ভাববাদী সফনিয় ঘোষণা করেন যে, ‘সদাপ্রভুর দিন’ আসবে। সদাপ্রভুর দিনে ঘটবে ঈশ্বরের সুদূরপ্রসারী ও ভয়ংকর শেষ বিচার – কিন্তু নম্রদের জন্য থাকবে ঈশ্বরের উদ্ধার, যেন তারা তাঁর সঙ্গে একটি চমৎকার ও উচ্ছ্বাসিত প্রেমের সম্পর্কে যুক্ত হয়।
সফনিয় হলেন একমাত্র ভাববাদী যিনি রাজা দায়ূদের বংশধর (সফনিয ১:১)। রাজা যোশিয় (৬৪০-৬০৯ খ্রীষ্টঃপূঃ), যিনি যিহূদার শেষ রাজাদের মধ্যে একমাত্র ঈশ্বর ভক্ত রাজা, তার রাজত্বের সময়ে ভাববাদী সফনিয় বাণী দেন। যোশিয়ের আগের রাজা মনঃশি ও রাজা আমোন, তারা যিহূদা জাতিকে গভীর দেবতাপূজা, ব্যাপক অনৈতিকতা ও সামাজিক অন্যায়ের দিকে ধাবিত করেছিলেন (সফনিয় ৩:১-৫)। কিন্তু রাজা যোশিয়, যিনি খুব অল্প বয়সে রাজত্ব করতে শুরু করেন এবং মনেপ্রাণে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিপূর্ণ ভয়ে চলেন, তিনি তার পিতামহ মনঃশি এবং তার বাবা আমোন দ্বারা আনা ক্ষতি কমাতে অত্যন্ত চেষ্টা করেন। ভাববাদী সফনিয় ও যিরমিয় যোশিয়কে সমর্থন করেন কিন্তু তারা বুঝতে পারেন যে, অনেক লোকেরা মাত্র অর্ধেক হৃদয়ে বাধ্য হচ্ছে। লোকদের মধ্যে বাহ্যিক বা নকল ধার্মিকতা সমস্যা হয়ে দেখা দেয় (সফনিয় ১:১৫, যির ৭:৮-১৫)।
এই নকল ধার্মিকতাকে ঝাঁকি দিয়ে সফনিয় ঘোষণা করেন যে, “সদাপ্রভুর দিন” হবে একটি ভয়ংকর ও ব্যাপক বিচারের দিন। ঈশ্বরের বিচার আসবে যিহূদার উপর, চারিদিকের দেশগুলো, হিংস্র ও দমনকারী আসিরিয়া এবং সারা পৃথিবীর উপর (সফনিয় ১:১-১৮, ২:৮-১৫)। তিনি যিহূদাকে সাবধান করেন “হে লজ্জাহীন জাতি… সেই দিন তুষের মত উড়ে আসছে; সেইজন্য নির্দিষ্ট সময় আসবার আগে, সদাপ্রভুর জ্বলন্ত ক্রোধ তোমাদের উপরে আসবার আগে, তাঁর ভীষণ অসন্তোষ তোমাদের উপরে পড়বার আগে তোমরা একসংগে জড়ো হও” (সফনিয় ২:১-২)। যেমন ঈশ্বরের সব বিচারবাণী, এই বাণীও প্রকৃতপক্ষে হল অনুতপ্ত হওয়ার একটি ডাক ও সুযোগ: “হে দেশের সব নম্র লোকেরা, তোমরা যারা সদাপ্রভুর আদেশমত কাজ কর, তোমরা তাঁর ইচ্ছামত ন্যায়ভাবে ও নম্রভাবে চল; তাহলে সদাপ্রভুর ক্রোধের দিনে হয়তো তোমরা আশ্রয় পাবে” (সফনিয় ২:৩)। “ক্রোধের দিনে আশ্রয় পাবে”, এই শব্দগুলো আরো আক্ষরিকভাবে অনুবাদ করা যায়: “ক্রোধের দিন লুকিয়ে থাকবে”। সফনিয় নামের অর্থ ‘ঈশ্বর তাকে লুকিয়ে রেখেছেন’। তাই সফনিয় এখানে নম্র লোকদের অনুতপ্ত হতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য নিজের নাম রূপকভাবে ব্যবহার করেন।
সফনিয় রাজা দায়ূদের বংশের একজন। ভাল রাজা হিষ্কিয় ছিলেন সফনিয়ের পিতামহের বাবা, সেই অতি খারাপ রাজা মনঃশি ছিলেন সফনিয়ের পিতামহের ভাই এবং সেই মন্দ রাজা আমোন ছিলেন তার বাবার কাকাত ভাই (সফনিয় ১:১)। তাই সফনিয় যথেষ্ট ভালভাবে জানেন রাজনৈতিক উঁচু শ্রেণীর লোকেরা কত দুর্নীতিগ্রস্ত। তার উঁচু শ্রেণীর আত্মীয়দের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য সফনিয় কোনো ভদ্র বা কোমল কথা বলেন না, বরং তিনি তাদের মন্দতা সবার সামনে সরাসরিভাবে প্রকাশ করেন: “ধিক্ সেই অত্যাচারী, বিদ্রোহী ও অশুচি শহরকে!… তার রাজকর্মচারীরা যেন গর্জনকারী সিংহ আর শাসনকর্তারা সন্ধ্যাবেলার নেকড়ে বাঘ; তারা সকালের জন্য কিছুই ফেলে রাখে না” (সফনিয় ৩:১-৩)। দুঃখের বিষয় যে, আত্মিক নেতারাও ঠিক রাজনৈতিক নেতাদের মত দুর্নীতিগ্রস্ত: “তার নবীরা হঠকারী ও বিশ্বাসঘাতক। তার পুরোহিতেরা পবিত্রকে অপবিত্র করে এবং আইন-কানুনের বিরুদ্ধে কাজ করে। … কিন্তু অন্যায়কারীদের লজ্জা নেই” (সফনিয় ৩:৪-৫)। সফনিয়ের সমসাময়িক ভাববাদী যিরমিয় দেশের নেতাদের বিষয়ে ঠিক একই রকম কথা বলেন (যির ৯:৪, ২০:১-২)।
