নহিমিয় পুস্তকে বাবিলের নির্বাসন থেকে ফিরে আসা যিহূদীদের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়, কিভাবে তারা অনেক বাধা পেরিয়ে যিরূশালেমের দেওয়াল পুনরায় নির্মাণ করে এবং নহিমিয় ও ইষ্রার নেতৃত্বে নিজেদেরকে নতুনভাবে আইন-কানুনে সমর্পিত করে।
ইষ্রা ও নহিমিয় এই দু’টি পুস্তক একসাথে যিহূদীদের একশো বছরের ইতিহাস (৫৩৯-৪৩২ খ্রীঃপূঃ) বর্ণনা করে: কিভাবে তারা বাবিলে নির্বাসন থেকে যিহূদায় ফিরে যায় এবং যিরূশালেমে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর তৈরি করে, আরাধনা ও আইন-শিক্ষা উন্নত করে এবং যিরূশালেমের দেওয়াল পুনরায় নির্মাণ করে। ইব্রীয় পবিত্র-শাস্ত্রে ইষ্রা ও নহিমিয় হল একটি যুগল পুস্তক, ‘ইষ্রা ১’ ও ‘ইষ্রা ২’। প্রকৃতভাবে দু’টি পুস্তক অনেক বিষয়ে সম্পর্কিত এবং দু’টি পুস্তক একজনই লেখক দ্বারা লিখিত বা প্রকাশিত: ধর্ম-শিক্ষক ইষ্রা।
৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদীদের বাবিলে নির্বাসনে নেওয়া হয়েছিল যেখানে তারা মোটামুটি ভাল অবস্থায় জীবন-যাপন করতে পেরেছিল। ভাববাদী যিরমিয় একটি অবিশ্বাস্য ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিলেন যে, সত্তর বছরের মধ্যে শক্তিশালী বাবিল সাম্রাজ্যকে পরাজিত করা হবে এবং তখন যিহূদীদের নির্বাসনও শেষ হয়ে যাবে (যির ২৯:১১)। যখন ৫৩৯ খ্রীষ্টপূর্বে রাজা কোরসের নেতৃত্বে মাদিয়-পারস্যরা বাবিল সাম্রাজ্য দখল করে তখন তারা বাবিলীয়দের দ্বারা নির্বাসিত জাতিদের নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন। এভাবে যিহূদীদের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে যায়। ৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে সরুব্বাবিলের নেতৃত্বে যিহূদীদের প্রথম একটি দল যিহূদায় ফিরে আসে। ঈশ্বরের আহ্বানে বাধ্য হওয়া সেই যিহূদীদের নামের তালিকা নহিমিয় পুস্তকে গুরুত্বের সঙ্গে ও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয় (নহিমিয় ৭)। ৫১৬ খ্রীষ্টপূর্বের মধ্যে তারা যিরূশালেমে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর সঠিক স্থানে পুনরায় নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। ৪৫৮ খ্রীষ্টপূর্ব ধর্ম-শিক্ষক ইষ্রা যিহূদীদের আর এক দল (বেশিরভাগ লেবীয় ও পুরোহিত) নিয়ে বাবিল থেকে যিহূদায় ফিরে আসেন। সেখানে পৌঁছে ইষ্রা কিছু প্রয়োজনীয় পুনঃসংস্কার পরিচালনা করেন।
৪৪৪ খ্রীষ্টপূর্বে নহিমিয়, যিনি মাদিয়-পারস্য রাজা অর্তক্ষস্তের পানপত্র বাহক ছিলেন, তিনি শুনতে পান যে, যিহূদায় ফিরে আসা যিহূদীরা নিজেকে এখনও দুর্বল অবস্থায় খুঁজে পায় এবং যিরূশালেম শহরের দেওয়াল ও ফটক এখনও ভাঙ্গা অবস্থায় আছে (নহিমিয় ১:১-৩)। নহিমিয় প্রার্থনা ও উপবাস করেন এবং রাজাকে অনুরোধ করে যিরূশালেমের দেওয়াল পুনরায় নির্মাণ করার অনুমতি পান (নহিমিয় ১:৪-২:১০)। যিরূশালেমে পৌঁছে তিনি দেওয়ালের অবস্থা জেনে নেন এবং যিহূদীদের সহযোগিতা পেয়ে দেওয়ালের নির্মাণ শুরু করেন (নিহিমিয় ২:১১-১৮)। তিনি ইচ্ছুক যিহূদীদের মিশানো একটি শ্রমিকদল পেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে তাদের সাজান ও কাজে লাগান: পুরোহিত ও লেবীয়, শাসনকর্তা ও গ্রামের লোকেরা, ধনী ও গরীব, পুরুষ ও মহিলা, স্বর্ণকার, সুগন্ধি তৈরিকর্তা, ব্যবসায়ী ও কৃষক, সবাই একসাথে কাজ করে (নহিমিয় ৩)। যদিও তাদের অনেক পুরানো ভাঙ্গা পাথরগুলো পরিষ্কার করতে হয় (নহিমিয় ৪:১০) এবং তারা একটি লম্বা দেওয়ালে অল্প ও ছড়িয়ে পড়া কর্মী মাত্র (নহিমিয় ৪:১৯) তবুও তারা মনেপ্রাণে ও প্রতিদিন অনেক ঘণ্টা ধরে পরিশ্রম করতে থাকে (নহিমিয় ৪:৬)।
চারিদিকে জাতিদের নেতারা দেওয়াল নির্মাণের বিরোধিতা করে। হয়তো তার কারণ হল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যিহূদীদের নিয়ে শত্রুতা অথবা তা হল বর্তমান বিষয়: তারা নহিমিয়ের নেতৃত্ব হুমকিস্বরূপ মনে করে। তারা চায় না যে, যিরূশালেম শক্তিশালী হয়ে উঠুক এবং এভাবে এলাকায় তাদের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ুক (নহিমিয় ২:১৯-২০)। প্রথমদিকে তারা নহিমিয়ের নির্মাণের প্রচেষ্টা নিচু চোখে দেখে এবং হাস্যকর বানায়। কিন্তু যখন দেওয়ালের কাজ এগিয়ে যায় (নহিমিয় ৪:৬) তারা যিরূশালেমকে হঠাৎ করে আক্রমণ করার জন্য গোপনে পরিকল্পনা করে (নহিমিয় ৪:৭-৮)। নহিমিয় পরিকল্পনার খবর পেয়ে যতদূর সম্ভব নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন: তিনি দেওয়ালে পাহারাদার রাখেন, তূরীর একটি জরুরী যোগাযোগ পদ্ধতি বসান, শ্রমিকদের সাথে অস্ত্র রাখতে দেন, সব শ্রমিকদের দেওয়ালের ভিতরে বাস করতে বলেন এবং আরো বেশি করে ঈশ্বরের কাছে সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা করেন (নহিমিয় ৪:১৫-২৩)।
