লেবীয় পুস্তকে মোশি ইস্রায়েল জাতির জন্য উৎসর্গগুলো, যাজকদের নিযুক্তকরণ, পুষ্টি, স্বাস্থ্য সেবা, জাতীয় দিবস এবং সামাজিক ন্যায্যতার বিষয়ে ঈশ্বরের আইন-কানুন বিস্তারিতভাবে লিখিত রাখেন।
সম্ভবত ইস্রায়েল জাতির মরুভূমিতে চল্লিশ বছর বিচরণের সময়ে মোশি তার পাঁচটি পুস্তক লেখেন (মোশির পঞ্চপুস্তক) যাতে তিনি উভয় ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা করেন এবং ঈশ্বরের আইন-কানুন দেন। কিভাবে জানা যায় যে মোশি লেবীয় পুস্তকের লেখক? পাঁচটি পুস্তকে বেশ কয়েক বার উল্লেখ করা হয় যে, মোশি “সব কিছু লিখে রাখলেন”। পুরাতন ও নতুন নিয়মের পরের লেখকেরা – এবং যীশু নিজেই – প্রায়ই “মোশির লেখা” হিসাবে চিহ্নিত করে এই পাঁচটি পুস্তকের উল্লেখ বা উদ্ধৃতি করেন। তাই মোশি লেখক হিসাবে ঘোষিত। লেবীয় পুস্তক হল মোশির তৃতীয় পুস্তক।
পঞ্চপুস্তকের প্রত্যেকটি লেখার মত লেবীয়ও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও ভিত্তিক পুস্তক। লেবীয় পুস্তকে মোশি বর্ণনা করেন ঈশ্বর কিভাবে সামাজিক আইন এবং জাতির আত্মিক জীবন স্থাপন করার মধ্য দিয়ে ইস্রায়েলকে দেশ হিসাবে গঠন করেন। ঈশ্বর একটি উৎসর্গ পদ্ধতি স্থাপন করেন যা অনুসরণ করে ইস্রায়েলীয়েরা পাপ, দোষ, পোড়ানো ও শান্তি উৎসর্গ দেবে (লেবীয় ১-৭)। পাপ ও দোষ উৎসর্গের উদ্দেশ্য হল পাপের ক্ষমা লাভ করা, পোড়ানো উৎসর্গের উদ্দেশ্য হল আত্ম-সমর্পণ ও ভক্তির প্রকাশ করা এবং শান্তি উৎসর্গের উদ্দেশ্য হল ঈশ্বরের সহভাগিতায় সময় কাটানো। উৎসর্গ সম্বন্ধীয় এই সব অতি নির্দিষ্ট ও বিস্তারিত নির্দেশনাগুলো দিয়ে ঈশ্বর ইস্রায়েলীয়দের দেখান যে, ক্ষমার ক্ষেত্রে এবং ঈশ্বরের উপস্থিতিতে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে হালকা মনোভাব, ‘কিছু ছাড় চাওয়া’ বা ‘নিজের মনের মত করা’ চলবে না। বরং ক্ষমা হল ঈশ্বরের দয়া এবং ঈশ্বরের নির্ধারিত পথ ছাড়া ক্ষমা পাওয়া সম্ভব না। ঈশ্বর এমন আরাধনাকারীদের খোঁজেন যারা নম্রতার সঙ্গে স্বীকার করে যে, ঈশ্বর পবিত্র, মানুষ পাপী এবং নিজের প্রচেষ্টায় মানুষ কখনও ঈশ্বরের চোখে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যে পথ ঈশ্বর তাঁর দয়ায় ঠিক করেছেন, সেই পথ নম্রতা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মেনে নিতে হবে।
লেবীয় পুস্তকে হারোণ ও তার ছেলেদের আনুষ্ঠানিকভাবে যাজক হিসাবে নিযুক্ত করার মাধ্যমে ইস্রায়েল জাতির যাজকত্ব স্থাপিত (লেবীয় ৮-১০)। যাজকদের নিযুক্তকরণ তাদের কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে হয় নি বরং শুধু ঈশ্বরের দয়ার দ্বারাই তা হয়েছে। ঈশ্বর দাবি করেন যে, যাজকেরা সাধারণ লোকদের চেয়ে উঁচু মানদণ্ডে জীবন-যাপন করেন এবং মধ্যস্থকারীর ভূমিকা পালন করেন। মধ্যস্থকারীর ভূমিকার হল লোকদের প্রতিনিধি হিসাবে বিনতি ও উৎসর্গ দান করার জন্য ঈশ্বরের সামনে দাঁড়ানো এবং একই সময়ে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে আদর্শ জীবন ও শিক্ষা দানের জন্য লোকদের সামনে দাঁড়ানো।
লেবীয় পুস্তকে ঈশ্বর একজন পবিত্র, খাঁটি ও সততার ঈশ্বর হিসাবে প্রকাশিত হন। ইস্রায়েল জাতি যদি চায় যে, এই ধরণের একজন পবিত্র ঈশ্বর তাদের মধ্যে বাস করেন তবে তাদেরও পবিত্র হওয়া প্রযোজন। পবিত্র হওয়ার জন্য যাজকেরা ইস্রায়েল জাতির পক্ষ হয়ে পাপ ও দোষ উৎসর্গ দেন। এছাড়া ইস্রায়েলীয়দের শুচি-অশুচি নিয়মও পালন করতে হবে (লেবীয় ১১-১৫)। পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় আইনগুলো ইস্রায়েল জাতিকে আত্মিক ক্ষেত্রে অন্য জাতিদের চেয়ে ভিন্নভাবে জীবন-যাপন করতে বাধ্য করে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আইনগুলো রোগ প্রতিরোধ করবে এবং জীবাণুর সংক্রমণ কমিয়ে দেবে। এই আইনগুলো দ্বারা প্রকাশ পায় যে, ঈশ্বর চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধে গুরুত্ব দেন। এছাড়া এগুলো দ্বারা ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে শিক্ষা দেন যে, একটি বস্তু জগতে প্রত্যেক আচরণের বাস্তব ফলাফল আছে, অর্থাৎ এই পৃথিবী ‘কারণ ও ফলাফল’ বা “যদি…তবে” অনুসারে চলে।
লেবীয় ১৬ অধ্যায়ে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান, অর্থাৎ প্রায়শ্চিত্ত দিন বা পাপ ঢাকার দিন সম্বন্ধীয় আইনগুলো পাওয়া যায়। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বাৎসরিক অনুষ্ঠানে ইস্রায়েল জাতি ক্ষমা চেয়ে এবং ঈশ্বরের নির্দেশ অনুসারে উৎসর্গ দেওয়ার মধ্য দিয়ে পুনরায় গ্রহণযোগ্য হয়। সেই দিনে সবচেয়ে বড় পাপ উৎসর্গ দেওয়া হয়, যার রক্ত ছিটিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মহাপুরোহিত তাম্বু, বেদী, যাজকদের এবং সমস্ত জাতিকে শুচি করেন। বছরে একবার করে নতুন একটি শুরু!
