৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে বাবিলীয়েরা যিহূদা দেশ, যিরূশালেম শহর ও ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে বলে যিরমিয় তার হৃদয়ের চরম দুঃখ বিলাপ পুস্তকে প্রকাশ করেন। বিলাপ পুস্তকে যিরমিয় এই বাস্তব ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে ধ্যান করেন। ঘটনাটি বিশেষভাবে বিধ্বংসী ও অতি দুঃখজনক কারণ যিরমিয় জানেন যে, তা ঘটার কোনো প্রয়োজনই ছিল না।
মোশির লেখা থেকে শুরু করে শতাব্দীর পর শতাব্দীতে ঈশ্বর ইস্রায়েলকে পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন যে, তারা প্রতিজ্ঞাত দেশ শুধুমাত্র ধরে রাখতে ও সেখানে বসবাস করতে পারবে যদি তারা ঈশ্বরের আইন-কানুনে বাধ্য হয়। লেবীয় পুস্তকে ঈশ্বর তাদের বলেছিলেন যে, সাতটি জাতিকে তাড়িয়ে দিয়ে তিনি ইস্রায়েলকে প্রতিজ্ঞাত দেশ দিয়েছেন এবং তিনি ঠিক কোন কারণে কনান দেশে বসবাস করার তাদের অধিকার বাতিল করেছেন: তাদের দেবতাপূজা, মন্দতা ও সামাজিক অন্যায় এমন পর্যায় চলে গিয়েছিল যে, ঈশ্বর তাদের বিচার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ঈশ্বর বার বার ইস্রায়েলকে সাবধানবাণী দেন যে, যদি তারা এই সাতটি জাতির মত পাপ করতে থাকে তবে তারাও ঈশ্বরের আশীর্বাদ এবং অবশেষে প্রতিজ্ঞাত দেশে বসবাস করার অধিকার হারাবে (লেবীয় ১৮:২৪-৩১)। তার মৃত্যুর আগে মোশি দ্বিতীয় প্রজন্ম ইস্রায়েলকে ঠিক এই একই কথা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন (২য় বিবরণ ২৮:১৫-৬৮)।
যিহূদা জাতি শুরুতে ভাল করেছিল কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দীতে তারা আরো খারাপের দিকে গিয়েছে। তাদের সাবধান করার জন্য ঈশ্বর অনেক ভাববাদীদের পাঠিয়েছিলেন যাদের কারণে যিহূদা কিছুটা অনুতাপ করে উদ্ধার পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা আবার একই মন্দতায় লিপ্ত হতে থাকে। ঈশ্বর দ্বারা পাঠানো শেষ ভাববাদী ছিলেন যিরমিয়, যিনি দীর্ঘ একচল্লিশ বছর ধরেই যিহূদার কাছে মন ফিরানোর জন্য ঈশ্বরের শেষ ডাক দিতে থাকেন যেন যিহূদা অনুতপ্ত হওযার আর একটি সুযোগ পায়। কিন্তু যিহূদার লোকেরা মন ফিরাতে রাজি না। ফলে যিরমিয় তার ধ্বংসবাণীগুলো একটার পর একটা পূর্ণ হতে দেখেন। কি হতাশার বিষয়, কারণ তা ঘটার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। যদি যিহূদা অনুতপ্ত হত তবে সর্বনাশকে প্রতিরোধ করা যেত। তাই যিরমিয় তার নিজের জাতি, শহর ও সদাপ্রভুর উপাসনা-ঘর ধ্বংস হতে দেখেন। তিনি আরো দেখেন কিভাবে যুদ্ধে এবং যিরূশালেম ঘেরাওয়ের কারণে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে লোকেরা মারা যেতে থাকে। যারা বেঁচে যায়, তাদেরকে দেবতাপূজারী বাবিলে নির্বাসনে নেওয়া হয়। যিরমিয় যিরূশালেমের ধ্বংসাবশেষে থেকে যান এবং দশকের পরে দশক তার আবেগপ্রবণ কিন্তু নিষ্ফল প্রচার, তার ত্যাগ-স্বীকার ও বাধ্যতা (যার ফলে তার উপর অপমান, হুমকি, জেল ও শারীরিক নির্যাতন এসেছিল) নিয়ে বিলাপ করেন। তার প্রাণপণ প্রচেষ্টা কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসতে সক্ষম হয় নি। তিনি পরাজিত, একা, নিষ্ফল ও নিরাশা গ্রস্ত। তার ত্যাগ-স্বীকার ফলহীন ও অর্থহীন হয়েছে মনে করে তিনি অন্তরে ক্ষোভ ও তিক্ততা নিয়ে লড়াই করছেন।
বিলাপ পুস্তকে যিরমিয় তার গভীর আবেগ, দুঃখ-কষ্ট, অন্তরে লড়াই ও দোষারোপ যেমন তেমনভাবে প্রকাশ করেন। তিনি কথা না ছেঁকে তার হতাশা, বিষণ্নতা ও মনমরা অবস্থা, এমন কি ঈশ্বরের উপরে তার রাগ ও ক্ষোভ ঢেলে দেন (বিশেষভাবে বিলাপ ৩:১-২১ পদে)।
বিলাপ পুস্তক লেখার ধরণ প্রকৃতপক্ষে অনেক সুন্দর সাজানো কবিতা। পুস্তকের ১ থেকে ৪ অধ্যায়ের পদগুলো ইব্রীয় বর্ণমালা অনুসারে ধারাবাহিকভাবে সাজানো, অর্থাৎ প্রত্যেকটি পদ ইব্রীয় বর্ণমালার অন্য একটি অক্ষর দিয়ে শুরু হয়। বাংলা ভাষায় বুঝিয়ে প্রথম পদ ‘ক’ দিয়ে শুরু, দ্বিতীয় পদ ‘খ’ দিয়ে শুরু, তৃতীয় পদ ‘গ’ দিয়ে শুরু ইত্যাদি। পুস্তকের পাঁচটি অধ্যায়ের মধ্যে চারটি অধ্যায় এভাবে সাজানো হয়েছে। কিন্তু এছাড়া অধ্যায়গুলো বাতিদানের মত সাজানো হয়েছে, ১ ও ৫ অধ্যায় সম্পর্কিত, ২ ও ৪ অধ্যায় সম্পর্কিত এবং মাঝের ৩ অধ্যায় হল পুস্তকের অতি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বিশেষভাবে গুরুত্ব পায় বিলাপ ৩:২২-৩৩ পদ, যা হল সারা পুস্তকের ঠিক মাঝখানের অনুচ্ছেদ এবং পুস্তকের সবচেয়ে বিখ্যাত পদ। কিভাবে সম্ভব যে, যিরমিয়ের অন্তরের দুঃখ-কষ্টের প্রকাশ এত সাজানো-গুছানো কবিতা হতে পারে? যিরমিয় কি চরম বিশৃঙ্খলার মধ্য অর্থ বা রীতিনীতি খোঁজেন? তিনি কি ধ্বংসের মধ্যে কোনভাবে সৌন্দর্য খোঁজেন? যখন ‘সব কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ এই মুহূর্তে তিনি কি একটি কাঠামো বা সমর্থন খোঁজেন? আমরা এর উত্তর জানি না।