সফনিয় ভয়ংকর বিচারবাণী ঘোষণা করেন: কর্মচারীদের উপর, পুরোহিত ও ভাববাদীদের উপর (সফনিয় ৩:১-৫), দেবতাপূজারীদের, মিশানো ধর্মের ও ঈশ্বর থেকে সরে যাওয়া লোকদের উপর (সফনিয় ১:৪-৬), একগুঁয়ে ও অনিচ্ছুকদের উপর (সফনিয় ৩:২), যিহূদা ও চারিদিকের দেশগুলোর উপর (সফনিয় ২:৫-১৫), দমনকারী আসিরিয়া সাম্রাজ্যের উপর (সফনিয় ২:১৩) এবং সমস্ত পৃথিবীর উপর (সফনিয় ১:১-৩) ঈশ্বরের বিচার অবশ্যই আসবে। পুস্তকের প্রথম পদগুলোতে (সফনিয় ১:২-৩) সফনিয় পৃথিবীর উপর ঈশ্বরের সার্বিক বিচারের বর্ণনা করেন, আদিপুস্তকে সৃষ্টির গল্পের বিপরীতমুখী পরিবর্তনের ভয়ংকর বর্ণনা। ঈশ্বরের মানদণ্ড সব সময় একই: মন্দ কাজ, অন্যায়, লোভ ও অনুতাপ প্রত্যাখ্যানের ফলে আসবে বিচার।
এই অন্ধকার ছবির অপর পক্ষে সফনিয় একটি অবিশ্বাস্য ও চমৎকার পুনরুদ্ধারও ঘোষণা করেন, এমন আশ্চর্য কিছু যার অংশ পাওয়ার জন্য কেউ যোগ্য নয়। যারা নম্র ও যারা ঈশ্বরকে অন্বেষণ করে, তারা ঈশ্বরের ক্রোধের দিনে রক্ষা (সফনিয় ২:৩) এবং ক্ষমা পাবে: “সদাপ্রভু তোমার শাস্তি দূর করে দিয়েছেন” (সফনিয় ৩:১৫)। “যারা সদাপ্রভুর উপর নির্ভর করে সেই রকম নত ও নম্র লোকদের আমি তোমার মধ্যে বাকী রাখব। ইস্রায়েলের সেই বাকী লোকেরা অন্যায় করবে না; তারা মিথ্যা কথা বলবে না এবং তাদের মুখে ছলনা থাকবে না। তারা খেয়ে নিরাপদে ঘুমাবে, কেউ তাদের ভয় দেখাবে না” (সফনিয় ২:১২-১৩)। তাদেরকেই ঈশ্বরের সঙ্গে একটি ঘনিষ্ট ও উচ্ছ্বাসিত সম্পর্কে আনা হবে “সেই দিন তোমাকে বলা হবে, “হে সিয়োন, তুমি ভয় কোরো না, তুমি নিরাশ হোয়ো না। তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু তোমার মধ্যে আছেন, তাঁর রক্ষা করবার শক্তি আছে। তিনি তোমার বিষয় নিয়ে খুব আনন্দিত হবেন, আর তাঁর গভীর ভালবাসার তৃপ্তিতে তিনি নীরব হবেন। তিনি তোমার বিষয় নিয়ে আনন্দ-গান করবেন” (সফনিয় ৩:১৬-১৭)। সফনিয়ের এই অতি সুন্দর ভবিষ্যদ্বাণী এখানে মশীহ সম্বন্ধীয় বাণী হয়ে যায়, কারণ শুধুমাত্র যীশুতে সেই ক্ষমা, পরিবর্তন ও ঈশ্বরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সম্ভব।
কিন্তু ঈশ্বর তাঁর পুনরুদ্ধার আরো ব্যাপকভাবে বিস্তার করবেন: “তাদের লজ্জার বদলে আমি তাদের সারা পৃথিবীতে প্রশংসা ও গৌরব দান করব… আমি যখন তোমাদের অবস্থা ফিরাব তখন পৃথিবীর সমস্ত জাতির মধ্যে আমি তোমাদের সম্মান ও গৌরবের পাত্র করব” (সফনিয় ৩:১৯-২০)। যিহূদার সেই অদ্ভূত পুনরুদ্ধারের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং অন্যেরা তা দেখতে পাবে। তিনি আর একটি ভবিষ্যদ্বাণী দেন: “তারপর আমি জাতিদের মুখ শুচি করব যাতে তারা সবাই আমার উপাসনা করতে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমার সেবা করতে পারে” (সফনিয় ৩:৯)। ঈশ্বরের সেই পরিবর্তনকারী ক্ষমতা শুধুমাত্র যিহূদার জন্য কাজ করবে তা নয়, বরং তাঁর ক্ষমতা প্রত্যেকটি জাতিকে পরিবর্তন করবে, যতজন নম্র ও ঈশ্বরের উপাসনা করতে আগ্রহী।
সফনিয় পুস্তকে বাইবেলের সবচেয়ে ভয়ংকর ও ব্যাপক ধ্বংসবাণী পাওয়া যায়, একই সাথে পাওয়া যায় মশীহের চমৎকার একটি দর্শন: তিনি সবার জন্য নিয়ে আসবেন সুদূরপ্রসারী পরিত্রাণ, পরিবর্তন ও পুনরুদ্ধার।
লেখক সফনিয় এবং পুস্তকের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
