ধর্ম ১০ – নতুন নিয়মে নেতৃত্ব – একজন ব্যক্তি নিয়ে অধ্যয়ন: পিতর

পিতরের পরিবার

  • যদিও ‘পিতর’ নাম দ্বারাই পরিচিত, তার প্রথম দেওয়া নাম ছিল ইব্রীয় ‘শিমিয়ন’ (প্রেরিত ১৫:১৪, ২ পিতর ১:১ গ্রীকে এই শব্দ পাওয়া যায়)। পরে তিনি তার নামের গ্রীক অনুবাদ ব্যবহার করতেন: ‘শিমোন’। বাংলায় দুইটা শব্দের অনুবাদ হিসাবে ‘শিমোন’ দেওয়া হয়েছে।
  • তার বাবার নাম ছিল যোনা (মথি ১৬:১৭), তাই যীশু তাকে শিমোন বার-যোহনা ডাকেন। যীশু তাকে যোহনের ছেলে বলেও ডাকেন (যোহন ১:৪২, ২১:১৭)।
  • মথি ৮:১৪, মার্ক ১:৩০ ও লূক ৪:৩৮ পদে উল্লিখিত যে যীশু পিতরের শাশুড়ির জ্বর সুস্থ করেন, তাই আমরা জানি যে পিতর বিবাহিত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে প্রচারে বের হন (১ করি ৯:৫)। বাইবেল উল্লেখ করে না তাদের সন্তান ছিল কিনা, কিন্তু তা অবশ্যই সম্ভব।
  • তিনি ছিলেন বৈৎসৈদার শহরের বাসিন্দা। বৈৎসৈদা ছিল গাওলানিতীয়া এলাকায় গালীল সাগরের পাড়ে একটি গ্রীক শহর (যোহন ১:৪৪)। আবারও উল্লেখ আছে যে তিনি গালীল সাগরের পাড়ে কফরনাহূম নামে একটি শহরে বাস করতেন (মার্ক ১:২৯)। হয় পিতরের পরিবারের দু্ইটি শহরে দুইটি বাড়ী ছিল, না হয় পিতর বৈৎসৈদা থেকে কফরনাহূমের কাছে সরে আসলেন।
  • তিনি একটি গালীলের স্বরাঘাতে কথা বলতেন (মার্ক ১৪:৭০) এবং তিনি শিক্ষিত ছিলেন না বরং সাধারণ লোক (প্রেরিত ৪:১৩), কিন্তু তিনি ‘যে যীশুর সংগী ছিলেন তাও বুঝতে পারলেন’ । তবুও ভাল যিহূদী ছেলে হিসাবে তিনি অবশ্যই পড়তে ও লিখতে জানতেন। যেহেতু গালীলে অনেক অযিহূদীও বাস করতেন, পিতর হয়তো কিছুটা গ্রীক ভাষাও পারতেন।
  • সিবদীয় এবং তার ছেলেরা যাকোব ও যোহনের সাথে পিতর মাছ ধরার ব্যবসায় একজন ভাগীদার ছিলেন (লূক ৫:১০)। যীশুর সাথে দেখা হওয়ার আগেও এই তিনজন একসাথে কাজ করতেন।

যীশুর পরিচর্যার সময়ে পিতর

  • পিতর ১২ শিষ্যদের নেতা ছিলেন। যীশু তাকেই প্রথম আহবান দিলেন এবং যত বার ১২ শিষ্যদের তালিকা উল্লিখিত, তত বার পিতরের নাম প্রথম (থি ১০:২, মার্ক ৩:১৬, লূক ৬:১৪)।
  • যীশুর সবচেয়ে ঘনিষ্ট সম্পর্কের তিনজন শিষ্য ছিলেন পিতর, যাকোব ও যোহন। তারা বেশ কয়েকটি বিশেষ সময়ে উপস্থিত: যখন যীশু যায়ীরের মেয়েকে মৃত থেকে জীবিত করে তোলেন (মার্ক ৫:৩৭), পাহাড়ের উপরে রূপান্তরের সময়ে (মার্ক ৯:২), জৈতূন পাহাড়ে যীশুর শিক্ষা দানের সময়ে (মার্ক ১৩:৩) এবং গেৎশিমানী বাগানে (মার্ক ১৪:৩৩)।
  • পিতর এবং যোহন হল সে দুইজন শিষ্য যাদের যীশু উদ্ধার পর্বের জন্য ভোজ প্রস্তুত করতে পাঠান (লূক ২২:৮)।
