যিহূদা তার পাঠকদের ভ্রান্ত শিক্ষকদের চরিত্র ও আচরণের বিষয়ে কঠোর একটি সাবধানবাণী দেন। তিনি তাদের চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা তাদের বিশ্বাসের জন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করে, ঈশ্বরের ভালবাসার মধ্যে থাকে, ঈশ্বরীয় চরিত্রে বৃদ্ধি পায় এবং যারা ভ্রান্ত শিক্ষকদের প্রভাবে পড়েছে তাদের সাবধানতার সঙ্গে রক্ষা করে।
লেখক নিজের পরিচয়ের বিষয়ে বলেন “আমি প্রভু খ্রীষ্টের দাস ও যাকোবের ভাই যিহূদা”। তা হল নম্র একটি আত্ম-পরিচয় কারণ তিনি যীশুর আপন ছোট ভাই (বা সৎ-ভাই), যোষেফ ও মরিয়মের স্বাভাবিকভাবে জন্ম গ্রহণ করা চতুর্থ ছেলে সন্তান, কিন্তু তিনি তা উল্লেখ করেন না (মার্ক ৬:৩, মথি ১৩:৫৫)। তার নম্রতা আরো প্রকাশ পায় যখন যিহূদা নিজেকে প্রেরিতদের মধ্যে একজন হিসাবে গুণেন না (যিহূদা ১৭-১৮)।
প্রথমদিকে যিহূদা যীশুর অনুসরণকারী ছিলেন না (মার্ক ৩:২১-২২, যোহন ৭:৫), কিন্তু আস্তে-আস্তে তিনি বুঝতে পারেন যে তার বড় ভাই যীশু আসলেই সে প্রতিজ্ঞাত মশীহ। মণ্ডলীর ঐতিহ্য (মণ্ডলীর আদিপিতা আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লিমেন্ট, পলিকার্প, তের্তুল্লিয়ান, ওরিগেন ও হেগেসিপ্পাস) বলেন যে, যীশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের ত্রিশ বা চল্লিশ বছরের মধ্যে যীশুর আপন ভাই যিহূদা যিহূদা নামে সে চিঠি লেখেন।
পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে যিহূদা একটি নির্দিষ্ট মণ্ডলীর কাছে লেখেন যা ভ্রান্ত শিক্ষকদের প্রভাবে পড়েছে, কিন্তু তিনি কোন মণ্ডলীর কাছে লেখেন, তা অজানা। মণ্ডলীটি নতুনভাবে স্থাপিত মণ্ডলী নয় (যিহূদা ৫) এবং কয়েকজন প্রেরিতদের সঙ্গে মণ্ডলীর পরিচয় আছে (যিহূদা ১৮)। হতে পারে মণ্ডলীতে বেশ কিছু যিহূদী বিশ্বাসী আছে বলে যিহূদা বেশি পুরাতন নিয়মের উদ্ধৃতিগুলি দেন এবং এমন লেখার ধরণ ব্যবহার করেন যা বিশেষভাবে যিহূদীদের জন্য সুবিধার ছিল। অবশ্যই অনেক মণ্ডলীগুলিতে যিহূদী বিশ্বাসী ছিল, তাই তা থেকে নিশ্চিত জানা যায় না মণ্ডলী ঠিক কোথায়। যিহূদা ও ২ পিতর চিঠির অনেক মিল আছে বলে চিন্তা করা যায় যে দুইটি চিঠি একই এলাকার পাঠকদের উদ্দেশ্যে লেখা। সাধারণত এশিয়া মাইনরকে পাঠকদের এলাকা হিসাবে ধরা হয়, কিন্তু তা নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায় না।
যিহূদা ভ্রান্ত শিক্ষকদের চরিত্র, আচরণ ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে খুব শক্তিশালী ও ভয়ংকর বর্ণনা দেন। কিন্তু তিনি সারা চিঠিতে একবারও বলেন না, তারা আসলে কি ভ্রান্ত শিক্ষা দেয়। তাই যিহূদা তাদের শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেয় না কিন্তু তাদের খারাপ চরিত্র ও মন্দ উদ্দেশ্যে তার অনেক কিছু বলার আছে। যিহূদা দাবি করেন যে একজন লোকের দৈনিক জীবনের ধরণ হল তার গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি। ফল দেখলে বুঝা যায় তা কি ধরণের গাছ।
যিহূদা ভ্রান্ত শিক্ষকদের বর্ণনা করেন এমন লোক হিসাবে যারা ছলনা করে, ঈশ্বরের দয়া খারাপ কাজের সুযোগে পরিণত করে, যীশুকে অস্বীকার করে (যিহূদা ৪), অধিকার অগ্রাহ্য করে (যিহূদা ৮), নিন্দা করে (যিহূদা ৮,১০)। তারা লোভী ও বিদ্রোহী লোক (যিহূদা ১১)। তারা তাদের কামনা-বাসনা অনুসারে চলা-ফেরা করে, তারা অভিযোগ করে, নিজেদের নিয়ে গর্ব করে, লাভের জন্য লোকদের খোশামোদ করে (যিহূদা ১৬), ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে (যিহূদা ১৮) এবং দলাদলির সৃষ্টি করে (যিহূদা ১৯)। যিহূদা শক্তিশালী রূপক দিয়ে ভ্রান্তদের বর্ণনা করেন। তিনি তাদের বর্ণনায় বলেন “বাতাসে বয়ে যাওয়া জলহীন মেঘ”, “ফলহীন গাছ”, “ঝড়ের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ, সমুদ্রের ফেনার মতই এদের লজ্জার কাজগুলো ভেসে উঠে” এবং “ঘুরে-বেড়ানো তারার মত” (যিহূদা ১২-১৩)।
যিহূদা বলেন যে তারা “চুপি চুপি ঢুকে পড়েছে” (যিহূদা ৪)। তা থেকে বুঝা যায় যে তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুলে পড়া বিশ্বাসী নয়, বরং তারা অবিশ্বাসী যারা পরিকল্পিতভাবে বিশ্বাসীদের উপর প্রভাব ফেলে, যেন তারা তাদের নিজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে। এর জন্য তিনি ভ্রান্ত শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ বিচার নিয়ে বার বার ভয়ংকর ধ্বংসাবাণী দেন (যিহূদা ৪,৫,৬,৭,১০,১১,১৩,১৫)।
মণ্ডলীর বিশ্বাসীরা এই অবস্থায় কি করবে? যিহূদা তাদের দিক-নির্দেশনা দেন যেন তারা অস্থিরমনাদের দয়া করে (যিহূদা ২২), যেন তারা আগুন থেকে তুলে এনে অন্যদের রক্ষা করে (যিহূদা ২৩), পাপ-স্বভাবের দ্বারা যাদের জীবন নোংরা হয়েছে তাদের অশুচি কাপড় পর্যন্ত ঘৃণা করে নিজেদের সাবধানে রেখে তাদের দয়া করে (যিহূদা ২৪)।