পুস্তকে কিন্তু বেশ কিছু বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার। যিরূশালেমের ধ্বংসের দুঃখজনক ঐতিহাসিক ঘটনা যখন যিরমিয় বর্ণনা করেন, তিনি তা কোমলভাবে প্রকাশ করেন না এবং এই ঘটনার কষ্ট বা জঘন্যতা কমানোরও চেষ্টা করেন না। তিনি বাস্তব কথা বলেন, তিনি নিজেকে বাস্তবতার সম্মুখীন হতে বাধ্য করেন, তিনি এই ঘটনার দুঃখজনক অর্থ ও ফলাফল এড়িয়ে যান না, যতই খারাপ হোক না কেন। তিনি বাস্তবতাকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেন, তিনি সত্যে থাকেন, তিনি মন একটু হাল্কা করার জন্য কোন মিথ্যা মেনে নেন না।
যিরমিয় এক মুহূর্তের জন্যও মনে করেন না যে, যা ঘটেছে, তা এমনি এমনি ঘটেছে বা তা কোন দুর্ঘটনা বা দুর্ভাগ্য মাত্র। তিনি আগে থেকে জানতেন কি ঘটবে এবং তিনি এই বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণীও দিয়েছেন। কেন তা ঘটেছে, তাও তিনি পরিষ্কারভাবে জানেন। তিনি জানেন ঠিক কেন ঈশ্বর নিজের হাতে তা ঘটিয়েছিলেন, তাঁর আগে দেওয়া বাণী অনুসারে। ঘটনাটি ঘটে নি সব কিছু ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে বা বাবিল সাম্রাজ্য শক্তিশালী হওয়ার কারণে। বরং যিহূদার ধ্বংস ঘটেছে কারণ যিহূদা পাপ করেছিল এবং পাপ করেই যাচ্ছিল। কোনো কিছু ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় নি। ঈশ্বর সিংহাসনেই আছেন। তিনিই এই বিচার ঘটিয়েছেন। এটি একটি আশার বাণীও হয়ে দাঁড়ায়, কারণ যদি তাঁর লোকেরা অনুতপ্ত হয়, তবে ঈশ্বর পুনরায় দয়া দেখাতে পারেন।
যদিও এই বিলাপে যিরমিয় তার অন্তরের গভীর দুঃখকষ্ট প্রকাশ করেন তবুও তিনি অবশেষে একটি আশা খুঁজে পান। ঈশ্বরের ন্যায্যতা ও নীতি অনুসারে কাজ না করার কারণে বিচার হয়েছে, কিন্তু ঈশ্বরের দয়া ও বিশ্বস্ততার কারণে পুনরুদ্ধারও থাকবে। যিরমিয় নিজের চোখে হয়তো তা পূর্ণ হতে আর দেখবেন না, কিন্তু এটা সত্য যে, “সদাপ্রভুর অটল ভালবাসার জন্য আমরা ধ্বংস হচ্ছি না, কারণ তাঁর করুণা কখনও শেষ হয় না… সদাপ্রভুর উপর যারা আশা রাখে ও তাঁর উপর নির্ভর করে তাদের তিনি মংগল করেন” (বিলাপ ৩:২২,২৫)। যিরমিয় তার পাঠকদের জন্য আদর্শ হয়ে ঈশ্বরের বিচার, তাঁর ইচ্ছা ও তাঁর পথই মেনে নেন, এবং তাতে তিনি সান্ত্বনা, শান্তি ও আশা লাভ করেন (বিলাপ ৩:২৫-৩৩)।
বিলাপের লেখক
পুস্তকটিতে লেখক নিজের পরিচয় না দিলেও পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, তিনি ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিরূশালেমের ঘেরাও, দখল ও ধ্বংস এবং পরবর্তীতে বেঁচে থাকা যিহূদার লোকদের নির্বাসন নিজের চোখে দেখেছেন (বিলাপ ১:১৩-১৫, ২:৬, ২:৯, ২:১২ ৪:১-১২, ৫:১-১৮)। আরো বুঝা যায় যে, যা ঘটেছে, লেখক তা ঈশ্বরের দৃষ্টিতে দেখেন: এমন নয় যে, এই ধ্বংস ঘটেছিল কারণ বাবিল সাম্রাজ্য শক্তিশালী বা বাবিলীয় দেবতা ঈশ্বরের চেয়ে মহান। বরং তার কারণ হল ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যিহূদা জাতির অনবরত পাপ ও অবাধ্যতা (বিলাপ ২:১৪, ৪:১৩, যির ৫:৩১, ২৩:১১-১২)।
বিলাপের লেখক কে? প্রকৃতপক্ষে সম্ভাবনা বেশি যে, যিরমিয় পুস্তকটি লিখেছেন:
- যিহূদায় মাত্র অল্প কয়েকজন শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকা ঈশ্বরীয় লোক ছিলেন, যাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত যিরমিয়।
- উভয় যিহূদী এবং খ্রিষ্টান ঐতিহ্য যিরমিয়কে বিলাপ পুস্তকের লেখক হিসাবে চিহ্নিত রাখে। পুরাতন নিয়মের সেপ্টুয়াজিন্ট অনুবাদ থেকে (Septuagint, ২৫০ খ্রীঃপূঃ) বিলাপ পুস্তকের শুরুতে এই ভূমিকা বাক্য যোগ দেওয়া হয়েছে: “ইস্রায়েল জাতির দখল ও নির্বাসন এবং যিরূশালেম শহর ধ্বংসে যিরমিয় বসে কেঁদিছিলেন এবং বললেন: …”
- যিরমিয় আগেও একটি বিলাপ লিখেছিলেন যা সবার কানে এসেছিল (২ বংশা ৩৫:২৫): তিনি রাজা যোশিয়ের মৃত্যুর বিষয়ে শোক প্রকাশ করে সম্ভবত ঠিক একই হতাশা ও মনের কষ্ট থেকে একটি বিলাপ করলেন।
- যিরমিয় বিলাপ করছেন, তা যির ৭:২৯, ৮:২১ ও ৯:১ পদেও উল্লিখিত।
- বিলাপ পুস্তকে লেখকের নিজের জীবনের কষ্টের বর্ণনা যিরমিয়ের জীবনের সাথে অনেক মিলে পাওয়া যায় (বিলাপ ৩:২৫-৩০, ৩:৫২-৬৩ দেখুন)।
- এছাড়া যিরমিয়ের ভাববাণীতে ও বিলাপ পুস্তকে ব্যবহৃত ভাষার, শব্দের ও কিছু রূপকের মিল পাওয়া যায়।
বিলাপ পুস্তক কোন পরিস্থিতিতে লেখা হয়েছিল?
