মূর্তি তৈরি করার নিষেধাজ্ঞা

দ্বিতীয় বিবরণ ৫:৮-৯ ১০ আজ্ঞা

“পূজার উদ্দেশ্যে তোমরা কোন মূর্তি তৈরী করবে না, তা আকাশের কোন কিছুর মত হোক বা মাটির উপরকার কোন কিছুর মত হোক কিম্বা জলের মধ্যেকার কোন কিছুর মত হোক। ৯ তোমরা তাদের পূজাও করবে না, তাদের সেবাও করবে না, কারণ কেবলমাত্র আমি সদাপ্রভুই তোমাদের ঈশ্বর। আমার পাওনা ভক্তি আমি চাই। যারা আমাকে ঘৃণা করে তাদের পাপের শাস্তি আমি তাদের তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত দিয়ে থাকি।”

দ্বিতীয় বিবরণ ৪:৯-১২

“যতদিন তোমরা বেঁচে থাকবে ততদিন তোমরা সতর্ক থাকবে এবং নিজেদের উপর কড়া নজর রাখবে যাতে তোমরা চোখে যা দেখেছ তা ভুলে না যাও এবং তোমাদের অন্তর থেকে তা মুছে না যায়। … ১০ তোমরা সেই দিনের কথা মনে কর যেদিন তোমরা হোরেবে তোমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভুর সামনে উপস্থিত হয়েছিলে … ১১ তখন তোমরা কাছে গিয়ে সেই পাহাড়ের নীচে দাঁড়িয়ে ছিলে … ১২ তোমরা তাঁর কথা শুনেছিলে কিন্তু কোন চেহারা দেখতে পাও নি, কেবল স্বরই শুনেছিলে।”

  • চারুকলায় আমরা বিভিন্ন জিনিস, গাছ-পালা, জীব-জন্তু বা মানুষের ছবি এঁকে থাকি। এটি কি ঈশ্বরের এই আজ্ঞা অনুসারে নিষিদ্ধ?
  • দেখা যায় যে, সব মানুষ স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন ছবি আঁকার বা মূর্তি তৈরি কাজে আকৃষ্ট। ছবি আঁকা কি উচিত নয়? অঙ্কন, চিত্র, আবক্ষ, মুখোশ, মূর্তি, পোস্টার বা ফোটো কি খারাপ বা মন্দ? তাহলে কি আয়না ব্যবহার করাও ঠিক নয়? নিষেধাজ্ঞাটি কি শুধুমাত্র মানুষ উপস্থাপনা করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? না কি মাত্র জীব-জন্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য (যেমন এখানে উল্লিখিত)? গাছ-পালার ছবি আঁকা কি ঠিক হবে? দূত বা আত্মাকে আঁকা কি নিষেধ?
  • ইস্রায়েল জাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কিভাবে এই আজ্ঞাটি বুঝেছিল এবং পালন করেছিল? প্রকৃতপক্ষে ইস্রায়েলে মানুষ, দূত বা আত্মার মূর্তি তৈরি করা নিষেধ ছিল।
  • ইসলাম এই আইন আরো কঠোরভাবে ব্যাখ্যা করেছে: মানুষের কোন ছবি, চিত্র, মূর্তি ইত্যাদি চলবে না। যদি মুসলিম শিল্পী কাজে মোহাম্মদের ছবি আঁকা হয় তবে তার মুখের সামনে একটি পরদাও আঁকা হয় (ছবিটি দেখুন)। খ্রিষ্টানরা যেমন ছবিসহ বাইবেল প্রকাশ করে, তা ইসলাম ধর্মে গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষ, জীব-জন্তু বা অন্যান্য ছবির পরিবর্তে কারুকাজ বিশিষ্ট নকশা ইসলাম ধর্মে গ্রহণযোগ্য (ছবি দেখুন)।
  • নীল পোস্টমেন (Neil Postman) নামে একজন আধুনিক সেকুলার লেখক তার একটি চমৎকার বইয়ে (‘Amusing ourselves to death’) বলেন যে, ইস্রায়েল জাতিকে ছবির নিষেধাজ্ঞা দ্বারা ঈশ্বর তাদেরকে ‘ছবির স্তর’ থেকে ‘ধারণার স্তরে’ উঠতে বাধ্য করেছিলেন। ছবি বা মূর্তির সামনে কোন ধর্মকর্ম অনুশীলনের চেয়ে তাদেরকে ঈশ্বরের চরিত্র, গুনাবলি, আচরণ, মনোভাব, কারণ, নীতি বা নৈতিকতাকে নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করেছিলেন। ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে এইভাবে উন্নত করেছিলেন।
  • পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে, পরবর্তীতে খ্রিষ্টানরা এই নিষেধাজ্ঞা মানত না। এর কারণ কি হতে পারে? সম্ভাবনা বেশি যে, এর কারণ হল এই: যীশু খ্রীষ্ট দ্বারা ঈশ্বর ‘দৃশ্যমান’ হয়েছিলেন। যীশু অর্থাৎ “এই পুত্রই হলেন অদৃশ্য ঈশ্বরের হুবহু প্রকাশ” (কলসীয় ১:১৫)। যীশুই হলেন পিতার প্রতিনিধি, যীশুকে দেখা মানে পিতাকে দেখা (যোহন ১৪:৯, ১ যোহন ১:১)। তাই ছবির নিষেধাজ্ঞা তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। তবুও লক্ষ্য করুন যে, আমরা যীশুর চেহারা, আকার, চুলের বা চামড়ার রং বা শরীরের গঠন সম্বন্ধে কিছুই জানি না। সুসমাচারগুলোতে তার একটি বর্ণনাও পাচ্ছি না। একই কথা প্রেরিতদের ক্ষেত্রেও বলা যায়।
  • পরবর্তী দৃষ্টি থেকে তাই চিন্তা করা যায় যে, ছবি বা মূর্তির ক্ষেত্রে ঈশ্বরের নিষেধাজ্ঞার অর্থ এই: যেন আমরা কোন সৃষ্টি জিনিস বা প্রাণী আরাধনা বা পূজার উদ্দেশ্যে তৈরি না করি (প্রতিমূর্তি, দেবতার ছবি)।
  • যদি আমরা যীশুর ছবি আঁকি তবে তা কি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়? খ্রিষ্টান মতবাদ ও অনুশীলনে তাতে কোন দোষ ধরা হয় নি এবং যীশুর ছবি বা মূর্তি বিভিন্ন চার্চে বা খ্রিষ্টানদের বাসায় দেখা যায় এবং আমরা ছবিসহ বাইবেল ছাপাতে থাকি, যীশুর মূভি দেখতে থাকি।
  • তবুও এখানে একটি প্রশ্ন উঠে আসে: কিভাবে যীশুকে উপস্থাপনা করব? কিভাবে তাঁকে আঁকব? তার চেহারায় কি রং দেব? তিনি কি ফর্সা বা কালো? লম্বা বা খাটো? সুন্দর মুখের বা স্বাভাবিক চেহারার? মুখ কি উজ্জল? তাঁর গায়ে কি দামী কাপড় দিব?
