
বিপরীতমুখী পরিবর্তন
- ১৮৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত পশ্চিমা দেশের অধিকাংশ লোকদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বাইবেল ভিত্তিক: তারা বিশ্বাস করত যে, একজন সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তার সৃষ্টিতে স্বক্রিয় ভূমিকা পালন করেন: তিনি আশীর্বাদ করেন, উদ্ধার করেন, প্রকাশ ও প্রজ্ঞা দান করেন এবং বিচার করেন। তারা বিশ্বাস করত যে, ঈশ্বর সব কিছুর উপরে প্রভু এবং সব কিছু, অর্থাৎ বস্তু জগত এবং আত্মিক জগত উভয় তাঁরই।
- ১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে চার্লস্ ডার্ভিন্ এই দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেন, তিনি বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার দ্বারা তা-ই করেন। বিশ্বাসীরা চার্লস্ ডার্ভিনের এই শিক্ষা অগ্রাহ্য করে কিন্তু তারা তা বিজ্ঞানের ভিত্তিতে করে না। বরং তারা দাবি করে যে, বিজ্ঞান হল বাইবেল, বিশ্বাস ও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে। বিশ্বাসীরা উপসংহারে আসে যে, বিজ্ঞান খারাপ, বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করা যায় না, বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিশ্বাসীদের জন্য উপযুক্ত কাজ নয়।
- বিজ্ঞানের পাশাপাশি অন্য ক্ষেত্রেও একই ধরণের পরিবর্তন ঘটতে লাগল: সরকারের ক্ষেত্রে বাইবেলের বিরুদ্ধীয় দৃষ্টিভঙ্গি ঘোষণা করা হয়, যেমন সমাজতান্ত্রিক চিন্তা বা হিটলারের National socialism ইত্যাদি), যার কারণে বিশ্বাসীরা সরকার ক্ষেত্রেও মন্দ বিষয় মনে করতে শুরু করে। ফলে অনেক বিশ্বাসীরা রাজনৈতিক বা সরকারের কাজ ত্যাগ করে তা অযোগ্য পেশা মনে করতে শুরু করে।

- এইভাবে খ্রিষ্টানদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বিখণ্ডিত হয়, তারা সব কিছু দু’ভাগে ভাগ করতে শুরু করে: আত্মিক বনাম জাগতিক, ভাল বনাম মন্দ, গুরুত্বপূর্ণ বনাম গুরুত্বহীন, যোগ্য বনাম অযোগ্য। ঈশ্বর আত্মিক বিষয়ের ঈশ্বর, কিন্তু তিনি জাগতিক বিষয়ের ঈশ্বর নন বলে ধারণা করা হত।
- আত্মিক কাজ মানে: রবিবারে উপাসনা, চার্চ, খ্রিষ্টান পরিচর্যা, প্রচার, খ্রিষ্টান মিশন, পরিবার, ইত্যাদি।
- জাগতিক কাজ মানে: পেশাগুলো, ব্যবসা, সরকারি কাজ, বিজ্ঞান, টাকা অর্জন, শিল্প ও বিনোদন ইত্যাদি।
- এই দ্বিখণ্ডিত চিন্তার একটি উদাহরণ: উনবিংশ শতাব্দীতে একজন ডাক্তার যদি ধরুন আফ্রিকায় মিশন কাজে পাঠানো হত তবে তার কাজ ছিল আফ্রিকায় অন্য মিশনারীদের বাঁচানো। আফ্রিকান লোকদের জন্য মেডিকেল ক্ষেত্রে সাহায্য করা অথবা আফ্রিকানদের গণস্বাস্থ্যের জন্য কাজ করা, এধরণের চিন্তা ছিল না।
- চার্লস্ ডার্ভিনের সময় থেকে খ্রিষ্টান মতবাদেও পরিবর্তন ঘটে: আগে ঈশ্বরের রাজ্য নিয়ে শিক্ষা দেওয়া হত (‘তোমার রাজ্য আইসুক … এখানে’)। পরবর্তীতে পরিত্রাণের মতবাদ প্রচলিত হয়। খ্রিষ্টানরা ‘পরিত্রাণ’ প্রচার করতে শুরু করে। তারা চিন্তা করে যে, শুধুমাত্র এক বিষয়ই আবশ্যক: প্রচারের মাধ্যমে আত্মাদের জয় করা যেন আরো অনেক মানুষ পরিত্রাণ পেয়ে স্বর্গে যেতে পারে। এছাড়া খ্রিষ্টানদের এই পৃথিবীতে তেমন কোনো ভূমিকা নেই। এই পৃথিবী ধ্বংসের পথে আছে, তাই এই পৃথিবীতে পরিবর্তন ঘটাতে চেষ্টা করা মানে ভুল বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকা। ‘জাহাজ ডুবে গেলে জাহাজের মেঝে পরিস্কার করা কি লাভ আছে?’ এই ধরণের চিন্তা প্রচলিত হতে শুরু করে।
