ঈশ্বর আদেশ দেন মানব জাতি যেন লোকসংখ্যা বাড়িয়ে পৃথিবী ভরিয়ে তোলে – আদি ১:২৮
- মানব জাতি যখন বৃদ্ধি পায় এবং ভৌগলিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন অবশ্যই ধীরে ধীর ভিন্নতাও দেখা দেবে, অর্থাৎ বিভিন্ন পরিবার, গোষ্ঠি, উপজাতি এবং অবশেষে জাতি সৃষ্টি হবে।
- বিভিন্ন জাতিগুলোর সৃষ্টি, এই বিষয়ে আমরা আদিপুস্তকে ঈশ্বরের অনুমোদন ও আনন্দ দেখতে পাই। ঈশ্বর তা চেয়েছিলেন, এইজন্য তিনি এই আদেশ দিয়েছিলেন।
- ঈশ্বর মানব জাতিকে জীব-জন্তু ও পৃথিবীর উপর রাজত্ব করার অধিকার দিয়েছিলেন, কিন্তু মানুষ মানুষের উপর রাজত্ব করবে, এই আদেশ তিনি দেন নি।
ঈশ্বর মানব জাতিকে বৃদ্ধি পেতে এবং পৃথিবী ভরিয়ে তুলতে পুনরায় আদেশ দেন – আদি ৯:১
- যখন ঈশ্বর নোহ ও তার পরিবার নিয়ে নতুন একটি শুরু করেন তখন তিনি এই বড় মনের আদেশ আবারও দেন। ঈশ্বরের উদ্দেশ্য পরিবর্তন হয় নি।
ঈশ্বর জাতিগুলো স্থাপন করেন এবং জাতিগুলোর ইতিহাস গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন – আদি ১০
- এই অধ্যায়ে আমরা নোহের পরিবারের বংশ তালিকা পাই। কিভাবে নোহের পরিবার থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠি ও জাতি সৃষ্টি হয়, তার বর্ণনাও পাই। ঈশ্বর যা আদেশ করেছেন তা-ই ঘটছে, যা আনন্দের ও উৎযাপনের বিষয়।
- মানব জাতির বৃদ্ধি, বৈচিত্রতা ও ছড়িয়ে পড়া, এসব ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখানো হয়েছে।
- আদি ১০:৫ যেফতের বংশধরেরা: ”এদের বংশের লোকেরাই শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষা (H3956 lashon), পরিবার (H4940 mishpachah) ও জাতি (H1471 goy) অনুসারে সাগর পারের ভিন্ন ভিন্ন দেশগুলোতে (H776 erets) ছড়িয়ে পড়েছিল।”
- আদি ১০:২০ হামের বংশধরেরা: একই বাক্য।
- আদি ১০:৩১ শেমের বংশধরেরা: একই বাক্য।
- আদি ১০:৩২ সারাংশ: “এরাই হল বংশ এবংজাতি হিসাবে নোহের ছেলেদের বিভিন্ন পরিবার। বন্যার পরে এদের বংশের লোকেরাই বিভিন্ন জাতি হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল
এই পদগুলোতে ব্যবহৃত শব্দগুলো এবং তার সম্ভাব্য অনুবাদ দেওয়া হয়েছে:
- জায়গা H776 ‘erets’ 2505x জমি, স্থায়ী জায়গা, ক্ষেত, মাটি, ভূমি, দেশ, পৃথিবী ইত্যাদি।
- ভাষা H3956 ‘lashon’ 116x ভাষা (আক্ষরিক অথবা রূপক অর্থে), কথা-বার্তা, ইত্যাদি।
- পরিবার H4940 ‘mishpachah’ 303x পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, দল, ইত্যাদি।
- জাতি H1471 ‘goy’ 559x জাতি, লোক, লোকদল, সৈন্যদল, পরজাতি, ইত্যাদি।
- এই পুনরুক্তি পদ দ্বারা আমরা “জাতি” শব্দের একটি বর্ণনা বা সংজ্ঞা পাই: এমন এক লোকদল যারা একই পরিচয়, সংস্কৃতি ও ভাষা ধরে রাখে। “দেশ” বলতে এমন একটি জাতি বুঝায় যা নিজের ভূমিতে বাস করে।
ঈশ্বর একটি দমনকারী সাম্রাজ্যকে অন্য জাতিদের উপর রাজত্ব করতে দেন না আদি ১১:১-৯
- ১০ অধ্যায়ে জাতিগুলোর সৃষ্টির উৎযাপন দেখা যায় কিন্তু ১১ অধ্যায়ে এর বিপরীত ঘটে: ”পরে তারা পূর্ব দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শিনিয়র দেশে একটা সমভূমি পেয়ে সেখানেই বাস করতে লাগল। ৩ তারা একে অন্যকে বলল, “চল, আমরা ইট তৈরী করে আগুনে পুড়িয়ে নিই।” এই বলে তারা পাথরের বদলে ইট এবং চুন-সুরকির বদলে আল্কাত্রা ব্যবহার করতে লাগল। ৪ তারা বলল, “এস, আমরা নিজেদের জন্য একটা শহর তৈরী করি এবং এমন একটা উঁচু ঘর তৈরী করি যার চূড়া গিয়ে আকাশে ঠেকবে। এতে আমাদের সুনামও হবে আর আমরা সারা জগতে ছড়িয়েও পড়ব না।” … ৭ কাজেই এস, আমরা নীচে গিয়ে তাদের ভাষায় গোলমাল বাধিয়ে দিই যাতে তারা একে অন্যের কথা বুঝতে না পারে।” ৮ তারপর সদাপ্রভু সেই জায়গা থেকে তাদের সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিলেন। এতে তাদের সেই শহর তৈরীর কাজও বন্ধ হয়ে গেল। ৯ এইজন্য সেই জায়গার নাম হল বাবিল, কারণ সেখানেই সদাপ্রভু সারা পৃথিবীতে ভাষার মধ্যে গোলমাল বাধিয়ে দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই তিনি তাদের পৃথিবীর সব জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।”
- লোকেরা এখানে ঈশ্বরের আদেশ জানার পরেও ঠিক বিপরীত আচরণ করে, অর্থাৎ তারা একটি কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্য স্থাপন করে। এই সাম্রাজ্যের ভিত্তি হল মানবীয় অহংকার। সম্ভাবনা বেশি যে, এখানে অল্প লোকজন অন্যদেরকে দমন করে।
- ঈশ্বর নির্দিষ্টভাবে হাত বাড়িয়ে ভাষার গোলমাল সৃষ্টি করেন এবং এভাবে এইসবের প্রতিরোধ করেন।
- এখান থেকেই কি বিভিন্ন ভাষার উৎপত্তি? অথবা এখানে কি সে মুহূর্ত বর্ণনা করা হয় যখন এক ভাষার লোকেরা অন্য ভাষার লোকদেরকে আর বুঝতে পারে না?
- পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেলে অবশ্যই ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভাষার তৈরি হয়। তা মন্দ কিছু নয়। এছাড়া বাবিলের উচুঁ গৃহের গল্পের আগেই বিভিন্ন ভাষার উল্লেখ আছে। উঁচু গৃহের কারণে যা ঘটে, তা হল ভাষার গোলমাল এবং যোগাযোগের ভাঙ্গন।
- ঈশ্বর চান যেন বিভিন্ন জাতি, সংস্কৃতি ও দেশ তৈরি হয়, কিন্তু তিনি কেন্দ্রীয় একটি সাম্রাজ্য চান না।
অব্রাহামের কাছে মহা জাতি হওয়ার প্রতিজ্ঞা আদি ১২:২-৩
“তোমার মধ্য থেকে আমি একটি মহা জাতি সৃষ্টি করব। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করব এবং এমন করব যাতে তোমার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আর তোমার মধ্য দিয়ে লোকে আশীর্বাদ পায়। ২ যারা তোমাকে আশীর্বাদ করবে আমি তাদের আশীর্বাদ করব, আর যারা তোমাকে অভিশাপ দেবে আমি তাদের অভিশাপ দেব। তোমার মধ্য দিয়েই পৃথিবীর প্রত্যেকটি জাতি আশীর্বাদ পাবে।”
- অনেক জাতিগুলোর সৃষ্টির পাশাপাশি ঈশ্বর অব্রাহামকে আলাদা করেন এবং তার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট একটি জাতি সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন।
- ঈশ্বর অব্রাহামের কাছে সাম্রাজ্য সৃষ্টি করার প্রতিজ্ঞা দেন না বরং একটি জাতি বা দেশ সৃষ্টি করার প্রতিজ্ঞা দেন। ঈশ্বর যখন নির্দিষ্টভাবে আচরণ করেন তখন তিনি সাম্রাজ্য নয় বরং একটি দেশই স্থাপন করেন।
- ঈশ্বর দ্বারা স্থাপিত জাতির জন্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্য কি? তিনি চান না তাঁর হাত দ্বারা স্থাপিত ইস্রায়েল জাতি স্বার্থপরভাবে অন্য সব জাতিগুলোর চেয়ে শুধুমাত্র নিজের জাতির উপর গুরুত্ব দেয়। বরং ঈশ্বর চান তাঁর জাতি যেন সব জাতিগুলোর জন্য আশীর্বাদের হয়।
ঈশ্বর অব্রাহামকে অনেক জাতির আদিপিতা হওয়ার প্রতিজ্ঞা দেন – আদি ১৭:৫
“তোমাকে অব্রাম (যার মানে ‘মহান পিতা’) বলে আর ডাকা হবে না, কিন্তু এখন থেকে তোমার নাম হবে অব্রাহাম (যার মানে ‘অনেক লোকের পিতা’); কারণ আমি তোমাকে অনেকগুলো জাতির আদিপিতা করে রেখেছি।”
- অব্রাহামের কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞাতে ঈশ্বর আরো বিষয় যুক্ত করেন: তিনি এক জাতির নয় বরং অনেক জাতির আদিপিতা হবেন।
- প্রতিজ্ঞাটি কিভাবে পূর্ণ হয়? আক্ষরিক অর্থে অব্রাহাম থেকে প্রকৃতপক্ষে কয়েকটি জাতি তৈরি হয়: ইশ্মায়েল দ্বারা আরব জাতি , এষৌ দ্বারা ইদোম জাতি, যাকোব দ্বারা ইস্রায়েল জাতি, কটূরা দ্বারা মিদিয়োন জাতি।
- কিন্তু অনেক জাতির আদিপিতা হওয়ার প্রতিজ্ঞা চূড়ান্তভাবে পূর্ণ হয় যীশুর মধ্য দিয়ে। অনেক জাতি থেকে লোকেরা যীশুর উপর বিশ্বাস রেখে পরিত্রাণ, অর্থাৎ ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাবে। যেমন পৌল বলেন “তাহলে দেখা যায়, ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে অব্রাহাম যেমন আশীর্বাদ পেয়েছিলেন ঠিক তেমনি তাঁর পর থেকে যারা ঈশ্বরকে বিশ্বাস করছে তারাও সেই আশীর্বাদ পাচ্ছে” (গালাতীয় ৩:৯)।