সফনিয় হলেন একমাত্র ভাববাদী যিনি রাজা দায়ূদের বংশধর (সফনিয ১:১)। ভাল রাজা হিষ্কিয় ছিলেন সফনিয়ের পিতামহের বাবা, সেই অতি খারাপ রাজা মনঃশি ছিলেন সফনিয়ের পিতামহের ভাই এবং সেই মন্দ রাজা আমোন ছিলেন তার বাবার কাকাত ভাই। সফনিয় রাজা যোশিয়ের রাজত্বের সময়ে, অর্থাৎ ৬৪০-৬০৯ খ্রীষ্টঃপূঃ পরিচর্যা করেন। যোশিয় যিহূদার শেষ রাজাদের মধ্যে একমাত্র ঈশ্বর ভক্ত রাজা। সফনিয় নামের অর্থ ‘সদাপ্রভু তাকে লুকিয়ে রেখেছেন’। বাইবেলের অন্যান্য পুস্তকে সফনিয়ের নাম উল্লেখ নেই এবং তিনি নিজের পুস্তকেও নিজের জীবন সম্বন্ধে কোন তথ্য দেন না। তাই তার বাণী ছাড়া তার সম্বন্ধে বেশি কিছু জানা যায় না।
যোশিয়ের আগের রাজা মনঃশি (৬৮৬-৬৪২ খ্রীঃপূঃ) ও রাজা আমোন (৬৪২-৬৪০ খ্রীঃপূঃ), তারা যিহূদা জাতিকে গভীর দেবতাপূজা, ব্যাপক অনৈতিকতা ও সামাজিক অন্যায়ের দিকে ধাবিত করেছিলেন (সফনিয় ৩:১-৫)। বিশেষভাবে মনঃশি, যিনি অনেক বছর ধরে রাজত্ব করেন তিনি নিজেকে এমন গভীর দেবতাপূজায় সমর্পিত করেন যে, তার আগে কোন রাজা তার মত করেন নি। তার বাবা হিষ্কিয় যে পূজার উঁচু স্থানগুলো ধ্বংস করেছিলেন, মনঃশি সেগুলো পুনরায় তৈরি করেন, সাথে আশেরা-খুঁটি ও নানা বেদী তৈরি করেন, আকাশের তারাদের পূজা করেন এবং এমন কি সদাপ্রভুর উপাসনা-ঘরেও প্রতিমা পূজার বেদী স্থাপন করেন। তিনি নিজের ছেলেকে আগুনে পড়িয়ে উৎসর্গ করেন, মায়াবিদ্যা ব্যবহার করেন, লক্ষণ দেখে ভবিষ্যতের কথা বলেন এবং ভূতের মাধ্যম ব্যবহার করেন (২ রাজা ২১:১-৯)।
গভীর দেবতাপূজার সাথে আসে ব্যাপক অনৈতিকতা ও সামাজিক অন্যায়: “এছাড়া মনঃশি এত নির্দোষ লোকদের রক্তপাত করেছিলেন যে, সেই রক্তে যিরূশালেমের এক সীমা থেকে অন্য সীমা পর্যন্ত পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তিনি যিহূদার লোকদের দিয়ে পাপ করিয়েছিলেন যার ফলে তারা সদাপ্রভুর চোখে যা মন্দ তা-ই করেছিল” (২ রাজা ২১:১৬)। সফনিয় তা এভাবে বর্ণনা করেন “ধিক্ সেই অত্যাচারী, বিদ্রোহী ও অশুচি শহরকে! সে কাউকে মানে না, শাসনও গ্রাহ্য করে না। সদাপ্রভুর উপর সে নির্ভর করে না, তার ঈশ্বরের কাছে যায় না। তার রাজকর্মচারীরা যেন গর্জনকারী সিংহ আর শাসনকর্তারা সন্ধ্যাবেলার নেকড়ে বাঘ; তারা সকালের জন্য কিছুই ফেলে রাখে না। তার নবীরা হঠকারী ও বিশ্বাসঘাতক। তার পুরোহিতেরা পবিত্রকে অপবিত্র করে এবং আইন-কানুনের বিরুদ্ধে কাজ করে” (সফনিয় ৩:১-৪)।
কিন্তু রাজা যোশিয়, যিনি খুব অল্প বয়সে রাজত্ব করতে শুরু করেন এবং মনেপ্রাণে ঈশ্বরের ভক্তিপূর্ণ ভয়ে চলেন, তিনি তার পিতামহ মনঃশি ও তার বাবা আমোন দ্বারা আনা ক্ষতি কমাতে অত্যন্ত চেষ্টা করেন। যোশিয়ের বয়স যখন মাত্র ৮ বছর তখন তিনি রাজা হয়ে সিংহাসনে বসেন (৬৪০ খ্রীঃপূঃ)। তার বয়স যখন ১৬ বছর যখন তিনি ঈশ্বরকে অন্বেষণ করতে শুরু করেন (৬৩২ খ্রীঃপূঃ)। তার বয়স যখন ২০ বছর তখন তিনি পুনঃসংস্কার শুরু করেন (৬২৮ খ্রীঃপূঃ, ২ বংশা ৩৪:১-৩)। তার পিতামহ মনঃশি মনেপ্রাণে নিজেকে দেবতাপূজায় সমর্পিত করেছিলেন, কিন্তু যোশিয় নিজেকে মনেপ্রাণে ঈশ্বের কাছে সমর্পিত করেন এবং যিহূদা থেকে দেবতাপূজা নির্মূল করতে চেষ্টা করেন। তিনি উপাসনা-ঘর থেকে সমস্ত প্রতিমার মূর্তি ও বেদী দূর করেন, পূজার পুরোহিতদের তাড়িয়ে দেন, পূজার উঁচু স্থানগুলো, আশেরা-খুঁটি, আকশের তারাদের পূজা, মোলক বা মিলকম ও কমোশ দেবের পূজা, মন্দিরে পুরুষ বেশ্যা ও তোফেৎ (যেখানে মোলক দেবের উদ্দেশ্যে শিশুদের আগুনে পুড়িয়ে উৎসর্গ করা হত), এসব ধ্বংস করেন। তিনি যিরূশালেম ও যিহূদার সব এলাকা এবং এমন কি আগে যা বিন্যামিন, ইফ্রায়িম ও পশ্চিম মনঃশি গোষ্ঠির এলাকা ছিল, সেখানেও সব দেবতাপূজা নির্মূল করতে চেষ্টা করেন (২ রাজা ২৩:৪-২০)।
