গীতসংহিতা পুস্তকে ব্যক্তিগত প্রার্থনাগুলো এবং ইস্রায়েলের জাতিগত প্রার্থনা বা গীতগুলো সংগ্রহ করে একসাথে প্রকাশ করা হয়েছে। গীতসংহিতায় ধন্যবাদের গীত ও আরাধনার গীত পাওয়া যায়, কিন্তু পাশাপাশি পাওয়া যায় আবেগময় দুঃখ ও বিলাপের গীত, গভীর কষ্ট থেকে বিনতির গীত ও অন্তরে সংগ্রামের গীত।
গীতসংহিতা পুস্তক হল একশত পঞ্চাশটি গীতের একটি সংগ্রহের প্রকাশ, অর্থাৎ পাঁচটি গীতের খণ্ডাংশের একটি সার্বিক সংগ্রহ। এই পাঁচটি খণ্ডাংশ ইস্রায়েলের ইতিহাসে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
সম্ভাবনা বেশি যে, রাজা দায়ূদ ও শলোমন, ধর্ম-শিক্ষক ইষ্রা এবং হয়তো রাজা হিষ্কিয় ও যোশিয় হলেন প্রধান সংগ্রহকারী। প্রায় ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বে রাজা দায়ূদ প্রথম গীতের সংগ্রহ শুরু করেন। প্রায় ৪৫০ খ্রীষ্টপূর্ব ধর্ম-শিক্ষক ইষ্রা গীতসংহিতা পুস্তক সমাপ্ত করেন এবং যেভাবে তিনি গীতসংহিতা সাজিয়ে প্রকাশ করেছিলেন ঠিক সেভাবে তা আজ আমাদের বাইবেলে পাওয়া যায়।
গীতের মধ্যে পাওয়া যায় ব্যক্তিগত গীত, জাতিগত গীত, শিক্ষা দেওয়ার গীত এবং এমন গীত যা অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হত। প্রায় অর্ধেক গীতের লেখক হলেন দায়ূদ। কোরহের সন্তানেরা, আসফ, মোশি, শলোমন এবং জ্ঞানী লোক ইষ্রাহীয় এথন ও হেমন গীতের লেখক হিসাবে উল্লিখিত। প্রায় তিন ভাগ গীতে কোনো লেখক উল্লেখ করা হয় নি।
অনেক গীতের উপরের লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে লেখকের নাম, সুর বা বাজনা সম্বন্ধীয় নির্দেশনা, গীতের শ্রেণী-বিভাগ, গীতের আনুষ্ঠানিক ব্যবহার এবং গীতটি কোন ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে লেখা হয়েছিল। সুর বা বাজনা সম্বন্ধীয় নির্দেশনা ও গীতের বিভিন্ন শ্রেণী-বিভাগের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত অনেক শব্দগুলোর অর্থ আমরা আজকে আর বুঝতে পারি না। কিন্তু গীতের লেখক এবং ঐতিহাসিক পরিস্থিতি সম্বন্ধীয় কথা গীতটি বুঝতে সাহায্য করে।
ব্যক্তিগত গীতগুলো একজনের অত্যন্ত ব্যক্তিগত প্রার্থনা হিসাবে লেখা হয়েছে। এই ধরণের গীত পরের শ্রোতাদের বা গীতের পরবর্তী ব্যবহারের বিষয় চিন্তা না করে প্রথম লেখা হয়েছে। গীতসংহিতার একটি ব্যক্তিগত গীত পড়া মানে হল, লেখকের জীবন ও প্রাণের উপর একটি জানালা খুলে দেওয়ার মত অথবা লেখকের গোপন দিনলিপি পড়ার মত। এই ধরণের গীতগুলো হল বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে ঈশ্বরের সঙ্গে লেখকের সম্পর্কের একটি প্রকাশ। তাই এই গীতগুলোতে বিভিন্ন ধরণের আবেগ প্রকাশ পায়: কৃতজ্ঞতা, মনে-প্রাণে প্রশংসা, ভক্তির সঙ্গে আরাধনা, গভীর নির্ভরতা, নিশ্চয়তা, সন্দেহ, গভীর কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা, একাকীত্ব ভাব, প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও হাল ছেড়ে দেওয়ার মত হতাশা। ব্যক্তিগত গীত হল ‘প্রাণ বা অন্তর ঢেলে দেওয়ার’ মত, বাস্তব, সৎ, যেমন তেমন, না ছেঁকে কথা।
বলা যায় যে, গীতগুলো হল ঈশ্বরের প্রতি মানুষের কথা। কিন্তু মানুষের এই কথাগুলো তাহলে কিভাবে ‘বাইবেল’ হয়ে গেল? কিভাবে মানুষের প্রার্থনাগুলো পরিণত হয়েছে ‘ঈশ্বরের অধিকারগত বাক্য’তে? গীতগুলো হল ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তিদের বাস্তব সম্পর্কের সাক্ষ্য। গীতগুলো হল আদর্শ, কিভাবে একজন মানুষ নিজেকে ঈশ্বরের কাছে প্রকাশ করতে পারে, কিভাবে একজন মানুষ তার জীবনের যে কোনো ঘটনা ঈশ্বরের সামনে নিয়ে আসতে পারে, কিভাবে সব কিছু ঈশ্বরের কাছে এনে একজন মানুষ তার পরিস্থিতির জন্য ঈশ্বরের দৃষ্টি লাভ করতে পারে। এই গীতগুলো শ্রোতাদের সাহায্য করে বাস্তবতাকে অস্বীকার না করে বরং বাস্তব বিষয়গুলো ঈশ্বরের সঙ্গে মোকাবেলা করতে। গীতসংহিতা পড়া দ্বারা আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের জীবনে এমন কোনো বিষয় বা পরিস্থিতি নেই, যা আমরা ঈশ্বরের কাছে নিয়ে আসতে পারি না।
গীতসংহিতায় সবচেয়ে কঠিন ও সবচেয়ে আবেগপূর্ণ গীতগুলো হল বিলাপের গীত ও শত্রুদের বা অত্যাচারীদের উপরে অমঙ্গল চাওয়ার গীত (imprecatory psalms)। এই ধরণের গীত আমরা সম্ভবত পছন্দ করি না বা ভয়ংকর মনে করি। এমন কি, আমরা হয়তো এই ধরণের গীত নিয়ে আপত্তি উঠাই যে, এমন গীত ঈশ্বরের বাক্যের মধ্যে না থাকা ভাল। কিন্তু এই গীতগুলো হল বাস্তব লোকদের দ্বারা লিখিত গীত, যারা নিজেকে অত্যন্ত কঠিন অবস্থায় খুঁজে পায় (তাদের বিরুদ্ধে অত্যাচার, অন্যায়, বিশ্বাসঘাতকতা, জীবনের হুমকি চলে)। তারা এই গীতে প্রকাশিত প্রার্থনার মধ্য দিয়ে ঘৃণা বা নিজের হাতে প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে বের হয়ে আসে এবং তা ঈশ্বরের বিচারের উপর ছেড়ে দেয়।
জাতিগত গীতগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন ধরণের বিষয় প্রকাশ পায়, জয় বা আশীর্বাদের জন্য কৃতজ্ঞতা, ইস্রায়েলের ঈশ্বরের জন্য আরাধনা, দেশ ও রাজার জন্য বিনতি, জাতিগত ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণ বা জাতির ব্যর্থতা ও পরাজয়ের জন্য বিলাপ।
চিন্তার চেয়ে বেশি গীতে মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়া যায়, প্রায় গীতসংগিতার পাঁচ ভাগ গীত মশীহ সম্বন্ধীয় গীত। পবিত্র আত্মা দিয়ে পরিচালিত মানুষের কথার মধ্যে সত্যিকারের ভবিষ্যদ্বাবাণী পাওয়া যায়। নতুন নিয়মে অন্য পুস্তকের চেয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে গীতসংহিতা পুস্তক থেকে।