মহা জাতি হয়ে যাওয়া হল ঈশ্বরের একটি সান্ত্বনা – আদি ২১:১৩,১৮
“তবে সেই দাসীর ছেলের মধ্য দিয়েও আমি একটা জাতি গড়ে তুলব, কারণ সে-ও তো তোমার সন্তান।”
- ঈশ্বর অব্রাহামের দাসী হাগারকে সান্ত্বনা দিয়ে প্রতিজ্ঞা দেন যে, ইশ্মায়েলের মধ্য দিয়ে তিনি অবশ্যই একটি জাতি গড়ে তুলবেন।
যাকোব থেকে গড়ে তোলা হবে “বহু জাতি” – আদি ৩৫:১১-১২
“ঈশ্বর তাঁকে আরও বললেন, “আমিই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। তুমি অনেক সন্তানের পিতা হয়ে সংখ্যায় বেড়ে ওঠো। তোমার মধ্য থেকেই একটা জাতি গড়ে উঠবে, আর গড়ে উঠবে একটা বহু গোষ্ঠীর জাতি”
সাধারণ অনুবাদ যেখানে “গড়ে উঠবে একটা বহু গোষ্ঠির জাতি” বলে, কেরী বলে: “তোমার হয়তে এক জাতি, এমন কি, জাতিসমাজ উৎপন্ন হইবে”। আর একটি অনুবাদ বলে: “তোমার থেকেই অন্য অনেক জাতি এবং রাজারা উৎপন্ন হবে”। ইংরেজিতে “a company of nations”।
- আশ্চর্য বিষয় যে বহু জাতির আদিপিতা হওয়ার প্রতিজ্ঞা এখানে নির্দিষ্টভাবে যাকোবকে বলা হয়েছে।
- যদি প্রতিজ্ঞাটি অব্রাহামের কাছে দেওয়া হত, বিষয়টি তেমন আশ্চর্যজনক হত না: অব্রাহাম দ্বারা তো আমরা প্রকৃতপক্ষে বেশ কয়েকটি জাতি পেয়েছি (অরাব, ইদোম, মিদিয়োন, অমালেক ইত্যাদি)।
- যদি আমরা অব্রাহামের ভাইয়ের ছেলে লোটকে অন্তর্ভুক্ত করি তবে আমরা আরো পাই মোয়াব ও অম্মোন জাতি।
- কিন্তু প্রতিজ্ঞাটি অব্রাহামকে কেন্দ্র করে নয় বরং যাকোবকে কেন্দ্র করে! যাকোব দ্বারা ইস্রায়েল জাতি সৃষ্টি হয়। ৯৩১ খ্রীষ্টপূর্বে ইস্রায়েল বিভক্ত হওয়ার কারণে দু’টি দেশ তৈরি হয় (উত্তরে ইস্রায়েল এবং দক্ষিণে যিহূদা)। এভাবে যাকোব থেকে ২টি জাতি পাই, কিন্তু “বহু জাতি”, এই প্রতিজ্ঞা কিভাবে পূর্ণ হয়? এর অর্থ কি হতে পারে?
- হয়তো এর অর্থ এই যে, ঈশ্বর চেয়েছেন যেন ইস্রায়েল গোষ্ঠিগুলো এমন একটি দেশে পরিণত হয় যার কেন্দ্রীয় সরকার নেই বরং তারা ১২ গোষ্ঠির একটি জোট হয়। তাদের একতার ভিত্তি হবে ঈশ্বরের উপর তাদের বিশ্বাস এবং মিলন তাম্বু। তারা সরকারের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রিক এবং ধর্মের ক্ষেত্রে এককেন্দ্রিক একটি জাতি হবে।
- অথবা ঈশ্বর চেয়েছেন যেন ইস্রায়েলের ১২টি গোষ্ঠি আলাদা জাতিতে পরিণত হয়, এমন ১২টা জাতি যা একই পুরুষের বংশধর হিসাবে বন্ধুত্বে এবং একই ঈশ্বরের উপর বিশ্বাসে যুক্ত।
- অথবা তা যীশু দ্বারাই পূর্ণ হয় যখন সব জাতি থেকে বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের নিজের লোক হয়ে যায়।
ঈশ্বর সব জাতিদের ইতিহাস জানেন – যাত্রা ৯:২৪
“শুধু যে কেবল শিল পড়ল তা নয়, তার সংগে সংগে অনবরত বিদ্যুৎ চম্কাতে লাগল। মিসর রাজ্যের আরম্ভ থেকে এই পর্যন্ত সারা দেশে এই রকম ভীষণ ঝড় আর কখনও হয় নি।”
- আমাদের কোন ধারণা নেই কখন মিসর দেশ হিসাবে স্থাপিত হয়েছিল, কিন্তু ঈশ্বর তা জানেন!