প্রায়শ্চিত্ত দিনের পাশাপাশি ঈশ্বর কয়েকটি বাৎসরিক পর্ব স্থাপন করেন (লেবীয় ২৩)। এই আনন্দপূর্ণ পর্বগুলো বা জাতীয় দিবসে ইস্রায়েলের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর স্মরণ এবং ঈশ্বরের চরিত্রের প্রকাশ ও উৎযাপন করা হয়: ঈশ্বর ক্ষমতাশালী উদ্ধারকর্তা, চুক্তির স্থাপনকারী, আহ্বান ও যোগানের উৎস, পবিত্র ও ভয়ংকর, সেই ঈশ্বর যিনি তার জাতির সহভাগিতা চান এবং তাদের সাথে বাস করেন।
লেবীয় পুস্তকে ঈশ্বর তাঁর জাতির জন্য আরো নৈতিক ও সামাজিক আইন দেন (লেবীয় ১৭-২৭)। তাদের একটি চুক্তি পালনকারী জাতি হওয়ার কথা – ঈশ্বরের সঙ্গে, পরস্পরের সঙ্গে এবং পরিবারের মধ্যে চুক্তি পালনকারী লোক। বিবাহ ও পরিবারের সুরক্ষা, যৌন ক্ষেত্রে খাঁটি ব্যবহার, দেবতা-পূজার বিরুদ্ধে সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত, মানবীয় অধিকার রক্ষা, মানুষের জীবনের মূল্য এবং মৌখিক প্রতিজ্ঞার সুরক্ষা, এই সব ঈশ্বরের চোখে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঈশ্বর চান যেন ইস্রায়েল একটি আইন-শৃঙ্খল, স্বাধীন, উৎপাদনশীল, নিরাপদ ও সুস্বাস্থ্যের জাতি হয় এবং এই আইনগুলোর মাধ্যমে তিনি তার জন্য ভিত্তি স্থাপন করেন।
ঈশ্বর ইচ্ছুক আছেন – কিন্তু ইস্রায়েল জাতি কি আইন-কানুন পালন করতে ইচ্ছুক? ইস্রায়েল জাতিকে তাদের স্বাধীন সিদ্ধান্তের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য ঈশ্বর একটি পুরো অধ্যায় ধরে কথা বলেন (লেবীয় ২৬)। ইস্রায়েল জাতিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে: হয়, তারা ঈশ্বরের প্রতি বাধ্যতা ও ভক্তিপূর্ণ ভয় পছন্দ করবে, যার ফলাফল হবে আশীর্বাদ, মঙ্গল ও জীবন। না হয়, তারা অবাধ্যতা ও দেবতা-পূজা পছন্দ করবে, যার ফলাফল হবে অভিশাপ, দারিদ্রতা ও মৃত্যু। যে কোন সময় তারা মৃত্যুর পথ ছেড়ে জীবনের পথে ফিরে আসতে পারে – যদি মন ফিরায়।
পুস্তকের লেখক এবং পুস্তকের সংরক্ষণ
লেবীয় পুস্তক হল মোশি পঞ্চপুস্তকের মধ্যে তৃতীয় বই। সম্ভবত, মোশি পঞ্চপুস্তক লেখেন যখন ইস্রায়েল জাতি চল্লিশ বছর মরুভূমিতে বিচরণ করে। পঞ্চপুস্তকে উভয় ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা এবং ঈশ্বরের দেওয়া আইন-কানুন পাওয়া যায়। আমরা কিভাবে জানতে পারি যে মোশি পঞ্চপুস্তকের লেখক? পাঁচটি পুস্তকে বেশ কয়েক বার উল্লেখ করা হয় যে মোশি “সব কিছু” লিখে রাখলেন (যাত্রা ১৭:১৪, ২৪:৪, ৩৪:২৭, গণনা ৩৩:২, ২য় বিবরণ ৩১:৯)।
লেবীয় পুস্তকের শেষ পদে মোশি এই সারাংশ দেন (লেবীয় ২৭:৩৪): “সদাপ্রভু ইস্রায়েলীয়দের জন্য এই সব আদেশ সিনাই পাহাড়ে মোশির কাছে দিয়েছিলেন”। এই শেষ পদ ইঙ্গিত দেয় যে মোশি নিজেই ঈশ্বরের কাছ থেকে আইন-কানুন বা দিক-নির্দেশনা পাওয়ার সাথে সাথে সেগুলো লিখে রাখতেন। এছাড়া তার জীবনের শেষে মোশি “এই আইন-কানুন আগাগোড়া একটি বইয়ে লিখে নিলেন” এবং লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আবাস তাম্বুতে নিয়ম-সিন্দুকের সাথে রাখার ব্যবস্থা করেন (২য় বিবরণ ৩১:২৪-২৫)। এভাবে মোশি পঞ্চপুস্তকের সংরক্ষণ ও নিয়মিতভাবে সম্পূর্ণ ইস্রায়েল জাতির কাছে তার পাঠ নিশ্চিত করেন (২য় বিবরণ ৩১:১০-৩৩)।
পুরাতন নিয়মের পরবর্তী লেখকেরা বার বার পঞ্চপুস্তককে (এবং তার মধ্যে লেবীয় পুস্তকও) “মোশির আইন-কানুন” বা “মোশির পুস্তকগুলি” বলে উল্লেখ বা উদ্ধৃতি করেন (যিহো ১:৭-৮, ১ রাজা ২:৩, ১৪:৬, দানিয়েল ৯:১১-১৩, ইষ্রা ৬:১৮, নহি ১৩:১, মালা ৪:৪)। পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে তারা পঞ্চপুস্তকের লেখক হিসাবে মোশিকে চিহ্নিত রাখেন। ঠিক তেমনি নতুন নিয়মের লেখকেরা – এবং যীশু নিজেই – আইন-কানুন থেকে উদ্ধৃতি করার সময় তা “মোশির লেখা” হিসাবে চিহ্নিত রাখেন এবং এভাবে মোশি লেখক হিসাবে ঘোষিত করেন (মথি ৮:৪, ২২:২৪, মার্ক ১:৪৪, ১২:২৬, লূক ১৬:২৯-৩১, যোহন ১:১৭, ৭:১৯, প্রেরিত ৩:২২, ২৬:২২, রোমিয় ১০:১৯, ১ করি ৯:৯, ২ করি ৩:১৫)। এভাবে আমরা নিশ্চিত জানতে পারি যে মোশি পঞ্চমপুস্তকের লেখক।
লেবীয় পুস্তকের পাঠকেরা
সিনাই পাহাড়ের সামনে যখন ইস্রায়েল জাতি ছাউনি ফেলে তখন ঈশ্বর মোশির কাছে বিস্তারিতভাবে আইন-কানুন প্রকাশ করেন। সম্ভাবনা বেশি যে, মোশি ঈশ্বরের বাণীগুলো পাওয়ার সাথে সাথে সেগুলো লিখে রাখেন এবং এভাবে তিনি লেবীয় পুস্তকটি সংকলন করেন। লেবীয় পুস্তক তাই সিনাই পাহাড়ে ১৪৪৬-১৪৪৫ খ্রীষ্টপূর্বে লেখা। মোশি পুস্তকটি ইস্রায়েল জাতির প্রথম প্রজন্মের জন্য লেখেন, যারা মিসর থেকে ইস্রায়েল জাতির অদ্ভুত উদ্ধার নিজের চোখে দেখেছিল। কিন্তু আরো বেশি মোশি ইস্রায়েল জাতির দ্বিতীয় প্রজন্মের জন্য লেখেন, যারা মিসরের বন্ধনের সময়ে ছোট ছিল অথবা যারা মরুভূমিতে জন্ম নিয়েছে। এছাড়া পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্যও তিনি লেখেন, কারণ ঈশ্বরের দেওয়া আইন-কানুন সব যুগেই প্রজোয্য এবং তা সবার জন্য দেওয়া হয়েছে।
ইস্রায়েল জাতির জন্য লেবীয় পুস্তকের গুরুত্ব
আদিপুস্তক এবং যাত্রাপুস্তকের মত, লেবীয় পুস্তকও ইস্রায়েল জাতির জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক। লেবীয় পুস্তকে ঈশ্বর ধর্মীয় জীবনের নির্দেশনা ও সরকারি আইন দেওয়ার মাধ্যমে ইস্রায়েলকে জাতি হিসাবে আরো গঠন করেন। একজন পবিত্র ঈশ্বর তাঁর পাপী জাতির সঙ্গে কিভাবে উপস্থিত হতে পারেন, লেবীয় পুস্তক এই প্রশ্নটির উত্তর দেয়: পাপ ঢাকার ব্যবস্থা এবং বাধ্যতা শেখানোর মধ্য দিয়ে তা সম্ভব।