ব্যক্তিগত বা জাতিগত গীত হোক, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যিহূদীরা ও খ্রিষ্টানরা গীতগুলো তাদের ব্যক্তিগত প্রার্থনা ও আরাধনায় ব্যবহার করে আসছে এবং গীতসংহিতা হল সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সবচেয়ে বেশি পড়া পুস্তকগুলোর মধ্যে একটি।
গীতসংহাতে পুস্তক হল একক গীতের একটি সংগ্রহ বলে আরো বিস্তারিত অধ্যয়ন করতে গেলে একটি করে গীত নিয়ে তা করতে হয়। নিচে ৪টি গীতের অধ্যয়ন দেওয়া হয়েছে: গীত ১৯ (প্রশংসা, ধ্যান, চেতনা), গীত ৩২ (ব্যক্তিগত সাক্ষ্য ও ধন্যবাদ), গীত ১ (প্রজ্ঞার গীত) এবং গীত ৭০ (অমঙ্গল চাওয়ার গীত)।
গীত ১৯
গান পরিচালকের সংকলনের জন্য। দায়ূদের গান।
1″মহাকাশ ঈশ্বরের মহিমা ঘোষণা করছে, আর আকাশ তুলে ধরছে তাঁর হাতের কাজ।
2দিনের পর দিন তাদের ভিতর থেকে বাণী বেরিয়ে আসে, আর রাতের পর রাত তারা ঘোষণা করে জ্ঞান।
3কিন্তু তাতে কোন শব্দ নেই, কোন ভাষা নেই, তাদের স্বরও কানে শোনা যায় না;
4তবুও তাদের ডাক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে; তাদের কথা ছড়িয়ে পড়ছে জগতের শেষ সীমা পর্যন্ত।
মহাকাশে সূর্যের জন্য তিনি একটা তাম্বু খাটিয়েছেন; 5সে বরের মত করে বাসর-ঘর থেকে বেরিয়ে আসে,
নির্দিষ্ট পথে দৌড়াবে বলে খেলোয়াড়-বীরের মত খুশী হয়ে ওঠে;
6সে আকাশের এক দিক থেকে ওঠে আর ঘুরে অন্য দিকে যায়; তার তাপ থেকে কিছুই রেহাই পায় না।
7সদাপ্রভুর নির্দেশে কোন খুঁত নেই, তা মানুষকে জাগিয়ে তোলে।
সদাপ্রভুর বাক্য নির্ভরযোগ্য, তা সরলমনা লোককে জ্ঞান দেয়।
8সদাপ্রভুর সমস্ত নিয়ম সোজা পথে চালায় আর অন্তরে দেয় আনন্দ।
সদাপ্রভুর আদেশ খাঁটি, তা অন্তরকে সতেজ করে।
9সদাপ্রভুর প্রতি যে ভক্তিপূর্ণ ভয়, তা শুচিতায় ভরা আর চিরকাল স্থায়ী।
সদাপ্রভুর আইন-কানুন সত্য, তাতে অন্যায় কিছু নেই।
10তা সোনার চেয়ে, প্রচুর খাঁটি সোনার চেয়েও বেশী কামনা করার মত জিনিস।
তা মধুর চেয়ে মিষ্টি, মৌচাকের ঝরা মধুর চেয়েও মিষ্টি।
11তা তোমার দাসকে সাবধান করে, আর তা পালন করলে মহালাভ হয়।
12নিজের ভুল কে বোঝে? আমার অজানা দোষ তুমি ক্ষমা কর।
13জেনে-শুনে অহংকারের বশে করা পাপ থেকে তোমার দাসকে তুমি দূরে রাখ;
তা যেন আমার উপর রাজত্ব না করে। তাহলেই আমি নিখুঁত হতে পারব,
মুক্ত থাকব ঈশ্বরের প্রতি ভীষণ বিদ্রোহের দায় থেকে।
14হে সদাপ্রভু, আমার আশ্রয়-পাহাড়, আমার মুক্তিদাতা,
আমার মুখের কথা ও আমার অন্তরের চিন্তা তোমাকে যেন খুশী করে।”
গীত ১৯-এর ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
গীতটির লেখক হলেন দায়ূদ। গীতসংহিতার প্রায় অর্ধেক গীতের উপরে লেখায় দায়ূদ লেখক হিসাবে উল্লিখিত এবং আর অল্প কিছু গীতের উপরে লেখায় দায়ূদকে লেখক হিসাবে উল্লিখিত করা হয় নি কিন্তু অন্য পুস্তকে গীতটি উদ্ধৃতি করার সময় তা দায়ূদের গীত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।গীতটির উপরে লেখায় ঐতিহাসিক পরিস্থিতির কোনো উল্লেখ নেই। গীতটি দায়ূদের একটি ব্যক্তিগত ধ্যান বা প্রার্থনা কিন্তু পরবর্তীতে গীতটি “প্রথম খণ্ডে” (গীত ১:১ পদের আগে দেখুন) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং একটি নির্দেশনা “গান পরিচালকের সংকলনের জন্য” যোগ দেওয়া হয়েছে।
গীতসংহিতার “প্রথম খণ্ড”, অর্থাৎ গীত ১ থেকে গীত ৪১ পর্যন্ত, এই সংগ্রহের মধ্যে অধিকাংশ গীত হল দায়ূদের ব্যক্তিগত গীত। ধারণা করা হয় যে দায়ূদ নিজেই হলেন এই খণ্ডের সংগ্রহকারী বা প্রকাশক। তাই প্রথম খণ্ড প্রায় ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বে প্রকাশিত করা হয়েছে।
গীত ১৯-এর প্রথম অংশ গীত ১৯:১-১০
এই পদগুলোতে দায়ূদ আকাশের বিশালতা ও মহত্ব নিয়ে ধ্যান করেন, উভয় দিনের বেলায় ও রাতের বেলায় (গীত ১৯:২)। সম্ভবত তিনি রাতের বেলায় হাজার হাজার তারা দেখে মহাবিশ্বের বিশালতার সামনে উবুড় হন (গীত ১৯:১-৪) এবং তিনি দিনের বেলায় তিনি সূর্যের শক্তি লক্ষ্য করে তার ভূমিকা নিয়ে চিন্তা করেন (গীত ১৯:৪খ-৬)।
দায়ূদ এই বস্তু জগতকে ঈশ্বরের সৃষ্টি হাসাবে মনোযোগ ও গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। সৃষ্টি ঈশ্বরেরই হাতের কাজ, তাঁর কারণে এই বস্তু জগতের অস্থিতত্ব আছে, এই পৃথিবীকে ঈশ্বর জীবন ও দম দিতে থাকেন। তাই এই সৃষ্টি নিয়ে ধ্যান করাই উপযুক্ত। সৃষ্টির সামনে ভক্তিপূর্ণ ভয়ে উবুড় হওয়াই উপযুক্ত, তার সৃষ্টিকর্তাকে আরাধনা করা আরো উপযুক্ত।
আকাশের কানো শোনার মত কোনো স্বর নেই “কিন্তু তাতে কোন শব্দ নেই, কোন ভাষা নেই, তাদের স্বরও কানে শোনা যায় না … তাতে কোন শব্দ নেই, কোন ভাষা নেই, তাদের স্বরও কানে শোনা যায় না”, কিন্তু “তবুও তাদের ডাক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে; তাদের কথা ছড়িয়ে পড়ছে জগতের শেষ সীমা পর্যন্ত” (গীত ১৯:৩-৪)। উভয় সত্য তিনি পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেন।
সৃষ্টি সম্বন্ধে খুব পরিষ্কারভাবে এবং জোরের সঙ্গে তার সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধে অনেক কিছু প্রকাশ করে। সৃষ্টি “মহাকাশ ঈশ্বরের মহিমা ঘোষণা করছে” এবং “তুলে ধরছে তাঁর হাতের কাজ” (গীত ১৯:১)।
সৃষ্টির এই ডাক, কথা বা সাক্ষ্য “জগতের শেষ সীমা প্রযন্ত” পৌঁছায় (গীত ১৯:৪), অর্থাৎ যে কোনো যুগেসব জাতির মানুষ সৃষ্টি দেখে ঈশ্বর সম্বন্ধে কিছু না কিছুটা বোঝে (রোমীয় ১:২০)।
