বিচারকর্তৃগণ পুস্তক হল ইস্রায়েলের ইতিহাসের বর্ণনা: যিহোশূয়ের সময় থেকে ইস্রায়েল রাজতন্ত্রে পরিণত হওয়া পর্যন্ত ১২জন বিচারক-উদ্ধারকর্তা ইস্রায়েলকে নেতৃত্ব দেন। ইস্রায়েল জাতি ঈশ্বরকে ও তাঁর আইন-কানুন অগ্রাহ্য করে আত্মিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে খারাপ থেকে আরো খারাপ অবস্থায় পতিত হয়।
বিচারকর্তৃগণ পুস্তক ইস্রায়েলের প্রায় ৩৫০ বছরের ইতিহাস বর্ণনা করে, যিহোশূয়ের মৃত্যু থেকে এমন সময় পর্যন্ত যখন ইস্রায়েল একটি রাজতন্ত্রে পরিণত হয় (১৩৮০-১০৪৩ খ্রীঃপূঃ)। পুস্তকটিতে লেখক নিজের পরিচয় দেন না এবং যিহূদী ঐতিহ্য থেকেও লেখক সম্বন্ধে কোন পরিষ্কার সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু ভাববাদী শমূয়েলকে, অথবা ভাববাদী নাথন বা গাদকে সম্ভাব্য লেখক হিসাবে ধারণা করা হয়।
বিচারকর্তৃগণ পুস্তকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থপূর্ণ বাক্য আছে, যা ৪বার পুনরুক্তি করা হয় (বিচার ১৭:৬, ১৮:১, ১৯:১, ২১:২৫): “তখনও ইস্রায়েলীয়দের মধ্যে কোন রাজা ছিল না। যে যা ভাল মনে করত সে তা-ই করত”। এই পুনরুক্তি থেকে বুঝা যায় যে, পুস্তক লেখার সময়ে ইস্রায়েলে ইতিমধ্যে রাজাদের রাজত্ব চলছে, তাই পুস্তকটি ১০৪৩ খ্রীষ্টপূর্বের পরে লেখা। চিন্তা করা যায় যে, বিচারকর্তৃগণ ঠিক এই রাজাদের উদ্দেশ্যেই লেখা হয়েছে, যেন বিচারকর্তৃগণ পুস্তকে উল্লিখিত খারাপ ঘটনাগুলো রাজতন্ত্রের সময়ে পুনরায় না ঘটে। সম্ভাবনা বেশি যে, ভাববাদী শমূয়েল নতুন রাজা শৌল এবং দায়ূদকে শিক্ষা ও শিষ্যত্ব দেওয়ার জন্য এই পুস্তক লেখেন। এছাড়া ইস্রায়েলের নেতাদের এবং লোকদের শিক্ষা ও শিষ্যত্ব দেওয়ার জন্যও পুস্তকটি লেখা।
বিচারকর্তৃগণ পুস্তক শুরু হয় যেখানে যিহোশূয় পুস্তক শেষ হয়েছে: কনানে ৭টি জাতির উপর যিহোশূয়ের জয় এবং কনান ইস্রায়েলের অধীনে আছে। বড় জয় অর্জন করা হয়েছে, শত্রুকে পরাজিত করা হয়েছে এবং ইস্রায়েলের সামনে অধিকার করার জন্য পড়ে আছে প্রতিজ্ঞাত দেশ। কিন্তু দেখা যায় যে, দেশের অধিকার নেওয়া এবং শহরে শহরে বাস করতে শুরু করা হল চিন্তার চেয়েও কঠিন। ইস্রায়েলীয়েরা তেমন বেশি এগিয়ে আসে না এবং ফলে অনেক কনানীয়েরা, যাদের মেরে ফেলা হয় নি বরং তাড়ানো হয়েছে, তারা ধীরে ধীরে ফিরে এসে শহরে শহরে ও গ্রামে গ্রামে আবার বাস করতে শুরু করে।
ইস্রায়েল যতবার যুদ্ধে নামে এবং একটি এলাকা দখল ও অধিকার নেওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালায়, ততবারই তারা জয় করে (বিচার ১:৩-২৬)। কিন্তু অনেক বার তারা তা করে না এবং অনেক শহরে কনানীয়েরা বাস করতে থাকে অথবা ফিরে এসে আবার বাস করতে শুরু করে (বিচার ১:২০,২১,২৭,২৯,৩১,৩৩-৩৬)। ঈশ্বর আদেশ দিয়েছিলেন কনানীয়দের তাড়াতে এবং তিনি তাদের সাথে বাস করতে নিষেধ করেছিলেন (দ্বিতীয় বিবরণ ৭:২-৪), কিন্তু ইস্রায়েল তা সম্পূর্ণভাবে পালন করে না। ঠিক বিপরীত ঘটে: ইস্রায়েলীয়েরা মাত্র কনানীয়দের সাথে বাস করা শুরু করে, এমন কি তারা তাদের সাথে বিয়ে করে মিশেও যায়। এভাবে তারা ধীরে ধীরে কনানীয় প্রতিমা-পূজা করতে শুরু করে, যার বিষয়ে ঈশ্বর তাদেরকে কঠোর সাবধাণবাণী দিয়েছিলেন।
একটি খারাপ চক্র চলতে শুরু করে: ইস্রায়েল জাতি ঈশ্বরকে অগ্রাহ্য করে এবং তাঁর আইন-কানুন অমান্য করে প্রতিমা-পূজা শুরু করে। এভাবে তারা ঈশ্বরের সঙ্গে চুক্তি ভাঙ্গে এবং যে ফলাফল ঈশ্বর তাদেরকে দ্বিতীয় বিবরণ ২৮ অধ্যায়ে সাবধান করেছিলেন, ঠিক সেগুলোই ঘটতে শুরু করে: নৈতিকতা ভেঙ্গে যায়, সামাজিক অন্যায় দেখা দেয় এবং রাজনৈতিক দুর্বলতা শুরু হয়। চারিদিকের জাতিরা উঠে এসে ইস্রায়েলকে বার বার লূটপাট করে, তাদের পরাজিত, নিয়ন্ত্রণ ও অত্যাচার করে।
ইস্রায়েল জাতি কষ্টের সময়ে ঈশ্বরের কাছে ফিরে এসে কান্না করে করুণা চায়। ঈশ্বর বিশ্বস্তভাবে সাড়া দেন এবং তাদের জন্য একজন বিচারক দাঁড় করান, যিনি অত্যাচারী জাতিকে পরাজিত করে তাদের উদ্ধার করেন। উদ্ধার পেয়ে ইস্রায়েল কিছু বছর শান্তিতে বাস করে কিন্তু পরবর্তীতে তারা আবারও প্রতিমা-পূজায় নামে এবং সেই খারাপ চক্র আবারও শুরু হয়। চক্র যতবার ঘুরে আসে ততবার অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে যেতে থাকে। চক্রটি যত চলতে থাকে বিচারকদের যোগ্যতাও তত কমে যায়, ভাল নেতা পাওয়া ঈশ্বরের জন্য আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অৎনীয়েল, দবোরা ও বারকের আসলে ঈশ্বরীয় চরিত্র আছে, কিন্তু শীঘ্রই অন্য ছবি দেখা যায়: গিদিয়োনের চরিত্র হল মোটামুটি, যিপ্তহের চরিত্র হল সমস্যাগ্রস্ত, শিমশোনের চরিত্র হল দুঃখ ও লজ্জার বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিচারকর্তৃগণ পুস্তকে তিনটি বিশেষ ঘটনার বর্ণনা আছে (case studies) যা দ্বারা লেখক ইস্রায়েল দেশে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যাওয়ার ফলাফল দেখান। প্রথম ঘটনা হল, গিদিয়োনের ছেলে অবীমেলক, যিনি অনেক রক্তপাত দ্বারা নিজেকে স্থানীয় রাজা হিসাবে দাবি করেন। দ্বিতীয় ঘটনা হল, একটি দরিদ্র লেবীয়ের গল্প, যিনি প্রথমে একটি পরিবারের এবং শেষে হিংস্র দান বংশের প্রতিমা-পূজার পুরোহিত হয়ে যান। শেষ ঘটনা বিন্যামীন বংশের গিবিয়া শহরে ঘটে, যেখানে সদোম ও ঘমোরার মত নির্যাতনকারী যৌনতা রাজত্ব করে। বিন্যামীন বংশের নেতারা গিবিয়ার ধর্ষণের ঘটনা বিচার করতে অগ্রাহ্য করে। লেবীয় বংশের একটি প্রতিহিংসাপ্রবণ লেবীয় সমস্যাটি এমনভাবে উষ্কিয়ে দেয় যে, তা ইস্রায়েলে একটি ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। ইস্রায়েল জাতি আত্মিক দিক দিয়ে, নৈতিক দিক দিয়ে এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে পচে গেছে। একটি ভয়ংকর জিনিস দেখা যায় যে, ইতিমধ্যে ইস্রায়েল কনানীয় জাতির মত হতে শুরু করেছে।
বিচারকর্তৃগণ পুস্তকের লেখক এবং লেখার তারিখ
বিচারকর্তৃগণ পুস্তকে ইস্রায়েল জাতির প্রায় ৩৫০ বছরের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে, যিহোশূয়ের মৃত্যু থেকে ইস্রায়েল রাজতন্ত্রে পরিণত হওয়া পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৩৮০ থেকে ১০৪৩ খ্রীষ্টপূর্ব পর্যন্ত। পুস্তকের লেখক নিজের পরিচয় দেন না এবং যিহূদী ঐতিহ্যগুলোও লেখকের পরিচয়ের বিষয়ে পরিষ্কার না। সম্ভবত ভাববাদী শমূয়েল পুস্তকটি লিখেছেন, যিনি ইস্রায়েলের আত্মিক নেতা যখন তারা রাজতন্ত্র দাবি করে – যদিও শমূয়েল এতে রাজি নন। অন্যান্য সম্ভাব্য লেখক হলেন ভাববদী নাথন বা গাদ। শমূয়েল, নাথন ও গাদ, তিনজনের সম্বন্ধে বংশাবলি পুস্তকে বলা হয়েছে যে, তারা ইস্রায়েল ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতেন (১ বংশা ২৯:২৯)।
বিচারকর্তৃগণ পুস্তকে একটি বাক্য ৪বার পুনরুক্তি করা হয়েছে: “তখনও ইস্রায়েলীয়দের মধ্যে কোন রাজা ছিল না। যে যা ভাল মনে করত সে তা-ই করত” (বিার ১৭:৬, ১৮:১, ১৯:১, ২১:২৫)। এই বাক্যের অবশ্যই গুরুত্ব আছে, কিন্তু এর অর্থ কি? বাক্য থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, বিচারকর্তৃগণ পুস্তক লেখার সময়ে ইস্রায়েলে ইতিমধ্যে রাজাদের রাজত্ব চলছে যদিও বর্ণিত ঘটনার সময় রাজা ছিল না। তাই আমরা বুঝতে পারি যে, বিচারকর্তৃগণ পুস্তক ১০৪৩ খ্রীষ্টপূর্বের পরে, অর্থাৎ শৌল রাজা হওয়ার পরে লেখা। এই বাক্য থেকে আরো ইঙ্গিত আসে যে, বিচারকর্তৃগণ পুস্তক লেখার একটি উদ্দেশ্য হল, ঠিক সেই রাজাদের (বা ইস্রায়েলের নেতাদের) নির্দেশনা দেওয়া, বিচারকর্তৃগণ পুস্তকে বর্ণিত খারাপ ঘটনাগুলো যেন তাদের রাজত্বেও না ঘটে। হয়তো বিচারকর্তৃগণ পুস্তক হল রাজা শোলকে এবং পরবর্তীতে রাজা দায়ূদকে শিক্ষা ও শিষ্যত্ব দান করতে ভাববাদী শমূয়েলের প্রচেষ্টা। বিচারকর্তৃগণ ১:২১ পদে যিরূশালেম শহর সম্বন্ধে একটি তথ্য দেওয়া হয় যে, যিবুষীয়রা ও বিন্যামিন গোষ্ঠির লোকেরা “সেখানে বাস করছে” । ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, দায়ূদ তার রাজত্বের শুরু দিকে (প্রায় ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বে) যিরূশালেম শহর দখল করেন এবং যিবুষীয়দের তাড়িয়ে দেন, তাই সেই সময় থেকে কথাটি আর প্রযোজ্য হবে না। একারণে বুঝা যায় যে, বিচারকর্তৃগণ পুস্তকটি যিরূশালেম দখলের আগে, অর্থাৎ ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বের আগে লেখা হয়েছিল।
ইস্রায়েল দেশের অবস্থা
বিচারকর্তৃগণ পুস্তক শুরু হয় যেখানে যিহোশূয় পুস্তক শেষ হয়েছে: যিহোশূয় কনান দেশ দখল ও জয় করেছেন, ৭টি কনানীয় জাতি সম্পূর্ণ পরাজিত অথবা তাড়ানো হয়েছে এবং কনান দেশ ইস্রায়েল জাতির সামনে অধিকার করার জন্য পড়ে আছে “গোটা দেশটি ইস্রায়েলীয়দের অধীনের আনা” হয়েছে (যিহোশূয় ১৮:১)।
কিন্তু দেশটি অধিকার করা, স্বক্রিয়ভাবে জমি নিজস্ব হিসাবে নেওয়া, শহরে শহরে বাস করা, দেখা যায় যে, এসব চিন্তার চেয়েও কঠিন এবং ইস্রায়েলীয়েরা তা নিয়ে “দেরি” করে (যিহোশূয় ১৮:৩)। ফলে তাড়ানো কনানীয়েরা ধীরে ধীরে তাদের শহরে ও গ্রামে ফিরতে শুরু করে। তাই বুঝা যায় যে, যদিও ইস্রায়েল সার্বিকভাবে জয় করেছিল এবং অনেক লোকদের মেরেও ফেলেছিল তবুও কনানীয়দের বড় একটি অংশ বিনষ্ট না করে বরং তাড়ানো বা তাৎক্ষনিকভাবে সরানো হয়েছিল। এর অর্থ এই: ইস্রায়েলীয়দের চাপ বা শক্তি যে মুহূর্তে শিথিল হয়ে যাবে, সেই মুহূর্তে কনানীয়েরা আগের স্থানে ফিরে আসবে।
