পৌল ও তীমথিয় কলসীয় শহরের মণ্ডলীর কাছে এই চিঠি লেখেন। কলসী ছিল রোম রাজ্যের এশিয়া মাইনর প্রদেশে এশিয়া জেলার একটি শহর (আজকের তুর্কী)। কলসী অবস্থিত ছিল রোম রাজ্যে পশ্চিম থেকে পূর্বে যাওয়ার মহাসড়কে।
পৌল তার তৃতীয় প্রচার যাত্রায় কলসী শহরের কাছাকাছি ইফিষ শহরে প্রায় তিন বছর ধরে সুসমাচার প্রচার করেন, বিস্তারিত শিক্ষা ও শিষ্যত্ব দেন এবং নতুন কর্মী গঠন করেন। প্রেরিত পুস্তকে ইফিষ শহরে পৌলের এই সময়ের সারাংশ করে বলা হয়: “তাতে যে যিহূদী ও গ্রীকেরা এশিয়া প্রদেশে থাকত তারা সবাই প্রভুর বাক্য শুনতে পেল” (প্রেরিত ১৯:৮-১০)। ইপাফ্রা নামে একজন লোক বিশ্বাসী এই সময় হন, পৌল তাকে প্রশিক্ষণ দেন এবং ইপাফ্রা তার নিজের শহর কলসীতে এবং একই উপত্যকায় লায়দিকেয়া ও হিয়রাপলি শহরে ফিরে গিয়ে সেখানে মণ্ডলী স্থাপন করেন (কল ৪:১২-১৩, কল ১:৭)। তাই কলসীয় মণ্ডলী পৌলকে নিজের চোখে দেখে নি (কল ২:১), কিন্তু মণ্ডলীগুলির স্থাপন ও বৃদ্ধি পৌলের নেতৃত্বে হয়েছিল। কলসীয় মণ্ডলীর কিছু প্রাচীনরা ইফিষে পৌলের সহকর্মী ছিলেন, যেমন ফিলীমন ও আর্খিপ্প (ফিলীমন ১)।
কলসীয় মণ্ডলীর বিশ্বাসীদেরকে চারিদিকের সংস্কৃতি দ্বারা অনেক চাপের সম্মুখিন হতে হয়। তার উত্তরে পৌল বলেন যদি তারা যীশুকে পেয়েছে তবে তারা তার সঙ্গে পূর্ণতা লাভ করেছে এবং অন্য কোনো আত্মিক চাপ গ্রহণ করা দরকার নেই। এর জন্য পৌল যীশুর একটি শক্তিশালী বর্ণনা দিয়ে তার চিঠি শুরু করেন: “এই পুত্রের সংগে যুক্ত হয়ে আমরা মুক্ত হয়েছি, অর্থাৎ আমরা পাপের ক্ষমা পেয়েছি। ১৫ এই পুত্রই হলেন অদৃশ্য ঈশ্বরের হুবহু প্রকাশ। সমস্ত সৃষ্টির আগে তিনিই ছিলেন এবং সমস্ত সৃষ্টির উপরে তিনিই প্রধান, ১৬ কারণ আকাশে ও পৃথিবীতে, যা দেখা যায় আর যা দেখা যায় না, সব কিছু তাঁর দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে। মহাকাশে যাদের হাতে রাজত্ব, কর্তৃত্ব, শাসন ও ক্ষমতা রয়েছে তাদের সবাইকে তাঁকে দিয়ে তাঁরই জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। ১৭ তিনিই সব কিছুর আগে ছিলেন এবং তাঁরই মধ্য দিয়ে সব কিছু টিকে আছে। ১৮ এছাড়া তিনিই তাঁর দেহের, অর্থাৎ মণ্ডলীর মাথা। তিনিই প্রথম আর তিনিই মৃত্যু থেকে প্রথম জীবিত হয়েছিলেন, যেন সব কিছুতে তিনিই প্রধান হতে পারেন। ১৯ ঈশ্বর চেয়েছিলেন যেন তাঁর সব পূর্ণতা খ্রীষ্টের মধ্যেই থাকে। ২০ তা ছাড়া পৃথিবীতে হোক বা স্বর্গে হোক, খ্রীষ্টের মধ্য দিয়ে তাঁর নিজের সংগে সব কিছুর মিলনও তিনি চেয়েছিলেন। খ্রীষ্ট ক্রুশের উপর তাঁর রক্ত দান করে শান্তি এনেছিলেন বলেই এই মিলন হতে পেরেছে” (কল ১:১৪-২০)।
যীশুই সব কিছু। যদি একজন বিশ্বাসী যীশুকে পেয়ে থাকে তবে সে সব কিছুই পেয়েছে। তার অন্য কোনো আত্মিক চাপ বা দাবি গ্রহণ করা প্রয়োজন নেই, যেমন যিহূদীদের, সন্যাসীদের, উদারপন্থীদের বা গুপ্ত দলদের চাপ। যিহূদীরা বিশ্বাসীদের চাপ দিত: তুমি কি আইন পালন করছ? তুমি কি আসলে ধার্মিক? সন্যাসীরা চাপ দিত: তুমি কি উপবাস করছ? তুমি কি তোমার শরীর নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম? উদারপন্থীরা চাপ দিত: কেন যা চাও তাই করছ না? তুমি কি জান না যে অনৈতিকতা আত্মাকে প্রভাবিত করতে পারে না? গুপ্ত দলের লোকেরা চাপ দিত: তুমি কি গুপ্ত জ্ঞান ও বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছ?
পৌলের উত্তর এই: যীশুতে বিশ্বাসীরা ইতিমধ্যে পূর্ণতা লাভ করেছে। যীশুতে বিশ্বাসীদের ধার্মিক বলে ঘোষণা ও গ্রহণ করা হয়েছে। যীশুতে তারা সব আশীর্বাদ ও আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। যীশু এসেছেন মানে যে আলো উপস্থিত। সূর্য উঠে গেছে বলে এখন কে মোম বাতি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে?
পরে পৌল কলসীয় বিশ্বাসীদের চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা এই সর্বশ্রেষ্ঠ যীশুকে পেয়ে পবিত্রভাবে জীবন-যাপন করে। পৌল চান যেন তারা শুধুমাত্র যীশুর উপর আস্থা রেখে তাদের পরিত্রাণের সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা পায় এবং যীশুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাঁর মত মনোভাবে ও আচরণে চলে। পৌল তাদের উৎসাহিত করেন যেন তারা গভীরভাবে খ্রীষ্টকে জেনে ও খ্রীষ্টেতে তাদের পরিচয় সম্পূর্ণভাবে বুঝে পবিত্র ও ফলবান জীবন করে।
কলসীয় মণ্ডলীর স্থাপন
কলসী শহর ছিল পূর্ব-পশ্চিম রোমীয় মহাসড়কে অব্স্থিত। শহরটি অনেক আগে স্থাপিত হয়েছিল এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ছিল জনবহুল একটি শহর। কলসী শব্দের অর্থ হল “বিরাট বড়” (ইংরেজিতে এই শব্দ «colossal” আজ পর্যন্ত ব্যবহিৃত)। যখন এশিয়া মাইনর এবং এশিয়া জেলা প্রায় ১৩৩ খ্রীষ্টাব্দে রোম রাজ্যের সাথে যোগ দেয় তখন কলসী শহর রোম রাজ্যের অধীনে চলে আসে।
পৌল নিজেকে কলসীয় চিঠির লেখক হিসাবে চিহ্নিত করেন (কল ১:১, ১:২৩, ৪:১৮) কিন্তু তিনি নিজেকে মণ্ডলীর স্থাপনকারী হিসাবে দাবি করেন না (কল ২:১)। পৌল, যিনি আর একজনের পরিচর্যার ক্ষেতে পা দিতে চান না (রোমীয় ১৫:২০) অথচ এখানে এমন একটি মণ্ডলীর কাছে চিঠি লেখেন যা তিনি নিজেই স্থাপন করেন নি। কেন তিনি তা করেন?
এশিয়ার মণ্ডলীগুলি কিভাবে স্থাপন হয়েছিল প্রেরিত পুস্তকে আমরা তার কোন খুঁটিনাটি অথ্য পাই না। কিন্তু একটি সারাংশ দেওয়া হয়: প্রেরিত পুস্তকের লেখক লূক বর্ণনা করেন যে পৌল তার তৃতীয় প্রচার যাত্রায় প্রায় তিন বছর ধরে (৫৩-৫৬ খ্রীঃ) এশিয়ার সদর থানা ইফিষে প্রচার করেন, শিক্ষা ও শিষ্যত্ব দেন এবং কর্মীদের গঠন করেন (প্রেরিত ১৯:৮-১০)। পৌল প্রিষ্কা ও আকিলার ইফিষে মণ্ডলী স্থাপন করার কাজে অংশ গ্রহণ করেন (প্রেরিত ১৮:১৮-২৬) এবং ইফিষকে তার পরিচর্যার কেন্দ্র বানিয়ে সারা এশিয়া এলাকা সুসমাচর ছড়ানোর কাজ করেন। ইফিষ শহরে পৌলের পরিচর্যাকে লূক এভাবে সারাংশ করে বর্ণনা করেন: “তাতে যে যিহূদী ও গ্রীকেরা এশিয়া প্রদেশে থাকত তারা সবাই প্রভুর বাক্য শুনতে পেল” (প্রেরিত ১৯:১০)।
পৌলের কাজের মাধ্যমে ইপাফ্রা নামে একজন বিশ্বাসী হয়ে যান, শিক্ষা পান এবং পরে তার নিজের শহর কলসীতে ফিরে গিয়ে সেখানে মণ্ডলী স্থাপন করেন (কল ১:৭)। তাছাড়া ইপাফ্রা কাছাকাছি লায়দিকেয়া ও ইয়রাপলি শহরেও নতুন মণ্ডলী স্থাপন করেন (কল ৪:১২-১৩)। তাই যদিও পৌল কলসীয়, লায়দিকেয়া ও ইয়রাপলি মণ্ডলীগুলির স্থাপনকারী নন তবুও সেগুলি তার একজন কর্মী দ্বারা স্থাপিত হয়েছিল বলে পৌল নিজেকে তাদের জন্য দায়ী মনে করেন এবং তাদের দেখাশুনা করতে থাকেন। সম্ভবত, কলসী মণ্ডলীর কিছু প্রাচীন বা সদস্য প্রথমে ইফিষে পৌল দ্বারা বিশ্বাসী হয়েছিলেন এবং পরে তাদের দেশে ফিরে গিয়েছিলেন, যেমন ফিলীমন বা আর্খিপ্প (ফিলীমন ১-২)।
কলসীয় চিঠি লেখার সময়ে পৌলের পরিস্থিতি
পৌল কলসীয় চিঠি জেলখানা থেকে লেখেন (কল ৪:৩, ৪:১০, ৪:১৮)। পৌল তার জীবনে সুসমাচার প্রচারের কারণে বেশ কয়েকবার জেলে ছিলেন, ৫০ খ্রীষ্টাব্দে ফিলিপী শহরের এক রাত, ৫৪-৫৫ খ্রীষ্টাব্দে ইফিষে, ৫৭ খ্রীষ্টাব্দে অল্পদিন যিরূশালেমে, ৫৭-৫৯ খ্রীষ্টাব্দে দুই বছর ধরে কৈসরিয়ায় এবং ৬০-৬২ খ্রীষ্টাব্দে রোমে যাওয়ার পরে আর ২ বছর রোম শহরে। কিন্তু কোন সময় তিনি কলসীয় চিঠিটি লেখেন। উত্তর দিতে গেলে আরো কিছু খুঁটিনাটি বিষয় দেখতে হবে:
আসলে পৌল একই সময়ে জেল থেকে কম পক্ষে চারটি চিঠি লেখেন: ফিলিপীয়, ইফিষীয়, কলসীয় ও ফিলীমন চিঠি (যাদেরকে জেলের চিঠিও বলা হয়)। চিঠিগুলি যে একসাথে লেখা ও পাঠানো হয়েছে তা চিঠিগুলির কিছু মিল দেখে বুঝা যায়: পৌল চারটি চিঠিতেই বলেন যে তিনি বন্দী, চিঠিগুলির বাহক তুখিক দুইটি চিঠিতে উল্লিখিত (কল ৪:৭, ইফি ৬:২১), পৌল দুইটি চিঠিতে বলেন যে তিনি আশা করেন যে তাকে শিঘ্রই ছেড়ে দেওয়া হবে (ফিলি ২:৩৪, ফিলীমন ২২), শুভেচ্ছা পাঠানোর ক্ষেত্রের প্রায় একই লোকেরা পৌলের সাথে উপস্থিত (কল ৪:৯-১৭, ফিলী ২৩-২৪) এবং দুইটি চিঠির মূল বিষয়ে অনেক মিল দেখা যায় (ইফিষীয়, কলসীয়)। ফিলিপীয় চিঠিতে পৌল উল্লেখ করেন যে “এখানকার রাজবাড়ীর সৈন্যদল” তার মধ্য দিয়ে সুসমাচার পাচ্ছে (ফিলি ১:১৩) এবং যে “সম্রাট কৈসরের বাড়ীর লোকেরা” সুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে (ফিলি ৪:২২)। এই দুইটি পদ থেকে বুঝা যায় যে সম্ভবত পৌল ৬০-৬২ খ্রীষ্টাব্দে রোম শহরের জেলখানা থেকে লেখেন।
মণ্ডলীর স্থাপন থেকে পৌলের চিঠি পাওয়া পর্যন্ত তাই ৬ থেকে ৯ বছর সময় গেছে। বোধ হয় যে ইপাফ্রা পৌলের সাথে দেখা করার জন্য রোম শহরে গিয়েছিলেন এবং তার কাছে মণ্ডলীর অবস্থা ও বর্তমান চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন (কল ৪:১২-১৩)। কিভাবে ইপাফ্রা রোম শহরে বন্দী হয়েছিলেন, তা পরিষ্কার না (ফিলীমন ২৩)। হতে পারে ইপাফ্রা চলে যাওয়ার সময় মণ্ডলীর দায়িত্ব স্থানীয় প্রাচীনদের হাতে দিয়েছিলেন, যেমন আর্খিপ্প ও ফিলীমন (ফিলীমন ২, কল ৪:১৮)।
কলসীয় মণ্ডলীর আত্মিক পরিস্থিতি
কলসীয় চিঠি পড়ে বুঝা যায় যে কলসীয় মণ্ডলী চারিদিকের বিভিন্ন ধর্ম, দল বা সংস্কৃতিগুলির সামনে পড়ে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল এবং এভাবে বিভিন্ন আত্মিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল:
যিহূদী ও যিহূদী আইন-কানুন
একটি বড় প্রভাব ছিল যিহূদী এবং তাদের আইন-কানুন পালন করার ভিত্তিতে ধার্মিক হওয়ার চাপ: “তোমরা কি আইন-কানুন পালন করছ? তোমরা ঐতিহ্যগুলি অনুসারে জীবন-যাপন করছ? তোমরা কি জান না যে ঈশ্বর এক হাজার বছর ধরে আইন-কানুন পালনের দাবি করেছেন? তোমরা কি জান না যে যীশু যিহূদী ছিলেন এবং তিনি নিজেও সুন্নত প্রাপ্ত ছিলেন? তোমরা কি যীশুর চেয়ে কম করে গ্রহণযোগ্য হবে? তোমরা কি ধর্মে সমর্পিত নও?”
পৌল তার চিঠিতে যিহূদী ধরণের এই চাপের বিষয়ে কিভাবে উত্তর দেন? “তোমরা সাবধান হও, যেন কেউ … তোমাদের বন্দী হিসাবে টেনে নিতে না পারে। খ্রীষ্টের সংগে সেই শিক্ষার কোন সম্বন্ধ নেই; মানুষের গড়া চলতি নিয়ম … উপরেই তা নির্ভর করে” (কল ২:৮)। তিনি তাদেরকে নিশ্চয়তা দান করে বলেন “এছাড়া তোমরা খ্রীষ্টের সংগে যুক্ত হয়েছ বলে তোমাদের সুন্নতও করানো হয়েছে। এই সুন্নত কোন মানুষের হাতে করানো হয় নি, খ্রীষ্ট নিজেই তা করেছেন; অর্থাৎ দেহের উপর পাপ-স্বভাবের যে শক্তি ছিল সেই শক্তি থেকে তিনি তোমাদের মুক্ত করেছেন” (কল ২:১১)। পৌল দেখান যে বিশ্বাসী হিসাবে কলসীয়রা আর আইনের অধীনে নয়: “তিনি আমাদের সব পাপ ক্ষমা করেছেন, আর আমাদের বিরুদ্ধে যে দলিল ছিল তার সমস্ত দাবি- দাওয়া সুদ্ধ তা বাতিল করে দিয়েছেন। সেই দলিল তিনি ক্রুশে পেরেক দিয়ে গেঁথে নাকচ করে ফেলেছেন” (কল ২:১৩-১৪)। “তোমরা কেন আবার জগতের নিয়মের অধীন হচ্ছ? যে সব জিনিস ব্যবহার করতে করতে নষ্ট হয়ে যায় সেই সব জিনিসের বিষয়ে এই রকম নিয়ম আছে-ধোরো না, খেয়ো না, ছুঁয়ো না। এই সব নিয়ম তো কেবল মানুষের দেওয়া আদেশ ও শিক্ষা” (কল ২:২০-২২)।
গ্রীক দর্শন
গ্রীক দর্শন ছিল একটি প্রচলিত চিন্তার ধরণ। গ্রীক দর্শন জ্ঞান, যুক্তি-তর্ক, বুদ্ধি ও ভাল কথা বলার ক্ষমতার উপরে গুরুত্ব দিত এবং তা বিশ্বাসীদের অন্যভাবে চ্যালেঞ্জ করত: “তোমার বিশ্বাস কি জ্ঞানের চেয়ে বুদ্ধিমান কিছু? আসল দার্শনিকদের সামনে দাঁড়িয়ে তুমি কি যুক্তি দিয়ে দেখাতে পারবে তুমি কেন বিশ্বাস করছ? শিক্ষিতদের সামনে তোমার ধর্ম কি ভেঙ্গে পড়ে না? তুমি এত নিশ্চিত কিভাবে? তোমার তো অন্ধ বিশ্বাস ছাড়া আর কিছু নেই। যদি এত নিশ্চিত হও তবে বুঝাতে পারছ না কেন?”
পৌল এই ধরণের চাপের বিষয়ে বলেন: “আমি তোমাদের এই কথা বলছি যাতে কেউ মন ভুলানো যুক্তিতর্ক দিয়ে তোমাদের ভুল পথে নিয়ে যেতে না পারে” (কল ২:৪)। “তোমরা সাবধান হও, যেন কেউ মানুষের ফাঁপা ছলনাপূর্ণ দর্শনের শিক্ষা দ্বারা তোমাদের বন্দী হিসাবে টেনে নিতে না পারে” (কল ২:৮)। “যেন তোমাদের পুরস্কার পাবার পথে বাধা না জন্মায়। এই রকমের লোক যা দেখেছে বলে ভান করে সেই বিষয়ে অনেক বড় বড় কথা বলে এবং বিনা কারণেই অহংকারে ফুলে ওঠে, কারণ তাদের মন পাপ-স্বভাবের অধীন” (কল ২:১৮)। “এই সব নিয়মগুলো দেখতে মনে হয় বেশ জ্ঞানে পূর্ণ … কিন্তু পাপ- স্বভাবকে বশ করবার ব্যাপারে এগুলোর কোন মূল্যই নেই” (কল ২:২৩)। পৌল দাবি করেন যে সেই“গুপ্ত সত্য” মানবীয় জ্ঞান দ্বারা বুঝা যায় না বরং “ঈশ্বর চাইলেন, অযিহূদীদের মধ্যেও তাঁর এই গুপ্ত সত্যের মহা গৌরব যে কি, তা যেন তাঁর সব লোকেরা জানতে পারে। সেই সত্য এই-খ্রীষ্ট তোমাদের অন্তরে আছেন বলে তোমরা মহিমা পাবার আশ্বাস পেয়েছ” (কল ১:২৭)। “খ্রীষ্টের মধ্যে সব জ্ঞান ও বুদ্ধি লুকানো আছে” (কল ২:৩), তাই আসল জ্ঞান নিজের বুদ্ধি বা যুক্তি-তর্কের ক্ষমতা থেকে আসে না।
সন্ন্যাস বা মনিঋষি চিন্তা
সন্ন্যাসের চিন্তা অনুসারে শুধুমাত্র আত্মা বা আত্মিক বিষয় ভাল কিন্তু মানুষের দেহ বা এই বস্তু জগত সব মন্দ। তাই আত্মিক হতে চাইলে শরীরকে কষ্ট দিতে হবে, জোর করে বশে আনতে হবে – উপসাব দিয়ে হোক বা আত্ম-যন্ত্রনা দিয়ে হোক। এভাবে একজন বিশ্বাসী আত্মিক অভিজ্ঞতা বা প্রকাশ পেয়ে আলোকিত হতে পারে। সন্ন্যাসের চিন্তা বিশ্বাসীদের চ্যালেঞ্জ করে বলে: “তুমি কি যথেষ্ট আত্মিক? তুমি কি যথেষ্ট কষ্ট করছ মনে কর? তুমি কি মনে কর একটু “দয়া” পেলে তুমি আত্মিক হতে পার? তুমি কি মনে কর যে গভীর আত্মিক অভিজ্ঞতা এত সহজে পাওয়া যায়? কিভাবে আত্মিক হবে যদি শরীরের উপর তোমার নিয়ন্ত্রণ নেই? যীশু তো কষ্টভোগের পথ পছন্দ করেছিলেন, ঠিক না?”
পৌল এই বিষয়ে শক্তিশালীভাবে উত্তর দেন: “নিজেদের দেহকে কষ্ট দেওয়া ও স্বর্গদূতদের উপাসনা করা যারা দরকারী বলে মনে করে তারা যেন তোমাদের পুরস্কার পাবার পথে বাধা না জন্মায়। এই রকমের লোক যা দেখেছে বলে ভান করে সেই বিষয়ে অনেক বড় বড় কথা বলে এবং বিনা কারণেই অহংকারে ফুলে ওঠে” (কল ২:১৮)। “জগতের লোকদের মতই তোমরা কেন আবার জগতের নিয়মের অধীন হচ্ছ? যে সব জিনিস ব্যবহার করতে করতে নষ্ট হয়ে যায় সেই সব জিনিসের বিষয়ে এই রকম নিয়ম আছে-ধোরো না, খেয়ো না, ছুঁয়ো না। এই সব নিয়ম তো কেবল মানুষের দেওয়া আদেশ ও শিক্ষা। এই সব নিয়মগুলো দেখতে মনে হয় বেশ জ্ঞানে পূর্ণ, কারণ কি করে উপাসনা করা যায়, কিভাবে নিজেদের নীচু করা যায়, কিভাবে নিজের দেহকে কষ্ট দেওয়া যায়, তা এই নিয়মগুলো লোকদের জানায়, কিন্তু পাপ- স্বভাবকে বশ করবার ব্যাপারে এগুলোর কোন মূল্যই নেই” (কল ২:২০-২৩)। পৌল বিশ্বাসীদের স্মরণ করিয়ে দেন যে ঈশ্বর উভয় আত্মিক ও বস্তু, দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের সৃষ্টিকর্তা (কল ১:১), মানুষের আত্মা এবং মানুষের শরীর উভয়েরই সৃষ্টিকর্তা। সব কিছু যীশুর মধ্য দিয়ে, যীশুর জন্য এবং যীশুর উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি হয়েছে (কল ১:১৬-১৭)। যীশুই পূর্ণতা, সব পূর্ণতা তাঁর মধ্যেই আছে, খ্রীষ্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমরা সেই পূর্ণতা পেয়েছি (কল ১:১৯, ২:৯-১০)। যদিও বিশ্বাসীদের শিখতে হবে তাদের শরীর উপুক্ত ও নৈতিকভাবে ব্যবহার করতে তবুও নিজে বেছে নেওয়া আত্ম-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে ‘আত্মিক’ হতে চাইলে, তা আসলে অহংকার এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা ছাড়া আর কিছু নয়।
উদারপন্থী
উদারপন্থীর চিন্তা সন্ন্যাসের চিন্তার সাথে মিল আছে: তারা বলে যে শুধুমাত্র আত্মা বা আত্মিক বিষয় ভাল কিন্তু মানুষের দেহ বা এই বস্তু জগত সব মন্দ। কিন্তু তারা অন্য উপসংহারে আসে: আত্মিক ও বস্তু জগত সম্পূর্ণ আলাদা। আত্মা এত উঁচু বিষয় যে শরীর নিয়ে একজন কি করে বা না করে, তা আত্মাকে প্রভাবিত বা দূষিত করতে পারে না। তাই আত্মিক মানুষ হল স্বাধীন মানুষ, যা চায় তাই করা অনুমোদিত, যৌন ক্ষেত্রে হোক, হৈ-হুল্লার ক্ষেত্রে হোক।
উদারপন্থী চিন্তা অন্যভাবে মণ্ডলীকে চাপ দিত: “তুমি কি জান না যে তোমার আত্মা তোমার দেহের চেয়ে উঁচু? যে ঈশ্বর দেহের চেয়ে মহান? সত্যি আত্মিক হওয়াতে দেহের কোন বিষয় আসে না। দয়া ও আত্মিক অনুমোদন পেয়েছ বল তোমরা স্বাধীন। সব কিছু ঈশ্বরের, সব কিছু অনুমোদিত। বস্তু জগতে এমন কিছু নেই যা তোমার আত্মাকে দূষিত করতে পারে।”
পৌল এর উত্তরে বলেন: “আলোর রাজ্যে ঈশ্বরের লোকেরা যে অধিকার লাভ করবে তার ভাগী হবার জন্য তিনি তোমাদের উপযুক্ত করে তুলেছেন, কারণ তিনি অন্ধকারের রাজ্য থেকে আমাদের উদ্ধার করে তাঁর প্রিয় পুত্রের রাজ্যে এনেছেন” (কল ১:১২-১৩)। “তাহলে তোমরা যখন খ্রীষ্টের সংগে মৃত্যু থেকে জীবিত হয়েছ তখন খ্রীষ্ট স্বর্গে যেখানে ঈশ্বরের ডান দিকে বসে আছেন সেই স্বর্গীয় বিষয়গুলোর জন্য আগ্রহী হও” (কল ৩:১)। “সেইজন্য তোমাদের পাপ-স্বভাবের মধ্যে যা কিছু আছে তা ধ্বংস করে ফেল। তাতে আছে সব রকম ব্যভিচার, অশুচিতা, কুবাসনা, মন্দ ইচ্ছা এবং লোভ যাকে এক রকম প্রতিমাপূজা বলা যায়” (কল ৩:৫)।
গুপ্ত ভ্রান্ত দল
গুপ্ত ভ্রান্ত দলগুলো ছিল দেব-দেবতা পূজা ভিত্তিক এমন দল যা তাদের সব কর্যক্রম, ধর্মীয় রীতি-নীতি বা অনুশীলন গুপ্ত করে রাখত। তারা গুপ্ত বলে মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য তাদেরকে ঘনিষ্ট সম্পর্কের একটি সমাজের প্রতিজ্ঞা করত। তারা এই দেবতার আত্মিক অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত প্রকাশের প্রতিজ্ঞা করত। গুপ্ত দলে একবার যোগ দিলে আর বের হওয়া যেত না। বড় ও কঠোর ধর্মকর্ম পালন, উৎসর্গ দান ও রক্তপাতের মাধ্যমে এই দলে প্রথম প্রবেশ করতে হত। এই ধরণের গুপ্ত দল কলসীতেও অবস্থিত ছিল বলে মণ্ডলীর উপর চাপ সৃষ্টি হত: “তুমি কি তোমার ঈশ্বরকে আসলে জান? তাঁর সাথে এক হওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করেছ? তুমি কি গুপ্ত জ্ঞানের অধিকারী? তুমি কি যা লুকানো আছে, সে রহস্য গভীরভাবে জান? তুমি কি রীতি-নীতি পালন করে প্রবেশ করেছ? তুমি কি সে মনোণিত আত্মিক লোকদের মধ্যে একজন?”
পৌল উত্তরে বলেন: “নিজেদের দেহকে কষ্ট দেওয়া ও স্বর্গদূতদের উপাসনা করা যারা দরকারী বলে মনে করে তারা যেন তোমাদের পুরস্কার পাবার পথে বাধা না জন্মায়। এই রকমের লোক যা দেখেছে বলে ভান করে সেই বিষয়ে অনেক বড় বড় কথা বলে এবং বিনা কারণেই অহংকারে ফুলে ওঠে, কারণ তাদের মন পাপ-স্বভাবের অধীন” (কল ২:১৮)। “খ্রীষ্টের সংগে মরে তোমরা যখন জগতের নানা রীতিনীতির কাছ থেকে দূরে সরে এসেছ তখন জগতের লোকদের মতই তোমরা কেন আবার জগতের নিয়মের অধীন হচ্ছ?” (কল ২:২০)। পৌল শক্তিশালীভাবে দাবি করেন যে শুধুমাত্র বিশেষ অল্প লোকদেরকে “গুপ্ত সত্য” দেওয়া হয়েছে, তা নয় বরং তিনি বলেন: “ঈশ্বরের বাক্যের মধ্যে যে গুপ্ত সত্য আগেকার লোকদের কাছে যুগ যুগ ধরে লুকানো ছিল, এখন তাঁর লোকদের কাছে তা প্রকাশিত হয়েছে। ঈশ্বর চাইলেন, অযিহূদীদের মধ্যেও তাঁর এই গুপ্ত সত্যের মহা গৌরব যে কি, তা যেন তাঁর সব লোকেরা জানতে পারে। সেই সত্য এই-খ্রীষ্ট তোমাদের অন্তরে আছেন বলে তোমরা মহিমা পাবার আশ্বাস পেয়েছ” (কল ১:২৬-২৭)। পৌল দাবি করেন যে সেই “গুপ্ত সত্য” সবারই কাছে প্রকাশিত হয়েছে, তাই রহস্য বলতে আর কিছু নেই, কোন বিশেষ জ্ঞান বা দলে প্রবেশ করার আর দরকার নেই। বরং ঈশ্বর যে উভয় যিহূদী এবং অযিহূদীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং ঈশ্বর যে আসলে প্রত্যেক বিশ্বাসীর অন্তরে বাস করেন, তা হল সেই অদ্ভুত “গুপ্ত সত্য” যা আগে প্রকাশিত হয় নি! আবারও তিনি গুরুত্বের সঙ্গে বলেন যে “ঈশ্বরের সমস্ত পূর্ণতা খ্রীষ্টের মধ্যে দেহ নিয়ে বাস করছে, আর খ্রীষ্টের সংগে যুক্ত হয়ে তোমরাও সেই পূর্ণতা পেয়েছ। তিনি মহাকাশের সমস্ত শাসনকর্তা ও ক্ষমতার অধিকারীদের উপরে” (কল ২:৯-১০)। আর কারও চাপ গ্রহণ করার দরকার নেই, অর্জন করার মত আত্মিক কিছু আর নেই – যীশুতে সব কিছুই পেয়েছ!
প্রয়োগ – এই মহান যীশুর যোগ্যরূপে জীবন-যাপন কর!
পৌল উপসংহার করেন: যদি বিশ্বাসীরা যীশুতে সব কিছুরই অধিকারী হয়েছে, যদি তাদের যীশুের মধ্য দিয়ে নিঃসর্তভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে একটি ঘনিষ্ট সম্পর্কে আনা হয়েছে, যদি যীশু তাদের জন্য এত অদ্ভুত একটি স্বাধীনতা অর্জন করেছেন – তবে এখন তাদের এই অদ্বিতীয় যীশুর যোগ্যরূপে জীবন-যাপন করা দরকার।
পৌল তাদের জন্য প্রার্থনা করেন যেন তারা “এতে যেন তোমরা সৎ কাজ করে ফলবান হও এবং ঈশ্বরকে আরও ভাল করে জানতে পার; আর এইভাবে যেন সব কিছুতে প্রভুকে সন্তুষ্ট করবার জন্য তাঁর যোগ্য হয়ে চলতে পার” (কল ১:১০)। “তোমরা যেভাবে খ্রীষ্ট যীশুকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করেছ ঠিক সেইভাবে তাঁর সংগে যুক্ত হয়ে তোমাদের জীবন কাটাও” (কল ২:৬)।
যীশু কে হন, তা ধরে রাখা
কিভাবে একজন মানুষের জীবন পরিবর্তিত হয়ে যায়? আরো কষ্ট করে বাধ্য হওয়ার প্রচেষ্টা দ্বারা অথবা আরো কঠোর নিয়ম পালন দ্বারা? পৌল বরং বলেন: যীশু কে হন এবং তিনি আমাদের জন্য কি করেছেন যদি আমরা তা আরো বুঝতে পারি, আরো গ্রহণ করি এবং আরো ধরে রাখি তবে আমাদের জীবন পরিবর্তিত হয়। পৌল আরো বলেন “আমি তোমাদের জানাতে চাই যে, তোমাদের জন্য এবং লায়দিকেয়া শহরের মণ্ডলীর লোকদের জন্য, আর যারা আমাকে দেখে নি তাদের সকলের জন্য আমি প্রাণপণ পরিশ্রম করছি। আমি চাই যেন তারা অন্তরে উৎসাহ পায় এবং ভালবাসায় এক হয়, আর খ্রীষ্টের বিষয় বুঝবার ফলে যে নিশ্চয়তা পাওয়া যায় সেই পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রচুর পরিমাণে লাভ করে। তার ফলে ঈশ্বরের গুপ্ত সত্যকে, অর্থাৎ খ্রীষ্টকে তারা জানতে পারবে। খ্রীষ্টের মধ্যে সব জ্ঞান ও বুদ্ধি লুকানো আছে” (কল ২:১-৩)।