সুতরাং ঈশ্বর প্রথমে ইস্রায়েল জাতিকে উৎসর্গের বিষয়ে বিস্তারিত আইন-কানুন দেন (লেবীয় ১-৭)। ঈশ্বর বিভিন্ন ধরণের উৎসর্গ করার আদেশ দেন: পাপ, দোষ, পুড়ানো, শস্য এবং শান্তি উৎসর্গ। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতির জন্য যাজকত্ব স্থাপন করেন (লেবীয় ৮-১০): তিনি লেবীয় বংশের হারোণকে মহাপুরোহিত হিসাবে এবং হারোণের ছেলেদের (সঙ্গে বংশধরদেরও) পুরোহিত হিসাবে নিযুক্ত করেন। পুরোহিত হিসাবে তারা ঈশ্বর এবং তাঁর জাতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে মধ্যস্থকারী হিসাবে ভূমিকা পালন করেন, অর্থাৎ তারা উৎসর্গ দান করেন, ঈশ্বরের আইনের বিষয়ে শিক্ষা দেন, ইস্রায়েল জাতির জন্য বিনতিতে দাঁড়ান এবং ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে ইস্রায়েলের কাছে ঈশ্বরের হৃদয় উপস্থাপনা করেন।
এর পরে ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে শুচি-অশুচি বিষয়ে নিয়ম দেন (লেবীয় ১১-১৫), যেন ইস্রায়েল আত্মিক ক্ষেত্রে অন্য জাতিদের চেয়ে ভিন্নভাবে জীবন-যাপন করে এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যেন সুস্বাস্থ্যে থাকে। ধর্মীয় আইন-কানুনের চরম অংশ হল প্রায়শ্চিত্ত দিন, অর্থাৎ জাতির পাপ ঢাকার সেই গম্ভীর বাৎসরিক অনুষ্ঠান (লেবীয় ১৬)। প্রায়শ্চিত্ত দিন ছাড়াও ঈশ্বর ইস্রায়েলকে আর ৭টি বাৎসরিক পর্ব পালন করতে বলেন। এই পর্বগুলোতে সম্পূর্ণ ইস্রায়েল জাতি একত্রিত হয়ে ইস্রায়েল জাতির ইতিহাসে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ ও তাঁর চরিত্র উৎযাপন করে (লেবীয় ২৩)। তাছাড়া ঈশ্বর লেবীয় পুস্তকে নৈতিক ও সামাজিক আইন দেন, যার মাধ্যমে তিনি ইস্রায়েল জাতির মধ্যে মানবীয় জীবন, বিবাহ, পরিবার ও ধন-সম্পাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চান (লেবীয় ১৭-২২)। লেবীয় পুস্তকের শেষের দিকে ঈশ্বর ইস্রায়েলীয়দের বুঝান যে তাদেরকে স্বাধীন ইচ্ছা দেওয়া হয়েছে (লেবীয় ২৬)। ইস্রায়েল জাতিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে: হয়, তারা ঈশ্বরের প্রতি বাধ্যতা ও ভক্তিপূর্ণ ভয় পছন্দ করবে, যার ফলাফল হবে আশীর্বাদ, মঙ্গল ও জীবন। না হয়, তারা অবাধ্যতা ও দেবতা-পূজা পছন্দ করবে, যার ফলাফল হবে অভিশাপ, দারিদ্রতা ও মৃত্যু। যে কোন সময় তারা মৃত্যুর পথ ছেড়ে জীবনের পথে ফিরে আসতে পারে – যদি মন ফিরায়।
উৎসর্গ পদ্ধতি লেবীয় ১-৭ অধ্যায়
কারও মতামত না নিয়ে ঈশ্বর একটি অতি নির্দিষ্ট ও খুঁটিনাটি উৎর্গ পদ্ধতি স্থাপন করেন। ছয় ধরণের উৎসর্গ স্থাপিত, যার মধ্যে ৪টি হল রক্ত উৎসর্গ, যেখানে একটি পশু জবাই করা হয়। অন্য দু’টি উৎসর্গ হল শস্য উৎর্গ ও ঢালন উৎসর্গ। প্রত্যেটি উৎসর্গের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য এবং নির্দিষ্ট নিয়ম আছে:
রক্তের উৎসর্গ সব রক্তের উৎসর্গের জন্য একটি নিখুঁত শুচি পশু বেদীতে আনা হয়। আরাধনাকারী পশুর মাথায় হাত রেখে তার গলা কেটে দেয়। পুরোহিত একটি বাটিতে পশুর রক্ত ধরে রাখেন এবং তা বেদীর গায়ে ঢেলে দেন। আরাধনাকারী পশু কেটে টুকরাগুলো ধুয়ে ফেলে। পুরোহিত নিয়ম অনুসারে পশুর অংশ আবাস-তাম্বুর সামনে ব্রোঞ্জ বেদীতে পুড়িয়ে উৎসর্গ করেন।
- পাপ উৎসর্গ
- আরাধনাকারীর আর্থিক ক্ষমতা অনুসারে পশু উৎসর্গ করা হয়: পুরোহিতের জন্য ষাঁড়, নেতার জন্য ছাগল, সাধারণ ব্যক্তির জন্য ভেড়া, গরীবদের জন্য পাখী এবং অত্যন্ত গরীবদের জন্য ময়দা। পাপ উৎসর্গের ক্ষেত্রে আরাধনাকারী উৎসর্গের কোনো অংশ পায় না, চর্বি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং পশুর মাংস পুরোহিতের পাওনা।
- এই উৎসর্গ ঈশ্বরকে খুশি করার সুগন্ধ হিসাবে ধরা হয় না।
- অনিচ্ছাকৃতভাবে পাপ করার ক্ষেত্রে, শুচি হওয়ার বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের সময়ে এবং সব বাৎসরিক পর্বের অংশ হিসাবে পাপ উৎসর্গ দেওয়া হয়।
- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাপ উৎসর্গ বাৎসরিক প্রায়শ্চিত্ত দিনে, অর্থাৎ পাপ ঢাকার দিনে দেওয়া হয়।
- এই পাপ উৎসর্গগুলোর মধ্য দিয়ে স্বীকার করা হয় যে, প্রত্যেক ব্যক্তি এবং সম্পূর্ণ জাতি পাপ করেছে।
- দোষ উৎসর্গ
- যদি কেউ চুরি করে, ঠকায় বা মিথ্যা বলে তবে দোষ উৎসর্গ হিসাবে তার একটি পুরুষ ভেড়া দিতে হয়।
- উৎসর্গের সাথে ক্ষতিপূরণও দিতে হয় (২০% মূল্য বাড়িয়ে)। এই উৎসর্গ ঈশ্বরকে খুশি করার সুগন্ধ হিসাবে ধরা হয় না।
- পুড়ানো উৎসর্গ
- আরাধনাকারীর ইচ্ছা বা আর্থিক ক্ষমতা অনুসারে একটি নিখুঁত ষাঁড়, পুরুষ ছাগল, পুরুষ ভেড়া, কবুতর বা ঘুঘু উৎসর্গ করা হয়।
- উৎসর্গের অর্থ হল নিজেকে সম্পুর্ণভাবে ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত করা। তাই আরাধনাকারী উৎসর্গের কোনো অংশ পায় না বরং সব কিছু ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
- পুরোহিত পশুর চামড়া পান।
- এই উৎসর্গ হল এমন উৎসর্গ “যার গন্ধে ঈশ্বর খুশী হন”।
- পুড়ানো উৎসর্গ ব্যক্তিগতভাবে দেওয়া যায়।
- পুরোহিতেরা জাতির পক্ষ হয়ে নিয়মিত দৈনিক ও সাপ্তাহিক পুড়ানো উৎসর্গ দেয়।
- এছাড়া সমস্ত পর্বে পুড়ানো উৎসর্গ দেওয়া হয়।
- বিভিন্ন শুচি হওয়ার আচার-অনুষ্ঠানেও পুড়ানো উৎসর্গ থাকে।
- বাইবেলে সবচেয়ে বেশি উল্লিখিত উৎসর্গ হল পুড়ানো উৎসর্গ।
- শস্য উৎসর্গ
- সব রক্তের উৎসর্গের সাথে পশুর আকার অনুসারে শস্য উৎসর্গ দেওয়া হয়।
- শস্য উৎসর্গ হিসাবে মিহি ময়দা, রুটি, পিঠা বা চাপাটি দেওয়া হয়, সাথে তেল, লবণ ও লোবান দেওয়া হয়।
- আরাধনাকারী উৎসর্গের কোনো অংশ পায় না, এক ছোট অংশ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে পুড়ানো হয় এবং বাকিটা পুরোহিত পান।
