১ ও ২ বংশাবলি পুস্তকে ইস্রায়েল জাতির পাঁচশো বছরের ইতিহাসের বর্ণনা করা হয়। প্রথমদিকে, আদর্শ রাজা হিসাবে বিশেষভাবে দায়ূদ ও শলোমনের উপরে জোর দেওয়া হয়, যারা যিরূশালেমের উপাসনা-ঘর এবং জাতীয় আরাধনা স্থাপন করেন। পরে যিহূদার বিভিন্ন রাজাদের ইতিহাস দেওয়া হয়, যাদের নেতৃত্বে দেশের অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপ হয়ে পড়ে, এমন সময় পর্যন্ত যখন উপাসনা-ঘর ধ্বংস করা হয় এবং সেখানকার আরাধনা বন্ধ হয়ে যায়।
১ বংশাবলি ও ২ বংশাবলি হল একজন লেখক দ্বারা লিখিত একটি মাত্র পুস্তক। লেখা অনেক লম্বা বলে তা দুইভাগ করা হয়েছে।
বংশাবলি পুস্তক ইস্রায়েল জাতির পাঁচশো বছরের ইতিহাসের বর্ণনা করে । পুস্তকটিতে অন্তর্ভুক্ত করা রয়েছে: রাজা শৌলের মৃত্যু (১ বংশা ৯-১০), রাজা দায়ূদের রাজত্ব (১০১১-৯৭১ খ্রীঃপূঃ), রাজা শলোমনের রাজত্ব ও উপাসনা-ঘরের নির্মাণ (৯৭১-৯৩১ খ্রীঃপূঃ) এবং যিহূদার রাজাদের রাজত্ব (৯৩১-৫৮৬ খ্রীঃপূঃ), যে পর্যন্ত না বাবিল যিহূদাকে দখল করে এবং যিরূশালেম ও উপাসনা-ঘর ধ্বংস করে । বংশাবলি পুস্তক শমূয়েল পুস্তকের কিছু অংশ পুনরালোচনা করে এবং রাজাবলি পুস্তকের সমান্তরালভাবে চলে। রাজাবলি পুস্তকের চেয়ে বংশাবলি পুস্তকে কিছু বিষয়ের আরো বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়, যেমন: রাজা দায়ূদ, শলোমন এবং অন্যান্য ঈশ্বর ভক্ত রাজাদের রাজত্ব সম্বন্ধে।
বংশাবলি পুস্তকে বিশেষভাবে যিরূশালেমে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর, সেখানকার ইস্রায়েলের জাতীয় আরাধনা, বাৎসরিক পর্বগুলোর পালন, পুরোহিত এবং লেবীয়দের উপরে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ: শমূয়েল ও রাজাবলি পুস্তক একসাথে গুনে দেখলে লেবীয়েরা শুধুমাত্র তিন বার উল্লিখিত, কিন্তু বংশাবলি পুস্তকে লেবীয়েরা একশো বার উল্লিখিত। তাই সম্ভাবনা বেশি যে, একজন লেবীয় বা পুরোহিত বংশাবলি পুস্তক লিখেছেন। যিহূদী ঐতিহ্য অনুসারে পুস্তকটি আইন-শিক্ষক ইষ্রা দ্বারা লেখা হয়, যিনি নির্বাসনের পরে যিরূশালেমে ফিরে গিয়ে পুনরায় নির্মিত উপাসনা-ঘরে ইস্রায়েলের জাতীয় আরাধনা উন্নত করার জন্য খুব পরিশ্রম করেন।
৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদীদের বাবিলে নির্বাসনে নেওয়া হয়েছিল। সত্তর বছর পরে (৫৩৮ খ্রীষ্টপূর্বে) তারা দেশে ফেরার অনুমতি পায়, ঠিক যেভাবে ভাববাদী যিরমিয় বলেছিলেন। প্রথমে ৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে সরুব্বাবিলের নেতৃত্বে প্রায় পঞ্চাশ হাজার যিহূদীরা যিহূদা দেশে ফিরে আসে। কিছু সমস্যার সম্মুখীন হলেও তারা যিরূশালেমে সঠিক স্থানে উপাসনা-ঘর পুনরায় নির্মাণ করতে সক্ষম হয়, যদিও এই দ্বিতীয় উপাসনা-ঘর শলোমন দ্বারা নির্মিত উপাসনা-ঘরের মত চমৎকার ও আকর্ষণীয় নয়। ৪৫৮ খ্রীষ্টপূর্বে পুরোহিত ইষ্রার নেতৃত্বে আরো কিছু যিহূদীরা দেশে ফিরে আসে। ইষ্রা আগ্রহের ও গুরুত্বের সঙ্গে যিহূদীদের আত্নিক জীবন গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন কাজ হাতে নেন, যেমন: উপাসনা-ঘরে আরাধনার উন্নয়ন, আইন-কানুন শেখানো, বাৎসরিক জাতীয় পর্বগুলো পালন, পুরোহিত ও লেবীয়দের বিষয়ে ব্যবস্থাপনা এবং ইব্রীয় শাস্ত্রের পুস্তকগুলোর সংগ্রহ (ইষ্রা ৭-১০)।
ইষ্রার সময়ে তার যিহূদী পাঠকদের অবস্থা কেমন ছিল? যদিও যিহূদীরা অনুমতি পেয়ে উঁচু আকাঙ্খা নিয়ে প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে এসেছিল তবুও যেমন তারা আশা করেছিল, প্রতিজ্ঞাত দেশে তাদের অবস্থা তেমন ভাল ছিল না: তারা দেবতাপূজারী মাদিয়-পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, দায়ূদ বংশের কোনো রাজা তাদের উপর আর রাজত্ব করেন না বরং একজন মাদিয়-পারস্যদের দ্বারা অনুমোদিত শাসনকর্তা তাদের উপরে রাজত্ব করেন। যিরূশালেমে উপাসনা-ঘর পুনরায় নির্মাণ হলেও তা ছিল শলোমনের চমৎকার মন্দিরের তুলনায় ছায়া মাত্র। যিরূশালেমের দেওয়াল তখনও ভাঙ্গা অবস্থায় ছিল বলে তাদের তেমন নিরাপত্তা ছিল না এবং দেশে যিহূদীদের ছাড়া আরো অনেক জাতির লোক বাস করে, এরা সেই জাতির লোক যারা ইতিহাসে যিহূদীদের শত্রু ছিল।
এই অবস্থায় যিহূদীদের মনে যে সব প্রশ্ন আসতে পারে, তা হল: ঈশ্বর কি আসলে আমাদের সঙ্গে আছেন? ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতির সঙ্গে তাঁর চুক্তি কি বাতিল করেছেন? ইস্রায়েল জাতিকে ঈশ্বর আগে যে প্রতিজ্ঞাগুলো দিয়েছেন সেগুলো কি ফিরে আসা যিহূদীদের উপরে আছে? কেন ঈশ্বর এর চেয়ে বেশি সাহায্য করেন না, দেশটি আরো সুন্দরভাবে স্থাপন করেন না? দেবতাপূজারী জাতিদের মধ্যে বাস করলে যিহূদীরা কিভাবে নিজের জাতীয় পরিচয় ও ধর্ম ধরে রাখতে পারবে? তাদের শিকড় কোথায়?