দায়ূদের কথায় বুঝা যায় যে তিনি ‘সৃষ্টির রব’ শুনে তার সংবাদ বোঝেন: আকাশের বিশলতা, বিস্ময়করতা ও মহত্ব দেখে তিনি সৃষ্টির পিছনে দেখতে পান সৃষ্টিকর্তার মহত্ব, অর্থাৎ সৃষ্টি “ঈশ্বরের মহিমা” ঠিকই ঘোষণা করছে। সৃষ্টি কত সুন্দর, কত শক্তিশালী, কত চমৎকার – তাহলে সৃষ্টিকর্তা আরো অনেক সুন্দর, শক্তিশালী ও চমৎকার।
তিনি সূর্য একজন “বরের” সাথে তুলনা করেন, যিনি তার “বাসর-ঘর থেকে বেরিয়ে আসে” এবং “নির্দিষ্ট পথে দৌড়াবে বলে খেলোয়াড়-বীরের মত খুশী হয়ে ওঠে” (গীত ১৯:৪-৫)। বর শব্দটি রূপকভাবে বুঝায় যে সূর্য হল সেই ‘প্রধান নায়ক’, সেই ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’, শক্তিশালী, সুন্দর, আকর্ষণীয়, সবার চোখের সামনে যাকে উৎযাপন করা হয়, যিনি তার ভূমিকা চমৎকারভাবে পালন করেন – সূর্যের জন্য একটি আনন্দপূর্ণ ও উপযুক্ত বর্ণনা (গীত ১৯:৬)।
গীত ১৯-এর দ্বিতীয় অংশ গীত ১৯:৭-১১
হঠাৎ করে গীতটি মোড় নেয় এবং দায়ূদ সৃষ্টির বিবেচনা শেষ করে করে বরং ঈশ্বরের “নির্দেশ”, “নিয়ম”, “আদেশ”, “আইন-কানুন” বা “বাক্য” নিয়ে ধ্যান করতে শুরু করেন (গীত ১৯:৭-১১)। ঈশ্বরের “নির্দেশ”, “নিয়ম”, “আদেশ”, “আইন-কানুন” বা “বাক্য” এসব শব্দগুলো একই বিষয় বুঝায়।
দায়ূদ তা নিয়ে ধ্যান করে তার বর্ণনা এভাবে দেন: “সদাপ্রভুর নির্দেশে কোন খুঁত নেই, তা নির্ভরযোগ্য, খাঁটি, শুচিতায় ভরা, চিরকাল স্থায়ী, সত্য, তাতে অন্যায় নেই” এবং তা “মানুষকে জাগিয়ে তোলে, জ্ঞান দেয়, অন্তরে আনন্দ দেয় ও অন্তরকে সতেজ করে তোলে”। তা হল “খাঁটি সোনার চেয়েও বেশী কামনা করার মত জিনিস … মধুর চেয়ে মিষ্টি” (গীত ১৯:১০)। তা মানুষদের সাবধান করে। তা পালন করতে মহালাভ আছে।
ঈশ্বরের আদেশের এই চমৎকার বর্ণনা ঠিক কি নিয়ে? প্রকৃতপক্ষে দায়ূদের হাতে ঈশ্বরের বাক্য বলতে মানে আদিপুস্তক থেকে শমূয়েল পুস্তক পর্যন্ত, বাইবেলের অন্যান্য পুস্তক এখনও লেখা হয় নি। প্রাথমিকভাবে দায়ূদ এখানে মোশির আইন-কানুন নিয়ে কথা বলেন।
আমরা কি মোশির আইন-কানুনকে নিখুঁত, আনন্দদায়ক, আকর্ষণীয় ও মিষ্টি মনে করি? আসলে আধুনিক যুগের মানুষ হিসাবে আমরা মোশির আইন-কানুন নিয়ে একদম আকৃষ্ট না, আমরা শুধুমাত্র খুশি যে আমরা ‘আইনের অধীনের আর নই’।
চিন্তা করুন মোশির আইন-কানুন নিয়ে দায়ূদের দৃষ্টি কত উঁচু! হয়তো আমরা এখানে কিছু মিশ করছি? হয়তো অনেক কিছু আমরা আর বুঝি না?
যেমন দায়ূদ সৃষ্টিকে ঈশ্বরের আকর্ষণীয় ও চমৎকার হাতের কাজ হিসাবে বুঝেছেন, তিনি ঠিক তেমনি তাঁর আইন-কানুন আকর্ষণীয় ও চমৎকার কিছু হিসাবে বোঝেন। ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টির মধ্যে প্রকাশিত। ঈশ্বর তাঁর আইন-কানুনে ঠিক তোমনি প্রকাশিত।
ঈশ্বরের আইন-কানুন ঈশ্বর সম্বন্ধে ঠিক কি প্রকাশ করে? আইন-কানুন হল ঈশ্বরের ইচ্ছার একটি প্রকাশ (ঈশ্বর কি চান? ঈশ্বর কি চান না?), অর্থাৎ ভাল-মন্দের একটি প্রকাশ (কি করা ভাল? কি করা ভাল না? কি উচিত? কি উচিত নয়?)।
আরো ভিত্তিকভাবে আইন-কানুন হল ঈশ্বরের চরিত্রের একটি প্রকাশ। ঈশ্বর ন্যায্য ব্যবহার কেন চান? কারণ তিনি ন্যায্য। কেন জীবন নষ্ট করা নিষেধ? কারণ তিনি জীবনদাতা। কেন গরীবদের অধিকার সুরক্ষা করা দরকার? কারণ ঈশ্বর দয়ালু, কারণ তাঁর প্রতিমূর্তিতে মানুষই মূল্যবান।
আইন-কানুন আমাদের ঈশ্বরের প্রজ্ঞা, নীতি ও মূল্যবোধ শেখায়। আইন-কানুন আমাদের বুঝায় আমাদেরকে কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া দরকার। আইন-কানুন দ্বারা মানুষের মূল্য, অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষিত।
মোশির পঞ্চপুস্তক হল বাইবেলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি। ঈশ্বর কে? আমরা কে? এ জগত কি? প্রতিবেশী কে? মন্দ কোথা থেকে আসল? মন্দতার শক্তির সীমানা? আমাদের করণীয় কি? সত্য বলতে কিছু আছে? আমাদের উদ্দেশ্য কি? এই সব প্রশ্নের উত্তর পঞ্চপুস্তক থেকে আসে। মোশির পঞ্চপুস্তকে দ্বারা আমরা জানি মানুষের সমস্যা কি, এই জগত কেন দেখতে এমন এবং এই সমস্যা সমাধান করার জন্য ঈশ্বর কি করবেন।
আইন-কানুন হল অন্তর সতেজ করার মত, নির্ভরযোগ্য, আনন্দদায়ক ও স্থায়ী। আইন আমাদের মঙ্গল করে। আইন পালন করলে মহালাভ আছে।
গীত ১৯-এর তৃতীয় অংশ গীত ১৯:১২-১৪
গীতের তৃতীয় অংশের শুরুতে দায়ূদ নিজেকে একটি প্রশ্ন করে “নিজের ভুল কে বোঝে?” (গীত ১৯:১২)। ঈশ্বরের খাঁটি আইন-কানুন নিয়ে ধ্যান করতে করতে দায়ূদ নিজের অযোগ্যতা নিয়ে চেতনা পান। তিনি প্রার্থনা করেন “জেনে-শুনে অহংকারের বশে করা পাপ থেকে তোমার দাসকে তুমি দূরে রাখ”। এই কথার মধ্য দিয়ে বুঝা যায় যে দায়ূদ অনেক আগে তার পাপের জন্য ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন – আইন-কানুনে প্রকাশিত ঈশ্বরের চমৎকার ন্যায্যতা ও তাঁর খাঁটি আইনের সামনে তিনি চেতনা পান যে তার মধ্যে হয়তো আরো অনেক ভুল চিন্তা, মনোভাব ও আচরণ আছে।
দায়ূদ চেতনা পান, তিনি নিজের অবস্থা ও বিপদ আরো বেশি বুঝতে পারেন। তিনি নত হয়ে আবারও ঈশ্বরের ক্ষমা চান, এমন বিষয় নিয়ে যাতে তার চেতনা এখনও কথা বলে নি। তিনি নিশ্চিত করতে চান যেন তিনি কোনো মতে ‘বিদ্রোহের পথে’ পা না দেন।
দায়ূদ ভালভাবে বোঝেন, নিজের ভূমিকা কি: নত হওয়া, পাপ স্বীকার করা, খাঁটি অবস্থা বা শুচিততা আকাঙ্ক্ষার বিষয় হিসাবে ধরা, ঈশ্বরের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া। কিন্তু তিনি একই ভালভাবে জানেন, যে মানুষের প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ দ্বারা এসব অর্জন করা যায় না, তা শুধুমাত্র ঈশ্বরের দয়া দ্বারা সম্ভব হয়।
