রাজাবলি পুস্তক হল একজন ভাববাদীর দৃষ্টিতে রাজা দায়ূদের সময় থেকে শুরু করে আসিরিয়া ও বাবিলের নির্বাসনে যাওয়া পর্যন্ত ইস্রায়েলের চারশো বছরের ইতিহাসের বর্ণনা।
প্রকৃতপক্ষে, ১ ও ২ রাজাবলি পুস্তকটি হল একজন লেখক দ্বারা লিখিত একটি মাত্র পুস্তক। লেখাটি অনেক লম্বা (তা একটি গুটানো স্ক্রলে ধরত না), একারণে তা দু’ভাগ করা হয়েছে। ১ ও ২ রাজাবলি পুস্তক দায়ূদের মৃত্যু সন্নিকট (৯৭১ খ্রীঃপূঃ) সময় থেকে বাবিলে যিহূদার নির্বাসন পর্যন্ত (৫৮৬ খ্রীঃপূঃ) ইস্রায়েল জাতির চারশো বছরের ইতিহাস বর্ণনা করে।
১ রাজাবলি পুস্তক দায়ূদের ছেলে রাজা শলোমনের উপর অতি মনোযোগ দেয়। শলোমন চল্লিশ বছর ধরে ইস্রায়েলের উপরে রাজত্ব করেন। তার রাজত্বের সময়কে ইস্রায়েলের সোনার যুগ বলা হয়, বাস্তবিকপক্ষে যা ছিল ইস্রায়েলের সবচেয়ে শান্তির, রাজনৈতিক স্থিরতার ও অর্থনৈতিক সুঅবস্থার এবং এমন কি অন্য জাতি বা দেশগুলোর উপর প্রভাব ফেলার একটি যুগ। কিন্তু এই সোনার যুগেও ইস্রায়েল দেশে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা দেখা যায়: দেবতাপূজা, কর-আদায়ের বিষয়ে অসমতা, স্বেচ্ছাচারী ও অভিলাসিতার সরকার এবং ধীরে ধীরে রাজনৈতিক অস্থিরতার বৃদ্ধি।
যখন ৯৩১ খ্রীষ্টপূর্বে শলোমনের ছেলে রহবিয়াম রাজত্ব শুরু করেন তখন তিনি ইস্রায়েলীয়দের করের বিষয়ে ন্যায্য অভিযোগে কান দেন না। ফলে রাজ্য দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়: যিহূদা (দক্ষিণে) এবং ইস্রায়েল (উত্তরে)। যিহূদা রাজ্য (অর্থাৎ যিহূদা বংশ, শিমিয়োন বংশ একং বিন্যামীন বংশের একটি অংশ) শলোমনের ছেলে রাজা রহবিয়ামের প্রতি বিশ্বস্ত হয়ে তার অধীনে থাকে। ইস্রায়েল রাজ্য (অর্থাৎ ইস্রায়েলের বাকি দশটি বংশ) আলাদা হয় এবং ঈশ্বরের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে ইফ্রয়িম বংশের নবাটের ছেলে যারবিয়ামের নেতৃত্বে নতুন একটি দেশ হয়ে যায়। দুঃখের বিষয় হল এই বিচ্ছেদ ইতিহাসে আর কখনও ঠিক হয় না, যিহূদা ও ইস্রায়েল দেশ একে অপরের শত্রু হয়ে যায় এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে।
তাই ৯৩১ খ্রীঃপূঃ থেকে ১ ও ২ রাজাবলি পুস্তক দু’টি দেশের ইতিহাসের বর্ণনা করে: দক্ষিণে যিহূদা দেশ (যার রাজধানী যিরূশালেম, যা দায়ূদের রাজবংশ দিয়ে শাসিত) এবং উত্তরে ইস্রায়েল দেশ (যার রাজধানী শমরিয়া, যা বিভিন্ন রাজবংশ দিয়ে শাসিত)।
দায়ূদের প্রতি ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা অনুসারে যিহূদা রাজ্যের উপরে সব সময় দায়ূদের একজন বংশধর রাজত্ব করেন। যিহূদার ইতিহাসে কিছু ভাল রাজা দেখা যায় (যেমন: আসা, যিহোশাফট, যোথম, হিষ্কিয় ও যোশিয়) এবং কিছু খারাপ রাজাও দেখা যায় (যেমন: যিহোরাম, আহস ও মনঃশি)। কিন্তু সব মিলিয়ে বলা যায় যে, যিহূদা দেশ ধীরে ধীরে দেবতাপূজায়, সামাজিক অন্যায় ও রাজনৈতিক দুর্বলতায় পড়তে থাকে। শেষে, অর্থাৎ ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে ঈশ্বর বাবিল সাম্রাজ্যকে যিহূদা, যিরূশালেম ও উপাসনা-ঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে এবং বেঁচে থাকা লোকদের নির্বাসনে নিয়ে যেতে অনুমতি দেন ।
উত্তরের ইস্রায়েল দেশের ইতিহাস আরো খারাপ ও মন্দ। উত্তর ইস্রায়েলের প্রথম রাজা যারবিয়ামকে ঈশ্বর একটি অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা দেন যে, যদি তিনি আইন-কানুন পালন করেন তবে দায়ূদের প্রতিজ্ঞার মত তার মধ্য দিয়ে ঈশ্বর একটি চিরস্থায়ী রাজবংশ গড়ে তুলবেন। কিন্তু যারবিয়াম ঈশ্বরের কথা অমান্য করে বৈথেল ও দান শহরে একটি মিশ্রিত বাছুর-পূজা স্থাপন করেন এবং তা ইস্রায়েলের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে ঘোষিত করেন। যারবিয়াম তাই ইস্রায়েল দেশকে দেবতাপূজার ভিত্তির উপরে স্থাপন করেন। ফলে ইস্রায়েল খুব তাড়াতাড়ি পুরোপুরিভাবে দেবতাপূজায়, সামাজিক অন্যায়-লাভে, উচ্ছৃঙ্খলায় ও রাজনৈতিক দুর্বলতায় পড়ে। রাজাবলি পুস্তকে ইস্রায়েলের একজন রাজাকেও ভাল রাজা বলা হয় নি, শুধুমাত্র রাজা যেহূ কিছু প্রশংসা পান কারণ তিনি ইস্রায়েল থেকে বাল-পূজা নির্মূল করার চেষ্টা করেন। অনবরত রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাজাদেরকে হত্যা এবং বিভিন্ন জাতি দ্বারা আক্রমণ ইস্রায়েলে ঘটতে থাকে। ইস্রায়েলের দুইশো বছরের ইতিহাসে ৯টি রাজবংশের ১৯জন রাজা রাজত্ব করেন। মাত্র দুইশো বছরের পরেই (৯৩১-৭২২ খ্রীঃপূঃ) ঈশ্বর আসিরিয়া সাম্রাজ্যকে ইস্রায়েলকে দখল ও সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে অনুমতি দেন। ইস্রায়েলের দেবতাপূজারী লোকসংখ্যাকে আসিরিয়া রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় নির্বাসিত করা হয় এবং তারা অন্যান্য দেবতাপূজারী জাতিদের সাথে মিশে যায়। তারা ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে আর কখনও নিজের দেশে ফিরে যেতে সক্ষম হয় না।
১ ও ২ রাজাবলি পুস্তক পড়লে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, তা হল ভাববাদীর দৃষ্টি থেকে লিখিত একটি পুস্তক। সম্ভাবনা বেশি যে, ভাববাদী যিরমিয় পুস্তকটি লিখেছেন। তাই পুস্তকে আমরা অনেক ভাববাদী, দেশের কাছে বা রাজার কাছে শক্তিশালী বাণীগুলো এবং সেই বাণীর পূর্ণতারও উল্লেখ পাই। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করুন: এই পুস্তকে যতজন ঈশ্বরের দেওয়া ভাববাণীতে বা আইন-কানুনে বাধ্য হয় অথবা যতজন পাপ করার পরে কোন রকম অনুতাপ করে, ততজনকেই ঈশ্বর সাথে সাথে উদ্ধার করেন, তার পরিস্থিতি যত খারাপ হোক না কেন। কিন্তু সব মিলিয়ে বলা যায় যে, রাজাদের ও সাধারণ লোকদের আচরণ মন্দ থেকে আরো মন্দ হয়ে যায়। আইন-কানুন (যেমন দ্বিতীয় বিবরণ ২৮) এবং প্রত্যেকটি ভাববাণী বলে যে, দেবতাপূজা ও অবাধ্যতার ফলাফল হল আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হওয়া, প্রতিজ্ঞাত দেশ হারানো এবং শেষে জীবনও হারানো। পুস্তকটি বর্ণনা করে কিভাবে ইস্রায়েল ও যিহূদা নিয়ে ঠিক তা-ই ঘটে। ঈশ্বরের সঙ্গে করা চুক্তি ইস্রায়েল জাতি ভেঙ্গে দিয়েছে বলে চুক্তিতে উল্লিখিত অভিশাপগুলো ফলাফলস্বরুপ তাদের উপরেএসে পড়ে।
