যোগাযোগ ১১ – ঈশ্বরের কথা বলার ধরণ: যিরমিয়
- অন্য নবীদের তুলনায় আমরা যিরমিয় সম্বন্ধে অনেক বেশি জানি। কারণ তিনি একজন নবী যিনি তার পুস্তকে শুধুমাত্র ঈশ্বরের বাণী লিখেন নি, বরং তিনি তাতে তার বিভিন্ন পরিস্থিতি, তার আবেগ, তার সন্দেহ, তার অন্তরের দ্বন্দ্ব, তার শারীরিক ও মানসিক কষ্টভোগ, তার একা থাকার নিরাশার কথা (লোকেরা তাকে বুঝে না, পছন্দও করে না), এই সব প্রকাশ করেন।
যিরমিয়ের পরিবার
- যিরমিয়ের বাবার নাম হল হিল্কিয়। যিরমিয় একটি পুরোহিত পরিবারে জন্ম নেন, তাই তিনি লেবীয় বংশের। তার শহর হল বিন্যামিন গোষ্ঠির এলাকার আনাথোত (যির ১:১)।
- দায়ূদের সময়ের পুরোহিত অবিয়াথর, যিনি দায়ূদের ছেলে আদোনিয়কে রাজা হওয়ার বিষয়ে সমর্থন করলেন (১ রাজা ১:৫) এবং যাকে দায়ূদ ফলে নিজের শহরে (আনাথোৎ) ফিরতে বললেন। দায়ূদ তাকে মৃত্যুর শাস্তি পাওয়ার যোগ্য মনে করেন কিন্তু তাকে মেরে ফেলেন না বরং নিজের শহরে নির্বাসিত করেন (১ রাজা ২:২৬)। এতে ভাববাদী শমূয়েল শীলোতে পুরোহিত এলির পরিবারের বিরুদ্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয় (১ রাজা ২:২৭, ১ শমূয়েল ৩:১১-১৪)। যেহেতু যিরমিয়ের শহরও আনাথোৎ হতে পারে তিনি অবিয়াথারের পরিবারে বংশধর।
- যির ৭:১২ পদে যিরমিয় লোকদের বলেন: ‘এখন তোমরা শীলোতে যেখানে আমি প্রথমে আমার বাসস্থান করেছিলাম সেখানে যাও আর আমার লোক ইস্রায়েলীয়দের দুষ্টতার জন্য আমি তার অবস্থা কি করেছি তা দেখ’, তাই তিনি ঐ সময়ে পুরোহিতদের দুর্নীতি স্মরণ করেন … এবং বর্তমানের পুরোহিতেদের দুর্নীতি নিয়ে দোষ ধরেন।
- পুরোহিত পরিবারে জন্ম নেওয়া ছেলে হিসাবে যিরমিয়কে আইন-কানুন, চুক্তি, তাম্বুতে সেবা, উৎসর্গ দান ও পর্বের পালন শেখানো উচিত ছিল। তিনি আসলে শিক্ষা পেয়েছেন কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা নই, কারণ এই সময় যিহূদা দেবতাপূজারী হয়ে গেছে এবং তারা আর জানে না ‘মোশির আইন-কানুন’ বলতে কিছু আছে (যিরমিয়ের ও রাজা যোশিয়ের সময়ে ৬২২ খ্রিঃপূঃ তাম্বুতে পরিষ্কার করার সময় ‘আইন-কানুন’ পুনরায় আবিষ্কার করা হয়, ২ বংশা ৩৪:১৪)। হতে পারে পুরোহিত শিক্ষা হয়ে গেছে ‘ধর্মকর্ম মাত্র’ এবং সেগুলি দেবতাপূজার সাথে মিশ্রিত কিছু।
যিরমিয়ের আহবান ৬২৭ খ্রিঃপূঃ
- তার আহবানের সময়ে যিরমিয় নিজের বিষয়ে বলেন ‘আমি তো ছেলেমানুষ / বালক’ । তার আহবানের সাল হল যোশিয়ের ১৩তম বছর, তাই ৬২৭ খ্রিঃপূঃ। যদি আমরা ধরে নেই যে তার আহবানের সময় যিরমিয় ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে, তবে তার জন্মসাল হবে ৬৪৫-৬৪০ সালের মধ্যে। তাই তিনি জন্ম নেন মন্দ রাজা মনঃশির রাজত্বকালের শেষ দিকে। যিরমিয় তাই ৩-৮ বছর রাজা যোশিয়ের ছোট, যার বয়স ২১ বছর ৬২৭ খ্রিঃপূ।
- ঈশ্বর তাকে বলেন: ‘তোমাকে মায়ের গর্ভে গঠন করবার আগেই আমি তোমাকে বেছে রেখেছি। তোমার জন্মের আগেই আমি তোমাকে আলাদা করে রেখে জাতিদের কাছে নবী হিসাবে নিযুক্ত করেছি’ (যির ১:৫)।
- যির ১:৬ আমরা একজন অল্প বয়সের যিরমিয় পাই, লাজ্জুক, অনভিজ্ঞ ও ভীত। বোধ হয় তিনি তার আহবান শোনে যথেষ্ট ভয় পায় এবং বেশি আগ্রহ বা সাহস প্রকাশ করেন না। হয়তো তার কারণ হল যে তিনি তখন হতবুদ্ধি জ্ঞান হন, অথবা তখন তাতে তার নম্রতার প্রকাশ পায়, অথবা তিনি বুঝতে পারেন যে এই আহবান তার জন্য অনেক কষ্টের হবে ইত্যাদি।
- ঈশ্বর তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য তার কথা শোনেন ও উত্তর দেন, কিন্তু তিনি তাকে ছাড়েন না বরং আহবানকে পুনরায় নিশ্চিত করেন: যিরমিয় আহবান প্রাপ্ত, তিনি আহবান পূর্ণ করবেন, তিনি ঈশ্বরের হাত দিয়ে সৃষ্টি, এই আহবানের জন্য সৃষ্টি ও আলাদা করা লোক (যির ১:৭)।
- ঈশ্বর যিরমিয়ের ভয় বুঝে নিজের উপস্থিতির নিশ্চয়তা দ্বারা তাকে সাহস দেন। তিনি তাকে দুইটি দর্শন দেখান ও তার মুখ স্পর্শ করা দ্বারা তাকে দেখান যে ঈশ্বরের কথা ঠিকই তার মুখে আছে (যির ১:৮)।
- যিরমিয়ের মুখে ঈশ্বরেরই বাক্য। তা সম্মানের বিষয়, কিন্তু পরে যখন অতি কষ্টে পড়ে তা বোঝাস্বরূপও দাঁড়াবে।
- দুইটি দর্শনের একটা হল নিশ্চয়তাদায়ক (যির ১:১১-১২): ঈশ্বর তাঁর বাক্য অবশ্যই পূর্ণ করবেন। অন্য দর্শনটি ভয়ংকর: উত্তর থেকে দুর্যোগ বা বিপর্যয় উত্তর থেকে যিহূদার উপরে আসবে (যির ১:১৩-১৬)।
- শুরু থেকে ঈশ্বর যিরমিয়কে বলেন যে তার বিরুদ্ধে অনেক শক্তিশালী লোত থাকবে: রাজারা, রাজপুত্ররা, পুরোহিতরা এবং সাধারণ লোকেরা। ‘তুমি কোমর বেঁধে দাঁড়াও এবং আমি তোমাকে যা বলতে আদেশ করি তা-ই তুমি তাদের বল। তাদের দেখে তুমি ভেংগে পোড়ো না, যদি পড় তাহলে আমি এমন করব যাতে তাদের সামনে তুমি একেবারে ভেংগে পড়’ (যির ১:১৭)। ঈশ্বরের এই কথা উভয় সাবধাণবাণী ও হুমকি, এবং সান্ত্বনাদায়ক কিছু নয়। কেন ঈশ্বর তা বলেন? ঈশ্বর নিশ্চয়তা দেন যে তিনি থেকে যিরমিয়কে সমর্থন করবেন ও সুরক্ষা দেবেন, কিন্তু যিরমিয়কেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়: সাহস করে ঈশ্বরের সাহায্যের উপর নির্ভর করা। সারা যিরমিয় পুস্তক ধরে আমরা এইটা দেখতে থাকব: যখন যিরমিয়ের দুঃখ, নিরাশা বা ভয় লাগে, ঈশ্বর মায়া-দয়ার চেয়ে তাকে আরো চ্যালেঞ্জ দেবেন।
রাজা যোশিয়ের পুনঃসংস্কারের সময় যিরমিয় ৬২৭-৬০৯ খ্রিঃপূঃ
- যিরমিয়কে যখন ঈশ্বরের আদেশে যিহূদাকে ধ্বংসবাণী দিতে হয়, যিহূদা তাকে অনেক কষ্ট দেওয়ার পরেও তার মধ্যে কোনো প্রতিশোধ নেওয়ার মনোভাব দেখা যায় না বরং তিনি যিহূদার ধ্বংস শুনে কান্না করেন: ‘হায়, আমার অন্তর, আমার অন্তর! আমি যন্ত্রণায় মোচড় খাচ্ছি। হায়, আমার অন্তর! আমার ভিতরে আমার অন্তর ধুক্ ধুক্ করছে। আমি চুপ করে থাকতে পারছি না, কারণ আমি তূরীর শব্দ শুনেছি, আমি যুদ্ধের হাঁক শুনেছি’ (যির ৪:১৯-২১)।