যখন বিরোধী লোকেরা বুঝে যে, তাদের গোপন পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়েছে তখন তারা পরিবর্তে নহিমিয়কে আটকানোর ও ক্ষতি করার জন্য একটি সভায় ডাকে (নহিমিয় ৬:২)। নহিমিয় সভায় আসার ডাক বার বার অস্বীকার করেন, এমন কি যখন তারা তাকে মাদিয়-পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নিন্দা সরকারের কাছে পৌঁছানোর হুমকি দেয়, তখনও নহিমিয় তাদের সাথে দেখা করতে রাজি না (নহিমিয় ৬:৩-৯)। পরবর্তীতে তারা নহিমিয়কে হুমকি দিয়ে নিজের জন্য উপাসনা-ঘরে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়ায় বাধ্য করতে চেষ্টা করে, যেন তারা তার সুনাম নষ্ট করতে পারে। কিন্তু আবারও তাদের কৌশল ব্যর্থ হয় (নহিমিয় ৬:১০-১৪)। নহিমিয় হলেন প্রার্থনাশীল, সতর্ক ও প্রজ্ঞাবান। তিনি প্রয়োজন অনুসারে কিছু পদক্ষেপ নেন কিন্তু তিনি তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার কোন প্রচেষ্টা সফল হতে দেন না। তিনি সাহসী, সমর্পিত এবং নিজের ব্যক্তির জন্য কোন সুযোগ-সুবিধা নিতে রাজি না, যার কারণে শ্রমিকেরা অনুপ্রেরণা পায় ও কাজ চালিয়ে নিতে থাকে।
বাইরে থেকে বিরোধিতা ছাড়া যিহূদী সমাজে অন্যায়গুলোও কাজের বাধা হয়ে দাঁড়ায়: অনেক গরীব যিহূদী ধনী যিহূদীদের কাছে ঋণী হয়ে পড়েছে অথবা এমন কি দাসত্বে পড়েছে (নহিমিয় ৫:১-৫)। এই বিষয়টি লক্ষ্য করার পরে নহিমিয় শক্তিশালী পদক্ষেপ নেন: তিনি ধনী যিহূদীদের দায়বদ্ধ করে রাখেন, আইন ভাঙ্গার জন্য তাদের ধমক দেন এবং তাদের থেকে শপথ নেন, যেন তারা ঋণগুলো এবং যিহূদী দাসদের ছেড়ে দেয় (নহিমিয় ৫:৬-১৩)। কেন ধনীরা নহিমিয়ের দাবি মেনে নেয়? সম্ভবত তার প্রধান কারণ হল যে, নহিমিয় নিজেই খুব সীমিত ব্যয়ে চলেন, তিনি শাসনকর্তার অনুমোদিত টাকা ও খাবার নিজের জন্য দাবি করেন না বরং তিনি খুব পরিশ্রম করেন এবং তার ব্যক্তিগত টাকাও দাসদের ‘মুক্তি’ কেনার জন্য ব্যয় করেন (নহিমিয় ৫:১৪-১৯)।
অবিশ্বাস্য যে, নহিমিয় ও তার শ্রমিকদল শুধুমাত্র বাহান্ন দিনের মধ্যেই দেওয়ালের কাজ সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হন, যাতে এমন কি শত্রুরাও বুঝতে পারে যে, এর পিছনে অবশ্যই ঈশ্বরের হাত ছিল (নহিমিয় ৬:১৫-১৯)। তারা একটি বড় আনন্দের অনুষ্ঠানে দেওয়াল ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করে (নহিমিয় ১২:২৭-৩৪)। পরে নহিমিয় শহরের বসবাসকারীদের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলেন (নহিমিয় ১১) এবং ফটকের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
পরবর্তীতে ধর্ম-শিক্ষক ইষ্রা সবার কাছে মোশির আইন-কানুন পড়ানোর ও বুঝিয়ে দেওয়ার একটি অনুষ্ঠান চালান, যার ফল হল উভয় অনুতাপ ও আনন্দ। যিহূদীরা কুঁড়ে-ঘরের পর্ব পালন করে এবং নিজেকে আইন-কানুন পালন করার একটি চুক্তিতে সমর্পিত করে। যদিও পুঃসংস্কারের কাজ আবারও প্রয়োজন হয়ে পড়ে (নহিমিয় ১৩) তবুও ইষ্রা ও নহিমিয় এই দু’জনের নেতৃত্ব দ্বারা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ও আত্মিক ক্ষেত্রে যিহূদীদের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে।
নহিমিয় পুস্তক ও তার লেখক
ইষ্রা ও নহিমিয় এই দু’টি পুস্তক একসাথে যিহূদীদের একশো বছরের ইতিহাস বর্ণনা করে (৫৩৯-৪৩২ খ্রীঃপূঃ), কিভাবে তারা বাবিলে নির্বাসন থেকে যিহূদায় ফিরে যায় এবং যিরূশালেমে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর তৈরি করে, আরাধনা ও আইন-শিক্ষা উন্নত করে এবং যিরূশালেমের দেওয়াল পুনরায় নির্মাণ করে। ইব্রীয় পবিত্র-শাস্ত্রে ইষ্রা ও নহিমিয় হল একটি যুগল পুস্তক, ‘ইষ্রা ১’ ও ‘ইষ্রা ২’। প্রকৃতভাবে দু’টি পুস্তক অনেক বিষয়ে সম্পর্কিত এবং নহিমিয় পুস্তকে আমরা উভয় নহিমিয়ের ও ইষ্রার নেতৃত্বের একটি বর্ণনা পাই। যিহূদী ঐতিহ্য অনুসারে ধর্ম-শিক্ষক ইষ্রা হলেন ৩টি পুস্তকের লেখক: ইষ্রা, নহিমিয় ও বংশাবলি।
