লূক অত্যন্ত সতর্কতার সাথে খোঁজ খবর নিয়ে প্রথম মণ্ডলীর একটি ইতিহাস লেখেন এবং তা থিয়ফিলের কাছে পাঠান। থিয়ফিল ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ রোমীয় কর্মকর্তা, যাকে লূক নিশ্চিত করতে চান যে, যীশু খ্রীষ্টের সে সুখবর যা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাচ্ছে তা দ্বারা উভয় যিহূদী এবং পরজাতিরা পরিত্রাণ পায়।
ডাক্তার লূক (কলসীয় ৪:১৪) ছিলেন পৌলের একজন অযিহুদী শিষ্য ও সহকর্মী। তিনি এমন অনেক মানুষের সাক্ষাৎকার নেন যারা নিজের চোখে যীশুকে দেখেছিলেন (লূক ১:১-৪)। সে সময়ে যত যীশু সম্বন্ধীয় লেখাগুলি ছিল, সেগুলিও ভাল করে লক্ষ্য করে তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সুন্দরভাবে সাজিয়ে একটি সুসমাচার লিখেন, যা আমরা লূক সুসমাচার হিসাবে পড়ি। তার দ্বিতীয় পুস্তক হল প্রেরিতদের কার্যাবলী (প্রেরিত)। এই দুইটি পুস্তক পরিষ্কারভাবে একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত, কারণ দুইটি পুস্তকই লূক থিয়ফিল নামে একজনের কাছে লিখেন (লূক ১:১-৪, প্রেরিত ১:১)। তার সুখবরে লূক যীশুর জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের উপরে জোর দেন, প্রেরিত পুস্তকে তিনি যীশু দ্বারা স্থাপিত সে পরিত্রাণ দানকারী ধর্মীয় আন্দোলন কিভাবে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, তার বর্ণনা দেন।
পৌল যখন দুই বছর কৈসরিয়া শহরে (৫৭-৫৯ খ্রীঃ) এবং পরে রোম শহরে বন্দী ছিলেন (৬০-৬২ খ্রীঃ), খুব সম্ভবত তখনই লূক সময় নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করেন এবং চোখের সাক্ষীদের সাক্ষ্য নিয়ে পুস্তকটি লিখেন।
লূক এই পুস্তকটি একজন “মাননীয় থিয়ফিলের” জন্য লিখেন। সেই সময় এই “মাননীয়” উপাধি উঁচু শ্রেণির রোমীয় শাসকদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হত (প্রেরিত ২৩:২৬, ২৪:৩, ২৬:২৫)। তাই অনুমান করা যায় যে থিয়ফিল উঁচু শ্রেণির কোন রোমীয় কর্মকর্তা ছিলেন, হয়তো এমন কি তিনি সেই রোমীয় বিচারক বা উকিল ছিলেন যার দ্বারা পৌলের মামলা রায় পেত (প্রেরিত ২২-২৮)। থিয়ফিলকে যদি লূক বুঝাতে চান যে যিহূদী যীশু পৃথিবীর পরিত্রাণকর্তা (লূক) এবং যিহূদী পৌলও ভাল লোক (প্রেরিত) তবে লূককে যিহূদীদের বিরুদ্ধে রোমীয়দের শক্তিশালী নেতিবাচক চিন্তাগুলি ভাঙ্গতে হবে। রোমীয়রা যিহুদী ধর্মাবলম্বীদের অন্ধবিশ্বাসী হিসাবে বিবেচনা করত কারণ তাদের কারণেই মূলত রোমীয় সাম্রাজ্যে বার বার অস্থিরতা তৈরি হত। রোমীয়রা খুব গর্ব করত যে তারা দখল করা দেশগুলিকে সুশৃঙ্খলায় নিয়ে আসবে এবং তাদের সে বিখ্যাত ‘রোমীয় শান্তি’ (Pax Romana) স্থাপন করবে। যিহূদীদের অনবরত আন্দোলন ও অস্থিরতা ছিল ‘রোমীয় শান্তির’ হুমকিস্বরূপ এবং রোমীয়রা যিহূদীদের এই কারণে নিচু চোখে দেখত ও ঘৃণা করত।
যেন থিয়ফিল লূকের লেখা ভাল চোখে দেখে, তার নিশ্চিত করানো প্রয়োজন যে যীশু খ্রীষ্ট কোন সাধারণ যিহুদী নন, তিনি অন্যান্য যিহুদীদের মত ধর্মান্ধও নন। এটা বুঝানো প্রয়োজন যে ধর্মান্ধ যিহুদীরাই যীশুর উপর অত্যাচার করে এবং শেষ পর্যন্ত তারাই যীশুকে ক্রুশে দিয়ে মেরে ফেলে। লূকের দেখাতে হয় যে যীশু কাউকে বিদ্রোহী করে তুলেন নি এবং তিনি কোনো রাজনৈতিক নেতাও নন। তাঁর মধ্যে কোন যিহুদী অহংকার বা কাউকে নিচু চোখে দেখার মনোভাব ছিল না। তিনি যিহুদী-অযিহুদী সকলের সাথেই মিশতেন। এমন কি যাদেরকে যিহুদীরা নিচু চোখে দেখত (যেমন বিজাতীয় লোক, পাপী, গরীব, অসুস্থ, মহিলা, ছোট ছেলেমেয়ে) সকলের সাথেই তিনি সম্পর্ক রেখেছেন। যীশু যিহুদীদের অহংকার এবং অন্য জাতিদের নিচু চোখে দেখার মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করেন। রোমীয়দের বিরোধিতা করাই একমাত্র সমাধান, যিহুদীদের এই মনোভাবের বিরুদ্ধে যীশু কথা বলেন এবং দেখিয়ে দেন যে তার চেয়ে মানুষের পাপপূর্ণ অন্তরের সাথেই মোকাবেলা করা প্রয়োজন।
থিয়ফিলকে লূকের দেখানো প্রয়োজন যে প্রথম মণ্ডলী, যীশুর অনুসরণকারীরা, ঠিক যীশুর মত ও পবিত্র আত্মা দিয়ে পরিচালিত: তারা রাজনৈতিক কাজ করে না, সহিংস্রতা দেখায় না, বরং তারা ঠিক সে একই ধর্মান্ধ যিহূদীদের দ্বারা অত্যাচারিত, যারা যীশুকেও অত্যাচার করেছিল। তারা যীশুর সুখবর প্রচার করে, লোকদের সেবা করে এবং পরিত্রাণের আমন্ত্রণ জানায়। শ্রোতারা সাড়া দিয়ে যদি পরিত্রাণ পায় তবে তাদের হৃদয় ও জীবন সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়। যে ধরণের লোকদেরকে রোমীয়রা ঘৃণা করে (অহংকারী, অন্য জাতিদের নিচু চোখে দেখা ও বিদ্রোহী যিহূদী), ঠিক তারাই পরিত্রাণ পায় ও এমন পরিবর্তিত হয়ে যায় যা তারা নিজের জাতি ও অন্য জাতিদের ভালবাসতে ও সেবা করতে শুরু করে।
লূক থিয়ফিলকে প্রথম মণ্ডলীর নেতাদের চরিত্র দেখান: পিতর, যোহন, স্তিফান, ফিলিপ, বার্ণবা, যাকোব। তিনি দেখান তারা কিভাবে পরিবর্তিত হন: রোমীয়দের ঘৃণাকারী ও ভিত যিহূদীরা হয়ে যায় যিহূদী-অযিহূদীদের স্বার্থহীন ও সাহসী নেতা। লূক খ্রিষ্টান আন্দোলনের নেতার উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন: পৌল। পৌলই সে ধর্মান্ধ ও হিংস্র ফরীশী যার জীবন একেবারে পরিবর্তন হয়ে যায় যখন যীশু তার সাথে দেখা করেন। তিনি একজন নির্ভয়ের প্রেরিতে পরিণত হন, যিনি খ্রীষ্ট ও তার মণ্ডলীর জন্য জীবন দিতে রাজি। যিনি অযিহূদীদের ঘৃণার চোখে দেখতেন, তিনি তাদের সমর্থক ও মঙ্গলকারী হয়ে যান। পৌলই হলেন সে সর্বোচ্চ উদাহরণ, কি ঘটে যখন যীশু এক মানুষের হৃদয় দখল করেন: তিনি একজন শক্তিশালী, নম্র, যীশুর মত মনোভাবের ও স্বার্থহীন নেতায় পরিণত হন, যিনি সে মুক্তদায়ক সুখবরের জন্য জীবন দেন।
লূক তার পুস্তকের অর্ধেক অধ্যায়ে পৌলের জীবন ও পরিচর্য্যার বর্ণনা দেন। কেন লূকের লেখায় পৌল এত বেশি গুরুত্ব পান? এক কারণ হতে পারে যে লূক বহুবছর পৌলের সঙ্গে যাত্রা ও পরিচর্যা করেছিলেন এবং পৌল অবশ্যই প্রথম মণ্ডলীর একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। কিন্তু যেহেতু লূক তার পুস্তকে ৮ অধ্যায় ধরে পৌলের বর্তমান মামলার বর্ণনা দেন (প্রেরিত ২১-২৮), চিন্তা করা যায় যে রোমীয় কর্মকর্তা থিয়ফিল ছিল রোমে একজন সরকারী উকিল বা বিচারক যার কাছে পৌলের মামলা আসে। তাই যদি হয় তবে প্রেরিত পুস্তক হল পৌল সম্বন্ধীয় পটভূমি তথ্যের সংগ্রহ বা তার জন্য সুরক্ষার দলিল: লূক দেখান যে পৌল পরিবর্তিত, তিনি ধর্মান্ধ ভাব ও সহিংস্রতা সম্পূর্ণ বাদ দিয়েছেন। কিন্তু যেখানে তিনি যান না কেন, বিরুদ্ধীয় লোক তাকে সংকটে ফেলতে চেষ্টা করে (উদাহরণস্বরূপ তার এই বর্তমানের মামলা)। লূক দেখান যে পৌল নির্দোষ, এবং প্রেরিত পুস্তকে নানা রোমীয় সরকারি অফিসার ঘোষণা করেন যে পৌলই নির্দোষ এবং যারা তার বিরুদ্ধীয়, তারাই ধর্মান্ধ। সারা প্রেরিত পুস্তকে এমন একজনও রোমীয় কর্মকর্তা নেই যিনি পৌলকে বিচার করতে রাজি হন।
লূক থিয়ফিলকে দেখান যে পবিত্র আত্মা দ্বারা যে ধর্মীয় আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা অনেক অত্যাচারের সম্মুখীন হলেও বৃদ্ধি পায় ও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ঈশ্বরের বাক্য পৃথিবীকে দখল করছে। যীশুর সুখবরকে থামানো যায় না এবং তার ঢেউ এমন কি রোম পর্যন্ত এসেছে। থিয়ফিল, তুমি কি সাড়া দেবে?
