেও ইয়োব পাপ করলেন না কিম্বা ঈশ্বরকে দোষী করলেন না” (ইয়োব ১:২২)।
গল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ঈশ্বর ইয়োবকে নিয়ে আবারও গর্ব করেন: “আমার দাস ইয়োবের দিকে কি তুমি লক্ষ্য করেছ? পৃথিবীতে তাঁর মত আর কেউ নেই। সে নির্দোষ ও সৎ। সে আমাকে ভক্তিপূর্ণ ভয় করে ও মন্দতা থেকে দূরে থাকে। যদিও তুমি বিনা কারণে তার সর্বনাশ করবার জন্য আমাকে খুঁচিয়ে তুলেছ তবুও সে এখনও কোন দোষ করে নি” (ইয়োব ২:১৩)। শয়তান তাকে শারীরিক কষ্টভোগে ফেলার পরে তিনি বলেন “আমরা ঈশ্বরের কাছ থেকে কি কেবল মংগলই গ্রহণ করব, অমংগল গ্রহণ করব না? ”। লেখক আরো মন্তব্য করেন “এই সব হলেও ইয়োব তাঁর কথার মধ্য দিয়ে পাপ করলেন না” (ইয়োব ২:১০)।
দুঃখের বিষয় এই যে ইয়োবের স্ত্রী ইয়োবকে তার কষ্টের সময় সমর্থন করে না বরং সে শয়তানের সাথে একমত হয়ে এই পরামর্শ দেয়: “তুমি এখনও দাবি করছ যে, তুমি নির্দোষ? ঈশ্বরকে দোষ দিয়ে মরে যাও”। শয়তান শুধু একজনকে ইয়োবের জীবন থেকে সরিয়ে দেয় নি, সে হল ইয়োবের স্ত্রী। স্ত্রীর কথা শুনে তাকে না সরানোর কারণ বুঝা যায়।
পরবর্তীতে ইয়োবের তিনজন বন্ধু তার দুর্দশার খবর পেয়ে পাশে দাঁড়ানো ও সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য দূর থেকে আসেন (ইয়োব ১:১১-১২)। ইয়োবের অবস্থা দেখে তারা কাঁদেন, শোক প্রকাশ করেন এবং সাত দিন ধরে ইয়োবের সঙ্গে মাটিতে বসে থাকেন। ইয়োব কথা শুরু না করা পর্যন্ত তারা চুপ করে থাকেন – বেশ ভাল একটি শুরু।
ছবি
পাঠক হিসাবে আমরা জানি যে শেষ দিকে ঈশ্বর তিন বন্ধুর বিচার করে বলেন “আমার দাস ইয়োব যেমন বলেছে তুমি ও তোমার বন্ধুরা সেইভাবে আমার বিষয় ঠিক কথা বল নি; সেইজন্য তোমাদের উপর আমার ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠেছে। কাজেই এখন সাতটা ষাঁড় ও সাতটা ভেড়া নিয়ে আমার দাস ইয়োবের কাছে যাও এবং নিজেদের জন্য পোড়ানো-উৎসর্গের অনুষ্ঠান কর। আমার দাস ইয়োব তোমাদের জন্য প্রার্থনা করবে আর আমি তা গ্রহণ করব, তোমাদের বোকামি অনুসারে ফল দেব না। আমার দাস ইয়োব যেমন আমার বিষয়ে ঠিক কথা বলেছে তোমরা তেমন বল নি” (ইয়োব ৪২:৭-৮)।
যে বন্ধুরা ভাল উদ্দেশ্যে এসেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তারাই ইয়োবের শত্রুর মত কাজ করেন এবং ঈশ্বর তাদেরকে দোষী হিসাবে ঘোষিত করেন – এটা কিভাবে সম্ভব? তারা নিজেদের কথা দ্বারা ঈশ্বরের ন্যায্যতা ও মঙ্গলময়তা রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, তবে কিভাবে তারা ভুল পথে পা দিলেন? তারা যা বলেছেন তা কি আসলে ভুল ছিল? আমাদের চিন্তা অনুসারে তাদের মতবাদ ইয়োবের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে সঠিক।
অন্য দিকে ইয়োব খোলাখুলিভাবে কষ্ট, রাগ, ক্ষোভ ও সন্দেহ প্রকাশ করেন, তিনি ঈশ্বরকে দোষারোপও করেন – এগুলো এমন কথা, যেগুলো আমরা মনে করি বাইবেল থেকে বাতিল করলে ভাল হত। কিন্তু পুস্তকের শেষে ঈশ্বর ইয়োব সম্বন্ধে বলেন যে তিনি ‘ঈশ্বরের বিষয়ে ঠিক কথা’ বলেছেন!
আরেকটি লক্ষনীয় বিষয়: ‘সময়’ ইয়োবের গল্পে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। শুরুর দিকে ইয়োব ঈশ্বরের পথ মেনে নেন এবং খুব সুন্দরভাবে সাড়া দিয়ে বলেন “সদাপ্রভুই দিয়েছিলেন আর সদাপ্রভুই নিয়ে গেছেন; সদাপ্রভুর গৌরব হোক” (ইয়োব ১:২১)। কিন্তু পরে আমরা তার মুখ থেকে গভীর ক্ষোভের কথাও শুনি “হায়, আমার কথা যদি কেউ শুনত! আমি সই দিয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমার কথা সত্যি; সর্বশক্তিমান যেন আমাকে উত্তর দেন, আমার বিবাদী যেন আমার দোষ লিখে দেখান। আমি নিশ্চয়ই তা আমার কাঁধে লাগিয়ে রাখব আর মুকুটের মত করে মাথায় পরব” (ইয়োব ৩১:৩৫-৩৬)। ইয়োবের এই দু’টি কথার মধ্যে কত বড় পার্থক্য দেখা যায়! অবশ্যই প্রশ্ন আসতে পারে যে প্রথম কথার সময় থেকে দ্বিতীয় কথার সময় পর্যন্ত কি ঘটল? কি ঘটেছিল যে এত বড় পরিবর্তন দেখা যায়? অদ্ভুত বিষয় হল: আসলে কিছুই ঘটে নি। সময় চলতে থাকে – কিন্তু ঈশ্বর কিছু করেন না। দুর্যোগ ঘটে, ইয়োব চমৎকারভাবে সাড়া দেন। আরো কঠোর দুর্যোগ ঘটে, তিনি আবারও চমৎকারভাবে সাড়া দেন। কিন্তু পরে কিছুই ঘটে না। ইয়োব সব কিছু সুন্দরভাবে মেনে নিয়ে চুপ করে কষ্টভোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন – কিন্তু কোন পরিবর্তন আসে না। ঈশ্বর কষ্টভোগ বন্ধ করেন না। সময় যখন পার হতে থাকে এবং ঈশ্বর ‘কিছু করেন না’ তখন মানুষের মনে ধীরে ধীরে তিক্ততা জন্মায়।