যিহূদা বিশ্বাসীদের আরো দেখান যে ভ্রান্ত শিক্ষার বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকারী প্রতিরোধ হল যীশুতে বৃদ্ধি পেতে থাকা। তিনি বিশ্বাসীদের স্মরণ করিয়ে দেন যে ঈশ্বর তাদের ডেকেছেন ও ভালবেসেছেন। যীশু খ্রীষ্ট তাদের রক্ষা করেছেন (যিহূদা ১) এবং তাদের দয়া, শান্তি এবং ভালবাসা দান করেছেন (যিহূদা ২)। ঈশ্বর তাঁর লোকদেরকে চিরকালের জন্য যা দিয়েছেন, তারা যেন তার পক্ষে প্রাণপণে যুদ্ধ করে, যিহূদা তার পাঠকদের চ্যালেঞ্জ করেন (যিহূদা ৩)। তিনি তাদের স্মরণ করিয়ে দেন ভ্রান্ত শিক্ষকদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে অবশ্যই বিচার করা হবে (যিহূদা ৫,৭)। তিনি তাদের চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা তাদের পরম পবিত্র বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নিজেদের গড়ে তোলে, পবিত্র আত্মার দ্বারা পরিচালিত হয়ে প্রার্থনা করে (যিহূদা ২০), ঈশ্বরের ভালবাসার মধ্যে থাকে এবং যীশুর দয়া যা তাদের অনন্ত জীবনে নিয়ে যাবে, তার জন্য যেন অপেক্ষা করে (যিহূদা ২১)। তিনি তাদের নির্দেশনা দেন যেন তারা যীশুর আশীর্বাদ ও সাহায্য চাইতে থাকে এবং তিনি তার চিঠি শেষ করেন একটি উৎসাহদায়ক দর্শন নিয়ে: যীশু বিশ্বাসীদের নিখুঁত অবস্থায় নিজের মহিমার সামনে আনন্দের সঙ্গে উপস্থিত করবেন (যিহূদা ২৪)।
চিঠির লেখক
চিঠির লেখক নিজের পরিচয় এভাবে বর্ণনা করেন: “আমি যীশু খ্রীষ্টের দাস ও যাকোবের ভাই যিহূদা” (যিহূদা ১)। নতুন নিয়মে যিহূদা নামে পাঁচজন ব্যক্তি উল্লেখ করা হয়েছে:
- যিহূদা ইষ্কারিয়োৎ, বারোজন শিষ্যদের মধ্যে একজন। তিনি যীশুকে ধরিয়ে দেন এবং সে দিন যীশু ক্রুশে মারা যান, সে দিন তিনি আত্ম-হত্যা করেন (প্রেরিত ১:১৮, মথি ২৭:৩-৫)। তাই তিনি যিহূদা চিঠির লেখক হতে পারেন না।
- যিহূদা, বারোজন শিষ্যদের একজন। যোহন তাকে এভাবে চিহ্নিত রাখেন: “যিহূদা (ইষ্কারিয়োৎ নয়) তাঁকে বললেন…” (যোহন ১৪:২২)। বারোজন প্রেরিতদের তালিকাগুলি তুলনা করলে বুঝা যায় যে এই যিহূদার অন্য নাম হল যাকোবের ছেলে থদ্দেয় (লূক ৬:১৬, মথি ১০:২-৪)। যিহূদা থদ্দেয় চিঠির লেখক হতে পারেন কিন্তু মণ্ডলীর আদিপিতারা তাই বলেন না।
- পৌল, দামেষ্কের পথে যীশুর সাথে দেখা হওয়ার পরেই দামেষ্কে একজন যিহূদার বাড়িতে থাকেন (প্রেরিত ৯:১১)। এই যিহূদা সম্বন্ধে আর কিছু জানা যায় না এবং মণ্ডলীর আদিপিতারা তাকে কোন ক্ষেত্রে উল্লেখ করেন না।
- যিহূদা বরশাব্বা, যিনি সীলের সঙ্গে যিরূশালেম সভার চিঠি অযিহূদী মণ্ডলীগুলোর কাছে পৌঁছিয়ে দেন। সীল এবং তাকে “নবী” বলা হয় (প্রেরিত ১৫:৩২)। এই যিহূদা সম্বন্ধে আর কিছু জানা যায় না এবং মণ্ডলীর আদিপিতারা তাকে কোন ক্ষেত্রে উল্লেখ করেন না।
- যীশুর ভাই যিহূদা, যাকোবের ভাই (যিনি যিরূশালেম মণ্ডলীর নেতা)। তিনি যীশুর চতুর্থ ভাই (মথি ১৩:৫৫, মার্ক ৬:৩)। যিহূদা চিঠের লেখক নিজেকে “যাকোবের ভাই” বলেন। মণ্ডলীর আদিপিতারাও তাকে যিহূদা চিঠির লেখক হিসাবে চিহ্নিত রাখেন।
যিহূদা নিজেকে যীশুর ভাই হিসাবে পরিচয় দেন না যাতে তার নম্রতা প্রকাশ পায়। তা ছাড়া তিনি দাবি করেন না যে তিনি প্রেরিতদের মধ্যে একজন (যিহূদা ১৭-১৮)। পৌল উল্লেখ করেন যে যীশুর আপন ভাইয়েরা সুসমাচার প্রচারক হিসাবে পরিচর্যা করেন (১ করি ৯:৫)।
যেমন যীশুর পরিবারের অন্য সদস্যরা – যিহূদাও প্রথমদিকে যীশুর অনুসরনকারী নন (মার্ক ৩:২১-২২, যোহন ৭:৫) কিন্তু আস্তে আস্তে তিনি বুঝতে পারেন যে তার বড় (সৎ)ভাই যীশু আসলে সে প্রতিজ্ঞাত উদ্ধারকর্তা। যিহূদা বিশ্বাসী হয়ে যান এবং তিনি অনেক বছর পরে এই চিঠির লেখক হয়ে যান। মণ্ডলীর আদিপিতারা আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লীমেন্ত, পলিকার্প, তের্তুলিয়ান, ওরিগেন ও হেগেসিপ্পাস সবাই তাদের লেখাগুলিতে যীশুর ভাই যিহূদাকে চিঠিটির লেখক হিসাবে চিহ্নিত রাখেন।
চিঠির পাঠকরা
যিহূদা তার চিঠিটি এমন একটি মণ্ডলীর কাছে লেখেন যা ভ্রান্ত শিক্ষকদের প্রভাবে পড়েছে। মণ্ডলীটি ঠিক কোথায়, তা অজানা কিন্তু চিঠি থেকে জানা যায় যে মণ্ডলী যে নতুন ভাবে স্থাপিত মণ্ডলী, তা নয় (যিহূদা ৫) এবং যে মণ্ডলীর সদস্যরা কয়েকজন প্রেরিতদের সাথে পরিচিত হয়েছে (যিহূদা ১৮)। ধারণা করা যায় যে মণ্ডলীতে বেশ কিছু যিহূদী বিশ্বাসী আছে কারণ চিঠিটির বেশ যিহূদী একটি ভাব আছে: যিহূদা পুরাতন নিয়মের ব্যক্তি বা ঘটনা উল্লেখ করেন, তিনি এমন কি যিহূদী আপোক্রিফা থেকে কিছু বিষয় উল্লেখ করেন এবং তিনি যিহূদীদের কানে গ্রহণযোগ্য ত্রিপদী, পাঁচপদী ও সাতপদী ব্যবহার করেন। যিহূদা চিঠি ও ২ পিতর চিঠির ভাষার বেশ মিল আছে বলে অনেকে মনে করে যে দুইটি চিঠি এশিয়া মাইনর প্রদেশের একটি মণ্ডলীর কাছে লেখা।
যিহূদা বলেন “যে সব কথা আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টের প্রেরিতেরা আগে বলেছিলেন তা তোমরা মনে করে দেখ। তাঁরা তোমাদের এই কথা বলতেন …” (যিহূদা ১৭-১৮)। ধারণা করা যায় যে চিঠিটি এমন সময়ে লেখা যখন অধিকাংশ প্রেরিত আর জীবিত নন, তাই কমবেশি ৬৫ খ্রীষ্টাব্দের পরে।
যিহূদা চিঠি ও ২ পিতর চিঠির ভাষার যথেষ্ট মিল আছে, হতে পারে কারণ দুটি চিঠির প্রধান বিষয় হল ভ্রান্ত শিক্ষকদের চরিত্র ও আচরণ। অনেকে মনে করে যে যিহূদা ২ পিতর থেকে উদ্ধৃতি করেছেন, অন্যরা মনে করে যে পিতর যিহূদা চিঠি থেকে উদ্ধৃতি করেছেন। আসলে তা জানা যায় না। কিছু মিল নিচে দেখানো হয়েছে:
- যিহূদা ২ ২ পিতর ১:২ অনেক শান্তি দান করুন
- যিহূদা ৪ ২ পিতর ২:১ ভ্রান্ত শিক্ষকরা আমাদের মালিক ও প্রভু অস্বীকার করে
- যিহূদা ৬ ২ পিতর ২:৪ স্বর্গদূতরা নিজেদের জায়গা ছেড়ে, তাদের বিচারের উদ্দেশ্যে অন্ধকারে বেঁধে রেখেছেন
- যিহূদা ৭ ২ পিতর ২:৬ সোদম ও ঘমোরা নমুনা হয়ে আছে
- যিহূদা ৮ ২ পিতর ২:১০ নিজের দেহ অশুচি করা, শাসন অগ্রাহ্য
- যিহূদা ৯ ২ পিতর ২:১১ স্বর্গদূত অপমানের কথা বলতে সাহস করেন নি