  • আমাদের খেয়াল করা দরকার যে, যা-ই আঁকি না কেন, তা হবে আন্দাজে আঁকা মাত্র। এছাড়া শিল্পীর ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা তার আঁকাতে প্রকাশ পাবে: শিল্পী যদি নীল চোখের মানুষ হয়ে থাকেন, তবে সম্ভাবনা বেশি যে তিনি যীশুর চোখ নীল রং দিয়ে আঁকবেন। প্রকৃতপক্ষে যীশুর অনেক ছবি এমন মিষ্টি ও কোমল, তাঁর হাত এত ফর্সা ও তার আঙ্গুল মহিলার মত, মনে হয় না যে তিনি একজন কাঠ মিস্ত্রি যিনি চাবুক বানিয়ে ব্যবসায়ীদের উপাসনা-ঘর থেকে তাড়িয়েছিলেন। যীশুর দয়ালু চরিত্র প্রকাশ করার প্রচেষ্টায় আমরা তাঁকে কোমল বানিয়ে আঁকি। যীশুর পবিত্রতা প্রকাশ করার প্রচেষ্টায় আমরা তাঁকে ফর্সা বানিয়ে আঁকি। যত যা আঁকি না কেন, আমি মাত্র খুব সীমিত একটি ছবি দিতে পারি।
  • বিষয়টি আরো বড় সমস্যাতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে: যীশুর সেই ছবি বা মূর্তি (এবং এমন কি তাঁর প্রতীক যেমন ক্রুশ) ধীরে ধীরে কুসংস্কার হয়ে যেতে পারে। উদাহরণ: আমার বাসায় যখন রং দেওয়ার কাজ চলে তখন কি যীশুর ছবি নামিয়ে রাখার জন্য আমি নিজেকে দোষী মনে করি? বাসায় যীশুর ছবি না থাকলে আমি কি নিরাপত্তার অভাব অনুভব করি? আজকে ক্রুশ পড়তে ভুলে গেছি বলে আমি ভয় করি যে, রাস্তা-ঘাটে কোন রকম দুর্ঘটনা ঘটবে? রাতে যখন একা বাসায় থাকি তখন কোন আওয়াজ শুনলে আমি কি বাইবেল আকড়ে ধরে রাখি?
  • এমন কি ভাল ছবি, জিনিস বা চমৎকার প্রতীক কুসংস্কারে পরিণত হতে পারে। একটি ছবি বা প্রতীক যদি আমার মনে মিথ্যা নির্ভরতা বা ভুল চিন্তা তৈরি করে তবে সেই ছবি বা প্রতীক আমার চোখের সামনে থেকে বা আমার বাসা থেকে সরিয়ে ফেলাই ভাল।
  • ঈশ্বর হয়তো ছবি ও মূর্তির নিষেধাজ্ঞা ইস্রায়েলের পরিস্থিতির কারণেও দিয়েছিলেন। ঈশ্বর এই আদেশ দেওয়ার এক দের বছরের মধ্যে ইস্রায়েল জাতি কনান অর্থাৎ প্রতিজ্ঞাত দেশে পা দেবে এবং সেখানে তারা প্রত্যেক বাসায়, প্রত্যেক ফটতে, গ্রামে, বড় গাছের নিচে ও পাহাড়ের উপরে বিভিন্ন ধরণের ছবি, মূর্তি, খুঁটি, সাধুদের কবর, মন্দির ও উঁচু স্থান ইত্যাদি পাবে। অনেকটা সোনা-রূপা ও শিল্পী কাজ দ্বারা সুন্দরভাবে সাজানো থাকবে। ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে কঠোর আদেশ দেন যেন তারা এইগুলোর প্রতি আকৃষ্ট না হয় বরং সব কিছু ধ্বংস করে ফেলে (দ্বিতীয় বিবরণ ৭:৫ এবং অন্যান্য পদ দেখুন)।
  • কনান দেশ দখল করার পরেও তারা দেবতাপূজারী জাতিদের মধ্যে বাস করে এবং ইস্রায়েলের ইতিহাসে দেখা যায় যে চারিদিকে দেশের প্রতিমাপূজা বা যাদু-বিদ্যা ইস্রায়েলকে প্রভাবিত ও প্রলোভিত করেছিল।
  • কনানীয় এবং চারপাশের জাতিদের প্রতিমাগুলো অনেক শিল্পী কাজ ও সোনা-রূপা দিয়ে আকর্ষণীয়ভাবে তৈরি করা হয়েছে বলে ইস্রায়েলীয়রা সেগুলো সহজে ধ্বংস করতে চায় না। দ্বিতীয় বিবরণ ৭:২৫ পদ বলে: “তাদের দেব-দেবতার মূর্তিগুলো তোমরা আগুনে পুড়িয়ে ফেলবে। তোমরা তাদের গায়ের সোনা-রূপার লোভ করবে না। নিজেদের জন্য তোমরা তা নেবে না, কারণ তা করলে তোমরা ওগুলোর ফাঁদে পড়বে। তোমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভুর কাছে ওগুলো ঘৃণার জিনিস।”
  • কনানীয় এবং চারপাশের জাতিদের বিভিন্ন ধরণের দেব-দেবতার ছবি ও মূর্তি ছিল: ভয় দেখানোর মূর্তি, আশ্চর্য করে তোলার মূর্তি, ক্ষমতা বা গুনাবলি প্রকাশ করার মূর্তি এবং সুন্দর, আকর্ষনীয় কামনার মূর্তি। প্রকৃতপক্ষে সৌন্দর্য দেখে মানুষ আরাধনা করতে অনুপ্রেরণা পায়।
  • বর্তমান সময়ের বিষয়ও বিবেচনা করুন: যখন মুসলিম জঙ্গীদল Islamic State (IS বা ISIS) এলাকার পর এলাকা দখল করেছিল তারা অনেক পুরাতন প্রত্নতত্ত্বের স্থান এবং সেখানে উপস্থিতি হাজার হাজার বছর আগের মূর্তি ধ্বংস করেছিল যেমন দ্বিতীয় বিবরণ ৭:৫ পদ বলে (বাবিলীয়, মাদিয়-পারস্য ও বৌদ্ধ মূর্তি ইত্যাদি)। আমাদের আধুনিক দেশগুলোতে বিভিন্ন জাতি একসাথে বাস করে, যার কারণে আমরা ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয় এবং সমস্ত সংস্কৃতির শিল্পীকাজ সুরক্ষিত করে রাখি। আমরা আজকাল এই ধরণের স্থান ধ্বংস করি না যদিও আত্মিক ক্ষেত্রে সেগুলো খুবই অন্ধকার।