যিরূশালেম ধ্বংস হওয়ার ঠিক পরে বিলাপ পুস্তক লেখা, যখন এই ঘটনা এখনও অবিশ্বাস্য কিন্তু একই সাথে কঠিন বাস্তবতার বিষয়। যিরূশালেমকে ১৮ জুলাই ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে পরাজিত করা হয়েছিল এবং শহর ও উপাসনা-ঘর ১৫ অগষ্ট ৫৮৬ খ্রীষ্টাপূর্বে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। সম্ভাবনা বেশি যে, বিলাপ ঠিক এই সময়ে বা অল্পক্ষণের মধ্যে লেখা হয়েছে। যিরমিয় তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনার সাথে কিভাবে সংগ্রাম করেন, বিলাপ পুস্তক হল তার প্রকাশ।
যদিও যিরমিয়কে তার জীবনের শেষে জোর করে মিসর দেশে নিয়ে যাওয়া হয়, পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে তিনি সেখানকার দেবতাপূজারী যিহূদীদের জন্য তার তিনটি পুস্তক (রাজাবলি, যিরমিয় ও বিলাপ) লেখেন নি বরং তিনি সেগুলো বাবিলে নির্বাসিত যিহূদীদের জন্য লেখেন। বাবিলে নির্বাসিতদের মধ্যে কিছু বিশ্বস্ত যিহূদী ছিল, যারা ঈশ্বরের বাক্য ও প্রতিজ্ঞা বিশ্বাস করত এবং যিরমিয়ের ও অন্যান্য লেখকদের পুস্তকগুলো গুরুত্বের সঙ্গে পড়ত ও সুরক্ষিত রাখত। এভাবে পুরাতন নিয়মের সংগ্রহ পাই।
ইস্রায়েল জাতি কিভাবে বিলাপ পুস্তকে বর্ণিত অবস্থায় পড়েছিল?
ইস্রায়েল জাতি কিভাবে বিলাপ পুস্তকে বর্ণিত সর্বনাশে পড়েছিল? প্রকৃতপক্ষে এর ইতিহাস ও কারণ অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছিল: মোশি থেকে শুরু করে শতাব্দীর পর শতাব্দীতে ঈশ্বর ইস্রায়েলকে পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন যে, তারা প্রতিজ্ঞাত দেশ শুধুমাত্র ধরে রাখতে ও সেখানে বসবাস করতে পারবে যদি তারা ঈশ্বরের আইন-কানুনে বাধ্য হয়।
লেবীয় পুস্তকে ঈশ্বর ইস্রায়েলকে জানান যে, কনান দেশে বাসকারী ৭টি জাতি দেশে বসবাস করার অধিকার কেন হারিয়েছে: তারা কনান দেশকে এমন দেবতাপূজা, মন্দ ও অন্যায় কাজ দ্বারা পূর্ণ করেছিল যে, ঈশ্বর দেশে তাদের অস্থিত্ব বিলিন করে দেওয়ার আদেশ দেন। সাথে সাথে ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকেও সাবধাণ করেন যে, যদি তারা সেই ৭টি জাতির মত দেবতাপূজা ও অন্যায় করে তবে ঈশ্বর অবশ্যই দেশে তাদের অস্থিত্বও বিলিন করে দেবেন (লেবি ১৮:২৪-৩১)। মৃত্যুর আগে মোশি দ্বিতীয় প্রজন্ম ইস্রায়েলকে আর একবার সাবধাণ করেন যে, ঈশ্বরকে অস্বীকার করলে ও তাঁর আইন অমান্য করলে তবে ইস্রায়েল জাতি ঈশ্বরের আশীর্বাদ, সুরক্ষা এবং শেষে দেশে বসবাস করার অধিকার হারাবে (দ্বিতীয় বিবরণ ২৮:১৫-৬৮)।
যিহূদা জাতি শুরুতে ভাল করেছিল কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দীতে তারা আরো খারাপের দিকে গিয়েছে। তাদের সাবধান করার জন্য ঈশ্বর অনেক ভাববাদীদের পাঠিয়েছিলেন যাদের কারণে যিহূদা কিছুটা অনুতাপ করে উদ্ধার পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা আবার একই মন্দতায় লিপ্ত হতে থাকে। ঈশ্বর দ্বারা পাঠানো শেষ ভাববাদী ছিলেন যিরমিয়, যিনি দীর্ঘ একচল্লিশ বছর ধরেই (৬২৭-৫৮৬ খ্রীঃপূঃ) যিহূদার কাছে মন ফিরানোর জন্য অনুরোধ করতে থাকেন যেন যিহূদা অনুতপ্ত হওযার আর একটি সুযোগ পায়। যিরমিয় হলেন যিহূদার কাছে ঈশ্বরের শেষ ডাক।
কিন্তু যিহূদার লোকেরা মন ফিরাতে রাজি না এবং যিরমিয়কে দুঃখের সঙ্গে দেখতে হচ্ছে কিভাবে তার ধ্বংসবাণীগুলো একটি পর একটি পূর্ণ হয়ে দেশ অপ্রয়োজনীয়ভাবে ধ্বংস হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে একটু অনুতপ্ত হলে সর্বনাশটি প্রতিরোধ করা যেত কিন্তু যিহূদার শেষ রাজারা হলেন ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিহীন লোক যারা যিরমিয়ের ধ্বংসবাণীগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বীকার করেন, এমন কি যখন বাবিল সাম্রাজ্য যিহূদাকে ইতিমধ্য চেপে ধরেছে।
৬০৫ খ্রীষ্টপূর্বে বাবিল সম্রাট নবূখদনিৎসর প্রথম বার যিহূদাকে দখল করেন, বড় একটি লোকদল বাবিলে নির্বাসিত করেন এবং যোশিয়ের দ্বিতীয় ছেলে যিহোয়াকীমকে বাবিলের অধীনস্থ রাজা হিসাবে সিংহাসনে বসিয়ে দেন। যিহোয়াকীম বাবিলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন যার ফলে বাবিল যিহূদা ও যিরূশালেমকে দ্বিতীয় বার ঘেরাও করে এবং ৫৯৭ খ্রীষ্টপূর্বে দখল করে। সেই সময় যিহূদার আর একটি লোকদলকে বাবিলে নির্বাসিত করা হয় এবং যোশিয়ের তৃতীয় ছেলে সিদিকিয়কে বাবিল অধীনস্থ রাজা হিসাবে সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া হয়। যখন রাজা সিদিকিয়ও বাবিলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন তখন বাবিল তৃতীয় বার যিহূদা ও যিরূশালেমকে ঘেরাও করে (১১ জানিয়ারি ৫৮৮-১৮ জুলাই ৫৮৬ খ্রীঃপূঃ) এবং দখল করে শহরটি এবং উপসনা-ঘরটি একেবারে ধ্বংস করে ফেলে। বাবিলীয়েরা যিরমিয়কে সম্মানের সঙ্গে মুক্ত করে যাকে যিহূদার রাজকর্মচারীরা বিশ্বাসঘাতক বলে কারাগারে এবং এমন কি কাদা ভরা কূয়ায় ফেলে দিয়েছিল।
