মোশি তার জীবনের শেষ দিকে ইস্রায়েলের দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে শেষ বক্তৃতা হিসাবে ঈশ্বরের আইন-কানুন ও তাদের জাতির ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেন এবং আহ্বান করেন যেন তারা প্রাণপণে নিজেকে ঈশ্বরের প্রতি ও তার আইন-কানুনের প্রতি সমর্পিত করে।
মোশি সম্ভবত ইস্রায়েল জাতির চল্লিশ বছর মরুভূমিতে বিচরণের সময়ে তার পাঁচটি পুস্তক লেখেন (মোশির পঞ্চপুস্তক) যাতে তিনি উভয় ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা এবং ঈশ্বরের আইন-কানুন দেন। কিভাবে জানা যায় যে মোশি পঞ্চপুস্তকের লেখক? পাঁচটি পুস্তকে বেশ কয়েক বার উল্লেখ করা আছে যে মোশি “সব কিছু লিখে রাখলেন”। পুরাতন ও নতুন নিয়মের পরের লেখকেরা – এবং যীশু নিজেই – প্রায়ই এই পাঁচটি পুস্তক “মোশির লেখা” হিসাবে উল্লেখ ও উদ্ধৃতি করেন। এভাবে মোশি লেখক হিসাবে ঘোষিত। দ্বিতীয় বিবরণ হল মোশির পঞ্চপুস্তক।
যেমন পঞ্চপুস্তকের অন্যান্য পুস্তক, দ্বিতীয় বিবরণ হল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও ভিত্তিক পুস্তক। এই পুস্তকে ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতির ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেন এবং আইন-কানুনের একটি পুনরালোচনা ও সারাংশ দেন। দ্বিতীয় বিবরণে ঈশ্বরের চরিত্র আরো পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এই পুস্তক হল ইস্রায়েল জাতির দ্বিতীয় প্রজন্মের সঙ্গে ঈশ্বরের চুক্তির প্রস্তাব। দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তক নোঙ্গরের মত কাজ করে: এই পুস্তকে সেই চুক্তি স্থাপন করা হয় যে চুক্তি অনুসারে ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে আশীর্বাদ অথবা অভিশাপ দেবেন, যা অনুসারে তাদের ইতিহাস চলবে এবং যা ভাববাদীরা স্মরণ করিয়ে দেবেন।
ইস্রায়েল জাতির প্রথম প্রজন্ম, যারা মিসরের কঠিন বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মিসর থেকে প্রস্থান করেছিল তারা পরবর্তীতে মরুভূমিতে চল্লিশ বছর বিচরণের সময়ে মারা গেছে। এখন ইস্রায়েল জাতির দ্বিতীয় প্রজন্ম উঠে এসেছে এবং তারা ইতিমধ্যে ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য হয়ে যর্দন নদীর পূর্বে পাড়ের ইম্মোরীয়দের ভূমি দখল করেছে। ইম্মোরীয়দের এই ভূমি ইতিমধ্যে ইস্রায়েলের তিনটি বংশকে উত্তরাধিকার হিসাবে দেওয়া হয়েছে। ইস্রায়েল যর্দনের পূর্বে যিরীহো শহরের ওপারের সমতল জায়গায় ছাউনি ফেলছে। মোশি জানেন যে, তিনি শীঘ্রই মারা যাবেন। তাই তিনি ইস্রায়েলীয়দের একত্রিত করে তাদের কাছে একটি শেষ বক্তৃতা দেন। দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তক হল মোশির সেই বক্তৃতার অনুলিপি। মোশি তাতে ইস্রায়েল জাতির দ্বিতীয় প্রজন্মকে ঈশ্বরের সঙ্গে চুক্তি করার প্রস্তাব দেন, যেন তারা নিজেকে ঈশ্বরের প্রতি এবং তাঁর আইন-কানুনের প্রতি সমর্পিত করে।
পুস্তকের প্রথম অংশে মোশি ইস্রায়েলীয়দেরকে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে তাদের জাতীয় ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেন: মিসর থেকে উদ্ধার, ঈশ্বরের সঙ্গে সিনাই পাহাড়ে ইস্রায়েল জাতির চুক্তি, মরুভূমিতে বিচরণের বছরগুলো এবং কিছু দিন আগে তাদের জয় ও ভূমি লাভ। মোশি আগে দেওয়া আইন-কানুনের পুনরালোচনা করেন: পরিবার, অর্থনীতি, সু্স্বাস্থ্য, সরকার, শিক্ষা, যোগাযোগ, শিল্প ও ধর্ম সম্বন্ধীয় আইন। তিনি দ্বিতীয় প্রজন্মের সামনে সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় আইন পুনরায় উপস্থাপন করেন।
মোশি ইস্রায়েল জাতির প্রতি ঈশ্বরের বিশ্বস্ততা দেখান: ইস্রায়েল জাতি শক্তিশালী, বড়, বিশেষ ও বাধ্য জাতি বলে ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে মনোনীত করেন নি (দ্বিতীয় বিবরণ ৭:৭, ৯:৪) বরং শুধুমাত্র ঈশ্বরের করুণা ও সার্বভৌম সিদ্ধান্তের কারণেই তাদেরকে বাছাই ও মনোনীত করেছেন। ঈশ্বর তাঁর ভালবাসা ইস্রায়েল জাতিকে দিয়েছেন এবং তাদের সঙ্গে চুক্তির সম্পর্কে থাকতে চান। তিনি তাদের ঈশ্বর হতে চান এবং তিনি চান, যেন তারা তাঁরই জাতি হয়। যদি ইস্রায়েল জাতি এই ধরণের পবিত্র ও সার্বভৌম ঈশ্বরের সঙ্গে চুক্তির সম্পর্কে থাকতে তবে তাদেরকে এই ঈশ্বরের আরাধনা করতে হবে এবং তাঁর আইন-কানুন মানতে হবে। যদি তারা তা করে, অর্থাৎ যদি তারা ঈশ্বরকে তাদের ব্যক্তিগত জীবন ও জাতীয় জীবনের কেন্দ্র হিসাবে গ্রহণ করে, তাঁকে ভালবাসে এবং তাঁর জীবন-দায়ী আইনে বাধ্য থাকে – তবে তারা নিজের উপরে মঙ্গল, সুস্বাস্থ্য, শান্তি, ন্যায্যতা, নিরাপত্তা ও স্থিরতা নিয়ে আসবে এবং তারা দীর্ঘদিন প্রতিজ্ঞাত দেশে বাস করতে পারবে।
কিন্তু তার বিপরীতও ঠিক: যদি তারা চুক্তি ভাঙ্গে, অর্থাৎ যদি তারা ঈশ্বরকে অগ্রাহ্য করে প্রতিমা-পূজা করে, যদি তারা তাঁর আইন-কানুন অমান্য করে এবং চারিদিকের জাতিদের মত করে – তবে তারা নিজের উপরে কষ্ট, অভাব, দুর্ভিক্ষ, দারিদ্রতা, অসুস্থতা, দ্বন্দ্ব, অন্যায়, যুদ্ধ ও মৃত্যু নিয়ে আসবে। শেষ ফল হিসাবে তারা প্রতিজ্ঞাত দেশ হারাবে।
মোশি এই দুইটি পথ ইস্রায়েলীয়দের সামনে তুলে ধরেন এবং তাদের জরুরীভাবে ও আবেগীয়ভাবে প্রতিমা-পূজার চেয়ে ঈশ্বরকে, বিদ্রোহের চেয়ে বাধ্যতা এবং মৃত্যুর চেয়ে জীবন পছন্দ করতে বলেন। ঈশ্বর তাঁর চুক্তিতে সমর্পিত; যা এখন ঘটবে তা ইস্রায়েল জাতির সাড়ার উপর নির্ভর করবে।