বংশাবলি পুস্তকে ইষ্রা ঠিক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেন। ইষ্রা পুস্তকের প্রথমদিকে যিহূদীদের বংশ তালিকা দেন, যাতে অব্রাহাম, এমন কি আদম পর্যন্ত তাদের পূর্বপুরুষদের উল্লেখ করা হয় (বংশা ১-৯)। এভাবে তিনি পাঠকদের তাদের পরিবার, পূর্বপুরুষ, ইতিহাস, শিকড় ও জাতি হিসাবে তাদের পরিচয় দেখান। বংশ তালিকার মধ্য দিয়ে ইষ্রা তাদের পরিচয়ের নোঙ্গর দেন, জাতি হিসাবে তাদের আহবান, নিযুক্তিকরণ ও ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দেন। এছাড়া তিনি আগের যুগের আদর্শ নেতাদের ইতিহাস দেখিয়ে তাদের অনুপ্রেরণা দেন। তিনি বিশেষভাবে রাজা দায়ূদের উপর জোর দেন, যিনি প্রাণপণে ঈশ্বরের আরাধনাকারী ও অন্বেষণকারী ছিলেন। ঈশ্বরের প্রতি দায়ূদের ভক্তি, ঈশ্বরের বাক্যের উপরে তার ভরসা, মরুএলাকায় কিভাবে তার সৈন্যদল গড়ে তুলেন, ঈশ্বরের নামে অন্য জাতিদের উপরে তার জয়লাভ, যিরূশালেমে নিয়ম-সিন্ধুক আনার তার আনন্দ, মন্দিরে নিয়মিত আরাধনা স্থাপন করার তার প্রচেষ্টা এবং পুরোহিত, লেবীয়দের ও সরকারি অফিসারদের বিষয়ে তার ব্যবস্থাপনা (১ বংশা ১১-২৯), এসব উল্লেখ করা দ্বারা লেখক ইষ্রা ফিরে আসা যিহূদীদের অনুপ্রেরণা ও চ্যালেঞ্জ করেন, যেন তারা তাদের মূল্যবান আহবান ও চমৎকার উত্তরাধিকার বুঝতে পারে এবং সে অনুসারে জীবন-যাপন করতে নিজেদের সমর্পিত করে।
দায়ূদের পরে লেখক ইষ্রা পুস্তকটিতে শলোমনের ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করেন, যিনি ক্ষমতায় আসার পরে দায়ূদের নির্দেশনা অনুসারে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর তৈরি করেন (২ বংশা ২-৭)। ইতিহাসে দেখা যায় যে, ঈশ্বর যেমন শুরু থেকে চেয়েছিলেন, ইস্রায়েল ঠিক তেমনি প্রকৃতভাবে খুব উন্নত ও আকর্ষণীয় একটি দেশে পরিণত হয় (২ বংশা ৮-৯)। এর পরে ইষ্রা যিহূদার পরবর্তী রাজাদের ইতিহাস বর্ণনা করেন (২ বংশা ১০-৩৬)। তিনি ইস্রায়েলের রাজাদের উল্লেখ না করে বরং বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে যিহূদার সেই রাজাদের বিস্তারিত বর্ণনা দেন, যারা ভাল ছিলেন, যারা হৃদয় স্থির করে ঈশ্বরকে অন্বেষণ করেছিলেন, যারা উপাসনা-ঘরে গুরুত্ব দিয়েছেন, জাতীয় আরাধনা পুনরায় স্থাপন করেছেন এবং পুরোহিত ও লেবীয়দের ব্যবস্থাপনা করেছেন। এই ভাল রাজাদেরকে ইষ্রা ফিরে আসা যিহূদীদের জন্য আদর্শ হিসাবে তুলে ধরেন। লেখক এই ভাল রাজাদের উদাহরণ দেখান যেন তার যিহূদী পাঠকেরা অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনা পেয়ে বর্তমান সমাজ ভালদিকে প্রভাবিত করে।
ভাল রাজাদের গল্প দ্বারা উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি ইষ্রা খারাপ রাজাদের গল্পও দেন। এ দ্বারা তিনি পাঠকদের সাবধান করে দেখান যে, যিহূদা রাজারা যখন ঈশ্বরকে অন্বেষণ করেন না তখন কত ক্ষতি হয়, কত সামাজিক সমস্যা দেখা দেয় এবং উপাসনা-ঘর ও ঈশ্বরের সত্যিকারের আরাধনা কত অবহেলিত হয়ে যায়। এই পথ থেকে মন না ফিরানোর কারণে যিহূদা জাতি শেষ পর্যন্ত প্রকৃতভাবে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর, প্রতিজ্ঞাত দেশ ও দায়ূদ রাজপরিবারের রাজত্ব এসব হারিয়ে নির্বাসনে যায়।
১ বংশাবলি ও ২ বংশাবলি হল একজন লেখক দ্বারা লিখিত একটি মাত্র পুস্তক। লেখা অনেক লম্বা বলে তা দুইভাগ করা হয়েছে।
বাইবেলের অন্য পুস্তকগুলোর সাথে বংশাবলি পুস্তকের সংযোগ
বংশাবলি পুস্তক ইস্রায়েলের পাঁচশো বছরের ইতিহাসের বর্ণনা করে (৯৭১-৯৩১ খ্রীঃপূঃ)। পুস্তকটিতে অন্তর্ভুক্ত করা রয়েছে: রাজা শৌলের মৃত্যু (১ বংশা ৯-১০), রাজা দায়ূদের রাজত্ব (১০১১-৯৭১ খ্রীঃপূঃ, ১ বংশা ১১-২৯), রাজা শলোমনের রাজত্ব ও উপাসনা-ঘর নির্মাণ (৯৭১-৯৩১ খ্রীঃপূঃ, ২ বংশা ১-৯) এবং যিহূদার রাজাদের রাজত্ব (৯৩১-৫৮৬ খ্রীঃপূঃ, ২ বংশা ১০-৩৬), যে পর্যন্ত না বাবিল যিহূদাকে দখল করে এবং যিরূশালেম ও উপাসনা-ঘর ধ্বংস করে।
বংশাবলি পুস্তক শমূয়েল পুস্তকের কিছু অংশ পুনরালোচনা করে এবং রাজাবলি পুস্তকের সমান্তরালভাবে চলে। রাজাবলি পুস্তকের চেয়ে বংশাবলি পুস্তকে কিছু বিষয়ের আরো বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন: রাজা দায়ূদ, শলোমন এবং অন্যান্য ঈশ্বর ভক্ত রাজাদের রাজত্ব সম্বন্ধে। যিহূদীদের বাইবেলের পুস্তকগুলো সাজানোর ধরণ অনুসারে ইব্রীয় শাস্ত্রের শেষ পুস্তকগুলো হল: রূত, বিলাপ, উপদেশক, ইষ্টের, দানিয়েল ইষ্রা, নহিমিয় ও (একেবারে শেষে) বংশাবলি। বংশাবলি পুস্তক হল যিহূদী ইতিহাসের একটি সারাংশ। বংশাবলি পুস্তকে ইষ্রা আগের বিভিন্ন লেখাগুলো উদ্ধৃতি করেন এবং সব লেখাগুলো সুন্দর করে চিহ্নিত করেন।
বংশাবলি পুস্তকের লেখক
বংশাবলি পুস্তকে বিশেষভাবে যিরূশালেমে থাকা ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর, সেখানকার ইস্রায়েলের জাতীয় আরাধনা, বাৎসরিক পর্বগুলোর পালন, পুরোহিত এবং লেবীয়দের উপরে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ: শমূয়েল ও রাজাবলি পুস্তক একসাথে গুনে দেখলে লেবীয়েরা শুধুমাত্র তিন বার উল্লিখিত, কিন্তু বংশাবলি পুস্তকে লেবীয়েরা একশো বার উল্লিখিত। তাই সম্ভাবনা বেশি যে, একজন লেবীয় বা পুরোহিত বংশাবলি পুস্তক লিখেছেন। যিহূদী ঐতিহ্য অনুসারে পুস্তকটি আইন-শিক্ষক ইষ্রা দ্বারা লেখা হয়, যিনি নির্বাসনের পরে যিরূশালেমে ফিরে গিয়ে পুনরায় নির্মিত উপাসনা-ঘরে ইস্রায়েলের জাতীয় আরাধনা উন্নত করার জন্য খুব পরিশ্রম করেন। রাজাবলি পুস্তক হল একজন ভাববাদীর (যিরমিয়) দৃষ্টি থেকে লেখা এবং বংশাবলি পুস্তক একজন পুরোহিতের দৃষ্টি থেকে লেখা। লেখক তার নাম পুস্তকে সরাসরি প্রকাশ করেন না, কিন্তু বিভিন্ন কারণে বেশ নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায় যে, পুস্তকটির লেখক হলেন আইন-শিক্ষক ইষ্রা, যিনি বাবিল থেকে যিহূদায় ফিরে এসেছিলেন যিহূদীদের যিরূশালেমে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘরে আরাধনা পুনরায় স্থাপন করার ক্ষেত্রে সাহায্য করার জন্য।