ঈশ্বর সমস্ত জাতিদের দায়বদ্ধ করে রাখেন – লেবীয় ১৮:২৪-৩১
“এই রকমের কোন কাজ করে তোমাদের মধ্যে কেউ যেন নিজেকে অশুচি না করে, কারণ তোমাদের সামনে থেকে যে সব জাতিকে আমি তাড়িয়ে দেব তারাও ঐভাবে নিজেদের অশুচি করেছে। ২৫ এতে তাদের দেশটা পর্যন্ত অশুচি হয়ে গেছে। … ২৬ কিন্তু তোমরা আমার নিয়ম ও আইন-কানুন মেনে চলবে। তোমাদের জাতির কিম্বা তোমাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির কোন লোক যেন এই রকমের কোন জঘন্য কাজ না করে। … ২৮ তোমরাও যদি দেশটা অশুচি কর তবে সেখানকার আগের জাতিদের মত দেশটা তোমাদেরও বমি করে ফেলে দেবে।”
- একটি জাতি যদি তাদের মাটিতে জঘন্য কাজ ও বড় অন্যায় করতে থাকে তবে জমি তাদের আর সহ্য করতে পারে না বরং জমি তাদেরকে ‘বমি’ করে বের করবে। “বমি করে ফেলে দেবে” এটি একটি রূপক শব্দ যা দ্বারা বুঝায় যে ইস্রায়েল যুদ্ধে পরাজিত হবে এবং তাদেরকে নির্বাসনে নিয়ে যাওয়া হবে। তারা তাদের পাপের কারণে জমির উপর অধিকার হারাবে।
- ঈশ্বর এখন, অর্থাৎ ১৪০৫ খ্রীষ্টপূর্বে ইস্রায়েল জাতি দ্বারা কনানীয়দের তাদের জঘন্য কাজের জন্য জমি থেকে সরিয়ে দেন (১৪০৫ খ্রীঃপূঃ)। কিন্তু তিনি ইস্রায়েল জাতিকে কঠোর সাবধানবাণী দেন যে, যদি তারা এই জমিতে কনানীয়দের মত জঘন্য কাজ করতে থাকে তবে ঈশ্বর তাদেরকে অবশেষে ঠিক কনানীয়দের মত এই জমি থেকে সরিয়ে ফেলবেন, যা ইস্রায়েলের জন্য আসিরিয়া দ্বারা (৭২২ খ্রীঃপূঃ) এবং যিহূদার জন্য বাবিল দ্বারা (৫৮৬ খ্রীঃপূঃ) পূর্ণ হয়।
ঈশ্বর ইস্রায়েলকে অন্য জাতিদের সীমানা সম্মান করতে বলেন – দ্বিতীয় বিবরণ ২
- ইস্রায়েল জাতি নিজের ইচ্ছা অনুসারে অন্য জাতিদের দখল করে তাদের জমির অধিকার পাবে, এমন নয়। ইস্রায়েলকে শুধুমাত্র ৭টি নির্দিষ্ট জাতিগুলো দখল করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে (দ্বিতীয় বিবরণ ৭:১)।
- যে জাতিদের আক্রমণ বা দখল করার অনুমতি ইস্রায়েলের নেই, এদেরও একটি নির্দিষ্ট তালিকা দেওয়া আছে: ইদোম (দ্বিতীয় বিবরণ ২:৪-৬), মোয়াব (দ্বিতীয় বিবরণ ২:৯) এবং অম্মোন (দ্বিতীয় বিবরণ ২:১৯)।
- এই দেশগুলোর ক্ষেত্রে ঈশ্বর ইস্রায়েলকে আদেশ দেন: এই দেশগুলোর সীমানার কাছে এসে তাদের কাছ থেকে পার হওয়ার অনুমতি চাইতে হবে। তারা পার হওয়ার সময়ে যে জল তুলে খাবে, এর দামও তাদের দিতে হবে।
- যখন এই জাতিগুলো ইস্রায়েলকে তাদের ভূমি দিয়ে পার হওয়ার জন্য অনুমতি না দেয় তখন এই দেশগুলোর সীমানা সম্মান করে ইস্রায়েলীয়দেরকে চারিদিকে হেঁটে যেতে হবে।
ঈশ্বর জাতিদেরকে অস্থিত্ব ও অধিকার দান করেন – দ্বিতীয় বিবরণ ২:৯-২৩
আর এখন: ২:৯ ঈশ্বর তা মোয়াবকে দিলেন। (লোট)
আগে: ২:১০ এমীম।
সেয়ীর এখন: ২:১২,২২ ঈশ্বর তা ইদোমকে দিলেন। (এষৌ)
আগে: ২:১২ হরীয়রা, । ইদোম হরীয়দের দখল করেছিল।
অম্মোন এখন: ২:২৯ ঈশ্বর তা অম্মোনকে দিলেন (লোট)
আগে: ২:২০ রফায়ীয়রা। অম্মোন রফায়ীয়দের দখল করেছিল।
ঘসা এখন: ২:২৩ কপ্তরীয়রা (ক্রীট এবং পরে পলেষ্টিয়া থেকে) (হাম)
আগে: ২:২৩ অব্বীয়রা। কপ্তরীয়রা অব্বীয়দের দখর করেছিল।
- দ্বিতীয় বিবরণ ২ অধ্যায়ে দেখতে পায় ঈশ্বর কিভাবে এক জাতিকে সরিয়ে অন্য একটি জাতিকে ভূমির উপর অধিকার দেন। এর ৪টি উদাহরণ আছে।
- প্রথম নজরে চিন্তা করা যায় যে, ঈশ্বর অব্রাহাম থেকে আসা জাতিদেরকে অন্য জাতিদের চেয়ে প্রাধান্য দেন।
- কিন্তু ৪র্থ উদাহরণ দেখায় যে, এই চিন্তা ঠিক নয়। হাম থেকে আসা কপ্তরীয়দের জন্য, অর্থাৎ এমন একটি জাতি যা অব্রাহামের সাথে সম্পর্কিত নয়, তাদের জন্যও ঈশ্বর আর একটি জাতি সরিয়ে দেন।
ঈশ্বর জাতিদের সরিয়ে দেন – আমোষ ৯:৭
“সদাপ্রভু বলছেন, “হে ইস্রায়েলের লোকেরা, তোমরা কি আমার কাছে কূশীয়দের মত নও? আমি কি মিসর থেকে ইস্রায়েলীয়দের, ক্রীট থেকে পলেষ্টীয়দের এবং কীর থেকে অরামীয়দের নিয়ে আসি নি?”
