সম্ভবত, ইস্রায়েলের মরুভূমিতে চল্লিশ বছর ঘুরার সময়ে মোশি তার পাঁচটি পুস্তক লেখেন (‘মোশির পঞ্চপুস্তক’) যাতে তিনি উভয় ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা এবং ঈশ্বরের আইন-কানুন লিপিবদ্ধ করেন। কিভাবে জানা যায় যে মোশি এর লেখক? পাঁচটি পুস্তকে বেশ কয়েক বার উল্লেখ করা আছে যে মোশি “সব কিছু লিখে রাখলেন”। পুরাতন ও নতুন নিয়মের পরের লেখকেরা – এবং যীশু নিজেও – প্রায়ই “মোশির লেখা” হিসাবে চিহ্নিত করে এই পাঁচটি পুস্তকের উল্লেখ বা উদ্ধৃতি করেন। তাই মোশি পঞ্চপুস্তকের লেখক হিসাবে ঘোষিত।
দ্বিতীয় পুস্তকে (যাত্রাপুস্তক) মোশি ইতিহাস লেখেন কিভাবে ঈশ্বর তাঁর শক্তিশালী হাত দ্বারা ইস্রায়েলকে মিসর দেশের বন্ধন থেকে উদ্ধার করেন। যদিও ইস্রায়েলীয়েরা একটি পরিবার থেকে এসেছে তবুও তাদের নিজের জাতির ইতিহাস সম্বন্ধে বেশি ধারণা নেই। ইস্রায়েলকে তাদের জাতির উৎস, আহ্বান ও ইতিহাস অর্থাৎ তাদের জাতিগত পরিচয় জানানোর উদ্দেশ্যে মোশি আদিপুস্তক লেখেন।
আদিপুস্তকের গুরুত্ব কত বেশি, তা প্রায় বলার বাইরে। আদিপুস্তক মানুষের মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়: ঈশ্বর কে? পৃথিবী ও মানব জাতির উৎস কি? ঈশ্বর এই বস্তু জগত সৃষ্টি করেন এবং তাঁর সৃষ্টিকে চমৎকার বলেন। তিনি তাঁর প্রতিমূর্তিতে মানুষ সৃষ্টি করেন এবং সব কিছুর উপরে তাদের নেতৃত্বের অধিকার দেন যেন তারা চাষ করে এবং তাদের পরিবেশ উন্নত করে। ঈশ্বর হলেন শক্তিশালী ও আনন্দপূর্ণ সৃষ্টিকর্তা। তিনি অধিকারদানকারী প্রভু। তিনি সম্পর্কের ঈশ্বর যিনি মানুষের সাথে সহভাগিতা খোঁজেন (আদি ১-২)। কিন্তু ঈশ্বরের মঙ্গলময়তা সন্দেহ করার কারণে প্রথম মানুষ তাঁর আদেশে অবাধ্য হয়ে পাপ করে। ফলে মানুষের লজ্জা, ভয় ও নিজেকে লুকানো শুরু হয়। ঈশ্বরের সঙ্গে, নিজের সঙ্গে, একে অপরের সঙ্গে ও প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় (আদি ৩)।
ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মানুষের আচরণ দ্বারা পৃথিবীতে মন্দতা তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায়: খুন, হিংস্রতা, বহুবিবাহ এবং প্রাণপণে সব ক্ষেত্রে মন্দ কাজ (আদি ৪-৬)। পাপের কারণে এমন অবস্থা তৈরি হয় যে ঈশ্বর পৃথিবীকে বিচার করেন। তিনি একটি বিরাট বন্যা দিয়ে পৃথিবী ধুয়ে ফেলেন এবং একটি মাত্র পরিবার নিয়ে নতুন করে শুরু করেন। কিন্তু এরপরেও মানুষের পাপ ও বিদ্রোহ বন্ধ হয় নি (আদি ৭-১১)।
ঈশ্বর ভিন্নভাবে আর একবার শুরু করেন: তিনি একজন মানুষকে অর্থাৎ অব্রাহামকে আহ্বান করেন এবং নিজেকে তার কাছে প্রকাশিত করেন। মোশি আদিপুস্তকের চার ভাগের তিন ভাগ অংশে ইস্রায়েলের চারজন আদিপিতাদের (অব্রাহাম, ইসহাক, যাকোব ও যোষেফ) জীবনী বর্ণনা করেন। ঈশ্বর অব্রাহামকে আহ্বান করেন এবং তাকে প্রতিজ্ঞা দেন যে তিনি একটি মহান জাতিতে পরিণত হবেন, তার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং তিনি কনান দেশের অধিকারী হবেন (আদি ১২:১-২)। অব্রাহাম সাড়া দেন এবং আহ্বানে বাধ্য হন: তিনি তার দেশ, পরিবার ও ধর্ম ত্যাগ করেন এবং ঈশ্বরের অনুসরণকারী হয়ে একটি নতুন জীবন ও দেশ পান। ঈশ্বর অব্রাহামকে আশীর্বাদের প্রতিজ্ঞা করেন এবং তাকে পৃথিবীর সব জাতিদের আশীর্বাদ হওয়ার ভূমিকা দেন (আদি ১২:২-৩, ১৩:১৫)। নিঃসন্তান বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অব্রাহাম ও সারার জন্য এই প্রতিজ্ঞাগুলো ছিল অবশ্যই যত চমৎকার তত অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য। তবুও অব্রাহাম ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা বিশ্বাস করেন, একারণে ঈশ্বর তাকে নির্দোষ বলে গ্রহণ করেন (আদি ১৫:৬)। ঈশ্বর অব্রাহামের সঙ্গে একটি চুক্তি স্থাপন করেন এবং তাকে নিশ্চয়তা দেন যে তাঁর প্রতিজ্ঞা অবশ্যই পূর্ণ হবে (আদি ১৫)। পরবর্তীতে চুক্তির বাহ্যিক চিহ্ন হিসাবে ঈশ্বর পরিবারের সব পুরুষের সুন্নত করার আদেশ দেন (আদি ১৭)।
অনেক বছর পার হয় কিন্তু প্রতিজ্ঞাত সন্তানের জন্ম হয় না। একারণে অব্রাহাম ও সারা নিজেদের কৌশলে সেই প্রয়োজনীয় সন্তানের ব্যবস্থা করেন: সারার মিসরীয় দাসী হাগারকে অব্রাহাম দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেন এবং হাগারের দ্বারা ইশ্মায়েলের জন্ম হয়। কিন্তু কৌশলের কারণে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয় (আদি ১৬)। ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা মানুষের কৌশল দ্বারা এবং বহুবিবাদের মাধ্যমে পূর্ণ হোক, এতে ঈশ্বর রাজি নন (আদি ১৬:১৮-১৯)। বরং তিনি সেই প্রতিজ্ঞাত সন্তান (ইসহাক) আশ্চর্যভাবে প্রথম স্ত্রী সারা দ্বারা জন্ম নিতে দেন (আদি ২১:১-৭)।
ইসহাক তার বাবা অব্রাহামের মত বিশ্বাসে ও বাধ্যতায় চলেন। তিনি তার নিঃসন্তান স্ত্রী রিবিকার জন্য প্রার্থনা করেন এবং তিনি বিশ বছর পরে জমজ সন্তান এষৌ ও যাকোবকে জন্ম দেন (আদি ২৫:১৯-২৬)।