অত্যন্ত সতর্কতার সাথে খোঁজ খবর নিয়ে লিখিত সুসমাচার
ডাক্তার লূক ছিলেন পৌলের একজন অযিহুদী শিষ্য ও সহকর্মী (কলসীয় ৪:১৪)। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত খোঁজ খবর নিয়ে সুশৃঙ্খল ও পর্যায়ক্রমিকভাবে একটি সুসমাচার লেখেন (লূক) এবং পরবর্তীতে মণ্ডলীর স্থাপন ও ছড়ানোর একটি ইতিহাসও লেখেন (প্রেরিত)। লূক এটা স্পষ্ট করেন যে তিনি যীশু খ্রীষ্টকে নিজের চোখে দেখেননি, বরং পরবর্তীতে খ্রীষ্টকে গ্রহণ করেন (অতএব তিনিও পাঠক থিয়ফিলের মত একই অবস্থায় ছিলেন)। যীশু খ্রীষ্টের বিষয়ে তখন যে সমস্ত লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, সেই সমস্ত লেখা তিনি বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করেন (লূক ১:১) এবং এমন অনেক মানুষের সাক্ষাৎকার নেন যারা নিজের চোখে যীশুকে দেখেছিলেন (লূক ১:১-৪)। তা ছাড়া লূক নিজেই নতুন স্থাপিত মণ্ডলীর নেতাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হয়েছেন। বিশেষভাবে তিনি প্রেরিত পৌলের দীর্ঘ দিনের সহকর্মী হিসাবে তার পরিচর্যা, বিভিন্ন প্রচার যাত্রা এবং কিভাবে মণ্ডলীর ছড়িয়ে পড়ছেন, তার চোখের সাক্ষী (প্রেরিত ১৬:১০ থেকে শেষ পর্যন্ত)।
ডাক্তার লূক তাই দুইটি পুস্তক লিখেছেন: লূক লিখিত সুসমাচার এবং প্রেরিত। এই দুই পুস্তকের মধ্যে বেশ পরিষ্কারভাবে সংযোগ দেখা যায়:
- দুইটি পুস্তক একই লোকের কাছে লেখা হয়েছে যার নাম থিয়ফিল (লূক ১:১-৪, প্রেরিত ১:১)।
- প্রেরিত পুস্তক লূক সুসমাচারের দিকে নির্দেশ করেন “তিনি (যীশু) যা করেছিলেন ও শিক্ষা দিয়েছিলেন … আমি আমার আগের বইতে লিখেছি।”
- পবিত্র আত্মার জন্য অপেক্ষার আদেশ দিয়ে লূক সুসমাচার শেষ হয় (লূক ২৪:৪৯) এবং প্রেরিত পুস্তক ঠিক তা নিয়ে শুরু হয় (প্রেরিত ১:২)।
- লূক ও প্রেরিতের ঘটনাগুলো ভৌগলিকভাবে একই এলাকায় ঘটে, এই কারণে এদের অনেকটা আয়নার প্রতিবিম্বের মত মনে হয়:
লূক ১:১ গালীল প্রেরিত ১৩:১ পৃথিবীর শেষ প্রান্ত
লূক ৯:৫১ যিরুশালেমের পথে প্রেরিত ৮:১ যিহুদীয়া, শমরিয়া
লূক ১৯:২৮ যিরুশালেম প্রেরিত ১:১ যিরুশালেম
পৌল যখন কৈসরিয়ায় ২ বছরের জন্য (প্রেরিত ২৩:২৪, ২৪:২৭, ৫৭-৫৯ খ্রীঃ) এবং এর পরে রোমে(প্রেরিত ২৮:৩০-৩১, ৬০-৬২ খ্রীঃ) বন্দী ছিলেন, খুব সম্ভবত তখন লূক তাঁর অনুসন্ধান ও লেখালেখির কাজ করেছিলেন।
লূক এবং প্রেরিত পুস্তকের লেখক
কোন লেখায় লূক তাঁর নিজের নাম উল্লেখ করেননি, তাহলে আমরা কিভাবে বুঝতে পারি যে এই দুইটি পুস্তক তিনিই লিখেছেন? এখানে অভ্যন্তরীণ কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় (বাইবেলের ভেতর থেকে প্রমাণ), সেই সাথে বহিরাগত কিছু প্রমাণও পাওয়া যায় (মণ্ডলীর আদিপিতাদের লেখা এবং মণ্ডলীর ইতিহাস থেকে পাওয়া।)
অভ্যন্তরীণ প্রমাণ
প্রেরিত পুস্তকে যখন পৌলের অতীত কাহিনী উল্লেখ করা হয় তখন “তারা, তাদের” এই ধরণের সম্বোধন ব্যবহৃত হয় (অর্থাৎ এই সময় লেখক দলের সাথে ছিলেন না)। আবার কোন কোন সময় “আমরা” সম্বোধন ব্যবহৃত হয় (অর্থাৎ এই সময় লেখক দলের সাথে ছিলেন)। এই বিষয় আমাদের হালকা সংকেত দেয় যে কে লেখক হতে পারে।
প্রেরিত পুস্তকের বিভিন্ন বাক্যে “আমরা” শব্দটি নির্দেশ করে যে লেখক পৌলের সংগে আছেন।
- প্রেরিত ১৬:১০ ২য় প্রচার যাত্রা, ত্রোয়াতে মিলিত হন, এর পরে ফিলিপীতে চলে যান।
- প্রেরিত ২০:৫-১৫ ৩য় প্রচার যাত্রা, পৌল ফিলিপীতে আবারও শিষ্যদের সাথে মিলিত হন, একসাথে মিলিতা বন্দরে যান।
- প্রেরিত ২১:১-১৮ ৩য় প্রচার যাত্রা, যিরুশালেমে ফিরে আসেন।
- প্রেরিত ২৪:২৩ কৈসরিয়াতে বন্দী অবস্থায় পৌল বন্ধুদের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি পান।
- প্রেরিত ২৪:২৭ কৈসরিয়ায় পৌল দুই বছর জেলে। এই সময় লূক কি করেছিলেন?