- কিছু শুচি হওয়ার আচার-অনুষ্ঠানে শস্য উৎসর্গ দেওয়া হয়।
- এছাড়া ফসল কাটার সময়ে অগ্রিমাংশ হিসাবে বিশেষ শস্য উৎসর্গ দেওয়া হয়। শস্য উৎসর্গের গন্ধে ঈশ্বর খুশি হন।
- ঢালন উৎসর্গ
- সব রক্তের উৎসর্গের সাথে পশুর আকার অনুসারে শস্য উৎর্গের পাশাপাশি আঙ্গুর রসের ঢালন উৎসর্গ দেওয়া হয়।
- ঢালন উৎসর্গ সম্পূর্ণভাবে বেদীর গায়ে ঢেলে দেওয়া হয়, কোনো অংশ খাওয়া হয় না।
- শান্তি উৎসর্গ
- লেবীয় পুস্তকে তিন ধরণের শান্তি উৎসর্গ বর্ণনা করা হয়: ধন্যবাদ, মানত পূরণ এবং স্বেচ্ছায় উৎসর্গ।
- ষাঁড়, গরু, ছাগল, ছাগী, ভেড়া বা ভেড়ী, সবগুলো দেওয়া যায়। হালকা খুঁতসহ পশুও দেওয়া অনুমোদিত।
- শান্তি উৎসর্গের ক্ষেত্রে পশুর চর্বি অংশগুলো ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে পুড়ানো হয়, সবচেয়ে ভাল অংশ (বুক ও ডান উরু) পুরোহিতের পাওনা এবং বাকি মাংস আরাধনাকারী ও তার পরিবারকে দেওয়া হয়, যেন তারা তা ভোজ হিসাবে ঈশ্বরের উপস্থিতিতে উপভোগ করতে পারে। শান্তি উৎসর্গ পঞ্চাশত্তমী পর্বে, নাসরীয় শপথ পূর্ণ হওয়ার সময়ে এবং যে কোনো সময় ব্যক্তিগতভাবে দেওয়া যায়।
- শান্তি উৎসর্গ হল আনন্দপূর্ণ ভোজ, যার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে সহভাগিতা প্রকাশ পায়। শান্তি উৎসর্গের গন্ধে ঈশ্বর খুশি হন।
মানুষ হিসাবে ঈশ্বরের সামনে আসা এবং তাঁর সঙ্গে সহভাগিতায় থাকার বিষয়ে ৬টি উৎসর্গের মধ্যে প্রত্যেকটি ভিন্ন কিছু প্রকাশিত করে। পাপ ও দোষ উৎসর্গে অনুতাপ, প্রায়শ্চিত্ত ও ক্ষতিপূর্ণ প্রকাশিত; পুড়ানো উৎসর্গে মনেপ্রাণে আত্ম-সমর্পণ প্রকাশিত, শান্তি উৎসর্গে ঈশ্বরের সঙ্গে সহভাগিতা প্রকাশিত এবং বিশেষ শস্য উৎসর্গে ঈশ্বরকে মঙ্গলময় যোগানদাতা হিসােব প্রকাশিত।
সব ধরণের উৎসর্গ খ্রীষ্টেতে চূড়ান্তভাবে পূর্ণতা পায়। যীশু হলেন মানব জাতির জন্য সেই একমাত্র ও সর্বোচ্চ পাপ উৎসর্গ (যিশাইয় ৫৩:১০-১২)। পাপ উৎসর্গের ছাই যেমন ছাউনির বাইরে ফেলা হয়, ঠিক তেমনি যীশু “ইস্রায়েলীয়দের থাকার এলাকার বাইরে” মারা গেলেন (ইব্রীয় ১৩:১১-১৩)। তিনি আমাদের জন্য পাপ উৎসর্গ হয়েছিলেন যেন “খ্রীষ্টের সঙ্গে যুক্ত থাকবার দরুন ঈশ্বরের পবিত্রতা আমাদের পবিত্রতা হয়” (২ করি ৫:২১)। তিনি দোষ উৎর্গ হয়ে আমাদের দোষ সরিয়ে দিলেন (ইব্রীয় ১০:৪,১১-১৪)। এছাড়া যীশুই হলেন আসল পুড়ানো উৎসর্গ, তাঁর জীবন হল প্রত্যেক মুহূর্তে পিতার কাছে সমর্পিত, সম্পূর্ণ বাধ্য ও মনেপ্রাণে ভক্তির একটি জীবন (রোমীয় ১২:১-২)। আবারও তিনিই আসল শান্তি উৎসর্গ, তিনি আমাদের ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত করেছেন (২ করি ৫:১৮, কল ১:২০), আমাদের পুত্র হিসাবে তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্কে ও সহভাগিতায় ফিরিয়ে এনেছেন (গালা ৪:৭) এবং মানুষ হিসাবে আমাদের মধ্যে যে শত্রুতা বা বিভেদ ছিল, তাও তিনি বাতিল করেছেন (ইফি ২:১৪)।
উৎসর্গগুলো হল ইস্রায়েল জাতিকে সেই গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিক সত্যগুলো, অর্থাৎ সুখবরের মূল বিষয়গুলো শেখানোর একটি ব্যবহারিক পদ্ধতি। উৎর্গে সুসমাচারের সব মৌলিক বিষয়গুলো প্রকাশিত: ঈশ্বর পবিত্র। মানুষ পাপী। মানুষ যা করুক না কেন, আমরা নিজেকে কখনও গ্রহণযোগ্য বা পবিত্র করে তুলতে পারি না। কিন্তু ঈশ্বর একটি পথ খুলে দিয়েছেন এবং আমরা বিশ্বাসে ও বাধ্যতায় এই পথটি গ্রহণ করি: যীশু। এখানে নিজের প্রচেষ্টায় কিছু অর্জন করার, অমত হওয়ার বা ঈশ্বরের সঙ্গে দামাদামি করার কোনো সুযোগ নেই। একজন যিহূদী আরাধনাকারী যে মনোভাবে উৎসর্গ দিত, ঠিক সেই একই মনোভাবে আমরা যীশুর কাছে এসে পরিত্রাণ পাই: ঈশ্বরের পবিত্রতা ও ন্যায্যতা দেখে আমরা নিজের পাপ, অযোগ্যতা ও আশাহীন অবস্থা তাঁর কাছে স্বীকার করি। ঈশ্বর যে পথ খুলে দিয়েছেন, সেই পথে বিশ্বাসে আগাই: পুরাতন নিয়মের সময়ে এর অর্থ ছিল উৎসর্গ পদ্ধতি পালন করা, নতুন নিয়ম থেকে এর অর্থ হল যীশুর উপর বিশ্বাস রাখা ও তাঁর অনুসরণ করা, কারণ “সারা জগতে আর এমন কেউ নেই যার নামে আমরা পাপ থেকে উদ্ধার পেতে পারি” (প্রেরিত ৪:১২)।
অবশ্য লেবীয় পুস্তকে স্থাপিত উৎসর্গ পদ্ধতি প্রকৃতপক্ষে আরাধনাকারীর পাপ কখনও “দূর করতে পারে না”, মানুষের পরিবর্তে একটি পশু দাঁড় করা যায় না (ইব্রীয় ১০:৩-৪)। যা ঈশ্বর পুরাতন নিয়মের আরাধনাকারী থেকে চেয়েছেন তা হল নম্রতা ও বাধ্যতার মনোভাব, ঈশ্বরের দেওয়া পথে রাজি হওয়ার মনোভাব। পুরাতন নিয়মের আরাধনাকারী নম্রতায় ও বাধ্যতায় ঈশ্বরের নির্দেশনা অনুসারে উৎসর্গ দিত, বিশ্বাস করে যে, ঈশ্বর কোনভাবে ক্ষমার পথ খুলে দিবেন। নতুন নিয়মের আরাধনাকারী হিসাবে আমরা নম্রতায়, বাধ্যতায় ও কৃতজ্ঞতায় যীশুর দিকে তাকাই, বিশ্বাস করে যে, যীশু ক্রুশে যা করেছেন এর উপর নির্ভর করে আমরা পরিত্রাণ পাই। পুরাতন অথবা নতুন নিয়মের সময়ে হোক, ক্রুশের আগে বা ক্রুশের পরে হোক, পরিত্রাণ পাওয়ার পথ একটাই। নম্রতায় ও বাধ্যতায় তাঁর উপর বিশ্বাস রাখা, ঠিক এই মনোভাব ঈশ্বর চান – এবং উৎসর্গ দেওয়ার সময়ে এই মনোভাবের “গন্ধে ঈশ্বর খুশী হন”। দায়ূদ এই সত্য বুঝে বলেছিলেন “পশু-উৎসর্গে তো তুমি খুশী হও না, হলে আমি তা করতাম; পোড়ানো-উৎসর্গেও তুমি সন্তুষ্ট হও না। ভাংগাচোরা অন্তরই ঈশ্বরের গ্রহণযোগ্য উৎসর্গ; হে ঈশ্বর, নত এবং নম্র মনকে তুমি তুচ্ছ করবে না” (গীত ৫১:১৬-১৭)। উৎসর্গ পদ্ধতিতে একই সময়ে ঈশ্বরের পবিত্রতা এবং তাঁর দয়া, তাঁর ন্যায্যতা এবং তাঁর করুণা প্রকাশিত।