মন স্থির করা, মনোগোগ দেওয়া
পৌল বিশ্বাসীদের চ্যালেঞ্জ করেন “তাহলে তোমরা যখন খ্রীষ্টের সংগে মৃত্যু থেকে জীবিত হয়েছ তখন খ্রীষ্ট স্বর্গে যেখানে ঈশ্বরের ডান দিকে বসে আছেন সেই স্বর্গীয় বিষয়গুলোর জন্য আগ্রহী হও” বা “মনোযোগ দাও” বা “মন স্থির করে রেখ” (কল ৩:১)। তিনি তাদের আরো বলেন “তোমাদের পুরানো “আমি”কে তার কাজ সুদ্ধ কাপড়ের মত ছেড়ে ফেলে তোমরা তো নতুন “আমি”কে পরেছ। এই নতুন “আমি” আরও নতুন হতে হতে তার সৃষ্টিকর্তার মত হচ্ছে, যেন সেই সৃষ্টিকর্তাকে তোমরা পরিপূর্ণভাবে জানতে পার” (কল ৩:৯-১০)। “কাপড়”এর রূপক খুবই উপযুক্ত একটি রূপক কারণ কাপড় পরা হল এমন কিছু যা বার বার স্বত্রিয়ভাবে করতে হয়। কাপড় পরা কঠিন নয় কিন্তু তা দৈনিক করতে হয়। ঠিক তেমনি পৌল কলসীয়দের বলেন যেন তারা তাদের মন ও চিন্তাকে পরিচালনা করে, সঠিক বিষয়ে মনোযোগ দেয়, সঠিক বিষয়ের জন্য আগ্রহী হয় এবং সত্যকে ধরে রাখে। মনের সঠিক পরিচালনার জন্য অনবরত মনোযোগ প্রয়োজন।
কৃতজ্ঞতা
একজন বিশ্বাসী হিসাবে আমি কিভাবে সেই মনের সঠিক পরিচালনা করব এবং সত্যকে ধরে রাখব? চিঠিটিতে পৌল একটি উত্তর হিসাবে বলেন: কৃতজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তা সম্ভব (কল ২:৭, ৩:১৬-১৭, ৪:২)। যদি আমরা কৃতজ্ঞ হই তবে খুব ব্যবহারিকভাবে যীশু কে হন এবং তিনি যা করেছেন, তা নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেই এবং মনে মনে ধরে রাখি। আমি তাতে মূল্য দিতে শিখি এবং বিশ্বস্ত হতে অনুপ্রেরণা পাই। কৃতজ্ঞতা আমাদের মনকে ঠিক সেই সন্দেহ, অনিশ্চয়তা বা হতাশা থেকে রক্ষা করে যা আসে যখন আমরা বিভিন্ন চাপের সম্মুখীন হই: ঈশ্বর যখন আমাদের বড় মনে সব কিছু দান করেছেন তখন “না” বলার কে আছে? তাছাড়া কৃতজ্ঞতা সুসম্পর্ক তৈরি করে, মানুষকে মূল্য দেয় ও ভাল আচরণ বা সেবা চিহ্নিত রাখে। পৌল এই চিঠিতে নিজেই কৃতজ্ঞ হওয়ার আদর্শ হন। চিঠির শুরুতে তিনি স্বীকার করেন মণ্ডলীর বিশ্বাস ও ভালবাসা থেকে তিনি কত উৎসাহ পেয়েছেন (কল ১:৩) এবং চিঠির শেষে তিনি বিভিন্ন সহকর্মীদের অবদানের জন্য তাদের প্রশংসা করেন (কল ৪:৭-১৭)।
ভবিষ্যৎ আশা
পৌল কলসীয়দের বিভিন্নভাবে নিশ্চয়তা দান করেন এবং তাদেরকে নিয়ে তার আশা প্রকাশ করেন: “খ্রীষ্ট যীশুর উপর তোমাদের বিশ্বাস এবং ঈশ্বরের সব লোকদের প্রতি তোমাদের ভালবাসার কথা আমরা শুনেছি, আর সেইজন্য যতবার আমরা তোমাদের জন্য প্রার্থনা করি ততবারই … ধন্যবাদ দিয়ে থাকি। স্বর্গে তোমাদের জন্য যা জমা করা আছে তা পাবার আশা থেকেই তোমাদের মধ্যে এই বিশ্বাস ও ভালবাসা জন্মেছে। যে সুখবর, অর্থাৎ সত্যের বাক্য তোমাদের কাছে পৌঁছেছে তার মধ্যেই তোমরা এই আশার কথা শুনেছ” (কল ১:৪-৫)। “অবশ্য এর জন্য খ্রীষ্টের বিষয়ে সুখবর থেকে যে নিশ্চিত আশা তোমরা পেয়েছ তা থেকে দূরে সরে না গিয়ে তোমাদের বিশ্বাসে স্থির থাকতে হবে” (কল ১:২৩)। “ঈশ্বর চাইলেন, অযিহূদীদের মধ্যেও তাঁর এই গুপ্ত সত্যের মহা গৌরব যে কি, তা যেন তাঁর সব লোকেরা জানতে পারে। সেই সত্য এই-খ্রীষ্ট তোমাদের অন্তরে আছেন বলে তোমরা মহিমা পাবার আশ্বাস পেয়েছ” (কল ১:২৭)। বিশ্বাসীদের হৃদয়ে যে আশা আছে, তা হল ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া একটি দান। আশা হল পবিত্র আত্মার একটি ফল। কিন্তু আশা ধরে রাখার ক্ষেত্রে বিশ্বাসীরও একটি ভূমিকা আছে: নিজের মন ঈশ্বরের উপর স্থির করা এবং দৈনিক বিষয়ে বিশ্বস্ত হওয়া।