- প্রেরিত ২৭:১-২৮:১৬ পৌলের সাথে রোমযাত্রার সময় (লেখক, পৌল ও আরিষ্টার্খ), তাই বলা যায় লেখক পৌলের সাথে রোমে ছিলেন।
পৌল রোমে বন্দী থাকা অবস্থায় যে চিঠি লেখেন, তাতে তিনি নিম্নলিখিত শিষ্যের কথা উল্লেখ করেন।
- কলসীয় ৪:১০-১১ যিহুদী- আরিষ্টার্খ, মার্ক, যুষ্ট যীশু। অযিহুদী- ইপাফ্রা, লূক, দীমা।
- ফিলীমন ২৩,২৪ ইপাফ্রা, মার্ক, আরিষ্টার্খ(থিষলনীকীর মাকিদনীয়া থেকে), দীমা, লূক।
- ২ তীমথিয় ৪:১১ পৌলের সাথে লূক একা আছেন। মার্ক অন্য কোথাও আছেন। দীমা চলে গেছে।
সম্ভাব্য লেখক:
- আরিষ্টার্খ সম্ভব নয়। তিনি লেখকের সাথে ভ্রমণ করছিলেন (প্রেরিত ২৭:২)
- মার্ক সম্ভব নয়। যখন ২য় প্রচার যাত্রায় লেখক ত্রোয়াতে পৌলের সাথে মিলিত হন, তখন মার্ক পৌলের সাথে ছিলেন না। মার্ক বার্ণবার সাথে চলে গিয়েছিলেন, তিনি অন্য একটি সুসমাচার লিখেছিলেন, আরও দুইটি পুস্তক লেখা অসম্ভব।
- ইপাফ্রা তিনি এশিয়া থেকে এসেছিলেন, কিন্তু ৩য় যাত্রার পূর্বে পৌল সেখানে যান নি। কলসীয় ১:৭-৮ নির্দেশ করে যে পৌল রোমে পৌছার পরে ইপাফ্রা সেখানে পৌছান।
- দীমা তিনি চলে গিয়েছিলেন, তার পক্ষে লেখা অসম্ভব।
- যুষ্ট যীশু আর কোথাও তার নামের উল্লেখ নেই।
- লূক খুব সম্ভবত তিনিই লেখক।
ডাক্তার লূকই পুস্তক দুইটির লেখক বলা যায়, কারণ লূক সুসমাচার ও প্রেরিত পুস্তকে ৪০০ এর বেশি চিকিৎসা বিষয়ক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা অন্যান্য সুসমাচারের তুলনায় অনেকটা নিখুঁত। উদাহরণ: খুব জ্বর (লূক ৪:৩৮), সর্বাঙ্গকুষ্ঠ-কেরী (লূক ৫:১২) যা কুষ্ঠরোগের পরবর্তী ধাপ নির্দেশ করে।
- জাস্টিন ১৬০ খ্রীঃ তিনি লূক পুস্তককে বলেন “যীশুর স্মৃতিকথা”, তিনি উল্লেখ করেন যে লূক পৌলের সঙ্গী ছিলেন।
- মিউরাটোরিয়ান ক্যানন ১৭০-১৮০ খ্রীঃ লূককে নির্দেশ করে বলেন, তিনি একজন ডাক্তার এবং পৌলের সঙ্গী ছিলেন
- ইরেন্যায়াস ১৭৫-১৯৫ খ্রীঃ তিনি বলেন যে লূক পৌলের অনুসারী ছিলেন। তিনি আরো বলেন “আমরা” সম্বোধন সংযোগ ও সম্পর্ক নির্দেশ করে।
- তের্তুলিয়ান ৩য় শতকের গোঁড়ার দিকে তিনি লূক সুসমাচারকে “পৌলের সুসমাচার” বলে উল্লেখ করেন।
- ইউসেবিয়াস ৪র্থ শতাকের গোঁড়ার দিকে আন্তিয়খিয়ার লূক, তিনি পৌলের সঙ্গী এবং লূক ও প্রেরিত পুস্তকে রচয়িতা।
- ওরিগেন ১৮৪-২৫৪ খ্রীঃ তার লেখায় তিনি লূক পুস্তকের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন এবং লূককে সেই উদ্ধৃতির লেখক হিসাবে উল্লেখ করেন।
- আলক্সান্দীয়ার ক্লীমেন্ট ১৫০-২১৫ খ্রীঃ তার লেখায় তিনি লূক পুস্তকের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন এবং লূককে সেই উদ্ধৃতির লেখক হিসাবে উল্লেখ করেন।
এ থেকে আমরা উপযুক্তভাবে উপসংহারে আসতে পারি যে পৌলের দীর্ঘদিনের সঙ্গী প্রচারক গ্রীক ডাক্তার লূকই হচ্ছেন লূক সুসমাচার ও প্রেরিত পুস্তক দুইটির লেখক।
যার উদ্দেশ্যে লেখা হয় (প্রাপক)
লূক “মাননীয় থিয়ফিল” এর উদ্দেশ্যে লেখেন, “মাননীয়” একটি উপাধি যা শুধু উঁচু শ্রেণির রোমীয় শাসকদের (প্রেরিত ২৩:২৬, ২৪:৩, ২৬:২৫) উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হত। যেমন ফীষ্ট এবং ফীলিক্স, এরা উভয়েই যিহুদিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন (পূর্ববর্তী শাসনকর্তা ছিলেন পীলাত)। এই তথ্য জোরালোভাবে সমর্থন করে যে থিয়ফিলও একজন উঁচু শ্রেণির রোমীয় কর্মকর্তা ছিলেন।
“থিয়ফিল” এই নামের অর্থ- “ঈশ্বরকে যে ভালবাসে”, এ থেকে কিছু লোক ধারণা করেন যে থিয়ফিল আসলে কোন মানুষ নন বরং সাধারণ মণ্ডলী বুঝানোর জন্য একটি গুপ্ত সংকেত। আর লূক এই মণ্ডলীর জন্যই লিখেছিলেন। লূক অবশ্যই তাঁর বিস্তারিত গবেষণার একটি আলাদা অনুলিপি রেখে মণ্ডলীর জন্য তা সহজলভ্য করতেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে থিয়ফিল একজন আসল মানুষ ছিলেন না। লূকের গবেষণার প্রকৃতি, প্রচার এবং সমর্থনধর্মী বিষয়সমূহ অন্য কিছুর দিকে ইংগিত করে।
রোমীয়দের ধারণা ছিল যে যিহুদীরা ধর্মান্ধ এবং তারাই রোমীয় সাম্রাজ্যে অশান্তির মূল কারণ। ওরা মনে করত ওদের প্রিয় বিষয় “রোমীয় শান্তি (Pax Romana)” যিহুদীদের কারণেই হুমকির সম্মুখে পড়েছে। যে সমস্ত জাতি রোমীয়দের অধীনে ছিল, তারা ওদের তুলনায় নিজেদের বেশি উন্নত, সভ্য, বেশি ন্যায্য এবং শ্রেষ্ঠ মনে করত। রোমীয়রা মনে করছিল যে সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে ওরা লোকদের আরও উন্নত করছে, ওদেরকে সভ্য করে তুলছে। ন্যায় বিচার দিয়ে ও রোমীয় শান্তি এনে ভাল সমাজ গড়ছে ও সবার উপকার করছে।
যারা এই রোমীয় সাম্রাজ্যের অংশী হতে চাইত না, যারা অস্থিরতা ও অশান্তির সৃষ্টি করত, ক্রমাগত বিদ্রোহ করত, ধর্মান্ধ ও প্রকৃতিবাদী ছিল তাদেরকে রোমীয়রা ঘৃণার চোখে দেখত। অবশ্যই যিহুদীরাও এই ঘৃণিত দলের মধ্যে পড়ত। মশীহের বিরুদ্ধে তাদের যে আন্দোলন, তা রোমীয়দের রাগিয়ে তুলেছিল।
যিহুদীয়ার চারপাশে শান্তি রক্ষার জন্য পুরো রোমীয় সাম্রাজ্যের প্রায় অর্ধেক সৈন্য মোতায়েন করে রাখতে হত। যিহুদীয়া এবং সিরিয়াকে রোমীয়রা তাদের সাম্রাজ্যের জন্য একটি বিষফোঁড়া হিসেবে বিবেচনা করত, একে তারা রোমের অধীনে কোন প্রদেশ বলে বিবেচনা করত না। এই সমস্ত পূর্বধারণা থিয়ফিলকে সুসমাচার শোনা থেকে জোরালোভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। সুসমাচারের উপর বিশ্বাস করতে ও এর দাবীতে সাড়া দিতে মারাত্মক বাঁধা দিতে পারে। এই সমস্ত পূর্বধারণার বিপরীতে লূক সতর্কতার সাথে তার লেখা লিখেছিলেন। লূকের এই লেখার মাধ্যমে থিয়ফিলকে নিশ্চিত করাতে হত যে,
- যীশু কোন সাধারণ স্থানীয় যিহুদী ব্যক্তিত্ব নন, তিনি পৃথিবীর মুক্তিদাতা এবং তিনি রোমীয়দের জন্যও এসেছেন।
- তিনি অন্যান্য যিহুদীদের মত ধর্মান্ধ নন, বরং ওরাই তাঁর বিরোধিতা করে এবং শেষ পর্যন্ত সেই যিহুদী ধর্মান্ধরাই যীশুকে ক্রুশে দিয়ে মেরে ফেলে।