যদি আমরা ইয়োবের জীবন দেখি, অবশ্যই বলা যায় যে তিনি অনেক বছর ভাল অবস্থায় বাস করেছিলেন, পরে সেই তুলনায় অল্প সময়ের জন্য কষ্টভোগ করেন এবং পরবর্তীতে পুনরায় একটি পরিপূর্ণ জীবন ফিরে পান (ইয়োব ৪২:১০-১৭)। তার কষ্টভোগ তুলনামূলকভাবে ছিল অল্প সময়ের জন্য। কিন্তু আমরা যখন কষ্টভোগের মধ্য দিয়ে যাই, যখন আর পরিবর্তনের আশা দেখতে পাই না, তখন আমরা মনে করি যে কষ্ট ছাড়া জীবনে আর কিছুই নেই। জীবনের একমাত্র বাস্তবতা হল কষ্টভোগ। কষ্টভোগ চলাকালীন সময় আশা ধরে রাখা বা জীবনের বড় ছবি বুঝা মানুষের জন্য খুবই কঠিন। ইয়োবও আশা হারিয়ে ফেলেন। তিনি নিশ্চিত হয়ে যান যে ঈশ্বর এই পর্যন্ত কিছু করেন নি মানে তিনি আর কখনও কিছু করবেন না।
কথাবার্তার মধ্যে ক্রমবৃদ্ধি
ইয়োব ও তার তিনজন বন্ধুর আলোচনার একটি সারাংশ নিচে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য করুন যে আলোচনা যত সামনে আগায় তা ধীরে ধীরে দ্বন্দ্বে পরিণত হয়, তাদের কথাবার্তা আরো আবেগপ্রবণ, আরো কঠোর এবং আক্রমনাত্মক হতে থাকে:
চার্ট
প্রথম আলোচনা
ইয়োব (ইয়োব ৩)
ইয়োব নিজের জন্মদিনকে অভিশাপ দেন, তিনি বলেন যে তার জন্ম না হলে ভাল হত, তিনি নিজের মারা যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং নিজের প্রতি করুণা প্রকাশ করেন।
ইলীফস ১ (ইয়োব ৪-৫)
ইলীফস নিজের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে কথা বলেন। তিনি ঈশ্বরকে এমন একজন ব্যক্তি হিসাবে বোঝেন যিনি ন্যায্য, যিনি মন্দদের শাস্তি এবং ভালদের আশীর্বাদ দেন: “আমি দেখেছি যারা মন্দের চাষ করে আর অশান্তির বীজ বোনে, তারা তা-ই কাটে … ধন্য সেই লোক, যাকে ঈশ্বর সংশোধন করেন। কাজেই সর্বশক্তিমানের শাসনকে তুচ্ছ কোরো না” (ইয়োব ৪:৮, ৫:১৭)। ইয়োবের জন্য ইলীফসের পরামর্শ হল তিনি যেন ঈশ্বরের সংশোধন মেনে নেন, ঈশ্বরের অন্বেষণ করেন এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা চান। তিনি মনে করেন ইয়োব তার কথায় অপমানিত হবেন কিন্তু তারপরেও তাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন যে, ইয়োব অন্যদের ঠিকই ভাল শিক্ষা দেন কিন্তু যখন নিজেই কষ্টের সম্মুখীন হন তখন ভেঙ্গে পড়েন। ইলীফস আশা প্রকাশ করেন যে ইয়োবের কষ্টভোগ ক্ষণিকের এবং তিনি স্বীকার করেন যে সবাই পাপ করে।
ইয়োব (ইয়োব ৬-৭)
ইয়োবের উত্তর হল সাধারণ কথা ও প্রার্থনার মিশ্রণ। তিনি আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন যেন ঈশ্বর তাকে মেরে ফেলেন। তিনি বলেন যে ঈশ্বরের তীর তাকে বিঁধেছে, তার প্রাণ সেগুলোর বিষ খাচ্ছে। তিনি তার বন্ধুদের কঠোরতা এবং তাদের নির্ভরযোগ্যতার অভাব নিয়ে অভিযোগ করেন। তারা তার দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেন কিন্তু তা করতে পারেন না। ইয়োব তার হতাশা প্রকাশ করে ঈশ্বরকে জিজ্ঞাসা করেন “তুমি কেন আমাকে তোমার তীরের লক্ষ্যস্থান করেছ?”।
বিলদদ ১ (ইয়োব ৮)
ঐতিহ্য, আইন-কানুন ও ‘কারণ-ফলাফল’ মতবাদের উপর ভিত্তি করে বিলদদ কথা বলেন। তিনি ঈশ্বরকে একজন অপরিবর্তনশীল আইন-দাতা ও ন্যায্য বিচারক হিসাবে দেখেন “আগেকার দিনের লোকদের জিজ্ঞাসা কর; তাঁদের পূর্বপুরুষেরা যা শিখেছিলেন তার খোঁজ নাও। আমরা তো গতকাল জন্মেছি, কিছুই জানি না; পৃথিবীর উপর আমাদের দিনগুলো ছায়ার মত চলে যায়” (ইয়োব ৮:৮-৯)। ঈশ্বর যে ন্যায্য, এই সত্য প্রমাণ করার জন্য তিনি অতি আগ্রহী। বিলদদ এই সারাংশে আসেন যে ইয়োবের সন্তানেরা নিজেদের দোষে মারা গেছে। তিনি মনে করেন যে ইয়োব তার পাপের কারণে কষ্টভোগ করছেন, তবে অনুতপ্ত হলে এখনও আশা আছে: “যদি তুমি খাঁটি ও সৎ হয়ে থাক, তবে এখনও তিনি তোমার পক্ষে কাজ করতে আগ্রহী হবেন আর তোমার সততাপূর্ণ জায়গায় আবার তোমাকে বসাবেন।”
ইয়োব (ইয়োব ৯-১০)
ইয়োব প্রকাশ করেন যে এমন কোন মানুষ নেই যিনি ঈশ্বরের সামনে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্য। তিনি ঈশ্বরের বিশালতা ও পরাক্রম স্বীকার করেন কিন্তু এটা তার কাছে সান্ত্বনাদায়ক বিষয় নয়, কারণ মানুষ হিসাবে ঈশ্বরের তুলনায় দুর্বল বলে সে কিছু করতে পারছে না: “তাঁকে বলবার জন্য কোথায় কথা খুঁজে পাব? আমি নিজেকে নির্দোষ মনে করলেও তাঁকে উত্তর দিতে পারি না; আমার বিচারকের কাছে আমি কেবল দয়াই ভিক্ষা করব … তিনি … বিনা কারণেই বারে বারে আমাকে আঘাত করেন। তিনি আমাকে নিঃশ্বাস নিতে দেন না বরং তিক্ততা দিয়েই আমার জীবন ভরে দেন … এটা যদি শক্তির ব্যাপার হয় তবে তিনি তো শক্তিশালী … আমি নির্দোষ, কিন্তু তাতে আমার কি আসে যায়? … দুর্দশার আঘাতে হঠাৎ নির্দোষীর মৃত্যু হলে তিনি হাসেন” (ইয়োব ৯:১৩-১৪)। তিনি ঈশ্বরের মঙ্গলময়তা স্মরণ করেন, একই সাথে তার হতাশা ও তিক্ততাও প্রকাশ করেন: “তোমারই হাত আমাকে গড়েছে, তৈরী করেছে; এখন তুমি কি ফিরে আমাকে ধ্বংস করবে?” (ইয়োব ১০:৮)।