পুরাতন নিয়মের সংক্ষিপ্ত সময়-তালিকা
ইস্রায়েল জাতির ইতিহাস এবং রাজাবলি পুস্তকের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝার জন্য পুরাতন নিয়মের একটি সংক্ষিপ্ত সময় তালিকা নিচে দেওয়া হল:
২০০০ খ্রীঃপূঃ | অব্রাহাম | |||
১৮৫০ খ্রীঃপূঃ | যাকোব | যাকোবের পরিবার মিসরে যায় | ||
১৪৪৬ খ্রীঃপূঃ | মোশি | মিসর থেকে ইস্রায়েল জাতির প্রস্থান | ||
১৪০৫ খ্রীঃপূঃ | যিহোশূয়য যিহোশূয় | ইস্রায়েল কনান দেশ দখল করে | ||
১০১১ খ্রীঃপূঃ | দায়ূদ | দায়ূদ যিহূদার উপর, এবং অবশেষে ৭ বছর পরে সমগ্র ইস্রায়েলের উপরে রাজত্ব করেন | ||
৯৭১ খ্রীঃপূঃ | শলোমন | শলোমনের রাজত্ব শুরু | ||
৯৩১ খ্রীঃপূঃ | রহবিয়াম যারবিয়াম | বিভক্ত রাজ্য। রহবিয়াম যিহূদার উপরে রাজত্ব করেন। যারবিয়াম ইস্রায়েলের উপর রাজত্ব করেন। প্রধান শত্রু: সিরিয়া | ||
৭৩২ খ্রীঃপূঃ | আসিরিয়া সিরিয়াকে দখল করে। | |||
৭২২ খ্রীঃপূঃ | আসিরিয়া ইস্রায়েলকে দখল ও নির্বাসিত করে। | |||
৬০৫ খ্রীঃপূঃ | নবূখদনিৎসর | বাবিল আসিরিয়াকে দখল করে। | যুদ্ধক্ষেত: কর্কমিশ | |
৫৮৬ খ্রীঃপূঃ | নবূখদনিৎসর | বাবিল যিহূদাকে দখল ও নির্বাসিত করে। | ||
৫৩৯ খ্রীঃপূঃ | কোরস–২ | মাদিয়–পারস্য বাবিলকে দখল করে। | যুদ্ধক্ষেত: বাবিল | |
৫৩৬ খ্রীঃপূঃ | কিছু যিহূদীরা প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে যায়। | |||
৩৩৩ খ্রীঃপূঃ | আলেকজান্ডার | গ্রীস মাদিয়–পারস্যকে দখল করে। | যুদ্ধক্ষেত: ইসোস্ | |
১৪৬ খ্রীঃপূঃ | রোম গ্রীসকে দখল করে। | যুদ্ধক্ষেত: করিন্থ | ||
৭০ খ্রীঃপূঃ | রোম প্যালেষ্টাইনকে দখল করে। |
১ ও ২ রাজাবলি পুস্তক হল একজন লেখক দ্বারা লিখিত একটি মাত্র পুস্তক। লেখাটি অনেক লম্বা (তা একটি গুটানো স্ক্রলে ধরত না), একারণে তা দু’ভাগ করা হয়েছে। ১ ও ২ রাজাবলি পুস্তক দায়ূদের মৃত্যু সন্নিকট (৯৭১ খ্রীঃপূঃ) সময় থেকে বাবিলে যিহূদার নির্বাসন পর্যন্ত (৫৮৬ খ্রীঃপূঃ) ইস্রায়েল জাতির চারশো বছরের ইতিহাস বর্ণনা করে। ইস্রায়েল রাজ্য বিভক্ত হওয়ার পরে লেখক পুস্তকটিতে উভয় ইস্রায়েলের রাজাদের ইতিহাস (৯৭১-৭২২ খ্রীঃপূঃ) এবং যিহূদার রাজাদের ইতিহাস (৯৭১-৫৮৬ খ্রীঃপূঃ) লিপিবদ্ধ করেন। আসিরিয়া সাম্রাজ্য দ্বারা ইস্রায়েলের ধ্বংস ও নির্বাসন (৭২২ খ্রীঃপূঃ) এবং বাবিল সাম্রাজ্য দ্বারা যিহূদার ধ্বংস ও নির্বাসন (৫৮৬ খ্রীঃপূঃ) পুস্তকটিতে বর্ণনা করা হয়।
১ ও ২ রাজাবলি পুস্তকটির লেখক ও লেখার তারিখ
যদিও ১ ও ২ রাজাবলি পুস্তটির লেখক নিজের পরিচয় দেন না তবুও পুস্তকটি পড়লে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, পুস্তকটি একজন ভাববাদীর দৃষ্টি থেকে লেখা হয়েছে। পুস্তকে আমরা অনেক ভাববাদী, দেশের বা বিভিন্ন রাজাদের কাছে শক্তিশালী বাণী এবং সেই বাণীগুলোর পূর্ণতারও উল্লেখ পাই। পুস্তকে ১৮ বার এই বাক্য পুনরুক্তি করে বলা হয়েছে: “সদাপ্রভু তাঁর দাস নবী … মধ্য দিয়ে যেমন বলেছিলেন তেমনই …”। পুস্তকের প্রধান বিষয়ের কারণে এবং যিহূদী ঐতিহ্য অনুসারে ভাববাদী যিরমিয়কে লেখক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তাছাড়া রাজাবলি ও যিরমিয় পুস্তকের মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মিল পাওয়া যায়, যাতে আরো প্রমাণিত হয় যে, পুস্তক দু’টি একই লেখক দ্বারা লিখিত।
অনিচ্ছুক যিহূদার কাছে ত্রিশ-চল্লিশ বছর কথা বলার পরে যিরমিয় তার জীবনের শেষের দিকে (প্রায় ৫৮০ খ্রীঃপূঃ) উভয় রাজাবলি ও যিরমিয়, এই দু’টি পুস্তক বাবিলে নির্বাসিত যিহূদীদের জন্য লেখেন। শুধুমাত্র পুস্তকের শেষ অনুচ্ছেদ (২ রাজা ২৫:২৭-৩০) পরে যোগ দেওয়া হয়েছে, যেখানে আমরা একটি আশাদানকারী ঘটনার উল্লেখ পাই: বাবিল রাজা যিহোয়াখীনকে জেল থেকে মুক্ত করেন (৫৬০ খ্রীঃপূঃ)।
নির্বাসিত যিহূদীদের কাছে যিরমিয়ের সংবাদ
যিরমিয় উভয় রাজাবলি ও যিরমিয়, এই দু’টি পুস্তক বাবিলে নির্বাসিত যিহূদীদের জন্য লেখেন। তিনি তাদেরকে নিশ্চিত করেন যে, ঠিক কোন কারণে তারা নিজেদেরকে নির্বাসনে খুঁজে পায়। তিনি দেখান যে, যদিও ঈশ্বর তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে তার জাতিকে বিচার করেছেন তবুও আশা আছে: যারা মন ফিরায়, যারা বিশ্বাস করে যে, ঈশ্বর তাঁর জাতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন, তাদেরকে নিয়ে ঈশ্বর নতুন শুরু ঘটাবেন। যিরমিয় চান যেন নির্বাসিত যিহূদীরা জানে যে, নির্বাসন এমনি এমনি ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা নয়, ঈশ্বরের দুর্বলতার বা ক্ষমতাহীনতার কারণে বা তাঁর নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণেও নির্বাসন ঘটে নি। কিন্তু নির্বাসনের কারণ হল যিহূদার অনবরত পাপ, ঠিক যেমন আইন-কানুন এবং সমস্ত ভাববাদীরা বলেছিলেন: আইন-কানুন ও চুক্তি ভাঙ্গলে অভিশাপ ও ধ্বংস আসবে এবং প্রতিজ্ঞাত দেশ হারাতে হবে। নির্বাসন ঘটে নি কারণ বাবিল খুবই শক্তিশালী, তা ঘটে নি কারণ বাবিলের দেবতারা ঈশ্বরের চেয়ে শক্তিশালী বরং সব কিছু খুব নির্দিষ্ট কারণে এবং ঈশ্বরের অনুমতিতে ও উপস্থিতিতে ঘটেছে। এজন্য আশা আছে: ঠিক যেমন ঈশ্বর ভাববাদীদের দ্বারা নির্বাসনের অগ্রিম ঘোষণা করেছিলেন এবং সেভাবে তা বাস্তবে পূর্ণও হল, ঠিক তেমনি ঈশ্বর ভাববাদীদের দ্বারা উদ্ধারের অগ্রিম ঘোষণা করেছিলেন, এটিও পূর্ণ হবে অর্থাৎ উদ্ধারের ভাববাণীও পূর্ণ হবে। ঈশ্বর তাঁর জাতিকে একটি নতুন শুরু দান করবেন এবং তাদের নিজের দেশে ফিরিয়ে আনবেন। ঈশ্বরের বিচারবাণী পূর্ণ হয়েছে – তাঁর উদ্ধারবাণীও পূর্ণ হবে। তাই যিরমিয় নির্বাসিত যিহূদীদের বলেন: নির্বাসনের আসল কারণ বুঝ! মন ফিরাও! নির্বাসনে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থাক! ফিরে যাওয়ার আশা ধরে রাখ!