তাই নহিমিয় পুস্তকের লেখক হলেন ইষ্রা, কিন্তু পুস্তকে খুব পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, তিনি নহিমিয়ের নথি ও লেখাগুলো উদ্ধৃতি করে এই পুস্তকে সংকলন করেছেন। এই পুস্তকে আমরা অনেক বার “আমি” দিয়ে নহিমিয়ের কথা পাই এবং প্রায়ই নহিমিয়ের চিন্তা, দুশ্চিন্তা, আবেগ ও কিছু করার পিছনে তার কারণের বর্ণনাও পাওয়া যায় (যেমন নহি ১:৪-১১, ২:১-৮ ইত্যাদি)।
ইষ্রা ও নহিমিয় পুস্তকের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মিল পাওয়া যায়: লেখার ধরণ, ব্যবহৃত শব্দ ও রূপক এবং এমন কি একই ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা। প্রকৃতপক্ষে ইষ্রা ও নহিমিয় সমসাময়িক নেতা, ইষ্রা আত্মিক ক্ষেত্রে এবং নহিমিয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। দু’টি পুস্তক বিভিন্নভাবে সংযুক্ত:
- ইষ্রা ২ অধ্যায়ে ফিরে আসা যিহূদীদের নাম ও সংখ্যার তালিকা নহিমিয় ৭ অধ্যায়ে আধুনিক করে আর একবার দেওয়া আছে।
- ইষ্রা পুস্তকে যখন বিরোধিতা নিয়ে কথা হয় (ইষ্রা ৪:৭-২৩) তখন নহিমিয়ের দেওয়ালের ক্ষেত্রে বিরোধিতাও উল্লেখ করা হয় (চার্ট দেখুন)।
- নহিমিয় পুস্তকে ইষ্রার পরিচর্যার বর্ণনা পাওয়া যায় (নহিমিয় ৮-১০)।
নহিমিয় পুস্তকে শেষ উল্লিখিত ঘটনা যার তারিখ দেওয়া আছে হল ৪৩২ খ্রীঃপূঃ। তাই সারাংশে বলা যায় যে, নহিমিয়ের নথি ও লেখাগুলো উদ্ধৃতি করে ধর্ম-শিক্ষক এষ্রা পুস্তকটি ৪৩২ খ্রীষ্টপূর্বের মধ্যে লেখেন। তিনি তার সময়ের যিহূদীদেরকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলোকে ইতিহাস জানানোর ও উৎসাহ দেওয়ার জন্য পু্স্তকটি লেখেন।
মাদিয়-পারস্য সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
ইষ্রা ও নহিমিয় এই দু’টি পুস্তক একসাথে যিহূদীদের একশো বছরের ইতিহাস বর্ণনা করে, প্রায় ৫৩৯ থেকে ৪৩২ খ্রীষ্টপূর্ব পর্যন্ত।
৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদীদের বাবিলে নির্বাসনে নেওয়া হয়েছিল যেখানে তারা মোটামুটি ভাল অবস্থায় জীবন-যাপন করতে পেরেছিল। যখন ৫৩৯ খ্রীষ্টপূর্বে রাজা কোরসের নেতৃত্বে মাদিয়-পারস্যরা বাবিল সাম্রাজ্য দখল করে তখন যিহূদীদের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে যায়। রাজা কোরস বাবিলীয়দের দ্বারা নির্বাসিত জাতিদের নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার এবং সেখানে নিজের ধর্ম পালন করার অনুমতি দেন (ইষ্রা ১:২-৩)। যিহূদীদের চোখের সামনে ঈশ্বরের দু’টি চমৎকার ভবিষদ্বাণী পূর্ণ হয়: প্রায় ১০০ বছর আগে যিশাইয় সেই কোরসের নাম উল্লেখ করে ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি এসে ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করবেন (যিশাইয় ৪৪:২৮-৪৫:১-৬)। এছাড়া ঈশ্বর ভাববাদী যিরমিয়ে দ্বারা ঘোষণা করেছিলেন যে, বাবিলে যিহূদীদের নির্বাসন ৭০ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে (যির ২৯:১১)।
এভাবে যিহূদীদের ইতিহাসে নতুন একটি অধ্যায় শুরু হয়: ৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে সরুব্বাবিলের নেতৃত্বে যিহূদীদের প্রথম একটি দল যিহূদায় ফিরে আসে। ঈশ্বরের আহ্বানে বাধ্য হওয়া সেই যিহূদীদের নামের তালিকা নহিমিয় পুস্তকে গুরুত্বের সঙ্গে ও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয় (নহিমিয় ৭)। ৫১৬ খ্রীষ্টপূর্বের মধ্যে তারা যিরূশালেমে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর সঠিক স্থানে পুনরায় নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। ৪৫৮ খ্রীষ্টপূর্ব ধর্ম-শিক্ষক ইষ্রা দিহূদীদের আর এক দল (বেশিরভাগ লেবীয় ও পুরোহিত) নিয়ে বাবিল থেকে যিহূদায় ফিরে আসেন। সেখানে পৌঁছে ইষ্রা কিছু প্রয়োজনীয় পুনঃসংস্কার পরিচালনা করেন।