সোফর ১ (ইয়োব ১১)
সোফর নিজেকে সঠিক মতবাদের রক্ষক এবং নীতিবিদ হিসাবে উপস্থাপন করেন। তিনি ঈশ্বরকে একজন ন্যায্য, অনমনীয়, নীতিগত, শক্তিশালী, কঠোর এবং দয়াহীন কর্তা হিসাবে দেখেন। তিনি নিশ্চিত যে ইয়োব পাপ করেছেন বলে তার সমস্যা হচ্ছে: “এটা জেনে রেখো, তোমার পাপ অনুসারে ঈশ্বর তোমাকে শাস্তি দেন না” (ইয়োব ১১:৬)। ইয়োব যে বর্তমান কষ্টের চেয়ে আরো অধিক শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, এই কথা অত্যন্ত আক্রমনাত্মক – এবং মিথ্যা, ঈশ্বর নিজেই বলেছেন যে ইয়োবের কষ্টভোগ “বিনাকারণে” হয়েছে (ইয়োব ২:৪)। সোফর শুধু একটি ইতিবাচক কথা বলেন, তিনি সেই কথায় ইয়োবকে অনুতপ্ত হতে বলেন কারণ তার জন্য এখনও আশা আছে (ইয়োব ১১:১৫)।
ইয়োব (ইয়োব ১২-১৪)
এত আক্রমনাত্মক কথার ফলে ইয়োবের মধ্যে একটা আত্ম-রক্ষার ভাব চলে আসে, তিনি বন্ধুদের বিরুদ্ধে তর্ক বা যুদ্ধ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হন। তিনি তার ‘প্রজ্ঞাবান’ বন্ধুদের দোষ ধরেন এবং নিজের বিরক্তি প্রকাশ করেন: “তোমরা ভাব তোমরাই কেবল জ্ঞানী মানুষ আর তোমাদের মৃত্যুর সংগে সংগে জ্ঞানও মরে যাবে। কিন্তু তোমাদের মত আমারও বুদ্ধি আছে; আমি তোমাদের চেয়ে নীচু নই; তোমরা যা বলেছ তা কে না জানে? … সৎ এবং নির্দোষ হলেও আমি এখন হাসির পাত্র ছাড়া আর কিছু নই। সুখী লোকেরা দুঃখ-কষ্টকে তুচছ করে… “ (ইয়োব ১২:২-৫)। “তোমরা যা জান আমিও তা জানি; আমি তোমাদের চেয়ে নীচু নই। … তোমরা তো সব কিছু মিথ্যা দিয়ে লেপে দিচ্ছ; তোমরা সবাই অপদার্থ ডাক্তার। আহা, তোমরা সবাই যদি চুপ করে থাকতে!” (ইয়োব ১৩:২-৪)। বন্ধুদের প্রতি অভিযোগের সাথে ঈশ্বরের কাছে বিলাপ ও প্রার্থনা ইয়োব মিশিয়ে ফেলেন “কেন তুমি মুখ লুকিয়ে রাখছ আর আমাকে শত্রু বলে ভাবছ?“ (ইয়োব ১৩:২৪)।
দ্বিতীয় আলোচনা
ইলীফস ২ (ইয়োব ১৫)
ইয়োবের কথা শুনে ইলীফস বিরক্ত হয়ে যান। তিনি ইয়োবের দোষ ধরেন: “তুমি তো ঈশ্বরকে ভক্তিপূর্ণ ভয় করা ছেড়ে দিয়েছ আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করাও কমিয়ে দিয়েছ। তোমার পাপের জন্যই তুমি এইভাবে কথা বলছ … আমি নই, কিন্তু তোমার নিজের মুখই তোমাকে দোষী করছে; তুমি তোমার নিজের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দিচছ” (ইয়োব ১৫:৪-৬)। “তুমি এমন কি জান যা আমরা জানি না, আর এমন কি বোঝ যা আমরা বুঝি না?” (ইয়োব ১৫:৯)। “ঈশ্বর যদি তাঁর দূতদের উপর বিশ্বাস রাখতে না পারেন, তাঁর চোখে যদি আকাশও খাঁটি না হয়” (ইয়োব ১৫:১৫)। “দুষ্ট লোক সারা জীবন যন্ত্রণা ভোগ করে; নিষ্ঠুরেরা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিনই যন্ত্রণা ভোগ করবে” (ইয়োব ১৫:২০)। ইয়োব এইমাত্র সব ধন-সম্পদ ও ছেলেমেয়ে হারিয়েছেন, এরকম দুরাবস্থায় ইলীফসের এই কথা অত্যন্ত কঠোর: “ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিহীনদের কোন ছেলেমেয়ে থাকবে না; তাদের ঘুষের বাড়ী-ঘর আগুনে গ্রাস করবে” (ইয়োব ১৫:৩৪)।
ইয়োব (ইয়োব ১৬-১৭)
ইয়োব উল্টোভাবে আক্রমণ করে বলেন: “কি রকম কষ্ট-দেওয়া সান্ত্বনাকারী তোমরা সবাই! … তোমাদের অবস্থা যদি আমার মত হত তবে আমিও তোমাদের মত কথা বলতে পারতাম … কথা বললেও আমার যন্ত্রণা কমে না; চুপ করে থাকলেও তা দূর হয় না। হে ঈশ্বর, তুমি তো আমাকে ক্ষয় হতে দিয়েছ” (ইয়োব ১৬,২,৪,৬,৭)। “ঈশ্বর আমাকে ভীষণভাবে আক্রমণ করেছেন এবং ক্রোধে আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছেন; … মন্দ লোকদের কাছে ঈশ্বর আমাকে তুলে দিয়েছেন … তবুও আমি কাউকে অত্যাচার করি নি এবং আমার প্রার্থনা খাঁটি রয়েছে” (ইয়োব ১৬:৯,১১,১৭)। তিনি তার আশাহীনতা প্রকাশ করে বলেন “আমার মন ভেংগে গেছে, আমার আয়ু শেষ হয়ে আসছে, আমার জন্য কবর অপেক্ষা করছে। ঠাট্টা-বিদ্রূপ কারীরা সত্যিই আমার চারপাশে আছে … মৃতস্থানকে যদি বলি, ‘তুমি আমার বাবা,’ … তাহলে আমার আশা কোথায়?” (ইয়োব ১৭:১-২,১৪-১৫)।
বিলদদ ২ (ইয়োব ১৮)