শলোমনের রাজত্ব ৯৭১-৯৩১ খ্রীঃপূঃ
১ রাজাবলি পুস্তক দায়ূদের ছেলে রাজা শলোমনের রাজত্বের উপর গুরুত্ব দেয়। শলোমন চল্লিশ বছর ইস্রায়েলের উপরে রাজত্ব করেন। শুরুতে দায়ূদের চতুর্থ ছেলে অর্থাৎ, শলোমনের ভাই আদোনিয় ইস্রায়েল দেশের উপর রাজত্ব করার অধিকার দখল করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু দায়ূদ শলোমনকে পরবর্তী রাজা হিসাবে ঘোষণা করেন (১ রাজা ১)। ফলে আদোনিয় নিজের দাবি পরিত্যাগ করেন।
শলোমন তার রাজত্ব ভালভাবে শুরু করেন: কিছু বিচারের বিষয় যা দায়ূদ সমাধান করতে সক্ষম হন নি, তা তিনি হাতে নেন (যোয়াব, শিমিয়ি ও আদোনিয়ের বিষয়)। শলোমন প্রতিশোধ নেওয়ার চেয়ে তিনজনকে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ দেন। শুধুমাত্র যখন তারা নিজেদের পুনরায় দোষী প্রমাণিত করেন, তখন তিনি তাদেরকে মৃত্যুদন্ড দেন (১ রাজা ২)।
ঈশ্বর শলোমনের সঙ্গে একটি স্বপ্নে দেখা করেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি কি চান। স্বপ্নে শলোমন ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রজ্ঞা চান। ঈশ্বর খুশি হন যে, তিনি ধন, জয় বা দীর্ঘ জীবন না চেয়ে বরং দেশ ন্যায্যভাবে পরিচালনার প্রজ্ঞা চান। ফলে ঈশ্বর শলোমনকে চারটি বিষয়ের প্রতিজ্ঞা করেন (প্রজ্ঞা, ধন, জয় ও দীর্ঘ জীবন) কিন্তু প্রতিজ্ঞার পূর্ণতা শলোমনের বাধ্যতার উপর নির্ভর করবে (১ রাজা ৩:১৪) – বাইবেলে এই শর্ত সব সময় থাকে। গল্পটি একটু বিশেষ কারণ সব কিছু একটি স্বপ্নে ঘটে। ঈশ্বর হয়তো এই স্বপ্নের মাধ্যমে শলোমনকে ভাল কিছু চাইতে এবং সঠিক বিষয়ে প্রাধান্য দিতে শেখাতে চেষ্টা করেন কারণ ঈশ্বরকে অন্বেষণ করার শলোমনের তেমন অভ্যাস ছিল না।
শলোমন ন্যায়বিচারে প্রকৃতভাবে ঈশ্বরের অসাধারণ প্রজ্ঞা লাভ করেন, যা একটি মামলা দিয়ে প্রকাশিত হয় (১ রাজা ৩:১৬-২৮)। দু’জন মহিলার মধ্যে একটি সন্তানের উপর অধিকার পাওয়ার মামলা শুনে শলোমন মহিলাদের উদ্দেশ্যগুলো খুঁজে বের করে সন্তানকে সেই মহিলাকে দেন যিনি সন্তানটির সুরক্ষা ও মঙ্গল চেষ্টা করেন। শলোমন গান, সঙ্গীত ও প্রবাদ রচনা এবং সংগ্রহ করেন। এছাড়া তিনি অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা উৎসাহিত করেন এবং তিনি নিজেও গবেষণা করেন (১ রাজা ৪:২৯-৩৪)। শলোমনের রাজত্ব হয়ে যায় ইস্রায়েল দেশের সোনার যুগ, যেখানে তারা শান্তি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সু-অবস্থা, বেচা-কেনা, সম্মান এবং অন্য জাতিদের উপর প্রভাবে ফেলার অধিকার লাভ করে (১ রাজা ৪:২০-২৮)। শিবা দেশের রাণীর পরিদর্শন হল এর একটি চমৎকার উদাহরণ (১ রাজা ১০)।
দায়ূদের নির্দেশনা অনুসারে শলোমন ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি নেন এবং তা সাধনও করেন। হতে পারে, নির্মাণের কারণে ইস্রায়েলে প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও দক্ষতার উন্নতিও ঘটে। দায়ূদ উপাসনা-ঘর নির্মাণের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও ধন-সম্পদ জমা করে রেখেছিলেন। একারণে, শলোমন যখন প্রকৃতপক্ষে নির্মাণ বাস্তবায়ন করেন, ইস্রায়েলের উপর তেমন কোন চাপ সৃষ্টি হয় না, জোরপূর্বক শ্রমেরও উল্লেখ নেই (১ রাজা ৬)। ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর উৎসর্গ করার সময়ে শলোমন ইস্রায়েলকে একত্র করে একটি চমৎকার অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। সেই অনুষ্ঠানে তার প্রার্থনায় প্রকাশ পায় যে, তিনি মোশির আইন-কানুন এবং ঈশ্বরের সঙ্গে ইস্রায়েলের চুক্তি সম্পূর্ণভাবে বুঝেছিলেন। ঈশ্বর একটি মেঘের মাধ্যমে তাঁর উপস্থিতি দৃশ্যমানভাবে প্রকাশিত করেন এবং এভাবে নতুন উপাসনা-ঘরে তাঁর অনুমোদন দেন, যেমন তিনি সিনাই পাহাড়ে মোশির আবাস-তাম্বুর অনুষ্ঠানেও দিয়েছিলেন (১ রাজা ৮:যাত্রা ৪০)। এই ঘটনা হল শলোমনের জীবনের সবচেয়ে চরম মুহূর্তে, যখন তিনি ঈশ্বরের জন্য ঘর নির্মাণ করে দায়ূদের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করেন এবং ঈশ্বর দৃশ্যমানভাবে তাঁর অনুমোদন দেন। এর পরে ঈশ্বর আর একবার শলোমনের সাথে দেখা করেন এবং তাকে চুক্তির সেই ‘পুরাতন’ চ্যালেঞ্জ দেন: “তুমি যদি খাঁটি অন্তরে আমার সামনে চল এবং আমার সব আদেশ পাল কর …”। সোনার যুগে, অনেক বড় কিছু অর্জন করার পরে এবং সম্মানিত হওয়ার পরে ঈশ্বর শলোমনকে স্মরণ করিয়ে দেন অথবা হয়তো সাবধানবাণী দেন যে, শুধুমাত্র বাধ্যতায় ঈশ্বর তাঁর আশীর্বাদ দিতে পারেন (১ রাজা ৯:১-১৪)।
শলোমনের পতন
মোশির আইন-কানুনে রাজাদেরকে অনেক ঘোড়া (অর্থাৎ সামরিক সরঞ্জাম), অনেক স্ত্রী বা অনেক ধন রাখতে নিষেধ করা হয়েছে (দ্বিতীয় বিবরণ ১৭:১৪-২১)। কিন্তু শলোমন তিনটি ক্ষেত্রেই আইনটি অমান্য করেন। এভাবে, দায়ূদের দ্বারা বহুবিবাহের সেই ধ্বংসের বীজ শলোমনের জীবনে উঠে এসে ধীরে ধীরে এক ধ্বংসের ফসল উৎপন্ন করে।
সামরিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রে শলোমন অনেক দেশ থেকে ঘোড়া ও রথ আমদানি করেন এবং ১৪০০ রথ ও ১২০০০ ঘোড়ার মালিক হয়ে ওঠেন (২ বংশা ৯:২৮), রথের শহর নির্মাণ করেন, ঘোড়ার দেখাশোনা ও খাবারের যোগানের পদ্ধতি বসান। মোট কথা তিনি এবং ঘোড়ার ও রথের আন্তর্জাতিক ক্রয়-বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করেন (১ রাজা ১০:২৬-২৯)।
ধনের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, ঈশ্বর অবশ্যই তাকে অনেক ধনের একটি প্রতিজ্ঞা দিয়েছিলেন এবং যদি কমবেশি সবার অবস্থা ভাল হয় তবে ধনী হওয়া অবশ্যই পাপ নয়। প্রকৃতপক্ষে, তিনি বেশ কয়েকটি বিশাল রাজপ্রাসাদ তৈরি করেন এবং এর বিলাসবহুল যোগানের জন্য তিনি ইস্রায়েল থেকে কর-আদায় করেন। কিন্তু যে পদ্ধতিতে তিনি কর-আদায় করতেন তাতে কোন সমতা ছিল না: শলোমন নিজের বংশ (যিহূদা) থেকে কর দাবি করতেন না যদিও যিহূদা বংশের লোকসংখ্যা ইস্রায়েলের অন্য সব বংশের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তবুও তিনি বাকি ১০টি বংশের উপর করের ভার চাপিয়ে দেন (১ রাজা ৪:৭-১৯,২২-২৩)।
উপাসনা-ঘর নির্মাণের জন্য ইস্রায়েলের উপরে বেশি চাপ সৃষ্টি হয় নি, কারণ দায়ূদ উপাসনা-ঘর নির্মাণের জন্য বিভিন্ন যুদ্ধ থেকে লুট করে প্রচুর ধন জমা রেখেছিলেন। কিন্তু ৭ বছর ধরে উপাসনা-ঘর নির্মাণের পরে শলোমন তার নিজের জন্য আজীবন বিভিন্ন দালান নির্মাণ করতে থাকেন: ১৩ বছর ধরে তিনি নিজের রাজপ্রাসাদের নির্মাণ করেন (১ রাজা ৭:১-১২), এছাড়া ফরৌণের কন্যার জন্য রাজপ্রাসাদ, প্রশাসনের জন্য বিভিন্ন দালান, শহরের দুর্গ, গুদাম শহর, রথ ও ঘোড়া রাখার শহর ইত্যাদি এবং এসব ছিল অত্যন্ত বিলাসী ধরণের (১ রাজা ৯:১৫-১৯)। নির্মাণের জন্য তিনি প্রথমে বিদেশীদের থেকে জোরপূর্বক শ্রম দাবি করেন (১ রাজা ৯:১৫,২০-২২) এবং পরবর্তীতে তিনি ইস্রায়েলীয়দের থেকেও জোরপূর্বক শ্রম দাবি করেন (১ রাজা ৫:১৩-১৮), যদিও তা ঈশ্বরের আইন-কানুন অনুসারে নিষিদ্ধ। শলোমনের জীবনের শেষের দিকে দেখা যায় যে, তার কর ও জোরপূর্বক শ্রম ইস্রায়েল জাতির উপর এমন বোঝা হয়ে ওঠে যে, দেশটি অর্থনৈতিক দিকে কঠিন অবস্থায় পড়ে। ফলে সমস্ত ইস্রায়েলীয়েরা পরবর্তী রাজা রহবিয়ামের কাছে এসে অনুনয়ের সাথে তাকে অনুরোধ করে যেন তিনি তাদের করের সেই ভারী জোয়াল থেকে কিছুটা মুক্তি দেন (১ রাজা ১২:৪)।
স্ত্রীর ক্ষেত্রে বলতে হয় যে, শলোমনের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তিনি নিজের জন্য ৭০০ স্ত্রী ও ৩০০ উপস্ত্রী গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে অনেকজন হল দেবতাপূজারী বিদেশী রাজকন্যা। এভাবে তিনি দেবতাপূজারী বিয়ে করার নিষেদ্ধাজ্ঞাও ভাঙ্গেন (দ্বিতীয় বিবরণ ৭:৪)। হতে পারে তিনি বেশ কয়েক শতক সন্তানদের বাবা হন (১ রাজা ১১:১-৩), কিন্তু সন্তানদের সাথে যে শলোমনের বাবা হিসাবে ভাল সম্পর্ক ছিল, এর সম্ভাবনা খুবই কম। শলোমন তাদেরকে মনোযোগ, শিক্ষা বা শিষ্যত্ব কিভাবে দেবেন? তাদের পারিবারিক জীবন দেখতে কেমন?
এছাড়া এই ধরণের রাজপ্রাসাদ চালানোর খরচ চিন্তার বাইরে। প্রকৃতপক্ষে, শলোমনের অতিরিক্ত বহুবিবাহ তার পতনের একটি বড় কারণ হয়ে যায়: তিনি বৃদ্ধ বয়সে তার স্ত্রীদের জন্য তাদের দেব-দেবতাদের উদ্দেশ্যে পূজার স্থান নির্মাণ করেন এবং তিনি নিজেও এই দেবতাদের পূজা করতে শুরু করেন (১ রাজা ১১:৪-৫)।
আরো একটি দুঃখজনক বিষয় হল যে, ইস্রায়েলের পরবর্তী রাজা শলোমনের ছেলে রহবিয়াম হলেন নয়মা নামে একটি দেবতাপূজারী অম্মোনীয় রাজকন্যার ছেলে। শলোমনের অনুপস্থিতিতে রহবিয়ামকে মানুষ হিসাবে গঠন করা ও শিক্ষা দানের বিষয়ে তার দেবতাপূজারী মা প্রধান প্রভাব ফেলে (১ রাজা ১৪:৩১)। পরবর্তীতে দেখা যায় যে, রহবিয়ামের কোন প্রজ্ঞা নেই, তিনি যিহূদার সিংহাসনে উঠার ৩ বছরের মধ্যে সারা যিহূদা জাতিকে দেবতাপূজা করার পথে পরিচালনা করেন (২ বংশা ১১:১৭, ১ রাজা ১৪:২২-২৪)। ঈশ্বর শলোমনকে তার পাপের কারণে কঠোর ধমক দেন এবং তাকে সাবধানবাণী দেন যে, তার রাজত্ব তার থেকে তুলে নেওয়া হবে (১ রাজা ১১:৯-১৩)। বাবা দায়ূদ যেমন বৎশেবার বিষয়ে পাপের কারণে ধমক পেয়ে মনেপ্রাণে অনুতপ্ত হয়ে মন ফিরিয়েছিলেন, শলোমন তা করেন না। যখন ঈশ্বর তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী লোক উঠাতে শুরু করেন শলোমন বরং তাদেরকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেন (১ রাজা ১১:১৪-৪০)।
ভাল শুরু হল একটি বিষয়, ভালভাবে শেষ করা হল সম্পূর্ণ অন্য একটি বিষয়! প্রজ্ঞা থাকা হল একটি বিষয়, প্রজ্ঞায় বাধ্য হয়ে জীবন-যাপন করা হল সম্পূর্ণ অন্য বিষয়! প্রকৃতপক্ষে, অল্প সময় চোখের দেখাকে ভুলানো যায়: এখনও ইস্রায়েলের অবস্থা বেশ ভাল দেখায়। কিন্তু ইতিহাস এগিয়ে গেলে দেখা যাবে যে, সব কিছু ভেঙ্গে যেতে বেশি সময় লাগে না।
রহবিয়াম, শলোমনের প্রজ্ঞাহীন পুত্র
শলোমনের মৃত্যুর পরে, অর্থাৎ ৯৩১ খ্রীষ্টপূর্বে ইস্রায়েলের লোকেরা রহবিয়ামকে রাজা হিসাবে গ্রহণ করার জন্য এবং একটি ন্যায্য বিষয়ে অনুরোধ করার জন্য রহবিয়ামের কাছে আসে: তার বাবা শলোমন তাদের উপর যে “ভারী জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছেন” যেন তিনি তা হালকা করে দেন (১ রাজা ১২:৩-৪)। রহবিয়াম অহংকারে ও মুর্খতায় তাদের অনুরোধ অগ্রাহ্য করেন এবং এর পরিবর্তে আরো ভারী জোয়াল চাপিয়ে দেওয়ার হুকমি তাদের দেন। ইস্রায়েল বংশের নেতারা তা শুনে বলেন “দায়ূদে আমাদের কি অংশ?” এবং তারা রহবিয়ামকে রাজা হিসাবে অগ্রাহ্য করে যিহূদা থেকে আলাদা হয়ে একটি নতুন দেশ স্থাপন করেন (১ রাজা ১২:১৬)।
এভাবে ইস্রায়েল রাজ্য বিভক্ত হয়ে যায়: দক্ষিণের যিহূদা বংশ (এবং শিমিয়োন বংশ ও বিন্যামিনের একটি অংশ) দায়ূদের রাজবংশের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে রাজা হিসাবে রহবিয়ামের অধীনে থেকে যায়। কিন্তু উত্তরের বাকি ১০টি বংশ যিহূদা থেকে আলাদা হয়ে ইস্রায়েল নামে একটি রাজ্য স্থাপন করে, এর উপর (ঈশ্বরের ভাববাণী অনুসারে) যারবিয়াম নামে একজন ইফ্রয়িম বংশের ব্যক্তি রাজত্ব শুরু করেন। এই দুঃখজনক বিচ্ছেদ ইতিহাসে আর কখনও ঠিক হয় না বরং যিহূদা ও ইস্রায়েল পরস্পরের শত্রু হয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে।
তাই ৯৩১ খ্রীষ্টপূর্ব থেকে ১ ও ২ রাজাবলি পুস্তকে দু’টি দেশের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়: দক্ষিণে দায়ূদের রাজবংশ দ্বারা শাসিত যিহূদা (রাজধানী: যিরূশালেম) এবং উত্তরে বিভিন্ন রাজপরিবার দ্বারা শাসিত ইস্রায়েল (রাজধানী: শমরিয়া)।
ইস্রায়েলের প্রথম রাজা যারবিয়াম একটি অদ্বিতীয় সুযোগ হাত ছাড়া করেন
যারবিয়াম ছিলেন ইফ্রয়িম বংশের একজন পরিশ্রমী ও দক্ষ ব্যক্তি, যাকে শলোমন কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত করে জোরপূর্বক শ্রমের দেখাশোনার দায়িত্ব দেন (১ রাজা ১১:২৬-২৮)। ঈশ্বর অহিয় নামে একজন ভাববাদী যারবিয়ামের কাছে পাঠিয়ে তাকে ইস্রায়েলের ১০টি বংশের উপর রাজত্ব করার অধিকার দেন এবং আরো একটি অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা যোগ করেন: “আমি দায়ূদের মতই তোমার বংশে রাজপদ স্থায়ী করব”। সব সময় প্রতিজ্ঞার যে শর্ত থাকে, তা এখানেও পুনরায় উল্লেখ করা হয়: প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হবে যদি যারবিয়াম ঈশ্বরের আইন-কানুন পালন করেন এবং দেবতাপূজা থেকে দূরে থাকেন (১ রাজা ১১:২৮-৩১)।
ভাববাদী অহিয়ের বাণীর প্রথম অংশ পূর্ণ হয় যখন ইস্রায়েল রহবিয়ামের কাছ থেকে ভাল সাড়া না পেয়ে তাকে অগ্রাহ্য করে এবং পরিবর্তে যারবিয়ামকে তাদের রাজা হিসাবে ঘোষিত করে। কিন্তু চমৎকার একটি প্রতিজ্ঞা পেলেও যারবিয়াম দায়ূদের মত ঈশ্বরের বাক্যের উপর নির্ভর করতে সক্ষম হন না। তিনি ভয় করেন যে, ইস্রায়েলীয়েরা যদি বাৎসরিক পর্বের জন্য যিরূশালেমে যেতে থাকে তবে তারা পুনরায় রহবিয়ামের অধীনতা মেনে নেবে (১ রাজা ১২:২৬)। লোকেরা যেন যিরূশালেমে যাওয়া বাদ দেয়, এজন্য তিনি উভয় বৈথেল ও দান শহরে সোনার বাছুর পূজার স্থান স্থাপন করেন এবং সেখানে যিরূশালেমের ধর্মের অনুশীলন নকল করে একটি মন্দির, বেদী, যাজত্ব ও নিয়মিত পর্ব বসান। এভাবে তিনি রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে দু্টি সোনার বাছুরের পূজা স্থাপন করেন – অথচ সব কিছু ‘সদাপ্রভুর নাম’ উল্লেখ করে করা হত (মোশির সময়ের মত, যাত্রা ৩২)।
যারবিয়ামের অবিশ্বস্ততার জন্য ঈশ্বর একজন ভাববাদী দ্বারা বৈথেলের বেদী ও পূজার স্থানের ধ্বংসবাণী ঘোষণা করেন (১ রাজা ১৩) এবং ভাববাদী অহিয় দ্বারা যারবিয়ামকে একটি বিচারবাণী দেন: তার রাজবংশ নির্মূল করা হবে (১ রাজা ১৪:১-১৮)। তা পূর্ণ হয় যখন যারবিয়ামের ছেলে নাদবকে (এবং সম্পূর্ণ রাজপরিবারকে) মাত্র দুই বছর রাজত্ব করার পরে খুন করা হয় (১ রাজা ১৫:২৫-৩০)।
ইস্রায়েল রাজাদের রাজত্বের একটি সারাংশ ৯৩১-৭২২ খ্রীঃপূঃ
যারবিয়াম তাই উত্তরের ইস্রায়েল রাজ্য দেবতাপূজার ভিত্তিতে স্থাপন করেন। ছিল ইস্রায়েলের প্রথম রাজধানী শহর, পরবর্তীতে শমরিয়া হয়ে যায় ইস্রায়েলের স্থায়ী রাজধানী শহর। রাষ্ট্রীয় ধর্ম বাছুরপূজা ছাড়াও ইস্রায়েল চারিদিকের দেশগুলোর দেবতাপূজাও গ্রহণ করে, ফলে সামাজিক অন্যায় ও রাজনৈতিক দুর্বলতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
রাজাবলি পুস্তকে ইস্রায়েলের একজন রাজাকেও “ভাল” বলা হয় না, ইস্রায়েলের রাজা আহাব ও তার সিদোনীয় রাজকন্যা স্ত্রী ঈষেবল বিশেষভাবে ইস্রায়েল জাতিকে মন্দের দিকে প্রভাবিত করেন, অর্থাৎ তারা বাল দেবের পূজা ইস্রায়েলে স্থাপন করেন এবং দেশে আইন-শৃঙ্খলা আরো নষ্ট করেন।
শুধুমাত্র রাজা যেহূ কিছুটা প্রশংসা পান কারণ তিনি শক্তিশালীভাবে বাল পূজার বিরুদ্ধে কাজ করেন। এজন্য ঈশ্বর তাকে প্রতিজ্ঞা দেন যে, চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত তার রাজবংশ স্থির থাকবে (২ রাজা ১০:২৮-৩০)। প্রতিজ্ঞাটি পূর্ণ হয় এবং এভাবে যেহূর রাজপরিবার ইস্রায়েলের অন্যান্য রাজপরিবারের তুলনায় দীর্ঘদিন স্থায়ী থাকে এবং ইস্রায়েল কিছুটা রাজনৈতিক স্থিরতা লাভ করে।
যেহূর রাজবংশের তৃতীয় পুরুষ যারবিয়াম-২ হলেন ইস্রায়েলের সর্বশেষ শক্তিশালী রাজা। তার রাজত্বের সময়ে ইস্রায়েল আর একবার কিছু শক্তি ও স্থিরতা ফিরে পায় – যদিও দেশে অনেক সামাজিক অন্যায় চলছিল এবং ধনীরা আরো ধনী ও গরীবেরা আরো গরীব হয়ে যাচ্ছিল(ভাববাদী আমোষ পুস্তক দেখুন)।
দেশ হিসাবে ইস্রায়েল শুধুমাত্র ২০০ বছর টিকে থাকে, এই সময়ের মধ্যে দেশটি ৯টি রাজবংশ দিয়ে শাসিত হয়। ইস্রায়েলের প্রত্যেক রাজা গড়ে ১১ বছরের চেয়েও কম রাজত্ব করেন, ৩টি রাজপরিবারের সবাইকে পরবর্তী রাজারা নিজ হাতে খুন করে রাজসিংহাসন দখল করেন। ইস্রায়েলের ১৯জন রাজাদের মধ্যে ৮জন রাজাদের (প্রায়, অর্ধেক রাজাদের!) খুন করে সরানো হয়। ৭২২ খ্রীষ্টপূর্বে ঈশ্বর আসিরিয়া সাম্রাজ্যকে ইস্রায়েল দেশকে দখল ও সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে অনুমতি দেন। বেঁচে থাকা বাকি ইস্রায়েলীয়দের নির্বাসিত করা হয় এবং তারা বিভিন্ন দেবতাপূজারী জাতিদের মধ্যে মিশে যায়। তারা তাদের পরিচয় হারায় এবং পরবর্তীতে কখনও নিজের দেশে ফিরে আসে না।
যিহূদার রাজাদের রাজত্ব ৯৩১-৫৮৬ খ্রীঃপূঃ
দায়ূদের কাছে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা অনুসারে দায়ূদের বংশধরেরা যিহূদার উপরে রাজত্ব করতে থাকে এবং এভাবে যিহূদা দেশ মাত্র একটি রাজবংশ দিয়ে শাসিত হয়।
যিহূদার ইতিহাসে বেশ কয়েকজন ভাল রাজা শাসন করেন (যেমন: আসা, যিহোশাফট, যোথম, হিষ্কিয় ও যোশিয়)। তারা ঈশ্বরীয় ছিলেন এবং তারা দেশেকে পুনসংস্কারের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী করে তোলেন। কিন্তু যিহূদার বেশ কয়েকজন মন্দ রাজাও শাসন করেন (যেমন: যোরাম, আহস ও মনঃশি)। এই রাজারা খারাপ প্রভাব ফেলেন এবং দেশের পতন ঘটান। নিচে দেওয়া তালিকায় লক্ষ্য করুন, কত বার একজন ভাল রাজার মন্দ ছেলে আছে এবং কত বার একজন মন্দ রাজার ভাল ছেলে আছে:
- অবিয় (মন্দ) > ছেলে আসা (ভাল)
- যিহোশাফট (ভাল) > ছেলে যোরাম (মন্দ)
- যোথম (ভাল) > ছেলে আহস (মন্দ)
- আহস (মন্দ) > ছেলে হিষ্কিয় (ভাল)
- হিষ্কিয় (ভাল) > ছেলে মনঃশি (মন্দ)
- মনঃশি / আমোন (মন্দ) > ছেলে যোশিয় (ভাল)
- যোশিয় (ভাল) > ছেল যিহোয়াহস, যিহোয়াকীম, সিদিকিয় (মন্দ)
যে সব রাজারা দেশে ভাল প্রভাব ফেলেন এবং দেশের পুনঃসংস্কার করেন তারা হলেন আসা, যিহোশাফট, হিষ্কিয় এবং যোশিয়, রাজাদের মধ্যে যোশিয় দেশের মঙ্গলের জন্য সবচেয়ে মনেপ্রাণে পুনঃসংস্কারের কাজ করেন। যোশিয়ের সময়ে দেশের অবস্থা এমন খারাপ ছিল যে, মোশির আইন-কানুন বলে কিছু আছে, এ বিষয়ে লোকেরা আর জানতো না। ৬২০ খ্রীষ্টপূর্বে যখন যোশিয় ঈশ্বরের উপাসনা-ঘর পরিষ্কার করতে বলেন তখন উপাসনা ঘরে মোশির আইন- কানুনের পুরানো গুটানো বই পেয়ে মোশির আইন-কানুন পুনরাবিষ্কার হয়। যোশিয় আইন-কানুন পড়ে ভেঙ্গে পড়েন এবং অনুতপ্ত হন (২ রাজা ২২:৮-১৩)। তিনি যিহূদার মধ্যে পুনঃসংস্কার ঘটান এবং যিহূদাকে ভালোর দিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। কিন্তু যখন তিনি মারা যান দেশ খুব তাড়াতাড়ি আবার দেবতাপূজায় ফিরে যায়, পরবর্তীতে দেশের পতন অপরিবর্তনীয় হয়ে যায়।
সারাংশ হিসাবে বলা যায় যে, যিহূদা দেশ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরো খারাপের দিকে যেতে থাকে এবং পুরোপুরিভাবে দেবতাপূজা, সামাজিক অন্যায় ও রাজনৈতিক দুর্বলতায় পতিত হয়। যিহূদার রাজারা গড়ে ২০ বছর রাজত্ব করেন। যিহূদায় শতকরা ১৭ ভাগ রাজাদের খুন করে সরানো হয়। যিহূদার দু’জন রাজা রাজপরিবারের সবাইকে খুন করে ক্ষমতা দখল করেন (যোরাম, অথলিয়া)। প্রায় ৪০০ বছরের রাজত্বে যিহূদা কিছুটা উপরের দিকে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিচের দিকে যেতে থাকে। অনেক ভাববাদীর সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করতে করতে শেষে দেশের অবস্থা এমন মন্দ হয় যে, ঈশ্বর ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে বাবিল সাম্রাজ্যকে যিহূদা, যিরূশালেম এবং উপাসনা-ঘর দখল ও সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে অনুমতি দেন। যিহূদার বেঁচে থাকা লোকসংখ্যাকে বাবিলে নির্বাসিত করা হয়।
রাজতন্ত্রের অতি দুঃখজনক ইতিহাস
ঈশ্বর দ্বারা স্থাপিত রাজনৈতিক পদ্ধতি (স্থানীয় লোকদের দ্বারা নিযুক্ত নেতারা, যারা লোকদের প্রতিনিধি এবং তাদের কাছে দায়বদ্ধ, দ্বিতীয় বিবরণ ১:৯-১৫) ইস্রায়েল ত্যাগ করে বরং রাজতন্ত্র দাবি করে (১ শমূয়েল ৮)। ঈশ্বর তাদের সাবধান করেছিলেন রাজতন্ত্র চাওয়ার ফলে কি ঘটবে এবং ১ ও ২ রাজাবলি হল এর দুঃখজনক বর্ণনা। ধ্বংসের বীজ থেকে তাড়াতাড়ি একটি খারাপ ফসল উঠে এসেছে: ক্ষমতার ভুল ব্যবহার, দায়বদ্ধতার বাইরের নেতারা, রাজাদের বিলাসিতা ও স্বেচ্ছাচারীতা, রাজপরিবার ধনী থেকে আরো ধনী হয় এবং সাধারণ লোকসংখ্যা গরীব থেকে আরো গরীব হয়। এমন কি দায়ূদের পরিবার (যা তুলনামূলকভাবে একটি ভাল পরিবার ছিল) এটাও এক দুই প্রজন্মের মধ্যে একেবারে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একারণেই ঈশ্বর রাজতন্ত্র চান নি।
১ ও ২ রাজাবলি পুস্তকের কিছু পুনরুক্তি বিষয়
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ইতিহাসের কর্তা
যদিও ঈশ্বরের জাতির লোকেরা অর্থাৎ, ইস্রায়েল ও যিহূদা দেশ উভয় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়, রাজাবলি পুস্তক অনুসারে এটি কোনভাবে ঈশ্বরের ক্ষমতার অভাবের কারণে হয় না, শুধুমাত্র ইস্রায়েলের পাপের কারণে ধ্বংস হয়। রাজাবলি পুস্তক ঈশ্বরকে ইতিহাসের কর্তা হিসাবে প্রকাশিত করে, অর্থাৎ ঈশ্বর হলেন সর্বশক্তিমান ও সার্বভৌম ঈশ্বর, যিনি মানব ইতিহাসে যে কোন কিছু ঘটাতে পারেন। তিনি আদেশ দিলে শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলো চলে আসে, তিনি আদেশ দিলে তারা আবারও চলে যায়। মাঝে মাঝে সামান্য ছোট সৈন্যদল ঈশ্বরের সাহায্যে শত্রুদের বিশাল সৈন্যদলকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়, মাঝে মাঝে এর বিপরীতও ঘটে। ঈশ্বরই সিংহাসনে বসে আছেন, তিনিই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। ঈশ্বরের জাতির অবস্থা নির্ভর করে না চারিদিকে জাতিদের শক্তির বা দুর্বলতার উপর – ঈশ্বরের জাতির অবস্থা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে ঈশ্বরের প্রতি তাদের বাধ্যতার না অবাধ্যতার উপর। এটি হল রাজাবলি পুস্তকের পাঠকদের, অর্থাৎ বাবিলে নির্বাসিত যিহূদীদের (এবং আমাদের) জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ: ‘অন্য লোকেরা’ আমাদের সমস্যা, এমন নয়, আমাদের শত্রু ‘বাইরে কোথাও’ আছে, তাও নয়। বরং আমাদের সমস্যা আমরা নিজেই, আমাদের অনিচ্ছুক হৃদয় হল আমাদের প্রধান শত্রু।
ঈশ্বর মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাকে সম্মান করেন
ঈশ্বরের স্বপ্ন ছিল যে, তাঁরই অধীনে থাকা তাঁর নিজস্ব একটি জাতি থাকুক (যাত্রা ১৯:৪-৬)। রাজাবলি পুস্তক বর্ণনা করে ঈশ্বর কিভাবে তাঁর সেই স্বপ্ন ধ্বংস হতে অনুমতি দেন, এটি আসলে আশ্চর্যের বিষয়! এতে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, ঈশ্বর তাঁর ইচ্ছা জোর করে বিস্তার করেন না, তা মানুষের উপরও নির্ভর করে। মানুষ ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য হবে (অথবা অবাধ্য হবে), এই সিদ্ধান্ত অনুসারে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন এগিয়ে যাবে, এমন কি তাদের দেশের ইতিহাস সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে এগিয়ে যাবে। একভাবে বলা যায় যে ঈশ্বর সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, আর একভাবে বলা যায় যে সব কিছু মানুষের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। ঈশ্বর অত্যন্ত চেষ্টা করেন যেন মানুষ ভাল সিদ্ধান্ত নেয় – তিনি আইন-কানুন দান করেন, শিক্ষক ও ভাববাদী পাঠান, ‘যদি-তবে’ বুঝিয়ে দেন, ফলাফল ঘটতে দেন, পুরষ্কার অথবা হুমকি দেন, মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য আংশিক বিচার করেন – তবুও ঈশ্বর মানুষের সিদ্ধান্ত বাদ দেবেন না, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা কখনও বাতিল করবেন না।
ঈশ্বর অনুতাপ দেখে তাৎক্ষণিকভাবে ও খুশি হয়ে সাড়া দেন
লক্ষণীয় বিষয় হল রাজাবলি (এবং বংশাবলি) পুস্তকে যত বার যে কেউ তার পাপের বিষয়ে অনুতপ্ত হয়, এমন কি আংশিক অনুতপ্ত হয় বা সংকটে আছে বলে অনুতপ্ত হয় (অবিয়াম ২ বংশা ১৩:১৪, আহাব ১ রাজা ২১:২৯, মনঃশি ২ বংশা ৩৩:১২), ঈশ্বর তত বারই সাথে সাথে সাড়া দেন এবং উদ্ধারের জন্য কোন না কোন পথ বের করেন, তাদের অবস্থা যত খারাপ হোক না কেন। শুধুমাত্র যখন তাঁর জাতি অনেক ভাববাদী পাঠানোর পরেও সাড়া আর দেয় না তখনই ঈশ্বর বিচার করেন। অর্থাৎ, অনেক সাবধানবাণী পাওয়ার পরেও মানুষ যখন আর সাড়া দেয় না বা মন ফিরায় না, আশা নেই বলে ঈশ্বর তখন বিচার করেন।
রাজাদের ব্যক্তিগত ‘হৃদয়’ বা ‘অন্তরের বাধ্যতা ও অবাধ্যতা’ অনুসারে মূল্যায়ন করা হয়
রাজাবলি পুস্তকে ৪০ বারের চেয়েও বেশি রাজাদের ‘হৃদয়’ বা ‘অন্তর’ নিয়ে কথা বলা হয় এবং সে অনুসারেই রাজাদেরকে মূল্যায়ন করা হয়। ঈশ্বরের দৃষ্টিতে একজন রাজার মূল্যায়ন করা হয় না তার সামরিক অভিযান বা অর্থনৈতিক সফলতা দেখে – বরং ঈশ্বরের প্রতি তার সাড়া, এবং আইন-কানুন ও ভাববাদীদের প্রতি তার বাধ্যতা দেখে রাজার মূল্যায়ন করা হয়।যে সব রাজারা ঈশ্বরকে অন্বেষণ করেন তারাই দেশে আইন-শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার নিয়ে আসেন।
আগের বাধ্যতার ফলে বাকি থাকা আশীর্বাদ এবং অবাধ্যতার ফলে বাকি থাকা অভিশাপ
ইস্রায়েল জাতির সাথে ঈশ্বরের চুক্তি এবং আইন-কানুনের শিক্ষা অনুসারে বাধ্যতার ফলাফল হল আশীর্বাদ, মঙ্গল, স্থিরতা, শান্তি ও দেশে আইন-শৃঙ্খলা এবং অবাধ্যতার ফলাফল হল অমঙ্গল, অভাব, অস্থিরতা, অন্যায়, যুদ্ধ ও মৃত্যু।
কিন্তু যেমন গাছে ফল তৈরি হতে সময় লাগে, ঠিক তেমনি বাধ্যতার (বা অবাধ্যতার) ফল প্রকাশিত হওয়ার জন্যও সময় লাগে। লক্ষ্য করুন, ইস্রায়েলে কখন এমন সময় আসে যখন ইস্রায়েল তখনও ভাল অবস্থায় ছিল কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক মন্দ কাজ চলছিল (এটাই হল ইস্রায়েলের আগের বাধ্যতার ফলে ‘বাকি থাকা আশীর্বাদ’) – এবং বিপরীতে এমন একটি সময় আসে যখন ইস্রায়েল মন ফিরিয়েছে কিন্তু আগের দুরাবস্থা থেকে ঠিক হওয়ার সময় লাগে (আগের অবাধ্যতার ফলে ‘বাকি থাকা অভিশাপ’)। শলোমনের সোনার যুগ (বিশেষভাবে তার রাজত্বের দ্বিতীয় অংশ) হল ‘বাকি থাকা আশীর্বাদ’ কিন্তু পরে দেখা যায় যে, সব কিছু ভেঙ্গে যেতে কোন সময় লাগে না। একইভাবে যারবিয়াম-২-এর রাজত্বে ইস্রায়েল দেশ তখনও শক্তিশালী (‘বাকি থাকা আশীর্বাদ’) যদিও দেশের আত্মিক অবস্থা খারাপ দিকে যাচ্ছিল। পরে দেখা যায় যে, তার সময়ে দেশের সুঅবস্থা চোখ ভুলানো মাত্র – এবং ইস্রায়েল পরবর্তীতে অল্পক্ষণের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়। ঠিক তেমনি কিছু ভাল রাজাদেরকে আগের রাজার খারাপ সিদ্ধান্তের ফলাফল ভোগ করতে হয় এবং তাদের ভাল সিদ্ধান্তের ফলাফল প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত সময় লাগে। যদি আমরা ঈশ্বরের চুক্তি ও আইন-কানুন বুঝি তবে আমরা এই ধরণের অবস্থা দেখে প্রতারিত হব না, ভাল কাজের ভাল ফল সাথে সাথে না পেয়ে আমরা নিরাশিত হব না।
দেবতাপূজা ও সামাজিক অন্যায়ের সংযোগ
ভাল রাজা হিষ্কিয়ের পরে তার ছেলে মনঃশি যিহূদার রাজা হয়ে যান। মনঃশি ছিলেন তার আগের সব রাজাদের চেয়ে আরো বেশি মন্দ। তিনি যিহূদাকে এমনভাবে দেবতাপূজায় পরিচালনা করেন যে, দেশটি পরবর্তীতে আর কখনও সম্পূর্ণ ঠিক হয় না। মনঃশি সম্বন্ধে রাজাবলি পুস্তক বলে “এছাড়া মনঃশি এত নির্দোষ লোকদের রক্তপাত করেছিলেন যে, সেই রক্তে যিরূশালেমের এক সীমা থেকে অন্য সীমা পর্যন্ত পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল” (২ রাজা ২১:১৬)। মনঃশির জীবনে খুব পরিষ্কারভাবে দেবতাপূজার ও সামাজিক অন্যায়ের সংযোগ দেখা যায়। ভাল ভালোর দিকে যিহোশাফটের আদর্শ দেখানো হয় যিনি উঁচুস্থান ও দেবতাপূজার কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে লোকদের আইনের বিষয়ে শিক্ষা দেন, বিচারকদের নিযুক্ত করেন, তাদের ন্যায়বিচার করতে বলেন এবং এভাবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাড়িয়ে তোলেন (২ বংশা ১৮:৭-৯, ১৯:৪)। এখানে আবারও সেই দুই বিষয় সংযুক্ত রয়েছে।
এখানে আমরা বাইবেলের একটি নীতি পাই: যে রকম দেবতা আমরা পূজা করি সে রকম লোক আমরা হয়ে যাই (২ রাজা ১৭:১৫, যির ২:৪, গীত ১১৫:৮, হোশেয় ৯:১০)। যারা একজন পবিত্র, ন্যায়বান ও দয়ালু ঈশ্বরকে আরাধনা করে, তারা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলবে যেখানে আইন-শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার থাকবে। কিন্তু যারা একটি রক্ত-খাওয়া দেবতাকে পূজা করে যার অনুশীলনেরঅর্থ হল মন্দিরে ব্যভিচার করা এবং এমন কি নিজের শিশু সন্তানকে বলি হিসাবে উৎসর্গ করা – এই রকম দেবতা পূজা করলে সেই সমাজে ব্যভিচার, ভাঙ্গা পরিবার, দুর্বলদের প্রতি খারাপ ব্যবহার, বিভিন্ন ধরনের অনৈতিকতা ও অন্যায় প্রচলিত হবেই।
কে কাদের ভাল দিকে অথবা মন্দের দিকে প্রভাবিত করে?