- যীশুই আসল মুক্তিদাতা, তিনি কোন বিদ্রোহী তৈরি করেন নি এবং তিনি কোন সামরিক নেতাও নন। তিনি কখনোই হিংস্রতার পক্ষে যান নি, তিনি কখনোই শিক্ষা দেননি যে রোমীয়দের উপস্থিতিই আসলে সমস্যা, তিনি সরকারের প্রতি বাধ্য ছিলেন, এমনকি যখন তাকে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করা হয় তখনও তিনি বাধ্য ছিলেন।
- যীশুর মাঝে কোন যিহুদী অহংকার ছিল না, তিনি অযিহুদীদের কাছেও গিয়েছিলেন। বিদেশী, সমাজচ্যুত মানুষ, পাপী, গরীব, অসুস্থ, মহিলা এবং শিশু সব ধরণের মানুষের কাছেই তিনি গিয়েছিলেন। তিনি যিহুদী অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করেন। রোমীওদের বিরোধিতা করাই একমাত্র সমাধান, যিহুদীদের এই মনোভাবের বিরুদ্ধে যীশু কথা বলেন এবং দেখিয়ে দেন যে আসলে মানুষের পাপপূর্ণ অন্তরের সাথেই মোকাবেলা করা প্রয়োজন।
- যীশু কখনোই নিজ সংস্কৃতির ভুল এবং দুর্বলতা দেখে অন্ধের মত থাকেননি। তিনি ধৈর্যশীল, স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, মিশুক এবং নৈতিকভাবে উন্নত ছিলেন।
তাই লূক বিস্তারিতভাবে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সুশৃঙ্খলভাবে একটি সুসমাচার এবং মণ্ডলীর একটি ইতিহাস লেখেন যা দ্বারা যথাযথভাবে আপীল করা যায়। লূক প্রমাণ করতে চান যে, তিনি যে ঘটনাগুলোর বিবরণ দিয়েছেন সেগুলো বাস্তব এবং ঐতিহাসিক, যাচাইযোগ্য এবং সত্য। রোমীয় নেতাদের মধ্যে যাদের সাথে যীশুর অন্তত একবার সাক্ষাত হয়েছে (যেমন পন্তীয় পীলাত) এবং আরো বেশি যাদের সঙ্গে প্রেরিত পৌলের সাক্ষাত হয়েছে (যেমন শাসনকর্তা সের্গীয় পৌল, গাল্লিয়, ফিলীক্স ও ফীষ্ট) তারা অনেকেই তখনও বেঁচে ছিলেন। নিশ্চিত জানার জন্য থিয়ফিল এখনও তাদেরকে এইসব ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
এখানে আরেকটি বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন। এমনও হতে পারে যে থিয়ফিল ছিলেন রোমীয় বিচারক বা উকিল যিনি রোমে (প্রেরিত ২২-২৮) পৌলের বিচারকার্যের সংগে সম্পৃক্ত ছিলেন। বেশ কিছু কারণে এটা অসম্ভব কিছু নয়:
- থিয়ফিল যদিও মণ্ডলীর কোন সদস্য নন তবুও তাকে সমস্ত বিষয় সম্পর্কে জানানো হয়েছে (লূক ১:৪)। তাই খুব সম্ভবত পৌলের মামলার প্রমাণ হিসাবে এগুলো তার কাছে উল্লেখ করা হয়েছে। লূক এই সমস্ত বিষয়ের সত্যতা সম্পর্কে তাকে নিশ্চয়তা দিতে চান।
- প্রেরিত পুস্তকের অর্ধেকের বেশি অংশ পৌলকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে। এখানে লূক হয়তো দেখান যে পৌলের ভ্রমণসঙ্গী হিসাবে থাকার কারণে তিনি অন্য শিষ্যদের তুলনায় পৌল সম্পর্কে বেশি জানেন। মণ্ডলীর ইতিহাস থেকে জানা যায় ১২ জন প্রেরিত শিষ্য খুবই সক্রিয় ছিলেন এবং অনেক দূরবর্তী জায়গায় সুসমাচার প্রচার করেছিলেন। অথচ প্রেরিত ১২ অধ্যায়ের পরে লূক আর তাদের কথা উল্লেখ করেন নি। কিন্তু কেন এত শক্তিশালীভাবে তিনি পৌলকে কেন্দ্রে রেখেছেন? > যদি পৌলের পক্ষে মামলার প্রমাণ হিসাবে আদালতে দাখিল করার জন্য লূক এই পুস্তক লেখেন তাহলে পুস্তকের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়। প্রথমে তিনি আন্দোলনের মূল উৎস দেখান এবং পরে মূল চরিত্রে প্রাধান্য দেন।
- প্রেরিত পুস্তকের মধ্যে পৌলের গ্রেফতার এবং মামলা চলাকালীন সময়ে যিরূশালেম এবং যিহূদিয়া প্রদেশের উপর অনেক বেশি গুরুত্ব দেখা যায়। প্রেরিত ২১-২৮ অধ্যায়ের পুরো অংশই এই দিকে প্রাধান্য দেয়। এই অংশটা পড়তে অনেকটা মামলার অনুলিপির ঘটনার মতই লাগে। আবার অন্য দিকে এটা অবাক করার মত বিষয় যে পৌলের কাজের সারাংশ লূক খুব ছোট করে তুলে ধরেন (উদাহরণ: প্রেরিত ১৯:৮-১০, এখানে পৌলের প্রায় ৩ বছরের পরিচর্যা কাজ মাত্র দুই বাক্যে তুলে ধরা হয়।) কিন্তু যদি পৌলের পক্ষে মামলার প্রমাণ হিসাবে আদালতে দাখিল করার জন্য লূক এই পুস্তক লেখেন তাহলে পুস্তকের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়।
- লূক ও প্রেরিত উভয় পুস্তকের মধ্যে লূক গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন যীশু এবং পৌলের বার বার রোমীয় উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাৎকার, সামরিক নেতাদের সাক্ষাৎকার এবং রোমীয় শাসকবর্গের সাক্ষাৎকার। যীশু খ্রীষ্টের ক্ষেত্রে যারাই তাঁর মামলা পরিচালনা করেন তারা সকলেই বুঝতে পারেন যে যীশু নিরপরাধ, পৌলের ক্ষেত্রেও যারাই তার মামলা পরিচালনা করেন তারা সবাই বুঝতে পারেন যে পৌল আইনের বিরুদ্ধে কিছু করেন নি। বিচারক থিওফিলকে লূক দেখান যে কেউই পৌলকে দোষ দিতে রাজি হন নি। যদি থিয়ফিল তাই করবেন তবে তিনি গোড়ামি যীহূদীদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করেন।
- লূক সুসমাচারে ফরীশীদের আচরণ, তাদের মুখের কথা এবং কাজের ঘটনাগুলো বিশেষভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এগুলো ছিল ফরীশীদের নেতিবাচক ছবি যেমন ধর্মান্ধতা, বংশগত উঁচু মনোভাব, হিংস্র প্রবণতা, অস্থিরতা। আর রোমীয়রা ঠিক এই ধরণের লোকদেরই অবজ্ঞার চোখে দেখত এবং ঘৃণা করত। কিন্তু কেন তাদের চরিত্র এরকম বিশেষভাবে ফুটিয়ে তোলা হল? দুইটি কারণে:
- প্রথমত রোমীয় থিয়ফিলকে দেখানোর জন্য যে ঠিক এই ধরণের ফরীশীদের সাথেই যীশুর দ্বন্দ্ব লাগত। এই ফরীশীরাই বিরোধিতা করে লজ্জাজনকভাবে যীশুকে মেরে ফেলে।
- দ্বিতীয় কারণ: পৌল নিজেও এরকম ছিলেন। তিনি ছিলেন ফরীশীদের ফরীশী কিন্তু পরে যীশু তাকে আঁকড়ে ধরেন। লূক শক্তিশালীভাবে দেখান যে যীশু যখন ধর্মান্ধ, উঁচু বংশীয়, অস্থির এবং হিংস্র ফরীশীকে ধরেন তখন তার কি অবস্থা হয়। সে যীশুর শিষ্য হয়ে যায়। অনেক অত্যাচার সহ্যের মাধ্যমে এবং ত্যাগস্বীকারের মধ্য দিয়ে নিজের জীবন বাজি ধরে শুধু যিহূদীদের মধ্যে নয় কিন্তু অযিহূদীদের মধ্যেও সুসমাচার বয়ে নিয়ে যায়। একজন ফরীশী অযিহুদীদের সমর্থক ও রক্ষক হয়ে যায়, এটা যীশুর কাজ। আর এই মানুষটাই থিওফিলের সামনে এখন বিচারের অপেক্ষায়।
