ইস্রায়েল জাতি যখন মরুভূমিতে চল্লিশ বছর ঘুরে, সম্ভবত তখন মোশি তার পাঁচটি পুস্তক লেখেন। মোশির এই পঞ্চপুস্তকে (Pentateuch) তিনি উভয় ইস্রায়েল জাতিকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা এবং সাথে সাথে ঈশ্বরের আইন-কানুন দেন। কিভাবে জানা যায় যে মোশি পঞ্চপুস্তকের লেখক? পাঁচটি পুস্তকে বেশ কয়েক বার উল্লেখ আছে যে মোশি “সব কিছু লিখে রাখলেন”। পুরাতন ও নতুন নিয়মের পরের লেখকেরা – এবং যীশু নিজেই – প্রায়ই “মোশির লেখা” হিসাবে চিহ্নিত করে এই পাঁচটি পুস্তকের উল্লেখ বা উদ্ধৃতি করেন। এভাবেই মোশি লেখক হিসাবে ঘোষিত। মোশির পঞ্চপুস্তকের মধ্যে যাত্রাপুস্তক হল দ্বিতীয় পুস্তক।
ইস্রায়েল জাতির জন্য (এবং সবার জন্য) যাত্রাপুস্তকের গুরুত্ব কত বেশি, তা প্রায় বলার বাইরে। যাত্রাপুস্তকে মোশি ইস্রায়েল জাতির উদ্ধারের ইতিহাস লিখে রাখেন, অর্থাৎ মিসরের বন্ধন থেকে তাদের আশ্চর্যভাবে মুক্তিলাভের গল্প। যাত্রাপুস্তকে সদাপ্রভু নিজেকে সর্বক্ষমতার অধিকারী ঈশ্বর হিসাবে প্রকাশিত করেন। যদিও মিসর ছিল সেই সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য তবুও মহান ঈশ্বর তাদেরকে ণত ও পরাজিত করেন। এই ঈশ্বরের তুলনায় মিসরীয় দেবতাগুলো হাস্যকর। ঈশ্বর তাঁর অত্যাচারিত জাতির জন্য চিন্তাশীল, তিনি মানুষদের কান্না শোনেন, দেখেন এবং দুর্বলদের পক্ষে দাঁড়ান। ঈশ্বর নিজেকে ইস্রায়েলের কাছে প্রকাশিত করেন। কিন্তু একই সময়ে তিনি নিজেকে মিসরের কাছে (মিসরীয় লোক, কর্মচারী ও ফরৌণের কাছে) এবং এমন কি চারিদিকে জাতিদের কাছেও প্রকাশিত করেন (যাত্রা ১৫:১৪-১৬, যিহোশূয় ২:৯-১১)।
মিসরের ফরৌণ ইস্রায়েলীয়দের নাগরিক হিসাবে দেশে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন না, তাদেরকে ছেড়ে দিতেও রাজি নন (যাত্রা ১:৬-৮)। ফরৌণ যদি দু’টার মধ্যে (রাখা বা ছাড়া) যে কোন একটা করতেন তবে তা পাপ হিসাবে দাঁড়াত না, কিন্তু ফরৌণ যা করেন, তা বড় অন্যায়। মোশি ইস্রায়েলের জন্য মুক্তি চান, ফরৌণ এই দাবি অস্বীকার করে বরং তাদের উপরে আরো পরিশ্রম চাপিয়ে দেন (যাত্রা ৫:৬-৯)।
ঈশ্বর মিসরের উপর আঘাত পাঠান। মোশি প্রত্যেকটি আঘাতের অগ্রিম ঘোষণা দেন এবং এভাবে আঘাত শুরু হওয়ার আগে ফরৌণকে মন ফিরানোর সুযোগ দেন। মোশি নির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করেন পরবর্তী আঘাত কখন শুরু হবে যেন সবাই বুঝতে পারে যে, এই আঘাতটি এমনি এমনি হচ্ছে না, বরং ঈশ্বর এটাই ঘটান। আঘাতগুলো দিনে দিনে আরো কঠোর হয়ে যায়। শুরুরদিকে আঘাতগুলো বিরক্তিকর, কিন্তু এখনও ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু যত সময় যেতে থাকে, আঘাতের ক্ষতির পরিমাপ বাড়ে। এছাড়া ঈশ্বর প্রত্যেক আঘাত দ্বারা মিসরীয়দের কয়েকটি দেব-দেবতা হাস্যকর বানান। তিনি দেখান যে দেব-দেবতারা নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, লোকদেরকেও রক্ষা করতে সক্ষম নয়। তা ছাড়া আঘাতগুলো যত ঘটতে থাকে, আঘাতগুলো তত নির্দিষ্ট হয়ে যায়। প্রথমদিকে আঘাতগুলো সবার উপর পড়ে, পরবর্তীতে শুধু মিসরীয়দের উপর আসে কিন্তু ইস্রায়েলীয়রা রেহাই পায়। পরে আঘাতগুলো শুধু এমন মিসরীয়দের উপর আসে যারা ঈশ্বরের ঘোষণায় কোন গুরুত্ব দেয় নি (যাত্রা ৯:১৯-২১) এবং শেষ আঘাতটি শুধু এমন লোকদের উপর পড়ে যারা ঈশ্বরের দেওয়া নির্দেশনা পালন করে নি, মিসরীয় হোক বা ইস্রায়েলীয় হোক (যাত্রা ১২:২৩)।
ফরৌণ বার বার নিজের হৃদয় কঠিন করে রাখেন। অনেক প্রমাণ পাওয়ার পরেও (আঘাতের নির্দিষ্ট ঘোষণা, ঘটা ও তুলে নেওয়া) ফরৌণ আঘাতের পিছনে ঈশ্বরের হাত অস্বীকার করেন, ইস্রায়েল জাতিকে ছেড়ে দেওয়ার দাবিও অস্বীকার করেন। তিনি জেনে বুঝে ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যকে ও ঈশ্বরকে প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন এবং শেষে এমন পর্যায় পৌঁছান যা থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। শেষ কয়েকটি আঘাতে ঈশ্বর নিজেই ফরৌণের হৃদয় আরো কঠিন করেন, অর্থাৎ ফরৌণ যে পথ পছন্দ করেছেন এবং সেই প্রতারণা তিনি আলিঙ্গন করেছেন, ঈশ্বর ফরৌণকে তার মধ্যে ছেড়ে দেন।
দশম আঘাত, অর্থাৎ সেই ভয়ংকর আঘাত যার ফলে মিসরীয়দের প্রথম ছেলের মৃত্যু ঘটে – আঘাতটির ঠিক ফরৌণের প্রথম বড় অন্যায়ের সাথে মিল আছে: ইস্রায়েলীয়দের সন্তানদের মেরে ফেলা (যাত্রা ১:২২)। এই ধ্বংসাত্মক আঘাতের পরে ফরৌণ ইস্রায়েল জাতিকে চলে যাওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তিনি মন পরিবর্তন করে ইস্রায়েলীয়দের পিছনে তার উন্নত মানের ঘোড়ার রথের সৈন্যদল পাঠান। তখন ঈশ্বর সব আশ্চর্যকাজের মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুতটা ঘটিয়ে দেন: তিনি সাগর ভাগ করে তাঁর জাতিকে উদ্ধার করেন এবং সাথে সাথে মিসরীয় সৈন্য ধ্বংস করেন।