- মোশির আইন-কানুন অনুসারে, ঈশ্বরের “shalom”, অর্থাৎ “ঈশ্বরের শান্তি” বা “সুঅবস্থা” দেখতে কেমন (দ্বিতীয় বিবরণ ২৮)? দেখা যায় যে, “ঈশ্বরের শান্তি” হল সব ক্ষেত্রেই শান্তি বা সুঅবস্থা: পরিবারে সুসম্পর্ক, উর্বর ক্ষেত-খামার, অর্থনৈতিক প্রাচুর্য, রাজনৈতিক স্থিরতা, সুরক্ষিত সীমানা, ন্যায় বিচার, যোগাযোগে সত্য, উপযুক্ত সময়ে বিশ্রাম, শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ, ব্যবহারিক জীবনে প্রজ্ঞা ইত্যাদি।
- যখন খ্রিষ্টানদের মধ্যে যীশুর দ্বিতীয় আগমন নিয়ে একটি নতুন মতবাদ প্রচলিত হয় (Dispensationalism) তখন এই দ্বিখণ্ডিত চিন্তা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে: এই পৃথিবীকে শীঘ্রই বিচার ও ধ্বংস করা হবে। আমাদেরকে জরুরীভাবে আত্মাদের জয় করতে হবে। যীশু ফিরে এসে আমাদেরকে তুলে ধরে আত্মিক স্বর্গে নিয়ে যাবেন। এই দৃষ্টি অনুসারে পৃথিবীর জন্য বা বর্তমান সমাজের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসা মানে সময় ও শক্তি নষ্ট করা মাত্র। তা হল আসল বিষয় থেকে সরে যাওয়া।
- সেই সময়ের পর থেকে এই দ্বিখণ্ডিত চিন্তা খ্রিষ্টান মিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের কাছে পৌঁছানো হয়, যেমন বাংলাদেশের কাছেও।
আত্মিক হওয়া মানে কি?
দ্বিখণ্ডিত চিন্তাটি পৌলের একটি কথা ভুল বুঝার কারণেই আরো বেড়ে যায়। যখন পৌল ‘মাংস’, ‘মাংসিক’, ‘জগত’, ‘জাগতিক’ বনাম ‘আত্মিক’ শব্দ ব্যবহার করেন তখন তিনি প্রকৃতপক্ষে কি বুঝাতে চান? চিন্তা করা হত যে:
- আত্মা ও স্বর্গ দেহ ও জগত
- ‘আত্মিক’, ‘স্বর্গের’ ‘মাংস’, ‘জাগতিক’, ‘বস্তু’
- = ভাল = খারাপ বা মন্দ
- স্থির থাকবে, অনন্তকাল স্থায়ী ক্ষণিক মাত্র, স্থির থাকবে না, ধ্বংস হয়ে যাবে
- ইভাঞ্জেলিকেল উদারপন্থী
- ঈশ্বরীয় জাগতিক
- পরিত্রাণ সামাজিক পরিবর্তন
এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে চিন্তা করা হয় যে, এই জগত এবং এই শরীর বিশ্বাসীর জন্য বড় প্রলোভন ও সমস্যা। বস্তু জগত হল পাপ-আক্রান্ত এবং ধ্বংসের পথে। বিশ্বাসীরা চিন্তা করে যে, যদি আমরা এই শরীরকে, অর্থাৎ ‘মাংসকে’ অতিক্রম করতে পারি তবে আমরা ‘আত্মিক’ হতে পারব।
এই চিন্তার ভুল ঠিক কোথায়?

- প্রকৃতপক্ষে এই চিন্তাগুলোর সাথে বাইবেলীয় চিন্তার তেমন মিল নেই: যদি এই বস্তু জগত খারাপ বা মন্দ তবে ঈশ্বর তা কেন সৃষ্টি করেছেন? তিনি এই বস্তু জগতকে কেন জীবন দিতে থাকেন? এই জগতকে কেন ভালবাসেন? শরীর যদি খারাপ এবং ‘প্রলোভন ছাড়া আর কিছু নয়’ তবে কেন ঈশ্বর মানুষকে শরীর দিয়েছেন? যদি শরীর মন্দ তবে ঈশ্বর কেন মানুষদের আত্মা বা স্বর্গদূত হিসাবে সৃষ্টি করেন নি? যদি মাংসই হল বড় সমস্যা তবে পৌল যখন “মাংসের কার্যগুলো সকল” বর্ণনা করেন (গালা ৫:১৯-২১) তিনি তালিকায় কেন অর্ধেকের চেয়েও বেশি এমন পাপ উল্লেখ করেন যা শরীরের সাথে কোন সংযোগ নেই? যেমন প্রতিমা-পূজা, যাদুবিদ্যা, শত্রুতা, ঝগড়া, রাগ, অমিল, দলাদলি, হিংসা ইত্যাদি।
- যদি মানুষের শরীর তার প্রলোভিত হওয়ার প্রধান কারণ হয়ে থাকে তবে শয়তান কিভাবে পাপ করেছে? তার তো কোন শরীরই নেই, সে তো মাত্র আত্মা। পাপের সবচেয়ে গভীর শিকড় শরীর, এমন নয়। বরং আমাদের অন্তরের অহংকারই হল প্রধান সমস্যা।
- যদি এই বস্তু জগত এবং মানুষের শরীর মন্দ, যদি স্বর্গ ‘আত্মিক মাত্র’ তবে কেন যীশু পুনরুত্থানে একটি বস্তু শরীর পান?