অব্রাহাম কয়েকবার মিথ্যা বলার কৌশলের আশ্রয় নেন (আদি ১২:১০-২০, আদি ২০)। একইভাবে ইসহাকও মিথ্যা বলার কৌশল ব্যবহার করেন (আদি ২৬:৬-১১) এবং যাকোবের জীবনেও এটা অভ্যাসে পরিণত হয়: তিনি তার ভাই এষৌকে প্রথম জাতের অধিকার এবং বাবার আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত করেন। পরবর্তীতে এষৌর ভয়ে যাকোব পালিয়ে যান। বৈথেলে ঈশ্বর যাকোবের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর তিনি বিশ বছর ধরে তার মামা লাবনের বাড়িতে থাকেন। লাবন যাকোবের সাথে বার বার প্রতারণা করেন। শেষে যখন যাকোব লাবনকে ছেড়ে কনান দেশে ফিরে যান, তখন তার চারটি স্ত্রী ও এগারোজন সন্তান ছিল। ঈশ্বরের দয়ায় যাকোব তার ভাই এষৌর সঙ্গে পুনরায় সুসম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হন। যাকোব যাযাবর হিসাবে তার পরিবারের সঙ্গে কনান দেশে থাকেন (আদি ৩৩-৩৫)। তার ছেলেদের মধ্যে ছলনার অভ্যাস চরম পর্যায় গিয়ে পরিবারের অস্থিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে (আদি ৩৪)। যাকোবের প্রিয় ছেলে যোষেফ তার ভাইদের দ্বারা মিসরে দাস হিসাবে বিক্রি হন। সেখানে তিনি অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে উঁচু পদের সম্মানিত ব্যক্তি হয়ে যান। মিসরীয় জাতিকে, চারিদিকের জাতিদের এবং তার পরিবারকে একটি কঠোর সাত বছরের দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করার জন্য ঈশ্বর তাকে ব্যবহার করেন। অবশেষে অন্যদের আশীর্বাদ করার আহ্বান কিছুটা পূর্ণ হয়। যাকোবের সম্পূর্ণ পরিবার সম্মানিত অতিথি হিসাবে মিসরের গোশন এলাকায় বাস করার জন্য মিসরে যায় (আদি ৩৭-৫০)।
লেখক ও পুস্তকের সংরক্ষণ
আদিপুস্তক হল মোশির পঞ্চপুস্তকের মধ্যে প্রথম বই। সম্ভবত ইস্রায়েল জাতি যখন চল্লিশ বছর মরুভূমিতে ঘুরে তখন মোশি পঞ্চপুস্তক লেখেন। পঞ্চপুস্তকে উভয় ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা এবং ঈশ্বরের দেওয়া আইন-কানুন পাওয়া যায়। কিভাবে জানা যায় যে মোশি এর লেখক? পাঁচটি পুস্তকে বেশ কয়েক বার উল্লেখ করা হয়েছে যে মোশি “সব কিছু” লিখে রাখলেন (যাত্রা ১৭:১৪, ২৪:৪, ৩৪:২৭, গণনা ৩৩:২, ২য় বিবরণ ৩১:৯)। বিশেষভাবে মোশি তার জীবনের শেষে ”এই আইন-কানুন আগাগোড়া একটি বইয়ে লিখে নিলেন” এবং গুরুত্বের সঙ্গে আবাস তাম্বুতে নিয়ম-সিন্দুকের সাথে রাখার ব্যবস্থা করেন (২য় বিবরণ ৩১:২৪-২৫)।তিনি পঞ্চপুস্তকের সংরক্ষণ এবং সাত বছর পর পর সমস্ত ইস্রায়েলীয়দের কাছে আইন-কানুন পড়ে শোনানো নিশ্চিত করেন (২য় বিবরণ ৩১:১০-৩৩)।
পুরাতন ও নতুন নিয়মের লেখকেরা বার বার পঞ্চপুস্তককে “মোশির আইন-কানুন” বা “মোশির পুস্তক” বলে উদ্ধৃতি করেন (যিহো ১:৭-৮, ১ রাজা ২:৩, ১৪:৬, দানিয়েল ৯:১১-১৩, ইষ্রা ৬:১৮, নহি ১৩:১, মালা ৪:৪)। এভাবে পঞ্চপুস্তকের লেখক হিসাবে মোশিকে চিহ্নিত করা হয়। ঠিক তেমনি নতুন নিয়মের লেখকেরা – এবং যীশু নিজেও – আইন-কানুন থেকে উদ্ধৃতি করে তা “মোশির লেখা” হিসাবে চিহ্নিত করেন এবং এভাবে মোশি লেখক হিসাবে ঘোষিত হন (মথি ৮:৪, ২২:২৪, মার্ক ১:৪৪, ১২:২৬, লূক ১৬:২৯-৩১, যোহন ১:১৭, ৭:১৯, প্রেরিত ৩:২২, ২৬:২২, রোমিয় ১০:১৯, ১ করি ৯:৯, ২ করি ৩:১৫)।
আদিপুস্তক লেখার জন্য মোশি কি কি উৎস ব্যবহার করেন?
আদিপুস্তকে এমন ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে যা মোশির কয়েক শতাব্দীর আগে ঘটেছিল। প্রশ্ন হল মোশি আগের যুগের সম্বন্ধে কিভাবে জানতেন অথবা কি কি উৎস ব্যবহার করে তিনি আদিপুস্তক লেখেন। সম্ভবত, তিনি অব্রাহামের পরিবারের মৌখিক ঐতিহ্য ও বংশতালিকা ব্যবহার করেন। চিন্তা করা যায় যে তিনি আগের যুগের কোন দলিলও ব্যবহার করেন, যদিও এপর্যন্ত এমন দলিল আবিষ্কার করা হয় নি। আদিপুস্তক উল্লেখ করে যে প্রথম দিকের মানুষেরা অনেক দীর্ঘজীবী ছিল। অংক করে বুঝা যায় যে একজন বৃদ্ধ বয়সের ব্যক্তি সহজেই ৭ থেকে ৮টি প্রজন্মের নাতী-পুতী নিজের চোখে দেখতেন। আদম তখনও বেঁচে ছিলেন যখন নোহের বাবা জন্মগ্রহণ করেন এবং নোহ তখনও বেঁচে ছিলেন যখন অব্রাহামের বয়স ৫০ বছর। তাই ধারণা করা যায় যে মৌখিক ঐতিহ্য সহজেই পরের যুগের মানুষদের কাছে পৌঁছাত। মোশি এভাবে আগের উৎস ব্যবহার করেন কিনা, তা নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায় না কিন্তু আমরা জানি যে তিনি পবিত্র আত্মার পরিচালনায় এমন পুস্তক লেখেন যা হাজার হাজার বছর ধরে, এমন কি আজ পর্যন্ত অদ্বিতীয় একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলছে।
মোশি আদিপুস্তক কার কাছে এবং কেন লেখেন?
দ্বিতীয় পুস্তকে (যাত্রাপুস্তক) মোশি বর্ণনা করেন যে, কিভাবে ঈশ্বর তাঁর শক্তিশালী হাত দ্বারা ইস্রায়েল জাতিকে মিসরের বন্ধন থেকে উদ্ধার করেন। মোশির সময়ের ইস্রায়েলীয়েরা হল একটি পরিবার থেকে আসা এক দল অত্যাচারিত মানুষ, যাদের নিজের জাতির উৎস, আহ্বান ও ইতিহাস অর্থাৎ জাতিগত পরিচয় সম্বন্ধে বেশি ধারণা নেই। তারা দশটি আঘাত এবং সূফ সাগরের বিষয়ে ঈশ্বরের ক্ষমতা নিজের চোখে দেখেছে কিন্তু বছর পর বছর তারা মরুভূমিতে ঘুরতে থাকে। ঈশ্বর যিনি তাদের মিসর থেকে উদ্ধার করেছেন, তিনি আসলে কে? কিভাবে তারা জাতি হিসাবে মিসরে চলে এসেছিল? তাদের আদিপিতা অব্রাহামের গল্প কি ছিল? প্রতিজ্ঞাত দেশ বলতে আসলে কি বুঝায়? প্রতিজ্ঞাটি কি সত্যি পূর্ণ হবে? ঈশ্বরের জাতি হিসাবে ইস্রায়েল কিভাবে নিজের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারে জীবন-যাপন করবে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য মোশি আদিপুস্তক লেখেন। আদিপুস্তকের মধ্য দিয়ে তিনি ইস্রায়েল জাতিকে তাদের উৎস, আহ্বান ও ইতিহাস, অর্থাৎ তাদের জাতিগত পরিচয় জানান। অব্রাহামের কাছে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা এখন তাদেরই উপরে আছে, তিনি তা দেখান এবং এই উঁচু আহ্বানে বিশ্বাসে ও বাধ্যতায় সাড়া দিতে তিনি তাদের চ্যালেঞ্জ করেন।
আদিপুস্তক দ্বারা মোশি ইস্রায়েল জাতিকে চারিদিকে জাতিগুলোর পরিচয় দেন, যাদের সাথে ইস্রায়েলীয়দের শিঘ্রই দেখা হবে। যাত্রা করতে করতে তারা কার সামনে পড়বে? কে কে তাদের আত্মীয়-জাতি? কোন জাতিকে সম্মান দিতে হবে? কোন কোন জাতিগুলো ঈশ্বর তাদের সামনে থেকে মুছে ফেলবেন? কেন তিনি তা করবেন? ঐজাতিগুলো কোন কারণে জমিতে বাস করার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে?