দিনের বেলায় মেঘের থাম ও রাতের বেলায় আগুনের স্তম্ভের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর মোশিকে ও ইস্রায়েল জাতিকে দৃশ্যমানভাবে পরিচালনা করেন। তিনি ইস্রায়েল জাতিকে মরু-এলাকা হয়ে সিনাই পাহাড়ে নিয়ে যান, যেখানে তিনি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ও সময় কাটাতে চান। ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতির কাছে প্রস্তাব দেন যেন তারা তাঁর সঙ্গে চুক্তি করে এবং এভাবেই ঈশ্বরের আপন জাতি হয়, এমন একটি আকর্ষণীয়, আদর্শ পুরোহিত রাজ্য যা ঈশ্বরকে চারিদিকে জাতিদের কাছে প্রকাশিত করবে (যাত্রা ১৯:৪-৬)। ইস্রায়েলীয়রা ঈশ্বরের সঙ্গে চুক্তিতে আসতে রাজি যদিও তারা ঈশ্বরের উপস্থিতিতে ভয় পায় (যাত্রা ২০:১৮-১৯)। তারা ঈশ্বরের দেওয়া আইন-কানুন পালন করতে (দশ আজ্ঞা ও অন্যান্য সামাজিক আইন, যাত্রা ২০-২৪) রাজি হয়। মোশি সেই আইনগুলো বর্তমান ইস্রায়েল এবং ইস্রায়েলের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য লিখিত রাখেন।
কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে ইস্রায়েল জাতি চুক্তি ভেঙ্গে ফেলে। যখন মোশি সিনাই পাহাড়ে চল্লিশ দিন ধরে ঈশ্বরের সঙ্গে সময় কাটান, তারা চোখের সামনে ঈশ্বরের উপস্থিতির মেঘ থাকলেও এবং দিনে দিনে মান্না খেলেও তারা ঈশ্বরকে অস্বীকার করে। ঈশ্বরের পরিবর্তে তারা নিজের হাতে বানানো একটি সোনার বাছুর মূর্তি তৈরি করে এবং ঘোষণা করে যে এই দেবতা তাদেরকে মিসর থেকে মুক্ত করে এনেছে। এটা দেখে ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে ধ্বংস করতে চান, কিন্তু তিনি ইস্রায়েল জাতির জন্য মোশিকে বিনতি করতে দেন এবং তার প্রার্থনায় সাড়াও দেন। যারা সোনার বাছুর ও তার পূজা চালিয়েছিল, তাদেরকে ধ্বংস করার জন্য ঈশ্বর ইস্রায়েলীয়দের চ্যালেঞ্জ করেন। মোশি ইস্রায়েলকে অনুতাপে পরিচালনা করেন এবং তাদের জন্য বিনতি করতে থাকেন। ঈশ্বর ইস্রায়েলকে তাঁর চুক্তির জাতি হিসাবে পুনরায় গ্রহণ করেন।
ঈশ্বরের সঙ্গে সহভাগিতায় সময় কাটানোর জন্য মোশি বার বার সিনাই পাহাড়ে ওঠেন, সেখানে ঈশ্বর তাকে একটি আবাস-তাম্বু, অর্থাৎ একটি আত্মিক কেন্দ্র তৈরি করার দিক-নির্দেশনা দেন। আবাস-তাম্বুটি হল শক্তিশালী একটি চিহ্ন যে, ঈশ্বর তাঁর জাতির মধ্যে বাস করতে চান। কিন্তু ঈশ্বর পবিত্র, তাই আবাস-তাম্বুতে প্রবেশ করতে গেলে খুব নির্দিষ্ট নিয়মগুলো পালন করতে হবে: ঈশ্বর কাছেই আছেন – কিন্তু ঈশ্বর পবিত্র! ঈশ্বর সহভাগিতা চান কিন্তু মানুষ পাপে পূর্ণ। ঈশ্বরের প্রতি আকর্ষণ, কিন্তু সাথে ভক্তিপূর্ণ ভয়। ইস্রায়েলীয়রা ঈশ্বরের নির্দেশনা অনুসারে আবাস-তাম্বু এবং তাম্বুর সব জিনিস-পত্র তৈরি করে। এগুলো সব তৈরি হওয়ার পরে ঈশ্বরের উপস্থিতি দৃশ্যমানভাবে মেঘের থামে আবাস-তাম্বুর উপরে নেমে আসে (যাত্রা ৪০)। এইটার দ্বারা ঈশ্বর নতুন তাম্বুকে তাঁর অনুমোদন দেন এবং সাথে প্রকাশ করেন যে, তিনি ইস্রায়েলকে পুনরায় গ্রহণ করেছেন। এই ঘটনা হল যাত্রাপুস্তকের চরম মুহূর্ত।
পুস্তকের লেখক এবং সংরক্ষণ
যাত্রাপুস্তক হল মোশির পঞ্চপুস্তকের মধ্যে দ্বিতীয় পুস্তক। সম্ভবত মোশি পঞ্চপুস্তক লেখেন যখন ইস্রায়েল জাতি চল্লিশ বছর মরুভূমিতে ঘুরে। পঞ্চপুস্তকে উভয় ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা এবং ঈশ্বরের দেওয়া আইন-কানুন পাওয়া যায়। আমরা কিভাবে জানতে পারি যে মোশি পঞ্চপুস্তকের লেখক? পাঁচটি পুস্তকে বেশ কয়েক বার উল্লেখ করা হয়েছে যে মোশি “সব কিছু” লিখে রাখতেন (যাত্রা ১৭:১৪, ২৪:৪, ৩৪:২৭, গণনা ৩৩:২, ২য় বিবরণ ৩১:৯)। বিশেষভাবে তার জীবনের শেষে তিনি “এই আইন-কানুন আগাগোড়া একটি বইয়ে লিখে নিলেন” এবং পুস্তকটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আবাস তাম্বুতে নিয়ম-সিন্দুকের সাথে রাখার ব্যবস্থা করেন (২য় বিবরণ ৩১:২৪-২৫)। এভাবে মোশি পঞ্চপুস্তকের সংরক্ষণ ও নিয়মিতভাবে সব ইস্রায়েল জাতির কাছে তার পাঠ নিশ্চিত করেন (২য় বিবরণ ৩১:১০-৩৩)।
পুরাতন নিয়মের পরবর্তী লেখকেরা বার বার পঞ্চপুস্তক (এবং তার মধ্যে যাত্রাপুস্তকও) “মোশির আইন-কানুন” বা “মোশির পুস্তকগুলো” বলে উল্লেখ বা উদ্ধৃতি করেন (যিহো ১:৭-৮, ১ রাজা ২:৩, ১৪:৬, দানিয়েল ৯:১১-১৩, ইষ্রা ৬:১৮, নহি ১৩:১, মালা ৪:৪)। পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, পরবর্তী লেখকেরা পঞ্চপুস্তকের লেখক হিসাবে মোশিকে চিহ্নিত রাখেন। ঠিক তেমনি নতুন নিয়মের লেখকেরা – এবং যীশু নিজেই – আইন-কানুন থেকে উদ্ধৃতি করার সময় তা “মোশির লেখা” হিসাবে চিহ্নিত রাখেন এবং এভাবে মোশিকে লেখক হিসাবে ঘোষিত করেন (মথি ৮:৪, ২২:২৪, মার্ক ১:৪৪, ১২:২৬, লূক ১৬:২৯-৩১, যোহন ১:১৭, ৭:১৯, প্রেরিত ৩:২২, ২৬:২২, রোমিয় ১০:১৯, ১ করি ৯:৯, ২ করি ৩:১৫)। এভাবে আমরা নিশ্চিত জানতে পারি যে মোশি পঞ্চমপুস্তকের লেখক।
যাত্রাপুস্তকের পাঠকেরা এবং ইস্রায়েল জাতির জন্য এই পুস্তকের গুরুত্ব
