রূত পুস্তক বিচারকদের যুগের একটি ইস্রায়েলীয় পরিবারের গল্প, যারা দুর্ভিক্ষের কারণে ইস্রায়েল দেশ ছেড়ে বিদেশে যায় (রূত ১:১)। পুস্তকটি হল বিচারকর্তৃগণ পুস্তকের হতাশার বর্ণনার সামনে চমৎকারভাবে বলা একটি অতি সুন্দর গল্প।
বৈৎলেহম শহরের ইলীমেলক ও তার স্ত্রী নয়মী সিদ্ধান্ত নেন যে, তারা দুর্ভিক্ষের কারণে তাদের দুই ছেলে মহলোন ও কিলিয়োনকে নিয়ে ভাল জীবন-যাপনের আশায় মোয়াব দেশে যাবেন। আশাটা ভেঙ্গে যায় যখন ইলীমেলক মোয়াব দেশে মারা যান। এরপরেও পরিবার ইস্রায়েল দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় না বরং নয়মীর ছেলেরা মোয়াবীয় মেয়েদের বিয়ে করেন: মহলোন রূতকে এবং কিলিয়োন অর্পাকে বিয়ে করেন। কিন্তু পরিবারের আরো কঠিন অবস্থা হয় যখন নয়মীর দু’জন ছেলে মারা যায়। পরবর্তীতে যখন নয়মী শোনেন যে, বৈৎলেহমের অবস্থা ভালদিকে গেছে, তখন তিনি ইস্রায়েল দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
রওনা দেওয়ার সময়ে তিনি তার বৌমাদের আশীর্বাদ করে বিদায় দেন যেন তারা তাদের সমাজে ফিরে গিয়ে নতুন বিয়ে করতে পারেন। অর্পা এই পথ পছন্দ করে নিজের সমাজে ফিরে যান কিন্তু রূত নয়মী ও তার ঈশ্বরের মধ্যে এমন কিছু দেখেন যা তিনি আর ছাড়তে রাজি হন না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার চিন্তার বিরুদ্ধে রূত সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি নয়মীর সঙ্গে বৈৎলেহমে ফিরে যাবেন।
সেখানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের দু’জনের প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য রূত মোশির আইন-কানুনে স্থাপিত একটি সাহায্যকারী পদ্ধতি ব্যবহার করেন: তিনি অন্যদের ক্ষেত-খামারে গিয়ে চাষীদের পিছনে পড়ে যাওয়া শস্য কুঁড়ান (লেবীয় ১৯:৯-১০, দ্বি বি ২৪:১৯-২২)। আইন অনুসারে রূতের তা করার অধিকার আছে কারণ তিনি বিদেশী, বিধবা ও গরীব, তাই তিনটি ক্ষেত্রেই তিনি এই সুযোগ পাওয়ার যোগ্য। অনেক পরিশ্রমী হওয়ার কারণে তিনি অন্যদের চোখে পড়েন, যেমন বোয়সের, যার ক্ষেত-খামারে রূত শস্য কুঁড়ান। বোয়স হলেন ইলীমেলকের একজন আত্মীয়। তিনি রূতের প্রেক্ষাপট বুঝে তার স্বার্থহীন সিদ্ধান্তের জন্য তাকে প্রশংসা করেন। তিনি নিশ্চিত করেন যেন রূত বিধবা হলেও নিরাপদে কাজ করতে পারেন এবং যেন তার পরিশ্রমের ফল তিনি পান। রূত বোয়সের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন এবং এই ধনী আত্মীয় থেকে আর কোন দাবি না করে বরং ফসল কাটার সময়ে শস্য কুঁড়ানোর সুযোগ ভালভাবে ব্যবহার করেন।
নয়মী লক্ষ্য করেন যে, বোয়স তাদের প্রতি ন্যায্য ও দয়ার ব্যবহার করছেন। ফলে তিনি মোশির আইন-কানুনে স্থাপিত আর একটি পদ্ধতির উপর আশা রাখেন: বিবাহ দাবি করার অধিকার (Levirate marriage)। এই আইন অনুসারে যদি কোন স্ত্রীর স্বামী মারা যায় তবে মৃত স্বামীর ভাইকে বিধবা স্ত্রীর বিয়ে করার অধিকার আছে। এভাবে দ্বিতীয় বিয়ের সন্তান জন্ম নিলে তবে সেই সন্তান মৃত ভাইয়ের নাম বহন করবে এবং তার উত্তরাধিকারী হয়ে যাবে (দ্বিতীয় বিবরণ ২৫:৫-১০)। যদিও নয়মীর মৃত স্বামী ইলীমেলকের বিয়ে করার মত কোন ভাই নেই এবং রূতের জন্য মহলোনের কোন জীবিত ভাই নেই, নয়মী সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি রূতকে বিয়ে করার জন্য আত্মীয় বোয়সকে অনুরোধ করবেন। নয়মীর নির্দেশনা অনুসারে রূত সাহস করে ও ঝুঁকি নিয়ে রাতের বেলায় বোয়সের কাছে প্রস্তাবটি নিয়ে যান।