ইষ্রার বর্ণনা হল “যিনি ইস্রায়েলকে দেওয়া সদাপ্রভুর সব আদেশ ও নিয়ম সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করেছিলেন সেই পুরোহিত ও ধর্ম-শিক্ষক ইষ্রার কাছে রাজা অর্তক্ষস্ত এই চিঠি লিখেছিলেন” (ইষ্রা ৭:১১)। তিনি যিহূদীদের দ্বিতীয় একটি দল বাবিল থেকে যিহূদায় ফিরে যাওয়ার জন্য গঠিত করেন এবং “ঈশ্বরের মংগলের হাত ইষ্রার উপরে ছিল বলে” (ইষ্রা ৭:৯) তিনি তাদের যিরূশালেমে পৌঁছাতে সক্ষম। তিনি পুস্তকে নিজের জীবনের মূল উদ্দেশ্য এভাবে বর্ণনা করেন: “ইষ্রা সদাপ্রভুর আইন-কানুন পড়বার, তা পালন করবার এবং তার নিয়ম ও নির্দেশ ইস্রায়েল দেশে শিক্ষা দেবার জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন” (ইষ্রা ৭:১০)।
যিহূদী ঐতিহ্য অনুসারে ইষ্রা তিনটি পুস্তকের লেখক: ইষ্রা, নহিমিয় ও বংশাবলি। এই তিনটি পুস্তকে ইব্রীয় শাস্ত্রে পর পরই রাখা আছে। এছাড়া লেখাগুলোতে একটি পরিষ্কার সংযোগ দেখা যায়: বংশাবলি পুস্তকের শেষ অনুচ্ছেদ এবং ইষ্রা পুস্তকের প্রথম অনুচ্ছেদ প্রায় হুবহু মিল আছে।
বাবিলের নির্বাসন থেকে যিহূদায় ফিরে যাওয়া
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যিহূদা দেশ খারাপ থেকে আরো খারাপ অবস্থায় পড়ে, শেষে বাবিল সাম্রাজ্য ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদা দখল ও ধ্বংস করে এবং দেশের বেঁচে থাকা লোকসংখ্যাকে নির্বাসনে নিয়ে যায়। যখন ৫৩৯ খ্রীষ্টপূর্বে মাদিয়-পারস্য বাবিলকে দখল করে তখন পরিবর্তন ঘটে। ৫৩৮ খ্রীষ্টপূর্বে জয়ী মাদিয়-পারস্য রাজা কোরস বাবিল দ্বারা নির্বাসিত জাতিদের – এবং যিহূদীদেরও – নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেন। ঠিক যেভাবে যিরমিয় ভাববাদী ৭০ বছর নির্বাসনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সেভাবেই এটি পূর্ণ হয়। এছাড়া যিরমিয় নির্বাসিত যিহূদীদের ঈশ্বরের উপরে আশা ধরে রাখতে এবং অনুমতি পেলে নিজের দেশে যাওয়ার সুযোগ ধরতে উৎসাহিত করেছিলেন।
যিহূদায় ফিরে আসা যিহূদীদের প্রথম দল ৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে সরুব্বাবিলের নেতৃত্বে বাবিল থেকে যিহূদায় ফিরে যায়। বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হলেও তারা যিরূশালেমের সঠিক স্থানে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর পুনরায় নির্মাণ করতে সক্ষম হয়, যদিও তা শলোমন দ্বারা নির্মিত উপাসনা-ঘরের চেয়ে অনেক সরল ছিল। যিহূদায় ফিরে আসা যিহূদীদের দ্বিতীয় দল ৪৫৮ খ্রীষ্টপূর্বে ইষ্রার নেতৃত্বে বাবিল থেকে যিহূদায় ফিরে যায়। সেখানে পৌঁছিয়ে আইন-কানুনের শিক্ষায় ও বিভিন্ন পুনসংস্কারের পরিচালনায় ইষ্রা নিজেকে সমর্পিত করেন। যিহূদায় ফিরে আসা যিহূদীদের তৃতীয় দল নিয়ে ৪৪৪ খ্রীষ্টপূর্বে নহিমিয় যিহূদায় ফিরে যান এবং শাসনকর্তা হিসাবে তিনি যিরূশালেমের দেওয়াল পুনরায় নির্মাণ কাজের জন্য তিনি উদ্যোগ নেন।
যিহূদায় ফিরে আসা যিহূদীদের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
যিহূদায় ফিরে আসা যিহূদীদের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি প্রকৃতভাবে তেমন ভাল ছিল না।
- ফিরে যাওয়ার অনুমতি আইনগতভাবে পাওয়ার পরেও বেশির ভাগ যিহূদীরা যিহূদায় ফিরে যায় না।
- আগের মত যিহূদার উপরে দায়ূদ রাজবংশের একজন নিজস্ব রাজা রাজত্ব করেন, তা নয়, বরং তাদের উপর মাদিয়-পারস্যদের দ্বারা নিযুক্ত একজন শাসনকর্তা রাজত্ব করেন যিনি এই বিশাল দেবতাপূজারী মাদিয়-পারস্য সাম্রাজ্যের কাছে দায়বদ্ধ।
- যিহূদীরা ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর তাদের আত্মিক কেন্দ্র হিসাবে পুনরায় নির্মাণ করতে পেরেছিল কিন্তু তা শলোমনের মন্দিরের তুলনায় একটি ছায়া মাত্র।
- নহিমিয় যিরূশালেমে না পৌঁছানো পর্যন্ত যিরূশালেমের দেওয়াল তখনও ভাঙ্গা অবস্থায় ছিল বলে তাদের বেশি নিরাপত্তা ছিল না।
- ৭০ বছর নির্বাসনের পরে নিজের দেশে ফিরে এসে আগের জমি ফেরত না পেয়ে তাদের এমন অন্য জাতিদের মধ্যে বাস করতে হয়, যারা ইতিহাসে ইস্রায়েলের শত্রু ছিল। এছাড়া মাদিয়-পারস্য বেশ কর আদায় করত, ফলে যিহূদীদের অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশি ভাল ছিল না।
এই ধরণের অবস্থায় পড়ে যিহূদীদের অন্তরে এই ধরণের বিভিন্ন প্রশ্ন বা সন্দেহ উঠতে পারে: ঈশ্বর কি আসলে আমাদের সঙ্গে আছেন? আমরা কি এখনও তাঁর নিজস্ব জাতি? ইস্রায়েল জাতির সাথে তাঁর চুক্তি কি এখনও প্রযোজ্য? তাঁর আহ্বান কি প্রকৃতভাবে আমাদেরই উপরে রয়েছে? কেন ঈশ্বর আমাদের জন্য এর চেয়ে বড় কোন উদ্ধার ঘটাচ্ছেন না? কেন আমাদের অন্য জাতিদের সঙ্গে এবং মাদিয়-পারস্যদের অধীনের বাস করতে হচ্ছে? এই অবস্থায় আমরা আমাদের জাতীয় পরিচয় এবং আমাদের ধর্মের অনুশীলন কিভাবে সুরক্ষিত রাখতে পারি? জাতি হিসাবে আমাদের শিকড় কোথায়? ঈশ্বরের চমৎকার প্রতিজ্ঞাগুলো কেন পূর্ণ হচ্ছে না?
