পরিবার ১১ – সন্তানদের শাসন করা
এই শিক্ষার ভিত্তি হল মার্টিন স্নীদারের বই ‘সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে শারীরিক শাসন’
হিতোপদেশ: সন্তানদের শাসন করার প্রয়োজনীয়তা
হিতো ১৩:২৪ ‘যে তার ছেলেকে শাস্তি দেয় না সে তাকে ভালবাসে না (কেরী: ‘সে তাকে দ্বেষ করে’; ইব্রীয় ‘সে তাকে ঘৃণা করে’), কিন্তু যে তাকে ভালবাসে সে তার শাসনের দিকে মনোযাগ দেয়।’
- একটি সন্তানকে শাসন না করা মানে তাকে ‘ঘৃণা করা’, তাকে সেবা না করে বরং অবহেলা করা, তাকে একটি আঘাতপূর্ণ ও বিপজ্জনক পথে পাঠিয়ে দেওয়া, যেখানে সন্তানের খারাপ সিদ্ধান্তের ফলাফল তার উপভোগ করতে হবে।
- অধ্যবসায় বা পরিশ্রম প্রয়োজন: মনোযোগ দেওয়া, সময় দেওয়া, যা হয়েছে তা জেনে নেওয়া, পিছনে লেগে থাকা, যা বলা হয়েছে আসলে করা, নিশ্চিত করা যে সন্তান জেদ দ্বারা বিষয়টি এড়িয়ে যেতে না পারে। এইগুলো করতে গেলে অনেক ধৈর্য্য ও সমর্পণ দরকার।
- যদি যত্ন সহকারে শাসন না করি, এক এক দিন এক এক রকম শাসন করি, তবে শাসনের ভাল ফল বা কার্যকারিতা থাকবে না। এভাবে শাসন করলে সন্তান শিখবে যে নীতি বা উপযুক্ত ব্যবহারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে শক্তিশালীদের মেজাজ।
হিতো ১৯:১৮ ‘তোমার ছেলেকে শাসন কর, কারণ তাতে আশা আছে; তার মৃত্যু ঘটাতে চেয়ো না।’
- শাসন ছোটবেলা থেকেই প্রয়োজন। শাসন শুরু করবেন না কেবলমাত্র যখন সন্তান ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ চলে যায় বা শাসন শুধুমাত্র নিজের বিরক্ত লাগার কারণে করবেন না।
- ছোটবেলা থেকে সন্তানকে নীতিমালা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, কারণ ও ফলাফল বুঝানোর জন্য একটি যত্নশীল ও নীতিভিত্তিক শাসন দরকার (diligent and consistent discipline)।
হিতো ২২:১৫ ‘ছেলে বা মেয়ের অন্তরে বোকামি যেন বাঁধা থাকে, কিন্তু শাসনের লাঠি তা তার কাছে থেকে দূর করে দেয়।’
- সন্তান যে সম্পূর্ণ নির্দোষ, তাও না। তাদেরও ছোটবেলা থেকে সে মানবীয় পাপ-স্বভাব আছে, যা স্বার্থপরতা, অহংকার, হিংসা ও দমনের দিকে টানে।
- যদি সন্তানদের এর চেয়ে ভাল পথ শেখানো না হয়, তবে তারা দুষ্ট হবে, এমন কি মন্দ হবে।

হিতো ২৩:১৩-১৪ ‘ছেলে বা মেয়েকে শাসন করতে অবহেলা কোরো না; তাকে লাঠি দিয়ে মারলে সে মরবে না। ১৪ তাকে অবশ্যই তুমি লাঠি দিয়ে মেরে শাস্তি দেবে, তাতে মৃতস্থান থেকে তাকে রক্ষা করবে।’
- আবারও শাসন করার প্রয়োজনীয়তা দেখানো হয়। শাসন উভয় সন্তান এবং বাবা-মায়ের জন্য মজার বিষয় নয়, কিন্তু প্রয়োজন বলে তা করা আবশ্যক। শাসন করতে খারাপ লাগলেও তা করতে এড়িয়ে যাবেন না।
- একটি সন্তানকে শাসন না করা মানে তাকে একটি মৃত্যুর পথে পাঠানো।
- সন্তানের চেয়ে বাবা-মায়ের প্রজ্ঞা বেশি, তাই বাবা-মায়ের সে সুনেতৃত্ব দেওয়া দরকার।
- ইব্রীয় শব্দ ‘লাঠি’ (H7626 ‘shebet’) বাইবেলে ১৭৮ বার উল্লিখিত। এর অর্থ হতে পারে লাঠি, খুন্তি, ডাল, সংশোধন।
হিতো ২৯:১৫ ‘সংশোধনের কথা ও শাসনের লাঠি জ্ঞান দান করে, কিন্তু যে ছেলেকে শাসন করা হয় না সে তার মাকে লজ্জা দেয়।’
- ‘সংশোধনের কথা ও শাসনের লাঠি’ তার মানে কি? ‘লাঠি’ মানে ফলাফল বাস্তবায়ন ভোগ করতে হয়, ‘সংশোধনের কথা’ মানে শাসনের কারণ পরিষ্কারভাবে বুঝাতে হয়। একটি সন্তান প্রজ্ঞায় বেড়ে উঠে গেলে উভয়ই প্রয়োজন।
- এমন একটি সন্তান যে কোনো রকম শিক্ষা বা শাসন না পায়, বাস্তব অর্থে সে হল অবহেলিত সন্তান। যে মনোযোগ, যে সময়, যে যত্ন তাকে দেওয়া উচিত ছিল, তা তাকে দেওয়া হচ্ছে না। একটি সন্তানকে নিজের ইচ্ছায় চলতে দেওয়া (‘যা চায় তাই করুক!’), তা হল তার প্রতি অযত্ন ও অবহেলা করা।
হিতোপদেশ পুস্তকের সঠিক ব্যাখ্যা
- হিতোপদেশ হল ব্যবহারিক প্রজ্ঞা বা দৈনন্দিন জীবনের বিষয় লক্ষ্যগুলোর একটি সংগ্রহ।
- হিতোপদেশ আইন-কানুন পুস্তক নয় বরং তা বিবেচনা করার বিষয় দিতে ও নতুন চিন্তা সৃষ্টি করতে চায়।
- হিতোপদেশ পাঠককে নিজে চিন্তা করার স্বাধীনতা দেয়, তাকে লক্ষ্য ও মূল্যায়ন করতে এবং নিজে উপসংহারে আসতে উৎসাহিত করে।
- হিতোপদেশ পাঠকদের আদেশ দেয় না বরং তাদের যুক্তি দিয়ে রাজী করতে বা শেখাতে চেষ্টা করে। উদ্দেশ্য এই নয় যে পাঠকেরা কথা অন্ধভাবে গ্রহণ করে বরং যেন তারা সেই বিষয় নিয়ে চিন্তা ও যুক্তি-তর্ক করে, বাস্তবতা লক্ষ্য করে নিজের একটি সারাংশে আসে।
- ঐতিহ্যগুলো যে সব সময় ভাল ও পালন করার যোগ্য, তা নয়। বরং যে ঐতিহ্য আমাদের উপযুক্ত ও ফলবান জীবন করতে শেখায় সেই ধরণের ঐতিহ্যগুলো মূল্যবান। যীশুও তা দেখান যখন তিনি বিশ্রামবারের কিছু ঐতিহ্য বা নিয়মগুলো অমান্য করে বলেন বিশ্রাম বারের আসল বিষয় কি: তা দেওয়া হয়েছিল মানুষেরই জন্য (মার্ক ২:২৭)।
বিদ্রোহী কিশোরের বিষয়ে আইন দ্বিতীয় বিবরণ ২১:১৮-২১
- আইনটি অনেক কঠোর বোধ হতে পারে। কিন্তু আসলে আইনটির একটি বড় প্রয়োগ হল: বাবা-মায়ের শাসন করার অধিকার ও হিংস্রতাকে সীমাবদ্ধ রাখা:
- একটি সন্তানকে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া বা মেরে ফেলার অধিকার বাবা-মাকে দেওয়া হয় নি। তা হল সরকারের দায়িত্ব, সন্তান যতই দুষ্ট হোক না কেন।
- আবারও বাবার একা সন্তানকে বিচার করার বা মেরে ফেলার অনুমতি নেই, মায়েরও রাজী হতে হবে ও তা প্রাচীনদের কাছে সমর্পিত করতে হবে, নিজের হাতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া নিষেধ। আরো বিস্তারিত শিক্ষার জন্য ‘পরিবার ০৮ বিদ্রোহী কিশোর’ দেখুন।
- আধুনিক প্রয়োগ: honor killings নিষিদ্ধ! একটি সন্তান যদি তার ব্যবহার দ্বারা পরিবারের উপর লজ্জা নিয়ে এসেছে (অথবা পরিবার তা মনে করে) তবে পরিবারের সন্তানকে মেরে ফেলার অধিকার নেই (উদাহরণ: অনৈতিকতা, প্রেমের কারণে বিবাহ, ধর্মান্তর)।
উদাহরণ: ১ শমূয়েল ২:২২-২৪ এলির ছেলেরা: শাসন নেই
উদাহরণ: ১ রাজা ১৫:৫-৬ দায়ূদের ছেলে আদোনিয়ার বিষয়ে সংশোধন নেই
‘এলি তখন খুব বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। ইস্রায়েলীয়দের প্রতি তাঁর ছেলেদের সমস্ত ব্যবহারের কথা এবং যে সব স্ত্রীলোকেরা সেবা-কাজের জন্য মিলন-তাম্বুর দরজার কাছে আসত তাদের সংগে তাদের ব্যভিচারের কথা তাঁর কানে গেল। ২৩ তিনি তাদের বললেন, ‘তোমরা এ কি করছ? তোমাদের খারাপ কাজের কথা আমি এই সব লোকদের কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছি।’
- এলি তার ছেলেদের কথা দিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন, কিন্তু তা অনেক দেরী করে করেন (ইতিমধ্যে তারা প্রাপ্ত বয়সের), কিন্তু তাদের আচরণে তিনি কোনো সীমানা বা নিয়ম ভাঙ্গার ফলাফল স্থাপন করেন না।
- এলি মাত্র বাবা হিসাবে কিন্তু মহাপুরোহিত হিসাবে তাদের নেতা এবং তার দায়িত্ব ছিল নিশ্চিত করা যে তারা এই ধরণের ব্যবহার না করে, বা করলে তাদের ফলাফল ভোগ করতে হবে। কিন্তু তিনি তা করেন নি এবং ফলে ছেলেদের ব্যবহারের কোনো পরিবর্তন হয় নি।
‘দায়ূদের…ছেলে আদোনিয় বড়াই করে বলতে লাগল, ‘আমিই রাজা হব।’ …৬ তার বাবা কোন কাজে তাকে কখনও বাধা দেন নি, বলেন নি, ‘কেন তুমি এই কাজ করেছ?’ সে অবশালোমের মত দেখতে সুন্দর ছিল।’
- দায়ূদ তার ছেলেকে কথাও বলেন না, বাধাও দেন না, কোনো আচরণের ফলাফলও স্থাপন করেন না।
সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে নতুন নিয়মের কথা: মারার নয় বরং শিষ্যত্বের আদেশ
- অনেক বিশ্বাসীরা মনে করে যে বাইবেল এই শিক্ষা দেয় যে সন্তানদের অবশ্যই ‘গায়ে হাত দিয়ে মারতে’ হবে। ‘শারীরিক মার দেওয়া’ বা ‘পিটুনি দেওয়ার’ আদেশ কি বাইবেলে আছে? এখানে বিভিন্ন ব্যবহৃত শব্দের একটি অধ্যয়ন দেওয়া হল:
- নতুন নিয়মের এমন কোনো পদ নেই যাতে সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে ‘শাস্তি’ শব্দ ব্যবহার করা হয়।
- যেখানে নতুন নিয়ম সন্তানদের শাসন করার বিষয়ে কথা বলে যেখানে ‘শাস্তি’ নয় বরং গ্রীক শব্দ ‘পাদায়া’ (G3809 ‘paideia’) অথবা গ্রীক শব্দ ‘পাদায়াইন’ (G3811 ‘padeuein’) ব্যবহৃত। এই শব্দের অর্থ এই: শিক্ষা দেওয়া, প্রশিক্ষণ দেওয়া, দিক-নির্দেশনা দেওয়া, শিষ্যত্ব দেওয়া, শাসন করা, সংশোধন করা এবং বৃদ্ধি করানো।
- কোথায় ব্যবহৃত: যীশুকে যখন চাবুক দেওয়া হয় (লূক ২৩:১৬, ২৩:২২), মোশিকে যখন শিক্ষা দেওয়া হয় (প্রেরিত ৭:২২), পৌল যখন গমলীয়েলের অধীনের পড়াশুনা করেন (প্রেরিত ২২:৩), ঈশ্বর যখন বিশ্বাসীদের সংশোধন করেন (১ করি ১১:২২, ২ করি ৬:৯, ১ তীম ১:২০, ২ তীম ২:২৫, ইব্রীয় ১২:৫,৭,৮,১১) এবং ঈশ্বরের বাক্য যে কাজ করে, তার বর্ণনায় (২ তীম ৩:১৬)। বুঝা যায় যে শব্দটির ব্যবহার ‘পিটুনি’ হতে পারে কিন্তু তার অনুবাদ ‘শিক্ষা দান’ও হতে পারে।
- শব্দটি মাত্র ইফি ৬:৪ পদে সন্তানদের শাসন করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত: ‘তোমরা যারা বাবা, তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়েদের বিরক্ত করে তুলো না, বরং প্রভুর শাসন (paideia)ও শিক্ষায় (nouthesia) তাদের মানুষ করে তোল।’
- নতুন নিয়মে অন্য সে পদগুলোতে সন্তানদের শাসন করার বিষয়ে কথা বলে সেখানে গ্রীক শব্দ ‘নৌথেসিয়া’ (G3559 ‘nouthesia’) ব্যবহৃত, যার অর্থ হল: মনোযোগ আকৃষ্ট করা, উপদেশ, ধমক বা সাবধাণবাণী দান।
- এই শব্দ নতুন নিয়মে কিভাবে ব্যবহৃত? ১ করি ১০:১১ পদে একজন বিশ্বাসী সম্বন্ধে, তীত ৩:১০ পদে একজন ভ্রান্ত শিক্ষক সম্বন্ধে, ইফি ৬:৪ সন্তানকে শাসন করার ক্ষেত্রে।
- কেবলমাত্র এক বার নতুন নিয়মের একটি শব্দ দেওয়া আছে যার অর্থ ‘শারীরিক শাস্তি’: ‘মাস্তীগো’ ইব্রীয় ১২:৬ পদে (G3146 ‘mastigoo’)। শব্দের অর্থ হল: মার দেওয়া, চাবুক দেওয়া, কশানো। কিন্তু এই পদে শব্দটি রূপকভাবে ব্যবহৃত:
- ইব্রীয় ১২:৪-১১ পদগুলো সন্তানকে শাসন করার বিষয়ে কথা বলে না বরং প্রত্যেক বিশ্বাসীকে পাপের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, এবং ঈশ্বরের সংশোধন (‘মাস্তীগো’) গ্রহণ করা হল প্রজ্ঞার কাজ, সেই বিষয়েই বলে।
- ‘মাস্তীগো’ শব্দ নতুন নিয়মে আর ৭ বার উল্লিখিত, অথবা যীশুর যন্ত্রণার বিষয়ে (মথি ২০:১৯, মার্ক ১০:৩৪, লূক ১৮:৩৩, যোহন ১৯:১) অথবা বিশ্বাসীদের অত্যাচারের বিষয়ে (মথি ১০:১৭, ২৩:৩৪)।
- সারাংশ: নতুন নিয়মে যত শব্দ সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত, একটারও আবশ্যক অর্থ নয়: ‘মার দাও!’ কিন্তু নতুন নিয়মে যা বুঝানো হয় তা হল সংশোধন হিসাবে অবশ্যই কিছু করা দরকার।
সন্তানদের কিভাবে শাসন করব?
সন্তানের শাসন করার ক্ষেত্রে শারীরিক শাসন (মারা) কি আবশ্যক? দেওয়া উচিত? দেওয়া অনুমোদিত?
- বাইবেলে ৪টি পদে ‘লাঠি’ উল্লিখিত (হিতো ১৩:২৪, ২২:১৫, ২৩:২৩-২৪, ২৯:১৫)।
- সন্তানকে লাঠি দিয়ে মারতে হয়, আসলে তার আদেশ হিতোপদেশে নেই, কিন্তু তা অবশ্যই অনুমোদিত।
- শারীরিক শাস্তি কি প্রয়োজন? অন্য কিছু কার্যকারী না হলে ‘শেষ সমাধান’ হিসাবে শারীরিক শাস্তি দেব? একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত শারীরিক শাস্তি অনুমোদিত কিন্তু পরে আর না? তাই যদি হয়, কোন বয়স পর্যন্ত অনুমোদিত? এই দেশে সন্তানদের শারীরিক শাস্তি কি নিষিদ্ধ বা আইনগতভাবে তা অনুমোদিত?
- শারীরিক শাস্তি যদি আবশ্যক, তবে কিভাবে তা করা উচিত? হাত দিয়ে মার? লাঠি দিয়ে মার? চাবুক দিয়ে মার? উলঙ্গ চামড়ায়? কাপড় পড়া অবস্থায়? পাছায়? পিঠে? মাথায়?
- কত পরিমাণে মার দেব? দিনে কত বার মার দেওয়া যায়? প্রয়োজন পড়লে দিনে কয়েক বার? কোন সময় প্রয়োজন? যত বার সন্তান ভুল করে? না খুব কম?
- সন্তানের কি ব্যবহার ‘মার দেওয়ার যোগ্য অপরাধ’? কিছুতে যদি সে একমত না হয়? না মাত্র বার বার জেদ করার পরে?
- কাকে মার দেওয়া উচিত? সব সন্তানদের? ছেলেদের ও মেয়েদের? কোন বয়স পর্যন্ত?
- আসলে বাইবেলের প্রধান নীতি ‘মার দিতেই হয়’, তা না, বরং: শাসন প্রয়োজন, খারাপ ব্যবহারের ফলাফল থাকা দরকার তা যেন সন্তান শেখে।
দেশের আইন কি বলে?

বেশ কয়েকটি দেশে ছেলে-মেয়েদের মারা এখন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, এমন কি বাবা-মায়েরও সন্তানদের মারার আর অধিকার নেই। অনেক দেশে বাবা-মায়ের সন্তানকে মার দেওয়া নিষিদ্ধ না, কিন্তু স্কুলে, কিন্ডারগার্ডেনে, ডে-ক্যায়ারে, হোস্টেলে বা এতিমখানায় তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং যারা তা করে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়।
নীল রং = স্কুলে ইত্যাদি নিষিদ্ধ।
লাল রং = স্কুলে ইত্যাদি অনুমোদিত।
সবুজ রং = পরিবারে এবং স্কুলে নিষিদ্ধ।

ছেলে-মেয়েদের মানবীয় অধিকারের বিষয়ে জাতিসংগের ঘোষণা (UN Committee: Rights of the Child)
- সংজ্ঞা: ‘যে কোনো ধরণের শাস্তি যেখানে ব্যাথা বা অস্বস্তি বিস্তার করার জন্য (যত হাল্কা হোক) শারীরিক শক্তি ব্যবহৃত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।’
শারীরিক শাস্তির বিভিন্ন ধরণ:
- পারিবারিক বা সংসারিক শাস্তি: পরিবার বা সংসারের মধ্যে শাস্তি, সাধারণত বাবা-মা বা গার্ডিয়ানদের দ্বারা বিস্তারিত শাস্তি।
- স্কুলে শারীরিক শাস্তি: স্কুল, কিন্ডারগার্ডেন, ডে-ক্যায়ার, এতিমখানায়, কলকারখানায় বা এ্যা-প্রেন্টিসসিপে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষক, অধ্যক্ষ, ওয়ার্ডেন, প্রধান, মিস্ত্রী বা নিয়োগকর্তাদের দ্বারা বিস্তারিত শাস্তি।
- বিচারসংক্রান্ত শারীরিক শাস্তি: আদালতে রায় অনুসারে শাস্তির একটি অংশ যদি শারীরিক শাস্তি হয়। অথবা ওয়ার্ডেন বা কারাগারের কর্মীদের দ্বারা বন্দিদের রায় অনুসারে বা শৃঙ্খলার জন্য শারীরিক শাস্তি।
- মানচিত্র: এমন দেশ যাতে সরকারের অধিকার আছে শারীরিক শাস্তি দিতে বেগুনী রঙে দেওয়া।

ছেলে-মেয়েদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের আইন:
বাসায় | স্কুলে | সরকার (বিচার বিভাগ) | অন্যান্য ছেলে–মেয়েদের দেখাশোনা কারী প্রতিষ্ঠান | ||
রায় হিসাবে শারীরিক শাস্তি | শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য শারীরিক শাস্তি | ||||
নিষিদ্ধ | ৪৪ | ১১৭ | ১৫৫ | ১১৬ | ৩৮ |
অনুমোদিত | ১৫৪ | ৮১ | ৪২ | ৭৮ | ১৬০ |
তথ্য নেই | – | – | ১ | ৪ | – |
শাস্তির বিষয়ে কিছু চিন্তা
শাস্তি মানে কি? শাস্তির উদ্দেশ্য বা ভূমিকা কি?
যদি বাবা-মা শাস্তি দেন তবে তাদের পরিষ্কার চিন্তা থাকা উচিত শাস্তি আসলে কি এবং শাস্তির উদ্দেশ্য কি।
- প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া সহজ না এবং অধিকাংশ বাবা-মা একবারও তা নিয়ে চিন্তা করেন না। শাস্তির মধ্যে কি কি বিষয় আছে?