বোয়স রূতের প্রস্তাবের উপযুক্ততা স্বীকার করেন। তিনি তাকে প্রসংশা করেন যে, তিনি অন্য পথে স্বামী পাওয়া প্রচেষ্টার চেয়ে এভাবে এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি রূতকে জানান যে, তার নিজের চেয়ে নয়মীর অন্য একজন আরো কাছের একজন আত্মীয় আছে। কিন্তু তিনি তাকে প্রতিজ্ঞা দেন যে, তিনি বিষয়টা নিয়ে আগাবেন। যদি সেই কাছের আত্মীয় রূতকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে তবে তিনি নিজেই তাকে বিয়ে করবেন।
পরের দিন সকালে বোয়স সেই কাছের আত্মীয়কে জিজ্ঞাসা করেন, সে নয়মীর ক্ষেত কিনতে ইচ্ছুক কিনা এবং এর সাথে বিধবা রূতকে বিয়ে করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি কিনা। আত্মীয়টি প্রথমে আগ্রহ দেখায়, কিন্তু যখন সে বুঝে যে, ক্ষেতের সঙ্গে একটি আবশ্যক বিবাহের দায়িত্ব আসে, তার সাথে একটি বিধবা শাশুড়ির ভার বহনের দায়িত্বও আসে এবং সন্তান হলে ক্ষেতটি বিধবার মৃত স্বামী মহলোনের নামে থাকবে, তখন সে পিছিয়ে যায়। কিন্তু বোয়সের সিদ্ধান্ত ভিন্ন। লাভজনক না হলেও তিনি ন্যায্যতার জন্য এবং এই দু’জন ঈশ্বরীয় মহিলাদের রক্ষা করার জন্য রূতকে বিয়ে করতে রাজি হন। তিনি আইনগতভাবে ক্ষেতটি কেনেন এবং রূতকে বিয়ে করেন। ঈশ্বর রূতের বিশ্বাস ও বিশ্বস্ততার জন্য তাকে একটি সম্মানজনক ও ঈশ্বরীয় বিবাহে নিয়ে আসেন। রূত ও বোয়সের সন্তান ওবেদের জন্ম হয়। এই ওবেদের সন্তান যিশয় এবং যিশয়ের সন্তান দায়ূদ। এভাবে বোয়স ও রূত একটি সম্মানজনক বংশের উৎস হয়ে যান যেমন প্রাচীনেরা তাদের আশীর্বাদ করে বলেছিলেন: “বৈৎলেহমে সবাই আপনার সুনাম করুক” (রূত ৪:১১)। বোয়স ও রূত শুধুমাত্র নামকরা রাজা দায়ূদের পূর্বপুরুষ নন, এমন কি তারা যীশুরও পূর্বপুরুষ। যারা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে এবং তাঁর আইন-কানুনে বাধ্য হয়ে চলে, তাদের (এবং তাদের সমাজের) উপরে ঈশ্বরের আশীর্বাদ কিভাবে নেমে আসে, গল্পটি হল এর সুন্দর একটি উদাহরণ।
রূত পুস্তকের শেষে হঠাৎ করে দায়ূদের বংশ তালিকা পাওয়া যায় বলেই পুস্তকটি অন্য একটি দিক নেয়, অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে গল্পটি হল রাজা দায়ূদের পূর্বপুরুষ সম্বন্ধীয়। লেখক কেন দায়ূদের পূর্বপুরুষদের বিষয়ে গুরুত্ব দেন? কেন দায়ূদের ঈশ্বরীয় পূর্বপুরুষ সম্বন্ধীয় গল্প বলা বা লিখিত রাখা প্রয়োজন? গল্পটির লেখক কে?
সম্ভবত, কিছু লোক দায়ূদের রাজা হওয়ার অধিকার নিয়ে সন্দেহ ও সমালোচনা করত: দায়ূদ মিশানো রক্তের, তার পূর্বপুরুষ রূত হলেন মোয়াবীয় (দ্বিতীয় বিবরণ ২৩:৩, হয়তো দ্বিতীয় বিবরণ ১৭:১৫)। এর উত্তরে লেখক দেখান যে, দায়ূদের বড় মা রূত ছিলেন একজন মোয়াবীয় (অর্থাৎ পরজাতি), কিন্তু তিনি সত্যিকারের ধর্মান্তরিত একজন ঈশ্বরীয় মহিলা। সম্ভবত, ভাববাদী শমূয়েল দায়ূদকে নতুন রাজা হিসাবে অভিষেক দিয়ে তার নেতৃত্বের উপযুক্ততা প্রমাণ করার জন্য রূত পুস্তক লেখেন।
রূত পুস্তক বিচারকদের যুগের একটি ইস্রায়েলীয় পরিবারের গল্প, যারা দুর্ভিক্ষের কারণে বিদেশে যায় (রূত ১:১)। পুস্তকটি হল বিচারকর্তৃগণের হতাশার বর্ণনার সামনে চমৎকারভাবে বলা একটি অতি সুন্দর গল্প।
রূতের বিশ্বাস রূত ১ অধ্যায়