পুস্তকের লেখক এবং লেখার তারিখ ও স্থান
দ্বিতীয় বিবরণ হল মোশির লেখা পঞ্চপুস্তকের মধ্যে পঞ্চম ও শেষ বই। সম্ভবত মোশি পঞ্চপুস্তক লেখেন যখন ইস্রায়েল জাতি চল্লিশ বছর মরুভূমিতে বিচরণ করে। পঞ্চপুস্তকে উভয় ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা এবং ঈশ্বরের দেওয়া আইন-কানুন পাওয়া যায়। আমরা কিভাবে জানতে পারি যে মোশি পঞ্চপুস্তকের লেখক? পাঁচটি পুস্তকে বেশ কয়েক বার উল্লেখ করা হয়েছে যে মোশি “সব কিছু” লিখে রাখতেন (যাত্রা ১৭:১৪, ২৪:৪, ৩৪:২৭, গণনা ৩৩:২, ২য় বিবরণ ৩১:৯)। দ্বিতীয় বিবরণ হল মৃত্যুর আগে ইস্রায়েল জাতির কাছে মোশির শেষ বক্তৃতা। পুস্তকটির শেষে বলা হয়েছে যে মোশি “এই আইন-কানুন আগাগোড়া একটি বইয়ে লিখে নিলেন” এবং লোখাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আবাস-তাম্বুতে নিয়ম-সিন্দুকের সাথে রাখার ব্যবস্থা করেন (২য় বিবরণ ৩১:২৪-২৫)। এভাবে মোশি পঞ্চপুস্তকের সংরক্ষণ এবং নিয়মিতভাবে সব ইস্রায়েলের কাছে তার পাঠ নিশ্চিত করেন (২য় বিবরণ ৩১:১০-৩৩)।
পুরাতন নিয়মের পরবর্তী লেখকেরা বার বার পঞ্চপুস্তককে (এবং তার মধ্যে দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তকও) “মোশির আইন-কানুন” বা “মোশির পুস্তকগুলো” বলে উল্লেখ বা উদ্ধৃতি করেন (যিহো ১:৭-৮, ১ রাজা ২:৩, ১৪:৬, দানিয়েল ৯:১১-১৩, ইষ্রা ৬:১৮, নহি ১৩:১, মালা ৪:৪)। পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, তারা পঞ্চপুস্তকের লেখক হিসাবে মোশিকে চিহ্নিত রাখেন। ঠিক তেমনি নতুন নিয়মের লেখকেরা – এবং যীশু নিজেই – আইন-কানুন থেকে উদ্ধৃতি করার সময় তা “মোশির লেখা” হিসাবে চিহ্নিত রাখেন এবং এভাবে মোশিকে লেখক হিসাবে ঘোষিত করেন (মথি ৮:৪, ২২:২৪, মার্ক ১:৪৪, ১২:২৬, লূক ১৬:২৯-৩১, যোহন ১:১৭, ৭:১৯, প্রেরিত ৩:২২, ২৬:২২, রোমিয় ১০:১৯, ১ করি ৯:৯, ২ করি ৩:১৫)। এভাবে আমরা নিশ্চিত জানতে পারি যে মোশি পঞ্চমপুস্তকের লেখক।
তাই মোশি দ্বিতীয় বিবরণ প্রায় ১৪০৫ খ্রীষ্টপূর্বে তার মৃত্যুর ঠিক আগেই লেখেন যখন ইস্রায়েল জাতি মোয়াবের তলভূমিতে ছাউনি ফেলেছিল। পুস্তকের শেষ অধ্যায় (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৪) মোশির চরিত্রের এবং তার মৃত্যুর বর্ণনা দেয়। সম্ভবত যিহোশূয় এই শেষ অধ্যায় লিখে পুস্তকটি সমাপ্ত করেন।
ইস্রায়েল জাতির জন্য দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তকের গুরুত্ব
মৃত্যুর আগে মোশির শেষ বক্তৃতা হিসাবে দ্বিতীয় বিবরণের অবশ্যই একটি গুরুত্ব ও ভার আছে। পুস্তকটি হল মোশির মাধ্যমে পাওয়া ইস্রায়েল জাতির উত্তরাধিকার। দ্বিতীয় বিবরণে মোশি যাত্রা, লেবীয় ও গণনা পুস্তকের ঐতিহাসিক ঘটনা এবং আইন-কানুনের পুনরালোচনা করেন। দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তকে ঈশ্বরের চরিত্র ও হৃদয় আগের পুস্তকগুলোর চেয়েও স্পষ্টভাবে প্রকাশিত।
দ্বিতীয় বিবরণ হল ইস্রায়েল জাতির দ্বিতীয় প্রজন্মের সাথে ঈশ্বরের চুক্তি স্থাপন (যেমন প্রথম প্রজন্মের সাথে ঈশ্বর সিনাই পাহাড়ে চুক্তি করেছিলেন, যাত্রা ১৯)। পুস্তকটি ইস্রায়েল জাতির জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি, যাতে আইন-কানুনের পিছনে ঈশ্বরের হৃদয় আগের তুলনায় আরো স্পষ্টভাবে বুঝানো হয়েছে। মোশির পঞ্চপুস্তক – এবং বিশেষভাবে দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তকটির সাথে ইস্রায়েল জাতির পরবর্তী ইতিহাস সংযুক্ত আছে। কেউ কেউ বলে যে পুরাতন নিয়মের বাকি পুস্তক ও ইস্রায়েল জাতির ইতিহাস, সব দ্বিতীয় বিবরণের উপর ভিত্তি করে ঘটে। প্রকৃতভাবে পুস্তকটি ইস্রায়েল জাতির জন্য নোঙ্গরস্বরূপ: দ্বিতিয় বিবরণ হল ঈশ্বরের চরিত্রের ও হৃদয়ের বর্ণনা, সেই মানদণ্ড যা অনুসারে তিনি ইস্রায়েল জাতিকে বিচার করবেন, ইতিহাসে যা ঘটবে এবং কেন তা ঘটবে, তারই ব্যাখ্যা এবং সেই চুক্তি যা ভাববাদীরা ইস্রায়েলকে স্মরণ করিয়ে দেবেন।
দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তকের কাঠামো
মোশি দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তক ঐসময়ের প্রচলিত একটি চুক্তি লিপিবদ্ধ রাখার পদ্ধতি অনুসারে সাজান: হিত্তীয় অধিরাজ-সামন্ত চুক্তি (Hittite suzerainty covenant)। হিত্তীয় অধিরাজ-সামন্ত চুক্তি ছিল অসম ব্যক্তিদের মধ্যে চুক্তি, যেমন একজন রাজা এবং তার সামন্তের মধ্যে চুক্তি অথবা একটি দখলকারী সাম্রাজ্য এবং পরাজিত একটি জাতির মধ্যে চুক্তি। দ্বিতীয় বিবরণ হল স্বর্গের রাজা এবং ইস্রায়েল জাতির মধ্যে চুক্তি।
হিত্তীয় অধিরাজ-সামন্ত চুক্তিতে নিচে দেওয়া অংশগুলো থাকত:
১ | চুক্তির স্থাপনকারী | প্রারাম্ভিকা বা শিরোনাম | দ্বিতীয় বিবরণ ১:১–৫ | চুক্তির স্থাপনকারী, অর্থাৎ অধিরাজের পরিচয় |
২ | চুক্তির ইতিহাস | প্রস্তাবনা: এ পর্যন্ত ইতিহাস | দ্বিতীয় বিবরণ ১:৬–৪:৪৭ | চুক্তির পিছনে অধিরাজ ও সামন্তের ইতিহাস ও ঘটনা, যার ফলে চুক্তি স্থাপিত হয়। অধিরাজ ও সামন্তরের মধ্যে এ পর্যন্ত সম্পর্ক। |
৩ | চুক্তির জীবন | সাধারণ নিয়ম | দ্বিতীয় বিবরণ ৫–১১ | চুক্তির নিয়মের উদ্দেশ্য। চুক্তির অধীনে জীবনের বর্ণনা। |
নির্দিষ্ট নিয়ম | দ্বিতীয় বিবরণ ১২–২৬ | চুক্তির নিয়মের নির্দিষ্ট বর্ণনা। সামন্তের কি করতে হবে। | ||