প্রতিফল ও প্রতিশোধ (Retribution, Revenge)
- একজনের বিরুদ্ধে যদি অন্যায় করা হয়, তার প্রতিফল বা প্রতিশোধ চাওয়া হল স্বাভাবিক বিষয়। বাইবেলে আইন ‘চোখের বদলে চোখ’ (যাকে বলা হয় ‘lex talionis’, যাত্রা ২১:২৫, দ্বিতীয় বিবরণ ১৯:২১) এই প্রতিশোধ দাবী সীমিত থাকা নিশ্চিত করে: ক্ষতির প্রতিশোধ পরিমাণে সীমাবদ্ধ হতে হবে।
ন্যায্যতা পুনরায় স্থাপন করা (Re-establishing Justice)
- একজন অপরাধীকে কারাগারে রাখলে তার অন্যায় অবশ্যই বাতিল করতে পারে না কিন্তু তাকে স্বাধীনতা হারাতে হয় একটি ন্যায্যতার ভাব তৈরি করে। আক্রমণকারী অন্যদের কষ্টের ও ক্ষতির কারণ হল, এখন তার কষ্ট ও ক্ষতি উপলব্দি করতে হয়।
ক্ষতিপূরণ (Reparation, restitution, compensation)
- দোষী যত ক্ষতি ঘটিয়েছে ও তার ফলে ভবিষ্যতে আরো কত ক্ষতি হবে, তার জন্য দায়িত্ব নিয়ে আর্থিক প্রতিশোধ করতে হবে। উদাহরণ: যাত্রা ২১:৩৩।
প্রায়শ্চিত্ত ও পুনর্বাসন (Atonement, rehabilitation)
- উদ্দেশ্য হল দোষীর দোষ মুছে ফেলা এবং তার সম্মান ও মর্যাদা পুনরায় স্থাপন করা। প্রায়শ্চিতের প্রক্রিয়ায় বাধ্য হওয়ার পরে ব্যক্তি আবার দোষ মুক্ত হতে পারে।
প্রতিরোধ, অন্তরায় (Prevention, deterrence)
- শাস্তির উদ্দেশ্য হল নিশ্চিত করা যে দোষী আর একবার একই অপরাধ করেন না। তা ছাড়া সবাই তার শাস্তি সম্বন্ধে জেনে একই অপরাধ করতে নিরুৎসাহিত হবে।
অন্য মানুষদের সুরক্ষা করা (Protection of society)
- সাধারণত এর অর্থ হল বহুদিনের বন্ধন নিশ্চিত করার জন্য অপরাধী ভবিষ্যতে একই অন্যায় আরো লোকদের বিরুদ্ধে করতে না পারে, মোট কথা যেন সমাজ সুরক্ষা পায়। উদাহরণ: বার বার ধর্ষণ।
মানদন্ড নিশ্চিত করা বা মূল্যবোধ সুরক্ষা করা (Enforce standards, protect values)
- অপরাধের শাস্তি দেওয়া দ্বারা দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও ন্যায্যতার মানদন্ড বিস্তার করা হয় এবং আইনে প্রকাশিত মূল্যবোধগুলো রক্ষা করা হয়।
সরকারের ক্ষেত্রে বা পরিবারের ক্ষেত্রে শাস্তির বিষয়ে পার্থক্য
সরকার: অপরাধীকে বিচার ও শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব দেশের বিচার বিভাগের, পরিবারের নয়, অন্যান্য নাগরিকদেরও নয়। আগের যুগে এবং আজ পর্যন্ত কিছু দেশে শাস্তি দেওয়ার অধিকার আছে স্বামীদের (স্ত্রীদের উপর) এবং বাবা-মায়ের (সন্তানদের উপর)। কিন্তু যত সময় এগিয়ে যায়, তা নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, স্বামীর অধিকার ইতিমধ্যে খুব সীমিত হয়ে গেছে, বাবা-মায়ের অধিকার আস্তে আস্তে সীমিত করা হচ্ছে।
পরিবার: ভিত্তিকভাবে বাবা-মাকে সন্তানদের উপরে অধিকার দেওয়া হয়েছে। তাই বাবা-মায়ের আরো সাবধান থাকতে হয় যেন তারা এক এক দিন এক এক রকম ধরণের বিচার বা নিজে-কেন্দ্রিক বিচার না করে। ছেলে-মেয়েদের মনোভাব ও আচরণের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভুল বিচার থেকে তাদেরকে রক্ষা করার কেউ নেই।
সরকার: নীতি হল: আইন ছাড়া কাউকে বিচার করা যায় না। আইনে পরিষ্কার লেখা থাকতে হয় কি করা নিষিদ্ধ এবং কি করা অনুমোদিত। আইন ভাঙ্গার কারণে শাস্তি হতে হয় আইন অনুসারে ঠিক করা বিষয়।
পরিবার: পরিবারের মধ্যে একসাথে সব নিয়ম ঠিক করতে হয়, এবং ভাল হয় যদি নিয়ম ভাঙ্গার ফলাফলও একসাথে ঠিক করা হয়। এভাবে করলে একটি জানা মাণদণ্ড থাকে, বাবা-মাকে বিরক্তের মুহূর্তে শাস্তি ঠিক করা প্রয়োজন হবে না, তাই ‘এ্ক এক দিন এক এক রকম’ শাস্তি বা নিজে-কেন্দ্রিক শাস্তি কম হবে।
সরকার: অপরাধের মহত্ব অনুসারে শাস্তির পরিমাপ ঠিক করতে হবে। অপরাধের সময়ে অপরাধীর অবস্থা ও উদ্দেশ্য বিবেচনা করতে হবে। ‘চোখের বদলে চোখ’ সে আইন অতিরিক্ত শাস্তির প্রতিরোধ করে।
পরিবার: এখানেও অপরাধের ও শাস্তির পরিমাপ মিলানো দরকার। কিন্তু তা অনেক বার নাও হতে পারে, কারণ প্রায়ই বাবা-মা রাগের বশে শাস্তি দেন অথবা যে ব্যবহারে গতকাল শাস্তি দেন নি, আজকে সে ব্যবহারে শাস্তি দিচ্ছেন। শাস্তি এমনভাবে দিতে হয় যা সন্তানের সম্মান ও মূল্য রক্ষা করা হয়। অপরাধ করার সময়ে সন্তানের অবস্থা ও উদ্দেশ্য কি ছিল তা বিবেচনা করতে হবে।
সরকার: দোষী হতে পারে কেবলমাত্র এমন ব্যক্তি যার বিবেক, বিচার-বুদ্ধি ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে। তাই ১৪ বছর বয়সের চেয়ে ছোটদের দোষী হিসাবে ধরা হয় না। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সের যুবক-যুবতীদের দোষ এক পরিমাণ পর্যন্ত। যদি একজন তার সিদ্ধান্তের ও কাজের ফল অত্যন্ত বুঝতে না পারে তবে সে দোষী নয়।
পরিবার: অনেক বার বাবা-মা সন্তানদের থেকে অতিরিক্ত দাবী করেন। তারা সন্তানদের কেবলমাত্র আইন ভাঙ্গার জন্য দোষ ধরেন না, তারা জ্ঞানের অভাব, অনুপযুক্ততা, অবিচক্ষণতা, শেখার অসুবিধা, তালন্তের অভাব ও অনিচ্ছাকৃত আচরণের জন্যও দোষ ধরেন। অধিকাংশ সন্তানদের সবচেয়ে বেশি মারা হয় যখন তাদের বয়স ২ বছরও হয় নি, তাই এমন একটি সময়ে যখন তাদের বুঝার ক্ষমতা খুব সীমিত।
অনেকবার সন্তানদের শারীরিক শাস্তি দেওয়ার অনেক অনুপযুক্ত কারণও আছে:
- বাবা-মা বিরক্ত বা রাগের বশে ও বিরক্ত বা রাগ কমানোর জন্য শারীরিক শাস্তি দেন। তাই তা নিয়ম, আগে ঠিক করা নির্দেশনা বা আসল উদ্দেশ্য অনুসারে নয় বরং প্রতিশোধ নেওয়ার কারণে। পরে অনেক বাবা-মায়ের খুব লজ্জা লাগে বা তারা চেতনা পান।
- অনেক বার ক্লান্তিতে, অধিক চাপে, অক্ষম ভাবে, ‘জানি না কি করব’ ভেবে বাবা-মা সন্তানকে শারীরিক শাস্তি দেন। পরে অনেক বাবা-মায়ের খুব লজ্জা লাগে বা তারা চেতনা পান।
- এর চেয়ে ভাল পদ্ধতি বা কৌশল জানে না তাই শারীরিক শাস্তি দেন।
- বাবা-মা শাস্তিকে তুলনামূলকভাবে কার্যকারী ও সহজ মনে করে। শারীরিক শাস্তি দ্বারা তারা সন্তানের মুহূর্তের বাধ্যতা নিশ্চিত করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘদিন দেখলে এভাবে শাস্তি দেওয়া কার্যকর নয়। বরং সন্তান ‘শক্ত’ হয়ে যায়, তার ভয় ও বাধ্যতা কমায়, তার মধ্যে বিদ্রোহের ভাব বাড়ে। অথবা সন্তান অতি-বাধ্য হয়ে যায়, যেখানে শাস্তি এড়িয়ে যাওয়া একটি কৌশল মাত্র হয়ে যায়।
শারীরিক শাস্তি কেন অনেক বার সমস্যা হিসাবে দাঁড়ায়
- অনেক বার শাস্তির মাপ ও শাস্তির ধরণ সন্তানের ভুল ব্যবহার অনুসারে নয়, বরং ‘সে দিনে বাবা-মায়ের অবস্থা কেমন’ (বিরক্ত? ক্লান্ত? অধৈর্য্য? খেয়াল নেই?)। তা এক ধরণের অন্যায্যতা হিসাবে দাঁড়ায় (‘গতকাল একই কাজে শাস্তি পাই নি, কিন্তু আজকে মার খাই’)। শাস্তির উদ্দেশ্য সব সময় হতে হয় সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ, বাবা-মায়ের জন্য সুবিধা না।
- ঝগড়া বা মারামারি বন্ধ করার জন্য যদি বাবা-মা শারীরিক শাস্তি কৌশল হিসাবে ব্যবহার করেন, তবে তা আসলে ভুল ছবি প্রকাশ করে: মার দিয়ে মারামারি বন্ধ করতে চাই…যার ক্ষমতা বেশি, সে ঠিক বলেছে। যে লোকেরা ছোটবেলায় বেশি মার খেয়েছে, পরে তাদেরই সন্তানদেরও অতিরিক্ত মার দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এর একটি কারণ হল যে তারা কোনো আদর্শ পায় নি কিভাবে শারীরিক শাস্তি ছাড়া সীমানা রক্ষা করা যায়। আবারও, যে সন্তানেরা বেশি শারীরিক শাস্তি পায়, সে সন্তানের অন্য বাচ্চাদের মার দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
- শারীরিক শাস্তিতে অনেক বার যে ব্যবহার আমি নিরুৎসাহিত করতে চাই, সে ব্যবহার দেখাই: ‘তোমার ভাইকে মারলে আমি তোরে মারব!’ অথবা ‘তোমার বোনের প্রতি ভাল ব্যবহার না করলে তোমাকে কষ্ট দেব!’। আসলে হিংস্রতা হিংস্রতাকে কি প্রতিরোধ করতে পারে?
- অনেক বার শারীরিক শাস্তিতে পরে বাবা-মায়ের পরে খারাপ লাগে (চেতনা) এবং সন্তান এই সারাংশে আসে: ‘হতে পারে আমি মন্দ’। অনেক বার শারীরিক শাস্তি সন্তানের শুধুমাত্র ব্যাথা লাগে না, অসম্মান ও পরাজয়ও লাগে, তাই যদিও বাবা-মা মাত্র এক বিষয়ে সংশোধন করতে চেয়েছিলেন, সন্তান তা নিজের ব্যক্তির অগ্রাহ্য হিসাবে বুঝে।
- একটি বেশি অবহেলিত সন্তান মাঝের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে শাস্তি যোগ্য অপরাধ করে, কারণ শাস্তি পেলে তবে কম পক্ষে বাবা-মা মনোযোগী ও ‘তাকে নিয়ে ব্যস্ত’। এই ধরণের একটি সন্তান অনেক বার অবহেলার চেয়ে শাস্তি মেনে নিতে রাজি।
- যারা বলে যে শারীরিক শাস্তি দেওয়া উচিত, তাদের কম পক্ষে একটি পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত, কোন সময় এবং কিভাবে তারা শারীরিক শাস্তি দেওয়া বন্ধ করবে। অধিকাংশ লোক বলে: যুবক-যুবতী বয়সে শারীরিক শাস্তি আর ব্যবহার করা উচিত নয়। শারীরিক শাস্তি ব্যবহার করতে থাকার চেয়ে তা অবশ্যই ভাল, কিন্ত এই নিয়মেরও কোনো শক্তিশালী ভিত্তি নেই।
- অতি কোঠর ও এক এক দিন এক এক রকম ধরণের শাস্তিগুলো একটি সন্তানের ব্যক্তিত্ব ও স্বভাব-চরিত্রকে ভাঙ্গতে পারে, এতে সে ভীত হয়ে যায়, এবং তার ইচ্ছা শক্তি আর থাকে না। সে ‘এমনি বাধ্য’ বা ‘অতি বাধ্য’ হয়ে যায়, যার কারণে ভবিষ্যতেও তাকে সহজেই ভুল কাজে বাধ্য করা যায়। সন্তানের আত্ম-পরিচালনা, সন্তানের ‘না’ বলার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় না। অথবা সন্তান নিস্ক্রিয় বিদ্রোহ ধরণের ব্যবহার করে এবং বাবা-মাকে আর কাছে আসতে দেয় না।
- শারীরিক শাস্তি সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উপর চাপ দেয়। তাই অনেক পরামর্শদাতা বলে যে শাস্তির পরে সন্তানকে আলিঙ্গন করা উচিত। কিন্তু তা করা (এবং সন্তানের তা মেনে নেওয়া) সহজ নয়।
আবারও: নতুন নিয়মের সন্তানদের শাসনের ক্ষেত্রে শিক্ষা
যীশু এবং ছেলে-মেয়ে
- যীশুর যুগে লোকেরা ছেলে-মেয়েদের সমাজের সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখত।
- ছেলে-মেয়েরা ছিল বাবা-মায়ের অধীনে: সন্তানের উপরে বাবার অধিকারের কোনো সীমানা ছিল না (শাসন করার ক্ষেত্রে হোক বা শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে হোক)।
- যখন যীশু ১২ বছর বয়সে আত্মিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন, তিনি এক ধরণের সম্মান ও গুরুত্ব পান (লূক ২:৪৭) কিন্তু তা ছিল ব্যতিক্রম।
- মথি ১৯:১৩-১৫, মার্ক ১০:১৩-১৬ ও লূক ১৮:১৫-১৭ পদে লেখা আছে যে যীশু ছেলে-মেয়েদের আশীর্বাদ করতেন এবং তাদেরকে বয়স্ক লোক, এমন কি নেতাদের চেয়েও গুরুত্ব দিতেন।
- এই ব্যবহার দ্বারা যীশু সাধারণ সাংস্কৃতিক আদব-কায়দা ও নিয়মগুলি ভাঙ্গতেন: তিনি আত্মিক নেতাদের (ফরীশী) মনোযোগ না দিয়ে বরং মা ও তাদের সন্তানদের গুরুত্ব দিতেন। এইটা মাত্র এক ব্যাপারে যেখানে যীশু সাংস্কৃতিক নিয়ম ভাঙ্গে, তিনি তা আর অনেক ক্ষেত্রে ভাঙ্গেন।
- শিষ্যদের প্রতিক্রিয়া হল সাংস্কৃতিক নিয়ম অনুসারে: তারা মায়েদের ধমক দেন। যীশু কিন্তু তাদেরই ধমক দেন তা করার জন্য এবং তিনি নিশ্চিত করেন যেন মায়েরা ও সন্তানেরা তার কাছে আসতে পারে। এই ব্যবহার দ্বারা যীশু ছেলে-মেয়ে ও প্রাপ্ত বয়সের লোকদের একই স্তরে রাখেন।
- মথি ১৮:১-৫ ‘সেই সময়ে শিষ্যেরা যীশুর কাছে এসে বললেন, ‘স্বর্গ-রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় কে?’ ২ তখন যীশু একটা শিশুকে ডেকে তাঁদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে বললেন, ৩ ‘আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, যদি তোমরা মন ফিরিয়ে শিশুদের মত না হও তবে কোনমতেই স্বর্গ-রাজ্যে ঢুকতে পারবে না। ৪ যে কেউ এই শিশুর মত নিজেকে নম্র করে সে-ই স্বর্গ-রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড়। ৫ আর যে কেউ এর মত কোন শিশুকে আমার নামে গ্রহণ করে সে আমাকেই গ্রহণ করে।.
- শিষ্যরা যখন রাজ্যে পদ ও মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন করেন, যীশু তখন তাঁর রাজ্যে কে ঢুকবে, তা নিয়ে উত্তর দেন। শিষ্যরা পদ পাওয়ার জন্য ‘রাজনৈতিক লড়াই’ করেন, যীশু তাদের সাবধানবাণী দেন যে মাত্র বাচ্চার মত নম্রতা থাকলে তাদের রাজ্যে প্রবেশ দেওয়া হবে।
- যীশু একটি বাচ্চাকে আদর্শ হিসাবে দেখান ও তার মত হতে বলেন। তিনি ছেলে-মেয়েদের সে গুণ ও মনোভাবকে প্রশংসিত করেন: নম্রতা (উল্লিখিত), কিন্তু সাথে যোগ দেওয়া যায় সততা, সরলতা, কৌতুহল, বিশ্বাস, নির্ভরতা, ইত্যাদি।
- যীশু নিজেকে ছেলে-মেয়েদের পাশে রাখেন: একটি বাচ্চাকে গ্রহণ করা মানেই যীশুকে গ্রহণ করা। যে ব্যবহার আমি একটি বাচ্চাকে দেখাই, সে ব্যবহার আমি আসলে যীশুর প্রতি করি।
- যীশু তাই বিভিন্ন মানুষের প্রতি ভালবাসা ও গুরুত্ব দানের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য করেন না।
- যীশু ছেলে-মেয়েদের সুস্থ করেন (মার্ক ৫:৪১, ৭:৩০, ৯:৫, যোহন ৪:৪৯)
- যীশু ৫’০০০ লোকদের খাওয়ানোর জন্য একটি ছেলের খাবারের দান ব্যবহার করেন (যোহন ৬:৯)।
- যীশু বড় নীতি হিসাবে মথি ৭:১২ পদে এই আদেশ দেন: ‘তোমরা অন্য লোকদের কাছ থেকে যে রকম ব্যবহার পেতে চাও তোমরাও তাদের সংগে সেই রকম ব্যবহার কোরো। এটাই হল মোশির আইন-কানুন ও নবীদের শিক্ষার মূল কথা’। এই নীতি অবশ্যই সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
- যীশুর মহান আর একটি আদেশ (মথি ২২:৩৯) সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য: ‘তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত ভালবাসবে’। আমার সন্তানও আমার প্রতিবেশী। আমার সন্তান খ্রীষ্টেতে আমার ভাই বা বোন। তা অনুসারে তার প্রতি ভাল ব্যবহার করা আবশ্যক। সন্তানদের বিষয়েও বাবা-মায়ের কাছে প্রথম আদেশ হল: ভালবাসা।
- যদিও যীশু সরাসরি সন্তানদের মানুষ করার বিষয়ে শিক্ষা বা আদেশ দেন না, তার ব্যবহার এই ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে: সম্মান দেখানো, গুরুত্ব দেওয়া, মূল্য দেওয়া, অনুমোদন স্বীকার করা, সম্মান ও ভালবাসার সঙ্গে ব্যবহার করা কারণ সন্তানও ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি (আদি ১:২৭) এবং তার সম্বন্ধেও ঈশ্বর বলেন: ‘রাজমুকুট হিসাবে তুমি তাকে দান করেছ গৌরব ও সম্মান’ (গীত ৮:৫)।
- পৌল মণ্ডলীর প্রতি দিক-নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রেও একই ধরণের কথা বলেন:
বাবা-মায়ের প্রতি আদেশ
ইফিষীয় ৬:৪ সন্তানদের বিরক্ত করে তুলো না
‘তোমরা যারা বাবা, তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়েদের বিরক্ত করে তুলো না, বরং প্রভুর শাসন (paideia) ও শিক্ষায় (nouthesia) তাদের মানুষ করে তোল।’
কলসীয় ৩:২১ সন্তানদের বিরক্ত করে তুলো না
‘তোমরা যারা পিতা, তোমাদের ছেলেমেয়েদের মন তেতো করে তুলো না, যেন তারা উৎসাহহীন হয়ে না পড়ে।’
- কেন দুই বার আদেশটি নির্দিষ্টভাবে বাবাদের বলা হয়েছে, মায়েদের না? মায়েরা সন্তানদের প্রয়োজন কি আরো বেশি বুঝে? বাবাদের ক্ষমতা ভুল ব্যবহার করার প্রলোভন কি বেশি? তাদের শ্রেষ্ঠত্ব কি এভাবে ব্যবহার করার প্রলোভন বেশি?
- কেন আমরা একটি সন্তানকে বিরক্ত করে তুলি? আসলে তা আমরা অনেক বার করি। কিন্তু কেন? নিজের ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্ব এভাবে প্রমাণ করার কি মজা আছে? বাবাদের এই ক্ষমতা বা স্বাধীনতাকে ঈশ্বর সীমিত রাখেন।
- বিরক্ত করে তোলা’ এই পদে যে শব্দ ব্যবহৃত (গ্রীক: ‘parorgizo’) মানে: রাগান্বিত বা বিরক্ত করে তোলা।
- মন তেতো করে তোলা’ এই পদে যে শব্দ ব্যবহৃত (গ্রীক: ‘erethizo’) মানে: ‘উস্কিয়ে দেওয়া, বিরক্ত বা বিপর্যস্ত করে তোলা, অপমানিত করা, উত্তেজিত করে তোলা, জ্বালাতন করা।
- উৎসাহহীন’ এই পদে যে শব্দ ব্যবহৃত (গ্রীক: ‘athumeo’) মানে সাহস হারানো, নিরুৎসাহিত হওয়া, আত্মা ভাঙ্গা, নির্জীব, লাজুক বা ভীত হওয়া।
- এই ধরণের ব্যবহার পেয়ে কেন একটি সন্তানের সাহস হারিয়ে যাবে? এর কারণ তা হল কারণ ছাড়া জ্বালাতন, যাতে একটি অক্ষম ভাব সৃষ্টি হয়, কোনো ভুল না করলেও কষ্ট, যিনি আমার সুরক্ষাকারী তিনিই আমার আক্রমণকারী, আমার দুর্বলতা বা কষ্ট হল তার আনন্দের কারণ বা বিনোদন। বাবা যদি সন্তানের সীমানা পার হন তবে সন্তানের রাগ উঠে, যা একটি উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া।
- খেয়াল করুন যে সন্তানদের কাছে বাবা-মায়ের প্রতি বাধ্য হওয়ার আদেশের সাথে সাথে আসে বাবাদের কাছে আদেশ সন্তানদের বিরক্ত করে না তুলতে (ইফিষীয় ৬:১ > ৬:৪, কলসীয় ৩:২০ >৩:২১)। তাই একটি ভারসাম্য রক্ষা করা হয়।
ঈশ্বর কিভাবে ইস্রায়েলকে শাসন করেছিলেন, তা কি সন্তানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?