ভাববাদী সফনিয় ও যিরমিয় যোশিয়কে সমর্থন করেন কিন্তু তারা বুঝতে পারেন যে, যদিও রাজা মনেপ্রাণে ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারে এগিয়ে যাচ্ছেন তবুও অনেক লোক মাত্র অর্ধেক হৃদয়ে বাধ্য হচ্ছে। রাজা যোশিয় যিরূশালেম উপাসনা-ঘরে সদাপ্রভুর আরাধনা পুনরায় স্থাপন করেন এবং মোশির আইন-কানুন অনুসারে পর্বগুলো আবার শুরু করেন। তিনি সবাইকে অংশ গ্রহণ করার আদেশ দেন। অনেকে সাড়া দেয়, কিন্তু আবারও অনেকে তা চাপের কারণে বা সুযোগ-সুবিধা না হারানোর জন্য করে। এভাবে লোকদের মধ্যে বাহ্যিক বা নকল ধার্মিকতা প্রচলিত হয়ে যায়। মিশানো ধর্মও দেখা যায়, লোকেরা সদাপ্রভুর আরাধনাও করে, একই সাথে দেবতাপূজাও করে (সফনিয় ১:১৫, যির ৭:৮-১৫)।
সফনিয় ভয়ংকর “সদাপ্রভুর দিন” ঘোষণা করেন
এই ধরণের অর্ধেক হৃদয়ের আরাধনা, নকল ধার্মিকতা বা মিশানো ধর্মকে ঝাঁকি দেওয়ার জন্য সফনিয় ঘোষণা করেন যে, “সদাপ্রভুর দিন” হবে একটি ভয়ংকর ও ব্যাপক বিচারের দিন। কার উপরে ঈশ্বরের বিচার আসবে?
- যিরূশালেমের উপর সফনিয় ১:১০-১৩ বিশেষভাবে রাজকর্মচারী, বিচারক, ভাববাদী, পুরোহিত
- যিহূদার উপর সফনিয় ১:৪-৬, ২:১-২
- চারিদিকের দেশগুলোর উপর সফনিয় ২:৫-১২ পলেষ্টীয়দের শহরগুলো, মোয়াব, অম্মোন, সমুদ্রের ধারে বাসকারী, কূশ
- আসিরিয়ার উপর সফনিয় ২:১৩-১৫ হিংস্র, দমনকারী ও ভয়ংকর সাম্রাজ্য
- সম্পূর্ণ পৃথিবীর উপর সফনিয় ১:২-৩, ১:১৮
প্রকৃতপক্ষে “সদাপ্রভুর দিন” হবে সেই দিন যখন ঈশ্বর সমস্ত পাপ, অন্যায় ও মন্দতার বিচার করবেন (সফনিয় ১:১৭)। সফনিয় এই দিনের বর্ণনায় বলেন: “মহা দিন … তাড়াতাড়ি আসছে … তখন যোদ্ধারা যন্ত্রণায় চিৎকার করবে … ক্রোধের দিন, দারুণ দুর্দশা ও মনের কষ্টের দিন, বিপদ ও ধ্বংসের দিন, গাঢ় অন্ধকারের দিন, মেঘ ও ঘন কালোর দিন … শিংগার আওয়াজ ও যুদ্ধের হাঁকের দিন” (সফনিয় ১:১৪-১৮)। সফিনিয় ভয়ংকর ভাষা ব্যবহার করেন, বিশেষভাবে যখন তিনি সমস্ত পৃথিবীর উপরে ঈশ্বরের বিচারের বর্ণনা করেন: “সদাপ্রভু বলছেন, “আমি পৃথিবীর বুক থেকে সব কিছুই শেষ করে দেব। মানুষ ও পশু, আকাশের পাখী ও সাগরের মাছ আমি শেষ করে দেব। আমি দুষ্টদের পতন ঘটাব। পৃথিবীর উপর থেকে আমি মানুষকে ধ্বংস করে দেব” (সফনিয় ১:২-৩)। সফনিয়ের এই ধ্বংসবাণী হল আদিপুস্তকে সৃষ্টির গল্পের বিপরীতমুখী পরিবর্তনের ভয়ংকর বর্ণনা।
এই ভয়ংকর বিচারবাণী দ্বারা তিনি যিহূদার অর্ধেক হৃদয়ে, নকলভাবে ধার্মিক ও আত্ম-বিশ্বাসে পূর্ণ লোকদের ঝাঁকি দেন: “হে লজ্জাহীন জাতি… সেই দিন তুষের মত উড়ে আসছে; সেইজন্য নির্দিষ্ট সময় আসবার আগে, সদাপ্রভুর জ্বলন্ত ক্রোধ তোমাদের উপরে আসবার আগে, তাঁর ভীষণ অসন্তোষ তোমাদের উপরে পড়বার আগে তোমরা একসংগে জড়ো হও” (সফনিয় ২:১-২)। যেমন ঈশ্বরের সব বিচারবাণী, এই বাণীও প্রকৃতপক্ষে হল অনুতপ্ত হওয়ার একটি ডাক ও সুযোগ: “হে দেশের সব নম্র লোকেরা, তোমরা যারা সদাপ্রভুর আদেশমত কাজ কর, তোমরা তাঁর ইচ্ছামত ন্যায়ভাবে ও নম্রভাবে চল; তাহলে সদাপ্রভুর ক্রোধের দিনে হয়তো তোমরা আশ্রয় পাবে” (সফনিয় ২:৩)। “ক্রোধের দিনে আশ্রয় পাবে”, এই শব্দগুলো আরো আক্ষরিকভাবে অনুবাদ করা যায়: “ক্রোধের দিন লুকিয়ে থাকবে”। সফনিয় নামের অর্থ ‘ঈশ্বর তাকে লুকিয়ে রেখেছেন’। তাই সফনিয় এখানে নম্র লোকদের অনুতপ্ত হতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য নিজের নাম রূপকভাবে ব্যবহার করেন, যেন তারা ঈশ্বরের ক্রোধের দিনে প্রকৃতপক্ষে লুকিয়ে থাকতে পারে।