এক সময় যিহূদীরা যিরূশালেম শহরের দেওয়াল পুনরায় নির্মাণ শুরু করতে চেষ্টা করে, কিন্তু সাথে সাথে বিরোধিতা উঠে। মাদিয়-পারস্য রাজা অর্তক্ষস্তের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয় যাতে যিহূদার আগের ইতিহাস উল্লেখ করে যিরূশালেম শহরের বার বার বিদ্রোহ করার বিষয় তোলা হয় (ইষ্রা ৪:৭-১৬)। অর্তক্ষস্ত ঐতিহাসিক লেখাগুলো দেখার আদেশ দেন এবং যিরূশালেমের বিভিন্ন বিদ্রোহের ঘটনা নিশ্চিত করা হয়। তা শুনে অর্তক্ষস্ত যিহূদীদের দেওয়াল নির্মাণের নিষেধাজ্ঞা দেন এবং এভাবে নির্মাণের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইষ্রা এই ঘটনার তারিখ দেন না কিন্তু তা ৪৬৪ খ্রীষ্টপর্বের পরে (অর্তক্ষস্তের রাজত্ব শুরু) এবং ৪৪৪ খ্রীষ্টপূর্বের আগে (নহিমিয় দ্বারা দেওয়াল নির্মাণ) ঘটে।
চেতনা ও সিদ্ধান্ত নহিমিয় ১ অধ্যায়
৪৪৪ খ্রীষ্টপূর্বে গল্পটি নতুন মোড় নেয়: সেই সময় নহিমিয় রাজধানী শূশনে বাস করা একজন যিহূদী, যিনি মাদিয়-পারস্য রাজা অর্তক্ষস্তের পানপত্র বাহক হিসাবে কাজ করেন। পানপত্র বাহক ছিল অতি সম্মানিত সরকারি ভূমিকা যাতে শুধুমাত্র অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও ভাল ব্যক্তি ব্যবহৃত হত। রাজা যা খান বা পান করেন, পানপত্র বাহকদের তা আগে খেতে হত – নিশ্চিত করার জন্য যে, খাবারে কোনো বিষ দেওয়া হয়েছে কিনা। এছাড়া তারা সব সময় রাজার সামনে উপস্থিতি থাকতেন, রাজার কাছে তাদের প্রবেশ ছিল এবং যত লোক বা বিষয় রাজার কাছে আনা হত, তারা রাজার কথা বা সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে জানতেন ।
এক দিন যিহূদা থেকে শূশনে ফিরে আসা কয়েকজন যিহূদী নহিমিয়কে জানান যে, যিহূদায় ফিরা যাওয়া যিহূদীদের অবস্থা খাবই কঠিন এবং যিরূশালেম শহর এত বছর পরেও ধ্বংসাবশেষ মাত্র, দেওয়াল ও ফটকগুলো ভাঙ্গা আছে (নহিমিয় ১:৩)। নহিমিয় এই খবর শুনে খুব গভীরভাবে দুঃখে পড়েন ও আবেগীয়ভাবে সাড়া দেন: তিনি কয়েকদিন ধরে কান্না, বিলাপ, উপবাস ও প্রার্থনা করেন (নহিমিয় ১:৪)। কেন এই শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া? যিরূশালেম অনেক আগে ধ্বংস হয়েছিল, তা নতুন খবর না। হতে পারে নহিমিয় মনে করতেন যে, ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা অনুসারে ফিরে যাওয়া যিহূদীদের অবস্থা ভাল, হয়তো এজন্যই তিনি কখনও নিজে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন মনে করেন নি। এখন তিনি বুঝতে পারেন যে, বিষয়টি এমনি এমনি ভাল হবে না, তার অংশ গ্রহণ ও প্রচেষ্টা হয়তো একটি পার্থক্য তৈরি করতে পারে। সম্ভবত তিনি সেই মুহূর্তে নিজের জীবন নতুন আলোতে দেখেন: তিনি বুঝেন যে, তার সরকারি চাকরী তাকে একটি অদ্বিতীয় সুযোগ দান করে, তাই রাজার কাছে তার সুনাম ও সুসম্পর্ক এই বিষয়ে অনেক বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
তিনি মনেপ্রাণে প্রার্থনা ও বিনতি করেন, তিনি জাতির পাপ নিজের পাপ হিসাবে স্বীকার করেন, তার জন্য ক্ষমা চান এবং ঈশ্বরের উপর নির্ভর করেন (নহিমিয় ১:৫-১১)। তিনি সুবিবেচনাপূর্ণভাবে প্রস্তুতিও নেন: যিরূশালেমের দেওয়াল পুনরায় নির্মাণের জন্য তার কি লাগবে, রাজনৈতিক অধিকার, অনুমতির দলিল, মাল পত্রের যোগান ইত্যাদি (নহিমিয় ২:৫-৮)।
অধিকার দান ও কাজে রাজি হওয়া নহিমিয় ২ অধ্যায়
নহিমিয় ঝুঁকি নিয়ে রাজার মনোযোগ আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করেন: তিনি রাজার সামনে তার দুঃখ বা শোক লুকিয়ে রাখেন না এই আশা করে যে, রাজা তাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করবেন। রাজা তার মুখ দেখে মিশুকভাবে তার অবস্থা জেনে নেন। নহিমিয় ভয় পান জেনে যে, এখন বিষয়টি আর এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না – হয়তো তার খেয়াল আছে যে, রাজা অর্তক্ষস্ত আগে একবার যিরুশালেমের দেওয়াল নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন।
নহিমিয় তার দুঃখের কারণ প্রকাশ করেন: তার শহরের, অর্থাৎ যিরূশালেমের দেওয়াল ভাঙ্গা। রাজা জানতে চান তার পরিকল্পনা বা দাবি কি এবং নহিমিয় স্বর্গের দিকে একটি প্রার্থনা পাঠিয়ে তিনি রাজাকে বলেন কাজে সফল হওয়ার জন্য তার কি কি প্রয়োজন। ঈশ্বরের দয়ার হাত প্রকাশিত যখন রাজা অর্তক্ষস্ত নহিমিয়ের সব দাবি পূর্ণ করেন (নহিমিয় ২:১০) এবং তাকে শাসনকর্তা হিসাবে যিহূদায় পাঠান।