- যিহূদা ১০ ২ পিতর ২:১২ ভণ্ড শিক্ষকেরা যা বোঝে না সেই সম্বন্ধে খারাপ কথা বলে বুদ্ধিহীন পশুদের মত নিজে থেকেই যা বুঝে তাতেই ধ্বংস হয়
- যিহূদা ১১ ২ পিতর ২:১৫ লোভের জন্য বিলিয়মের ভুলের হাতে নিজেদের ছেড়ে দিয়েছে
- যিহূদা ১২ ২ পিতর ২:১৩ তারা ময়লার মত হয়
- যিহূদা ১২ ২ পিতর ২:১৭ বাতাসে বয়ে নিয়ে যাওয়া জলহীন মেঘের মত
- যিহূদা ১৩ ২ পিতর ২:১৭ ভীষণ অন্ধকার এদের জন্য জমা করে রাখা হয়েছে
- যিহূদা ১৫ ২ পিতর ২:৬-৯ ভক্তিহীন লোকদের বিচার
- যিহূদা ১৬ ২ পিতর ২:১৮ নিজেদের নিয়ে গর্ব করে
- যিহূদা ১৭ ২ পিতর ৩:২ যে সব কথা প্রেরিতেরা আগে বলেছিলেন
- যিহূদা ১৮ ২ পিতর ৩:৩ ঠাট্টা বিদ্রুপ করাই যাদের স্বভাব, ভক্তিহীন কামনা-বাসনা অনুসারে চলবে
- যিহূদা ২১ ২ পিতর ৩:১২ খ্রীষ্টের দয়া যেন তোমাদের অনন্ত জীবনে নিয়ে যায় তারই অপেক্ষায়
মণ্ডলীর মূল সমস্যা: ভ্রান্ত শিক্ষকরা
যিহূদা তার চিঠির শুরুতে সমস্যাটি চিহ্নিত রাখেন: “যে লোকদের শাস্তি সম্বন্ধে আগেই শাস্ত্রে লেখা হয়েছিল তারা তোমাদের মধ্যে চুপি চুপি ঢুকে পড়েছে। ঈশ্বরের প্রতি এই লোকদের ভক্তি নেই; আমাদের ঈশ্বরের দয়াকে তারা লমপটতার একটা অজুহাত মনে করে এবং যিনি আমাদের একমাত্র মালিক ও প্রভু সেই যীশু খ্রীষ্টকে তারা অস্বীকার করে” (যিহূদা ৪)। ২ পিতর চিঠিতে পিতর সাবধানবাণী দেন যে ভ্রান্ত শিক্ষকরা আসবে (২ পিতর ২:১) কিন্তু যিহূদা চিঠিতে ভ্রান্ত শিক্ষকরা মণ্ডলীতে উপস্থিত।
তারা কি শিক্ষা দেয়? যিহূদা এই বিষয়ে বেশি কিছু বলেন না। তিনি ভ্রান্ত শিক্ষার সংশোধনে বেশি বলেন না কিন্তু ভ্রান্ত শিক্ষকদের খারাপ চরিত্র, আচারণ ও উদ্দেশগুলি নিয়ে তার অনেক কিছু বলার আছে।
যিহূদা চিঠি ও ২ পিতর চিঠির মধ্যে এত মিল আছে বলে উপসংহারে আসা যায় যে ২ পিতর চিঠিতে যেমন ঠিক তেমনি যিহূদা চিঠিতেও ভ্রান্ত শিক্ষরা হল নস্টিক। দুটি চিঠিতে ভ্রান্ত শিক্ষকদের বর্ণনার মিল:
- ২ পিতর ২:১ যিহূদা ৪ এমন জীবন ও শিক্ষা যা যীশুকে অস্বীকার করে
- ২ পিতর ২:১০-১৮ যিহূদা ৪, ১২ ভোজে ময়লার মত, অনৈতিক, অন্যদের দূষিত করে, স্বাধীনতার প্রতিজ্ঞা দেয়
- ২ পিতর ২:৩, ১২-১৮ যিহূদা ১৬ চালাক, তাদের উদ্দেশ্য লোভ বা লাভ, ছলনার কথা বলে, মিষ্টি কথা দিয়ে ভুলায়
- ২ পিতর ২:১, ১০-১১ যিহূদা ৮ দুঃসাহসী, নিজেদের ইচ্ছা মত চলে
- ২ পিতর ২:১ যিহূদা ৮ নবী বা শিক্ষক হতে দাবি করে
- ২ পিতর ২:২, ১০, ১৮ যিহূদা ১৮ নিজেদের ইচ্ছা মত চলে, বিভেদ সৃষ্টি করে, অহংকারী
- ২ পিতর ৩:৩ যিহূদা ১৮ নিন্দাকারী
- ২ পিতর ৩:১৫-১৬ – শাস্ত্রের বা পৌলের কথা ঘুরিয়ে বলে
- – যিহূদা ৪ যীশুর দয়াকে লস্পটতার একটা অজুহাত মনে করে
ভ্রান্ত শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত একটি মণ্ডলী
সে সময় প্রচলিত ভ্রান্ত শিক্ষা ছিল নস্টিসিসম। যদিও নস্টিক চিন্তা যিহূদা চিঠিতে সরাসরি উল্লেখ নেই তবুও নিচে নস্টিসিসমের একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে:
নস্টিসিসমের বর্ণনা
নস্তিসিসম ছিল একটি মিশানো ভ্রান্ত শিক্ষা যা কিছু শতাব্দী ধরে মণ্ডলীকে খুব হৈরানি করেছে। প্রেরিত যোহন এবং মণ্ডলীর বেশ কয়েকজন আদিপিতারা তাদের অধিকাংশ লেখাগুলি ছিল নস্টিসিসমের বিরুদ্ধেই লেখা।
গ্নস্টিসিসমের শব্দটি গ্রীক থেকে আসল: ‘নসিস’ গ্রীক ভাষার শব্দ যার অর্থ হল ‘জ্ঞান’। যদিও নস্টিসিসমের মধ্যে বিভিন্ন দল বা শাখাও ছিল, তাদের সবার এই ক্ষেত্রে মিল ছিল যে তারা জ্ঞানের উপরে খুব গুরুত্ব দিত। তারা ‘জ্ঞান’ বললে বুঝত: ‘গুপ্ত আত্মিক জ্ঞান, যা দ্বারা পরিত্রাণ পাওয়া যায়’।
নস্টিসিসম খুব গুরুত্বের সঙ্গে দাবি করত যে বস্তু জগত ও আত্মিক জগত সম্পূর্ণ আলাদা: বস্তু জগত মন্দ, আত্মিক জগত ভাল (বাস্তবতা দ্বিখন্ডিত)।
নস্টিসিসম বলে যে ‘একজন সর্বোচ্চ কর্তা’ আছেন। তিনি সম্পূর্ণ ভাল, তিনি আত্মা ও তাই এই মন্দ বস্তু জগত থেকে এমন দূরে বা এত আলাদা যে তিনি বস্তু জগতে কখনও হাত দেবেন না, তার সম্বন্ধে কিছু জানেনও না। এই কর্তার কোন ব্যক্তিত্ব নয়, তাকে জানা যায় না, চেনাও যায় না। নস্টিক চিন্তায় ‘জানা’ মানে ‘দমন করা’। সর্বোচ্চ কর্তাকে কেউ দমন করতে পারে না বলে কেউ তাদে জানতে সক্ষমও হবে না।
কিন্তু তা যদি হয়, এই বস্তু পৃথিবী কিভাবে তৈরি হয়েছে? মন্দ কিভাবে তৈরি হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে নস্টিসিসম একটি খুব জটিল ব্যাখ্যা দেয়: এই সর্বোচ্চ কর্তা থেকে রশ্মির মত কিছু বের হতে থাকে। এই রশ্মিগুলোও ভাল, কিন্তু কর্তার মত ভাল আর না। তাই একটি আত্মিক জগত জন্ম নেই যেখানে নানা ধরণের আত্মিক অস্থিত্ব আছে, যাদের বিভিন্ন পরিমাণে ‘ভাল’। নস্টিসিসম অনুসারে আস্তে আস্তে কিছুটা মন্দ ধরণেরও তৈরি হয়েছে। এই বিভিন্ন রশ্মিগুলোকে ‘এ্যায়োন’ (Aeon) বলা হয়। সব এ্যায়োনরা একসাথে কর্তার পূর্ণতা বুঝায়, যাকে ‘প্লেরোমা’ (pleroma) বলা হত।
নস্টিসিসম বলে যে মন্দ ‘এ্যায়োনদের’ মধ্যে একজন কর্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে (বা না চেয়ে দূর্ঘটনায়) বস্তু জগত সৃষ্টি করে ফেলেছিল। কিছু নস্টিক শিক্ষক বলত যে বাইবেলের সৃষ্টিকর্তাই সে মন্দ ‘এ্যায়োন’। তাই নস্টিকরা পুরাতন নিয়ম খুব নীচু চোখে দেখত যদিও তারা নতুন নিয়ম থেকে বিভিন্ন চিন্তা দত্তক নিত।