বিলদদও ইয়োবের কথায় অপমানিত হয়ে যান। তিনি ইলীফসের চেয়ে একটু ভদ্র, কিন্তু তারপরেও ধারালোভাবে বলেন: “তোমার চোখে কেন আমরা বুদ্ধিহীন হয়েছি? তুমি তো রাগে নিজেকে টুকরা টুকরা করছ … তোমার জন্য কি … পাহাড়কে তার জায়গা থেকে সরিয়ে দিতে হবে?” (ইয়োব ১৮:৩-৪)। তিনি দুষ্টদের বিষয়ে বলেন “নিজের জাতির মধ্যে তার কোন বংশধর থাকবে না; সে যেখানে থাকত সেখানে আর কেউ থাকবে না” (ইয়োব ১৮:১৯) – যিনি এইমাত্র নিজের সন্তানদের হারিয়েছেন, তার কাছে এইরকম কথা বলা আসলে নিষ্ঠুরতা।
ইয়োব (ইয়োব ১৯)
বন্ধুদের কথা শুনে ইয়োব আরো গভীর হতাশায় ডুবে যেতে থাকেন এবং তাদের আক্রমণ করে বলেন: “তোমরা আর কতক্ষণ আমার মনে কষ্ট দেবে আর কথার ঘায়ে আমাকে চুরমার করবে? তোমরা অনেকবার আমাকে অপমান করেছ; লজ্জাহীনভাবে তোমরা আমার সংগে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছ। … যদি সত্যিই তোমরা আমার উপরে নিজেদের উঁচু করতে চাও, আমার এই নীচু অবস্থা নিয়ে আমার দোষ প্রমাণ করতে চাও, তাহলে জেনো যে, ঈশ্বরই আমার প্রতি অন্যায় করেছেন; নিজের জালে তিনিই আমাকে ঘিরেছেন” (ইয়োব ১৯:২,৩,৫,৬)। ইয়োব তাদের মিনতি করে বলেন: “হে আমার বন্ধুরা, আমার ব্যথার ব্যথী হও, কারণ ঈশ্বরের হাত আমাকে আঘাত করেছে। ঈশ্বরের মত করে কেন তোমরা আমার পিছনে তাড়া করছ? তোমরা কি আমাকে কষ্ট দেওয়া থামাবে না?” (ইয়োব ১৯:২১-২২)। ইয়োব দাবি করেন যে তার বিষয় শোনা হোক, তার মামলা লিখিত রাখা হোক, যেন সবাই দেখতে পায় যে ঈশ্বর তার বিরুদ্ধে কত অন্যায় করেছেন: “হায়, আমার সব কথা যদি লেখা হত! সেগুলো যদি বইয়ের পাতায় থাকত! যদি পাথরের ফলকে লোহার যন্ত্র ও সীসা দিয়ে চিরকালের জন্য তা খোদাই করা থাকত!” (ইয়োব ১৯:২৩-২৪)। ইয়োবের এই দাবি অবশ্যই পূর্ণ হয়, তাই ‘ইয়োব’ নামে একটি পুস্তক বাইবেলে আছে!
এত কিছুর পরেও ঈশ্বরের প্রতি ইয়োব তার বিশ্বাস ও আস্থা প্রকাশ করেন: “আমি জানি আমার মুক্তিদাতা জীবিত আছেন; … আমার চামড়া ধ্বংস হয়ে যাবার পরেও আমি জীবিত অবস্থায় ঈশ্বরকে দেখতে পাব” (ইয়োব ১৯:২৫-২৬)। ইয়োব তার কষ্ট, রাগ ও হতাশার মধ্যেও ঈশ্বরকে গুরুত্ব দিতে থাকেন। ঈশ্বরই হলেন ইয়োবের সমস্যা এবং ঈশ্বরই হবেন ইয়োবের উদ্ধার।
সোফর ২ (ইয়োব ২০)
সোফরের দ্বিতীয় সাড়ায় প্রকাশ পায় যে তিনি ইয়োবের কথায় চরম অপমানিত বোধ করেছেন। তিনি ইয়োবকে ইঙ্গিত করে ঘোষণা করেন যে দুষ্টদের ‘জয়’ বেশি দিন টিকবে না। তার কথা সম্পূর্ণ নেতিবাচক। তিনি আর কোন আশা, উৎসাহ বা দয়া প্রকাশ করেন না বরং ইয়োবকে হুমকি দেন এবং ভয় দেখান। তিনি খুব প্রাণবন্তভাবে বর্ণনা করেন যে বিচারে দুষ্টদের শেষ অবস্থা কি হবে।
ইয়োব (ইয়োব ২১)
সোফরের দোষারোপ, বিচার ও হুমকি শুনে ইয়োব আবারও আক্রমণ করেন। তিনি বলেন যে “যদি … তবে” মতবাদ (ভাল কাজ করলে ভাল ফল পাব, মন্দ কাজ করলে মন্দ ফল পাব) এই মতবাদ সব সময় কাজ করে না। মন্দরা প্রায়ই শাস্তি পায় না বরং ভাল অবস্থায় বসবাস করে।
তৃতীয় আলোচনা
ইলীফস ৩ (ইয়োব ২২)
ইলীফসের তৃতীয় বারের কথায় তিনি ইয়োবকে আরো নিরুৎসাহিত করে তোলেন এবং ঘোষণা করেন যে ইয়োবের জীবন, মনোভাব, এমন কি ইয়োব যা-ই করেন, তাই ঈশ্বরের চোখে গুরুত্বহীন: “মানুষ কি ঈশ্বরের উপকার করতে পারে? তুমি সৎ হলে কি সর্বশক্তিমান সুখী হবেন? তুমি নির্দোষ হলে কি তাঁর লাভ হবে?” (ইয়োব ২২:২-৩)। ইয়োবের পাপ ও দোষ তিনি সরাসরি ঘোষণা করেন: “তোমার মন্দতা কি অনেক নয়? তোমার পাপেরও তো সীমা নেই। তুমি অকারণে তোমার ভাইদের কাছ থেকে বন্ধক নিতে; তুমি লোকদের কাপড় খুলে নিয়ে তাদের উলংগ রাখতে। তুমি ক্লান্তদের জল খেতে দিতে না; যাদের খিদে আছে তাদের খাবার দিতে না। … তুমি বিধবাদের খালি হাতে বিদায় করতে আর অনাথদের অধিকার কেড়ে নিতে” (ইয়োব ২২:৫-৯)। ইলীফস নিজের কল্পনা অনুসারে ইয়োবের পাপের একটি তালিকা বানিয়ে ঘোষণা করেন – তিনি এমন পাপগুলো তালিকায় তোলেন যা ইয়োব কখনও করেন নি! ইলীফস নিজের মতবাদ রক্ষা করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বানাতে থাকেন। ইলীফসের কথায় শুধু একটি ইতিবাচক দিক দেখা যায়। তিনি ইয়োবকে আর একবার অনুতপ্ত হতে ডাকেন “তুমি ঈশ্বরের কথায় রাজী হও … তাহলে তোমার মংগল হবে। … তোমার নম্রতার জন্যই ঈশ্বর তোমাকে উদ্ধার করবেন” (ইয়োব ২২:২১,২৯)।
ইয়োব (ইয়োব ২৩-২৪)
