পরিবার ০২ – ব্যভিচার

 ব্যভিচারের নিষেধাজ্ঞা ও সংজ্ঞা

দ্বিতীয় বিবরণ ৫:১৮   ‘ব্যভিচার কোরো না।’
যাত্রা ২০:১৪          ‘ব্যভিচার কোরো না।’

লেবীয় ২০:১০        ‘যদি কেউ তার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সংগে, অর্থাৎ অন্য কোন লোকের স্ত্রীর সংগে ব্যভিচার করে তবে ব্যভিচারী এবং                         ব্যভিচারিণী দু’জনকেই মেরে ফেলতে হবে।’

 ব্যভিচার মানে কি?

  • আপন স্বামী / স্ত্রী ছাড়া অন্য কারো সাথে যৌন সম্পর্ক রাখা।
    • বিবাহিতদের জন্য: ব্যভিচার হল অন্য কোন ব্যক্তির সাথে (বিবাহিত বা অবিবাহিত) যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে বিবাহের শপথ ভাঙ্গা ।
    • অবিবাহিতদের জন্য: কোন বিবাহিত ব্যক্তির সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন (English: adultery)। বিবাহ করার অঙ্গীকার ছাড়া দুইজন অবিবাহিত ব্যক্তির মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাও পাপ (English: fornication) কিন্তু তা বাইবেলে ব্যভিচারের চেয়ে কিছুটা ভিন্নভাবে দেখা হয়।
  • বাইবেলে ঈশ্বর ব্যভিচারের জন্য পুরুষ ও মহিলার জন্য একই আইন দিয়েছেন।
  • বাইবেলে পুরুষ ও মহিলার জন্য যৌন আচরণের ক্ষেত্রে কোন ভিন্ন মানদণ্ড নেই।
  • অনেক সমাজে যৌন ক্ষেত্রে উচু মানদণ্ড রাখতে মহিলাদের উপর বেশি চাপ দেওয়া হয় কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে আরো স্বাধীনতা দেওয়া হয়।
  • বাইবেলে জীবন, বিবাহ ও পরিবার নষ্টের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয় (মৃত্যুদণ্ড)।
ব্যভিচার মানে বিবাহের শপথ ভাঙ্গা
  • কেন ঈশ্বর ব্যভিচার করতে নিষেধাজ্ঞা করেছেন? ব্যভিচার করলে কি কি ফলাফল হয়?
  • ব্যভিচারের ক্ষতি বুঝার জন্য প্রথমে বুঝা দরকার বিবাহ কি।
  • বিবাহ হচ্ছে দুইজন ব্যক্তির মধ্যে সকল চুক্তির মধ্যে সর্বোচ্চ চুক্তি।
    • বিবাহের শপথ কোন কোন ক্ষেত্রে আছে? অন্য যে কোন চুক্তির চেয়ে বিবাহের চুক্তিতে অনেক বেশি ক্ষেত্র রয়েছে: মানসিক, শারীরিক, আত্মিক, আর্থিক, পারিবারিক নাম, সুনাম, সময় (বর্তমান ও ভবিষ্যৎ) ইত্যাদি।
    • শুধুমাত্র একজনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ (বহুবিবাহের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন)
    • সারা জীবনের অঙ্গীকার, মৃত্যু পর্যন্ত, যে কোন পরিস্থিতিতে (সুখে দুঃখে)
    • সম্পূর্ণ বিশ্বাস, সমর্পণ, নির্ভরতা, আস্থা, খোলা মন
  • কে আপনাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট বা আঘাত দিতে পারে? যাকে আপনি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেন, যিনি আপনার প্রতি সবচেয়ে বেশি অঙ্গীকারাবদ্ধ
  • যত বেশি একটি বিবাহ চমৎকার হতে পারে, তত বেশি কষ্টদায়ক হতে পারে যদি বিবাহ ভাঙ্গে।।
  • কারও নিঃস্বার্থ ভালবাসা পাওয়া যতটা চমৎকার, ততটাই কষ্টদায়ক যখন সেই ব্যক্তি শপথ ও বিশ্বাস ভাঙ্গে।
  • যে কোন সংস্কৃতিতে প্রেমের গানে দেখা যায় প্রেম প্রতিজ্ঞা করে ‘চিরদিনের’ জন্য।

 