যে যিহূদীরা এই তৃতীয় ঘেরাও ও যুদ্ধে বেঁচে যায়, তাদেরকে বাবিলে নির্বাসিত করা হয়। শুধুমাত্র অল্প কিছু কৃষকদের গদলিয় নামে একজন শাসনকর্তার অধীনে যিহূদায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। যখন গদলিয়কে খুন করা হয় তখন তারা বাবিলের ভয়ে যিরমিয়ের নির্দিষ্ট বাণীর বিরুদ্ধে গিয়ে মিসর দেশে পালিয়ে যায় এবং যিরমিয়কেও জোর করে নিয়ে যায়।
বিলাপ পুস্তকের কাঠামো
অবাক লাগার বিষয় যে, বিলাপ পুস্তক অতি সুন্দরভাবে সাজানো একটি কবিতা। অধ্যায়গুলো হল বর্ণমালা অনুসারে সাজানো, প্রত্যেকটি পদ ইব্রীয় বর্ণমালার ধারাবাহিকভাবে একটি অক্ষর দিয়ে শুরু হয়। ইব্রীয় বর্ণমালায় ২২টি অক্ষর আছে বলে বিলাপের অধ্যায়গুলোতে ২২টি পদ আছে।
বাংলা ভাষায় ‘অনুবাদ’ করে কাঠামো দেখতে এমন:
১ অধ্যায় ২২টি বর্ণমালা অনুসারে সাজানো ৩ লাইনের ছড়া ক_____ _____ _____
(প্রথম লাইনের প্রথম শব্দের প্রথম অক্ষর, ২২টি পদ) খ_____ _____ _____
গ_____ _____ _____ইত্যাদি।
২ অধ্যায় ২২টি বর্ণমালা অনুসারে সাজানো ৩ লাইনের ছড়া ক_____ _____ _____
(প্রথম লাইনের প্রথম শব্দের প্রথম অক্ষর, ২২টি পদ খ_____ _____ _____
গ_____ _____ _____ইত্যাদি।
৩ অধ্যায় ২২টি বর্ণমালা অনুসারে সাজানো ৩ লাইনের ছড়া ক_____ ক____ ক____
(সব লাইনের প্রথম শব্দের প্রথম অক্ষর, ৬৬টি পদ) খ_____ খ____ খ____
গ_____ গ____ গ____ইত্যাদি।
৪ অধ্যায় ২২টি বর্ণমালা অনুসারে সাজানো ২ লাইনের ছড়া ক_____ _____
(প্রথম লাইনের প্রথম শব্দের প্রথম অক্ষর, ২২টি পদ) খ_____ _____ ____
গ_____ _____ ____ ইত্যাদি।
৫ অধ্যায় ২২টি ১ লাইনের বাক্য _____
বিলাপের ৪টি অধ্যায় তাই বর্ণমালা অনুসারে সাজানো। এছাড়া সম্পূর্ণ পুস্তকই একটি বাতিদান কাঠামো অনুসারে বসানো হয়েছে: ১ম ও ৫ম অধ্যায় সম্পর্কিত, ২য় ও ৪র্থ অধ্যায় সম্পর্কিত এবং ৩ অধ্যায় হল সেই গুরুত্বপূর্ণ মাঝের অধ্যায়। ৩য় অধ্যায়ের মাঝখানের অংশ হল সেই অতি বিখ্যাত বিলাপ ৩:২২-৩৩ পদ, যাতে আশার কথা প্রকাশিত।
কেন বিলাপ পুস্তক এত সাজানো? কিভাবে সম্ভব যে, যিরমিয়ের অন্তরের দুঃখ-কষ্টের প্রকাশ এত সাজানো-গুছানো কবিতা হতে পারে? যিরমিয় কি চরম বিশৃঙ্খলা, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সংগ্রাম, হতাশা ও সর্বনাশের মধ্যে অর্থ বা রীতিনীতি খোঁজেন? তিনি কি ধ্বংসের মধ্যে কোনভাবে সৌন্দর্য খোঁজেন? এমন একটি সময়ে যখন সব কিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে, যা স্থির ছিল সব ভেঙ্গে গেছে, যখন বোধ হয় সব কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে তখন এই ধরণের একটি শক্তিশালী কাঠামো কি ভাল লাগে? তিনি কি এই কাঠামো দ্বারা ঘটনার দুঃজনক সম্পূর্ণতা প্রকাশ করতে চান? তিনি কি শোকের ও হতাশার বিশালতা এভাবে প্রকাশ করেন? আমরা নিশ্চিত কোন উত্তর দিতে পারি না।
বিলাপ পুস্তকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পুনরুক্তি বিষয়
বিচারের প্রধান কারণ হল যিহূদার পাপ
বিশেষভাবে বিলাপ ১ অধ্যায়ে এই বিষয় খুব পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত: “তার অনেক পাপের জন্য সদাপ্রভুই তাকে দুঃখ দিয়েছেন। … আমার সব পাপ তিনি জোয়ালের মত বেঁধেছেন; তিনি হাত দিয়ে সেগুলো একসংগে বুনেছেন। সেগুলো আমার ঘাড়ের উপর দেওয়া হয়েছে … “সদাপ্রভু ন্যায়বান, আমি তো তার আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি” (বিলাপ ১:৫,১৪,১৮, ইত্যাদি)।
ঈশ্বরের বিচার এক এক দিন এক এক রকম হয় না, তা হূট করে ঘটে যাওয়ার মত কোনো ঘটনাও নয় বা ঈশ্বরের জ্বলন্ত ক্রোধের কারণেও ঘটে নি। ঈশ্বরের ক্রোধ সব সময় নীতি-ভিত্তিক, নিয়ন্ত্রিত, যুক্তিসঙ্গত ও অর্থপূর্ণ। ঈশ্বর বিচারের বিষয়ে অগ্রিম ঘোষণা দিয়েছিলেন, বার বার সাবধাণবাণীও দিয়েছিলেন, ভাববাদীদের পাঠিয়ে তার কারণও বুঝিয়েছিলেন এবং অনুতপ্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট সুযোগও দিয়েছেন। মানুষ যখন জেদী হয়ে সব চেতনা, বিবেক ও অনুতাপের সুযোগ ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বীকার করতে থাকে, শুধুমাত্র তখনই ঈশ্বর বিচার করেন।