ঈশ্বর তার প্রতি অন্যায় করেন, ইয়োবের সাড়ায় এই চিন্তা প্রকাশ পায় “যদি কেবল জানতাম কোথায় তাঁকে পাওয়া যায় … তবে আমি তাঁর কাছে আমার নালিশ জানাতাম আর আমার নিজের পক্ষে অনেক কথা বলতাম। তখন তিনি আমাকে কি উত্তর দিতেন তা জানতে পারতাম, আর যা বলতেন তা বুঝতে পারতাম” (ইয়োব ২৩:৩-৫)। ইয়োব ঈশ্বরের ন্যায় বিচার নিয়ে সন্দেহ এবং তাঁর প্রতি নিজের ভয় প্রকাশ করেন “তিনি আমার জন্য যা ঠিক করে রেখেছেন তা-ই করেন; ঐ রকম অনেক পরিকল্পনা তাঁর এখনও জমা রয়েছে। কাজেই আমি তাঁর সামনে ভীষণ ভয় পাই” (ইয়োব ২৩:১৪-১৫)
বিলদদ ৩ (ইয়োব ২৫)
বিলদদ নতুন কিছু যোগ দেন না: “রাজ্য ঈশ্বরেরই … স্বর্গের উঁচু জায়গায় তিনি শান্তি স্থাপন করেন। … তাহলে ঈশ্বরের কাছে মানুষ কি নির্দোষ হতে পারে?” (ইয়োব ২৫:২,৪)।
ইয়োব (ইয়োব ২৬-৩১)
তার শেষ কথায় ইয়োব আর একবার তার বন্ধুদের দোষ ধরেন: “তুমি শক্তিহীনকে এ কেমন সাহায্য করলে আর দুর্বলকে এ কেমন রক্ষা করলে? জ্ঞানহীনকে এ কেমন পরামর্শ দিলে আর মহাজ্ঞান প্রকাশ করলে? তুমি কার সাহায্যে এই সব কথা বলছ?” (ইয়োব ২৬:২-৪)। “তারা আমাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে” (ইয়োব ৩০:১)।
নিজের দুর্দশার বিষয়ে ইয়োব আবারও দাবি করেন যে এটি তার পাপের জন্য কোন শাস্তি নয়, তার দাবি যে তিনি নির্দোষ: “যিনি আমার বিচার করতে অস্বীকার করছেন সেই জীবন্ত ঈশ্বরের দিব্য, যিনি আমার প্রাণকে তেতো করে তুলেছেন সেই সর্বশক্তিমানের দিব্য যে … যতদিন ঈশ্বরের নিঃশ্বাস আমার নাকের মধ্যে আছে, ততদিন আমার মুখ অন্যায় কথা বলবে না, আমার জিভ্ ছলনার কথা বলবে না … আমি যে নির্দোষ সেই দাবি আমি ছাড়ব না, বলতেই থাকব” (ইয়োব ২৭:২-৬)।
তিনি আফসোস করে বলেন: “আহা, ঈশ্বর যখন আমার দেখাশোনা করতেন তখনকার মাস ও দিনগুলো যদি আমি ফিরে পেতাম! আমার মাথার উপর তখন তাঁর বাতি জ্বলত, আর তাঁর আলোতে আমি অন্ধকারের মধ্যে চলাফেরা করতাম … আমার সেই সফলতার দিনগুলোতে ঈশ্বর তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুভাব দিয়ে আমার তাম্বুকে আশীর্বাদ করতেন। সর্বশক্তিমান তখন আমার সংগে ছিলেন আর আমার চারপাশে আমার ছেলেমেয়েরা ছিল” (ইয়োব ২৯:২-৫)। “এখন আমার জীবনে ভাটা পড়েছে; কষ্টের দিনগুলো আমাকে আক্রমণ করেছে … তুমি আমার প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করছ; তোমার শক্তিশালী হাতে তুমি আমাকে আক্রমণ করেছ। তুমি আমাকে তুলে নিয়ে বাতাসে ছেড়ে দিয়েছ; ঝড়ের মধ্যে ফেলে তুমি আমাকে নাচাচ্ছ। আমি জানি তুমি আমাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছ” (ইয়োব ৩০:১৬,২১-২৩)।
ইয়োব শেষ বারের মত ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ করেন: “হায়, আমার কথা যদি কেউ শুনত! আমি সই দিয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমার কথা সত্যি; সর্বশক্তিমান যেন আমাকে উত্তর দেন, আমার বিবাদী যেন আমার দোষ লিখে দেখান। আমি নিশ্চয়ই তা আমার কাঁধে লাগিয়ে রাখব আর মুকুটের মত করে মাথায় পরব। আমার প্রতিটি ধাপের হিসাব আমি তাঁকে দেব; রাজপুত্রের মত আমি তাঁর কাছে এগিয়ে যাব” (ইয়োব ৩১:৩৫-৩৭)।
সরু ও কঠোর মতবাদ
বন্ধুরা সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ভাল উদ্দেশ্য নিয়েই ইয়োবের কাছে এসেছিলেন। তারা ইয়োবের কাছে সাধারণ ও গ্রহনযোগ্য মতবাদ প্রকাশ করতে থাকেন (যেমন: ‘ঈশ্বর মানুষের চেয়ে মহান’, ‘সব মানুষ পাপী’, ‘ঈশ্বর ন্যায্য’ ইত্যাদি)। তারা নিজেদের কথা দ্বারা ঈশ্বরের ন্যায্যতা ও মঙ্গলময়তা রক্ষা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের মতবাদ রক্ষা করার জন্য কঠোর, আবেগপ্রবণ এবং এমন কি আক্রমণাত্মক কথা বলেন। এটা কিভাবে সম্ভব? কিভাবে তারা ভুল পথে পা দিলেন? পুস্তকের শেষে ঈশ্বর তাদের দোষ ধরেন এবং ঘোষণা করেন যে তারা ঈশ্বরকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন “তুমি ও তোমার বন্ধুরা সেইভাবে আমার বিষয় ঠিক কথা বল নি” (ইয়োব ৪২:৭)।
এখানে আমরা একটি বড় সাবধানবাণী পাই যে, ‘সত্য’ বললেও আমরা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারি। আমাদের অতি সরু বা কঠোর মতবাদ ঈশ্বরকে উপযুক্তভাবে উপস্থাপন করে না, অনেক সময় আমাদের মতবাদ এই জগতের জটিল বাস্তবতার জন্য উপযুক্ত নয়।
বন্ধুদের পরামর্শ বা তর্কের সারাংশ এই: ঈশ্বর ন্যায্য। ইয়োব যেহেতু কষ্টভোগে আছেন তাই অবশ্যই তিনি কোনো পাপ করেছেন। কিন্তু বন্ধুদের এই কথায় ইয়োব রাজি নন। তিনি দাবি করেন না যে তিনি কখনও পাপ করেন নি, কিন্তু তিনি দাবি করেন যে বর্তমান দুর্দশা তার কোন নির্দিষ্ট পাপের শাস্তি নয়। আসলে ঈশ্বর শুরু থেকে ঠিক একই কথা বলেছিলেন (ইয়োব ২:৩)। বন্ধুরা ভাল উদ্দেশ্যে এসেছিলেন, কিন্তু তারা ইয়োবের কষ্টভোগ দেখে নিজেদের মতবাদ নিয়ে দিধাদ্বন্দ্বে পড়েন। তারা নিজের চিন্তা ও মতবাদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা স্বীকার করেন না বরং নিজেদের মতবাদ রক্ষা করার জন্য ইয়োবকে ত্যাগ করতে রাজি হন। আর এটাই হল তাদের পাপ।