একারণে অন্যান্য জাতি বা ধর্মের চেয়ে ঈশ্বরের উৎসর্গ পদ্ধতি অনেক ভিন্ন: আরাধনাকারী বড় বা ছোট পশু উৎসর্গ করে, তাতে কিছু যায় আসে না, মনোভাবই হল আসল। এছাড়া অন্য ধর্মে উৎসর্গ দানের অর্থ হল দেবতার দয়া অর্জন করা, ধর্মকর্ম দ্বারা দেবতার সাহায্য নিশ্চিত করা বা নিজের পদ-মর্যাদা বাড়ানো। কিন্তু ঈশ্বররের উৎসর্গ পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন: মানুষের প্রচেষ্টা দ্বারা কিছুই অর্জন করা যায় না, গ্রহণযোগ্য হওয়া, নিজেকে প্রমাণ করা বা ঈশ্বরকে বাধ্য করানো যায় না। এছাড়া অন্যান্য ধর্মে মন্দিরে গিয়ে দেবতার উদ্দেশ্য উৎসর্গ দানের সাথে অনেক বার ব্যভিচার অথবা আরো খারাপ কাজ যুক্ত ছিল। কিন্তু ঈশ্বরের উৎসর্গ পদ্ধতিতে পবিত্রতাই প্রকাশিত, উৎসর্গের সাথে যুক্ত আছে নৈতিক জীবনের দাবি। উৎসর্গ করার সময়েই অনৈতিকতা একদম চলবে না। ঈশ্বরের উৎসর্গ পদ্ধতি মানে না ‘একটু ভাল উৎসর্গ যদি দেই তবে পাপের অনুমোদন পাই’।
যাকজদের নিযুক্ত লেবীয় ৮-১০ অধ্যায়
ঈশ্বর তাঁর সার্বভৌম ইচ্ছা অনুসারে মোশির বড় ভাই হারোণকে মহিপুরোহিত হিসাবে বেছে নেন, সঙ্গে হারোণের ছেলেদের ও ভবিষৎ বংশধরদেরও বেছে নেন। পুরোহিতদের ভূমিকা হল মধ্যস্থকারী হওয়া: তারা লোকদের পক্ষ হয়ে ঈশ্বরের সামনে উৎসর্গ দেন এবং লোকদের জন্য বিনতি করেন। আবারও তারা আদর্শ জীবন-যাপন করে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে লোকদেরকে ঈশ্বরের চরিত্র, পথ ও আইন সম্বন্ধে শিক্ষা দেন।
প্রথম বারের মত যাজকদের নিযুক্তকরণের জন্য মোশি একটি বড় অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন যাতে পাপ উৎসর্গ, পুড়ানো উৎর্গ ও দোলানো উৎসর্গ দেওয়া হয়। নতুন নিযুক্ত পুরোহিতেরা যখন বেদীতে প্রথম বার উৎসর্গ দান করেন তখন ঈশ্বর দৃশ্যভাবে তাদেরকে তাঁর অনুমোদন দান করেন: তিনি মেঘের থামের মধ্যে তাঁর মহিমা দেখান এবং আবাস-তাম্বু থেকে আগুন পাঠিয়ে বেদীতে দেওয়া উৎসর্গ পুড়িয়ে ফেলেন। এটি দেখে লোকেরা চিৎকার করে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে। আগে যেমন ঈশ্বর নতুন স্থাপিত আবাস-তাম্বুকে তাঁর আশ্চর্য ও দৃশ্যমান অনুমোদন দিয়েছিলেন (যাত্রা ৪০:৩৪-৩৫), ঠিক তেমনি তিনি এখন নতুন নিযুক্ত যাজকদের ক্ষেত্রেও তা করেন (লেবীয় ৯:২২-২৪)।
কিন্তু যখন হারোণের বড় দু’জন ছেলে ঈশ্বরের নিয়মের বাইরে ধূপ উৎসর্গ করেন (সম্ভবত মাতাল অবস্থায়, লেবীয় ১০:৮) তখন ঈশ্বর আবারও আবাস-তাম্বু থেকে আগুন পাঠান, এবার তাদের মেরে ফেলার জন্য (লেবীয় ১০:১-৩)। ঈশ্বর এইমাত্র নিযুক্ত হারোণকে এবং তার বাকি দু’জন ছেলেদের সবার সামনে শোখ প্রকাশ না করার আদেশ দেন, কারণ তারা এখন ঈশ্বরের প্রতিনিধি, নিজেদের প্রতিনিধি নন। নিযুক্ত হওয়ার দিনেই যে যাজকেরা ঈশ্বরের আইনকে সম্মান না করে বরং ‘নিজের মত চালান’, ঈশ্বর তা এই কঠোর ও তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ দ্বারা বিচার করেন এবং সাথে ভবিষ্যৎ দুর্নীতির প্রতিরোধও করেন। ঈশ্বর পবিত্র – যেন কেউ তা ভুলে না যায়!
শুচি-অশুচি হওয়ার বিষয়ে আইন লেবীয় ১১-১৫ অধ্যায়
মোশির মাধ্যমে ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে শুচি বা অশুচি হওয়ার বিষয়ে বেশ কয়েকটি ব্যবহারিক আইন দেন: পুষ্টি সম্বন্ধীয় (লেবীয় ১১), চর্মরোগ সম্বন্ধীয় (লেবীয় ১৩-১৪), ক্ষয় করা ছাৎলা সম্বন্ধীয় (লেবীয় ১৪) এবং রোগ সংক্রমণ সম্বন্ধীয় আইন (লেবীয় ১৫)। এই আইনগুলো দেওয়ার পিছনে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য কি? বিভিন্ন উত্তর দেওয়া যায়:
- কেউ কেউ বলে যে, ঈশ্বর এই আইনগুলো দেন যেন ইস্রায়েল জাতি নিজেকে অন্য জাতিদের থেকে আলাদা করে রাখে। প্রকৃতপক্ষে এই আইনগুলো ব্যবহারিকভাবে পালন করলে অন্য ধর্মের মানুষের সাথে বসবাস করা প্রায় অসম্ভব। এই চিন্তা অনুসারে শুচি-অশুচি আইনের উদ্দেশ্য হল ইস্রায়েল জাতিকে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিচয়, সংস্কৃতি ও অনুশীলন দেওয়া।
- আবারও কেউ বলে যে, এই আইনগুলোতে ঈশ্বর এমন বিষয়গুলো নিষেধ করেন যা কনানীয়দের বিভিন্ন দেবতা পূজায় প্রচলিত ছিল। এই চিন্তা অনুসারে শুচি-অশুচি আইনের উদ্দেশ্য হল ইস্রায়েল জাতিকে কনানীয় দেবতা পূজা থেকে দূরে রাখা।
- আবারও কেউ বলে যে, ঈশ্বর এই আইনগুলো দিয়েছেন, কারণ সেগুলো পালন করলে প্রকৃতপক্ষে ইস্রায়েল জাতির গণস্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিষ্কার-পরিছন্নতা উন্নত হবে এবং রোগ সংক্রমণের প্রতিরোধ হবে। এই চিন্তা অনুসারে শুচি-অশুচি আইন হল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিষয়, অর্থাৎ ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে এই পৃথিবীতে আরো ভালভাবে জীবন-যাপন করার বিষয়ে ব্যবহারিক শিক্ষা দেন। শুচি-অশুচি আইনগুলোর পিছনে বৈজ্ঞানিক কারণ কি হতে পারে? নিচে এই বিষয়ে কিছু চিন্তা দেওয়া হয়েছে:
- পুষ্টি
- ভূমির উপরে বাস করা জীব-জন্তুর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সেই জন্তুগুলো শুচি (অর্থাৎ খাওয়ার যোগ্য) যাদের পা দ্বিখণ্ডিত এবং যা জাবর কাটে।
- সমুদ্র ও নদীর জলের প্রাণীদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সেই জন্তুগুলো শুচি (অর্থাৎ খাওয়ার যোগ্য) যাদের পাকা ও আঁশ আছে।
- পাখীদের ক্ষেত্রে একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে কোনগুলো শুচি বা খাওয়ার যোগ্য।
- পোকাদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র এমনগুলো শুচি বা খাওয়ার যোগ্য যাদের যুক্ত পা বা হাঁটু আছে এবং যারা লাফিয়ে বেড়ায়।
- এই আইনগুলোর পিছনে কি কি বৈজ্ঞানিক কারণ থাকতে পারে?