বিচারকর্তৃগণ পুস্তকে দেখা যায় যে, যতবার ইস্রায়েলীয়েরা উদ্যোগ নিয়ে শহর ও জায়গাগুলো স্বক্রিয়ভাবে তাদের অধীনে নিয়ে আসতে চেষ্টা করে, ততবার তারা যুদ্ধে জয় করে এবং তা করতে সক্ষম হয় (বিচার ১:৩-২৬)। অধিকার করার প্রক্রিয়া যে এক মুহূর্তে হয় না, তা আসলে কোন সমস্যা নয়, বরং ঈশ্বর আগে থেকে তা-ই বলেছিলেন: “তোমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভুই তোমাদের সামনে থেকে ঐ সব জাতিকে আস্তে আস্তে তাড়িয়ে দেবেন। তাদের সবাইকে তোমরা একসংগে তাড়িয়ে দেবে না, কারণ তাহলে তোমাদের চারপাশে বুনো জানোয়ারের সংখ্যা বেড়ে যাবে” (দ্বিতীয় বিবরণ ৭:২২, যাত্রা ২৩:৩০)। এর অর্থ এই যে, ইস্রায়েলের জন্য সমর্পিত হয়ে অধিকার করার কাজে লেগে থাকাই যথেষ্ট। কিন্তু বাস্তবে তারা তা করে না এবং অনেক শহর ও গ্রামগুলোতে ধীরে ধীরে কনানীয়েরা ফিরে আসতে থাকে। ফলে ইস্রায়েল সেখানে কনানীয়দের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করে (বিচার ১:২গ,২১,২৭,৩১,৩৩-৩৬)। প্রকৃতপক্ষে শেষে দেখা যায় যে, ইস্রায়েল জাতি প্রতিজ্ঞাত দেশ বা প্রতিজ্ঞাত এলাকার শুধুমাত্র অর্ধেকই বাস্তবে তাদের অধীনে নিয়ে আসে। তারা পাহাড়ি এলাকাগুলো নিজেদের অধিকারে রাখতে পারে কিন্তু সমতল এলাকাগুলোর বেশিরভাগই তারা হারায়। মানচিত্রতে তা দেখানো হয়েছে: লাল এলাকাগুলো ইস্রায়েলীয়েরা অধিকার করে নেয়, সবুজ এলাকাগুলো প্রতিজ্ঞাত দেশের অংশ কিন্তু সেগুলো তারা বাস্তবে নিজেদের অধীনে আনতে পারে নি।
বিচারকর্তৃগণের লেখক শেষে বলেন যে, “সমভূমি থেকে লোকদের তাড়িয়ে দিতে পারে নি, কারণ তাদের লোহার রথ ছিল” (বিচার ১:১৯)। অবশ্যই কনানীয়দের রথ ছিল এবং তাও ঠিক যে, সমভূমিতে রথগুলো থাকার বিষয় সবচেয়ে বেশি পার্থক্য করে, কিন্তু যিহোশূয় সেই রথ ও ঘোড়াযুক্ত সৈন্যদলকে পরাজিত করেছিলেন এবং তিনি ইস্রায়েলীয়দের বলেছিলেন যে, “কনানীয়দের লোহার রথ থাকলেও এবং তারা শক্তিশালী হলেও তোমরা তাদের তাড়িয়ে দেবে” (যিহোশূয় ১৭:১৮)। এছাড়া বিচারকর্তৃগণ পুস্তকের পরবর্তী ঘটনাগুলোতে দেখা যায় যে, বিচারক দবোরা ও বারাক পায়ে হেটে ৯০০ রথের একটি সৈন্যদলকে আক্রমণ করেন এবং তাদের উপরে জয়লাভ করেন (বিচার ৪:১২-১৬)।
এভাবে ইস্রায়েল জাতি কনানীয়দের ধ্বংস করার ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে (দ্বিতীয় বিবরণ ৭:২-৪)। কিন্তু তার চেয়ে, ইস্রায়েলীয়েরা কনানীয়দের সাথে শুধুমাত্র বাস করতে শুরু করে না, এমন কি তারা তাদের সাথে বিয়ে করতে ও মিশে যেতেও শুরু করে। ফলে তারা ধীরে ধীরে কনানীয় দেবতাপূজায় লিপ্ত হয় “ইস্রায়েলীয়েরা … তাদের মেয়েদের বিয়ে করত এবং নিজেদের মেয়েদের তাদের ছেলেদের সংগে বিয়ে দিত আর তাদের দেব-দেবতাদের পূজা করত” (বিচার ৩:৫-৬)। ঈশ্বর তাদেরকে ঠিক এই বিষয়ের বিরুদ্ধে মোশির মধ্য দিয়ে কঠোর সাবধাণবাণী দিয়েছিলেন ।
তাদের এই অবাধ্যতা দেখে ঈশ্বর বলেন: “আমি তোমাদের কাছ থেকে এই লোকদের তাড়িয়ে দেব না; তারা তোমাদের জন্য ফাঁদ হবে, কারণ তোমরা তাদের দেব-দেবতাদের ফাঁদে পড়বে … আমি যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলাম তা এরা পালন করে নি … সেইজন্য যিহোশূয় মারা যাবার সময়ে যে সব জাতি দেশে রয়ে গেছে তাদের আমি ইস্রায়েলীয়দের সামনে থেকে তাড়িয়ে দেব না” (বিচার ২:৩,২০-২১)। ইস্রায়েলীয়েরা তাদের এই অবহেলা ও পাপ দ্বারা একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। তাদের অবাধ্যতা দেখে ঈশ্বর যিহোশূয়ের কাছে দেওয়া ‘আবশ্যক জয়ের প্রতিজ্ঞা’ তুলে নেন, এখন থেকে সম্পূর্ণ প্রতিজ্ঞাত দেশ অধিকার করার নিশ্চয়তা আর নেই, ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত অধিকার পাওয়ার আশা আর নেই।
কিন্তু ঈশ্বর পাপ দ্বারা তৈরি এই নতুন বাস্তবতাকে আবারও মঙ্গলেরদিকে ব্যবহার করেন: “ইস্রায়েলীয়দের বংশধরেরা যারা আগে কোন দিন যুদ্ধ করে নি তাদের যুদ্ধের ব্যাপারে শিক্ষিত করে তুলবার জন্য তিনি তা করেছিলেন … সদাপ্রভু … যে আদেশ দিয়েছিলেন তা এই ইস্রায়েলীয়েরা মেনে চলে কি না তা পরীক্ষা করবার জন্য এই সব জাতিকে রেখে দেওয়া হয়েছিল” (বিচার ২:২২, ৩:২,৪)। ঈশ্বর দয়ালু বলে আশা আছে এবং বাধ্য হওয়ার সুযোগও রয়েছে। দেশের উপর অধিকার ধরে রাখা আরো অনেক জটিল, বিভ্রান্তিকর ও কঠিন হয়ে গেছে, কিন্তু অসম্ভব নয়। ইস্রায়েল জাতিকে আরো শিক্ষিত ও দক্ষ করে তোলার উদ্দেশ্যে ঈশ্বর এই বাস্তবতা ব্যবহার করতে চান, কিন্তু তাদেরকেও তা চাইতে হবে। দেখা যায় যে, তারা বেশি ইচ্ছুক নয়।
বিচারকর্তৃগণের চক্র