নস্টিসিসম বলত যে সর্বোচ্চ কর্তা থেকে কিছু টুকরা বা রশ্মি ভেঙ্গে গিয়ে মন্দ বস্তুর মধ্যে আটকিয়ে পড়েছিল, এমন কি কিছু মানুষের দেহে এই ধরণের একটি ঐশ্বিক টুকরা আটকিয়ে গেল। তাই নস্টিসিসম বলে যে তিন ধরণের মানুষ আছে:
- নস্টিক মানুষ (gnostic) তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্তার একটি টুকরা আছে, তারা আলোকিত ও আত্মিক ও তাদের আশা আছে, যে নানা আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করলে তারা মৃত্যুতে পুনরায় জন্ম থেকে মুক্ত হয়ে সর্বোচ্চ কর্তার সঙ্গে আবার এক হতে পারে।
- সাইকিক মানুষ (psychic) তারা কম উন্নত মানুষ, তাদের মধ্যে হয়তো সর্বোচ্চ কর্তার টুকরা আছে, তারা হয়তো আলোকিত হতে পারে। নস্টিকরা মনে করত যে খ্রীষ্টানরা প্সাইকিক দলে পড়ে।
- হাইকিক মানুষ (hychic) তারা বস্তু মানুষ মাত্র, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্তার কোন টুকরা নেই, তারা আলোকিত হওয়ার আশা নেই, তাই তারা পরিত্রান পেতে পারে না ও ধ্বংসে সমর্পিত।
নস্টিসিসম খ্রিষ্টান ধর্ম থেকে এই চিন্তা দত্তক নিল যে সে সর্বোচ্চ কর্তা একজন উদ্ধারকর্তা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন যার মধ্য দিয়ে প্সাইকিক বা নস্টিক মানুষ প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়। যাদের মধ্যে একটি ঐশ্বিক টুকরা আছে, তারা জ্ঞান ও আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করার মধ্য দিয়ে আলোকিত হতে সক্ষম হবে এবং তাদের দেহে আটকানো ঐশ্বিক টুকরা মৃত্যুর সময়ে মুক্ত হয়ে কর্তার সাথে আবার এক হবে।
তাই নস্টিক চিন্তায় অনুসারে পাপ-স্বভাব বা খারাপ আচরণ মানুষের এক নম্বর সমস্যা নয় বরং মানুষের সমস্যা হল ‘দেহ’ বা ‘বস্তু জগত’। নস্টিসিসম অনুসারে ‘পরিত্রাণ’ মানে না ‘যীশু দ্বারা পাপ থেকে উদ্ধার পাওয়া’ বরং মানে যে মানুষ জ্ঞান লাভের মধ্য দিয়ে তার দেহে সে ঐশ্বিক টুকরা মুক্ত করতে সক্ষম। এভাবে সে ‘আলোকিত’ বা ‘পরিত্রাণ প্রাপ্ত’ হয়ে যায়।
নস্টিসিসম অনুসারে মানুষের কি প্রয়োজন? মানুষের প্রয়োজন জ্ঞান লাভ একটি বিশেষ প্রকাশ লাভ করা, আলোকিত হওয়া ও আত্মিক অভিজ্ঞতা পাওয়া। কে তা পেতে সক্ষম হবে? শুধুমাত্র বিশেষ লোক তা পেতে সক্ষম হবে, সবাই না। তাই নস্টিসিসম ছিল ‘বিশেষ লোকদের গুপ্ত দল’। নস্টিকরা অন্য মানুষদের আশাহীন বলে বাদ দিত। নস্টিকদের মধ্যে বিভিন্ন দল বা আলোকিত হওয়ার বিভিন্ন স্তর থাকত। নস্টিসিসমে ফলে উচু-নীচু ভাব ও যথেষ্ট অহংকার থাকত।
নস্টিকরা দাবি করত যারা আলোকিতদের স্তরে পৌঁছায় তারা পাপ দ্বারা আর আক্রান্ত নয় বা নিজেকে আর দোষী করতে সক্ষম হয় না। যদি পরিত্রাণ জ্ঞান, আত্মিক অভিজ্ঞতার বা আলোকিত হওয়ার উপর নির্ভর করে তবে তা নৈতিক ব্যবাহর-আচরনের উপরে নির্ভর করে না। ফলে নস্টিকরা নৈতিকতায় বেশি গুরুত্ব দিত না। নস্টিকরা দাবি করত যে মানুষের দেহ মন্দ এবং যে মানুষের দেহ ও তার আত্মা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। তাই একজন মানুষের আত্মা একবার আলোকিত হলে তবে সে দেহ নিয়ে পরে কি করে, তা কিছু যায় আসে না।
এই দ্বিখন্ডিত চিন্তা থেকে দুই ধরণের শিক্ষা তৈরি হল, এক পাশে সন্যাসী চিন্তা (দেহকে দমন করা ও কষ্ট দিয়ে মানুষ বস্তুর উপরে জয়ী হয়) অথবা ওপাশে উদারপন্থী চিন্তা (দেহ আত্মাকে দূষিত করতে পারে না, তাই দেহ নিয়ে যা চাই তাই করা যায়)। যিহূদা ভ্রান্ত শিক্ষদের অনৈতিকতা ও কামনা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেন (যিহূদা ৪, ৭, ৮, ১২, ১৮)।
কিভাবে নস্টিকরা যীশুর বিষয় বুঝতেন?
নস্টিসিসম তাই বিশ্বাস করতে পারে না যে, ঈশ্বর মানুষ হলেন, কারণ পবিত্র আত্মা বা কোন কর্তা নিজেকে বস্তু শরীর দিয়ে দূষিত করবে না। তাহলে তারা যীশুর গল্প কিভাবে বুঝত?
কিছু নস্টিকরা বলত যে যীশু ছিলেন ‘আত্মা মাত্র’, এমন একটি আত্মা যা নিজেকে ‘মানুষের মত’ প্রকাশ করতেন কিন্তু আসলে স্পর্শ করা যেত না বরং মাটির উপর ভেসে যেত এবং পায়ের ছাপ বলতে কিছু পাওয়া যেত না।
অন্য কিছু নস্টিকরা দাবি করত যে (এইটাকে ‘ডোসিটিসিসম’ বলা হয়): যীশু পবিত্র আত্মা দিয়ে জন্ম নেন নি বরং তিনি মরিয়ম ও যোষেফের সাধারণ সন্তান ছিলেন, যদিও তিনি অন্য লোকদের চেয়ে একজন ধার্মিক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। তার বাপ্তস্মের সময়ে তিনি ‘খ্রীষট’ আত্মা পাওয়া হন। যে খ্রীষ্ট-আত্মা-পাওয়া যীশু ছিলেন প্রথম নস্টিক, তিনি এই মন্দ জগতের নয়, তিনি প্রলোভিতও হন না, তিনি আঘাত বা ব্যাথা পান না, তিনি ছিলেন এমন একজন আত্মিক ব্যক্তি যাকে বস্তু জগত স্পর্শ করতে সক্ষম নয়।
কিছু নস্টিকরা শিক্ষাও দিত যে যীশু একজন আত্মা মাত্র, মানুষ নন, তিনি ‘চেহারা দেখা দিলেন’ ও মাটি না ছুঁয়ে হাটতেন, ধূলায় তার পায়ের কোনো ছাপ পাওয়া যেত না।
যীশু ক্রুশে দেওয়ার আগে আত্মা খ্রীষ্ট তাকে ছেড়ে স্বর্গে চলে গেছে কারণ একজন আত্মাকে কষ্ট বা লজ্জা দেওয়া সম্ভব না। এই জগত তাকে দূষিত করতে পারে না, মৃত্যু তাকে স্পর্শ করতে পারে না। যীশুকে যন্ত্রণা দেওয়া ও ক্রুশে মারা যাওয়ার আগেই খ্রীষ্ট আত্মা তাকে ত্যাগ করে চলে গেছিল কারণ কোন আত্মা যন্ত্রণা বা মৃত্যু দিয়ে দূষিত হতে পারে না। হয়তো একারণে যিহূদা বলেন যে ভ্রান্ত শিক্ষকরা “আমাদের একমাত্র মালিক ও প্রভু যীশু খ্রীষ্টকে … অস্বীকার করে “ (যিহূদা ৪)।
নস্টিসিসম কিভাবে বাইবেলীয় শিক্ষার বিরুদ্ধে?