  • পিতর অনেক বার চিন্তা না করে অনেক কিছু বলে ফেলতেন। পিতরই যীশুকে অনুরোধ করেন তাকে জলের উপরে হাঁটতে বলতে (মথি ১৪:২৮)। রূপান্তরের সময়ে তিনি না বুঝে প্রস্তাব দিয়ে ফেলেন এখানে যীশু, মোশি ও এলিয়ের জন্য কুঁড়ে-ঘর বানাতে (মথি ১৭:৪, মার্ক ৯:৫, লূক ৯:৩৩), মার্ক মন্তব্য করেন যে ‘কি যে বলা উচিত তা পিতর বুঝলেন না’ (মার্ক ৯:৬)। পিতর বড় করে প্রতিজ্ঞা দেন যে তিনি বিশ্বস্ত থাকবেন, অন্যরা না হলেও: ‘সবার মনে বাধা আসলেও আমার মনে বাধা আসবে না।’ (মথি ২৬:৩৩,৩৫, মার্ক ১৪:২৯, লূক ২২:৩৪, যোহন ১৩:৩৬)। অবশ্যই পরে অন্যান্য শিষ্যেরাও একই প্রতিজ্ঞা করে ফেলেন, তারাও চিন্তা না করে তাই করেন। পিতর আপত্তি উঠান যখন যীশু তার পা ধুচ্ছেন (যোহন ১৩:৬-৯) এবং তিনিই সে শিষ্য যিনি যীশুর গ্রেফতারের সময় মহাপুরোহিতের দাসের কান কেটে ফেলে (যোহন ১৮:১০)। পিতর ঠিকই চেষ্টা করেন যীশুর মামলার সময়ে পুরোহিতের উঠানে ঢুকতে কিন্তু তার শেষ ফল যে তিনি ভয়ে যীশুকে অস্বীকার করেন (মথি ২৬:৬৯-৭৫, মার্ক ১৪:৬৬-৭২, লূক ২২:৫৪-৬২, যোহন ১৮:১৫-১৮)। পিতর যীশুর মৃত্যুর পরে শিষ্যদের আবার গালীলে মাছ ধরার জন্য নিয়ে যায় (যোহন ২১:৩) এবং তিনি সাগরে লাফ দেন যখন তিনি বুঝতে পারেন যে যীশু উপস্থিত (যোহন ২১:৭)।
  • তিনি অনেক বার ১২ শিষ্যদের পক্ষে যোগাযোগকারী এবং অনেক বার এমন প্রশ্ন বলে ফেলেন যা সবার ছিল। তিনি যীশুকে অনুরোধ করেন দৃষ্টান্তগুলি বুঝাতে (মথি ১৫:১৫, লূক ১২:৪১), তিনি যীশুকে জিজ্ঞাসা করেন কত বার একজন ভাইকে ক্ষমা করতে হয় (মথি ১৮:২১), তিনি জিজ্ঞাসা করেন যারা যীশুর অনুস্মরণকারী হিসাবে সব কিছু ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন তারা কি পুরষ্কার পাবে (মথি ১৯:২৭, মার্ক ১০:২৮, লূক ১৮:২৮), যখন অনেকে চলে যাওয়ার বিষয়ে যীশু শিষ্যদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন পিতর একটি প্রশ্নের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন যে আর কোথাও যাওয়া যাবে না (যোহন ৬:৬৮) এবং তিনি জিজ্ঞাসা করেন কে যীশুকে ধরিয়ে দেবেন (যোহন ১৩:২৪)। তিনি যীশুকে বলেন যে সবাই তাঁকে খোঁজে (মার্ক ১:৩৬) এবং খেয়াল করেন যে ডুমুর গাছ শুকিয়ে গেছে (মার্ক ১১:২১)। যখন ভীড়ের ঠেলাঠেলিতে যীশু জিজ্ঞাসা করেন কে তাঁকে স্পর্শ করেছে, পিতর উত্তরে ভীরের কথা বলেন (লূক ৮:৪৫)। উপাসনা ঘরের কর-আদায়কারীরা পিতরকে জিজ্ঞাসা করে যীশু কর দেন কিনা, যার কারণে যীশু পরে একটি মাছের মুখে পাওয়া যাওয়া রূপার টাকা কর হিসাবে দেন (মথি ১৭:২৪)। গেৎশিমানী বাগানে যীশু পিতরকে জিজ্ঞাসা করেন একটি ঘন্টা কেন জেগে থাকতে পারলেন না (মথি ২৬:৪০, মার্ক ১৪:৩৭)।