৪ | চুক্তির অনুসমর্থন | আশীর্বাদ ও অভিশাপ | দ্বিতীয় বিবরণ ২৭–৩০ | চুক্তিতে বাধ্য হলে সমান্তকে কি সুযোগ–সুবিধা দেওয়া হবে। চুক্তিতে অবাধ্য হলে সামন্তকে কি ফলাফল বা শাস্তি ভোগ করতে হবে। |
৫ | চুক্তির স্মরণ | চুক্তির লেখা গুদাম করে রাখা | দ্বিতীয় বিবরণ ৩১:৯,২৪–২৫ | সামন্তের মন্দিরে চুক্তির একটি কপি রাখা হয়। |
সবাইকে শোনানো | দ্বিতীয় বিবরণ ৩১:১০–১২,৩২ | চুক্তির নিয়ম সবাইকে রীতিমত শোনাতে হবে। | ||
৬ | চুক্তির সাক্ষী | সাক্ষীদের ডাকে | দ্বিতীয় বিবরণ ৩০:১৯, ৩১:১৯, ৩২:১–৪৩ | দেব–দেবতাদের চুক্তির সাক্ষী হিসাবে ডাকা হয়। |
পূর্বের ইতিহাসের বর্ণনা দ্বিতীয় বিবরণ ১-৪ অধ্যায়
মোশি ইস্রায়েল জাতিকে পূর্বের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেন: সিনাই পাহাড়ের ঘটনাগুলো, কাদেশ মরুপ্রান্তরে কনান দেশ দখল করতে প্রত্যাখ্যান করা, মরুভূমিতে বিচরণ করার বছরগুলো এবং অবশেষে কিছুদিন আগে যর্দনের পূর্ব এলাকা যুদ্ধে জয় করে দখল করা।
মোশি তাদের মনে করিয়ে দেন যে, একটি অতি স্পষ্ট পার্থক্য করা দরকার: সাতটি জাতি আছে, যাদের সরিয়ে দিয়ে জমি অধিকার করা যাবে (দ্বিতীয় বিবরণ ৭:৭) কিন্তু অন্যান্য জাতিদের (যেমন ইদোম, মোয়াব, অম্মন) সীমানা সম্মান করতে হবে। তাদেরকে আক্রমণ করা চলবে না, ইস্রায়েল জাতি তাদের জমির এক ইঞ্চিও পাবে না। পার্থক্যটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাতে বুঝা যায় – সাতটি জাতির ধ্বংসের কারণ হল তাদের অন্যায় ও মন্দ কাজ, এমন মন্দ কাজ যা বিচার করা প্রয়োজন (দ্বিতীয় বিবরণ ৯:৪)। ঈশ্বরের চোখে ইস্রায়েল জাতির বিশেষ যোগ্যতা, প্রিয়তা বা আহ্বানের কারণেই সাতটি জাতিকে সরানো হচ্ছে, এমন নয়।
মরুভূমিতে বিচরণ ও দখলের ঘটনাগুলো পুনরালোচনা করার সময়ে, মোশি প্রত্যেক জাতি সম্বন্ধে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য দেন। আমরা সেগুলো হয়তো গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না, কিন্তু মোশি তা উল্লেখযোগ্য মনে করেন: ঈশ্বর প্রত্যেকটি জাতির ইতিহাস ও অবস্থা জানেন। পুনরালোচনায় স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, ঈশ্বর যেমন এখন কয়েকটি জাতিকে সরিয়ে দিয়ে ইস্রায়েল জাতিকে তাদের জমি দেন, ঠিক তেমনি তিনি আগে অন্যান্য জাতিদের জন্যও করেছেন: মোয়াবের সামনে থেকে তিনি এমীয়দের সরিয়ে দিয়েছিলেন (দ্বিতীয় বিবরণ ২:৯-১০), ইদোমের সামনে থেকে তিনি হরীয়দের সরিয়ে দিয়েছিলেন (দ্বিতীয় বিবরণ ২:১২), অম্মোনীয়দের সামনে থেকে তিনি রফায়ীমদের সরিয়ে দিয়েছিলেন (দ্বিতীয় বিবরণ২:২০) এবং কাপ্তরীদের সামনে থেকে তিনি অব্বীয়দের সরিয়ে দিয়েছিলেন (দ্বিতীয় বিবরণ ২:২৩)। শেষ উদাহরণটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাতে পরিষ্কার হয় যে, ঈশ্বর কাজটি মাত্র অব্রাহামের সাথে সম্পর্কিত জাতিদের জন্য করেন না (যেমন ইদোম, মোয়াব, অম্মোন)। বরং তিনি তা এমন জাতির জন্যও করেন যা অব্রাহামের সাথে সম্পর্কিত নয় (যেমন কাপ্তরীম)। একই বিষয়ে আমোষ ৯:৭ পদেও প্রকাশিত।
আমাদের আধুনিক চিন্তা (যে শুধুমাত্র ইস্রায়েল জাতি ঈশ্বরের বিশেষ দয়া পায়), পঞ্চপুস্তকে জাতিদের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্কের বিষয়ে তার চেয়ে আরো প্রশস্ত একটি ছবি দেখানো হয়: ঈশ্বর সব জাতির অস্থিত্ব চান এবং তিনি তাদের সৃষ্টি করেন (আদি ১:২৮)। তিনি কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যগুলোর বিস্তার প্রতিরোধ করেন (আদি ১১:৪)। তিনি দুঃখিত মানুষকে সান্ত্বনা দিতে গেলে তাদেরকে ‘বড় জাতি হওয়ার প্রতিজ্ঞা’ দেন (আদি ১২:২, ১৭:২০, ২১:১৮)। তিনি অব্রাহামকে আহ্বান করেন যেন তার মধ্য দিয়ে সব জাতিগুলো আশীর্বাদ পায় (আদি ১২:৩)। তিনি প্রত্যেকটি জাতির ইতিহাস জানেন (যাত্রা ৯:১৮, দ্বিতীয় বিবরণ ২:৯-১২,২০-২৩)। তিনি সব জাতিদেরকে দায়বদ্ধ করে রাখেন (আদি ১৫:১৬, লেবীয় ১৮:২৪-২৬, দ্বিতীয় বিবরণ ৯:৪, আমোষ ১-২, রোমীয় ১:২০)। ঈশ্বর চেয়েছেন যেন ইস্রায়েল জাতি একটি আদর্শ পুরোহিত জাতি হয় (যাত্রা ১৯:৪-৬), অর্থাৎ এমন একটি আকর্ষণীয় মধ্যস্থকারী জাতি, যার মধ্য দিয়ে অন্যান্য জাতি ঈশ্বরের দিকে আকৃষ্ট হয় (দ্বিতীয় বিবরণ ৪:৫-৮)। এমন না যে, ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে তাদের ধার্মিকতা (দ্বিতীয় বিবরণ ৯:৪), লোকসংখ্যা বা মহত্বের জন্য বেছে নিয়েছেন (দ্বিতীয় বিবরণ ৭:৭)। ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকেও দায়বদ্ধ করে রাখেন, যেমন সব জাতিদের ঈশ্বরের প্রতি একটি দায়বদ্ধতা আছে। যদি ইস্রায়েল সেই সাতটি জাতির মত অন্যায় ও মন্দতা করতে থাকে তবে প্রতিজ্ঞাত দেশ তাদেরকেও “বমি করে ফেলে দেবে” (লেবীয় ১৮:২৪-৩১)। ইস্রায়েল ‘ঈশ্বরের বিশেষ দয়ার’ একটি উদাহরণ নয়, ইস্রায়েল জাতি হল একটি উদাহরণ, ঈশ্বর যা সব জাতির জন্যই করতে আগ্রহী ও প্রস্তুত।
নতুন নিয়মে জাতিদের বিষয়ে ঈশ্বরের এই বড় দৃষ্টি ও মহাপরিকল্পনা সমর্থন পায়: ঈশ্বর জাতিদের সৃষ্টি করেন, তাদেরকে অস্থিত্ব, সময় ও সীমানা দান করেন (প্রেরিত ১৭:২৬)। যীশু সব জাতির মানুষদের জন্য এসেছেন (মথি ২৮:২০) এবং সব জাতির মানুষ তার সিংহাসনের সামনে আরাধনা করবে (প্রকাশিত ৭:৯)। যতজন বিশ্বাস করবে ততজনই পরিত্রাণ পাবে, তারা যে কোন জাতি, শ্রেণী বা অবস্থা থেকে আসুক না কেন – ঠিক যেমন পুরাতন নিয়মে ঈশ্বর এমন আইন-কানুন দিয়েছিলেন যার মধ্য দিয়ে যে কোন জাতির উন্নয়ন হবে।
