করিন্থীয় মণ্ডলীকে একটি ব্যাথাপূর্ণ পরিদর্শনের পরে পৌল এই চিঠি লেখেন যেন মণ্ডলীর সঙ্গে সম্পর্কের আরো পুনর্মিলন হয় এবং যেন তারা বুঝতে পারে যে পৌলের সুখবর ও তার প্রেরিত্ব আসল।
পৌল যখন ইফিষ শহরে, তিনি করিন্থ মণ্ডলী সম্বন্ধে এমন কথা শোনেন যে তিনি দুশ্চিন্তিত (১ করি ১:১১, ১৬:১৭-১৮)। উত্তরে তিনি ১ করিন্থীয় চিঠি লেখেন। তিনি সাথে সাথে করিন্থের দিকে রওনা দিতে পারেন না বলে তিনি তীমথিয়কে পাঠান যেন তিনি জানতে পারেন, তার চিঠি কিভাবে গ্রহণ করা হল (১ করি ১৬:১০-১১, প্রেরিত ১৯:২২)। হতে পারে তীমথিয় আরো দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করার একটি রিপোর্ট নিয়ে এসেছিলেন, কারণ পৌল মন পরিবর্তন করে সাথে সাথে করিন্থের দিকে রওনা দেন (২ করি ১:১৭)। কিন্ত এই পরিদর্শনের ফলাফল ভাল হয় না। করিন্থ মণ্ডলীর অনেকে পৌলের সংশোধন ও নেতৃত্ব অগ্রাহ্য করে। পৌল পরে এটাকে ‘ব্যাথাপূর্ণ পরিদর্শন’ বলেন (২ করি ২:১)। তিনি তাড়াতাড়ি করিন্থ ছেড়ে চলে যান।
যদি করিন্থীয় শুধুমাত্র পৌলকে ব্যক্তি হিসাবে অপছন্দ বা অগ্রাহ্য করত, তবে পৌলের এত দুশ্চিন্তা থাকত না। কিন্তু তিনি জানেন যে তাকে অগ্রাহ্য করলে করিন্থীয় মণ্ডলী সুখবরের গুরুত্বপূর্ণ ও ভিত্তিক সত্যগুলিও অগ্রাহ্য করবে। তা ছাড়া তাকে অগ্রাহ্য করলে করিন্থীয়রা নিজের উপর অন্য ধরণের, এমন কি খারাপ নেতৃত্ব টেনে নিয়ে আসবে। এর জন্য পৌল তাদের ছাড়তে রাজি না: তিনি তার একজন বহুবছরের বিশ্বাসযোগ্য সহকর্মী, তীতকে মণ্ডলীর কাছে পাঠান এই আশায় যে তিনি পৌল ও মণ্ডলীর মধ্যে একটি পুনর্মিলন ঘটাতে পারেন (২ করি ৭:৬, ৭:১৩-১৪, ৮:২৩)। পৌল খুব আগ্রহের সঙ্গে, এমন কি ভয় ও দুশ্চিন্তার সঙ্গে, তীতের ফেরার জন্য অপেক্ষা করেন (২ করি ২:১২-১৩)। যখন তীত ভাল খবর নিয়ে ফিরে আসেন যে করিন্থীয় মণ্ডলী মন ফিরিয়েছে তখন পৌল অত্যন্ত আনন্দিত ও অনেক শান্তি অনুভব করেন (২ করি ৭:৬-১৬)।
পৌল উত্তরে করিন্থীয় মণ্ডলীর কাছে আর একটি চিঠি লিখেন (২ করিন্থীয়)। পৌল করিন্থীয়দের নিশ্চয়তা দেন যে তিনি তাদের সত্যি ভালবাসেন ও তাদের চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা আরো মন ফিরায় (২ করি ৭:২-১৬)। তিনি এই চিঠি তার তৃতীয় পরিদর্শনের আগে পাঠান (হতে পারে আবার তীতের মাধ্যমে) যেন তারা আরো পরিবর্তিত হওয়ার সুযোগ পায় এবং পৌলের পরিদর্শনের জন্য প্রস্তুত হয়।
১ করিন্থীয় চিঠি ছিল চেতনাদায়ক, টিটকারী দেওয়ার ও চ্যালেঞ্জ করার মত একটি চিঠি, ২ করিন্থীয় চিঠি সম্পূর্ণ ভিন্ন: তা হল একটি অতি আবেগীয় চিঠি যেখানে পৌল খোলা হৃদয়ে, এমন কি ভাঙ্গা অন্তর থেকে ও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে তাদের এই চিঠি লেখেন। চিঠির মূল বিষয় হল করিন্থীয়দের সাথে ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্ক আবার সম্পূর্ণভাবে ঠিক করা, পৌলের নেতৃত্ব ও প্রেরিত্ব আরো বুঝানো ও সুরক্ষা করা এবং কিছু “বিশেষ প্রেরিতদের” বিষয়ে সাবধানবাণী দেওয়া, যারা মণ্ডলীতে ঢোকে পৌলের বিরুদ্ধে কথা বলেছে ও মণ্ডলীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে।
পৌল এই চিঠিতে আবারও গ্রীক সংস্কৃতির ভুল চিন্তার বিরুদ্ধে শিক্ষা দেন, বিশেষভাবে একজন ভাল নেতা, প্রেরিত বা শিক্ষক হওয়া মানে কি। গ্রীক চিন্তা অনুসারে সফল একজন নেতা মানে একজন ভাল বক্তা যিনি শক্তিশালীভাবে যুক্তি-তর্ক ও নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনা করতে পারেন, যার জনপ্রিয়তা আছে ও যিনি বক্তৃতার জন্য অনেক টাকা দাবি করতে পারেন। পৌল তার বিপরীতে বলেন যে সত্যিকারের নেতা বা প্রেরিত হল এমন একজন যিনি ত্যাগ-স্বীকার করে অন্যদের সেবা দেন, ঝুঁকি নেন, সাহসী হন এবং অভাব ও অত্যাচার মেনে নেন যেন মানুষের কাছে ঈশ্বরের ভালবাসা দেখাতে পারে। পৌল নিজের প্রেরিত হওয়ার অধিকার করে বলেন যে করিন্থীয়রা নিজেই হল তার পরিচর্য্যার ফল, প্রেরিত হিসাবে তার গর্ব ও তার সুপারিশ চিঠি। তিনি তাদের দেখান যে যেমন যীশু কষ্টভোগ ও ত্যাগ-স্বীকার মেনে নেওয়া দ্বারা আসল জয় লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, ঠিক তেমনি একজন আসল প্রেরিতের জীবনে সে একই কষ্টভোগ ও ত্যাগ-স্বীকার থাকবে।
পৌল পার্থক্য দেখান তার নিজের নেতৃত্ব ও সে “বিশেষ প্রেরিতদের” আত্ন-কেন্দ্রিক ও স্বার্থপর ধরণের নেতৃত্বের মধ্যে। তারা নতুন কোন মণ্ডলী স্থাপন করে না বরং আর একজনের কষ্টের কাজ দিয়ে স্থাপিত মণ্ডলীতে ঢোকে তারা সেখানে বড় কথা বলে ও মণ্ডলী থেকে ধনী হতে চেষ্টা করে।
করিন্থীয় ৮ ও ৯ অধ্যায়ে পৌল করিন্থীয়দের উৎসাহিত করেন যেন তারা পুনরায় অভাবী যিরূশালেম মণ্ডলীর জন্য একটি দান তুলতে শুরু করে। এই জমা টাকায় পৌল একেবারেই হাত দিবেন না, বরং মণ্ডলীর নিজের লোকেরা তা পৌছাবে। পৌল দেখান যে করিন্থীয়দের প্রতি তার আগ্রহ হল স্বার্থহীন একটি আগ্রহ, তার করিন্থীয় টাকার জন্য কোন লোভ নেই।
করিন্থীয় মণ্ডলী ও পৌলের মধ্যে যোগাযোগ