যাত্রাপুস্তক ইস্রায়েল জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুস্তকটি হল ইস্রায়েল জাতির উদ্ধারের ইতিহাস, মিসরের দাসত্ব থেকে তাদের মুক্তিলাভের গল্প। ঈশ্বর নিজেকে সর্বশক্তিমান ও সমস্ত মিসরীয় দেবতাদের উপরে সার্বভৌম ঈশ্বর হিসাবে প্রকাশিত করেন। তিনি তাঁর অত্যাচারিত জাতির জন্য যত্ন নেন, তাদের কান্না শোনেন এবং তাদের কষ্ট দেখেন। তিনি দুর্বল ও নির্যাতিতদের পক্ষে দাঁড়ানোর ঈশ্বর। ঈশ্বর নিজেকে শুধুমাত্র ইস্রায়েলীয়দের কাছে প্রকাশ করেন, তা নয় বরং তিনি নিজেকে মিসরীয়দের কাছে প্রকাশ করেন (ফৌরণের কাছে, কর্মকর্তাদের কাছে এবং সাধারণ লোকদের কাছে), এমন কি চারিদিকে জাতিগুলোর কাছেও প্রকাশিত করেন (যাত্রা ১৫:১৪-১৬, যিহো ২:৯-১০)। ঈশ্বর হলেন অদ্বিতীয় ক্ষমতাশালী উদ্ধারকর্তা।
কিন্তু আর একটি প্রশ্ন উঠে আসে: উদ্ধার – কিন্তু কোন উদ্দেশ্যে? ইস্রায়েল জাতির উদ্ধার হয়েছে – এখন তাদের নিয়ে ঈশ্বরের পরিকল্পনা কি? ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে “নিজের কাছে নিয়ে আসার জন্য” মরুভূমিতে নিয়ে যান (যাত্রা ১৯:৪)। ঈশ্বর ইস্রায়েলকে আমন্ত্রণ করেন যেন তারা তাঁরই সাথে সম্পর্কে আসে, তাঁরই জাতি হয়ে যায়, তাঁর সঙ্গে যেন চুক্তি স্থাপন করে। তিনি তাদের এমন একটি আকর্ষণীয়, পুরোহিত জাতিতে পরিণত করতে চান যা ঈশ্বরকে অন্য জাতিদের কাছে উপস্থাপন করে এবং আশীর্বাদ পেয়ে অন্য জাতিদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হয়। অব্রাহামের আহ্বান ছিল এক ব্যক্তির বা পরিবারের কাছে আহ্বান (আদি ১২:১-৩), ঠিক তেমনি ঈশ্বর এখন অব্রাহাম থেকে উৎপন্ন সেই ইস্রায়েল জাতিকে আহ্বান করেন।
ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে ইস্রায়েল জাতিকে একটি ঈশ্বরীয়, আইন-শৃঙ্খল ও ন্যায্য জাতিতে পরিণত হতে হবে। এর জন্য ঈশ্বর প্রথমেই ইস্রায়েলকে দশ আজ্ঞা এবং পরে আরো সামাজিক আইন-কানুন দান করেন। যাত্রাপুস্তকের দ্বিতীয় অংশে ঠিক এর বর্ণনা পাওয়া যায়: কিভাবে ইস্রায়েল তাঁর জাতিগত আহ্বান পায়, ঈশ্বরের সঙ্গে চুক্তিতে আসে এবং কিভাবে ঈশ্বর ইস্রায়েল দেশের সংবিধান ও আইন-কানুন স্থাপন করেন।
যাত্রাপুস্তক আরো বর্ণনা করে কিভাবে ইস্রায়েল আবাস-তাম্বু, অর্থাৎ তাদের ধর্মীয় বা আত্মিক কেন্দ্র স্থাপিত হয়। আবাস-তাম্বুটি হল শক্তিশালী একটি চিহ্ন যে, ঈশ্বর তাঁর জাতির মধ্যে বাস করতে চান। কিন্তু ঈশ্বর পবিত্র, তাই আবাস-তাম্বুতে প্রবেশ করতে গেলে খুব নির্দিষ্ট নিয়মগুলো পালন করতে হবে: ঈশ্বর কাছেই আছেন – কিন্তু ঈশ্বর পবিত্র! ঈশ্বর সহভাগিতা চান কিন্তু মানুষ পাপে পূর্ণ। ঈশ্বরের প্রতি আকর্ষণ, কিন্তু সাথে ভক্তিপূর্ণ ভয়।
ইস্রায়েলীয়রা সম্পূর্ণ বাধ্যতায় ঈশ্বরের নির্দেশনা অনুসারে আবাস-তাম্বু এবং তাম্বুর সব জিনিস-পত্র তৈরি করে। এগুলো সব তৈরি হওয়ার পরে ঈশ্বরের উপস্থিতি দৃশ্যমানভাবে মেঘের থামে আবাস-তাম্বুর উপরে নেমে আসে (যাত্রা ৪০)। এইটার দ্বারা ঈশ্বর নতুন তাম্বুকে তাঁর অনুমোদন দেন এবং সাথে প্রকাশ করেন যে, তিনি ইস্রায়েলকে পুনরায় গ্রহণ করেছেন। এই ঘটনা হল যাত্রাপুস্তকের চরম মুহূর্ত।
মোশি ১৪৪৬-১৪০৫ খ্রীষ্টপূর্বে মরুভূমিতে ঘুরার সময়ে যাত্রাপুস্তক লেখেন। তিনি যাত্রাপুস্তকে ইস্রায়েল জাতির বর্তমান উদ্ধারের ইতিহাসের এবং দেশ হিসাবে তাদের স্থাপনের গল্প বর্ণনা করেন (চুক্তি, আইন, আবাস-তাম্বু)। মোশি পুস্তকটি ইস্রায়েল জাতির প্রথম প্রজন্মের কাছে লেখেন, যারা এইসব ঘটনাগুলো নিজের চোখে দেখেছিলেন। এছাড়াও তিনি আরো বেশি তা ইস্রায়েল জাতির দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে লেখেন, যারা মরুভূমিতে জন্ম নিয়েছে এবং এই ঘটনাগুলো শুধু গল্প হিসাবে শুনেছে। মোশি নিশ্চিত করতে চান যে ইস্রায়েলের দ্বিতীয় প্রজন্ম – এবং সঙ্গে ভবিষ্যতের প্রজন্মগুলোও – তাদের জাতির আহ্বান, ইতিহাস, ঈশ্বরের সাথে চুক্তি ও আইন-কানুন জানে – যেন তারাও ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে এবং এই মহান আহ্বানের প্রতি বিশ্বস্ত হয়।
মিসরে দাসত্ব
আদিপুস্তকের শেষে বর্ণনা করা হয় প্রায় ১৮৭৬ খ্রীষ্টপূর্বে কিভাবে অব্রাহামের পরিবার সম্মানিত অতিথি হিসাবে মিসর দেশে বাস করতে শুরু করে। যাত্রাপুস্তক শুরুতে বর্ণনা করে কিভাবে অব্রাহামের পরিবার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মিসর দেশ তাদের দিয়ে ভরে যাচ্ছে – যেমন ঈশ্বর মানব জাতিকে করতে বলেছিলেন (আদি ১:২৮, ৯:১) এবং যেমন ঈশ্বর অব্রাহামের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন (আদি ১২:১-৩)। তাই যদিও ইস্রায়েল এখনও প্রতিজ্ঞাত কনান দেশের অধিকারী হয় নি তবুও অব্রাহামের কাছে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হতে শুরু হয়েছে।
ইস্রায়েল জাতির বৃদ্ধির কারণে মিসরের নতুনভাবে ক্ষমতায় ওঠা আঠারোতম রাজবংশের ফরৌণ দুশ্চিন্তিত হয়ে যান। তিনি ইস্রায়েলীয়দের নাগরিক হিসাবে শান্তিতে দেশে থাকতে দেন না, কিন্তু তাদের ছেড়ে দিতেও রাজি নন (যাত্রা ১:৬-৮)। তিনি দুশ্চিন্তিত কারণ ইস্রায়েল জাতি নীল নদীর ব-দ্বীপে গোষেণ এলাকায় বসবাস করে, অর্থাৎ মিসর দেশের সীমানার কাছে একটি এলাকা, যেখানে মিসরের শত্রুরা ইতিহাসে বিভিন্ন সময় দেশকে আক্রমণ করেছিল। তিনি ভয় করেন যে ইস্রায়েল শত্রুদের সাথে হাত মিলাবে। কিন্তু অপর পক্ষে বলা যায় যে, সেখানে একটি শক্তিশালী দল বসবাস করলে তবে এটা মিসর দেশের জন্য সুরক্ষার ব্যবস্থাও হতে পারত। যা ফরৌণ করেন – শান্তভাবে বসবাসকারী একটি দলকে নির্যাতন করার মাধ্যমে শত্রু বানানো – তা অবশ্যই প্রজ্ঞার কাজ নয়। ভয় ভাল পরামর্শদাতা নয়। ফরৌণ যদি দু’টার মধ্যে (রাখা বা ছাড়া) যে কোন একটা করতেন তবে তা পাপ হিসাবে দাঁড়াত না, কিন্তু ফরৌণ যা করেন, তা বড় অন্যায়।