দেশ দখল ও অধিকারে করার আদেশ
দ্বিতয়য় বিবরণ পুস্তকে প্রায় ৬০ বার কনান দেশ দখল ও অধিকার করার বিষয় উল্লিখিত, অনেক বার তা আদেশ হিসাবে পাওয়া যায়: ‘গিয়ে দখল কর!’ বা ‘অধিকার কর!’। কেন এই আদেশ এত পুনরুক্তি করা প্রয়োজন? মনে করা যায় যে জমি দখল করা ও অধিকার করা আকর্ষণীয় বিষয় – তাহলে এত উৎসাহ দরকার কেন? প্রকৃতপক্ষে পরবর্তীতে দেখা যায় যে – দুঃখের বিষয় – ইস্রায়েল জাতির প্রথম প্রজন্ম কাদেশ মরুপ্রান্তরে ঠিক এই আদেশ পালন করার বিষয়ে ব্যর্থ হয়েছিল (গণনা ১৩-১৪)। ইস্রায়েল জাতি ঐসময়ে মাসের পর মাস অভিযোগ করা দ্বারা নিজের বিশ্বাস ভেঙ্গে দিয়ে এমন পর্যায় পৌঁছায় যে, শেষে তারা প্রতিজ্ঞাত দেশ দখল করার জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্বাস, সাহস ও বাধ্যতা আনতে আর সক্ষম হয় নি।
দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তকের মধ্য দিয়ে মোশি ইস্রায়েল জাতির দ্বিতীয় প্রজন্মকে প্রস্তুত করেন ও অনুপ্রেরণা দেন, তারা যেন পরবর্তীতে যখন তারা দখল করার একই চ্যালেঞ্জের সম্মুখে দাঁড়াবে তখন তারা তাদের মাবাবার চেয়ে ভাল করতে পারে।
আদেশটি পুনরুক্তি করে বলার পিছনে আর একটি কারণ হল যে, ইস্রায়েল জাতি তার ইতিহাসে একবারও জমির মালিক ছিল না। অব্রাহামের সময়ে এবং হতে পারে এমন কি মিসরের সময়েও তারা যাযাবর ধরণের জীবন-যাপন করত। এক জায়গা ছেড়ে আর এক জায়গায় চলে যাওয়া এবং জমির মালিক হয়ে স্থায়ীভাবে জমিতে চাষ করা – এই দু’টির জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম দৃৃষ্টি ও মনোভাব প্রয়োজন, দায়িত্ব গ্রহণও ভিন্ন স্তরের। যাযাবর হিসাবে একটি জমিতে বাস করার সময় কি করলাম বা না করলাম, এর ফলাফল আমার উপরে তেমন পড়ে না কারণ আমি এলাকা ছেড়ে চলে যাব। তাই আচার-আচরণের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ এবং দীর্ঘদিনের চিন্তা যাযাবরের ক্ষেত্রে কম। কিন্তু জমির মালিক হলে আচার-আচরণের ফলাফল আমার উপরেই পড়ে, তাই মালিকানা দায়িত্বশীলতা, ধনাধ্যক্ষতা, দীর্ঘদিনের চিন্তা ও পুনরায় বিনিয়োগ শেখায়। ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে আর যাযাবর না হতে বলেন। ঠিক তেমনি ঈশ্বর আমাদেরকেও চ্যালেঞ্জ করেন যেন আমরা আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, তালন্ত ও সময় দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করি, যেন আমরা সবারই সম্পদ (যেমন দেশের অবকাঠামো বা পরিবেশ) নিয়েও দায়িত্বশীল হই।
পুনরুক্তি বিষয় “বাধ্যতা”
আগের পুস্তকগুলোর তুলনায় দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তকে মোশি ইস্রায়েল জাতির দ্বিতীয় প্রজন্মকে আরো বেশি মনেপ্রাণে বাধ্য হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দেন। ৫০ বারের মত তিনি তাদের আদেশ দেন “শুন!”, প্রায় ৮০ বার তিনি তাদেরকে “ঈশ্বরের আইন-কানুনে বাধ্য হতে, নিয়মগুলো পালন করতে, ঈশ্বরের পথে চলতে এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারে জীবন-যাপন” করতে বলেন। এছাড়া প্রায় ৬০ বার তিনি তাদের দেশ দখল ও অধিকার করার বিষয়ে চ্যালঞ্জ করেন (আগের অনুচ্ছেদ দেখুন) কারণ এই মুহূর্তে বাধ্যতার প্রধান বিষয় হল কনান দেশ দখল। মোশি তাদের বিভিন্নভাবে অনুপ্রেরণা দান করেন:
- তিনি দেখান যে, শুধু তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্যে তিনি আইন-কানুন চাপিয়ে দেন না, মানুষ অন্ধভাবে বা অনিচ্ছুকভাবে আইনে বাধ্য হবে, এটাও ঈশ্বরের ইচ্ছা নয়। এর চেয়ে তিনি চান, যেন ইস্রায়েল জাতি ঈশ্বরের মঙ্গলময়তা, অর্থাৎ তাঁর আইন-কানুন, নীতি ও পথের মঙ্গলময়তা এমন ভালভাবে বুঝে যে, তারা মনেপ্রাণে ও স্বেচ্ছায় বাধ্য হয় (দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৪-৫, ১০:১২, ২৮:৪৭)।
- মোশি তাদের দেখান যে, ঈশ্বর প্রথমেই তাদেরকে ভালবেসেছিলেন (দ্বিতীয় বিবরণ ৭:৭-৮) এবং তিনি তাদের প্রতি প্রত্যেক মুহূর্তে বিশ্বস্ত ছিলেন, আছেন ও থাকবেন (দ্বিতীয় বিবরণ ৪:৫-৮)।
- মোশি দেখান যে, ঈশ্বরের আইন-কানুন হল জয়ী ও সফল একটি জীবনের জন্য ব্যবহারিক পরিচালনা। ঈশ্বর বাস্তবতার ঈশ্বর। তিনি তাদেরকে বোঝান, মানুষ যা করে তার বাস্তব ফলাফল থাকবে, ভাল করলে ভাল ফলাফল এবং খারাপ করলে খারাপ ফলাফল। আইন-কানুন তাই এই ধরণের বাক্যতে পূর্ণ “যদি তুমি … তবে …”। এইটা দ্বারা মোশি ইস্রায়েল জাতিকে তাদের সিদ্ধান্তের গুরুত্ব, ক্ষমতা ও ফলাফল দেখান (বিশেষভাবে দ্বিতীয় বিবরণ ২৮ এবং ৩০:১৫-২০) দেখুন।
পুস্তকটির প্রায় অর্ধেক লেখা হল আইন-কানুন, অর্থাৎ ঈশ্বর কি আচরণ চান, তার বর্ণনা। এক দিকে বলা যায় যে তা হল বাহ্যিক আচরণ সম্বন্ধীয়, রূপকভাবে বললে ‘কংকাল’। কিন্তু পুস্তকের বাকি অর্ধেক লেখা হল আইন-কানুন পালন করার জন্য অনুপ্রেরণা, অর্থাৎ আইনের পিছনে ঈশ্বরের হৃদয়, তিনি কেন সেই আইনগুলো দিয়েছিলেন – তা বলা যায় অন্তরের বিষয়, মনোভাব সম্বন্ধীয়, রূপকভাবে বললে ‘পোশির মাংস’।