- ঈশ্বর কিভাবে ইস্রায়েল জাতিকে শাসন করেছিলেন, অনেক পরামর্শদাতা তা থেকে সন্তানদের মানুষ করার নিয়ম তোলেন।
- যদিও ভিত্তিক কিছু চিন্তা এভাবে নেওয়া যায়, সাবধান থাকা দরকার:
- ইস্রায়েল জাতি ছিল প্রাপ্ত বয়সদের একটি সমাজ, যাদের জ্ঞান, বিচার বুদ্ধি, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও তাদের আচরণের জন্য দায়বদ্ধতা ছিল। তারা ভাল ও মন্দ বুঝতে পারতেন ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। তাই তারা ছিলেন দায়ী ও অপরাধ করলে দোষী।
- তারপরেও ইস্রায়েল জাতি তাদের শাস্তি বা বিচারের জন্য বেশিরভাগ ঈশ্বরের উপর দোষ চাপাত। ঈশ্বরের শাস্তিগুলির দুই ভূমিকা ছিল: ন্যায্যতা পুনরায় স্থাপন এবং শিক্ষা। ‘পাপের জন্য শাস্তি পেলে পর মানুষ কেন তা নিয়ে নালিশ করবে? ৪০ এস, আমরা আমাদের জীবন-পথের পরীক্ষা করি ও যাচাই করি এবং সদাপ্রভুর কাছে ফিরে যাই। ৪১ এস, আমরা আমাদের অন্তর ও হাত স্বর্গে ঈশ্বরের দিকে উঠাই আর বলি’ (বিলাপ ৩:৩৯-৪১)।
- কিন্তু একটি সন্তানের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন: বিশেষভাবে একটি সন্তান যখন এখনও বয়স কম, তার জ্ঞান ও বিচার বুদ্ধি কম, সে এখনও একটি আচরণের ফল সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারে না এবং তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা সীমিত।
- তাই একটি সন্তানের দোষও কম, তাই শাস্তি দেওয়ার উপযুক্ততাও কম।
- কিন্তু অনেকবার বিশেষভাবে ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে সবচেয়ে বেশি মারা হয়।
- আর এক কারণে ইস্রায়েল জাতি ও সন্তানদের এভাবে তুলনা করা বেশি ভাল না: ঈশ্বর অনেক বার বছরের পর বছর নম্রতায় ও অনেক ধৈর্য্যের সঙ্গে অপেক্ষা করার পরে শাস্তি দিয়েছেন। এইটা সহজে সন্তানদের শাসন করার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না, কারণ সন্তানদের ক্ষেত্রে শাস্তি বা ফলাফল নিয়ে দেরি করা উচিত না। আসলে: ভুল ব্যবহার থেকে শাস্তি বা ফলাফল নির্ধারণ পর্যন্ত যত দেরি হয়, তা তত কম কার্যকারী হয়।
- আর একটি কারণে ইস্রায়েল জাতি ও সন্তানের শাসন তুলনা করা সমস্যা: ঈশ্বর নিজেই বলেন যে তিনি বেশিরভাগ সময় তাঁর শাসনের প্রচেষ্টায় নিস্ফল হয়েছিলেন: ‘হে আকাশ শোন, হে পৃথিবী শোন, সদাপ্রভু বলছেন, “আমি ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করেছি ও তাদের বড় করে তুলেছি, কিন্তু তারা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। ৩ গরু তার মনিবকে চেনে, গাধাও তার মালিকের যাবপাত্র চেনে; কিন্তু ইস্রায়েল তার মনিবকে চেনে না, আমার লোকেরা আমাকে বোঝে না।(যিশাইয় ১:২-৩)
কিভাবে শারীরিক শাস্তি ছাড়া সন্তানদের শাসন করা যায়
শাস্তি দেওয়া লক্ষ্য নয়, ব্যবহার পরিবর্তনই হল লক্ষ্য
- সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে শাসনের লক্ষ্য কখনও হওয়া উচিত নয় শাস্তি দেওয়া। লক্ষ্য সব সময় হওয়া উচিত: আমি সন্তানের মধ্যে একটি স্থায়ী পরিবর্তিত ব্যবহার কিভাবে আনতে পারি। শাসনের লক্ষ্য হল ভাল, উপযুক্ত ও ন্যায্য ব্যবহার শেখানো।
- তাই যদি আমার লক্ষ্য হয়, তবে প্রশ্ন হয়ে উঠে: একটি সন্তান একটি ব্যবহারের ধরণ কিভাবে শিখে?
উদাহরণ: মা এবং তার ছেলে রানা
- চার বছরের রানা বাইরে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছে। মা জানালা দিয়ে তাকে ডেকে দুপুরের খাবারের জন্য আসতে বলেন। রানা সাড়া দেয় না বরং খেলতে থাকে। ৩ মিনিট পরে মা আর একবার ডাকে, আগের চেয়ে একটু জোরে। রানা আবারও সাড়া দেয় না বরং খেলতে থাকে। মা তৃতীয় বার ডাকে, এবার তার কণ্ঠস্বরে বিরক্তির ভাব বুঝা যায়। রানা এখনও সাড়া দেয় না। মা ৪র্থ বার তাকে ডাকে এবং এবার চিল্লিয়ে তাকে হুমকি দেন: ‘যদি তুমি এক্ষুনি না আস, আমি তোমাকে পিটুনি দেব এবং খাবারের পরে আর বাইরে যেতে দেব না!’ রানা এখনও একটু দেরী করে কিন্তু শেষে বন্ধুদের থেকে বিদায় নেয় বলে ‘মনে হয় এখন গেলে ভাল’ এবং আস্তে আস্তে বাড়ীতে ঢোকে।
- রানা কি শিখেছে? > মা প্রথম বার ডাকলে মনোযোগী না হলে চলে কারণ অমান্য হলেও কিছু ঘটে নি। ২য় বার যখন মা ডাকে, সে সময়ও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন নেই কারণ কিছু ঘটে নি। রানা আরো শিখলেন যে মা রেগে ও জোরে যদি কথা বলেন, তবে সাড়া দেওয়া ভাল, কারণ হয়তো কিছু খারাপ ফলাফল আসতেও পারে। রানা আস্তে আস্তে বাড়ীতে ঢোকে কারণ সে বেশ নিশ্চিত যে মা তার হুমকি অনুসারে করবে না।
শেখার প্রক্রিয়া (বিশেষভাবে ছোট ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে)
- রানা ভাল করে লক্ষ্য করে তার অভিজ্ঞতা থেকে শিখবে। সে শিখবে তার মায়ের কথাকে কোন সময় গুরুত্ব দিতে হবে এবং কোন সময় গুরুত্ব না দিলেও চলে। নীচে দেওয়া বিষয়গুলি তার চিন্তা প্রভাবিত করবে:
মা সে ফলাফল বা শাস্তি নির্ধারণ করেন
- যদি মায়ের কথা অমান্য করে কোনো ফলাফল বা শাস্তি না আসে তবে রানা ঠিকই শিখবে যে মায়ের কথাকে অমান্য করা যায়, মায়ের কথার গুরুত্ব নাও থাকতে পারে।
কত সময় যায় তার ব্যবহার থেকে ফলাফল বা শাস্তি আসা পর্যন্ত
- যদি ফলাফল বা শাস্তি মাত্র বেশ কিছুক্ষণ পরে আসে (সুবিধার কারণে বা যে কোনো কারণে) তবে সন্তান তার ব্যবহারের ও শাস্তির সংযোগ নাও বুঝতে পারে।
একই ব্যবহারে কি সব সময় একই ফলাফল হয়?
রানার সাড়া | মা কি ফলাফল বা শাস্তি নির্ধারণ করেন | কত সময় গেছে | সব সময় হয় না মাঝের মধ্যে হয়? | |
১ম ডাক | নেই | নেই | শূন্য | বোধ হয় সব সময় এভাবে চলে |
২য় ডাক | নেই | নেই | শূন্য | বোধ হয় সব সময় এভাবে চলে |
৩য় ডাক | নেই | নেই | শূন্য | বোধ হয় সব সময় এভাবে চলে |
৪র্থ ডাক, চিল্লানো, হুমকি | যেতে শুরু করে | হয়তো শাস্তি বা ফলাফল হবে | ঢোকার যত সময় লাগে | মাঝে মধ্যে মা যা হুমকি দিয়ে বলেছেন তা আসলে করেন |
- যদি একই ব্যবহারে একবার শাস্তি বা ফলাফল পায়, কিন্তু আর একবার পায় না (মায়ের বর্তমান ধৈর্য্য বা বিরক্তি অনুসারে), তবে সন্তান তার ব্যবহারের ও শাস্তির সংযোগ বুঝবে না। রানার সাড়া মা কি ফলাফল বা শাস্তি নির্ধারণ করেন কত সময় গেছে সব সময় হয় না মাঝের মধ্যে হয়? ১ম ডাক নেই নেই শূন্য বোধ হয় সব সময় এভাবে চলে ২য় ডাক নেই নেই শূন্য বোধ হয় সব সময় এভাবে চলে ৩য় ডাক নেই নেই শূন্য বোধ হয় সব সময় এভাবে চলে ৪র্থ ডাক, চিল্লানো, হুমকি যেতে শুরু করে হয়তো শাস্তি বা ফলাফল হবে ঢোকার যত সময় লাগে মাঝে মধ্যে মা যা হুমকি দিয়ে বলেছেন তা আসলে করেন
- রানার কাছে মায়ের যোগাযোগের মধ্যে মিল নেই, আসলে রানার সহজে এলোমেলো লাগতে পারে: মাঝে মধ্যে মা যা বলে তাই করে, কিন্তু অনেকবার তার কথার কোনো অর্থ থাকে না।
মা কিভাবে রানাকে এর চেয়ে ভাল ব্যবহার শেখাতে পারেন?