যদিও মোশি তার সময়ের ইস্রায়েল জাতির কাছে আদিপুস্তক লেখেন তবুও তিনি ইস্রায়েলের ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলো নিয়েও চিন্তা করেন। ইস্রায়েল জাতির এই ইতিহাস, আহ্বান, তাদের কাছে ঈশ্বরের কথা ও প্রতিজ্ঞাগুলো পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। মোশি এটা নিশ্চিত করার জন্য তার জীবনের শেষের দিকে ব্যবস্থা নেন যে সম্পূর্ণ জনগণকে সাত বছর পর পর একবার করে আইন-কানুন শোনানো হবে (২য় বিবরণ ৩১:৯-১৩)।
আদিপুস্তক কখন লেখা? কোথা থেকে লেখা?
১ রাজা ৬:১ পদে রাজা শলোমনের উপাসনা ঘরের নির্মাণের তারিখ দেওয়ার সময়ে তা প্রস্থানের সাল ভিত্তি করে বলা হয়: “মিসর দেশ থেকে ইস্রায়েলীয়দের বেরিয়ে আসবার পর চারশো আশি বছরের সময় ইস্রায়েলীয়দের উপর শলোমনের রাজত্বের চতুর্থ বৎসরের সিব মাসে, অর্থাৎ দ্বিতীয় মাসে শলোমন সদাপ্রভুর ঘরটি তৈরী করতে শুরু করলেন”। নানা অন্য উৎসবের কারণে শলোমনের রাজত্বের শুরুর তারিখ (৯৭১ খ্রীঃপূঃ) এবং সঙ্গে নির্মাণের শুরু তারিখ (৯৬৭ খ্রীঃপূঃ) নির্দিষ্টভাবে জানা যায়। তাই প্রস্থানের সাল হল ১৪৪৬ খ্রীঃপূঃ। মোলির জন্ম তাহলে ১৫২৬ খ্রীষ্টপূর্বে ছিল কারণ প্রস্থানের সময়ে তার বয়স আশি বছর এবং চল্লিশ বছর ইস্রায়েলকে মরুভূমিতে দেখাশুনা করার পরে তিনি ১৪০৫ খ্রীঃপূঃ সালে মারা যান। তাই আদিপুস্তক (এবং মোশীর সব পুস্তকগুলি) ১৪৪৬-১৪০৫ খ্রীষ্টপূর্বে মরুভূমিতে ঘুরে লেখা হয়।
বাইবেলীয় দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব
আদিপুস্তকের গুরুত্ব কত বেশি, তা প্রায় বলার বাইরে। ঈশ্বর কে, তাঁর চরিত্র কেমন, বস্তু জগতের গুরুত্ব, জীব-জন্তু ও মানুষের অতুলনীয় মূল্য, পৃথিবীতে মানুষের উদ্দেশ্য কি, কাজের সম্মান, লোকসংখ্যা বৃদ্ধি, মানুষের উন্নয়ণ, জাতিতে ভাগ হওয়া ও পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার গুরুত্ব – সব কিছু আদিপুস্তকে বর্ণনা করা হয়। পুস্তকটি মানুষকে বুঝায় যে বর্তমান পৃথিবী উভ্য়ই ঈশ্বরের চমৎকার সৃষ্টি এবং একইসাথে মন্দ দিয়ে আক্রান্ত। আরো জানা যায় যে, কিভাবে মন্দতা শুরু হয়েছিল এবং কিভাবে তা এখনও খারাপ প্রভাব ফেলে। মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার গুরুত্ব নিয়ে আদিপুস্তক একটি অতি বাস্তব চিত্র দেখায়, উভয় ভাল সিদ্ধান্তের ভাল ফলাফল এবং খারাপ সিদ্ধান্তের খারাপ ফলাফল।
আদিপুস্তক বর্ণনা করে ঈশ্বর কিভাবে অব্রাহামকে (এবং পরবর্তীতে তার পরিবারকেও) ডাকেন এবং তাকে আশীর্বাদিত হতে ও অন্যদেরকে আশীর্বাদ দেওয়ার জন্য আহ্বান করেন। আদিপুস্তক দেখায় ঈশ্বর অব্রাহামের সাথে কিভাবে সম্পর্ক রাখেন, নিজেকে তার কাছে কিভাবে প্রকাশিত করেন, যখন অব্রাহাম ভাল এবং খারাপ সিদ্ধান্ত নেন তখন ঈশ্বরের সাড়া কেমন এবং কিভাবে অব্রাহামের পরিবারের মধ্য দিয়ে ইস্রায়েল জাতি তৈরি হয়। ইস্রায়েল হল সেই জাতি যা ঈশ্বর তাঁর শক্তিশালী হাত দ্বারা মিসরের বন্ধন থেকে উদ্ধার করেন এবং সিনাই পাহাড়ে নিয়ে এসে তাঁর অধীনে একটি জাতি হিসাবে গঠন করেন (যাত্রাপুস্তক)।
এক নজরে আদিপুস্তক
আদিপুস্তকের প্রথম বিভাগে (আদি ১-১১) সব কিছুর উৎস ও শুরুর বর্ণনা পাওয়া যায়: পৃথিবী, মহাবিশ্ব, গাছ-পালা, জীব-জন্তু, মানুষ, জাতিগুলো ও মন্দ। চারটি বড় ঘটনা উল্লেখ করা হয়: সৃষ্টি (আদি ১-২), পাপে পতন (আদি ৩-৪), প্লাবন (আদি ৬-৯) এবং বিভিন্ন জাতির উৎপত্তি (আদি ১০-১১)। আদিপুস্তকের দ্বিতীয় বিভাগে (আদি ১২-৫০) চারজন আদিপিতার জীবনের বর্ণনা পাওয়া য়ায়: অব্রাহাম, ইসহাক, যাকোব ও যোষেফ।
সৃষ্টি
মোশি সরল ভাষায় একটি অতুলনীয় ঘটনা বর্ণনা করেন: ঈশ্বর কিভাবে মহাকাশ ও পৃথিবী (এবং তার মধ্যে যত যা আছে) সৃষ্টি করেন এবং সব কিছু সাজিয়ে একটি সুন্দর সুশৃঙ্খলায় নিয়ে আসেন। তিনি সব কিছু তাঁর মুখের বাক্যের ক্ষমতায় সাধন করেন, এই ‘ঈশ্বরের বাক্য’-কেই যোহন যীশু হিসাবে চিহ্নিত করেন (যোহন ১:১,১৪)।
ঈশ্বর প্রথমে পৃথিবীর তিনটি স্থান তৈরি করেন (আকাশ, সাগর ও ভূমি) এবং পরে প্রত্যেক স্থানের জন্য বাসিন্দা সৃষ্টি করেন (গাছ-পালা, জল প্রাণী, পাখি জাতীয় ও ভূমির প্রাণী)। ঈশ্বর প্রত্যেক জীবন্ত প্রাণীর জন্য যোগান নিশ্চিত করেন এবং নিজ জাত অনুসারে বংশ বৃদ্ধি করার ক্ষমতা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। জীবন, বৃদ্ধি, উন্নয়ণ, ভিন্নতা ও ছড়িয়ে পড়া – এসব হল ভাল ও পরিকল্পিত। সময় ও তার পরিমাপ শুরু হয় এবং ইতিহাস তখন থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ঈশ্বরের হাতের সব সৃষ্টি তাঁর বৈশিষ্ট্যগুলো প্রতিফলিত করে কিন্তু তিনি শুধুমাত্র মানুষকে (ষষ্ঠ দিনে সৃষ্ট) “ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে” সৃষ্টি করেন। মানুষকে (উভয় পুরুষ ও মহিলাকে) একটি উচ্চ আহ্বান ও দায়িত্ব দেওয়া হয়: ঈশ্বরের চমৎকার সৃষ্টিকে দেখাশুনা করা। অন্যান্য ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে পৃথিবী বা বস্তু জগতের সৃষ্টি হল একটি দুর্ঘটনা (নস্তিসিস্ম), মানুষের জন্য একটি শাস্তি (গ্রীক), এমন কিছু যা এমনি এমনি ঘটেছে (নাস্তিক) অথবা গুরুত্বহীন (বৌদ্ধ)। এর বিপরীতে বাইবেল সৃষ্টির ক্ষেত্রে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য, আকৃতি, যত্ন, অনুমোদন ও আনন্দ দেখায়। আদিপুস্তক ১ অধ্যায়ে বার বার সৃষ্টির মঙ্গলময়তা ও তা নিয়ে ঈশ্বরের মূল্যায়ন ঘোষিত: “সেগুলো সত্যিই খুব চমৎকার হয়েছিল”।