আদেশের তালিকা দেওয়া বা জানা সহজ, কিন্তু সেগুলোতে বাধ্য থাকার অনুপ্রেরণা ধরে রাখা কঠিন। যদি মোশি শুধু আইন-কানুনের পুনরালোচনা করতেন, তবে তিনি হতেন প্রথম ও প্রধান ফরীশী। মোশি জানতেন যে, অনিচ্ছুক হওয়ার সত্ত্বেও আইন-কানুনে বাধ্য থাকার কিছুটা লাভ আছে (খারাপ ফলাফল এড়িয়ে যাওয়া যায়) – কিন্তু ঈশ্বর এতে সন্তুষ্ট নন। বরং তিনি চান যেন তারা জেনে বুঝে অন্তরে রাজি হয়ে মনেপ্রাণে সমর্পিত ও বিশ্বস্ত হয়। অপর পক্ষে ‘মনে মনে রাজি কিন্তু আসলে পালন করি না’ – তাও ঈশ্বরের চোখে যথেষ্ট নয়। ঈশ্বরকে ভালবাসা মানেই ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য থাকা, যেমন যোহন নতুন নিয়মে তার চিঠিতে এত শক্তিশালীভাবে বলেন (১ যোহন)। বাধ্যতায় (এবং শুধুমাত্র বাধ্যতায়) ঈশ্বর তাঁর আশীর্বাদ দিতে পারেন। যতজন বাধ্য ততজনই আশীর্বাদ প্রাপ্ত হবে। ঈশ্বরের আশীর্বাদ কোন রহস্যজনক কোন বিষয় নয়, ভাগ্যের উপরে নির্ভরশীল, ‘এমনি এমনি’ বা ‘এক এক দিন এক এক রকম’ কোন বিষয়ও নয়। আশীর্বাদ আইনের সাথেই সম্পর্কিত, আশীর্বাদ যে একটি ‘আলাদা পুরষ্কার যা বাধ্যতার উপর লাগানো হয়েছে’, এমন নয়। আইনে বাধ্যতা ঠিক সেই বিষয় যা আশীর্বাদ নিয়ে আসতে সক্ষম। আইন হল সেই ব্যবহার যাতে আশীর্বাদ আছে। আইনই আশীর্বাদ। আশীর্বাদ ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে, আইনের মধ্য দিয়েও আসে।
পুরাতন নিয়মের ইস্রায়েল জাতির জন্য যেমন, নতুন নিয়মের বিশ্বাসীদের জন্যও একই প্রলোভন কাজ করে যে, আমরা ঈশ্বরের পুত্রের বিশ্বস্ততার চেয়ে দাসের মনোভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দেওয়া জিনিস হিসাবে মানি। মোশি আমাদের অনুপ্রেরণা দেন, যেন আমরা ঈশ্বরের হৃদয় বুঝি এবং তাঁর আপন হিসাবে মনেপ্রাণে সাড়া দেই।
পুনরুক্তি বিষয় ‘আইন-কানুন’
দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তকে অনেক বেশি পুনরুক্তি বিষয় হল “আইন”, “নিয়ম”, “আদেশ” ও “নির্দেশ” – পুস্তকে প্রায় ১৫০ বারই তার উল্লেখ। অনেক বার আইন-কানুন আগের অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বাধ্যতার বিষয়ের সাথে সংযুক্ত।
পুরাতন নিয়মের আইন-কানুনের গুরত্ব নিয়ে কথা বলতে গেলে আগে স্পষ্ট করতে হবে যে, তা নতুন নিয়মের শিক্ষার বিরুদ্ধে কোন কথা নয়। নতুন নিয়ম আমাদের স্পষ্টভাবে বলে যে, পুরাতন নিয়মের আইন-কানুন পালন করা দ্বারা কেউ কোনোভাবে ঈশ্বরের চোখে নির্দোষ, ধার্মিক বা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না (গালাতীয় ২:১৬)। প্রকৃতপক্ষে পুরাতন নিয়মও একই বিষয় বলে। লক্ষ্য করুন যে, মিসর থেকে ইস্রায়েল জাতির উদ্ধার, ঈশ্বরের জাতি হিসাবে তাদের নিয়োগ বা ঈশ্বরের চুক্তির স্থাপন (যাত্রা ১৯:৪-৬), এই সব কিছু ছিল ইস্রায়েলকে আইন-কানুন দেওয়ার আগেই। আইন-কানুনের প্রতি বাধ্য হয়ে আদর্শ একটি জাতি হওয়া, সব কিছুই ছিল চুক্তির পরের বিষয়। আসলে তা হওয়ার কথা ছিল ঈশ্বরের মঙ্গলময়তা ও দয়ায় পেয়ে কৃতজ্ঞ হৃদয়ের সাড়া, ঈশ্বরের উন্নয়নকারী ও মঙ্গলকারী আইনের অধীনে থাকা স্বেচ্ছায় মনোভাব। আত্ম-ধার্মিক হয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা অথবা অহংকারের সঙ্গে তা অর্জন করার প্রচেষ্টা – আইন-কানুন এই মনোভাব তৈরি করার জন্য দেওয়া হয় নি। ঈশ্বর শুরু থেকে জানেন যে, ইস্রায়েলীয়রা কখনও সব আইন পালন করতে পারবে না। আবাস-তাম্বু, যাজকত্ব, উৎসর্গ পদ্ধতি ও পর্বগুলো ঠিক এই জন্য দেওয়া হয়েছিল: ব্যর্থ হওয়ার পরেও এই পবিত্র ঈশ্বরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার উপায়।
তাই আইন-কানুন উদ্ধার করতে বা গহণযোগ্য করে তুলতে পারে না, কিন্তু তারপরেও আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে: আইন-কানুন হল ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রকাশ, একই সাথে ঈশ্বরের চরিত্রেরও প্রকাশ। একজন ন্যায্য ঈশ্বর চান যেন মানুষদের মধ্যে ন্যায্যতা থাকুক। আইন-কানুনে ঈশ্বরের সত্য ও নীতিগুলো প্রকাশিত। আইন-কানুন রক্ষা করতে চায় যা ঈশ্বর মূল্যবান বলে চিহ্নিত করেন: জীবন, মানুষ, বিবাহ, পরিবার, সম্পদ, শ্রম ইত্যাদি। পাপী মানুষের সমাজ কখনও পরিপূর্ণ হয় না, কিন্তু একটি জাতি বা সমাজ কিভাবে গঠন করা যায়, কিভাবে আরো ন্যায্যতা ও সুঅবস্থার দিকে প্রভাবিত করা যায়, আইন-কানুন তার নীতিমালা দেয়। এই নীতিমালাগুলো ইস্রায়েল জাতিকে – এবং যে কোন জাতিকে – ন্যায্যতা, স্বাধীনতা, সুঅস্থা ও স্থিরতার দিকে উন্নত করবে।
আইন-কানুন যখন পড়েন তার মধ্যে ব্যাতিক্রম বা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজবেন না, বরং আইন-কানুনের পিছনে ঈশ্বরের হৃদয়, উদ্দেশ্য ও নীতি দেখতে চেষ্টা করেন। উদাহরণ: ঈশ্বর আইন দিয়েছেন যে, স্ত্রীকে ত্যাগ করলে তাকে একটি ত্যাগপত্র হাতে দিতে হবে (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১)। আসলে ঈশ্বর এই আইন দেন নি স্ত্রী ত্যাগ করার সুযোগ তৈরি করার জন্য, তিনি স্ত্রীকে ত্যাগ ঘৃণা করেন। বরং এই আইন দিয়ে ঈশ্বর নিশ্চিত করতে চান যে, যদি স্বামী স্ত্রীকে ত্যাগ করে তাহলে কম পক্ষে আইনগতভাবে তা করে, যেন মহিলাটি চাইলে আইনগতভাবে ও নৈতিকভাবে একটি নতুন বিয়ে করতে পারে। তাই আইনটি হল ‘ক্ষতি কমানোর’ বা ‘সর্বনিম্ন ন্যায্যতা নিশ্চিত করার’ একটি আইন। আর একটি উদাহরণ: যদি ঈশ্বর বলেন যে, ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সঠিক মাপের বাটখারা ও পরিমাপ পাত্র থাকে (দ্বিতীয় বিবরণ ২৫:১৫-১৬)। এর অর্থ এই নয় যে ওজন ও পরিমাণে ঠকানো যায় না কিন্তু দৈর্ঘ্য প্রস্থের মাপের বিষয়ে লোকদের ঠকানো যায়। নীতিটি হল: ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ও সততা থাকুক, যদিও ঠকানোর পরিমাণ এত ছোট যে তার বিষয়ে মামলা করা সম্ভব নয়। আর একটি উদাহরণ: গরীবদের সাহায্যের ক্ষেত্রে ঈশ্বর বলেন যে দ্বিতীয় বার গিয়ে ফসল নেওয়া যাবে না বরং তা গরীবদের জন্য রেখে দিতে হবে (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১৯-২২)। তবে এর অর্থ এই নয় যে, যদি আমি পেশায় কৃষক না হই তবে আমার গরীবদের প্রতি কোন দায়িত্ব নেই।