যিরূশালেমে পৌঁছে নহিমিয় গোপনে দেওয়ালের অবস্থা পরীক্ষা করে দেখেন এবং শেষে যিহূদী নেতাদের কাছে তার দেওয়াল নির্মাণের পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। রাজা অর্তক্ষস্তের অনুমতি ইতিমধ্যে আছে শুনে তারা রাজি হন এবং নিজেকে নির্মাণ কাজে সমর্পিত করেন (নহিমিয় ২:১১-১৮)।
পরিশ্রম ও একতা নহিমিয় ৩ অধ্যায়
ইচ্ছুক যিহূদীরা শ্রমিক হিসাবে নহিমিয়ের কাছে একত্র হয়। শ্রমিকদের সংখ্যা সীমিত এবং তারা বিভিন্ন ধরণের লোক। নহিমিয় খুব যত্নের সঙ্গে তাদের সাজিয়ে কাজে লাগান। শ্রমিকদের মধ্যে আছে পুরোহিত ও লেবীয়, শাসনকর্তা ও গ্রামের লোকেরা, ধনী ও গরীব, পুরুষ ও মহিলা, স্বর্ণকার, সুগন্ধি তৈরিকর্তা, ব্যবসায়ী ও কৃষক – এবং এখন সবাই একসাথে কাজ করবে (নহিমিয় ৩)। যদিও তাদের অনেক পুরানো ভাঙ্গা পাথরগুলো পরিষ্কার করতে হয় (নহিমিয় ৪:১০) এবং তারা একটি লম্বা দেওয়ালে অল্প ও ছড়িয়ে পড়া কর্মী মাত্র (নহিমিয় ৪:১৯) তবুও তারা মনেপ্রাণে ও প্রতিদিন অনেক ঘণ্টা ধরে পরিশ্রম করতে থাকে (নহিমিয় ৪:৬)। নহিমিয় তাদের সঙ্গে কাজ করেন এবং প্রত্যেক সমস্যা, বাধা বা প্রয়োজন লক্ষ্য করেন। যেন শ্রমিকদের কাজের সময় বাড়াতে পারেন এবং ও কাজের জন্য তাদের অনুপ্রেরণা ধরে রাখতে পারেন তাই নহিমিয় সবাইকে তাদের নিজের বাড়ীর কাছাকাছি দেওয়াল নির্মাণে লাগান (নহিমিয় ৩:২৩ থেকে)।
বিরোধিতা ও কাজে সমর্পিত থাকা নহিমিয় ৪ অধ্যায়
চারিদিকের জাতিদের নেতারা দেওয়াল নির্মাণে বিরোধিতা করে, বিশেষভাবে হোরোণীয় সনবল্লট, অম্মোনীয় কর্মকর্তা টোবিয় ও আরবীয় গেশম। হয়তো তার কারণ হল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যিহূদীদের নিয়ে শত্রুতা অথবা তা হল নতুন শত্রুতা: তারা নহিমিয়ের নেতৃত্ব হুমকিস্বরূপ মনে করে। তারা চায় না যে, যিরূশালেম শক্তিশালী হয়ে উঠুক এবং এভাবে এলাকায় তাদের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ুক (নহিমিয় ২:১৯-২০)।
প্রকৃতপক্ষে যে কোন শহরের জন্য দেওয়াল ও ফটক থাকা মানেই হল শহরের একটি মান-সম্মান, অধিকার, আক্রমণ প্রতিরোধ এবং নিজেকে খুন, লুটপাত ও ধ্বংস থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা। যুদ্ধ বা ঘেরাওয়ের হুমকি হলে চারিদিকে গ্রামের লোকেরা কাছাকাছি দেওয়াল ঘেরা শহরে পালিয়ে আশ্রয় নিত। দেওয়াল ছিল পরিচয়ের ও গর্বের বিষয়। দেওয়াল দ্বারা পার্থক্য করা হয়, কার ভিতরে আসার অধিকার আছে এবং কার নেই। রাজধানী হিসাবে যিরূশালেমের দেওয়াল ও ফটক ছিল আরো গুরুত্বপূর্ণ এবং তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল উপাসনা-ঘর সুরক্ষিত রাখা, যেন তা অশুচি, লুটপাত বা ধ্বংস করা না হয়। এছাড়া যিরূশালেম সম্বন্ধে চমৎকার ভবিষ্যদ্বাণীও ছিল (যেমন মীখা ৪:১-২) এবং একারণে যিরূশালেমের সুরক্ষা ও সম্মান ছিল যিহূদীদের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একারণেও যিহূদীদের বিপক্ষের লোকেরা কোনমতেই চায় না যে, যিরূশালেমে দেওয়াল হোক এবং তাই শুরু থেকে তারা বিরোধিতা করতে থাকে (নহিমিয় ২:১০)।
প্রথমদিকে তারা নহিমিয়ের নির্মাণের প্রচেষ্টা নিচু চোখে দেখে এবং হাস্যকর বানায়। কিন্তু যখন দেওয়ালের কাজ এগিয়ে যায় (নহিমিয় ৪:৬) তখন তারা যিরূশালেমকে হঠাৎ করে আক্রমণ করার জন্য গোপনে পরিকল্পনা করে (নহিমিয় ৪:৭-৮)। নহিমিয় তাদের পরিকল্পনার খবর পেয়ে যতদূর সম্ভব নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন: তিনি দেওয়ালে পাহারাদার রাখেন, তূরীর একটি জরুরী যোগাযোগ পদ্ধতি বসান, শ্রমিকদের সাথে অস্ত্র রাখতে দেন, সব শ্রমিকদের দেওয়ালের ভিতরে বাস করতে বলেন এবং আরো বেশি করে ঈশ্বরের কাছে সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা করেন (নহিমিয় ৪:১৫-২৩)।
যখন বিরোধী লোকেরা বুঝে যে, তাদের গোপন পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়েছে তখন তারা পরিবর্তে নহিমিয়কে আটকানোর ও ক্ষতি করার জন্য একটি সভায় ডাকে (নহিমিয় ৬:২)। নহিমিয় সভায় আসার ডাক বার বার অস্বীকার করেন, এমন কি যখন তারা তাকে মাদিয়-পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নিন্দা সরকারের কাছে পৌঁছানোর হুমকি দেয়, তখনও নহিমিয় তাদের সাথে দেখা করতে রাজি হন না (নহিমিয় ৬:৩-৯)। পরবর্তীতে তারা নহিমিয়কে হুমকি দিয়ে নিজের জন্য উপাসনা-ঘরে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়ায় বাধ্য করতে চেষ্টা করে, যেন তারা তার সুনাম নষ্ট করতে পারে। কিন্তু আবারও তাদের কৌশল ব্যর্থ হয় (নহিমিয় ৬:১০-১৪)।