বিচারের কারণ
সফনিয় রাজা দায়ূদের বংশের একজন। ভাল রাজা হিষ্কিয় ছিলেন সফনিয়ের পিতামহের বাবা, সেই অতি খারাপ রাজা মনঃশি ছিলেন সফনিয়ের পিতামহের ভাই এবং মন্দ রাজা আমোন ছিলেন তার বাবার কাকাত ভাই (সফনিয় ১:১)। তাই সফনিয় যথেষ্ট ভালভাবে জানেন রাজনৈতিক উঁচু শ্রেণীর লোকেরা কত দুর্নীতিগ্রস্ত। হয়তো সফনিয় তার উঁচু শ্রেণীর আত্মীয়দের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেতে পারতেন কিন্তু তিনি তা না করে বরং তাদের মন্দতা সবার সামনে সরাসরিভাবে প্রকাশ করেন: ”ধিক্ সেই অত্যাচারী, বিদ্রোহী ও অশুচি শহরকে!… তার রাজকর্মচারীরা যেন গর্জনকারী সিংহ আর শাসনকর্তারা সন্ধ্যাবেলার নেকড়ে বাঘ; তারা সকালের জন্য কিছুই ফেলে রাখে না” (সফনিয় ৩:১-৩)। সবার সামনে নিজের পরিবারের ও প্রভাবশালীদের দোষ ধরে এই অত্যন্ত অপ্রিয় বাণী দেওয়ার জন্য সফনিয়ের অবশ্যই অনেক সাহস প্রয়োজন হয়েছিল।
দুঃখের বিষয় যে, যিরূশালেমের আত্মিক নেতারাও ঠিক রাজনৈতিক নেতাদের মত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তারা কি রাজা মনঃশি ও আমোনের সময় থেকে নেতৃত্বে আছেন, না কি যোশিয়ের পুনঃসংস্কারের পরে সুযোগ-সুবিধা ধরে নেতৃত্বে এসেছিলেন, তা জানা যায় না। কিন্তু পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, তারা যোশিয়, সফনিয় বা যিরমিয়ের মত লোক নন: “তার (যিরূশালেমের) নবীরা হঠকারী ও বিশ্বাসঘাতক। তার পুরোহিতেরা পবিত্রকে অপবিত্র করে এবং আইন-কানুনের বিরুদ্ধে কাজ করে। তার মধ্যে বাসকারী সদাপ্রভু ন্যায়বান; তিনি কোন অন্যায় করেন না। প্রতিদিন সকালে তিনি ন্যায়বিচার করেন; তা করতে তিনি ভুল করেন না। কিন্তু অন্যায়কারীদের লজ্জা নেই” (সফনিয় ৩:৪-৫)। সফনিয়ের সমসাময়িক ভাববাদী যিরমিয় দেশের নেতাদের বিষয়ে ঠিক একই রকম কথা বলেন (যিরমিয় ৯:৪, ২০:১-২)।
রাজনৈতিক ও আত্মিক নেতাদের পাশাপাশি সফনিয় যিহূদার ও যিরূশালেমে বসবাসকারী, অর্থাৎ সাধারণ লোকদেরও দোষ ধরেন: তারা মন্দ (সফনিয় ১:৩), তারা এখনও সদাপ্রভুর চেয়ে বাল দেবতার ও আকাশের তারাদের পূজা করে (সফনিয় ১:৪-৫), তারা ঈশ্বরের বাধ্য হয় না, তাঁর ইচ্ছা জানতেও চায় না (সফ ১:৬)। যিরূশালেমের এই লোকেরা নিজেদেরকে নিয়ে সন্তুষ্ট এবং বলে যে “সদাপ্রভু ভাল-মন্দ কিছুই করবেন না” (সফ ১:১২), তারা ব্যবসায়ী (সফ ১:১১), তারা ধনী (সফনিয় ১:১৩,১৮), তাদের লজ্জা নেই (সফনিয় ২:১), তারা সেই “অত্যাচারী, বিদ্রোহী, অশুচি শহর” (সফ ৩:১), তারা “কাউকে মানে না, শাসনও গ্রাহ্য করে না। সদাপ্রভুর উপর … নির্ভর করে না … ঈশ্বরের কাছে যায় না” (সফনিয় ৩:২) এবং তারা “আগ্রহের সঙ্গে খারাপ কাজ করতে থাকে” (সফনিয় ৩:৭)। এই বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, অনেক লোক যোশিয়ের পুনঃসংস্কারে মনোযোগ ও গুরুত্ব দেয় নি, তার মত মনেপ্রাণে সাড়াও দেয় নি।
বিভিন্ন জাতি সম্বন্ধীয় বিচার বাণী ও তার পূর্ণতা
সফনিয় বেশ কিছু জাতি সম্বন্ধে বিচারবাণী ঘোষণা করেন। নিচের তালিকায় সেগুলো দেওয়া আছে এবং ইতিহাসে তা কিভাবে পূর্ণ হয়েছে, তার তথ্যও দেওয়া আছে:
ভবিষ্যদ্বাণী | পদ | কতটি পদ | পূর্ণতা | |