- ‘সদাপ্রভু যিরমিয়কে উপাসনা-ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে এই খবর ঘোষণা করতে বললেন যে, যিহূদার যে সমস্ত লোক এই দরজাগুলো দিয়ে সদাপ্রভুর উপাসনা করবার জন্য ঢোকে তারা যেন সদাপ্রভুর বাক্য শোনে’ (যির ৭:২)। যিরমিয়কে এখানে সবার সামনে কথা বলতে হয় ও ‘ধার্মিকদের’ চ্যালেঞ্জ করতে হয়, যাতে তারা অপমান বোধ করবে। মূল সংবাদ হল: ধার্মিকতার উপর মিথ্যা নির্ভরতার চেয়ে আসলে মন ফিরাও! এই কথা কেউ শুনতে চাইবে না।
- যির ৭:১৬ পদে ঈশ্বর যিরমিয়কে বলেন: ‘এই লোকদের জন্য তুমি কোন প্রার্র্থনা কোরো না, কিম্বা তাদের জন্য কান্নাকাটি বা কোন বিশেষ অনুরোধ কোরো না…কারণ আমি তোমার কথা শুনব না’। ঈশ্বরের আর প্রার্থনা না শোনার কারণ হল যে তারা গভীর ভাবে দেবতাপূজায় যুক্ত (‘আকাশ-রাণীর পূজা’)।
- যির ৭:২৯ যিরমিয়কে আদেশ দেওয়া হয় ‘তোমার চুল কেটে তুমি দূরে ফেলে দাও; গাছপালাহীন পাহাড়ে পাহাড়ে বিলাপ কর’। ঈশ্বর বার বার কথা বলেছিলেন কিন্তু যিহূদা তাঁর কথা কোনো রকম শুনতে রাজি না।
- যিরমিয়ের যখন দেশের, রাজাদের, পুরোহিতদের, মিথ্যা ভাববাদীদের ও সাধারণ লোকদের ধ্বংসবাণী দিতে হয় তিনি কান্না করে বলেন (যির ৮:১৮-২১): ‘আমার দুঃখ এত বেশী যে, তার সান্ত্বনা নেই; আমার মধ্যে আমার অন্তর ভীষণ দুঃখ পাচ্ছে।…আমার লোকেরা ভেংগে পড়েছে বলে আমিও ভেংগে পড়েছি; আমি শোক করছি আর ভীষণ ভয় আমাকে ধরেছে’। ঈশ্বরের ধ্বংসবাণী শুনে লোকদের যে আবেগ ও সাড়া থাকা উচিত, যিরমিয়ের তা আছে, কিন্তু লোকেরা এভাবে সাড়া দেয় না। যিরমিয় তাদের জন্য দুঃখ করেন, কিন্তু তারা তার কথা অস্বীকার করে।
- যির ৯:১-২ পদে যিরমিয় বলেন: ‘হায়, আমার মাথাটা যদি জলের ঝরণা হত, আর আমার চোখ হত জলের ফোয়ারা! তাহলে আমার জাতির যে লোকদের মেরে ফেলা হয়েছে তাদের জন্য আমি দিনরাত কাঁদতাম। হায়, মরু-এলাকায় যাত্রীদের থাকবার জায়গার মত আমার যদি একটা জায়গা থাকত! তাহলে আমার লোকদের ছেড়ে আমি সেখানে চলে যেতে পারতাম’।
- যির ১০:২৩-২৫ পদে যিরমিয়কে যিহূদার বিরুদ্ধে বাবিলীয়দের আক্রমনের ভবিষ্যদ্বাণী দিতে হয় (আবারও দেবতাপূজার কারণে), তিনি বলেন ‘হে সদাপ্রভু, কেবল ন্যায়বিচার দিয়ে তুমি আমাকে সংশোধন কর…যে সব জাতি তোমাকে স্বীকার করে না, যারা তোমাকে ডাকে না, তাদের উপর তোমার ক্রোধ ঢেলে দাও’। যদিও তার নিজের জাতি তার প্রতি অনেক খারাপ, এমন কি হিংস্র ব্যবহার করে, তিনি তাদের মঙ্গল চাইতে থাকেন এবং নিজেকে তাদের একজন মনে করতে থাকে।
- যির ১১:১৪-১৭ পদে ঈশ্বর যিরমিয়কে আবারও বলেন: ‘এই লোকদের জন্য তুমি কোন প্রার্থনা কোরো না কিম্বা তাদের জন্য কোন মিনতি বা অনুরোধ কোরো না…আমি শুনব না’। তাতে বুঝা যায় যে সব কিছুর পরেও যিরমিয় ঠিকই যিহূদার জন্য বিনতী করে এসেছেন।
- যির ১১:১৮-২১ পদে প্রকাশ পায় যে যিরমিয়ের আপন পরিবার তাকে মেরে ফেলার জন্য পরিকল্পনা নিচ্ছে। তিনি নিজেকে ‘জবাই করতে নিয়ে যাওয়া শান্ত ভেড়ার বাচ্চা বলেন। যিরমিয় এই প্রেক্ষাপটে নিজেকে ঈশ্বরের উপর ফেলে দিয়ে তাঁর সুরক্ষার উপর নির্ভর করেন। তিনি অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়াও ঈশ্বরের হাতে সমর্পিত করেন।
- যিরমিয় ঈশ্বরের কাছে অভিযোগ করেন (যির ১২:১-৪): ‘হে সদাপ্রভু, আমি যখন তোমার বিরুদ্ধে কোন নালিশ করি তখন তুমি যে নির্দোষ তা সব সময়ই প্রমাণিত হয়। তবুও আমি তোমার বিচার সম্বন্ধে তোমার সংগে কিছু কথা বলব। দুষ্টদের পথ কেন ভাল হয়?…হে সদাপ্রভু, তুমি আমাকে জান; তুমি আমাকে দেখে থাক এবং তোমার প্রতি আমার ভক্তি কতখানি তা পরীক্ষা করে থাক।…আর কত দিন দেশ শোক করবে?’।যিরমিয় এখানে সৎ-সরলভাবে প্রার্থনা করেন, তার মনের কষ্ট ও ক্ষোভ ঈশ্বরের কাছে ঢেলে দেন। কিন্তু তা করার মধ্যেও তিনি ঈশ্বরের মহত্ব স্বীকার করেন, ঈশ্বরকে তার কেন্দ্র হিসাবে ধরে রাখেন ও তাঁরই দিকে তাকাতে থাকেন, যেমন ইয়োবও করতেন।
- যেমন আমরা মনে করতাম ঈশ্বর উত্তর দিবেন, সেভাবে তিনি উত্তর দেন না (যির ১২:৫): ‘মানুষের সংগে দৌড় প্রতিযোগিতায় যদি তুমি ক্লান্ত হয়ে পড় তবে ঘোড়াদের সংগে দৌড়ে তুমি কি করে পারবে? কেবল শান্তিপূর্ণ দেশে যদি তুমি নিজেকে নিরাপদ মনে কর তাহলে যর্দনের ধারের জংগলে তুমি কি করে থাকবে?’… ঈশ্বর যিরমিয়কে ‘বেচারার’ মত কথা বলেন না, তাকে তেমন দয়া-মায়াও করেন না, বরং তিনি তাকে আরো বেশি করে ও আরো বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেন।

- যির ১২:৬ পদে ঈশ্বর যিরমিয়কে সরাসরি বলেন যে তার আপন পরিবার তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ষড়যন্ত্র করে: ‘তোমার ভাইয়েরা, অর্থাৎ তোমার বংশের নিজের লোকেরা তোমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে; তারাও তোমার পিছনে লেগেছে। তোমার বিষয় ভাল কথা বললেও তাদের বিশ্বাস কোরো না’। আবারও ঈশ্বর সম্পূর্ণ বাস্তব ও সত্য কথা বলেন, তা কষ্টের বিষয় হলেও। তিনি যিরমিয়ের কষ্ট, সংকট ও তার জীবনের বিরুদ্ধে হুমকি সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করেন।