পৌল, সীল ও তীমথিয় দ্বিতীয় প্রচার যাত্রার সময়ে, অর্থাৎ ৫০ থেকে ৫২ খ্রীষ্টাব্দে করিন্থ মণ্ডলী স্থাপন করেছিলেন। প্রায় তিন বছর পরে, যখন পৌল তার তৃতীয় প্রচার যাত্রায় আড়াই বছরের মত ইফিষ শহরে ছিলেন (প্রায় ৫৪ খ্রীঃ) তখন তিনি করিন্থীয় মণ্ডলীর বিষয়ে উদ্বেগজনক খবর পান (১ করি ১:১১, ১৬:১৭-১৮)। এই প্রতিবেদনের সাড়া হিসাবে তিনি ১ করিন্থীয় চিঠি লেখেন। তিনি নিজেই করিন্থীয় মণ্ডলী পরিদর্শন করতে চান কিন্তু ইফিষে পরিচর্যার কারণে সাথে সাথে রওনা না পেরে তিনি তীমথিয়কে করিন্থে পাঠিয়ে দেন, যেন তিনি গিয়ে দেখেন যে মণ্ডলীর লোকেরা তার চিঠি কিভাবে গ্রহণ করেছে (১ করি ১৬:১০-১১, প্রেরিত ১৯:২২)। সম্ভবত তীমথিয় আগের চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক খবর নিয়ে ফিরে আসেন, কারণ পৌল নিজের পরিকল্পনা পরিবর্তন করে অবিলম্বে করিন্থীয় পরিদর্শনে যান (২ করি ১:১৭)। পৌলের এই পরিদর্শন ভাল যায় না, করিন্থীয় মণ্ডলী পৌলের সংশোধন এবং নেতৃত্ব প্রত্যাখ্যান করে। পৌল সেখান থেকে দ্রুত বিদায় নেন। এই পরিদর্শনকে পৌল পরে দুঃখদায়ক (বা ব্যাথা/বেদনাপূর্ণ) বলে বর্ণনা করেন (২ করি ২:১)।
সাধারণভাবে একজন ব্যক্তি হিসাবে প্রত্যাখিত হলে পৌল বেশি দুশ্চিন্তা করতেন না, কিন্তু তিনি জানেন যে তাকে প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে করিন্থীয় মণ্ডলী সুসমাচারের ভিত্তিক সত্যগুলোও প্রত্যাখ্যান করার পথে রয়েছে এবং যে তারা এভাবে নিজেদের মধ্যে মন্দ নেতৃত্ব টেনে নিয়ে আসছে। এই কারণে পৌল তাদের ছেড়ে দিতে রাজি নন, তিনি মণ্ডলীর সাথে পুনর্মিলনের জন্য একজন অনেকদিনের বিশ্বস্ত সহকর্মী তীতকে পাঠিয়ে দেন (২ করি ৭:৬, ৭:১৩-১৪, ৮:২৩)। তীত খুব সম্ভবত পৌলের কাছ থেকে একটি ‘কঠিন চিঠি’ বহন করে করিন্থীয় মণ্ডলীর কাছে যান – এমন একটি চিঠি যা পৌল “অনেক দুঃখ ও মনের ব্যথায় চোখের জলের বিতর দিয়ে দিয়ে” লিখেছেন (২ করি ২:৪)। এই চিঠি ছিল অনেক প্রভাবসম্পন্ন, ভীতিজনক এবং শক্তিশালীভাবে তিরস্কারমূলক একটি চিঠি (২ করি ১০:৮-৯), তিনি এই চিঠি দিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন যে করিন্থীয়েরা আসলেই অনুতপ্ত হয়ে পৌলের সংশোধন ও তার প্রৈরিতিক অধিকার মনে নেয় কিনা (২ করি ২:২, ৭:৮)।
পৌল খুবই চিন্তিত যখন তিনি ম্যাসিডোনিয়ায় তীতের আগম ও তিবেদনের জন্য অপেক্ষা করেন (২ করি ২:১২-১৩)। যখন তীত মণ্ডলীর অনুতপ্ত হওয়ার সুখবর নিয়ে আসেন তখন পৌল অতিশয় আনন্দিত হন (২ করি ৭:৬-১৬)।
পৌল উত্তরে করিন্থয়দের কাছে আর একটি চিঠি লেখেন, যা আমরা ২ করিন্থীয় চিঠি হিসাবে জানি। তার তৃতীয় পরিদর্শনের জন্য মণ্ডলীকে প্রস্তুত করার এবং সম্পর্কের আরো গভীর পুনর্মিলন ঘটার উদ্দেশ্যে পৌল এই চিঠিটি লেখেন এবং সম্ভবত আবারও তীতের হাতে মণ্ডলীর কাছে পাঠান। পৌল ২ করিন্থীয় চিঠিতে তাদের প্রতি নিজের অবিরত ভালবাসা সম্পর্কে আশ্বাস দেন এবং তাদেরকে আরো পরিপূর্ণভাবে অনুতপ্ত হওয়ার জন্য এবং আরো গভীর সুস্থতার জন্য চ্যালেঞ্জ দেন (২ করি ৭:২-১৬)।
ক্রম | ঘটনা | বর্ণনা |
০১ | প্রথম পরিদর্শন | পৌল তার দ্বিতীয় প্রচার যাত্রায় করিন্থীয় মণ্ডলী স্থাপন করেন (৫০–৫২ খ্রীঃ)। সেখানে তিনি দেড় বছরের মত সময় অবস্থান করেন (প্রেরিত ১৮:১১) এবং প্রচারকাজ করেন। এর পরে তিনি ইফিষের উদ্দেশ্যে রওনা দেন (প্রেরিত ১৮:১–১৮)। |
০২ | ১ম চিঠি (“আগের চিঠি“) | পৌল তার চিঠিতে মণ্ডলীর লোকদের সাবধান করেন, তিনি তাদেরকে অনৈতিক কাজে জড়িত বিশ্বাসীদের থেকে দূরে থাকার জন্য নির্দেশ দেন (১ করি ৫:৯)। এই চিঠিট হারিয়ে গেছে, তাই বাইবেলে নেই। এই চিঠি নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক ভুল বুঝাবুঝি এবং সমস্যার সৃষ্টি হয়। ১ করি ৫:১০–১১ পদ থেকে বুঝা যায় যে পৌল যা বুঝাতে চেয়েছিলেন মণ্ডলীর লোকেরা তা বুঝে নি। কেউ কেউ মনে করে যে ২ করি ৬:১৪–৭:১ পদ (অসম জোয়ালীর অংশটুকু) হল এই “আগের চিঠি” এবং তা ২ করিন্থীয় চিঠির অংশ হিসাবে সংরক্ষিত করা হয়েছে। |
০৩ | ক্লোয়ীর ঘরের লোকদের প্রতিবেদন | ক্লোয়ীর ঘরের বিশ্বাসীরা লোক পাঠিয়ে পৌলকে জানান: আগের চিঠি নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে, মণ্ডলীতে দলাদলি, বিভেদ, বিশৃঙ্খলা এবং তর্ক চলছে (১ করি ১:১১), প্রভুর ভোজে খারাপ ব্যবহার দেখা দিচ্ছে (১ করি ১১:১৮) এবং পৌলের নেতৃত্ব ও অধিকারের বিষয়ে আপত্তি উঠানো হচ্ছে (১ করি ৪:৩, ১৮)। |
০৪ | করিন্থীয়দের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে পৌলের কাছে চিঠি | বিয়ে (১ করি ৭), প্রতিমার কাছে উৎসর্গ করা খাবার নিয়ে প্রশ্ন (১ করি ৮), পবিত্র আত্মার দান সম্পর্কে ভুল বুঝা (১ করি ১২) এই সমস্ত বিষয় নিয়ে পৌলের কাছে একটি চিঠি যায়। খুব সম্ভবত স্তিফান, ফর্তুনাত ও আখায়িক করিন্থ থেকে এই চিঠি পৌলের কাছে নিয়ে যান এবং মণ্ডলীতে দলাদলি ও অনৈতিকতার বিষয়েও প্রতিবেদন করে (১ করি ১৬:১৭–১৮)। |
০৫ | প্রকৃত পরিকল্পনা | পৌলের পরিকল্পনা করেন যে তিনি পঞ্চাশত্তমী পর্ব পর্যন্ত ইফিষে থাকবেন, পরে ম্যাসিডোনিয়া প্রদেশ হয়ে করিন্থে যাবেন। (১ করি ১৬:৫–৯) |
০৬ | ২য় চিঠি, মানে “১ম করিন্থীয়“ | ৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পৌল যখন ৩য় প্রচার যাত্রায় ছিলেন তখন ইফিষ থেকে লেখা। খুব সম্ভবত স্তিফান, ফর্তুনাত এবং আখায়িক দ্বারা পাঠানো হয় (১ করি ১৬:১৫–১৮)। |