  • পিতর যীশুকে ‘খ্রিষ্ট’ (গ্রীক ভাষায়) বা ‘মশীহ’ (ইব্রীয় ভাষায়) বলে, এই ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে চারটি সুসমাচারে উল্লেখ (মথি ১৬:১৬, মার্ক ৮:২৯, লূক ৯:২০, যোহন ১৩:৩৭)।
  • কিন্তু পিতর এই চরম মুহূর্তের পরে আবার হারিয়ে যান কারণ তিনি গ্রহণ করতে পারেন না যে মশীহ কষ্টভোগ করবেন (মথি ১৬:২২, মার্ক ৮:৩২)।
  • যীশু তার নাম ‘পিতর’ রাখেন (মথি ১৬:১৮) ‘এই পাথরের উপরেই আমি আমার মণ্ডলী গড়ে তুলব’। কথাটি তর্কের বিষয় হয়ে গেছে। ক্যাথলিক মণ্ডলীর ব্যাখ্যা হল যে পিতর তাই মণ্ডলীর ভিত্তি। প্রোটেসট্যানট মণ্ডলীর ব্যাখ্যা হল যে পিতর ব্যক্তি হিসাবে মণ্ডলীর ভিত্তি নন বরং মণ্ডলীর ভিত্তি হল যা পিতর এখানে স্বীকার করেছেন: “যীশুই মশীহ”।
  • কেউ এভাবেও ব্যাখ্যা করে যে যীশু এখানে একটি শব্দ নিয়ে পার্থক্য দেখায়: পিতরের ক্ষেত্রে যীশু সে শব্দ ব্যবহার করেন তার অর্থ হল ‘শিলাগুটি’ (pebble) এবং মণ্ডলীর ক্ষেত্রে যীশু যে শব্দ ব্যবহার করেন তার অর্থ হল ‘বড় পাথর’ (boulder)।

যীুশুকে অস্বীকার করার পরে যীশু পিতরকে পুনরুদ্ধার করেন

  • পিতর বড় কথা বলে একটি প্রতিজ্ঞা করে ফেলেন যে তিনি যীশুকে ছেড়ে চলে যাবেন না, এমন কি পার্থক্য দেখিয়ে তা করেন: ‘সবার মনে বাধা আসলেও আমার মনে বাধা আসবে না’ (মথি ২৬:৩৩,৩৫, মার্ক ১৪:২৯, লূক ২২:৩৪, যোহন ১৩:৩৬)। যীশু ভবিষ্যদ্বাণী দেন যে পিতর এই প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে তাঁকে অস্বীকার করবেন (মথি ২৬:৩৪, লূক ২২:৩১-৩৪)।
  • গ্রেফতারের সময় পিতর চেষ্টা করেন যীশুকে তলোয়ারের শক্তি দ্বারা রক্ষা করতে। কিন্তু যীশু তাকে ধমক দেন ও পরিবর্তে আঘাত প্রাপ্ত লোককে সুস্থ করেন (লূক ২২:৫০-৫১, যোহন ১৮:১০-১১)।
  • পিতর পুরোহিতের উঠান পর্যন্ত যীশুর পিছনে পিছনে যান (মথি ২৬:৫৮, মাার্ক ১৪:৫৪, লূক ২২:৫৪, যোহন ১৮:১৫), কিন্তু যখন কিছু লোক তাঁকে চিনে ফেলে তিনি যীশুকে অস্বীকার করেন (মথি ২৬:৭০,৭২,৭৪, মার্ক ১৫:৬৬-৭২, লূক ২২:৫৪-৬২, যোহন ১৮:১৭-২৭)।
  • পুনরুত্থিত যীশু মহিলাদের বলেন এই সুখবর শিষ্যদের জানাতে, তিনি বিশেষভাবে তা পিতরকে জানাতে বলেন (মার্ক ১৬:৭-৮, যোহন ২০:২)। পিতর কবরে গিয়ে দেখেন যে কাপড়রগুলো পড়ে আছে (লূক ২৪:১২, যোহন ২০:৬)। পুনরুত্থিত যীশু পিতরের সাথে দেখা করেন (লূক ২৪:৩৪, ১ করি ১৫:৫)।
  • গালীল সাগরের পাড়ে যীশু পিতরের সাথে দেখা করেন। তিনি তাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য তিন বার জিজ্ঞাসা করেন তিনি তাঁকে ভালবাসেন কিনা। তিনি তাকে মণ্ডলীতে নেতৃত্ব দেওয়ার ভূমিকায় তাকে পুনরায় স্থাপন করেন (যোহন ২১:১৫-১৮) এবং ভবিষ্যদ্বাণী দেন যে পিতর শহীদ মৃত্যু বরণ করবেন (যোহন ২১:১৮)।

প্রথম মণ্ডলীর নেতা হিসাবে পিতর

  • যীশুর পুনরুত্থান ও স্বর্গারোহণের পরে প্রেরিতদের তালিকায় আবারও পিতরের নাম প্রথমে দেওয়া (প্রেরিত ১:১৩) এবং তিনি প্রেরিতদের নেতা হিসাবে ভূমিকা পালন করেন। তা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যিহূদার পরিবর্তে মত্তথিয়কে বেছে নেওয়ার গল্পে (প্রেরিত ১:১৫)।
  • যখন পবিত্র আত্মা নেমে আসেন, পিতরই দাঁড়িয়ে প্রচার করেন এবং জমে যাওয়া লোকদেরকে বুঝান এখানে কি ঘটছে (প্রেরিত ২)।
  • পিতর এবং যোহন উপাসনা-ঘরের সুন্দর নামে দরজায় যখন একজন পঙ্গু লোককে সুস্থ করেন তারা আবারও প্রচার করেন (প্রেরিত ৩)। তাতে ধর্ম নেতারা বিরক্ত পেয়ে পিতর ও যোহনকে গ্রেফতার করে মহাপুরোহিতের সামনে আনেন, যেখানে আবারও পিতর শিষ্যদের পক্ষ হয়ে কথা বলেন। নেতারা পিতর ও যোহনের সাহস দেখে তাদের প্রচারের নিষেধাজ্ঞা দেন যা পিতর ও যোহন অগ্রাহ্য করেন: মানুষের চেয়ে ঈশ্বরের আদেশ পালন করতে হবে (প্রেরিত ৪)।
  • নেতা হিসাবে পিতর অননিয় ও সাফিরাকে ধমক দেন ও শাসন করেন (প্রেরিত ৫:১-১১)। তার ছায়া পড়লে মানুষ সুস্থ হয়ে যায় (প্রেরিত ৫:১৫)। তাকে অন্য শিষ্যদের সাথে আবার গ্রেফতার করা হয় কিন্তু তারা আশ্চর্যভাবে মুক্তি পান। পরে তাকে আবারও গ্রেফতার করা হয়, যিহূদী পরিষদের সামনে দাঁড় করানো হয়, পিটুনি দেওয়া হয় এবং শেষে তিনি গমলীয়েলের পরামর্শ দ্বারা মুক্তি পান (প্রেরিত ৫)।
  • শমরিয়ায় ফিলিপের পরিচর্য্যার কথা শুনে পিতর ও যোহনকে যিরূশালেম থেকে শমরিয়ায় পাঠানো হয়। তারা লোকদের জন্য প্রার্থনা করে যেন তারা পবিত্র আত্মা পায়। শিমোন, একজন যাদুকর, যখন পবিত্র আত্মার দান টাকা দিয়ে কিনতে চায়, পিতর তাকে ধমক দেন (প্রেরিত ৮)। এই সব ঘটনায় পিতর নেতার ভূমিকা পালন করেন।
  • তার পরে হতে পারে (যীশুর ভাই) যাকোব যিরূশালেমের মণ্ডলীর নেতা হয়ে যান, যাতে পিতর আরো স্বাধীনতা পান প্যালেষ্টাইনের অন্যান্য এলাকায় যাত্রা করতে যেখানে মণ্ডলীর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
  • প্রেরিত ৯ অধ্যায়ে লুদ্দা শহরে পিতরের পরিচর্য্যার বর্ণনা দেওয়া হয় যেখানে তিনি পঙ্গু ঐনিয়কে সুস্থ করেন। যাফো শহরে তিনি টাবিথা নামে একজন বিশ্বাসীনীকে মৃত্যু থেকে উঠিয়ে দেন।
  • প্রেরিত ১০ অধ্যায়ে বর্ণনা করেন পিতর কিভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শন দেখেন। তিনি রোমীয় সৈন্যদলের শতপতি কর্ণীলিয়ের বাড়ীতে গিয়ে প্রচার করেন, কর্ণীলিয় ও তার পরিবার বিশ্বাসী হয়ে যান ও পবিত্র আত্মার দান পান। তারাই প্রথম পরজাতি যারা বিশ্বাসী হয়ে যায়। পিতর যিরূশালেমে ফিরে এলে যখন কিছু প্রেরিতরা এই ঘটনার কারণে আপত্তি উঠান তখন পিতর তাদের উত্তর দেন এবং ঈশ্বর যা প্রকাশ করেছেন, তা ব্যাখ্যা করেন (প্রেরিত ১১)।
  • রাজা হেরোদ সিবদিয়ের পুত্র যাকোবকে মেরে ফেলেন এবং দেখেন যে, যিহূদীরা তাতে খুশি, তিনি পিতরকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য গ্রেফতার করেন। সে রাতে ঈশ্বরের একটি স্বর্গদূত পিতরকে মুক্ত করেন এবং পিতর মণ্ডলীর সাথে দেখা করেন যারা তার মুক্তির জন্য প্রার্থনা করে ও প্রার্থনার পূর্ণতা দেখে অবাক হয়ে যায় (প্রেরিত ১২)। পৌল যিরূশালেমে এসে পিতর ও যাকোবের সঙ্গে দেখা করেন (গালাতীয় ১:১৮)। যাকোব, পিতর ও যোহনকে সে সময় মণ্ডলীর স্তম্ভ হিসাবে মানা হত। তারা পৌলের সুসমাচার ও তার পরজাতিদের কাছে আহবান বুঝেন ও অনুমোদিত করেন (গালাতীয় ২:৯-১০)।
  • কিছুক্ষণ পরে পিতর সিরিয়ার আন্তিয়খিয়ায় আসেন ও সেখানে অযিহূদী বিশ্বাসীদের সাথে সহভাগিতা করেন। কিন্তু যখন যিরূশালেম থেকে আসা বিশ্বাসীরা তাকে এই বিষয়ে চাপ দেয়, তখন তিনি অযিহূদী বিশ্বাসীদের সঙ্গে সহভাগিতা রাখা বাদ দেন। পৌল পিতরকে মুখে মুখে ধমক দেন এবং প্রচারের সঙ্গে আচরণের মিল না থাকার জন্য তার দোষ ধরেন (গালাতীয় ২:১১-১৪)। বুঝা যায় যে পিতর পৌলের ধমক মেনে নিয়ে মন পরিবর্তন করেন কারণ পরে যখন যিরূশালেমে এই বিষয়ে প্রেরিতদের একটি সভা হয়, পিতর পৌলের কথাকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করেন (প্রেরিত ১৫)।

পিতরের পরের জীবন ও মৃত্যু

  • পিতর যিরূশালেমের প্রেরিত সভায় উপস্থিত (৪৯ খ্রিঃ)। তিনি পৌলকে সমর্থন করেন যে অযিহূদী বিশ্বাসীদের জন্য যিহূদী নিয়ম পালন করা আবশ্যক নয় (প্রেরিত ১৫)। সভার এই সিদ্ধান্ত হল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও স্মারক সিদ্ধান্ত যা দ্বারা মণ্ডলীর ইতিহাস শক্তিশালীভাবে প্রভাবিত হয়।
  • আমরা জানি পিতর এক সময় পৌল দিয়ে স্থাপিত করিন্থ মণ্ডলীর কাছে বেড়াতে যান কারণ সেখানে একটি দল আছে যারা পিতরকে অনুসরণ করে (১ করি ১:১২)।
  • পিতরের নাম এশিয়া মাইনেরে বিথুনিয়া, পন্ত, গালাতীয়া, এশিয়া ও কাপ্পাদকিয়া এলাকার মণ্ডলীগুলির সাথেও যুক্ত,