বংশাবলি পুস্তক লেখার পিছনে ইষ্রার উদ্দেশ্য
উপরে উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য এবং যিহূদীদের এই ধরণের সন্দেহ দূর করার জন্যই ইষ্রা বংশাবলি পুস্তক লেখেন। পুস্তকের প্রথমদিকে তিনি যিহূদী জাতির শিকড় দেখানোর জন্য তাদের পূর্বপুরুষদের বংশ তালিকা উল্লেখ করেন। তিনি তাদের সম্মানিত জাতির পিতা অব্রাহাম এবং এমন কি আদিপিতা আদম থেকে শুরু করে তাদের বংশ তালিকা দেখান (১ বংশা ১-৯)।
পরবর্তীতে তিনি তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে মহান রাজা দায়ূদের ইতিহাস বর্ণনা করেন। তিনি পাঠকদের দায়ূদের আদর্শ দিয়ে উৎসাহিত করেন: দায়ূদ ঈশ্বরের একজন সত্যিকার আরাধনাকারী ছিলেন, তিনি ঈশ্বরকে তার সমস্ত অন্তর দিয়ে অন্বষণ করেন, ঈশ্বরের বাক্যের উপর ভরসা রাখেন, ঈশ্বরের নামে মরুভূমিতে একটি শক্তিশালী সৈন্যদল গড়ে তুলতে সক্ষম হন, অসংখ্য যুদ্ধে জয়লাভ করেন, ঈশ্বরের নিয়ম-সিন্দুক যিরূশালেমে নিয়ে এসে তিনি আনন্দ করেন এবং পুরোহিত, লেবীয় ও সরকারী কর্মকর্তাদের সংগঠিত করেন (১ রাজা ১১-২৯)। এইসব উৎসাহ দানকারী ঘটনাগুলো দ্বারা ইষ্রা ফিরে আসা যিহূদীদের নিজের জাতীয় পরিচয় ও ভূমিকা বুঝতে এবং (দায়ূদের মত) এই উঁচু মাণের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ করেন।
পরবর্তীতে, ইষ্রা রাজা শলোমনের রাজত্ব সম্বন্ধ বর্ণনা করেন: শলোমনকে কিভাবে নতুন রাজা হিসাবে পছন্দ করা হয়, রাজা দায়ূদের দায়িত্ব কিভাবে তার কাছে হস্তান্তর করা হয় (১ বংশা ২৮), কিভাবে তিনি তার রাজত্ব শুরু করেন ও ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রজ্ঞা পান (২ বংশা ১-৩), কিভাবে তিনি যিরূশালেমের উপাসনা-ঘর নির্মাণ করেন (২ রাজা ২,৪-৭) এবং তার রাজত্বের সময়ে ইস্রায়েল কিভাবে আহ্বান পূর্ণ করে অন্য জাতিদের জন্য একটি আকর্ষণীয় আদর্শ দেশে পরিণত হয় (২ বংশা ৮-৯, যাত্রা ১৯:৪-৬)।
বংশাবলি পুস্তকে ইষ্রা উত্তরের ইস্রায়েল রাজাদের ইতিহাস না দিয়ে এর পরিবর্তে তিনি শুধুমাত্র দক্ষিণের যিহূদা রাজাদের, অর্থাৎ দায়ূদের বংশের রাজাদের ইতিহাস বর্ণনা করেন। এছাড়া যিহূদার মন্দ রাজাদের বিষয়ে কম মন্তব্য করে বরং তিনি ভাল রাজাদের বিষয়ে বেশি আলোচনা করেন: যারা দেশে পুনঃসংস্কার নিয়ে আসেন, উপাসনা-ঘর মেরামত করেন, উপাসনা-ঘরের আরাধনায় গুরুত্ব দেন এবং পুরোহিত ও লেবীয়দের সংগঠিত করেন। ইষ্রা এই রাজাদের আদর্শ দেখিয়ে নির্বাসন থেকে ফিরে আসা যিহূদীদের অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনা দিতে চেষ্টা করেন, যেন তারা তাদের সমাজ ঈশ্বরীয় আদর্শে গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়।
যিহূদার ইতিহাস কেন খারাপের দিকে গিয়েছে, এর কারণ দেখিয়ে ইষ্রা শ্রোতাদের সাবধান করেন যেন তারা তাদের পূর্বপুরুষদের মত প্রতিজ্ঞাত দেশ, দায়ূদের বংশের ধারাবাহিকতা এবং উপাসনা-ঘর না হারায়। বরং ঈশ্বরকে অন্বেষণ করে এবং উপাসনা-ঘর ও আরাধনায় গুরুত্ব দেয়।
বংশ তালিকা ১ বংশাবলি ১-৯
ইষ্রা প্রথমে আদম থেকে অব্রাহাম পর্যন্ত, এবং অব্রাহম থেকে যাকোবের বারোজন ছেলে পর্যন্ত বংশ তালিকা দেন। পরবর্তীতে তিনি ইস্রায়েলের ১২ বংশের তালিকা দেন, কিন্তু তিনি বিশেষভাবে ইস্রায়েলের দু’টি বংশের উপর গুরুত্ব দেন: যিহূদা ও লেবী। ইস্রায়েলের বাকি ১০টি বংশ ৭২২ খ্রীষ্টপূর্বে আসিরিয়া সাম্রাজ্য দ্বারা ধ্বংস ও নির্বাসিত করা হয়। ইস্রায়েলের বেঁচে থাকা নির্বাসিত লোকসংখ্যা দেবতাপূজারী হয়ে যায় এবং অন্য জাতিদের সাথে মিশে যায়। তারা আর কখনও প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে আসে না এবং তারা তাদের জাতীয় পরিচয় হারায়। একারণে ইষ্রা তাদের বিষয়ে বেশি উল্লেখ করেন না। যিহূদা বংশ (এবং সঙ্গে শিমিয়োন বংশ, বিন্যামিন বংশের একটি অংশ ও অনেক লেবীয়েরা) বাবিল সাম্রাজ্য দ্বারা ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে ধ্বংস ও নির্বাসিত হয়। যিহূদার বেঁচে থাকা নির্বাসিত লোকসংখ্যার মধ্য থেকে শুধু ৫০ হাজার লোকসংখ্যা ৫৩৮ খ্রীষ্টপূর্বে মাদিয়-পারস্য রাজা কোরসের অনুমতি পেয়ে প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে আসে এবং এদের উপরেই গুরুত্ব দিয়ে ইষ্রা বংশ তালিকা উল্লেখ করেন। এছাড়া তিনি লেবীয়দের উপর গুরুত্ব দেন; এদের মধ্যে তিনি পুরোহিতের বংশ, ফটক রক্ষী, পবিত্র আসবাব-পত্র রক্ষী ও গায়কদলের উপর গুরুত্ব দেন (১ বংশা ৯)।
এভাবে ইষ্রা তার পাঠকদের ঐতিহাসিক শিকড় ও ঈশ্বরের জাতি হিসাবে তাদের পরিচয় দেখান। অনেকে ইতিহাসে হারিয়ে গেছে কিন্তু বর্তমানে তারাই ঈশ্বরের সেই জাতি যাদের উপরে ইস্রায়েলের আহ্বান ও প্রতিজ্ঞাগুলো রয়েছে এবং তাদের বর্তমান বিশ্বস্ততার উপর সব কিছু নির্ভর করে।