- জাবর কাটা পশু শুধুমাত্র পাতা খায়। মাংস খাওয়ার চেয়ে পাতা খাওয়ার ক্ষেত্রে জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা খুবই কম। এছাড়া খাদ্য শৃঙ্কল আরো ছোট, তাই বিষাক্ত কিছু জমিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম।
- যে মাছের পাকা আছে সেগুলো স্বক্রিয়ভাবে সাতার কাটতে পারে এবং প্রবাহমান পানিতে বাস করে। অপর পক্ষে পাকা নেই মানে সমুদ্র বা নদীর স্থলে থাকা এমন প্রাণী যা ‘টোকাই’ বা ‘টুকরী’, অর্থাৎ যা ময়লা, পচা বা মরা জিনিস খায় অথবা পানি ছেঁকে খায়। এছাড়া দেখা যায় যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পানিতে থাকা বিষাক্ত প্রাণীর আঁশ নেই।
- যে পাখী গাছ ভিত্তিক খাবার খায় (যেমন বীজ-বাদাম) সেগুলো অনুমোদিত। যে পাখী মাংস, অশুচি পশু, মরা বা পচা মাংস খায়, সেগুলো নিষিদ্ধ।
- পোকার ক্ষেত্রে শুধু ফড়িং শুচি। হয়তো কিছু জন্তু নিষিদ্ধ হওয়ার আর একটি কারণ হল যে তাদের মাংস দূর থেকে আমদানি করতে হয় অথবা তাদের মাংস সহজে গুদাম করা যায় না।
- আর একটি চিন্তা: এমন পশু যা সব কিছু খায় (যেমন শূকর) সেগুলো খাবারের ক্ষেত্রে মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বি। কিন্তু এমন পশু যা পাতা খায় (যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া) সেগুলো এমন জমি থেকে বাঁচতে পারে যেখানে মানুষের জন্য খাবার তৈরি করা যায় না (যেমন উঁচু পাহাড়ে)।
- আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য “বিজ্ঞান ০৪ – পুষ্টি” দেখুন।
- চর্ম রোগ
- ঈশ্বর পুরোহিতদের স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করতে বলেন। এভাবে তারা সাধারণ লোকদের ব্যবহারিক প্রয়োজন ও সমস্যার সাথে পরিচিত হতে থাকেন। রোগ নির্ণয় করার জন্য শারীরিক পরীক্ষা এবং সাবধানতার সঙ্গে কিছু সময় ধরে লক্ষণের খেয়াল করা প্রয়োজন।
- চর্ম রোগরের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে চামড়ার চেহারা, ঘায়ের গভীরতা, লক্ষণের প্রক্রিয়া, সংক্রমণের সম্ভাবনা এবং অন্যদের কাছে ছড়ার ঝুঁকি মূল্যায়ন করা পুরোহিতদের দায়িত্ব।
- বাড়ীতে রোগ
- মানুষ ছাড়াও বাড়ী বা জিনিসগুলোতে জীবাণুর সংক্রমণ বা ক্ষয় করা ছাৎলা রোগ থাকতে পারে। আবারও লক্ষণ পরীক্ষা করে দেখতে হয়, সময়ে প্রক্রিয়া ও সংক্রমণ খেয়াল করতে হয়।
- প্রথম ধাপে বাড়ীর বা জিনিসের আক্রান্ত অংশকে ফেলে সংক্রমণ বন্ধ করতে চেষ্টা করতে হয়। রোগ পুনরায় দেখা দিলে তবে বাড়ী বা জিনিসকে ধ্বংস করতে হয়।
- আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য “বিজ্ঞান ০৫ – চামড়া রোগ” দেখুন।
- শরীর থেকে স্রাব
- মানুষ কি দিয়ে অশুচি হয়?
- মানুষ অশুচি হওয়া কারণ: শরীর থেকে স্রাব, অশুচি লোককে বা অশুচি জিনিসকে স্পর্শ, মরা কিছুকে স্পর্শ ইত্যাদি।
- মানুষ সহজে অশুচি হয় কিন্তু বেশ তাড়াতাড়ি আবার শুচি হওয়ার পদ্ধতিও আছে: যত কিছু অশুচি হয়েছে তা আলাদা করে ধুঁয়ে ফেলতে হয় এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
- যে লোক অশুচি ঈশ্বর তাকেই দায়িত্ব দেন নিশ্চিত করতে যেন অন্য কেউ তার কারণে অশুচি না হয়, রোগ বা জীবাণু যেন ছড়িয়ে না পড়ে।
- আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য “বিজ্ঞান ০২ – শরীরের স্রাব ও রোগ সংক্রমণ” দেখুন।
- মানুষ কি দিয়ে অশুচি হয়?
- পুষ্টি
অশুচি হওয়া আসলে মানে কি? ‘অশুচি’ শব্দটির অর্থ যে ‘খারাপ’, ‘অনৈতিক’ বা ‘মন্দ’, তা নয়। অশুচি মানে ‘সম্ভবত জীবাণু উপস্থিত’। প্রতিবেশীকে ভালবাসার মানে তো ঠিক এই: আমি যদি অশুচি হই তবে আমি শুচি-অশুচি নিয়ম পালন করা দ্বারা নিশ্চিত করি যেন আমার অবহেলার কারণে অন্য কারও রোগ পাওয়ার ঝুঁকি না হয়।
ইস্রায়েল জাতির জাতীয় পর্বগুলো লেবীয় ২৩ অধ্যায়
ইস্রায়েল জাতির আত্মিক জীবন ও ধর্মীয় শিক্ষার জন্য ঈশ্বর বেশ কয়েকটি বাৎসরিক পর্ব স্থাপন করেন। বছরে তিন বার ইস্রায়েল জাতির সবাই আবাস-তাম্বুতে একত্রিত হয়। সেখানে সেই পর্বগুলো পালনের মাধ্যমে তারা ঈশ্বরের চরিত্র এবং ইস্রায়েল জাতির ইতিহাসে তাঁর হস্তক্ষেপ উৎযাপন করে। এই পর্বগুলো ছিল আকর্ষণীয়, আনন্দপূর্ণ ও শিক্ষণীয় উৎসব, বিশেষভাবে ছেলেমেয়েদের জন্য।
- বিশ্রাম বার
- বিশ্রাম বার ছিল ইস্রায়েল জাতির সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বিশ্রাম বারে কাজ না করে বরং ঈশ্বরের সঙ্গে সময় কাটানো হয়।
- ঈশ্বর নিজেই সপ্তম দিন বিশ্রাম দিন হিসাবে স্থাপন ও পালন করেছিলেন (আদি ২:১-৩)।
- বিশ্রাম বারের অনুশীলন সবার জন্য বাধ্যতামূলক, ছেলেমেয়ে, দাস-দাসী, কাজের পশু এবং বিদেশী।
- বিশ্রাম বার পালন না করার শাস্তি মৃত্যদণ্ড! ইব্রীয় পুস্তকের লেখক বলেন যে, ঈশ্বরের লোকদের জন্য তাঁর দেওয়া বিশ্রাম হল পরিত্রাণের একটি ছবি (ইব্রীয় ৪:১-১১)।
- বিশ্রাম দিনে সকালে ও সন্ধায় একটি করে ভেড়া পুড়ানো উৎসর্গ দেওয়া হয়।
- অমাবস্যা
- প্রত্যেক মাস অমাবস্যার সময়ে আবাস-তাম্বুতে একটি ছাগল পাপ উৎসর্গ হিসাবে এবং আর একটি ছাগল, একটি ষাঁড় ও ৭টি ভেড়া পুড়ানো উৎসর্গ হিসাবে দেওয়া হয়।