তিনি ঈশ্বরকে তার “আশ্রয়-পাহাড়” ও “মুক্তিদাতা” হিসাবে স্বীকার করেন (গীত ১৯:১৪ক), সেই ঈশ্বর যিনি তাকে ধরে রাখতে ও উদ্ধার করতে সক্ষম। তিনি গীতটি একটি নম্র অনুরোধ নিয়ে সমাপ্ত করেন “আমার মুখের কথা ও আমার অন্তরের চিন্তা তোমাকে যেন খুশী করে” (গীত ১৯:১৪খ)।
গীত ১৯-এর মধ্য ক্রমবৃদ্ধি
প্রথম দৃষ্টিতে গীতটির ৩টি অংশ বেশ ভিন্ন লাগে এবং ৩টি অংশের মধ্যে সম্পর্কও চোখে পড়ার মত নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গীতের ৩টি অংশের মধ্যে শক্তিশালী একটি সংযোগ এবং ধারাবাহিকতা আছে:
দায়ূদ সৃষ্টি নিয়ে ধ্যান করেন, রাতেরবেলায় মহাবিশ্বরের তারার বিশালতা এবং দিনের বেলায় সূর্যের মহিমা ও শক্তি। তিনি সৃষ্টির সৌন্দর্য ও মহত্ব দেখে অবাক হন, এবং আরো বেশি সৃষ্টির পিছনে সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতা ও বিশালতা।
কিন্তু সেই চমৎকার ও ক্ষমতাশালী ঈশ্বর মাত্র দূরের বা পূর্বের সৃষ্টিকর্তা নন, তিনি নিজেকে এই পৃথিবীর মানুষদের কাছে তার আইন-কানুন দিয়ে প্রকাশিত করেছেন, অর্থাৎ মানুষের জীবনের উপর তাঁর দাবি আছে। তাঁর সেই দাবি, অর্থাৎ তাঁর আইন অত্যন্ত ন্যায্য ও খাঁটি, কিন্তু তার মধ্য দিয়ে এই বিষয়ও প্রমাণ পায়, মানুষ হিসাবে আমাদের আচার-আচরণ ঈশ্বরের মানদণ্ড থেকে কত দূরে।
দায়ূদ আইন-কানুনকে ভালবাসেন, ঈশ্বরের চমৎকার চরিত্রের প্রকাশ হিসাবে হিসাবে আইন-কানুনের গুরুত্ব, মহত্ব ও স্থায়িত্ব স্বীকার করেন। ঈশ্বরের আইন সম্পূর্ণ ভাল, মঙ্গল ও উপকারী – আমরা যদি তা আসলে পালন করতাম।
সৃষ্টির পিছনে সেই বিশাল ঈশ্বরের চরিত্র হল ন্যায্য ও খাঁটি আইনের ভিত্তি, সেই ঈশ্বরের সামনে দায়ূদ নিজের অযোগ্যতা স্বীকার করেন, এবং তাই তো।
যতবার আমরা সৃষ্টি দ্বারা হোক বা ঈশ্বরের বাক্য দ্বারা হোক, যত বার আমরা ঈশ্বরের প্রকাশ পাই, ততবার আমরা নত হয়ে আমাদের অযোগ্যতা ও অসহায় অবস্থা নিয়েও প্রকাশ পাই।
তাই এই বিশাল ও ন্যয্য ঈশ্বরের কাছেই দায়ূদ নিজেকে নত করেন এবং নম্রভাবে তাঁর দয়া চান – আর কেউ নেই যার কাছে বিনতি করা যেত।
পুনঃসংস্কারের নেতারা সৃষ্টিকে ‘ঈশ্বরের প্রথম পুস্তক বলতেন, তারা বাইবেলকে ‘ঈশ্বরের দ্বিতীয় পুস্তক বলতেন এবং পবিত্র আত্মার পরিচালনায় মানুষের বিবেক ‘ঈশ্বরের তৃতীয় বই বলতেন’ (?)। এই তিনটি পুস্তকের মধ্য দিয়েই ঈশ্বর সত্যকে (‘Veritas’) প্রকাশিত করেন। এই চিন্তা হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকার ক্রেষ্টে দেখা যায়। এটা দ্বারা বুঝা যায়, পুনঃসংস্কারের নেতারা বস্তু জগত ও বিজ্ঞান কত সুদৃষ্টিতে দেখতেন।
গীত ৩২
দায়ূদের মস্কীল-গান।
1ধন্য সেই লোক, যার ঈশ্বরের প্রতি বিদ্রোহ ক্ষমা করা হয়েছে, যার পাপ ঢাকা দেওয়া হয়েছে।
2ধন্য সেই লোক, যার অন্যায় সদাপ্রভু ক্ষমা করেছেন আর যার অন্তরে কোন ছলনা নেই।
3আমি যখন পাপ স্বীকার করি নি তখন সারা দিন কোঁকাতে কোঁকাতে আমার হাড় ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল;
4কারণ তখন দিনরাত আমার উপরে তোমার হাতের চাপ ভারী ছিল;
গরমকালের গরমে যেমন হয় তেমনি করে আমার দেহের শক্তি কমে যাচ্ছিল। [সেলা]
5তখন আমার পাপ আমি তোমার কাছে স্বীকার করলাম, আমার অন্যায় আমি আর ঢেকে রাখলাম না।
আমি বলেছিলাম, “আমার বিদ্রোহের কথা আমি সদাপ্রভুর কাছে স্বীকার করব।”
তাই পাপের দরুন আমার দোষ তুমি ক্ষমা করে দিলে। [সেলা]
6কাজেই যতদিন সুযোগ আছে ততদিন তোমার ভক্তেরা তোমার কাছে প্রার্থনা করুক;
সত্যিই, বিপদ যখন বন্যার জলের মত হয়ে দেখা দেবে তখন তা তাদের কাছে আসবে না।
7তুমিই আমার লুকিয়ে থাকার জায়গা। তুমি আমাকে কষ্টের হাত থেকে রক্ষা করছ।
মুক্তির আনন্দ-গানে তুমিই আমাকে ঘিরে রাখছ। [সেলা]
8আমি সদাপ্রভু তোমাকে জ্ঞান দেব আর যে পথে যেতে হবে তা দেখিয়ে দেব;
তোমাকে চোখে চোখে রেখে আমি নির্দেশ দেব।
9তোমরা ঘোড়া বা গাধার মত হোয়ো না যাদের বুঝবার শক্তি নেই;
মুখে লাগাম ও দড়ি দিয়ে তাদের বশে রাখতে হয়,
তা না দিলে তারা তোমাদের কাছে আসবে না।
10দুষ্টকে অনেক যন্ত্রণা পেতে হয়, কিন্তু যে সদাপ্রভুর উপর নির্ভর করে
সদাপ্রভুর অটল ভালবাসা তাকে ঘিরে রাখে।
11হে ঈশ্বরভক্ত লোকেরা, সদাপ্রভুই যেন তোমাদের আনন্দের বিষয় হন,
তাঁকে নিয়েই তোমরা খুশী হও;
তোমরা যারা অন্তরে খাঁটি, তোমরা সকলে আনন্দ-গান কর।
গীত ৩২ এর ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
গীতটির লেখক হলেন দায়ূদ। গীতসংহিতা পুস্তকের প্রায় অর্ধেক গীতের উপরে লেখায় দায়ূদ লেখক হিসাবে উল্লিখিত এবং আর অল্প কিছু গীতের উপরে লেখায় দায়ূদকে লেখক হিসাবে উল্লিখিত করা হয় নি কিন্তু অন্য পুস্তকে গীতটি উদ্ধৃতি করার সময় তা দায়ূদের গীত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গীতটির উপরে লেখায় ঐতিহাসিক পরিস্থিতির কোনো উল্লেখ নেই। “মস্কিল-গান” হল গীতের উপরে লেখায় এমন একটি শব্দ, যার অর্থ আর জানা যায় না। হয়তো শব্দটি গীতের ধরণ, কাঠামো বা তার ব্যবহার সম্বন্ধীয় একটি বর্ণনা। অথবা তা বাদ্যযন্ত্র সম্বন্ধীয় কোনো কথা। গীতসংহিতার ১২টি গীতকে “মস্কিল-গান” বলা হয়: গীত ৩২, ৪২, ৪৪, ৪৫, ৫২-৫৫, ৭৪, ৭৮, ৮৮, ৮৯।
গীত ৩২ হল প্রথম খণ্ডের একটি গীত (গীত ১-৪১), যার মধ্যে বেশিরভাগ গীত হয় দায়ূদের ব্যক্তিগত গীত। ধারণা করা হয় যে দায়ূদ নিজেই প্রথম খণ্ডের সংগ্রহকারী ও প্রকাশক। তাই তার তারিখ ধরা হয় প্রায় ১০০০ খ্রীষ্টপূর্ব।
গীতটি সম্বন্ধে কিছু লক্ষ্য