রাজা শৌল ১ বংশাবলি ১০
রাজা শৌলের বিষয়ে ইষ্রা বেশি বর্ণনা করেন না। শৌল দায়ূদের তুলনায় কত ভিন্ন এবং কত মন্দ, ইষ্রা তা দেখান। শৌলের জীবনের শেষের ঘটনা সত্যিই অতি দুঃখজনক: তিনি ঈশ্বর থেকে বিছিন্ন এবং গভীর হতাশা-গ্রস্ত। তিনি একটি আশীর্বাদশূন্য যুদ্ধে তার তিনটি ছেলের মৃত্যুর পরে আত্ম-হত্যা করেন (১ রাজা ১০)।
রাজা দায়ূদ ১ বংশাবলি ১১-২৯
শৌলের মৃত্যুর চেয়ে দায়ূদের মৃত্যু অনেক ভিন্ন: দায়ূদ তার সম্পূর্ণ জীবনে, এমন কি তার শেষ দিন পর্যন্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ ছিলেন। তিনি তার একজন ঈশ্বরীয় ছেলে সিংহাসনে উঠতে দেখেন, তিনি উপাসনা-ঘর নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেন এবং শান্তিতে মারা যান (১ বংশা ২৮-২৯)।
শৌলের যে পাপগুলোর কারণে ঈশ্বর তার রাজ্যবংশ স্থায়ী হতে দেন নি, দায়ূদ সেই পাপগুলো করেন না, ইষ্রা তা যত্নসহকারে দেখান: দায়ূদ যুদ্ধের ক্ষেত্রে ঈশ্বরের নির্দেশনায় বাধ্য হন (১ বংশা ১৪:৮-১৭), শৌল কিন্তু তা করেন নি (১ শমূয়েল ১৩)। শৌল পুরোহিত ভূমিকা নিজের জন্য দখল করেন (১ শমূয়েল ১৫)। কিন্তু দায়ূদ নিয়ম-সিন্দুক যিরূশালেমে নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় যখন ব্যর্থ হন তখন তিনি সংশোধন মেনে নিয়ে দ্বিতীয় অভিযানে সঠিকভাবে অর্থাৎ, পুরোহিতদের ভূমিকায় গুরুত্ব দিয়ে নিয়ম-সিন্দুক যিরূশালেমে নিয়ে আসেন (১ বংশা ১৫:১১-১৫)।
দায়ূদ শৌলের কাছ থেকে পালিয়ে মরুভুমিতে – এবং শেষে এমন কি শত্রুদের মধ্যে – বাস করেন, যদিও এই বিষয়ে ইষ্রা বেশি মনোযোগ দেন না। কিন্তু তিনি অনেক বিস্তারিত বর্ণনা দেন কিভাবে একের পর এক সৈন্যদল স্বেচ্ছায় দায়ূদের সাথে যোগ দেয় (১ বংশা ১২)। ইষ্রা বর্ণনা করেন দায়ূদ কিভাবে সত্যিকারের নেতৃত্বে বৃদ্ধি পান: পলাতক ব্যক্তি হিসাবে তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা প্রত্যেক মুহূর্তে সম্ভব জেনেও তিনি নম্রভাবে ও অনেক ঝুঁকি নিয়ে লোকদের গ্রহণ করেন, যখ্ন লোকেরা তার কাছে যায়। দায়ূদের নেতৃত্ব এমন ধরণের হয়ে ওঠে যে, ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অনেক লোকেরা তার নেতৃত্বের অধীনে আসার জন্য আগ্রহী হয়। দায়ূদ তাদেরকে নিরাপত্তা বা পুরষ্কার দিতে অক্ষম জেনেও তার কাছে যায়। লক্ষ্য করুন, কোথা থেকে তারা আসে: যিহূদা বংশ থেকে সৈন্যরা (দায়ূদের নিজের বংশ), বিভিন্ন বংশ থেকে, বিন্যামিন বংশ থেকে (রাজা শৌলের বংশ), শৌলের পরিবার থেকে (১ বংশা ১২:১) এবং এমন কি অন্য জাতিদের থেকে: যিৎমা হলেন মোয়াবীয় (১ বংশা ১১:৪৬), দায়ূদের ত্রিশজন নামকরা বীরদের মধ্যে সেলক হলেন অম্মোনীয় (১ বংশা ১১:৩৯), উরিয় হলেন হিত্তীয় (১ বংশা ১১:৪১) এবং দায়ূদের প্রতি অতি বিশ্বস্ত করেথীয় ও পলেথীয়েরা (১ বংশা ১৮:১৭) হতে পারে এরা বিদেশী সৈন্যদল ছিল। এমন কি যখন দায়ূদ সবচেয়ে বেশি আপোষ করেন (তিনি পলেষ্টীয়দের পক্ষে ইস্রায়েলের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যান), মনঃশি বংশের কিছু সৈন্যেরা ইস্রায়েল থেকে তার কাছে চলে আসে (১ বংশা ১২:১৯)। ইষ্রা এই বিষয়ে মন্তব্য করেন যখন ইস্রায়েলের আর একটি সৈন্যদল দায়ূদের সাথে যোগ দেয় “ইষাখর-গোষ্ঠীর দু’শো জন নেতা … তাঁরা ছিলেন বুদ্ধিমান এবং বুঝতে পারতেন ইস্রায়েলীয়দের কখন কি করা উচিত” (১ বংশ ১২:৩২)। দায়ূদ এমন একজন নেতা যিনি তার কষ্টের সময়েও সীমার ওপার থেকে লোকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন।
এভাবে ইষ্রা গুরুত্ব সহকারে ৬ অধ্যায় ধরে দায়ূদের নেতৃত্ব, সামরিক দক্ষতা এবং যুদ্ধে জয়লাভের বর্ণনা করেন (১ রাজা ১১-১২,১৮-২০,২৭)। দায়ূদের একটি বিষয়ের উপর ইষ্রা অতি মনোযোগ দেন: ঈশ্বরের জন্য একটি উপাসনা-ঘর তৈরি করতে দায়ূদের আকাঙ্ক্ষা। দায়ূদের এই আক্ঙ্ক্ষার সাড়ায় ঈশ্বর দায়ূদকে প্রতিজ্ঞা করেন যে, ঈশ্বরই বরং দায়ূদের জন্য একটি ঘর তৈরি করবেন, প্রকৃতপক্ষে যা ছিল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী মশীহ সম্বন্ধীয় প্রতিজ্ঞা (১ বংশা ১৭)। দায়ূদ বোঝেন এই প্রতিজ্ঞা কত অদ্ভুৎ। তিনি উপাসনা-ঘর তৈরি করার অনুমতি পান নি বলে তিনি মনেপ্রাণে উপাসনা-ঘর তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় যোগানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন: তিনি উপাসনা-ঘর তৈরির বিস্তারিত ও বিশদ পরিকল্পনা, প্রচুর যোগান ও দায়িত্ব তার ছেলে শলোমনের কাছে হস্তান্তর করেন এবং তাকে অনেক অনুপ্রেরণাও দান করেন। ইষ্রা ১৩ অধ্যায় ধরে এর বর্ণনা করেন (১ বংশা ১৩-১৭,২১-২৬,২৮-২৯)!