ঈশ্বর মানুষকে তাঁর প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করেন। ত্রিত্ব ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি হয়েছে বলেই মানুষ দুই লিঙ্গে সৃষ্ট এবং তাদের সম্পর্ক ও সহভাগিতার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। মানুষের মধ্যে যখন সুসম্পর্ক বিরাজ করে সেই সময়ে পৃথিবীতে ত্রিত্ব ঈশ্বরের সবচেয়ে উচ্চ প্রকাশ দৃশ্যমান হয়। উভয় পুরুষ ও নারী একইভাবে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি, তারা একইভাবে আশীর্বাদের পাত্র, একইভাবে একটি উচ্চ আহ্বানে আহূত এবং একসঙ্গে পৃথিবীর উপরে অধিকারী। ঈশ্বর তাদেরকে একটি চমৎকার বাগানে রাখেন এবং তাদের সঙ্গে সহভাগিতায় থাকেন।
ঈশ্বর তাদের মধ্যে বিবাহ স্থাপন করেন এবং ঘোষণা করেন “এইজন্যই মানুষ মা-বাবাকে ছেড়ে তার স্ত্রীর সংগে এক হয়ে থাকবে আর তারা দু’জন একদেহ হবে” (আদি ২:২৪)। এই কথা দ্বারা ঈশ্বর বিবাহ দ্বারা নতুন স্থাপিত পরিবারকে আগের পরিবারের চেয়ে প্রাধান্য দেন।
ঈশ্বর সব কিছুর উপর সার্বভৌম। ঈশ্বরের মত মানুষও নিজের উপর সার্বভৌম, ইচ্ছা-শক্তি প্রাপ্ত এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ।
মন্দ কোথা থেকে আসল
আদি ৩:১ পদে শয়তান একটি সাপের রূপ ধরে এসে মিথ্যা বলে ও প্রতারণা করে। শয়তান কোথা থেকে আসল? যদি সমস্ত সৃষ্টি “চমৎকার” তবে একটি মন্দ প্রাণী কিভাবে সৃষ্টি হল? ঈশ্বর কি মন্দ কিছু সৃষ্টি করেছেন? অথবা তিনি কি শয়তানকে সৃষ্টি করেন নি? তবে এর অর্থ এই যে শয়তান অসৃষ্ট। কিন্তু শয়তান যদি অসৃষ্ট হয় তবে শয়তানও ঈশ্বরের মত অনন্ত এবং ‘ঈশ্বরের জাত’!
এই প্রশ্নের বাইবেলীয় উত্তর হল ঈশ্বরই শুধুমাত্র অসৃষ্ট এবং তিনি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। এমন কিছু নেই যা তাঁকে দ্বারা সৃষ্টি হয় নি। ঈশ্বর নিজের পাশাপাশি দুইটি জাত সৃষ্টি করেছেন যাকে তিনি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া ক্ষমতা দিয়েছেন: আত্মা (বা দূত) ও মানুষ। স্বাধীন ইচ্ছা হল ভাল বিষয় – কিন্তু একটি সমস্যাও আছে: যদি কোন ব্যক্তি তার স্বাধীন ইচ্ছা অনুসারে ভালটা পছন্দ করতে সক্ষম হয় তবে খারাপ বা মন্দ সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতাও তার থাকে। দেখা যায় যে কিছু আত্মারা মন্দ সিদ্ধান্ত নিয়েছে (তারা অহংকারী হয়ে ঈশ্বরকে অস্বীকার করে নিজেকে প্রাধান্য দিয়েছে) এবং তারা (মন্দ আত্মারা / শয়তান) তাদের বিদ্রোহ দিয়ে মানুষকেও সংক্রমিত করেছে (আদি ৩:১, ৩:৪-৫)।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার চিহ্ন হিসাবে ঈশ্বর বাগানে একটি মাত্র গাছ রাখেন এবং তার ফল খেতে নিষেধ করেন। নিষিদ্ধ করা সেই গাছ দিয়ে শয়তান মানুষকে প্রলোভিত করে। যদিও সেই মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষ ঈশ্বরের চরিত্রে ও আচরণে কেবলমাত্র মঙ্গলময়তা দেখেছে তবুও তারা ঈশ্বরের মঙ্গলময়তার উপর নির্ভর না করে নিজের জন্য সেই একটি জিনিষ যা তারা মনে করে তাদের দেওয়া হয় নি, এর ব্যবস্থা করে নিষিদ্ধ করা গাছের ফল খায় (আদি ৩:৬)।
সাথে সাথে অবাধ্য হওয়ার পরিণতি দেখা যায়: মানুষ দু’টি শক্তিশালী আবেগের হাতে নিজেদের খুঁজে পায়: ভয় ও লজ্জা। তাদের লজ্জাবোধ হয়েছে কারণ তাদের নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়: নিজেকে নিয়ে তারা আর শান্তি, আরাম ও নিশ্চয়তা পায় না এবং সাথে সাথে তারা নিজেদের লুকাতে, ঢাকতে ও ভান করতে শুরু করে। তা ছাড়া ঈশ্বরের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়, একে ‘আত্মিক মৃত্যু’ বলা হয়: তারা ঈশ্বরকে নিয়ে ভয় পায় এবং আর এগিয়ে আসতে চায় না (আদি ৩:৭-১০)।
পরস্পরের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়: যখন ঈশ্বর তাদেরকে পাপ স্বীকারের দিকে টানতে চান তখন এর পরিবর্তে তারা নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য পরস্পরকে দোষ দেয়: স্বার্থপরতা রাজত্ব করতে শুরু করে (আদি ৩:১২-১৩)। তারা শয়তানকে, পরিস্থিতিকে এবং শেষে ঈশ্বরকেও দোষ দিতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে কাকে দোষ দেয় এটা বড় বিষয় নয় বরং বড় বিষয় হল তারা দোষারোপ করতে করতে যা আসলে প্রয়োজন, সেই কাজ আর করতে রাজি না: তারা পাপ স্বীকার করে না, নিজেদের আচরণের জন্য দায়িত্ব নেয় না এবং ক্ষমা চায় না।
আর একটি ফলাফল হল যে সৃষ্টির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়, যদিও এর ক্ষতি প্রকৃতিতে ধীরে ধীরে দেখা যায়: তখন থেকেই বেঁচে থাকার জন্য কঠোর পরিশ্রম, প্রতিকূল পরিবেশ এবং মৃত্যুর নিশ্চয়তা তাদের সঙ্গী হয় (আদি ৩:১৬-১৯)।