- ঈশ্বর যখন যিরমিয়ের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন (যির ১২:৭-৮) বোধ হয় যে ঈশ্বর তাঁর নিজের কষ্ট, সংকট ও দুঃখ প্রকাশ করেন। বোধ হয় যিরমিয়কে ‘বেশি সান্ত্বনা’ না দিয়ে ঈশ্বর নিজের কষ্টে ব্যস্ত – তা কেমন লাগে? ঈশ্বর কি যিরমিয়ের প্রতি দয়ালু নন? হয়তো তাতে যিরমিয়ের আরো বড় সম্মান প্রকাশিত: ঈশ্বর তার কষ্ট বুঝেন ও তার সঙ্গে বসে তাঁরই কষ্ট সম্বন্ধে শেয়ার করেন। ঈশ্বর এমন একজনের সাথে তাঁর হৃদয় শেয়ার করেন, যিনি তাঁর কষ্ট বুঝেন ও যার একই আবেগও আছেন। এতে যিরমিয় সান্ত্বনা পাবেন, এবং এতে যিরমিয়ের আহবান আরো পরিষ্কার হয়ে যায়: ঈশ্বরের কষ্ট বোঝা, ঈশ্বরের হৃদয়কে প্রকাশ করা।
- পরের পদের কথা এমন যে বুঝা যায় তা কি ঈশ্বরের কথা বা কি যিরমিয় তা বলেন, যিনি ঈশ্বরের হৃদয়ের অংশীদার হয়ে গেছেন (যির ১৩:১৭): ‘তোমরা যদি কথা না শোন তবে তোমাদের অহংকারের জন্য আমি গোপনে কাঁদব, ভীষণভাবে কাঁদব ও আমার চোখ জলে ভেসে যাবে, কারণ সদাপ্রভুর লোকদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হবে’। তা হল অনিচ্ছুক মানুষদের জন্যই কান্না।
- যখন একটি দুর্ভিক্ষ ঘটে যিরমিয় ঈশ্বরের কাছে কান্না করেন (যির ১৪:১-১০) ‘হে সদাপ্রভু, তুমি আমাদের মধ্যেই আছ আর আমরা তো তোমারই; তুমি আমাদের ত্যাগ কোরো না’।
- যির ১৪:১১-১২ পদে এমন কি তৃতীয় বার (!) ঈশ্বর যিরমিয়কে বিনতী করতে নিষেধ করেন: ‘তুমি এই লোকদের মংগলের জন্য প্রার্থনা কোরো না…আমি তা গ্রহণ করব না’ । লোকদের থেকে অনেক কষ্ট পাওয়ার পরেও এবং ঈশ্বর দুইবার নিষেধ করার পরেও যিরমিয় লোকদের জন্য বিনতী করেন! তিনি লোকদের খারাপ ব্যবহারের জন্য ঈশ্বরকে কারণ বা অজুহাত দেখান (যির ১৪:১৩-১৬): লোকেরা সাড়া দেয় না কারণ মিথ্যা ভাববাদীরা তাদেরকে প্রতারণায় ফেলেছে। ঈশ্বর উত্তরে বলেন যে তিনি মিথ্যা ভাববাদীদের অবশ্যই ‘যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ বা মড়ক’ দ্বারা ধ্বংস করবেন। যদিও লোক দুর্ভিক্ষে অর্ধেক মনের অনুতাপ দেখায় ঈশ্বর তা মানবে না (যির ১৫:১-৩): ‘মোশি ও শমূয়েলও যদি আমার সামনে এসে দাঁড়ায় তবুও আমার অন্তর এই লোকদের জন্য নরম হবে না’।
- ঈশ্বর এখানে যিরমিয়কে অনুমোদন করেন বা তাকে সম্মান দেন: ঈশ্বর বিনতী শুনবেন না, তার কারণ এই নয় যে যিরমিয়ের বিনতী যথেষ্ট নয় বরং লোকদের খারাপ মনোভাবের জন্য। ঈশ্বর যিরমিয় এখানে মোশি ও শমূয়েলের সাথে রাখেন, তাতে যিরমিয় যে ভূমিকা পালন করে, তা প্রশংসিত হয়। ঈশ্বর পরিষ্কারভাবে বলেন যে যিরমিয়ের পরিচর্যা যে বেশি ফল দেখা দেয় না (কেউ মন ফিরায় না), তা যিরমিয়ের দোষ না।
- যিরমিয় আবারও অভিযোগ করেন (যির ১৫:১০): ‘হায়! হায়! মা আমার, তুমি কেন আমাকে জন্ম দিয়েছ, যার সংগে গোটা দেশটা ঝগড়া ও লড়াই করে? আমি ধার দিই নি কিম্বা কেউ আমাকে ধারও দেয় নি, তবুও প্রত্যেকে আমাকে অভিশাপ দেয়’।
- যির ১৫:১১-১২ পদে ঈশ্বর যিরমিয়কে নিশ্চয়তা দেন: ‘একটা মংগলের উদ্দেশ্যে আমি নিশ্চয় তোমাকে রেহাই দেব’, । আবারও ঈশ্বর মায়া-দয়া করেন না, বরং তাকে স্মরণ করিয়ে দেন যাও সত্য: হ্যাঁ, যিরমিয়ের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, কিন্তু তারপরেও ঈশ্বর রেহাই দিচ্ছেন।
- যির ১৫:১৩-১৮ পদে যিরমিয় কান্না করে বলেন: ‘হে সদাপ্রভু, তুমি তো সবই বুঝতে পার; কাজেই আমার কথা স্মরণ কর ও আমার প্রতি মনোযোগ দাও। আমার অত্যাচারীদের উপর তুমিই প্রতিশোধ নাও।…তোমার জন্য কেমন টিট্কারি সহ্য করছি। তোমার বাক্য প্রকাশিত হলে পর আমি তা অন্তরে গ্রহণ করলাম; সেই বাক্য ছিল আমার আনন্দ ও আমার অন্তরের সুখ, কারণ হে সর্বক্ষমতার অধিকারী ঈশ্বর সদাপ্রভু, আমি তো তোমারই।…তোমার হাত আমার উপরে ছিল বলে আমি একাই বসে থাকতাম আর তুমি আমাকে রাগে পরিপূর্ণ করেছ। কেন আমার ব্যথার শেষ নেই, কেন আমার ঘা ভাল হয় না, কেন তা সারানো যায় না? তুমি কি আমার কাছে মিথ্যা স্রোত ও অস্থায়ী ফোয়ারার জলের মত হবে?’ । যিরমিয়ের কথায় কষ্ট, প্রতিশোধ নেওয়া, আত্ম-রক্ষা ও অভিযোগ সব মিশানো আছে। তিনি তার অন্তর ঢেলে দেন, এবং আমরা তার আবেগ ও কষ্ট ভালভাবে বুঝতে পারি।
- কিন্তু আবারও ঈশ্বরের উত্তর দয়া-মায়ার কোনো উত্তর নয়, বরং আরো চ্যালেঞ্জ (যির ১৫:১৯-২১): ‘তুমি যদি মন ফিরাও তবে আমি তোমাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনব যাতে তুমি আমার সেবা করতে পার; যদি তুমি বাজে কথা না বলে মূল্যবান কথা বল তবে তুমি আমার মুখ হয়ে কথা বলবে।…এই লোকদের কাছে আমি তোমাকে ব্রোঞ্জের একটা শক্তিশালী দেয়ালের মত করব; তারা তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে কিন্তু তোমাকে হারিয়ে দিতে পারবে না, কারণ আমি সদাপ্রভু বলছি যে, তোমাকে উদ্ধার করতে ও বাঁচাতে আমি তোমার সংগে সংগে থাকব’। ঈশ্বর তাকে অনুতপ্ত হতে চ্যালেঞ্জ করেন, তাকে ক্ষমার ও সুরক্ষার নিশ্চয়তাও দেন এবং তাকে তার আহবানের পুনরায় নিশ্চয়তা দেন: ‘তুমি আমার সাক্ষাতে দাঁড়াইবে’ (কেরী)। আবারও ঈশ্বর সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করেন যে যিরমিয়ের বিরুদ্ধে অত্যাচার চলছে: ঈশ্বর তাকে তাঁর শক্তিশালী হাত দিয়ে সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেন, যেমন তার প্রথম আহবানেও করেছিলেন (যির ১:৪-১৯)।
- যির ১৬:১-৪ পদে ঈশ্বর চ্যালেঞ্জের উপরে চ্যালেঞ্জ দেন: যিরমিয় বিয়ে করতে পারবে না এবং তার কখনও ছেলে-মেয়ে হবে না। ঈশ্বর ইচ্ছাকৃতভাবে যত মানবীয় সান্ত্বনা থাকতে পারে ততটা সরিয়ে দেন। এইটা কি যিরমিয় ১৫ অধ্যায়ের যিরমিয়ের কষ্টের উপযুক্ত উত্তর? এই ধরণের আহবান পেলে কি রাজি হতাম? আমি কি ঈশ্বরের উপরে শর্ত বিস্তার করি তিনি কি চাইতে পারেন এবং কি চাইতে পারেন না?