০৭ | সম্ভাব্য পরিকল্পনা | নিজে ম্যাসিডোনিয়া হয়ে করিন্থে যাওয়ার আগে পৌল তীমথিয়কে করিন্থে পাঠিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেন। হয়তো তিনি দেখতে চেয়েছিলেন যে করিন্থীয় মণ্ডলীর উপরে ১ম করিন্থীয় চিঠির প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল (১ করি ১৬:১০–১১, প্রেরিত ১৯:২২)। |
০৮ | তীমথিয় খারাপ প্রতিবেদন নিয়ে ফিরে আসেন | সম্ভবত ৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তীমথিয় করিন্থে যান (প্রেরিত ১৯:২২)। মণ্ডলীর পরিস্থিতি আরো খারাপ দিকে গিয়েছে এবং পৌলের অধিকারের অগ্রাহ্য বেড়েছে, তীমথিয় এই খারাপ খবর নিয়ে করিন্থ থেকে ইফিষে ফিরে এসে পৌলকে জানান। |
০৯ | প্রথমবারের পরিকল্পনা পরিবর্তন | পৌল জরুরীভাবে করিন্থ পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ইফিষ থেকে ম্যাসিডোনিয়া যাওয়ার পরিবর্তে, ইফিষ থেকে সরাসরি করিন্থে যাওয়ার চিন্তা করেন যেন এভাবে করিন্থ মণ্ডলীকে দুইবার পরিদর্শন করতে পারেন (২ করি ১:১৫–১৬)। |
১০ | পৌলের করিন্থে ২য় পরিদর্শন (দুঃদায়ক পরিদর্শন) | পৌল জরুরীভাবে ইফিষ থেকে সরাসরি করিন্থ পরিদর্শনে যান (২ করি ২:১, ১৩:১–২)। এই পরিদর্শনের কথা প্রেরিত পুস্তকে উল্লেখ নেই, কিন্তু পৌল তা “দুঃখদায়ক” বা বেদনাদায়ক একটি পরিদর্শন বলেন, কারণ মণ্ডলী তার প্রৈরিতিক অধিকার অগ্রাহ্য করে এবং বিভিন্ন বিষয়ে পৌলের দোষ ধরেন, যেমন পরিকল্পনা পরিবর্তনের বিষয় (২ করি ১:১৭)। তাই পৌল দ্রুত করিন্থ থেকে চলে গিয়ে ইফিষে ফিরে যান। |
১১ | ২য়বারের মত পরিকল্পনা পরিবর্তন | পৌল আগেরবারের মত বেদনাদায়ক পরিদর্শন এড়ানোর জন্য করিন্থ যাওয়ার পরিকল্পনা পিছিয়ে দেন (২ করি ১:২৩–২:১)। |
১২ | ৩য় চিঠি (“কঠিন চিঠি“) | নিজে যাওয়ার পরিবর্তে পৌল তীতকে দিয়ে করিন্থে একটি কঠিন চিঠি পাঠান। তিনি ২ করি ২:৪, ৭:৮ পদে এই চিঠির উল্লেখ করেন। এই চিঠি ছিল প্রভাব বিস্তারকারী, ভীতিকর, শক্তিশালীভাবে ধমক দেওয়ার মত চিঠি (২ করি ১০:৯–১০)। পৌল দেখতে চেয়েছিলেন যে লোকেরা আসলে অনুতপ্ত, বাধ্য এবং তার প্রৈরিতিক অধিকার মেনে নেয় কি না। এই জন্য তিনি কঠিন চিঠিটি লেখেন (২ করি ২:৯, ৭:৮)। এই চিঠিও হারিয়ে গেছে বলে বাইবেলে নেই। (কেউ কেউ মনে করে ১ম করিন্থীয়ই হল সেই কঠিন চিঠি, আবার কেউ মনে করেন লেখাটি ২ করি ১০–১৩ অধ্যায় হিসাবে সংরক্ষিত করা হয়েছে) |
১৩ | ত্রোয়া এবং ম্যাসিডোনিয়ায় তীতের জন্য অপেক্ষা | পৌল ইফিষীয় ত্যাগ করে ত্রোয়াতে যান এবং সেখানে চিন্তিত অবস্থায় তীতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন, কখন তীত আসবেন এবং করিন্থ মণ্ডলী এই কঠিন চিঠি কিভাবে গ্রহণ করেছে তার খোঁজ নিয়ে আসবেন (২ করি ২:২)। তীত ফিরছে না দেখে পৌল ম্যাসিডোনিয়াতে চলে যান (২ করি ২:১৩, ৭:৫) এবং সেখানে তীতের সাথে মিলিত হন। তিনি খবর শুনে সান্তনা পান যে করিন্থীয় মণ্ডলী তার চিঠি ভালোভাবে গ্রহণ করেছে (২ করি ৭:৫–১৫)। তীত এই সময় ভণ্ড শিক্ষকদের কথাও উল্লেখ করেন যাদেরকে “বিশেষ প্রেরিত” বলে প্রকাশ করা হয়। পৌলের নেতৃত্ব অস্বীকার করে এবং মণ্ডলীকে তার বিরুদ্ধে লাগানোর মাধ্যমে তারা নিজেরা ক্ষমতা ধরার চেষ্টা করছে (২ করি ১০–১২ অধ্যায়)। |
১৪ | ৪র্থ চিঠি, মানে “২য় করিন্থীয়“ | তীতের খবার পেয়ে পৌল উত্তরে ২য় করিন্থীয় চিঠি লেখেন এবং নিজে করিন্থে যাওয়ার আগে তীতের হাতে চিঠিটি পাঠান (২ করি ৮:১৭)। এই চিঠি ম্যাসিডোনিয়া থেকে ৫৬ খ্রিষ্টাব্দে লেখা। মণ্ডলীর ভাল মনোভাব ও অনুতাপের জন্য পৌল তার আনন্দ প্রকাশ করেন, নিজের প্রৈরিতিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করেন, মণ্ডলীর লোকদের তার ৩য় পরিদর্শনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন এবং যিরুশালেমের জন্য দানও প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেন (২ করি ৮, ৯ অধ্যায়)। |
১৫ | ৩য় পরিদর্শন | তৃতীয় প্রচারযাত্রা চলতে থাকা অবস্থায় ৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পৌল তৃতীয় বার করিন্থ পরিদর্শন করেন। করিন্থের সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার পরে তিনি রোমীয় চিঠি লেখেন (রোমীয় ১৫:২৩–২৮)। তিনি যিরূশালেমের জন্য আর্থিক দান সংগ্রহ করে যিহূদিয়ায় ফিরে যান (প্রেরিত ২০:২)। |
১ম করিন্থীয় ছিল অনেকটা সংশোধনকারী, ধমক দেওয়ার মত এবং ব্যাঙ্গ করার মত একটি চিঠি কিন্তু এই ২য় করিন্থীয় হল এমন একটা চিঠি যেখানে পৌলের গভীর আবেগ প্রকাশ পায়। এখানে তিনি নিজের হৃদয় খুলে করিন্থীয়দের প্রতি তার অবিরত ভালবাসা ও যত্নের নিশ্চয়তা দেন। ১ম করিন্থীয় চিঠির মধ্যে একটি পরিষ্কার বিষয়ভিত্তিক কাঠানো দেখা যায় কিন্তু ২য় করিন্থীয় চিঠিটিতে কাঠামো অনেকটা কম কারণ পৌল তার হদয়ের আবেগ খোলাভাবে ঢেলে দিচ্ছেন।
করিন্থীয়দের সাথে পৌলের সম্পর্ক
২ করিন্থীয় ১, ২, ৬ ও ৭ অধ্যায়ে পৌল কিভাবে করিন্থীয়দের প্রতি চিন্তিত ছিলেন এবং ওদের জন্য কষ্ট সহ্য করেছিলেন, সেই বিষয়গুলো তুলে ধরেন। তিনি আরো প্রকাশ করেন যে তাদের অনুতাপের কথা শুনে তিনি কতটা সস্তি ও আনন্দ পেয়েছিলেন।