গীতের শুরুতে দু’বার বলা হয় “ধন্য সেই লোক যার …” (গীত ৩২:১-২)। এই ধরণের কথা প্রজ্ঞার সাহিত্যে বেশ প্রচলিত এবং ব্যবহার করা হয় দেখানোর জন্য ঈশ্বর কি ধরণের মনোভাব ও আচরণ ঈশ্বরের অনুমোদন ও পুরষ্কার পায়। যীশু এই কথার ধরণ ব্যবহার করেন যখন তিনি পাড়ারে তাঁর সেই বিখ্যাত শিক্ষা দেন (মথি ৫:১-১২)।
কে ধন্য? “যার ঈশ্বরের প্রতি বিদ্রোহ ক্ষমা করা হয়েছে, যার পাপ ঢাকা দেওয়া হয়েছে … যার অন্যায় সদাপ্রভু ক্ষমা করেছেন আর যার অন্তরে কোন ছলনা নেই” (গীত ১:১-২)।
যদিও কথাটি প্রজ্ঞার সাহিত্যের মত, তা বিপদ কেটে গেছে বলে দায়ূদের একটি দীর্ঘশ্বাস। দায়ূদ এখান তার ভাল ব্যবহার দিয়ে গর্ব করেন না, বরং তিনি অযোগ্য হলেও ক্ষমা পেয়েছেন বলে তার জন্য তার কৃতজ্ঞতা ও স্বস্থিরতা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন না ‘ধন্য যারা পাপ করে না’ (যদিও তা সত্য), তিনি বরং বলেন ‘ধন্য যারা ক্ষমা পেয়েছে’।
এই কথার মধ্য দিয়ে দায়ূদ তার অযোগ্যতা ও দোষ খোলাভাবে প্রকাশ করেন: তিনি পাপ করেছেন, তিনি দোষী। “পাপ ঢাকা দেওয়া” মানে তিনি আসলে পাপ করেছেন, যার জন্য ক্ষমা প্রয়োজন।
কেন তাকে পাপ ক্ষমা করা হয়েছে? পরবর্তী পদে তা প্রকাশ পায়:
গীত ৩২-এ ক্রমবৃদ্ধি
প্রকৃপক্ষে গীতে একটি ক্রমবৃদ্ধি দেখা যায়:
- ১-২ পদ ক্ষমা পেয়েছেন বলে দায়ূদের দীর্ঘশ্বাস।
- ৩-৪ পদ দায়ূদ বর্ণনা করেন পাপ স্বীকার করার আগে তার কেমন লেগেছিল।
- ৫ পদ দায়ূদ সেই মুহূর্ত বর্ণনা করেন যখন তিনি অবশেষে পাপ স্বীকার করেছিলেন এবং ক্ষমা পেয়েছিলেন
- ৬-৭ পদ তিনি উদ্ধারকর্তা ঈশ্বরকে বর্ণনা করেন।
- ৮-৯ পদ তিনি অন্যদেরকে উৎসাহিত করেন যেন তারা দেরী না করে বরং সাথে সাথে ঈশ্বরের কাছে আসে।
- ১০ পদ তিনি ঈশ্বরের বিশ্বস্ততা ঘোষণা করেন
- ১০-১১ পদ তিনি পাঠকদের কৃতজ্ঞ হতে, আনন্দ করতে ও অন্তর থেকে খাঁটি হতে উৎসাহিত করেন।
গীত ৩২:৩-৪
তিনি ৩ পদের শুরুতে বলেন “আমি যখন পাপ স্বীকার করি নি …” যার সাথে যুক্ত আছে ৫ পদে “তখন আমার পাপ আমি তোমার কাছে স্বীকার করলাম”।
বুঝা যায় যে ৩ ও ৪ পদ হল তার পাপ স্বীকার না করার অবস্থা: “সারা দিন কোঁকাতে কোঁকাতে আমার হাড় ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিলতখন দিনরাত আমার উপরে তোমার হাতের চাপ ভারী ছিল; গরমকালের গরমে যেমন হয় তেমনি করে আমার দেহের শক্তি কমে যাচ্ছিল।” দায়ূদ এখানে দেখান যে মনে ও আবেগে তার সেই দ্বন্দ্ব এমন কি তার শারীরিক অবস্থার উপর শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিল।
অনেক কষ্ট লাগলেও “আমার উপরে তোমার হাতের চাপ ভারী ছিল”, দায়ূদ এখন এই খারাপ অবস্থা ঈশ্বরের একটি দয়া হিসাবে দেখেন। সম্ভবত ‘ঈশ্বরের হাতের চাপ’ এখানে চেতনার কামড় বুঝায় যার ফলে তার অশান্তি, অস্থির ও লজ্জা লাগে ও তার ঘুম নষ্ট হয়। তার অবস্থা এমন হয়ে যায় যে তিনি বিষয়টি অস্বীকার আর করতে পারেন না।
গীত ৩২:৫
অবশেষে তার অবস্থা এমন যে তিনি যা করা প্রয়োজন তা করতে রাজি হয়: তিনি ঈশ্বরের কাছে ফিরে আসে ও তার পাপ স্বীকার করেন: “তখন আমার পাপ আমি তোমার কাছে স্বীকার করলাম, আমার অন্যায় আমি আর ঢেকে রাখলাম না। আমি বলেছিলাম, “আমার বিদ্রোহের কথা আমি সদাপ্রভুর কাছে স্বীকার করব।” তাই পাপের দরুন আমার দোষ তুমি ক্ষমা করে দিলে। [সেলা]
তিনি বলেন যে তার ‘এগিয়ে আসা’, ‘মুখে পাপ স্বীকার করা’ এবং তার অন্যায় আর না ঢেকে রাখা’ প্রয়োজন ছিল। মনে মনে চিন্তা করা যে ‘ঈশ্বর তো আমার পাপ যে কোনভাবে জানি তাই স্বীকার করার লাভ কি?’ এটা যথেষ্ট নয়। দায়ূদ বুঝতে পারেন যে তার চেয়ে এগিয়ে আসা দরকার। কেন এগিয়ে আসা দরকার?
এগিয়ে এসে মুখ দিয়ে পাপ স্বীকার করা হল নম্রতার একটি কাজ, নিজের লজ্জা গ্রহণ করার একটি কাজ। পাপকে ‘পাপ’ বলা দরকার, আমার নিজের আচরণের জন্য সম্পূর্ণ করা দরকার: ‘আমি ভুল করেছি’। তা ঈশ্বরের কাছে (এবং ভাল হয় একজন মানুষের কাছেও) বলা প্রয়োজান।
‘খারাপ লাগে’, ‘লজ্জা লাগে’ বা খারাপ অবস্থা পড়লাম বলে ‘আফসোস করা’ বা ‘বেচারা ভাব’, তা অনুতাপ নয়। এমন কি পাপ স্বীকার করা এবং আসলে দায়িত্ব নেওয়া একই নয়। হয়তো আমি স্বীকার করি যে ‘এটা করেছি’ কিন্তু আমি এখনও অন্যদেরকে, পরিস্থিতিকে বা ঈশ্বরকে দোষারোপ করি। অনুতপ্ত হওয়া মানে আমার আচরণের জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়িত্ব নেওয়া: ‘আমি এটা করেছি। তা করা ঠিক হয় নি। আমি তা জানতাম কিন্তু তারপরেও তা করলাম। অন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব ছিল, আমাকে অন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল।’
এভাবে নিজের লজ্জা গ্রহণ করা ও নম্র হওয়া হল একদম কঠিন এবং আমরা তার এড়িয়ে যাওয়া অত্যন্ত চেষ্টা করি। দায়ূদ এই পদে দেখান যে পাপ ক্ষমার দেরী হয় না ঈশ্বরের কারণে, বরং আমাদের কারণে। ঈশ্বর ইচ্ছুক ও প্রস্তুত আছেন আমাদের পাপ ক্ষমা করতে এবং আমাদের দোষ ও লজ্জা সরিয়ে দিতে।
এটি গুরুত্বপূর্ণ: ক্ষমার কোন অভাব বা সীমানা নেই। ঈশ্বর তাঁর পক্ষ থেকে যে কোনো মুহূর্তে আমাদের পাপ ক্ষমা করতে প্রস্তুত – যদি আমরা অনুতপ্ত হয়। সমস্যা হল আমাদেরই অহংকার ও অনিচ্ছুক মনোভাব। যদি পাপের ক্ষমা না পাই, তা হল আমাদেরই দোষ।
গীত ৩২:৬-৭
ঈশ্বর ক্ষমা করেছেন, লেখকের প্রার্থনার উত্তর দিয়ে তাকে রক্ষা করেছেন এর সাক্ষ্য দিয়ে লেখক এখন ঈশ্বরের ভক্তদেরকে উৎসাহিত করেন: “তুমিই আমার লুকিয়ে থাকার জায়গা। তুমি আমাকে কষ্টের হাত থেকে রক্ষা করছ। মুক্তির আনন্দ-গানে তুমিই আমাকে ঘিরে রাখছ।” এখানে “কষ্টের হাত” কি বুঝায়?