- ইস্রায়েল জাতি তার মনোয়নকে অহংকারের বিষয় হিসাবে ধরে নিয়েছে। এই মিথ্যা বিশ্বাস ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ঈশ্বর তাদেরকে এই পদে দেখান যে, যা তিনি ইস্রায়েলের জন্য করেছিলেন, তা তিনি অনেক জাতিদের জন্যও করেছিলেন। যেমন: তিনি কপ্তরীয়দের (অর্থাৎ পলেষ্টীয়দের) ক্রীট থেকে (দ্বিতীয় বিবরণ ২:২৩ দেখুন) এবং অরামীয়দের কীর থেকে নিয়ে এসেছেন।
- এই পদটি ইস্রায়েলের জন্য অবশ্যই চেতনাদায়ক ও আচমকার মত ছিল। প্রকৃতপক্ষে আমাদেরও এই বিষয় নিয়ে কোন খেয়াল নেই।
ঈশ্বর একটি জাতির জন্য কি ধরণের সরকার চান – দ্বিতীয় বিবরণ ১৯:৯-১৪
“সেই সময় আমি তোমাদের বলেছিলাম, ‘আমার একার পক্ষে তোমাদের বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। … ১২ কিন্তু আমি একা কি করে তোমাদের সব ঝগড়া-বিবাদ মিটাবার ভার ও বোঝা বহন করব? ১৩ তোমরা তোমাদের প্রত্যেকটা গোষ্ঠী থেকে কয়েকজন করে জ্ঞানবান, বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞ লোক বেছে নাও; আমি তাদের উপর তোমাদের দেখাশোনার ভার দেব।’ তোমরা তার উত্তরে বলেছিলে, ‘আপনি যা বলছেন তা-ই করা ভাল।’”
- ঈশ্বর যখন ইস্রায়েলের জন্য তাঁর ইচ্ছা অনুসারে সরকার স্থাপন করেন তখন তিনি নির্বাচিত ও প্রতিনিধি একটি সরকার স্থাপন করেন, যেখানে সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। লোকদের অনুমতি নিতে হবে।
- সরকারের প্রধান দায়িত্ব হল ন্যায় বিচার ও আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। এই বিষয়ে বিস্তারিত শিক্ষা পাওয়া যায় “সরকার ০১ – নেতা নিযুক্ত”।
কিভাবে ইস্রায়েল জাতি গণতন্ত্র থেকে রাজতন্ত্র হয়ে যায় – ১ শমূয়েল ৮
- মোশি ইস্রায়েলকে গণতন্ত্র হিসাবে স্থাপন করার প্রায় ৪০০ বছর পরে ইস্রায়েল জাতি ভাববাদী শমূয়েলের কাছে এসে রাজা দাবি করে, যেমন অন্য জাতিদের রাজা আছে।
- রাজা চাওয়ার মানে হল রাজতন্ত্র চাওয়া। এর অর্থ এই যে, গণতান্ত্রিক সরকারের চেয়ে তারা রাজতন্ত্র দাবি করে। এভাবে তারা নেতাদেরকে নিযুক্ত করার অধিকার হাতছাড়া করে। প্রথম রাজা নিযুক্ত হওয়ার পরে আর নেতা নিযুক্ত করা যাবে না: রাজার পুত্র সিংহাসনে বসবে, তিনি যোগ্য ব্যক্তি হোক বা না হোক। প্রথম রাজা থেকে যে রাজবংশ তৈরি হবে, তা অভিলাসে বাস করবে এবং সাধারণ লোকদের প্রতিনিধি আর হবে না, লোকদের কষ্ট আর বুঝবে না।
- এইভাবে ইস্রায়েল অন্য জাতিদের মত হয়ে যায়: শক্তিশালী হওয়ার সময়ে তারা চারিদিকে জাতিদের আক্রমণ ও দমন করে, দুর্বল হওয়ার সময়ে তারা অন্য জাতিদের শিকার হয়ে দাঁড়ায়।
- যদিও দায়ূদ ব্যক্তিগতভাবে একজন ঈশ্বরভক্ত ব্যক্তি ছিলেন তবুও তিনি তার রাজত্বের সময়েও ঈশ্বরের মানদণ্ড রক্ষা করতে পারেন নি। দায়ূদের পুত্র শলোমন তা আরো কম করেন এবং দায়ূদের নাতী রহবিয়াম হবেন দায়বদ্ধতা ছাড়া ব্যক্তি, যিনি ইস্রায়েলীয়দের অত্যাচার করেন। “সরকার ০৬ – ইস্রায়েল ইতিহাসে রাজতন্ত্র” দেখুন।
লোকদের প্রতিনিধিত্ব না থাকলে তবে তাদের থেকে কর-আদায় করা যাবে না – ১ রাজা ১২:৪-১৬
“আপনার বাবা আমাদের উপর একটা ভারী জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু এখন আপনি আমাদের উপর চাপানো সেই কঠিন পরিশ্রম কমিয়ে ভারী জোয়ালটা হালকা করে দিন; তাহলে আমরা আপনার সেবা করব।”… ১৩ রাজা বৃদ্ধ নেতাদের উপদেশ অগ্রাহ্য করে লোকদের খুব কড়া উত্তর দিলেন। ১৪ তিনি সেই যুবকদের পরামর্শ মত বললেন, “আমার বাবা তোমাদের জোয়াল ভারী করেছিলেন, আমি তা আরও ভারী করব। আমার বাবা চাবুক দিয়ে তোমাদের মেরেছিলেন, আমি তোমাদের মারব কাঁকড়া-বিছা দিয়ে।” ১৫ এইভাবে রাজা লোকদের কথায় কান দিলেন না। … ১৬ ইস্রায়েলীয়েরা যখন বুঝল যে, রাজা তাদের কথা শুনবেন না তখন তারা রাজাকে বলল, “দায়ূদের উপর আমাদের কোন দাবি নেই। যিশয়ের ছেলের উপর আমাদের কোন অধিকার নেই। হে ইস্রায়েল, তোমরা যে যার বাড়ীতে ফিরে যাও। হে দায়ূদ, এখন তোমার নিজের গোষ্ঠী তুমি নিজেই দেখ।”
- শলোমনের রাজত্বের সময়কে যদিও ইস্রায়েলের সোনার যুগ হিসাবে গোনা হয় তবুও শলোমন ইস্রায়েলের উপর অতিরিক্ত করের দাবি ছাপিয়েছিলেন – তার অনবরত নির্মাণ কাজ এবং অতি বড় রাজ-পরিবার (৭০০ স্ত্রী ও ৩০০ উপস্ত্রী) থাকার কারণে। এছাড়া তিনি নিজের গোষ্ঠি থেকে কর না নিয়ে অন্য গোষ্ঠিদের থেকে বেশি কর আদায় করেন। শলোমনের জীবনের শেষে ইস্রায়েল নিজেকে অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় খুঁজে পায়।
- যে গোষ্ঠি যাদের উপরে অতিরিক্ত কর ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল যখন রাজা রহবিয়ামকে কর কমানোর অনুরোধ করে তখন তিনি তাদের সেবা না করে বরং তাদেরকে আরো দমন করতে চেষ্টা করেন। ফলে উত্তরের গোষ্ঠিগুলো তার নেতৃত্ব অগ্রাহ্য করে আলাদা দেশ স্থাপন করে। ইস্রায়েল এইভাবে দু’টি দেশে ভাগ হয়ে যায় এবং ইতিহাসে এই বিচ্ছেদের আর কখনও সমাধান হয় না।
- এই গল্প থেকে নীতি নেওয়া যায়: লোকদের প্রতিনিধিত্ব না দিলে কর-আদায় করার অধিকারও নেই। সরকারের অধীনে থাকা লোকদেরকে সেবা করা এবং তাদের কাছে দায়বদ্ধ হওয়াই হল সরকারের দায়িত্ব। দায়বদ্ধতা ছাড়া একজন দমনকারী রাজাকে ঈশ্বর চান না, এর চেয়ে ঈশ্বর নিজের জাতিকে বিভক্ত হতে দেন!