পৌল জোর দিয়ে বলেন যে করিন্থীয়দের সাথে দ্বন্দ্বের বিষয়টি তার জন্য খুবই কষ্টদায়ক ছিল, কিন্তু সাথে সাথে তিনি ইফিষের দিক থেকেও যথেষ্ট চাপের মুখে ছিলেন (২ করি ১:৮-১১)। তিনি বর্ণনা করেন এই তীব্র কষ্টের সময়ে ঈশ্বর তাকে কিভাবে সান্ত্বনা দান করেছেন এবং এখন তিনি করিন্থীয় এবং অন্যান্যদের সেই সান্ত্বনা দান করতে সক্ষম (২ করি ১:৪)। করিন্থীয় মণ্ডলীর প্রতি নিজের অপরাধবোধের যে মানুষিক চাপ, তা পৌল এইভাবে কমান। ইফিষের সমস্যার উল্লেখ করা দ্বারা পৌল নিশ্চিত করে যে করিন্থীয়রা তার কাছ থেকে অতিরিক্ত চাপ না পায়।
করিন্থীয় মণ্ডলীর বিষয়ে পৌল তার বিশ্বাস ও প্রতাশা বার বার প্রকাশ করেন, এমনকি তাদের বিষয়ে নিজের গর্বও প্রকাশ করেন। তিনি তাদের প্রতি নিজের পিতার হৃদয় দেখান: “তোমাদের সম্বন্ধে আমাদের স্থির বিশ্বাস আছে” (২ করি ১:৭), “আমি খুশি হয়েছি, কারণ সব ব্যাপারেই আমি তোমাদের উপর নির্ভর করতে পারি” (২ করি ৭:১৬)।
তার চেয়েও বেশি করিন্থীয়দের অনুতাপের বিষয়ে পৌল তার সস্তি ও আনন্দ মুক্তভাবে প্রকাশ করেন “তবে ঈশ্বর, যিনি দুঃখিতদের সান্ত্বনা দান করেন, তিনি তীতের আসবার মধ্য দিয়ে আমাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। কেবল তাই নয়, তীত নিজে তোমাদের দ্বারা সান্ত্বনা পেয়েছেন বলে আমরাও সান্ত্বনা পেয়েছি” (২ করি ৭:৬-৭) এবং “যদিও আমি আমার আগের চিঠির দ্বারা তোমাদের দুঃখ দিয়েছিলাম তবুও আমি দুঃখিত নই” (২ করি ৭:৮)।
পৌল তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা পৌলের প্রতি আরো খোলা হয় এবং আরো ইতিবাচক সাড়া দিতে থাকে “দেখ, এখনই উপযুক্ত সময়, আজই উদ্ধার পাবার দিন। … আমরা এমন কিছু করি না যার দ্বারা কেউ কোন রকমে মনে বাঁধা পায়” (২ করি ৬:২-৩)। তিনি আরো বলেন “করিন্থীয় বিশ্বাসীরা, আমরা তোমাদের কাছে খোলাখুলিভাবেই কথা বলেছি এবং তোমাদের কাছে আমাদের অন্তর সম্পূর্ণভাবে মেলে ধরেছি। আমরা আমাদের অন্তর তোমাদের জন্য খুলে রেখেছি, কিন্তু তোমরা তোমাদের অন্তর আমাদের বিরুদ্ধে বন্ধ করে রেখেছ। আমার সন্তান হিসাবে আমি তোমাদের বলছি, আমরা যেমন তোমাদের জন্য আমাদের অন্তর খোলা রেখেছি তোমরাও তেমনি তোমাদের অন্তর আমাদের জন্য খুলে দাও” (২ করি ৬:১১-১৩)। পৌল তার খোলা হৃদয় প্রকাশ করেন, আরো প্রকাশ করেন তিনি করিন্থীয় বিশ্বাসীদের জন্য কত আগ্রহী।
পৌল তার ভ্রমণের পরিকল্পনা পরিবর্তন করেছিলেন, সম্ভবত এই বিষয়টি বড় করে তুলে বিশেষ প্রেরিতরা পৌলকে নিয়ে অনেক সমালোচনা করেছিল। পৌল বিশ্বাসীদের নিশ্চয়তা দেন যে তিনি “ঈশ্বরের দেওয়া পবিত্রতায় এবং সরলতায়” (২ করি ১:১২) আচরণ করেছেন এবং যে তিনি অনুপযুক্তভাবে বা বিচার বিবেচনা না করে নিজের কথা ভেঙ্গে দিয়েছেন, তা না (২ করি ১:১৮) বরং তাদেরকে রক্ষা করার জন্যই তিনি সাথে সাথে তাদের কাছে ফিরে যান নি (২ করি ১:২৩, ২:১)।
২ করিন্থীয় ২ অধ্যায়ে পৌল সেই অনৈতিক পুরুষের বিষয়ে লেখেন যার বিষয়ে তিনি ১ করি ৫ অধ্যায়েও নির্দেশনা দিয়েছিলেন যেন মণ্ডলী তাকে বের করে। ২ করিন্থীয় পড়লে বুঝা যায় যে মণ্ডলী আসলেই পৌলের নির্দেশনা অনুসারে লোকটিকে বের করেছিল এবং এই প্রতিক্রিয়া দ্বারা সে লোক চেতনা পেয়ে অনুতপ্ত হয়। এরজন্য পৌল ২ করি ২:৫-১১ পদে মণ্ডলীকে উৎসাহিত করেন তারা যেন লোকটিকে ক্ষমা করে এবং তাকে পুনরায় নিশ্চয়তা দেয় যে তারা তাকে ভালোবাসে।
পৌলের প্রেরিতত্ব এবং সুসমাচার
পৌল যখন সত্যিকারের প্রেরিতত্বের বিষয় তোলেন তখন লক্ষ্য করুন কোন বিষয়ে তিনি গুরুত্ব দেন – এবং কি সের উপর তিনি কোন গুরুত্ব দেন না। তিনি গুরত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন প্রেরিতদের যেন ঈশ্বরীয় আচরণ (ভালবাসা, নিঃস্বার্থ সেবা, বিশ্বস্ততা) এবং ঈশ্বরীয় চরিত্র ও মনোভাব থাকে, এমন একটি মনোভাব যাতে পবিত্র আত্মার ফল পাওয়া যায়। কিন্তু যে বিষয়গুলো গ্রীক সাংস্কৃততে প্রশংসিত, যেমন: জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রতিভা, দক্ষতা, উপস্থাপনা, চেহারা, বাকপটুতা বা জনপ্রিয়তা, সেগুলোর পৌল ভাল নেতৃত্বের ক্ষেত্রের উল্লেখযোগ্য মনে করেন না। প্রেরিত হিসাবে তার আহ্বানের গল্প, কিভাবে পুনরুত্থিত যীশু তার সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছিলেন, সে বিশেষ অভিজ্ঞতাও তিনি প্রেরিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন না। মণ্ডলীতে সঠিক মতবাদ দান, কি করা উচিত বা না করা উচিত তার শিক্ষা, তাও তিনি উল্লেখ করেন না।
পৌল ভালভাবে জানেন যে ভুল বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে করিন্থীয়ে বিশ্বাসীরা ভাল নেতৃত্বকে সরিয়ে দিয়েছে (যেমন: পৌল, ক্লোয়ী, স্তিফান ইত্যাদি, ১ করি ১৬:১৬) বরং নিজেদের উপরে বেশ কিছু খারাপ নেতৃত্ব নিয়ে এসেছে।
নেতৃত্বি সম্বন্ধীয় রূপক
ভাল প্রেরিতত্ব মানে কি এবং ভ্রান্ত প্রেরিত কেমন, তা বুঝানোর জন্য পৌল ২ করিন্থীয় চিঠিতে বেশ কিছু শক্তিশালী রূপক ব্যাবহার করেন:
- ১ম রূপক: “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, আমরা খ্রীষ্টের সংগে যুক্ত হয়েছি বলে ঈশ্বর তাঁর জয়-যাত্রায় সব সময় আমাদের চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। খ্রীষ্টকে জানা একটা সুগন্ধের মত। ঈশ্বর তাঁর জয়-যাত্রায় সেই সুগন্ধ আমাদের মধ্য দিয়ে সব জায়গায় ছড়িয়ে দেন” (২ করি ২:১৪)। রূপকের অর্থ কি? যুদ্ধে বিজয়ী রোমীয় সেনাপতি এবং সম্রাটরা নিজেদের বিজয় দেখানোর জন্য এবং ক্ষমতার চিহ্ন হিসাবে বন্দীদেরকে লাইন ধরে হাঁটিয়ে প্রদর্শন করত। পৌল এখানে তার প্রেরিতত্বের বিজয় দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন কিন্তু সাথে সাথে তিনি প্রকাশ করেন প্রেরিতের সেই ক্রমাগত কষ্টভোগ (২ করি ৬:৪-৭, ১১:২৩-২৯)।