হয়তো তা ঠিক সেই পাপ, চেতনা, মনের দ্বন্দ্ব, অশান্তি ও লজ্জা বুঝায় যা থেকে দায়ূদ পাপ স্বীকার দ্বারা মুক্ত হয়েছে। হয়তো তা ঈশ্বর থেকে বিছিন্ন হওয়ার সেই অবস্থা বুঝায়, যা থেকে তিনি এখন উঠতে আসতে পেরেছে। হয়তো “কষ্টের হাত” একটি নির্দিষ্ট কঠিন অবস্থা বা বিপদ বুঝায় যা থেকে তিনি এখন রক্ষা পেয়েছে। যে পাপ তিনি স্বীকার করতে দেরি করেছেন, সম্ভবনা আছে যে তা ছিল কোনো অত্যাচার বা আক্রমণের কারণে রাগ, ক্ষোভ বা প্রতিশেধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
গীত ৩২:৮-৯
দায়ূদ এখন বিষয়টি ঈশ্বরের পক্ষ থেকে দেখেন এবং তিনি এই দু’টি পদে ঈশ্বরের পক্ষ হয়ে বলেন। প্রথম তিনি ঈশ্বরের একটি প্রতিজ্ঞা প্রকাশ করেন “আমি সদাপ্রভু তোমাকে জ্ঞান দেব আর যে পথে যেতে হবে তা দেখিয়ে দেব; তোমাকে চোখে চোখে রেখে আমি নির্দেশ দেব”। পরে তিনি ঈশ্বরের পক্ষ হয়ে চ্যালেঞ্জ করেন: “তোমরা ঘোড়া বা গাধার মত হোয়ো না যাদের বুঝবার শক্তি নেই; মুখে লাগাম ও দড়ি দিয়ে তাদের বশে রাখতে হয়, তা না দিলে তারা তোমাদের কাছে আসবে না।”
কথাটি অবশ্যই গীতের প্রথম অংশের সাথে সম্পর্কিত। ঈশ্বর তাঁর দয়ায় অবশ্যই ক্ষমা করেন কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য হল যে মানুষ তাঁর পথ শিখবে, তাঁর ইচ্ছা ও চরিত্র বুঝবে এবং তা অনুসারে জীবন-যাপন করবে। ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা এই যে তিনি অবশ্যই আমাদের জ্ঞান, শিক্ষা, নির্দেশ ও পরিচালনা দান করবেন।
ঘোড়া ও গাধার নেতিবাচক উদাহরণ একই বিষয় বুঝায়: ঈশ্বর চান যেন আমরা জেদ ত্যাগ করে তাঁর বিরুদ্ধে না যায়, যেন আমরা তার চেতনার রব অগ্রাহ্য না করি, এমন একজন যাকে জোর করে লাগাম দিয়ে রাজি করাতে না হয়।
ঈশ্বরের আসল উদ্দেশ্য হল আমাদের নিজের কাছে নিয়ে আসা, তিনি আমাদের সাথে সহভাগিতায় ও ঘনিষ্ট সম্পর্কে থাকতে চান। কিন্তু তিনি এই উদ্দেশ্যে আমাদের জোর করবেন না, তিনি চান যেন আমরা তাঁকে বুঝি, যেন “চোখে চোখ রেখে” তিনি আমাদের পরিচালনা করতে পারেন। “চোখে চোখ রেখে” মানে যত্ন, গুরুত্ব ও মনোযোগের সঙ্গে, মানে স্বাধীনতাকে সম্মান দিয়ে পরিচালনা, মানে স্বেচ্ছায় ইচ্ছা মিলানো।
দায়ূদ এভাবে নিজেকে এই ঘোড়া বা গাধার সাথে তুলনা করে, তিনিই জেদী হয়ে ঈশ্বরের কাছে আসতে চান নি (গীত ৩২:৩-৪) এবং শুধুমাত্র যখন তার উপরে “ঈশ্বরের হাতের চাপ ভারী” ছিল তখন তিনি ঈশ্বরের কাছে সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন দায়ূদ বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। তিনি জানেন যে আমাদের ফিরে পাওয়ার উদ্দেশ্যে ঈশ্বর অনেক কিছু করতে রাজি। তিনি এর জন্য কৃতজ্ঞ, কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছেন যে তা প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়। একজন ইচ্ছুক, বাধ্য, নম্র ও সাড়া দেওয়ার মানুষের প্রতি ঈশ্বরের “লাগাম” ব্যবহার করা দরকার নেই। আমাদের লাগাম দিয়ে বাধ্যতায় আনার ঈশ্বরের আনন্দ নেই, তবুও তিনি আমাদের মঙ্গলের জন্য তা করতে রাজি। লাগামের ব্যবহার প্রয়োজন হলে তবে ঈশ্বরকে পাওনা সম্মান দেওয়া হয় না।
দায়ূদ সম্পর্কের গুরুত্ব বোঝেন। তিনি ঈশ্বরকে ‘মনে শান্তি পাওয়ার যন্ত্র’ হিসাবে ব্যবহার করতে চান না। অনুতাপ শান্তি পাওয়ার কৌশল না, অনুতাপ হল ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কে ফিলে আসার পথ।
গীত ৩২:১০-১১
গীতের লেখক এই সারাংশে আসেন: “দুষ্টকে অনেক যন্ত্রণা পেতে হয়” (গীত ৩২:১০)। “দুষ্ট” এখানে এমন লোকদের বুঝায় যারা তাদের মন্দ আচরণ দ্বারা অন্যদেরকে কঠিন অবস্থায় এবং ভুলভাবে সাড়া দেওয়ার প্রলোভনে ফেলে। কিন্তু হতে পারে “দুষ্ট” এমন লোকদেরকেও বুঝায় যারা অনুতপ্ত হতে প্রত্যাখ্যান করে, যারা চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে ও অন্যদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে থাকে।
এই লোকদের যন্ত্রণার বিপরীতে আছে এমন লোক যারা ঈশ্বরের প্রতি সাড়া দেয় “হে ঈশ্বরভক্ত লোকেরা, সদাপ্রভুই যেন তোমাদের আনন্দের বিষয় হন, তাঁকে নিয়েই তোমরা খুশী হও; তোমরা যারা অন্তরে খাঁটি, তোমরা সকলে আনন্দ-গান কর।”
ঈশ্বর দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি আমাদের তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে থাকতে আমন্ত্রণ করেন।
গীত ১
1ধন্য সেই লোক,
যে দুষ্টদের পরামর্শমত চলে না,
পাপীদের পথে থাকে না,
ঠাট্টা-বিদ্রূপ কারীদের আড্ডায় বসে না;
2বরং সদাপ্রভুর আইন-কানুনেই তার আনন্দ,
আর সেটিই তার দিনরাতের ধ্যান।
3সে যেন জলস্রোতের ধারে লাগানো গাছ,
যা সময়মত ফল দেয়,
আর যার পাতা শুকিয়ে ঝরে যায় না;
সে সব কাজেই সফলতা লাভ করে।
4কিন্তু দুষ্টেরা সেরকম নয়;
তারা যেন বাতাসে উড়ে যাওয়া তুষ।
5এইজন্য বিচারের দিনে দুষ্টেরা টিকবে না,
পাপীরা ঈশ্বরভক্তদের দলে টিকে থাকতে পারবে না;
6কারণ ঈশ্বরভক্তদের চলার পথের উপর সদাপ্রভুর খেয়াল আছে,
কিন্তু দুষ্ট লোকদের চলার পথে রয়েছে ধ্বংস।
গীত ১-এর ভূমিকা
গীতের উপরে লেখায় কোনো লেখকের নাম, ঐতিহাসিক পরিস্থিতি বা অন্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।গীত ১ হল প্রথম খণ্ডের প্রথম গীত (গীত ১-৪১)। প্রথম খণ্ডের বেশিরভাগ গীত হল দায়ূদের ব্যক্তিগত গীত। ধারণা করা হয় যে দায়ূদ নিজেই প্রথম খণ্ডের সংগ্রহকারী ও প্রকাশক। তাই তার তারিখ ধরা হয় প্রায় ১০০০ খ্রীষ্টপূর্ব।
গীত ১ হল প্রজ্ঞার গীত, অর্থাৎ গীতটি বিশেষ পরিস্থিতিতে একজনের প্রার্থনা নয় বরং পাঠকদেরকে শিক্ষা দেওয়ার একটি গীত। গীতটির হিতোপদেশ পুস্তকের মত ভাব আছে, যার উদ্দেশ্য হল লোকদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া এই পৃথিবীতে প্রজ্ঞাবান, সত্য ও ঈশ্বরীয় জীবন-যাপন করা মানে কি।