যিহূদা ধ্বংস হবে | সফ ১:২–২৮, ২:১–৩, ৩:১, ৩:৭ | ২২টি | ৫৮৬ খ্রীঃপূঃ | বাবিল দ্বারা পূর্ণ |
ঘসা বা গাজা জনশূণ্য হবে | সফ ২:৪ | ১টি | ৬০৫ খ্রীঃপূঃ | কর্কমিশ থেকে ফেরার পথে মিসরের ফরৌণ নখো দ্বারা পূর্ণ |
অস্কিলোন, ইক্রোণ, পলেষ্টীয়াকে লুট করা হবে | সফ ২:৪ | ১টি | ১৪৬ খ্রীঃপূঃ | মাক্কাবীয় যোনাথন দ্বারা শহরগুলো পুড়ানো ও লুট করা হয় |
আসদোদকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে | সফ ২:৪ | ১টি | মিসরীয় ফরৌণ প্সামটিক ১ (৬৬৩–৬০৯ খ্রীঃপূঃ) ২৯ বছর ধরে ঘেরাওয়ের পরে আসদোদকে দখল করেন। | |
মোয়াব সদোমের মত হবে | সফ ২:৯ | ১টি | ৫৮২–৮১ খ্রীঃপূঃ | বাবিলের রাজা নবূখদনিৎসর দ্বারা পূর্ণ। |
অম্মোন ঘমোরার মত হবে | সফ ২:৯ | ১টি | ১৬৪ খ্রীঃপূঃ | মাক্কাবীয় যোহন হুর্কানাস যর্দনের পূর্বের এলাকা তার অধীনে আনেন। |
কূশীয়েরা তলোয়ার দিয়ে মারা পড়বে | সফ ২:১২ | ১টি | ৫২৫ খ্রীঃপূঃ | পারস্য রাজা কাম্বিস্ মিসরকে দখল করেন। |
নীনবী ও আসিরিয়াকে ধ্বংস | সফ ২:১৩–১৫ | তটি | ৬১২ খ্রীঃপূঃ ৬০৫ খ্রীঃপূঃ | বাবিল দ্বারা নীনবীকে দখল ও ধ্বংস (ধ্বংসাবশেষের গিরি মাত্র থেকে যায়)। বাবিল দ্বারা আসিরিয়াকে পরাজিত। |
সফনিয়ের বিচারবাণীর মধ্যে বিষেশভাবে আসিরিয়ার ধ্বংসবাণী লক্ষণীয়। আবিরিয়া শতাব্দী পর শতাব্দীর ধরে ছিল সেই বিশাল, হিংস্র ও দমনকারী সাম্রাজ্য যার বিরুদ্ধেবিদ্রোহী হয়ে কেউ সফল হতে পারে নি। সম্ভবত যোশিয়ের পুনঃসংস্কারের সময়ে, অর্থাৎ ৬২৮ খ্রীষ্টপূর্বে সফনিয় এই অতি সাহসী ধ্বংসবাণী ঘোষণা করেন, এমন একটি সময়ে যখন আসিরিয়া তখনও ছিল ভয়ংকর ও অজেয়। কিন্তু ৬২৭ খ্রীষ্টপূর্বে আসিরিয়ার শেষ শক্তিশালী রাজা অশূর-বনিপল মারা যান এবং আসিরিয়া দুর্বল হতে শুরু করে। ৬২৬ খ্রীষ্টপূর্বে আসিরিয়ার একটি প্রদেশ, অর্থাৎ বাবিল তার নতুন শাসক নাবোপলাসরের নেতৃত্বে আসিরিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং স্বনির্ভর হতে সক্ষম হয়। ৬১২ খ্রীষ্টপূর্বে নাবোপলাসর একটি জোট বেঁধে আসিরিয়ার রাজধানী নীনবীকে দখল ও ধ্বংস করেন। ৬০৫ খ্রীষ্টপূর্বে বাবিলের জোট আসিরিয়া সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দেয়। তাই সফনিয়ের অনেক শ্রোতারা আসিরিয়ার ধ্বংস তাদের নিজের চোখে দেখতে পাবে।
একটি চমৎকার পুনরুদ্ধার যা পাওয়ার জন্য কেউ যোগ্য নয়
উদ্ধার সবার জন্য
বিচারবাণীগুলোর ভয়ংকর ও অন্ধকার ছবির অপর পক্ষে সফনিয় একটি অবিশ্বাস্য ও চমৎকার পুনরুদ্ধারও ঘোষণা করেন, এমন আশ্চর্য কিছু যার অংশ পাওয়ার জন্য কেউ যোগ্য নয়। এই আশারবাণী সফনিয় পুস্তকের শেষ অংশে পাওয়া যায় (সফনিয় ৩:৯-১০) কিন্তু তার আগেও বিভিন্ন পদে পুনরুদ্ধারের আশা দেখা যায়:
- সফনিয় ২:৩ “হে দেশের সব নম্র লোকেরা, তোমরা যারা সদাপ্রভুর আদেশমত কাজ কর, তোমরা তাঁর ইচ্ছামত ন্যায়ভাবে ও নম্রভাবে চল; তাহলে সদাপ্রভুর ক্রোধের দিনে হয়তো তোমরা আশ্রয় পাবে।” এখানে একজনের জাতিগত পরিচয় কি, তার চেয়ে তার মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ: যারা নম্র, বাধ্য এবং যারা ঈশ্বরকে অন্বেষণ করে, তারাই আশ্রয় পাবে।
- সফনিয় ২:৭ “সেই এলাকা যিহূদার বংশের বেঁচে থাকা লোকদের অধিকারে থাকবে; সেখানে তারা পাল চরাবার জায়গা পাবে।”
- সফনিয় ২:৯ মোয়াব ও অম্মোনের বিষয়ে তিনি বলেন: “আমার জাতির বেঁচে থাকা লোকেরা তাদের লুট করবে ও তাদের দেশ অধিকার করবে।” এই বাণী কি ইতিহাসে কোন সময়ে পূর্ণ হয়েছে? আক্ষরিকভাবে নিলে তা এখনও পূর্ণ হয় নি। তাহলে তা কি ভবিষ্যতে কোন সময়ে ঘটবে? হয়তো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে প্রশ্ন করা দরকার, তা হল: “আমার জাতির বেঁচে থাকা লোক” মানে কি? একটি আরো বড় দল থেকে যারা বেঁচে গেছে, তাদেরকে বুঝানো হয়েছে। সফনিয়ের সময়ে যিহূদার বেশিরভাগ লোকেরা ঈশ্বরকে ও তাঁর বাক্যকে অগ্রাহ্য করে, কিন্তু যিহূদার মধ্যে কিছু লোক আছে, যারা তারপরেও সফনিয়ের বাণীতে সাড়া দেয়। এখন এই লোকদেরই উপরে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা রয়েছে।
সফনিয় ৩:৯ পদ থেকে সবগুলো পদ পুনরুদ্ধার সম্বন্ধীয়। প্রকৃতপক্ষে পুনরুদ্ধারের এই বর্ণনা আরো ব্যাপক হয়ে যাচ্ছে:
- সফনিয় ৩:৯-১০ “তারপর আমি জাতিদের মুখ শুচি করব যাতে তারা সবাই আমার উপাসনা করতে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমার সেবা করতে পারে। কূশ দেশের নদীগুলোর ওপার থেকে আমার উপাসনাকারীরা, আমার ছড়িয়ে পড়া লোকেরা আমার উদ্দেশে উৎসর্গের জিনিস নিয়ে আসবে।” কেরী অনুবাদে “যেন তাহারা সকলেই সদাপ্রভুর নামে ডাকে ও একযোগে তাঁহার আরাধনা করে।”
- সফনিয় ভবিষ্যদ্বাণী বলে ঘোষণা করেন যে, ঈশ্বর পৃথিবীর উপরে হস্তক্ষেপ করবেন, তিনি সব জাতিদের শুচি করবেন এবং এমন জাতিদের স্বাগতম জানাবেন, যারা তাঁকে ডাকবে, উপাসনা ও সেবা করবে। এখানে সফনিয়ের কথাটি মশীহ সম্বন্ধীয় বাণীতে পরিণত হয়ে যায় এবং পুরাতন নিয়মের অন্যান্য মশীহ সম্বন্ধীয় বাণীর সাথে মিল পাওয়া যায়। যেমন যোয়েল ২:৩২ “রক্ষা পাবার জন্য যে কেউ সদাপ্রভুকে ডাকবে সে রক্ষা পাবে” যা পিতর পঞ্চাশপ্তমী দিনে উদ্ধৃতি করেন। একইভাবে সফনিয়তে: “তারা সকলেই সদাপ্রভুর নামে ডাকে ও তার আরাধনা করে … কূশ দেশের নদীগুলোর ওপার থেকে উপসনাকারীরা ঈশ্বরের উদ্দেশে উৎসর্গ” দেবে। “কূশ দেশ” মানে কি? শুধুমাত্র কূশ দেশের লোকেরা? সম্ভবত কূশ শব্দটি এখানে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থাৎ তা ‘শেষ প্রান্ত’ বা ‘যত দূরে’ বুঝায়। “ছড়িয়ে পড়া লোকেরা” এই কথা দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? কেউ কেউ বলে যে, তা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া যিহূদীদেরকে বুঝায়। কিন্তু পাশাপাশি অন্যান্য পদ দেখে বুঝা যায় যে কথাটি ‘ঈশ্বরের লোক’দের সম্বন্ধে বলা হয়েছে, অর্থাৎ যারা ইচ্ছুক, নম্র, আগ্রহী, বাধ্য, যারা প্রভুর নাম ডাকে। প্রকৃতপক্ষে কূশ দেশে অর্থাৎ আধুনিক যুগের ইথিওপিয়া দেশে সেই সময় কোনো যিহূদী বসবাস করত না, পরবর্তীতেও সেখানে যিহূদীদের কখনও নির্বাসিত করা হয় নি। পদটি রূপকভাবে বুঝায় যে, সুসমাচার পৃথিবীর শেষ প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে এবং সব জাতি থেকে লোকেরা এই সুখবরে শুনে নম্রতায় ও বাধ্যতায় সাড়া দেবে।
নম্ররা উদ্ধার ও পরিবর্তন লাভ করবে
- সফনিয় ৩:১১-১৩ “তুমি আমার প্রতি যে সব অন্যায় করেছ তার জন্য তুমি সেই দিন লজ্জিত হবে না, কারণ এই শহর থেকে আমি সব অহংকারী ও গর্বিত লোকদের বের করে দেব। আমার পবিত্র পাহাড়ের উপরে তুমি আর কখনও গর্ব করবে না। ১২ যারা সদাপ্রভুর উপর নির্ভর করে সেই রকম নত ও নম্র লোকদের আমি তোমার মধ্যে বাকী রাখব। ১৩ ইস্রায়েলের সেই বাকী লোকেরা অন্যায় করবে না; তারা মিথ্যা কথা বলবে না এবং তাদের মুখে ছলনা থাকবে না। তারা খেয়ে নিরাপদে ঘুমাবে, কেউ তাদের ভয় দেখাবে না।”
সফনিয়ের এই সুন্দর বাণী হল পরিত্রাণের একটি ছবি। যীশুর ক্রুশীয় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঈশ্বর লোকদের পাপ ক্ষমা করে তাদের লজ্জা মুছে ফেলবেন এবং তাদেরকে পবিত্র করে তুলে নিজের সহভাগিতায় নিয়ে আসবেন। অহংকারী মানুষ নয় বরং নত, নম্র ও তাঁর দয়ায় পরিবর্তিত মানুষেরা তার সামনে উপস্থিত থাকবে। - সফনিয় ৩:১২ পদের শেষে বংলা কেরী অনাবাদ বলে “তাহারা সদাপ্রভুর নামের শরণ লইবে”, ইংরেজি অনুবাদ তা রাখা হয় “তারা ঈশ্বরের নামে আশ্রয় নেবে”। “আশ্রয় নেওয়া” এই কথাটি আবারও সফনিয ২:৩ পদ স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে নম্ররা ঈশ্বরের ক্রোধের দিনে “লুকিয়ে থাকবে” (সফনিয়ের নামের অর্থ)। যেমন মোশির আইন-কানুনে প্রথম বলা হয়েছে (দ্বিতীয় বিবরণ ২৮) ঠিক তেমনি সফনিয় দেখানে যে, নত, নম্র, আগ্রহী ও বাধ্য লোকদের উপরেই রয়েছে ঈশ্বরের আশীর্বাদের প্রতিজ্ঞা।
নম্ররা ঈশ্বরের সাথে উচ্ছ্বাসিত প্রেমের সম্পর্কে থাকবে
কিন্তু সফনিয়ের ভবিষ্যদ্বাণী আরো অদ্ভূত হয়ে যায়:
- সফনিয় ৩:১৪-১৭ “হে সিয়োন-কন্যা, গান কর; হে ইস্রায়েল, জয়ধ্বনি কর; হে যিরূশালেম-কন্যা, তুমি খুশী হও ও তোমার সমস্ত অন্তর দিয়ে আনন্দ কর। ১৫ সদাপ্রভু তোমার শাস্তি দূর করে দিয়েছেন, তিনি তোমার শত্রুকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ইস্রায়েলের রাজা সদাপ্রভু তোমার মধ্যে রয়েছেন; তুমি আর কখনও অমংগলের ভয় করবে না। ১৬ সেই দিন তোমাকে বলা হবে, “হে সিয়োন, তুমি ভয় কোরো না, তুমি নিরাশ হোয়ো না। ১৭ তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু তোমার মধ্যে আছেন, তাঁর রক্ষা করবার শক্তি আছে। তিনি তোমার বিষয় নিয়ে খুব আনন্দিত হবেন, আর তাঁর গভীর ভালবাসার তৃপ্তিতে তিনি নীরব হবেন। তিনি তোমার বিষয় নিয়ে আনন্দ-গান করবেন।”
এটা পরিত্রাণের একটি অতি সুন্দর বর্ণনা: ক্ষমা প্রাপ্ত, শাস্তি থেকে মুক্ত, গ্রহণ করা, সুরক্ষিত, ভয়মুক্ত, নিরাশা মুক্ত মানুষ যাদের মধ্যে ঈশ্বর নিজেই থাকবেন (‘ইম্মানুয়েল’, যীশুর পদবী)। আরো আশ্চর্য বিষয়: ঈশ্বর তাঁর নম্র মানুষদের নিয়ে, অর্থাৎ বিশ্বাসীদেরকে নিয়ে, এমন কি আমাকে নিয়ে “খুব আনন্দিত হবেন”, “ভালবাসার তৃপ্তিতে নীরব হবেন” এবং আমাদের “বিষয়ে আনন্দ-গান করবেন”!
সব জাতি দেখবে
তিনি মশীহ সম্বন্ধীয় পুরাতন নিয়মের অন্যান্য পদগুলোর মত ভাষা ব্যবহার করে (যেমন যিশাইয় ৩৫:৫, মীখা ৪:১-২ ও আদি ১২:১-৩) আরো বড় কিছু ঘোষণা করেন:
- সফনিয় ৩:১৯-২০ “আমি খোঁড়াদের উদ্ধার করব এবং যারা ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের জড়ো করব। তাদের লজ্জার বদলে আমি তাদের সারা পৃথিবীতে প্রশংসা ও গৌরব দান করব। ২০ হে যিরূশালেমের লোকেরা, সেই সময়ে আমি তোমাদের নিয়ে এসে জড়ো করব। আমি যখন তোমাদের অবস্থা ফিরাব তখন পৃথিবীর সমস্ত জাতির মধ্যে আমি তোমাদের সম্মান ও গৌরবের পাত্র করব, আর তোমরা তা দেখতে পাবে। আমি সদাপ্রভু এই কথা বলছি।”
নম্র, ইচ্ছুক ও বাধ্য লোকদেরকে নিয়ে ঈশ্বরের পরিবর্তনকারী ক্ষমতা, অর্থাৎ সেই অদ্ভূত পরিত্রাণের খবর ছড়িয়ে পড়বে। অনেকে ঈশ্বরের লোকদের সাক্ষ্য ও পরিবর্তণ দেখবে ও আকৃষ্ট হবে।
সফনিয় পুস্তকে প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে ভয়ংকর ও ব্যাপক ধ্বংসবাণী পাওয়া যায়, কিন্তু একই সাথেও মশীহের একটি অতি চমৎকার দর্শনও পাওয়া যায়: সেই সুদূরপ্রসারী পরিত্রাণ এবং সব ইচ্ছুকদের জন্য চমৎকার একটি পুনরুদ্ধার ও রূপান্তর।