ইলীমেলক হলেন বৈৎলেহম-ইফ্রাথা শহরে বাস করা একজন যিহূদা বংশের লোক। ইস্রায়েলে একটি দুর্ভিক্ষ ঘটে, হয়তো এটা বিচারকর্তৃগণ ৬:২-৬,১১ পদে উল্লিখিত অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সাথে মিল আছে। বৈৎলেহম শব্দের অর্থ হল ‘রুটির ঘর’। দুর্ভিক্ষের কারণে বর্তমানে ‘রুটির ঘরে’ রূটি নেই। ইলীমেলক ও তার স্ত্রী নয়মী সিদ্ধান্ত নেন যে, তারা তাদের দুই ছেলে মহলোন ও কিলিয়োনকে নিয়ে ভাল জীবন-যাপনের আশায় মোয়াব দেশে যাবেন। তাদের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রূত পুস্তকে কোন মন্তব্য নেই, কিন্তু বিচারকর্তৃগণ পুস্তকে (এবং মোশির আইন-কানুনে) এই বিষয়ে কথা আছে: ঈশ্বর দুর্ভিক্ষ বা অত্যাচার ঘটতে দেন যেন ইস্রায়েল জাতি পাপ থেকে মন ফিরায় এবং ঈশ্বরকে অন্বেষণ করে দেশের জন্য বিনতি করে – তবে কষ্টের কারণে দেবতাপুজারী দেশে চলে যাওয়ার বিষয়ে কোন কথা উল্লেখ নেই।
ইলীমেলক ও নয়মী তাদের দুই ছেলে নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে বিদেশে চলে গিয়েছে কিন্তু কৌশলটা সফল হয় না: ইলীমেলক মোয়াব দেশে মারা যান। এরপরেও নয়মী ইস্রায়েল দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন না বরং তার ছেলেরা মোয়াবীয় মেয়েদের বিয়ে করে: মহলোন রূতকে এবং কিলিয়োন অর্পাকে বিয়ে করে। মোশির আইন-কানুন অনুসারে বিদেশীকে বিবাহ করা নিষেধ না কিন্তু দেবতাপূজারীকে বিয়ে করা অত্যন্ত নিষেধ। আবারও এই পরিবারের সিদ্ধান্তগুলোর আপোষ বোধ আছে।
কিন্তু পরিবারের আরো কঠিন অবস্থা হয় যখন নয়মীর দু’জন ছেলে মারা যায়। পরবর্তীতে যখন নয়মী শোনেন যে, বৈৎলেহমের অবস্থা ভালদিকে গেছে, তখন তিনি ইস্রায়েল দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
রওনা দেওয়ার সময়ে তিনি তার বৌমাদের আশীর্বাদ করে বিদায় দেন যেন তারা তাদের সমাজে ফিরে গিয়ে নতুন বিয়ে করতে পারেন। তাদের এভাবে বিদায় দেওয়ায় বৌমাদের প্রতি নয়মীর যত্ন প্রকাশিত হয়, কারণ বৌমাদের ছেড়ে না দিলে নয়মী যাত্রার ও বৃদ্ধকালীন সময়ের জন্য সঙ্গী ও সাহায্য পেতেন। অর্পা তার নিজের সমাজে ফিরে যাওয়ার পথ পছন্দ করে বিদায় নেয় কিন্তু রূত নয়মী ও তার ঈশ্বরের মধ্যে এমন কিছু দেখেন যা তিনি আর ছাড়তে রাজি হন না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার চিন্তার বিরুদ্ধে রূত সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি নয়মীর সঙ্গে বৈৎলেহমে ফিরে যাবেন। তিনি বলেন: “আপনাকে ছেড়ে চলে যাবার জন্য আপনি আমাকে জোর করবেন না, কিম্বা আপনার সংগে যেতে আমাকে বারণ করবেন না। আপনি যেখানে যাবেন আমিও সেখানে যাব আর আপনি যেখানে থাকবেন আমিও সেখানে থাকব। আপনার লোকেরাই হবে আমার লোক আর আপনার ঈশ্বরই হবেন আমার ঈশ্বর” (রূত ১:১৬)। এখানে একটি পার্থক্য দেখা যায়: নয়মী তার দেশ ত্যাগ করেছিলেন অর্থনৈতিক কারণে এবং আবার দেশে ফিরে যান অর্থনৈতিক কারণে। কিন্তু রূত তার নিজের দেশ ত্যাগ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেন। প্রকৃতপক্ষে রূতের এই সিদ্ধান্ত অদ্ভুত, কারণ তিনি সম্পূর্ণ ঝুঁকি নেন: তিনি অন্য জাতির মধ্যে এবং একটি অপরিচিত দেশে বাস করার সিদ্ধান্ত নেন যদিও পরিবারে সুরক্ষাকারী একজনও পুরুষ নেই। রূত একজন বৃদ্ধা বিধবার সাথে যান, যিনি তাকে কিছু দিতে আর পারেন না বরং হয়তো শীঘ্রই মারা যাবেন – যার ফলে রূত সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়বেন। এছাড়া ইস্রায়েলে গিয়ে রূতের জন্য ভাল বিয়ে করার আশা খুবই কম, কারণ তিনি বিদেশী, লোকেরা মনে করবে তিনি দেবতাপূজারী, তার সম্পদ নেই, তিনি কুমারী নন বরং বিধবা এবং এপর্যন্ত কোন সন্তানকে জন্ম দেন নি বলে হতে পারে তিনি বন্ধা।
নয়মী ও রূত বার্লি ফসল মাড়াইয়ের শুরুর দিকে বৈৎলেহমে পৌঁছান। নয়মী তার শহরের লোকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন “আমাকে নয়মী (যার মানে ‘হাসি-খুশী’) বলে আর ডেকো না, বরং মারা (যার মানে ‘তেতো’) বলে ডাক, কারণ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আমার জীবনকে তেতো করে দিয়েছেন। আমি ভরা হাতে গিয়েছিলাম কিন্তু সদাপ্রভু আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে এনেছেন। সদাপ্রভু … আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যখন আমাকে কষ্টে ফেলেছেন“ (রূত ১:২০-২১)। “খালি হাতে” এ কথাটি রূতকে বেশি সম্মান দেয় না। এছাড়া “ভরা হাতে গিয়েছিলাম“ এই বর্ণনাটিও অনেক কিছু প্রকাশ করে। প্রকৃতপক্ষে, চলে যাওয়ার সময়ে নয়মী নিজেকে গরীব মনে করতেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যই তো মোয়াব দেশে গিয়েছিলেন। অনেক বার আমরাও নয়মীর মত বর্তমান সময়ে কৃতজ্ঞ থাকি না এবং মাত্র পরে আমরা বুঝতে পারি, কত কি যে আমাদের তারপরেও ছিল।
রূতের বিশ্বস্ততা রূত ২ অধ্যায়
বৈৎলহমে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে নয়মী ও নিজের প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য রূত মোশির আইন-কানুনে স্থাপিত একটি সাহায্যকারী পদ্ধতি ব্যবহার করেন: তিনি অন্যদের ক্ষেত-খামারে গিয়ে চাষীদের পিছনে পড়ে যাওয়া শস্য কুঁড়ান (লেবীয় ১৯:৯-১০, দ্বি বি ২৪:১৯-২২)। আইন-কানুন অনুসারে রূতের তা করার অধিকার আছে কারণ তিনি বিদেশী, বিধবা ও গরীব। তাই তিনটি ক্ষেত্রেই তিনি এই সুযোগ পাওয়ার যোগ্য।
অনেক পরিশ্রমী হওয়ার কারণে তিনি অন্যদের চোখে পড়েন, যেমন বোয়সের, যার ক্ষেত-খামারে রূত শস্য কুঁড়ান। বোয়স হলেন ইলীমেলকের একজন ধনী আত্মীয়। লক্ষণীয় বিষয় যে, যদিও নয়মীর এই ধনী আত্মীয় আছে, তবুও এই দু’জনে মহিলারা যে তার উপর পড়েন বা তার থেকে কিছু দাবি করেন, এমন নয়। রূত যখন ক্ষেতে কাজ শুরু করেন তিনি জানেন না যে, ক্ষেতের মালিক তাদের একজন আত্মীয় বরং ঈশ্বর তা এভাবে ঘটতে দেন (রূত ২:৩)।
বোয়সের ভাল চরিত্র তার আচার-ব্যবহারে প্রকাশ পায়: তিনি শ্রমিকদের সাথে ভদ্র কথা বলেন এবং তাদের আশীর্বাদ করেন। তিনি তার শ্রমিকদের বেশ ভালভাবে চিন্তেন, কারণ তা না হলে তিনি লক্ষ্য করতেন না যে, রূত নতুন। তিনি যত্নশীল এবং নতুন শ্রমিকের খোঁজ নেন। তিনি তার তদারকের কাছে প্রশ্ন করে ঠিকমত উত্তর আশা করেন এবং পান। যখন তিনি জানতে পারেন যে, রূত হলেন মাহোলনের বিধবা স্ত্রী যার সম্বন্ধে তিনি ইতিমধ্যে শুনেছেন (রূত ২:১১), তখন তিনি নিজেও রূতের কাছে ভদ্রতা ও স্নেহের সাথে পিতার মত আচরণ করেন। কাজের ক্ষেত্রে একজন একাকী যুবতীর প্রেক্ষাপট বুঝে তিনি রূতকে প্রজ্ঞাপূর্ণ দিক-নির্দেশনা দেন এবং তার পুরুষ শ্রমিকদেরও রূতকে কষ্ট না দিতে আদেশ দেন (রূত ২:৮-১১)। ইস্রায়েলে আসার স্বার্থহীন সিদ্ধান্তের জন্য রূতকে তিনি প্রশংসা করেন এবং তাকে আশীর্বাদ করে বলেন “এইজন্য সদাপ্রভু যেন তোমাকে আশীর্বাদ করেন। ইস্রায়েলীয়দের ঈশ্বর সদাপ্রভু, যাঁর ডানার নীচে তুমি আশ্রয় নিতে এসেছ, তিনি যেন তোমাকে তোমার পাওনা পুরোপুরিই দেন” (রূত ২:৮-১২)। বোয়সের কথায় প্রজ্ঞা, চিন্তাশীলতা, বুঝার ক্ষমতা ও অনুমোদন প্রকাশ পায়। তিনি ভাল চরিত্রের ব্যক্তি এবং তা হিসাবে তিনি আর একজন ভাল চরিত্রের ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে সক্ষম। তার কথায় কোন উঁচু-নীচু ভাব নেই। তিনি রূতকে তার ভাল সিদ্ধান্তগুলোতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য সময় বের করেন।
রূত কৃতজ্ঞতা ও নম্রতার সঙ্গে উত্তর দেন, এই ধনী লোক থেকে কিছু দাবি করার মত কোন কথা বা মনোভাব তার নেই (রূত ২:১০)।
রূতের ব্যবহার রূতকে যোগ্য একজন ব্যক্তি হিসাবে আরো প্রমাণিত করে। তা দেখে বোয়স আরো উদ্যোগ নিয়ে নিশ্চিত করেন যেন রূত দুপুরের খাবারে অংশ পান, যেন একাকী মহিলা কর্মী হিসাবে নিরাপদে কাজ করতে পারেন এবং যেন তার পরিশ্রমের ফল পান, এমন কি বেশি যেন পান (রূত ২:১৪-১৬)।
যখন রূত সন্ধ্যার পরে শস্য নিয়ে বাসায় ফিরে আসেন নয়মী তখন বুঝতে পারেন যে, শস্যের পরিমাণটি সাধারণ দিনের শ্রমের চেয়ে বেশি এবং তিনি ক্ষেতের মালিকের নাম জিজ্ঞাসা করেন। রূত দুপুরের খাবারের কিছু অংশ নয়মীর জন্য রেখেছিলেন। এতে প্রকাশ পায় যে, এই দু’জন মহিলা কত যত্ন সহকারে তাদের সীমিত সম্পদ ব্যবহার করেন (রূত ২:১৭-২৩)।
বোয়স ও নয়মী যেমন তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তেমনভাবে রূত মহিলা শ্রমিকদের সাথে কাজ করে যান। যদি রূত একটি নতুন বিবাহের প্রচেষ্টা করতেন তবে কাজের সময় হত কারও চোখে পড়ার ভাল সুযোগ, কিন্তু তিনি এটা করেন না। রূত ফসল কাটার সম্পূর্ণ সময়ে পরিশ্রম করতে থাকেন ভাল জেনে যে, এমন দিন আসবে যখন কাজ খুঁজে পাওয়া আরো কঠিন হবে (রূত ২:২৩)।
বিবাহের প্রস্তাব রূত ৩ অধ্যায়
নয়মী লক্ষ্য করেন যে, বোয়স তাদের প্রতি ন্যায্য ও দয়ার ব্যবহার করেন। একারণে তিনি মোশির আইন-কানুনে স্থাপিত আর একটি পদ্ধতির উপর আশা রাখেন: বিবাহ দাবি করার অধিকার (Levirate marriage)। এই আইন অনুসারে যদি স্বামী মারা যায় তবে মৃত স্বামীর ভাইকে বিয়ে করার অধিকার দাবি করতে পারে। দ্বিতীয় বিয়ের সন্তান জন্ম নিলে, সেই সন্তান মৃত ভাইয়ের নাম বহন করবে এবং তার উত্তরাধিকারী হয়ে যাবে (দ্বিতীয় বিবরণ ২৫:৫-১০)। যদিও নয়মীর মৃত স্বামী ইলীমেলকের কোন ভাই নেই যাকে বিয়ে করতে পারেন এবং রূতের জন্য মহলোনের কোন জীবিত ভাই নেই, নয়মী সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি তার একজন আত্মীয়ের কাছে রূতকে বিয়ে করার অনুরোধ করবেন। বোয়সের চেয়ে নয়মীর একজন কাছের আত্মীয় আছে এবং সম্ভবত নয়মী তাকে চেনেন, কিন্তু তিনি বোয়সকে পছন্দ করেন, কারণ তিনি ইতিমধ্যে তাদের প্রতি দয়া ও ভাল ব্যবহার দেখিয়েছেন।
নয়মী রূতকে নির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা দেন: স্নান করে ও সুগন্ধি তেল মেখে যব মাড়ার খামারে বোয়সের কাছে গিয়ে যখন তিনি সেখানে ঘুমিয়ে পড়েন (সম্ভবত তার ফসল সুরক্ষা করার উদ্দেশ্যে বোয়স সেখানে ঘুমাবেন) তখন তার পায়ের উপর থেকে চাদরটা সরিয়ে শুয়ে পড়া এবং অপেক্ষা করা তিনি কি বলেন। “পায়ের উপর থেকে চাদরটা সরানো” এই কথাটির দ্বিতীয় অর্থ হল ‘যৌনাঙ্গ অনাবৃত করা’ (যেমন লেবীয় ১৮ “ব্যক্তির আবরণীয় অনাবৃত করানো” (কেরী), যিশাইয় ৭:২০, ১ বংশা ১৯:৪-৫, যাত্রা ৪:২৫ দেখুন)। মোট কথা রূত এভাবে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে বোয়সকে অনুরোধ করেন যেন তিনি তাকে (কম পক্ষে) একটি Levirate বিবাহ হিসাবে বিয়ে করেন।
নয়মীর নির্দেশনা অনুসারে রূত সাহস করে ও ঝুঁকি নিয়ে রাতের বেলায় প্রস্তাবটি বোয়সের কাছে নিয়ে যান। রূতকে এখানে বিশ্বাসের সাথে নির্ভর করতে হবে যে, ইস্রায়েলে আইন-কানুন মেনে চলা হয়, তার শাশুড়ির নির্দেশনা প্রজ্ঞাবান, বোয়স ঈশ্বরীয় ব্যবহার করবেন এবং ঈশ্বর তাকে সুরক্ষিত রাখবেন। এপর্যন্ত রূত প্রেমের ক্ষেত্রে খুব স্বনিয়ন্ত্রণ দেখিয়েছেন (রূত ২:২৩) কিন্তু এখানে তিনি সাহস ও বিশ্বাসের সাথে এগিয়ে যান।
ঘুম ভাঙ্গলে যখন বোয়স রূতকে দেখেন, তখন রূত সৎ-সরলভাবে তার প্রস্তাব রাখেন: “আমি আপনার দাসী রূত। আপনি আপনার চাদরের নীচে আপনার এই দাসীকে আশ্রয় দিন, কারণ আপনি আমার দায়িত্ব বহনকারী আত্মীয়দের মধ্যে একজন” (রূত ৩:৯)।
বোয়স নিশ্চয় সেই সময় চমকে যান এবং এক মুহূর্তে তার ভয়, বিরক্ত, এমন কি রাগ লাগতে পারে, কিন্তু তিনি শেষে সম্মানের সঙ্গে উত্তর দেন: “সদাপ্রভু তোমাকে আশীর্বাদ করুন। এই পর্যন্ত তুমি যে বিশ্বস্ততা দেখিয়েছ তার চেয়ে এইবার আরও বেশী বিশ্বস্ততা দেখালে, কারণ ধনী-গরীব কোন যুবকের পিছনেই তুমি যাও নি” (রূত ৩:১০)। তিনি তাকে “অয়ি বৎসে” বলেন (কেরী), যা স্নেহশীল ও সম্মানজনক, কিন্তু তিনি তা বলে নিজেকে সুরক্ষাকারী বা অভিভাবক হিসাবে দাঁড় করান, প্রেমিক হিসাবে নয়। বোয়স রূতকে নৈতিক ও ঈশ্বরীয় আচার-ব্যবহারের মহিলা হিসাবে প্রশংসা করেন, তার এই প্রস্তাবের উপযুক্ততাও তিনি স্বীকার করেন।
তিনি আরো বলেন: “তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি যা চাইবে আমি তোমার জন্য তা-ই করব। আমার গ্রামের সকলেই জানে যে, তুমি একজন ভাল মেয়ে। আমি তোমার দায়িত্ব বহনকারী আত্মীয়দের একজন বটে, কিন্তু আমার চেয়েও নিকট আত্মীয় আর একজন আছেন। তুমি আজ রাতটা এখানেই থাক। কাল সকালে যদি তিনি তোমার দায়িত্ব বহন করতে রাজী হন তবে ভালই; তিনিই তা করুন। কিন্তু যদি তিনি রাজী না হন তবে আমি জীবন্ত সদাপ্রভুর দিব্য দিয়ে বলছি যে, আমি তোমার দায়িত্ব বহন করব। সকাল না হওয়া পর্যন্ত তুমি এখানেই শুয়ে থাক” (রূত ৩:১১-১৩)। তিনি আবারও রূতকে একটি ‘ভাল মেয়ে’ হিসাবে প্রশংসা করেন, যিনি সবার সম্মান অর্জন করেছেন। তিনি তাকে নিশ্চয়তা দেন যে, তা ন্যায্য দাবি অনুসারে করা হবে। যদি সেই নিকট আত্মীয় তাকে বিয়ে করে তবে ভাল। সে যদি তা না করে তবে বোয়স তা নিজেই তাকে বিয়ে করবেন। অনেকে এই পদগুলোর ব্যাখ্যা এভাবে করেন যে, বোয়স ও রূত একে অপরের প্রেমে পড়েছে। আসলে এমন নয় যে, বোয়স রূতকে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল করেন, কিন্তু তিনি নিজেকে সমর্পিত করেন যেন রূত একটি উপযুক্ত বিবাহ করতে পারেন। এছাড়া তিনি কোনো ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক কথা বা কামুক ব্যবহার দেখান না, যদিও প্রস্তাব অনুসারে তিনি তা করতে পারতেন। আবারও বোয়স এখানে একজন স্বনিয়ন্ত্রিত, সৎ, আইন-শৃঙ্খল, ন্যায্য ও যত্নশীল ব্যক্তি হিসাবে প্রমাণিত হন।
তিনি উদারভাবে রূত ও নয়মীর জন্য শস্য দান করেন এবং রূতকে খুব সকালে অন্ধকার থাকতে বাড়িতে পাঠান যেন তার দুর্নাম না হয়। কারণ গুজব-গল্প বোয়সের চেয়ে রূতকে বেশি ক্ষতি করতে পারে। খবর শুনে নয়মী নিশ্চিত যে, বোয়স বিষয়টি নিয়ে তার প্রতিজ্ঞা অনুসারে তাড়াতাড়ি আগাবেন (রূত ৩:১৪-১৮)।
উদ্ধার রূত ৪ অধ্যায়
পরবর্তী সকালে বোয়স শহরের ফটকে যান যেখানে আবারও ঈশ্বরের হাত দেখা যায়: ঠিক সেই সময় নিকট আত্মীয়টিকে সেখানে পাওয়া যায় (রূত ৪:১)। বোয়স প্রয়োজনীয় সাক্ষীদের ডাকেন যেন বিষয়টি আইনগতভাবে এগিয়ে যায় (রূত ৪:২)। আইন অনুসারে তিনি নিকট আত্মীয়ের কাছে ইলীমেলকের ক্ষেত কেনার বা উদ্ধার করার প্রস্তাব দেন এবং আত্মীয়টি তা করতে আগ্রহী হয় (রূত ৪:৩-৪)। বোয়স তাকে জানান যে, ক্ষেতের সাথে মৃত মালিকের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করার দায়িত্বও আসে। বোয়সের সেই মুহূর্তে কি চিন্তা বা অনুভূতি, তা আমরা জানি না। হয়তো তিনি খুশি হবেন যদি আত্মীয়টি দায়িত্ব গ্রহণ করে। অথবা তিনি আশা করেন যে আত্মীয়টি প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে তিনি নিজেই রূতকে বিয়ে করতে পারবেন। যখন আত্মীয়টি বিধবার দায়িত্ব নেওয়ার বিষয় শুনে তখন সে পিছিয়ে যায় এবং বলে “আমি তা করতে পারব না, কারণ আমার নিজের সম্পত্তি নিয়ে তখন আমি বিপদে পড়ে যাব”। কথাটি অবশ্যই ঠিক। আইন অনুসারে তার ক্ষেত কেনার সঙ্গে মৃত মালিকের বিধবা স্ত্রী ও শাশুড়ির ভার বহন করতে হবে, রূতকে বিয়ে করতে হবে এবং ছেলের জন্ম হলে ছেলেটি তার নিজের হিসাবে গণনা করা হবে না বরং মৃত মহলোনের ছেলে হিসাবে গণনা করা হবে। মহলোন ও রূতের বিবাহিত জীবনে কোনো সন্তান হয় নি, তাও এখানে রূতের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ক্ষেতের সাথে এত দায়িত্ব সংযুক্ত আছে বলে সেই আত্মীয়ের চোখে তা আর সুবিধার বা লাভজনক নয়। তাই সে দায়িত্বটি বোয়সের হাতে অর্পন করে (রূত ৪:৫-৬)।
বোয়স দায়িত্বটি গ্রহণ করেন: ক্ষেত, বিধবা এবং Levirate বিবাহ। আত্মীয়টির মত বোয়সেরও এখানে সুবিধা বা লাভ নেই, তবুও তিনি দায়িত্ব নিতে রাজি, ন্যায্যতার জন্য, করুণার জন্য এবং রূতের জন্য। রূত এপর্যন্ত নিঃসন্তান হলেও বোয়স নিজেকে তার কাছে সমর্পিত করেন – তিনি আইনগতভাবে ক্ষেত কেনেন এবং রূতকে বিয়ে করেন (রূত ৪:৭-১০)। একটি প্রশ্ন এখানে আসতে পারে: বোয়স কি অবিবাহিত, অথবা তিনি কি রূতকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেন? আমরা নিশ্চিত জানি না কিন্তু বৃদ্ধ নেতাদের আশীর্বাদ থেকে ইঙ্গিত পাই যে, বোয়সের এপর্যন্ত কোনো সন্তান হয় নি (রূত ৪:১০-১২)। ধরুন, যদিও এখানে রূতকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করা হয়, এরপরেও এটি ঈশ্বরীয়, ন্যায্য ও দয়ালু স্বামীর সাথে সম্মানজনক একটি বিবাহ।
নেতারা ও উপস্থিত লোকেরা বোয়স ও রূতকে আশীর্বাদ করেন “যে স্ত্রীলোকটি আপনার ঘরে যাচ্ছে সদাপ্রভু করুন যেন সে রাহেল ও লেয়ার মত হয়, যাঁরা ইস্রায়েল জাতি গড়ে তুলেছিলেন। ইফ্রাথায় আপনি ধন লাভ করুন এবং বৈৎলেহমে সবাই আপনার সুনাম করুক। এই স্ত্রীলোকের গর্ভে সদাপ্রভু আপনাকে যে সন্তান দেবেন তার মধ্য দিয়ে আপনার বংশ যেন তামরের গর্ভের যিহূদার ছেলে পেরসের বংশের মত হয়” (রূত ৪:১১-১২)।
দেখা যায় যে, এই আশীর্বাদটি ছিল একটি ভাববাদীমূলক উক্তি যা ইতিহাসে পূর্ণ হয়: বোয়স ও রূতের সন্তান হয় এবং এভাবে তাদের মধ্য দিয়ে “জাতি গড়ে তোলা” হয় এবং বৈৎলেহমে আসলে “সুনামের” লোক আসবে: রাজা দায়ূদ এবং পরবর্তীতে এমন কি মশীহ নিজেই তাদের পরিবারে জন্ম নেবেন। পরবর্তীতে ভাববাদী মীখা ভবিষ্যদ্বাণী করবেন যে, ঠিক এই বৈৎলেহম থেকে মশীহ আসবেন (মীখা ৫:২) এবং বোয়স ও রূতের নাম উভয় যীশুর বংশ তালিকায় পাওয়া যায় (মথি ১)।
লেখক এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি পার্থক্য দেখান: যে আত্মীয় আর একজনের, অর্থাৎ মহলোনের নামে রূতকে কোনো সন্তান দিতে রাজি ছিল না, সে গল্পটিতে নাম-ছাড়া ব্যক্তি হিসাবে থেকে যায়। কিন্তু বোয়স, যিনি মহলোনের নামে রূতকে একটি সন্তান দিতে রাজি ছিলেন, তারই নাম এমন কি মশীহের বংশ-তালিকায় পাওয়া যায়। তিনিই হয়েছেন ইস্রায়েলের সবচেয়ে নামকরা রাজবংশের আদিপিতা এবং এমন কি মশীহেরও আদিপিতা।
বোয়স রূতকে বিয়ে করেন। যদিও মহলোন ও রূতের বিবাহিত সময়ে সন্তান হয় নি তবুও বোয়সের সাথে বিয়ের পরে তিনি গর্ভবতী হন এবং একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন, যার নাম ওবেদ, অর্থাৎ ‘দাস’ রাখা হয় (রূত ৪:১৩)। বৈৎলেহমের মহিলারা নয়মীর সঙ্গে আনন্দ করে: ঈশ্বর তাকে নিঃসন্তান হয়ে পড়তে দেন নি, রূতের মধ্য দিয়ে তার একজন নাতী, “দায়িত্ব বহনকারী আত্মীয়” ও “বুড়ো বয়সে দেখাশোনা” করার একজন হয়েছে। এই নাতীকে জন্ম দিয়েছেন “তোমার ছেলের বৌ, যে তোমাকে ভালবাসে এবং যে তোমার কাছে সাত ছেলের চেয়েও বেশি” (রূত ৪:১৬-১৭)। রূতের জন্য উপযুক্ত ও চমৎকার সুপারিশ!