লূক সুসমাচারে পুনরুক্তি বিষয়গুলোর প্রেরিত পুস্তকে ধারাবাহিকতা
এইসব বুঝে অবাক লাগে না লেখক লূক তার সুসমাচারে কি কি বিষয়ে গুরুত্ব দেন:
- এমন লোকদের সাক্ষাত যারা যীশুকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করেন (লূক ২৩:৪, ২৩:১৮-১৫, ২৩:২২, ২৩:৪১, ২৩:৪৭, ২৩:৫১)।
- যীশুর পরিত্রাণ সবার জন্য: যিহূদী এবং অযিহূদীদের, পুরুষ, মহিলা ও ছেলেমেয়েদের, অসুস্থ, বিকলঙ্গ, অশুচি, সমাজের বাইরে পড়া ও পাপীদের জন্য।
- যীশুকে অগ্রাহ্য করা হয়, বিশেষভাবে ফরীশীদের দ্বারা।
- যীশুর শিক্ষা মানুষের অন্তর ও মনোভাব চ্যালেঞ্জ করে।
- যীশুর রাজ্য সত্যই এসে গেছে, কিন্তু রাজ্যের ধরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন।
- ঈশ্বরের ইচ্ছা পবিত্র আত্মা দ্বারাই পূর্ণ হয়।
- চোখের সাক্ষীদের সাক্ষাতের উল্লেখ।
- সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য (লূক ২:১-২, ৩:১-২)।
যখন প্রেরিত পুস্তকে আমরা যীশু দ্বারা স্থাপিত এই আন্দোল ছড়িয়ে পড়ার বর্ণনা পাই, এইসব বিষয়গুলো আবারও দেখতে পাই।
ঐতিহাসিক ঘটনার সুনির্দিষ্ট বর্ণনা
যেমন লূক সুসমাচারে, প্রেরিত পুস্তকেও লূক অতি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য দেন। তিনি অনেক রোমীয় শাসনকর্তা, কর্মচারী বা সামরিক নেতাদের নাম দিয়ে উল্লেখ করেন। থিয়ফীল তাদের নাম অবশ্যই জানতেন, কেউ কেউ হয়তো ব্যক্তিগতভাবেও জানতেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন এখনও বেঁচে আছেন বলে পাঠক থিয়ফিল তাদের থেকে তিনি খোঁজ নিতে পারেন। অনেকে অন্যান্য ইতিহাস বইয়েও উল্লিখিত:
রাজা আরিতা প্রেরিত ৯:২৫ ৩৪ খ্রীঃ
দামেস্কে, যিহূদীরা পৌলকে মেরে ফেলার জন্য ষড়যন্ত্র করে এবং ফটকগুলোতে পাহাড়া দিতে থাকে; কিন্তু শিষ্যরা রাতে বেলা একটা ঝুড়িতে করে দেয়ালের একটা জানলার মধ্য দিয়ে তাঁকে নীচে নামিয়ে দেয়। সাথে সাথে ২ করি ১১:৩২ “দামেস্কে রাজা আরিতার নিযুক্ত শাসনকর্তা আমাকে ধরবার জন্য দামেস্কীয়দের শহর পাহারা দেবার আদেশ দিয়েছিলেন” পাওয়া যায় দামেস্কের রাজাও সেই সময় পৌলকে ধরতে চেয়েছিল।
বাইবেলের বাইরের ঐতিহাসিক লেখা থেকে তথ্য পাওয়া যায় যে আরিতা (Aretas, ৯ খ্রীঃপূঃ – ৪০ খ্রীঃ) ছিলেন “নাবাতীয়া” (Nabatea) এলাকার রাজা। নাবাতীয়া প্রথম রোম রাজ্যের অধীনে আসে, পরে রোমীয় রাজ্যের একটি প্রদেশ হয়ে যায়। তার মেয়ে হেরোদ আগ্রিপ্পকে বিয়ে করেন। পরে যখন হেরোদ তার ভায়ের স্ত্রী হেরোদিয়াকে বিয়ে করতে চান, তিনি আরিতার মেয়েকে তালাক দেন। যোহন বাপ্তিস্মদাতা এর প্রতিবাদ করেছিলেন বলে, তাকে জেলে দেওয়া হয় এবং পরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় (মার্ক ৬:১৭)। রাজা আরিতা তার মেয়েকে অপমাণিত হয়েছে বলে ৩৬ খ্রীষ্টাব্দে হেরোদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক ছিল নাবাতীয়দের একটি উপনিবেশ। রাজা আরিতা দামেস্কে তার অধীনে একজন শাসক রাখতেন; তার নাম পাওয়া যায় না। হতে পারে সম্রাট কালিগুলা (৩৭-৪১ খ্রীঃ) আরিতাকে দামেস্ক উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন। দামেস্কের শাসক এবং স্থানীয় যিহূদীরা পৌলকে মেরে ফেলার একটি ষড়যন্ত্র করেন হতে পারে কারণ পৌল বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করেছিলেন। তার উল্লেখ গালাতীয় ১:১৭ পদে পাওয়া যায়, যেখানে বলা আছে যে পৌল “আরব দেশে” গিয়েছিলেন যা “নাবাতীয়া”ও বলা হত।
যিরুশালেমে (ও সারা রোম রাজ্যে) দুর্ভিক্ষ প্রেরিত ১১:২৮ ৪৬ খ্রীঃ
আগাব নামে মণ্ডলীর একজন নবী ভাববাদী এই দুর্ভিক্ষের ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিলেন, তা লূক প্রেরিত ১১:২৮ পদে উল্লেখ করেন। দুর্ভিক্ষটি সম্রাট ক্লৌদিয়ের রাজত্বের সময় (৪১-৫৪ খ্রীঃ) আসলে ঘটেছিল। আন্তিয়খিয়া মণ্ডলী দুর্ভিক্ষের কারণে যিরূশালেম মণ্ডলীর কাছে বার্ণবা ও পৌলের হাত দ্বারা এটি দান পাঠান।
যিহূদী ইতিহাসবিদ যোসিফাস এই দুর্ভিক্ষ উল্লেখ করে বলেন যে যিহূদী হেলেনা (Helena), আদিয়াবিনির রাণীমা (Adiabene), মিসর থেকে ভূট্টা ও সিরিয়া থেকে ডুমুর এনে যিরূশালেমে বিতরণ করেছিলেন। যোসিফাস বলেন যে দুর্ভিক্ষটি রোমীয় শাসনকর্তা ক্রিসপুস ফাদুস (Crispus Fadus, ৪৪-৪৬ খ্রীঃ) এবং তিবিরিয় জুলিয়াস আলেকজান্ডারের (Tiberius Julius Alexander, ৪৬-৪৮ খ্রীঃ) রাজত্বের সময় ঘটেছিল, তাই ৪৬ খ্রীষ্টাব্দে।
হেরোদ আগ্রিপ্পের ১ মৃত্যু প্রেরিত ১২:২৩ ৪৪ খ্রীঃ
লূকের মত যিহূদী ইতিহাসবিদ যোসিফাস হেরোদ আগ্রিপ্পের মৃত্যু উল্লেখ করেন। যোসিফাস অনুসারে হেরোদ রোমীয় সম্রাটকে সম্মান দেখানোর জন্য বিভিন্ন উচুপদের কর্মচারীদের নিমন্ত্রণ দেন এবং বড় একটি অনুষ্ঠান চালান। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন তিনি রূপার জামা পরেন এবং সূর্য উঠার সময় লোকদের সামনে আসেন। রোদের কারণে তার জামা খুব উজ্জ্বল দেখায়। তখন লোকেরা তা দেখে তাকে দেবতা বলে তোষামদ করতে থাকে, কিন্তু হেরোদ তোষামদের বিরুদ্ধ তাদের কিছুই বলে না। তখন তিনি মারা যান। তিনি বলেন, হোরদ পাঁচ দিন ধরে প্রচণ্ড পেটের ব্যাথা শেষে মারা যান। হয়তো এপেডিসাইটিসের কারণে মৃত্যু ঘটে।
যিহুদীদের রোম থেকে তাড়ানো প্রেরিত ১৮:২ ৪৯ খ্রীঃ