বড় সাম্রাজ্যের সাথে মৈত্রী চুক্তি করা বা জোটে আসার বিষয়ে ঈশ্বরের সাবধানবাণী – যিশাইয় ৩০:১-৩
“সদাপ্রভু বলছেন, “ধিক্ সেই একগুঁয়ে সন্তানেরা, যারা পরিকল্পনামত কাজ করে কিন্তু আমার পরিকল্পনামত নয়। তারা বন্ধুত্ব স্থাপন করে কিন্তু আমার আত্মার ইচ্ছামত নয়। এইভাবে তারা পাপের উপরে পাপ বোঝাই করে। ২ তারা আমার সংগে পরামর্শ না করে মিসরে যায়; তারা সাহায্যের জন্য ফরৌণের আশ্রয় খোঁজে আর মিসরের ছায়ায় খোঁজে রক্ষার স্থান। ৩ কিন্তু ফরৌণের আশ্রয়ে তারা লজ্জা পাবে এবং মিসরের ছায়া তাদের অসম্মান আনবে।”
- ইস্রায়েল ও যিহূদার ইতিহাসে প্রায়ই দেখা যায় তারা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করার পরিবর্তে নিরাপত্তা বা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য বড় সাম্রাজ্যের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করায় গুরুত্ব দেয়। প্রত্যেক বারই এই রাজনৈতিক কৌশল নিষ্ফল হয়ে পড়ে অথবা এমন কি বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- উদাহরণ: বাবিলের সাথে যিহূদার রাজা হিষ্কিয়ের মৈত্রী চুক্তি (যিশাইয় ৩৯:৫-৬): “তখন যিশাইয় হিষ্কিয়কে বললেন, “সর্বক্ষমতার অধিকারী সদাপ্রভু যা বলছেন তা আপনি শুনুন। ৬ সদাপ্রভু বলছেন, এমন দিন আসবে যখন আপনার রাজবাড়ীর সব কিছু এবং আপনার পূর্বপুরুষদের জমানো যা কিছু আজ পর্যন্ত রয়েছে সবই বাবিলে নিয়ে যাওয়া হবে, কিছুই পড়ে থাকবে না।”
বাইবেলে বড় সাম্রাজ্য
- বাইবেলে বেশ কয়েকটি বড় সাম্রাজ্য উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন আসিরিয়া, বাবিল, মাদিয়-পারস্য, গ্রীস ও রোম।
- সাম্রাজ্যের প্রধান নেতারা কিছু ক্ষেত্রে ভাল ব্যবহার দেখান। যেমন: বাবিল রাজা নবূখদনিৎসর যিরমিয়ের প্রতি ভাল ব্যবহার করেন (যিরমিয় ৪০:২-৫) এবং তিনি তার অহংকার থেকে মন ফিরান (দানিয়েল ৪:৩৪-৩৭), মাদিয়-পারস্য রাজা দারিয়াবস দানিয়েলকে সিংহের গর্ত থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেন (দানিয়েল ৬:১৪), রোমীয় পিলাত যীশুকে মুক্ত করতে চেষ্টা করেন।
- কিন্তু অধিকাংশ সময়ে বাইবেলে বড় সাম্রাজ্যের নেতিবাচক ছবি দেখানো হয়। সাম্রাজ্যের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রূপক হল ‘জন্তু’ (দানিয়েল ৭–৮)। প্রকাশিত বাক্যেও আমরা সেই একই রূপকগুলো পাই।

- সাধারণত ‘জন্তু’ বুঝায় রাক্ষুসে, ভয়ংকর, দমনকারী ও আক্রমনার্থক (যেমন ‘সিংহ’, ‘ভাল্লুক’ অথবা চিতাবাঘ’)। এই রূপক দ্বারা সাম্রাজ্যগুলোর হিংস্রতা, ক্ষমতার লোভ, অত্যাচার ও দায়বদ্ধতাহীনতা দেখানো হয়। আসিরিয়া সাম্রাজ্য সম্বন্ধে ঈশ্বর বলেন “তোমার অশেষ নিষ্ঠুরতা কে না ভোগ করেছে?” (নহূম ৩:১৯)। প্রকাশিত বাক্যে রোম রাজ্যকে একটি অহংকারী, আত্ম-বিশ্বাসী বেশ্যা হিসাবে বর্ণনা করা হয় যা শহীদদের রক্ত খেয়েই মাতাল (প্রকাশিত বাক্য ১৭:১-৬)।
- যখন একটি জাতি অন্য জাতিদেরকে অত্যাচার করতে শুরু করে তখন সেই জাতিদের অনেক নিষ্ঠুরতা ও রক্তপাত ভোগ করতে হয়। এছাড়া যখন দখলকারী একটি জাতি বড় সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়, সে জাতি অতিরিক্ত ক্ষমতা পেয়ে প্রলোভনে পড়ে, অর্থাৎ দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারীতা ও বিলাসিতার ফাঁদে পড়ে। অবশেষে এই জাতি নিজের লজ্জা প্রকাশ করেই ধ্বংস হয়ে যায়। সাম্রাজ্যগুলো দীর্ঘদিন টিকে থাকবে না।
ঈশ্বর সাম্রাজ্য স্থাপন করেন না বরং জাতিগুলো স্থাপন করেন – দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৮
“মহান ঈশ্বর যখন বিভিন্ন জাতিকে (H1471 goy) সম্পত্তি ভাগ করে দিলেন, আর মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে ভাগ করলেন, তখন ইস্রায়েল জাতির (H5971 am) লোকসংখ্যা মনে রেখে তিনি অন্য জাতিদের সীমানা ঠিক করে দিলেন।”