  • কারণ তার প্রথম চিঠি (১ পিতর) এবং হয়তো তার দ্বিতীয় চিঠি (২ পিতর) তাদেরই কাছে লেখা (১ পিতর ১:১)। তিনি তাদেরকে একটি চোখের সাক্ষীর অধিকারের সঙ্গে লিখেন (২ পিতর ১:১৬-১৮): ‘আমরা তাঁর মহিমা নিজেদের চোখেই দেখেছি। ১৭ ‘ইনি আমার প্রিয় পুত্র, এঁর উপরে আমি খুব সন্তুষ্ট,’ স্বর্গ থেকে বলা এই কথার মধ্য দিয়ে খ্রীষ্ট পিতা ঈশ্বরের কাছ থেকে সম্মান ও গৌরব লাভ করেছিলেন। ১৮ আমরা যখন তাঁর সংগে সেই পবিত্র পাহাড়ে ছিলাম তখন স্বর্গ থেকে বলা এই কথাগুলো শুনেছিলাম’। আমরা নিশ্চিত জানি না তিনি এই মণ্ডলীগুলি স্থাপন করেছিলেন কিনা কিন্তু তিনি কম পক্ষে তাদের সাথে পরিচিত ছিলন।
  • অনেকে বলে যে পিতর রোম মণ্ডলীর স্থাপনকারী, কিন্তু তার আসলে কোনো প্রমাণ নেই। নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে পিতর রোম মণ্ডলীতে সময় কাটিয়েছেন তার জীবনের শেষের দিকে। তিনি তার একটি চিঠি (১ পিতর) বেশ নিশ্চিতভাবে রোম থেকে লিখেছেন (১ পিতর ৫:১৩) সম্রাট নীরোর অত্যাচারের আগেই। রোম শহর পুড়ে যাওয়ার জন্য নীরো খ্রিষ্টানদের উপর দোষ চাপিয়ে দিলেন এবং ৬৪ থেকে ৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একটি ভয়ংকর অত্যাচার চালিয়েছিলেন। এই অত্যাচারে পিতর, পৌল এবং আরো এক হাজার বিশ্বাসীরা শহীদ মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
  • ক্যাথলিক মণ্ডলীর ঐতিহ্য অনুসারে পিতর বন্ধুদের পরামর্শ অনুসারে অত্যাচার এড়িয়ে যাওয়ার জন্য রোম শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। আপ্পিয়ার রাস্তা হাঁটার সময়ে দর্শনে তার যীশুর সাথে দেখা হয়। তিনি যীশুকে জিজ্ঞাসা করেন: ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ যীশু উত্তর দেন: ‘আমি রোমে যাই আর একবার ক্রুশে মারা যাওয়ার জন্য’। এই কথা শুনে পিতর লজ্জা পেয়ে রোম শহরে ফিরে যান যেখানে নীরো তাকে মৃত্যুদন্ড হিসাবে ক্রুশে দেন। পিতর অনুরোধ করে যে তাকে মাথা নীচে ও পা উপরে উল্টাভাবে ক্রুশে দেওয়া হয় কারণ যীশুর মত মারা যাওয়ার তিনি যোগ্য নন।
  • মণ্ডলীর ইতিহাসবিদ ইউসেবিয়াস (মৃত্যু ৩৩৯ খ্রিঃ) লিখেছেন: ‘বোধ হয় যে পিতর পন্ত, গালাতীয়া, বিথুনিয়া, কাপ্পাদকিয়া ও এশিয়া এলাকার যিহূদীদের কাছে প্রচার করেছেন এবং অবশেষে রোম শহরে এসেছেন, যেখানে তাকে উল্টো করে ক্রুশে দেওয়া হয়েছিল, কারণ তিনি তাই অনুরোধ করেছিলেন’।
  • মণ্ডলীর ঐতিহ্য বলে যে পিতরের স্ত্রীও (কন্কর্দিয়া বা পের্পেটুয়া) শহীদ মৃত্যু বরণ করেছেন। পিতর তাকে সাহস দেওয়ার জন্য বলেছেন: ‘প্রিয়া, আমাদের প্রভুকে স্মরণ কর!’