সব সৌন্দর্য ঈশ্বরকে প্রকাশিত করে

  • সব সৌন্দর্য ঈশ্বরকে প্রকাশিত করে। কিন্তু একটি সুন্দর দেবতার মূর্তির ক্ষেত্রে কি বলব? সুন্দর সাজানো মন্দির বা চমৎকার স্থাপত্য কোন চোখে দেখব? যদিও এই ধরণের শিল্পীকাজে বিভিন্ন দেব-দেবতাকে গৌরবান্বিত করে তোলা হয় তবুও বলা যায় যে, এখানে শিল্পীর সৃজনশীলতা ও তালন্ত প্রকাশ পায়, যা ঈশ্বর কাছ থেকে দেওয়া। সৌন্দর্যকে সুন্দর বলা যায়। কিন্তু সুন্দর বলে তা পূজা করতে হবে, এমন নয়, অন্যরা যদিও তা করে থাকে।
  • এমন কোন সৌন্দর্য আছে যা ভাল নয়? যারা দেবতা তৈরি করে বা দেবতা পূজা করে, ঈশ্বর তাদের বিষয়ে বর্ণনা দেন যে, তারা তাঁকে ঘৃণা করে। দেখা যায়, ঈশ্বর থেকে দেওয়া দান-তালন্ত দ্বারা মানুষ সুন্দর পূজার জিনিস তৈরি করতে পারে, যদিও সেগুলো ঈশ্বরকে অসম্মানিত করে। তিনি কত বড় মনের ঈশ্বর!
  • এই কথা ঠিক যে, সৌন্দর্যকে পূজা করার একটি প্রলোভন সব সময় আছে, একটি জিনিসকে তার সৌন্দর্যের জন্যই পূজা করার প্রলোভনও সব সময় আছে। সৌন্দর্যের ঈশ্বরকে অস্বীকার করেই তা করা যায়। সৌন্দর্য সৃষ্টি করার সৃজনশীলতা ও দান-তালন্ত ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে, মানুষ তা অস্বীকার করেও সেই সৃজনশীলতা ব্যবহার করতে পারে।
  • দাতার চেয়ে দানকে আরাধনা বা পূজা করা, এই প্রলোভন সব সময় আছে। সৃষ্টিকর্তার চেয়ে সৃষ্টিকে আরাধনা বা পূজা করা, এই প্রলোভ্ন সব সময় আছে। তালন্ত দানকারী ঈশ্বরের চেয়ে শিল্পীকে প্রাধান্য দেওয়া, এই প্রলোভনও সব সময় আছে।
  • প্রতিমাপূজা তো ঠিক তা-ই: আমি চোখের সামনে বিষয়টি সঠিক মনে করি, সৃষ্টিকর্তার চেয়ে সৃষ্টি বা শিল্পীর চেয়ে ছবিতে গুরুত্ব দেই। এরজন্য এই ধরণের পদ প্রয়োজন: “তোমরা তাদের পূজাও করবে না … কারণ কেবলমাত্র আমি সদাপ্রভুই তোমাদের ঈশ্বর। আমার পাওনা ভক্তি আমি চাই।” কেরী: “কেননা তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু আমি স্বগৌরব রক্ষণে উদ্যোগী ঈশ্বর” ইংরেজিতে: “for I the LORD your God am a jealous God.”
  • চিন্তা করুন: ঈশ্বর নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী নিজেই তৈরি করেন। মানুষ যে সৌন্দর্যকে বা সুন্দর জিনিসকে পূজা করে, এই সম্ভাবনা অবশ্যই আছে, তবুও ঈশ্বর সৌন্দর্যকে এই কারণে বাতিল করেন না, সৃজনশীলতা বা সৌন্দর্য তৈরি করার দান-তালন্তও বাতিল করেন না। ঈশ্বর জীব-জন্তুদের সৃষ্টি বাদ দেন নি ভয় করে যে, মানুষ জীব-জন্তুকে হয়তো পূজা করবে। তিনি কোন ক্ষেত্রে সৌন্দর্য বা সৃজনশীলতা নিষেধ করেন না, তার প্রতিরোধও করেন না, এই বলে যে, মানুষ তা হয়তো পূজা করে তাঁকে অস্বীকার করবে। বরং তিনি নিজেই অতি সুন্দর জিনিস সৃষ্টি করেন। সৌন্দর্যের একটি প্রলোভন আছে, সৌন্দর্যকে ভুল ব্যবহার করা সম্ভব, কিন্তু ঈশ্বর এই ঝুঁকি নিতে রাজি কারণ তিনি সৌন্দর্যকে চান এবং সৌন্দর্যকে দান করতে চান।