- ঈশ্বর নিজের হাতে জাতিদের অস্থিত্ব, জমির উপরে অধিকার এবং তাদের সীমানা ঠিক করে দেন। তিনিই জাতিদের সৃষ্টিকর্তা, তিনি তাদের টিকিয়ে রাখেন।
- ইতিহাসে প্রায় দেখা যায় যে, যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতিদের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করা হয়। এটি এমন একটি সন্তানের মত, যা ব্যভিচারে বা ধর্ষণ থেকে জন্ম নিয়েছে: যদিও ব্যভিচার ও ধর্ষণ অন্যায়ের কাজ তবুও সন্তানের জীবন ঈশ্বর থেকে দেওয়া, পবিত্র এবং যোগ্য।
- পৌল যখন এথেন্সে প্রচার করেছিলেন তখন সম্ভবত দ্বিতীয় বিবরণের এই পদ তার মনে ছিল:
ঈশ্বর জাতিদের সৃষ্টি করেন, টিকিয়ে রাখেন এবং তাদের সীমানা নির্ধারণ করেন – প্রেরিত ১৭:২৬-২৭
“তিনি একজন মানুষ থেকে সমস্ত জাতির লোক সৃষ্টি করেছেন (অন্য অনুবাদ: “সমস্ত জাতি করেছেন”) যেন তারা সারা পৃথিবীতে বাস করে। তারা কখন কোথায় বাস করবে তাও তিনি ঠিক করে দিয়েছেন। ২৭ ঈশ্বর এই কাজ করেছেন যেন মানুষ হাতড়াতে হাতড়াতে তাঁকে পেয়ে যাবার আশায় তাঁর খোঁজ করে। কিন্তু আসলে তিনি আমাদের কারও কাছ থেকে দূরে নন।”
- ঈশ্বর জাতিদের সৃষ্টি করেন, তাদের সময় ও সীমানা ঠিক করেন, তাদেরকে অধিকার ও দায়িত্ব দান করেন।
- ঈশ্বর পৃথিবীতে জাতিগুলো সৃষ্টি করেছেন বলে আমাদের অবশ্যই জাতিগুলোর বিষয়ে ঈশ্বরের দৃষ্টি কি, তা জানা দরকার: জাতির জন্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্য কি? জাতি হিসাবে কিভাবে টিকে থাকা যায়? একটি জাতির আহ্বান, অবদান ও আশীর্বাদ হওয়ার ভূমিকা ঠিক কি? একটি জাতি কিভাবে পরিচালনা করা উচিত? জাতিগুলোর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত?
- প্রকৃতপক্ষে আমাদের এই বিষয়ে বেশি ধারণা, শিক্ষা বা মতবাদ নেই।
ইউরোপে পুনসংস্কারের কারণে জাতীয়তার গুরুত্ব পুনরায় আবিষ্কার
- খ্রিষ্টান ধর্ম প্রথমদিকে রোম সাম্রাজ্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই পরিবেশে বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে যখন রোমীয় সম্রাট কনস্টান্টিন নিজেই বিশ্বাসী হয়ে যান তখন খ্রিষ্টান ধর্ম রোম সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হয়ে যায়। রোম সাম্রাজ্যের পরিবেশে খ্রিষ্টান ধর্ম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে খ্রিষ্টানদের বেশি খেয়াল ছিল না যে, ঈশ্বর প্রকৃতপক্ষে বড় সাম্রাজ্যের চেয়ে বরং বিভিন্ন ছোট জাতির স্থাপন চান।
- যখন প্রায় ৪০০ খ্রীষ্টাব্দে রোম সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যায় তখন ক্যাথলিক মণ্ডলী রোম সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হয়ে যায়। সঙ্গে ক্যাথলিক চিন্তায় জাতি সম্বন্ধীয় মতবাদের চেয়ে সাম্রাজ্য সম্বন্ধীয় মতবাদ গুরুত্ব পায়। ক্যাথলিক মণ্ডলীতে এইভাবে এমন মতবাদ প্রচলিত হয়ে যায় যা সরকারের ক্ষেত্রে খ্রিষ্টান সম্রাট ও খ্রিষ্টান সাম্রাজ্য প্রয়োজন মনে করে। এর একটি উদাহরণ: Charlemagne-এর সাম্রাজ্য ৮০০ খ্রীষ্টাব্দে (মানচিত্র দেখুন)।
- যখন ১৬ম শতাব্দীতে পুনঃসংস্কার ঘটে এবং বাইবেল বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয় তখন বাইবেলীয় সেই চিন্তা যে, সাম্রাজ্যের চেয়ে ঈশ্বর জাতি বা আত্ম-চালিত দেশ চান, তা আবার বৃদ্ধি পায়।
- ইউরোপের সাম্রাজ্যগুলো যখন ভেঙ্গে যায় তখন ছোট আত্ম-চালিত জাতি বা দেশ তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মানচিত্রে দেখা যায় ১৪৩০ খ্রীষ্টাব্দে ইউরোপে ছোট দেশের সৃষ্টি।
- সাথে বাইবেলের চিন্তা (সাম্রাজ্য নয় বরং আত্ম-চালিত জাতি বা দেশ হোক) আলোচনা ও লিখিত রাখা হয়। ‘নিজের দেশকে ভালবাসা ও সেবা করা’, এই মনোভাব ও আচার-ব্যবহার প্রশংসাযোগ্য বিষয় হয়ে উঠে।
- ইউরোপের দক্ষিণ দিকে, অর্থাৎ যেখানে ক্যাথলিক মণ্ডলী বেশি প্রভাবশালী, সেখানে সাম্রাজ্যকে গুরুত্বে দেওয়ার মতবাদ থেকে যায়।