তা করতে গেলে নীচে দেওয়া বিষয়গুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে:
একটি ইতিবাচক, ঘনিষ্ট সম্পর্ক
- সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে একটি নীতি সব সময় প্রযোজ্য: ‘আগে সম্পর্ক, পরে শাসন’। একটি ইতিবাচক সম্পর্ক হল শাসনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকারী। বাবা-মায়ের নিশ্চিত করতে হয় যে তারা অনবরত সন্তানকে ইতিবাচক কথা বলেন ও আচরণ করেন: ভালবাসার প্রকাশ, ভাল ব্যবহারের জন্য প্রশংসা, মনোযোগ, তাদের কথায় গুরুত্ব দেওয়া, খেলা, মজা করা, স্পর্শ করা, আলিঙ্গন করা ইত্যাদি।
- দয়া করে খেয়াল করুন যে ঈশ্বর ১০ আজ্ঞা দেওয়ার আগেই নিজের চরিত্রের এবং ইস্রায়েলের জন্য তিনি কি করেছেন, তা নিয়ে কথা বলেন (যাত্রা ২০:২): উদ্ধারকর্তা ঈশ্বর, যত্নকারী ঈশ্বর। মাত্র পরে তিনি ১০ আজ্ঞা দেন।
- আরো চিন্তা করুন: ঈশ্বর নিজের সুবিধার জন্য মানুষকে আইন দেন না বরং মানুষের মঙ্গলের জন্য। ‘সদাপ্রভুর নির্দেশে কোন খুঁত নেই, তা মানুষকে জাগিয়ে তোলে। সদাপ্রভুর বাক্য নির্ভরযোগ্য, তা সরলমনা লোককে জ্ঞান দেয়। ৮ সদাপ্রভুর সমস্ত নিয়ম সোজা পথে চালায় আর অন্তরে দেয় আনন্দ। সদাপ্রভুর আদেশ খাঁটি, তা অন্তরকে সতেজ করে’ (গীত ১৯:৭-৮)।
যোগাযোগ
- মা রানাকে সমস্যার মাঝখানে না বরং যখন মাথা ঠাণ্ডা থাকে সে সময়ে।
- এভাবে করলে তবে যোগাযোগ বিরক্তি বা রাগ দিয়ে পরিচালিত নয়। একবার রাগ লাগে, তবে রানার ভয় লাগবে, এবং ভয় লাগলে সে বর্তমান হুমকি নিয়ে চিন্তিত, তাই মা কেন কি বলে, তা সে কম গুরুত্ব দেবে।
- আবারও: ঈশ্বর ইস্রায়েলকে ১০ আজ্ঞা দেন নি একটি দ্বন্দ্বের বা ঝামেলার সময়ে বরং যখন তিনি তাদেরকে মরুভূমিতে আলাদা করে নিয়েছেন।
- মা বিষয়টি ইতিবাচক ভাষা দিয়ে বলবেন। বলবেন না ‘যখন তোমাকে ডাকি তুমি বাইরে থাকবে না!’ বরং বলুন: ‘যখন ডাকি তুমি সাথে সাথে ভিতরে আসো! যা করা উচিত না, তার উপরে মনোযোগ না দিয়ে বরং যা করা উচিত তাতে মনোযোগ দেওয়া একটি সন্তানের জন্য সুবিধা।
- আগে মাথা ঠাণ্ডার সময়ে যোগাযোগ করার সময় মা রানাকে বলবেন, তার কথা মানলে কি হবে বা না মানলে কি হবে। তাই একটি ব্যবহারের শাস্তি বা ফলাফল আগে থেকে ঠিক করা আছে বা তা নিয়ে সবাই আগে রাজি হয়েছিল। এভাবে করলে মানে যে মায়ের রাগের মুহূর্তে উপযুক্ত শাস্তির ধরণ বা শাস্তির মাফ খুঁজে বের করতে হবে না। তা না করলে অনেক বার পরে খারাপ লাগে (‘কি যে বললাম!’) এবং ঘোষিত হুমকি পূর্ণ করা হয় না।
- তাই মা রানাকে আগে ব্যবহারের ফলাফল বলবেন, রাগের সময়ে না, চিল্লিয়ে না, হুমকির সঙ্গে না। তা না করলে রানা শিখবে যে মা যদি না চিল্লায় তার কথার কোনো গুরুত্ব নেই।
- মা রানাকে বুঝান: ‘যেমন এখন চলছে, তা ভাল না। আমি রাগী হয়ে যাই, এবং তা তোমার জন্যও ভাল না। আমি চাই যে আমরা ভিন্নভাবে চলি: যখন আমি তোমাকে সামনের বার ডাকি, তুমি সাথে সাথে আস। যদি তুমি না আস, আমি তোমাকে সাথে সাথে নিতে আসব। কারণ তাতে আমার সময়ের খরচ হয়, তোমার খাবারের পরে থালা-বাসন নিয়ে সাহায্য করতে হবে।
যা বলেছেন ঠিক তাই করেন
- যদি সামনের বার মা ঠিক তার কথা অনুসারে করেন তবে রানা শিখবেন যে তার মায়ের কথার অর্থ ও গুরুত্ব আছে, এবং তারও গুরুত্ব দিতে হবে।
- সন্তান খারাপ ব্যবহার করলে সে ঘোষিত ফলাফল বা শাস্তি অবশ্যই নির্ধারণ করতে হবে: পরে না বরং সাথে সাথে নির্ধারণ করতে হবে, মাঝের মধ্যে না বরং প্রত্যেক বারই। যদি রানা দেখতে পায় যে তার মা ঠিক তার কথা অনুসারে প্রত্যেক বারই এই আচরণ করেন তবে সে বুঝবে যে মায়ের কথার অর্থ আছে, মায়ের কথায় গুরুত্ব দিতে হবে কারণ যা বলেছেন তিনি আসলে করেন।
- হয়তো এমন কি সামনের বার থেকে তার ব্যবহার আরো ভাল হবে, অথবা সামনের বার সে পরীক্ষা করে দেখবে মা আসলে যা বলেন তা করেন কিনা। মাকে যা বলেছেন তাই অবশ্যই করতে হয়, রাগে না, কিন্তু গুরুত্বের সঙ্গে: প্রথম ডাকে যদি রানা না আসে তিনি সাথে সাথে নিতে যাবেন ও তাকে ভিতরে নিয়ে আসতে যাবেন, চিল্লানো দরকার নেই, হুমকিও দরকার নেই। যদি মা প্রত্যেকবার এভাবে করেন তবে রানা খুব তাড়াতাড়ি শিখবে।

উপযুক্ত ও ভাল ব্যবহার প্রশংসা করা
- যখন রানা বাধ্য হন, মা তাকে প্রশংসা করেন। অনেক পরিবারে সন্তানরা খারাপ কিছু করার সাথে সাথে ধমক পায়, কিন্তু ভাল কিছু করলে বেশি উৎসাহ বা প্রশংসা পায় না। কিন্তু একটি উপযুক্ত বা ভাল ব্যবহার শেখার জন্য প্রশংসা খুবই কার্যকারী। এভাবে রানা তার ভাল কাজের জন্য মায়ের ইতিবাচক মনোযোগ পায়।
- বিশেষভাবে অল্প বয়সের বাচ্চারা মায়ের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারবে না।
- তা সমস্যা নয় যতক্ষণ মা প্রত্যেক বার তার কথা অনুসারে একই ব্যবহার দেখান। তার এই ব্যবহার বাচ্চাটি ঠিকই বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারে যে নিয়মের গুরুত্ব আছে, যদিও সে হয়তো গুরুত্ব এখনও বুঝে না।
- কিন্তু সন্তানের বয়স যত বৃদ্ধি পায়, তত বাবা-মায়ের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি পরিবর্তিত হওয়ার কথা (ছবি দেখুন):
- ছোট ছেলে-মেয়ে সম্পূর্ণভাবে বাবা-মায়ের উপর নির্ভরশীল। বাবা-মা সরাসরি প্রভাব ফেলেন, সন্তানের প্রয়োজন মেটান ও ঠিক করেন একটি সন্তান কি করবেন বা না করবেন।
- যদি বাবা-মা ভাল পরিবেশ, ভাল অভ্যাস, পরিষ্কার নিয়ম ও নিয়ম ভাঙ্গার জন্য সব সময় কথা অনুসারে ফলাফল যদি থাকে তা সন্তানদের নিরাপত্তা দান করে এবং তাদের ‘শক্তিশালী শিকড় বসাতে’ সাহায্য করবে।
- কিন্তু যখন সন্তানদের বয়স বেড়ে যায়, বাবা-মায়ের নিশ্চিত করা দরকার যে সন্তান নিজেকে চালাতে ও নিজে সিদ্ধান্ত নিতে শিখে। সন্তানদের ‘ডানা’ দান করা দরকার। বাবা-মায়ের প্রভাব কমে আসতে হবে। আলোচনা, মূল্যায়ন ও চুক্তি করা আরো গুরুত্ব পাবে।
- কিন্তু যে কোনো পর্যায় খুব গুরুত্বপূর্ণ যে উভয় বাবা-মা এবং সন্তান যে ব্যবহারে রাজি হয়েছে, যে কথা দেওয়া হয়েছে, যে চুক্তি করা হয়েছে যেন তা অনুসারে চলে। যুবক-যুবতীদেরও বুঝতে হবে যে কিছু নিয়ম থেকে থাকবে এবং সেগুলি ভাঙ্গলে ফলাফল আসবে। স্বচলিত হওয়া মানে উভয় স্বাধীনতা এবং একই সময়ে দায়িত্ব।
শাস্তি ও ফলাফলের মধ্যে পার্থক্য বোঝা
- কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি ও ফলাফলের মিল আছে। একটি সন্তান হয়তো একটি ফলাফল শাস্তি মনে করতে পারে অথবা একটি শাস্তি ফলাফলও মনে করতে পারে। কিন্তু তারপরেও দুইটা বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে:
(শারীরিক) শাস্তি | (যুক্তিগত) ফলাফল |
অনেক বার ‘শাস্তির জন্যই শাস্তি‘ | সন্তানের মঙ্গল চিন্তা করে ফলাফল |
গুরুত্ব দেয় শাস্তি, শাস্তির ধরণ ও শাস্তির পরিমাপে | যা শেখা দরকার, তাতে গুরুত্ব দেয় |
অনেক বার ব্যক্তিকে নিয়ে অসন্তোষ | বিষয় বা ব্যবহারকে নিয়ে অসন্তোষ |
অনেক আবেগ | বিষয়ের উপর জোর > আবেগ কম |
সন্তান বেশি কিছু শিখে না | সন্তান আরো বেশি ও আরো কার্যকারীভাবে শেখে |
নিয়ম যে ভাঙ্গা হয়েছে, তার উপর মনোযোগ | নিয়মের অর্থ বা গুরুত্ব কি, তার উপর মনোযোগ |
বাবা–মা শক্তির বা হিংস্রতার বিস্তার দেখান | বাবা–মা বিচার–বুদ্ধির ব্যবহার দেখান |
সন্তানরাও শক্তি বা হিংস্রতার বিস্তার শেখে | তা কম হয় |
একটি অল্প বয়সের সন্তান শাস্তিগুলি মেনে নেবে | যত বয়স বাড়ে, শারীরিক শাস্তি মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে যায়, বুঝানো আরো কার্যকারী |
- ফলাফল যদি প্রত্যেক বার হয়, তবে সন্তান সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুরুত্ব ও ক্ষমতা, নিজের দায়িত্ব এবং কারণ ও ফলাফল বুঝবে, যা বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার মধ্যে একটি।
- উইনস্টন চার্চিল একবার বলেছেন: ‘মহত্বের জন্য দাম দিতে হয়: দায়িত্ব গ্রহণ’। দায়িত্ব হল একটি ব্যক্তির সম্মান ও গুরুত্বের সঙ্গে সংযুক্তি। যদি সন্তানরা তাদের আচরণের ফলাফল উপলব্দি করে তবে তারা বুঝতে পারে যে তাদের ব্যক্তি হিসাবে গুরত্ব ও ভূমিকা আছে।
এই শিক্ষার বিরুদ্ধে আপত্তিগুলি
- অনেকে বলে যা অনেক যুগ ধরে বলা হত: শারীরিক শাস্তি ছাড়া সন্তানদের মানুষ করা সম্ভব নয়।
- কিন্তু: আধুনিক দেশের কিন্ডারগার্ডেন বা ডে-ক্যায়ার কেন্দ্রতে সরকারী আইনের অধীনে আছে: কোনো ছেলে-মেয়েকে শারীরিক শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না। মারলে কর্মীর চাকরী সাথে সাথে বন্ধ করা হয়। তা ছাড়া এই ধরণের জায়গায় অনেক ভিন্ন পরিবারে মানুষ হওয়া বাচ্চা একসাতে আসে। এই ধরণের জায়গায় কর্মীরা তাহলে বাচ্চাদের মধ্যে শৃঙ্খলা কিভাবে রক্ষা করে?
- প্রথম: ‘শাসনের আগেই সুসম্পর্ক’। এই ধরণের জায়গায় এসে একটি বাচ্চাকে আগে সেবা-যত্ন ও সমর্থন দেখাতে হবে যেন নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হতে পারে। বাচ্চাকে সম্মান করা হয়, গ্রহণ করা হয়, তাকে মনোযোগ দেওয়া হয়।
- যদি একটি বাচ্চা অনুপযুক্ত ব্যবহার দেখায় একজন কর্মী তাকে সাথে সাথে মিশুকভাবে কিন্তু গুরুত্বের সঙ্গে বুঝায় যে তার ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়, কেন তা গ্রহণযোগ্য নয় এবং পরিবর্তে সে কি করতে পারে তাও দেখায়। হয়তো বাচ্চাকে কিছুক্ষণের জন্য আলাদা করা হয়। বয়স যত বাড়বে তত বেশি তাকে কারণ বুঝানো হয়, কেন একটি ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয় এবং নিয়ম ভাঙ্গার ফলাফল কি হবে (উদাহরণ: তাকে আলাদা একটি চেয়ারে বসানো হয়, তার আঘাতপ্রাপ্ত বাচ্চার কাছে মাফ চাইতে হয়, আঘাতপ্রাপ্ত বাচ্চার জন্য তার কিছু করতে হয়, ইত্যাদি)। যদি সে ভাল ব্যবহার করে তাকে প্রশংসা করা হয়।
- আবারও একটি বাচ্চাকে ভাল ব্যবহার শেখালে প্রধান বিষয়গুলি হল: সুসম্পর্ক, নিয়মগুলির পরিষ্কার যোগাযোগ, নিয়ম ভাঙ্গলে সাথে সাথে ও প্রত্যেক বার ফলাফল নির্ধারণ করা, ভাল ব্যবহারের জন্য প্রশংসা।
- কিন্ডারগার্ডেন বা ডে-ক্যায়ারে তারা এভাবে করে এবং অধিকাংশ বাচ্চা দুই তিন দিনের মধ্যে তা শিখে ফেলে। একটি খুব জেদী বাচ্চার হয়তো সর্বোচ্চ দুই তিন সপ্তাহও লাগতে পারে, কিন্তু সব মিলিয়ে বলা যায় যে তারা চিন্তার চেয়ে তাড়াতাড়ি শেখে। অবশ্যই তা শুরুতে কঠিন ও ক্লান্তির কাজ, কিন্তু তা কার্যকারী।
- অনেক বার এই ধরণের বাচ্চা যখন বাবা বা মা তাকে নিতে আসে বাচ্চা যে মুহূর্তে বাবা-মা দরজায় প্রবেশ করে, বাচ্চা আগের মত ব্যবহার আবার শুরু করে। ছেলে-মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি শিখে কার কথায় তাদের গুরুত্ব দিতে হচ্ছে এবং কার কথার কোনো গুরুত্ব নেই।
ভালবাসা (ক্ষমা করা, ধৈর্য্য ধরা) বা শাসন?