ফলে ইস্রায়েলের ইতিহাসে একটি দুঃজনক চক্র চলতে শুরু করে: ইস্রায়েল আইন-কানুনে অবাধ্য হয়, দেবতাপূজায় আসক্ত হয় ও এভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে চুক্তি ভাঙ্গে। পরবর্তীতে তার খারাপ ফলাফল দেখা যায়, যেমন দ্বিতীয় বিবরণ ২৮ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে: অনৈতিকতা, সামাজিত অন্যায় ও রাজনৈতিক দুর্বলতা। চারিদিকের জাতিগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং ইস্রায়েলীয় জাতিকে দখল, লুটপাট, অত্যাচার ও দমন করতে শুরু করে। কষ্টের সময়ে ইস্রায়েল অনুতপ্ত হয় এবং ঈশ্বরের কাছে কান্না করে করুণা চায়। ঈশ্বর বিশ্বস্তভাবে তাদের জন্য শাসনকর্তাদের “দাঁড় করাতেন” যারা “লুটকারীদের হাত থেকে ইস্রায়েলকে রক্ষা করতেন”। ফলে শান্তির একটি সময় হয়। কিন্তু কিছু বছরের মধ্যে ইস্রায়েল আবারও পাপ করতে শুরু করে এবং এভাবে চক্র চলতে থাকে। এই শাসনকর্তাদের ‘বিচারক’ বলা হত (তাই পুস্তকের নাম ‘বিচারকর্তৃগণ’)।
প্রকৃতপক্ষে ধীরে ধীরে চক্র আরো খারাপের দিকে যেতে থাকে: যত বছর পার হয় অত্যাচারীদের হাতে পড়লেও তারা ঈশ্বরকে ডাকতে তত দেরি করে, বিশ্রামের বা সুঅবস্থার সময় কমতে থাকে এবং বিচারকদের চরিত্রের মান ও ঈশ্বরের প্রতি তাদের ভক্তিও কমতে থাকে। যত সময় আগাচ্ছে ঈশ্বরের জন্য একজন যোগ্য নেতা খুঁজে পেতে আরো কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমদিকের বিচারক অৎনীয়েল, দবোরা ও বারকের চরিত্র ঈশ্বরীয়, কিন্তু পরবর্তীতে বিচারক গিদিয়োনের চরিত্র মিশানো একটি ছবি, বিচারক যিপ্তহের চরিত্র হল জটিল ধরণের এবং বিচারক শিমশোনের চরিত্র দুঃখের বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়।
সরকারের ভূমিকায় বিচারকেরা
মোশির মাধ্যমে ঈশ্বর আত্মিক ক্ষেত্রে ইস্রায়েল জাতিকে একটি কেন্দ্রীয় আরাধনা দান করেছিলেন: তাদের ধর্মীয় কেন্দ্র হল আবাস-তাম্বু, যেখানে যাজকেরা উপস্থিত, যেখানে উৎসর্গ দেওয়া হয় এবং যেখানে বছরে তিন বার ইস্রায়েল একত্রিত হয়ে জাতীয় পর্ব পালন করে। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে একটি বিকেন্দ্রিক পদ্ধতি দিয়েছেন: ইস্রায়েলীয়েরা শহরে শহরে এবং গ্রামে গ্রামে নিজেদের প্রতিনিধি (কর্মচারী ও বিচারক) নিযুক্ত করে। ইস্রায়েলের কোন কেন্দ্রীয় সরকার ছিল না, কোন রাজধানী, কেন্দ্রীয় প্রশাসন বা স্থায়ী সৈন্যদল ছিল না। প্রত্যেক বংশ নিজেদের বিষয় দেখাশোনা করত। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইস্রায়েল হল ইচ্ছুক স্বচালিত ১২ বংশের একটি ঢিলা জোট, যা আত্মীয়তা, ধর্ম ও আইন-কানুন দ্বারা সংযুক্ত। চারিদিকের দেশগুলোতে ছিল কেন্দ্রীয় ধরণের সরকার, যেমন মিসর, যেখানে ফরৌণই সব কিছু। কিন্তু ঈশ্বর তা ইস্রায়েলের জন্য চান নি (আদি ১৭:১৬ ও ৩৫:১১ পদ দেখুন)।
আধুনিক যুগের মানুষ হিসাবে আমরা এটা দুর্বল, অগোছালো ও অকার্যকারী সরকার মনে করি। কিন্তু সাবধান: ঈশ্বর পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেছেন যে, কেন্দ্রীয় রাজতন্ত্রের চেয়ে তিনি এইটি চান: ঈশ্বর ইস্রায়েলকে কোন কেন্দ্রীয় সরকার, স্থায়ী সৈন্যদল এবং অবশ্যই কোন স্থায়ী রাজপরিবার দেন নি। সংকট বা আক্রমণের সময় ঈশ্বর ইস্রায়েলের জন্য একজন শক্তিশালী ও জয়ী বিচারক-শাসনকার্তা দাঁড় করবেন, কিন্তু সেই বিচারকও স্থায়ী কোন সরকার চালাবেন না।
গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করুন যে, ঈশ্বর কোন বংশ থেকে বিচারকদের দাঁড় করাতেন? অৎনীয়েল হলেন যিহূদা বংশের, এহূদ হলেন বিন্যামিন বংশের, দবোরা হলেন ইফ্রয়িম বংশের, বারক হলেন নপ্তালী বংশের, গিদিয়োন হলেন পশ্চিম মনঃশি বংশের, যিপ্তহ হলেন গাদ বংশের এবং শিমশোন হলেন দান বংশের। যতদিন ধরে ঈশ্বরই ইস্রায়েল জাতির নেতাদের পছন্দ করেন, ততদিন তিনি অল্প সময়ের জন্য এবং একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য বিভিন্ন বংশ থেকে এমন শাসনকর্তা দাঁড় করাতেন যাদেরকে পরবর্তীতে আবার বাদ দেওয়া যায়।
ইস্রায়েল রাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে
ঈশ্বর ইস্রায়েলকে একটি গণতন্ত্র হিসাবে স্থাপন করেছিলেন, অর্থাৎ জনগণ স্থানীয় নেতা নিযুক্ত করে (দ্বিতীয় বিবরণ ১:৯-১৮)। কিন্তু বিচারকর্তৃগণ পুস্তকে দেখা যায় যে, লোকেরা অন্য জাতিদের মত রাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে, যত সময় যায় তত বেশি। গিদিয়োনের জয়ের পরে ইস্রায়েলীয়েরা তার কাছে গিয়ে বলে: “আপনি মিদিয়নীয়দের হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করেছেন, সেইজন্য আপনি ও আপনার বংশধরেরাই আমাদের শাসনকর্তা হন” (বিচার ৮:২২)। কথাটি অবশ্যই বোকামি, কারণ একটি রাজবংশ যদি ৩ প্রজন্ম ধরে ক্ষমতায় থাকে তবে চতুর্থ প্রজন্মের নেতাকে ক্ষমতা থেকে কিভাবে সরানো সম্ভব?