- ইংল্যান্ড যখন প্রটেস্টেন্ট হয়ে যায়, তা পুনঃসংস্কার বা চিন্তার গভীর পরিবর্তনের কারণে হয় না, বরং তা ইংল্যান্ডের রাজার মুহূর্তের সিদ্ধান্তের কারণে ঘটে (ক্যাথলিক মণ্ডলী রাজাকে তার স্ত্রীকে বিচ্ছেদ করার অনুমতি দেয় নি বলে তিনি প্রটেস্টেন্ট মতবাদ গ্রহণ করেন!)। ফলে পুনঃসংস্কারের সেই শিক্ষা যে জাতি গুরুত্বপূর্ণ, তা ইংল্যান্ডে বেশি গুরুত্ব পায় না বরং ক্যাথলিক সাম্রাজ্য সম্বন্ধীয় মতবাদ প্রভাবশালী হতে থাকে। ফলে ইংল্যান্ড যখন নিজেই একটি সাম্রাজ্য স্থাপন করতে যাচ্ছেন এর বিরুদ্ধে বেশি আপত্তি বা প্রতিরোধ দেখা যায় না। এইভাবে আমরা বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পাই।
- ১৮ম শতাব্দীতে আমেরিকার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য সংগ্রাম শুরু করে। এর একটি কারণ ছিল যে ব্রিটিশরা (বাইবলের নীতি অমান্য করে) প্রতিনিধিত্ব না দিয়ে আমেরিকার উপনিবেশগুলো থেকে যথেষ্ট কর আদায় করত। এই কারণে উপনিবেশগুলোতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন বৃদ্ধি পায় এবং ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দে আমেরিকার উপনিবেশগুলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্ব-নির্ভরতা লাভ করে।
- ২০শ শতাব্দীতে যখন ব্রিটিশরা আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র (US)কে অনুরোধ করে যেন তারা ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে বিশ্বযুদ্ধে যুক্ত হবে তখন আমেরিকা একটি শর্ত রাখে। তারা ইংল্যান্ডকে একটি চুক্তিতে (the Transatlantic Charter) বাধ্য করে: যুদ্ধের পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা জাতিদেরকে অবশ্যই স্বনির্ভরতা ও আত্ম-পরিচালনার অধিকার দান করতে হবে।
- অনেকে মনে করে যে, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল জার্মানদের জাতিয়তাবাদ। ফলে জাতিয়তাবাদ সমস্যা মনে করে অনেক ইউরোপীয় জাতি এর চেয়ে একটি জোট স্থাপন করতে ভাল মনে করে, যার ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সৃষ্টি হয়। এইভাবে ভারসাম্য আবারও বড় সাম্রাজ্যের দিকে চলে যায়।


- তাই দেখা যায় যে, খ্রিষ্টান ধর্মে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাম্রাজ্যের মতবাদ এবং জাতিয়তার মতবাদের মধ্যে লড়াই ছিল। তারপরেও খ্রিষ্টান প্রভাবে স্বনির্ভর ও আত্ম-চালিত জাতি বা দেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং এই দেশগুলো শক্তিশালীও হয়ে উঠেছে।
- ইসলামের চিন্তায় জাতিয়তাবাদ নেই বললে চলবে, প্রধান চিন্তা হল সাম্রাজ্যের মতবাদ। যখন মোহাম্মাদ ৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে মারা যান, তিনি একটি কেন্দ্রীয় সরকার বা দেশ রেখে যান। ইসলাম ধর্মে সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ হল খলিফার শাসন, অর্থাৎ একজন আল্লাহভক্ত, শক্তিশালী খলিফা যিনি বড় একটি মুসলিম সাম্রাজ্যের উপর রাজত্ব করেন।
- ৬৩২ থেকে ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন খলিফারা বড় সাম্রাজ্য স্থাপন করে রাজত্ব করেন, যেমন অটোমান সাম্রাজ্য।
- তাই দেখা যায় যে, ইসলাম ধর্মে জাতীয়তা মতবাদের চেয়ে সাম্রাজ্যের মতবাদ বেশি শক্তিশালী। বর্তমান দিনেও ‘খলিফা দিয়ে শাসিত সাম্রাজ্য’, এই চিন্তা দেখা দেয় যখন ২০১৪ খ্রীষ্টাব্দে ISIS সৈন্যদল মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় Abu Bakr al-Baghdadi নামক একজন খলিফা ঘোষণা করে এবং এইভাবে একটি খলিফার শাসন বিস্তার করতে চেষ্টা করে। যদিও পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমানরা ISIS-এর আন্দোলন অগ্রাহ্য করেছিল তবুও এই ঘটনা দ্বারা দেখা যায় যে, একজন খলিফার রাজত্ব করার আশা বলতে কিছু আছে।