- ২য় রূপক: “যারা উদ্ধার পাচ্ছে এবং যারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাদের কাছে ঈশ্বরের পক্ষে আমরা সত্যি সত্যিই খ্রীষ্টের সুগন্ধ। কিন্তু যারা ধ্বংস হচ্ছে তাদের কাছে আমাদের সুগন্ধ হল মৃত্যুর গন্ধ, যার ফল হল অনন্ত মৃত্যু; আর যারা উদ্ধার পাচ্ছে তাদের কাছে আমরা জীবনের সুগন্ধ” (২ করি ২:১৫-১৬)।
- ৩য় রূপক: “নিজেদের লাভের জন্য যারা ঈশ্বরের বাক্য নিয়ে ব্যবসা করে আমরা সেই সব লোকদের মত নই; বরং খ্রীষ্টের সংগে যুক্ত হয়ে ঈশ্বরের সামনে ঈশ্বরের পাঠানো লোক হিসাবে আমরা খাটি অন্তর থেকে কথা বলি” (২ করি ২:১৭)। এখানে পৌল ভ্রান্ত প্রেরিতদের হকারদের সঙ্গে তুলনা করেন। হকার মানে এমন লোক যার মাল অত্যন্ত সস্তা বা বাজে, এমন একজন যে নিজের মাল বিক্রি করার জন্য যে কোন কিছু বলতে রাজি আছে, মিথ্যা হোক, প্রতারণা হোক।
- ৪র্থ রূপক: “কোন কোন লোকের যেমন দরকার হয়ে থাকে, আমাদেরও কি সেই রকম তোমাদের কাছে বা তোমাদের কাছ থেকে প্রশংসার চিঠির দরকার হয়ে পড়েছে? কখনও না। আমাদের অন্তরের মধ্যে লেখা তোমরাই তো আমাদের চিঠি।… আমাদের অন্তরের মধ্যে লেখা … সবাই জানে … সবাই পড়েছে … তোমরাই যে খ্রীষ্টের লেখা চিঠি … কালি দিয়ে লেখা হয় নি বরং জীবন্ত ঈশ্বরের আত্মা দিয়েই লেখা… পাথরের ফলকের উপরে হয় নি, মানুষের অন্তরের উপরেই তা লেখা হয়েছে” (২ করি ৩:১-৩)। গ্রীক চোখে যারা আদর্শ শিক্ষক, তাদের সাথে এখানে পুরো পার্থক্য দেখা যায়। তারা সুপারিশ চিঠির উপরে নির্ভর করে, শারীরিক সৌন্দর্য এবং দক্ষতার উপরে অনেক গুরুত্ব দেয়, সঠিক শিক্ষার চেয়ে উপস্থাপনায় বেশি গুরুত্ব দেয়, শিক্ষার জন্য অর্থ দাবি করে এবং আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা নিয়ে গর্ব করে। অন্যদিকে পৌল তাঁর খ্যাতির জন্য সম্পূর্ণভাবে তার পরিচর্যার ফলের উপরে নির্ভর করেন। তাকে দিয়ে স্থাপিত মণ্ডলী যদি ভালভাবে না চলে তবে এটা পৌলের খ্যাতি নষ্ট করবে। করিন্থীয় মণ্ডলীর খারাপ অবস্থাই হল পৌলের ক্ষতি বা লজ্জা। পৌলকে অকার্যকর প্রমাণ করার ক্ষমতা করিন্থীয় বিশ্বাসীদের হাতেই আছে এবং তারা এটা প্রায় করেই ফেলছে। পৌল তাদের প্রতি খোলা, নম্র, আগ্রহী, গভীরভাবে সংযুক্ত। তিনি শুধু নিরাপদ দূরত্বে থেকে তাদের কিছু পরামর্শ দিচ্ছেন, তা না।
- ৫ম রূপক: প্রেরিতরা হলেন নতুন নিয়মের পরিচর্যাকারী “নতুন ব্যবস্থার কথা জানাবার জন্য … এই ব্যবস্থা অক্ষরে অক্ষরে আইন-কানুন পালনের ব্যাপার নয়, কিন্তু পবিত্র আত্মার পরিচালনায় অন্তরের বাধ্যতার ব্যাপার। … এখনকার ব্যাবস্থার মহিমা আরও অনেক বেশি” (২ করি ৩:৫-১০)। সেই বিশেষ প্রেরিতরা যারা করিন্থীয় মণ্ডলীতে খারাপ প্রভাব ফেলেছে তারা সম্ভবত যিহূদী ছিলেন বলেই পৌল এখানে নতুন ও পুরাতন ব্যবস্থা বা আইনের বিষয়টি উল্লেখ করেন (২ করি ১১:২২)। সম্ভবত তারা পুনরায় এই শিক্ষা দিত যে যিহূদী আইন-কানুন পালনের মধ্য দিয়ে বিশ্বাসীরা ধার্মক হয়। তাই পৌল পুরাতন ব্যাবস্থা এবং নতুন ব্যাবস্থার মধ্যে তুলনা দেখান:
পুরাতন ব্যাবস্থা / নিয়ম / চুক্তি | নতুন ব্যাবস্থা / নিয়ম / চুক্তি |
চিঠি অক্ষরে লিখিত | আত্মা দ্বারা লিখিত ৩:৬ |
মৃত্যু আনে ৩:৬ | আত্মা জীবন দান করেন ৩:৬ |
মৃত্যুর বিধান ৩:৭ | আত্মার বিধান ৩:৭ |
পাথরের খোঁদাই করা ৩:৩, ৩:৭ | মানুষের হৃদয়ে লেখা ৩:৩ |
অনেক মহিমাযুক্ত ৩:৭ | আরও বেশি মহিমাযুক্ত ৩:৮, ৩:৯ |
দোষারোপকারি ব্যাবস্থা ৩:৯ | নির্দোষকারী ব্যাবস্থা ৩:৯ |
এমন মহিমা যে ইস্রায়েলীয়রা তাকাতে পারেনি | ঈশ্বরের মহিমা ধারন করতে পারে |
আগে মহিমাপূর্ণ ছিল, এখন নেই বললেই চলে ৩:১০ | আগের মহিমা অতিক্রম করে গেছে ৩:১০ |
শেষ হয়ে যাচ্ছিল ৩:১১ | চিরকালের জন্য ৩:১১ |
অন্তরের উপরে পর্দা থাকে ৩:১৪ | খ্রিষ্টে তাকালে পর্দা সরে যায় ৩:১৬ |
স্বাধীনতা নেই (পাপ, অপরাধ, আইন থেকে) | প্রভু হলেন আত্মা = মুক্তি ৩:১৬ |
আইন হৃদয়কে পরিবর্তন করতে পারে না | পরিবর্তিত হয়ে যীশুর মত হয় > মহিমাপূর্ণ ৩:১৮ |
- পৌল মোশির গল্প উল্লেখ করেন, তার সিনাই পর্বত থেকে উজ্জ্বল চেহারা সহকারে নেমে আসার গল্প যেখানে তিনি পরে নিজের চেহারা ঢেকেছিলেন (যাত্রা ৩৪:২৯-৩৫)। পৌল এটা এইভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, মোশির মুখের উজ্জলতা কমে যাচ্ছিল বলেই তিনি নিজর মুখ ঢেকেছিলেন।
- পৌল তার পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেন যে উভয় চুক্তিই ছিল ঈশ্বরের কাছ থেকে, উভয় চুক্তিরই গৌরব ছিল। প্রথমটি চুক্তি ছিল দ্বিতীয় চুক্তির জন্য প্রস্তুতি, কিন্তু শুধু দ্বিতীয়টির মধ্য দেয়ে পূর্ণতা আসে – পুরাতন নিয়মের সবকিছুর পূর্ণতাই হলেন যীশু খ্রীষ্ট।
- তাবে আমরা কিভাবে পরিবর্তিত হতে সক্ষম হব? পৌল ব্যাখ্যা করেন যে আমরা নিজেদের অনেক চেষ্টা দ্বারা পরিবর্তিত হই না বরং “আমরা সবাই খোলা মুখে আয়নায় দেখা ছবির মত করে প্রভুর মহিমা দেখতে দেখতে নিজেরাও মহিমায় বেড়ে উঠে বদলে গিয়ে তাঁরই মত হয়ে যাচ্ছি। প্রভুর, অর্থাৎ পবিত্র আত্মার শক্তিতেই এটা হয়” (২ করি ৩:১৮)।