ফরৌণ নির্যতনের একটি ক্রমবৃদ্ধি ঘটান: প্রথম অর্থনৈতিক চাপ ও দাসত্ব, পরে ধাত্রীদের দ্বারা গোপনে ছেলে-সন্তানদেরকে মেরে ফেলা এবং অবশেষে সৈন্য পাঠিয়ে ছেলে-সন্তানদেরকে মেরে ফেলা। তিনি চিন্তা করেন যে মেয়ে-সন্তান কাজের লোক বানানো যাবে, কিন্তু ছেলে-সন্তান হয়তো বিদ্রোহী হয়ে উঠবে।
মোশির জন্ম ও জীবন
ঠিক সেই নির্যাতনের সময়ে ইস্রায়েলের লেবী বংশের এক দম্পত্তির একটি ছেলে সন্তান হয়। তারা শিশুটিকে নীল নদীর পাড়ে নলখাগড়ার মধ্যে লুকানোর চেষ্টা করে। ফরৌণের কন্যা যখন তাকে আবিষ্কার করেন তিনি সাথে সাথে বুঝতে পারেন যে, শিশুটি নির্যাতিত ইব্রীয়দের সন্তান। কিন্তু তিনি শিশুকে রক্ষা করেন, তার নাম “মোশি” রাখেন এবং তার আসল মাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব দেন। মাই ছাড়ানোর পরে ফরৌণের কন্যা শিশুকে দত্তক নেন এবং এভাবে মোশি মিসরীয় রাজবাড়ীতে বড় হন। অবশ্যই গল্পটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠে: কেন ফরৌণের কন্যা তাকে গ্রহণ করেন? কেন কেউ তাকে বাধা দেয় না? মোশি কি জানতেন যে তিনি দত্তক নেওয়া সন্তান? বড় হতে হতে তাকে রাজবাড়ীতে সম্মানের চোখে বা ঘৃণার চোখে দেখা হত? বাইবেল এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয় না।
সম্ভবত মোশি মিসরীয় পড়াশুনা লাভ করেন, সামরিক প্রশিক্ষণ পান এবং দেবতাপূজায় ও বিলাসিতার জীবনে বেড়ে ওঠেন (ইব্রীয় ১১:২৪-২৬)। তিনি কখন বুঝতে পারলেন যে তিনি মিসরীয় নন বরং ইব্রীয়? যাত্রাপুস্তক তা বলে না। আমরা মাত্র জানি যে, চল্লিশ বছর বয়সে মোশি নির্যাতিত ইব্রীয়দের পক্ষ নিতে শুরু করেন। মোশি কি চেতনা পেয়ে নিজেকে দোষী মনে করেন? তিনি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত বলে নিজকে কি ‘কিছু করার দায়ী’ মনে করেন? তিনি নিজেকে কি উদ্ধারকর্তা হিসাবে দেখেন? আমরা জানি না। একদিন তিনি ইব্রীয়দের নির্যাতন দেখে রাগান্বিত হন এবং একজন মিসরীয় দাস চালককে খুন করেন (যাত্রা ২:১১-১২)। তিনি ইস্রায়েলীয়দের সাহায্য করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তারা উল্টা তাকে ভয় দেখিয়ে বলেন যে তার অপরাধ জেনে গেছে। ফরৌণ মোশিক এখন হুমকিস্বরূপ মনে করেন এবং তাকে মেরে ফেলার আদেশ দেন (যাত্রা ২:১৩-১৫)। মোশি মিসর ছেড়ে মিদিয়োন দেশে পালিয়ে যান। যেখানে পৌঁছিয়ে তিনি কিছু নির্যাতিত রাখাল মেয়েদেরকে সাহায্য করতে চেষ্টা করেন এবং এবার তিনি সফল হন। মেয়েদের পরিবার, যার প্রধান হলেন মিদিয়োনীয়দের মহাপুরোহিত, মোশিকে গ্রহণ করে। মোশি পরিবারটির একজন মেয়েকে বিয়ে করেন এবং তাদের সাথে সাধারণ জীবন কাটাতে শুরু করেন। মোশির ও তার স্ত্রী সিপ্পোরার দু’জন ছেলে হয়।
চল্লিশ বছর ধরে মোশি রাখালের জীবন করেন (যাত্রা ২:১৫-২২)। চিন্তা করা যায় যে, মিদিয়োনে বাস করতে করতে ইস্রায়েল জাতির জন্য মোশির দায়িত্ব ভাব, যত্ন বা আশা ধীরে ধীরে কমে যায়। তিনি কি খুশি মনে বা আফসোসের সঙ্গে ইস্রায়েলের জন্য চিন্তা ছেড়ে দেন, তা বলা যায় না। কিন্তু তিনি মিদিয়োনে একটি নতুন জীবন এবং কম পক্ষে কিছুটা শান্তি লাভ করেন।
মোশির আহ্বান
কিন্তু মোশিকে নিয়ে ঈশ্বরের পরিকল্পনা শেষ হয় নি। মোশির বয়স যখন আশি বছর এবং সম্ভবত তিনি শান্তিতে তার জীবন শেষ করার চিন্তা করেন, তখন ঈশ্বর তার সাথে একটি জ্বলন্ত গাছের মধ্য দিয়ে সাক্ষাৎ করেন। ঈশ্বর মোশিকে ইস্রায়েল জাতিকে মিসর দেশ থেকে মুক্ত করার জন্য আহ্বান করেন (যাত্রা ৩:১-১২)। মোশি জিজ্ঞাসা করেন, তিনি ইস্রায়েল জাতির কাছে ঈশ্বরের পরিচয় কিভাবে দেবেন। ঈশ্বর পূর্বপুরুষদের দেওয়া জ্ঞানের সাথে মিল রেখে নিজের পরিচয় এভাবে দেন: “আমি তোমার বাবার ঈশ্বর, আমি অব্রাহামের, ইসহাকের ও যাকোবের ঈশ্বর” (যাত্রা ৩:৬) কিন্তু এছাড়া তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ও আরো ভিত্তিকভাবে প্রকাশিত করেন: “যিনি ‘আমি আছি’ আমিই তিনি” (যাত্রা ৩:১৪)। এই অতিগুরুত্ব প্রকাশের অর্থ কি? ঈশ্বর এমন ঈশ্বর যিনি আছেন, যিনি উপস্থিত, যিনি বাস্তব, স্বক্রিয়, সয়ং সম্পূর্ণ, অসৃষ্ট, অপরিবর্তনশীল, বিশ্বস্ত এবং যথেষ্ট … এই বাক্যের অর্থ কি, তার কোন শেষ নেই।
এই আহ্বান পেয়ে মোশি অত্যন্ত ভিত। তিনি নিজেকে অযোগ্য এবং অক্ষম মনে করেন এবং তোতলা বলে তিনি আহ্বানটি একেবারে প্রত্যাখ্যান করেন। প্রকৃতপক্ষে এই মহাকাজ মোশির জন্য অসম্ভব। ‘মোশি কে?’ এই প্রশ্নের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল ‘ঈশ্বর কে, যিনি মোশিকে তা করতে বলেন?’ মোশি অক্ষম হলেও ঈশ্বর অক্ষম নন। ঈশ্বর তার “না” গ্রহণ করেন না। বরং তিনি মোশিকে কিছু আশ্চর্য কাজ উপস্থাপনা করার ক্ষমতা দেন এবং তার ভাই হারোণকে সাহায্যকারী বক্তা হিসাবে নিয়ে আসেন (যাত্রা ৪:১০-১৬)।