দায়ূদের জীবনের দুর্বলতা ও সমস্যার গল্পগুলো ইষ্রা বাদ দেন: বৎশেবার সাথে তার ব্যভিচার, ঊরিয়ের খুন, ছেলেদের নিয়ে সমস্যা ও অবশালোমের বিদ্রোহ। দায়ূদের দুর্বলতা ইষ্রা শুধুমাত্র একটি গল্পের মধ্যে প্রকাশ করেন: দায়ূদ একটি লোকগণনা করার আদেশ দেন, যার ফলে একটি মহামারী ঘটে। কিন্তু হতে পারে, ইষ্রা এই গল্প শুধুমাত্র এক কারণে উল্লেখ করেন: দেখানোর জন্য যে, কিভাবে উপাসনা-ঘরের স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে (১ বংশা ২১)।
মোট কথা, ইস্রায়েলের সবচেয়ে মহান ও আদর্শ রাজার গল্প বলার মাধ্যমে ইষ্রা তার পাঠকদের উৎসাহিত করতে চান যেন তারা দায়ূদের মত হয়: মনেপ্রাণে ঈশ্বরের কাছে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্কে সমর্পিত, সব ভরসা ঈশ্বরের উপর রাখার ব্যক্তি, উপাসনা-ঘরের ও আরাধনার প্রতি আগ্রহী, বাধ্য ও প্রভাবশালী।
রাজা শলোমন ২ বংশাবলি ১-৯
রাজাবলি পুস্তকের মত বংশাবলি পুস্তকেও ইষ্রা শলোমনের স্বপ্ন উল্লেখ করেন, যাতে শলোমন ঈশ্বরের কাছ থেকে নম্রভাবে প্রজ্ঞা চেয়ে ঈশ্বরের বড় মনের যোগান পান (২ বংশা ১)।উপাসনা-ঘর ও তার আসবাব-পত্র নির্মাণের প্রস্তুতি এবং উপাসনা-ঘরের বাস্তব নির্মাণের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় ইষ্রা ৬ অধ্যায় ধরে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। তিনি আরো বর্ণনা করেন কিভাবে শলোমন নিয়ম-সিন্দুক নতুন উপাসনা-ঘরে আনেন এবং একটি চমৎকার প্রার্থনা করে সব কিছু আনুষ্ঠানিকভাবে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করেন (২ বংশা ২-৭)। ইষ্রা শলোমনের বিভিন্ন দালান ও শহরের নির্মাণ, অসংখ্য উৎসর্গ, পর্বে অংশ গ্রহণ, তার ধন ও জাক-জমক উৎযাপন করেন। ঈশ্বর যেমন ইস্রায়েলকে আহ্বান করেছিলেন (যাত্রা ১৯:৪-৬) তারা ঠিক তেমনি একটি আকর্ষণীয় আদর্শ দেশে পরিণত হয়, এর একটি চমৎকার উদাহরণ হল শিবা দেশের রাণীর ইস্রায়েল দেশ পরিদর্শন (২ বংশা ৮-৯)। ইষ্রা তার পাঠকদের দেখান একটি জাতি যদি ঈশ্বরের অধীনে বাস করে তবে তা কত সুন্দর, চমৎকার ও শক্তিশালী একটি সাক্ষ্য। তাই তিনি তাদেরকে আশা ও অনুপ্রেরণা দেন যেন তারাও ঈশ্বরের উপরে আশা রেখে তাদের বর্তমান অবস্থায় বিশ্বস্ত হয়। রাজাবলি পুস্তকে শলোমন সম্বন্ধে যে নেতিবাচক আচরণের উল্লেখ পাওয়া যায়, বংশাবলি পুস্তকে সেগুলোর উল্লেখ নেই, অর্থাৎ শলোমনের অতিরিক্ত কর-আদায়, তার জোরপূর্বক শ্রম এবং জীবনের শেষে তার দেবতাপূজা, এসব সম্বন্ধে ইষ্রা একটি কথাও উল্লেখ করেন না।
যিহূদা দেশের রাজারা ২ বংশাবলি ১০-৩৬
পরবর্তীতে ইষ্রা শলোমনের পরে যিহূদার ৪০০ বছরের ইতিহাস (৯৩১-৫৮৬ খ্রীঃপূঃ) বর্ণনা করেন, যিহূদা কিভাবে শীর্ষ অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে দেবতাপূজায় ও আইন-শৃঙ্খলার বাইরে, অর্থাৎ উচ্ছৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে। এই বর্ণনায় ইষ্রা আবারও ঈশ্বরকে অন্বেষণ ও উপাসনা-ঘরে সত্যিকারের আরাধনার উপর গুরুত্ব দেন এবং তিনি প্রত্যেক রাজাকে ঠিক এ অনুসারেই মূল্যায়ন করেন: ভাল রাজারা ঈশ্বরকে মনেপ্রাণে অন্বেষণ করেন, তারা উপাসনা-ঘর মেরামত করেন, তার জন্য যোগান দেন, উৎসর্গ করেন, পর্বগুলোতে গুরুত্ব দেন, জাতিকে ধর্মের অনুশীলনে অনুপ্রেরণা দেন এবং লেবীয় ও পুরোহিতদের সংগঠিত করেন। কিন্তু ইষ্রা এর বিপরীতে সেই মন্দ রাজাদের বিষয়ও দেখান যারা “ঈশ্বর সদাপ্রভুর ইচ্ছা জানবার জন্য সমস্ত মন-প্রাণ স্থির” (১ বংশা ২২:১৯, ২ বংশা ১২:৪, ১৫:১২) করেন নি, অর্থাৎ যারা ঈশ্বরকে, তাঁর আরাধনায়, উপাসনা-ঘর, পর্বগুলো ও লেবীয়দের উপরে গুরুত্ব দেন নি বরং দেবতাপূজারী হয়ে যান এবং এভাবে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের উপরে এবং এমন কি জাতি ও দেশের উপরে ধ্বংস টেনে নিয়ে আসেন।
ইষ্রা পরিষ্কারভাবে বোঝান যে, একবার যদি জাতির হৃদয় অবিশ্বস্ত হয়ে যায়, তবে উপাসনা-ঘর দালান হিসাবে আর রক্ষা করার প্রয়োজন নেই। যিহূদা দেশ ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর অশুচি করে এবং এমন কি উপাসনা-ঘরকে প্রতিমা পূজার স্থানে পরিণত করে। এই কারণে ঈশ্বর তার ঘর ছেড়ে দিয়ে তা লুটপাতে ও ধ্বংসে সমর্পিত করেন, যার বাস্তবায়ন ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে প্রকৃতভাবে ঘটে। ঈশ্বর কোন দালানের উপর গুরুত্ব দেন না, তিনি কোন মিথ্যা ধার্মিকতা বা যা কেবলই ‘খোসা মাত্র’ চান না। ইষ্রার যুগের যিহূদীরা উপাসনা-ঘর পুনরায় নির্মাণ করে যদিও তা শলোমনের মন্দিরের চেয়ে খুব সামান্য ছিল। কিন্তু ঈশ্বর তার উপস্থিতি ও আশীর্বাদ সেখানে পুনরায় দিতে রাজি। তিনি তাদের বর্তমান সময়েও সেখানে ইচ্ছুক ও বাধ্য লোকদের সঙ্গে সহভাগিতায় বাস করতে চান।
যিহূদী সমাজ বা ইস্রায়েল জাতির অস্থিত্ব কিভাবে থাকবে? ইষ্রা বংশাবলিতে এই প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কারভাবে দেন: যিহূদী সমাজের অস্থিত্ব থাকবে যদি তারা উপাসনা-ঘর, সেখানকার আরাধনা ও জাতীয় পর্ব পালন দেশের আত্মিক কেন্দ্র হিসাবে গুরুত্ব দেয়। তিনি তা সমাজের ক্ষেত্রে বলেন, কিন্তু আরো বেশি প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রেও বলেন। তিনি তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে ”ঈশ্বর সদাপ্রভুর ইচ্ছা জানবার জন্য সমস্ত মন-প্রাণ স্থির” করতে চ্যালেঞ্জ করেন, যেন আদর্শ ব্যক্তি হয়ে তারা সমাজে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ইষ্রা দেখান যে, শুধুমাত্র যদি তারা উভয় ব্যক্তিগতভাবে এবং জাতিগতভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে চুক্তিতে ও সহভাগিতায় বাস করে তবে তাদের মঙ্গল হবে।
বংশাবলি পুস্তকের মধ্য দিয়ে ইষ্রা তার সমসাময়িক যিহূদী শ্রোতাদের, পরবর্তী প্রজন্মদের যিহূদী পাঠকদের এবং আমাদের আধুনিক বিশ্বাসীদের উৎসাহিত করেন: এটাই তোমার পরিচয়, তোমার আহ্বান। এতে চলতে তুমি নিজেকে সমর্পিত কর। তিনি সাবধাণবাণীও দেন যেন আমরা আগের ইস্রায়েলের পাপ ও ব্যর্থতা এড়িয়ে যাই এবং একই ভুল না করি!