ঈশ্বর নিজেই বিচার ঘটিয়েছেন
যিরমিয় খুব পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেন যে, ঈশ্বর নিজের হাতে বিচারটি ঘটিয়েছেন, তিনিই কর্তা, তিনিই বিচারক। তা বিশেষভাবে বিলাপ ২ অধ্যায়ে দেখা যায়: “হায়, সদাপ্রভু কিভাবে তাঁর ক্রোধে সিয়োন-কন্যাকে অন্ধকারে ঢেকে ফেলেছেন! … জ্বলন্ত ক্রোধে তিনি ইস্রায়েলের সমস্ত শক্তি নষ্ট করে দিয়েছেন। … তাঁর শক্তিশালী হাত তিনি গুটিয়ে নিয়েছেন। … সদাপ্রভু শত্রুর মত হয়েছেন; তিনি ইস্রায়েলকে গ্রাস করেছেন” (বিলাপ ২:১,৩,৫, ইত্যাদি)।
যিরমিয় কোন মতে মনে করেন না যে, বাবিল সাম্রাজ্যের পরাত্রম, সামরিক শক্তি বা শ্রেষ্ঠত্বের কারণে তারা যিহূদাকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। যিরূশালেমের ধ্বংস প্রমানিত করে যে, ঈশ্বরের উদ্ধার করার ক্ষমতা নেই বা তিনি বাবিলীয় দেবতাদের চেয়ে দুর্বল – এই চিন্তাটি যিরমিয়ের একদমই নেই। ‘আমরা তাদের চেয়ে দুর্বল, তাই তা ঘটল’, ‘যদি আমাদের আরো অস্ত্র থাকত তবে পরাজিত হতাম না’, ‘বেচারা আমরা! ঈশ্বর কেন আমাদের ত্যাগ করেছেন?’ – এই ধরণের চিন্তা বিলাপ পুস্তকে একেবারেই পাওয়া যায় না। বিলাপ পুস্তকে বলা হয় নি ‘বাবিল করেছে …’ বরং প্রত্যেক বার বলা হয়েছে ‘ঈশ্বরই করেছেন …’।
এর অর্থ এইও যে, ঈশ্বর নিজের দেশ, নিজের রাজধানী, নিজের উপাসনা-ঘর, আরাধনা, যাজকত্ব ও উৎসর্গ পদ্ধতি নির্মূল করেন: “তিনি বাগানের গাছের মত করে তাঁর বাসস্থানকে উপ্ড়ে ফেলেছেন; ধ্বংস করে দিয়েছেন তাঁর নির্দিষ্ট মিলন স্থানকে। … সদাপ্রভু সিয়োনকে তার সব পর্ব ও বিশ্রামবারের কথা ভুলিয়ে দিয়েছেন; ভয়ংকর ক্রোধে রাজা ও পুরোহিতকে তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। সদাপ্রভু তাঁর বেদীকে অগ্রাহ্য করেছেন, ত্যাগ করেছেন তাঁর পবিত্র জায়গা” (বিলাপ ২:৬-৭)।
কিন্তু কেন ঈশ্বর এমন করেছেন? কেন ঈশ্বর এমন একটি ঘটনা ঘটিয়েছেন যা সব জাতিরা এমনভাবে ব্যাখ্যা করবে যে, ইস্রায়েলের ঈশ্বর হলেন দুর্বল, তিনি উদ্ধার করতে জানেন না এবং তিনি বাবিলীয় দেবতাদের চেয়ে নিকৃষ্ট। ঈশ্বর এখানে তাঁর সুনাম ও মহিমা হারাতে রাজি, কিন্তু কি সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার জন্য তিনি তা ঘটাতে রাজি? ইতিহাসে দু’বার ঈশ্বর তার উপাসনা-ঘর একদম ধ্বংস হতে দেন (৫৮৬ খ্রীঃপূঃ এবং ৭০ খ্রীঃ), এবং দু’বার প্রায় একই কারণে: যখন উপাসনা-ঘর একটি নকল ধার্মিকতার কেন্দ্র হয়ে যায়, এমন একটি দালানে পরিণত হয় যা দেখতে সুন্দর কিন্তু প্রকৃতপক্ষে লোকদের ঈশ্বরের সঠিক আরাধনা থেকে মনোযোগ মিথ্যা বিশ্বাসের উপরে নিয়ে যায় এবং শেষে ঈশ্বরের বিরুদ্ধেই দাঁড়ায় – তবে উপসনা-ঘর বাদ দিলেই ভাল। এই ধরণের মিথ্যা বিশ্বাসগুলো বা ভুল নির্ভরতাগুলো ভাঙ্গার জন্য ঈশ্বর তার সুনাম হারাতে রাজি। বিষয়টি দেখতে কেমন বা মানুষ কি বলবে, তার চেয়ে বরং ঈশ্বর বাস্তববাদী এবং মানুষকে সত্য জানানো তাঁর চোখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বাসী হিসাবে আমরা অনেক বার মনে করি যে, ঈশ্বরের সুনাম, মণ্ডলীর সু্নাম বা খ্রিষ্টান ধর্মের সুনম রক্ষা করা আবশ্যক, খারাপ সাক্ষ্য, দূর্নাম বা অসম্মান যেন না হয়। যদিও উদ্দেশ্যটি ভাল তবুও সুনাম রক্ষা করার জন্য পাপ লুকানো, অস্বীকার করা অথবা মন্দ আচরণ প্রকাশ বা তার প্রতিরোধ না করা, এইটা ঈশ্বরের ইচ্ছা নয়। লোকেরা মিথ্যা বিষয়ের উপর ভরসা রাখবে, তাও ঈশ্বর চান না। লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়ালেও – সত্য প্রকাশিত হোক।
বাস্তবতা গ্রহণ করা
যিরূশালেমের ধ্বংসের দুঃখজনক ঐতিহাসিক ঘটনা যখন যিরমিয় বর্ণনা করেন, তিনি তা কোমলভাবে প্রকাশ করেন না এবং এই ঘটনার কষ্ট বা জঘন্যতা কমানোরও চেষ্টা করেন না। তিনি বাস্তব কথা বলেন, তিনি নিজেকে বাস্তবতার সম্মুখীন হতে বাধ্য করেন, তিনি এই ঘটনার দুঃখজনক অর্থ ও ফলাফল এড়িয়ে যান না, যতই খারাপ হোক না কেন। তিনি বাস্তবতাকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেন, তিনি সত্যে থাকেন, তিনি মন একটু হাল্কা করার জন্য কোন মিথ্যা মেনে নেন না।