গীত ১:১-২
গীতের প্রথম দু’টি পদে এমন লোকদেরকে বর্ণনা করা হয় যারা ঈশ্বরকে খুশি করার মত চলে এবং একারণে “ধন্য” হয়।
প্রথম পদে (গীত ১:১) লেখক দেখান একজন ভাল লোক কি কি খারাপ আচারণ এড়িয়ে যায়: “ধন্য সেই লোক, যে দুষ্টদের পরামর্শমত চলে না, পাপীদের পথে থাকে না, ঠাট্টা-বিদ্রূপ কারীদের আড্ডায় বসে না।” পদটিতে ৩টি সমান্তরাল লাইন আছে, “দুষ্ট”, “পাপী” ও “ঠাট্টা-বিদ্রুপ কারী” হল সান্তরাল এবং “দুষ্ট পরামর্শমত চলা”, “পাপীদের পথে থাকা” ও “আড্ডায় বসা” হল সমান্তরাল।
- “দুষ্টদের পরামর্শমত চলে না” মানে মন্দ মানুষদের বুদ্ধি ও পরামর্শ গ্রহণ না করা। প্রায়ই মন্দ পরামর্শ শুনতে খুব সহজ, যুক্তিপূর্ণ, স্মার্ট ও কন্ভিন্স করার হত। কিন্তু তাদের যুক্তি বহুদিনের ফলাফল নিয়ে চিন্তা নেই, ঈশ্বরের বাস্তবতা নিয়েও চিন্তা নেই এবং তা মানুষকে ‘সহজ পথে’ অথচ দূর্নীতির দিকে নিয়ে যায়।
- “পাপীদের পথে থাকে না” মানে যেখানে পাপীরা আছে সেখানে না যাওয়া, তাদের পথে না পড়া, তাদের সঙ্গে সময় না কাটানো। যদিও একজন পরিপক্ক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ লোক পাপীদের মধ্যে সময় দিয়ে তাদেরকে একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়ে তাদের উপর একটি ভাল প্রভাব ফেলতে পারে (যেমন যীশু, যোষেফ ও দানিয়েল করেছিলেন), তবুও যারা কম পরিপক্ক, কম প্রজ্ঞাবান ও অল্প বয়সের, তারা সহজেই মন্দদের মধ্যে গিয়ে তাদেরই দ্বারা প্রভাবিত হয়। অনেক বার নিজেকে এই ধরণের লোকদের থেকে ব্যবহারিক বা ভৌগলিকভাবে সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
- “ঠাট্টা-বিদ্রুপ কারীদের আড্ডায় বসে না” আগের কথার মত নিজেকে ভৌগলিকভাবে এই ধরণের লোকদের থেকে দূরে রাখা ভাল, কিন্তু মনের চিন্তার ক্ষেত্রেও তাদের থেকে দূরে থাকা দরকার। তাদের সাথে মেশা মানে তাদের চিন্তা দিয়ে প্রভাবিত হওয়া। তারা মনে করে যে সব কিছু বিশ্লেষণ করে বিচার করতে পারে, তারা সব কিছু জানে, সবার উদ্দেশ্য ও কৌশল বুঝে। ঠাট্টা-বিদ্রুপ কারী লোক সবাইকে নীচু চোখে দেখে, নিজেকে সবার চেয়ে ভাল মনে করে, কাউকে সম্মান করে না, কারও মূল্য বা অবদান স্বীকার করতে রাজি না।
গীতের দ্বিতীয় পদে (গীত ১:২) লেখক দেখান একজন ভাল লোকের কি কি মনোভাব ও আচারণ থাকে: “বরং সদাপ্রভুর আইন-কানুনেই তার আনন্দ, আর সেটিই তার দিনরাতের ধ্যান।”
বর্ণিত এই মনোভাব হল ঠাট্টা-বিদ্রুপের ঠিক বিপরীত: ভালটা ভাল হিসাবে স্বীকার করা ও তাতে আনন্দ করা, ঈশ্বরের বাক্যকে আমার বিচার-বুদ্ধির চেয়ে মহান একটি প্রজ্ঞা হিসাবে মানা। “দিনরাতের ধ্যান” মানে স্বক্রিয়ভাবে ঈশ্বরের বাক্যকে মনোযোগ ও গুরুত্ব দেওয়া, নিজেকে বাক্যের অধীনে রাখা (সব কিছুর উপরে না যেমন ঠাট্টা-বিদ্রুপে) এবং ঈশ্বরের আরো বড় দৃষ্টি আমার উপর প্রভাব ফেলতে সুযোগ দেওয়া।
গীত ১:৩ রূপক শব্দ: গাছ
তাই যদি করি তবে তার ফল এই: “সে যেন জলস্রোতের ধারে লাগানো গাছ, যা সময়মত ফল দেয়, আর যার পাতা শুকিয়ে ঝরে যায় না; সে সব কাজেই সফলতা লাভ করে।”
লেখক এখানে “গাছ” রূপক অর্থে ব্যবহার করেন: একটি গাছ, ভাল জায়গায় লাগানো, পানির যোগান, সফল (যদিও তা দেখতে গেলে সময় লাগে), সবুজ, যা সহজে শুকিয়ে যায় না। গাছের রূপক মানে এমন লোক, যিনি অন্যদের জন্য আশীর্বাদ (যেমন একটি গাছ ছায়া, আরাম, ওক্সিজেন, সৌন্দর্য, ফল, ওষুধী পাতা, মাটির স্থিরতা, সুরক্ষা ইত্যাদি যোগান দেয়)। যে মানুষ ঈশ্বরের অধীনের জীবন-যাপন করে, তিনি শক্তিশালী, ভাল জিনিসে ভরা, ফলবান, দানশীল, প্রভাবশালী, সান্ত্বনাদানকারী, স্থিরতাদানকারী মানুষ হয়ে যায়, এমন একজন যিনি অন্যদের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
গীত ১:৪-৬ রূপক শব্দ: তূষ
মন্দ মানুষদের গাছের সাথে নয় বরং তুষের সাথে তুলনা করা হয়: “কিন্তু দুষ্টেরা সেরকম নয়; তারা যেন বাতাসে উড়ে যাওয়া তুষ। এইজন্য বিচারের দিনে দুষ্টেরা টিকবে না, পাপীরা ঈশ্বরভক্তদের দলে টিকে থাকতে পারবে না; … কিন্তু দুষ্ট লোকদের চলার পথে রয়েছে ধ্বংস।”
লেখক “তুষ” আবারও রূপক অর্থে ব্যবহার করেন: তুষ মানে মূল্যহীন, অস্থায়ী, সহজে আগুন ধরে, সহজে উড়ে যাওয়া, হালকা, পাতলা, কোনো ভার বা গরুত্ব নেই, খালে খোসা। তুষ বিরক্তিকর: তার চোখে, নাকে, মুখে এসে অনেক বিরক্তি সৃষ্টি করে কিন্তু এই ‘বড় প্রভাব’ ভান মাত্র, আসলে তুষ অপদার্থ, তাতে কিছু হয় না। দুষ্টদের বর্ণনায় আবারও ৩টি বিষয় বলা হয়: তারা “বিচারের দিনে টিকবে না”, তারা ভালদের মধ্য “থাকতে পারবে না” ও তাদের ধ্বংস আসবে। ঈশ্বর তাঁর লোকদেরকে নিশ্চয়তা দেন যে মন্দতা স্থির থাকতে পারবে না, জয় করবে না বরং মন্দকে বিচার ও ধ্বংস করা হবে।
গীত ১:৬ কারণ ও প্রতিজ্ঞা
কেন মন্দতা ও মন্দরা টিকে থাকতে পারবেন না? কারণ “ঈশ্বরভক্তদের চলার পথের উপর সদাপ্রভুর খেয়াল আছে।” কিন্তু তাও ঠিক: যদি ঈশ্বর খেয়াল না করতেন তবে সম্ভাবনা বেশি যে মন্দরা টিকত। ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি পৃথিবীতে হস্তক্ষেপ করবে এবং ফলে মন্দতাকে চিরকাল থাকতে দেওয়া হবে না।
গীত ১-এর মধ্যে সময় সম্বন্ধীয় শব্দগুলো
ঈশ্বরকে এই প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করা কি প্রয়োজন? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে গীতটির মধ্যে সব সময় সম্বন্ধীয় শব্দগুলো লক্ষ্য করা ভাল: ঈশ্বরের ভক্তরা “দিনরাত” তাঁর আইন-কানুন নিয়ে ধ্যান করবে, তারা গাছের মত যা “সময়মত ফল দেয়” এবং দু’টি ভবিষ্যদ্বাণী দুষ্টেরা “বিচারের দিনে … টিকবে না” এবং তাদের “চলার পথে রয়েছে ধ্বংস।”