পুনসংস্কারের রাজারা আসা, যিহোশাফট, হিষ্কিয় ও যোশিয়
যিহূদায় আত্মিক জাগরণ ঘটাতে যে ৪জন রাজা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন, ইষ্রা বংশাবলি পুস্তকে তাদের বিস্তারিত বর্ণনা করেন:
যিহূদার রাজা আসা ৯১১-৮৭০ খ্রীঃপূঃ ২ বংশা ১৪-১৫
রাজা আসা দেব-দেবতাদের সমস্ত বেদী, পূজার উঁচু স্থান ও পূজার পাথরগুলো ধ্বংস করেন, পুরুষ মন্দির-বেশ্যাদের তাড়িয়ে দেন (১ রাজা ১৫:১২) এবং তার বাবার মাকে আশেরা-মূর্তি তৈরি করার কারণে রাজমাতার পদ থেকে সরিয়ে দেন। যখন একটি বিশাল কূশীয় সৈন্যদল তার বিরুদ্ধে আসে তিনি ঈশ্বরের উপর নির্ভর করেন এবং ঈশ্বর তাকে তাদের উপরে জয় দান করেন। এর পরেই ভাববাদী অসরিয় রাজা আসা ও যিহূদার লোকদেরকে বলেন “আপনারা যতদিন সদাপ্রভুর সঙ্গে থাকবেন ততদিন তিনিও আপনাদের সঙ্গে থাকবেন … তাঁর ইচ্ছা জানতে চাইলে আপনারা তা জাতে পারবেন … শক্তিশালী হন, নিরাশ হবেন না, কারণ আপনাদের কাজের পুরষ্কার আপনার পাবেন”। এই উৎসাহ পাওয়ার পরে রাজা আসা তার অধীনে থাকা সমস্ত এলাকার, অর্থাৎ যিহূদা, বিন্যামিন ও শিমিয়োন বংশের এলাকার দেব-দেবতাদের বেদীগুলো ধ্বংস করেন, ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর মেরামত করেন এবং সবাইকে একটি আনন্দপূর্ণ চুক্তির নতুনীকরণ অনুষ্ঠানে পরিচালনা করেন। এমন কি ইস্রায়েল দেশের অধীনে থাকা ইফ্রয়িম ও মনঃশি এলাকা থেকে অনেক লোক তার কাছে চলে আসে।
যিহূদার রাজা যিহোশাফট ৮৭০-৮৪৮ খ্রীঃপূঃ ২ বংশা ১৭-১৯
রাজা যিহোশাফট আইন-কানুনে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন ধরণের দেবতাপূজার উঁচু স্থান ও পুরুষ মন্দির-বেশ্যাদের দেশ থেকে নির্মূল করেন এবং কর্মচারীদের ও লেবীয়দের লোকদের ঈশ্বরের আইন-কানুন শেখানোর জন্য যিহূদার সমস্ত জায়গার লোকদের কাছে পাঠান। তিনি নিজেও আইন শিক্ষা ও লোকদের অনুতপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন এলাকায় যান, এতে তার শিক্ষা দানের ও সাধারণ লোকদের সাথে মিশার আগ্রহ প্রকাশ পায়। যখন মোট তিনটি জাতির সৈন্যদল যিহূদাকে আক্রমণ করার জন্য একত্র হয় তখন তিনি বড় বড় কথা বলার চেয়ে সমস্ত দেশকে প্রার্থনায় ও উপবাসে ডাকেন। ঈশ্বর তাকে একজন ভাববাদী দ্বারা যুদ্ধ ছাড়া জয়ের নিশ্চয়তা বাণী দেন এবং পরে ঠিক এভাবে পূর্ণ হয়। যদিও রাজা যিহোশাফট ইস্রায়েলের মন্দ রাজা আহাবের সাথে বিপজ্জনক একটি মৈত্রী চুক্তি করেন তবুও তিনি আদর্শ রাজা হিসাবে দেশের পুনঃসংস্কার ঘটান।
যিহূদার রাজা হিষ্কিয় ৭১৫-৬৮৬ খ্রঃপূঃ ২ বংশা ২৯-৩২
হিষ্কিয় রাজা ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে তার মনোভাব পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত করেন: তিনি প্রথম দিনেই ঈশ্বরের উপাসনা-ঘরের দরজা খুলে দেন, মেরামত কাজ শুরু করেন, দানশীলতার সঙ্গে কাজের জন্য যোগান দেন, সবার সামনে অনুতাপ করেন এবং আরাধনায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি দেবতাপূজার উঁচু স্থানগুলো ও পাথরগুলো ধ্বংস করেন, তিনি ঈশ্বরের উপর নির্ভর করেন এবং আইন-কানুনে বাধ্য হন। তিনি লেবীয়দের ও পুরোহিতদের সংগঠিত করেন এবং পরিচর্যায় তাদের উৎসাহিত করেন। এছাড়া তিনি লোকদের দশমাংশ দিতে উৎসাহিত করেন যেন লেবীয়দের জন্য যোগান নিশ্চিত করা হয়। তিনি মোশির আইন-কানুনে বর্ণিত উদ্ধার-পর্ব পুনরায় চালিয়ে নেওয়ার জন্য যিহূদার সবাইকে এবং এমন কি ইস্রায়েলীয় অধীনস্থ এলাকার বাসিন্দাদের আমন্ত্রণ জানান। কেউ কেউ তার এই প্রচেষ্টা দেখে নিন্দা করে কিন্তু অনেকে সাড়া দেয়। তিনি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন যখন আসিরিয়া সাম্রাজ্য শুধুমাত্র রাজধানী শহর যিরূশালেম ছাড়া যিহূদার বাকি এলাকাগুলো দখল করে। আসিরিয়া যখন রাজধানী যিরূশালেমকে ঘেরাও ও দখল করার হুমকি দেন তখন এই চরম মুহূর্তে হিষ্কিয় ঈশ্বরের কাছে কান্না করেন। ভাববাদী যিশাইয় তাকে নিশ্চয়তা দেন যে, আসিরিয়া যিরূশালেম ঘেরাও বা দখল করতে সক্ষম হবে না, বরং অন্যভাবে পরাজিত হয়ে চলে যাবে – এবং ঠিক তা-ই ঘটে। এখানে আমরা একটি চমৎকার উদাহরণ পাই: একজন রাজনৈতিক নেতা (রাজা হিষ্কয়) এবং একজন আত্মিক নেতা (ভাববাদী যিশাইয়) ঈশ্বরের উপর নির্ভর করতে পরস্পরকে সাহায্য করেন – এবং ঈশ্বরের দয়ায় একটি চমৎকার উদ্ধার ঘটে।
যিহূদার রাজা যোশিয় ৬৪০-৬০৯ খ্রীঃপূঃ ২ বংশাবলি ৩৪-৩৫