গিদিয়োন এই আবেদনের উত্তরে ঈশ্বরের ইচ্ছা ও পথ সম্বন্ধে অনেক জ্ঞান প্রকাশ করেন “আমরা কেউ তোমাদের শাসনকর্তা হব না- আমিও না, আমার ছেলেও না; সদাপ্রভুই হবেন তোমাদের শাসনকর্তা” (বিচারক ৮:২৩)। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল যে, পরবর্তীতে গিদিয়োনের দেবতাপূজা ও বহুবিবাহের মধ্য দিয়ে কম যোগ্য সন্তান জন্ম নেয়। তার একজন ছেলে, অবীমেলক যিনি ক্ষমতা ধরে নিজেকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করেন। তা করার জন্য তিনি ভাইদের খুন, নির্দোষদের রক্তপাত, স্বেচ্ছায় আক্রমণ, জনগণের বিরুদ্ধে খারাপ ব্যবহার এবং ইস্রায়েলের পশ্চিমা বংশের মধ্যে একটি যুদ্ধও ঘটান (বিচার ৯)। অবীমেলকের রাজত্ব শুধুমাত্র তিন বছর স্থায়ী থাকে কিন্তু সেই তিন বছরে তিনি অনেক সীমানা পার হয়ে যথেষ্ট ক্ষতি করেন। তার কারণে ইস্রায়েলের ইতিহাসে প্রথম বার:
- টাকা দিয়ে সৈন্যদল নিয়োগ করা হয় (আগেসেনা নিয়োগ সব সময় স্বেচ্ছায় ছিল)।
- একজন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খুন করার জন্য একটি সৈন্য দল ব্যবহার করা হয়।
- একজন নেতা ক্ষমতায় আসায় ঈশ্বরের কোন হাত নেই।
- একজন নেতা ক্ষমতায় আসেন এমন একটি সময়ে যখন জাতি কোন হুমকির সম্মুখীন নয়।
- সৈন্যদল নিয়োগে একটি মন্দির থেকে টাকা নেওয়া হয়, এবং দেবতাপূজার মন্দির থেকে তা নেওয়া হয়।
- ইস্রায়েলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাবা থেকে ছেলের কাছে চলে আসে, অর্থাৎ রাজত্ব করার অধিকার পারিবারিক বিষয় হিসাবে দেখা হয়।
- ইস্রায়েলের একটি সৈন্যদল নিজের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়।
অবীমেলক এগুলো সব ঘটান এবং তা ভবিষ্যতের উপরে একটি খারাপ প্রভাব ফেলে।
বংশদের মধ্যে একতা ভাঙ্গার পথে
যিহোশূয় পুস্তকে বংশদের মধ্যে একতা ও বিশ্বস্ততা দেখা যায়: যর্দনের পূর্বের বংশগুলো তাদের প্রতিজ্ঞা অনুসারে পশ্চিমের বংশদেরকে কনান দেশ দখলে সাহায্য করে এবং যিহোশূয় তাদেরকে শান্তিতে ও কৃতজ্ঞতায় বিদায় দেন (যিহোশূয় ২২:১-৬)। বংশগুলোর মধ্যে যখন একটি বেদী নিয়ে খুব বড় ভুল বুঝাবুঝি হয় তখন বংশগুলো যথেষ্ট ত্যাগ-স্বীকার ও সততার মনোভাবে তা সমাধান করে (যিহোশূয় ২২:১০-৩৪)।
বিচারকর্তৃগণ পুস্তকে প্রথম বার একতা ভাঙ্গার চিহ্ন পাওয়া যায় যখন বিচারক দবোরা ও বারক অরামীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। যে বংশ সৈন্যদল পাঠিয়ে সাহায্য করেছিলেন দবোরা তার গানে তাদেরকে প্রশংসা করেন (ইফ্রয়ি, বিন্যামিন, সবূলূন, ইষাখর)। কিন্তু যে বংশ সৈন্যদল পাঠায় নি সেই বংশগুলোকে তিনি ধমক দেন (রূবেন, গাদ, দান, আশের, বিচার ৫)।
বিচারক গিদিয়োনের সময়ে প্রথম বড় সমস্যা হয় (বিচার ৮:১)। ইফ্রয়িম বংশ রাগ প্রকাশ করে বলে, কেন গিদিয়োন যুদ্ধে নামার সময় তাদেরকে ডাকেন নি, যদিও যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনি তাদের ডেকেছিলেন। গিদিয়োন এই অভিযোগে খুব নম্র ও সম্মান দেখানোর একটি উত্তর দিয়ে সবার রাগ কমাতে সক্ষম হন। এভাবে তিনি একটি গৃহযুদ্ধের হুমকি এড়িয়ে যান (বিচার ৮:২-৩৩)।
গিদিয়োনের ছেলে অবীমেলকের মধ্যে বাবার মত নম্রতা ও মাথা ঠাণ্ডা নেই। তিনি নিজেকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করেন এবং একটি গৃহযুদ্ধ ঘটান। যদিও তিনি তা শুধুমাত্র স্থানীয় পর্যায় করেন, তা হল খুব খারাপ একটি ঘটনা।
বিচারক যিপ্তহের সময় প্রথমবার বংশের বিরুদ্ধে বংশের যুদ্ধ ঘটে: আবারও ইফ্রয়িম রাগ ও অভিযোগ করে যে, তাদের যুদ্ধে ডাকা হয় নি। যিপ্তহ তাদের অভিযোগে রাজি নন। ফলে একটি অপ্রত্যাশিত গৃহ যুদ্ধ ঘটে যাতে চল্লিশ হাজারেরও বেশি ইফ্রয়িম বংশের সৈন্যদের মেরে ফেলা হয় (বিচার ১২:১-৬)।
বিচারকর্তৃগণ পুস্তকের শেষে একটি অতি খারাপ গল্প ঘটে। দ্বন্দ্ব শুরু হয় যখন বিন্যামিন বংশের নেতারা তাদেরই এলাকায় একটি অপরাধে শাস্তি দিতে অস্বীকার করেন, এমন কি অন্য বংশগুলো চাপ দেওয়ার পরেও তারা তা অস্বীকার করেন। এভাবে তারা একটি যুদ্ধ ঘটায় যাতে ত্রিশ হাজারেরও বেশি ইস্রায়েলীয় সেনাদের মেরে ফেলা হয় এবং বিন্যামিন বংশ প্রায় নির্মূল করা হয় (বিচার ১৯-২১)।
“তখনও ইস্রায়েলীয়দের মধ্যে কোন রাজা ছিল না”
বিচারকর্তৃগণ পুস্তকে ৪বার এই বাক্য পুনরুক্তি করা হয় “তখনও ইস্রায়েলীয়দের মধ্যে কোন রাজা ছিল না। যে যা ভাল মনে করত সে তা-ই করত” (বিচার ১৭:৬, ১৮:১, ১৯:১, ২১:২৫)। কিন্তু বাক্যটির অর্থ আসলে কি? সাধারণত আমরা তা এভাবে ব্যাখ্যা করি:
- যখন বংশদের মধ্যে একতা নেই এবং জাতিতে দ্বন্দ্ব চলে তখন সমস্যাটির সমাধান কি? > একজন শক্তিশালী, কার্যকারী, কেন্দ্রীয় সরকার।
- যখন চারিদিক থেকে শত্রুরা আক্রমণ করে তখন সমস্যাটির সমাধান কি? > একজন শক্তিশালী নেতা, একটি কার্যকারী কেন্দ্রীয় সরকার এবং উন্নত মানের একটি স্থায়ী সৈন্যদল।
- যখন জাতিতে অনৈতিকতা বাড়ে তখন সমস্যাটির সমাধান কি? > একজন শক্তিশালী আদর্শ নেতা যিনি জাতিকে অনুপ্রেরণা দিতে পারেন এবং তাদের আইন-কানুনে বাধ্য করতে সক্ষম হন।
যখন একটি দেশে বিভেদ, অনৈতিকতা, অনাচার ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে, যখন দিগন্তে শত্রু দেখা যায় তখন আমরা সবাই একজন শক্তিশালী নেতা চাই। এবং প্রথম দৃষ্টিপাতে বিচারকর্তৃগণ পুস্তক ঠিক তাই বলে মনে হয়: বিচারকদের যুগ ছিল সমস্যার, একজন রাজা তাদের চেয়ে ভাল করবেন। অনেকে পুস্তকটি ঠিক এভাবেই ব্যাখ্যা করে – এবং অবশ্যই আমরা সবাই ‘গুহায় দায়ূদের গল্প’ (১ শমূয়েল ২৪) বিচারকর্তৃগণ পুস্তকের শেষের গল্পগুলোর চেয়ে (বিচার ১৭-২১) পছন্দ করি।
কিন্তু শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার কি আসলেই আরো কার্যকারী? একজন শক্তিশালী নেতা কি প্রকৃতপক্ষে আরো ভাল করবেন? রাজারা কি বিচারকদের চেয়ে ভাল? রাজতন্ত্র কি আগের পদ্ধতির চেয়ে ভাল?