নস্টিসিসম হল একটি বিপজ্জনক ভ্রান্ত শিক্ষ যা মানুষের পাপ সমস্যা মনে করে না। নস্টিসিসমে পাপ স্বীকার, অনুতাপ, ক্ষমা চাওয়া ও জীবনকে পরিবর্তন করার কোন দাবি নেই। পবিত্র জীবন-যাপন, নৈতিক ব্যবহার, স্বার্থহীনতা, সেবা ও ভালবাসার গুরুত্ব নেই। নস্টিকরা ভাল আচরণ-চরিত্রের অনুসন্ধানে নয় বরং জ্ঞান, প্রকাশ ও আত্মিক অভিজ্ঞতার অনুসন্ধানে।
নস্টিসিসম অধিকাংশ মানুষকে নীচু চোখে দেখে, নিজেকে বিশেষ মনে করে, পার্থক্য করে ও অন্যদের বাদ দেয়। তাই নস্টিসিসম ‘আলোকিতদের’ অহংকার, স্বার্থপরতা ও অন্যদের নীচু চোখে দেখা উৎসাহিত করে, ‘সাইকিকদের’ (বিশ্বাসীদের) নিজের পরিত্রাণ নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে এবং ‘হাইকিকদের’ (বাকি সব লোকদের) জন্য কোন আশা দেখায় না। তা হল সুসমাচারের ঠিক বিপরীত যা সব জাতিদের জন্য যীশুতে বিশ্বাস দ্বারা আশার বাণী দেয়।
গ্নস্তিসিস্মে মানুষের সিদ্ধান্ত, সুখবর শুনে সাড়া, মানুষের হৃদয় ও মনোভাব একটাতেও গুরুত্ব দেয় না। বরং কার মধ্যে ঐশ্বিক টুকরা থাকে, তা নিয়ে ব্যস্ত। ফলে অহংকার, মানুষদের মধ্যে পার্থক্য করা ও নিজের জ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত থাকার একটি মনোভাব উৎসাহিত করে। নস্টিসিসম অধিকাংশ লোকদের ‘আলো ছাড়া’ ও এমন কি ‘আশা ছাড়া’ মনে করে এবং তাই পরিত্রাণ ও অনন্ত জীবন নিয়ে নিশ্চয়তা নষ্ট করে (কলসীয় পুস্তক দেখুন)।
জ্ঞান, প্রকাশ, বিশেষ আত্মিক অভিজ্ঞতা, আলোকিত হওয়ার অনুসন্ধান, গুপ্ত জ্ঞান, নিজেকে আলাদা মনে করা, তা সব লোকদের প্রতারণার ঝুঁকিতে, এমন কি অনৈতিকতার ঝুঁকিতেও ফেলে।
নস্টিসিসম বিশ্বাস করে না যে যীশু ঈশ্বর যিনি মানুষ হিসাবে পৃথিবীতে এসেছেন (কেন একজন খাঁটি আত্মা এই মন্দ বস্তু জগতে নামবে?), যে যীশু পুনরুত্থিত হয়েছেন (কেন একটি খাঁটি আত্মা নতুন দেহ চাইবে?), যে যীশুর দ্বিতীয় আগমনে সব সৃষ্টির পুনরুদ্ধার ঘটবে (কেন ঈশ্বর একটি বস্তু জগত পুনরায় স্থাপন করবেন?)।
মণ্ডলীর কাছে যিহূদার কথা
ভ্রান্ত শিক্ষকদের খারাপ চরিত্র, আচরণ ও উদ্দেশ্যগুলির বর্ণনা
যদিও যিহূদা ভ্রান্ত শিক্ষকদের শিক্ষার বিষয়ে বেশি কিছু বলেন না তবুও তিনি অনেক শক্তিশালী ভাষা দিয়ে তাদের চরিত্র ও আচরণের বর্ণনা দেন। এই ছোট চিঠির ২৫ পদে তিনি ২৫টা বর্ণনা দেন, তারাই কেমন লোক। তিনি দেখান যে তাদের উদ্দেশ্য হল নিজের আনন্দভোগ বা কামনা, টাকা-পয়সা বা লোভ এবং লোকদের উপরে নিয়ন্ত্রণ বা ক্ষমতা। নিচে দেওয়া তালিকায় একই রং ব্যবহৃত:
- যিহূদা ৪ যে লোকদের শাস্তি সম্বন্ধে আগেই শাস্ত্রে লেখা হয়েছিল
- যিহূদা ৪ তারা তোমাদের মধ্যে চুপি চুপি ঢুকে পড়েছে
- যিহূদা ৪ আমাদের ঈশ্বরের দয়াকে তারা লমপটতার একটা অজুহাত মনে করে
- যিহূদা ৪ যিনি আমাদের একমাত্র মালিক ও প্রভু সেই যীশু খ্রীষ্টকে তারা অস্বীকার করে
- যিহূদা ৭ সদোম, ঘমোরা মতই ব্যভিচার, এমন কি, অস্বাভাবিক ব্যভিচার করেছিল
- যিহূদা ৮ মন্দ স্বপ্নের বশে নিজেদের দেহ অশুচি করছে
- যিহূদা ৮ শাসন অগ্রাহ্য করছে
- যিহূদা ৮ গৌরবের পাত্রদের বিরুদ্ধে অপমানের কথা বলছে (মীখায়েল এমন কি শয়তানকেও অপমান করেন নি)
- যিহূদা ১০ ভণ্ড শিক্ষকেরা যা বোঝে না সেই সম্বন্ধে খারাপ কথা বলে
- যিহূদা ১০ বুদ্ধিহীন পশুদের মত নিজে থেকেই যা বোঝে তাতেই ধ্বংস হয়
- যিহূদা ১১ ধিক্ সেই লোকদের! তারা কয়িনের পথে গেছে (হিংসা, ভাইকে খুন)
- যিহূদা ১১ লাভের জন্য বিলিয়মের ভুলের হাতে নিজেদের ছেড়ে (লাভের জন্য অন্যদের পাপের প্রলোভনে ফেলে)
- যিহূদা ১১ আর কোরহের মত বিদ্রোহ করে ধ্বংস হয়ে গেছে (আত্মিক অহংকার, বিদ্রোহ)
- যিহূদা ১২ তোমাদের সেই ভোজের মধ্যে তারা ময়লার মত হয়
- যিহূদা ১২ দুঃসাহস নিয়ে তোমাদের প্রীতি-ভোজে যোগ দেয় … এরা কেবল নিজেদের বিষয়েই চিন্তা করে
- যিহূদা ১২ বাতাসে বয়ে নিয়ে যাওয়া জলহীন মেঘের মত
- যিহূদা ১২ ফল পাড়বার সময়ে ফলহীন বলে শিকড় সুদ্ধ উপ্ড়ে ফেলা গাছের মত
- যিহূদা ১৩ এরা ঝড়ের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত; সমুদ্রের ফেনার মতই এদের লজ্জার কাজগুলো ভেসে ওঠে
- যিহূদা ১৩ এরা ঘুরে বেড়ানো তারার মতই; চিরকালের জন্য ভীষণ অন্ধকার এদের জন্য জমা করে রাখা হয়েছে।
- যিহূদা ১৬ সব সময় অসন্তুষ্টির ভাব দেখায়, নিজেদের ভাগ্যের দোষ দেয়
- যিহূদা ১৬ তারা নিজেদের নিয়ে গর্ব করে
- যিহূদা ১৬ লাভের জন্য লোকদের খোশামোদ করে
- যিহূদা ১৮ ঠাট্টা-বিদ্রূপ করাই যাদের স্বভাব, তাদের ভক্তিহীন কামনা-বাসনা অনুসারে চলবে
- যিহূদা ১৯ এই লোকেরা দলাদলির সৃষ্টি করে এবং তারা নিজেদের ইচ্ছামত চলে। তাদের অন্তরে পবিত্র আত্মা নেই।
যিহূদার বর্ণনা অনুসারে ভ্রান্ত শিক্ষক হল ছলনার লোক, তারা যীশুর দয়াকে কামনার অজুহাত মনে করে, যীশুকে অস্বীকার করে, অধিকার অগ্রাহ্য করে, অপমান বা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে, কামনা দিয়ে চালিত, লোভী ও বিদ্রোহী, অসন্তোষ, গর্ব ও তামাশার লোক ও বিভেদ সৃষ্টিকারী। যিহূদা তাদের বর্ণনায় শক্তিশালী রূপক ব্যবহার করেন: “জলহীন মেঘ”, “ফলহীন গাছ”, “ঝড়ের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউর মত” যাতে “লজ্জার কাজগুলো ভেসে উঠে”, ঘরে বেড়ানো তারা (যিহূদা ১২-১৩, নিচের ছবি দেখুন)।
যিহূদা চান যেন তার পাঠকরা একজন শিক্ষকের দৈনন্দিন জীবন ও আচার-ব্যবহার দেখে বুঝে শিক্ষকটি কি ধরণের লোক – গাছের ফল দেখে গাছকে চেনা যায়। সত্য মানে না কোন গোপন জ্ঞান বা বিশেষ আত্মিক অভিজ্ঞতা (যেমন নস্টিকরা অনুসন্ধান করত) বরং সত্য এমন কিছু যা দৈনন্দিন ব্যবহারিক বিষয়ে বা একজন ঈশ্বরীয়, ভালবাসা ও সেবাপূর্ণ জীবনে প্রমাণিত।
যিহূদা পাঠকদের নিশ্চয়তা দেন যে আগে থেকে যীশু ও প্রেরিতরা ঘোষণা করেছিলেন যে ভ্রান্ত শিক্ষকরা আসবে (যিহূদা ১৭-১৮)। তাই এই বিষয় ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বা ভয় পাওয়ার কিছু নয়, তা পাঠকদের দোষও নয় বরং তা কেবল এমন একটি বাস্তব বিষয় যার বিরুদ্ধে তাদের শক্তিশালীভাবে দাঁড়াতে শিখতে হবে।
মণ্ডলীতে যে ভ্রান্ত শিক্ষকরা এসেছে, তারা কি ছলনাকারী বা তারা সাধারণ বিশ্বাসী যারা একটি ভ্রান্ত শিক্ষার প্রভাবে পড়েছে? যিহূদা বলেন যে ভ্রান্ত শিক্ষকরা পাঠকদের মধ্যে “চুপি চুপি ঢুকে পড়েছে” (যিহূদা ৪) যা থেকে বুঝা যায় যে ভ্রান্ত শিক্ষকরা ছলনা দ্বারা ও খারাপ উদ্দেশ্যে মণ্ডলীতে ঢুকে পড়েছে, এমন না যে তারা বিশ্বাসী যারা ভুল শিক্ষার প্রভাবে পড়েছে। তারা ভান করে নিজেকে বিশ্বাসী হিসাবে উপস্থাপনা করে যেন মণ্ডলীতে প্রভাব ফেলতে পারে কিন্তু তারা আসল বিশ্বাসী নয়, তারা যীশু খ্রীষ্টকে অস্বীকার করে (যিহূদা ৪)।
একারণে যিহূদা বার বার জোরের সঙ্গে বলেন যে এই ছলনাকারীদের চুড়ান্ত বিচার নিশ্চিত (যিহূদা ৪, ৫, ৬, ৭, ১০, ১১, ১৩, ১৫)। এই ধ্বংসবাণীগুলির মধ্য দিয়ে যিহূদি ভ্রান্ত শিক্ষক এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত বিশ্বাসীদেরকে একটি শক্তিশালী সাবধাণবাণী দেন।
মণ্ডলীতে বিভিন্ন লোকদের জন্য কি করা দরকার?
মণ্ডলীতে বিভিন্ন লোকদের জন্য এখন কি করা দরকার? যিহূদা এই বিষয়ে ব্যবহারিক আদেশ দোন:
• সবাই ভ্রান্ত শিক্ষকদের থেকে দূরে থেকো (যিহূদা ৪)!
• যাদের বিশ্বাস স্থির নয় তাদের দয়া কর (যিহূদা ২২)!
• অন্যদের আগুন থেকে তুলে এনে রক্ষা কর (যিহূদা ২৩)!
• পাপ-স্বভাবের দ্বারা যাদের জীবন নোংরা হয়েছে তাদের অশুচি কাপড় পর্যন্ত ঘৃণা কর এবং নিজেদের সাবধানে রেখে তাদের দয়া কর (যিহূদা ২৩)!
এই আদেশগুলির মধ্যে একটি ধারাবাহিকতা পাওয়া যায়: মণ্ডলীর সদস্যরা যে পরিমাণে ভ্রান্ত শিক্ষায় সাড়া দিয়েছে তা অনুসারে তাদের প্রতি এখন ব্যবহার করতে হবে (ছবি দেখুন)।
খ্রীষ্টেতে বৃদ্ধি পেতে থাক!
যিহূদা বিশ্বাসীদের দেখান যে ভ্রান্ত শিক্ষার বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভাল প্রতিরোধ হল অনবরত খ্রীষ্টের মধ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকা। তিনি তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন যে পিতা ঈশ্বর ও যীশু তাদের “ডেকেছেন ও ভালবেসেছেন এবং … রক্ষা করেছেন” (যিহূদা ১) এবং যে তারা ঈশ্বরের দয়া, শান্তি ও ভালবাসার পাত্র (যিহূদা ২)। যিহূদা তাদের চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা “খ্রীষ্টীয় ধর্মি-বিশ্বাসের পক্ষে … প্রাণপণে যুদ্ধ” করে (যিহূদা ৩)। তিনি তাদের নিশ্চয়তা দেন যে ভ্রান্ত শিক্ষক বা ছলনাকারীদের অবশ্যই বিচার করা হবে (যিহূদা ৫)যেমন আগে থেকে বলা হয়েছে (যিহূদা ১৭)। তিনি তাদের নির্দেশ দেন যেন তারা “পরম পবিত্র বিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে নিজেদের গড়ে” তুলে, “পবিত্র আত্মার দ্বারা পরিচালিত হয়ে প্রার্তনা” করতে থাকে (যিহূদা ২০), “ঈশ্বের ভালবাসার মধ্যে” থাকে এবং “যীশু খ্রীষ্টের দয়া” তাদের “অনন্ত জীবনে নিয়ে যায় তারই অপেক্ষায়” (যিহূদা ২২) এবং যেন ঈশ্বরের উপর নির্ভর করতে থাকে যিনি তাদের “উছোট খাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে নিখুঁত অবস্থায় নিজের মহিমার সামনে আনন্দের সংগে উপস্থিত করতে পারেন” (যিহূদা ২৪-২৫)। এই অনুপ্রেরণা দায়ক উঁচু দৃষ্টি দিয়ে যিহূদা তার চিঠি শেষ করেন।
পুরাতন নিয়মের বাইরে কিছু আপোক্রিফার লেখাগুলি উদ্ধৃতি
যখন যিহূদা ভ্রান্ত শিক্ষদের খারাপ চরিত্র ও লজ্জাহীন ব্যবহারের বর্ণনা দেন তিনি পুরাতন নিয়মের বাইরে কিছু আপোক্রিফার লেখাগুলি উদ্ধৃতি বা উল্লেখ করেন:
যিহূদা তার চিঠির ৯ম পদে একটি যিহূদী আপোক্রিফা লেখা উল্লেখ করেন যার নাম হল “মোশিকে গ্রহণ” (The assumption of Moses), মণ্ডলীর আদিপিতা ওরিগেন বলেন। লেখাটির মূল কপি আজকে আর পাওয়া যায় না তবুও তার গ্রীক অনুবাদের কিছু টুকরা পাওয়া গেছে। যিহূদী আপোক্রিফা হল বেশ কিছু যিহূদী লেখার একটি সংগ্রহ যারা পুরাতন নিয়মের সাথে সম্পর্কিত। যিহূদীরা আপোক্রিফা জানত ও পড়ত কিন্তু তারা আপোক্রিফাকে “ঈশ্বরের অধিকারগত বাক্য” মনে করত না।
তার চিঠির ৬, ১৪ ও ১৫ম পদে যিহূদা আর একটি যিহূদী লেখা উল্লেখ করেন যার নাম হল “১ হনোক” (1 Enoch 1:9, 6:1-8:4, 10:1-6)। লেখাটির শুধুমাত্র অল্প কিছু দলিলের টুকরা আজ পর্যন্ত থেকে গেছে। লেখাটি হল ইব্রীয় ভাষায় লিখিত “সুদো-এপিগ্রাফা” (Pseudo-Epigrapha) নামে একটি সংগ্রহের অংশ। সুদো-এপিগ্রাফার মধ্যে এমন লেখা পাওয়া যায় যা বাইবেলের একটি ব্যক্তি তুলে নিয়ে ‘তার নামে’ কাল্পনিক কথা বলে, যেমন এখানে হনোক। এভাবে লেখক তার কথায় গুরুত্ব দিত।
প্রথম বাইবেলের কথা ও যোগ দেওয়া কথা দেখানো হবে, পরে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে যিহূদা এই লেখাগুলি কেন ব্যবহার করেন এবং তিনি তা দ্বারা কি বুঝান।
যিহূদা ৯ মোশির কবর দান এবং মীখায়েলের ধমক
পুরাতন নিয়ম মোশির মৃত্যুর বর্ণনা এভাবে দেন: “সদাপ্রভু যা বলেছিলেন সেই অনুসারে সদাপ্রভুর দাস মোশি ঐ মোয়াব দেশেই মারা গেলেন। মোয়াব দেশের বৈৎ-পিয়োরের কাছে যে উপত্যকা ছিল সেখানে সদাপ্রভুই তাঁকে কবর দিলেন, কিন্তু তাঁর কবরটা যে কোথায় তা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৪:৫-৬)। এই পদগুলি পড়লে অনেকে প্রশ্ন করে: কিভাবে মোশি মারা গেলেন? কে তাকে কবর দিলেন? ঈশ্বর? ঈশ্বর কি অশুচি লাশ স্পর্শ করেন? তা করলে তিনি কি অশুচি হন? অথবা যদি ঈশ্বর নিজের হাতে কবর না দিলে কি একটি স্বর্গদূত তাই করতে বলেছিলেন? – এই ধরণের প্রশ্ন বেশ স্বাভাবিক, যে বিষয়ে বাইবেল কোন খুঁটিনাটি বর্ণনা দেয় না সে বিষয়ে মানুষের কল্পনা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর বাইবেল দিতে চায় না তা বাইবেল থেকে জোর করে বের না করাই ভাল। যিহূদী ইতিহাসবিদ যোষিফাস ফ্লাভিয়াস (Josephus Flavius) এই বিষয়ে মন্তব্য করেন যে ঈশ্বর লুকিয়ে মোশিকে কবর দিলেন যেন তার কবর পূজার স্থান বা মাজার হয়ে না যায়।
যিহূদী আপোক্রিফার “মোশির গ্রহণ” লেখাটিতে এখানে কাল্পনিক বিষয় যোগ দেওয়া হয়: ঈশ্বর স্বর্গদূত মীখায়েলকে পাঠান যেন তিনি মোশিকে কবর দেন কিন্তু শয়তান প্রতিরোধ করে বলৈন যে মোশির দেহ তারই কারণ মোশি খুন করেছিলেন (যাত্রা ২:১২) এবং ফলে তিনি দোষী। শয়তান মোশির নামে নিন্দা করে ও মীখায়েলের সাথে তর্ক করে কিন্তু মীখায়েল শয়তানকে শুধুমাত্র বলেন “প্রভু তোমাকে ধমন দিউন” যাতে শয়তান চলে যায়।
সে স্বর্গদূত মীখায়েল কে? বাইবেলে পাঁচ বার তার উল্লেখ করা হয়:
দানিয়েল ১০:১৩ “মীখায়েল নামে প্রধান স্বর্গদূতদের একজন” উল্লেখ যিনি যুদ্ধ করেন
দানিয়েল ১০:২১ “তোমার লোকদের প্রধান সেই মীখায়েল”এর উল্লেখ, মানে ইস্রায়েলের প্রধান
দানিয়েল ১২:১ “তোমার লোকদের রক্ষাকারী মহান স্বর্গদূত মীখায়েল”
প্রকাশিত বাক্য ১২:৭ “মীখায়েল ও তাঁর অধীন দূতেরা সেই দানব ও তাঁর দূতদের সংগে যুদ্ধ করলেন”
যিহূদা ৯ আপোক্রিফার উল্লেখ: মীখায়েল শয়তানকে ধমক দেন
সব মিলিয়ে বলা যায় যে মীখায়েল হল ঈশ্বরের একটি সৃষ্টি, একজন দূত বা আত্মা যাকে ঈশ্বরের লোকদের সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হন। যিহূদী আপোক্রিফায় মীখায়েল হলেন ইস্রায়েলের সুরক্ষাকারী দূত ও বিনতিকারী (১ হনোক ২০:৫, ৮৯:৭৬)।
যিহূদা ৬, ১৪-১৫ যে দূত পাপ করেছে, তার বিষয়ে হনোকের কথা
পৌল বিশ্বাসীদের বিভিন্ন সময় যিহূদী কাহিনী নিয়ে ব্যস্ত থাকার বিরুদ্ধে সাবধানবাণী দেন (১ তীম ১:৪, ৪:৭, ২ তীম ৪:৪, তীত ১:১৪, ২ পিতর ১:১৬)। আদিপুস্তক বলে (আদি ৬:১-২): “মানুষ যখন পৃথিবীর উপর নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে চলল এবং তাদের মধ্যে অনেক মেয়েরও জন্ম হল তখন ঈশ্বরের সন্তানেরা এই মেয়েদের সুন্দরী দেখে যার যাকে ইচ্ছা তাকেই বিয়ে করতে লাগল”। দুটি পদের উপর ভিত্তি করে একটি প্রচলিত যিহূদী কাহিনী উঠল: স্বর্গদূতদের পতনের গল্প। সবচেয়ে বিস্তারিত স্বর্গদূতদের পতনের গল্প ১ হনোক নামে একটি সুদো-এপিগ্রাফার লেখায় পাওয়া যায়। কাহিনীটি আসলে প্রচলিত ছিল, অধিকাংশ যিহূদী বিশ্বাসীরা তা জানত যদিও তারা তা ‘ঈশ্বরের অধিকারগত বাক্য’ হিসাবে মানত না। উদাহরণস্বরূপ নিচে দেওয়া যিহূদীদের লেখায় উল্লেখ আছে যে তারা কাহিনীটি সত্য মনে করত না:
• সুদো ফিলো নামে একজন ফরীশী (১ম শতাব্দ, Pseudo Philo, Book of Antiquities 3:1)
• রব্বী শিমিয়োন বিন ইয়োহাই (Rabbi Simeon Ben Yohai, Genesis Rabbah 26:5)
• ত্রীফো, একজন যিহূদী যিনি মণ্ডলীর আদিপিতা শহীদ যাষ্টিনের সাথে তর্ক করেছিলেন (Trypho, Dialogue 1:79:1)
তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: যীশু নিজেই বলেন যে পুনরুত্থিত মানুষ দূতের মত (মার্ক ১২:২৫), যার দ্বারা তাও বুঝা যায় যে দূতের ক্ষেত্রের যৌন সম্পর্কের প্রশ্ন আসে না।
নস্টিকরা স্বর্গদূতদের পতরের গল্প বিশ্বাস করত।
কোন যিহূদা এই ধরণের লেখাগুলি উল্লেখ করেন?
কেন যিহূদা এই ধরণের লেখাগুলি উল্লেখ করেন বা এমন কি উদ্ধৃতি করেন? তিনি উদ্ধৃতিটি করেছেন, এর অর্থ কি এই যে তিনি সে লেখাগুলি ‘ঈশ্বরের অধিকারগত বাক্য’ মনে করেন? তিনি তা উদ্ধৃতি করেছেন, এর অর্থ কি এই যে লেখাগুলি ফলে ‘ঈশ্বরের অধিকারগত বাক্য’ হয়ে গেল? এর অর্থ কি এই যে সম্পূর্ণ ‘মোশির গ্রহণ’ বা ‘১ হনোক’ লেখাগুলি ‘ঈশ্বরের বাক্য’? এর অর্থ কি এই যে যিহূদা এখানে ভুল করেন, তাই তারই সম্পূর্ণ লেখা গ্রহণযোগ্য নয়? তার লেখা তাহলে কি বাইবেল থেকে বাদ দেওয়া ভাল?
প্রথম আমাদের বলতে হয় যে নতুন নিয়মের প্রায়ই একজন লেখক বাইবেলের বাইরে কোন লেখা থেকে উদ্ধৃতি করেন। নিচে এই ধরণের উদ্ধৃতির একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে:
পদ
কে করেন
কি উদ্ধৃতি করেন
বর্ণনা
উদ্ধৃতি
মথি ১১:১৭
যীশু
বাচ্চাদের ছড়া?