লূক উল্লেখ করেন যে সম্রাট তিবিরিয় যিহূদীদের রোম থেকে তাড়ান (প্রেরিত ১৮:২)। এটা ৪৯ খ্রীষ্টাব্দে ঘটে। এই ঘটনা রোমীয় ইতিহাসবিদ সুতনিয়ও (Suetonius) উল্লেখ করেন। “ক্লৌদিয়ের জীবন” (Life of Claudius) নামক তার একটি বইয়ে তিনি বলৈন: “যেহেতু যিহুদীরা ক্রেস্টাস (Chrestus) নামে একজনের কারণে বার বার আন্দোলন করেছে, তাই সম্রাট তিবিরিয় তাদের বের করে দেন”। সে উল্লিখিত ক্রেস্টাস অবশ্যই খ্রীষ্টকে বুঝায়। প্রেরিত পুস্তক থেকে আমরা জানে যে যিহূদীরা বার বার খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়েছিল। পরে ৫৪ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট নীরো এই আদেশ বাতিল করেন এবং অনেক যিহুদীরা আবার ইটালীতে ফিরে আসে।
আখায়া প্রদেশের শাসনকর্তা গাল্লিয় প্রেরিত ১৮:১২ ৫১-৫২ খ্রীঃ
লূক গাল্লিয় নামে একজন করিন্থ প্রদেশের রোমীয় শাসনকর্তা উল্লেখ করেন যিনি পৌলকে বিচার করতে অস্বীকার করেন (প্রেরিত ১৮:১২)। রোমীয় ইতিহাস থেকে আমরা জানে যে গাল্লিয় ছেলেন বৃদ্ধ সেনেকার (৫০ খ্রীঃপূঃ-৪০খ্রীঃ) ছেলে এবং বিখ্যাত অনুজ সেনেকার ভাই। এই সেনেকা ছিলেনদার্শনিক ও নীরোর (৩ খ্রীঃপূঃ-৬৫খ্রীঃ) উপদেষ্টা। গাল্লিয় ৫১ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে আখায়া প্রদেশের শাসক হন। তিনি অসুস্থতার কারণে পদটি ছেড়ে দেন এবং ৫২ খ্রীঃ সমুদ্রভ্রমণে চলে যান। ছবিটি হল করিন্থীয় একটি খোদায় করে লেখা যাতে গাল্লিয় উল্লিখিত।
যিহূদিয়ার শাসনকর্তা ফীলিক্স ও ফীষ্ট প্রেরিত ২৫:১ ৫৯ খ্রীঃ
কৈসরিয়ায় পৌলের মামলা বর্ণনা করার সময় লূক উভয় যিহূদিয়ার শাসনকর্তা ফীলিক্স এবং ফীষ্টকে উল্লেখ করেন (প্রেরিত ২৪:২৭)। রোমীয় ইতিহাস বলে যে সেই সময়ে যিহুদী-অযিহুদীদের শত্রুটা বাড়তে থাকে এবং কৈসরিয়াতে তাদের মধ্যে মারামারি চলতে থাকে। ফীলিক্সের হস্তক্ষেপের ফলে যিহুদী নেতৃত্বে অনেক রক্তক্ষয় হয় বলে রোমীয় সম্রাট ৫৯ খ্রী তাকে শাসনকর্তার পদ থেকে বাদ দেন।
রোমীয় সরকারী অফিসাররা পৌলকে এবং সুসমাচারের আন্দোলনকে বিচার করতে অস্বীকার করেন
প্রেরিত পুস্তকে লূক বার বার উল্লেখ করেন যে বেশ কয়েকজন উঁচু পদের রোমীয় সরকারী অফিসার পৌলকে এবং সুসমাচারের আন্দোলনকে বিচার করতে অস্বীকার করেন:
- প্রেরিত ১৩:৭-১২ শাসনকর্তা সের্গিয়-পৌল সাইপ্রাস বিশ্বাস করেন
- প্রেরিত ১৮:১২-১৭ শাসনকর্তা গাল্লিয় করিন্থ পৌলকে বিচার করতে অস্বীকার
- প্রেরিত ১৯:২১-৪১ শহরের কর্তা ইফিষ আন্দোলনকে থামিয়ে দেন
- প্রেরিত ২১:২৭-৩৬ রোমীয় সৈন্যদলের প্রধান সেনাপতি যিরূশালেমন পৌলকে যিহূদীদের থেকে রক্ষা করেন
- প্রেরিত ২২:২২-২৯ রোমীয় প্রধান সেনাপতি ক্লৌদিয় লুসিয় যিরূশালেম পৌলকে চাবুক দেন, পৌল তাকে চ্যালেঞ্জ করেন
- প্রেরিত ২৩:১২-১৫ রোমীয় সৈন্য যিরূশালেম > কৈসরিয়ায় পৌলকে যিহূদীদের থেকে রক্ষা করেন
- প্রেরিত ২৩:২৬-৩০ রোমীয় প্রধান সেনাপতি লুসিয় যিরূশালেম > কৈসরিয়ায় চিঠি পাঠান পৌলকে অপরাধী মনে করেন না
- প্রেরিত ২৪:২২-২৬ রোমীয় শাসনকর্তা ফীলিক্স কৈসরিয়া পৌলকে বিচার করেন না
- প্রেরিত ২৫:১-১২ রোমীয় শাসনকর্তা ফীষ্ট কৈসরিয়া পৌলের দোষ পান না
- প্রেরিত ২৫:৩২ হেরোদ আগ্রিপ্প-২, ফীষ্ট কৈসরিয়া পৌলকে ছেড়ে দেওয়া যেত
- প্রেরিত ২৭:১ রোমীয় সৈন্যদলের শতপতি যুলিয় কৈসরিয়া > রোমে যাত্রা পৌলকে ভাল ব্যবহার দেখান
- প্রেরিত ১৩:৭-১২ রোমীয় সৈন্যদলের শতপতি যুলিয় কৈসরিয়া > রোমে যাত্রা পৌলকে বাঁচাতে চেষ্টা করেন
লূক পাঠক থিয়ফিলকে পরিষ্কারভাবে দেখান যে যতবার পৌল একজন রোমীয় সরকারি অফিসারের সামনে দাঁড়ালেন ততবার তারা তার কোনো অপরাধ বা দোষ খুঁজে পান না এবং তাকে বিচার করতে প্রত্যাখান করেন। যদি থিয়ফিল রোমীয় কর্মচারী বা এমন কি বিচারক হিসাবে পৌলকে বিচার করেন, তবে তিনি ঠিক সেই হিংস্র ও গোড়া যিহূদীদের পক্ষে দাঁড়ান যাদের রোমীয়রা পছন্দ করে না। যেমন লূক তার সুসমাচারে যীশুর ক্ষেত্রে দেখিয়েছিলেন তিনি ঠিক তেমনি প্রেরিত পুস্তকে পৌলের ক্ষেত্রে দেখান যে তিনি নির্দোষ। যদিও যিহূদীরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাতে থাকেন, পৌল নিজে কোনো আন্দোলনকারী নয়, তিনি আইন ভাঙ্গেন না, আক্রমনার্তক কোন ব্যবহার করেন না।
পবিত্র আত্মার আগমন
যীশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পরে তিনি আর ৪০ দিন ধরে নিজেকে বিভিন্ন সময়ে শিষ্যদের কাছে প্রকাশিত করেছিলেন এবং তাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন (প্রেরিত ১:৩, ১ করি ১৫:৫-৯)। চল্লিশ নম্বর দিনে তিনি স্বর্গে চলে যান শিষ্যদের দিয়ে যেন তারা একসাথে থাকে এবং পবিত্র আত্মার আগমনের জন্য অপেক্ষা করেন (প্রেরিত ১:৭)। দশ দিন পরে, পুনরুত্থান থেকে পঞ্চাসতম দিনে, পঞ্চমসপ্তমি নামে যিহূদীদের একটি পর্বে, যখন যিরূশালেম শহর আবার যিহূদীদের দ্বারা ভরা, ঠিক সে দিনে পবিত্র আত্মা শক্তিতে শিষ্যদের উপর নেমে আসেন (প্রেরিত ২:১-৪)। এই ঘটনাটির অদ্বিতীয় গুরুত্ব আছে: পবিত্র আত্মা শিষ্যদের সাহস ও শক্তি যোগান করেন এবং তাদের ভিত, সন্দেহ ও সংকোচগ্রস্ত লোক থেকে যীশুর এমন অনুস্মরনকারীতে পরিণত করেন, যাদের মধ্যে সাহস, একটি অধিকার এবং পুনরুত্থিত খ্রীষ্টকে ঘোষণা করার একটি সমর্পণ আছে। তাদের এই শক্তিশালী পরিবর্তন এবং ফলের মণ্ডলীর বিস্ফরনের মত বৃদ্ধি কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? শুধুমাত্র একটি উত্তর সম্ভব: যীশু বাস্তবভাবে মৃতদের থেকে পুনরুত্থিত হয়েছেন এবং পবিত্র আত্মার আসলে শিষ্যদের উপরে আসলেন।
পবিত্র আত্মার আগমনের বর্ণনায় লূক তা “জোর বাতাস” এবং “আগুনের জিভের” সাথে তুলনা করেন। উভয় বর্ণনা গুরুত্বপূর্ণ কারণ পুরাতন নিয়মে শক্তিশালী বাতাস (যিহি ১:৪) এবং আগুন (যাত্রা ১৩:২২, ৪০:৩৮, লেবীয় ১০:২, গণনা ১৬:৩৫) ঈশ্বরের ভয়াবহ ও পবিত্র উপস্থিতি বুঝাত। ঈশ্বর দেখান যে এখন তার উপস্থিতি আর যিরূশালেমের উপাসনা ঘরে নয় বরং এই নতুন স্থাপিত মণ্ডলীতে আছে, যারা এভাবে ঈশ্বরের “নতুন উপাসনা ঘর” হয়ে যায়।