- পৌল দৃঢ়ভাবে বলেন যে তিনি পরিচর্যাকাজে নিযুক্ত হয়েছেন শুধু ঈশ্বরের অনুগ্রহের কারণে, এবং তাঁর অনুগ্রহ পেয়ে তিনি বলতে পারেন “লোকে যে সব লজাপূর্ণ কাজ করে তা আমরা একেবারেই করি না। আমরা কোন কাজে ছলনা করি না, ঈশ্বরের বাক্যে কোন ভুলের ভেজাল দিই না। আমরা বরং ঈশ্বরের সত্য প্রকাশ করে তাঁরই সামনে সব মানুষের বিবেকের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য বলে তুলে ধরি” (২ করি ৪:১-২)।
- ৬ষঠ রূপক: সত্যিকারের প্রেরিত্ব বর্ণনা করার জন্য পৌল আর একটি শক্তিশালী রূপক ব্যবহার করেন (২ করি ৪:৭- ৫:১০): “কিন্তু এই ধন মাটির পাত্রে রাখা হয়েছে, আর আমরাই সেই মাটির পাত্র। মাটির পাত্রে তা রাখা হয়েছে যেন লোকে বুঝতে পারে যে, এই অসাধারণ মহাশক্তি আমাদের নিজেদের কাছ থেকে আসে নি বরং ঈশ্বরের কাছ থেকেই এসেছে।
- সব দিক থেকেই আমাদের উপরে চাপ পড়ছে, তবু আমরা ভেংগে পড়ছি না।
- বুদ্ধিহারা হলেও আমরা সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে পড়ছি না;
- অত্যাচারিত হলেও ঈশ্বর আমাদের ত্যাগ করছেন না;
- মাটিতে আছড়ে ফেললেও আমরা ধ্বংস হচ্ছি না।
- আমরা সবসময় প্রভু যীশুর মৃত্যু আমাদের দেহে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি, যেন আমাদের দেহের মধ্যে যীশুর জীবনও প্রকাশিত হয়।”
- কারণ আমরা জানি, যিনি প্রভু যীশুকে জীবিত করেছিলেন তিনি তাঁর সংগে আমাদেরও জীবিত করবেন এবং তোমাদের সংগে আমাদেরও নিজের সামনে উপস্থিত করবেন” (২ করি ৪:১৪)।
- পৌল খোলামেলাভাবে বর্ণনা করেন যে মানুষ আসলে কতটা দুর্বল এবং সীমাবদ্ধ। তিনি জেনেশুনে ইচ্ছাকৃতভাবে বর্তমান জগতের বিশৃঙ্খলার মধ্যে অনন্ত আশা ছড়িয়ে দেন। তিনি বর্তমান সমস্যাগুলো অস্বীকার করেন না, কিন্তু তিনি চিরন্ত্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান সমস্যায়বিষয় নিয়ে আসেন। ঈশ্বরের মধ্য দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেও গৌরব আছে, আরো কত না বেশি গৌরব থাকবে যখন আমাদের শারীরিক পুনরুত্থান এবং চিরস্থায়ী পুনরুদ্ধার বাস্তব হয়ে যাবে (যেমন তিনি ১ করি ১৫ অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন)।
- এই নিশ্চয়তা আমাদের আশা দান করে (২ করি ৪:১৬-১৮, ৫:১-৫) “এইজন্য আমরা হতাশ হই না।
- যদিও আমাদের বাইরের দেহ ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে তবুও আমাদের ভিতরের মানুষ দিনে দিনে নতুন হয়ে উঠছে।
- এখন আমরা অল্পকালের জন্য যে সামান্য কষ্টভোগ করছি তার ফলে আমরা চিরকালের মহিমা লাভ করব। এই মহিমা এত বেশী যে, তা মাপা যায় না।
- যা দেখা যায় আমরা তার দিকে দেখছি না, বরং যা দেখা যায় না তার দিকেই দেখছি।
- যা দেখা যায় তা মাত্র অল্প দিনের, কিন্তু যা দেখা যায় না তা চিরদিনের।
- এই পৃথিবীতে যে তাম্বুতে আমরা বাস করি … যদি নষ্ট হয়ে যায় তবুও ঈশ্বরের দেওয়া একটা ঘর আমাদের আছে।। এই ঘর মানুষের হাতের তৈরি নয়, তা স্বর্গে চিরকাল ধরেই আছে।
- এই দেহে থাকা অবস্থায় আমরা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছি এবং সমস্ত অন্তর দিয়ে চাইছি যেন স্বর্গের সেই নতুন দেহ দিয়ে আমাদের ঢাকা হয়।
- সেই দেহ পেলে পর দেখা যাবে যে, আমরা উলংগ নই।”
- ৭ম রূপক: ২ করি ৫:১১-২১ পদে পৌল প্রেরিতদের জন্য আরও একটি রূপক ব্যাবহার করেন। তারাই খ্রীষ্টের দূত, পুনর্মিলনের পরিচর্যাকাজের সাথে সংযুক্ত। তারা এই পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ঈশ্বরের মনোনীত প্রতিনিধি, তাদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। পুনর্মিলন এবং শান্তি আনয়নের জন্য তারা দূত – বিশ্বাসীদের জন্য কত উঁচু মাপের একটি ছবি!
- চিঠির একটি আবেগীয় অংশ, অর্থাৎ ২ করি ৬:১-১৩ পদে পৌল করিন্থীয়দের অনুরোধ জানান, তারা যেন তাদের হৃদয় খুলে পৌলের প্রতি আরো সাড়া দেন। এর পরপরই আসে ২ করি ৬:১৪-১৯ পদ (যা যিহিস্কেল ৩৭:২৭, যিশাইয় ৫২:১১, ৪৩:৬, যিরমিয় ৫১:৪৫, ২ শমূ ৭:১৪, হোশেয় ২:১ পদগুলো উদ্ধৃতি বা ইঙ্গিত করে)। বিবাহের ক্ষেত্রে বিশ্বাসীদের শুধু একজন বিশ্বাসীকেই বিয়ে করা উচিত, এই শিক্ষা দেওয়ার জন্য সাধারণত এই পদ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই অনুচ্ছেদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সম্ভাবনা বেশি যে লেখক এই অংশ আসলে বিবাহের বিষয়ে লেখেন নি বরং তিনি তা লেখেন যেন করিন্থীয় বিশ্বাসীরা ভণ্ড প্রেরিতদের জোয়ালীতে আবদ্ধ না হয়। ইতিমধ্যে এই ভণ্ড প্রেরিতরা মণ্ডলীর অনেক ক্ষতি করে ফেলেছে।
- এটা একটি লক্ষণীয় বিষয় যে বেশ কয়েকটি জনপিয় বাইবেল পদ ২ করিন্থীয় থেকে আসে, যেমন “যা দেখা যায় আমরা তো তার দ্বারা চলি না, বরং বিশ্বাসের দ্বারা চলাফেরা করি” অথবা “যদি কেউ খ্রীষ্টের সংগে যুক্ত হয়ে থাকে তবে সে নতুনভাবে সৃষ্ট হল। তার পুরানো সব কিছু মুছে গিয়ে সব নতুন হয়ে উঠেছে”। এটা কি একটা চমৎকার বিষয় নয় যে এরকম হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যেও অনেক সুন্দর ও সান্ত্বনাজনক বাক্য লেখার জন্য ঈশ্বর পৌলকে ব্যাবহার করেছেন?