ব্যভিচার – আঘাতপ্রাপ্ত স্বামী বা স্ত্রীর উপর প্রভাব
  • ব্যভিচারে বিশ্বাস ভাঙ্গা, বিশ্বাসঘাতকতা, চুক্তি, প্রতিজ্ঞা ও শপথ ভাঙ্গা হয়।
  • গভীর প্রত্যাখ্যান, গভীর অনিশ্চয়তা, গভীর আত্ম-সন্দেহ…বেশিরভাগ মানুষই আর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারে না।
  • বিশ্বাস ভাঙ্গার পর তাকে ক্ষমা করলেও সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করা কঠিন … মনের যুদ্ধ।
  • ভাঙ্গা বিশ্বাস > পুনরায় ঘটার ভয় > ক্রমাগত দুশ্চিন্তা, নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা (সে কোথায়? কি করছে? কার সাথে কথা বলে? কোন দিকে তাকায়?) > হিংসা, তুলনা, প্রতিযোগিতা, কৌশলে চালনা।
  • যৌন রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
  • সাধারণত স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর বেশি ক্ষতি হয়, কারণ সে বেশী ত্যাগ স্বীকার করেছে (চাকরী, ক্যারিয়ার, সুনাম)
ব্যভিচার – ব্যভিচারকারীর উপর প্রভাব
  • ব্যভিচারকারীর জীবনে কি ঘটেছে যে ব্যভিচারে যুক্ত হয়?
    • ঈশ্বরের রব ও চেতনাকে ক্রমাগত অগ্রাহ্য করেছে।
    • জেনে শুনে প্রজ্ঞার বিপরীতে আচরণ করেছে।
    • জীবন সঙ্গীর প্রতি মনকে বন্ধ করেছে, নিজের হৃদয়কে কঠিন করেছে, লুকিয়েছে, …যার ফলাফল জীবন সঙ্গীর প্রতি সম্মান হারিয়েছে এবং তাকে নিচু চোখে দেখেছে।
    • মিথ্যা বলেছে, প্রতারণা করেছে, কৌশল অবলম্বন করেছে, পরিকল্পনা করেছে…না হলে এমনি এমনি ব্যভিচার ঘটে না।
    • যদিও শেষে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে কিন্তু শুরুতে অনেক ছোট ছোট ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
  • ব্যভিচারকারীর উপর প্রভাব… যদি অনুতপ্ত হয়েছে এবং কেউ ঘটনাটা জানে না?
    • ব্যভিচারের ফলে লজ্জা, দোষী মনোভাব, আত্ম-সম্মান, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও আত্মবিশ্বাস হারানো।
    • আত্ম-চেতনার প্রতি আর সচেতন নয়, খারাপ কাজের বিরুদ্ধে নিজেকে সুরক্ষা করার হার কমে যায়।
    • স্মৃতি, মনে মনে সেই ছবি, মনের সাথে দ্বন্দ্ব, না চাইলে ও তুলনার চিন্তা আসে।
    • খারাপ অভ্যাসের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব, একবার সীমানা অতিক্রম করলে তা আবার করার সম্ভাবনা আরো বাড়ে।
  • ব্যভিচারকারীর উপর আরো প্রভাব…যদি সঙ্গী জানতে পারে
    • সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক আঘাত প্রাপ্ত, তা পুনরায় স্থাপন করা আরো কঠিন।
    • অশান্তি, ঝগড়া, সন্দেহ, অবিশ্বাস, ভয়, হিংসা, নিয়ন্ত্রণ যার ফলে বিবাহের সম্পর্ক অনেক সময় আরো খারাপের দিকে যায়।
    • যদিও দুইজন একসাথে সমস্যার সমাধান করতে রাজি হয় তবুও বছরের পর বছর বিশ্বস্ত ব্যবহার প্রয়োজন হয় বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে।
    • বাবা বা মা হিসাবে নৈতিক কর্তৃত্ব হারানো (যেমন রাজা দায়ূদের জীবনে দেখা যায়)।
  • ব্যভিচারকারীর উপর প্রভাব… যদি অনুতপ্ত না হয়:
    • ঈশ্বরের রব ও চেতনার প্রতি সাড়া না দিতে দিতে চেতনা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়, আবেগের ক্ষেত্রে মন বদ্ধ হয়ে যায়, আত্ম-চতুরতা বাড়ে, নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে গর্ব শুরু > বিবাহে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করতে অক্ষম।
    • যাকে কৌশলে চালনা করে, তাকে হৃদয় থেকে সম্মান করতে পারে না। যাকে ব্যবহার করে তাকে ভালবাসতে পারে না।
    • বিবাহের সম্পর্ক ধ্বংস হয় এবং পরবর্তী সম্পর্কগুলিও প্রভাবিত হয়।
  • দ্বৈত জীবন করলে (একদিকে জীবন সঙ্গী, অন্যদিকে যৌন সঙ্গী) ব্যভিচারকারীর জন্য সব সময় মানসিক চাপ, সবাইকে (এমন কি নিজেকেও) প্রতারণা করা।
  • যদি বিবাহ ভাঙ্গে > দ্বন্দ্ব, তালাক, পরিবার (স্ত্রী / স্বামী ও সন্তান) হারানো, সুনাম ও সম্মান হারানো, অর্থনৈতিক ক্ষতি।

 