এইসব বিরোধিতা ও কৌশলের মাঝখানে নহিমিয় হলেন প্রার্থনাশীল, সতর্ক ও প্রজ্ঞাবান। তিনি প্রয়োজন অনুসারে কিছু পদক্ষেপ নেন কিন্তু তিনি তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা সফল হতে দেন না। তিনি খুব ব্যবহারিক চিন্তা করেন এবং বিপদ হালকাভাবে নেন না। তিনি যত্নের সঙ্গে আগান, কিন্তু তারপরেও তিনি সাহসী ও আশাবাদী। তিনি নিজেও কাজে নামেন এবং শ্রমিকদের সমস্যা বা বাধা বোঝেন এবং সেই সাথে সমাধানও করেন। তিনি নিজের জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা নিতে রাজি হন না, যার কারণে শ্রমিকেরা অনুপ্রেরণা পেয়ে কাজ চালিয়ে নিতে থাকে। তিনি কাজে ও বড় উদ্দেশ্যে অত্যন্ত সমর্পিত। তিনি প্রত্যেক মুহূর্তে প্রার্থনাশীল এবং পরিশ্রমী, তিনি প্রত্যেক চ্যালেঞ্জে সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল এবং সাথে সাথে তিনি বিভিন্ন সম্ভাবনার জন্য প্রস্তুতি নেন। আমাদের আধুনিক যুগে আমরা এই দু’টি বিষয় বিপরীত মনে করি (‘কাজ করা মানে প্রার্থনায় বিশ্বাস না করা’ বা ‘বিকল্প ধারার প্রস্তুতি নেওয়া মানে ঈশ্বরের উপর নির্ভর না করা’) – কিন্তু নহিমিয় আমাদের অন্য কিছু শেখান: তিনি প্রার্থনাও করেন (বিশ্বাস) এবং সেই সাথে কাজও করেন (পদক্ষেপ গ্রহণ)।
অন্যায় ও অন্যায়ের সমাধান নহিমিয় ৫ অধ্যায়
কঠোর পরিশ্রম, দান ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্মাণের সময়ে শুধুমাত্র যে বাইরে থেকে হুমকি আসছে তা নিয় বরং যিহূদী সমাজের ভিতরেও সমস্যা দেখা দেয়: অনেক গরীব যিহূদী ধনী যিহূদীদের কাছে ঋণী হয়ে পড়েছে অথবা এমন কি দাসত্বে পড়েছে (নহিমিয় ৫:১-৫)। সম্ভবত দারিদ্রতার কারণ হল মাদিয়-পারস্য সরকারের কর-আদায়, সন্তানদের সংখ্যা এবং ঋণে সুদ বা অতিরিক্ত সুদ নেওয়া। এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, গরীবদের ধার দেওয়ার আর জমি নেই, বন্ধকে দেওয়ার আর জিনিস নেই, এমন কি তাদের সন্তানদেরও ইতিমধ্যে বন্ধকে দিতে হয়েছে। এই বিষয়টি লক্ষ্য করার পরে নহিমিয় শক্তিশালীভাবে পদক্ষেপ নেন:
তিনি ধনী যিহূদীদের দায়বদ্ধ করে রাখেন, আইন ভাঙ্গার জন্য তাদের ধমক দেন এবং তাদের থেকে শপথ নেন, যেন তারা ঋণগুলো এবং যিহূদী দাসদের ছেড়ে দেয় (নহিমিয় ৫:৬-১৩)। নহিমিয় মূলত একটি ‘জুবল বছর’ বা ‘ফিরে পাবার বছর’ বিস্তার করেন (Jubilee, লেবীয় ২৫ অধ্যায় দেখুন): ঋণের মকুব করা, বন্ধন শ্রমিকদের মুক্ত করা এবং জমি আসল মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া। কেন ধনীরা নহিমিয়ের দাবি মেনে নেয়? সম্ভবত তার প্রধান কারণ হল যে, নহিমিয় নিজেই খুব সীমিত ব্যয়ে চলেন, অর্থাৎ তিনি শাসনকর্তার অনুমোদিত টাকা ও খাবার নিজের জন্য দাবি করেন না বরং তিনি খুব পরিশ্রম করেন এবং তার ব্যক্তিগত টাকাও দাসদের ‘মুক্তি’ কেনার জন্য ব্যয় করেন (নহিমিয় ৫:১৪-১৯)।
দেওয়াল সমাপ্ত ও উৎসর্গ, লোকসংখ্যা বাড়ানো নহিমিয় ৬, ১১, ১২ অধ্যায়
অবিশ্বাস্য যে, নহিমিয় ও তার যিহূদী শ্রমিকদল শুধুমাত্র বাহান্ন দিনের মধ্যে দেওয়ালের নির্মাণ সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হন, যাতে এমন কি শত্রুরাও বুঝে পারে যে, এর পিছনে অবশ্যই ঈশ্বরের হাত ছিল (নহিমিয় ৬:১৫-১৯)। দেওয়ালগুলো ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করার জন্য যিহূদীরা একটি বড় আনন্দের অনুষ্ঠান উৎযাপন করে: লোকদের দু’টি দলে ভাগ করে দু’টি দল বিপরীত দিকে দেওয়ালের উপরে শহরের চারিদিকে গিয়ে গান করে ও আনন্দ করে এমন সময় পর্যন্ত যে, তার মাঝখানে আবার একত্রিত হবে (নহিমিয় ১২:২৭-৩৪)।
দেওয়াল ও ফটক এখন আছে বলে নতুন ব্যবস্থাপনার বিষয় উঠে: নহিমিয় ফটকের দেখাশোনার জন্য বিশ্বস্ত পাহারাদার লাগান। তাদের বলা হয় যেন তারা “রোদ বেশী না হওয়া পর্যন্ত” ফটক খুলে না দেয়, কারণ সেই সময় যিরূশালেমের লোকসংখ্যা কম ছিল এবং তখনও বেশি নতুন বাড়ী তৈরি হয় নি (নহিমিয় ৭:১-৪)। তাই নহিমিয় শহরে বসবাসকারীদের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলার জন্য ব্যবস্থা নেন (নহিমিয় ১১)। এই পর্যন্ত যিরূশালেমের বেশিরভাগ লোকসংখ্যা হল পুরোহিত, লেবীয়, উপাসনা-ঘরের সেবাকারী ও শলোমনের সেবাকারীরা। সব প্রচেষ্টার পরেও যিরূশালেম এখনও আকর্ষণীয় বাসস্থানে পরিণত হয় নি।