তারা অল্প কিছু ক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জন করেছে: তারা নতুন করে ভয়, লজ্জা, দোষ, বিভেদ, দুরত্ব, কষ্ট, বিরক্তি ও ব্যর্থতার জ্ঞান লাভ করেছে। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞান কমে গেছে: তারা সর্বজান্তা ঈশ্বরের থেকে গাছের পিছনে লুকাতে কার্যকারী মনে করে, তারা মনে করে দোষারোপ করায় লাভ আছে এবং তারা সেই শুধুমাত্র কাজ এড়িয়ে যায় যা আসলে প্রয়োজন: মনে-প্রাণে অনুতাপ। কে পাপ সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি বুঝে, যে ব্যক্তি পাপ করে অথবা যে ব্যক্তি পাপ করে না? প্রকৃতপক্ষে মাতাল লোক মনে করে যে আরো মদ খেলে ‘ক্ষতি হবে না’, কিন্তু তার চারিদিকের লোকেরা ভাল করে জানে এর কত ক্ষতি পড়ে। যীশু কখনও পাপ করেন নি তবুও তিনি পাপ সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি জানেন।
পাপের ফলাফলগুলো কেবলমাত্র শুরু হয়েছে: শতাব্দীর পর শতাব্দীতে সেগুলো আরো খারাপ হতে থাকবে:
- নিজের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে বলে লজ্জা, অশান্তি, অস্থিরতা, ভয়, হীনমন্যতা, হতাশা, মনমরা, মানসিক রোগ, আত্ম-আঘাত, আত্ম-হত্যা ইত্যাদি শুরু হয়।
- ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে বলে আত্মিক বিছিন্নতা, ভুল চিন্তা, দ্বিধাদণ্ড, উল্টাপাল্টা বিশ্বাস, মিথ্যা নির্ভরতা, অর্থহীন ধর্মকর্ম, আত্মিক ক্ষমতার ভুল ব্যবহার, প্রতারণা, দেবতাপূজা, যাদুমন্ত্র ইত্যাদি শুরু হয়।
- মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে বলে মতের অমিল, দ্বন্দ্ব, স্বার্থপরতা, দোষারোপ, হিংসা, তুলনা, প্রতিযোগিতা, অযত্ন, ত্যাগ, নিয়ন্ত্রণ, দমন, ঘৃণা, অত্যাচার, হিংস্রতা ইত্যাদি শুরু হবে।
- প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে বলে কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ফলতা, ব্যর্থতা, অনুর্বরতা, অভাব, খরা, দুর্ভিক্ষ, রোগ, দুর্যোগ ইত্যাদি শুরু হয়।
মানুষ তখনও তাদের দোষ স্বীকার করে নি, কিন্তু তাঁর দয়ায় ঈশ্বর তাদেরকে সেই মুহূর্তে উদ্ধারের একটি প্রতিজ্ঞা দেন: এক দিন তাদের বংশ থেকে এমন একজন আসবেন, যিনি সাপের মাথা পিষে দেবেন – যদিও সাপ তাকে ছোবল মারবে (আদি ৩:১৫)। প্রতিজ্ঞাটি হল বাইবেলে মশীহ সম্বন্ধীয় সর্বপ্রথম ভবিষ্যদ্বাণী। বাণীটি যীশু দ্বারা পূর্ণ হবে: যীশুই সেই উদ্ধারকর্তা যিনি যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়ে মানুষের জন্য উদ্ধার নিশ্চিত করবেন।
মানুষের লজ্জা ঢেকে দেওয়ার জন্য ঈশ্বর তাদের জন্য পশুর চামড়া দিয়ে পোষাকের ব্যবস্থা করেন (আদি ৩:২১)। ঈশ্বরের এই কাজ আর একটি শক্তিশালী ছবি হিসাবে দাঁড়ায়: শুধুমাত্র রক্ত দ্বারাই পাপ ঢেকে দেওয়া সম্ভব।
অধঃপতনের শুরু
মানব বংশ তাড়াতাড়ি মন্দ থেকে আরো মন্দ আচরণে পদার্পণ করে: যদিও ঈশ্বর প্রথম খুন প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করেন তবুও তা ঘটে (আদি ৪:১-১৬)। এরপরে বহুবিবাহ ও সীমাহীন প্রতিশোধ শুরু হয় (আদি ৪:২৩-২৪) এবং মানব জাতি বিশৃঙ্খলা, স্বেচ্ছাচারী মন্দতা, অনৈতিকতা, দুরাচার ও হিংস্রতায় পতিত হয় (আদি ৬:৫,১১)।
মানব জাতি পাপ করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে এভাবে চলতে দেওয়ার চেয়ে এর বিচার করা উপযুক্ত। তাই ঈশ্বর একটি বিশ্বব্যাপী প্লাবনের মধ্য দিয়ে পৃথিবী থেকে সব মন্দতা মুছে পৃথিবীকে ধুয়ে ফেলেন। শুধুমাত্র নোহ ঈশ্বরকে ভক্তিপূর্ণ ভয় করতেন বলে ঈশ্বর তার পরিবারকে দিয়ে নতুন করে পৃথিবী শুরু করেন। নোহ যে সম্পূর্ণভাবে নিষ্পাপ ছিলেন, তা নয় তবে তিনি সবার চেয়ে ধার্মিক ছিলেন। যখন ঈশ্বর তাকে মানুষ ও জীব-জন্তু সুরক্ষার জন্য একটি জাহাজ তৈরি করতে বলেন তখন তিনি ঈশ্বরের কথায় বাধ্য হন। জাহাজ তৈরি করতে প্রায় একশত বছর সময় লাগে। নোহের জাহাজ নির্মাণ ছিল চারিপাশের লোকদের জন্য একটি সাবধানবাণী কিন্তু কেউ মন ফিরাতে রাজি ছিল না। শেষে ঈশ্বর তাঁর কথা অনুসারে ১২ মাস ধরে একটি বিশ্যব্যাপী প্লাবন ঘটান যাতে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। পরে ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা দেন যে তিনি এভাবে আর কখরও পৃথিবীকে বিচার করবেন না।
ঈশ্বর যেমন করে প্রথম মানুষদের আহ্বান এবং ফলবান হওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনভাবে তা নতুন করে নোহের পরিবারকে দেওয়া হয় (আদি ৮:২২-৯:১)।
ধীরে ধীরে এই পরিবার থেকে অনেক গোষ্ঠি এবং গোষ্ঠি থেকে বিভিন্ন জাতি তৈরি হয়। জাতিগুলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে ভিন্নতা সৃষ্টি হয়। আদি ১০ অধ্যায় দ্বারা এই বিষয়ে ঈশ্বরের আনন্দ প্রকাশ পায়। অধ্যায়টি হল জাতিগুলোর আত্মীয়তা ও ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন বর্ণনা।
কিন্তু কিছু মানুষ ছড়িয়ে পড়ার প্রতিরোধ করতে চায়: “এস, আমরা নিজেদের জন্য একটা শহর তৈরী করি এবং এমন একটা উঁচু ঘর তৈরী করি যার চূড়া গিয়ে আকাশে ঠেকবে। এতে আমাদের সুনামও হবে আর আমরা সারা জগতে ছড়িয়েও পড়ব না” (আদি ১১:৪)। তাদের অহংকারে তারা ঈশ্বরের বিরুদ্ধীয় একটি কেন্দ্রীয় সমাজ, সংস্কৃতি ও সরকার স্থাপন করতে চায়। প্লাবনের আগে মানুষ একটি স্বেচ্ছাচারী নৈরাজ্য স্থাপন করার প্রলোভনে পড়েছিল কিন্তু প্লাবনের পরে তারা একটি দমনকারী কেন্দ্রিক একনায়কতন্ত্র স্থাপন করার প্রলোভনে পড়ে। ঈশ্বর দু’টারই বিপক্ষে। তিনি বরং ছোট জাতিগুলো চান যারা নিজেদেরকে রাজত্ব করতে সক্ষম।
ইস্রায়েল জাতির শুরু