  • এখানে আমরা ঈশ্বরের চরিত্র সম্বন্ধে কি বুঝতে পারি? আমরা তাঁর বড় মন দেখি, তাঁর দানশীলতা ও উদারতা। তিনি প্রাচুর্যের ও পূর্ণতার ঈশ্বর। তিনি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন না, তিনি সব কিছু প্রতিরোধ বা নিষেধও করেন না। বরং তিনি তাঁর সৃষ্টি মানুষদের বুঝার ক্ষমতা ও স্বাধীন ইচ্ছা দান করেন যেন তারা তাঁর মঙ্গলময়তা দেখে সঠিকটা আরাধনা করতে পছন্দ করতে পারে।
  • পৌল রোমীয় ১১:২৯ পদে বলেন “ঈশ্বর যা দান করেন এবং যাকে ডাকেন সেই বিষয়ে তাঁর মন তিনি বদলান না।” কি অদ্ভুত বিষয়! যদিও মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে অর্থাৎ সব সৌন্দর্য ও সৃজনশীলতার উৎস অস্বীকার করতে পারে তবুও না দেওয়ার চেয়ে ঈশ্বর তারপরেও দিতে চান। ঈশ্বর সত্যি সুন্দর!
  • তাই ঈশ্বরের দেওয়া দান, তালন্ত বা দক্ষতাগুলো বদলানো হবে না। মানুষ অননুতপ্ত হলেও বা মানুষ দানটি খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলেও তিনি তা বদলাবেন না। ঈশ্বরকে অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করলেও শিল্পী ঈশ্বরের দেওয়া দান-তালন্ত ব্যবহার করতে পারে। শিল্পী নিজের চেয়ে বড় কিছু অস্বীকার করলেও তা করতে পারে। অনৈতিক ধরণের জীবন-যাপন করলেও তা করতে পারে।
  • একজন শিল্পী যদিও ঈশ্বরকে অস্বীকার করে অথবা অনৈতিকভাবে জীবন-যাপন করে তবুও বিশ্বাসী হিসাবে আমরা শিল্পীর সৃজনশীলতা, দান-তালন্ত ও সুন্দর শিল্পকাজ ঈশ্বরের দেওয়া ভাল বিষয় বলে উৎযাপন ও উপভোগ করতে পারি।
  • বিশ্বাসী হিসাবে আমার কি ধরণের গান-বাজনা শোনা উপযুক্ত বা উপযুক্ত নয়? কি ধরণের ছবি বা মুভি দেখব? কি ধরণের দেখব না? নিজেকে প্রশ্ন করুন: গান-বাজনাটি কি আমাকে ঈশ্বরের দিকে আকৃষ্ট করে বা এর বিপরীত? গান-বাজনাটি কি ঈশ্বরের সত্যকে সমর্থন করে বা এর বিপরীত? গান-বাজনাটি কি আমার আবেগ আরো শক্তিশালী করে তোলে (যেমন আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ, নিরাশা, আক্রমণার্থক মনোভাব)? এই আবেগ যে, আমার মধ্যে বেড়ে যায়, তা কি ভাল বিষয়? আপনার উপরে গান-বাজনার ব্যবহারিক প্রভাব মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিন।
  • বাংলাদেশের একটি উদাহরণ: হিন্দু পূজার সময়ে খ্রিষ্টান বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের মূর্তিগুলো দেখতে নিষেধ করে। ছেলেমেয়েরা গোপনে তারপরেও সেগুলো দেখতে যায় এবং এতে খুব ভয় পায়। এর চেয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেগুলো দেখতে যাওয়া এবং তাদের সাথে আলোচনা করা ও এই বিষয়ে বুঝিয়ে দেওয়া আরো ভাল হত।
  • অনেক বিশ্বাসী আছে যারা খ্রিষ্টান গান-বাজনার চেয়ে সেকুলার গান-বাজনা পছন্দ করে কারণ সেগুলোর মান আরো ভাল। প্রকৃতপক্ষে স্বীকার করতে হয় যে, অনেক খ্রিষ্টান গান-বাজনা বা শিল্প কাজের মান কম। তা দুঃখের বিষয়! আমার গানে যীশুর নাম উল্লেখ করেছি, এর মানে এই নয় যে, গানের মান কম হলেও চলবে।
  • অনেক শতাব্দী ধরে খ্রিষ্টান শিল্পীরা অতি চমৎকার মানের শিল্প কাজ করেছিলেন, যেখানে ঈশ্বরীয় সংবাদ এবং ঈশ্বরীয় দান-তালন্ত উভয়ই প্রকাশিত (Michelangelos’ paintings and sculpture, Haendel’s Messiah, Dostoyevsky’s novels ইত্যাদি)।