ফরৌণের সাথে দ্বন্দ্ব
ঈশ্বর যেমন বলেছেন, মোশি তেমনি মিসর দেশে ফিরে গিয়ে ফরৌণের সামনে উপস্থিত হয়ে ইস্রায়েল জাতির মুক্তি দাবি করেন। ফরৌণ দাবিটি অস্বীকার করেন এবং পরিবর্তে ইস্রায়েলীয়দের কাজের চাপ আরো বাড়িয়ে দেন (যাত্রা ৫:৬-৯), এমন একটি কৌশল যা দ্বারা তিনি ইস্রায়েলীয়দের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেন। ফরৌণের কৌশল কার্যকারী: ইস্রায়েলীয়রা আরো চাপ পেয়ে মোশির বিরুদ্ধে উঠে এবং মোশি গিয়ে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এভাবে সবার অবস্থা আগের চেয়ে আরো কঠিন হয়ে যায় (যাত্রা ৫:২১-২২)। কিন্তু এখন ঈশ্বর নিজেই বিষয়টি হাতে নেন: “তুমি দেখে নিয়ো, ফরৌণের অবস্থা এবার আমি কি করি” (যাত্রা ৬:১)। লক্ষ্য করুন যে, এই মুহূর্তে ঈশ্বর কারো কাছ থেকে বিশ্বাস দাবি করেন না কারণ ঈশ্বর নিজেকে এখনও শক্তিশালীভাবে প্রকাশিত করেন নি। পরবর্তীতে যখন তিনি বিভিন্নভাবে তাঁর ক্ষমতা দেখাবেন তখনই তিনি কিছুটা বিশ্বাস দাবি করবেন, কিন্তু এখন তাঁর কোন দাবি নেই। এখন তিনি নিজেই ইস্রায়েলের পক্ষে যুদ্ধে নামবেন।
দশ আঘাত
ঈশ্বর মিসর দেশের উপর আঘাত ঘটাতে শুরু করেন। একটি পরিষ্কার ধারাবাহিকতা দেখা যায়: মোশি প্রত্যেকটি আঘাতের অগ্রিম ঘোষণা করার মাধ্যমে আঘাতের আগেই অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি করেন। তিনি নির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করেন আঘাত কখন শুরু এবং কখন শেষ (কিছু আঘাতের ক্ষেত্রে)। তা দ্বারা ঈশ্বর দেখান যে, আঘাতগুলো এমনি এমনি ঘটে নি, তা সাধারণ দুর্যোগ নয় বরং ঈশ্বরের হাত দিয়ে সাধন করা একটি ঘটনা (যাত্রা ৮:৯-১৩)। প্রথমদিকে আঘাতগুলো বিরক্তিকর কিন্তু বেশি ক্ষতিকারক না (নীল নদীর পানি রক্ত হয়ে যাওয়া, ব্যাং, মশা, পোকা)। কিন্তু যত বেশি ফরৌণ প্রমাণ অস্বীকার করে নিজের হৃদয় কঠিন করে তোলেন, তত বেশি আঘাতের ক্ষতি বাড়ে। পাঁচ নম্বর আঘাতে (পশুর উপরে রোগ) প্রথম বার বড় ও স্থায়ী অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ছয় নম্বর আগাতে প্রথম বার মানুষের দেহের ক্ষতি হয় (ফোঁড়া)। সাত নম্বর আঘাতে (শিলা ও আগুন) প্রথম বার একটি প্রধান ফসল নষ্ট হয় (মসীনা আর যব)। আট নম্বর আঘাতে (পঙ্গপাল) মিসরের চাষের সর্বনাশ ঘটে, এমন কি বহুবছরের ক্ষতি (পঙ্গপাল শুধু সবুজ পাতা খায়, তা না বরং কাণ্ডের চামড়া ও গাছের শিকড়ও খেয়ে ফেলে)। নবম আঘাতে অর্থনৈতিক ক্ষতির চেয়ে মিসরীয়দের মানসিকভাবে আক্রমণ করা হয় (এমন অন্ধকার যাতে আলো জ্বালালেও লাভ নেই এবং কেউ জানে না কত দিন এইভাবে চলবে)। দশম আঘাতে মানুষের জীবনের উপর অপরিবর্তনীয় ক্ষতি ঘটে (প্রথম জাতের মৃত্যু)। মিসরীয়দের বিরুদ্ধে এই শেষ আঘাত প্রথমদিকে ইস্রায়েলের উপরে নির্যাতনের সাথে মিল আছে: ফরৌণ ইস্রায়েলীয়দের ছেলে সন্তানদের মেরে ফেলার আদেশ দিয়েছিলেন, যা দ্বারা দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল (যাত্রা ১:২১)। এখন ঈশ্বর মিসরের প্রথম জাত দাবি করেন।
তাছাড়া ঈশ্বর আঘাতগুলোর মধ্য দিয়ে মিসরীয় দেব-দেবতাদেরও হাস্যকর বানান। প্রত্যেক আঘাতে এক না অন্য একটি দেবতা ক্ষমতাহীন হিসাবে প্রমাণিত করেন: দেবতারা মিসর দেশকে রক্ষা করতে পারে না, তারা এমন কি নিজেকেও রক্ষা করতে সক্ষম নয়। নীল নদীর দেবতারা (ক্নূম ও হাপিস্) প্রতিরোধ করতে পারে না যে ঈশ্বর নীল নদী রক্তে পরিণত করেন, সুস্থতার দেবী হেকমেট সবার গায়ের ফোঁড়া হওয়ার প্রতিরোধ করতে সক্ষম নয়, সূর্য ও আলোর দেব ‘রা’ অন্ধকার প্রতিরোধ করতে পারে না এবং ফরৌণের প্রথম জাত, যাকে ‘রা-এর পুত্র’ হিসাবে পূজা করা হত, তার মৃত্যু কেউ প্রতিরোধ করতে পারে না। এভাড়া আঘাতের মধ্য দিয়ে মিসরীয় দেব-দেবতাদের মূর্তির চেহারা নিয়েও মজা করা হয়, যেমন সুস্থতা ও সন্তান জন্মের দেবী হেকমেটের মূর্তীতে একটি ব্যাঙের মাথা আছে (২য় আঘাত: ব্যাং), সৃষ্টির ও নীল নদীর দেব খ্নূমের মূর্তির পুরুষ ভেড়ার মাথা আছে এবং উর্বরতার দেব হাপিসের মূর্তিতে ষাঁড়ের মাথা আছে (৫ম আঘাত: পশুর মৃত্যু)। আঘাতগুলো যখন চলছিল, মিসরীয়রা ঠিক এই দেব-দেবতাদের ডেকে সুরক্ষার প্রার্থনা করত – কিন্তু কোন রেহাই পেত না। আঘাতের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর নিজেকে মিসরীয় সমস্ত দেব-দেবতার চেয়ে শক্তিশালী হিসাবে প্রমাণিত করেন – মিসরীয়দের বাধ্য হয়ে এই উপসংহারে আসতে হয়েছিল।
আঘাতের ক্রমবৃদ্ধি যাদুকরদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়: প্রথম দু’টি আঘাত তারা নকল করতে পারে: তারা জল রক্তে পরিণত করতে এবং ব্যাঙ বানাতে সক্ষম – অবশ্যই আরো ভাল লাগত যদি তারা আঘাত নকল করার ও পরিস্থিতি আরো খারাপ বানানোর চেয়ে আঘাতটি পিছাতে সক্ষম হত! কিন্তু তৃতীয় আঘাত থেকে তারা আর নকল করতে পারে না – এবং তারা তা ফরৌণের কাছে খোলামেলাভাবে স্বীকার করে: “এটি ঈশ্বরের আঙ্গুল!” (যাত্রা ৮:১৯)। পঞ্চম আঘাতের সময় যখন সবার গায়ে ফোঁড়া আছে তখন ঠিক তেমনি যাদুকরদের গায়ে ফোঁড়া পাওয়া যায়।