‘আমরা তোমাদের জন্য বাশী বাজালাম, তোমরা নাচলে না; বিলাপের গান গাইলাম তোমরা বুক চাপড়ালে না’
মথি ২৩:৩৫
যীশু
যিহূদী ঐতিহ্য বা
ঈশ্বর থেকে জ্ঞান
আসল ঐতিহাসিক ঘটনা, কিন্তু পুরাতন নিয়মে তার উল্লেখ নেই
‘নির্দোষ হেবলের খুন থেকে আরম্ভ করে আপনারা যে বরখিয়ের ছেলে সখরিয়কে পবিত্র স্থান আর বেদীর মাঝখানে খুন করেছিলেন’
প্রেরিত ৭:২২
স্তিফান
মৌখিক ঐতিহ্য
‘মোশি মিসরীয়দের সমস্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হলেন …’
প্রেরিত ১৭:২৮
পৌল
গ্রীক কবী আরাটাস ‘ফেনোমেনা ৫’
এথেন্সে আয়েরপাগে তার একটি উক্তি
‘আমরাও তাঁর সন্তান’
১ করি ১০:৮
পৌল
Rabbinic Midrash on the Rock
উদ্ধৃতি না, কিন্ত উল্লেখ: ‘ঈশ্বরের দেওয়া যে পাথর তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছিল …’
১ করি ১৫:৩২-৩৩
পৌল
অযিহূদী কবী মেনান্দার
‘এসো আমরা খাওয়া-দাওয়া করি কারণ কালকে আমরা মরে যাব’ .. ‘খারাপ সঙ্গী ভাল লোককেও খারাপ করে দেয়’
গাল ৩:১৯ প্রে ৭:৩৮
পৌল, স্তিফান
যিহূদী ঐতিহ্য
‘আইন-কানুন দেওয়া হয়েছিল স্বদূতদের মধ্য দিয়ে’ .. ‘মোশিই সেই স্বর্গদূতের সঙ্গে সেখানে ছিলেন’ ..
২ তী ৩:৮
পৌল
যিহূদী ‘হাগ্গাদা’
বাইবেলের বাইরের বিভিন্ন যিহূদী লেখায় তার উদ্ধতি পাওয়া যায়
‘যেভাবে যান্নি ও যাম্ব্রি মোশির বিরুদ্ধে দাঁডিয়েছিল’
তীত ১:১২
পৌল
গ্রীক কবী / নবী এপিমেনিদেস
‘ক্রীট দ্বীপের লোকেরা বরাবরই মিথ্যাবাদী, বুনো পশুর মত এবং অলস’
ইব্রীয় ১১:৩৫
?
২ মাকাব্বীয়
পুরাতন নিয়মের আপোক্রিফা
উদ্ধৃতি না, কিন্ত উল্লেখ: ‘আরো নিজের ইচ্ছায় জেল থেকে খালাস না নিয়ে নির্যাতন ভোগ করেছিলেন, যেন তাঁরা মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে আরো ভাল জীবনের অধিকারী হন’
ইব্রীয় ১১:৩৭
?
যিহূদী ঐতিহ্য
যিশাইয়ের মৃত্যুর বর্ণনা
উদ্ধৃতি না, কিন্ত উল্লেখ: ‘করাত দিয়ে দু’ টুকরা করে কেটেছিল’
যাকোব ৫:১৭
যাকোব
অন্যান্য যিহূদী লেখা
১ রাজা ১৭:১ বলেন যে এলিয় ভাববাণী দিলেন কিন্তু প্রার্থনা উল্লেখ নেই
উদ্ধৃতি না, কিন্ত উল্লেখ: ‘এলিয় আমাদের মতই একজন ছিলেন। তিনি আকোল ভাবে প্রার্থনা করলেন যেন বৃষ্টি না হয়, আর সাড়ে তিন বছর দেশে বৃষ্টি হয় নি’
২ পিতর ২:২২খ
পিতর
সিরিয়ান ‘আহিকারের গল্প’ থেকে ?
তার আরো উদ্ধতি পাওয়া যায় গ্নোস্তিক লেখায় (‘পিতরের এ্যপোকালিপ্স’, ‘থোমার কার্য’)
‘কুকুর নিজের বমির দিকে ফেরে’ .. ‘শূকরকে ধোয়ানো হলেও সে কাদায় পড়াপড়ি দেয়’
যিহূদা ৬
যিহূদা
আপোক্রিফা, ১ হোনক ১২:৪
‘যে স্বর্গদূত নিজেদের অধিকার রক্ষা না করে নিজেদের জায়গা ছেড়ে চলে গিয়েছিল তাদের কথা মনে কর’
যিহূদা ৯
যিহূদা
সুদো-এপিগ্রাফা:
‘মোশির গ্রহণ’
উদ্ধৃতি না, কিন্ত উল্লেখ: ‘প্রধান স্বর্গদূত মীখায়েল যখন মোশির দেহ নিয়ে শয়তানের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন তখন তিনি তার বিরুদ্ধে কোন অপমানের কথা বলে তাকে দোষী করতে সাহস করেন নি। তিনি বরং বলেছিলেন, ‘প্রভু যেন তোমাকে বাধা দেন।’
যিহূদা ১৪-১৫
যিহূদা
আপোক্রিফা
১ হনোক ১:৯
উদ্ধৃতি না, কিন্ত উল্লেখ: ‘আদমের বংশের সপ্তম পুরুষ হনোক এই লোকদের বিষয়ে আগেই বলেছিলেন, ‘দেখ, প্রভু তাঁর হাজার হাজার পবিত্র দূতদের নিয়ে সকলের বিচার করতে আসছেন… ‘
বাইবেলের বাইরের লেখাগুলি থেকে উদ্ধৃতি নেওয়া – এর অর্থ কি? এর অর্থ কি নয়?
পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে আপোক্রিফা ও সুদো-এপিগ্রাফা ‘ঈশ্বরের অধিকারগত বাক্য’ নয়। অধিকাংশ যিহূদী এই লেখাগুলি জানত কিন্তু সেগুলি কখনও ‘ঈশ্বরের অধিকারগত বাক্য’ মনে করত না।
লেখাগুলি ‘ঈশ্বরের অধিকারগত বাক্য’ নয় – কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে প্রত্যেকটি কথাই তবে আবশ্যক মিথ্যা কথা। অন্যান্যা লেখাগুলিতে সত্য থাকতেও পারে। হয়তো হনোক তা আসলে বলেছিলেন।
যীশু ও স্তিফান এমন ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করেন যা সত্য, কিন্তু পুরাতন নিয়মে উল্লিখিত নয় (মথি ২৩:৩৫, প্রেরিত ৭:২২)। অনেক সত্য ঘটনা আছে যা কোন লেখায় উল্লেখ করা হয় নি। পুরাতন নিয়মে না উল্লিখিত ঘটনাগুলি নতুন নিয়মে উল্লেখ করা যে নিষেধ, তা নয়। সব কিছু যা বলতে যাবে যে আগে আর কোথাও লেখা থাকতে হবে – এই দাবি আমরা কোনই লেখার ক্ষেত্রে করি না। প্রশ্ন এই নয়: আগে কোথাও লেখা হয়েছে কিনা? প্রশ্ন হল: যা বলা হয়েছে তা সত্য কিনা? এমন না যে যিহূদা এই উদ্ধৃতিগুলি থেকে বাইবেলের বিরুদ্ধে কিছু মতবাদ বের করেন।
হয়তো যিহূদা উদ্ধতিগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে ভ্রান্ত শিক্ষদের ‘প্রিয় লেখাগুলি’ থেকে নেন। হয়তো তিনি তাদের দেখাতে চান যে এমন কি ভ্রান্ত শিক্ষকদের পছন্দের লেখাগুলিত যা তিনি বলতে চান, তার প্রমাণ আছে। হয়তো তিনি টিটকারী হিসাবে এই লেখাগুলি ব্যবহার করেন ‘দেখ, এমন কি এই ধরণের লেখাগুলি তো একই জিনিস বলছে!’। হয়তো ভ্রান্ত শিক্ষকদের নিজেরই প্রিয় লেখাগুলি থেকে যিহূদা সাবধানবাণী দিলে তা আরো কার্যকারী।
যা হোক, যিহূদা যে বিষয়ের জন্য আপোক্রিফা বা সুদো-এপিগ্রাফা নিয়ে আসেন, তা সুসমাচারের কোন ভিত্তিক বিষয় নয়।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishstudy.com দেখুন।