এই জগতে বাসকারী মানুষ হিসাবে আমাদের অভিজ্ঞতা ঠিক এই গীতের কথার বিপরীত: আমরা অনেক বার দেখি যে, যারা মন্দ ও ঠাট্টা-বিদ্রুপকারী, তারা সফল হয় ও তারা সুঅবস্থায় থাকে, তারা স্বেচ্ছাচারীভাবে জীবন-যাপন করে এবং বোধ হয় যে তাদের কিছুই হয় না। অপর পক্ষে যে লোকেরা ভাল ও ন্যয়্য আচরণ করতে, তারা অনেক বার চাপে পড়ে, তাদের ঠকানো হয় এবং তাদের অধিকার অস্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে অন্যায় করা হয়। তারা যে বেশি “ধন্য” বা “সফল”, তা দেখা যায় না।
তারপরেও গীত এর বিপরীত দাবি করে এবং লোকদেরকে বিপরীত বিশ্বাস ধরে রাখতে বলেন।
এর জন্য সেই সময় সম্বন্ধীয় শব্দগুলো গুরুত্বপূর্ণ: দিনে দিনে ধৈর্য ধরে ঈশ্বরের দৃষ্টি ধরে না রাখলে আমরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ি। গাছে ফল হয়, তার সময় লাগে। ঈশ্বর যা বলেছেন তার বাস্তবতা দেখতে যথেষ্ট সময লাগে, কিন্তু তিনি আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে আমরা তার বাস্তবায়ন দেখব, কারণ তার “খেয়াল আছে”।
প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর যদি এই নিশ্চয়তা বা প্রতিজ্ঞা দান না করতেন, আমরা মন্দদের সফলতা দেখতে দেখতে ভেঙ্গ পড়তাম এবং নিরুৎসাহিত হয়ে ভাল করতে বাদ দিতাম।
গীতটি তাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ফল হতে হতে সময় লাগবে, মানুষের আচারণের ফলাফল প্রকাশিত হতে সময় লাগবে (উভয় ভাল ও খারাপ আচরণের)। মন্দদের বিচার করা হবে, ভক্তেরা অবশেষে প্রমাণিত হবে এবং ভাল কাজ করার জন্য তারা নিজেকে আর ‘মুর্খ’ বলবেন না।
চূড়ান্তভাবে মন্দতা নয় বরং ঈশ্বরের ভক্তিপূর্ণ ভয় টিকে থাকবে!
গীত ৭০
গান পরিচালকের সংকলনের জন্য। দায়ূদের গান। একটা স্মৃতি জাগানো গান।
1হে ঈশ্বর, আমাকে বাঁচাও; হে সদাপ্রভু, আমাকে সাহায্য করতে শীঘ্র এস।
2যারা আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টায় আছে তারা লজ্জিত ও অপমানিত হোক;
যারা আমার সর্বনাশ দেখতে চায় তারা মাথা নীচু করে ফিরে যাক।
3যারা আমাকে দেখে বলে, “বেশ হয়েছে!” তারা লজ্জা পেয়ে ফিরে যাক।
4কিন্তু যারা তোমার ইচ্ছামত চলে তারা তোমাকে নিয়েই আনন্দিত ও খুশী হোক;
যারা তোমার করা উদ্ধারের কাজ ভালবাসে তারা সব সময়েই বলুক, “ঈশ্বরের গৌরব হোক!”
5আমি দুঃখী ও অভাবী; হে ঈশ্বর, তুমি শীঘ্র আমার কাছে এস।
তুমি তো আমার সাহায্যকারী ও উদ্ধারকর্তা;
হে সদাপ্র্রভু, দেরি কোরো না।
ভূমিকা
গীত ৭০ হল গীতসংহিতার দ্বিতীয় খণ্ডের (গীত ৪২-৭২) একটি গীত। দ্বিতীয় খণ্ডে বেশ কিছু জাতীয় গীত পাওয়া যায়। মনে করা হয় যে এই খণ্ডের প্রকাশক শলোমন, যিনি তা প্রায় ৯০০ খ্রীষ্টপূর্বে সংগ্রহ করে প্রকাশিত করে।
তবুও গীত ৭০ আসলে হল দায়ূদের একটি ব্যক্তিগত প্রার্থনা, এমন সময়ে যখন তিনি আবারও জীবনের হুমকিতে পড়ে অনেক কষ্টের মধ্যেও ঈশ্বরের উপর নির্ভর করতে থাকেন।
শত্রুদের উপরে অমঙ্গল চাওয়ার গীতগুলো
গীত ৭০ হল শত্রুদের উপরে অমঙ্গল করার একটি গীত (imprecatory psalm), যাতে লেখক যারা তার বিরুদ্ধে অন্যায় করে, তাকে অত্যাচার করে বা তাকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করছে, তাদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ঈশ্বরকে মিনতি করেন।
গীত ৭০:২-৩ পদে তিনি ৩ বার বলেন অত্যাচারীরা যেন “অপমানিত হোক”, “মাথা নীচু করে ফিরে যাক”এবং “লজ্জা পেয়ে ফিরে যাক”। দায়ূদ ঈশ্বরকে ডাকেন যেন তিনি শত্রুদের দ্বিধাদ্বন্দ্বে, লজ্জায়, অসম্মানে ও দুরাবস্থায় ফেলেন, এমন লেকদেরকে যারা দায়ূদকে চাপ, অত্যাচার, আঘাত এবং এমন কি জীবনের হুমকি দেয়: “তারা লজ্জিত ও অপমানিত হোক; যারা আমার সর্বনাশ দেখতে চায় তারা মাথা নীচু করে ফিরে যাক। 3যারা আমাকে দেখে বলে, “বেশ হয়েছে!” তারা লজ্জা পেয়ে ফিরে যাক। কিন্তু যারা তোমার ইচ্ছামত চলে তারা তোমাকে নিয়েই আনন্দিত ও খুশী হোক; যারা তোমার করা উদ্ধারের কাজ ভালবাসে তারা সব সময়েই বলুক, “ঈশ্বরের গৌরব হোক!”
আমরা যারা আমরা নতুন নিয়মের শিক্ষায় অভ্যস্ত, আমরা এই ধরণের কথা শুনে অবাক হয় এবং তা মানতে চাই না। আমাদের কানে আছে যীশুর উক্তিগুলো, যেমন “তোমার অত্যাচারীদের জন্য প্রার্থনা কর”।
অনেকে অমঙ্গল চাওয়ার গীত অপছন্দ করে, অথবা এমন কি ভুল মনে করে। এর একটি কারণ হল: দায়ূদ যে পরিমাণে অন্যায়, আক্রমণ, ভয় ও জীবনের হুমকির সম্মুখীন হন, সেই পরিমাণে আমরা কখনও পড়ি নি। অথচ আমরা এর চেয়ে অনেক সামান্ন অন্যায়ের সম্মুখীন হলে (যেমন আমাদের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য) তবে আমরা ক্ষমা করা খুব কষ্টের বিষয় মনে করি। অমঙ্গলের গীতগুলো কঠোর বিচার করার আগে আমাদের নিজের হৃদয় পরিক্ষা করে দেখা ভাল হয়।
দায়ূদ এই গীতের প্রার্থনার মধ্য দিয়ে নিজের ভয়, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, অন্যায় ভাব, বেচারা ভাব, প্রতিশোধ নেওয়ার ভাব নিয়ে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
তিনি সব আবেগ, কষ্ট, ক্ষোভ, ঘৃণা ও প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ঈশ্বরের উপরে ছেড়ে দেন। তিনি বরং ঈশ্বরকে প্রতিশোধ নিতে ডাকেন, যা ক্রোধে ও আত্ম-ধারমিকতায় ‘বিচার নিজের হাতে নেওয়ার’ চেয়ে অনেক ভাল। তিনি সচেতন যে তিনিও অনেক ক্ষেত্রে দোষী, যদিও এই বর্তমান জীবনের হুমকির ক্ষেত্রে (যেমন শৌল দায়ূদকে শিকার করেন) তার কোনো দোষ নেই।
ঈশ্বরের উপর নির্ভর করা, প্রতিশোধ নিজের হাতে না নেওয়া, যে বিচারককে ডাকা যিনি সম্পূর্ণ ন্যায্য, নিরপেক্ষ ও সবার উপরে, তা করতে পেরে হল বড় জয়।