জাতি গঠনের জন্য নীতিমালা
মোশির পঞ্চপুস্তকে ঈশ্বর বিস্তারিত আইন-কানুন দেন, নৈতিক আইন, সামাজিক বা সরকারি আইন এবং ধর্মীয় আইন (যাত্রা ২০-২৩, লেবীয়, গণনা ১-১০, ১৭-১৯, ২৬-৩৬, দ্বিতীয় বিবরণ)। তিনি একটি জাতির বা সমাজের সব ক্ষেত্র নিয়েই জীবনদায়ক আইন বা নীতি দেন। এগুলো অধ্যয়ন করলে অনেক চমৎকার বিষয় পাওয়া যায়। নিচে আইন-কানুন থেকে অল্প কিছু নীতি দেওয়া হয়েছে। আরো বিস্তারিত অধ্যযনের জন্য একই ওয়াবসাইটে “সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে” দেখুন।
সরকার সরকারি নেতা নিযুক্ত করার অধিকার জনগণের। রাজনৈতিক ক্ষমতা কার থাকুক? তা সব সময় উচু স্তরের দিকে না বরং নিম্ন স্তরের দিকে দিতে হবে। সরকারের প্রথম দায়িত্ব হল ন্যায় বিচার ও আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। আদালত নিরপেক্ষতা থাকুক, ঘুষ নিষিদ্ধ।
সরকারে
নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ আলাদা হতে হবে। মানবীয় জীবন মূল্যবান, খুন বা অবহেলার কারণে হত্যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। দুর্ঘটনায় হত্যা মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য নয়। নিজের হাতে বিচার নেওয়া প্রতিরোধ করতে হবে, শুধু সরকারকে বিচার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক নেতার ছেলে নেতা না হোক। ঈশ্বর রাজতন্ত্র চান না।
অর্থনীতি
ব্যক্তিগত ধন-সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ধন-সম্পদের সুরক্ষা হল অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিক্তি। জমি মূল্যবান। নিজের বা অন্যের মালিকানা সুরক্ষা, ধনাধক্ষ্য হওয়া, পুনরায় বিনিয়োগ, দীর্ঘ-দিনের পরিকল্পনা, নতুন প্রচেষ্টার সুরক্ষা, দক্ষতার উৎসাহ সব আবশ্যক। মানুষের শ্রম, সময়, শ্রমিক নিজেই, উৎপাদন করার ক্ষমতা এসব মূল্যবান বলে তার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। জীবনের মাণ, চমৎকার মাণের উৎপাদন, পাওয়া যাওয়া ও উপুক্ত দাম, এসব গুরুত্বপূর্ণ। ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা, ঋণ যেন পাওয়া যায়, ঋণের পরিমাণ ও সময়ের ক্ষেত্রে সীমানা, গরীবদের সুযোগ দেওয়ার পদ্ধতি, কৃতজ্ঞতা, বিশ্বস্ততা, ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীলতা, প্রজন্মের পর প্রজন্ম পরিবারে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সঞ্চয়, জামীন না হওয়া, ঘুষ না নেওয়া ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া, এগুলো সব উৎসাহিত বা নিশ্চিত করা।
বিজ্ঞান
ঈশ্বরের সৃষ্টি, আকৃতি এবং এই বস্তু জগত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সৃষ্টিকর্তা নিজের আইন মানেন, তেমনি তাঁর সৃষ্টিও প্রাকৃতিক আইন অনুসারে চলে, তাই বৈজ্ঞানিক আইন খুঁজে পাওয়া যায়। লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বিজ্ঞান প্রয়োজন, আরো ঘনঘনভাবে বাস করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জমি, চাষ, চাষী ও চাষের উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক প্রয়োজনের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে (খাবার যোগান, আরামের ব্যবস্থা, চিকিৎসা ইত্যাদি)। বিশুদ্ধ খাবার পানি, পুষ্টি, পরিষ্কার-পরিছন্নতা, পয়ঃনিষ্কাশন, রোগ সংক্রমণের প্রতিরোধ সব আবশ্যক। লক্ষ্য করা, লিখিত রাখা, মানচিত্রাঙ্কন, হিসাব-নিকাশ, ব্যবস্থাপনা, নীরিক্ষণ, মূল্যয়ন সব হল গুরত্বপূর্ণ ও প্রয়োজন। ঈশ্বর দায়বদ্ধতা, কার্যকারীতা, উপযুক্ত সরবরাহ, যত্ন ও সেবা চান।
পরিবার
মানবীয় জীবনের অতুলনীয় মূল্য, সুসম্পর্ক, বিবাহ, পরিবার, মা-বাবা ও ছেলেমেয়েদের মধ্যে সম্পর্ক, এসব অত্যন্ত মূলবান। পরিবারে প্রধান নিয়ম হল ভালবাসা ও যত্ন নেওয়া। নিরাপত্তা, অংশভুক্ত হওয়া, নোঙ্গর দেওয়া, আদর্শ হওয়া, উৎসাহ দান, সমর্থন, পরিচালনা ও স্বাধীনতা দান, এসব ছেলেমেয়েরা পরিবার থেকে পাওয়া অতি প্রয়োজন। ছেলেমেয়েদের খুব যত্ন ও মনোযোগ সহকারে শিষ্যত্ব দান এবং তাদের নিজের দায়িত্ব ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে উৎসাহিত করা দরকার। মা-বাবাকে রক্ষক ও উৎস হিসাবে সম্মান দান করা দরকার। দু’জন স্বেচ্ছায় নিজেকে একটি বিবাহে সমর্পিত করে, তাদের উপর বিবাহের অধিকার নির্ভর করে। বিবাহ করতে গেলে আগের পরিবার ছেড়ে দেওয়া দরকার, নতুন পরিবার আগের পরিবারের চেয়ে প্রাধান্য পাবে। যৌন সম্পর্ক কেবল বিবাহের সুরক্ষাকারী কাঠামোতে থাকে। ঈশ্বর একবিবাহ চান।
শিক্ষা
ঈশ্বর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুঝার ক্ষমতা ও বাস্তব চিন্তার উৎস। মা-বাবার দায়িত্ব সন্তানের জন্য একটি উৎসাহমূলক পরিবেশ ও আবিষ্কার করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দরকার। শিক্ষার্থী থেকে খোলা মন, ইচ্ছুক হৃদয়, কৌতুহল ও প্রয়োগ করার আকাঙ্ক্ষা প্রয়োজন। পরিবারে সাধারণ জীবন-যাপন হল শেখার প্রাথমিক স্থান। ভিন্ন প্রজন্মের ব্যক্তি একসাথে কাজ করলে এবং কাজের একটি ব্যবহারিক প্রয়োগ ও উদ্দেশ্য থাকলে তবে শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি শেখে।