- অবশ্যই একজন ঈশ্বরীয় নেতা জাতিকে এক পরিমাণে অনুপ্রেরণা দিতে পারেন (যেমন রাজা দায়ূদ) এবং সবচেয়ে ভাল রাজারা তা হয়তো একটি সীমিত সময়ের জন্য করতে সক্ষম হন (যেমন রাজা যোশিয়)। কিন্তু ভাল রাজার ভাল দিকের প্রভাবের চেয়ে খারাপ রাজাদের খারাপের দিকে প্রভাব অনেক বেশি (যেমন রহবিয়াম, আহাব, আহস ও মনঃশি)।
- একটি জাতির অনৈতিকতা বা অনাচারের বিরুদ্ধে সরকার আসলে কি করতে পারে? আইন-কানুন দিয়ে একটি জাতিকে আইনে বাধ্য করানো যায় না। ভাল একটি সরকার খারাপ আচারণে শাস্তি দেয়, কিন্তু এর পরে আর কিছু করার নেই। আইন-কানুন কি আইন-কানুন পালন করার অনুপ্রেরণা বা শক্তিই সৃষ্টি করে? তাই যদি হত তবে কেন অনেক দেশে উন্নয়ন দেখা যায় না। অনেক দেশে চমৎকার সংবিধান ও আইন আছে, কিন্তু তার বিস্তার বাস্তবে দেখা যায় না।
- কেন্দ্রীয় সরকার বা শক্তিশালী একটি ব্যবস্থাপনা হয়তো শুরুতে কার্যকারী, কিন্তু অনেক বার তা ধীরে ধীরে নিজেকে ফাঁপিয়ে তোলে, কার্যকারীতা কমে যায়, উঁচু-নীচু ভাব বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষমতার ভুল ব্যবহার ও কঠোর দুর্নীতি বাড়ে। ইতিমধ্যে শলোমনের স্বর্ণ যুগে কর-আদায় ও বাধ্যতামূলক শ্রম লোকদের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায় (১ রাজা ১২:১-১১)।
- দেশের নিরাপত্তা কি একটি বড় স্থায়ী সৈন্যদলের উপর নির্ভর করে? হয়তো কিছু ক্ষেত্রে নির্ভর করে কিন্তু মনে রাখবেন যে, ঈশ্বর গিদিয়োনকে সৈন্যের সংখ্যা কমাতে বাধ্য করেন এবং তারা ৩০০ সেনা নিয়ে একটি বড় জয় ঘটান। পরবর্তীতে রাজাবলিতে দেখা যায় যে, বিশাল সৈন্যদলও পরাজিত হয়, ইস্রায়েলীয় হোক বা বিদেশী হোক। ঈশ্বর কম লোক দিয়ে বা বেশি লোক দিয়ে উদ্ধার করতে পারেন, যেমন যোনাথন ১ শমূয়েল ১৪:৬ পদে বলেন।
ঈশ্বর অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেন, যে রাজতন্ত্র ইস্রায়েল চায় তিনি তা চান না (১ শমূয়েল ৮)। এমন কি, তিনি ইস্রায়েলের রাজা চাওয়ার বিষয়ে শমূয়েলকে বলেন “তারা তোমাকে অগ্রাহ্য করে নি, আসলে আমাকেই অগ্রাহ্য করেছে যেন আমি তাদের উপর রাজত্ব না করি” (১ শমূয়েল ৮:৭)। ঈশ্বর পরিষ্কারভাবে বলেন যে, তিনি মোশি দ্বারা স্থাপিত গণতন্ত্র চান, এবং রাজতন্ত্র যে সমস্যা সমাধান করবে, তা মিথ্যা আশা মাত্র। রাজতন্ত্রে নতুন নেতা পরিবারগতভাবে ঠিক হয়, তিনি জনগণ দিয়ে নিযুক্ত নেতা নন, তাই জনগণের প্রতিনিধিও নন, ভাল চরিত্রের জন্য নিযুক্তও নন। রাজতন্ত্রে দ্বিতীয় বিবরণে ঈশ্বরের দেওয়া নীতিগুলো সব অমান্য করা হয় (দ্বিতীয় বিবরণ ১:৯-১৮)।
রাজতন্ত্র হয়তো প্রথমদিকে কার্যকারী মনে হয়, এমন কি চমৎকার বিষয় মনে হতে পারে, যখন প্রথম নেতাকে তার চরিত্র ও দক্ষতা অনুসারে রাজা বানানো হয়। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি সমস্যা দেখা দেবে: রাজা স্বেচ্ছাচারী হয়ে যাবেন, আইন বা দায়বদ্ধতা অমান্য করবেন, দিনে দিনে তার ক্ষমতার ভুল ব্যবহার বাড়বে, সাধারণ লোকদের চেয়ে তার জীবনের মান অনেক ভিন্ন হবে, রাজপরিবারের মধ্যে অভিলাসিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভাইকে খুন করার মধ্য দিয়ে সিংহাসন দখল শুরু হবে। একজন খারাপ রাজা নামানোর আর কোন পথ নেই বলে রাজাকে খুন ও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হবে এবং দেশের অস্থিরতা বাড়বে, এমন কি গৃহ যুদ্ধও ঘটতে পারে।
যদি ইস্রায়েল রাজতন্ত্র দাবি না করত, হয়তো শৌল হতেন তাদের পরবর্তী বিচারক-শাসনকর্তা, দায়ূদ হতেন তার পরের বিচারক-শাসনকর্তা এবং তার পরেই হয়তো যারবিয়াম। ঈশ্বরের পথই হল: সমস্যা সমাধানে সীমিত সময়ের জন্য কাজ সাধন করার নতুন নেতৃত্ব, যার অধিকারও সীমিত। এছাড়া নেতৃত্ব এক পরিবারে, এমন কি এক বংশেও যেন না থাকে।
বিচারকেরা
- যিহূদা বংশ থেকে কালেবের ভাতিজা অৎনীয়েল হলেন ইস্রায়েলের প্রথম বিচারক-শাসনকর্তা, যিনি অরামীয় রাজা কূশন-রিশিয়াথয়িমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয় লাভ করতে সক্ষম হন (বিচার ৩:৭-১১)। তার জয়ের ফলে ইস্রায়েলের ৪০ বছর বিশ্রাম ও শান্তি হয়।
- পরবর্তীতে মোয়াব, অমালেক ও অম্মোন জাতি একটি জোট হিসাবে যর্দনের পূর্বের বংশদের এলাকা অনেকটা দখল করে ইস্রায়েলকে ১৮ বছর ধরে অত্যাচার করে। বিন্যামিন বংশের বিচারক-শাসনকর্তা এহূদ, তিনি মোয়াবীয় রাজা ইগ্লোনকে খুন করে যর্দনের কাছের এলাকা পুনরায় ইস্রায়েলের অধীনে আনতে সক্ষম হন (বিচার ৩:১২-৩০)। তার জয়ের ফলে ইস্রায়েলের ৮০ বছর বিশ্রাম ও শান্তি হয়।
- যখন পলেষ্টীয়েরা পশ্চিম দিক থেকে ইস্রায়েলকে আক্রমণ করে তখন বিচারক শম্গর (তার বংশ উল্লেখ নেই) সেই আক্রমণ থেকে ইস্রায়েলকে উদ্ধার করেন (বিচার ৩:৩১)।