তা ছাড়া শিষ্যদের উপরে পবিত্র আত্মার আগমন আর একটি বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে: বাবিলে ভাষার কারণে বিভেদ (আদি ১১:৯): শিষ্যরা নানা ভাষায় কথা বলার কারণে রোম রাজ্যের নানা এলাকা থেকে আসা যিহূদীদের কাছে যীশুর সুসমাচার পৌঁছানো হয়। প্রথম দিন থেকে মণ্ডলী হল একটি আন্তরজাতিক মিশনারি আন্দোলন যাতে নানা ভাষা ও সংস্কৃতি এক হয়ে যায়।
পবিত্র আত্মা দ্বারা বিভোদ ও সামাজিক পার্থক্যগুলো বাতিল করা হয়, তা ভাবাবাদী যোয়েল থেকে পিতরের উদ্ধৃতিও স্বীকার করে (যোয়েল ২:২৮-৩২): এখন বৃদ্ধরা ও যুবক, দাস ও স্বাধীন, পুরুষ ও মহিলা ঈশ্বরের শক্তি উপলব্দি করতে পারে এবং তার শক্তিতে পরিচর্যাও করতে পারে। পবিত্র আত্মার আগমন এবং শিষ্যদের প্রচারের ফলে এক মুহূর্তে নতুন মণ্ডলী জন্ম নেয়: তিন হাজার লোক পরিত্রাণ পায়।
প্রথম মণ্ডলীর সাক্ষ্য দান
পবিত্র আত্মার আগমন থেকে শিষ্যরা সাথে সাথে সাক্ষীতে পরিণত হয়, যেমন যীশু বলেছিলেন। তারা যীশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের সাক্ষী হিসাবে ঘোষণা করেন যে যীশু মসীহ ও প্রভু এবং তারা সাথে আশ্চর্য কাজও করতে শুরু করেন।
যিহূদী নেতারা, যারা মনে করেছিলেন যে নেতা যীশুকে মেরে ফেলা দ্বারা তারা এই নতুন আন্দোলন ভাঙ্গতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাদের আরো শক্তিশালী কিছুর স্মুখীন হতে হয়: নতুন মণ্ডলী। তারা সাথে সাথে হুমকি, গ্রেফতার এবং ও অত্যাচার করা দ্বারা মণ্ডলীকে পরাজিত করতে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। বিশ্বাসীরা জীবন দিতে রাজি আছে কিন্তু তারা চুপ করবে না।
শুরু থেকে এবং প্রেরিত পুস্তকের ইতিহাস যত আগায় এই দুইটি বিষয় সমান্তরালভাবে দেখা যাবে: ঈশ্বরের বাক্য ছড়িয়ে পড়বে (প্রেরিত ৬:৭, ৯:৩১, ১৯:২০ ইত্যাদি) এবং সাথে সাথে বিশ্বাসীদের অত্যাচার করা হবে (প্রেরিত ৫:১৭-১৮, ৭:৫৮, ৮:২, ১২:১-২ ইত্যাদি)। যত অত্যাচার আসুক না কেন, তা ঈশ্বরের বাক্যকে থামাতে পারে না, বরং বিপরীত, তনেক বার অত্যাচার আরো ছড়িয়ে পড়ার কারণ হয়ে যায় (প্রেরিত ৮:১)। অত্যাচারিত যখন হয় মণ্ডলী হয় ঈশ্বরের আশ্চর্য উদ্ধারের হাত দেখতে পায় (প্রেরিত ৫:১৯, ১২:৬-১১, ১৬:২৬), না হয় শহীদ মৃত্যু গ্রহণ করে (প্রেরিত ৭:৫৮, ১২:১)। কেন ঈশ্বর এক সময় রক্ষা করেন এবং আর এক সময়ে রক্ষা করেন না, তার জন্য কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। মণ্ডলী উভয় বাস্তবতাই উপলব্দি করে, আশ্চর্যভাবে উদ্ধার এবং শহীদ মৃত্যু, এবং আজ পর্যন্ত তাই দেখা যায়।
প্রথম মণ্ডলী বৃদ্ধি পায় এবং একটি নতুন সমাজ হয়ে যায়। বিশ্বাসীরা “সবাই মনেপ্রাপণে এক ছিল” এবং তারা “কোন কিছুই নিজের বলে দাবি করত না বরং সব কিছুই যার যার দরকার মত ব্যবহার করত” (প্রেরিত ৪:৩২)। তারা “প্রেরিতদের শিক্ষা শুনত … এবং সব সময় ঈশ্বরের প্রশংসা করত এবং সব লোক তাদের সম্মান করত” (প্রেরিত ২:৮২-৪৭)। যখন হুমকির সম্মুখীন হয় তারা সাহস ও প্রয়োজনীয় শক্তির জন্য প্রার্থনা করে (প্রেরিত ৪:২৯) এবং তারা চারিদিকে লোকদের কাছে সেবা ও সুসমাচার দিতে থাকে। সমস্যা দেখা দিলে তারা সেগুলো সমাধান করে (প্রেরিত ৬:১-৬)। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা সবাইকে অংশ গ্রহণ করতে দেয় (প্রেরিত ৬:২, ১৫:৪, ১৫:৬)।
প্রথম অযিহূদীরা বিশ্বাসী হয়ে যায়
প্রথমদিকে শিষ্যরা শুধুমাত্র যিরূশালেমে প্রচার করেন, পরবর্তীতে তারা যিহূদিয়ায়, শমরিয়ায় এবং আরো দূরের এলাকায় সুসমাচার প্রচার করতে শুরু করে, কিন্তু এখনও তারা সেখানকার যিহূদীদেরই কাছে সুসমাচার পৌঁছায়।
শুধুমাত্র যখন ঈশ্বর পিতরকে একটি শক্তিশালী দর্শন দেন তখন তিনি বুঝতে পারেন যে যীশুর সুসমাচার শুধুমাত্র যিহূদীদের জন্যই নয় বরং অযিহূদীদেরই জন্যও (প্রেরিত ১০)। সে সময় থেকে বিশ্বাসীরা অযিহূদীদের কাছেও প্রচার করতে শুরু করে এবং তাদের মধ্য থেকেও অনেকে যীশুকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করে (প্রেরিত ১১-১২)।
পরে পবিত্র আত্মা বার্ণবা ও পৌলকে আরো দূরের এলাকায় সুসমাচার প্রচার করতে আহ্বান করেন (প্রেরিত ১৩:১-৩)। এভাবে পৌলের – এবং পরে অন্যান্য প্রেরিতদের – প্রচার যাত্রা শুরু হয় যার ফলে রোম রাজ্যের নানা জায়গায় মণ্ডলী ছড়িয়ে পড়তে থাকে (প্রেরিত ১৩-২১)।
এই প্রচার যাত্রাগুলো দ্বারা অনেক যিহূদী-অযিহূদী মিশানো মণ্ডলী স্থাপিত হয় যার ফলে একটি প্রশ্ন উঠে আসে: যদি একজন অযিহূদী খ্রীষ্টে বিশ্বাসী হয়ে যায় তবে যিহূদীরা পুরাতন নিয়মের যে নিয়ম পালন করে আসছেন (যেমন সুন্নত, খাবারের নিয়ম ইত্যাদি), তাদেরকে কি সেগুলোও পালন করতে হবে? বিশ্বাসীরা দ্বিমত: কেউ কেউ বলে “হ্যাঁ”, কেউ কেউ বলে “না”। এই গুরুত্ব তর্কের প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য মণ্ডলীর প্রেরিত ও প্রাচীনরা যিরূশালেমে একটি সভা ডাকে (প্রেরিত ১৫)। তারা তার্ক করে, কিছু বাস্তব ঘটনা বিবেচনা করে (অযিহূদীদের উপরে পবিত্র আত্মার আগমন নিয়ম-কানুন পালন করার আগে) এবং পুরাতন নিয়ম থেকে প্রজ্ঞা খুঁজে। শেষে তারা একমত হয় যে অযিহূদীদেরকে যিহূদী আইন পালন করতে হবে না, শুধুমাত্র সাসংস্কৃতিক কারণে তাদের কিছু বিষয়ে যিহূদীদের বিবেচনা করতে অনুরোধ করা হয় (প্রেরিত ১৫:২০-২১)। সভার সিদ্ধান্ত লিখিত রাখা হয় এবং মণ্ডলীতে মণ্ডলীতে গিয়ে জানানো হয় যার ফল আনন্দ ও একতা। এই গল্প দ্বারা বুঝা যায় কিভাবে মণ্ডলী একটি সম্পূর্ণ যিহূদী সমাজ থেকে অল্প কিছু বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক ও অন্তরভুক্ত রাখার একটি আন্দোলনে পরিণত হয়। এইটি হল একটি অদ্ভূত ঐতিহাসিক ঘটনা, যা শুধুমাত্র যীশুর পুনরুত্থানের বাস্তবতা এবং পবিত্র আত্মার পরিচালনা দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। তা ছাড়া পাঠক থিয়ফিল – এবং আমরা আজকে – এই আন্দোলনের জন্য কি কারণ দেখাব?
প্রেরিতদের পরিচর্যা
লূক যখন যীশুর আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনা করেন তখন তিনি শুরু থেকে যারা ছিলেন সে বারোজন প্রেরিতদের গল্প দেন (যেমন পিতর, যোহন, যাকোব), কিন্তু বেশ তাড়াতাড়ি তিনি অন্য প্রেরিতদেরও গল্প বলেন (যেমন স্তিফান, বার্ণবা ইত্যাদি)। যদিও প্রথম থেকে চোখের সাক্ষীদের উপরে গুরুত্ব দেওয়া হয় তবুও শিঘ্রই ঈশ্বরের আত্মা আরো লোকদের আহ্বান করেন, তাদের পরিবর্তিত করেন এবং তাদের অধিকার দেন। তা থেকে বুঝা যায় যে যীশুর আন্দোলন বিকেন্দ্রিক এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে উঁচু-নীচু কঠোর কোন কাঠামো নেই। লূক বিশেষভাবে পৌলের গল্পে বেশি গুরুত্ব দেন, যিনি পরে আহত্য একজন প্রেরিত।
লূক পৌলের আগের জীবন, তার মন পরিবর্তন, তার পরিচর্যা এবং সাইপ্রাস, গালাতীয়া, ম্যাসিডোনিয়া, আখায়া ও এশিয়ায় তার তিনটি প্রচার যাত্রার বর্ণনা করেন। পৌলের মধ্য দিয়ে খ্রিষ্টান ধর্ম মানচিত্রের উপর বিস্ফোরণের মত ছড়িয়ে পড়ে। পরে পৌল অনেক সময় বিভিন্ন বন্ধনে কাটান। যদিও তাকে এক জায়গায় আটকানো হয় তবুও তিনি প্রচার, শিক্ষা দান, শিষ্যত্ব দান, কর্মী গঠন ও চিঠি লেখার কাজ চালিয়ে নিয়ে যান।
রোমীয় ন্যায় বিচার
প্রেরিত পুস্তকে লূক সরকারি কর্মকর্তা থিয়ফিলকে দেখান রোমীয় সরকার জায়গায় জায়গায় কেমন কাজ করে। তিনি থিয়ফিলের জন্য বাস্তব একটি ছবি দেখান রোমীয় সরকার যখন ন্যায় কাজ করে – এবং যখন করে না। ইতিবাচকদিকে রোমীয় সরকার পৌলকে নানা বার রাগান্বিত যিহূদীদের হাতে থেকে রক্ষা করে, আদালতে তাকে বিচার করতে চায় না বরং তার যে দোষ নেই, তা স্বীকার করে। নেতিবাচকদিকে লূক দেখান যে রোম সরকার কিছু দুর্নীতি গ্রস্ত ও হিংস্র স্থানীয় রাজাদের সমর্থন করে (যেমন হেরোদ রাজবংশ) এবং দুর্বল ও নীতিহীন শাসনকর্তাও রাজত্য করতে দেন (পন্তীয় পিলাত, ফীলিক্স)। রোমীয় সরকারের কর্মকর্তা হিসাবে অথবা এমন কি বিচারক হিসাবেএই বর্ণনাগুলো দ্বারা থিয়ফিলের গর্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয় কারণ রোমীয়রা তাদের ন্যায় বিচার ও সরকারের শৃঙ্খলা নিয়ে গর্ব করত।
সাথে আর একটি চিন্তার বিষয় আছে: যদি থিয়ফিল একজন ভাল রোমীয় সরকারি কর্মকর্তা যিনি রোমীয় ন্যায় বিচারে গুরুত্ব দেন তবে তার কেমন লাগে যখন তিনি বর্তমান সম্রাটের দিকে তাকায়, নীরো, যিনি এই সময় ৬ বছর রাজত্য করেন (৫৪-৬৮ খ্রীঃ)। ইতিমধ্যে নীরোর বিলাসিতা, অবহেলা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও আইনকে তুচ্চ করার মনোভাব নিজেকে যথেষ্ট প্রকাশিত করছে, এবং তা যে কোন ভাল সরকারি কর্মকর্তার জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়। যখন থিয়ফিল লূক দ্বারা লিখিত যীশু ও পৌলের বর্ণনা পড়েন তখন বাধ্য হয়ে তার স্বীকার করতে হবে যে যা রোম রাজ্যের এখন আসলে দরকার ছিল হল ঠিক যীশু ও পৌলের ধরণের স্বার্থহীন ও আত্ম-ত্যাগের নেতৃত্ব – কিন্তু তা তো নেই। হয়তো খ্রিষ্টান ধর্মের কিছু দেওয়ার আছে, এমন কি রোম রাজ্যের কাছে কিছু দেওয়ার আছে?
ঈশ্বরের বাক্যকে থামানো সম্ভব না
প্রেরিত পুস্তকের মধ্য দিয়ে লূক থিয়ফিলকে দেখান যে ঈশ্বরের বাক্য এবং যীশুর সুসমাচার থামানো অত্যন্ত অসম্ভব। যত বার কেউ সাক্ষীদের মুখ বন্ধ করতে চান অথবা অত্যাচার দ্বারা মণ্ডলীকে আক্রমণ করে তত বার তারা নিঃস্ফল হয় এবং বরং বাক্যকে আরো ছড়িয়ে পড়তে দেয়। যত বিশে মণ্ডলীকে অত্যাচার করা হয়, তারা শান্ত ব্যবহারে সমর্পিত। যীশু দ্বারা যে ঢেউ শুরু হয়েছে সে ঢেউ রোম পর্যন্তও পৌঁছিয়েছে, এমন কি থিয়ফিল পর্যন্ত। তিনি ব্যক্তি হিসাবে কি সাড়া দেবেন? পৌলের বিচারক যদি হন তবে তিনি কাভাবে সাড়া দেবেন?
পুস্তকের প্রয়োগ
প্রেরিত পুস্তক আমাদের একটি শক্তিশালি সাক্ষ্য দেন যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মানুষদের উদ্ধার ও পরিবর্তিত করতে সমর্পিত। তিনি তার মণ্ডলীকে স্থাপন করেছেন, বৃদ্ধি দিয়েছেন এবং গঠন করতে থাকেন যত অত্যাচার আসুক না কেন বা যত বেশি পৃথিবীর মানচিত্র পরিবর্তিত হোক না কেন। ঈশ্বরের বাক্য এগিয়ে যাবেই, তার নিশ্চয়তা আমাদের দেওয়া আছে। কিন্তু আমাদের সাড়াও দিতে হবে, আমাদের বিশ্বাস খ্রীষ্টের উপর রেখে এবং পবিত্র আত্মা দিয়ে ভিতর থেকে পরিবর্তিত হয়ে। আমাদের ঈশ্বরের স্বাধীনতাদায়ক সত্যের সাক্ষী ও আদর্শ হতে হবে। আমাদের সুসাচার প্রচার, শিষ্যদের শিক্ষা দান ও অন্যান্যদের সেবা করতে সমর্পিত হতে হবে। আমাদের বাক্যকে জানতে হবে, তাতে বাধ্য হতে হবে এবং প্রয়োজনীয় শক্তি, পরিচালনা ও সহ্য করার ক্ষমতা পাওয়ার জন্য পবিত্র আত্মার উপর নির্ভর করতে হবে।