আঘাতগুলোর ক্রমবৃদ্ধি লক্ষ্য করলে বুঝা যায় যে আঘাতগুলো দিন দিন আরো নির্দিষ্ট হয়ে যাচ্ছে: প্রথম দিকের আঘাতগুলো সবার উপর পড়ে (আঘাত ১-৩)। পরবর্তীতে – ৪ নম্বর আঘাত থেকে – আঘাতগুলো মিসরীয়দের আক্রান্ত করে কিন্তু ইস্রায়েলীয়রা রেহাই পায়। ৭ম আঘাতে – প্রথম আঘাত যাতে বড় ক্ষতি হয় – মোশি মিসরীয়দের বলেন যেন তারা তাদের পশুগুলো আশ্রয়স্থানে নিয়ে যায় যেন শিলা বৃষ্টিতে তাদের ক্ষতি না হয়। যারা ঈশ্বরের বাক্যে গুরুত্ব দেয় এবং বাধ্য হয় – মিসরীয় হলেও – তারা আঘাত থেকে রেহাই পায় (যাত্রা ৯:১৯-২১)। এই আঘাতের মধ্য দিয়ে ইচ্ছুক-মনা লোক শিখবে যে ঈশ্বর তাদেরই রেহাই দিতে রাজি – যদি তারা তাঁকে স্বীকার করে।
সর্বশেষে ১০ম আঘাতে ইস্রায়েলীয়দেরও আর বসে থাকা চলে না। যদি ইস্রায়েলীয়রা বাধ্য না হয় এবং উদ্ধার পর্বে সেই মেষ জবাই না করে ও রক্ত চৌকাঠে না লাগায় তবে তাদেরও প্রথম জাত ধ্বংস হবে (যাত্রা ১২:২৩)। সম্ভাবনা আছে যে ইচ্ছুক-মনা মিসরীয়রা এই আদেশগুলো পালন করার মাধ্যমে তাদের প্রথম জাতকে রক্ষা করতে পেরেছে।
কিভাবে তা জানা যায়? লক্ষ্য করুন যে উদ্ধার বা নিস্তার পর্বের দিক-নির্দেশনার মাঝখানে একটি নিয়ম পাওয়া যায়: অন্য জাতির একজন উদ্ধার পর্বে অংশ গ্রহণ করতে চাইলে তবে তার আগে সুন্নত করতে হয়। আমরা এই নিয়ম এখানে কেন পাই? কারণ অন্য জাতির লোকেরা সেই সময় ইস্রায়েল জাতির সাথে যুক্ত হতে চেষ্টা করেছিল, তারা নিয়ম ও শর্ত পূর্ণ করে ১০ম আঘাত থেকে রক্ষা পেল – যেমন তারা ৭ম আঘাতে শিখেছিল। যাত্রা ১২:৩৮ পদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইস্রায়েল জাতি যখন সর্বশেষে মিসর দেশ ছেড়ে রওনা দেয় তখন তাদের সঙ্গে “অন্য জাতির লোক”ও যায়। সম্ভবত ইস্রায়েলের সাথে অন্য জাতির দাসরাও রওনা দিল। সম্ভাবনা আছে সাথে কিছু মিসরীয়রাও রওনা দিল, এমন লোক যারা ঈশ্বরের বাক্যে বিশ্বাস করে উদ্ধার পেয়েছিল। লক্ষ্য করুন যে আঘাতগুলো যত আগায় তত মিসরীয়রা আর ফরৌণের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বরং মোশির কথায় গুরুত্ব দেয় (যাত্রা ১১:৩)। মিসরীয়রা ভালভাবে জানে ফরৌণ কি বলবেন – তিনি নিজের অহংকার রক্ষা করার জন্য সারা দেশ ধ্বংস হতে দিতে রাজি – কিন্তু মোশি কি ঘোষণা করবেন, তা আবশ্যই জানা প্রয়োজন। লক্ষ্য করুন যে, ঈশ্বর নিশ্চিত করেন যেন ধ্বংসাত্মক ১০ম আঘাতের আগেই ইস্রায়েলীয়রা ও মিসরীয়দের মধ্য যোগাযোগ হয়। ৯ম আঘাতের সময়ে মিসরীয়রা ইস্রায়েলীয়দের দিকে আকৃষ্ট হবে কারণ তাদেরই আলো আছে, এবং আরো নির্দিষ্টভাবে ১০ম আঘাতের সময়ে ইস্রায়েলীয়রা মিসরীয়দের থেকে কাপড় ও সোনার অলংকার ধার করে নেয়। ইচ্ছুক-মনা মিসরীয়রা অবশ্যই সেই সময়ে ইস্রায়েলীয়দের কাছ থেকে খোঁজ নিত মোশির ঘোষণা অনুসারে এখন কি ঘটতে যাচ্ছে।
সম্ভবত বেশ কিছু সাধারণ লোকেরা ঠিকই বুঝতে পেরেছে কি ঘটে যাচ্ছে এবং কেন তা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে ফরৌণ বার বার ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের হৃদয় কঠিন করে রাখেন। অনেক নির্দিষ্ট ও শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়া পরেও তিনি জেদ করে ঈশ্বরের হাত অস্বীকার করেন – বার বার তা করেন – এমন একটি সময় পর্যন্ত যখন ফেরার আর পথ নেই। শেষ কয়েকটি আঘাতের সময়ে ঈশ্বর নিজেই ফরৌণের হৃদয় আরো কঠিন করে ফেলেন। যা ফরৌণ এত শক্ত মন দিয়ে চেয়েছেন এবং যে পথ তিনি অনুসরণ করেছেন, সেই পথে ঈশ্বর তাকে শেষ পর্যন্ত যেতে দেন।
প্রস্থান এবং লোহিত সাগর বিভক্ত
ধ্বংসাত্মক ১০ম আঘাতের পরে (যা ইস্রায়েলীয় সন্তানদের মেরে ফেলার ফরৌণের আদেশের মত, যাত্রা ১:২২) – ফরৌণ অবশেষে ইস্রায়েলকে ছেড়ে দিতে রাজি, তিনি এমন কি চলে যাওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে তিনি মন আবারও কঠিন করে ইস্রায়েলীয়দের পিছনে সেই ভয়ংকর রথ ও ঘোড়সওয়ার পাঠান। আঘাতের চেয়েও অদ্ভুত ও অদ্বিতীয় একটি আশ্চর্য কাজে ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতির সামনে লোহিত সাগর ভাগ করে তাদের রক্ষার পথ তৈরি করেন। সাথে তিনি মিসরীয় সৈন্যদের একেবারে ধ্বংস করেন। এই অতি পরাত্রমশালী উদ্ধার ইস্রায়েলীয়দের জাতিগত পরিচয়ের একটি নোঙ্গর, তাদের ইতিহাসের একটি ভিক্তি পাথর এবং ঈশ্বরের চরিত্রের একটি অতুলনীয় প্রকাশ হয়ে যায়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ইস্রায়েল এই ঘ্টনাটি স্মরণ করবে এবং পুরাতন ও নতুন নিয়মে প্রায়ই তার পুনরালোচনা ও উৎযাপন দেখা যায়।
মরুভূমির উদ্দেশ্যে রওনা
মোশি ও ইস্রায়েল জাতি মিসর ছেড়ে মরু-এলাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ঈশ্বরের উপস্থিতি একটি মেঘের বা আগুনের থাম হিসাবে দৃশ্যমানভাবে তাদের সামনে গিয়ে তাদেরকে পরিচালনা করে। আনুমানিক ২০ লক্ষ লোক নিয়ে (যাত্রা ১২:৩৭) একটি মরুভূমির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া – চিন্তা করুন মোশির কত বড় সাহস ও বিশ্বাস দরকার ছিল!