সত্য বলা কি ভুল হতে পারে বা সত্য কি কখনও পাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে? ইয়োব পুস্তক দেখে তাই মনে হচ্ছে, দয়াহীনভাবে সত্যের প্রকাশ পাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দয়াহীন সত্য উপকারের পরিবর্তে অপকার করবে। আমরা হয়তো সত্য বলি কিন্তু অনেক সময় আমাদের মনোভাব ও উদ্দেশ্য ঠিক থাকে না। ইয়োবের বন্ধুদের সমস্যাও ঠিক তা-ই। তারা যদি একবারও বলতেন যে ‘আমরা আপনার চেয়ে ধার্মিক নই, আমাদের কোন ধারণা নেই যে আমরা কেন দুর্দশাতে নেই আর আপনি কেন আছেন’ … ‘আমরাও ঈশ্বরের সামনে নির্দোষ নই এবং আমাদেরকেও তিনি শাস্তি দিতে পারতেন’ … ‘ঈশ্বর ন্যায্য, তাই এই দুর্দশা ঈশ্বরের শেষ কথা বলে আমরা মনে করি না, এখনও আশা আছে’ – এই ধরণের কথা ইয়োবের জন্য অনেক সান্ত্বনাদায়ক হত, অন্ততপক্ষে এটা তার জন্য আক্রমনাত্মক হত না।
আরো খোলা একটি দৃষ্টি – ইলীহূ (ইয়োব ৩২-৩৭)
বন্ধুদের মধ্যে ইলীহূ একটু ভিন্ন। ইয়োবের অন্য বন্ধুদের চেয়ে তার বয়স কম এবং শুধু তার নামই যিহূদী বংশীয়। সম্ভবত অন্যদের চেয়ে তিনি একটু পরে পৌঁছান। যখন অন্যরা কথা বন্ধ করেন তখন তিনি কথা বলা শুরু করেন। তিনিও যুক্তিভিত্তিক কথা বলেন কিন্তু তার মতবাদ অন্যদের চেয়ে বেশ প্রশস্ত। অন্য বন্ধুদের মত তিনিও ঈশ্বরকে একজন শিক্ষক ও সংশোধনকারী হিসাবে দেখেন, কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলেন যে ঈশ্বরের ন্যায্যতা এমন যে মানুষ তা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারে না “সর্বশক্তিমান আমাদের নাগালের বাইরে এবং ক্ষমতায় অনেক মহান; তাঁর ন্যায়বিচার ও সততার দরুন তিনি অত্যাচার করেন না” (ইয়োব ৩৭:২৩)। তিনি ইয়োবকে নম্রতায় নিজের বুঝার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করার জন্য এবং ঈশ্বরের প্রতি বশীভূত হওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। তিনি অন্য বন্ধুদের মত ঈশ্বরের ন্যায্যতা ও মঙ্গলময়তা ঘোষণা করেন কিন্তু তাদের মত ইয়োবকে দোষ দেন না। তিনি ইয়োবের সাথে দাঁড়ান এবং বলেন যে হয়তো এখানে এমন কিছু চলছে যা মানুষ বুঝতে পারে না।
ইলীহূ ইয়োবকে বেশ কড়া সাবধানবাণী দেন: ‘সাবধান হন, মন্দের দিকে যাবেন না, আপনি তো কষ্ট পাওয়ার চেয়ে মন্দই মনোনীত করেছেন’ (ইয়োব ৩৬:২১)। তিনি ইয়োবকে সাবধান করেন যেন তিনি মন্দকে মনোনীত না করেন, যেন তিনি কষ্ট এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ঈশ্বর সম্বন্ধে ‘কঠোর উপসংহারে’ না আসেন (যেমন: ‘যদি ঈশ্বর আমার প্রতি এমন অন্যায় করেন তবে তাকে ঈশ্বর হিসাবে অগ্রাহ্য করি। এমন ঈশ্বরকে কারও প্রয়োজন নেই’)। এভাবে ইয়োব যেন অন্তর থেকে ঈশ্বরকে দূরে ঠেলে না দেন, ইলীহূ তাকে সাবধান করেন। ইয়োব যদি ঈশ্বর সম্বন্ধে এরকম ‘কঠোর উপসংহারে’ আসেন তবে সাময়িকভাবে হয়তো তার কষ্টভোগ বা অন্তরের দ্বন্দ্ব কমে যাবে, কিন্তু এটা ভাল নয়। এই পর্যন্ত ইয়োব ঈশ্বরের বিরুদ্ধে রাগ, ক্ষোভ, তিক্ততা, হতাশা ও দোষারোপ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু ঈশ্বর এসব পাপ হিসাবে ধরেন নি। তবে ‘কঠোর উপসংহারে’ আসাটা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ হয়ে দাঁড়ায়। এরজন্য ইলীহূর সাবধানবাণী যে “কষ্ট পাওয়ার চেয়ে মন্দই মনোনীত” না করা ভাল।
ঈশ্বর যে ইয়োবকে কতটা স্নেহ ও মমতার চোখে দেখেন, তা ইলীহূর এই পরামর্শ এবং ইয়োবের পক্ষে ঈশ্বরের শেষ কথা থেকে (ইয়োব ৪২:৭) আমরা বুঝতে পারি। তিনি ঈশ্বরকে দোষারোপ করেছেন ঠিকই, কিন্তু কঠোর কষ্টভোগে ছিলেন বলেই তিনি তা করেছেন। এখানে ইয়োব নিরাশাগ্রস্ত, আত্ম-ধার্মিক, রাগান্বিত এবং তেতো মনা হন। এই অবস্থায় তিনি ঈশ্বরকে সন্দেহ করেন, তাঁর দোষ ধরেন এবং আত্ম-হত্যা পর্যন্ত করার চিন্তা করেন, কিন্তু এত কষ্ট, দ্বন্দ্ব, ক্ষোভ ও নিরাশার মাঝেও তিনি ঈশ্বর-কেন্দ্রিক হতে থাকেন: তিনি ঈশ্বরের কাছেই অভিযোগ করেন, শুধু ঈশ্বরেরকেই দোষারোপ করেন এবং ঈশ্বরের কাছ থেকেই উত্তর দাবি করেন। একজন বিরক্ত, পরাজিত ও রাগী বাচ্চা যেমন হতাশায় বাবার বুকে মার দিতে থাকে, ইয়োব মানসিকভাবে অনেকটা সেই বাচ্চার অবস্থায় আছেন, কিন্তু ঈশ্বর তাকে আকড়ে ধরেন, ছেড়ে দেন না (ছবি দেখুন)।