তিনি প্রাণবন্ত ভাষায় ভিন্নভাবে বাস্তবতার বর্ণনা করেন, যেমন আবেগপ্রবন পার্থক্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে: “হায়! যে শহর একদিন লোকজনে পরিপূর্ণ ছিল সে কেমন একা পড়ে রয়েছে। যে শহর একদিন জাতিদের মধ্যে প্রধান ছিল, সে এখন বিধবার মত হয়েছে। যে ছিল প্রদেশগুলোর রাণী সে এখন হয়েছে দাসী … তার বিপক্ষেরা তার মনিব হয়েছে” (বিলাপ ১:১,৫)। তিনি শক্তিশালী রূপক ব্যবহার করেন “সিয়োনের রাস্তাগুলো শোক করছে, কারণ নির্দিষ্ট পর্বে কেউ আর আসে না। … তার নেতারা এমন সব হরিণের মত যারা চরবার জায়গা পায় না; তারা দুর্বল হয়ে তাদেরই আগে আগে পালিয়ে গেছে যারা তাদের তাড়া করছে” (বিলাপ ১:৪,৬)। তিনি আবেগপূর্ণ চেতনাদায়ক প্রশ্ন ব্যবহর করেন: “স্ত্রীলোকেরা কি তাদের নিজেদের সন্তানদের খাবে? যাদের তারা লালন-পালন করেছে? প্রভুর পবিত্র জায়গায় কি পুরোহিত ও নবীদের মেরে ফেলা হবে? … তোমার আঘাত সাগরের মত বড়; কে তোমাকে সুস্থ করতে পারে? … যদি সদাপ্রভু আদেশ না দেন তবে কে মুখে বলে কিছু ঘটাতে পারে? … পাপের জন্য শাস্তি পেলে পর মানুষ কেন তা নিয়ে নালিশ করবে? তুমি কি চিরকালের জন্য আমাদের ভুলে যাবে?” (বিলাপ ২:২০,১৩, ৩:৩৭,৩৯, ৫:২০)। তিনি যিরূশালেমকে ব্যক্তি হিসাবে চিন্তা করে নিজেকে তার স্থানে রেখে কথা বলেন: “আমাকে যে যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছে সেই রকম যন্ত্রণা কি আর কাউকে দেওয়া হয়েছে …? আমার যুবক-যুবতীরা বন্দী হয়ে দূরে চলে গেছে। আমার প্রেমিকদের আমি ডাকলাম কিন্তু তারা আমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করল” (বিলাপ ১:১২,১৯-১৯)। তিনি গভীর শোক ও আবেগ প্রকাশ করেন: “কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখ দুর্বল হয়ে পড়েছে, আমার ভিতরেও যন্ত্রণা হচ্ছে; আমার লোকেরা ধ্বংস হয়েছে … তোমার লোকদের অন্তর সদাপ্রভুর কাছে কেঁদে কেঁদে বলেছে, “হে সিয়োন-কন্যার দেয়াল, তোমার চোখের জল দিনরাত নদীর মত বয়ে যাক; তোমার নিজেকে শান্তি পেতে দিয়ো না … ওঠো, রাতের প্রত্যেক প্রহরের শুরুতে কেঁদে ওঠো; সদাপ্রভুর সামনে জলের মত ঢেলে দাও তোমার অন্তর। … তোমার ছেলেমেয়েরা যারা খিদের জ্বালায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ছে, তাদের জীবন বাঁচাবার জন্য তাঁর উদ্দেশে তোমার হাত তোল। … আমার লোকেরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেজন্য আমার চোখ থেকে জলের স্রোত বইছে” (বিলাপ ২:১১, ২:১৮-১৯, ৩:৪৮)। তিনি দুঃখ-কষ্টের আরো বাস্তব বর্ণনায় দেখান তা বিভিন্ন দলের উপর কিভাবে প্রভাব ফেলে: “আমরা অনাথ হয়েছি, আমাদের বাবা নেই, আমাদের মায়েরা বিধবা হয়েছে … আমাদের পূর্বপুরুষেরা পাপ করেছিলেন; … কিন্তু আমরা তাঁদের শাস্তি বহন করছি। … সিয়োনে স্ত্রীলোকদের নষ্ট করা হয়েছে; যিহূদার গ্রাম ও শহরে নষ্ট করা হয়েছে কুমারী মেয়েদের। উঁচু পদের কর্মচারীদের হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে; বৃদ্ধ নেতাদের সম্মান দেখানো হয় নি। যুবকদের যাঁতা ঘুরিয়ে পরিশ্রম করতে হচ্ছে; ছোট ছেলেরা কাঠের বোঝার ভারে টলমল করছে। শহর-ফটকের কাছে বৃদ্ধ নেতারা আর বসেন না; যুবকেরা বাজনা বাজানো থামিয়েছে” (বিলাপ ৫:৩,৭,১১-১৪)।
আবেগ, গভীর ভয় ও হতাশা প্রকাশ করার কি কোন লাভ আছে? বিলাপ পুস্তকে আমরা আবেগ চেপে রাখার কোন ছবি পাই না (stoic), আবেগ অস্বীকার করার ছবি (বৌদ্ধ ধর্মি) বা আবেগ ‘লাগা উচিত না’, এই ধরণের ছবিও দেখা যায় না। তার পুস্তকের মধ্য দিয়ে যিরমিয় নিজেকে জোর করে বাস্তবতার সম্মুখে রাখেন, বিশ্রী হলেও, ভাল না লাগলেও, ব্যাখ্যা বা অর্থ না জানলেও তিনি নিজেকে বাস্তবতার সম্মুখীন হতে বাধ্য করেন। যিরমিয় কান্না, নিরাশা ও ক্ষোভ, এসব আবেগ বাস্তব ও ঘটনার প্রতি উপযুক্ত ও অনুমোদিত সাড়া হিসাবে প্রকাশ করেন। যিরমিয় আমাদের দেখান যে, ঈশ্বরের সম্মুখে সব আবেগ প্রকাশ করা যায়, প্রকৃতপক্ষে সেইগুলো প্রকাশ করা ভাল। আবেগ প্রকাশ করলে ঈশ্বর আমাদের অন্তর স্পর্শ করতে, সুস্থ করতে, মলম লাগাতে, সান্ত্বনা দিতে, অর্থ ও গুরুত্ব বুঝাতে ও আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান। নিজের আবেগ নিয়ে যেমন তেমনভাবে ঈশ্বরের সামনে আসলে, অর্থাৎ আলোতে নিয়ে আসলে একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়, সুস্থ হওয়ার ও শান্ত হওয়ার একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু নিজের কষ্ট, রাগ, ক্ষোভ বা নিরাশা চেপে রাখলে তবে সেই নেতিবাচক আবেগগুলো মনের অন্ধকার কোনায় ঘুরতে থাকে।