- উত্তর দিক থেকে কনানীয়েরা ইস্রায়েলকে ১৮ বছর ধরে অত্যাচার করে। এই সংকটের উত্তরে ঈশ্বর ইফ্রয়িম বংশের দবোরাকে আহ্বান করেন, একজন মহিলা ভাববাদী ও বিচারক, যিনি রামা ও বৈথেল শহরের মাঝের একটি জায়গায় বসে লোকদের ন্যায় বিচার করতেন। দবোরা ঈশ্বরের আদেশ বুঝে নপ্তালী বংশের কেদশ শহরের সেনাপতি বারককে চ্যালেঞ্জ করেন, নপ্তালী ও সবূলূন বংশের সৈন্যদল নিয়োগ করে অত্যাচারী কনানীয় রাজা হাৎসোরের যাবিনকে আক্রমণ করতে। দবোরা ও বারক, একটি অদ্ভূত দলীয় নেতৃত্ব একসাথে একটি ভয়ংকর ৯০০ লোহার রথের সৈন্যদলকে আক্রমণ করেন। ঈশ্বর একটি বৃষ্টি দান করেন যার কারণে কীশোন নদী দ্বারা সম্পূর্ণ এলাকায় বন্যা হয়। ভারী লোহার রথ কাদায় আটকে পড়ে এবং কনানীয় সৈন্যরা রথ ছেড়ে পালিয়ে যায়। তাদের সেনাপতি সীষরাও পালান এবং কেনীয় হেবরের স্ত্রী যায়েল সাহস করে তাকে মেরে ফেলে (বিচার ৪-৫)। তাদের জয়ের ফলে ইস্রায়েলের ৪০ বছর বিশ্রাম ও শান্তি হয়।
- পরবর্তীতে মিদিয়োন, অমালেক এ পূর্বের জাতিরা ইস্রায়েলকে ৭ বছর ধরে এমনভাবে অত্যাচার করে যে, শেষ পর্যন্ত দেশ দুর্ভিক্ষে পড়ে। ঈশ্বর পশ্চিম মনঃশি বংশের গিদিয়োনকে আহ্বান করেন। গিদিয়োন ঈশ্বরকে দেশের দুরাবস্থার জন্য দোষ দেন কিন্তু শেষে তিনি আহ্বানে সাড়া দেন। তিনি তার বাবার বাল দেবের পূজার স্থান ধ্বংস করেন এবং ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য হয়ে সেনার সংখ্যা কমানোর পরে কেবল ৩০০ সেনাদের সাহায্যে শত্রুদের যুদ্ধে পরাজিত করতে সক্ষম হন। যখন তিনি জয়ী হয়ে ফিরে আসেন ইফ্রয়িম বংশের লোকেরা তাদেরকে যুদ্ধে না ডাকার বিষয়ে গিদিয়োনের কাছে রাগ ও অপমান বোধ প্রকাশ করে। গিদিয়োন খুব নম্র ও সম্মানের সঙ্গে তাদেরকে যুদ্ধে যোগ দিয়ে অম্মোনীয়দের আরো তাড়াতে আমন্ত্রন জানান। ইফ্রয়িম তার উত্তর মেনে নেয়। যখন ইস্রায়েলীয়েরা গিদিয়োনকে রাজা বানাতে চায়, তিনি প্রজ্ঞার সঙ্গে তা অগ্রাহ্য করেন। কিন্তু ধীরে ধীর গিদিয়োনের দুর্বলতা দেখা যায়। তিনি লুটে পাওয়া সোনা দিয়ে একটি মূর্তি বানান এবং অনেক স্ত্রী গ্রহণ করেন (বিচারক ৬-৮)। অবীমেলক নামে গিদিয়োনের একজন ছেলে নিজেকে শিখিম শহরে রাজা হিসাবে ঘোষণা করেন এবং বিভিন্ন কৌশল দিয়ে নিজের ক্ষমতা বিস্তার করেন। তিন বছরের মধ্যে তাকে মেরে ফেলা হয় কিন্তু তিনি সেই অল্প সময়ে যথেষ্ট ক্ষতি ও রক্তপাত ঘটান (বিচার ৯)।
- ইফ্রয়িমের শামীর গ্রামে বাসকারী ঈষাখর বংশের তোলয় ২৩ বছর ধরে ইস্রায়েলের বিচারক ও শাসনকর্তা হিসাবে ভূমিকা পালন করেছিলেন (বিচার ১০:১-২)।
- গাদ বা গিলিয়োদ বংশের যায়ীরও ২৩ বছর ধরে ইস্রায়েলের বিচারক ও শাসনকর্তার ভূমিকা পালন করেন (বিচার ১০:৩-৫)। তার ৩০জন ছেলে ছিল, যাদের ৩০টি গ্রামের উপরে অধিকার ছিল।
গাদ বংশের যিপ্তহ ছিলেন একজন পতিতার ছেলে। তার বাবার বৈধ ছেলেদের দ্বারা অগ্রাহ্য হয়ে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। যখন অম্মোনীয়েরা ইস্রায়েলকে এবং বিশেষভাবে গাদ বংশকে চাপিয়ে রাখে তখন বংশের নেতারা যিপ্তহকে ফিরে আসতে ও তাদের পক্ষে অম্মোনীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অনুরোধ করেন। তিনি রাজি হন এবং বিশাল একটি জয় লাভ করতে সক্ষম হন। কিন্তু যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তিনি একটি হঠকারী শপথের কারণে তার একমাত্র কন্যাকে উৎসর্গ করেন (বিচার ১১)। ইফ্রয়িম বংশের লোকেরা আবারও তাদেরকে যুদ্ধে না ডাকার কারণে রাগ ও অপমান বোধ প্রকাশ করে, যার ফলে গাদ ও ইফ্রয়িম বংশের মধ্যে একটি অপ্রয়োজনীয় গৃহ যুদ্ধ ঘটে যাতে ৪০ হাজারেরও বেশি লোক মারা যায় (বিচার ১২)। - বৈথলেহম গ্রামের যিহূদা বংশের ইব্সন ৭ বছর ধরে ইস্রায়েলের বিচারক হন (বিচার ১২:৮-১২)।
- পরে সবূলূন বংশের এলোন ১০ বছর ধরে ইস্রায়েলের বিচারক হন (বিচার ১২:১১-১২)।
- পরবর্তীতে ইফ্রয়িম বংশের হিল্লেলের ছেলে অবদোন ৮ বছর ধরে ইস্রায়েলের বিচারক হন। তার গ্রামের নাম পিরিয়াথোন (বিচার ১২:১৩-১৫)।
- পলেষ্টীয়েরা পশ্চিম দিক থেকে ৪০ বছর ধরে ইস্রায়েলকে অত্যাচার করে। দান বংশের একটি নিঃসন্তান দম্পত্তি স্বর্গদূত থেকে খবর পান যে, তাদের একটি ছেলে সন্তান হবে, যার আজীবন নাসরীয় শপথ পালন করতে হবে (আংগুর, মদ, চুল কামানো নিষেধ)। ঈশ্বরের বাক্য অনুসারে মানোহ ও তার স্ত্রীর শিমশোন নামে একটি ছেলে হয় (বিচার ১৩)।
- শিমশোনের অদ্ভূত শারীরিক শক্তি ছিল এবং তিনি অবশ্যই খুব চমৎকার একজন বিচারক-শাসনকর্তা হতে পারতেন কিন্তু তিনি একবারও ঈশ্বরকে অন্বেষণ করেন না। তিনি তার শক্তির কারণে পলেষ্টীয়দের বিরুদ্ধে কিছু ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হন, কিন্তু তা ঈশ্বরের আদেশে বা প্রজ্ঞায় হয় না। বরং তা বিভিন্ন প্রেমিকাদের পিছনে শিমশোনের দৌঁড়ানোর জন্যই হয়। তিনি প্রথমে একজন পলেষ্টীয় স্ত্রী নেন, কিন্তু বিবাহের অনুষ্ঠানে একটি দ্বন্দ্বের কারণে তাকে আবার হারান (বিচার ১৪)। তিনি তাকে পুনরায় দাবি করে সফল হতে না পেরে পলেষ্টীয়দের ফসলক্ষেত পুড়িয়ে দেন। পলেষ্টীয়েরা প্রতিশোধে তার স্ত্রী ও স্ত্রীর পরিবার পুড়িয়ে মেরে ফেলে। আবারও শিমশোন এর জন্য প্রতিশোধ নিয়ে পলেষ্টীয়দের মধ্যে বেশ কয়েকজন মেরে ফেলেন। উত্তরে পলেষ্টীয়েরা দান বংশের উপরে অত্যাচার বাড়ায়। শেষে দান বংশের লোকেরা শিমশোনের কাছে এসে তাকে পলেষ্টীয়দের হাতে আত্ম-সমর্পণ করতে অনুরোধ করে, কিন্তু আত্ম-সমর্পণ করতে গিয়ে তিনি তাণ্ডব ঘটিয়ে আরো এক হাজার পলেষ্টীয়দের মেরে ফেলেন (বিচার ১৫)।
তিনি একটি পলেষ্টীয় পতিতার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে তাকে অবশেষে তার শক্তির রহস্য বলে ফেলেন: নাসরীয় শপথ। পতিতাটি তার চুল কামিয়ে দেয় এবং পলেষ্টীয়েরা তাকে গ্রফতার করে তার চোখ নষ্ট করে ফেলে। কারাগারে তার চুল পুনরায় বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঈশ্বরের অনুমতিতে তিনি একটি শেষ ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হন: যখন তার বিষয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করার জন্য তাকে একটি পলেষ্টীয় ভোজে আনা হয়, তখন তিনি দালানটির স্তম্ভ ধরে পুরো দালান তাদের উপরে ফেলে দেন, তাতে পলেষ্টীয়দের উঁচু শ্রেণীর ৩০০০ লোক মারা যায় (বিচার ১৬)। শিমশোনের গল্পগুলো অবশ্যই রসালো ও বিখ্যাত, কিন্তু দুঃখের বিষয়ও। কত যে বিশাল কাজগুলো শিমশোন সাধন করতে পারতেন, ইস্রায়েলের জন্য কত বড় জয় নিয়ে আসতে পারতেন যদি তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারে বাধ্য হয়ে তার আহ্বান পূর্ণ করতেন! কিন্তু ছোট ছোট কিছু স্থানীয় ঘটনা ছাড়া তার জীবন দ্বারা আর কিছু হয় নি।
জঘন্য দু’টি ঘটনা
বিচারকর্তৃগণ পুস্তকের শেষে দু’ট অতি খারাপ গল্প পাওয়া যায়, যার মধ্য দিয়ে লেখক দেখান যে, দেবতা পূজার ফলে ইস্রায়েল জাতির নৈতিকতা, একতা ও আইন-শৃঙ্খলা কত গভীরভাবে ভেঙ্গে গেছে – এবং ফলে একটি সমাজে কি কি ঘটতে পারে! উভয় গল্পের প্রধান ব্যক্তি হল একজন লেবীয়। গল্পগুলো তাই বিশেষভাবে আত্মিক নেতৃত্বের দোষ ধরে।
প্রথম গল্পে (বিচার ১৭-১৮) একজন গরীব লেবীয় চাকরী পাওয়ার আশায় ইফ্রয়িম বংশের এলাকায় ঘুরে। মীখা নামে একজন লোক তাকে চাকরী দেয়। মীখা আগে তার মায়ের টাকা চুরি করেছিল। যখন তার মা চোরকে অভিশাপ দেয় তখন সে তার চুরি স্বীকার করে। তার মা টাকা ফেরত পেয়ে তা দ্বারা একটি রূপার মূর্তি বানায় এবং একটি পূজার স্থান স্থাপন করে। প্রথমে মীখা তার ছেলেদেরকে পূজার স্থানের পুরোহিত বানায়, পরে লেবীয়কে পেয়ে খুশি মনে তাকে তার ব্যক্তিগত পুরোহিত হিসাবে গ্রহণ করে। যখন দান বংশের ৫জন সৈন্য উত্তর দিকে দান বংশের জন্য নতুন জমি খোঁজার অভিযানে মীখার বাসায় আসে তখন তারা সেই লেবীয়ের সাথে পরিচিত হয়। তারা যখন একটি সৈন্যদল নিয়ে দান বংশের সেই এলাকা দখল করতে যায়, তখন তারা মীখার রূপার মুর্তি চুরি করে লেবীয়কে নতুন জায়গায় তাদের বংশের পুরোহিত হতে প্রস্তাব দেয়। লেবীয় রাজি হয়ে তাদের সাথে যায়।
এই গল্পের সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হল যে, প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তির প্রত্যেকটি আচরণ হল ঈশ্বরের আইন-কানুনের বিরুদ্ধে। কিন্তু তা মাত্র না, গল্পের শেষে লেখক পাঠকদের আরো ধাক্কা দেন: সেই নীতিহিন, সুবিধাবাদী, বিশৃঙ্খল, দেবতাপূজারী লেবীয়ের নাম হল যোনাথন, মোশির নাতী (বিচার ১৮:৩০)! ইস্রায়েলের সেই চমৎকার নেতা ও আইন-দাতার আপন নাতীর আর কোন ধারণা নেই যে, ঈশ্বর কে হন এবং তিনি কি চান।
দ্বিতীয় গল্প আরো খারাপ (বিচর ১৯-২১)। এই গল্পও একজন লেবীয় নিয়ে শুরু, যিনি তার পলাতক উপস্ত্রী নিয়ে বিন্যামিন এলাকায় যাত্রা করে। যখন রাত হয়ে পড়ে তখন তারা রাত কাটানোর জন্য একটি ইস্রায়েলীয় শহর খুঁজে পায়, গিবিয়া। একজন স্থানীয় বৃদ্ধ লোক তাদেরকে অতিথি হিসাবে গ্রহণ করে, কিন্তু রাতের বেলা এমন একটি ঘটনা ঘটে যা একেবারে সদোমের মত: গিবিয়ার পুরুষেরা বৃদ্ধ লোকের কাছ থেকে লেবীয়কে যৌন সম্পর্কের জন্য দাবি করে। বৃদ্ধ লোক তাদের দাবি অগ্রাহ্য করতে চেষ্টা করে, এমন কি নিজের মেয়েদের তাদের দিয়ে দিতে চায়, কিন্তু অবশেষে লেবীয় তার উপস্ত্রীকে তাদের হাতে দিয়ে দেয়। তারা তাকে সারা রাত ধরে ধর্ষণ করে এবং স্ত্রীলোকটি বৃদ্ধের দরজায় মারা যায়। সকালে লেবীয় তাকে সেখানে দেখে তাকে উঠে রওনা দিতে বলে। পরে সে বুঝতে পারে যে, তার উপস্ত্রী মারা গেছে। নিজের খারাপ চেতনা ও কাপুরুষতা ঢেকে দেওয়া জন্য লেবীয়টি সিদ্ধান্ত নেয় যে, অপমানিত হওয়া এবং বিষয়টি জঘন্য কাজ হিসাবে ঘোষণা করাই ভাল পথ। সে উপস্ত্রীর দেহ ১২ টুকরা করে তা ইস্রায়েলের ১২ বংশদের কাছে পাঠিয়ে তাদের সাড়া দাবি করে। ১১ বংশের লোকেরা সাড়া দেয় এবং বিন্যামিন বংশের নেতাদের গিবিয়ার অপরাধটিতে শাস্তি দিতে বলে। বিন্যামিন বংশ চাপটি অগ্রাহ্য করে বলে একটি অতি ক্ষতিকারক গৃহ যুদ্ধ শুরু হয়, যাতে প্রায় চল্লিশ হাজার সেনাদের মৃত্যু ঘটে এবং বিন্যামিন বংশকে প্রায় নির্মূল করা হয় (বিন্যামিনের মাত্র ৬০০জন পুরুষ বেঁচে যায়)। আবারো লেখক পাঠকদের ধাক্কা দিতে চান: বিন্যামিনের গিবিয়া হল মহাপুরোহিত পীনহসের শহর (যিহোশূয় ২৪:৩৩) এবং ঘটনাটি পীনহস জীবিত থাকতেই ঘটে (বিচার ২০:২৮)।
দু’টি গল্প উভয়ই দেখায় যে, কত তাড়াতাড়ি ইস্রায়েলের নৈতিকতা, আইন-শৃঙ্খলা, একতা ও নিরাপত্তা খারাপের দিকে যেতে থাকে, দেশের আত্মিক, নৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা দিনে দিনে অবনতি হয়। ঠিক একারণেই তো ঈশ্বর ইস্রায়েলকে এত কঠোর সাবধাণবাণী দিয়েছিলেন।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।