- তূরী বাজানো হয়। সম্ভবত পর্বের উদ্দেশ্য হল নতুন মাসটি ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত করা।
- উদ্ধার পর্ব
- উদ্ধার বা নিস্তারপর্ব হল বাৎসরিক একটি পর্ব যার জন্য সবাই আবাস-তাম্বুতে একত্রিত হয়।
- পর্বটিতে মিসর থেকে ইস্রায়েলের প্রস্থান উৎযাপন করা হয়। মিসরে ইস্রায়েলের প্রথম জাত কিভাবে ভেড়ার রক্ত চৌকাঠে লাগিয়ে রেহাই পেয়েছিল, তা স্মরণ করার জন্য এই পর্বে প্রত্যেকটি পরিবারে একটি ভেড়া উৎসর্গ করা হয়।
- যীশুর ক্রুশীয় মৃত্যু ঘটেছিল ঠিক এই নিস্তার পর্বের দিনে এবং তিনি এভাবে নিস্তার পর্বের অর্থ চূড়ান্তভাবে পূর্ণ করেছেন: তাঁর রক্ত দিয়ে তিনি মানব জাতির জন্য প্রকৃভাবে ক্ষমা বা রেহাই অর্জন করেছেন।
- ক্রুশে তাঁর রক্ত ঢেলে দেওয়ার কারণে মৃত্যুদায়ক দূত যে শুধুমাত্র ‘পার হন’, তা নয়, বরং পাপীদের মৃত্যুদণ্ড যীশুর উপরে পড়েছে বলে বিশ্বাসীরা সম্পূর্ণভাবে ক্ষমা ও পরিত্রাণ পাই।
- খামিহীন রুটির পর্ব
- এই পর্বটি ঠিক উদ্ধার পর্বের পরের সপ্তাহে উৎযাপন করা হয়।
- খামিহীন রুটির পর্বেও প্রস্থানের সময়ের ঘটনাগুলো স্মরণ করা হয়।
- পঞ্চাশত্তমী, সাত সপ্তাহ বা প্রথম ফসল তোলার পর্ব
- পর্বটি উদ্ধার পর্বের ৫০ দিন (৭ সপ্তা বা ৭ গুণ ৭ দিন) পরে উৎযাপ করা হয়।
- তাতে সিনাই পাহাড়ে মোশির কাছে ঈশ্বরের আইন-কানুন দান স্মরণ করা হয়।
- সাথে প্রথম তোলা ফসলের ধন্যবাদের অনুষ্ঠানও পালন করা হয়।
- পর্বে পাপ উৎসর্গ, পুড়ানো উৎসর্গ ও শান্তি উৎসর্গ দেওয়া হয় এবং নতুন কাটা শস্য দোলানো উৎসর্গ হিসাবে দেওয়া হয়।
- ঠিক এই পঞ্চাশত্তমী পর্বের দিনে প্রেরিত ২ অধ্যায়ে বর্ণিত ঘটনা ঘটে: পবিত্র আত্মা বিশ্বাসীদের উপরে আসেন এবং ফলে তিন হাজার লোক বিশ্বাস করে নতুন মণ্ডলী স্থাপিত হয়। বাইবেলে “ফসল” হল খ্রীষ্টের কাছে এসে পরিত্রাণ পাওয়ার একটি ছবি।
- শিংগাধ্বনির পর্ব
- ইস্রায়েল পঞ্জিকার সপ্তম মাসে প্রথম দিনে সারা দিন শিংগা বাজানো হয় এবং পাপ ও পুড়ানো উৎর্গ দেওয়া হয়।
- এই পর্ব হল অনুতাপের একটি সময়ের শুরু যার শীর্ষ হল প্রায়শ্চিত্ত বা পাপ ঢাকার দিন।
- যিহূদী সরকারি পঞ্জিকা অনুসারে তা হল বছরের প্রথম দিন।
- কুঁড়ে ঘরের পর্ব
- পর্বটি হল ফসলের জন্য একটি আনন্দপূর্ণ ধন্যবাদের পর্ব।
- তাতে ৪০ বছরের মরুভূমিতে বিচরণের সময় স্মরণ করার জন্য ইস্রায়েলীয়েরা এক সপ্তাহ ধরে খেজুর পাতা দিয়ে বানানো কুঁড়ে ঘরে থাকে। পর্বের ৮টা দিনের প্রত্যেকটি দিনে পাপ উৎসর্গ এবং বড় পুড়ানো উৎসর্গ দেওয়া হয়। এছাড়া অনেকে ব্যক্তিগতভাবেও পুড়ানো ও শান্তি উৎসর্গ দেয় এবং পর্বটি হল পরস্পর্কে উপহার দানের একটি সময়।
আইন-কানুন লেবীয় ১৭-২৭ অধ্যায়
লেবীয় পুস্তকে ঈশ্বর মোশির মাধ্যমে ইস্রায়েল জাতিকে বিভিন্ন আইন দেন, যেমন:
- উৎসর্গ
- ইস্রায়েল জাতি যত উৎসর্গ করে, সেগুলো সব আবাস-তাম্বুর ব্রোঞ্জ বেদীতেই এবং হারোণ পরিবারের পুরোহিতের মধ্য দিয়েই দিতে হবে।
- এছাড়া উৎসর্গ দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ (লেবীয় ১৭:১-৯)।
- যার যার স্থানে যেভাবে হোক ইস্রায়েলীয়েরা যেন উৎসর্গ না দেয়, সম্ভবত এটা প্রতিরোধ করার জন্য ঈশ্বর এই আইনটি দেন।
- যদি যেখানে সেখানে উৎসর্গ দেওয়া হয় তবে সম্ভাবনা বেশি যে, উৎসর্গগুলো ধীরে ধীরে কনানীয়দের পূজার সাথে মিশে যায় (২ রাজা ১৮:৪, আমো ৪:৪)।
- ধর্ম ক্ষেত্রে ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতির জন্য কেন্দ্রীয় আরাধনা স্থাপন করেন।
- পশু জবাই
- মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে ইস্রায়েলীয়েরা যেখানে সেখানে পশু জবাই করতে পারে, কিন্তু পশুর রক্ত ঢেলে দিতে হবে কারণ পশুরু রক্তেই জীবন (আদি ৯:৩)।
- ঈশ্বর প্রাণীর জীবনের জন্য একটি সর্বনিম্ন সম্মান দাবি করেন।
- যৌন সম্পর্ক
- যদিও ঈশ্বর বিবাহের চুক্তির বাইরে যৌন সম্পর্ক ইতিমধ্যে ১০ আজ্ঞায় নিষেধ করেছিলেন (“ব্যভিচার করিও না”) তবুও তিনি এই ক্ষেত্রে আরো বিস্তারিত আইন দেওয়া প্রয়োজন মনে করেন, বিশেষভাবে যেন পরিবারের মধ্যে নিকট আত্মীয়দের সাথে যৌন সম্পর্ক রাখা না হয় (লেবীয় ১৮:১-২৩)।
- এই আইনগুলো দ্বারা ঈশ্বর মহিলাদের, যুবতীদের এবং বিশেষভাবে অল্প বয়সীদের পরিবারে শক্তিশালী প্রধান পুরুষদের কাছ থেকে রক্ষা করেন।
- আইনগুলো দ্বারা পরিবারের মধ্যে মহিলাদের কষ্টের সম্পর্কে ফেলা নিষেধ করা হয় (যেমন দুই বোন একসাথে বা মা ও কন্যাকে একসাথে প্রেমিকা হিসাবে নেওয়া নিষেধ)।
- পরিবারের মধ্যে মহিলাদের বেআইনী, সম্মানবিহীন, অধিকারবিহীন ও ভবিষ্যৎবিহীন যৌন সম্পর্কে যেন ব্যবহার করা না হয়, সেজন্য ঈশ্বর এই আইনগুলো দিয়েছেন।
- এছাড়া সমকামী যৌন সম্পর্কে এবং পশুর সাথে যৌন সম্পর্কও নিষেধ করা হয়।
- এই সব ধরণের আচরণ মিসরীয়দের ও কনানীয়দের মধ্যে প্রচলিত ছিল, কিন্তু ঈশ্বর এগুলো ইস্রায়েল জাতিতে দেখতে চান না।
- ঈশ্বর কঠোর একটি সাবধাণবাণী দেন: যে সাতটা জাতিকে ইস্রায়েল ধ্বংস করবে এবং তাদের জমির অধিকার করবে – যদি ইস্রায়েল তাদের মত আচার-আচরণ করে তবে যেমন এখন তাদেরই ধ্বংস করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি ঈশ্বর ইস্রায়েলকেও ধ্বংস করবেন। ইস্রায়েল জাতি প্রতিজ্ঞাত দেশ হারাবে এবং মাত্র অল্প কিছু লোক নির্বাসিত হয়ে বাঁচবে (লেবীয় ১৮:২৪-৩১)।
- আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য ‘পরিবার ০৬ – নিষিদ্ধ যৌন সম্পর্ক’ দেখুন।
- দারিদ্রতার হ্রাস
- দারিদ্রতার প্রতিরোধ করার জন্য ঈশ্বর আইন-কানুনে দু’টি পদ্ধতি স্থাপন করেন: বিশ্রাম বছর এবং জুবল বছর।
- বিশ্রাম বছরের নিয়ম অনুসারে সাত বছর পর পর, অর্থাৎ বিশ্রাম বছরে সবার ঋণ মওকুফ এবং সব বন্ধন শ্রম মুক্ত করতে হয়।
- এভাবে ঈশ্বর ঋণে বা পরাধীনতায় পড়া লোকদের জন্য রীতিমত নতুনভাবে শুরু করার সুযোগ নিশ্চিত করেন।
- আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য ‘অর্থনীতি ০৯ – ঋণ নেওযা ও দেওয়া’ এবং ‘অর্থনীতি ১০ – জাতীয় ঋণ ও বন্ধন শ্রম’ দেখুন।
- এছাড়া ঈশ্বর ৫০ বছর পর পর একটি জুবল বছর পালন করতে বলেন, যেখানে ঋণ মওকুফ ও বন্ধন শ্রম মুক্ত করার সাথে সব জমি আসল মালিকদের কাছে ফেরত দিতে হয়।
- এভাবে ঈশ্বর নিশ্চিত করেন যে, ইস্রায়েলের প্রত্যেক প্রজন্ম কম পক্ষে একবার সম্পূর্ণ নতুনভাবে শুরু করার সুযোগ পাবে (লেবীয় ২৫)।
- সামাজিক আইন
- ঈশ্বর বিভিন্ন ধরণের সামাজিক আইন, অর্থাৎ মানবীয় অধিকারের সুরক্ষাকারী আইন স্থাপন করেন, যেমন মা-বাবার অধিকার সুরক্ষার জন্য (লেবীয় ১৯:৩), ছেলেমেয়েদের জন্য (লেবীয় ১৯:২৯), বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য (লেবীয় ১৯:৩২), আত্মীয়দের জন্য (লেবীয় ১৯:১৭), প্রতিবেশীদের জন্য (লেবীয় ১৯:১৩,১৬,১৯), বিদেশীদের জন্য (লেবীয় ১৯:৩৩-৩৪), গরীবদের জন্য (লেবীয় ১৯:-১০), দুর্বলদের জন্য (লেবীয় ১৯:২৪), শ্রমিকদের জন্য (লেবীয় ১৯:১৩), শ্রমের জন্য (লেবীয় ১৯:৩,১৩), ব্যক্তিগত সম্পদের জন্য (লেবীয় ১৯:১৩), ন্যায় বিচারের জন্য (লেবীয় ১৯:১৫) এবং নিরাপত্তার জন্য (লেবীয় ১৯:১৮)।
- ধর্মীয় আইন
- ধর্ম ক্ষেত্রেও ঈশ্বর বিভিন্ন আচার-আচরণ নিষেধ করেন: দেবতাপূজা (লেবীয় ১৯:৪), মূর্তি তৈরি (লেবীয় ১৯:৪), লক্ষণ-বিদ্যা, মায়বিদ্যা বা যাদুর ব্যবহার (লেবীয় ১৯:২৬), ভূতের মাধ্যম বা মন্দ আত্মার সাথে সম্বন্ধ রাখা (লেবীয় ১৯:৩১) এবং অন্যান্য পৌত্তলিক আচার-অনুষ্ঠান (লেবীয় ১৯:২৭-২৮)।
- কথার গুরুত্ব
- ঈশ্বর মুখের কথার গুরত্ব এবং কথার শক্তির বিষয়ে বিভিন্ন আইন দেন: শপথ ভাঙ্গা ঠিক না এবং যদি একটি শপথ ফেরত নেওয়া প্রয়োজন তবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে একটি উৎসর্গ ও জরিমানা দিতে হয় (লেবীয় ২৭)।
- মন্দ উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের নাম নিয়ে আরেকজনকে অভিশাপ যদি কেউ দেয় তবে তাকে কঠোরভাবে শাস্তি দিতে হয় (লেবীয় ২৪:১০-২৩)।
- ঈশ্বরের নাম নিয়ে মিথ্যা শপথ বা প্রতিজ্ঞা করা নিষেধ (লেবীয় ১৯:১২)।
- একজন কানা লোককে অভিশাপ বা অপমান করা অথবা একজন অন্ধরের পথে উছোট খাওয়ার মত কিছু রাখা নিষেধ, তার দুর্বলতা কেউ ব্যবহার না করুক বা তা নিয়ে কেউ হাসাহাসি না করুক (লেবীয় ১৯:১৪)।
- নিন্দা করা বা ক্ষতিকারক কথা নিষেধ (লেবীয় ১৯:১৬)।
- মৌখিক চুক্তি অবশ্যই পালন করতে হয় (লেবীয় ১৯:৩৫-৩৬)।
- মৃত্যুর শাস্তি
- দেবতাপূজা, যাদু, সন্তানকে উৎসর্গ এবং যত যা জীবন, স্বাধীন ইচ্ছা, বিবাহ সম্পর্ক, মা-বাবার অধিকার, পরিবার এবং পরিবারের মধ্যে নিরাপত্তা ধ্বংস করে – এসব আচার-আচারণে ঈশ্বর মৃত্যুদণ্ড দেন।
কারণ ও ফলাফল শেখানো লেবীয় ২৬ অধ্যায়
লেবীয় পুস্তকের ২৬ অধ্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে বুঝান যে, মানুষ হিসাবে তাদেরকে প্রকৃতভাবে স্বাধীন ইচ্ছা ও নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দান করা হয়েছে। সঙ্গে তিনি তাদের শেখান যে, যেমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাস্তব, ঠিক তেমনি সিদ্ধান্তের ফলাফলও বাস্তব – উভয় ভাল ও খারাপ দিকে।
যদি তারা ঈশ্বরের ভক্তিপূর্ণ ভয়ে চলে এবং আইন-কানুনে বাধ্য হয়, তবে এর ফলাফল হবে আশীর্বাদ, মঙ্গল, সুস্বাস্থ্য, শান্তি, জীবন এবং স্থায়ীভাবে প্রতিজ্ঞাত দেশের উপর অধিকার। যদি তারা দেবতাপূজা করে এবং ঈশ্বরের আইন-কানুনে অবাধ্য হয়, তবে তার ফলাফল হবে অভিশাপ, অভাব, অসুস্থতা, যুদ্ধ, মৃত্যু এবং প্রতিজ্ঞাত দেশের অধিকার হারানো।
যে কোন মুহূর্তে মন ফিরানোর সুযোগ আছে এবং যদি তারা অনুতপ্ত হয় তবে ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা দিয়েছেন যে, তিনি তাদেরকে পুনরায় গ্রহণ করবেন। ঈশ্বরের কোনো অহংকার নেই, তিনি অনুতপ্ত মানুষকে কখনও অগ্রাহ্য করেন না।
ঈশ্বর মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে সম্মান করেন। সাথে তিনি মানুষকে তার সিদ্ধান্তের জন্য দায়বদ্ধও রাখেন। মানুষ হিসাবে আমরা প্রায়ই নিজের সিদ্ধান্তের ফলাফল অস্বীকার করি বরং ঈশ্বরকে আমাদের পরিস্থতির জন্য দোষ দেই। কিন্তু তা ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর মানুষকে অনেক ক্ষমতা দান করেছেন, এভাবে তিনি মানুষকে সম্মান দেখিয়েছেন। মানুষ আসলেই ভাল কাজ করার সক্ষম – এবং মন্দ কাজ করারও সক্ষম। একটি বাস্তব পৃথিবীতে বাস্তব সিদ্ধান্তগুলো বাস্তব ফলাফল নিয়ে আসে। ঈশ্বর ইস্রায়েলকে শিক্ষা দেন, যেন তারা সঠিকটা পছন্দ করতে শেখে।