মীখা যিহূদার লোকদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা ইস্রায়েল দেশের ধ্বংস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, মনেপ্রাণে ও নম্রভাবে ঈশ্বরের কাছে ফিরে আসে এবং দেশে ন্যায় কাজ নিশ্চিত করে। তিনি তাদেরকে একটি নতুন যুগের জন্য আশা ধরে রাখতে বলেন, যখন যিহূদা অন্যান্য জাতিদেরকে ঈশ্বরের দিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে।
মীখা নিজের পরিচয় হিসাবে শুধুমাত্র তার গ্রামের নাম মরেষৎ উল্লেখ করেন। সম্ভবত, মরেষৎ যিহূদার পশ্চিম দিকের নিচুভূমিতে কৃষি সমৃদ্ধ এলাকায় অবস্থিত একটি গ্রাম ছিল।
মীখা তার বাণীর তারিখ হিসাবে যিহূদার রাজা যোথম, আহস ও হিষ্কিয়কে উল্লেখ করেন। এই রাজারা ৭৩৯-৬৮৬ খ্রীষ্টপূর্ব পর্যন্ত রাজত্ব করেন বলে নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় যে, মীখা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বাণী প্রচার করেন। শুরুতে তিনি উভয় উত্তরের ইস্রায়েল জাতির কাছে এবং দক্ষিণের যিহূদা জাতির কাছে কথা বলেন। মীখা এবং তার আগে আরো অনেক ভাববাদীরা যেমন বলেছিলেন, ঠিক তেমনি ৭২২ খ্রীষ্টপূর্বে আসিরিয়া সাম্রাজ্য ইস্রায়েল দেশকে দখল, ধ্বংস ও নির্বাসিত করে। প্রকৃতপক্ষে আসিরিয়া ইস্রায়েলের পরে যিহূদাকেও আক্রমণ করে কিন্তু ঈশ্বরের দয়ায় যিহূদা একটুর জন্য রক্ষা পায়।
ইস্রায়েল আর নেই বলে মীখা পরবর্তীতে যিহূদার কাছে ঈশ্বরের বাণী প্রচার করতে শুরু করেন। মীখা মনে করেন না যে, এই রক্ষার কারণে যিহূদার আত্ম-অভিনন্দন করা ঠিক হবে। বরং তিনি তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন: “এইজন্য আমি কান্নাকাটি ও বিলাপ করব… এর কারণ শমরিয়ার ক্ষত আর ভাল হবে না; তা যিহূদার কাছে এসে গেছে। তা আমার লোকদের ফটক পর্যন্ত, এমন কি, যিরূশালেম পর্যন্ত পৌঁছেছে” (মীখা ১:৮-৯)। যে পাপের কারণে ইস্রায়েলকে (শমরিয়া) ধ্বংস করা হয়েছিল, সেই পাপ ইতিমধ্যে যিহূদার মধ্যেও উপস্থিত, তা নিয়ে মীখা দুশ্চিন্তিত। তিনি যিহূদাকে এই বিষয়ে সাবধানবাণী দেওয়ার জন্য রূপকভাবে পাপকে রোগ, ক্ষত বা দূষণের সঙ্গে তুলনা করেন।
খুবই সরাসরি ও পরিষ্কারভাবে মীখা যিহূদা লোকদের দোষ ধরেন, বিশেষভাবে লোভ ও অন্যায়-লাভের বিষয়: “ধিক্ তাদের, যারা অন্যায়ের পরিকল্পনা করে, যারা নিজেদের বিছানায় মন্দের ফন্দি আঁটে।…তারা ক্ষেত-খামার আর ঘর-বাড়ীর প্রতি লোভ করে তা কেড়ে নেয়। তারা মানুষকে ঠকিয়ে তার ঘর-বাড়ী ও তার জায়গা-জমি নিয়ে নেয়।… যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা লোকদের মত যারা নিশ্চিন্তে পথ চলছে তাদের গা থেকে তোমরা কাপড় খুলে নিচ্ছ” (মীখা ২:১-২,৮)।
মীখা বিশেষভাবে রাজনৈতিক ও আত্মিক নেতাদের চ্যালেঞ্জ করেন: “হে যাকোবের নেতারা, অর্থাৎ ইস্রায়েলের বংশের শাসনকর্তারা, আপনারা শুনুন। আপনাদের কি ন্যায়বিচার সম্বন্ধে জানা উচিত নয়? আপনারা তো ভাল কাজকে ঘৃণা করে মন্দ কাজকে ভালবাসেন; আপনারা আমার লোকদের গা থেকে চামড়া আর হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে নিচ্ছেন… সেখানকার নেতারা ঘুষ খেয়ে বিচার করে, পুরোহিতেরা বেতন নিয়ে শিক্ষা দেয় এবং নবীরা টাকা নিয়ে ভাগ্য গণনা করে।… যে সব নবীরা আমার লোকদের বিপথে নিয়ে গেছে…সেই দর্শনকারীরা লজ্জিত হবে এবং গণকেরা অসম্মানিত হবে। তারা সবাই মুখ ঢাকবে, কারণ ঈশ্বর কোন উত্তর দেবেন না” (মীখা ৩:১-২,১১,৫-৭)। মীখা ধনীদেরও চ্যালেঞ্জ করেন: “যে লোকের কাছে ঠকাবার দাঁড়িপাল্লা ও ওজনে কম বাট্খারা আছে তাকে কি আমি নির্দোষ বলে মনে করব? তোমাদের ধনী লোকেরা অত্যাচারী, তোমরা মিথ্যাবাদী এবং তোমাদের মুখ ছলনার কথা বলে” (মীখা ৬:১১-১২)। যাদের হাতে নেতৃত্ব বা অন্য ধরণের কোনো ক্ষমতা আছে, তাদেরকে আরো কঠোরভাবে বিচার করা হবে, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সাধারণ লোকদের কোনো দোষ নেই: “দেশ থেকে ঈশ্বরভক্তদের মুছে ফেলা হয়েছে; সৎ লোক একজনও নেই। রক্তপাত করবার জন্য সবাই ওৎ পেতে আছে; প্রত্যেকে তার নিজের জালে অন্যকে আট্কাতে চায়। অন্যায় কাজ করতে তাদের দু’হাতই পাকা” (মীখা ৭:২-৩)।
কিন্তু মীখা শুধুমাত্র দোষ ধরতে থাকেন, তা নয়। তিনি তার শ্রোতাদের কাছে ঈশ্বরের হৃদয়ও প্রকাশ করেন এবং তাদেরকে পথ দেখান, ঈশ্বরকে খুশি করার মত একটি জীবন কেমন: “আমি কি নিয়ে সদাপ্রভুর সামনে যাব এবং স্বর্গের ঈশ্বরের উপাসনা করব? আমি কি পোড়ানো-উৎসর্গের জন্য এক বছর বয়সের কতগুলো বাছুর নিয়ে তাঁর সামনে যাব? সদাপ্রভু কি হাজার হাজার ভেড়া কিম্বা দশ হাজার নদী-ভরা জলপাই তেলে খুশী হবেন? আমার অন্যায়ের জন্য কি আমি আমার প্রথম সন্তান, আমার পাপের জন্য আমার শরীরের ফল উৎসর্গ করব? ওহে মানুষ, যা ভাল তা তো তিনি তোমাকে দেখিয়েছেন। ন্যায় কাজ করা, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে ভালবাসা আর তোমার ঈশ্বরের সংগে নম্রভাবে যোগাযোগ-সম্বন্ধ রক্ষা করা ছাড়া সদাপ্রভু তোমার কাছে আর কিছু চান না” (মীখা ৬:৬-৮)।
ইস্রায়েল দেশ ধ্বংস হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে মীখা যিহূদার বিষয়েও বলেন যে, যিহূদাকেও বিচার করে ধ্বংস করা হবে (মীখা ৩:১২)। মীখা হলেন প্রথম ভাববাদী যিনি ঈশ্বরের আদেশে যিহূদাকে এই ধ্বংসবাণী দেন, কিন্তু মীখার পরে আরো ভাববাদীরা ঠিক তা-ই পুনরায় বলেন।
যিহূদার ধ্বংসের ওপারে মীখা একটি চমৎকার পুনরুদ্ধারও দেখেন, যাতে শুধুমাত্র যিহূদাকে পুনরায় স্থাপন করা হবে, তা নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ নতুন যুগ শুরু হবে: “শেষকালে সমস্ত পাহাড়ের মধ্যে সেই পাহাড়টাকেই সবচেয়ে উঁচুতে তোলা হবে… সব জাতি স্রোতের মত তার দিকে যাবে। অনেক জাতির লোক এসে বলবে, “চল, আমরা সদাপ্রভুর পাহাড়ে উঠে যাই, চল, যাকোবের ঈশ্বরের ঘরে যাই। তিনি আমাদের তাঁর পথ সম্বন্ধে শিক্ষা দেবেন আর আমরা তাঁর পথে চলব।” তারা এই কথা বলবে, কারণ সিয়োন থেকে নির্দেশ দেওয়া হবে আর যিরূশালেম থেকে বের হবে সদাপ্রভুর বাক্য” (মীখা ৪:১-২)।
এটি হল একটি অতি আশ্চর্য মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী: ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা দেন যে, তিনি যিরূশালেমে যা করবেন (অর্থাৎ, যীশু ও তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যু) তা সব জাতিদের জন্য কেন্দ্র ও আকর্ষণের বিষয় হয়ে যাবে। যিরূশালেম থেকে ঈশ্বরের বাক্য (অর্থাৎ, সুসমাচার) ছড়িয়ে পড়বে এবং জাতিদেরকে ঈশ্বরের দিক-নির্দেশনা শেখানো হবে। মীখা তার শ্রোতাদের ও পাঠকদের মশীহ সম্বন্ধীয় একটি শক্তিশালী ছবি দেন, যা তাদেরকে আশা দান করবে এবং যার মাধ্যমে তারা বর্তমান জীবন বাধ্যতায় কাটানোর জন্য শক্তি ও অনুপ্রেরণা পাবে।
পুস্তকের লেখক
মীখা নিজের পরিচয় হিসাবে শুধুমাত্র তার গ্রামের নাম মরেষৎ উল্লেখ করেন। সম্ভবত মরেষৎ যিহূদার পশ্চিম দিকের নিচুভূমিতে কৃষি সমৃদ্ধ এলাকায় অবস্থিত একটি গ্রাম ছিল। নিচুভূমিতে থাকা মরেষতের মত গ্রামগুলো ইস্রায়েলের ইতিহাসে প্রায়ই ইস্রায়েলের যুদ্ধ-ক্ষেত্র হয়ে যেত, এই গ্রামগুলোকে বার বার দখল ও লূট করা হত, পরবর্তীতে আবার পুনরুদ্ধার করা হত এবং আবারও শত্রুদের হাতে চলে যেত (উদাহরণ: ২ বংশা ২৮:১৮)। মীখার সময়ে বিশাল আসিরিয়া সাম্রাজ্য আবারও যিহূদার জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে ওঠে, একারণে সম্ভাবনা বেশি যে, মরেষৎ আবারও শত্রুদের হাতে ছিল।
মীখার নামের অর্থ হল ‘কে সদাপ্রভুর মত?’ এবং মীখা পুস্তকে এই কথাটি আসলে পাওয়া যায়: “তোমার মত ঈশ্বর আর কেউ নেই” (মীখা ৭:১৮)। মীখার নাম কোন ঐতিহাসিক লেখায় উল্লেখ নেই বলে তার জীবন সম্বন্ধে আমরা মাত্র জানি যা তার পুস্তকে প্রকাশিত। মীখার শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কেউ তার প্রচার নিয়ে খুশি না: “এই সব কথা বোলো না, এই সব বিষয়ে কোন কথা বোলো না, কারণ আমাদের উপরে অসম্মান আসবে না” (মীখা ২:৬)। কিন্তু মীখা তাদের আপত্তি মেনে নেন না, এর বিপরীতে তিনি দাবি করেন “সরলাচারী লোকের পক্ষে আমার বাক্য সকল কি মঙ্গলজনক নহে?” (মীখা ২:১-১১, কেরী অনুবাদ)। মীখা সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাণী দেন (মীখা ২:১-১১) এবং তিনি নির্ভয়ে নেতাদের দোষ ধরেন (মীখা ৩:১-৪)। কিছু ভাববাদীরা মীখার সাথে দ্বন্দ্ব করে দাবি করে যে, তিনি ঈশ্বরের ভাববাদী নন। কিন্তু মীখা এই বিষয়েও শক্তির সঙ্গে দাবি করেন যে, তার বাণী ঈশ্বর থেকেই: “কিন্তু আমি যাকোবকে তার অন্যায়, ইস্রায়েলকে তার পাপ সম্বন্ধে জানাবার জন্য সদাপ্রভুর আত্মার দেওয়া শক্তিতে, ন্যায়বিচারে ও সাহসে পূর্ণ হয়েছি” (মীখা ৩:৬-৮)। এই ধরণের অপ্রিয় কথা বলার কারণে মীখা অনেক বার হুমকির মুখে পড়েন, যেমন যিরমিয় ২৬:১৮ পদে যেখানে মীখার বিরুদ্ধে একটি মামলা উল্লিখিত।
ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
ভাববাদী মীখা তার বাণীর তারিখ হিসাবে যিহূদার তিনজন রাজাকে উল্লেখ করেন: রাজা যোথম (৭৩৯-৭৩১ খ্রীঃপূঃ), রাজা আহস (৭৩১-৭১৫ খ্রীঃপূঃ) এবং রাজা হিষ্কিয় (৭১৫-৮৬৮ খ্রীঃপূঃ, মীখা ১:১)। এই রাজারা ৭৩৯-৬৮৬ খ্রীষ্টপূর্ব পর্যন্ত রাজত্ব করেন বলে নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় যে, মীখা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বাণী প্রচার করেন।
যোথম রাজা যোথম একজন ভাল রাজা ছিলেন: “এইভাবে যোথম শক্তিশালী হয়ে উঠলেন, কারণ তিনি বিশ্বস্তভাবে তাঁর ঈশ্বর সদাপ্রভুর পথে চলতেন” (২ বংশা ২৭:৬)। তার রাজত্বের সময় থেকে মীখা বাণী দিতে শুরু করেন।
আহস যোথমের ছেলে আহস ছিলেন একজন মন্দ রাজা। তিনি যিহূদায় বাল দেবতার জন্য পূজার স্থান তৈরি করেন, তার ছেলেদের আগুন পুড়িয়ে উৎসর্গ করেন এবং পাহাড়ে ও প্রত্যেকটি সবুজ গাছের নীচে পূজার স্থানে পূজা করতেন (২ বংশা ২৮:১-৪)। ইস্রায়েলের রাজা পেকহ (৭৪০-৭৩২ খ্রীঃপূঃ) তার আগের শত্রু সিরিয়ার রাজা রৎসীনের সাথে মৈত্রী চুক্তি স্থাপন করে একত্রে যিহূদাকে আক্রমণ করে। রাজা আহস ধ্বংসাত্মকভাবে পরাজিত হন। এই যুদ্ধে যিহূদার ১.২ লক্ষ সেনাদের মেরে ফেলা হয় এবং আর ২ লক্ষ যিহূদার লোকদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় (২ বংশা ২৮:৫-৮)। ওদেদ নামে ইস্রায়েলীয় একজন ঈশ্বর ভক্ত লোকের বিনতির কারণে কিছু বন্দীদেরকে যিহূদা দেশে ফেরত পাঠানো হয় (২ বংশা ১৮:৮-১৫)। ভাববাদী যিশাইয় রাজা আহসকে নত হতে ও তার সুরক্ষার জন্য ঈশ্বরের উপরে নির্ভর করতে আদেশ দেন (যিশাইয় ৭:৭-৯) কিন্তু এতে সাড়া না দিয়ে আহস বরং টাকা দিয়ে আসিরিয়ার সাথে মৈত্রী চুক্তি স্থাপন করেন। এই চুক্তি দ্বারা তিনি যিহূদার ধ্বংসের বীজ বপন করেন এবং পরবর্তীতে তা যিহূদার উপরে সর্বনাশ নিয়ে আসে (২ বংশা ২৮:১৬-২৮)। এই সংকটে আহস “রাজা আহস সদাপ্রভুর প্রতি আরও অবিশ্বস্ত হলেন”, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে আসিরিয়ার দেবতার পূজা যিহূদায় স্থাপন করেন, সদাপ্রভুর উপাসনা-ঘর বন্ধ করেন এবং যিরূশালেমের প্রত্যেকটি জায়গায়, রাস্তায় ও মোড়ে দেব-দেবতাদের উদ্দেশ্যে বেদী তৈরি করেন (২ বংশা ২৮:২২-২৭)। মীখা ইস্রায়েলের রাজধানী শমরিয়ার সম্পূর্ণ ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী দেন (মীখা ১:৬-৭)।
ইস্রায়েলের রাজা পেকহ ও সিরিয়ার রাজা রৎসীনের জয় বেশি দিন টিকে না। আসিরিয়ার রাজা তিগ্লৎ-পিলেষর উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করেন এবং ৭৩২ খ্রীষ্টপূর্বে সিরিয়ার রাজধানী দামেষ্ক দখল ও ধ্বংস করেন। আসিরিয়া ইস্রায়েলকেও আক্রমণ ও পরাজিত করে এবং তারা ইস্রায়েলের রাজা হোশেয়কে তাদের অধীনস্থ রাজা হিসাবে ইস্রায়েল দেশের উপর রাজত্ব করতে দেয় (৭৩২-৭২২ খ্রীঃপূঃ)। পরবর্তীতে রাজা হোশেয় যখন আসিরিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, তখন আসিরিয়া রাজা সলমেষর এবং পরবর্তী রাজা সোর্গন-২ ইস্রায়েল ও রাজধানী শমরিয়কে দখল ও সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে, ঠিক যেভাবে ভাববাদী হোশেয়, আমোষ ও মীখা বলেছিলেন। ইস্রায়েল দেশের বেঁচে থাকা লোকদের নির্বাসিত করা হয় এবং জোর করে অন্য জাতিদের সাথে মিশানো হয়। এভাবে তারা জাতি হিসাবে ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে আসিরিয়া ইস্রায়েলের পরে যিহূদাকেও আক্রমণ করে কিন্তু ঈশ্বরের দয়ায় যিহূদা একটুর জন্য রক্ষা পায়।
ইস্রায়েল আর নেই বলে মীখা পরবর্তীতে যিহূদার কাছে ঈশ্বরের বাণী প্রচার করতে শুরু করেন। মীখা মনে করেন না যে, এই রক্ষার কারণে যিহূদার আত্ম-অভিনন্দন করা ঠিক হবে। বরং তিনি তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন: “এইজন্য আমি কান্নাকাটি ও বিলাপ করব… এর কারণ শমরিয়ার ক্ষত আর ভাল হবে না; তা যিহূদার কাছে এসে গেছে। তা আমার লোকদের ফটক পর্যন্ত, এমন কি, যিরূশালেম পর্যন্ত পৌঁছেছে” (মীখা ১:৮-৯)। যে পাপের কারণে ইস্রায়েলকে (শমরিয়া) ধ্বংস করা হয়েছিল, সেই পাপ ইতিমধ্যে যিহূদার মধ্যেও উপস্থিত, তা নিয়ে মীখা দুশ্চিন্তিত। তিনি যিহূদাকে এই বিষয়ে সাবধানবাণী দেওয়ার জন্য রূপকভাবে পাপকে রোগ, ক্ষত বা দূষণের সঙ্গে তুলনা করেন।
হিষ্কিয় আহসের ছেলে হিষ্কিয় হলেন একজন ঈশ্বরীয় রাজা, যিনি তার বাবার মাধ্যমে যিহূদা দেশে আসা ক্ষতি পিছাতে চেষ্টা করেন: তিনি দেবতার মূর্তি, খুঁটি, উঁচু স্থান ও পূজার স্থানগুলো সরান, তিনি সদাপ্রভুর উপাসনা-ঘর পুনরায় খোলেন, পরিষ্কার ও মেরামত করেন, লেবীয় ও পুরোহিতদের জন্য ব্যবস্থাপনা করেন এবং সবাইকে নিয়ে যিরূশালেমে বড় ধরণের নিস্তার-পর্ব পালন করেন। ৭১৫ খ্রীষ্টাব্দে আসিরিয়ার রাজা সনহেরীব যিহূদাকে আক্রমণ করে রাজধানী শহর যিরূশালেম ছাড়া বাকি ৪৬ টি যিহূদার প্রাচীর ঘেরা শহর দখল করেন। যখন তিনি যিরূশালেমকেও আক্রমণ করার হুমকি দেন, তখন হিষ্কিয় তার রাজত্বের সবচেয়ে বড় সংকটের সম্মুখে পড়েন। হিষ্কিয় ঈশ্বরের উপর ভরসা রেখে ভাববাদী যিশাইয়ের বাণীতে (যিশাইয় ৩৭) বাধ্য হয়ে সাহস করেন এবং আসিরিয়ার আত্ম-সমর্পণের দাবি অস্বীকার করেন। ঈশ্বর অলৌকিকভাবে আসিরিয়ার সৈন্যদল পরাজিত করেন (২ বংশা ৩২:১-২৩)।
মীখা কাদের কাছে ভাববাণী দেন?
মীখা তার পুস্তকের শুরুতে (মীখা ১:১) “শমরিয় ও যিরূশালেম”-এর কাছে, অর্থাৎ ইস্রায়েল ও যিহূদার কাছে কথা বলেন। তিনি আত্মিক ব্যভিচারের বিষয়ে, অর্থাৎ দেবতাপূজার জন্য ইস্রায়েল জাতির দোষ ধরেন (মীখা ১:২-৭)। কিন্তু সাথে সাথে তিনি যিহূদাকেও দোষী বলে ধরেন “যাকোবের পাপের জন্য দায়ী কে? শমরিয়া কি নয়? যিহূদার পূজার উঁচু স্থানের জন্য দায়ী কে? যিরূশালেম কি নয়?” (মীখা ১:৫)।
এই পদগুলোর পর থেকে তিনি শুধুমাত্র যিহূদার কাছে কথা বলেন “এর কারণ শমরিয়ার ক্ষত আর ভাল হবে না; তা যিহূদার কাছে এসে গেছে। তা আমার লোকদের ফটক পর্যন্ত, এমন কি, যিরূশালেম পর্যন্ত পৌঁছেছে” (মীখা ১:৯)। যে পাপের কারণে ইস্রায়েলের ক্ষত হয়েছে এবং ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেই একই পাপ ইতিমধ্যে যিহূদাকেও আক্রান্ত করেছে।
মীখা তার পুস্তকে বিভিন্ন দলের কাছে নির্দিষ্টভাবে কথা বলেন: “যারা অন্যায়ের পরিকল্পনা করে” (মীখা ২:১), “ইস্রায়েলের বেঁচে থাকা লোক” বা “বাকি লোক” (মীখা ২:১২, ৪:৮,১৩, ৭:৮,১১), “যাকোব বংশের নেতারা ও শাসনকর্তারা” (মীখা ৩:১-৪,৯), ভ্রান্ত ভাববাদীরা (মীখা ৩:৫), বৈৎলেহম শহর (মীখা ৫:২) এবং সব লোকদের কাছে (মীখা ১:৫-৭,৮-১৬, ৪:৯, ৫:১,১০, ৬:১,৫,৯)। মাঝে মাঝে তিনি চেতনাদায়ক বা চিন্তা ওঠানোর প্রশ্নও করেন (মীখা ৬:৬,৮, ৭:১,৭), এবং মাঝে মাঝে সরাসরি ঈশ্বরের কাছেও কথা বলেন (মীখা ৭:১৪,১৮)।
মীখার সংবাদ
মীখা খুব পরিষ্কার ভাষায়, এমন কি অতি সরাসরিভাবে কথা বলেন এবং লোকদের দোষ ধরেন। তিনি বিশেষভাবে এই বিষয়গুলো নিয়ে তাদের দোষ ধরেন:
লোভ ও অন্যায়-লাভ
ভাববাদী আমোষ ইস্রায়েলের লোকদের যে বিষয়ে দোষ ধরেছিলেন, মীখাও ঠিক সেই একই বিষয়ে যিহূদার লোকদের দোষ ধরেন: “ধিক্ তাদের, যারা অন্যায়ের পরিকল্পনা করে, যারা নিজেদের বিছানায় মন্দের ফন্দি আঁটে …তারা ক্ষেত-খামার আর ঘর-বাড়ীর প্রতি লোভ করে তা কেড়ে নেয়। তারা মানুষকে ঠকিয়ে তার ঘর-বাড়ী ও তার জায়গা-জমি নিয়ে নেয়। … আজকাল আমার লোকেরা শত্রুর মত হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা লোকদের মত যারা নিশ্চিন্তে পথ চলছে তাদের গা থেকে তোমরা কাপড় খুলে নিচ্ছ” (মীখা ২:১-২,৮)। “দুষ্ট লোকদের ঘরে অসৎ উপায়ে পাওয়া ধন-সম্পদ ও ঠকাবার মাপের টুকরি আছে যা আমি ঘৃণা করি। যে লোকের কাছে ঠকাবার দাঁড়িপাল্লা ও ওজনে কম বাট্খারা আছে তাকে কি আমি নির্দোষ বলে মনে করব? তোমাদের ধনী লোকেরা অত্যাচারী, তোমরা মিথ্যাবাদী এবং তোমাদের মুখ ছলনার কথা বলে” (মীখা ৬:২০-১২)। “সেখানকার নেতারা ঘুষ খেয়ে বিচার করে, পুরোহিতেরা বেতন নিয়ে শিক্ষা দেয় এবং নবীরা টাকা নিয়ে ভাগ্য গণনা করে” (মীখা ৩:১১)। এগুলো সব হল মোশির আইন-কানুন ভাঙ্গার বিষয় (দ্বিতীয় বিবরণ ২৫:১৩-১৬, ১৮:১৯ ইত্যাদি)। যখন মানুষ ঈশ্বরের ভক্তি ও তাঁর আইন অগ্রাহ্য করে তখন সব সময় এর সাথে সমাজে বিশৃঙ্খলা, অবিচার, ও অন্যায়ও বাড়ে এবং গরীব ও দুর্বলদের উপরে নির্যাতনও বৃদ্ধি পায়।
নেতৃত্বের ভুল ব্যবহার ও সামাজিক অন্যায়
মীখা বিশেষভাবে উভয় রাজনৈতিক ও আত্মিক নেতাদের দোষ ধরেন: “হে যাকোবের নেতারা, অর্থাৎ ইস্রায়েলের বংশের শাসনকর্তারা, আপনারা শুনুন। আপনাদের কি ন্যায়বিচার সম্বন্ধে জানা উচিত নয়? আপনারা তো ভাল কাজকে ঘৃণা করে মন্দ কাজকে ভালবাসেন; আপনারা আমার লোকদের গা থেকে চামড়া আর হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে নিচ্ছেন; আপনারা আমার লোকদের মাংস খাচ্ছেন, তাদের চামড়া তুলে ফেলে হাড়গুলো টুকরা টুকরা করে ভাঙ্গছেন; আপনারা হাঁড়ির মধ্যেকার মাংসের মত করে তাদের টুকরা টুকরা করে কাটছেন” (মীখা ৩:১-৩)। “সেখানকার নেতারা ঘুষ খেয়ে বিচার করে, পুরোহিতেরা বেতন নিয়ে শিক্ষা দেয় এবং নবীরা টাকা নিয়ে ভাগ্য গণনা করে” (মীখা ৩:১১)। “যে সব নবীরা আমার লোকদের বিপথে নিয়ে গেছে … তোমাদের জন্য অন্ধকার আসছে, তোমরা গণনা করে কিছু বলতে পারবে না। তোমাদের জন্য সূর্য ডুবে যাবে এবং দিন অন্ধকার হয়ে যাবে … তাতে সেই দর্শনকারীরা লজ্জিত হবে এবং গণকেরা অসম্মানিত হবে” (মীখা ৩:৫-৭)। তিনি ধনীদেরও দোষ ধরেন: “যে লোকের কাছে ঠকাবার দাঁড়িপাল্লা ও ওজনে কম বাট্খারা আছে তাকে কি আমি নির্দোষ বলে মনে করব? তোমাদের ধনী লোকেরা অত্যাচারী” (মীখা ৬:১১-১২)। যাদের নেতৃত্ব বা ক্ষমতা আছে তাদেরকে ঈশ্বর আরো কঠোরভাবে তাদের আচার-ব্যবহারের জন্য দায়বদ্ধ রাখবেন। যখন নেতাদের ভক্তির অভাব থাকে এবং যখন তারা তাদের ক্ষমতা, পদ বা ভূমিকা স্বার্থপরভাবে ব্যবহার করেন তখন সমাজে আইন-শৃঙ্খলা ও ন্যায্যতার হৃাস হয়।
তবে মীখা সাধারণ লোকদেরও দোষ ধরেন: “দেশ থেকে ঈশ্বরভক্তদের মুছে ফেলা হয়েছে; সৎ লোক একজনও নেই। রক্তপাত করবার জন্য সবাই ওৎ পেতে আছে; প্রত্যেকে তার নিজের জালে অন্যকে আট্কাতে চায়। অন্যায় কাজ করতে তাদের দু’হাতই পাকা” (মীখা ৭:২-৩)। শুধুমাত্র যদি সমাজের প্রত্যেক স্তরে বা শ্রেণীতে ঈশ্বরের ভক্তিপূর্ণ ভয় কাজ করে তবে একটি সমাজ উন্নত, শান্ত ও স্থির থাকে।
দেবতাপূজারী জাতিদের তুলনায় ঈশ্বরের লোকেরা আর ভিন্ন নয়
কিছু পদগুলোতে মীখা বিশেষভাবে যিহূদার অহংকারকে চ্যালেঞ্জ করেন (মীখা ৩:১-৩)। তিনি নেতাদের বলেন “হে যাকোবের নেতারা, অর্থাৎ ইস্রায়েলের বংশের শাসনকর্তারা, আপনারা শুনুন। আপনাদের কি ন্যায়বিচার সম্বন্ধে জানা উচিত নয়? … আপনারা আমার লোকদের মাংস খাচ্ছেন, তাদের চামড়া তুলে ফেলে হাড়গুলো টুকরা টুকরা করে ভাঙ্গছেন”। হিংস্র ও ঘৃণ্য আসিরিয়া সাম্রাজ্য যুদ্ধে পরাজিত লোকদের জীবিত অবস্থায় চামড়া কেটে খুলে ফেলার জন্য বিখ্যাত ছিল। আসিরিয়ার বিভিন্ন রাজ-প্রাসাদের দেওয়ালে খোদাই করা জয়ের ছবিতে তা দেখা যায় (ডানের ছবি দেখুন)। কিন্তু এখানে মীখা বলেন যে, যিহূদার নেতারা একই হিংস্র কাজ নিজের লোকদের প্রতি করে, যা অতি ধারালো একটি রূপক। মোট কথায় মীখা বলেন যে, সবচেয়ে হিংস্র দেবতাপূজারী জাতির তুলনায় যিহূদা আর ভাল নয়।
মিথ্যা ধার্মিকতা ও প্রতারণা
মীখা বিশেষভাবে কষ্ট পান যে, লোকদের সত্যের প্রতি আর কোনো সমর্পণ নেই: “যদি কোন মিথ্যাবাদী ও ঠগ এসে বলে, ‘আমি বলছি যে, তোমাদের প্রচুর মদ ও আংগুর-রস হবে,’ তবে সে-ই হবে এই জাতির জন্য উপযুক্ত নবী!” (মীখা ২:১১)। “যে সব নবীরা আমার লোকদের বিপথে নিয়ে গেছে তাদের যদি কেউ খেতে দেয় তবে তারা “শান্তি” বলে ঘোষণা করে; কিন্তু যদি খেতে না দেয় তবে তারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত হয়। সেইজন্য সদাপ্রভু সেই নবীদের বলছেন, “তোমাদের জন্য রাত আসছে, তোমরা কোন দর্শন পাবে না; তোমাদের জন্য অন্ধকার আসছে, তোমরা গণনা করে কিছু বলতে পারবে না। তোমাদের জন্য সূর্য ডুবে যাবে এবং দিন অন্ধকার হয়ে যাবে।” তাতে সেই দর্শনকারীরা লজ্জিত হবে এবং গণকেরা অসম্মানিত হবে। তারা সবাই মুখ ঢাকবে, কারণ ঈশ্বর কোন উত্তর দেবেন না” (মীখা ৩:৫-৭)। “সেখানকার … পুরোহিতেরা বেতন নিয়ে শিক্ষা দেয় এবং নবীরা টাকা নিয়ে ভাগ্য গণনা করে। আর তবুও তারা সদাপ্রভুর সাহায্যের আশা করে বলে, “সদাপ্রভু কি আমাদের মধ্যে নেই? আমাদের উপর কোন বিপদ আসবে না” (মীখা ৩:১১-১২)। “তোমরা মিথ্যাবাদী এবং তোমাদের মুখ ছলনার কথা বলে” (মীখা ৬:১২)। এমন লোকের জন্য যিনি সত্য বলতে তার জীবনের মূল কাজ করেছেন, এই ধরণের মনোভাবে একদম কষ্টকর।
মীখার প্রাণবন্ত ভাষা
তার শ্রোতাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য মীখা প্রাণবন্ত ভাষা ব্যবহার করেন।
- তিনি জোরালো উক্তি ব্যবহার করেন: “আমরা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছি; আমাদের জাতির সম্পত্তি নিয়ে নেওয়া হয়েছে। সদাপ্রভু তা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছেন” (মীখা ২:৪)। “হে যাকোবের বংশের নেতারা, ইস্রায়েলের বংশের শাসনকর্তারা … আপনারা তো ন্যায়বিচার তুচ্ছ করছেন এবং যা সোজা তা সবই বাঁকা করে তুলছেন। আপনারা রক্ত দিয়ে সিয়োনকে, অন্যায় দিয়ে যিরূশালেমকে গড়ে তুলছেন” (মীখা ৩:৯-১০)।
- তিনি তার শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করার জন্য অনেক চেতনাদায়ক বা চিন্তা ওঠানোর প্রশ্ন ব্যবহার করেন, যেমন: “যাকোবের পাপের জন্য দায়ী কে? শমরিয়া কি নয়? যিহূদার পূজার উঁচু স্থানের জন্য দায়ী কে? যিরূশালেম কি নয়?” (মীখা ১:৫)। “হে যাকোবের নেতারা, অর্থাৎ ইস্রায়েলের বংশের শাসনকর্তারা, …আপনাদের কি ন্যায়বিচার সম্বন্ধে জানা উচিত নয়?” (মীখা ৩:১)। “কেন তুমি এখন জোরে জোরে কাঁদছ? তোমার কি রাজা নেই? তোমার পরামর্শদাতা কি মরে গেছে? সেইজন্য কি প্রসব-ব্যথায় কষ্ট পাওয়া স্ত্রীলোকের মত ব্যথা তোমাকে ধরেছে?” (মীখা ৪:৯)। “হে আমার লোকেরা, আমি তোমাদের কি করেছি? কিভাবে আমি তোমাদের কষ্ট দিয়েছি? আমাকে উত্তর দাও” (মীখা ৬:৩)। “আমি কি নিয়ে সদাপ্রভুর সামনে যাব এবং স্বর্গের ঈশ্বরের উপাসনা করব? আমি কি পোড়ানো-উৎসর্গের জন্য এক বছর বয়সের কতগুলো বাছুর নিয়ে তাঁর সামনে যাব? সদাপ্রভু কি হাজার হাজার ভেড়া কিম্বা দশ হাজার নদী-ভরা জলপাই তেলে খুশী হবেন? আমার অন্যায়ের জন্য কি আমি আমার প্রথম সন্তান, আমার পাপের জন্য আমার শরীরের ফল উৎসর্গ করব?” (মীখা ৬:৬-৭)।
- মীখা শব্দ ও শব্দের অর্থ নিয়ে খেলা করেন। মীখা ১:১০-১৩ পদে আসিরিয়দের আক্রমণের একটি বর্ণনা দেওয়ার জন্য মীখা যিহূদার বিভিন্ন ছোট শহর ও গ্রামের নাম উল্লেখ করেন এবং নামগুলো অর্থ অনুসারে ব্যবহার করেন (মীখার গ্রাম মোরেষেতের কাছাকাছি উল্লিখিত গ্রামগুলো অবস্থিত ছিল)।
- গাত (অর্থ: কান্নাকাটি) > “গাতে কান্নাকাটি কর না”
- বৈৎ-লি-অপ্রা (অর্থ: ধূলার বাড়ি) > “বৈৎ-লি-অফ্রাতে ধুলায় গড়াগড়ি দাও”
- শাফির (অর্থ: কাপড় কেড়ে নেওয়া) > “তোমরা উলংগ ও লজ্জিত হয়ে চলে যাও”
- সানন (অর্থ: নড়ানো) > “তারা বের হয়ে আসতে পারবে না”
- বৈৎ-এৎসল (অর্থ: ? এর বাড়ি) > “বিলাপ; সে আর তোমাদের পক্ষে দাঁড়াবে না”
- এই ধরণের ভাষায় বাংলাদেশে শুনতে এমন হতে পারে: ‘সদাপ্রভু বলেন “আমি রাঙ্গামাটির মাটি রক্তে লাল করে ফেলব, আমি ঢাকা ক্রোধে ঢেকে দেব, আমি চট্টগ্রাম ছোট গ্রাম বানাব”‘।
- এছাড়া মীখা আর একটি নাটকীয় পদ্ধতি ব্যবহার করেন: আদালতে মামলা (courtroom oracle, মীখা ৬:১-১৬): “হে মীখা, তুমি উঠে দাঁড়িয়ে পাহাড়-পর্বতের সামনে তোমার মামলা উপস্থিত কর; তোমার যা বলবার আছে তা পাহাড়গুলো শুনুক”। এখানে ঈশ্বর হলেন বাদী, ইস্রায়েল হল আসামী। বাদী তার মামলা বা দোষারোপ ঘোষণা করেন (মীখা ৬:৩), পরবর্তীতে দোষারোপ সমর্থন করার জন্য তদন্তের প্রমাণ দেখানো হয় (মীখা ৬:৪-১৬), এর পরে একটি রায় ঘোষণা করা হয় (মীখা ৬:১৬খ)। ঈশ্বর হলেন একই সাথে বিচারক, বাদী ও রায় বাস্তবায়নকারী। মামলায় ঈশ্বর যিহূদার দোষ স্থির করেন। আদালতে মামলা, এই নাটকীয় পদ্ধতি হল শক্তিশালী উপায়, বিশেষভাবে এমন সময়ে যখন আদালতে বিচারকেরা দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন।
মীখা পথ দেখান
কিন্তু মীখা শুধুমাত্র তার শ্রোতাদের দোষ ধরতে থাকেন, তা নয়। তিনি তাদের কাছে ঈশ্বরের হৃদয়ও প্রকাশ করেন এবং তাদেরকে পথ দেখান, ঈশ্বরকে খুশি করার মত একটি জীবন কেমন। মীখার সেই অতি চমৎকার ও পরিচিত কথা দিয়ে তিনি শ্রোতাদের অন্তর স্পর্শ করতে চান, তাদের অনুপ্রেরণাও দিতে চান: “আমি কি নিয়ে সদাপ্রভুর সামনে যাব এবং স্বর্গের ঈশ্বরের উপাসনা করব? আমি কি পোড়ানো-উৎসর্গের জন্য এক বছর বয়সের কতগুলো বাছুর নিয়ে তাঁর সামনে যাব? সদাপ্রভু কি হাজার হাজার ভেড়া কিম্বা দশ হাজার নদী-ভরা জলপাই তেলে খুশী হবেন? আমার অন্যায়ের জন্য কি আমি আমার প্রথম সন্তান, আমার পাপের জন্য আমার শরীরের ফল উৎসর্গ করব? ওহে মানুষ, যা ভাল তা তো তিনি তোমাকে দেখিয়েছেন। ন্যায় কাজ করা, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে ভালবাসা আর তোমার ঈশ্বরের সংগে নম্রভাবে যোগাযোগ-সম্বন্ধ রক্ষা করা ছাড়া সদাপ্রভু তোমার কাছে আর কিছু চান না” (মীখা ৬:৬-৮)।
মীখার এই উক্তি “আমার অন্যায়ের জন্য কি আমি আমার প্রথম সন্তান, আমার পাপের জন্য আমার শরীরের ফল উৎসর্গ করব?” শুধুমাত্র যে রূপক অর্থের, তা নয়। ইতিমধ্যে রাজা আহস যিরূশালেমের দেওয়ালের বাইরে হিন্নম উপত্যকায় তার ছেলেদের “আগুনে পুড়িয়ে উৎসর্গ” করতেন (২ বংশা ২৮:৩)। পরবর্তীতে রাজা হিষ্কিয় পূজার স্থানটি ধ্বংস করেন কিন্তু মন্দ রাজা মনঃশি ও আমোনের সময় এই অতি মন্দ পূজা (মোলক পূজা) পুনরায় চালিত হয় এবং যিরমিয় এর বিরুদ্ধে আবার ধ্বংস বাণী ঘোষণা করেন (যির ১৯:৫)। আজকের দিন পর্যন্ত পৃথিবীর কিছু জায়গায় গোপনে শিশু উৎসর্গ চালিত রয়েছে।
মীখার বিচার বাণী
মীখা প্রথমে উত্তরের ইস্রায়েল দেশ ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী দেন (মীখা ১:৬-৭), যা অল্প কিছু বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ৭২২ খ্রীষ্টপূর্বে পূর্ণ হয়। এর পরবর্তীতে মীখা সবাইকে আকস্মিকভাবে বলেন যে, যিহূদাও ধ্বংস হয়ে যাবে: “কাজেই আপনাদের জন্য সিয়োনকে ক্ষেতের মত করে চাষ করা হবে, যিরূশালেম হবে ধ্বংসের স্তূপ, আর উপাসনা-ঘরের পাহাড়টা ঘন ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা পড়বে।” (মীখা ৩:১২)। “হে সিয়োন-কন্যা, প্রসব-ব্যথায় কষ্ট পাওয়া স্ত্রীলোকের মত তুমি ব্যথায় মোচড়াও, কারণ … তুমি বাবিলে যাবে” (মীখা ৪:১০)।
মীখা হলেন প্রথম ভাববাদী যিনি যিহূদার ধ্বংসের এই অপ্রিয় ভবিষ্যদ্বাণী দেন, তবুও তার পরে আরো বেশ কয়েকজন ভাববাদী এই একই সংবাদ ঘোষণা করেন। প্রকৃতপক্ষে মীখা এমন একটি সময়ে বাবিলীয়দের দ্বারা যিহূদা ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করেন যখন বাবিল তখনও ক্ষমতাশালী দেশ হয়ে ওঠে নি। যিহূদার ধ্বংসবাণীটি ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে পূর্ণ হয় যখন বাবিল যিহূদা, যিরূশালেম এবং উপাসনা-ঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এবং বেঁচে থাকা লোকদের বাবিলে নির্বাসিত করে।
মীখা পুস্তকে একটি ভয়ংকর অথচ লক্ষণীয় পুনরুক্তি বিষয় দেখা যায়: যিহূদার লোকদের পাপের সাথে হুবহু মিল রেখে ঈশ্বর তাদেরকে বিচার করবেন। এতে তাঁর ন্যায্যতা প্রকাশ পায়:
- মীখা ২:২ “তারা ক্ষেত-খামার আর ঘর-বাড়ীর প্রতি লোভ করে তা কেড়ে নেয়। তারা মানুষকে ঠকিয়ে তার ঘর-বাড়ী ও তার জায়গা-জমি নিয়ে নেয়।”
> মীখা ২:৪ “আমাদের জাতির সম্পত্তি নিয়ে নেওয়া হয়েছে। সদাপ্রভু তা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছেন। আমাদের ক্ষেত-খামার তিনি বিশ্বাসঘাতকদের দিয়ে দিয়েছেন।” - মীখা ২:৮ “যারা নিশ্চিন্তে পথ চলছে তাদের গা থেকে তোমরা কাপড় খুলে নিচ্ছ।”
> মীখা ১:১১ “হে শাফীরে বাসকারী লোকেরা, তোমরা উলংগ ও লজ্জিত হয়ে চলে যাও।” - মীখা ৩:১ তার পুস্তকটিতে মীখা অথবা ঈশ্বর ৭ বার লোকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য বলেন “ওহে শুন! কান দাও!” (মীখা ১:২, ৩:১,৪,৯, ৬:১,২,৯, ৭:৭) কিন্তু তারা কোনভাবে সাড়া দেয় না।
> মীখা ৩:৪ “সময় আসছে যখন আপনারা সদাপ্রভুর কাছে কান্নাকাটি করবেন, কিন্তু তিনি আপনাদের উত্তর দেবেন না। সেই সময় তিনি আপনাদের দিক থেকে নিজের মুখ ফিরিয়ে রাখবেন, কারণ আপনারা মন্দ কাজ করেছেন।” - মীখা ২:৬,১১ “এই সব কথা বোলো না, এই সব বিষয়ে কোন কথা বোলো না, কারণ আমাদের উপরে অসম্মান আসবে না।”
> মীখা ৩:৬-৭ “তোমাদের জন্য রাত আসছে, তোমরা কোন দর্শন পাবে না … তারা সবাই মুখ ঢাকবে, কারণ ঈশ্বর কোন উত্তর দেবেন না।” - মীখা ৩:৫ “যে সব নবীরা আমার লোকদের বিপথে নিয়ে গেছে।”
> মীখা ৭:৪-৫ “তোমাদের শাস্তির দিন এসে পড়েছে। এখনই তোমাদের বুদ্ধিহারা হওয়ার সময়। … কোন বন্ধুর উপর বিশ্বাস স্থাপন কোরো না।”
মীখার উদ্ধার বাণী
মীখা বিচারের ওপারে ঈশ্বরের পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনাও দেখেন। উদ্ধারের বিষয়ে তিনি কয়েকটি ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী দেন:
১। বাবিলের নির্বাসনের পরে ঈশ্বর যিহূদাকে পুনরায় স্থাপন করবেন
উত্তরের ইস্রায়েল দেশের জন্য নয় কিন্তু যিহূদার জন্য ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা করেন যে, ঈশ্বর তাঁর জাতির নির্বাসিত লোকদের পুনরায় জোর করে প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরিয়ে এনে পুনরুদ্ধার করবেন: “হে যাকোব, আমি নিশ্চয়ই তোমাদের সবাইকে জড়ো করব; আমি অবশ্যই ইস্রায়েলের বেঁচে থাকা লোকদের একত্র করব। বস্রার ভেড়াগুলোর মত করে … তাদের একত্র করব; দেশটা আবার লোকে ভরে যাবে।” বন্দীদশা থেকে ফিরে আসবার জন্য যিনি পথ খুলে দেবেন তিনি তাদের আগে আগে যাবেন … সদাপ্রভু, যিনি তাদের রাজা, তিনি তাদের আগে আগে যাবেন” (মীখা ২:১২-১৩)। এই ‘বেঁচে থাকা লোকেরা’ বা ‘বাকি লোকেরা’ সিনাই পাহাড়ে ফিরে এসে সেখানে স্থাপিত হবে (মীখা ৪:৬-৮)। যত জাতি যিহূদার পতনের সময় আনন্দ করেছিল তারা লজ্জিত হবে (মীখা ৩:১১-১৩, ৭:৮-১০)।
উদ্ধারের এই ভবিষ্যদ্বাণী ৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে পূর্ণ হয় যখন যিহূদীরা ৭০ বছর বাবিলের নির্বাসনে থাকার পরে সরুব্বাবিলের নেতৃত্বে (দায়ূদের একজন বংশধর) নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি পায় (ইষ্রা ১)।
যিহূদার পুনরুদ্ধারের বিষয়ে মীখা অনেক বার ‘বেঁচে থাকা লোক’ বা ‘বাকি লোক’ নিয়ে কথা বলেন। ইব্রীয় যে শব্দটি মীখা ব্যবহার করেন (H7611, ইংরেজিতে ‘remnant’) এর অর্থ হল ‘থেকে যাওয়া, বেঁচে থাকা, বাকি থাকা, বড় দলের সেই অল্পজন এখনও আছে’। ‘বাকি লোকেরা’ বললে তিনি ঈশ্বরের জাতির মধ্যে এমন লোকদের বুঝান যারা প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর ভক্ত, তাঁর বাণী মানে, যারা বাধ্য ও বিশ্বস্ত হতে থাকে যদিও দেশ হিসাবে যিহূদার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। তারা সেই লোকেরা যারা নির্বাসনেও ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে, যারা তার পুনরুদ্ধারের বাণী বিশ্বাসের সাথে ধরে রাখে এবং যখন প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ আসবে, সেখানে তারা ঈশ্বরের বাক্য অনুসারে ফিরে যাবে।
মীখা বলেন যে ঈশ্বরের উদ্ধারের প্রতিজ্ঞা সব রক্ত-মাংস যিহূদীদের জন্য না বরং সেই ‘বাকি লোকদের’ জন্য। তিনি তাদেরই সম্বন্ধে বলেন: “হে যাকোব, আমি নিশ্চয়ই তোমাদের সবাইকে জড়ো করব; আমি অবশ্যই ইস্রায়েলের বেঁচে থাকা লোকদের একত্র করব” (মীখা ২:১২), “আমি খোঁড়াদের বাঁচিয়ে রাখব এবং তাড়িয়ে দেওয়া লোকদের করব একটা শক্তিশালী জাতি”(মীখা ৪:৭)। ঈশ্বর বাকি লোকদের পাপ ক্ষমা করবেন “তোমার মত ঈশ্বর আর কেউ নেই যিনি তাঁর বেঁচে থাকা লোকদের পাপ ও অন্যায় ক্ষমা করে দেন” (মীখা ৭:১৮)। ‘বাকি লোকেরা’ শক্তিশালী হবে: “যাকোবের বেঁচে থাকা লোকেরা হবে … সিংহের মত” (মীখা ৫:৮) এবং তারা অন্য জাতিদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হবে “অনেক জাতির মধ্যে যাকোবের বেঁচে থাকা লোকেরা হবে সদাপ্রভুর কাছ থেকে আসা শিশিরের মত” (মীখা ৫:৭)। কিভাবে ‘বাকি লোকেরা’ সব জাতিদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হবে?
২। ঈশ্বর আরো বড় একটি পুনরুদ্ধার ঘটাবেন, এমন কি একটি সম্পূর্ণ নতুন যুগ নিয়ে আসবেন
নির্বাসিত যিহূদীরা প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে যেতে পারবে এবং আবার আগের মত সেখানে থাকবে, এর চেয়েও বড় কিছু মীখা দেখেন। তিনি বাণী দেন যে ঈশ্বর মানুষের পাপ ও অন্যায়, এই সমস্যা একটি সম্পূর্ণ নতুন স্তরে সমাধান করবেন “তোমার মত ঈশ্বর আর কেউ নেই যিনি তাঁর বেঁচে থাকা লোকদের পাপ ও অন্যায় ক্ষমা করে দেন। তুমি চিরকাল ক্রোধ পুষে রাখ না বরং তোমার অটল ভালবাসা দেখাতে আনন্দ পাও। তুমি আবার আমাদের উপর মমতা করবে; তুমি আমাদের সব পাপ পায়ের তলায় মাড়াবে এবং আমাদের সব অন্যায় সাগরের গভীর জলে ফেলে দেবে। অনেক অনেক দিন আগে তুমি আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে যেমন শপথ করেছিলে তেমনিভাবেই তুমি অব্রাহাম ও যাকোবের বংশের কাছে বিশ্বস্ত থাকবে এবং তোমার অটল ভালবাসা দেখাবে” (মীখা ৭:১৮-২০)।
তা কিভাবে ঘটবে? “শেষকালে সমস্ত পাহাড়ের মধ্যে সেই পাহাড়টাকেই সবচেয়ে উঁচুতে তোলা হবে। … সব জাতি স্রোতের মত তার দিকে যাবে। অনেক জাতির লোক এসে বলবে, “চল, আমরা সদাপ্রভুর পাহাড়ে উঠে যাই … তিনি আমাদের তাঁর পথ সম্বন্ধে শিক্ষা দেবেন আর আমরা তাঁর পথে চলব।” তারা এই কথা বলবে, কারণ সিয়োন থেকে নির্দেশ দেওয়া হবে আর যিরূশালেম থেকে বের হবে সদাপ্রভুর বাক্য” (মীখা ৪:১-২)।
এই অতি চমৎকার মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণীতে যিরূশালেমে ঈশ্বর যা ঘটাবেন (যীশুর ক্রুশীয় মৃত্যু) তা দেখান, যা দ্বারা তিনি পাপের সমস্যা একেবারে সমাধান করবে। যিরূশালেমে পাপ থেকে সেই উদ্ধার সব জাতিদের আকৃষ্ট করবে। যিরূশালেম থেকে ঈশ্বরের বাণী বের হয়ে ছড়িয়ে পড়বে (সুসমাচার) এবং ঈশ্বরের শিক্ষা ও তার পথ বুঝার ক্ষমতা সব জাতিদেরকে দেওয়া হবে।
প্রকৃতপক্ষে, মীখার ‘অন্যান্য জাতিদের’ সম্বন্ধে অনেক কিছু বলার আছে: তিনি জানেন যে জাতিরা নিজের দেবতাপূজায় আটকিয়ে আছে “সব জাতিরা তাদের দেব-দেবতার শক্তিতে কাজ করলেও …” (মীখা ৪:৫)। অনেক জাতি ঈশ্বরের জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে “কিন্তু এখন অনেক জাতি তোমার বিরুদ্ধে জড়ো হয়েছে” (মীখা ৪:১১)। কিন্তু ঈশ্বর জাতিদের কাছে কথা বলবেন “ওহে জাতিরা, তোমরা সবাই কান দাও; হে পৃথিবী ও তার মধ্যেকার সব কিছু, শোন” (মীখা ১:২) এবং ঈশ্বর নিশ্চিত করবেন যে অন্যান্য জাতিগুলোও ঈশ্বরের প্রকাশ, শিক্ষা ও ঈশ্বরের কাছে আসার সুযোগ পাবে: “অনেক জাতির লোক এসে বলবে, “চল, আমরা সদাপ্রভুর পাহাড়ে উঠে যাই … তিনি আমাদের তাঁর পথ সম্বন্ধে শিক্ষা দেবেন আর আমরা তাঁর পথে চলব।” … সিয়োন থেকে নির্দেশ দেওয়া হবে আর যিরূশালেম থেকে বের হবে সদাপ্রভুর বাক্য” (মীখা ৪:১-২)। শেষকালে ঈশ্বর জাতিদের বিচার করবেন এবং শান্তি ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করবেন “তিনি জাতিদের মধ্যে বিচার করে দেবেন এবং দূরের শক্তিশালী লোকদের মধ্যে আপোষ-মীমাংসা করবেন। … এক জাতি অন্য জাতির বিরুদ্ধে আর তলোয়ার উঠাবে না; তারা আর যুদ্ধ করতে শিখবে না” (মীখা ৪:৩)।
মীখা তার শ্রোতা ও পাঠকদের কাছে মশীহের যুগ সম্বন্ধে একটি শক্তিশালী রূপক বর্ণনা করেন: মশীহ কি বলবেন এবং কি অর্জন করবেন। এভাবে মীখা শ্রোতা ও পাঠকদের একটি চমৎকার আশা দেন যার শক্তিতে তারা বর্তমান যুগে ঈশ্বরের বাধ্যতায় জীবন-যাপন করার জন্য অনুপ্রেরণা পাবে।
পরিশিষ্ট – যিশাইয় ও মীখার বাণীর মধ্যে মিল
যেহেতু, মীখা ও যিশাইয় সমসাময়িক ভাববাদী এবং দু’জনই যিহূদার কাছে কথা বলেন, সেহেতু অবাক লাগে না যে তাদের বাণীতে ও লেখায় বেশ মিল পাওয়া যায়। এ কারণে কেউ কেউ মীখা পুস্তককে ‘ছোট যিশাইয়’ পুস্তক বলে থাকে।
- মীখা ও যিশাইয় উভয় ইস্রায়েলের বিচার ও যিহূদার সমস্যা নিয়ে কথা বলেন।
- ঈশ্বর আর উত্তর দিচ্ছেন না (বিশেষভাবে নেতাদের কাছে)। মীখা ৩:৪-৭ যিশাইয় ১:১৫
- যিহূদার দোষ হিসাবে দুর্বলদের প্রতি অন্যায়ের উল্লেখ। মীখা ৩:১-৩, ৭:৩-৪ যিশাইয় ১০:১-৩
- ভ্রান্ত নবীদের বিরুদ্ধে বাণী। মীখা ৩:১১ যিশাইয় ২৮:৭
- গুরুত্বের সঙ্গে বলেন যে, ঈশ্বর ছাড়া কোনো পরিত্রাণ নেই। মীখা ৭:১৮-২০ যিশাইয় ৪৩:২৫
- যিহূদাকে বিচার করা হবে কিন্তু পরে একটি পুনরুদ্ধার থাকবে। মীখা ৪:১০ যিশাইয় ৪০-৬৬
- মশীহের ভবিষ্যৎ রাজত্বের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী। মীখা ৪:১-১০, ১১:১-৯ যিশাইয় ২:১-৪
- মশীহ ‘রাজনৈতিক উদ্ধারকর্তা মাত্র’ নন। মীখা ৪:২ যিশাইয় ৫৩
- যীশুর জন্মের উল্লেখ। মীখা ৫:২ যিশাইয় ৯:৬
- ঈশ্বরকে রাখাল হিসাবে বর্ণনা। মীখা ৫:৪ যিশাইয় ৪০:১১
- ‘বাকি লোক’দের জন্য আশা ও পুনরুদ্ধারের প্রতিজ্ঞা।