যোগাযোগ
মুখের কথার শক্তি, সম্মান ও গুরুত্ব। প্রতিজ্ঞা, শপথ, চুক্তি, সাক্ষাৎ সবই সৎ হতে হবে এবং তা পূর্ণ করতে হবে। সত্য ও বাস্তবতার কাছে সমর্পণ অত্যন্ত প্রয়োজন। মিথ্যা, মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা শপথ, প্রতারণা, নিন্দা ও অভিশাপ দেওয়া সব খুবই ক্ষতিকার। মানুষ নিজের মনের উপর সার্বভৌম, যা শুনি তা যাচাই করে গ্রহণ বা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আছে।
শিল্প ও বিনোদন
মানুষদের সৌন্দর্য, শান্তি, বিশ্রাম, আরাম ও হালকা মনে থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। উভয় কাজ ও বিশ্রাম দরকার। সব ধরণের সৌন্দর্যের অনুমোদন: চারুকলা, শিল্প কাজ, নড়াচড়া, খেলাধূলা, স্পর্শ, কন্ঠস্বর, গান-বাজনা, স্বাদ ইত্যাদি।
ধর্ম
এই ক্ষেত্রে ঈশ্বরের পবিত্রতা ও দয়া, তাঁর ন্যায্যতা ও করুণা উভয় প্রকাশিত। ঈশ্বরই আদর্শ, মহাপুরোহিত, উৎসর্গ, বিনতিকারী, সেবক ও প্রভু। তিনি তাঁর পছন্দ মত লোকদের আত্মিক নেতৃত্ব দান করেন। আত্মিক নেতাদের আয় লোকসংখ্যার আয়ের সাথে সংযুক্ত থাকুক। আত্মিক নেতাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকুক কিন্তু সম্ভাব্য নেতাদের শিষ্যত্ব, শিক্ষা ও চেতনা দান।
পুনরুক্তি বিষয় – পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা দান
স্বক্রিয়ভাবে, গুরুত্ব ও মনোযোগের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা দান কত আবশ্যক, মোশি দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তকে তা উল্লেখ করেন, পারিবারিক, ধর্মীয় বা জাতীয় শিক্ষা হোক। ঈশ্বরের চরিত্র, ইস্রায়েল জাতির সঙ্গে তাঁর ইতিহাস, তাঁর আইন-কানুন সবই যত্নসহকারে ছেলেমেয়েদের শেখাতে হবে কারণ জাতির ভবিষ্যৎ এর উপর নির্ভরশীল: “তোমাদের অন্তর ও মনে আমার এই কথাগুলো গেঁথে রাখবে, তা মনে রাখবার চিহ্ন হিসাবে হাতে বেঁধে রাখবে এবং কপালে লাগিয়ে রাখবে। তোমাদের ছেলেমেয়েদের সেগুলো শিখাবে। ঘরে বসে থাকবার সময়, পথে চলবার সময়, শোবার সময় এবং বিছানা থেকে উঠবার সময় তোমরা এই সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে। তোমাদের বাড়ীর দরজার চৌকাঠে এবং ফটকে তোমরা সেগুলো লিখে রাখবে। যদি তোমরা এই সব কর তবে যে দেশ দেবার শপথ সদাপ্রভু তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে করেছিলেন সেই দেশে তোমরা ও তোমাদের ছেলেমেয়েরা ততকাল বেঁচে থাকবে যতকাল এই পৃথিবীর উপর মহাকাশ থাকবে” (দ্বিতীয় বিবরণ ১১:১৮-২১)।
পনরুক্তি বিষয় – কনান দেশে প্রবেশ করে সব দেব-দেবতা, মূর্তি, ছবি, খুঁটি ইত্যাদি ধ্বংস করার আদেশ
কনানীয়দের দেবতাপূজা ছিল অত্যন্ত মন্দ ধরণের। অনেক পূজায় মন্দির বেশ্যাদের সাথে যৌন সম্পর্ক এবং এমন কি বাচ্চাকে আগুনে পুড়িয়ে উৎসর্গ করা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঈশ্বর ঠিক এই বিশ্রী কনানীয় পূজাগুলোর কারণে – এবং এর ফলে যে সামাজিক অন্যায় ও মন্দতা সৃষ্টি হয়েছে, তার কারণে – কনান দেশে সেই সাতটি জাতিকে ঈশ্বর ধ্বংস করতে আদেশ দিয়েছেন (লেবীয় ১৮:২৪-২৫, দ্বিতীয় বিবরণ ৯:৪)। ইস্রায়েল যখন কনান দেশ দখল করবে, তারা প্রত্যেক শহরে দেবতার উদ্দেশ্য মন্দির, প্রত্যেক মোড়ে ও পাহাড়ে পূজার স্থান, খুঁটি বা মূর্তি এবং প্রত্যেক বাড়ীতে বেদী ও পূজার চিহ্ন বা ছবি পাবে। এই সব কিছয ঈশ্বর তাদের একেবারে ধ্বংস করতে বলেন: “তাদের রাজাদের তিনি তোমাদের হাতে তুলে দেবেন আর তোমরা তাদের নাম পৃথিবী থেকে মুছে ফেলবে। কেউ তোমাদের বাধা দিয়ে রাখতে পারবে না; তোমরা তাদের ধ্বংস করে ফেলবে। তাদের দেব-দেবতার মূর্তিগুলো তোমরা আগুনে পুড়িয়ে ফেলবে। তোমরা তাদের গায়ের সোনা-রূপার লোভ করবে না। নিজেদের জন্য তোমরা তা নেবে না, কারণ তা করলে তোমরা ওগুলোর ফাঁদে পড়বে। তোমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভুর কাছে ওগুলো ঘৃণার জিনিস” (দ্বিতীয় বিবরণ ৭:২৪-২৫)। দেব-দেবতা নয় বরং কেবল ঈশ্বরই প্রভু, শুধুমাত্র তিনিই আরাধনা পাওয়ার যোগ্য এবং তিনি তাঁর পাওনা ভক্তি দাবি করেন। দেবতাপূজা মানে বাস্তব ঈশ্বরকে অগ্রাহ্য করে নিজেকে একটি মিথ্যা বিশ্বাসে সমর্পিত করা, দেবতারা তাদের পূজারীদের উদ্ধার করতে সক্ষম নয়। দেবতাপূজা মানুষদের জন্য ধ্বংসাত্মক কারণ আমরা যে ধরণের দেবতাকে মানি বা অনুসরণ করি, আমরাও সেই রকম হয়ে যাই (২ রাজা ৭:১৪-১৫, যিরমিয় ২:৪, গীত ১১৫:৩-৮)। যদি লোকেরা একটি রক্ত-খাওয়া, যৌনতায় আসক্ত কনানীয় দেবকে পূজা করে তবে তারা পরিবার, ব্যভিচার, মানবীয় অধীকার, মানুষের জীবনের মূল্য ইত্যাদি কোন দৃষ্টিতে দেখবে? তাদের সমাজে কি চলবে? প্রকৃতপক্ষে এই দেবতার চরিত্র ও আচরণের সাথে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজ ব্যবস্থার সাথে মিল থাকবে।
পুনরুক্তি বিষয় – মনের বিষয়ের উপর গুরুত্ব দান
দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তকে মোশি তার শ্রোতাদের ও পাঠকদের ৪৫ বারের মত মন সম্বন্ধীয় আদেশ দেন। যেমনঃ ‘স্মরণ কর’, ‘মনে রেখ’, ‘ভুলে যেও না’, ‘মনোযোগ দাও’, ‘যত্ন সহকারে কর’, ‘সাবধাণ হও’, ‘গুরুত্ব দাও’। ঠিক এই ক্ষেত্রে ইস্রায়েল জাতির প্রথম প্রজন্ম ভাল করে নি বলে তারা কনান দখলের বিষয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। যদিও তারা ঈশ্বরের অত্যন্ত শক্তিশালী আশ্চর্য কাজ (যেমন মিসরে ১০ আঘাত ও সুফ সাগর ভাগ করা) নিজের চোখে দেখেছিল এবং সিনাই পাহাড়ে ঈশ্বরের দৃশ্যমান উপস্থিতি উপলব্দি করেছিল তবুও তারা মরুভূমিতে কষ্টের সম্মুখীন হয়ে তাদের কৃতজ্ঞতার অভাবে, বিশ্বাসবিহীন কথা ও অনবরত অভিযোগ দ্বারা নিজেদের সাহস ও মনবল হারিয়ে ফেলেছিল। দৈনিক মান্নার যোগান এবং ঈশ্বরের মেঘের থাম দেখে নিজের বিশ্বাস বৃদ্ধি করানোর চেয়ে তারা নিজেদেরকে আত্ম-দয়ামায়ায় ও যুক্তিহীন উপসংহারে সমর্পিত করেছিল। নিজেদের মনকে পরিচালনা না করে তারা শেষে কনান দেশ দখলের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার সময়ে ভেঙ্গে পড়েছিল।
একারণে মোশি ইস্রায়েল জাতির দ্বিতীয় প্রজন্মকে স্বক্রিয়ভাবে তাদের মনকে পরিচালনা করতে, ঈশ্বরের আশ্চর্য হাত কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করতে, সত্য ধরে রাখতে, সঠিক উপসংহারে আসতে এবং এভাবে তাদের বিশ্বাস ও সাহস গঠন করতে আদেশ দেন। তিনি তাদের আরো চ্যালঞ্জ করেন, যখন প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হবে এবং তারা কনান দেশ অধিকার করবে, তখন তারা যেন তাদের মনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে থাকে: “যখন … তোমাদের সব কিছু বেড়ে যাবে, তখন তোমরা অহংকারী হয়ে উঠবে এবং যিনি মিসর দেশের গোলামী থেকে তোমাদের বের করে এনেছেন তোমাদের সেই ঈশ্বর সদাপ্রভুকে তোমরা ভুলে যাবে” (দ্বিতীয় বিবরণ ৮:১৩-১৪)। আমাদের বর্তমান যুগের অনবরত বিনোদন ও চিত্তবিক্ষেপের সময়েও মোশির আদেশ পালন করা খুবই প্রয়োজন। আমরা যেন নিজের মনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে কৃতজ্ঞতায়, আরাধনায়, নিরবে ঈশ্বরের রব শোনায় এবং তিনি যা করেছেন তার স্মরণে সমর্পিত করি।
স্মরণ করার জন্য ঈশ্বর একটি অনুষ্ঠানের নির্দেশও দেন: কনান দেশে প্রবেশ করার পরে ইস্রায়েল জাতি শিখিম শহরে গিয়ে অর্ধেক জাতি কাছের এবল পাহাড়ে এবং অর্ধেক জাতি ঐপাড়ে গরিষীম পাহাড়ে দাঁড়িয়ে তারা নাটকীয়ভাবে ঈশ্বরের আইন-কানুন স্মরণ করবে। লেবীয়রা মাঝখানে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় বিবরণ ২৭ অধ্যায়ে উল্লিখিত কিছু নিষিদ্ধ আচরণের অভিশাপ জোরে ঘোষণা করবে এবং ইস্রায়েল “আমনে” বলে চিৎকার করে তাদের অনুমোদন দেবে – অদ্ভুত একটি অনুষ্ঠান!
ভালভাবে শেষ করা
মোশি তার লেখাটি ইস্রায়েলের কাছে একটি আহ্বান দিয়ে সমাপ্ত করেন: যেমন সিনাই পাহাড়ে ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতির প্রথম প্রজন্মের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন, ঠিক তেমনি তিনি এখন ইস্রায়েল জাতির দ্বিতীয় প্রজন্মের সাথেও চুক্তি করতে চান “দেখ, আজ আমি তোমাদের সামনে যা তুলে ধরছি তা হল জীবন ও মংগল কিম্বা মৃত্যু ও অমংগল। আজ তোমাদের কাছে আমার আদেশ এই যে, তোমরা তোমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভুকে ভালবাসবে, তাঁর পথে চলবে এবং তাঁর আদেশ, নিয়ম ও নির্দেশ মেনে চলবে। তাহলে তোমরা বাঁচবে এবং সংখ্যায় বেড়ে উঠবে, আর …ঈশ্বর সদাপ্রভু তোমাদের আশীর্বাদ করবেন। কিন্তু যদি তোমাদের অন্তর তাঁর কাছ থেকে সরে যায় এবং তোমরা তাঁর অবাধ্য হও আর যদি তোমরা দেব-দেবতার পূজার টানে তাদের কাছে মাথা নীচু কর, তবে আজ আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি যে, তোমরা নিশ্চয়ই ধ্বংস হয়ে যাবে … তোমরা বেশী দিন বেঁচে থাকবে না … তোমরা জীবনকে বেছে নাও” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩০:১৫-১৯)।
সমস্ত ইস্রায়েল জাতির উপস্থিতিতে মোশি যিহোশূয়কে জাতির নেতৃত্ব হস্তান্তর করেন যেন সবাই স্পষ্টভাবে জানে ঈশ্বর কাকে মনোনিত করেছেন এবং যেন যিহোশূয় ভালভাবে শুরু করতে পারেন (দ্বিতীয় বিবরণ ৩১:১-৮)। এছাড়া মোশি সম্পূর্ণ আইন-কানুন বা পঞ্চপুস্তক পুরোহিত ও প্রাচীনদের হাতে হস্তান্তর করেন যেন তারা তা যত্ন সহকারে সংরক্ষিত করে রাখেন এবং সাত বছর পর পর তা সমস্ত ইস্রায়েল জাতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পড়ে শুনাবেন (দ্বিতীয় ৩১:৯-১৩,২৪-২৯)।
মোশি একটি জাতীয় ‘অপেরা’ বা গানে ইস্রায়েল জাতিকে নিয়ে ঈশ্বরের ইতিহাস পুনরায় উপস্থাপন করেন, কিছু ভাববাদীমূলক কথাও বলেন। গান আকারে মোশি দিয়েছেন মানে যে, তা মুখস্ত করার জন্য সুবিধা, অর্থাৎ স্মরণ করার একটি ভাল পদ্ধতি। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী দেন যে, ইস্রায়েল অবিশ্বস্ত হবে ও পাপ করবে কিন্তু যদি তারা মন ফিরায় তবে আশা আছে (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২)। মোশি ১২ বংশকে নির্দিষ্ট করে এক একটি আশীর্বাদ দেন (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৩)। তিনি শেষ বারের মত ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করতে পাহাড়ে ওঠেন, এইবার স্থায়ীভাবে তাঁর সঙ্গে থাকার জন্য। শারীরিক শক্তি ও সুস্বাস্থ্যের অবস্থা থেকে ঈশ্বরের আদেশে মোশি মারা যান (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৪:৭) এবং ঈশ্বর নিজেই তাকে অজানা জায়গায় কবর দেন (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৪:৬) – কি চমৎকার একটি মৃত্যু!