- কেউ কেউ বলেন যে বাইবেলে ভাববাদী যিহিষ্কেল কখনও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন নি, কিন্তু যিরমিয় তা করতে থাকে। তাই উপসংহারে বলা হয় যে যিহিষ্কেল তার আহবানে বিশ্বস্ত, যিরমিয় ঈশ্বরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে আছেন। কিন্তু সাবধান! যিরমিয় হয়তো অন্যদের চেয়ে সৎ এবং ইচ্ছুক, তার অন্তরের সংগ্রাম শেয়ার করতে। সহজে বিচার করবেন না। কখনও আর একজনের চ্যালেঞ্জ ছোট মনে করবেন না। যিরমিয়ের আহবান কঠিন।
- ঈশ্বর যিরমিয়কে আদেশ দেন (যির ১৬:৫-৮): ‘যে বাড়ীতে লোকে শোক করে সেই বাড়ীতে ঢুকো না…ভোজের বাড়ীতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করতে বোসো না’। যিরমিয় ইতিমধ্যে এই ধরণের জীবন-যাপনের অভিজ্ঞতা হয়েছে ও তিনি তা নিয়ে তার কষ্ট প্রকাশ করেছেন (যির ১৫:১৭): ‘যারা হৈ হুল্লোড় করে মদ খায় আমি কখনও তাদের দলে বসি নি, তাদের সংগে কখনও আনন্দ করি নি; তোমার হাত আমার উপরে ছিল বলে আমি একাই বসে থাকতাম আর তুমি আমাকে রাগে পরিপূর্ণ করেছ’, । বলা যায় যে তিনি এই পরীক্ষায়, এই কষ্টের ইতিমধ্যে ভাগী হয়েছে, হয়তো ঈশ্বর সেকারণে তাকে এই কঠিন আহবান দিতে পেরেছেন।
- যিরমিয় যে কোনো বিবাহের বা দাফন দেওয়ার অনুস্থানে অংশ গ্রহণ করতে পারবেন না, তা হল লোকদের জন্য একটি নাটকীয় চিহ্ন বা সংবাদ: শীঘ্রই ধ্বংস ও মৃত্যু আসবে, লোকেরা নিজের পছন্দ মত জীবন-যাপন করার স্বাধীনতা হারাবে। যিরমিয় কেবল মাত্র সংবাদ বলেন না, তার জীবনই হয়ে গেছে সংবাদ।
- যির ১৭:১৪-১৮ যিরমিয় প্রকাশ করেন লোকেরা ঈশ্বরের দয়া (বিচার করতে দেরী করেন) হাস্যকর বানায়: ‘দেখ, তারা আমাকে বলতে থাকে, ‘সদাপ্রভুর বাক্য কোথায়? এখন তা পূর্ণ হোক’। যিরমিয় তা শুনে প্রতিশোধ বা অমঙ্গলের দাবী করেন না বরং তিনি বলেন:‘হে সদাপ্রভু, আমাকে সুস্থ কর, তাতে আমি সুস্থ হব; আমাকে উদ্ধার কর, তাতে আমি উদ্ধার পাব…তোমার লোকদের পালক হওয়া থেকে আমি তো পালিয়ে যাই নি; তুমি জান আমি বিপদের দিন চাই নি। আমার মুখ থেকে যা বের হয় তা তোমার কাছ থেকে লুকানো নেই।…আমার অত্যাচারীদের লজ্জায় ফেলা হোক, কিন্তু তুমি আমাকে লজ্জা থেকে রক্ষা কর’। যিরমিয় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের উপরে ফেলে দেন, তিনি সহজে অপমানিত হন না, তিনি মাত্র এমন সম্মান চান, যা ঈশ্বর তাকে দেন। তিনি তার দুর্বলতা ও বিপদ জানেন এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে সাহায্য ও সুস্থতা যাঞ্না করেন। তিনি ঈশ্বরের মত হৃদয়ে বিচার বা প্রতিশোধ চান না (যদিও তিনি শত্রুদের উপর প্রতিফল আসার জন্য প্রার্থনা করেন), তিনি বিচারে আনন্দ পান না।
- যির ১৮:১৮-২৩ পদে বর্ণনা করা আছে কিভাবে লোকেরা যিরমিয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তার উপর দোষ চাপিয়ে দিতে চায়। তিনি কান্না করে বলেন: ‘ভালোর শোধ কি মন্দ দিয়ে করা হবে?…মনে করে দেখ, তোমার ক্রোধ যাতে তাদের উপর থেকে ফিরে যায় সেইজন্য আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে তাদের পক্ষ হয়ে কথা বলেছি…তাদের পুরুষ লোকেরা মড়কে মারা যাক, আর যুদ্ধে তলোয়ারের আঘাতে তাদের যুবকেরা কাটা পড়ুক…আমাকে মেরে ফেলবার জন্য এই সব ষড়যন্ত্রের কথা তো তুমি জান। তাদের এই অন্যায় তুমি ক্ষমা কোরো না’ কিন্তু সব কথার মাঝে তিনি আবারও নিজেকে ঈশ্বরের উপর ফেলে দেন। ঈশ্বর ছাড়া তার কোনো সুরক্ষা বা আশ্রয় নেই।
- তোফট নামক একটি পূজার স্থানে একটি নাটকীয় চিহ্ন নির্ধারণ করার পরে (মাটির পাত্র ভাঙ্গা) যিরমিয় সে স্থানে ছেলে-মেয়েকে পূজায় উৎসর্গ করা ও আকাশের রাণীর পূজার বিরুদ্ধে কথা বলেন (যির ১০:১-৯)। তা করার কারণে মন্দিরের প্রধান কর্মচারী পশহূর যিরমিয়ের শত্রু হয়ে যায়, তাকে মারধর করে, তাকে আটকিয়ে সারা রাত হাড়িকাঠে বন্ধ করে রাখে এবং মাত্র পরের সকালে তাকে ছেড়ে দেন। এই গল্প থেকে বুঝা যায় সে সময়ের পুরোহিতরাও কত বেশি দেবতাপূজায় লিপ্ত ছিল অথবা কত বেশি সদাপ্রভুর আরাধনা ও দেবতাপূজা মিশে গেছে। যেহেতু যিরমিয় পুরোহিত পরিবারের ছেলে, এভাবে পুরোহিতদের বিরুদ্ধে কথা বলা তার জন্য কত কষ্টের বিষয় ছিল, পশহূর অবশ্যই ছিল যিরমিয়ের চেয়ে বয়স্ক ও সম্মানিত লোক।
- যিরমিয় অভিযোগ করেন (যির ২০:৭-১৮):‘হে সদাপ্রভু, তুমি আমাকে ভুলিয়েছ বলে আমার এই অবস্থা হয়েছে; তুমি আমার চেয়ে শক্তিশালী বলে তুমি জয়ী হয়েছ। আমি সারা দিন ঠাট্টার পাত্র হয়েছি… কাজেই সদাপ্রভুর বাক্যের জন্য সারা দিন আমাকে অপমান ও ভীষণ নিন্দা করা হয়। কিন্তু যদি আমি বলি, ‘আমি… আর কিছু বলব না,’ তবে তাঁর কথা আমার অন্তরে যেন জ্বলন্ত আগুন হয়ে হাড়ের মধ্যে বন্ধ হয়ে থাকে…সত্যিই আমি আর তা ভিতরে রাখতে পারি না।… আমার সমস্ত বন্ধুরা এই বলে আমার পিছ্লে পড়বার অপেক্ষায় আছে… কিন্তু সদাপ্রভু শক্তিশালী যোদ্ধার মত আমার সংগে সংগে আছেন… তুমি তো সৎ লোকদের পরীক্ষা করে থাক এবং প্রত্যেকের অন্তর ও মনের কথা জান। আমার শত্রুদের উপর তোমার প্রতিশোধ নেওয়া আমাকে দেখতে দাও… তোমরা সদাপ্রভুর উদ্দেশে গান কর… তিনি দুষ্টদের হাত থেকে অভাবীদের প্রাণ উদ্ধার করেন… আমি যেদিন জন্মেছিলাম সেই দিনটা অভিশপ্ত হোক…কষ্ট আর দুঃখ দেখবার জন্য এবং লজ্জায় আমার জীবন কাটাবার জন্য কেন আমি গর্ভ থেকে বের হয়ে আসলাম?… কষ্ট আর দুঃখ দেখবার জন্য এবং লজ্জায় আমার জীবন কাটাবার জন্য কেন আমি গর্ভ থেকে বের হয়ে আসলাম?