ছবি
যদিও ইয়োব প্রচলিত মতবাদের বিপরীতে অনেক কিছু বলে ফেলেন (যা আমরা বাইবেলে না থাকলে ভাল মনে করতাম) কিন্তু ঈশ্বর ইয়োবের কথা তার বিরুদ্ধে ধরে রাখেন না, অপমানিত হন না এবং তা নিয়ে ইয়োবের দোষও ধরেন না। ঈশ্বরের পিতৃ হৃদয়ের একটি চমৎকার প্রকাশ এখানে দেখা যায়!
কিন্তু শুধু তা-ই না, এছাড়া ইয়োবের মনের গভীর কষ্টের কথা, ঈশ্বরের উপর ঢেলে দেওয়া রাগের কথা, তার তিক্ততার প্রকাশ ও তার দোষারোপের বিষয় ঈশ্বর লিপিবদ্ধ রাখতে বলেন যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ তা পড়তে পারে। ইয়োব একবার দাবি করেছিলেন যে সবাইকে দেখানোর জন্য সব কিছু ‘লিখে রাখা হোক’ (ইয়োব ৩১:৩৫-৩৬) – এবং শেষে ঠিক তা-ই হল এবং ইয়োব পুস্তক আমাদের হাতে এল। যদি ঈশ্বর শুধু নিজের প্রশংসার কথা বাইবেলে রাখতেন, যদি শুধু নিজের সুনাম রক্ষা করার জন্য ব্যস্ত থাকতেন তাহলে বাইবেলে ইয়োব পুস্তক পাওয়া যেত না। ঈশ্বর নিজের প্রশংসা পাওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন যেন দুঃখ-কষ্টে আক্রান্ত মানুষ তাঁর প্রকাশ ও সান্ত্বনা পায়, ইয়োব পুস্তক তা প্রকাশ করে। এগুলো দেখে ঈশ্বরের চরিত্র সম্বন্ধে আমরা কি শিখতে পারি?
ঈশ্বর কথা বলেন
যখন ইয়োব মনে করেন যে আশা আর নেই, বলার মত কিছু নেই, জীবনে আর ভাল কিছু হবে না, তখনই ঈশ্বর ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে দেখা করেন। তার সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় থেকে সরাসরি কথা বলেন (৩৭-৪১ অধ্যায় ধরে!)। একজন মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের এমন বিস্তারিত ও সরাসরি কথা বাইবেলে অদ্বিতীয়। ঈশ্বর যে ভালবেসে ইয়োবের কাছে আসেন, তার অভিযোগ গ্রহণ করেন, তাকে গুরুত্ব দেন, তার সঙ্গে কথা বলে যত্ন নেন – এই বিষয়টিই হল তার জন্য সুস্থতাকারী মলমের মত। এভাবে ঈশ্বর তাকে স্পর্শ করেন এবং নম্র হতে সাহায্য করেন। তবে লক্ষণীয় বিষয় হল, ঈশ্বর সুস্থতাকারী হিসাবে কাছে আসলেও তিনি ইয়োবের কোন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেন না, কষ্টভোগের কারণও প্রকাশ করেন না, বরং তিনিই এখন উল্টোভাবে সৃষ্টির বিষয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকেন। প্রশ্নগুলোর মধ্য দিয়ে ঈশ্বর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও অসীম জ্ঞান, ক্ষমতা ও মঙ্গলময়তা প্রকাশ করেন। ঈশ্বর ইয়োবকে তর্ক করার জন্য আহ্বান করেন যেন ইয়োব তর্কের মধ্য দিয়ে নিজের জ্ঞানকে প্রমাণিত করেন। ঈশ্বরের আত্ম-প্রকাশ এত শক্তিশালী যে ইয়োব স্তব্ধ হয়ে যান। ঈশ্বরের অসীম জ্ঞান তাকে নম্রতা শেখায় এবং সান্ত্বনা দেয়। ঈশ্বর ইয়োবকে দেখান যে মানুষ হিসাবে তার দৃষ্টি, চিন্তা এবং যুক্তি-তর্ক অতি সীমিত, আর একারণে ঈশ্বরকে বিচার করার অধিকার তার নেই। কষ্টভোগের কারণে ইয়োব মনে মনে সব কিছু হ্যাঁ অথবা না, এই ধরণের উত্তরে আনার চেষ্টা করছিলেন (‘যদি ঈশ্বর কষ্ট থামান তবে তিনি ন্যায্য, যদি ঈশ্বর না থামান তবে তিনি ন্যায্য নন’)। কিন্তু বাস্তবতা এই ধরণের চিন্তার চেয়ে অনেক জটিল এবং ঈশ্বরের দৃষ্টি এর চেয়ে অনেক বড়। একটি সাধারণ ঘটনার পিছনে অনেক ভিন্ন ভিন্ন কারণ, বিষয় ও উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
ঈশ্বরের কথার সাড়ায় ইয়োব বলেন “আমি তো অযোগ্য, আমি কেমন করে তোমাকে উত্তর দেব? আমার মুখে আমি হাত চাপা দিয়েছি। … “আমি জানি তুমি সব কিছুই করতে পার; তোমার কোন পরিকল্পনাই নিষ্ফল হয় না। … এই কথা ঠিক যে, আমি যা বুঝি নি সেই বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম; তা এত আশ্চর্য যে, আমার বুঝবার নাগালের বাইরে। … আগে আমার কান তোমার বিষয় শুনেছে, কিন্তু এখন আমার চোখ তোমাকে দেখল। কাজেই আমি যা বলেছি তা এখন ফিরিয়ে নিচ্ছি, আর ধুলা ও ছাইয়ের মধ্যে বসে অনুতাপ করছি” (ইয়োব ৪০:৪-৫, ৪২:১-৬)। ইয়োবের এই কথা প্রথম বারের মত দেখে মনে হতে পারে যে ঈশ্বর এখানে তাঁর পরাক্রম দ্বারা ইয়োবকে চুরমার করে বশে আনেন, কিন্তু হয়তো ইয়োব কথাটি হাসিমুখে বলেন: তার প্রয়োজনগুলো মেটানো হয়েছে, ঈশ্বর নিজেই তার সাথে দেখা করেছেন। দেখা যাচ্ছে যে বিচারক হিসাবে ঈশ্বর আসলে দয়ালু। ঈশ্বরের প্রকাশ ও স্নেহের মধ্য দিয়ে ইয়োব তার প্রশ্নগুলোর উত্তর পেলেন।
ঈশ্বর কি শয়তানের চালাকি দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন?