রাজাবলি পুস্তক পড়তে পড়তে নিজেকে প্রশ্ন করুন: কে কাদের কিভাবে ভালোর দিকে অথবা মন্দের দিকে প্রভাবিত করে? এটি নিয়ে একটি মজার অধ্যয়ন করা যায়। অধ্যয়নে দেখা যায় যে, ৫টি দল আছে যারা প্রভাব ফেলেন: রাজারা, ভাববাদীরা, পুরোহিতেরা, সরকারি কর্মকর্তারা এবং রাজ পরিবারের সদস্যরা।
শলোমনের ক্ষেত্রে, তিনি তার দেবতাপূজারী স্ত্রীদের (পরিবারের সদস্য) দ্বারা খারাপের দিকে অনেক বেশি প্রভাবিত (১ রাজা ১১:৩) হন। রাজাদের অবশ্যই প্রভাব বেশি, দেশকে উভয় দেবতাপূজার দিকে অথবা ঈশ্বরের আরাধনায় আকৃষ্ট করার দিকে। কিন্তু রাজা যোশিয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, যদিও তিনি রাজা হিসাবে অত্যন্ত মনেপ্রাণে দেশকে ভাল দিকে প্রভাবিত করতে উদ্যোগ নেন, তবুও লোকদের অনুতাপ তেমন গভীর ছিল না, তেমন দীর্ঘ সময়েরও ছিল না (২ বংশা ৩৪:৩৩)। ভাববাদীদের অবশ্যই একটি প্রভাব আছে এবং পুরোহিতদেরও প্রভাব আছে (যিহোয়াদা, ২ রাজা ১১)। কিছু সময়ে দেশের অবস্থা খুব খারাপ দেখায় (যেমন আহাবের রাজত্বের সময়ে) কিন্তু ঈশ্বর নিরাশায় পড়া এলিয়কে বলেন যে, ইস্রায়েলে ৭ হাজার লোক বাকি আছে যারা আহাব ও ঈষেবলের প্রভাবের পরেও বাল দেবকে পূজা করে নি (১ রাজা ১৯:১৮)। সিদিকিয়ের রাজত্বের শেষের দিকে রাজার কর্মচারীরা রাজাকে ভাববাদীর কথা না শোনার দিকে এবং বাবিলের সাথে মিত্রতার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করার দিকে প্রভাবিত করেন, যদিও শেষে এর অর্থ হল দেশের ধ্বংস (যির ৩৮:২৪-২৮)।
এর অর্থ এও যে, ঈশ্বর যদিও একটি দেশকে বিচার করছেন তবুও তিনি বিচারের মাঝখানেও ইচ্ছুক লোকদের জন্য উদ্ধারের পথে দেখাবেন।
রাজাবলি পুস্তকে ভাববাদীদের ও ভাববাণীর গুরুত্ব
১ ও ২ রাজাবলি পুস্তকে খুব পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, পুস্তকটি একজন ভাববাদী দিয়ে লিখিত। সম্ভাবনা বেশি যে, যিরমিয় ভাববাদী পুস্তকটি লিখেছেন। পুস্তকে ৪০জন ভাববাদীদের উল্লেখ করা হয় এবং তাদের বাণী (এবং বাণীর পূর্ণতা) গুরুত্বের সঙ্গে দেখানো হয়। পুস্তকে ১৮ বার উক্ত বাক্য পুনরুক্তি করে বলা হয়: “সদাপ্রভু তাঁর দাস নবী … মধ্য দিয়ে যেমন বলেছিলেন তেমনই …”। এছাড়া লক্ষ্য করুন যে, যতবার একজন রাজা একটি ভাববাণী, আইন-কানুনের শিক্ষা বা ঘটনার কারণে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন, তত বারই ঈশ্বর সাথে সাথে তাকে উদ্ধার করেন, তার পরিস্থিতি যত খারাপ হোক না কেন।
ভাববাদীরা দেশের জন্য বাণী দেন, রাজাদের বা নেতাদের জন্য বাণী দেন কিন্তু সাধারণ লোকদের জন্যও বাণী দেন। বিশেষভাবে এলিয় ও ইলীশায় ভাববাদী, যাদের বিষয়ে আমরা রাজাবলি পুস্তকে অনেকঅধ্যায় পাই (১ রাজা ১৭-২২, ২ রাজা ১-১৩), তারা অনেক সাধারণ ব্যক্তিদের কাছে কথা বলেন। ভাববাদীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে বাণী দেন, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাদের কথাগুলো ঠিক নতুন বা অসাধারণ, তা নয় বরং তারা লোকদেরকে ঈশ্বরের চুক্তি ও মোশির আইন-কানুন স্মরণ করিয়ে দেন: বাধ্য হলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ এবং অবাধ্য হলে ঈশ্বরের অভিশাপ। তারা বর্তমান অবস্থা বা সমস্যার বিষয়ে ঈশ্বরের দৃষ্টি দেখান। তারা চেতনা দেন, পথ দেখান এখন কি করতে হবে এবং তারা লোকদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা সেই মুহূর্ত থেকে ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি সাড়া দেয়।
এলিয়, যিনি ভাববাদীদের প্রতিনিধি হিসাবেও দাঁড়ান (মার্ক ৯:৪), তিনি হলেন রাজাবলি পুস্তকে একজন প্রধান ব্যক্তি। তিনি রাজা আহাব ও তার সিদোনীয় রাজকন্যা স্ত্রী ঈষেবলের বিরুদ্ধে বাণী দেন কারণ তারা আগের রাজাদের চেয়েও বেশি ইস্রায়েল দেশকে পুরোপুরিভাবে দেবতাপূজায় সমর্পিত করেন।
এলিয় এবং পরবর্তীতে ইলীশায় অনেক আশ্চর্য কাজ করেন অথবা আশ্চর্য অভিজ্ঞতা লাভ করেন: প্রকৃতির ক্ষেত্রে (বৃষ্টি বন্ধ, বৃষ্টি শুরু, বিশুদ্ধ খাবার পানি, যর্দন নদী ভাগ করা ইত্যাদি), আশ্চর্য যোগান (কাক দ্বারা খাবার, তেল, ময়দা, তরকারি ইত্যাদি), সুস্থতা অথবা এমন কি পুনরায় জীবন দান (বিধবার ছেলে, শূনেমীয় মহিলার ছেলে, একজন মৃত), রাজনৈতিক ক্ষেত্রে (আগুন, বিচার, ভবিষ্যদ্বাণী, সৈন্যদের অন্ধ করে ফেলা ইত্যাদি) এবং ভবিষ্যৎ জানার ক্ষেত্রে। এলিয় প্রায় ১৪টি আশ্চর্য কাজ করেন এবং ইলীশায় প্রায় ২৮টি, হয়তো এতে এলিয়ের “দ্বিগুণ আত্মা” পাওয়ার ইলীশায়ের অনুরোধ পূর্ণ হয় (২ রাজা ২:৯)। সুসমাচারে যীশুর আশ্চর্য কাজের মিল খুঁজলে এলিয় ও ইলীশায়ের আশ্চর্য কাজগুলো সবচেয়ে কাছাকাছি। যীশুও প্রকৃতি, জ্ঞান, যোগান, সুস্থতা ও জীবন ফিরানোর ক্ষেত্রে আশ্চর্য কাজ করেন। নতুন নিয়মে এলিয়কে বেশ কয়েকটি পদে উল্লেখ করা হয়, যেমন সেই পদে যেখানে যীশু ভাববাদী মালাখীর এলিয় সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী (মালা ৪:৫-৬) ব্যাখ্যা করে বলেন যে, তা বাপ্তিস্মদাতা যোহন সম্বন্ধীয় ছিল।
এভাবে রাজাবলি পুস্তক ইস্রায়েল জাতির ৪০০ বছর ইতিহাস বর্ণনা করে এবং দেখায় যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঈশ্বরের লোকদের সিদ্ধান্তগুলো আরো মন্দ হয়ে যায়। আইন-কানুন অনুসারে (দ্বিতীয় বিবরণ ২৮) এবং প্রত্যেক ভাববাদীর সাবধাণবাণী অনুসারে দেবতাপূজার ও অবাধ্যতার ফলাফল হল আশীর্বাদ হারানো, দেশ ও জীবন হারানো – এবং ইস্রায়েলের ইতিহাসেও ঠিক তা-ই ঘটে। ইস্রায়েল জাতি ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের চুক্তি ভেঙ্গে দিয়েছে, চুক্তির অভিশাপগুলো বাস্তবে তাদের উপরে এসেছে – কিন্তু ঈশ্বর তার জাতিকে নিয়ে আশা ছেড়ে দেন নি। এর জন্য লেখক উদ্ধারের একটি ছোট আশাবাণী দিয়ে তার পুস্তকটি সমাপ্ত করেন: বাবিলে রাজা যিহোয়াখীনকে মুক্ত করা হয়েছে (২ রাজা ২৫:২৭-৩০)।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।