যিরমিয়ের সংগ্রাম
যিরমিয় তার দেশ, শহর ও ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর সব ধ্বংস হতে দেখেন, তার জাতিকে যুদ্ধে, ঘেরাওয়ের কারণে দুর্ভিক্ষে ও মহামারীতে বিনষ্ট হতে দেখেন। যে অল্প সংখ্যক লোক বেঁচে গিয়েছিল, তাদের বন্দী হিসাবে দেবতাপূজারী বাবিল সাম্রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
যিরমিয় এই উপসংহারে আসতে বাধ্য যে, বছরের পর বছর প্রাণপণে ঈশ্বরের বাক্য প্রচার করা এবং যত কষ্ট হোক ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য হওয়ার কোন লাভ হয় নি, তিনি কোনো পরিবর্তন আনতে সক্ষমও হন নি। কত ত্যাগ-স্বীকার, অগ্রাহ্য, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, জীবনের হুমকি, বন্দী অবস্থা ও নির্যাতন তিনি মেনে নিয়েছেন! কিন্তু মোট কথা তার কোনো লাভ ছিল না। এই মুহূর্তে যিরমিয়ের হতাশা, পরাজয়, সর্বনাশ, একা হয়ে পড়া, ফলহীনতা, অক্ষমতা বা ক্ষোভ কত বেশি, তা আমরা মাত্র অনুভাব করতে পারি। তার সব পরিশ্রম, প্রচেষ্টা, প্রার্থনা, আশা ও ত্যাগ স্বীকার সব অর্থহীন মনে হচ্ছে।
যিরমিয় বিলাপ পুস্তকে তার অন্তরে সংগ্রাম, গভীর আশাহীনতা, এমন কি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ খোলাভাবে প্রকাশ করেন, বিশেষভাবে বিলাপ ৩:১-২১ পদে। তিনি কথা না ছেঁকে হৃদয় ঢেলে দেন: “আমি সেই লোক, যে সদাপ্রভুর ক্রোধের শাস্তি পেয়েছে। তিনি আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন; তিনি আমাকে আলোতে নয়, কিন্তু অন্ধকারে হাঁটিয়েছেন; সত্যিই সারাদিন ধরে তিনি আমার বিরুদ্ধে বারে বারে তাঁর হাত তুলেছেন। আমার চামড়া ও মাংসকে তিনি শুকিয়ে ফেলেছেন আর হাড়গুলো ভেংগে দিয়েছেন। তিনি মনোদুঃখ ও কষ্ট দিয়ে আমাকে আটক করে ঘিরে রেখেছেন। যারা অনেক দিন আগে মারা গেছে তাদের মত করে তিনি আমাকে অন্ধকারে বাস করিয়েছেন। আমি যাতে পালাতে না পারি সেজন্য তিনি আমার চারদিক ঘিরে রেখেছেন; আমাকে ভারী শিকল দিয়ে বেঁধেছেন। যখন আমি ডাকি বা সাহায্যের জন্য কাঁদি, তখন আমার প্রার্থনা তিনি শোনেন না। ভারী ভারী পাথর দিয়ে তিনি আমার পথ বন্ধ করেছেন; আমার পথ তিনি বাঁকা করে দিয়েছেন। আমার কাছে তিনি ওৎ পেতে থাকা ভাল্লুক আর লুকিয়ে থাকা সিংহের মত; পথ থেকে তিনি আমাকে টেনে এনে টুকরা টুকরা করেছেন এবং আমাকে একা ফেলে রেখে গেছেন। … তেতো দিয়ে তিনি আমাকে পূর্ণ করেছেন, বিষ দিয়ে আমার পেট ভরিয়েছেন। তিনি পাথর দিয়ে আমার দাঁত ভেংগেছেন আর ধুলার মধ্যে আমাকে মাড়িয়েছেন। শান্তি আমার কাছ থেকে দূর করা হয়েছে; মংগল কি, তা আমি ভুলে গেছি। তাই আমি বলি, “আমার শক্তি চলে গেছে। সদাপ্রভুর কাছ থেকে আমি যা কিছু আশা করেছিলাম তা-ও আর নেই।” আমার কষ্ট ও ঘুরে বেড়াবার কথা মনে কর; মনে কর আমার তেতো ও বিষে পূর্ণ জীবনের কথা।”
ঈশ্বরকে এই ধরণের কথা বলার সাহস তিনি কোথা থেকে পান? ঈশ্বরের দোষ কি এভাবে ধরা যায়? ঈশ্বরের স্বভাব-চরিত্র এবং আচরণ সম্বন্ধে কি এত নেতিবাচক কথা বলা ঠিক? যিরমিয়ের কথা কি ঠিক? তার কথা কি পবিত্র আত্মা দিয়ে চালিত লেখা? আমরা যদি বাইবেলের প্রকাশক হতাম তবে আমরা এই ধরণের কথা ‘ঠিন নয়’ বলে অবশ্যই বাদ দিতাম! কিন্তু ঈশ্বর যিরমিয়ের কষ্টের কথা বাদ দেন না। এর বিপরীত: ঈশ্বর নিশ্চিত করেন যে, ঠিক এই নেতিবাচক, গভীর হতাশার ও ক্ষোভের কথাগুলো যেন লিখে রাখা হয়, যেন শতাব্দীর পর শতাব্দীতে লোকেরা পড়তে পারে, যিরমিয়ের ঠিক কেমন লেগেছিল এবং ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তার কি বলার ছিল যেন তা জানা যায়। আমরা হলে বলতাম যে, উঁচুপদস্থ লোকদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক কিছু বলা যায় না। আমরা হলে বলতাম যে, ঈশ্বরের চরিত্র নিয়ে এত গভীর সন্দেহ করা ঠিক না এবং তা প্রকাশ করা মানে ঈশ্বরকে অপমানিত করা। কিন্তু ঈশ্বর কি করেন? আশ্চর্য বিষয় যে, তিনি একজন মানুষের অন্তর ঢেলে দেওয়া মনের সংগ্রাম, গভীর হতাশা, দোষারোপ, রাগ এবং এমন কি ক্ষোভের প্রকাশ নিয়ে নেন এবং সেই মানবীয় কথাগুলো ঈশ্বরের অনন্তকালীন অধিকারগত বাক্যে পরিণত করেন – কি অদ্ভুত বিষয়! যরিমিয়ের সংগ্রামের কথা হয়ে যায় ঈশ্বরের বাক্য। ইহাই প্রভুর বাণী!