বেশ তাড়াতাড়ি ইস্রায়েলীয়রা বিভিন্ন ধরণের অভিযোগ শুরু করে: জল নেই, খাবার নেই এবং মাংস নেই। মানুষ হিসাবে যে তাদের আহার ও জল প্রয়োজন, তার কোন প্রশ্ন নেই, ঈশ্বর খুশি মনে তা যোগান দেন। শুরুতে ঈশ্বর ইস্রায়েলীয়দের কাছ থেকে বেশি বিশ্বাস দাবি করেন না। কিন্তু তাঁর বিশ্বস্ত যোগান দেখতে থাকার পরেও যখন ইস্রায়েল জাতি ইচ্ছাকৃতভাবে অভিযোগ, বিশ্বাসহীন দাবি এবং মিসরের ‘সুঅবস্থা’ নিয়ে অবাস্তব তুলনা করতে থাকে তখন তা ধীরে ধীর সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ঈশ্বর বিশ্বস্তভাবে দৈনিক মান্না প্রধান খাবার হিসাবে এবং মাঝের মধ্যো এক ঝাঁক পাখি মাংস হিসাবে যোগান দেন। যত দিন ইস্রায়েল মরুভূমিতে চলাফেরা করে তত দিনই ঈশ্বর মান্নার যোগান দেন। কিন্তু যেই দিন তারা প্রতিজ্ঞা দেশে পৌঁছায়, সেই দিনই মান্না বন্ধ হয়ে যায় (যিহোশূয় ৫:১২)। আমাদের আধুনিক ভাষায় মান্নাকে ‘ত্রাণ’ বলা যায়, অর্থাৎ এমন লোকদের জন্য দান যারা দানটি না পেলে মারা যাবে। কিন্তু যে মুহূর্ত প্রতিজ্ঞাত দেশে পৌঁছিয়ে খাবারের আয়োজনের সুযোগ পাওয়া যায়, সেই মুহূর্তে ঈশ্বর ত্রাণ বন্ধ করেন। কারণ তা না করলে ইস্রায়েল অলস ও দায়িত্বহীন একটি জাতিতে পরিণত হবে। ত্রাণ হিসাবে মান্নার বৈশিষ্ট নিয়ে চিন্তা করুন: মান্না গুদাম করে রাখা সম্ভব ছিল না, তাই তা গোপনে মজুত করা (hoarding) বা ত্রয়-বিক্রয় করা সম্ভব ছিল না। এখানে ঈশ্বরের চমৎকার প্রজ্ঞা বুঝা যা: ত্রাণের এই বৈশিষ্ট থাকলে তবে ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি বা বেচাকেনা করা সম্ভব নয়। এছাড়া মান্নাই ছিল ইস্রায়েলকে বাধ্যতা শেখানোর একটি পদ্ধতি: ঈশ্বরের নির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা পালন না করলে মান্না সাথে সাথে পচে যেত। ঈশ্বর প্রমাণ করেন যে তিনি যোগানদাতা, কিন্তু একইসাথে তিনি ইস্রায়েলীয়দের তাঁর বাক্যে বাধ্য হতে শেখান।
অমালেকীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
অমালেকীয়রা, কনান দেশের দক্ষিণ দিকে প্রান্তরে বসবাসকারী একটি জাতি, ইস্রায়েলকে আক্রমণ করে (যাত্রা ১৭)। কেন তারা আক্রমণ করে? প্রকৃতপক্ষে তারা ইস্রায়েল জাতির পথেও পড়ে না। এছাড়া অমালেকীয়েরা হল ইস্রায়েলীয়দের একটি আত্মীয় জাতি: যাকোবের ভাই এষৌয়ের নাতির নাম হল অমালেক। অমালেকীয়রা হল তারই বংশধর। শক্তিশালী মিসরীয়দের পরাজয়ের পরে কেন অমালেকীয়রা আক্রমণ করতে সাহস পায়? হতে পারে তারা আক্রমণ করে কারণ তারা মনে করে ইস্রায়েলীয়রা জলের অভাবে মৃত্যুর কাছাকাছি – এত পরিমাণ লোকসংখ্যা মরুভূমিতে বাঁচতে পারে না, তা তারা ভালই জানে। হয়তো এই চিন্তা করে তারা মনে করে যে, ইস্রায়েল জাতিকে তাড়াতাড়ি ও সহজে পরাজিত ও লুটপাত করা যাবে। দ্বিতীয় বিবরণ ২৫:১৭-১৯ পদে ঈশ্বর অমালেকীয়দের দোষ ধরেন যে তারা এমন ইস্রায়েলীয়দের আক্রমণ করেছে যারা বড় দল থেকে পিছিয়ে পড়েছে – দুর্বল, অসুস্থ, বিকলঙ্গ, বুড়ে বা গর্ভবতী লোকেরা। এই আচরণের জন্য ঈশ্বর অমালেকীয়দের দোষ ধরেন এবং তাদের ধ্বংসে সমর্পিত জাতিদের তালিকায় যোগ দেন।
যিথ্রোর পরামর্শ
যদিও মোশির শ্বশুর যিথ্রো ইস্রায়েলীয় নন, মিসর থেকে ইস্রায়েলের উদ্ধারের ইতিহাস শুনে তিনি আনন্দ করেন এবং ঘোষণা করেন যে, ঈশ্বর সমস্ত দেব-দেবতাদের চেয়ে মহান। তিনি ঈশ্বরকে স্বীকার করেন এবং তাঁর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ দান করেন। যখন তিনি দেখেন মোশি কিভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইস্রায়েলীয়দের ঝগড়া-বিবাদ শুনে ন্যায় বিচার করেন তিনি মোশির কাছে প্রস্তাব রাখেন যে, আরো বিচারক ও সরকারি কর্মকর্তাদের নিযুক্ত করা দরকার। তিনি পরামর্শটি নম্রভাবে তার জামাইয়ের কাছে বলেন এবং ঈশ্বরের পরিচালনার অধীনে রাখেন (যাত্রা ১৮:২৩)। মোশি যিথ্রোর পরামর্শ পালন করেন। তিনি ইস্রায়েল জাতির প্রত্যেক বংশ থেকে জ্ঞানবান, বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞ লোক নিযুক্ত করে এভাবে ইস্রায়েলের প্রথম সরকার গঠন করেন (যাত্রা ১৮:১৯-২৩, দ্বিতীয় বিবরণ ১:৯-১৮)।
ইস্রায়েল জাতির সঙ্গে ঈশ্বরের চুক্তি
ইস্রায়েল জাতি সিনাই (অর্থাৎ হোরেব) পাহাড়ে পৌঁছিয়ে পাহাড়ের সামনে তাম্বু ফেলে। ঈশ্বর তাদেরকে কনান দেশে সরাসরি না নিয়ে বরং মরুভূমিতে নিয়ে গিয়েছেন যেন প্রতিজ্ঞাত দেশ দখলের আগে ইস্রায়েলকে জাতি ও দেশ হিসাবে গঠিত করতে পারেন। ঈশ্বর তাদেরকে মিসরের দাসত্ব থেকে উদ্ধার করে “ঈগল পাখীর ডানায় বয়ে নেবার মত … নিজের কাছে নিয়ে” এসেছেন (যাত্রা ১৯:৪)। ইস্রায়েল জাতিকে তাঁর পরিচয় দেওয়ার এবং জাতি হিসাবে তাদের ভিত্তি স্থাপন করার জন্য সিনাই পাহাড়ে ঈশ্বর ইস্রায়েলের সঙ্গে সময় ব্যবহার করেন। তিনি এক দল আঘাতজনিত দাসদের একটি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করতে যাচ্ছেন। ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতির কাছে চুক্তি স্থাপন করার প্রস্তব দেন: যদি তারা ঈশ্বরের আইন-কানুন পালন করে তবে তারা ঈশ্বরের নিজস্ব জাতি হবে এবং একটি আকর্ষণীয়, আদর্শ পুরোহিতদের রাজ্যে পরিণত হবে, এমন একটি জাতি যা চারিদিকে জাতিদের কাছে ঈশ্বরকে প্রকাশ করবে (যাত্রা ১৯:৫-৬)। “পুরোহিতদের রাজ্য” এই শব্দটির অবশ্যই গুরুত্ব আছে। একজন পুরোহিতের ভূমিকা কি? পুরোহিত হলেন ঈশ্বর ও লোকদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একজন মধ্যস্থকারী, অর্থাৎ পুরোহিত লোকদের পক্ষে ঈশ্বরের কাছে বিনতি ও উৎসর্গ করেন এবং ঈশ্বরের পক্ষে তাঁরই প্রতিনিধি হিসাবে আদর্শ জীবন দেখান, লোকদেরকে শিক্ষা দেন ও ভাববাদীমূলক কথা বলেন। কিন্তু এই পদ (যাত্রা ১৯:৬) বলে যে, সম্পূর্ণ ইস্রায়েল জাতি একসাথে হবে মধ্যস্থকারী, অর্থাৎ মাঝখানে দাঁড়ানোর লোক – তবে কাদের মাঝখানে দাঁড়াবে? এক পাশে ঈশ্বর এবং অন্য পাশে কে? উত্তর হল: অন্যান্য জাতি। তাই ইস্রায়েলের আহ্বান হল এমন একটি আদর্শ জাতি হতে (এমন বাধ্য, ঈশ্বর দিয়ে চালিত, ন্যায্য, শান্ত, প্রজ্ঞাপূর্ণ, সুসাস্থ্যের ও সুঅবস্থার জাতি) যেন অন্যান্য জাতিরা তাদেরকে দেখে ঈশ্বরের প্রতি আকৃষ্ট হবে। একজন পুরোহিতের জন্য স্বার্থপরভাবে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা চলবে না, পুরোহিত হওয়া মানেই অন্যদের পক্ষে দাঁড়ানো। তাই ইস্রায়েল জাতির আহ্বান নিজেদের জন্য নয় বরং অন্য জাতিদেরই জন্য। তাদের আশীর্বাদ দেওয়া হয়েছে যেন তারা অন্য জাতিদের জন্য আশীর্বাদের হয় – যেমন ঈশ্বর অব্রাহামকে শুরু থেকে বলেছিলেন (আদি ১২:৩)।