বাইবেলে অদ্ভুত একজন শিল্পীর বর্ণনা

যাত্রা ৩১:১-৬ – বৎসলেল ও অহলীয়াব জ্ঞান ও সব রকম কারিগরী কাজের দক্ষতার অধিকারী

“তারপর সদাপ্রভু মোশিকে বললেন, ২ “দেখ, আমি যিহূদা-গোষ্ঠীর ঊরির ছেলে বৎসলেলকে বেছে নিয়েছি। ঊরি হল হূরের ছেলে। ৩ আমি এই বৎসলেলকে ঈশ্বরের আত্মা দিয়ে পূর্ণ করেছি। আমি তাকে জ্ঞান, বিবেচনাশক্তি, অভিজ্ঞতা এবং সব রকম কারিগরী কাজের ক্ষমতা দিয়ে রেখেছি। ৪ তাতে সে নিজের মন থেকে সোনা, রূপা ও ব্রোঞ্জের উপর সুন্দর সুন্দর নক্‌শা তৈরী করতে পারবে, ৫ দামী দামী পাথর কাটতে ও বসাতে পারবে আর কাঠের এবং অন্য সব রকম হাতের কাজও করতে পারবে। ৬ এছাড়া তাকে সাহায্য করবার জন্য আমি দান-গোষ্ঠীর অহীষামকের ছেলে অহলীয়াবকেও বেছে নিয়েছি। যে সব ওস্তাদ কারিগর এই কাজ করবে তাদেরও আমি এমন জ্ঞান দিয়ে রেখেছি যাতে তোমাকে দেওয়া আমার আদেশ মতই তারা সব জিনিস তৈরী করতে পারে।”