সরুব্বাবিলের নেতৃত্বে ফিরা আসা যিহূদীদের নাম ও সংখ্যার দ্বিতীয় তালিকা নহিমিয় ৭ অধ্যায়
ইষ্রা খুব মনোযোগ সহকারে যিহূদায় ফিরে আসা যিহূদী নেতাদের নাম ও সঙ্গে লোকদের সংখ্যা (পরিবার অনুসারে বা বাসস্থান অনুসারে) লিপিবদ্ধ করেন। পুরোহিত, লেবীয় (গায়ক, পাহারাদার ও উপাসনা-ঘরের সেবাকারী দল) এবং শলোমনের চাকরদের বংশ তিনি আলাদা করে উল্লেখ করেন। আসলে আমরা সরুব্বাবিলের সময়ে ফিরে আসা যিহূদীদের ২টি তালিকা পাই, একটি ইষ্রা ২ অধ্যায়ে এবং এখানে নহিমিয় ৭ অধ্যায়ে সেটির পুনরুল্লেখ। এই দু্’টি তালিকা তুলনা করলে সংখ্যার একটু কমবেশি লক্ষ্য করা যায়। সম্ভবত নহিমিয় পুস্তকের তালিকা হল আগের তালিকার সংশোধন বা আধুনিকীকরণ, কারণ সম্ভবত আরো যিহূদী চলে এসেছিল অথবা আবার চলেও গিয়েছিল।
যদিও আমরা নামের ও সংখ্যার তালিকা পড়া বেশি মজা পাই না তবুও তালিকাগুলোর গুরুত্ব অবশ্যই আছে। তালিকাগুলো আমাদের দেখায় যে, ঐতিহাসিক ঘটনা ও তথ্য যত্ন সহকারে লিপিবদ্ধ করা এবং কার্যকারী ব্যবস্থাপনা সবই প্রয়োজন। আরো দেখায় যে, প্রত্যেকটি মানুষের সাড়া, ত্যাগ-স্বীকার ও বাধ্যতা অত্যন্ত মূল্যবান। আগের যুগে একজন ইস্রায়েলীয় জন্মগতভাবে ঈশ্বরের জাতির সদস্য হত কিন্তু এখন তা প্রত্যেক ব্যক্তির ঈশ্বরের প্রতি সাড়া দেওয়ার ও নিজেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটি বিষয় হয়ে যায়। তাই এই তালিকাগুলো হল ইচ্ছুক লোকদেরই তালিকা। নতুন নিয়মের দিকে আগালে জাতিগত পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তির সিদ্ধান্তের গুরুত্ব বাড়তে থাকে।
আইন-কানুন পড়ানো ও কুঁড়ে-ঘরের পর্ব পালন নহিমিয় ৮ অধ্যায়
মোশির আইন-কানুনে যেমন বলা হয়, ঠিক তেমনি যিহূদীরা সপ্তম মাসে একটি সভায় একত্র হয়। উপবাস করে, চট পরে ও মাথায় ধূলা দিয়ে তারা ধর্ম-শিক্ষক ইষ্রাকে পবিত্র শাস্ত্র থেকে পড়তে বলেন এবং যাদের বুঝার ক্ষমতা আছে (পুরুষ, মহিলা ও ছেলেমেয়ে), তারা আইনের পাঠ শুনে (নহিমিয় ৮:১-২)। তারা ভক্তিপূর্ণ ভয়ে এবং মনোযোগ সহকারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আইন-কানুনের পাঠ শুনতে থাকে। পাঠের সঙ্গে লেবীয়েরা আইনের সাহায্যকারী ব্যাখ্যা করে, যেন সবাই বুঝে কি পড়া হল (নহিমিয় ৮:৫-৮)। আইন শুনে লোকেরা চেতনা পায় এবং ঈশ্বেরে বাক্য বুঝেছে বলে কান্না শুরু করে। ইষ্রা ও নহিমিয় লোকদের উৎসাহিত করেন যে, তাদের অনুতাপে ঈশ্বর খুশি হন। এভাবে ইষ্রা ও নহিমিয় এই ভক্তের সভা একটি আনন্দের ও উৎযাপনের সভায় পরিণত করে বলেন “কারণ সদাপ্রভুর দেওয়া আনন্দই হল আপনাদের শক্তি” (নহিমিয় ৮:৯-১২)।
আইন-কানুনের নির্দেশ অনুসারে এবং অনেক আনন্দের সঙ্গে তারা বাছুরিক কুঁড়ে-ঘরের পর্ব পালন করে, যেখানে স্মরণ করা হয় কিভাবে ইস্রায়েল মরুভূমিতে তাম্বু ফেলে বসবাস করেছিল (নহিমিয় ৮:১৩-১৮)।
জাতীয় পাপ স্বীকার ও অনুতাপ প্রার্থনা নহিমিয় ৯ অধ্যায়
লক্ষণীয় বিষয় হল যে, তাদের এই আনন্দের উৎসবটি চেতনা পাওয়ার, পাপ স্বীকার করার ও অনুতপ্ত হওয়ার সময়ে পরিণত হয়। এর প্রভাবে যারা দেবতাপূজারী মহিলাদের বিয়ে করেছিল তারা সেই বিয়েগুলো বিচ্ছেদ করে (নহিমিয় ৯:২)। সম্ভবত, তা হল সেই একই ঘটনা যা ইষ্রা ৯-১০ অধ্যায়েও বর্ণনা করা হয়েছে। অথবা তা হল একই সমস্যা যা পুনরায় দেখা দিল। ইষ্রা ও লেবীয়েরা সেই সময় একটি অনুতাপের প্রার্থনা পরিচালনা করেন, যাতে তারা ইস্রায়েলের অবিশ্বস্ততার ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেন। তারা ঈশ্বরকে ডাকেন যেন তিনি তাদের বর্তমান কষ্ট বিবেচনা করেন এবং তাদের আবারও দয়া দান করেন (নহিমিয় ৯:৬-৩৭)।
আইন-কানুন পালন করার জন্য লোকদের চুক্তি নহিমিয় ১০ অধ্যায়
এই চেতনা ও অনুতাপের ফলে যিহূদী পুরুষ, মহিলা ও ছেলেমেয়েরা নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য থাকার একটি চুক্তিতে সমর্পিত করে। নহিমিয়, নেতারা, লেবীয়দের বিভিন্ন দল এবং পুরোহিতেরা লোকদের পক্ষ হয়ে চুক্তির সেই দলিলে সাক্ষর করেন এবং এই চুক্তির সাক্ষী, স্মরণ ও দায়বদ্ধতা হিসাবে তা সীলমোহর করে রেখে দেন (নহিমিয় ৯:৩৮-১০:২৭)।