- যদি এই বস্তু জগতকে ধ্বংস ও বাতিল করা হবে তবে কেন প্রকাশিত বাক্যের শেষে প্রতিজ্ঞা দেওয়া হয় যে, ঈশ্বর “নতুন মহাকাশ ও নতুন পৃথিবী” স্থাপন করবেন (প্রকাশিত ২১:১)। আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য “বিজ্ঞান ০৯ – মহাকাশ ও পৃথিবী” দেখুন।
সংশোধন করার পরে ছবি দেখতে কেমন
- ঈশ্বর আত্মিক এবং বস্তু জগত উভয়কে সৃষ্টি করেছেন, চেয়েছেন এবং আজ পর্যন্ত এর যত্ন নেন।
- আত্মিক এবং বস্তু জগত উভয় পাপে আক্রান্ত, উভয়কে ঈশ্বর বিচার করে ধ্বংস করবেন (২ পিতর ৩:৭), উভয়কে ঈশ্বর “খ্রীষ্টের শাসনের অধীনে আনবেন” (ইফিষীয় ১:১০), উভয় “ক্ষয়ের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে ঈশ্বরের সন্তান্তদের স্বাধীনতার ভাগী” হবে (রোমীয় ৮:২১), মানুষ বদলে যাবে (১ করি ১৫:৪২,৫১), “পৃথিবীতে হোক বা স্বর্গে হোক” সব কিছু “খ্রীষ্টের মধ্য দিয়ে তাঁর নিজের সঙ্গে … মিলনে” এনেছেন বা “সম্মিলিত করেন” (কলসীয় ১:২০) এবং ঈশ্বর উভয়কে নতুনভাবে সৃষ্টি করবেন (প্রকাশিত ২১:১)।
- যদিও আমাদের মৃত্যুর পরে মৃত দেহ মাটিতে গলে যাবে এবং আমাদের আত্মা যীশুর কাছে চলে যাবে (স্বর্গে আত্মাগুলো যীশুর সঙ্গে), এই অবস্থা যে শেষ অবস্থা, এমন নয়। যীশুর দ্বিতীয় আগমনে তিনি এসে আত্মিক ও বস্তু জগতে যত মন্দ আছে (মন্দ আত্মা ও মন্দ মানুষ) বিচার করে সরাবেন এবং উভয় আত্মিক ও বস্তু জগত পাপ-মুক্ত করে পুনরায় স্থাপন করবেন। সব মানুষের শারীরিক পুনরুত্থান হবে, যেমন যীশুরও হয়েছিল।
- মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ এই নয় যে, আমাদের শরীর আছে এবং আমরা বস্তু জগতে বাস করি। বরং আমাদের চ্যালেঞ্জ হল জীবনের সব কিছু যীশু ও পবিত্র আত্মার অধীনে নিয়ে আসা। ‘আত্মিক হওয়া’ মানে না ‘আত্মা হওয়া’। ‘আত্মিক হওয়া’ মানে প্রত্যেক মুহূর্তে পবিত্র আত্মার পরিচালনায় এবং যীশুর মনোভাবে জীবন-যাপন করা, চাষ করার সময়ে, প্রচার করার সময়ে, সন্তানকে খাওয়ানোর সময়ে, পরিষ্কার করার সময়ে, ব্যবসা করার সময়ে ইত্যাদি।
- ‘জাগতিক না হওয়া’ মানে মানুষ হিসাবে স্বার্থপরতা, অহংকার, আত্ম-কেন্দ্রিক চিন্তা এবং দমন করার আকাঙ্খা দিয়ে চালিত না হওয়া।
৪০০০ বছর ধরে একই কথা
- আদম আদি ১:২৮-৩০ ‘এই পৃথিবীকে তোমার শাসনের অধীনে আন!’
- অব্রাহাম আদি ১২:১-৩ ‘পৃথিবীর সব জাতিদের আশীর্বাদ কর!’
- যীশু মথি ২৮:১৯ ‘সব জাতিদের শিষ্য করে তুলো!’