পৃথিবীকে আশীর্বাদ করার এবং নতুন একটি শুরু ঘটাতে জন্য ঈশ্বর একজন ব্যক্তিকে আহ্বান করেন: অব্রাহাম। ঈশ্বর নিজেকে তার কাছে প্রকাশিত করেন। আদিপুস্তকের বড় অংশ হল অব্রাহাম ও তার পরিবারের ইতিহাসের বর্ণনা। অব্রাহাম, ইসহাক, যাকোব ও যোষেফ – ইস্রায়েলের এই চারজন আদিপিতাদের জীবনের বর্ণনা দ্বারা মোশি তার পাঠক ইস্রায়েল জাতিকে তাদের উৎস, শুরু, পরিচয়, আহ্বান ও ইতিহাস জানান।
অব্রাহাম – ইস্রায়েল জাতির প্রথম আদিপিতা
নোহের ছেলে শেথের বংশধরের মধ্য থেকে ঈশ্বর অব্রাহামকে ডাকেন, যিনি কলদীয়দের দক্ষিণে ঊর শহরের বাসিন্দা। ঊর ছিল নান্না (Nanna) বা সীন (Sin) নামে একটি চাঁদ দেবের পূজার কেন্দ্র। এই থেকে বুঝা যায় যে অব্রাহাম দেবতাপূজার সংস্কৃতিতে বড় হন (যিহো ২৪:২)। সম্ভবত, অব্রাহামের বাবা তেরহ নিজের দেশ ছেড়ে কনান দেশে যাওয়ার জন্য ঈশ্বরের আহ্বান প্রথমে পেয়েছিলেন (আদি ১১:৩১)। অব্রাহাম, সারা ও লোটকে নিয়ে তেরহ ঊর থেকে কনানের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন কিন্তু তিনি শুধুমাত্র হারণ পর্যন্ত আসেন। এরপরে অব্রাহাম নিজে ঈশ্বরের ডাক শুনে আহ্বানে বাধ্য হন: তিনি পরিবার, সংস্কৃতি ও আগের ধর্ম ত্যাগ করে ঈশ্বরের অনুসরণকারী হয়ে একটি নতুন বিশ্বাস, জীবন ও দেশ গ্রহণ করেন (আদি ১২:১)।
ঈশ্বর অব্রাহামকে প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি একটি মহাজাতিতে পরিণত হবেন, একটি মহা নাম পাবেন এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদের পাত্র হবেন – যেন তার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সব পরিবার বা জাতি ঈশ্বরের আশীর্বাদ পায় (আদি ১২:২-৩)। এর পরবর্তীতে ঈশ্বর আরো প্রতিজ্ঞা করেন যে অব্রাহাম কনান দেশের অধিকারী হবেন (আদি ১২:৭)। যাযাবর ও নিঃসন্তান বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অব্রাহাম ও সারার জন্য প্রতিজ্ঞাটি ছিল অবশ্যই যত চমৎকার তত অদ্ভুত বা অবিশ্বাস্য। কিন্তু তারা এই আহ্বানে বাধ্য হন এবং বছরের পর বছর ধরে এই বিশ্বাসে স্থির থাকতে চেষ্টা করেন: ‘ব্রাম সদাপ্রভুর কথ বিশ্বাস করলেন আর সদাপ্রভু সেইজন্য তাকে নির্দোষ বলে গ্রহণ করলেন” (আদি ১৫:৬)। পৌল আদিপুস্তকের এই পদটি অনেক গুরুত্বের সঙ্গে উদ্ধৃতি করে বলেন যে ঈশ্বরের চোখে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য ঠিক এই বিশ্বাসই আবশ্যক (গালাতীয় ৩:৬, রোমীয় ৪:৩)।
এভাবে ঈশ্বর অব্রাহামের সঙ্গে একটি একপার্শ্বিক, নিঃশর্ত চুক্তি স্থাপন করেন (আদি ১৫:১২-২১)। কয়েক বছর পরে ঈশ্বর এই চুক্তির বাহ্যিক চিহ্ন হিসাবে সুন্নত করার আদেশ দেন (আদি ১৭)।
প্রতিজ্ঞা থাকা সত্ত্বে অনেক বছর পার হওয়ার পরেও যেহেতু অব্রাহাম ও সারার কোন সন্তান হয় না সেহেতু তারা নিজেদের প্রচেষ্টায় সন্তান পাওয়ার জন্য একটি কৌশল বের করেন: অব্রাহাম হাগার নামে একটি মিসরীয় দাসীকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেন। তারা যেমন আশা করেছিলেন সেভাবে অল্পদিনের মধ্য হাগার গর্ভবতী হয় এবং ইস্মায়েল নামে একটি সন্তান প্রসব করে। কিন্তু যা তারা আশা করেন নি, তাও ঘটে: পারিবারিক দ্বন্দ্ব শুরু হয় (আদি ১৬)। ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা মানুষের কৌশল দ্বারা এবং বহুবিবাদের মাধ্যমে পূর্ণ হোক, এতে ঈশ্বর রাজি নন (আদি ১৬:১৮-১৯)। বরং তিনি সেই প্রতিজ্ঞাত সন্তান (ইসহাক) আশ্চর্যভাবে প্রথম স্ত্রী সারা দ্বারা জন্ম নিতে দেন (আদি ২১:১-৭)।
বহুবিবাহের ফলে দু’জন মা এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হবে, এটা অতি আশ্চর্যের কিছু নয়। হাগার ও ইশ্মায়েল চিরবিদায় সারা দাবি করেন। ইশ্মায়েলের বয়স সেই সময় প্রায় ১৮ বছর। যদিও অব্রাহাম খুশি নন তবুও ঈশ্বর সারার দাবিকে সমর্থন করেন বলে তা-ই ঘটে। ঈশ্বর মরুভূমিতে হাগার ও ইশ্মায়েলকে যোগান দেন (আদি ২১:৮-২১)। ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা অনুসারে ইশ্মায়েল ঈশ্বরের আশীর্বাদ পান এবং ১২জন পুত্রের বাবা এবং একটি শক্তিশালী জাতির আদিপিতা হন। আরব দেশের লোকেরা ইশ্মায়েলকে তাদের আদিপিতা হিসাবে স্বীকৃতি দেয় (আদি ২৫:১২-১৮)।
পুস্তকের একটি চরম মুহূর্তে ঈশ্বর অব্রাহামকে কাছে তার প্রতিজ্ঞাত পুত্র ইসহাককে উৎসর্গ করতে বলেন। ঈশ্বরের কথায় বাধ্য হয়ে অব্রাহাম মোরিয়া পাহাড়ে ইসহাককে উৎসর্গ করতে যান। তিনি যখন ইসহাককে উৎসর্গ করতে শুরু করেন, ঈশ্বর সেই সময় তাকে থামিয়ে ইসহাকের পরিবর্তে পোড়ানো উৎসর্গের জন্য একটি ভেড়ার ব্যবস্থা করেন। এটা যীশু খ্রীষ্টের দিকে একটি শক্তিশালী অগ্রিম ছবি: একদিন পাপী মানুষের পরিবর্তে পিতা ঈশ্বর নিজের পুত্রকে পাপ-উৎসর্গ হিসাবে দান করবেন। যেখানে ঘটনাটি ঘটে সেই মোরিয়া পাহাড়কে পরের শতাব্দীগুলোতে যিরূশালেমের কাছাকাছি একটি জায়গা হিসাবে চিহ্নিত রাখা হয় (২ বংশা ৩:১)।
আদিপিতা ইসহাক – প্রতিজ্ঞার ধারাবাহিকতা
ঈশ্বর যেমন অব্রাহামের কাছে প্রতিজ্ঞা দিয়েছিলেন ঠিক তেমনি তিনি ইসহাকের কাছেও প্রতিজ্ঞা দেন (আদি ২৬:১-৫)। ইসহাক তার বাবার মত বিশ্বাসে ও বাধ্যতায় সাড়া দেন। তিনি তার কাকা নাহোরের নাতী রিবিকাকে বিয়ে করেন। যখন রিবিকারও দীর্ঘ বছর ধরে সন্তান হয় না তখন ইসহাক তার বাবা-মায়ের মত বহুবিবাহের কৌশলে নামেন না। এর পরিবর্তে তিনি তার স্ত্রীর জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন। বিশ বছর পরে রিবিকা গর্ভবতী হন এবং যমজ সন্তান এষৌ ও যাকোবকে প্রসব করেন (আদি ২৫:১৯-২৬)।