বাইবেলের অন্যান্য পুস্তকের চেয়ে ইয়োব পুস্তকে শয়তানের কথা তুলনামূলকভাবে বেশি, অর্থাৎ ১৪ বার উল্লিখিত। পুস্তকের শুরুতে মনে হতে পারে যে শয়তান চালাকি করে ঈশ্বরকে পরিচালিত করছে, কৌশলে ঈশ্বরের অহংকার উষ্কিয়ে তুলছে ও অপ্রয়োজনীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাধ্য করছে – এবং এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার শিকার হলেন ইয়োব।
কিন্তু পুস্তকের শেষে ভিন্ন একটি ছবি প্রকাশিত হয়। শয়তানকে আর উল্লেখও করা হয় না। এই গল্পে প্রকৃতপক্ষে শুধু একজনই পরাজিত, আর সে হল শয়তান। ইয়োব তার কষ্টভোগের মধ্য দিয়ে একটি অদ্বিতীয় অভিজ্ঞতা লাভ করেন, ঈশ্বরের চরিত্রের একটি অতুলনীয় প্রকাশও তিনি পান (ইয়োব ৪২:৫)। ঈশ্বর ইয়োবের বন্ধুদের ধমক দেন ঠিকই, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তারাও ঈশ্বরের ভক্তিপূর্ণ ভয় এবং যথেষ্ট নতুন প্রকাশ লাভ করেন। কিছু কিছু মূল্যবান প্রকাশ আছে যা কষ্টভোগ ছাড়া শেখা সম্ভব নয়। যে ঘটনাটি শয়তান মন্দ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, সেই ঘটনাটি ঈশ্বর ভক্তিপূর্ণ ভয় বৃদ্ধি এবং নিজের চরিত্র সম্বন্ধে গভীর প্রকাশ দানের জন্য ব্যবহার করেছেন। এছাড়া পরবর্তী প্রজন্মের পাঠকেরা ইয়োব পুস্তক থেকে সান্ত্বনা, প্রজ্ঞা, ঈশ্বরের পথ মেনে নেওয়া এবং আকড়ে ধরে রাখার জন্য অনুপ্রেরণা পায়। শয়তান আসলে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত।
কেউ কেউ এই পুস্তক পড়ে ‘কঠোর ঈশ্বর ও বেচারা ইয়োব’ নামে একটি সংঘ খুলতে চায়। সম্ভবত এই সংঘের জন্য যথেষ্ট সদস্যও পাওয়া যেতে পারে। তবুও একটি বিষয় নিশ্চিত যে এই সংঘে অনেক সদস্য পেলেও একজন সদস্যকে পাবেন না, তিনি হলেন স্বয়ং ইয়োব। পুস্তকের এক পর্যায়ে তিনি হয়তো যোগ দিতে আগ্রহী হতেন, কিন্তু শেষে আর আগ্রহী হতেন না।
ইয়োবের কিছু ভাববাদীমূলক কথা
যদিও ইয়োব তার কষ্ট থেকে অনেক নেতিবাচক কথা বলে ফেলেন কিন্তু সেখানে চমৎকার কিছু ভাববাদীমূলক কথাও পাওয়া যায়। তিনি ঘোষণা করেন: “আমি জানি আমার মুক্তিদাতা জীবিত আছেন; শেষে তিনি পৃথিবীর উপরে এসে দাঁড়াবেন। আমার চামড়া ধ্বংস হয়ে যাবার পরেও আমি জীবিত অবস্থায় ঈশ্বরকে দেখতে পাব। আমি নিজেই তাঁকে দেখব; অন্যে নয়, কিন্তু আমি আমার নিজের চোখেই তাঁকে দেখব। আমার অন্তর আকুলভাবে তা চাইছে” ইংরেজী অনুবাদ “ঈশ্বরকে আমার পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পাব” (ইয়োব ১৯:২৫-২৭)। ইয়োব এমন একজনকে চান যিনি তার পক্ষে সালিশ করেন (ইংরেজীতে একজন ‘আম্পায়ার’, ইয়োব ৯:৩৩), তিনি একজন মধ্যস্থকারীর জন্য দাবি করছেন (ইয়োব ৩৩:২৩)। আর আসলেই ঈশ্বর এক দিন ইয়োবের দাবি পূর্ণ করে একজনকে দান করবেন: যীশুই তিনি, যিনি সেই সালিশ করার লোক, আম্পায়ার, মধ্যস্থকারী, উদ্ধারকর্তা, সমর্থক-উকিল ও পাশে দাঁড়ানোর লোক। যীশু মানুষের কষ্টভোগ সম্পূর্ণভাবে বোঝেন কারণ তিনিও সব রকম পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং মৃত্যুসম কষ্টভোগ করেছিলেন (ইব্রীয় ৪:১৫)।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।