ব্যভিচার – সন্তানদের উপর প্রভাব
  • বাবা বা মায়ের ব্যভিচারের কারণে সন্তানেরা তাদের আত্ম-পরিচয় নিয়ে সন্দেহে পড়ে > সন্তান এইটা নিজেকে প্রত্যাখ্যান হিসাবে নেয়। তাদের জন্মের উৎস (বাবা-মায়ের সম্পর্ক) নষ্ট হয়ে যায় তাদের পরিচয় এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।
  • তাদের আত্ম-পরিচয় ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে > গভীর ভয়, আত্ম-সন্দেহ, আশাহীনতায় ভুগে।
  • সন্তানেরা বাবা-মাকে নিখুঁত হিসাবে দেখে এবং এভাবে দেখার কারণে বিচ্ছেদের জন্য নিজেদেরকে দোষী মনে করে > ‘হতে পারে আমি ভুল করেছি’, ‘আমি সে বিচ্ছেদের কারণ’।
  • সন্তান হিসাবে তাদের এমন ভূমিকা পালন করতে হয় যা তাদের করার কথা নয়: পরিচালনা দিতে হয়, দুঃখের কাহিনী শুনতে হয়, অভিভাবক বা ভাই-বোনদের সুরক্ষা করতে হয়, নিশ্চিত করতে হয় যেন পরিবার ভেঙ্গে না পড়ে।
  • অনেক বার বাবা-মায়ের যুদ্ধের মাঝখানে পড়তে হয় ‘তুমি বাবার চেয়ে আমাকে বেশি ভালবাস, তাই না?’
  • গভীর প্রত্যাখ্যান, যা অনেক বার সম্পূর্ণভাবে আর পুনঃস্থাপন করা যায় না। প্রায় স্কুলে পড়াশুনার মান নেমে যায়, শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা দেখা যায়।
  • বিবাহ, পরিবার, সমস্যার সমাধান ও জীবনের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে যায়।
  • তাই ভগ্ন পরিবারের সন্তানদের উপর সারা জীবন ধরে ক্ষতিকারক প্রভাব চলতে থাকে: স্কুলে সমস্যা, যুবক-যুবতী বয়সে উচ্ছৃঙ্খলা, পেশাগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমস্যা, ঝুঁকি নেওয়ার ভয়, নিজের বিবাহে অশান্তি এবং বেশিরভাগ নিজেই তালাক প্রাপ্ত হয়।
  • অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ক্ষতি: পশ্চিমা সমাজে গরীব হওয়ার এক নম্বর কারণ হচ্ছে ভগ্ন পরিবার: এক বেতনে দুই সংসার চালানো, সন্তানেরা সুযোগ কম পায়, প্রায় ঘর, স্কুল ও পরিবেশ পরিবর্তন, এমন পরিস্থিতি যাতে বেশি সুযোগ-সুবিধা নেই।

 

ব্যভিচার – অন্য দম্পতিদের উপর প্রভাব
  • বেশি বেশি বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে সব দম্পতিদের উপর নিরাশার প্রভাব জন্মে: ভয়, অবিশ্বাস, সন্দেহ, পরস্পরকে নিয়ন্ত্রণ, নিয়ন্ত্রণ করা, হিংসা বৃদ্ধি পায়, এমন কি কারণ ছাড়া।
  • বিবাহে বিশ্বস্ততার উপর আস্থা ভাঙ্গে ও সমস্যা সমাধান যে সম্ভব তা বিশ্বাস করতে পারে না।
  • পশ্চিমা দেশে উচু হারের তালাকের কারণে লোকেরা আর বিশ্বাস করতে পারে না যে বিবাহ টিকতে পারে।
  • প্রাচ্য দেশে তালাকের হার কম কেন? হতে পারে মহিলারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুরুষের উপর নির্ভরশীল বলে অনেক কিছু সহ্য করে।

 

ব্যভিচার – সমাজের উপর প্রভাব
  • পরিবারের অবস্থা যেমন দেশের অবস্থা তেমন হবে। ভগ্ন পরিবার থেকে তৈরি হয় ভগ্ন মানুষ ও ভগ্ন সমাজ।
  • যে দেশে ভগ্ন পরিবার বেশী সে দেশে শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও শারীরিক সমস্যা বেশী।
  • প্রায় ভগ্ন পরিবারই দরিদ্র। তা ছাড়া এর অর্থনৈতিক ক্ষতি দেশের উপরেও পড়ে। ভগ্ন পরিবারের পিছনে কল্যাণের খরচ (welfare costs) গাণিতিক হারে বাড়তে থাকে > জাতীয় ঋণ বাড়ে।
  • যেখানে একটি চুক্তি ভাঙ্গা হয়, অন্য ধরণের চুক্তি ভাঙ্গার সম্ভাবনা বাড়ে।