আইন-কানুন দান
ইস্রায়েল জাতি ঈশ্বরের সঙ্গে এভাবে চুক্তিতে আসতে রাজি। তিন নম্বর দিন, অর্থাৎ চুক্তি স্থাপনের অনুষ্ঠানের সেই বিশেষ দিনের জন্য ঈশ্বর তাদের প্রস্তুত হতে বলেন। ঈশ্বর তাদের বুঝিয়ে দেন যে, তূরীর শেষ ধ্বনির সময়ে তাদের সবাইকে সিনাই পাহাড়ে উঠার অনুমতি দেওয়া আছে যেন সরাসরিভাবে ঈশ্বরের সাথে দেখা করতে পারে (যাত্রা ১৯:১৩)। কিন্তু সেই তৃতীয় দিনে ঈশ্বরের উপস্থিতি যখন শক্তিশালী ও দৃশ্যমানভাবে সিনাই পাহাড়ের উপরে নেমে আসে তখন ইস্রায়েল জাতি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় এবং ঈশ্বরের সাথে সরাসরি দেখা করার চেয়ে মোশিকে এগিয়ে যেতে বলে (যাত্রা ২০:১৮-১৯)। তাদের এই আচরণ হল যাত্রাপুস্তকের একটি চরম ব্যর্থতার মুহূর্ত: তারা ঈশ্বরের কাছে যেতে রাজি না, তারা ঈশ্বকে তেমন বুঝতে বা জানতে চায় না এবং তাঁর প্রতি তেমন আগ্রহীও নয়। কিন্তু মোশি – যদিও তিনি অন্যান্য ইস্রায়েলীয়দের মত ঈশ্বরের শক্তিশালী উপস্থিতি ও পবিত্রতা দেখে ভয়ে কাঁপেন, তবুও তিনি সেই অদ্ভুত ঈশ্বরের প্রতি আকৃষ্ট ও আগ্রহী। তিনি এগিয়ে যান এবং সিনাই পাহাড়ে ওঠেন।
পাহাড়ে সেই সময় ঈশ্বর মোশিকে ১০ আজ্ঞা দেন, যা আইন-কানুনের ভিত্তি। তিনি মোশিকে ইস্রায়েলের জন্য আরো আত্মিক ও সামাজিক আইন দান করেন। শুধু ঈশ্বরকে আরাধনা করার বিষয় নয় বরং মানবীয় জীবনের অতুলনীয় মূল্য, বিবাহ ও পরিবারের গুরুত্ব, মানুষের শ্রম, সময়, সম্পত্তি ও চুক্তির গুরুত্ব – এগুলো সব আইন-কানুনে প্রকাশিত ও সুরক্ষিত। ঈশ্বর আইন-কানুনের মধ্য দিয়ে একটি আইন-শৃঙ্খল, ন্যায্য, স্বাধীন ও আত্মদায়ী সমাজের ভিত্তি স্থাপন করতে যাচ্ছেন।
সোনার বাছুর এবং মোশির বিনতি
যখন মোশি ঈশ্বরের দিক-নির্দেশনা পাওয়ার জন্য ৪০ দিন ধরে সিনাই পাহাড়ে কাটান তখন ইস্রায়েল নিজেকে নেতা ছাড়া ও পরিচয় ছাড়া জাতি মনে করে। তারা একটি সোনার বাছুরের মূর্তি তৈরি করে এটাকে মিসর থেকে তাদের উদ্ধার করার দেবতা হিসাবে আরাধনা করতে শুরু করে। কেন তারা এত তাড়াতাড়ি ঈশ্বরের সঙ্গে স্থাপিত চুক্তি ভেঙ্গে দেয়? তাদের পেটে মান্না আছে এবং তাদের সামনে সিনাই পাহাড়ে একটি অস্বাভাববিক মেঘ ঝুলানো আছে – কেন তারপরেও সেই বিভ্রান্তি? ইস্রায়েলীয়রা মিসরে বড় হয়েছে যেখানে বিভিন্ন দেবতাদের মধ্যে ‘হাপিস্’ নামে একটি ষাঁড়ের দেবও পূজা করা হত, হয়তো একারণে তারা মূর্তিটি তৈরি করে। অথবা তারা মনে করে যে, সেই সোনার বাছুর বা ষাঁড়ের উপরে আসল ঈশ্বর সিংহাসনে বসে আছেন। তাদের মনের চিন্তা এই মুহূর্তে কি, তা নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায় না।
ইস্রায়েল জাতি নতুন স্থাপিত চুক্তি একেবারে ভেঙ্গে দিয়েছে বলে ঈশ্বর তাদেরকে ধ্বংস করে মোশিকে নিয়ে একটি নতুন জাতি স্থাপন করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এরপরেও ঈশ্বর মোশিকে বিনতি করার অনুমতি দেন এবং ইস্রায়েলের জন্য তার কান্নায় সাড়া দেন। ঈশ্বরের মন পরিবর্তন দেখে মোশি বাছুরের মূর্তি ধ্বংস করে ইস্রায়েল জাতিকে তাদের দোষ দেখান, প্রধান অপরাধীদের মৃত্যুর শাস্তি দেন, ইস্রায়েল জাতিকে অনুতাপে পরিচালনা করেন এবং ঈশ্বরের প্রতি বিনতি করতে থাকেন। ঈশ্বর ইস্রায়েলকে পুনরায় তাঁর চুক্তির জাতি হিসাবে গ্রহণ করেন।
আবাস-তাম্বু
মোশি বেশ কয়েক বার সিনাই পাহাড়ে উঠে ঈশ্বরের সঙ্গে সময় কাটান। তিনি সেখানে একটি আবাস-তাম্বু তৈরি করার দিক-নির্দেশনা পান, যা পরবর্তীতে ইস্রায়েল জাতির আত্মিক কেন্দ্র হিসাবে ভূমিকা পালন করে। আবাস-তাম্বু হল ঈশ্বরের একটি শক্তিশালী প্রকাশ: ঈশ্বর সেই ঈশ্বর যিনি তাঁর জাতির সঙ্গে সঙ্গেই আছেন এবং তাঁর জাতির মধ্যে বসবাস করতে আগ্রহী। এই ছবিটি নতুন নিয়মের লেখকেরা উদ্ধৃতি করে বলবেন যে, এটা যীশুর মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে পূর্ণ হয়েছে (যোহন ১:১৪)। আবাস-তাম্বু এবং তাম্বুর আসবাব-পত্র এইসব হল যীশু সম্বন্ধীয় ছবি।
আবাস-তাম্বু একটি সমস্যাও প্রকাশ করে: ঈশ্বর তাঁর জাতির সঙ্গে বাস করতে চান, কিন্তু পবিত্র ঈশ্বর কিভাবে একটি পাপ-পূর্ণ জাতির মধ্যে বাস করবেন? আবাস-তাম্বু উভয় পাশ দেখায়: ঈশ্বর তাঁর লোকদের মধ্যে উপস্থিত থাকতে আগ্রহী কিন্তু পবিত্র ঈশ্বরের উপস্থিতিতে থাকা হালকা বিষয় নয়। ঈশ্বর কাছে আছেন, কিন্তু ঈশ্বর পবিত্র। ঈশ্বর মানুষদের সঙ্গে সহভাগিতা চান কিন্তু তাঁর সম্মুখে আসার জন্য অনেক কঠোর নিয়ম দেওয়া আছে। ইস্রায়েলীয়রা যেন তাঁর প্রতি আগ্রহী হয় – কিন্তু যেন ভক্তিপূর্ণ ভয়ে তাঁর সামনে আসে। এই সমস্যা শুধুমাত্র যীশুতে সমাধান করা হয়।
তাম্বুর সব কিছু তৈরি হওয়ার পরে ঈশ্বরের উপস্থিতি দৃশ্যমানভাবে মেঘের থামে আবাস-তাম্বুর উপরে নেমে আসে (যাত্রা ৪০:৩৪-৩৫)। এই ঘটনা হল যাত্রাপুস্তকের চরম মুহূর্ত যখন ঈশ্বর এই নতুন তাম্বুকে তাঁর অনুমোদন দান করেন এবং প্রকাশ করেন যে, তিনি ইস্রায়েল জাতিকে পুনরায় গ্রহণ করেছেন।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন!