শমূয়েল পুস্তকে বর্ণনা করা হয় যে, ভাববাদী শমূয়েলের নেতৃত্বের সময়ে ইস্রায়েল কিভাবে একটি রাজতন্ত্রে পরিণত হয় এবং প্রথম দুই রাজা শৌল ও দায়ূদ কিভাবে রাজত্ব করেন।
ইস্রায়েলের সবচেয়ে নামকরা নেতাদের মধ্যে তিনজন নেতার জীবনের বর্ণনা শমূয়েল পুস্তকে দেওয়া হয়েছে, তারা হলেন: ভাববাদী শমূয়েল, রাজা শৌল ও রাজা দায়ূদ। পুরাতন নিয়মের পুস্তকগুলোর মধ্যে শমূয়েল পুস্তকটি হল অনেক জনপ্রিয় পুস্তকগুলোর মধ্যে একটি। পুস্তকটির জনপ্রিয়তার একটি কারণ হল যে, এই পুস্তকে নেতাদের জীবনের উভয় শক্তিশালী এবং দুর্বল দিক অনেক বিস্তারিতভাবে এবং অতি বাস্তবভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। শমূয়েল পুস্তকটিতে অনেক আকর্ষণীয় ও মজার গল্প পাওয়া যায় এবং অনেক শিক্ষণীয় বিষয়ও আছে।
শমূয়েল পুস্তকটি কে লিখেছেন, তা অজানা। কিন্তু নিশ্চিত বলা যায় যে পুস্তকটি ভাববাদী শমূয়েল, নাথন ও গাদের লেখা (১ বংশা ২৯:৯) এবং দায়ূদ ও শলোমনের ইতিহাস লেখক যিহোশাফটের লেখাগুলোর উপর ভিত্তি করে রচনা করা হয়েছে (১ রাজা ৪:৩)।
প্রধান ব্যক্তি শমূয়েল হলেন একটি পুরোহিত পরিবারের সন্তান। তার মা হান্না প্রথমদিকে বন্ধা, কিন্তু যখন ঈশ্বর তার প্রার্থনা অনুসারে তাকে একটি ছেলে দেন, তখন হান্না তার এই সন্তান শমূয়েলকে অল্প বয়সে মহাপুরোহিত এলিকে দিয়ে ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত করেন। মহাপুরোহিতের পরিবার দুর্নীতিগ্রস্ত, কিন্তু শমূয়েল বড় হতে হতে একজন ঈশ্বরীয় পুরোহিত ও নেতায় পরিণত হন। ঈশ্বর তাকে ভাববাদী হিসাবে আহ্বান করেন এবং তিনি ইস্রায়েলের বিচারক হিসাবেও ভূমিকা পালন করেন।
পলেষ্টীয়েরা ইস্রায়েলকে যখন বার বার আক্রমণ করছিল এবং ইস্রায়েলীয়েরা দেখে শমূয়েলের ছেলেরা তাদের বাবার মত সৎ নয় বরং দুর্নীতিগ্রস্ত, তখন ইস্রায়েলের নেতারা শমূয়েলের কাছে এসে জাতির নেতৃত্বের জন্য “অন্য সব জাতির মত” একজন রাজা চান (১ শমূয়েল ৮:১-৬)। ইস্রায়েলীয়েরা অন্য জাতিগুলোর অনুসরণকারী হয়ে রাজতন্ত্র চায়। এর অর্থ এই যে, তারা অন্য জাতিদের কাছে আদর্শ হওয়ার ঈশ্বর থেকে দেওয়া সেই আহ্বানকে অগ্রাহ্য করে (যাত্রা ১৯:৪-৬)। ইস্রায়েলীয়দের রাজা চাওয়া মানেই তারা ঈশ্বরকে ইস্রায়েলের রাজা হিসাবে অগ্রাহ্য করে। শমূয়েল তাদের কঠোর সাবধানবাণী দেন যে, একটি রাজতন্ত্র কত অন্যায় ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। কিন্তু ইস্রায়েলীয়েরা ঈশ্বরের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে তারপরেও রাজা দাবি করে। তাই শমূয়েল তাদের জন্য ইস্রায়েলের প্রথম রাজা অভিষিক্ত করেন: বিন্যামীন বংশের শৌলকে।
শৌল হলেন মানুষের পছন্দের মত রাজা, সুদর্শন, লম্বা, যুদ্ধে জয়ী ও বড় মনের। যদিও শৌল গুরুত্বপূর্ণ আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করেন এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে তার আহ্বানের নিশ্চয়তা পান (১ শমূয়েল ৯), তিনি কখনও সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখতে ও তাঁর প্রতি বাধ্য হতে সক্ষম হন নি। শৌল জনপ্রিয় হতে চান বলে তার কথা তিনি বার বার বদলান (১ শমূয়েল ১৩-১৫)। এছাড়া শৌল দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় ঈশ্বরের প্রতি অবাধ্য হন: এক সময় তিনি নিজের হাত দ্বারা উৎসর্গ দান করেন (যা আইন অনুসারে শুধুমাত্র পুরোহিতদের অধিকার) এবং আর এক সময়ে তিনি অমালেকীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করেন। শৌলের সেই অবাধ্যতার কারণে ঈশ্বর ঘোষণা করেন যে, তিনি শৌলের পরিবারকে রাজপরিবার হিসাবে অগ্রাহ্য করেছেন এবং রাজত্ব করার অধিকার শৌলের কাছ থেকে তুলে নিয়েছেন (১ শমূয়েল ১৫:২৮)। তবে এই ঘোষণার পরেও শৌল জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখতে থাকেন।
পরবর্তীতে, ভাববাদী শমূয়েল ঈশ্বরের আদেশে অন্য একজন ব্যক্তিকে ইস্রায়েলের নতুন রাজা হিসাবে অভিষিক্ত করেন। তিনি বৈৎলেহমে গিয়ে ঈশ্বরের নির্দেশনা অনুসারে একটি পরিবারের অষ্টম ছেলে, অর্থাৎ দায়ূদ নামে একজন রাখাল যুবককে রাজা হিসাবে বেছে নেন (১ শমূয়েল ১৬)। দায়ূদের ঈশ্বরের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। যখন শুধুমাত্র দায়ূদেরই গীত ও গান রাজা শৌলের মানসিকতা রক্ষা করতে পারে এবং আরো বেশি যখন দায়ূদ অত্যাচারী পলেষ্টীয়দের বীরযোদ্ধা গলিয়াৎকে পরাজিত করেন, তখন তিনি নিজেকে সবার দৃষ্টিতে খুঁজে পান (১ শমূয়েল ১৭)। শৌল দায়ূদকে তার সেনাপতি হিসাবে নিযুক্ত করেন। এই ভূমিকায় তিনি একজন ভাল নেতা হিসাবে আরো প্রমাণিত হন এবং তার জনপ্রিয়তা ও সুনাম আরো বেড়ে যায়। কিন্তু এসব দেখে শৌল অস্থির হয়ে ওঠেন। শৌল যখন শুনতে পান যে, ভাববাদী শমূয়েল দায়ূদকে রাজা হিসাবে অভিষিক্ত করেছেন তখন থেকেই তিনি দায়ূদকে ভয় করতে ও তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখতে শুরু করেন এবং বিভিন্নভাবে তাকে ফাঁদে ফেলতে চেষ্টা করেন। যখন তার কৌশলগুলো নিষ্ফল হতে থাকে তখন তিনি খোলাখুলিভাবে দায়ূদকে খুন করতে চেষ্টা করেন। বিপরীতে শৌলের প্রথম সন্তান যোনাথন, যাকে ঈশ্বর তার বাবার অবাধ্যতার কারণে রাজপদ থেকে বঞ্চিত করেছেন এবং যার স্থান দায়ূদ পাবেন, তিনি তার বাবার মত না করে বরং ঈশ্বরের ইচ্ছা মেনে নিয়ে দায়ূদের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু ও বিশ্বস্ত সমর্থনকারী হয়ে যান (১ শমূয়েল ২০, ২৩:১৭)। দায়ূদ নিজেকে রাষ্ট্রীয় শত্রু ও পলাতক লোক হিসাবে খুঁজে পান যাকে শৌল বছরের পর বছর তাড়া করে বেড়ান, এমন একটি সময় পর্যন্ত যখন শৌল এবং তার তিনজন ছেলে একটি আশাহীন যুদ্ধে মারা যান (১ শমূয়েল ৩১)। পরবর্তীতে দায়ূদ প্রথমে যিহূদা বংশের উপর (২ শমূয়েল ২) এবং সাত বছর পরে সারা ইস্রায়েল জাতির রাজা হয়ে যান (২ শমূয়েল ৫)।
দায়ূদ ইস্রায়েলের সবচেয়ে ঈশ্বরীয়, প্রিয় ও সবচেয়ে সফল রাজা হয়ে যান। তিনি চারিদিকের জাতিগুলো পরাজিত করেন, ইস্রায়েলের জন্য অনেক জমি দখল করেন এবং ইস্রায়েলকে একটি সুরক্ষিত ও অর্থনৈতিক সু-অবস্থার দেশে পরিণত করেন। তিনি যিরূশালেম শহর দখল করে তা তার রাজধানী হিসাবে পছন্দ করেন এবং সম্মানের সঙ্গে সেখানে ঈশ্বরের নিয়ম-সিন্দুক নিয়ে আসেন।
ধীরে ধীরে রাজতন্ত্র পছন্দ করার সেই খারাপ বীজ থেকে একটি ধ্বংসাত্মক ফসল উঠে আসতে শুরু করে: দায়ূদ ব্যভিচার করেন ও খুন করেন এবং এভাবে তার ক্ষমতা সম্পূর্ণ ভুলভাবে ব্যবহার করেন (২ শমূযেল ১১)। তিনি অনেক মহিলাদের স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেন এবং ফলে তার পরিবার আরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়: দায়ূদ তার ছেলেদের শাসন করেন না, যার ফলে তার পরিবারে সন্তানদের মধ্যে ধর্ষণ, খুন, ঘৃণা, বিদ্রোহ ও রক্তপাত ঘটে।
এত সুনাম ও এত দুর্বলতার পরেও দায়ূদ তার সারা জীবনে ঈশ্বরের প্রতি সমর্পিত হতে থাকেন, তিনি নম্র হয়ে মন ফিরান এবং খুশি মনে ঈশ্বরকে তার জীবনের সব ভাল জিনিসের উৎস হিসাবে স্বীকার করেন। ঈশ্বর তাকে একটি অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা দেন যে, তার অর্থাৎ তার পরিবারের মধ্য দিয়ে একটি চিরস্থায়ী রাজ্য গড়ে উঠবে (২ শমূয়ল ৭:১৬)। এই প্রতিজ্ঞা সর্বোচ্চভাবে যীশুর মধ্য দিয়ে পূর্ণ হয়।
ইস্রায়েলের সবচেয়ে নামকরা নেতাদের মধ্যে তিনজন নেতার জীবনের বর্ণনা শমূয়েল পুস্তকে দেওয়া হয়েছে, ভাববাদী শমূয়েল, রাজা শৌল ও রাজা দায়ূদ। পুরাতন নিয়মের পুস্তকগুলোর মধ্যে শমূয়েল পুস্তকটি অনেক জনপ্রিয়দের মধ্যে একটি। পুস্তকটির জনপ্রিয়তার একটি কারণ হল যে, এই পুস্তকে নেতাদের জীবনের, উভয় শক্তিশালী এবং দুর্বল দিক, অনেক বিস্তারিতভাবে এবং অতি বাস্তবভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। শমূয়েল পুস্তকটিতে অনেক আকর্ষণীয় ও মজার গল্প আছে – এবং অনেক শিক্ষণীয় বিষয়ও আছে।
পুস্তকের লেখক এবং পুস্তকে ব্যবহৃত উৎসগুলো
শমূয়েল পুস্তকটি কে লিখেছেন, তা অজানা। পুস্তকটিতে বর্ণিত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলের প্রাণবন্ত বর্ণনার কারণে পুস্তকটির ‘চোখের সাক্ষী দ্বারা লিখিত’ একটি ভাব আছে। লেখক অজানা হলেও নিশ্চিত বলা যায় যে, পুস্তকটি ভাববাদী শমূয়েল, নাথন ও গাদের লেখা (১ বংশা ২৯:৯) এবং দায়ূদ ও শলোমনের ইতিহাস লেখক যিহোশাফটের লেখাগুলোর উপর ভিত্তি করে রচনা করা হয়েছে (১ রাজা ৪:৩)। তাই চিন্তা করা যায় যে, পুস্তকটি বেশ তাড়াতাড়ি, অর্থাৎ দায়ূদের মৃত্যুর অল্প দিনের মধ্যে লেখা হয়েছে (৯৭১ খ্রীষ্টপূর্বের পরে)। অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে, পুস্তকটি ৯৩১ থেকে ৭২২ খ্রীষ্টপূর্বের মধ্যে, এমন একজন লেখক লেখেন যিনি প্রমাণ করতে চান যে শুধুমাত্র দায়ূদের পরিবারের রাজত্ব করার অধিকার আছে। এভাবে তিনি উত্তরের ইস্রায়েল রাজ্যে বাসকারী ইস্রায়েলীয়দের দক্ষিণের যিহূদা রাজ্যে চলে আসার জন্য আকৃষ্ট করতে চান। পুস্তকটির কিছু পদগুলোতে মন্তব্য করা বা ব্যাখ্যা করার একটি ভাব আছে (১ শমূয়েল ২৭:৬, ১৩:১৮ ইত্যদি) যা থেকে বুঝা যায় যে, পরবর্তী যুগের একজন প্রকাশক তার যুগের পাঠকদের বুঝার সুবিধার জন্য শমূয়েল পুস্তকটিতে কিছু ব্যাখ্যা যোগ দিয়েছিলেন।
ভাববাদী শমূয়েলের ছোটবেলা
শমূয়েলের জন্ম হয় ইফ্রয়িমের পাহাড়ি এলাকায় রামা শহরে বাসকারী একটি পুরোহিত পরিবারে। তার বাবা ইলকানা দুটি বিয়ে করেন এবং শমূয়েলের মা হান্না প্রথমদিকে বন্ধা ছিলেন। বহুবিবাহে আবদ্ধ থাকা একজন নিঃসন্তান মহিলা হিসাবে হান্না কান্না করে ঈশ্বরের কাছ থেকে একজন ছেলে-সন্তান চান। ঈশ্বর তার প্রার্থনা শোনেন এবং তাকে একটি ছেলে-সন্তান দান করেন, যার নাম তিনি শমূয়েল রাখেন। কৃতজ্ঞতায় হান্না শমূয়েলকে নাসরীয় হিসাবে বড় করেন (গণনা ৬) এবং তাকে অল্প বয়সে মহাপুরোহিত এলিকে দিয়ে ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত করেন (১ শমূয়েল ১)।
এভাবে শমূয়েল মহাপুরোহিত এলির যত্নে বড় হন। এলি ঈশ্বরের বিষয়ে আগ্রহী, কিন্তু তিনি তার দুর্নীতিগ্রস্ত ছেলেদের শাসন করেন না, যারা তাদের পুরোহিত পদ ব্যক্তিগত লাভ ও ব্যভিচারের জন্য ব্যবহার করেন (১ শমূয়েল ২)। এর বিপরীতে শমূয়েল ঈশ্বরের ভক্তিপূর্ণ ভয়ে চলেন এবং একজন ঈশ্বরীয় ব্যক্তি হিসাবে বৃদ্ধি পান। ঈশ্বর অল্প বয়সে তাকে ভাববাদী হওয়ার জন্য আহ্বান করেন (১ শমূয়েল ৩)। তার সর্বপ্রথম বাণীটি খুব কঠিন, যা ছিল এলি ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে একটি বিচারবাণী। ভাববাদী হিসাবে শমূয়েলকে অপ্রিয় ও অস্বস্তির সত্যগুলো প্রকাশ করতে শিখতে হয় এবং এতে তিনি ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য হন।
ঈশ্বরের নিয়ম-সিন্দুক পলেষ্টীয়দের মাঝে
পলেষ্টীয়দের বিরুদ্ধে ঘন ঘন যুদ্ধের মধ্যে একটি যুদ্ধে ইস্রায়েলীয়েরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা ঈশ্বরের নিয়ম-সিন্দুক যুদ্ধে নিয়ে যাবে। যে নিয়ম-সিন্দুক সম্মানের সঙ্গে ইস্রায়েল জাতিকে পরিচালনা করত তা এখন ঈশ্বরকে অন্বেষণ না করে যুদ্ধের ক্ষেত্রে আনানো হয় (১ শমূয়েল ৪)। ঈশ্বরের উপস্থিতি বা পবিত্রতায় গুরুত্ব না দিয়ে ইস্রায়েল স্বেচ্ছাচারীভাবে নিয়ম-সিন্দুক একটি কুসংস্কার হিসাবে ব্যবহার করতে চায়।
কিন্তু ঈশ্বর এভাবে সুরক্ষা দিতে রাজি নন: তিনি ইস্রায়েলকে পরাজিত হতে এবং তাঁর নিয়ম-সিন্দুক পলেষ্টীয়দের হাতে পড়তে দেন যদিও উভয় ইস্রায়েলীয়েরা এবং পলেষ্টীয়েরা তা ঈশ্বরের অক্ষমতার প্রমাণ হিসাবে দেখবে। লক্ষণীয় বিষয়: একটি অননুতপ্ত ইস্রায়েল জাতিকে (যা ভক্তিপূর্ণ ভয়ের চেয়ে ধর্ম-কর্মের কুসংস্কারে চলে) জয় দেওয়ার চেয়ে তাদেরকে তাঁরই বিষয়ে সন্দেহে পড়তে ঈশ্বর ভাল মনে করেন। এলির দুর্নীতিগ্রস্ত ছেলেরা এই যুদ্ধে মারা যায় এবং এলি যখন শোনেন যে নিয়ম-সিন্দুক পলেষ্টীয়দের হাতে পড়েছে তখন তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে মারা যান (১ শমূয়েল ৪:১০-২২)।
কিন্তু ঈশ্বর নিয়ম-সিন্দুক ও তাঁর নাম রক্ষা করতে জানেন, নিজেকে ইস্রায়েলীয় ও পলেষ্টীয় উভয়ের কাছে প্রকাশিত করতেও জানেন। তিনি একটি খুব মজার গল্প ঘটান: পলেষ্টীয়েরা নিয়ম-সিন্দুক যুদ্ধ-জয়ের স্মৃতির চিহ্ন হিসাবে তাদের দেব দাগোনের মন্দিরে রাখে। কিন্তু দাগোনের মূর্তিটি নিয়ম-সিন্দুকের সামনে উবুড় হয়ে পড়তে থাকে, এটি পলেষ্টীয়দের কাছে অতি স্পষ্ট একটি সংবাদ (১ শমূয়েল ৫:৩-৪)। এছাড়াও এই নিয়ম-সিন্দুক সামলানো সমস্যার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, যে পলেষ্টীয় শহরে নিয়ম-সিন্দুকটি নিয়ে যাওয়া হয় সেই শহরের লোকেরা ফোঁড়া ও ইঁদুরের উৎপাতে আক্রান্ত হয়। এতে পলেষ্টীয়দের মধ্যে এমন সমস্যা ও ভয়ের সৃষ্টি হয় যে, তারা নিয়ম-সিন্দুক ইস্রায়েলীয়দের কাছে ফিরে পাঠানো ছাড়া আর কোন উপায় খুঁজে পায় না। তারা খুব ভদ্রভাবে, সোনার উপহার সহ ক্ষমাপ্রার্থনার সঙ্গে তা ইস্রায়েল দেশের দিকে ফিরে পাঠায়। কিছু ইস্রায়েলীয়েরা নিয়ম-সিন্দুক ফিরে পেয়ে আনন্দ ও ভক্তিপূর্ণ ভয়ে তা গ্রহণ করে (বৈৎ-শেমশ), অন্য কিছু ইস্রায়েলীয়েরা নিয়ম-সিন্দুক সম্মান ছাড়া স্পর্শ করে এবং ঈশ্বরের বিচার ভোগ করে (১ শমূয়েল ৬:১৯)। অর্থাৎ এমন না যে, ঈশ্বর পলেষ্টীয়দের একটি মানদণ্ডে দায়বদ্ধ করেন যা ইস্রায়েল জাতির না মানলেও চলে।
বিচারক ও ভাববাদী হিসাবে শমূয়েলের ভূমিকা
শমূয়েল অনেক বছর ধরে বিচারক হিসাবে ভূমিকা পালন করেন এবং বছরে একবার বৈথেল, গিলগল ও মিস্পাতে গিয়ে ন্যায়বিচার করেন (১ শমূয়েল ৭:১৬)। তিনি একজন আদর্শবান ও ন্যায়বান ব্যক্তি এবং তিনি তার সমস্ত আচার-আচরণের বিষয়ে স্বচ্ছভাবে ইস্রায়েল জাতির কাছে দায়বদ্ধ থাকেন (১ শমূয়েল ১২:১-৫)।
শুধু এক ক্ষেত্রে শমূয়েলের দুর্বলতা প্রকাশিত – এলির মত নিজের ছেলেদের ক্ষেত্রে তিনি অতি ব্যর্থ: তিনি নিজের দু’জন ছেলেকে বিচারক বানান যদিও মোশির আইন-কানুন অনুসারে স্থানীয় লোকদেরই নিজেদের উপরে বিচারক নিযুক্ত করার কথা (দ্বিতীয় বিবরণ ১:১৩-১৮, ১৬:১৮-২০)। এটি অবাক লাগার বিষয় নয় যে, শমূয়েল সৎ হলেও তার ছেলেরা ঘুষ খায় ও অন্যায় বিচার করে (১ শমূয়েল ৮:১-৩) এবং তাদের নিয়ে নিরাশাই হল ইস্রায়েলের রাজা চাওয়ার একটি কারণ। যখন নতুন রাজা ঠিক হয় তখর শমূয়েল খুব সুন্দর ও স্বচ্ছভাবে নতুন রাজা শৌলের কাছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব হস্তান্তর করেন। কিন্তু শমূয়েল বিশ্বস্তভাবে ইস্রায়েলের পুরোহিত, ভাববাদী ও বিনতিকারী হিসাবে ভূমিকা পালন করতে থাকেন (১ শমূয়েল ১২:২৩)।
বাইবেলে যে একজন নেতার হাতে রাজনৈতিক ও আত্মিক নেতৃত্ব উভয়ই থাকে, তা শুধুমাত্র দুটি ব্যতিক্রম সময়ে দেখা যায় এবং তা বেশ শীঘ্রই পরিবর্তিত করা হয়: রাজনৈতিক নেতৃত্ব একজনের হাতে এবং আত্মিক নেতৃত্ব আর একজনের হাতে চলে যায়। মোশির সময়ে হারোণকে মহাপুরোহিতের ভূমিকা দেওয়া হয় এবং শমূয়েলের সময়ে শৌলকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়া হয়।
ইস্রায়েল কিভাবে একটি বংশভিত্তিক গণতন্ত্র থেকে একটি রাজতন্ত্রে পরিণত হয়
পলেষ্টীয়েরা যখন ইস্রায়েলকে আক্রমণ করতে থাকে এবং দেখা যায় যে, শমূয়েলের ছেলেরা তাদের বাবার মত সৎ নয় বরং দুর্নীতিগ্রস্ত (অর্থাৎ সেখানেও ভাল ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের আশা নেই) তখন ইস্রায়েলের প্রাচীনেরা শমূয়েলের কাছে এসে জাতির নেতা হিসাবে “অন্য সব জাতির মত” একজন রাজা চান (১ শমূয়েল ৮:১-৬)। ইস্রায়েল অন্য জাতিগুলোর মত হতে চায়। ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে এমন একটি আকর্ষণীয় ও আদর্শ জাতি হতে আহ্বান করেছিলেন যাতে অন্য জাতিগুলো তাদের মত হতে চাইবে (যাত্রা ১৯:৪-৬)। কিন্তু এখন তারা বাস্তবে ঈশ্বরের এই আহ্বানকে অগ্রাহ্য করে, এমন কি ঈশ্বরকে ইস্রায়েলের রাজা হিসাবে অগ্রাহ্য করে (১ শমূযেল ৮:৭)। শমূয়েলের দ্বারা ঈশ্বর তাদেরকে কঠোর সাবধানবাণী দেন যে, রাজতন্ত্রে পরিণত হওয়ার অর্থ কত ঝুঁকিপূর্ণ: জনগণ দ্বারা নতুন নিযুক্ত নেতৃত্ব আর থাকবে না, বিলাসিতায় অভ্যস্ত রাজপরিবার দ্বারা সাধারণ লোকদের প্রতিনিধিত্ব আর হবে না, তারা স্বৈরাচারীভাবে লোকদের উপর ক্ষমতা খাটিয়ে আরো ধনী হয়ে যাবে এবং সাধারণ লোকেরা গরীব থেকে আরো গরীব হয়ে যাবে (১ শমূয়েল ৮:১০-১৮)। ইস্রায়েলীয়েরা এই সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে এবং শেষে ঈশ্বর ইস্রায়েলকে রাজতন্ত্রে যেতে মুক্ত করেন কারণ তিনি নিজেই লোকদের হাতে নেতৃত্ব ঠিক করার অধিকার দান করেছিলেন (দ্বিতীয় বিবরণ ১:১৩-১৪)।
রাজতন্ত্র মানে হল যদিও প্রথম রাজা নিযুক্ত করা যায়, পরবর্তীতে রাজার বংশধরেরা ভাল হলেও অথবা মন্দ হলেও রাজত্ব করবেন এবং জাতি বা দেশ একটি রাজবংশের অধীনেই থাকবে। একটি রাজবংশ যদি রাজত্ব করবে তবে ইস্রায়েল কোন পরিবারকে পছন্দ করবে? ঈশ্বর বিন্যামিন বংশের শৌলকে দেখান এবং শমূয়েল তাকে ইস্রায়েলের প্রথম রাজা হিসাবে অভিষিক্ত করেন (১ শমূয়েল ৯)।
ইস্রায়েলের প্রথম রাজা শৌল
শৌল হলেন মানুষের পছন্দের মত রাজা, সুদর্শন, লম্বা, যুদ্ধে জয়ী এবং বড় মনের অধিকারী। কিন্তু তিনি জনপ্রিয় হওয়ার প্রচেষ্টা দিয়ে চালিত, প্রকৃতপক্ষে তিনি গভীর হীনমন্যতায় ভোগেন (১ শমূয়েল ১৫:১৭)। যদিও শৌল গুরুত্বপূর্ণ আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করেন এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে কয়েকভাবে তার আহ্বানের নিশ্চয়তা পান (১ শমূয়েল ৯), তিনি কখনও সত্যিকারভাবে ঈশ্বরকে চিনতে এবং প্রকৃতভাবে ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য হতে সক্ষম হন না। তিনি জনপ্রিয় হতে চান বলে তিনি তার কথা বার বার বদলান (১ শমূয়েল ১৩-১৫)। তিনি ভীত হয়ে ধর্মকর্ম করেন (যেমন নিয়ম-সিন্দুকটি যুদ্ধে আনা, শপথ করা বা শপথ দাবি করা, পুরোহিত থেকে পরিচালনা চাওয়া, উৎসর্গ দান) কিন্তু ঈশ্বর আসলে কি চান, তা তিনি কখনও সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারেন না, বুঝতে আগ্রহীও না। তিনি চেষ্টা করেন লোকদের দাবি ও ঈশ্বরের আদেশের মধ্যে আপোষ আনতে, কিন্তু সবশেষেও তিনি বাধ্য হন না। তিনি ঈশ্বরকে কঠোর ও অতি দাবিকারী মনে করেন, এমন কেউ যাকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব না। শৌল দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় ঈশ্বরের প্রতি অবাধ্য হন: এক সময় তিনি নিজের হাত দ্বারা উৎসর্গ দান করেন এবং আর এক সময়ে তিনি অমালেকীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করেন। শৌলের সেই অবাধ্যতার কারণে যখন ঈশ্বর ঘোষণা করেন যে, তিনি শৌলের পরিবারকে রাজপরিবার হিসাবে অগ্রাহ্য করেছেন এবং রাজত্ব করার অধিকার শৌলের কাছ থেকে তুলে নিয়েছেন (১ শমূয়েল ১৫:২৮) তখন শৌল হালকাভাবে অনুতাপ করেন কিন্তু এর চেয়ে তিনি বর্তমান অবস্থায় নিজের মান-সম্মান রক্ষা করতে ব্যস্ত হন “তবুও … আমার জাতির বৃদ্ধ নেতাদের ও ইস্রায়েলীয়দের সামনে আমার সম্মান রাখুন” (১ শমূয়েল ১৫:৩০)। শমূয়েল তাকে শক্তিশালী ধমক দিয়ে বলেন যে, ধর্মকর্ম বা উৎসর্গের চেয়ে ঈশ্বর বাধ্যতা চান, কিন্তু শৌল কথাটিতে তেমন গুরুত্ব দেন না (১ শমূয়েল ১৫:২২-২৩)।
দায়ূদের অভিষেক
কিছুদিন পরে ঈশ্বর শমূয়েলকে শৌলের পরিবর্তে আর একজনকে রাজা হিসাবে অভিষিক্ত করতে বলেন। শমূয়েল শৌলকে ভালবাসেন বলে তিনি এতে খুশি নন (১ শমূয়েল ১৫:৩৪-১৬:১) কিন্তু বাধ্য হয়ে তিনি বৈৎলেহম গ্রামে গিয়ে ঈশ্বরের পরিচালনায় যিশয় নামে একজনের ৮টি ছেলেদের মধ্যে অষ্ঠম ছেলেকে অভিষিক্ত করেন (১ শমূযেল ১৬:১-১৩)। এভাবে দায়ূদ নামে একজন ১৭ বছরের যুবক রাখালকে ইস্রায়েলের দ্বিতীয় রাজা হিসাবে অভিষিক্ত করা হয়।
অল্পদিনের মধ্যে দায়ূদ সুনামের অধিকারী হয়ে ওঠেন যখন তিনি রাজা শৌলের গায়ক ও বাদ্যযন্ত্রকার হয়ে যান। দায়ূদ হলেন একমাত্র ব্যক্তি যার প্রভাবে শৌল মন্দ আত্মা থেকে রেহাই পান (১ শমূয়েল ১৬:১৪-২০)। ইস্রায়েলের বিরুদ্ধে পলেষ্টীয়দের এক যুদ্ধের সময়ে দায়ূদ তার সৈনিক বড় ভাইদের কাছে যখন খাবার পৌঁছিয়ে দেন তখন তিনি শুনতে পান যে, কিভাবে পলেষ্টীয়দের বীরযোদ্ধা গলিয়াৎ ইস্রায়েলের ঈশ্বরকে অপমান করে। অন্য ইস্রায়েলীয়দের মত ভীত না হয়ে দায়ূদ বরং ঈশ্বরের গৌরবকে অসম্মান করা হয় বলে রাগানন্বিত হন। তিনি তার রাখালের ফিংগা নিয়ে গলিয়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে হত্যা করেন। সেই দিন ইস্রায়েলের একটি বড় জয় ঘটে (১ শমূয়েল ১৭)। শৌল দায়ূদকে তার সৈন্যদলে নিযুক্ত করেন এবং শৌলের প্রথম সন্তান যোনাথন, যদিও তিনি দায়ূদের চেয়ে বয়সে বড় তবুও তিনি দায়ূদের মধ্যে তার মত একজনকে দেখে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন (১ শমূয়েল ১৮:১-৫, ১৪:১-১৫)।
শৌল ও দায়ূদ
দায়ূদের দক্ষতা, পদ-মর্যাদা ও সুনাম তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায়। ঈশ্বর তার সঙ্গে আছেন এবং যেখানে তিনি যান না কেন এবং হাতে কিছু নেন না কেন, সব ক্ষেত্রে তিনি সফল ও জনপ্রিয়। প্রথমদিকে শৌল তাকে নিয়ে অনেক খুশি ছিলেন, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি নিজের মনে দায়ূদের প্রতি হিংসা, সন্দেহ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী চিন্তা বৃদ্ধি হতে দেন। শমূয়েল পুস্তকে উল্লেখ নেই ঠিক কোন সময়ে শৌল ও যোনাথন জানতে পারেন যে, শমূয়েল দায়ূদকে তাদের পরিবর্তে পছন্দ করে অভিষিক্ত করেছেন কিন্তু ঘটনাটি অবশ্যই বেশি দিন লুকানো সম্ভব ছিল না। তবে দায়ূদের অভিষেকের ঘটনা জানার পরে শৌল ও যোনাথনের সাড়া একে অপরের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরীত – যেমন তাদের দু’জনের মনোভাব ও চরিত্রও সম্পূর্ণ বিপরীত।
শৌলের বড় ছেলে যোনাথন হলেন সাহসী, স্বক্রিয় ও অনেক জনপ্রিয়, একজন অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিপূর্ণ রাজপুত্র (১ শমূয়েল ১৩-১৪)। যোনাথন বুঝতে পারেন যে, ঈশ্বর তার বাবা শৌলকে বিভিন্ন কারণে অগ্রাহ্য করেছেন, সঙ্গে তিনি শৌলের রাজবংশ, অর্থাৎ তাকে নিজেই অগ্রাহ্য করেছেন। যোনাথন যোগ্য ব্যক্তি হলেও তার বাবার ভুল ব্যবহারের কারণে রাজত্ব করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। অবশ্যই ঈশ্বরের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া তার জন্য সহজ ছিল না, কারণ অনেক ক্ষেত্রে তিনি দায়ূদের মত লোক, ঈশ্বরীয়, সাহসী, বিশ্বস্ত ও বাধ্য। যোনাথন রাজা হওয়ার দাবি ছেড়ে দিয়ে বরং দায়ূদের বন্ধু, সমর্থনকারী ও রক্ষক হয়ে যান। যদিও শৌলের তুলনায় যোনাথন বেশি বঞ্চিত হবেন যখন দায়ূদ সিংহাসনে বসবেন তবুও যোনাথন ঈশ্বরের ইচ্ছা মেনে নেন, এর চেয়ে বেশি তিনি তা মনেপ্রাণে আলিঙ্গন করেন।
পরবর্তী বছরগুলোতে যোনাথন বিশ্বস্তভাবে তার বাবা শৌলের সঙ্গে থাকেন, শৌলের রাজত্ব যত খারাপের দিকে যায় যোনাথন তত ন্যায্যতার ও ঈশ্বরীয় মানদণ্ডের পক্ষে দাঁড়িয়ে ভাল প্রভাব ফেলেন। শৌল দায়ূদকে তাড়িয়ে বেড়ালেও যোনাথন দায়ূদের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু, শক্তিশালী সমর্থনকারী এবং শিষ্যত্ব দানকারী হয়ে ওঠেন। যোনাথন দায়ূদকে ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্ষমতা না ধরার একটি আদর্শ মনোভাব দেখান এবং দায়ূদ তা শিখে পরবর্তীতে শৌলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন – সেই চমৎকার গল্প যেখানে দায়ূদ গুহাতে শৌলের বিরুদ্ধে হাত না তোলেন (১ শমূয়েল ২৪, ২৬)। যোনাথনের আহ্বান ছিল ‘পথ প্রস্তুত করা এবং আসল রাজাকে আসতে দেওয়া’ এবং তিনি এই ভূমিকা চমৎকারভাবে পূর্ণ করেন – ঠিক যেমন নতুন নিয়মে বাপ্তিস্মদাতা যোহন যীশুর প্রতি তেমন একটি ভূমিকা অতি চমৎকারভাবে পালন করেন।
বিপরীতে শৌল ক্ষমতা ছাড়তে রাজি নন। তিনি তার ছেলের মত ঈশ্বরের ইচ্ছা যখন বোঝেন তা মেনে নেন না, তিনি ধীরে ধীরে সম্মানের সঙ্গে রাজত্ব করার ক্ষমতা দায়ূদের কাছে হস্তান্তর করতে পারতেন, কিন্তু এর পরিবর্তে তিনি বিভিন্ন কৌশলে দায়ূদকে ফাঁদে ফেলতে চেষ্টা করেন। তার এই পরিকল্পনা যখন আর কার্যকারী হয় না তখন তিনি তাকে সরাসরি খুন করতে চেষ্টা করেন। এই প্রক্রিয়ায় শৌলের চরিত্র, মনোভাব ও আচরণ খারাপ থেকে আরো খারাপ হয়ে যায়: হিংসা, হীনমন্যতা, ভয়, যুক্তিবিহীন সিদ্ধান্ত, ক্ষমতা খাটানো, ভুল লোকদের পরামর্শ গ্রহণ, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা ও হিংস্রতা। চেতনার রব বা সুবিচারের চিন্তা তখনও তার কাছে আসত, কিন্তু তিনি নিজের মনকে সম্পূর্ণভাবে মন্দের হাতে ছেড়ে দেন – ক্ষমতা হস্তান্তর তো দূরের কথা। শেষে তিনি হতাশায় ভোগেন এবং একটি আশাহীন যুদ্ধে আঘাত পেয়ে আত্ম-হত্যা করেন এবং সঙ্গে তার দু’টি ছেলে ও যোনাথনকেও সর্বনাশে টেনে নিয়ে যান (১ শমূয়েল ৩১)।
পলাতক দায়ূদ
যখন শৌলের ব্যবহার জীবনের হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়, তখন দায়ূদ শৌলের কাছ থেকে পালিয়ে যান। শৌল তাকে অনেক বছর ধরে তাড়া করে বেড়ান এবং তিনি বার বার প্রায় শৌলের হাতে পড়েন। ইস্রায়েলের যত লোক বিভিন্ন কারণে অসন্তুষ্ট, শৌলের রাজত্বে কষ্ট পায় বা এমনি অপরাধী হয়, তারা কোনভাবে পলাতক দায়ূদের কাছে চলে আসে (১ বংশ ১২:১-২২)। দায়ূদ তাদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটান এবং তাদের একটি শক্তিশালী সৈন্যদলে পরিণত করেন। তিনি তাদের মধ্যে একতা, বিশ্বস্ততা ও ভক্তিপূর্ণ ভয় নিয়ে আসতে সক্ষম। তাদের সাথে বাস করার ও যুদ্ধক্ষেত্রে থাকাকালীন সময়ে দায়ূদ তার আদর্শ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তাদের গভীর বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন। শৌল যা কখনও করতে সক্ষম হন নি, দায়ূদ তা করতে পারেন: নীতি ও ন্যায্যতা রক্ষার জন্য দায়ূদ অত্যন্ত অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেন এবং তা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন (আবারও গুহার গল্প, ১ শমূয়েল ২৪,২৬)। তিনি তার অনুসরণকারীদের শিষ্যত্ব দেন যেন তারা প্রতিশোধ না নেয়, বিচার নিজের হাতে না করে এবং তাদের ক্ষমতা ভুলভাবে না খাটায়। গীতসংহিতার বেশ কয়েকটা গীতে প্রকাশ পায় যে, নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করা দ্বারাই দায়ূদকে ক্ষমাশীল, প্রতিশোধ না নেওয়া এবং ঈশ্বরের উপরে সব কিছু ছেড়ে দেওয়ার মনোভাবে আসতে হয়েছিল।
অবশেষে, দায়ূদ পলেষ্টীয়দের কাছে পালিয়ে গিয়ে তাদের মধ্যে বাস করে কিছুটা নিরাপত্তা উপভোগ করতে পারেন। কিন্তু তিনি প্রতারণার একটি জীবন করেন: তিনি সামনের দিকে পলেষ্টীয়দের খুশি করতে চেষ্টা করেন কিন্তু গোপনে ইস্রায়েলের সুবিধার পক্ষে কাজ করেন (১ শমূয়েল ২৭)। এক সময় তার কৌশল ভেঙ্গে যায় এবং বিপরীতে দায়ূদ ও তার সৈন্যদলের ক্ষতি হয়, এমন কি তার নিজের লোকেরা তার বিরুদ্ধে যাওয়ার হুমকি দেয়। এটিই হল দায়ূদের জীবনের সবচেয়ে নির্মম মুহূর্ত “কিন্তু দায়ূদ তাঁর ঈশ্বর সদাপ্রভুর উপর নির্ভর করে অন্তরে শক্তি পেলেন” (১ শমূয়েল ৩০:১-৬)। ঈশ্বরের সঙ্গে দায়ূদের একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল এবং এর উপর তিনি সংকটের সময়ে নির্ভর করতে পারতেন, ঈশ্বরের মঙ্গলময়তা নিয়ে তার এমন গভীর জ্ঞান ছিল যে, তিনি এই ধরণের চরম বিপদের সময়ে ঈশ্বরের কাছে গিয়ে শক্তি খুঁজে পেতেন।
যিহূদা ও ইস্রায়েলের উপরে দায়ূদের রাজত্ব
দায়ূদ কখ্নও নিজেকে রাজা হিসাবে বিস্তার করেন না বরং প্রথমে যিহূদা বংশের নেতারা তার কাছে এসে তাদের উপরে তাকে রাজত্ব করতে অনুরোধ করেন (২ শমূয়েল ১:১-৭)। তাই তিনি হিব্রোণ শহরে যিহূদা বংশের উপরে রাজত্ব করতে শুরু করেন। সেই একই সময়ে, অর্থাৎ শৌলের মৃত্যুর পরে ইস্রায়েলের প্রধান সেনাপতি ও শৌলের কাকা অবনের ঈশবোশত নামে শৌলের একজন ছেলেকে ইস্রায়েলের রাজা হিসাবে ঘোষণা করেন। ৭ বছর ধরে এভাবে দু’টি রাজ্য সমান্তরালভাবে চলে কিন্তু অবশেষে অবনের ঈশবোশতের উপর বিরক্ত হয়ে নিজেকে দায়ূদের কাছে সমর্পিত করেন। অবনের এবং ঈশবোশতকে যখন খুন করা হয় তখন ইস্রায়েলের বাকি বংশের নেতারা দায়ূদের কাছে এসে তাদের উপরও তাকে রাজত্ব করতে অনুরোধ করেন (২ শমূয়েল ৫:১-৫)। দায়ূদের প্রতি ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হয়, অর্থাৎ তিনি সম্পূর্ণ ইস্রায়েল জাতির উপরে রাজত্ব করেন এবং তা লোকদের ইচ্ছা অনুসারেই করেন (দ্বিতীয় বিবরণ ১:১৩-১৪)। দায়ূদ রাজত্ব করার ক্ষমতা দখল করেন নি বরং তিনি ঈশ্বরের সময় এবং জাতি রাজি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন – এর জন্যই তখন তার রাজ্যাবিষেকে “ইস্রায়েল দেশের লোকদের মনে আনন্দ ছিল” (১ বংশা ১২:৩৮-৪০)। অনেক অসম্মান ও কষ্টের পরে দায়ূদ উভয় যিহূদা ও ইস্রায়েলের উপরে একজন অতি প্রিয় রাজা হিসাবে রাজত্ব করেন।
একতার চিহ্ন
দায়ূদ যিরূশালেম শহর দখল করেন এবং তা তার রাজধানী হিসাবে পছন্দ করেন। যিরূশালেম শহর ছিল যিহূদা বংশ ও ইস্রায়েলের অন্য বংশের ঠিক মাঝখানে এবং সেই সময় পর্যন্ত কোনো বংশ শহরটি স্থায়ীভাবে দখল ও অধিকার করতে সক্ষম হয় নি। তাই দায়ূদ প্রজ্ঞার সাথে নিজের বংশ যিহূদাকে প্রাধান্য দেওয়ার চেয়ে এমন একটি শহর রাজধানী তৈরি করতে পছন্দ করেন যা উভয় বংশগুলোর মধ্যে একতা সৃষ্টি করে।
এছাড়া দায়ূদ নিয়ম-সিন্দুক যিরূশালেমে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। কিন্তু নিয়ম-সিন্দুক যিরূশালেমের নিয়ে আসার প্রথম প্রচেষ্টায় তিনি ব্যর্থ হন কারণ তিনি একটি সামরিক অভিযানের কৌশলের সাহায্যে তা সাধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার এই সামরিক অভিযানে যখন ঈশ্বর তাকে বাধা দেন তকন তিনি ঈশ্বরের উপরে বিরক্ত হন ও চমকে যান। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ঈশ্বরের আইন-কানুন পড়ে তার ভুল ব্যবহার বুঝতে পারেন। দ্বিতীয় বার তিনি পুরোহিতদের নিয়ম-সিন্দুক বহনকারী হিসাবে সঠিক ভূমিকা পালন করতে দেন এবং এভাবে সম্মান ও আনন্দের সঙ্গে নিয়ম-সিন্দুক যিরূশালেমে নিয়ে আসেন (২ শমূয়েল ৬)।
দায়ূদ রাজা হিসাবে যুদ্ধ চালানোর ক্ষেত্রে আগের মত সব সময় ঈশ্বরের উপর নির্ভর করেন এবং এভাবে পলেষ্টীয়দের বিরুদ্ধে দু’টি গুরত্বপূর্ণ যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেন (২ শমূয়েল ৫:১৭-২৫)। তিনি চারিদিকে সব জাতিগুলোর সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হন এবং এভাবে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় ইস্রায়েল দেশকে একটি বড় আকারে ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।
নিয়ম-সিন্দুকের জন্য একটি চমৎকার ঘর নির্মাণ করার পরিকল্পনায় ঈশ্বরের প্রতি দায়ূদের কৃতজ্ঞতা ও ভক্তি প্রকাশ পায়। যত বেশি তার ব্যক্তিগত ধন, পদ-মর্যাদা ও সম্মান বাড়ে তিনি নিশ্চিত করতে চান যে, ঈশ্বরের গৌরবও যেন তত বাড়ে: “দেখুন, আমি বাস করছি এরস কাঠের ঘরে আর ঈশ্বরের সিন্দুকটি রয়েছে তাম্বুতে” (২ শমূয়েল ৭:২)।
ঈশ্বর তাঁর সেই মনোভাবে সাড়া দিয়ে উল্টা দায়ূদকে একটি অতি চমৎকার ও সুদূরপ্রসারিত প্রতিজ্ঞা দেন “আমি সদাপ্রভু আরও বলছি যে, আমি নিজেই তোমার বংশকে গড়ে তুলব”। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, দায়ূদের একটি “ঘর”, একটি ছেলে, একটি রাজবংশ, এমন কি একটি চিরস্থায়ী রাজ্য থাকবে (২ শমূয়েল ৭:১১-১৭)।
যদিও ঈশ্বর বলেন যে, দায়ূদ নয় বরং তার একজন ছেলে ঈশ্বরের ঘর নির্মাণ করবেন তবুও ঈশ্বর তারই রাজবংশ স্থায়ীভাবে রাজত্ব করতে দেবেন, এমন কি চিরকাল পর্যন্ত রাজত্ব করতে দেবেন, এটি অত্যন্ত অদ্ভুত একটি প্রতিজ্ঞা। দায়ূদ অতি বিস্মিত হন এবং তিনি এই চমৎকার প্রতিজ্ঞায় নম্রতা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সাড়া দেন “হে প্রভু সদাপ্রভু, আমিই বা কি আর আমার বংশই বা কি যে, তুমি আমাকে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছ” (২ শমূয়েল ৭:১৮)।
দায়ূদের দুর্বলতাগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে
রাজতন্ত্র দ্বারা যে সমস্যাগুলো নিয়ে ঈশ্বর শমূয়েলের মাধ্যমে সাবধানবাণী দিয়েছিলেন সেগুলো এমন কি দায়ূদের মত একজন ঈশ্বরীয় রাজার জীবনে প্রকাশিত হতে শুরু করে এবং তা তার ছেলে, নাতী ও পরবর্তী প্রজন্মের রাজাদের জীবনেও আরো অনেক বেশি প্রকাশিত হয়:
দায়ূদ নতুন স্ত্রী গ্রহণ করতে থাকেন। বাইবেলে তার ৭জন স্ত্রীর নাম উল্লেখ করা আছে, আরো ৯জন স্ত্রীর নাম উল্লেখ নেই। পরবর্তীতে একটি ঘটনায় যখন দায়ূদ তার ছেলে অবশালোমের কাছ থেকে যিরূশালেম ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি সেখানে দশজন উপস্ত্রী রেখে যান। ঈশ্বর তার আইন-কানুনে রাজাদের ক্ষেত্রে বেশি স্ত্রী গ্রহণ নিষেধ করেছিলেন (দ্বিতীয় বিবরণ ১৭:১৭)। সম্ভবত এর কারণ হল অতিরিক্ত শারীরিক অভিলাস ও স্বনিয়ন্ত্রনের অভাব, কিন্তু আর একটি কারণ হল বেশি বেশি সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা। বেশি বেশি স্ত্রী ও সন্তান মানে যে, এই সন্তানেরা পারিবারিক জীবন বলতে কিছু পায় না, বাবার সাথে সময় পায় না, মায়েদের মাধ্যমে তারা শিষ্যত্ব পায় যারা বহুবিবাহের কারণে নিজের প্রয়োজনগুলো নিয়ে যুদ্ধ করে বা কৌশল দ্বারা তা অর্জন করে। অবাক লাগার বিষয় নয় যে, পরবর্তীতে দেখা যায় দায়ূদের ছেলেদের জীবনে বাবার ভূমিকা অনেক কম।
তাছাড়া বহুবিবাহ দায়ূদকে মহিলাদের সম্বন্ধে আরো ভাল দৃষ্টি দিয়েছে বা তাকে আরো সন্তুষ্ট করেছে, তা নয়। বরং যখন তিনি একটি সুন্দরী মহিলাকে দেখেন (ঊরিয়ের স্ত্রী বৎশেবা) তিনি তার সাথে ব্যভিচার করেন। ঊরিয় ছিলেন দায়ূদের ত্রিশজন বীরযোদ্ধাদের মধ্যে একজন, দায়ূদের একজন বিশ্বস্ত সহ-যোদ্ধা। দায়ূদ বৎশেবাকে শুধুমাত্র ‘একটি রাতের জন্য’ নিয়েছিলেন, তাকে নিয়ে দায়ূদের কোন ভবিষ্যৎ চিন্তা ছিল না। শুধুমাত্র যখন বৎশেবা গর্ভবতী হয়ে পড়ে তখন তিনি এই বিষয়ে গুরুত্ব দেন। তিনি বৎশেবার গর্ভাবস্থা লুকানোর জন্য তার স্বামী ঊরিয়কে যুদ্ধ থেকে আনান। কিন্তু ঊরিয় সততা ও অন্যদের প্রতি সমর্পণের কারণে তার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক রাখে না। কৌশল ব্যর্থ হয়েছে দেখে দায়ূদ শত্রুদের হাত দ্বারা যুদ্ধে ঊরিয়কে মেরে ফেলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন (২ শমূয়েল ১১)।
দায়ূদের ক্ষমতার এই গুরুতর ভুল ব্যবহার এবং বড় অপরাধ আলোতে আনার জন্য ঈশ্বর ভাববাদী নাথনকে পাঠান (২ শমূয়েল ১২)। দায়ূদ পাপ স্বীকার করেন, মনেপ্রাণে অনুতাপ করেন ও মন ফিরান (গীত ৫১)। তার ব্যভিচারের সন্তানটি মারা যায় কিন্তু দায়ূদ বিধবা বৎশেবাকে বিয়ে করেন এবং তার সঙ্গে ৪জন ছেলের বাবা হয়ে যান। তাদের চতুর্থতম ছেলের নাম হল শলোমন এবং ঈশ্বরের কথা অনুসারে তিনি ইস্রায়েলের পরবর্তী রাজা হন।
দায়ূদের আরো একটি দুর্বলতা হল যে, তিনি তার ছেলেদের শাসন করেন না। দায়ূদের পরিবার সম্বন্ধে যতটা গল্প শমূয়েল পুস্তকে পাওয়া যায়, একটাতেও দায়ূদ আদর্শ বাবা হিসাবে প্রকাশিত হন না, তিনি তার ছেলেদের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক, শিষ্যত্ব, শাসন ও ন্যায্যতার ক্ষেত্রে দুর্বল। তার বড় ছেলে অম্নোন নিজেকে কামনায় সমর্পিত করেন এবং তার সৎ-বোন তামরকে প্রথমে ধর্ষণ এবং পরে অগ্রাহ্য করেন (২ শমূয়েল ১৩:১-২২)। তার তৃতীয় ছেলে অর্থাৎ তামরের আপন ভাই অবশালোম ঘৃণা ও প্রতিশোধ নিতে নিজেকে সমর্পিত করেন (সম্ভবত দায়ূদ শাসন করেন না বলে)। ফলে অবশালোম তার সৎ-ভাই অম্নোনকে খুন করেন (২ শমূয়েল ১৩:২৩-৩৮) এবং পালিয়ে যান। কিন্তু পরবর্তীতে, যখন তাকে যিরূশালেমে ফিরিয়ে আনা হয়, তখনও দায়ূদ তার ছেলে অবশালোমের সাথে সম্পর্ক ঠিক করেন না। পরবর্তীতে অবশালোম গোপনে দায়ূদের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ চালান যার কারণে ইস্রায়েলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং অনেক লোকদের প্রাণ নষ্ট হয় (২ শমূয়েল ১৫-১৮)। দায়ূদের চতুর্থ ছেলে আদোনিয় শলোমনের রাজ-সিংহাসন দখল করতে চেষ্টা করেন (১ রাজা ১)। এই সব সমস্যাগুলো দায়ূদের বহুবিবাহের এবং দায়ূদের শাসনের অভাবের কারণেই সৃষ্টি হয়। দায়ূদ সমস্যাগুলো একবারও হাতে নেন না, ছেলেদের সাথে সমস্যা নিয়ে কথা বলেন না, তাদের শাসন বা বিচার করেন না, ভাল পথও দেখান না। হয়তো তিনি নিজেও যৌন ক্ষেত্রে ও হিংস্রতার ক্ষেত্রে পাপ করেন বলে (বৎশেবা ও ঊরিয়) তিনি শাসন করতে সাহস পান না অথবা মনে করেন যে, শাসন করার অধিকার তার নেই। কিন্তু ফলে আর অনেক ধ্বংসের বীজ বপন করা হয়।
তার প্রধান সেনাপতি যোয়াবকেও দায়ূদ শাসন করতে সক্ষম হন না। যোয়াব দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বীকে (আমাসা ও অবনের) মেরে ফেলেন কিন্তু দায়ূদ তার বিচার করেন না। তবুও যোয়াব দায়ূদের জন্য একজন অতি বিশ্বস্ত সমর্থনকারী ছিলেন এবং প্রয়োজনের সময়ে তিনি দায়ূদকে চ্যালেঞ্জও করেন (২ শমূয়েল ১৮-১৯)।
ভবিষ্যৎ উপাসনা-ঘরের স্থান
২ শমূয়েল পুস্তকের শেষের দিকে লেখক দু’টি কঠিন ঘটনা উল্লেখ করেন। একটি ঘটনায় তিনি দেখান যে, দায়ূদ কিভাবে একটি দুর্ভিক্ষের সময়ে ঈশ্বরকে অন্বেষণ করেন। দুর্ভিক্ষের কারণ হল যিহোশূয়ের সময়ে গিবিয়োনীয়দের সাথে তার করা একটি শান্তির চুক্তি, যা শৌল পরবর্তীতে ভেঙ্গে দেন যখন তিনি গিবিয়োনীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন (২ শমূয়েল ২১:১-৩, যিহোশূয় ৯)। দায়ূদ বিষয়টি সমাধান করার জন্য গিবিয়োনীয়দের জিজ্ঞাসা করেন অপরাধটির প্রায়শ্চিত্তের জন্য তারা কি দাবি করে। তাদের অনেক লোক শৌলের হাতে মারা যাওয়ার পরেও তারা একটি সীমিত দাবি রাখে: তারা শৌল পরিবারের ৭জনের মৃত্যু চায়। দায়ূদ তাদের দাবি রক্ষা করেন এবং ফলে দুর্ভিক্ষ থেমে যায় (২ শমূয়েল ২১:১-১৪)।
লেখক দ্বিতীয় ঘটনা বর্ণনা করেন যে, সম্ভবত অহংকার বা দমনের চিন্তার ফলে কিভাবে দায়ূদ একটি সামরিক লোকসংখ্যা গণনা করেন। এর ফলাফলস্বরূপ ঈশ্বর ইস্রায়েলে একটি মহামারী পাঠান। যিরূশালেমের একটু বাইরে অরৌণা নামে একজন যিবূষীয়ের খামারে, অর্থাৎ শস্যের আছড়ানর জায়গায় যখন ধ্বংসকারী স্বর্গদূত উপস্থিত হন দায়ূদ তাকে দেখতে পান। ঈশ্বরের আদেশ অনুসারে দায়ূদ সেখানে একটি বেদী স্থাপন করেন এবং উৎসর্গ দান করেন। ফলে মহামারী থেমে যায় (২ শমূয়েল ২৪)। দায়ূদ সেই স্থানটি কিনে ফেলেন এবং পরবর্তীতে ঠিক সেখানে শলোমন ঈশ্বরের আবাস-তাম্বু নির্মাণ করেন।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।