রাজা যোশিয় কেবল ৮ বছর বয়সে তার অতি মন্দ দাদু রাজা মনঃশি এবং তার মন্দ বাবা রাজা আমোন থেকে রাজত্ব পান। যখন তার বয়স ১৬ যোশিয় ঈশ্বরকে অন্বেষণ করতে এবং ২০ বছর বয়সে যিহূদা দেশে পুনঃসংস্কার করতে শুরু করেন। তিনি মনেপ্রাণে যিরূশালেম ও যিহূদা এলাকা থেকে প্রত্যেকটি দেবতাপূজারী দেবী, মূর্তি, পাথর, খুঁটি, উঁচু স্থান, মন্দির, মন্দির বেশ্যা, মন্দির পুরোহিত, বাচ্চা পোড়ানোর স্থান, ভূতের মাধ্যম বা যাদুকর ধ্বংস করতে থাকেন। তিনি অত্যন্ত আগ্রহ ও যত্নসহকারে যা তার অধীনে নয় (ইফ্রয়িম ও নপ্তালী বংশের এলাকা) এমন এলাকা পর্যন্তও পুনঃসংস্কার করতে থাকেন। তিনি ইস্রায়েলের বৈথেল শহরের বাছুর পূজার বেদীও ধ্বংস করেন, যা ইস্রায়েলের প্রথম রাজা যারবিয়াম-১ স্থাপন করেছিলেন। এভাবে যিহূদার একজন ভাববাদী দ্বারা ঘোষিত ৩০০ বছর আগের ভাববাণী পূর্ণ হয় (১ রাজা ১৩:২)। যখন যোশিয়ের বয়স ২৪ বছর, সেই সময় তিনি টাকা জমিয়ে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর পরিষ্কার ও মেরামত করেন। সেই সময় উপাসনা-ঘরে মোশির আইন-কানুনের গুটানো বই বা স্ক্রল পাওয়া যায়। এতে বুঝা যায় যে, রাজা মনঃশি ও রাজা আমোনের রাজত্বকালীন অবস্থা এমন হয়েছিল যে, যিহূদা লোকেরা আর জানত না ঈশ্বরের আইন-কানুন বলতে কিছু আছে! রাজা যোশিয়কে যখন আইন-কানুনের স্ক্রল পড়ানো হয় তখন তিনি ভেঙ্গে পড়েন এবং চোখের জল ফেলে ঈশ্বরের কাছে অনুতপ্ত হন। রাজা যোশিয় ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে আগ্রহী ছিলেন এবং তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছামত মনেপ্রাণে কাজ করেন বলে মহিলা ভাববাদী হুল্দা তাকে একটি ব্যক্তিগত আশাবাণী দেন, যদিও যিহূদা দেশের বিচারের নিশ্চয়তাও তিনি ঘোষণা করেন। যোশিয় মাত্র ৪০ বছর বয়সে মারা যান এবং তার মৃত্যুর পরে যিহূদা বেশ তাড়াতাড়ি দেবতাপূজায় ফিরে যায়। কিন্তু তারপরেও যিহূদার সব রাজাদের মধ্যে যোশিয় হলেন একমাত্র রাজা যাকে সম্পূর্ণভাবে “দায়ূদের মত” বলা হয়। ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি, মনেপ্রাণে বাধ্যতা এবং ঈশ্বরের প্রতি আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে যোশিয় প্রকৃতপক্ষে হলেন একজন অদ্বিতীয় রাজা।
ইচ্ছুকদের সমাজ
একটি বিষয়, যা রাজাবলি পুস্তকে তেমন প্রকাশ পায় না কিন্তু বংশাবলি পুস্তকে খুব পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়, তা হল: যদিও একটি জাতি বা দেশ মন্দতার পথে এগিয়ে যাচ্ছে তবুও সেই দেশে অবস্থিত ঈশ্বর ভক্ত ব্যক্তিরা বিপরীত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যদি তারা দেশের খারাপ পরিস্থিতিতেও ঈশ্বরকে অন্বেষণ করে এবং তাঁর প্রতি বাধ্য হয় তবে ঈশ্বর তাদের জন্য একটি উদ্ধারের পথ খুলে দেবেন।
উত্তরের ইস্রায়েল রাজ্যের প্রথম রাজা যারবিয়াম-১ যখন ইস্রায়েল দেশকে একটি মিশানো ধর্মের বাছুর পূজার ভিত্তিতে স্থাপন করেন, সেই সময় অনেক ঈশ্বর ভক্ত ও বিশ্বস্ত পুরোহিত ও লেবীয়েরা তাদের শহর ও উত্তরাধিকার ত্যাগ করে দক্ষিণের যিহূদা দেশে চলে আসেন “ইস্রায়েলের সমস্ত এলাকার পুরোহিত ও লেবীয়েরা তাঁর পক্ষে ছিলেন। লেবীয়েরা তাদের পশু চরাবার মাঠ ও সম্পত্তি ত্যাগ করে যিহূদা ও যিরূশালেমে চলে আসল, কারণ যারবিয়াম আর তাঁর ছেলেরা সদাপ্রভুর পুরোহিতের পদ থেকে তাদের বাতিল করে দিয়েছিলেন” (৯৩১-৯২৮ খ্রীঃপূঃ, ২ বংশা ১১:১৩)। যদিও তাদের অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয় তবুও তাদের সিদ্ধান্তের প্রজ্ঞা ভবিষ্যতে প্রমাণিত হয়: ইস্রায়েল ধ্বংস হয়ে যায় এবং তার লোকসংখ্যা কখনও নির্বাসন থেকে ফিরে আসে না।
রাজা যারবিয়াম-১এর সময়ে যেমন ইস্রায়েলের ভক্তরা যিহূদা দেশে চলে আসে, প্রায় সেই রকম রাজা আসার সময়ও ঘটে (২ বংশা ১৫:৮, প্রায় ৯১১-৮৭০ খ্রীঃ) এবং পরবর্তীতে প্রায় একইভাবে রাজা হিষ্কিয়ও উত্তর এলাকার বাকি লোকদের আমন্ত্রণ করেন (২ বংশা ৩০:১০-১২, ৭১৫-৭০১ খ্রীঃপূঃ)।
এভাবে কম পক্ষে ৩টি সময়ে ইচ্ছুকমনা ও খোলা হৃদয়ের লোকেরা সুযোগ পায়, যিহূদা দেশে চলে আসতে, সেখানে ঈশ্বরের আহ্বান, অনুমোদন ও ভবিষ্যৎ আশা রয়েছে। পরে দেখা যায় যে, যদিও যিহূদাকেও নির্বাসিত করা হয় তবে বাবিলে নির্বাসন থেকে প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে যাওয়া সুযোগ আসবে। ইষ্রার পাঠকেরা হলেন ঠিক সেই ধরণের ইচ্ছুক হৃদয়ের লোক, যারা ঈশ্বরের বাক্যের উপরে বিশ্বাস রেখে বাবিলে অনেক কিছু ত্যাগ করে যিহূদা দেশে ফিরে এসেছেন। ইষ্রা তাদের উৎসাহিত করে নিশ্চয়তা দেন যে, ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা তাদেরই উপরে রয়েছে এবং ঈশ্বর তাদের উৎসর্গ, কাজ ও ত্যাগ-স্বীকার নিঃষ্ফল হতে দেবেন না।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।