  • ঈশ্বর বৎসলেলকে বেছে নিয়েছেন, অর্থাৎ তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে শিল্প ক্ষেত্রে এবং হতে পারে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও আহ্বান পেয়েছিলেন (যাত্রা ৩১:২)। তিনি লেবীয় বা পুরোহিত ছিলেন না কিন্তু তিনি এখানে ধর্মের ক্ষেত্রে তার তালন্ত ও দক্ষতা ব্যবহার করেছিলেন।
  • তাম্বু ও তার আসবাব-পত্র তৈরি করা হবে বলে এখানে ইস্রায়েলের মধ্যে সৃজনশীলতা ও দ্ক্ষতা উন্নত করার বড় সুযোগ ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়েছিল। এখানে ধর্মের ক্ষেত্রটি একজন যুবক শিল্পীকে উৎসাহিত করে এবং সমর্থনও করে।
  • ঈশ্বর বলেন যে, তিনি বৎসলেলকে “ঈশ্বরের আত্মা দিয়ে পূর্ণ” করেছেন (যাত্রা ৩১:৩)। ইব্রীয় ভাষায় যে শব্দ এখানে ব্যবহার করা হয়েছে, তা হল ‘রূয়াখ্’, সেই একই শব্দ পুরাতন নিয়মের বিভিন্ন পদে ‘বাতাস’, ‘অনিল’, ‘প্রাণ’ বা ‘আত্মা’ (উভয় ঈশ্বরের এবং মানুষের আত্মা) অনুবাদ করা হয়েছে।
  • যদিও শিল্পীর দক্ষতা, বুঝার বুদ্ধি ও জ্ঞান আছে তবুও পবিত্র আত্মা তাকে পরিচালনা করবেন এবং অনুপ্রেরণা দান করবেন যেন তিনি নিজের স্বাভাবিক জ্ঞান-দক্ষতার চেয়েও অধিক কাজ করতে সক্ষম হন। আমরা এখানে মানুষের দান-দক্ষতা ও ঈশ্বরের অনুপেরণা একসাথে কাজ করতে দেখি। দেখা যায় যে, বৎসলেল বিভিন্ন শিল্প কাজে দক্ষ ছিলেন (ধাতুর কাজ, তাঁতের কাজ ইত্যাদি)।
  • একটি চমৎকার শিল্প কাজ দেখে আমরা কি আলাদা করে বলতে পারি, ঈশ্বরের ভূমিকা কি ছিল, শিল্পীর স্বাভাবিক দানের ভূমিকা কি ছিল? তার চর্চা ও অভিজ্ঞতার ভূমিকা কি ছিল? তার মনোভাবের ভূমিকা কি ছিল? প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি এভাবে আলাদা করা যায় না। সব কিছু অর্থাৎ দান, ।তালন্ত, চর্চা, অভিজ্ঞতা, সুযোগ, উৎসাহ, সৃজনশীলতা, অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা চূড়ান্তভাবে ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে।
  • বাইবেলের এই শাস্ত্রাংশ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, শিল্পী, শ্রমিক, পরিশ্রম, ব্যবহারিক কাজ, চর্চা, অভিজ্ঞতা, বস্তু মাধ্যমকে গুরুত্ব দেওয়া, দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও সৌন্দর্য, এই সব ঈশ্বরের চোখে কত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক। ঈশ্বর চমৎকার কাজ পছন্দ করেন। তিনি ব্যবহারিক কাজ, পরিশ্রম, প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ পছন্দ করেন। ঘাম ফেলা এবং হাত ময়লা হওয়া, তা হল ঈশ্বরীয় বিষয়!
  • ঈশ্বর প্রত্যেক জাতির অনেক লোকদেরকে বিভিন্ন ধরণের দান-তালন্ত ও দক্ষতা দান করেন। এছাড়া তিনি প্রত্যেক জাতিতে কিছু বিশেষ দান-তালন্ত ও দক্ষতা দান করেন, এমন কি মাঝের মধ্যে অদ্ভুত দান-তালন্তও দান করেন। অতি দক্ষতাশালী ছেলেমেয়েরা একটি গরীব বস্তীতেও জন্ম নিতে পারে। উৎসাহমূলক পরিবেশ বা সুযোগ না পেলে তারা হয়তো তাদের অধিক দক্ষতা সম্পূর্ণভাবে উন্নত করতে পারে না, যা এই দেশের জন্য দুঃখের ও লোকসানের বিষয়। ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় যে, যুদ্ধের সময়ে অর্থাৎ চরম প্রয়োজনের সময়ে একটি জাতি তাদের সবচেয়ে দক্ষ নাগরিকদের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। যাত্রাপুস্তকে দেখা যায় যে, আনুমানিক ২০ লক্ষ্য ইস্রায়েল জাতির লোকসংখ্যার মধ্যে ঈশ্বর ২জন ব্যক্তিকে অদ্ভুত দক্ষতা দান করেছিলেন (যাত্রা ১২:৩৭)।