‘নিজের নিরাপত্তার জন্য স্ত্রীর বিষয়ে মিথ্যা বলা’ অব্রাহামের এই কৌশলের সাহায্যে সুরক্ষার প্রচেষ্টা ইসহাকের জীবনেও দেখা যায় (আদি ১২:১০-২০, ২০, ২৬:৬-১১)। ঈশ্বর তবুও প্রত্যেক বার হাত বাড়িয়ে সারা ও রিবিকাকে উদ্ধার করেন। ইসহাকের উপরে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছিল বলে তিনি ধনী হয়ে ওঠেন। একারণে দেখা যায় যে, পলেষ্টীয় এলাকায় যাযাবর হিসাবে সময় কাটানোর সময়ে পলেষ্টীয় রাজা তাকে চলে যেতে অনুরোধ করেন। কূয়ার জলের বিষয়ে বার বার দ্বন্দ্বের পরে তারা শান্তির চুক্তি স্থাপন করে বিদায় নেন (আদি ২৬)।
আদিপিতা যাকোব – আগ্রহী, প্রতারণায় দক্ষ এবং এরপরেও আশীর্বাদিত
প্রতারণার পাশাপাশি অব্রাহামের পরিবারে আর একটি সমস্যা দেখা যায়, তা হল পক্ষপাত। ইসহাক দ্বিতীয় সন্তান যাকোবের চেয়ে শিকার করায় দক্ষ প্রথম সন্তান এষৌকে ভালবাসতেন কিন্তু রিবিকার প্রিয় বেশি ভালবাসতেন যাকোবকে (আদি ২৫:২৭-২৮)। যাকোব তার ভাইয়ের দুর্বলতা জেনে কৌশল করে তার কাছ থেকে একটি খাবারের দামে প্রথম সন্তানের অধিকার কিনে নেন (আদি ২৫:২৯-৩৪)। মায়ের পরামর্শ অনুসারে যাকোব তার অন্ধ বাবাকে প্রতারিত করে বড় ভাইয়ের আশীর্বাদও চুরি করেন (আদি ২৭)। এর ফলে এষৌর ভয়ে তিনি পদ্দন-অরামে তার মামার বাড়ীতে পালিয়ে যান। পথে যেতে যেতে বৈথেল নামে একটি জায়গায় যখন তিনি ঘুমিয়ে পড়েন, তখন ঈশ্বর তার সাথে স্বপ্নে দেখা করেন। অব্রাহাম ও ইসহাকের কাছে ঈশ্বর যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সেই প্রতিজ্ঞা তখন তিনি যাকোবের কাছেও করেন। ঈশ্বর আরো প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি যাকোবকে নিরাপদে আবার কনান দেশে ফিরিয়ে আনবেন (আদি ২৮:১০-১৭)। যাকোব যা কৌশলে দখল করতে চেয়েছিলেন ঈশ্বর তাকে দয়ায় তা দান করেন বলে যাকোব হতভম্ব হন। কিন্তু তারপরেও যাকোব তার আগের সীমিত চিন্তা অনুসারে ঈশ্বরের সঙ্গে দামাদামি করতে থাকেন: “যদি ঈশ্বর আমার এই যাত্রাপথে আমাকে রক্ষা করেন, যদি তিনি আমাকে খোরাক-পোশাক যুগিয়ে দেন … তবে এই সদাপ্রভুকেই আমি আমার ঈশ্বর বলে মানব” (আদি ২৮:১৮-২২)। যাকোব তার মামা লাবনকে খুঁজে বের করে তাদের সাথে থাকেন এবং লাবনের ছোট মেয়ে রাহেলের প্রেমে পড়েন। তিনি রাহেলকে বিয়ে করার শর্তে লাবনের পাল দেখাশোনার কাজ করতে রাজি হন। কিন্তু বিবাহের অনুস্থানে লাবনের কৌশলে যাকোবকে রাহেলের পরিবর্তে তার বড় বোন লেয়াকে দেওয়া হয়। কৌশল ও প্রতারণায় দক্ষ যাকোব তারই মত একজন প্রতারণাকারীর হাতে পড়ে গেছেন বলে তিনি বহুবিবাহে জড়িয়ে পড়েন। ফলে তার দু’জন স্ত্রীর মধ্যে কার সন্তান বেশি, এ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি যুদ্ধ শুরু হয়। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তিনি আরো দু’জন উপস্ত্রী গ্রহণ করেন এবং সর্বমোট ১১জন সন্তানের জন্ম হয় (আদি ৩০:১-২৪)।
এর পরে যাকোব যখন কনান দেশে ফিরতে চান তখন তিনি আরো ৬ বছর লাবনের কাজ করেন। এই সময়ে তিনি ঈশ্বরের আশীর্বাদে নিজের জন্য শক্তিশালী পশুপাল তৈরি করতে সক্ষম হন (আদি ৩০:২৫-৩৪)। যাকোব ও লাবনের পরিবারের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয় এবং যাকোব তার পরিবার ও পশুপাল নিয়ে পালিয়ে কনানের উদ্দেশ্যে বের হন। লাবন তাকে অনুসরণ করেন কিন্তু ঈশ্বরের নিশ্চিত করেন যে যাকোবকে ক্ষতি করা না হয়। তারা শান্তি চুক্তি করে বিদায় নেন (আদি ৩১), যা যাকোবের জন্য খুব মূল্যবান ছিল কারণ এগিয়ে গেলে তাকে তার ভাই এষৌয়ের সামনে পড়তে হবে।
দ্বন্দ্বের ও ভয়ের এই সময়ে যখন যাকোব নিরাপত্তাহীন, একা ও দুর্বল, ঠিক তখনই ঈশ্বর তার সঙ্গে দেখা করেন, প্রকৃতপক্ষে তার সঙ্গে লড়াই করেন। যাকোব দাবি করেন যে আশীর্বাদ না পাওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁকে ছেড়ে দেবেন না। ঈশ্বর তাকে আশীর্বাদের নিশ্চয়তা দেন এবং ‘যাকোব’ নামের পরিবর্তে তাকে ‘ইস্রায়েল’ নাম দেন, এর অর্থ হল ‘যার জন্য ঈশ্বরই লড়াই করেন’। যিনি একসময় মনে করতেন যে নিজের কৌশলে ও প্রতারণা দ্বারা ভাল জিনিস দখল না করা মানে বঞ্চিত হওয়া কিন্তু এখন ঈশ্বর নিজেই তার জন্য যুদ্ধ করবেন (আদি ৩২:২২-৩২)। এরপরে আরো একটি পুরাতন সমস্যা সমাধান হয়: আগের শত্রুতা থাকলেও এষৌ যাকোবকে আনন্দের সঙ্গে স্বাগতম জানান। তারা বুঝতে পারেন যে যদিও তাদের বাবা ইসহাক প্রতিযোগিতার মনোভাবে তাদের আশীর্বাদ করেছিলেন তবুও দু’জনেরই ধন-সম্পদ ও পশুপাল এমন বেশি হয়ে উঠেছিল যে দুই পরিবার একই জায়গায় একসাথে আর থাকতে পারে না (আদি ৩৩:১-১৭)। তারা শান্তিতে পরস্পর থেকে বিদায় নেন।