- যিরমিয় এখানে তার অন্তরের কষ্ট, আবেগ ও চিন্তা বলে ফেলেন। কথাগুলির মধ্যে অভিযোগ, ঈশ্বরকে দোষারোপ, দুঃখ, ভয়, ঈশ্বরকে স্বীকার, উদ্ধারের জন্য কৃতজ্ঞতা ও ক্ষোভ সব মিশানো আছে। যিরমিয় এখানে ছেঁকে কথা বলেন না বরং ভিতরের কষ্ট, যন্ত্রণা, অন্তরে যা আছে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে দেন।
- কেউ কেউ বলে: কি করে সম্ভব যে যিরমিয় এই ধরণের লজ্জাহীন বা ভক্তিহীন কথা বলে ফেলেন (ও লিখিত রাখেন)। কিন্তু তাকে বিচার করতে সাবধান: তিনি সম্পূর্ণ সৎ হয়ে, নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের উপরে ফেলে দেন ও তাকে তার জীবনের কেন্দ্র হিসাবে ধরে রাখতে থাকেন। হ্যাঁ তার অনেক খারাপ লাগে, খোপ ও বিরক্তও লাগে, কিন্তু তা ঢেলে দেওয়া দ্বারা তিনি ঈশ্বরের অনবরত বিশ্বস্ততা ধরে রাখতে থাকেন। তিনি ঈশ্বর থেকে আলাদা হন না: ‘এভাবে যদি হয়, তবে ঈশ্বরের ভক্ত জীবন আর করব না!’ বরং তিনি তাঁর এবং কেবলমাত্র তাঁর উপরে আশা রাখতে থাকেন। যদি মনে করেন যিরমিয়ের কথা উপযুক্ত নয়, হয়তো আপনি এখনও তার কষ্ট ও তার বিশ্বস্ততা বুঝেন নি।
যিহূদার শেষ রাজা সিদিকিয়ের সময়ে যিরমিয় ৫৯৭-৫৮৬ খ্রিঃপূঃ
- যির ২৬:২০-২৩ পদে উরিয় নামে একজন ভাববাদী ঠিক যিরমিয়ের মত ভাববাণী দিতে শুরু করেন। লোকেরা উরিয়কে জীবনের হুমকি দেন ও তিনি মিসরে পালিয়ে যান। রাজা যিহোয়াকীম তার পিছনে লোক পাঠান এবং তাকে যিহূদায় এনে মেরে ফেলা হয়। যিরমিয়ের এই গল্প শুনে কেমন লাগত? অবশেষে তার মত একজন পাওয়া যায়, একজন যিনি বুঝেন। এবং অল্পক্ষণের মধ্যে তাকে হত্যা করা হয়।
- যির ২৮:১-১৭ পদে হননিয় নামে একজন ভ্রান্ত ভাববাদী মন্দিরে পুরোহিতদের এবং সবার সামনে যিরমিয়ের বিরুদ্ধে বলতে শুরু করেন যে বাবিলের ক্ষমতা ২ বছরের মধ্যে ভেঙ্গে যাবে এবং যিহোয়াখীন ও মন্দিরের জিনিস-পত্র ফিরে আসবে। যিরমিয় উত্তরে বলেন যে সত্য কি তা প্রমানিত হবে যখন ভাববাণী পূর্ণ হয়। তা তিনি দ্বিতীয় বিবরণের কথা অনুসারে বলেন। হননিয় যিরমিয়ের ঘাড়ে চোয়াল ভেঙ্গে দেন এবং যিরমিয়ের কথার বিপরীত দাবী করেন। যিরমিয় জায়গা ছেড়ে চলে যান। একটু পরে তিনি ভাববাণী দেন যে হননিয় এই বছরের মধ্যে মারা যাবে। মোশির আইন অনুসারে ভ্রান্ত ভাববাদী মৃত্যু শাস্তির যোগ্য (দ্বিতীয় বিবরণ ১৩:১-৫)। যিরমিয়ের কথার তিন মাসের মধ্যে হননিয় মারা যায়।

- এখানে দেখা যায় ‘ভাববাদীদের লড়াই’। খেয়াল করুন যে যিরমিয় (যদিও তা দ্বিতীয় বিবরণ অনুসারে ঠিক হত) সাথে সাথে কোনো মৃত্যুবাণী দেন না। কেবল মাত্র পরে, ঈশ্বর যখন তাকে বলেন, তিনি হননিয়ের মৃত্যুবাণী ঘোষণা করেন।
- লোকেরা যদি সত্য জানার আগ্রহী, তারা ভাববাদীরা লড়াই করলেও তা জানতে পারে। এখানে ঈশ্বর যিরমিয়কে এবং তার ভাববাণীকে সত্য হিসাবে প্রমাণিত করেন। লোকেরা যে এই ভাববাদীর লড়াইয়ের কারণে প্রতারিত হবে, তা না। ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশিত করেন। লোকদের সমস্যা এই নয় যে তারা সত্য জানে না, সমস্যা হল যে তারা সত্যি ভাববাণী পাওয়ার পরেও অনুতপ্ত হতে চায় না।
- যখন প্রথম বার যিরূশালেমকে পরাজিত করে এবং অনেক লোকদের বাবিলের নির্বাসনে নিয়ে যাওয়া হয়, যিরমিয় এই নির্বাসিত যিহূদী, পুরোহিত ও ভাববাদীদের কাছে একটি চিঠি লিখেন (যির ২৯:১-২৩)। তার মূল কথা হল নিশ্চয়তা দান: এমন না যে যিরূশালেমে থাকা যিহূদীদের চেয়ে নির্বাসিত যিহূদীদের উপরে ঈশ্বরের ক্রোধ বেশি। আসলে বিপরীত কথা: যিরূশালেমের যিহূদীরা হল ‘খারাপ ডুমুর’ এবং তাদেরও শীঘ্রই নির্বাসিত করা হবে।
- তিনি নির্বাসিত যিহূদীদের আশাবাণী দেন: তোমরা ঘর তৈরি কর, বাগান লাগাও, বিয়ে কর, বাচ্চা নাও এবং যে শহরে বাস কর তার মঙ্গল চাও। ৭০ বছরের পরে (কিন্তু এর আগে না!) ঈশ্বর যিহূদীদের মঙ্গল করবেন এবং তাদের বাবিল থেকে নিজের দেশে ফিরে নিয়ে আসবেন।
- যিরমিয়কে যদিও অনেক ধ্বংসবাণী দিতে হয়, তিনি যতদূর সম্ভব স্বক্রিয়ভাবে গঠনের কাজও করেন, যেমন ঈশ্বর তার আহবানের সময়েও বলেছিলেন (যির ১:১০)। যিরমিয় লোকদের প্রয়োজন (এখানে নির্বাসিতদের প্রয়োজন) বোঝেন ও মেটান, এমন একটি সময়ে যখন কেউ তাকে বোঝে না ও তার প্রয়োজন মেটায় না।
- ভাববাদী সমিয় নির্বাসন থেকে যিরূশালেমে পুরোহিত সফনিয়কে একটি চিঠি লিখেন এবং তাকে যিরমিয়ের মুখ বন্ধ করতে বলেন। হতে পারে তা যিরমিয়ের জন্য দ্বিগুণ নিরাশার বিষয়, আবারও তার বিরুদ্ধে কাজ করা হয় কিন্তু এইবার এমন একজন যে নির্বাসনে আছে, যে যিরমিয়ের ভবিষ্যদ্বাণী নিজের চোখে পূর্ণ হতে দেখেছেন! বাবিলেও লোকদের মধ্যে প্রতারণা চলতে থাকে এবং সেখান থেকেও যিরমিয়কে অত্যাচার করা হচ্ছে, যদিও তিনি ভাল মনোভাবে তাদের ঈশ্বরের বাণী পাঠিয়েছিলেন (যির ২৯:২৪-৩২)।
- যির ৩০:১-৩ পদে ঈশ্বর যিরমিয়কে আদেশ দেন তিনি যত কথা তাকে বলেছেন, তা সব লিখিত রাখতে কারণ ঈশ্বর সে ভবিষ্যদ্বাণী ও উদ্ধারবাণী অবশ্যই পূর্ণ করবেন। ঈশ্বর যিরমিয়ের পরিচর্যাকে অনুমোদন ও গুরুত্ব দেন যদিও কেউ তার কথা শুনতে চায় না। ঈশ্বরের বাণী, ঈশ্বরের বাক্য, ঈশ্বরের দৃষ্টি ও ঈশ্বরের উদ্ধারের প্রতিজ্ঞা সুরক্ষিত রাখা আবশ্যক যেন পরের যুগের যিহূদীরা তা জানবে এবং ইতিহাসে ঈশ্বরের কাজ বুঝবে। যিরমিয় নির্বাসিত যিহূদীদের (এবং নির্বাসনে জন্ম নেওয়া পরবর্তী প্রজন্ম) প্রয়োজন বোঝেন এবং তা মেটানোর জন্য বিশ্বস্তভাবে কাজ করেন যেন পরের লোকেরাও জানবে: উদ্ধার আসবে। অবশেষে যিরমিয় আশার কথা ঘোষণা করতে পারেন।
- যির ৩১:২৬ যিরমিয় ঘুমে একটি উদ্ধারের স্বপ্ন দেখেন ও তা আনন্দ ও আরাম পান।