হিতো ২২:২৯     “তুমি কি এমন কোন লোককে দেখেছ যে পাকা হাতে কাজ করে? সে রাজাদের জন্য কাজ করবে, সাধারণ লোকদের অধীনে কাজ করবে না।”
লূক ১২:৪৮       “যাকে বেশী দেওয়া হয় তার কাছে থেকে বেশী দাবি করা হবে; আর লোকে যার কাছে বেশী রেখেছে তার কাছে তারা বেশীই চাইবে।” চমৎকার দান-তালন্ত ও দক্ষতা থাকলে এইগুলো ভাল কাজে লাগানোর দায়িত্বও আছে, অর্থাৎ অন্যদের জন্য উপকারী হওয়ার দায়বদ্ধতাও আছে।
মথি ১৩:১২       “কারণ যার আছে তাকে আরও দেওয়া হবে, আর তাতে তার অনেক হবে। কিন্তু যার নেই তার যা আছে তা-ও তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে।” যারা তাদের দান-তালন্ত ও দক্ষতা ভাল কাজে লাগায় তারা সেগুলোর ব্যবহার, বৃদ্ধি ও উন্নয়ন দেখতে পাবে। যারা এগুলো ভাল ব্যবহার না করে তারা এগুলোর হৃাস দেখবে।”

  • বাবা-মায়ের কাছে একটি কথা: ছেলেমেয়েদের গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করুন। অত্যন্ত চেষ্টা করুন যেন তারা বিভিন্ন ধরণের সুযোগ, কাজ বা খেলা উপভোগ করতে পারে। লক্ষ্য করুন তারা স্বাভাবিকভাবে কোন কোন কাজে মজা পায়, তাদের মনোযোগ কি দিয়ে আকৃষ্ট হয় বা তারা কোন কাজে বেশি সময় দিতে পছন্দ করে। নিজের আকাঙ্ক্ষা বা বুদ্ধি অনুসারে তাদের উপরে দাবি করবেন না।
  • ঈশ্বর আমাদের যে ভূমিকা বা দায়িত্ব দান করেন, যে আহ্বানে আমাদের ডাকেন, সেই অনুসারে তিনি আমাদেরকে দান-তালন্তও দেবেন। বিশেষ প্রয়োজনের সময়ে তিনি আমাদের স্বাভাবিক দক্ষতা বেশি না থাকলেও তা যোগান দিতে পারেন।

১ করি ১২:৬      “আমাদের প্রত্যেককে ভিন্ন ভিন্ন কাজ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু একই ঈশ্বর ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে কাজ করে থাকেন।”

  • ঈশ্বর হলেন সব দান-তালন্ত ও দক্ষতার উৎস। তিনি যে কোন একজনকে যে কোন তালন্ত দান করতে পারেন। এখানে অহংকার করার কোন কারণ নেই, লজ্জা করারও কারণ নেই। এর চেয়ে যেন আমরা নিজের দান-দক্ষতা অন্যদের জন্য ব্যবহার করি এবং আমাদের যা নেই, তা খুশি মনে অন্যদের থেকে গ্রহণ করি। সবার যে সমস্ত দান-তালন্ত আছে, এমন নয়। ঈশ্বর এইভাবে সহভাগিতা, একতা ও অন্যদের উপর নির্ভর করার একটি মনোভাব তৈরি করতে চান।
  • আজকাল আমরা এমন আত্মিক নেতা হতে চাই যিনি সব ক্ষেত্রে এবং সব পরিচর্যা কাজে দক্ষ। কিন্তু এই চিন্তা কি সত্যিই ভাল? একজন ব্যক্তি যিনি সয়ং-সম্পূর্ণ, যিনি একা সব কিছু পারেন, যিনি অন্যের উপর নির্ভর করেন না, এই ধরণের নেতা কি আসলে ভাল? এই ধরণের ‘খ্রিষ্টান একনায়কতন্ত্র’ বেশি প্রজ্ঞাবানও না, বেশি নিরাপদও না। সংশোধন এবং অন্যদের উপরে নির্ভরতা না থাকলে তবে ক্ষমতার ভুল ব্যবহারের সম্ভাবনা অনেক বাড়ে। এর চেয়ে ভাল হয় যদি আমরা সবাই অংশ গ্রহণ করি, নম্রতায় নিজের ভূমিকা পালন করি, নিজের দান ব্যবহার করি, অন্যদের দানের জন্য কৃতজ্ঞ হই এবং সুসম্পর্কে থাকি।