লোভকে ধ্বংস করে ফেলা
পৌল অন্যান্যা বিষয়ের সঙ্গে বিশ্বাসীদের লোভের বিষয়েও সাবধানবাণী দেন: “সেইজন্য তোমাদের পাপ-স্বভাবের মধ্যে যা কিছু আছে তা ধ্বংস করে ফেল। তাতে আছে সব রকম ব্যভিচার, অশুচিতা, কুবাসনা, মন্দ ইচ্ছা এবং লোভ যাকে এক রকম প্রতিমাপূজা বলা যায়” (কল ৩:৫)। কেন পৌল লোভকে “এক রকম প্রতিমাপূজা” বলেন? লোভ মানে আমি আমার প্রয়োজন বা আমার আকাঙ্ক্ষা অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে এবং বিশেষভাবে ঈশ্বরের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই। লোভ হল কৃতজ্ঞতার বিপরীত। কৃতজ্ঞতা বলে: “দেখ, কত কিছু আমি পেয়েছি”। লোভ বলে: “ঈশ্বর আমাকে যথেষ্ট দেন নি। যা আমি চাই তা আমার নিজের জন্য অর্জন করতে হবে”। লোভ হল অবিশ্বাসের একটি প্রকাশ। একটি প্রবাদ বিবেচনা করুন: “টাকা-পয়সা ভাল দাস, কিন্তু খারাপ মনিব”।
জীবনের ও কাজের মূল্য
পৌল চান যেন বিশ্বাসীরা তাদের জীবনের, সাক্ষ্যের ও পরিশ্রমের মূল্য বোঝে। তিনি তাদেরকে বিশ্বস্ত, পরিশ্রমী ও স্বক্রিয় হতে উৎসাহিত করেন, যেন তারা নিজের অবদানের ক্ষমতা বোঝে। তিনি তা দাসদের ক্ষেত্রেও বলেন। আমরা চিন্তা করি যে দাসদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বলতে কিছু নেই, কিন্তু পৌল উল্টা তাদেরকে নিজের আচরণ ও মনোভাবের গুরুত্ব বুঝান: “তোমরা যারা দাস, তোমরা সব বিষয়ে তোমাদের এই জগতের মনিবদের বাধ্য থেকো। যখন তাঁরা তোমাদের লক্ষ্য করেন কেবল তখনই যে তাঁদের খুশী রাখবার জন্য তাঁদের বাধ্য থাকবে তা নয়, বরং খাঁটি অন্তরে প্রভুর উপর ভক্তি রেখে তাঁদের বাধ্য থেকো” (কল ৩:২২)। পৌল চান যেন বিশ্বাসীরা তাদের সময়, সুযোগ ও সাক্ষ্য দানের মূল্য বোঝে: “যারা ঈশ্বরের লোক নয় তাদের সংগে বুদ্ধি ব্যবহার করে চোলো এবং খ্রীষ্টের বিষয়ে সাক্ষ্য দেবার প্রত্যেকটা সুযোগ কাজে লাগায়ো” (কল ৪:৫)।
একতা
কলসীয় বিশ্বাসীরা নিজেদেরকে বিভিন্ন চাপের সম্মুখীন খুঁজে পায়, যিহূদী, গ্রীক দর্শন, সন্ন্যাস, উদারপন্থী অথবা গুপ্ত ভ্রান্ত দল থেকে হোক। সেগুলি সব শিক্ষা দেয় যে কিছু লোক ভাল এবং অন্যরা খারাপ, কিছু লোক ‘ভিতরে’ ও কিছু লোক ‘বাইরে’, কেউ কেউ গ্রহণযোগ্য আবার অন্যদের অগ্রহ্য করা হয়েছে। এই ধরণের চিন্তাগুলি অহংকার, আত্ম-ধার্মিকতা, উঁচু-নীচু ভাব, তুলনা ও বিভেদকে উৎসাহিত করে। পৌল এর বিরুদ্ধে বলেন যে সব মানুষ সমান: আমরা সবাই একইভাবে অযোগ্য, আমাদের সবার জন্য ঈশ্বরের দয়া প্রয়োজন এবং আমরা সবাই যীশুতে এই দয়া পাই। সুসমাচার তাই অহংকার, আত্ম-ধার্মিকতা, তুলনা ও বিভেদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। যীশুর দয়াই একতার ভিত্তি। পৌল যীশুতে পরিত্রাণ সম্বন্ধে বলেন: “এই অবস্থায় অযিহূদী বা যিহূদীর মধ্যে, সুন্নত-করানো বা সুন্নত-না-করানো লোকের মধ্যে, অশিক্ষিত, নীচজাতি, দাস বা স্বাধীন লোকের মধ্যে কোন তফাৎ নেই; সেখানে খ্রীষ্টই প্রধান এবং তিনি প্রত্যেকের মধ্যেই আছেন” (কল ৩:১১)। অহংকারের আর কোন কারণ নেই! লজ্জারও আর কোন কারণ নেই!
কলসীয় চিঠির একটি মূল সুর হল এই: পৌল চান বিশ্বাসীরা যেন জানে যীশুতে তারা সব কিছু পেয়েছে, যেন তারা আর কোন আত্মিক চাপ গ্রহণ না নেয় বরং কৃতজ্ঞতায় এবং নিশ্চয়তায় বিশ্বস্তভাবে জীবন-যাপন করে: “খ্রীষ্ট তোমাদের অন্তরে আছেন বলে তোমরা মহিমা পাবার আশ্বাস পেয়েছ” (কল ১:২৭)।
বিস্তারিত অধ্যনের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।