- যির ৩২ অধ্যায়ে যিরমিয় ঈশ্বরের আদেশে বাবিলীয়রা ঘেড়াও করলেও তার আত্মীয় থেকে একটি জমি কিনেন (নাটকীয় চিহ্ন হিসাবে): ‘এই দেশে ঘর-বাড়ী, জায়গা-জমি ও আংগুর ক্ষেত আবার কেনা-বেচা চলবে’। আবারও বুঝা যায় যে যিরমিয়ের হৃদয়ে কোনো ক্ষোপ নেই: তার সন্তান নেই, তাই এই জমি তার সন্তানদের হাতে যাবে না, কেনার লাভ নেই, এবং উদ্ধার যখন ঘটবে তিনি আর থাকবেন না। কিন্তু তারপরেও যিরমিয় এখানে খুব আনন্দ করেন যে উদ্ধার আসবে, যদিও তিনি তা আর দেখবেন না। এই বিষয়েও বুঝা যায় যে যিরমিয়ের জীবন হয়ে গেছে ‘সংবাদ’, তিনি তার জীবন দ্বারা ঈশ্বরের ক্ষমা, করুনা ও মঙ্গলের প্রতি আকাঙ্খা দেখান।
- যিহোয়াকীম রাজার রাজত্বের ৪র্থ বছরে যিরমিয় ঈশ্বরের সমস্ত বাণী জমিয়ে বারূকের সাহায্যে একটি গুটিয়ে রাখা বইয়ে লিখেন (যির ৩৬:১-৮)।
- যেহেতু সে সময় যিরমিয়কে মন্দিরে যাওয়া নিষেধ করা হয়েছে তিনি বারূককে বই সেখানে সবার সামনে পড়তে বলেন। তাই যিহোয়াকীমের ৫ম বছর, ৯ম মাসে বারূক মন্দিরে গমরিয়ের কামরায় বইটি পড়ান। রাজার কর্মচারীরা কথা শুনে ভীত হয়ে যান এবং তা রাজাকে শোনানো প্রয়োজন মনে করেন। তারা বারূককে যিরমিয়কে নিয়ে লুকিয়ে থাকতে বলেন (যির ৩৬:৯-১৯)। কর্মচারীরা ভালভাবে বুঝতে পারে যে রাজার কাছে তা শোনানো হল ঝামেলার বিষয় কারণ তিনি নানা ক্ষেত্রে অন্যায় করতে থাকেন।
- একদিকে বলা যায় যে যিরমিয় তো সে একই বাণী বছরের পর বছরে সবার সামনে ঘোষণা করে আসছেন। কিন্তু সব বাণীগুলি একসাথে পড়া হয় বলে, ঈশ্বর ভক্ত লোকেরা আতঙ্কিত হয় কারণ তারা বাণীর মধ্যে সে প্রক্রিয়া বুঝতে পারে। তারা বোঝে যে সংবাদটা তর্কের বিষয় হবে, কিন্তু না রাজাকে শোনানো চলবে না।
- বইটা যখন যিহোয়াকীমের কাছে পড়া হয় তিনি টুকরা টুকরা কেটে তা পুড়িয়ে ফেলেন তিনি আদেশ দেন যেন বারূক ও যিরমিয়কে গ্রেফতার করা হয় কিন্তু ঈশ্বর তাদের লুকান (যির ৩৬:২০-২৬)।
- বারূকের সাহায্যে যিরমিয় আর একবার সব বাণীগুলি একটি গুটিয়ে রাখা বইয়ে লিখেন এবং তিনি নতুন বাণীগুলি যোগ দিতে থাকেন (যির ৩৬:২৭-৩২)। কেন ঈশ্বর তাদের শুরু থেকে দুই কপি বানাতে বলেন নি? আগের কাজ সব নিস্ফল? দ্বিগুন কষ্ট কিসের? উদাহরণ: উইলিয়াম কেরীর বাইবেলের অনুবাদ শেষ করার পরেই বাড়ী পুড়ে গেল ও সব কাজ ধ্বংস হয়েছিল। তবে কি করব? আর একবার শুরু করব! সে সময় ধৈর্য্য প্রয়োজন ছিল, আজকেও প্রয়োজন। আমরা যারা সব কিছু তাড়াতাড়ি পেতে চাই, এখানে অনেক কিছু শেখার আছে।
- যখন মিসরীয় সৈন্যদল চলে যায়, যিহূদার শেষ রাজা সিদিকিয় যিরমিয় প্রার্থনা করতে অনুরোধ করেন (যির ৩৭:১-১০)। আবারও যিরমিয়ের একটি নেতিবাচক ভাববাণী দিতে হয়: বাবিল তারপরেও যিহূদাকে দখল করবে। যিরমিয় এখানে অবশেষে একটু সম্মান পান, কিন্তু শেষ রাজাও তার কথা মানে না, এবং যিরমিয়কে সুরক্ষা করতে রাজি না।
যিরূশালেমের ধ্বংস পর্যন্ত শেষ সময়ে যিরমিয় জেলে
- যখন বাবিলীয়রা যিরূশালেমকে আবার ঘেড়াও করে রাখে সব কিছু চরম অবস্থায় যায় (যির ৩৭:১১-১৬): যিরমিয় একটি জমি অধিকার নেওয়ার জন্য বিন্যামিন গোষ্ঠীর এলাকায় যেতে চান যদিও তার নিজের পরিবার ও শহর তাকে মৃত্যুর হুমকি দিয়েছিল। এই গল্প হল আগের জমি কেনার গল্পের সমান্তরাল (যির ৩২)। যিরমিয়ের কেমন লাগে, এখন পরিবারের সাথে আবার দেখা করতে? ভয়? বা তাদের হৃদয়ে তার জন্য তারপরেও একটু সম্মান জন্মিয়েছে? বা সবাই হাসবে যে যিরমিয় জমির অধিকার নেবেন কারণ সন্তান নেই এবং বাবিলের আক্রমন সম্ভাব্য?
- যখন তিনি যিরূশালেমে ফিরেন যিরিয় নামক একজন পাহারাদারদের সেনাপতি তাকে গ্রেফতার করে ও দোষারোপ করেন যে যিরমিয় বাবিলীয়দের কাছে আত্ম-সমর্পন করেছেন (এই কথা অর্থহীন কারণ আত্ম-সমর্পন করলে তবে যিরূশালেমে ফেরার কি প্রয়োজন?)। ইর্যা অন্যদের উষকিয়ে দেন এবং যিরমিয়ের মারধর ঘটান। তাকে লেখক যোনাথনের বাড়ীতে আটকানো হয়। সে আশার নাটকীয় চিহ্ন (জমি কেনা) এখন হয়ে গেছে অত্যাচার বাড়ানোর অজুহাত।
- রাজা সিদিকিয় গোপনে যিরমিয়ের সাথে দেখা করেন ও ঈশ্বরের দিক-নির্দেশনা জানতে চান (যির ৩৭:১৭-২১)। যিরমিয় রাজাকে আর একটি কঠিন সংবাদ দেন: ‘আপনাকে বাবিলের রাজার হাতে তুলে দেওয়া হবে’। যিরমিয়কে অন্যায্যভাবে গ্রেফতার ও অত্যাচার করা হয়, তা নিয়ে তিনি সিদিকিয়কে চ্যালেঞ্জ করেন ও তাকে জিজ্ঞাসা করেন সে শান্তিবাণীর মিথ্যা ভাববাদীরা কোথায়। বোধ হয় যতবার যিরমিয়ের কথা বলতে হয়, তাকে সবসময় ঠিক তাই বলতে হয় যা কেউ শুনতে চায় না এবং যা বলা অত্যাচার আকৃষ্ট করবে।
- যিরমিয় যিরূশালেমের সব লোকদের বলেন নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাবিলের কাছে আত্ম-সমর্পন করতে (যির ৩৮:১-৬)। এই সংবাদ (যা অবশ্যই লোকদের যুদ্ধ করার সাহস ভেঙ্গে দেয়) রাজার কর্মচারীরা কোনো রকম মানতে রাজি না। তারা রাজা সিদিকিয়কে চাপ দেন যেন তিনি যিরমিয় দেশের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেন। সিদিকিয় যিরমিয়কে তাদের হাতে সমর্পিত করেন বলে ‘সে তো আপনাদের হাতেই রয়েছে; রাজা আপনাদের বিরুদ্ধে যেতে পারেন না’। যিরমিয়কে একটি কাদার কূয়ায় ফেলে দেওয়া হয়। যদি যিরমিয়ের বয়স আহবানের সময় ১২ বছর ধরা হয়, তবে তার বয়স ৬০ বছরের কাছাকাছি।
- যিরমিয়কে দেশের অমঙ্গল করার জন্য দোষারোপ করা হয়। এই কথা অবশ্যই মিথ্যা কিন্তু তাদের চোখে তা সম্পূর্ণ প্রমানিত বিষয়। তাই যিরমিয় নিজের দেশের দুরাবস্থা, ক্ষতি ও ধ্বংসের অংশীদার হয়ে যান, এমন একটি ধ্বংস যার বিষয়ে তিনি সাবধাণবাণী দিয়েছিলেন, যার বিরুদ্ধে তিনি সারা জীবন কাজ করতে চেষ্টা করেছিলেন এবং যা তিনি কখনও হদয়ে চান নি। দেশের অবস্থা যত খারাপ হয়ে যায়, তার ভবিষদ্বাণী তত প্রমানিত হয়ে যায়, কিন্তু তত বেশি তার জীবনের হুমকিস্বরূপ হয়ে যায়।