- আসলে প্রত্যেক মুহূর্তে উভয়ই প্রয়োজন: ভালবাসা এবং শাসন। শাসনের উদ্দেশ্য এই নয় ‘সন্তানকে দেখানো এখানে কর্তা কে’ বরং শাসনের উদ্দেশ্য হল সন্তানকে উপযুক্ত, ভাল ও ন্যায্য ব্যবহার শেখানো এবং চুক্তির কথা রক্ষা করা।
- যদি কথা অনুসারে সাথে সাথে এবং প্রত্যেক বার ফলাফল নির্ধারণ করা হয়, তবে তা দীর্ঘদিনের জন্য আর অনেক শান্তি, আরাম, স্বাধীনতা ও সুসম্পর্ক নিয়ে আসে। না হলে প্রত্যেক ছোট দৈনন্দিন বিষয় হয়ে যায় ‘দুইজনের ইচ্চার শক্তির লড়াই’।
- কিন্তু ভালবাসা দেখানো আবশ্যক: যা প্রয়োজন ও কার্যকারী হল ভালবাসার কারণে ও বাচ্চার মঙ্গলের জন্য ফলাফল নির্ধারণ করা (কথা অনুসারে, সাথে সাথে ও প্রত্যেক বার)। এভাবে করলে তা উভয় বাবা-মা এবং সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ।
- শাসনের ভালবাসা প্রয়োজন। ভালবাসায় শাসন প্রয়োজন। ভালবাসা দেখানোর জন্যই কথা অনুসারে ফলাফল নির্ধারণ করুন!
সন্তান মানুষ করার বিভিন্ন পদ্ধতি
- নীচে দেওয়া ছবিতে সন্তানকে মানুষ করার ২টি প্রবণতা দেখানো হয়েছে যাতে ৪টি ভিন্ন পদ্ধতি সৃষ্টি হয়:
অযত্ন বা উদাসীন পদ্ধতি (১) (Indifferent style)
- নিয়ম কম, সীমানা কম, বাবা-মা হাত দেন কম। গ্রহণ, মনোযোগ, আগ্রহ ও আবেগের প্রকাশ কম। বাবা-মা সন্তান মানুষ করার দায়িত্ব গ্রহণ করে না।
অসংযত বা ইচ্ছাপূরণ পদ্ধতি (২) (Indulgent Style)
- নিয়ম কম, সীমানা কম, বাবা-মা হাত দেন কম। কিন্তু ভালবাসার প্রকাশ, নিঃশর্ত গ্রহণ, মনোযোগ ও আগ্রহের প্রকাশ। বাবা-মা তাদের সন্তানের ব্যবহারের জন্য দায়িত্ব নেন না। সাধারণত সন্তান বাবা-মাকে চালায় বা দমন করে।
স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্বের পদ্ধতি (৩) (Authoritarian style)
- অনেক নিয়ম, অনেক দাবী, অনেক নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু বেশি সমর্থন, ভালবাসা বা গ্রহণ নেই। যা সন্তান করবে না কেন, তা যথেষ্ট ভাল নয়। বাধ্যতা হল বাবা-মায়ের প্রধান দাবী ও মূল্যায়ন করার মাত্র মানদণ্ড। সন্তান স্বক্রিয় বা স্বচালিত হতে কোনো উৎসাহ পায় না। শাস্তির বিস্তার দ্বারা সন্তানকে বাবা-মায়ের ইচ্ছায় বাধ্য করানো হয়।
অধিকারগত বা প্রামাণ্যের পদ্ধতি (৪) (Authoritative style)
- অনেক ভালবাসা, সমর্থন ও গ্রহণের প্রকাশ কিন্তু তার সাথে পরিষ্কার নিয়ম ও নিয়ম ভাঙ্গলে কথা অনুসারে ফলাফল। বাধ্যতার দাবী কিন্তু নিজে সিদ্ধান্ত ও দায়িত্ব নেওয়া হল শেষ লক্ষ্য। বাবা-মা নিয়মের গুরুত্ব ও কারণ বুঝান, ফলাফল নির্ধারণ করেন কিন্তু তারা সন্তানের অবস্থা ও পর্যায়ও বিবেচনা করেন। বাবা-মার সন্তানের জন্য উঁচু মাণের আশা আছে কিন্তু তারা সন্তানকে নিজের সিদ্ধান্ত ও দায়িত্ব নিতে উৎসাহিত করেন।
- বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেল যে, এমন সন্তান যাদের অধিকারগত বা প্রমাণের পদ্ধতিতে (৪) বড় করা হয়েছিল, তাদের আরো আত্ম-সম্মান ছিল, তারা অনুপযুক্ত বা অন্যায্য ব্যবহার কম করত, তাদের নিরাশায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল, বরং সাহস বেশি ছেল। তাদের শারীরিক অবস্থা আরো ভাল ছিল এবং তারা স্কুলের পরীক্ষায় আরো ভাল মার্ক পেত।
- কেউ কেউ তৃতীয় একটি প্রবণতা যোগ দেন: স্বনির্ভরতাকে অনুমোদিত বা উৎসাহিত করা।
- গবেষণায় দেখা গেল যে এমন সন্তান যাদের অধিকারগত বা প্রমাণের পদ্ধতিতে (৪) বড় করা হয়েছিল তারা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি সাহসী, দায়িত্বশীল ও সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে অনেক ইচ্ছক ছিল।

বাধ্যতার ভূমিকা বা গুরুত্ব কি?
- অনেকে আদি ৮:২১ ‘ছোটবেলা থেকেই তো মানুষের মনের ঝোঁক মন্দের দিকে’ পদ ভিত্তি করে শতাব্দীর পর শতাব্দী মনে করল যে সন্তানদের মানুষ করার প্রধান লক্ষ্য হওয়া দরকার লাঠি দিয়ে সে ‘মন্দের দিকে” মনকে তাড়াতে বা যতদূর সম্ভব ভাঙ্গতে।
- তাই তো, একটি অবাধ্যতর কারণে (অথবা আসলে একটি বিশ্বাস ঘাতকতার কারণে) মানুষ পতিত হয়েছে। অবশ্যই বাধ্যতা ভাল ও প্রয়োজন।
- কিন্তু আদিপুস্তক থেকে শুরু করে আমাদের এর চেয়ে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিও দেখানো হয়
- ঈশ্বর বাগানের সব গাছের ফল খেতে অনুমতি দিয়েছিলেন, মাত্র একটি গাছ ছিল নিষিদ্ধ (আদি ২:১৬-১৭)। চিন্তা করুন: পৃথিবীতে ৩০’০০০ হাজার ধরণের গাছ আছে, তাই ঈশ্বরের এই আদেশ ছোট মনের আদেশ নয়। বলা যায় যে তিনি ২৯’৯৯৯ বার বলেছেন: ‘তুমি তোমার খুশীমত খেতে পার” এবং একবার মাত্র বলেছেন ‘খাবে না’। ঈশ্বর মানুষদের বাধ্যতার জন্য তৈরি করেন নি কিন্তু সহভাগিতা ও জীবনের জন্য।
- ‘মানুষের জন্যই বিশ্রামবার সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু বিশ্রামবারের জন্য মানুষের সৃষ্টি হয় নি’ (মার্ক ২:২৭)।
- ‘আমি দয়া দেখতে চাই, পশু-উৎসর্গ নয়’ ঈশ্বর বলেন (মথি ১২:৭)
- যীশু আমাদের ‘দাস’ বলেন না বরং আমাদের ‘বন্ধু’ বলেন (যোহন ১৫:১৫)।
- পৌল ইফিষীয় ৫ অধ্যায়ে বাধ্য হওয়ার আদেশের ভূমিকা হিসাবে একটি ভালবাসার সম্পর্কের আদেশ দেন: পরস্পরের কাছে বশীভূত হওয়া (ইফিষীয় ৫:২১), পরস্পর্কে সম্মান ও প্রাধান্য দেওয়া।
- ঈশ্বর তার মহিমা ও পরাক্রম প্রকাশ করে মানুষকে জোর করে দখল করেন না বরং তিনি আঘাতের হৃদয় স্পর্শ করার জন্য তার পুত্রকে দুর্বল শিশু হিসাবে ও একটি ভিন্ন কণ্ঠস্বর হিসাবে পাঠান।
- হ্যাঁ, তিনি পবিত্র ঈশ্বর যিনি তাঁর পাওনা ভক্তি চান, কিন্তু ১০০০ প্রজন্ম পর্যন্ত তাঁর বুক ভরা দয়া থাকবে (যাত্রা ২০:৫-৬)।
- স্বাধীনতার জন্যই খ্রিষ্ট আমাদের স্বাধীন করেছেন (গালাতীয় ৫:১)।
- ‘কোন কিছু করা আমার পক্ষে অনুচিত নয়।’… কিন্তু আমি কোন কিছুরই দাস হব না’ (১ করি ৬:১২)। ‘কোন কিছু করা অনুচিত নয়।’… কিন্তু সব কিছুই যে মানুষকে গড়ে তোলে তা নয়’ (১ করি ১০:২৩)।
- অল্প বয়সের ছেলে-মেয়েদের জন্য বাধ্যতা আবশ্যক কারণ তারা একটি ব্যবহার বিপজ্জনক কিনা বা কি কি ফলাফল হবে তা এখনও সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারে না। রাস্তা পার হওয়া, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া বা দাঁত ব্রাশ করা, সব উপযুক্ত ব্যবহার তাদের প্রথম শিখতে হবে। অন্যদের প্রয়োজন বিবেচনা করতেও শিখতে হবে: বাবা-মায়ের ও প্রয়োজন আছে এবং সন্তানের তা সম্মান করতে শিখতে হবে।
- ঈশ্বর বাবা-মাকে অধিকার দিয়েছেন যেন তারা সন্তানদের এই শেখার ও বৃদ্ধি পাওয়া প্রক্রিয়ায় পরিচালনা দেন। কিন্তু যেমন তাদের অধিকার দিয়েছেন, সাথে ঈশ্বরের প্রতি, যিনি সব অধিকারের উৎস, একটি দায়বদ্ধতাও থাকে। যীশু আদেশ দেন যেন যারা নেতৃত্ব দেন, যেন তারা অনুস্মরণকারীদের সেবা করেন (মথি ২০:২৬-২৮)। তাই নেতা হিসাবে বাবা-মায়েরা সন্তানের বাধ্যতা নিজের সুবিধার জন্য চাইবে না, বরং সন্তানের সর্বোচ্চের জন্য।
- নীচে দেওয়া কথা হল ‘শিক্ষা ০৫–ভিত্তিক চিন্তা’-এর একটি সারাংশ। বিস্তারিত শিক্ষার জন্য ‘শিক্ষা ০৫’ দেখুন!
মানুষকে নিয়ে বাইবেলীয় দৃষ্টিভঙ্গী এবং সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব
- মানুষ নিয়ে ঈশ্বরের দৃষ্টির ভিত্তি হল আদি ১:২৬-২৭ পদ, শুধুমাত্র মানুষই ‘ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি’ বা ‘ঈশ্বরের মত সৃষ্টি’। তাই যদি হয় তা থেকে আমরা কি কি নীতিমালা পাই?
মানুষ ঈশ্বরের উপরে নির্ভরশীল
- মানুষ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি, তারা ঈশ্বরের মত ব্যক্তি। মানুষের গুরুত্ব ও সম্মান ঈশ্বর থেকে আসে: ঈশ্বরের সাথে তাদের সম্পর্ক আছে, তারা তাঁরই লোক, তারা তাঁর উপর নির্ভরশীল, তারা তাঁর কাছ থেকে আহবান ও উদ্দেশ্য পায়। ঈশ্বর যে উদ্দেশ্যে একজন মানুষ সৃষ্টি করেছেন যখন তা সে আসলে পূর্ণ করে, তখন তার হৃদয়ে সিদ্ধি, সন্তোষ ও গভীর তৃপ্তি আসে।
- সন্তান মানুষ করলে তাদের দেখানো দরকার যে আমরা তখনই ‘আসল মানুষ’ হতে পারি, যখন ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কে থাকে। কিন্তু একজন মানুষ ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কে থাকতে চায় কিনা তা হল প্রত্যেক মানুষের স্বাধীন সিদ্ধান্ত। বাবা-মা যত বিশ্বস্ত বিশ্বাসী হোক বা তারা যত চমৎকার বাবা-মা হোক, তারা সন্তানদের পরিত্রাণ নিশ্চিত করতে পারবে না।
মানুষ সম্পর্কের জন্যই তৈরি
- ঈশ্বর সম্পর্কের ঈশ্বর। ঈশ্বর ত্রিত্ব ঈশ্বর: স্বর্গস্থ পিতা, পুত্র যীশু ও পবিত্র আত্মা অনন্তকাল আগে থেকেই সুসম্পর্কে ও শান্তিতে বাস করেন। তাই মানুষ (যিনি ত্রিত্ব ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি) অবশ্যই সম্পর্কের লোক।
মানুষের অতুলনীয় মূল্য ও সম্মান দেওয়া হয়েছে
- মানুষ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি বলে তার অতুলনীয় মূল্য ও উঁচু সম্মান নিশ্চিত করা হয়েছে (গীত ৮:৫-৯ দেখুন)। তাই যে কোনো মানুষ সম্মানজনক ব্যবহার পাওয়ার যোগ্য। ‘ঈশ্বর মানুষকে এমন প্রেম করিলেন যে, আপনার এক জাত পুত্রকে দান করিলেন…’ (যোহন ৩:১৬)।
- এই কথাও ঠিক যে সন্তান মানুষ হিসাবে পাপ-স্বভাব আছে এবং ‘ছোটবেলা থেকেই তো মানুষের মনের ঝোঁক মন্দের দিকে।’ (আদি ৮:২১)। অবশ্যই যীশু মানুষকে অনুতপ্ত হওয়ার ডাক দেন কারণ তারা আসলে পাপী, কিন্তু যীশুর জীবন দেখলে তাঁর মধ্যে কোনো ‘বিচার করার মনোভাব’ পাই না (যদিও মানুষকে বিচার করার তাঁর অধিকার ও যথেষ্ট কারণ আছে) বরং যা দেখি হল যীশু মানুষকে কত সম্মান, দয়া ও ভালবাসার চোখে দেখেন এবং এমন কি সমাজের বাইরে পড়া লোকদের প্রতি তাঁর ব্যবহার কত স্নেহশীল।
- পাপের বিষয়ে চেতনা বাবা-মায়ের ভূমিকা নয় বরং পবিত্র আত্মার কাজ। বাবা-মা হিসাবে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যেন আমরা সন্তানদের সম্মান, মূল্য ও নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নষ্ট না করি।
মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও দায়িত্ব আছে
- যেমন ঈশ্বরের স্বাধীন ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে, তাঁর প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি মানুষেরও ঠিক তা আছে।
- ঈশ্বর মানুষকে সমস্ত স্বাধীনতা, একটি মাত্র নিয়ম এবং (চাইলে) নিয়ম ভাঙ্গারও ক্ষমতাও দিয়েছেন। সে একটি নিয়ম ভাঙ্গা মানেই ঈশ্বরকে হৃদয়ে প্রথম স্থান না দেওয়া এবং নিজেকে ঈশ্বরের চেয়ে বড় হিসাবে ঘোষণা করা। ঈশ্বর আগে থেকে তাদের বুঝিয়েছেন যে এই সিদ্ধান্তের ফলাফল মৃত্যু। কিন্তু শারীরিক মত্যু সাথে সাথে আসে না, মানুষকে সময় দেওয়া হয়েছে আরো সিদ্ধান্ত নিয়ে ও তার সিদ্ধান্তের বাস্তব ফল উপভোগ করতে।
- যখন ঈশ্বর যীশুকে পাঠান মানুষকে উদ্ধার করার জন্য তিনি একইভাবে মানুষকে পরিত্রাণের প্রস্তাব দেন, কিন্তু আসলে ‘প্রস্তাব’: মানুষের ক্ষমতা আছে গ্রহণ করতে অথবা অগ্রাহ্য করতে। মানুষের সিদ্ধান্তের ভার আছে: সিদ্ধান্তের ফলাফল আছে, তা অস্বীকার করা যায় না, এড়িয়েও যাওয়া যায় না ‘তোমরা ভুল কোরো না, ঈশ্বরের সংগে তামাশা চলে না; কারণ যে যা বুনবে সে তা-ই কাটবে’ (গালা ৬:৭)।
- এইটা হুমকিস্বরূপ নয় বরং ঈশ্বর থেকে মানুষকে দেওয়া সে সম্মান ও ক্ষমতার একটি অংশ: মানুষের সিদ্ধান্তের ভার আছে, বাস্তব ফলাফল আছে, ঈশ্বর মানুষের সিদ্ধান্ত উল্টায়ও না, সিদ্ধান্তের ফলাফল ‘মুছে ফেলবে’ না।
মানুষকে আত্মনির্ধারণ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে
- ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট মানুষের নিজের জীবন চালানো বা আত্মনির্ধারণের একটি আকাঙ্খা আছে।
- যদিও মানুষের আত্মনির্ধারণের সীমানা আছে তবুও ঈশ্বর মানুষকে এই পৃথিবী নিজের অধীনে আনার আদেশ দিলেন যা করতে গেলে সিদ্ধান্ত নেওয়া, স্বচালিত হওয়া, আত্মনির্ধারণ, সচেতনতা ও স্বনিয়ন্ত্রণ অবশ্যই প্রয়োজন।
মানুষ যোগাযোগকারী
- যেমন ঈশ্বর যোগাযোগকারী ঠিক তেমনি তাঁর প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট মানুষও যোগাযোগকারী। যোগাযোগ যে মানুষ করতে পারে তা দেখায় যে মানুষ ব্যক্তি, যার চিন্তা, সচেতনতা, আত্মনির্ধারণ ও ইচ্ছার শক্তি আছে।
মানুষের আহবান ও সৃজনশীলতা আছে
- ঈশ্বর মানুষকে ও একটি কাজ বা আহবান দিয়েছেন। এই কাজ বা আহবান পূর্ণ করার জন্য ঈশ্বর মানুষকে প্রয়োজনীয় অধিকার, দক্ষতা ও সৃজনশীলতাও দিয়েছেন। যেমন ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও, মানুষের দান, তালন্ত ও সৃজনশীলতা আছে বলে তার তা স্বক্রিয়ভাবে কাজে লাগানোর একটি দায়িত্বও আসে। মানুষ তা করলে আনন্দ, সন্তোষ ও তৃপ্তি পায় এবং আত্ম-সম্মান বাড়ে।
- সন্তানকে মানুষ করার ধরণ এমন হতে হবে যেন সন্তান তার দান, তালন্ত ও আকাঙ্খাগুলি আবিষ্কার করতে পারে ও স্বক্রিয়ভাবে কাজে লাগাতে সুযোগ ও সমর্থন পায়। সন্তানের বাবা-মায়ের উৎসাহ প্রয়োজন যেন তারা নিজের কাজের ও ইতিবাচক উপদানে সুযোগ ও আনন্দ পায়।
সমস্ত মানুষের একই মূল্য আছে
- বাইবেলে ঈশ্বর আমাদের নিজেকে এবং প্রতিবেশিকে ভালবাসতে আদেশ দেয়। এই দুটি আদেশের মধ্যে একটি উপযুক্ত টেন্সন আছে। তাতে প্রকাশিত যে প্রত্যেক মানুষই মূল্যবান।
- যদি আমি শুধুমাত্র আমার প্রয়োজন ও দাবী মেটাতে ব্যস্ত, আমি স্বার্থপর হব, একা হয়ে পড়ব এবং আমার উপযুক্ত সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু যদি আমি শুধুমাত্র অন্যদের প্রয়োজন ও দাবী মেটাতে ব্যস্ত, তবে আমি নিজেকে মুছে ফেলে নিজেকে হারাব এবং এভাবেও উপযুক্ত সম্পর্ক থাকবে না। সমস্ত মানুষের একই মূল্য আছে বলে একটি ভাল ও উপযুক্ত ভারসাম্য তৈরি হয় যাতে পরস্পর্কে বিবেচনা ও দুইপাশে সেবা থাকবে।
ঈশ্বর মানুষকে নিয়ে আনন্দ করেন
- যখন ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন তিনি তৃপ্তি ও আনন্দ পান। ‘সদাপ্রভুর গৌরব অনন্তকাল থাকুক; তিনি যেন নিজের কাজে আনন্দিত হন’ (গীত ১০৪:৩১)।
- মণ্ডলীতে অনেক শতাব্দী ধরে একটি শিক্ষা প্রচলিত ছিল যে ঈশ্বর ‘মানুষকে সহ্য করেন মাত্র’ এবং ‘আনন্দভোগই হল পাপ’।
- যীশু বলেন: ‘চোর কেবল চুরি, খুন ও নষ্ট করবার উদ্দেশ্য নিয়েই আসে। আমি এসেছি যেন তারা জীবন পায়, আর সেই জীবন যেন পরিপূর্ণ হয়।’ (যোহন ১০:১০)। এই পৃথিবীর কষ্ট, যন্ত্রনা ও অন্যায়ের পূর্ণ খেয়াল থাকার পরেও যীশু এমন একটি জীবন করেন যাতে ঈশ্বরের আনন্দ ও অনুমোদন বুঝা যায়: তিনি পানি থেকে দ্রাক্ষারস বানান যেন বর-কনে লজ্জায় না পড়ে, ফরীশীরা তাঁর দোষ ধরে কারণ তিনি কর-আদায়কারী ও রাজাকারদের সাথে ভোজ খান, তিনি ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব উপভোগ করেন (যেমন লাষার, মার্থা ও মরিয়মের সাথে), তিনি একটি পাপী মহিলাকে অনুমতি দেন, তার একটি অতিদামী সুগন্ধী তেল তাঁর জন্য ‘নষ্ট করতে’, তিনি সারা রাত পরিশ্রম করা জেলেদের জন্য নাস্তা প্রস্তুত করে রাখেন (যোহন ২১:৯)।
- সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের তা করা দরকার: যেন পরিবার হিসাবে খেলা-ধূলা, ভোজ, আনন্দ বা মজা থাকে, পরিমান মত, এবং মাঝের মধ্যে ‘পরিমাণ মত’ এর চেয়েও বেশি যেন থাকে। এমন সন্তান যাদের ভালবাসা হয়, গুরুত্ব দেওয়া হয়, উৎসাহ দেওয়া হয়, যাদের নিয়ে আনন্দ করা হয়, যাদের নিজেকে এবং অন্যদের ভালবাসতে শেখানো হয়, তাদের সম্পর্কগুলি অনেক স্বাধীন, উপযুক্ত ও ‘সুস্থ’।