যাকোব যখন শিখিম শহরের কাছাকাছি তাম্বু ফেলেন, শিখিম শহরের নেতার পুত্র যাকোবের কন্যা দীনার সাথে ব্যভিচার করে অথবা তাকে ধর্ষণ করে। শিখিম শহরের নেতা অন্যায়টি স্বীকার করেন এবং বিষয়ের জন্য দায়িত্ব নিতে, ক্ষতিপূরণ দিতে এবং একটি বিয়ে সম্পন্ন করতে অত্যন্ত চেষ্টা করেন। যাকোবের দু’জন ছেলে শিমিয়োন ও লেবি কৌশল করে বিবাহের শর্ত হিসাবে সুন্নত দাবি করে। শিখিমের লোকেরা সুন্নত করতে রাজি হয়। সুন্নত করানোর পরে শিখিমের পুরুষেরা যখন দুর্বল, সেই সময় শিমিয়োন ও লেবি আক্রমণ করে শহরের সমস্ত পুরুষদের মেরে ফেলে, মহিলাদের দাস হিসাবে নেয় এবং ধন-সম্পত্তি লুট করে। অব্রাহামের পরিবারের তিনটি প্রজন্মের এই মিথ্যা বলা ও প্রতারণার চর্চাটি এখন চতুর্থ প্রজন্মে একটি নিষ্ঠুরতায় পরিণত হয়। ঈশ্বরের করা চুক্তির এই পবিত্র চিহ্নটি (সুন্নত) তারা একটি গণহত্যা ঘটানোর জন্য ব্যবহার করে। ফলশ্রুতিতে যাকোব ভয় পেয়ে স্ব-পরিবারে বৈথেল শহরে আসেন কারণ ছোট পরিবার ও যাযাবর হলেও তারা স্থানীয় লোকদের বিরুদ্ধে বড় অন্যায় করেছিলেন।
ঈশ্বর যাকোবকে একটি পারিবারিক অনুতাপ ও নতুন করে পুনরায় সমর্পণে পরিচালিত করেন (আদি ৩৫:১-১৫) কিন্তু যাকোবের ছেলেদের অত্যন্ত বেশি দুঃসাহস বলে তারা শিঘ্রই আবার শিখিমের দিকে পাল চরায়। এ দ্বারা বুঝা যায় যে তাদের কোন লজ্জা নেই, চেতনা নেই, ভয়ও নেই। মনোনিত পরিবার হওয়া সত্ত্বেও তারা এমন প্রতারণা ও নিষ্ঠুরতা করতে রাজি ছিলেন – সম্ভবত একারণে ঈশ্বর তাদের জাতি হিসাবে ৪০০ বছর দাসত্বে পড়তে দেন, যা ঈশ্বর অনেক আগে অব্রাহামের কাছে প্রকাশিত করেছিলেন (আদি ১৫:১৩)। তারা যখন ঠিক সেই একই শিখিম শহরের কাছাকাছি যান তখনই একটি নতুন অতি খারাপ ঘটনা ঘটে যাতে তাদের নিষ্ঠুরতা আবারও প্রকাশিত হয়: তারা শুধুমাত্র হিংসার কারণে নিজেদের ছোট ভাই যোষেফকে খুন করতে চায়। শেষে খুনের পরিবর্তে তারা যোষেফকে দাস হিসাবে বিক্রি করে। যোষেফ বাধ্য হয়ে মিসরে যান এবং এভাবে অনেক ঘটনার পরে পরিবারের জন্যও সেখানে যাওয়ার পথ তৈরি হয় – যা দ্বারা ইস্রায়েল জাতি মিসরে দাসত্বে পড়ে।
আদিপিতা যোষেফ – অবশেষে চমৎকার চরিত্রের ব্যক্তি
যোষেফ হলেন যাকোবের প্রিয় স্ত্রী রাহেলের প্রথম সন্তান। যাকোবের ছোটবেলায় পক্ষপাত কত বেশি সমস্যা তৈরি করেছিল, তা থেকে সাবধাণ না হয়ে তিনি খোলাভাবে যোষেফকে প্রিয় সন্তান হিসাবে চিহ্নিত রাখেন। যোষেফ তার ভাইদের মন্দতার বিষয়ে যাকোবকে জানান। এছাড়া যোষেফ ভবিষ্যৎ সম্বন্ধীয় দু’টি স্বপ্ন দেখে পরিবারকে জানান, যার অর্থ ছিল যে পরিবারের সবাইকে তার সামনে নত হতে হবে। এর ফলে পরিবারে হিংসা ও দ্বন্দ্ব আরো বেড়ে যায়। ভাইয়েরা যোষেফকে খুন করতে পরিকল্পনা করে কিন্তু শেষে তারা তাকে দাস হিসাবে বিক্রি করে (আদি ৩৭)। যোষেফকে মিসরে নিয়ে গিয়ে তাকে ফরৌণের একজন কর্মকর্তার কাছে বিক্রি করা হয়।
যোষেফ তার ভাইদের ক্ষমা করে ও ক্ষোভ ছেড়ে দিয়ে যেখানে ঈশ্বর তাকে রাখেন, সেখানে তিনি প্রাণপণে ও চমৎকারভাবে কাজ করতে থাকেন। ঈশ্বর তার সঙ্গে সঙ্গে থাকেন এবং তাকে আশীর্বাদ ও মানুষের চোখে অনুগ্রহ দিতে থাকেন। যখন তার মনিব পোটীফরের স্ত্রী তাকে ব্যভিচারে রাজি করাতে চান তখন যোষেফ পাপ ও প্রতারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তার উপর দোষ চাপানো হয় এবং তাকে জেলে দেওয়া হয় (আদি ৩৯)। জেলে আবারও একই ঘটনা ঘটতে থাকে: তার বিরুদ্ধে যে অন্যায় করা হয়েছে তিনি তা ক্ষমা করে ক্ষোভ ছেড়ে দিয়ে জেলেও প্রাণপণে কাজ করতে শুরু করেন। ফরৌণের দু’জন কর্মচারীকে জেলে দেওয়া হয়। জেলে তারা স্বপ্ন দেখার কারণে দুশ্চিন্তিত হন। যোষেফ – যিনি স্বপ্নের কারণে যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছিলেন এবং স্বপ্নের বিষয়ে ক্ষোভ ধরে রাখতে পারতেন – তিনি তারপরেও কর্মচারীদের স্বপ্নগুলো ঈশ্বরের পরিচালনায় ঠিকমত ব্যাখ্যা করেন। কর্মচারীরা জেল থেকে বের হন এবং পরবর্তীতে যোষেফকে ভুলে যাওয়া হয় (আদি ৪০)।
যখন ফরৌণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেন, শুধুমাত্র তখনই যোষেফের কথা স্মরণ করা হয় এবং তাকে স্বপ্নের অর্থ বুঝানোর জন্য ফরৌণের সামনে আনা হয়। ঈশ্বরের সাহায্যে যোষেফ স্বপ্নগুলো বুঝতে সক্ষম হন: প্রথমে মিসর দেশে সাতটি প্রাচুর্য্যপূর্ণ বছর আসবে কিন্তু পরের সাতটি বছরে দুর্ভিক্ষ ও অভাব থাকবে। ফরৌণ কৃতজ্ঞ হয়ে নিজের পরে দ্বিতীয় স্থানে মিসরীয় রাজ্যের উপরে যোষেফকে পদাভিষিক্ত করেন (আদি ৪১)।
সব দেশের উপরে যখন সেই ঘোষিত দুর্ভিক্ষ নেমে আসে তখন যাকোবের ভাইয়েরও খাবার কেনার জন্য মিসরে যায়। যোষেফের ভাইয়েরা যোষেফকে দেখেও চিনতে পারে না (আদি ৪২)। যোষেফ কৌশল করে তাদের এমন অবস্থায় ফেলেন যাতে তাদের পরীক্ষা করা হয়: ছোট ভাই বিন্যামিনকে ত্যাগ করলে তারা সবাই মুক্তি পাবে। যদিও অনেক দিন আগে তারা যোষেফকে ত্যাগ করেছিল তবুও বর্তমান ঘটনার মধ্যে তারা ঈশ্বরের হাত দেখে। তারা চেতনা পেয়ে ছোট ভাই বিন্যামিনকে ত্যাগ করতে রাজি না। তাদের সাড়া দেখে যোষেফ নিজের পরিচয় দেন (আদি ৪৩-৪৫)। তিনি যাকোব পরিবারকে মিসরে আসতে বলেন এবং যত দিন দুর্ভিক্ষ চলতে থাকে, তত দিন তাদের যোগান নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন: “তোমরা আমার অমংগল করতে চেয়েছিলে, কিন্তু ঈশ্বর তার ভিতর দিয়ে মংগলের পরিকল্পনা করেছিলেন যাতে অনেক লোকের প্রাণ রক্ষা পায়; আর আজ তা-ই হচ্ছে” (আদি ৫০:২০)। অব্রাহামের পরিবারের একজন আসলেই জাতিদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হলেন।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন!