ভাববাদী যিশাইয় তার বাণীর মধ্য দিয়ে যিহূদাকে নিশ্চয়তা দেন যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরই তাঁর প্রতিজ্ঞা অনুসারে দেশের সুরক্ষা, লোকদের পরিত্রাণ এবং প্রতিজ্ঞাত উদ্ধারকর্তা মশীহকে দান করবেন। এই নিশ্চয়তার আলোকে তিনি যিহূদার রাজাদের ও লোকদের চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা দেবতাপূজা ও শক্তিশালী দেশের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির উপর মিথ্যা ভরসা না রেখে বরং ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখেন।
যিহূদার রাজা উষিয়, যোথন, আহস, হিষ্কিয় ও মনঃশির রাজত্বের সময়ে (৭৩৯-৬৮৬ খ্রীঃপূঃ) ঈশ্বর যিশাইয়কে যিহূদা জাতির ভাববাদী হিসাবে আহ্বান করেন। যিশাইয় প্রায় ষাট বছর ধরে ঈশ্বরের পক্ষে কথা বলেন। তিনি ভাল রাজাদের নেতৃত্বে (উষিয়, যোথন, হিষ্কিয়) দেশকে উন্নত হতে দেখেন এবং খারাপ রাজাদের নেতৃত্বে (আহস, মনঃশি) দেশকে দুরাবস্থায় পড়তে দেখেন। যিশাইয়ের পরিচর্যার শুরুর দিকে যিহূদা রাজ্য ইস্রায়েল ও উত্তরের অরাম (সিরিয়া) রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যখন শক্তিশালী ও হিংস্র আসিরিয়া সাম্রাজ্য ইস্রায়েল ও অরামকে দখল ও নির্বাসিত করে তখন যিহূদাও আসিরিয়ার হুমকির সম্মুখে পড়ে। আসিরিয়া যিহূদা দেশের বড় একটি অংশ দখল করে এবং অনেক লোকদেরকে নির্বাসনে নিয়ে যায়।
এই ধরণের অস্থির পরিস্থিতিতে যিহূদা (ছোট জাতি হিসাবে) বড় জাতিদের সাথে মৈত্রী চুক্তি স্থাপন করার জন্য অনেক প্রলোভিত হয়। কিন্তু যিশাইয় বার বার সাবধানবাণী দেন যেন যিহূদা তা না করে। ভয়ংকর সাম্রাজ্যের সম্মুখে পড়ার কারণ কি? যিশাইয় স্পষ্টভাবে বলেন যে তার কারণ এই নয় যে যিহূদার সামরিক ক্ষমতা ও লোকসংখ্যা কম বরং তার কারণ হল যে তারা ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য নয়। ঈশ্বর নিজেই অনুমতি দিয়েছেন যে এই ধরণের ভয়ংকর সাম্রাজ্য সামরিক হুমকিস্বরূপ হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যে মোশির আইন-কানুনে ঈশ্বর স্পষ্টভাবে বলেছিলেন: “যদি তোমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভুর কথায় কান না দাও… সদাপ্রভু এমন করবেন যাতে তোমরা তোমাদের শত্রুদের সামনে হেরে যাও। তোমরা এক দিক দিয়ে তাদের আক্রমণ করবে কিন্তু তাদের সামনে থেকে পালিয়ে যাবে সাত দিক দিয়ে” (২য় বিবরণ ২৮:১৫,২৫)। ঈশ্বর আগে থেকে বলেছিলেন যে তাঁর জাতিকে অুতাপের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি কৌশল হবে তাদেরকে সামরিক হুমকির সম্মুখে পড়তে দেওয়া। ইস্রায়েল জাতির মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্যই ঈশ্বর তাদের আংশিকভাবে বিচার করেন এবং এর মাধ্যমে তিনি তাদেরকে অনুতপ্ত হওয়ার ডাক দেন। তাই যখন শক্তিশালী আসিরিয়া সাম্রাজ্য হুমকি হয়ে দেখা দেয় তখন যিহূদার কোন রাজনৈতিক চুক্তির উপরে ভরসা রাখার চেয়ে বরং দেবতাপূজা থেকে মন ফিরিয়ে জীবন্ত ঈশ্বরকে অন্বেষণ করা উচিত, যাঁর প্রকৃতভাবে উদ্ধার করার ক্ষমতা আছে।
এই সংবাদ দেওয়া দ্বারা যিশাইয় যিহূদার কয়েকজন রাজাকে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি রাজা আহসকে নিশ্চয়তা দেন যে ইস্রায়েল ও অরামের হুমকিকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই: “এই যুদ্ধ হবেও না, ঘটবেও না… ইফ্রয়িম এমনভাবে ধ্বংস হবে যে, জাতি হিসাবে সে আর থাকবে না… তোমাদের বিশ্বাসে যদি তোমরা স্থির হয়ে না থাক তবে তোমরা কোনমতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না” (যিশাইয় ৭:৭-৮)। কিন্তু রাজা আহস প্রয়োজনীয় সাহস এনে বিশ্বাসে দাঁড়াতে সক্ষম হন না বরং তিনি রাজনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নেন এবং পরবর্তীতে পরাজিত হয়ে যান।
প্রায় ত্রিশ বছর পরে রাজা হিষ্কিয় আহসের চেয়ে আরো বড় একটি হুমকির সম্মুখে পড়েন: আসিরিয়া যিহূদার একটি বড় অংশ এবং সাথে ৪৬টি প্রাচীরযুক্ত শহর দখল করে। আসিরিয়া এখন যিরূশালেম শহর দখল করতে আসে, শুধুমাত্র শহর যর এখনও তাদের অধীনের আসে নি। এভাবে আসিরিয়া যিহূদার রাজা হিষ্কিয়কে চাপ প্রয়োগ করে আত্ম-সমর্পণ দাবি করে। হিষ্কিয় এই মহাসংকটে ঈশ্বরকে ডাকেন। ঈশ্বরের আদেশে ভাববাদী যিশাইয় রাজা হিষ্কিয়কে আসিরিয়ার রাজা সম্বন্ধীয় একটি বাণী দেন: “সদাপ্রভু বলেছেন, ‘তুমি যা শুনেছ… তাতে ভয় পোয়ো না। শোন, আমি তার মধ্যে এমন একটি মনোভাব সৃষ্টি করব যার ফলে সে একটা সংবাদ শুনে নিজের দেশে ফিরে যাবে, আর সেখানে আমি তাকে তলোয়ারের ঘায়ে শেষ করে দেব” (যিশাইয় ৩৭:৫-৭)। রাজা আহস বিশ্বাসে দাঁড়াতে পারেন নি, কিন্তু রাজা হিষ্কিয় ঈশ্বরের এই প্রতিজ্ঞার উপর বিশ্বাস রেখে আত্ম-সমর্পণের দাবি অগ্রাহ্য করেন। ঈশ্বর তাঁর প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করে তাকে আশ্চর্যভাবে উদ্ধার করেন: আসিরিয়ার রাজা সনহেরীব তার নিজের দেশে ফিরে যান এবং সেখানে তার দুইজন ছেলে তাকে হত্যা করেন (৬৮১ খ্রীষ্টপূর্ব)।
বর্তমান রাজনৈতিক ঘটনাগুলো সম্বন্ধীয় যিশাইয়ের এই অল্প-মেয়াদী ভবিষ্যদ্বাণীগুলো যখন সবার চোখের সামনে পূর্ণ হয় (যিশাইয় ১-৩৯) তখন যিশাইয় একজন সত্যিকার ভাববাদী হিসাবে প্রমাণিত হন (২য় বিবরণ ১৮:২২)। যিশাইয়ের অল্পমেয়াদী ভিবষ্যদ্বাণীগুলো পূর্ণ হয়েছে বলে তার দীর্ঘ-মেয়াদী ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর (যিশাইয় ৪০-৬৬) বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রমাণিত হয়েছে। যিশাইয়ের সমসাময়িক শ্রোতারা এবং তার পুস্তকের পরবর্তী যুগের পাঠকেরা সবাই তা দেখে জানবে যে সেই দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যদ্বাণীগুলোও বিশ্বাসযোগ্য। তা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ সব ভাববাদীদের মধ্যে যিশাইয়েরই কাছে ঈশ্বর সবচেয়ে নির্দিষ্ট ও বিস্তারিত মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী দেন।
যিশাইয় ঘোষণা করেন যে ঈশ্বর ভবিষ্যতে একটি সম্পূর্ণ “নতুন কাজ” (যিশাইয় ৪৩:১৯) করতে যাচ্ছেন। তিনি একটি অদ্বিতীয় পুনরুদ্ধার ও একটি সান্ত্বনা, নিরাপত্তা ও সুঅবস্থার যুগ স্থাপন করবেন। যিশাইয় ঘোষণা করেন যে ঈশ্বর একজনকে পাঠাবেন যাঁকে “সদাপ্রভুর দাস” বলা হয়। “সদাপ্রভুর দাস” সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণীগুলো কাকে বুঝায়? প্রথমত তা ইস্রায়েল জাতি নিজেকে বুঝায়, তারাই “সদাপ্রভুর দাস”। দ্বিতীয়ত তা কোরস নামে মাদিয়-পারস্যদের একজন সামরিক উদ্ধারকর্তাকে বুঝায় (যিশাইয় ৪৪:২৬-৪৫:৭), কিন্তু চূড়ান্তভাবে তা মশীহকে বুঝায়।
যিশাইয় মশীহকে এভাবে বর্ণনা করেন: তিনি সত্যিই ঈশ্বরের সেবক, তিনি নম্র, বিশ্বস্ত, তিনি সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের উপর ভরসা রাখেন এবং অন্যদের জন্য কষ্টভোগ করতে রাজি। “সদাপ্রভুর দাস” হলেন সেই প্রতিজ্ঞাত উদ্ধারকর্তা যিনি ভবিষ্যতে আসবেন। কিন্তু যারা এই বর্তমান যুগে ঈশ্বরকে অন্বেষণ করে তাদের জন্যও তিনি আদর্শ হন। “সদাপ্রভুর দাস”এর আচরণ বা চরিত্র হল সেই আচরণ বা চরিত্র যা ঈশ্বর তাঁর সব অনুসরণকারীদের মধ্যে দেখতে আশা করেন: নম্রতা, শুধুমাত্র ঈশ্বরেরই উপর ভরসা, অন্যদের সেবা করার আগ্রহ এবং ঈশ্বরের উপর গভীর বিশ্বাস। চূড়ান্তভাবে মশীহ নিজেই, কিন্তু তাঁর অনুসরণকারীরাও হবেন “জাতিদের কাছে আলো” (যিশাইয় ৪৯:৬)।
লেখক যিশাইয়
লেখক নিজেকে “আমোসের ছেলে যিশাইয়” হিসাবে পরিচয় দেন (যিশাইয় ১:১, ২:১)। তার বাবার নামের বানান ভাববাদী আমোষের চেয়ে ভিন্ন এবং এই নামে বাইবেলে আর কাউকে উল্লেখ করা হয় নি। তাই এটি থেকে নতুন তথ্য পাওয়া যায় না। যিশাইয়ের নামের অর্থ হল ‘ইয়াওয়ে উদ্ধার করেছেন’। যিশাইয় ৩০:৮ পদে ঈশ্বর যিশাইয়কে সব বাণীগুলো একটি পুস্তকে লিখে রাখতে বলেন: “তুমি এখন এই কথা একটা ফলকে ও একটা বইয়ে লিখে রাখ, যেন আগামী দিনগুলোতে সেটা ইস্রায়েলীয়দের জন্য একটা চিরস্থায়ী সাক্ষ্য হয়ে থাকে”, ফলে আমরা যিশাইয় নামে একটি পুস্তক পাই।
যিশাইয় পুস্তকের দ্বিতীয় অংশে (যিশাইয় ৪০-৬৬ অধ্যায়) মাদিয়-পারস্যের রাজা কোরস সম্বন্ধে এবং মশীহ যীশু সম্বন্ধে অতি নির্দিষ্ট ও অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়া যায়। এমন পণ্ডিত যারা বিশ্বাস করে না যে ঈশ্বর ভবিষ্যৎ জানেন বা সত্যিকারের ভবিষ্যদ্বাণী দিতে সক্ষম নন, তারা ঘোষণা করে যে যিশাইয় পুস্তকের দ্বিতীয় অংশ অনেক পরে লেখা, অর্থাৎ ঘটনাগুলো ঘটার পরেই লেখা। তাই তারা দাবি করে যে যিশাইয় পুস্তকের দ্বিতীয় অংশ বেশ কয়েক শতাব্দী পরে অন্য একজনের দ্বারা লিখিত যাকে তারা ‘Deutero Isaiah’ বলে।
কিন্তু এই দাবি বাইবেলের অন্যান্য লেখার সাথে মিলে না। বংশাবলি পুস্তকে যিশাইয়কে তার পুস্তকের লেখক হিসাবে চিহ্নিত রাখা হয়: “হিষ্কিয়ের অন্যান্য সমস্ত কাজের কথা এবং তাঁর ঈশ্বরভক্তির কাজ সম্বন্ধে আমোসের ছেলে নবী যিশাইয়ের দর্শনের বইতে” এবং “যিহূদা ও ইস্রায়েলের রাজাদের ইতিহাস” নামে বইটিতে লেখা আছে” (২ বংশাবলি ৩২:৩২)। যীশু যিশাই পুস্তকের দ্বিতীয় অংশ থেকে বিভিন্ন উদ্ধৃতি করেন (যিশাইয় ৫৩:১, ৬:৯-১০) এবং তিনি সেগুলো “নবী যিশাইয়ের বলা কথা” বলে চিহ্নিত রাখেন (যোহন ১২:৩৮-৪০)। তাই যীশু কোন ‘Deutero Isaiah’ মানেন না। যীশুর মত লেখক পৌল রোমীয় পুস্তকে এবং লেখক মথি মথি সুসমাচারে যিশাইয় পুস্তকের দ্বিতীয় অংশ থেকে উদ্ধৃতি করে তা যিশাইয়ের লেখা হিসাবে ঘোষণা করেন।
২ বংশা ২৬:২২ পদে লেখা আছে যে যিশাইয় ভাববাণী ছাড়া যিহূদার রাজাদের সম্বন্ধীয় ঐতিহাসিক লেখাও রচনা করেছেন (যেমন রাজা উষিয়ের ইতিহাস) কিন্তু সেই পুস্তকগুলো হারিয়ে গেছে।
এতিহাসিক পরিস্থিতি
যিশাইয় তার পুস্তকের শুরুতে বলেন যে তিনি যিহূদার রাজা উষিয়, যোথম, আহস ও হিষ্কিয়ের সময়ে পাওয়া ভাববাণী পুস্তকটিতে লিপিবদ্ধ করেছেন (যিশাইয় ১:১)। তাই সম্ভাবনা বেশি যে তার পুস্তকের অধ্যায়গুলো নিচে দেওয়া তারিখের সময়ে লেখা:
- উষিয় ৭৬৭-৭৩৯ খ্রীঃপূঃ যিশাইয় ১-৫ অধ্যায়
- যোথম ৭৩৯-৭৩১ খ্রীঃপূঃ যিশাইয় ৬ অধ্যায়
- আহস ৭৩১-৭১৫ খ্রীঃপূঃ যিশাইয় ৭-১২ অধ্যায় (যিশাইয় ৭:১)
- হিষ্কিয় ৭১৫-৬৮৬ খ্রীঃপূঃ যিশাইয় ১৩-৬৬
- শেষ উল্লিখিত ঐতিহাসিক ঘটনা ৬৮১ খ্রীঃপূঃ আসিরিয়ার রাজা সনহেরীবের মৃত্যু (যিশাইয় ৩৭:৩৭-৩৮)
যিশাইয় বলেন যে তিনি রাজা উষিয়ের মৃত্যুর বছরে (৭৩৯ খ্রীঃপূঃ) ঈশ্বরের দর্শন পান (যিশাইয় ৬)। তার প্রথম ভাববাণীগুলো হয়তো তিনি একটু আগে বলতে শুরু করেছিলেন। যিহূদী ঐতিহ্য বলে যে যিহূদার মন্দ রাজা মনঃশির সময়ে (৬৮৬-৬৪২ খ্রীঃপূঃ) যিশাইয়কে বয়স্কো হলেও করাত দিয়ে দু’ভাগ করে মেরে ফেলা হয়েছিল (হয়তো ইব্রীয় ১১:৩৭ এই ঘটনাকে বুঝায়)। সম্ভবত যিশাইয় রাজা মনঃশির রাজত্বের সময়ে নতুন কোন ভাববাণী আর পান নি যদিও এই রাজার মন্দ রাজত্বের সময়ে ভক্তদের যিশাইয়ের আগের বাণীগুলো অতি মূল্যবান ও প্রয়োজন ছিল। পুস্তকে শেষ উল্লিখিত ঐতিহাসিক ঘটনাটি হল আসিরিয়ার রাজা সনহেরীবের মৃত্যু (৬৮১ খ্রীঃপূঃ, যিশাইয় ৩৭:৩৭-৩৮)। পরবর্তী যুগে একজন প্রকাশক যদি এই পদগুলো যদি যোগ না দিয়ে থাকেন তবে তার অর্থ এই যে যিশাইয় প্রায় ৬০ বছর ধরে ভাববাদী হিসাবে কথা বলেন (৭৪০-৬৮১ খ্রীঃপূঃ)।
যিশাইয়ের শ্রোতারা হল যিহূদা জাতি এবং যিহূদার রাজারা। এছাড়া সুদূরের ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছেন বলে তিনি ইস্রায়েলের পরবর্তী প্রজন্মগুলো, এমন কি দূরের প্রজন্মগুলোর জন্যও লেখেন।
রাজাবলি ও বংশাবলি থেকে আমরা যিশাইয়ের সময়ের যিহূদার রাজাদের সম্বন্ধে কিছুটা ঐতিহাসিক তথ্য পাই:
উষিয় ৭৬৭-৭৩৯ খ্রীঃপূঃ ২ বংশা ২৬, ২ রাজা ১৫:১-৭
উষিয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঈশ্বর ভক্ত একজন রাজা ছিলেন। তিনি ঈশ্বরের প্রতি বাধ্যতায় চলেন এবং পলেষ্টীয় ও অম্মোন জাতিদের উপরে জয়লাভ করতে সক্ষম হন। তিনি যিহূদা শহরগুলোর দূর্গ ও প্রাচীর আরো মজবুত করেন, বড় সৈন্যদল রাখেন এবং দেশের সামরিক সরঞ্জাম এবং চাষ পদ্ধতি উন্নত করে তোলেন। যখন তার শক্তি ও সুনাম বৃদ্ধি পায়, তিনি অহংকারী হয়ে যান এবং পুরোহিতদের ভূমিকা দখল করে মন্দিরে ধূপ জ্বালাতে চান। ঈশ্বর তাকে কুষ্ঠরোগ দিয়ে শাস্তি দেন। এই বিষয়ে তার মন ফিরানোর কোন উল্লেখ নেই।
যোথম ৭৩৯-৭৩১ খ্রীঃপূঃ ২ বংশা ২৭, ২ রাজা ১৫:৩২-৩৮
যোথম ঈশ্বর ভক্ত একজন রাজা ছিলেন যিনি “শক্তিশালী হয়ে উঠলেন, কারণ তিনি বিশ্বস্তভাবে তাঁর ঈশ্বর সদাপ্রভুর পথে চলতেন” (২ বংশা ২৭:৬)।
আহস ৭৩১-৭১৫ খ্রীঃপূঃ ২ বংশা ২৮, ২ রাজা ১৬
যোথমের ছেলে আহস হলেন মন্দ রাজা। তিনি বাল দেবতার উদ্দেশ্যে পূজার স্থান নির্মাণ করেন, “তিনি পূজার উঁচু স্থানগুলোতে, পাহাড়ের উপরে ও প্রত্যেকটি ডালপালা ছড়ানো সবুজ গাছের নীচে পশু উৎসর্গ করতেন ও ধূপ জ্বালাতেন“ এবং “সদাপ্রভু যে সব জাতিকে ইস্রায়েলীয়দের সামনে থেকে দূর করে দিয়েছিলেন তাদের জঘন্য কাজের মতই তিনিও তাঁর ছেলেদের আগুনে পুড়িয়ে উৎসর্গ করলেন” (২ বংশা ২৮:১-৪)। ইস্রায়েলের রাজা পেকহ (৭৪০-৭৩২ খ্রীঃপূঃ), যিনি তার আগের দীর্ঘদিনের শত্রু অরামের (সিরিয়া) রাজা রৎসীনের সাথে নতুনভাবে মৈত্রী চুক্তি করেছেন, তিনি যিহূদার রাজা আহসকে ভীষনভাবে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে যিহূদার ১.২ লক্ষ সেনা জীবন হারায় এবং আরো ২ লক্ষ বেসামরিক লোকদের বন্দী করা হয় (২ বংশা ২৮:৫-৮)। ওদেদ নামে একজন ঈশ্বর ভক্ত লোকের উদ্যোগে কিছু বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া ও নিজের দেশে ফিরে পাঠানো হয় (২ বংশা ২৮:৮-১৫)। এই পরাজয়ের পরেও আহস নিজেকে নত করেন না, ঈশ্বরের উপর নির্ভরও করেন না (যেমন যিশাইয় তাকে করতে চ্যালেঞ্জ করেন, যিশাইয় ৭:৭-৯) বরং তিনি টাকা দিয়ে আসিরিয়া সাম্রাজ্যকে একটি মৈত্রী চুক্তিতে রাজি করান (২ বংশা ২৮:১৬-২৮)। এই কৌশলের শেষ ফল হল যে আসিরিয়া উল্টা যিহূদাকে আক্রমণ করে। “এই কষ্টের সময়ে রাজা আহস সদাপ্রভুর প্রতি আরও অবিশ্বস্ত হলেন”, তিনি পরিকল্পিতভাবে আসিরিয়ার দেবতাপূজা যিহূদায় স্থাপন করেন, সদাপ্রভুর উপাসনা-ঘর বন্ধ ও “যিরূশালেমের সমস্ত জায়গায় বেদী স্থাপন” করেন (২ বংশা ২৮:২২-২৭)।
নবী মীখা ভবিষ্যদ্ববাণী দেন যে ইস্রায়েলের রাজধানী শমরিয়া সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে (মীখা ১:৬-৭)। প্রকৃতভাবে দেখা যায় যে অরামের (সিরিয়া) রাজা রৎসীন ও ইস্রায়েলের রাজা পেকহের মৈত্রী চুক্তি ও জয় বেশি দিন স্থায়ী হয় না: আসিরিয়ার সম্রাট তিগ্লৎ-পিলেষর উত্তর থেকে অরাম দেশকে দখল, পরাজিত ও নির্বাসিত করেন (৭৩২ খ্রীঃপূঃ)। তিনি পেকহের পরিবর্তে হোশেয়কে ইস্রায়েলের রাজা হিসাবে স্থাপন করেন (৭৩২-৭২২ খ্রীঃপূঃ)। হোশেয় আসিরিয়ার পরবর্তী রাজা শলমনেষরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। যখন সার্গোন আসিরিয়ার নতুন রাজা হিসাবে সিংহাসনে ওঠেন তিনি ৭২২ খ্রীঃপূঃ ইস্রায়েল দেশ এবং রাজধানী শমরিয়াকে দখল ও ধ্বংস করেন, যেমন ভাববাদী হোশেয়, আমোষ ও মীখা বলেছিলেন। ইস্রায়েল জাতির বেঁচে থাকা লোকদের নির্বাসিত করা হয় এবং জোরপূর্বকভাবে অন্য জাতিদের সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়। তারা জাতি হিসাবে তাদের পরিচয় হারায় এবং ইতিহাসে তাদের আর উল্লেখ নেই।
হিষ্কিয় ৭১৫-৬৮৬ খ্রীঃপূ ২ বংশা ২৯-৩২, ২ রজা ১৮-২০
আহসের ছেলে হিষ্কিয় হলেন ঈশ্বর ভক্ত একজন রাজা যিনি চেষ্টা করেন তার বাবা আহস যিহূদার যে ক্ষতি সাধন করেছিলেন, তা থেকে দেশকে মুক্ত করতে: তিনি দেবতার মূর্তী, বেদী, খুঁন্তি, পূজার স্থান ও উঁচু স্থানগুলো ধ্বংস করেন। পরিবর্তে তিনি সদাপ্রভুর উপসনা-ঘর খোলেন এবং তা পরিষ্কার ও মেরামত করেন। তিনি লেবীয়দের ও পুরোহিতদের সংগঠিত করেন এবং আইন অনুসারে বড় একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্ধার পর্ব পালন করেন।
৭১৫ খ্রীঃপূঃ আসিরিয়ার রাজা সনহেরীব যিহূদাকে আক্রমণ করে যিহূদার ৪৬টি প্রাচীরযুক্ত শহর এবং বেশিরভাগ এলাকা দখল করেন। তিনি যিহূদার বিশাল একটি লোকদল নির্বাসিত করেন এবং রাজধানি যিরূশালেমকে ঘেরাও করতে প্রস্তুতি নেন। নিঃসন্দেহে ঘটনাটি ছিল হিষ্কিয়ের রাজত্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই মহাসংকটে যিশাইয় তাকে ঈশ্বরের কাছ থেকে একটি আশার বাণী দেন (যিশাইয় ৩৭)। রাজা আহস যা করতে পারেন নি, তার ছেলে হিষ্কিয় তা করতে সক্ষম হন: তিনি ঈশ্বরের বাণীর উপর ভরসা রেখে বাধ্য হন এবং উত্তরে ঈশ্বর যিরূশালেমকে দু’বার আশ্চর্যভাবে ঘেরাও থেকে রক্ষা করেন (২ বংশা ৩২:১-২৩): ৭০৩ খ্রীষ্টপূর্বে আসিরিয়ার সম্রাট খবর পান যে অন্য একটি জাতি তাকে আক্রমণ করছে এবং ফলে তিনি ঘেরাও সিথিল করেন, ৭০১ খ্রীষ্টপূর্বে ঈশ্বর এক রাতে আসিরিয়ার ১৮৫’০০০ সেনাদের মৃত্যু ঘটান। রাজা হিষ্কিয়ের স্থিরতার জন্য যিহূদা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সুনাম বৃদ্ধি পায়।
এই সময় যিহূদার আত্মিক অবস্থা কেমন? যিশাইয় যিহূদা জাতিকে প্রাথমিকভাবে তিনটি ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ করেন: দেবতাপূজা (যিশাইয় ৪১, ৪৪-৪৮), নকল ধার্মিকতা (যিশাইয় ৫৮) এবং সামরিক সুরক্ষার জন্য অন্য দেশগুলোর উপর নির্ভর করা (বিভিন্ন অধ্যায়ে)। যিশাইয়ের সমসাময়িক ভাববাদী হলেন মীখা।
এক নজরে যিশাইয়
যিশাইয় পুস্তকের দু’টি বড় ভাগ আছে, ১-৩৯ অধ্যায় এবং ৪০-৬৬ অধ্যায়।
প্রথম বিভাগ
যদিও প্রথম বিভাগে মশীহ সম্বন্ধীয় কিছু ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়া যায় তবুও বেশিরভাগ কথা হল যিশাইয়ের সময়ের যিহূদা জাতির কাছে ঈশ্বরের সংবাদ। যিশাইয়কে অনেক বিচারবাণী দিতে হচ্ছে এবং তিনি উভয়ই যিহূদা জাতিকে এবং বর্তমান রাজাকে তাদের পাপের বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেন।
যিশাইয়কে প্রধানভাবে একটি পাপের সংশোধন করতে হচ্ছে: ঈশ্বরের উপর নির্ভর না করা, যার ফলে যিহূদা দু’টি পাপে লিপ্ত হয়: তারা ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্যান্য দেব-দেবতাকে পূজা করে (আত্মিক ক্ষেত্রে পাপ) এবং তারা ঈশ্বরের উপর নির্ভর না করে বরং সামরিক সুরক্ষার জন্য অন্য দেশগুলোর সাথে মৈত্রী চুক্তির উপর ভরসা রাখে (রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পাপ)। ঠিক এই দু’টি পাপ নিয়ে ভাববাদী হোশেয় ইতিমধ্যে কথা বলেছিলেন। হোশেয় রূপকভাবে এই দু’টি পাপকে ব্যভিচারের সাথে তুলনা করেছেন: ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বস্ত হয়ে অন্য দেবতাকে পূজা করা হল যিহূদার এক রকম ব্যভিচার এবং ঈশ্বরের উপর নির্ভর না করে সামরিক চুক্তির উপর ভরসার রাখা হল যিহূদার আর এক রকম ব্যভিচার। এই দু’টি পাপের কারণে যিশাইয়কে অধ্যায়ের পর অধ্যায় ধরে ধ্বংসবাণী ঘোষণা করতে হচ্ছে – যদিও তিনি বিচারের ওপারে একটি অদ্ভুত পুনরুদ্ধারের ঘোষণাও করেন (যিশাইয় ২:১-৪, ১১-১২, ২৪-২৭)।
প্রথম বিভাগে ভাববাণীর মাঝখানে দু’টি ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনাও পাওয়া যায়: যখন অরাম (সিরিয়া) ও ইস্রায়েল মৈত্রী চুক্তিতে এক হয়ে যিহূদাকে আক্রমণ করে তখন রাজার আহসের সাড়া (যিশাইয় ৭-৮, প্রায় ৭৩০ খ্রীঃপূঃ) এবং যখন আসিরিয়া সাম্রাজ্য যিহূদাকে দখল করে তখন রাজা হিষ্কিয়ের সাড়া (যিশাইয় ৩৭-৩৯, প্রায় ৭০০ খ্রীঃপূঃ)।
এছাড়া প্রথম বিভাগে যিহূদার চারিদিকে অবস্থিত্ব বিভিন্ন জাতির বিরুদ্ধে ঈশ্বরের বিচারবাণীও পাওয়া যায় (যিশাইয় ১৩-২৩)।
দ্বিতীয় বিভাগ
দ্বিতীয় বিভাগের বেশিরভাগ কথা হল বিচারের ওপারে পুনরুদ্ধার সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী। যিশাইয় আশার বাণী দেন যে কোরস নামে একজন সামরিক উদ্ধারকর্তা আসবেন যাকে ঈশ্বর তাঁর নির্বাসিত জাতিকে মুক্ত করার জন্য ব্যবহার করেন। নির্বাসিতরা প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে এসে আবার সেখানে বাস করতে পারবে। কিন্তু যিশাইয় তার চেয়ে বিশাল ও অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণী দেন: একজন মশীহ আসবেন এবং তাঁর প্রভাবে ঈশ্বর তাঁর লোকদের যেমন দেখতে চেয়েছিলেন, তারা তাতে রূপান্তরিত হবে: তারা হবে ঈশ্বরের সত্যিকারের দাস এবং জাতিদের জন্য আলোস্বরূপ।
যিশাইয় যখন “সদাপ্রভুর দাস” নিয়ে কথা বলেন তখন তিনি প্রথমত তার জাতি ইস্রায়েলকে, দ্বিতীয়ত উদ্ধারকর্তা কোরসকে এবং চূড়ান্তভাবে মশীহকে বুঝান।
যদিও যিশাইয় পুস্তকের দু’টি বিভাগ বেশ ভিন্ন তবুও বিভাগগুলো অনেক সম্পর্কিত। প্রথম বিভাগে দেখা যায় কিভাবে বর্তমান রাজনৈতিক ঘটনাগুলো সম্বন্ধে যিশাইয়ের অল্প-মেয়াদী ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পূর্ণ হয় যার কারণে যিশাইয় একজন সত্যিকার ভাববাদী হিসাবে প্রমাণিত হন (২য় বিবরণ ১৮:২২)। যিশাইয়ের অল্পমেয়াদী ভিবষ্যদ্বাণীগুলো পূর্ণ হয়েছে বলে পুস্তকের দ্বিতীয় বিভাগে তার দীর্ঘ-মেয়াদী ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রমাণিত হয়েছে। যিশাইয়ের সমসাময়িক শ্রোতারা এবং তার পুস্তকের পরবর্তী যুগের পাঠকেরা সবাই তা দেখে জানবে যে তার দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যদ্বাণীগুলোও বিশ্বাসযোগ্য। তা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ সব ভাববাদীদের মধ্যে যিশাইয়েরই কাছে ঈশ্বর সবচেয়ে নির্দিষ্ট ও বিস্তারিত মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী দেন। এভাবে পুস্তকের প্রথম বিভাগ দ্বিতীয় বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্বাস তৈরি করে। ঈশ্বরের বাক্যের উপর বিশ্বাস ও ভরসা রাখা হল যিশাইয় পুস্তকের মূল সংবাদ।
ঈশ্বরকে দেখা যিশাইয় ৬ অধ্যায়
যিশাইয় একটি দর্শনে ঈশ্বরকে দেখতে পান। এই দর্শন তার জীবন, তার আহ্বান এবং তার পরিচর্যার জন্য ভিত্তিস্বরূপ। তিনি পুস্তকের ৬ অধ্যায়ে তার বর্ণনা দেন: “যে বছরে রাজা উষিয় মারা গেলেন সেই বছরে আমি দেখলাম প্রভু খুব উঁচু একটা সিংহাসনে বসে আছেন। তাঁর রাজ-পোশাকের নীচের অংশ দিয়ে উপাসনা-ঘরটা পূর্ণ ছিল। তাঁর উপরে ছিলেন কয়েকজন সরাফ … তাঁরা একে অন্যকে ডেকে বলছিলেন, “সর্বক্ষমতার অধিকারী সদাপ্রভু পবিত্র, পবিত্র, পবিত্র; তাঁর মহিমায় গোটা পৃথিবী পরিপূর্ণ” (যিশাইয় ৬:১-৩)। যিশাইয় ঈশ্বরের মহত্বের এবং তাঁর পবিত্রতার একটি অতি শক্তিশালী প্রকাশ পান – ঈশ্বর এত পবিত্র যে তাঁর উপস্থিতিতে এমন কি স্বর্গদূতেরাও মুখ ঢাকেন। কেন তারা ৩ বার বলেন “পবিত্র, পবিত্র, পবিত্র”? হতে পারে ঈশ্বরের পবিত্রতার উপর গুরুত্ব দেওয়ার জন্য তারা তা করে। আরো চিন্তা করা যায় যে তারা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ত্রিত্ব ঈশ্বরকে দেখে ৩ বার “পবিত্র” বলেন। এই পদগুলোর আর একটি লক্ষণীয় বিষয় হল যে এখানে ঈশ্বরের মহত্ব এবং পৃথিবীতে তাঁর মহিমা যুক্ত করা হয়েছে।
ঈশ্বরের দর্শন পেয়ে যিশাইয় উপযুক্তভাবে ভক্তিপূর্ণ ভয়ে ও চেতনায় সাড়া দেন: “হায়, আমি ধ্বংস হয়ে গেলাম, কারণ আমার মুখ অশুচি এবং আমি এমন লোকদের মধ্যে বাস করি যাদের মুখ অশুচি। আমি নিজের চোখে রাজাকে, সর্বক্ষমতার অধিকারী সদাপ্রভুকে দেখেছি” (যিশাইয় ৬:৫)। ঈশ্বরের পবিত্রতার সম্মুখে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষ নিজের পাপ, অযোগ্যতা ও অসহায় অবস্থা বুঝতে পারে। মানুষ হিসাবে যিশাইয়ের এখানে কিছু করার নেই বরং ঈশ্বর নিজেই যিশাইয়ের অবস্থার সমাধান করেন: তাঁর আদেশে একজন স্বর্গদূত বেদী থেকে একটি কয়লা নিয়ে যিশাইয়ের মুখ স্পর্শ করে। তা রূপকভাবে যীশুর ক্রুশ এবং পাপের ক্ষমা বুঝায়: “দেখ, এটা তোমার মুখ ছুঁয়েছে; তোমার অন্যায় দূর করা হয়েছে এবং তোমার পাপ মুছে ফেলা হয়েছে” (যিশাইয় ৬:৭)। তার পাপ ও লজ্জা মুছে ফেলা এবং তাকে ঈশ্বরের সঙ্গে সহভাগিতায় আনা হয়েছে বলে যিশাইয় এখন (সম্ভবত) ত্রিত্ব ঈশ্বরের মধ্যে আলোচনা শুনে ঈশ্বরের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারেন: “আমি কাকে পাঠাব? আমাদের পক্ষ হয়ে কে যাবে?” (যিশাইয় ৬:৮)। আবারও যিশাইয়ের সাড়া তাৎক্ষণিক: “এই যে আমি, আপনি আমাকে পাঠান” (যিশাইয় ৬:৯)।
ঈশ্বর যিশাইয়কে বোঝান যে লোকদের কাছে তাঁর বাণী পৌঁছানো হল কঠিন কাজ এবং তিনি বাণী দিলেও শেষে বিচার প্রয়োজন হবে (যিশাইয় ৬:১০-১৩)।
এই দর্শন থেকে যিশাইয়ের জীবনের মূল সংবাদ আসে: এই ধরণের ঈশ্বরকে বিশ্বাস না করা কি চলবে? এই ধরণের ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে দেবতা পূজা করা কি চলবে? ঈশ্বরের বিচার করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কি সন্দেহ করা চলবে? ঈশ্বর বিচারের ওপারে যে একটি চমৎকার পুনরুদ্ধার নিয়ে আসবেন, তা কি বিশ্বাযোগ্য প্রতিজ্ঞা নয়?
যিহূদার আসল সমস্যার নির্নয় যিশাইয় ১-৫ অধ্যায়
যদি আপনি যিহূদার লোকদের জিজ্ঞাসা করতেন তাদের সমস্যা আসলে কি তবে সম্ভাবনা বেশি যে তারা উত্তরে বলত: ‘ঈশ্বর যা বলেছেন তিনি তা করেন না। এজন্য আমরা হিংস্র আসিরিয়ার সাম্রাজ্যের হৃমকির সম্মুখে পড়ে আছি’। এর বিপরীতে ঈশ্বরের চোখে প্রকৃতভাবে সমস্যাটি কি, যিশাইয় তা ঘোষণা করেন : “হে আকাশ শোন, হে পৃথিবী শোন, সদাপ্রভু বলছেন, “আমি ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করেছি ও তাদের বড় করে তুলেছি, কিন্তু তারা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। গরু তার মনিবকে চেনে, গাধাও তার মালিকের যাবপাত্র চেনে; কিন্তু ইস্রায়েল তার মনিবকে চেনে না, আমার লোকেরা আমাকে বোঝে না।” হায়! তারা একটা পাপে পূর্ণ জাতি, দোষের ভারে বোঝাই লোক, অন্যায়কারীদের বংশ, কুকাজ করা সন্তান। তারা সদাপ্রভুকে ত্যাগ করেছে এবং ইস্রায়েলের সেই পবিত্রজনকে অগ্রাহ্য করেছে আর তাঁর দিকে পিছন ফিরিয়েছে” (যিশাইয় ১:২-৪)। লোকদের গাধার সাথে তুলনা করা অবশ্যই ভাল লাগার কথা নয় কিন্তু কথাটি ঠিক: গাধা কমপক্ষে বুঝে কে তাকে খাবার দেয় কিন্তু ঈশ্বরের লোকেরা তা বুঝে না!
ঈশ্বর খুব তীক্ষ্ণভাবে যিহূদা জাতিকে মূল্যায়ন করেন: “হে সদোমের শাসনকর্তারা, সদাপ্রভুর বাক্য শোন। হে ঘমোরার লোকেরা, আমাদের ঈশ্বরের নির্দেশে কান দাও। সদাপ্রভু বলছেন, “তোমাদের কোন পশু-উৎসর্গ আমার দরকার নেই। ভেড়া ও মোটাসোটা পশুর চর্বি দিয়ে পোড়ানো-উৎসর্গ যেন আমার গলা পর্যন্ত উঠেছে; গরু, ভেড়ার বাচ্চা ও ছাগলের রক্তে আমি কোন আনন্দ পাই না। তোমরা যে আমার কাছে উপস্থিত হয়ে আমার সব উঠান পায়ে মাড়াও, এ তোমাদের কাছে কে চেয়েছে? … অমাবস্যার উৎসব ও নির্দিষ্ট ভোজ-সভা ঘৃণা করি। … যদিও বা অনেক প্রার্থনা কর আমি তা শুনব না, কারণ তোমাদের হাত রক্তে পূর্ণ। তোমরা নিজেদের খাঁটি কর, শুচি হও। আমার চোখের সামনে থেকে তোমাদের সব মন্দ কাজ দূর করে দাও; তা আর কোরো না। তোমরা ভাল কাজ করতে শেখো, ন্যায়বিচার কর, অত্যাচারীদের সংশোধন কর, অনাথদের পক্ষে থাক, বিধবাদের মামলার তদারকি কর” (যিশাইয় ১:১০-১৭)। ঈশ্বর এখানে তাঁর জাতিকে ‘সদোম ও ঘমোরার লোকেরা’ বলেছেন তা অবশ্যই শ্রোতাদের কাছে অপমানস্বরূপ। তারা নিজেকে যথেষ্ট ধার্মিক মনে করে বলে কথাটি তাদের অহংকারকে চ্যালেঞ্জ করে।
যেমন ভাববাদী আমোষ ও মীখা তার আগে করেছিলেন, ঠিক তেমনি যিশাইয় যিহূদার সামাজিক অন্যায় নিয়ে দোষ ধরেন, বিশেষভাবে সামাজিক অন্যায় যদি মিথ্যা ধার্মিকতার সাথে যুক্ত থাকে। অন্যায় কাজের পাশাপাশি একটু ধর্মকর্ম করলে তা ঈশ্বরের চোখে কখনও গ্রহণযোগ্য হবে না “হায়, সতী শহরটা কেমন বেশ্যার মত হয়ে গেছে! সে এক সময় ন্যায়বিচারে পূর্ণ ছিল; সততা তার মধ্যে বাস করত, কিন্তু এখন বাস করছে খুনীরা। … তোমার শাসনকর্তারা বিদ্রোহী ও চোরদের সংগী; তারা সবাই ঘুষ খেতে ভালবাসে আর উপহার পেতে চায়। তারা অনাথদের পক্ষে থাকে না আর বিধবাদের মামলা তাদের কাছে স্থান পায় না” (যিশাইয় ১:২১-২৩)। যিশাইয় এখানে ভাববাদী হোশেয়ের রূপক “বেশ্যা” ব্যবহার করেন: যিহূদা জাতিকে বেশ্যা বা অবিশস্ত স্ত্রীর সাথে তুলনা করা হয় যে তার স্বামী, অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি অবিশস্ত হয়েছে।
যিহূদার নৈতিকতা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে দেশের জন্য ভাল নেতৃত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায় না “যে সব জিনিস ও লোকদের উপর লোকে নির্ভর করে সেই সব যিরূশালেম ও যিহূদা থেকে সর্বক্ষমতার অধিকারী প্রভু সদাপ্রভু দূর করে দিতে যাচ্ছেন। … এছাড়া তিনি বীর ও যোদ্ধাদের, শাসনকর্তা ও নবীদের, গণক ও বৃদ্ধ নেতাদের, পঞ্চাশ সৈন্যের সেনাপতি ও সম্মানিত লোকদের, পরামর্শদাতা, চালাক যাদুকরদের ও মন্ত্র-পড়া সাপুড়েদের দূর করে দিতে যাচ্ছেন। তাদের উপরে তিনি অল্প বয়সী ছেলেদের কর্তা বানাবেন; অল্প বুদ্ধির যুবকেরা তাদের শাসনকর্তা হবে। মানুষ মানুষকে, প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে অত্যাচার করবে” (যিশাইয় ৩:১-৫)। যেখানে নৈতিকতা ভেঙ্গে যায় সেখানে আইন-শৃঙ্খলা এবং মানবীয় অধিকারের বিস্তার বন্ধ হয়ে যায়।
যিশাইয় পুস্তকের উভয় বিভাগে একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরুক্তি বিষয় লক্ষ্য করুন: দেবতাপূজা হল অর্থহীন, মুর্খ ও হাস্যকর: “যারা খোদাই করে প্রতিমা তৈরী করে তারা অপদার্থ; তাদের এই মূল্যবান জিনিসগুলো উপকারী নয়। সেই প্রতিমাগুলোর পক্ষ হয়ে যারা কথা বলে তারা অন্ধ, কিছু জানে না; সেইজন্য তারা লজ্জা পাবে। কে দেবতা তৈরী করেছে আর অপদার্থ প্রতিমা ছাঁচে ঢেলেছে? … কেউ এরস গাছ কাটে, কিম্বা হয়তো তর্সা বা এলোন গাছ বেছে নেয়। সে বনের গাছপালার মধ্যে সেটাকে বাড়তে দেয়, কিম্বা সে ঝাউ গাছ লাগায় আর বৃষ্টি সেটা বাড়িয়ে তোলে। পরে সেটা মানুষের জ্বালানি কাঠ হয়। সে তার কিছু নিয়ে আগুন পোহায়, আবার আগুন জ্বেলে রুটি সেঁকে, আবার একটা দেবতা তৈরী করে তার পূজাও করে, আবার প্রতিমা তৈরী করে মাটিতে পড়ে তাকে প্রণাম করে। … সে তার কাছে প্রার্থনা করে বলে, “আমাকে উদ্ধার কর; তুমিই আমার দেবতা” (যিশাইয় ৪৪:৯-১৭)। দেবতাপূজা দু’দিকেই বড় পাপ: তা সত্যিকারের ঈশ্বরকে অপমানিত করে এবং তা দেবতাপূজারীকে ক্ষতি করে কারণ সে এমন একটি জিনিসের উপর ভরসা রাখে যা তার জীবন বহন করতে সক্ষম নয়, যা তাকে উদ্ধারও করতে পারবে না।
কিন্তু যিহূদা জাতি যিশাইয়ের কথা অমান্য করে। ঈশ্বর তাঁর মনোনীত জাতি থেকে যে ফল আশা করেন, তা তারা দিতে রাজি না (যিশাইয় ৫:১-৭)। এই বিপজ্জনক পথে এগিয়ে যেতে থাকার কারণে যিহূদা ধীরে ধীরে এমন জাতিতে পরিণত হয় যা ঈশ্বরের বিচারের যোগ্য। মন ফিরানোর সুযোগ অস্বীকার করতে করতে যিহূদার হৃদয় এমন কঠিন হয়ে যায় যে অনুতাপের ডাক তাদের কাছে আর পৌঁছায় না।
ঐতিহাসিক ঘটনা: আহস, আপনি কার উপর নির্ভর করবেন? যিশাইয় ৭-৯ অধ্যায়
যিশাইয়ের বাণীগুলোর মাঝখানে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে (যিশাইয় ৭-৮ অধ্যায়)। ইস্রায়েলের রাজা পেকহ আসিরিয়া সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে একটি জোটে যোগ দেন, যাতে অরামের রাজা রৎসীন এবং পলেষ্টীয় শহর অস্কিলোন ও ঘসাও যোগ দেয় (২ বংশা ২৮:১৮)। যিহূদা যোগ দিতে অগ্রাহ্য করে বলে ইস্রায়েলের রাজা পেকহ এবং অরামের রাজা রৎসীন ৭৩৫ খ্রীষ্টপূর্ব যিহূদার রাজা যোথমকে আক্রমণ করেন (২ রাজা ১৫:৩৭)। ইস্রায়েল ও অরাম আলাদা আলাদাভাবেও আক্রমণ করে (২ বংশা ২৮:৫-৬) এবং একসাথেও আক্রমণ করে (২ রাজা ১৬:৫)। যোথম মারা যাওয়ার পরে এই চাপ তার ছেলে রাজা আহসের উপরে পড়ে। আহস দুই রাজার আক্রমণের এবং ভবিষ্যৎ ঘেরাওয়ের প্রস্তুতি হিসাবে যিরূশালেমের পানির সরবরাহ দেখতে যান। সেখানে যিশাইয় তার সাথে দেখা করেন এবং তাকে ঈশ্বর থেকে একটি ভাববাণী দেন: “আমি প্রভু সদাপ্রভু বলছি যে, এই যুদ্ধ হবেও না, ঘটবেও না, … কারণ অরামের মাথা দামেস্কই বা কি আর দামেস্কের মাথা রাজা রৎসীনই বা কে? পঁয়ষট্টি বছরের মধ্যে ইফ্রয়িম এমনভাবে ধ্বংস হবে যে, জাতি হিসাবে সে আর থাকবে না” (যিশাইয় ৭:৬)।
যিশাইয় আহসকে সুযোগ দেন ঈশ্বরের বাক্যের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ হিসাবে একটি ভাববাদীমূলক চিহ্ন চাইতে। আহস কোন চিহ্ন দাবি করতে রাজি না, কিন্তু ঈশ্বরের প্রতি প্রয়োজনীয় বিশ্বাস এনে তাঁর উপর নির্ভর করার সাহসও করতে পারেন না। বরং তিনি আসিরিয়ার সম্রাটকে টাকা দিয়ে মৈত্রী চুক্তির প্রস্তাব পাঠিয়ে ইস্রায়েল ও অরামের বিরুদ্ধে আসিরিয়ার সাহায্য চান (২ রাজার ১৬:৭-৯, ২ বংশা ২৮:১৬)।
আসিরিয়া এই আমন্ত্রনে খুশি মনে সাড়া দেয়: তারা উত্তর থেকে আক্রমণ করে প্রথমে ৭৩৪ খ্রীঃপূর্বে অরাম এবং ইস্রায়েলকে দখল করে। পরে তারা ৭৩২ খ্রীষ্টপূর্বে অরামকে (২ রাজা ১৬:১৯) এবং ৭২২ খ্রীষ্টপূর্বে ইস্রায়েলকে সম্পূর্ণভাবে দখল ও ধ্বংস করে। কিন্তু আসিরিয়া থেমে না গিয়ে বরং আরো দক্ষিণ দিকে অভিযান চালিয়ে যিহূদাকেও দখল করে – এভাবে আহসের কৌশল তাকে রক্ষা না করে বরং উল্টা তাকে পরাজিত করে (২ বংশা ২৮:২০-২১, যিশাইয় ৭:১৭)।
আহসের কাছে ঈশ্বরের এই বাণী যদিও নিঃস্ফল হয় তবুও বাণীর মাঝখানে একটি অদ্ভুত মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়া যায়। আহস চিহ্ন চান নি কিন্তু ঈশ্বর তাঁর পক্ষ থেকে একটি চিহ্ন দেবেন: এক কুমারী গর্ভবতী হয়ে একটি সন্তান প্রসব করবেন যার নাম হবে ইম্মানুয়েল। সন্তানটির ভাল-মন্দ বুঝার বয়স হওয়ার আগে ইস্রায়েল ও অরামের সেই দুই রাজা এবং তাদের রাজ্য আসিরিয়া দ্বারা ধ্বংস হবে। যিশাইয় বাণীটি ৭৩৫ খ্রীষ্টপূর্বে দেন এবং তা ৭৩২ খ্রীষ্টপূর্বে অরামের ক্ষেত্রে ও ৭২২ খ্রীষ্টপূর্বে ইস্রায়েলের ক্ষেত্রে পূর্ণ হয়, তাই প্রায় ৩ ও ১৩ বছরের মধ্যে (যিশাইয় ৭:১৪-১৯)।
সম্ভবত এই বাণীতে উল্লিখিত সন্তান হল যিশাইয়ের দ্বিতীয় ছেলে “মহের-শালল-হাশ-বস” (যার নামের অর্থ হল “শীঘ্র লুট করা, তাড়াতাড়ি কেড়ে নেওয়া”, যিশাইয় ৮:১-৪)। কিন্তু বাণীটির আরো বড় একটি পূর্ণতা আছে: তা মশীহ দ্বারা পূর্ণ হয় যেমন মথি তার উদ্ধৃতিতে ঘোষণা করেন (মথি ১:২৩)। যিশাইয় আরো মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী দেন: “ঈশ্বর সবূলূন ও নপ্তালি এলাকাকে নীচু করেছিলেন, কিন্তু ভবিষ্যতে সমুদ্রের কিনারার রাস্তা থেকে ধরে যর্দন নদীর পূর্ব পারের এলাকা পর্যন্ত অযিহূদীদের গালীলকে তিনি সম্মানিত করবেন … তাদের উপর সেই আলো জ্বলবে” (যিশাইয় ৯:১-২, যা মথি ৪:১৫-১৬ পদে উদ্ধৃতি করা হয়)। “এই সমস্ত হবে, কারণ একটি ছেলে আমাদের জন্য জন্মগ্রহণ করবেন, একটি পুত্র আমাদের দেওয়া হবে। শাসন করবার ভার তাঁর কাঁধের উপর থাকবে, আর তাঁর নাম হবে আশ্চর্য পরামর্শদাতা, শক্তিশালী ঈশ্বর, চিরস্থায়ী পিতা, শান্তির রাজা। তাঁর শাসনক্ষমতা বৃদ্ধির ও শান্তির শেষ হবে না। তিনি দায়ূদের সিংহাসন ও তাঁর রাজ্যের উপরে রাজত্ব করবেন; তিনি সেই সময় থেকে চিরকালের জন্য ন্যায়বিচার ও সততা দিয়ে তা স্থাপন করবেন ও স্থির করবেন। সর্বক্ষমতার অধিকারী সদাপ্রভুই গভীর আগ্রহে এই সমস্ত করবেন” (যিশাইয় ৯:৬-৭)।
বিভিন্ন জাতির বিরুদ্ধে বিচারবাণী যিশাইয় ১৩-৩৫ অধ্যায়
যিশাইয় শুধুমাত্র যিহূদার বিরুদ্ধে বিচারবাণী ঘোষণা করেন, তা নয় বরং তিনি যিহূদার চারিদিকে বিভিন্ন জাতির বিরুদ্ধেও বিচারবাণী দেন (যিশাইয় ১৩-৩৫)। বিশাল আসিরিয়া সাম্রাজ্যের হুমকির সম্মুখে যিহূদা ও চারিদিকের অন্যান্য ছোট দেশ বিভিন্ন জোটে যোগ দেওয়ার প্রলোভনে পড়ে – যদিও ঈশ্বর এই কৌশলের বিরুদ্ধে বার বার সাবধান করেন। ভয়ংকর সাম্রাজ্যের সম্মুখে পড়ার কারণ কি? যিশাইয় স্পষ্টভাবে বলেন যে তার কারণ এই নয় যে যিহূদার সামরিক ক্ষমতা ও লোকসংখ্যা কম বরং তার কারণ হল যে তারা ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য নয়। ঈশ্বর নিজেই অনুমতি দিয়েছেন যে এই ধরণের ভয়ংকর সাম্রাজ্য সামরিক হুমকিস্বরূপ হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে মোশির আইন-কানুনে ঈশ্বর স্পষ্টভাবে বলেছিলেন: “যদি তোমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভুর কথায় কান না দাও… সদাপ্রভু এমন করবেন যাতে তোমরা তোমাদের শত্রুদের সামনে হেরে যাও। তোমরা এক দিক দিয়ে তাদের আক্রমণ করবে কিন্তু তাদের সামনে থেকে পালিয়ে যাবে সাত দিক দিয়ে” (২য় বিবরণ ২৮:১৫,২৫)। অবাধ্য হলে ঈশ্বর তাঁর জাতিকে বিভিন্ন সংকটে পড়তে দেন (যেমন সামরিক হুমকি) যেন তাদের মনোযোগ পুনরায় আকৃষ্ট করে তিনি তাদের অনুতপ্ত হওয়ার ডাক দিতে পারেন। কিন্তু যিহূদা আসিরিয়ার হুমকির সম্মুখে পড়ে কৌশল করে অন্য দেশের সাথে জোটে যোগ দেয়। তার চেয়ে বরং তাদের দেবতাপূজা থেকে মন ফিরিয়ে জীবন্ত ঈশ্বরকে অন্বেষণ করা উচিত, যাঁর প্রকৃতভাবে উদ্ধার করার ক্ষমতা আছে।
জাতিদের বিরুদ্ধে বিচারবাণীগুলোতে দু’ভাগ দেখা যায়। প্রথম ভাগে (যিশাইয় ১৩-২৭, ৭২৮-৭১১ খ্রীঃপূঃ) ঈশ্বর কয়েকটি জাতিকে (বাবিল, পলেষ্টিয়া, মোয়াব, অরাম, কূশ, মিসর, ইদোম ও আরব দেশ) সাবধান করেন যেন তারা আসিরিয়ার রাজা শলমনেষর-৫ ও সোর্গন-২-এর বিরুদ্ধে জোটে যোগ না দেয়। যিহূদা জোটের বাইরে আছে এবং যিশাইয় যিহূদাকে বলেন জোটে যোগ না দিতে। যিশাইয় ২৪-২৭ অধ্যায় হল মশীহ সম্বন্ধীয়, যাতে এ্যাপোকালিপ্টিক ধরণের লেখা পাওয়া যায়। ঐসময়ের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা:
- ৭২৮ খ্রীঃপূঃ আসিরিয়ার রাজা তিগ্লত-পিলেষর মারা যান এবং শলমনেষর নতুন রাজা হয়ে যান।
- ৭২৭ খ্রীঃপূঃ বেশ কয়েকটি দখল করা দেশ আসিরিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, যাতে ষড়যন্ত্রের চালক ছিল পলেষ্টীয় অসদোদ শহর।
- ৭২৫ খ্রীঃপূঃ মিসর ও ইস্রায়েল মৈত্রী চুক্তি করে, কিন্তু ইস্রায়েল মিসর থেকে বেশি সাহায্য পায় না।
- ৭২৩ খ্রীঃপূঃ আসিরিয়া শমরিয়া শহরকে ঘেরাও করে। রাজা শলমনেষর মারা যান এবং সোর্গন ২ রাজা হয়ে যান।
- ৭২২ খ্রীঃপূঃ সোর্গন শমরিয়া শহরকে দখল, ধ্বংস ও নির্বাসিত করেন।
- ৭১১ খ্রীঃপূঃ আসিরিয়া উভয় অরাম ও অসদোদ দখল করে। ফলে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়।
- ৭০৯ খ্রীঃপূঃ আসিরিয়া বিদ্রোহী বাবিলকে পুনায় দখল করে এবং বাবিলের রাজা মরোদক-বালাদানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়।
জাতিদের বিরুদ্ধে বিচারবাণীর দ্বিতীয় ভাগে (যিশাইয় ২৮-৩৫, ৭০৫-৭০১ খ্রীঃপূঃ), যিহূদা আসিরিয়ার রাজা সনহেরীবের বিরুদ্ধে একটি জোটে যোগ দেয়, যার ফলে যিহূদার উপর দুর্যোগ নেমে আসে। যিশাইয় যিহূদাকে সাবধান করেন যেন মিসরের সাথে মৈত্রী চুক্তির উপর ভরসা না রাখে। যিশাইয় ৩৪-৩৫ অধ্যায় হল মশীয় সম্বন্ধীয়, যাতে এ্যাপোকালিপ্টিক ধরণের লেখা পাওয়া যায়। ঐসময়ের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা:
- ৭০৫ খ্রীঃপূঃ আসিরিয়ার রাজা সোর্গনকে মেরে ফেলা হয়। বাবিল বিদ্রোহে করে ও মৈত্রী দেশের খোঁজ করে।
- ৭০৫ খ্রীঃপূঃ বাবিলের রাজা যিহূদার রাজা হিষ্কিয়ের কাছে রাজদূত পাঠান।
- ৭০৩ খ্রীঃপূঃ আসিরিয়া বিদ্রোহী বাবিলকে পুনরায় পরাজিত করে।
- ৭০২ খ্রীঃপূঃ আসিরিয়া পলেষ্টীয় শহর ইক্রোন ও মিসরকে পরাজিত করে। হিষ্কিয় ষড়যন্ত্র করেছে বলে আসিরিয়ার কাছে ক্ষমা চান। আসিরিয়া অতিরিক্তি কর দাবি করে। শেষে হিষ্কিয় এত কর দিতে প্রত্যাখান করে ঈশ্বরের উপর নির্ভর করেন।
- ৭০১ খ্রীঃপূঃ আসিরিয়া ফৈনীকীয়া, পলেষ্টিয়া ও যিহূদার ৪৬টি প্রাচীরযুক্ত শহর দখল করে, ২ লক্ষ লোক নির্বাসিত করে এবং হিষ্কিয়ের কাছে যিরূশালেম দখল করার হুমকি দেয়।
যিশাইয় ৭০১ খ্রীষ্টপূর্বের আক্রমণ যিহূদার উপরে ঈশ্বরের আংশিক বিচার হিসাবে ব্যাখ্যা করেন কিন্তু তিনি আশাও প্রকাশ করেন যে ঈশ্বর যিহূদাকে রক্ষা করবেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী দেন যে ঈশ্বর পরবর্তীতে আসিরিয়াকেও বিচার করবেন, যার ফলে যিহূদার একটি আত্মিক জাগরণ ঘটবে।
ঐতিহাসিক ঘটনা: হিষ্কিয়, আপনি কার উপর নির্ভর করবেন? যিশাইয় ৩৬-৩৯ অধ্যায়
যিহূদার রাজা আহস বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখে পড়ার ত্রিশ বছর পরে রাজা হিষ্কিয় ঠিক তেমনি বিশাল হুমকির সম্মুখীন হন: আসিরিয়া সাম্রাজ্য যিহূদা এলাকার ৪৬ প্রাচীরযুক্ত শহর দখল করে, প্রায় ২ লক্ষ লোক বন্দী করে এবং যিহূদার শেষ শহর যিরূশালেম ঘেরাও করতে প্রস্তুত হচ্ছে। রূপকভাবে বললে আসিরিয়া রাজা হিষ্কিয়ের গলা চেপে ধরে দাবি করে তিনি যেন আত্ম-সমর্পণ দাবি করেন। এই মহাসংকটে পড়ে হিষ্কিয় ঈশ্বরকে ডাকেন এবং ভাববাদী যিশাইয়কে আসিরিয়ার হুমকি সম্বন্ধে জানান। যিশাইয় তাকে ঈশ্বরের এই বাণী দেন: “তুমি যা শুনেছ, অর্থাৎ আসিরিয়ার রাজার কর্মচারীরা আমার বিরুদ্ধে যে সব অপমানের কথা বলেছে তাতে ভয় পেয়ো না। শোন, আমি তার মধ্যে এমন একটা মনোভাবের সৃষ্টি করব যার ফলে সে একটা সংবাদ শুনে নিজের দেশে ফিরে যাবে, আর সেখানে আমি তাকে তলোয়ারের ঘায়ে শেষ করে দেব” (যিশাইয় ৩৭:৫-৭)। যা রাজা আহস করতে পারেন নি রাজা হিষ্কিয় তা করতে সক্ষম হন: তিনি ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা বিশ্বাস করে আসিরিয়ার আত্ম-সমর্পণের দাবি অগ্রাহ্য করেন এবং পরবর্তীতে ঈশ্বর তাকে অদ্ভুতভাবে উদ্ধার করেন ৭০৩ খ্রীষ্টপূর্বে আসিরিয়ার সম্রাট খবর পান যে অন্য একটি জাতি তাকে আক্রমণ করছে এবং ফলে তিনি ঘেরাও সিথিল করেন, ৭০১ খ্রীষ্টপূর্বে ঈশ্বর এক রাতে আসিরিয়ার ১৮৫’০০০ সেনাদের মৃত্যু ঘটান (যিশাইয় ৩৭:৩৬-৩৭)। আসিরিয়ার রাজা সনহেরীব নিজের দেশে ফিরে যান এবং ৬৮১ খ্রীষ্টপূর্বে তার দু’জন ছেলে তাকে খুন করে (যিশাইয় ৩৭:৩৮)।
সম্ভবত হিষ্কিয়ের অসুস্থতা, সুস্থ হওয়ার জন্য ঈশ্বরের কাছে তার প্রার্থনা (যিশাইয় ৩৮) এবং বাবিল রাজদূতদের পরিদর্শন (যিশাইয় ৩৯) সনহেরীবের হুমকির আগে ঘটে। হিষ্কিয়ের বিনতির উত্তরে ঈশ্বর তার জীবনের মেয়াদ ১৫ বছর বাড়িয়ে দেন। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় যে তার ছেলে মনঃশি, যিহূদার সবচেয়ে মন্দ রাজা, হিষ্কিয়ের সেই ১৫ বছরের মধ্যে জন্ম নেন। বাইবেল বলে না হিষ্কিয় এপর্যন্ত নিঃসন্তান ছিলেন অথবা বড় ভাইদের সরিয়ে ১২ বছরের মনঃশি রাজা হিসাবে সিংহাসনে ওঠেন (২ রাজা ২১:১)। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট: মনঃশিকে রাজপদ দেওয়া হল একটি ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত এবং হয়তো তা হিষ্কিয়ের অযত্নের একটি ফল, যেমন তিনি ঈশ্বরের বিচারবাণী পেয়ে অযত্ন করেন (যিশাইয় ৩৯:৮)।
পুনরুদ্ধারের প্রতিজ্ঞা যিশাইয় ৪০-৬৬ অধ্যায়
যিশাইয় আসিরিয়ার আক্রমণ, জোটে যোগ দেওয়ার নিঃস্ফলতা ও বিশ্বাসে স্থির থাকা দ্বারা যিহূদার উদ্ধার এসব বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিলেন এবং ৭০১ খ্রীষ্টপূর্বের মধ্যে তা সবার চোখের সামনে পূর্ণ হয়। একারণে যিশাইয় একজন সত্যিকারের ভাববাদী হিসাবে প্রমাণিত (দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:২২) এবং তার আরো সুদুর ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণীর জন্যও বিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি হয়েছে:
- বিশাল আসিরিয়া সাম্রাজ্য ধ্বংস হবে যিশাইয় দ্বারা প্রায় ১০০ বছর আগে ঘোষিত পূর্ণ: ৬০৫ খ্রীঃপূঃ
- বাবিল সাম্রাজ্যের বৃদ্ধি ও যিহূদাকে আক্রমণ যিশাইয় দ্বারা প্রায় ১৫০ বছর আগে ঘোষিত পূর্ণ: ৫৮৬ খ্রীঃপূ
- কোরসের আগমন ও যিহূদীদের দেশে ফিরা যাওয়া যিশাইয় দ্বারা প্রায় ২০০ বছর আগে ঘোষিত পূর্ণ: ৫৩৯-৫৩৬ খ্রীঃপূঃ
- মশীহ যিশাইয় দ্বারা প্রায় ৭০০ বছর আগে ঘোষিত পূর্ণ: যীশুতে
পুস্তকের প্রথম বিভাগে যিশাইয় ইতিমধ্যে মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিলেন (যিশাইয় ২:২-৫): প্রভুর উপাসনা-ঘরের পাহাড় উঁচু করে তোলা হবে, জাতিগুলো স্রোতের মত তার কাছে আসবে এবং বলবে “চল, আমরা সদাপ্রভুর পাহাড়ে উঠে যাই, চল, যাকোবের ঈশ্বরের ঘরে যাই। তিনি আমাদের তাঁর পথ সম্বন্ধে শিক্ষা দেবেন আর আমরা তাঁর পথে চলব”। ঈশ্বর জাতিগুলোর মধ্যে শান্তি স্থাপন করবেন এবং তিনি ইস্রায়েলের বেঁচে থাকা লোকদেরকে গর্ব ও গৌরবের পাত্র ও পবিত্র বলবেন (যিশাইয় ৪:২-৬)। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী দেন যে “যিশয়ের গোড়া থেকে একটা নতুন চারা বের হবেন” (যিশাইয় ১১:১-১০) এবং সেই ব্যক্তি সদাপ্রভুর আত্মা দিয়ে পরিচালিত হয়ে ন্যায় বিচার ও শান্তি নিয়ে আসবেন। ঈশ্বর সব জাতিদের মধ্য থেকে তাঁরই লোক একত্র করবেন (যিশাইয় ১১:১১-১৬)।
পুস্তকের দ্বিতীয় বিভাগে যিশাইয় এই ভবিষ্যদ্বাণীর উপরে ভিত্তি করে ধাপে ধাপে পুনরুদ্ধারের আরো প্রতিজ্ঞা ও বর্ণনা দেন। ঈশ্বর নিজেই দেখা দেবেন এবং তিনি প্রমাণ করবেন যে তাঁর মত আর কেউ নেই। তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ। তিনি নিজেকে সত্যিকারের ঈশ্বর হিসাবে প্রকাশিত করবেন: পরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তা, যিনি ভবিষ্যৎ জানেন এবং ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করেন, স্বক্রিয় ও যত্নশীল একজন উদ্ধারকর্তা (যিশাইয় ৪০-৪৮)।
যিশাইয় ঘোষণা করেন যে এই পরিত্রাতা অদ্বিতীয় এবং তিনি সম্পূর্ণ “নতুন একটা কাজ” করবেন (যিশাইয় ৪৩:১৯), অর্থাৎ সান্ত্বনার, নিরাপত্তার ও মঙ্গলের একটি যুগ স্থাপন করবেন: “আমার লোকদের সান্ত্বনা দাও, সান্ত্বনা দাও। যিরূশালেমের লোকদের সংগে নরমভাবে কথা বল, আর তাদের কাছে এই কথা ঘোষণা কর যে, তাদের দুঃখ-কষ্ট শেষ হয়েছে, তাদের পাপের ক্ষমা হয়েছে, তাদের সব পাপের ফল তারা সদাপ্রভুর হাত থেকে পুরোপুরিই পেয়েছে” (যিশাইয় ৪০:১)।
এসব কিভাবে হবে? যিশাইয় বলেন যে পূর্ব থেকে বিজয়ী একজন আসবেন, কোরস, মাদিয়-পারস্যের একজন উদ্ধারকর্তা (যিশাইয় ৪১,৪৫,৪৮), যিনি বাবিল সাম্রাজ্য নত ও পরাজিত করবেন (যিশাইয় ৪৬-৪৭) এবং ঈশ্বরের লোকদেরকে বাবিলের নির্বাসন থেকে প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেবেন (যিশাইয় ৪৮:২০-২২)।
যিশাইয় “সদাপ্রভুর দাস” নামে একজনের ভিবষ্যদ্বাণী দেন এবং কয়েকটি ‘সদাপ্রভুর দাসের গান’-এর মাধ্যমে তার জীবনের বর্ণনা করেন (যিশাইয় ৪২:১-৭, ৪৯:১-৯, ৫০:৪-৯, ৫২:১৩-৫৩:১২ এবং ৬১:১-৩)। কিন্তু “সদাপ্রভুর দাস” কে? এই উপাধী দ্বারা যিশাইয় কাকে বুঝান?
- প্রথমে ইস্রায়েল জাতিকে বুঝান (ঈশ্বরের লোক যারা ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করে)।
- দ্বিতীয়ত তিনি মাদিয়-পারস্যের কোরসকে বুঝান (যিনি ইস্রায়েলকে নির্বাসন থেকে মুক্ত করে ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করেন)।
- কিন্তু তিনি চূড়ান্তভাবে প্রতিজ্ঞাত মশীহকে বুঝান (যীশু খ্রীষ্ট যিনি সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারে কাজ ও জীবন-যাপন করেন)।
যিশাইয় মশীহের বর্ণনা এভাবে দেন: মশীহ সত্যিকার অর্থে ঈশ্বরকে সেবা করেন এবং ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণ বাধ্য হয়ে তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করেন। তিনি নম্র ও মনেপ্রাণে বিশ্বস্ত। তিনি প্রত্যেক মুহূর্তে ঈশ্বরের উপর নির্ভর করেন এবং অন্যদের জন্য ত্যাগ-স্বীকার ও কষ্টভোগ করতে রাজি। “সদাপ্রভুর দাস”ই হলেন সেই প্রতিজ্ঞাত উদ্ধারকর্তা যিনি ভবিষ্যতে আসবেন। কিন্তু এমন কি এখন তিনি ঈশ্বরের অন্বেষণকারীদের জন্য আদর্শ। “সদাপ্রভুর দাস”-এর মনোভাব ও চরিত্র হল ঠিক যা ঈশ্বর তাঁর অনুসরনকারীদের মধ্যে দেখতে চান: নম্রতা, শুধুমাত্র ঈশ্বরের উপর ভরসা, অন্যদের সেবা করার জন্য আগ্রহ এবং ঈশ্বরের প্রতি গভীর বিশ্বাস।
সদাপ্রভুর এই দাস জাতিগুলোর জন্য আলোস্বরূপ হবেন (যিশাইয় ৪৯:৬) এবং তিনি তার অনুসরনকারীদেরও জাতিগুলোর জন্য আলোস্বরূপ ব্যবহার করবেন (যিশাইয় ৬০:১-৩)। তিনি সব কিছু, এমন কি সম্পূর্ণ সৃষ্টি পুনরুদ্ধার ও নতুন করে স্থাপন করবেন (যিশাইয় ৬৫:১৭)।
যিশাইয় যিহূদা জাতির এবং যিহূদার ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলোর জন্য একটি অদ্ভুত দর্শন রেখে যান, একটি উদ্ধার যা বিশ্বাস এবং যোগ্যতারও অধিক আশ্চর্য। ঈশ্বর এমন লোকদের খোঁজ করেন যারা নম্র, যারা ঈশ্বরের এই প্রতিজ্ঞাগুলো বিশ্বাস করে এবং তাঁর চরিত্রের উপর ভরসা রাখে। আজও তিনি ঠিক এমন লোকদেরই খোঁজ করেন।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।