যোগাযোগ ০৯ – যীশুর কথা বলার ধরণ: নীকদীম
সুসমাচারগুলিতে যীশুর কয়েকটি ব্যক্তিগত আলোচনার বর্ণনা আছে। তেমনই রাতের বেলায় নীকদীমের সাথে যীশুর কথা হল সবচেয়ে লম্বা আলোচনার মধ্যে একটি।
নীকদীম কে ছিলেন?
নীকদীমের কথা প্রথম উল্লেখ যীশুর সাথে এই রাত্রিবেলার আলোচনায়, পরে তার বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায় যখন যিরূশালেমে আত্মিক নেতারা যীশুর বিষয়ে আলোচনা করেন তখন এবং শেষে যীশুকে কবর দেওয়ায় তিনি সাহায্য করেন:
যোহন ৩:১ “ফরীশীদের মধ্যে নীকদীম নামে যিহূদীদের একজন নেতা ছিলেন।”
যোহন ৭:৪৫-৫২ “যে কর্মচারীদের পাঠানো হয়েছিল তারা প্রধান পুরোহিতদের ও ফরীশীদের কাছে ফিরে আসল। তখন তাঁরা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তাকে আন নি কেন?” সেই কর্মচারীরা বলল, “লোকটা যেভাবে কথা বলে সেইভাবে আর কেউ কখনও বলে নি।” এতে ফরীশীরা সেই কর্মচারীদের বললেন, “তোমরাও কি ঠকে গেলে? ৪৮ নেতাদের মধ্যে বা ফরীশীদের মধ্যে কেউ তো তার উপর বিশ্বাস করে নি। কিন্তু এই যে সাধারণ লোকেরা, এরা তো মোশির আইন-কানুন জানে না; এদের উপর অভিশাপ রয়েছে।” নীকদীম, যিনি আগে যীশুর কাছে গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন এই সব ফরীশীদের মধ্যে একজন। তিনি বললেন, “কারও মুখের কথা না শুনে এবং সে কি করেছে তা না জেনে কাউকে শাস্তি দেবার ব্যবস্থা কি আমাদের আইন-কানুনে রয়েছে?” ফরীশীরা নীকদীমকে উত্তর দিলেন, “তুমিও কি গালীলের লোক? পবিত্র শাস্ত্রে খুঁজে দেখ, গালীলে কোন নবীর জন্মগ্রহণ করবার কথা নেই।”
যোহন ১৯:৩৮-৩৯ “এই সমস্ত ঘটনার পরে অরিমাথিয়া গ্রামের যোষেফ যীশুর দেহটা নিয়ে যাবার জন্য পীলাতের কাছে অনুমতি চাইলেন। যোষেফ ছিলেন যীশুর গুপ্ত শিষ্য, কারণ তিনি যিহূদী নেতাদের ভয় করতেন। পীলাত অনুমতি দিলে পর তিনি এসে যীশুর দেহ নিয়ে গেলেন। ৩৯ আগে যিনি রাতের বেলায় যীশুর কাছে এসেছিলেন সেই নীকদীমও প্রায় তেত্রিশ কেজি গন্ধরস ও অগুরু মিশিয়ে নিয়ে আসলেন।”
- নীকদীম ছিলেন একজন ফরীশী, যিহূদীদের একজন কর্তা এবং তিনি যিরূশালেমে আত্মিক নেতাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভায় উপস্থিত। তাই উপসংহারে বলা যায় যে তিনি ছিলেন যিহূদী নেতা পরিষদের (সানহীদ্রেন, Sanhedrin) একজন। পরিষদের অর্ধেক কর্তারা ছিলেন পুরোহিত, অর্ধেক ছিলেন ফরীশী (প্রেরিত ২৩:৬)।
- যোহন সুসমাচারে দেখা যায় যে নীকদীম আরিমাথিয়ার যোষেফের সাথে সম্পর্ক আছে। লূক সুসমাচারে (লূক ২৩:৫০-৫২) যোষেফের বর্ণনা এভাবে দেন: তিনি ছিলেন ধার্মিক ও ঈশ্বর ভক্ত একজন ভাল লোক, যিনি ঈশ্বরের রাজ্যের অপেক্ষা করতেন এবং তিনি যিহূদী পরিষদের সিদ্ধান্তে রাজি ছিলেন না যে যীশুকে মেরে ফেলা হবে। যোষেফ পিলাতের অনুমতি পেয়ে যীশুকে নিজের কবরে দাফন করেন, নীকদীম দাফনের জন্য বড় পরিমাণে গন্ধরস ও অগুরু কিনে দেন।
- যোষেফ যীশুর একজন গোপন অনুসরণকারী। নীকদীম রাতের বেলায় যীশুর সাথে দেখা করেন এবং যিহূদী সভায় খুব সাবধান করে আপত্তি উঠান। তাতে বুঝা যায় আত্মিক নেতারা (উভয় পুরোহিত এবং ফরীশী) কত শক্তিশালী ভাবে যীশুর বিরুদ্ধে ছিলেন এবং তারা সবার উপরে কত চাপ বা অত্যাচার সৃষ্টি করতেন।
ফরীশীদের চিন্তা বা মতামত কি ছিল?
- ‘ফরীশী’ শব্দের অর্থ হল ‘আলাদা করা’, ‘পবিত্র’ বা ‘খাঁটি’ একজন। ফরীশী আন্দোলন শুরু হয় মাক্কাবীয়দের সময়ে (১৬৭ খ্রিঃপূঃ থেকে) যখন যিহূদীরা তাদের দেবতা পূজারী ও অত্যাচারী সেলুকীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল। ফরীশীরা ছিলেন নতুন নিয়মের যুগের সবচেয়ে সম্মানিত, বড় ও প্রভাবশালী দল। তারা ছিলেন সে ধার্মিক যিহূদীরা যারা আপোষ করতে রাজি ছিলেন না।
- যে কোনো একজন যিহূদী পুরুষ ফরীশীদের সাথে যোগ দিতে পারত। অধিকাংশ যিহূদীরা ছিলেন সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক। কিন্তু তারা অন্যদের অশুচি বলে নিজেকে সামাজিকভাবে আলাদা রাখত। তারা স্বাধীনতা প্রিয় যিহূদীদের, ‘পাপী’দের এবং অযিহূদীদের তুচ্ছ করত।
- ফরীশীরা গ্রামে গ্রামে যিহূদী সমাজগৃহে মোশির আইনের বিষয়ে শিক্ষা দিত। তারা মোশীকে খুব সম্মান করত ও সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রত্যেক খুঁটিনাটি আইন পালন করতে আদেশ দিত। তারা বিশ্বাস করত যে সমস্ত যিহূদী যদি শুধুমাত্র ২৪ ঘণ্টা ঈশ্বরের সমস্ত আইন পালন করত, তবে অবশেষে মশীহ ফিরে আসবেন এবং সব সমস্যা সমাধান করবেন।
- আইন পালন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে তারা ‘আরো অতিরিক্ত আইন’ যোগ করত। উদাহরণ: মোশির আইন-কানুনে লেখা আছে ‘বিশ্রামবার পবিত্র বলে মান্য কর’। ফরীশীরা আরো নিয়ম যোগ দিত, বিশ্রাম বারে ঠিক কি করা অনুমোদিত বা নিষিদ্ধ, কতদূর হাটা যায় বা যায় না, কত কেজি বহন করা যায় বা যায় না ইত্যাদি।
- এই মৌখিক নিয়ম বা ‘ঐতিহ্য’গুলি ছিল অতি খুঁটিনাটি ও পালন করা কঠিন। ফলে আইনের পিছনে ঈশ্বরের নীতি বা উদ্দেশ্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত ছোট খুঁটিনাটি বিষয়ে।
- তা ছাড়া ফরীশীরা দাবী করত যে তাদের সে যোগ দেওয়া মৌখিক আইন মোশির আইন-কানুনের মত অধিকারগত ও সবাইকে তা পালন পালন করতে হয়।
- ফরীশীরা সম্পূর্ণ পুরাতন নিয়ম ঈশ্বরের আইন-গত বাক্য হিসাবে মানত যদিও সদ্দূকীরা শুধুমাত্র মোশির আইন-কানুন ঈশ্বরের আইন-গত বাক্য হিসাবে মানত।
- ফরীশীরা বিশেষভাবে সুন্নত, বিশ্রাম বার ও শুচি-অশুচি নিয়মের পালনে গুরুত্ব দিত যেন যিহূদীরা অবশ্যই নিজেকে আলাদা করবে ও এতে তাদের পরিচয় খুঁজে পাবে।
- ফরীশীরা অযিহূদীদের, রোমীয় শাসন ও যারা রোমীয়দের সাথে হাত মিলাত তাদের বিশেষভাবে ঘৃণা করত। তারা বিশ্বাস করত যে শুধুমাত্র নিজেকে অযিহূদীদের থেকে আলাদা করলে ঈশ্বর খুশি হবেন এবং আবার দয়া দেখাবেন।
- ফরীশীরা স্বর্গদূত ও মন্দ আত্মার অস্তিত্ব বিশ্বাস করত। তারা বিশ্বাস করত যে মৃত্যুর পরে জীবন আছে, যে যুগের শেষে ঈশ্বর একটি শারীরিক পুনরুত্থান ঘটাবেন। এই বিষয়ে তারা সদ্দূকীদের সাথে একমত ছিল না।
- পুনরুত্থানের বিশ্বাসের সাথে তারা বিশ্বাস করত যে মশীহ ফিরে এসে দায়ূদের মত ইস্রায়েলকে পুনরুদ্ধার করবেন, তাদের রোমীয় অত্যাচারীদের থেকে মুক্ত করে পুনরায় অন্যদের উপরে শাসন করতে দেবেন।
- তারা পুরোহিত বা সদ্দূকী দল সম্বন্ধে বলত যে তারা দুর্নীতিগ্রস্ত ও রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধানী; তারা আত্মিক নেতা হলেও ঈশ্বরের প্রতিনিধি নয় এবং উপযুক্ত নেতৃত্ব ও দেয় না। ফরীশীরা বর্তমান পুরোহিতদের এবং মন্দিরে উৎসর্গ-পদ্ধতি খাঁটি মনে করত না।
- ফরীশীরা ছিল খুব ঈশ্বর ভক্ত ও সমর্পিত লোক, কিন্তু তারাও ছিল আত্মধার্মিক, উচ্চতর, অহংকারী, তুলনাকারী, অন্যদের বাদ দেওয়া ও দমনকারী লোক। আইন-কানুনে অতি গুরুত্ব দিলে এই ধরণের মনোভাব সহজেই তৈরি হয়। ফরীশীরা এই মনোভাব সমস্যা মনে করত না।
যীশুর সঙ্গে নীকদীমের আলোচনা
যোহন ৩:২ “একদিন রাতে তিনি যীশুর কাছে এসে বললেন, “গুরু, আমরা জানি আপনি একজন শিক্ষক হিসাবে ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছেন, কারণ আপনি যে সব আশ্চর্য কাজ করছেন, ঈশ্বর সংগে না থাকলে কেউ তা করতে পারে না।”
- যীশু বিশ্রামবার পালনে অতি গুরুত্ব দেন নি এবং যীশু নিজেকে পাপীদের থেকে আলাদা করেন নি বলে ফরীশীরা তাঁকে নিয়ে বেশি খুশি ছিল না।
- কিন্তু ফরীশী হলেও এবং নেতা হলেও নীকদীম যীশুর কাছে আসেন। তাতে বুঝা যায় যে তিনি একজন নম্র ফরীশী ছিলেন যিনি আসলে ঈশ্বরের অনুসরণকারী। তিনি বুঝতে পেরেছেন যে যীশু ঈশ্বর থেকে পাঠানো একজন। তিনি বলেন ‘আমরা জানি’ (বহুবচন), যাতে বুঝা যায় যে আরো ফরীশী যীশুকে অগ্রাহ্য করে নি।
- নীকদীম যীশুর আশ্চর্য কাজ দেখে উপসংহারে আসলেন যে তিনি ‘ঈশ্বরের সঙ্গে’ একজন। যীশু এই যুক্তিতে বা উপসংহারে রাজি: যোহন ১০:৩৮ পদে যীশু একই যুক্তিতে বলেন: ‘কিন্তু যদি করি তবে আমাকে বিশ্বাস না করলেও আমার কাজগুলো অন্ততঃ বিশ্বাস করুন। তাতে আপনারা জানতে ও বুঝতে পারবেন যে, পিতা আমার মধ্যে আছেন আর আমি পিতার মধ্যে আছি।’
- সবাই কিন্তু এই যুক্তিতে রাজি নয়। বেশ কয়েক বার যীশু আশ্চর্য কাজ করার কারণে তারা মনে করতেন যীশু ‘মন্দ আত্মায় পাওয়া’ লোক (যেমন মার্ক ৩:৩২ পদে)। কিন্তু হ্যাঁ: ক্ষমতা আসলে কোথাও থেকে আসে।
- নীকদীম রাতে যীশুর কাছে আসেন। নীকদীমের যীশুকে অনুসন্ধান যেন অন্যরা জানতে না পারে, হতে পারে এই ভেবে তিনি ভীত।
- নীকদীম যীশুকে সম্মানের সঙ্গে কথা বলেন ও তাঁকে ‘গুরু’ ডাকেন। যেহেতু নীকদীম সামাজিক নেতা এবং (হতে পারে) যীশুর চেয়ে বয়স্ক, তা হল সম্মানের ও নম্রতার কথা।
- মজার বিষয় যে নীকদীম যীশুর কাছে কোনো নির্দিষ্ট প্রশ্ন নিয়ে আসেন না। তিনি এমনি কথা শুনতে ও শিখতে এসেছেন। যীশুর প্রকাশ্যে শিক্ষা দান ও ব্যবহার কিছুটা তার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে এবং তার মনকে আকৃষ্ট করেছে। কিন্তু তিনি নিশ্চিত জানেন না তিনি যীশুর কাছ থেকে কি চান বা তাঁর কাছ থেকে তার ঠিক কি দরকার। কিন্তু তিনি নিশ্চিত জানেন যে যীশুর কাছ থেকে তার কিছু গ্রহণ করা দরকার।
যোহন ৩:২ “যীশু নীকদীমকে বললেন, “আমি আপনাকে সত্যিই বলছি, নতুন করে জন্ম না হলে কেউ ঈশ্বরের রাজ্য দেখতে পায় না।”
- যীশু আলোচনার বিষয় ঠিক করেন: ঈশ্বরের রাজ্য। ফরীশীরা ঠিক তা-ই নিয়ে আসতে চেষ্টা করছেন। যীশু একটি প্রচলিত ও গুরুত্বপূর্ণ হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা তোলেন।
- ঈশ্বরের রাজ্য কিভাবে নিয়ে আসা যায়? ফরীশীদের সাধারণ উত্তর হত: মোশির আইন-কানুন পালন করা দ্বারা, মনে-প্রাণে বাধ্য হওয়া দ্বারা, সবাইকে তাতে বাধ্য করানো দ্বারা, যারা বাধ্য হয় না তাদের থেকে নিজেকে আলাদা করা দ্বারা, অযিহূদী পাপীদের থেকে দূরে থাকা দ্বারা, নিজেকে শুচি রাখা দ্বারা। তা-ই ছিল প্রশ্নের প্রচলিত ও সাধারণ উত্তর।
- যীশু প্রশ্নের উত্তরে সম্পূর্ণ অন্য কিছু বলেন। তাঁর উত্তর এমন ভিন্ন যে বুঝা যায় যে যীশু নীকদীমকে এখানে ইচ্ছাকৃত ভাবে ঝাঁকাছেন: ঈশ্বরের রাজ্য দেখতে গেলে ‘নতুন করে জন্ম’ দরকার। কোনো প্রোগ্রাম দরকার নেই, আইন পালনের কোনো কঠোর প্রচেষ্টা বা আত্ম-ধার্মিকতার দরকার নেই, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য কিছু। সম্পূর্ণ পরিবর্তনকারী একটি ঘটনা।
- আধুনিক যুগে বিশ্বাসীদের কাছে ‘নতুন জন্ম’ অনেক প্রচলিত একটি রূপক কথা, যার অর্থ ও গুরুত্ব নিয়ে মণ্ডলী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কথা বলেছে। নীকদীমের জন্য ‘নতুন জন্ম’ রূপকটি সম্পূর্ণ নতুন।
- কেন যীশু এখানে এই রূপক ‘নতুন জন্ম’ নিয়ে আসেন? ‘নতুন জন্ম’ মানে কি? ‘নতুন জন্ম’ মানে একটি অদ্বিতীয় ঘটনা, একটি নতুন জীবনের সৃষ্টি, নতুন একটি অস্তিত্বের হঠাৎ শুরু, এমন কিছু যা আমি মানুষ হিসাবে ঘটাতে পারি না, এমন কিছু যা আমাকে নিয়ে ঘটে।
- জন্মের রূপক ও দেখায় যে ঈশ্বরের রাজ্যের আগমন হল এমন কিছু যা একজন ব্যক্তিকে নিয়ে হয়, প্রত্যেক শিশুকে এক একজন করে জন্ম নিল। ঈশ্বরের রাজ্য প্রাথমিকভাবে একটি সামাজিক বা জাতীয় বিষয় নয়, ঈশ্বরের রাজ্য একজন ব্যক্তির মধ্যেই উপস্থিত।

যোহন ৩:৪ “তখন নীকদীম তাঁকে বললেন, “মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে কেমন করে তার আবার জন্ম হতে পারে? দ্বিতীয় বার মায়ের গর্ভে ফিরে গিয়ে সে কি আবার জন্মগ্রহণ করতে পারে?”
- পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে নীকদীম এই উত্তরে বিস্মিত, অবাক, দ্বিধাদন্ধ গ্রস্ত ও বিভ্রান্ত। তিনি রূপকের অর্থ নিয়ে প্রশ্ন করেন, কিন্তু তিনি তেমন জানেনও না, কিভাবে জিজ্ঞাসা করতে।
যোহন ৩: ৫-৬ “উত্তরে যীশু বললেন, ‘আমি আপনাকে সত্যিই বলছি, জল এবং পবিত্র আত্মা থেকে জন্ম না হলে কেউই ঈশ্বরের রাজ্যে ঢুকতে পারে না। মানুষ থেকে যা জন্মে তা মানুষ, আর যা পবিত্র আত্মা থেকে জন্মে তা আত্মা।”
- যীশু নীকদীমের প্রশ্নের উত্তর দেন, নাও দেন। যীশুর কথা দ্বারা নীকদীমের প্রশ্ন উত্তর পায়: এই জন্ম হল পবিত্র আত্মা দ্বারা একটি ঘটনা।
- কিন্তু একই সময়ে যীশু রূপকের উপর আরো রূপক ব্যবহার করেন: ‘নতুন জন্ম’…‘জল এবং পবিত্র আত্মা থেকে জন্ম’…‘বাতাস বয়’।
- হয়তো ‘জল এবং আত্মা থেকে জন্ম’ একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য বুঝায়: নতুন জন্ম উভয় এমন একটি ঘটনা যা মাত্র ঈশ্বর ঘটাতে পারেন (আত্মা থেকে) এবং এমন কিছু যাতে মানুষের ইচ্ছুক মনও প্রয়োজন (জল থেকে); ‘জল’ তাহলে ‘বাপ্তিস্ম’ বুঝায়।
যোহন ৩:৭-৮ “আমি যে আপনাকে বললাম, আপনাদের নতুন করে জন্ম হওয়া দরকার, এতে আশ্চর্য হবেন না। বাতাস যেদিকে ইচ্ছা সেই দিকে বয় আর আপনি তাঁর শব্দ শুনতে পান, কিন্তু কোথা থেকে আসে এবং কোথায়ই বা যায় তা আপনি জানেন না। পবিত্র আত্মা থেকে যাদের জন্ম হয়েছে তাদেরও ঠিক সেই রকম হয়।”
- যীশু পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন যে নীকদীম কিছুই বুঝতে পারেন নি, তাই তিনি বলেন: ‘আশ্চর্য হবেন না’। কিন্তু তারপরেও যীশু ইচ্ছাকৃত ভাবে এর চেয়ে সরাসরি উত্তর বা পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেন না বরং তিনি রূপক ও অবাক লাগার মত কথা যোগ দিতে থাকেন।
যোহন ৩:৯ “নীকদীম যীশুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এ কেমন করে হতে পারে?”
- নীকদীম হারিয়ে গেছেন। তিনি আগের প্রশ্ন আরো সাধারণভাবে আর একবার করেন। তিনি যীশুর কথা উদ্ধৃতি করার সময়ে ‘এ’ ব্যবহার করেন কারণ তিনি আর জানেন না যা বলা হয়েছে তার অর্থ বা বর্ণনা কি।
- কেন যীশু এমনভাবে যোগাযোগ রাখেন? মনে হয় যীশু পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন যে নীকদীম এই মুহূর্তে কিছু বুঝতে পারে না। যীশু তার চিন্তাকে নাড়া দেন, তার মতবাদকে এবং ফরীশীদের উত্তরগুলিকে চ্যালেঞ্জ করেন। যীশু বিশেষভাবে ফরীশীদের সে আত্ম-ধার্মিক ‘সব কিছু জানি’ মনোভাব ভেঙ্গে দেন।
- যীশু নীকদীমকে দেখান যে তার চিন্তার চেয়ে অনেক কিছু আছে, যে একটি শিশুর মত হতে হয় তা বুঝার জন্য, যে আইন আরো পালন করার মানবীয় প্রচেষ্টা ঈশ্বরের রাজ্য নিয়ে আসবে না, ঈশ্বরের আত্মার কাজও ঘটাতে পারে না বরং একটি ফলহীন আত্ম-ধার্মিকতায় নিয়ে যায়। যীশু দেখান: যা প্রয়োজন হল এমন কিছু যা মানুষ ঘটাতে পারে না, যা মানুষ তেমন বর্ণনা করতে পারে না, নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না ও জোর করে নিয়ে আসতেও পারে না, বরং যা দরকার হল একটি ঘটনা, একটি অভিযান, একটি সম্পর্ক।
যোহন ৩:১০-১২ “তখন যীশু তাঁকে বললেন, “আপনি ইস্রায়েলীয়দের শিক্ষক হয়েও কি এই সব বোঝেন না? আপনাকে সত্যিই বলছি, আমরা যা জানি তা-ই বলি এবং যা দেখেছি সেই সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিই, কিন্তু আপনারা আমাদের সাক্ষ্য অগ্রাহ্য করেন। আমি আপনাদের কাছে জাগতিক বিষয়ে কথা বললে যখন বিশ্বাস করেন না তখন স্বর্গীয় বিষয়ে কথা বললে কেমন করে বিশ্বাস করবেন?”
- যীশুর ধমক নির্দিষ্টভাবে নীকদীমের কাছে নয়, বরং সাধারণভাবে ফরীশী ও যিহূদীদের কাছে। মনে হচ্ছে যীশু জানেন যে নীকদীম এই কঠিন উত্তর ও রূপকগুলিতে নিরাসিত হবেন না, বরং তাতে তার মনে আরো প্রকাশ আসবে। যীশু জানেন যে নীকদীম তাঁর প্রকাশ্যে শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করেছেন বলে তিনি অন্যদের চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে এসেছেন।
- যীশু দেখান যে সত্য বুঝা নির্ভর করে ইচ্ছুক মন, ইচ্ছা প্রকাশ, নতুন চিন্তা আসতে দেওয়া, অনিশ্চয়তা সহ্য করা ও অন্বেষণ করার উপর। নীকদীম এগুলি করেছেন, অধিকাংশ ফরীশীরা তা করতে রাজি ছিল না।
- যীশু দাবী করেন যে তিনি ঈশ্বর থেকে সত্য প্রকাশ করছেন। নীকদীম তার প্রথম কথায়ও তাই স্বীকার করেছিলেন।
যোহন ৩: ১৩-১৮ “যিনি স্বর্গে থাকেন এবং স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন সেই মনুষ্যপুত্র ছাড়া আর কেউ স্বর্গে ওঠে নি। মোশি যেমন মরু-এলাকায় সেই সাপকে উঁচুতে তুলেছিলেন তেমনি মনুষ্যপুত্রকেও উঁচুতে তুলতে হবে, যেন যে কেউ তাঁর উপরে বিশ্বাস করে সে অনন্ত জীবন পায়। “ঈশ্বর মানুষকে এত ভালবাসলেন যে, তাঁর একমাত্র পুত্রকে তিনি দান করলেন, যেন যে কেউ সেই পুত্রের উপরে বিশ্বাস করে সে বিনষ্ট না হয় কিন্তু অনন্ত জীবন পায়। ঈশ্বর মানুষকে দোষী প্রমাণ করবার জন্য তাঁর পুত্রকে জগতে পাঠান নি, বরং মানুষ যেন পুত্রের দ্বারা পাপ থেকে উদ্ধার পায় সেইজন্য তিনি তাঁকে পাঠিয়েছেন। যে সেই পুত্রের উপরে বিশ্বাস করে তার কোন বিচার হয় না, কিন্তু যে বিশ্বাস করে না তাকে দোষী বলে আগেই স্থির করা হয়ে গেছে, কারণ সে ঈশ্বরের একমাত্র পুত্রের উপরে বিশ্বাস করে নি।”
- যীশু এখানে ‘ঈশ্বরের সামনে গ্রহণযোগ্যতা’ ও ‘ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক’, ‘পাপ থেকে উদ্ধার’ ও ‘অনন্ত জীবন’, এই সব বিষয়ের নতুন সংজ্ঞা দেন: তা আইন পালনের উপর নির্ভরশীল নয় বরং যে যীশুকে ঈশ্বর পাঠিয়েছেন সে যীশুকে কেন্দ্র করেই পাওয়া যায়।
- যীশুর এই নতুন সংজ্ঞা হল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফরীশীরা তাতে কোনো মতেই রাজি হবে না, উত্তরটি নীকদীমকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলবে। কিন্তু তারপরেও এতে একজন ফরীশীর হৃদয়ে একটি আকর্ষণ আছে, একটি সত্য বাজবে, একটি আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতার আশা ডাকবে: ফরীশীরা ও সবাই তো তা-ই চেয়েছিল, ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কে থাকা।
- যীশু নীকদীমকে উৎসাহিত করেন যেন তিনি প্রশ্ন করতে থাকেন, চিন্তা করতে থাকেন, অন্বেষণ করতে, যেন তিনি বুঝেন যে যা তিনি আগে থেকে জানেন তাতে কোনো উত্তর নেই। যীশু তাকে ঈশ্বরের সাথে নতুন ও গভীর একটি সম্পর্কের প্রস্তাব দেন।
যোহন ৩:১৯-২১ “তাকে দোষী বলে স্থির করা হয়েছে কারণ জগতে আলো এসেছে, কিন্তু মানুষের কাজ মন্দ বলে মানুষ আলোর চেয়ে অন্ধকারকে বেশী ভালবেসেছে। যে কেউ অন্যায় কাজ করতে থাকে সে আলো ঘৃণা করে। তার অন্যায় কাজগুলো প্রকাশ হয়ে পড়বে বলে সে আলোর কাছে আসে না। কিন্তু যে সত্যের পথে চলে সে আলোর কাছে আসে যেন তার কাজগুলো যে ঈশ্বরের ইচ্ছামত করা হয়েছে তা প্রকাশ পায়।”
- যীশু বলেন যে ঈশ্বরের, আলোর এবং যীশুরই অন্বেষণ করা আবশ্যক।
- অনেকে তা বুঝতে পারে না, জ্ঞানের অভাব বা সামাজিক বাধার কারণে নয় বরং অহংকারের কারণে।
- অহংকার, বন্ধ মন, আত্ম-ধার্মিকতা ধরে রাখা, পাপকে লুকানো বা অস্বীকার, এই মনোভাবগুলি যীশুকে অনুসন্ধান করতে বাধা দেয়। দুঃখের বিষয় যে অধিকাংশ ফরীশীদের হৃদয়ে এই বাধাগুলি শক্তিশালী ভাবে কাজ করত।
- যীশু এই বিষয়ে কঠোর সাবধাণবাণী দেন: ‘সব কিছু জানা’, বন্ধ মন, আত্ম-ধার্মিকতা ধরে রাখা, নিজেকে নিয়ে অতি নিশ্চিত হওয়া, আত্মিক নেতারা এক্ষেত্রে দোষী। বরং যা দরকার হল একটি নম্রতা, একটি আকাঙ্ক্ষা, একটি সরলতা, একটি ইচ্ছুক মন, অন্বেষণ, স্বীকার করা, নতুন চিন্তা আসতে দেওয়া, ঈশ্বরের আশ্চর্য পথে রাজি হওয়া: যীশুকে মেনে নেওয়া যা দরকার হল শিশুর মত হয়ে নতুন জন্ম মেনে নেওয়া।
নীকদীম এই আলোচনায় কি সাড়া দিয়েছিলেন?
- যোহন ৩ অধ্যায়ে লেখা নেই নীকদীম যীশুর সাথে এই আলোচনায় কেমন সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা জানি যে নীকদীম অহংকার গিলে খেয়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং যীশুর অন্বেষণ করতে থেকেছেন। সে নম্রতা যার কারণে তিনি প্রথম বার যীশুর কাছে এসেছিলেন সে নম্রতা তাকে পরেও সাহায্য করে সত্যকে অন্বেষণ করতে ও যীশুর পিছনে লেগে থাকতে।
- যখন আত্মিক নেতারা যীশুকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা নেন তখন নীকদীম যীশুর পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলেন ও তাদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে মাথা ঠাণ্ডা করে একটি আইনগত ও ভাল আপত্তি উঠান (যোহন ৭:৪৫-৫২): আদালতে আসামীর কথা ভাল করে না শুনলে এবং তদন্ত করে সত্য জেনে না নিলে কোনো রায় দেওয়া ঠিক হবে না (দ্বিতীয় বিবরণ ১:১৬, ১৯:১৫)।
- যীশুর মৃত্যুর পরে নীকদীম আরিমাথিয়ার যোষেফের সাথে যীশুকে সম্মান দিয়ে কবর দেন। যদিও তারা হতে পারে যীশুর অন্য শিষ্যদের মত হতভম্ব, তারা তাড়াতাড়ি অনুমতি নিয়ে যীশুকে কবর দেন, এমন একটা কাজ যা অন্য ফরীশীদের থেকে সহজে লুকানো যাবে না (যোহন ১৯:৩৮-৩৯)।
- নীকদীমের নাম প্রেরিত পুস্তকে উল্লিখিত নয় কিন্তু প্রেরিত ৬:৭ ও ১৫:৫ পদ বলে যে অনেক পুরোহিত ও ফরীশী যীশুর মৃত্যু পরে বিশ্বাসী হয়ে প্রথম মণ্ডলীতে যোগ দিয়েছিলেন।
- ক্যাথলিক ও পূর্বের অর্থোডক্স মণ্ডলীতে নীকদীমের জীবন সম্বন্ধে আরো গল্প পাওয়া যায় এবং প্রত্যেক বছর ৩১শে আগষ্ট সাধু নীকদীম ও আরিমাথায়ার সাধু যোষেফকে স্মরণ করা হয়।
যীশুর যোগাযোগের ধরণ নিয়ে কিছু চিন্তা
- যীশু বিভিন্ন লোকদের সাথে খুব ভিন্নভাবে কথা বলেন। যীশু লোকদের প্রয়োজন ও চিন্তা জানেন এবং সে অনুসারে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
- যীশু তাঁর সত্যগুলি ভিন্নভাবে প্রকাশ করেন কিন্তু সব সময় তাঁর যোগাযোগ জীবন-দায়ী।
- যীশু প্রত্যেক প্রশ্নে সরাসরি উত্তর দেন না। তিনি সব সময় ‘সব কিছু পরিষ্কারভাবে’ প্রকাশ করেন নি। কোন কিছুর সম্পূর্ণ প্রকাশ (মানে অর্থ) তিনি লোকদের ‘চামচ দিয়ে’ খাইয়ে দেন নি। তিনি লোকদের মতবাদকে নাড়া দেন, তাদের চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করেন, মাঝে মধ্যে তাদের ধমক দেন বা চমক দেওয়ার জন্য কিছু বলেন, এমন কি একটি সীমিত সময় পর্যন্ত লোকদের দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেও ফেলেন।
- তিনি শ্রোতাদের মাথায় এমন ছবি বা কথা ঢুকিয়ে দেন যা তাদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে, তাদের আগের চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করতে থাকে, তাদের জানার আকাঙ্ক্ষাকে বৃদ্ধি করতে থাকে এবং তাদের মনে কাজ করতে থাকে।
- যীশু প্রভাবশালী নেতাদের ভয় পান না। তিনি তাদের উপস্থিতিতে লজ্জা পান না, তিনি তাদের সময় দেন, কিন্তু তাদের বশীভূত হন না। তিনি তাদের খুশি করার জন্য কথা বলেন না, তাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেন না, তাদের জোর করে আলোচনার মধ্যে ধরে রাখতে চেষ্টা করেন না। তিনি ‘একটু সাহায্য’ করার জন্য নিজের কথা পরিবর্তিত করেন না, নিজের কথা আরো গ্রহণযোগ্য করার জন্য ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কথা বলেন না। আমরা একজন উঁচু ব্যক্তির সামনে যেভাবে কথা বলি, যীশু একেবারে সেভাবে করেন না!
- কিন্তু নীকদীম ফরীশী বলে যীশু তাকে তুচ্ছও করেন নি, তার কাছ থেকে নিজেকে আলাদাও করেন নি, তার সাথে আলোচনা অগ্রাহ্যও করেন নি যদিও তিনি জানেন যে অধিকাংশ ফরীশীরা কঠোরভাবে তার বিরুদ্ধে কথা বলে।
- যীশু যে কোনো অন্বেষণকারীকে সময় ও উত্তর দেন, সেই ব্যক্তি যে কোন দলেরই হোক না কেন বা তার যাই প্রয়োজন হোক না কেন। তিনি যে কোনো অন্বেষণকারীকে গুরুত্ব দেন, সম্মানের সঙ্গে তাদের সাথে কথা বলেন এবং মনে করেন যে সে লোক তাঁর কথা বুঝতে পারছে বা আস্তে-আস্তে বুঝবে। যীশু মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেন না: পাপী বা ধার্মিক, পুরুষ বা মহিলা, প্রভাবশালী বা সাধারণ লোক, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত লোক।