- এবদ-মেলক নামে একজন কূশীয় নপুংসক অবশেষে যিরমিয়কে কূয়া থেকে মুক্ত করেন (যির ৩৮:৭-১৩)। সে নপুংসক সাহসী, স্বক্রিয়, যিরমিয় ভক্ত, যত্মশীল, প্রজ্ঞাবান ও তিনি আইন অনুসারে সব কিছু করেন। যিরমিয় রক্ষা পান না তার পরিবারের লোকদের মধ্য দিয়ে, কর্মচারী অহীকামের মধ্য দিয়ে (যিনি তাকে কয়েকবার সমর্থন করতেন) অথবা একজন যিহূদী দ্বারা বরং একজন ঈশ্বর ভক্ত কূশীয় নপুংসক দ্বারা। খেয়াল করুন যে রাজা সিদিকিয় নিজেকে অক্ষম মনে করেন যিরমিয়কে বাঁচাতে, কিন্তু এই সাধারণ লোক তা ঠিকই ঘটাতে সক্ষম হন। এবদ-মেলক তার সে বিশ্বস্ততার জন্য একটি ভবিষ্যদ্বাণী পান যে তিনি ঘেড়াও ও দখল হলেও বাঁচবে (যির ৩৯:১৫-১৮)।
- রাজা সিদিকিয় আবারও গোপনে যিরমিয়ের সাথে দেখা করেন (যির ৩৮:১৪-২৮) ও তাকে অনুরোধ করেন তা কাউকে না জানাতে। যিরমিয় তার কাছে সত্য বলতে থাকেন এবং তার অনুরোধ অনুসারে করেন, এমন একজন রাজার প্রতি যিনি তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। যিরমিয় কূয়ায় আর না কিন্তু জেলে থাকেন সে দিন পর্যন্ত যখন বাবিলীয়রা যিরূশালেমকে দখল করে।
যিরমিয়ের শেষ বছরগুলি ৫৮৬ খ্রিঃপূঃ পরে
- যখন বাবিলীয়রা যিরূশালেমকে দখল করে, তারা যিরমিয়কে বন্দি হিসাবে রামা শহরে নিয়ে যায় এবং তাকে সেখানে বাবিল রাজা নবূখদনিৎসরের সামনে দাঁড় করায়। নবূখদনিৎসর যিরমিয়কে মুক্তি দেন ও সবাইকে তার প্রতি ভাল ব্যবহার করতে আদেশ দেন। অবশেষে যিরমিয় কিছুটা ন্যায্যতা ও সম্মান পান। কার কাছ থেকে? একজন দেবতাপূজারী দখলকারী রাজার কাছ থেকে। তা তো লজ্জার বিষয়!
- নবূখদনিৎসর যিরমিয়কে প্রস্তাব দেন বাবিলে এসে শান্তিতে ও সম্মানে জীবন করতে (যির ৪০:১-৬) কিন্তু যিরমিয় তার চেয়ে যিহূদায় থাকা বাকী লোকদের সাথে থাকতে পছন্দ করেন। কেন? তা কি এখনও তার আহবানের অংশ? তিনি বুড়ো হিসাবে আর যাত্রা আর করতে চান না? বা তিনি বিশ্বস্তভাবে যেখানে ঈশ্বর তাকে আহবান দিয়েছেন, সেখানে পরিচর্যা করতে থাকেন? বা তিনি তা দিয়ে লোকদের দেখাতে চান যে বাবিলের নির্বাসনের সময় সীমিত, তিনি তাদের আশা দিতে চান যে এক দিন যিহূদীরা যিহূদায় ফিরবে?
- বাবিলীয়রা গদলিয় নামে একজন যিহূদী বাকী থাকা যিহূদীদের উপরে শাসনকর্তা হিসাবে স্থাপন করেন। যখন ইশ্মায়েল নামে একজন বিদ্রোহী নেতা গদলিয়কে খুন করে বাকি থাকা যিহূদীরা বাবিলের প্রতিশোধের ভয়ে মিসরে পালাতে চিন্তা করে (যির ৩১:১-১০)। তারা যিরমিয়কে অনুরোধ করে তাদের পক্ষ হয়ে ঈশ্বরকে অন্বেষণ করতে। যিরমিয় তাদের দেবতাপূজা ছাড়তে এবং ভয় না করে দেশে থাকতে বলেন। তারা তার কথা অমান্য করে দেবতাপূজা করতে থাকে ও তারপরেও মিসরে পালায়। তা মাত্র না, তারা যিরমিয় ও বারূককে জোর করে মিসরে নিয়ে যায় (যির ৪২-৪৪)।
- এটাই যিহূদা ও যিরমিয়ের জন্য সর্বোচ্চ পরাজয়। আবারও দেখা যায় যিরমিয়ের পরিচর্যায় কোনো সাড়া নেই: এখন যে তার প্রত্যেক বাণী পূর্ণ হয়েছে ও তিনি সঠিক ভাববাদী হিসাবে প্রমাণিত, তারপরেও কেউ তার কথা বিশ্বাস করে না। আরো খারাপ: তাকে জোর করে মিসরে ফিরিয়ে নেওয়া হয় যেখানে ঈশ্বর বলেছিলেন যেন ইস্রায়েলীয়রা ফিরে না যায় (দ্বিতীয় বিবরণ ১৭:১৬)। যিরমিয় যা বলুক না কেন, তারা দেবতাপূজায় লিপ্ত থাকে। যিরমিয় বিশ্বস্তভাবে তাদের কাছে সত্য বলতে থাকেন যদিও তারা তাকে কারণ ও যুক্তি ছাড়া অগ্রাহ্য করতে থাকে।
- হতে পারে মিসরে যিরমিয় তার পুস্তকগুলি লেখা শেষ করেন (যিরমিয়, বিলাপ ও রাজাবলি), যদিও তিনি মিসরের জেদী যিহূদীদের কাছে না বরং বাবিলে নম্র যিহূদীদের কাছে লিখেন। এটি হল যিরমিয়ের শেষ সেবা, যত্ন, বিশ্বস্ততা ও বিশ্বাসের কাজ: ইতিহাস ঈশ্বরের কথা অনুসারে ঠিকই এগিয়ে যাবে: তাই কি ঘটল এবং ঈশ্বরের ভবিষ্যদ্বাণী অবশ্যই লিখিত রাখতে হবে।
- কেন ঈশ্বর যিরমিয়কে এর চেয়ে বেশি জয় বা সাফল্য দেখতে দেন না? কেন একটি কঠিন জীবনের শেষে তার আরো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়? কেন এমন কি শেষেও কোনো সফলতা দেখা যায় না? বোধ হয় ঈশ্বর যিরমিয়কে কঠোরভাবে ব্যবহার করেন, হয়তো বাইবেলে সব অন্য ব্যক্তিদের চেয়েও কঠোর।
- আমরা ঈশ্বরের এভাবে করার কারণ হয়তো বুঝব না কিন্তু আমরা জানি যে যিরমিয় মাত্র ঈশ্বরের সংবাদ দেন না, তিনি (এবং তার পুরো জীবন) সংবাদই হন। তিনি মাত্র ঈশ্বরের কথা বলেন না, তিনি তা উপলব্দি করেন। ইস্রায়েল নিয়ে ঈশ্বরের স্বপ্ন সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেছে। যিরমিয়ের স্বপ্ন বা আশাও ভেঙ্গে গেছে। যিরমিয় (এবং তার সারা জীবন) হলেন ইস্রায়েল জাতির কাছে ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তিনি ইস্রায়েলের একটি চরম খারাপ সময়ে তাদের কাছে ঈশ্বরের হৃদয় দেখান। যিরমিয় ঈশ্বরের একটি ছবিস্বরূপ। যিরমিয় দ্বারা যীশুর একটি অগ্রিম ছবিও উপস্থাপনা করা হয়, যিনি নিজেই ঈশ্বরের সম্পূর্ণ ছবিস্বরূপ হন।
যীশু ও যিরমিয়ের জীবনের মিল
- যীশু ও যিরমিয় উভয় দীর্ঘদিন ধরে অনিচ্ছুক, এমন কি বিরুদ্ধীয় লোকদের কাছে কথা বলেন, এমন লোক যাদের তাদের ক্ষতি করার ক্ষমতা আছে।
- যীশু ও যিরমিয় উভয় এই অনিচ্ছুক ও প্রতিকূল লোকদের প্রতি ঈশ্বরের দয়ালু ও কমল হৃদয় দেখান ও তাদের ঈশ্বরের দিকে ফিরতে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করেন।
- যীশু ও যিরমিয় উভয় বিচারের কথা বলেন, কিন্তু বিচার চান না এবং তাদের কোনো আনন্দ নেই যখন আক্রমনাত্মক লোক বিচার পায়। তারা উভয় ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