যিরমিয়ের জীবন দেখে আমরা অবশ্যই বুঝতে পারি কেন তার এমন লাগে। ছোটবেলা থেকে তাকে তুচ্ছ ও ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হয়, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা ও জীবনের হুমকি দেওয়া হয়, রাজনৈতিক ও আত্মিক নেতারাই তা করেন, এবং এমন কি তার নিজের গ্রাম ও পরিবারের লোকেরাও তা করে। তিনি ক্ষমা করতে থাকেন, যিহূদার মঙ্গল ও উদ্ধার চাইতে থাকেন, বিনতি করতে থাকেন, তাদের প্রতি ঈশ্বরের দয়ার হৃদয় দেখাতে থাকেন – তাদের মাধ্যমে অপমান, হুমকি, নিযাতন, বন্ধন এবং অনাহারে রাখা সহ্য করার পরেও।
যিরূশালেমের ধ্বংস যখন ঘটে তখন যিরমিয় একজন সত্যিকারের ভাববাদী হিসাবে প্রমাণিত হন (দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:২০-২২)। কিন্তু যিরমিয়ের এই অনুমোদন কেমন লাগে? দেশের ধ্বংসের পরে অল্প কয়েকজন অনাহারী, পরাজিত যিহূদীদের বলতে পারা যেম ‘আমি ঠিক বলছি, দেখ না?’ – এর আনন্দ কি? যিরমিয় প্রমানিত হলেও এই ‘জয়’-এর মধ্যে তার কোনো আনন্দ নেই। বিলাপ পুস্তকে তিনি নিজের জাতির সাথে দাঁড়িয়ে লোকদের জন্য অন্তর থেকে শোক প্রকাশ করেন। তিনি ধ্বংস দেখে কান্না করেন এবং এত দিন ধরে তার ত্যাগ-স্বীকারের জীবন ও পরিচর্যার নিঃস্ফলতা নিয়ে নিরাশা প্রকাশ করেন।
যিরমিয় একটি দুঃখের যুগে এবং একটি জেদী জাতি নিয়ে আটকিয়ে আছেন, একজন ঈশ্বরকে নিয়ে আটকিয়ে আছেন যিনি তাকে একটি সান্ত্বনাহীন, একক, অন্তর ভেঙ্গে দেওয়ার মত আহ্বান দিয়েছেন: তেত শেষ সর্বনাশ পর্যন্ত তিনি বিশ্বস্তভাবে ঈশ্বরের হৃদয় প্রকাশ করতে থাকেন। যত কষ্টে ও সংগ্রামে নিজেকে খুঁজে পান না কেন, যিরমিয় ঈশ্বরকে ধরে রাখেন, এমন কি তার নিরাশা ও ক্ষোভের সময়েও। তিনি বিরক্ত, রাগী ও নিরাশা গ্রস্ত শিশুর মত যা ঈশ্বরের বুকে ধাক্কা দেয় – এবং ঈশ্বর তাকে ধরে রাখতে থাকেন। যিরমিয় ঈশ্বরের সঙ্গেই কষ্টভোগ করেন।
ঈশ্বরের কষ্টভোগ
যিরমিয়ের কষ্টভোগ নিয়ে অনেক কথা বলার পরে আমাদের সচেতন হওয়া ভাল যে ঈশ্বরও কষ্টভোগ করেন। ঈশ্বরই সেই স্বার্থহীন ভালবাসার ঈশ্বর যিনি তাঁর মনোনীত জাতিকে ইচ্ছাকৃতভাবে জেদ করে মন্দতা ও দেবতাপূজা আলিঙ্গন করতে দেখেন, এমন পর্যায় পর্যন্ত যেখানে ঈশ্বর তাদের আর উদ্ধার করতে পারেন না।
ঈশ্বর হলেন সেই হতাশা-গ্রস্ত প্রেমিক যিনি তার জাতির পিছনে দৌঁড়িয়েছেন, সেই লজ্জা গ্রস্ত স্বামী যার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে এবং যিনি সব কিছু শেষ করার সেই তেত দায়িত্ব পালন করেন। ঈশ্বরের কেমন লাগে যখন তার ৮২০ বছরের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়?
কিন্তু সব কিছুর মাঝখানে ঈশ্বর উদ্ধারকর্তা হতে থাকেন। তিনি যিরমিয়কে নিয়ে গর্বিত যিনি সব সংগ্রাম ও হতাশার মাঝেও ঈশ্বরের হৃদয় বিশ্বস্তভাবে প্রকাশ করতে থাকেন। ঈশ্বর যিরমিয়ের বিলাপ ব্যবহার করবেন, পুস্তকের সেই ঢেলে দেওয়া কষ্টের কথাগুলো তিনি শতাব্দীর পর শতাব্দীতে এমন লোকদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করতে থাকেন, যাদের বিরুদ্ধে বড় অন্যায় করা হয়েছে, যাদের সব কিছু হারাতে হয়েছে অথবা যাদের চরম হিংস্রতার সম্মুখে পড়তে হয়েছে।
পুস্তকের বা বাতিদানের মাঝখানের কথা
যিরমিয় কঠোর কষ্টভোগের মাঝে একটি পথ খুঁজে পান: “তবুও আমার আশা আছে, কারণ আমি এই কথা মনে করি: সদাপ্রভুর অটল ভালবাসার জন্য আমরা ধ্বংস হচ্ছি না, কারণ তাঁর করুণা কখনও শেষ হয় না; প্রতিদিন সকালে তা নতুন হয়ে দেখা দেয়; তাঁর বিশ্বস্ততা মহৎ” (বিলাপ ৩:২১-২৩)। সব কষ্টভোগের মাঝখানে যিরমিয় নিজের মনকে ধরে রেখে নিজেকে সেই অদৃশ্য বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেন যা কষ্টভোগের মত বাস্তব: তিনি ঈশ্বরের উপর নির্ভর করেন, ঈশ্বর যা তার জন্য ঠিক করেন, তিনি তা মেনে নেন এবং তিনি তার আহ্বান ও ভূমিকা মনেপ্রাণে পালন করেন “সদাপ্রভুর উপর যারা আশা রাখে ও তাঁর উপর নির্ভর করে তাদের তিনি মংগল করেন। সদাপ্রভু উদ্ধার না করা পর্যন্ত নীরবে অপেক্ষা করা ভাল” (বিলাপ ৩:২৫-২৬)। এখানে যিরমিয়ের দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ পায়, এমন একটি বিশ্বাস যা সহ্য করে, বিশ্বস্ত হতে থাকে এবং হতাশা অতিক্রম করে।
তিনি একা পড়ে রয়েছেন, তার সমর্থনকারী কেউ নেই বললে চলে, কিন্তু তিনি এমন কি এই অবস্থায়ও ঈশ্বরের মঙ্গলময়তা দেখতে সক্ষম হন “যৌবন কালে জোয়াল বহন করা মানুষের জন্য ভাল। সদাপ্রভুই সেই জোয়াল তার উপর দিয়েছেন, তাই সে একা চুপ করে বসে থাকুক। সে ধুলাতে মুখ ঢাকুক, হয়তো আশা থাকতেও পারে। যে তাকে মারছে তার কাছে সে গাল পেতে দিক, নিজেকে অপমানে পূর্ণ হতে দিক” (বিলাপ ৩:২৭-৩০)।
অনেক কঠিন আহ্বান পেলেও যিরমিয় অন্তরে ঈশ্বর থেকে আলাদা হন না, তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন এবং তাঁর কাছ থেকে শক্তি নিতে থাকেন। তিনি একটি অতি স্বচ্ছ ও শক্তিশালী জ্ঞান লাভ করেন: যদিও ঈশ্বর কষ্ট সরিয়ে নেন না, মানুষের কষ্টভোগ দেখতে তাঁর কোনো আনন্দ নেই: “তবুও তাঁর অটল ভালবাসা অনুসারে তিনি করুণা করবেন, কারণ তিনি ইচ্ছা করে মানুষকে কষ্ট কিম্বা মনোদুঃখ দেন না” (বিলাপ ৩:৩৩)। এই পদ হল বাতিদানের ঠিক মাঝখানের পদ, বিলাপ পুস্তকের কেন্দ্র ও মূল সংবাদ। কষ্টভোগে ঈশ্বরের কোন আনন্দ নেই, কষ্ট দেওয়াও তাঁর উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু ঈশ্বরের জন্য কষ্টভোগ কখনও অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন বা আশাহীন হয়ে দাঁড়ায় না – কষ্টভোগের মধ্য দিয়ে মূল্যবান কিছু অর্জন করা যায়, ঈশ্বর কষ্টভোগ থেকে মঙ্গল তৈরি করতে জানেন।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।