সারাংশ

  • ঈশ্বর পরিচর্য্যায় অনেক ভিন্ন ব্যক্তিত্বের, তালন্তের ও ধরণের লোকদেরকে সর্বোচ্চভাবে ব্যবহার করেছেন, তা দেখা উৎসাহের ব্যাপার: একজন আত্ম-ধার্মিক ফরীশী যেমন পৌল, একজন আশা ভঙ্গকারী লোক যেমন যোহন মার্ক, একজন লাজুক, শান্ত লোক যেমন তীমথিয়, একজন ‘কথা-বলে-ফেলা-পরে-চিন্তা-করা’ লোক যেমন পিতর। পুরাতন নিয়ম অন্তরভুক্ত রাখলে: একজন তোতলা লোক যেমন মোশি, একজন কৃষক যেমন আমোষ, একজন কূটনীতিক নপুংসক যেমন দানিয়েল ইত্যাদি।
  • ব্রিটিশ লেখক সি.এস. লূইস যেমন বলেছেন: ‘বড় দমনকারীরা সবাই এক ধরণের, কিন্তু পবিত্ররা কত যে ভিন্ন!’
  • পিতর রোম রাজ্যের ‘পিছনের উঠানে’ একজন অল্প শিক্ষিত জেলে হিসাবে জন্ম নেন। তার জীবনের শেষে তিনি গ্রীক ভাষায় এমন লোকদের চিঠি লিখেন যারা এমন জায়গায় বাস করে যা পিতর জানতেন না পৃথিবীতে আছে। তার লেখা ঈশ্বরের আইনগত বাক্য হিসাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে গেছে ও তা শতাব্দীর পর শতাব্দী কোটি কোটি মানুষ দ্বারা পড়া হয়েছে।
  • পিতরের জীবন একটি শক্তিশালী উদাহরণ কিভাবে ঈশ্বর মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ উন্নয়নকারী – যদি আমরা সাড়া দেই। একটি প্রবাদ যেমন বলে: ‘খ্রিষ্টান বিশ্বাসই মানে অনবরত প্রশিক্ষণ’ (‘Christianity is an education’)
  • পিতর এমন নেতা যিনি প্রয়োজন হলে সামনে দাঁড়াতে পারেন কিন্তু যিনি মনে করেন না সামনে দাঁড়ানো আবশ্যক। যখন ঈশ্বর তাকে অন্যদিকে পরিচালনা দেন তিনি নিশ্চিন্তে যিরূশালেম মণ্ডলীর নেতৃত্ব আর একজনের কাছে হস্তান্তর করেন।
  • পিতর যে কোনো ভুল করেন, তা নয়। তিনি অনেক বার ভুলভাবে সাড়া দেন, বেশি কথা বলে ফেলেন এবং নেতা হিসাবেও ভুল করেন। তাই তার পরবর্তীতে কোনো মণ্ডলীর নেতারও অব্যর্থ বা ভুলমুক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। ৪৮ খ্রিষ্টাব্দে আন্তিয়খিয়ায় যখন পৌল তাকে পরজাতিদের বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেন, পিতর পৌলের ধমক ও সংশোধন মেনে নেন, তা সত্য হিসাবে বুঝেন ও পরবর্তীতে সমর্থন করেন। নেতারা যে ভুল করবে না, বাইবেলে তার কোনো দাবী নেই, কিন্তু তাদের নম্র হওয়া এবং সত্যে গ্রহণ করাই আবশ্যক।
  • বামের ছবি: রোমে সাধু পিতরের বাসিলিকা।