- যীশু ও যিরমিয় উভয় এমন একটি সময় ইস্রায়েলের কাছে কথা বলেন যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে, যখন সরকার খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে, যখন ধর্ম ও রাজনৈতিক বিষয় দণ্ডের সম্মুখে, যখন হিংস্রতা ও বিদ্রোহ চারিদিকে বাড়ে, যখন বিপর্যয় ও সর্বনাশের আগমন বুঝা যায়।
- যীশু ও যিরমিয় উভয় অন্যদের পাপের কারণে কষ্টভোগ করেন এবং তাদের এমন কিছু সহ্য করতে হয় যা তারা পাওয়ার যোগ্য নন: যিরমিয়কে অত্যাচার, বন্দিদশা, যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় এবং তার দেশের পরাজয়, ধ্বংস ও নির্বাসনের সাক্ষী হতে হয়। অপরপক্ষে যীশু সম্পূর্ণ নিস্পাপ ও নির্দোষী হলেও ক্রুশে সর্বোচ্চ কষ্টভোগ করেন ও আমাদের জন্য জীবন দান করেন।
- যীশু ও যিরমিয় উভয় তাদের জীবনে নানা যন্ত্রণায় কষ্ট পান। যিরমিয়ের জীবনে বার বার সে সংগ্রাম দেখা যায়। যীশুর জীবনেও তা দেখা যায়, বিশেষভাবে গেৎশিমানী বাগানে।
- যীশু ও যিরমিয় উভয় তাদের মৃত্যুর ওপাড়ে একটি উদ্ধারের কথা বলেন।
- যীশু ও যিরমিয় উভয় তাদের যুগের ধার্মিক ও রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা অত্যাচারিত হন।
- ঈশ্বর তাদের দুইজনকে সবচেয়ে কঠিন ও দুর্বল অবস্থায় পড়ার সময় রক্ষা করেন, এমন সময় যখন বোধ হয় সব ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ আছে।
- যীশু ও যিরমিয় উভয় লোকদের জন্য বিনতি করেন।
- “তাঁর সামনে যে আনন্দ রাখা হয়েছিল তারই জন্য তিনি অসম্মানের দিকে না তাকিয়ে ক্রুশীয় মৃত্যু সহ্য করলেন” যীশুর মত যিরমিয়ও এক পরিমাণে তা করেন (ইব্রীয় ১২:২)।
সারাংশ
- যিরমিয় তার পুস্তকে এত সৎভাবে তার সংগ্রাম, লোকদের সাথে দ্বন্দ্ব, কষ্ট, হুমকি, ভয়, অত্যাচার, যন্ত্রণা, মৃত্যুর ভয়, খোপ, প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্খা ও নিরাশা শেয়ার করেন।
- যিরমিয় লড়াই করেন ঈশ্বরের সঙ্গে, যে ধ্বংসবাণী তার সব সময় দিতে হচ্ছে তার সঙ্গে, লোকদের মনোভাব ও অবিশ্বাসের সঙ্গে। যিহূদার ধ্বংস আসলে তার কথা প্রমাণিত, কিন্তু তার দেশের ধ্বংস দেখতে কি আনন্দ আছে?
- ইস্রায়েল জাতি যখন ধীরে ধীরে পতন এবং শেষে ধ্বংস হয়ে যান, যিরমিয়ও এর ভাগীদার হন। তিনি তা মেনে নন, যদিও তার দোষ নেই। ঈশ্বরকে অগ্রাহ্য করার মনোভাব, যার কারণে ঈশ্বর ইস্রায়েলীয়দের বিচার করেন, যিরমিয়ের এই মনোভাব নেই। তিনি বিচারের যোগ্য নন, তিনি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিচার চান নি। তিনি তার জাতির অপ্রয়োজনীয় কষ্টভোগে অংশ গ্রহন করেন যদিও তারা তাকে ও তার কথাকে অগ্রাহ্য করেছে, তাকে হাস্যকর বানিয়েছে, তাকে দোষারোপ করেছে ও তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে।
- যিরিমিয় প্রায় ৬০ বছর ধরে বিশ্বস্তভাবে কষ্টকর ও ত্যাগ-স্বীকারের পরিচর্যা করার পরেও কোনো ফল পান না বলেই চলে। কিন্তু সব কিছুর মধ্যে তিনি সঠিকারের ভাববাদী হিসাবে প্রকাশিত হয়ে যান (তার ধ্বংসেরবাণী পূর্ণ হয়েছে, যিরূশালেম পরাজিত)। তার অতি গুরুত্ব আছে কারণ এই পূর্ণতা তার আশা বাণীর বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ (৭০ বছেরের মধ্যে বাবিল নির্বাসন শেষ হয়ে যাবে!)।
- যিরমিয়ের ৭০ বছরের ভবিষ্যদ্বাণীর নির্বাসিত যিহূদীদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ: তা দ্বারা তারা নিজের দুরাবস্থার কারণ বুঝতে পারে, কিন্তু আশাও পাবে, যে তাদের উপরে ঈশ্বরের আহবান এখনও আছে: যিহূদীরা একদিন ফিরবে, তারা আবার উত্তরাধিকার পাবে এবং ঈশ্বরের উদ্ধার ও মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী ঠিকই পূর্ণ হয়ে যাবে।
- সে সুদূর মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী যিরমিয়ের চেয়ে অন্যান্য ভাববাদীরা বেশি বলেছেন (বিশেষভাবে যিশাইয়), কিন্তু সেগুলি এতদূরের যে যিহূদীরা মনে করতে যিরূশালেম যখন ধ্বংস এইগুলি সব বাতিল হয়েছে। এর জন্য যিরমিয়ের এই শীঘ্রই পূর্ণ হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী (৭০ বছরের মধ্যে তোমরা ফিরবে!) নির্বাসিত যিহূদীদের জন্য আশা ও বিশ্বাসের একটি উৎস ছিল।
- যিরমিয়ের সে ৭০ বছরের ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে দানিয়েল ঈশ্বরকে অন্বেষণ করবেন (দানিয়েল ৯:১-২)। ঈশ্বর দানিয়েলকে আবার এমন ভবিষ্যদ্বাণী দেবেন যাতে যিহূদীরা দেশে ফেরার পর থেকে যীশু আসার পর্যন্ত ইতিহাস বুঝার একটি দিক-নির্দেশনা পাবে (দানিয়েল ৭-১২ অধ্যায়) এবং তা তাদের জন্য শক্তিতে ও বিশ্বাসে পরিণত হয়ে যাবে।
- অল্পদিন দেখলে যিরমিয়ের পরিচর্যা নিস্ফল, কিন্তু বহুদিন দেখলে তারই বাণীগুলি হবে যিহূদীদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং আশা ও বিশ্বাস ধরে রাখার বড় সাহায্য। তা ছাড়া তার সে বাণী ও নিজের জীবনের বর্ণনা ঈশ্বরের অধিকারগত ও জীবনদায়ী বাক্য হয়ে যাবে যা ২৫০০ বছর পরে আমরা এখনও অধ্যয়ন করছি।
- যিরমিয়ের আহবান ও পরিচর্যা বোধ হয় পরাজয় ও কষ্ট মাত্র। ঈশ্বর তার সঙ্গে আছেন, তার কষ্ট বোঝেন কিন্তু তাকে আরো চ্যালেঞ্জ করেন এবং কষ্টের পথে আরো দূরে পাঠান। তাই বুঝা যায় ঈশ্বর তাঁর সে সেবা, তাঁকে জানা, তাঁর সংবাদদাতা হওয়া, প্রতিকূল সময়েও সঠিক কাজ করা একটি বড় সম্মান ও পুরস্কার মনে করেন, এমন বড় সম্মান ও পুরস্কার যে তার তুলনায় সে কষ্টভোগ, নিরাশা, যন্ত্রণা ও লোকদের অবিশ্বাস মেনে নেওয়া ছোট বিষয়!
- যিরমিয় ঈশ্বরের সাথে এই বিষয়ে একমত হয়ে যান (তারপরেও ভাল ছিল!), কিন্তু তা তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ও লড়াই এবং তিনি তা লুকান না।