তারা আইন-কানুনের সারাংশ এভাবে দেন: দেবতাপূজারী স্ত্রী বা স্বামী গ্রহণ না করা, বিশ্রাম বারে বেচাকেনা না করা, বিশ্রাম বছরের ঋণ মকুব করা এবং ফসল না পাওয়ার বিষয় মেনে নেওয়া, উপাসনা-ঘরের কর দেওয়া, উৎসর্গগুলোর জন্য নিয়মিত জ্বালানী কাঠ নিয়ে আসা এবং প্রথম জাত, প্রথম ফসল ও দশমাংশ উপাসনা-ঘরে নিয়ে আসা, যেন লেবীয়দের আয় নিশ্চিত হয় (নহিমিয় ১০:২৮-৩৯)। যদিও এই তালিকায় তারা আইন-কানুন থেকে শুধুমাত্র কিছুটা আইন তুলেছে তবুও এই সারাংশে বর্তমান অবাধ্যতার সংশোধন দেখা যায় (নহিমিয় ৯:২, ১৩:১-৩,৪-১৪,১৫-২২,২৩-৩১ দেখুন)।
পুরোহিত ও লেবীয়দের তালিকা নহিমিয় ১২ অধ্যায়
নহিমিয় ১২ অধ্যায়ে আমরা পুরোহিত ও লেবীয়দের বিস্তারিত তালিকা পাই। নহিমিয় ও ইষ্রা দু’জনই লেবীয়দের ও পুরোহিতদের ক্ষেত্রে ভাল ব্যবস্থাপনা ও পুনঃসংস্কার আনায় গুরুত্ব দেন, এই তালিকাগুলোতে তা প্রকাশিত। ফলে লোকদের চোখে লেবীয় ও পুরোহিতদের সম্মান বাড়ে।
যিহূদায় ফিরে আসার পরে নহিমায়ের পুনঃসংস্কার নহিমিয় ১৩ অধ্যায়
১২ বছর ধরে শাসনকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করার শেষ দিকে, অর্থাৎ ৪৩২ খ্রীষ্টপূর্বে নহিমিয় সম্ভবত রাজা অর্তক্ষ্যস্তকে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য (নহিমিয় ১৩:৬) এবং তার সাথে একটি আন্তরিক পুনর্মিলনের জন্য (নহিমিয় ২:৬) যিহূদা থেকে রওনা দেন। যখন নহিমিয় আবার যিহূদায় ফিরে আসেন তখন তিনি দেখতে পান যে, কয়েকটি বিষয় (যার জন্য তিনি সুন্দর ব্যবস্থাপনা করে চলে গিয়েছিলেন) তার অনুপস্থিতিতে ভেঙ্গে গেছে বা দুর্নীতিতে পড়েছে। নহিমিয়ের মত একজন ত্যাগ-স্বীকারের ও মনেপ্রাণের নেতার জন্য তা অবশ্যই খুব নিরাশার বিষয়। তিনি খুবই আবেগীয় প্রতিক্রিয়া দেখান, রাগ প্রকাশ থেকে এমন কি কিছু লোকদেরকে মার দেওয়া পর্যন্ত (নহিমিয় ১৩:২৫)। যে বিষয়গুলোর প্রতিরোধের জন্য লোকেরা চুক্তিতে সমর্পিত হয়েছিল, ঠিক সেইগুলো এখন আবারও দেখা দিয়েছে, সম্ভবত এজন্যই নহিমিয়ের নিরাশা এত বেশি: দেবতাপূজারী বিয়ে করা (নহিমিয় ১৩:২৩-২৭), বিশ্রাম বারে বেচা-কেনা (নহিমিয় ১৩:১৫-২২) এবং লেবীয়দের যোগানের ক্ষেত্রে অবহেলা (নহিমিয় ১৩:১০-১৪)। তবুও যারা এই ধরণের কাজ করেছে, তিনি তাদেরকে শাসনকর্তা হিসাবে শাস্তি দেন না বরং বলেন যে, তিনি আইন ভাঙ্গা ভবিষ্যতে আর মেনে নেবেন না। বিভিন্ন ধরণের দুর্নীতির বিরুদ্ধে নহিমিয়ের মনেপ্রাণে প্রচেষ্টা হল আমাদের জন্যও আদর্শস্বরূপ।
দুর্নীতি এবং নিজের আত্মীয়কে প্রাধান্য দেওয়া, এমন কি তা পুরোহিত পরিবারেও দেখা যায়। মহাপুরোহিত ইলিয়াশীবের পরিবারের সদস্যরা দেবতাপূজারী বিয়ে করেছে, এমন কি বিরোধীয় সন্বল্লট ও টোবিয়ের পরিবারের লোকদের সাথে বিয়ে করেছে। এখানে দু’টি ব্যাখ্যা সম্ভব: হয়তো পুরোহিত পরিবারের দেবতাপূজারী বিয়ে করা হল নহিমিয়ের অনুপস্থিতির সময়ের ঘটনা – যার অর্থ হল যে, মহাপুরোহিত নহিমিয় ও ইষ্রার এই প্রচেষ্টা এবং চুক্তি তুচ্ছ করে সবার সামনে বিপরীত আচরণ করেছেন। অথবা যখন দেবতাপূজারী অন্যান্য বিয়েগুলো বিচ্ছেদ করা হয়েছিল তখন লোকেরা তা বাধ্য হয়ে মেনে নেয়, কিন্তু মহাপুরোহিত পরিবার তা অগ্রাহ্য করেছিল। উভয় ব্যাখ্যা মহাপুরোহিত পরিবারকে ভাল আলোতে দেখায় না।
দেখা যায় যে, মহাপুরোহিত ইলিয়াশীবের পরিবারের লোকেরা দেবতাপূজারী বিয়ে করে (বা বিচ্ছেদ করে না), শুধুমাত্র তা-ই নয়, ইলিয়াশীব শত্রু অম্মোনীয় টোবিয়কেও উপাসনা-ঘরে একটি বড় কামরা দান করেন, যেখানে আগে পবিত্র দানগুলো রাখা হত। উপাসনা-ঘর এভাবে মহাপুরোহিতের অনুমোদনে অশুচি করা হয় শুনে, নহিমিয় রেগে গিয়ে টোবিয়ের জিনিসপত্র নিজের হাত দিয়ে বাইরে ফেলে দেন (নহিমিয় ১৩:৪-৯)।
এমন কি নহিমিয়ের মত সৎ, সমর্পিত ও অনুপ্রেরণাপূর্ণ একজন নেতা থাকলেও লোকদের মধ্যে অনুপ্রেরণা, সততা, নৈতিকতা ও ঈশ্বরের ভক্তিপূর্ণ ভয়ে চলা ধরে রাখা কঠিন। মানুষের হৃদয়ে অনবরত পবিত্র আত্মার চেতনা ও নতুনীকরণের কাজ অত্যন্ত প্রয়োজন।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।