ঈশ্বর রূতকে তার বিশ্বাস ও বিশ্বস্ততার জন্য একটি ঈশ্বরীয় বিয়ে, নিরাপত্তা ও যোগান দান করেছেন। রূতের জন্য বোয়স যে মঙ্গল প্রার্থনা করেছিলেন, তাকেই দ্বারা প্রার্থনাটি পূর্ণ হয় (রূত ২:১২)। তারা একসাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের উৎস হযে যায়। যারা ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখে এবং যে সমাজ ঈশ্বরের আইন-কানুন মেনে চলে, তাদেরই উপরে ঈশ্বরের প্রচুর আশীর্বাদ থাকে, রূতের গল্পটি তা সুন্দরভাবে দেখায়।
রূত পুস্তকের শেষে বংশ তালিকার গুরুত্ব
পুস্তকটির শেষে একটি বংশ তালিকা দেওয়া হয়েছে (রূত ৪:১৮-২২): যিহূদার ছেলে পেরস (কনানীয় তামর দ্বারা), পেরসের ছেলে হিষ্রোণ, হিষ্রোণের ছেলে রাম, রামের ছেলের অম্মীনাদব, অম্মীনাদবের ছেলের নহশোন, নহশোনের ছেলে সল্মোন, সল্মোনের ছেলে বোয়স (কনানীয় রাহব দ্বারা, মথি ১:৫), বোয়সের ছেলে ওবেদ (মোয়াবীয় রূত দ্বারা), ওবেদের ছেলে যিশয় এবং যিশয়ের ছেলে দায়ূদ। এই বংশ তালিকায় বেশ কিছু প্রজন্ম বাদ দেওয়া হয় (ইব্রীয় ভাষায় ‘ছেলে’ শব্দটি ‘বংশধর’ও বুঝায়), তবুও রূত, বোয়স এবং দায়ূদকে পরিষ্কারভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে (রূত ৪:১৭)। এখানে গল্পটি একটি নতুন দিক পায়:
রূত পুস্তকে বংশ তালিকা দেখে বুঝা যায় যে, গল্পটি লেখা হয়েছে দায়ূদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস জানানোর জন্য। কিন্তু একজন লেখক কেন দায়ূদের পরিবারের পূর্বের ইতিহাস জানানো প্রয়োজন মনে করেন? গল্পটি নিয়ে লেখকের উদ্দেশ্য কি? কে সেই লেখক?
একটি বিষয় পরিষ্কার: গল্পটি দায়ূদের সময়ে লেখা হয়েছে এবং দায়ূদের কারণে লেখা হয়েছে। হয়তো গল্পটি এমন সময় লেখা হয়েছে যখন দায়ূদ ইতিমধ্যে রাজা হয়েছেন এবং লেখকের উদ্দেশ্য হল ইস্রায়েলের মহান রাজার পরিবারিক পূর্বের ইতিহাস জানানো। অথবা গল্পটি আরো আগে লেখা হয়েছে, যখন দায়ূদকে অভিষিক্ত করা হয়েছে কিন্তু বেশ কয়েকজন আছে যারা দায়ূদের রাজত্ব চায় না অথবা যাদের দায়ূদের রাজত্ব করার অধিকার নিয়ে আপত্তি আছে। তবে দায়ূদের রাজত্ব করার অধিকার নিয়ে কি ধরণের আপত্তি উঠানো হচ্ছে?
হয়তো কেউ কেউ দায়ূদকে ইস্রায়েলের রাজা হিসাবে চায় না কারণ তার রক্ত মিশানো (কনানীয় রক্তের তামর ও রাহব এবং মোয়াবীয় রক্তের রূত)। দ্বিতীয় বিবারণ ২৩:৩ পদে লেখা আছে “কোন অম্মোনীয় কিম্বা মোয়াবীয় সদাপ্রভুর লোকদের সমাজে যোগ দিতে পারবে না; তার চৌদ্দ পুরুষেও কেউ তা কখনও করতে পারবে না” এবং দ্বিতীয় বিবরণ ১৭:১৫ পদ বলে যে, কোন বিদেশী ইস্রায়েলের রাজা হতে পারে না। হয়তো রূত পুস্তকের লেখক ঠিক তা দেখাতে চান: দায়ূদের বড় মা রূত যদিও মোয়াবীয় ছিলেন তবুও তিনি ইস্রায়েলের ঈশ্বরের একজন সত্যিকারের অনুসরণকারী এবং একজন ঈশ্বরীয় মহিলা ছিলেন। ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, রাজা শৌল যখন দায়ূদকে তাড়া করে বেড়ান, দায়ূদের মোয়াবীয় এবং পলেষ্টীয়দের সাথে সুসম্পর্ক ছিল। উদাহরণস্বরূপ, তিনি তার মা-বাবাকে নিরাপত্তায় রাখার উদ্দেশ্যে তাদেরকে মোয়াব দেশে নিয়ে যান (১ শমূয়েল ২২:৩) এবং তিনি নিজেই এক সময় পলেষ্টীয়দের মধ্যে বাস করেন (১ শমূয়েল ২৭-২৯)। হয়তো ভাববাদী শমূয়েল, যিনি দায়ূদকে ইস্রায়েলের পরবর্তী নেতা হিসাবে অভিষিক্ত করেছেন, তিনি এই পুস্তকটি লেখা দ্বারা লোকদের চোখে দায়ূদের নেতৃত্বের উপযুক্ততা প্রমাণ করতে চান। ভাববাদী শমূয়েল, নাথন ও গাদ, এই তিনজন সম্বন্ধে বলা আছে যে, তারা দায়ূদের রাজত্বের ইতিহাস লিখিত রাখতেন (১ বংশা ২৯:২৯)।
এসব কারণে ধারণা করা যায় যে, ভাববাদী শমূয়েল রূত পুস্তক সেই সময়ে লেখেন যখন তিনি দায়ূদকে ইতিমধ্যে নতুন রাজা হিসাবে অভিষিক্ত করেছেন (১০২৪ খ্রীঃপূঃ) কিন্তু তখনও তিনি সিংহাসনে বসেন নি (১০১১ খ্রীঃপূ), অর্থাৎ এমন একটি সময়ে যখন রাজা শৌল তাকে তাড়া করে বেড়ান এবং তার সম্বন্ধে নিন্দা ও বিশ্বাসঘাতকতা উৎসাহিত করছেন। সম্ভবত, শমূয়েল রূত পুস্তকটি দায়ূদের সমর্থনের পক্ষে লেখেন, তার বিরুদ্ধে যারা আপত্তি উঠাচ্ছে, তারা যেন দায়ূদের নেতৃত্বের যোগ্যতার প্রমাণ পায়।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।