অর্থ সংগ্রহ ২ করিন্থীয় ৮-৯
যিরুশালেম মণ্ডলীর উদ্দেশ্যে উদারভাবে দান তোলার জন্য পৌল মাকিদনিয়া এবং আখায়ার মণ্ডলীসমূহকে উৎসাহিত করছিলেন, করিন্থীয় মণ্ডলীও ছিল এদের মধ্যে একটি (১ করি ১৬:১-৪)। পৌলের সাথে করিন্থীয়দের মতবিরোধ শুরু হওয়ার আগেই এই অর্থ সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছিল।
যীশুর সময়ে ইতিমধ্যে যিরুশালেম ও যিহূদিয়া ছিল রোম সম্রাজ্যের একটি অস্থির, এমন কি বিদ্রোহী জায়গা, কিন্তু ৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে অবস্থা দিনে দিনে আরো খারাপ হয়ে গিয়েছিল। একজন পর একজন ভ্রান্ত মশীহের নেতৃত্বে যিহূদী বিদ্রোহীরা সাধারণ জনগণকে উস্কিয়ে তুলে রোম রাজ্যের বিরুদ্ধে একটি পর একটি হিংস্র বিদ্রোহ চালিয়েছিল। রোমীয়দের চোখে সে প্রিয় রোমীয় শান্তি (Pax Romana) ও আইন-শৃঙ্খলা যিহূদীদের দ্বারা নষ্ট হচ্ছিল বলে তারা যিহূদীদের ঘৃণা করত এবং যিহূদিয়া তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য রোম সরকার এই এলাকায় অনেক সৈন্য রাখে, ব্যাবসা-বাণিজ্যের পথ (বিশেষভাবে গম সরবরাহ) আটকে দেয় এবং কঠিন ভাবে রাজত্ব করতে থাকে। এর সাথে আবার ছিল আঞ্চলিক দুর্ভিক্ষ। এবস কিছু দ্বারা সাধারণ যিহূদীরা এবং তাদের মধ্যেও যিরুশালেম মণ্ডলী প্রভাবিত হত।
পৌল করিন্থীয় বিশ্বাসীদের নিয়মিত দান সংগ্রহ করার জন্য নির্দেশ দেন। প্রত্যেক ব্যক্তি যতটুকু পারে এবং চায় তা যেন আলাদা করে জমা রাখে যেন শেষ মুহূর্তে দান তোলার সে মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যেন তা না হয। করিন্থ গত বছর থেকেই এই অর্থ সংগ্রহ করা শুরু করেছিল (২ করি ৮:১০-১১) কিন্তু খুব সম্ভবত পৌলের সাথে দ্বন্দ্ব তাদের এই উদারতার উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ম্যাসিডোনিয়া মণ্ডলীর উদারতার কথা উল্লেখ করে পৌল করিন্থীয়দের অনুপ্রাণিত করেন “তারা নিজেদেরই প্রথমে প্রভুর কাছে ও পরে ঈশ্বরের ইচ্ছামত আমাদের কাছে দিয়ে দিয়েছিল” (২ করি ৮:৫)। দান যদি একজন দেন, তা প্রথমত ঈশ্বরের কাছেই একটি দান। পৌল যীশুর কথাও স্মরণ করিয়ে দেন “তোমরা তো আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টের দয়ার দানের কথা জান যে, তিনি নিজে ধনী হয়েও তোমাদের জন্য গরীব হলেন, যেন তার গরীব হওয়ার মধ্য দিয়ে তোমরা ধনী হতে পার” (২ করি ৮:৯)।
এখানে পৌল দান দেওয়ার কিছু নীতিমালা দেখান: যার যা আছে সেই অনুসারে তার দান দেওয়া উপযুক্ত, একজনের যা নেই, সে যেন তা না দেয়। একদম দরিদ্রতায় পরে যাবে সেইভাবে যেন দান না দেয় বরং যে প্রাচুর্যের মধ্যে আছে সে যেন প্রাচুর্যের অংশ থেকে যাদের নেই তাদের সাথে ভাগ করে (২ করি ৮:১২)। দান যেন ইচ্ছুকভাবে হয়, জোর-জুলুম করে যেন দান করা না হয়। যদি বাধ্য হয়ে বা চাপে পরে দান দিতেই হবে এমন মনে হয়, যদি দান দেওয়ার মধ্যে কোন আনন্দ না থাকে তাহলে যেন দান না দেয় (২ করি ৮:১৩-১৫, ৯:৭)। ঈশ্বর প্রচুর পরিমাণে যোগান দিতে সক্ষম “যেন তোমরা সব রকম ভাল কাজের জন্য খোলা হাতে দান করতে পার” (২ করি ৯:৮-১৩)। পৌল অর্থ পরিচালনার ক্ষেত্রে সততার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জোর দেন “এই বিরাট বিলি করবার ব্যাপারে কেউ যেন আমাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে না পারে সেইজন্য আমরা এই ভাইকেও পাঠাচ্ছি। আমরা কেবল প্রভুর সামনে নয়, কিন্তু মানুষের সামনেও সৎভাবে চলবার দিকে মনোযোগ দিই” (২ করি ৮:২০-২১)। পৌল নিজে এই আর্থিক দান হাতে নেবেন না “তোমাদের সেই দান যিরুশালেমে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোমরা যাদের যোগ্য মনে করবে, আমি চিঠি দিয়ে তাদের পাঠিয়ে দেব” (১ করি ১৬:৩)।
সে বিশেষ ভ্রান্ত প্রেরিতদের বিপরীতে পৌল পরিষ্কারভাবে তার চরিত্রের পার্থক্য তুলে ধরেন “যদি কেউ তোমাদের দাস বানায়, … তোমাদের ফাঁদে ফেলে … তোমরা সেই সবও সহ্য কর” (২ করি ১১:২০)। পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে বিশেষ প্রেরিতেরা পৌলের উপরে আক্রমণ করেছিল, কারণ তিনি মণ্ডলীর কাছ থেকে কোন টাকা নেন নি (২ করি ১২:১৩)!
পৌল এবং সেই বিশেষ প্রেরিতেরা
এই বিশেষ প্রেরিতেরা কারা ছিল? তাদের সম্পর্কে আমরা বেশি কিছু জানি না। ২ করি ২:১৭ পদে পৌল তাদেরকে ঈশ্বরের বাক্যের ব্যাবসায়ী বলে অভিহিত করেন। ২ করি ৩:১ পদে পৌল উল্লেখ করেন যে তারা সুপারিশ পত্র চায় এবং এই পত্রের উপরে নির্ভর করে। ২ করি ১০:৯-১১ পদে পৌল তাদের কথাই উদ্ধৃতি করে বলেন, কোন কোন লোক বলে “তার চিঠিগুলো মনে দাগ কাটে এবং তা শক্তিশালীও বটে, কিন্তু সে কাছে থাকলে দেখা যায়, সে দুর্বল এবং তার কথা শোনবার মত এমন কিছু নয়। এই রকম লোক বুঝুক যে, আমরা অনুপস্থিত থেকে আমাদের চিঠির মধ্য দিয়ে যে কথা বলছি, উপস্থিত হলে পর তাই করব”। এই ধরণের পদ দেখে বুঝা যায় যে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে পৌল এবং তার সুসমাচারকে তুচ্ছ করছে।
পৌল আরো বিদ্রুপ সহকারে বলেন “তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের প্রশংসা করে থাকে। আমরা তাদের দলে নিজেদের ফেলতে বা তাদের সংগে নিজেদের তুলনা করতে সাহস করি না। কি মূর্খ তারা! কারণ তারা নিজেরা যা ভাল মনে করে তার সংগেই নিজেদের তুলনা করে ও তা দিয়েই নিজেদের বিচার করে। কিন্তু যতটুকু গর্ব করা উচিত তার বাইরে আমরা গর্ব করব না, বরং ঈশ্বর আমাদের কাজের যে সীমানা ঠিক করে দিয়েছেন তার মধ্য থেকেই গর্ব করব” (২ করি ১০:১২-১৩)। পৌল যোগ করে বলেন “তাতে তোমাদের কাছ থেকে গিয়ে আরও দূরের জায়গাগুলোতেও সুখবর প্রচার করতে পারব। এর ফলে কেউ বলতে পারবে না যে, অন্য লোকে যেখানে কাজ করেছে তাদের সেখানকার কাজের জন্য আমরা গর্ব করছি” (২ করি ১০:১৬)। বিশেষ প্রেরিতেরা ঠিক এটাই করে, যে মণ্ডলী ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে তারা সেটা অনধিকার দখল করে। কিন্তু আসল প্রেরিতেরা যা করে, অর্থাৎ নতুন ক্ষেত্রে সাহসীভাবে কাজ শুরু করা, এত কষ্টের কাজ তারা করতে রাজি না।
বিশেষ প্রেরিতেরা যা প্রচার করে পৌল সেটাকে অন্য যীশু, আলাদা পবিত্র আত্মা এবং ভিন্ন সুসমাচার বলে উল্লেখ করেন (২ করি ১১:৩-৬)। কথা বলার ক্ষেত্রে বেশি প্রশিক্ষিত ও দক্ষতার কারণে তারা নিজেদেরকে পৌলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দাবি করে। পৌল বলেন “আলাদা কোন রকম সুখবর যখন তোমরা পাও, তখন তো দেখছি খুশী হয়েই সেই সব মেনে নাও” (২ করি ১১:৪)। প্রতারণার মধ্য দিয়ে মণ্ডলী হারানোর বিষয় পৌল যথাযথভাবেই চিন্তিত। পৌল মণ্ডলীর কাছ থেকে কোন অর্থনৈতিক সাহায্য গ্রহণ করেন নি, তিনি নিজের প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য নিজের হাতে কাজ করেছিলেন এবং ম্যাসিডোনিয়া মণ্ডলীর কাছ থেকে উপহার হিসাবে অর্থ পেয়েছিলেন (২ করি ১১:৭-১১)। দেখে মনে হচ্ছে, পৌল যে করিন্থীয়দের কাছ থেকে টাকা নেন নি, এই বিষয়কে ব্যবহার করেই বিশেষ পেরিতেরা পৌলের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হয়েছিল।
পৌল এই বিশেষ প্রেরিতদেরকে, যারা নিজেদেরকে পৌলের সমান বলে স্বীকৃতি পেতে চায়, আরো বলেন “ভণ্ড প্রেরিত, প্রতারণাকারী কর্মী, এরা ছদ্মবেশী কর্মী হিসেবে নিজেদেরকে খ্রীষ্টের প্রেরিত বলে” (২ করি ১১:১২-১৫)। পৌলের এই বর্ণনা থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে তারা কেবল মণ্ডলীর বিভ্রান্ত বিশ্বাসী, তা নয়। বরং তারা অবিশ্বাসীরা যারা বাইরে থেকে মণ্ডলীতে প্রবেশ করেছে যেন তারা বিশ্বাসীদের প্রতারণায় ফেলে কিছু সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে। এই ধরণের খারাপ লোকদের দিয়ে প্রভাবিত হওয়ার জন্য ও তাদের বিশ্বাস করার জন্য পৌল করিন্থীয়দের ধমক দেন “শুধু তাই নয়, যদি কেউ তোমাদের দাস বানায়, তোমাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে, তোমাদের ফাঁদে ফেলে, তোমাদের মনিব হয়ে দাঁড়ায় কিম্বা তোমাদের গালে চড় মারে, তোমরা সেই সবও সহ্য কর” (২ করি ১১:১৬-২০)। করিন্থীয় বিশ্বাসীরা বাইবেলীয় চিন্তার চেয়ে গ্রীক ধরণের চিন্তাধারায় বেশি গুরুত্ব দিত, ঠিক একারণেই ভ্রান্ত প্রেরিতরা এত সহজে মণ্ডলীতে ঢুকে বড় কথা বলা দ্বারা প্রভাব ফেলতে পেরেছিল।
পৌল মরিয়া হয়ে বিশেষ প্রেরিতদের বিদ্রুপ করেন এবং তাদের সাথে নিজের পার্থক্য দেখান। তিনি করিন্থীয়দের বুঝানোর চেষ্টা করেন যে বিশেষ প্রেরিতেরা যেরকম দাবি করে, তারা কখনওই পৌলের চেয়ে সেরকম শ্রেষ্ঠ কেউ নয় (২ করি ১১:২২-২৩)। এই বিশেষ প্রেরিতেরা বিস্ময়কর দর্শন, স্বপ্ন এবং বিভিন্ন আত্মিক অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় কথা বলে বিশ্বাসীদের মুগ্ধ করে এবং নিজেদেরকে ‘খুব আধ্যাত্মিক’ হিসাবে প্রমাণ করে। পৌল বাধ্য হয়ে নিজের বিস্ময়কর দর্শন ও আত্মিক অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে দেখান যে তিনিও কোনভাবেই তাদের থেকে কম নন। অবশ্য পৌল এভাবে তর্ক করতে ঘৃণা করেন, তাই তিনি নিজেকে বোকার ভূমিকায় রাখেন এবং শুধু বিদ্রূপাত্মক কথা বলেন। এছাড়া তিনি নিজেকে অন্য একজন ব্যক্তি হিসাবে প্রকাশ করে বলেন “খ্রীষ্টে বিশ্বাসী একজন লোককে আমি চিনি” (২ করি ১২:১-১৩)।
দেখে মনে হচ্ছে বিশেষ প্রেরিতেরা এমন কি পৌলের উদ্দেশ্য ও প্রেরণা নিয়ে নিয়ে তার দোষ ধরেছিলেন “যাহোক, আমি তোমাদের বোঝা হই নি, কিন্তু হয়তো কেউ তাতে বলবে যে, আমি চালাক বলে ছলনা করে তোমাদের ভুলিয়েছি। আমি যাদের তোমাদের কাছে পাঠিয়েছিলাম তাদের কারও দ্বারা কি তোমাদের ঠকিয়েছি?” (২ করি ১২:১৬-১৭)। এটা খুব সম্ভবত তীমথিয় এবং তীতের সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই দ্বন্দ্বে পৌল এত ভিত্তিহীন আঘাত পেয়েছেন, তার চরিত্র ও উদ্দেশ্যগুলো নিয়ে এত সোমালোচনা শুনতে হয়েছে, তারপরেও করিন্থীয়দের প্রতি এত ক্ষমার হৃদয় দেখানোর পরে পৌল অনেক আবেগপূর্ণভাবে করিন্থীয়দের চ্যালেঞ্জ করে বলেন “যদি আমি তোমাদের বেশী ভালবাসি তবেঁ কি তোমরা আমাকে কম ভালবাসবে?” (২ করি ১২:১৫)।
করিন্থীয় মণ্ডলীর আশেপাশে এখনও যে সব বিশেষ প্রেরিতেরা ঘুরাঘুরি করছে ওদের নিয়ে মণ্ডলীর কি করা উচিত হবে? “ঈশ্বর আরও বলেছেন, এইজন্য তোমরা অবিশ্বাসীদের মধ্য থেকে বের হয়ে এস ও আলাদা হও” (২ করি ৬:১৪-৭:১)। এই বাক্য মণ্ডলীর বিশ্বাসীদের উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে না, এমন কি আশেপাশের যে সমস্ত অবিশ্বাসীদের কাছে সুসমাচার দিতে হবে তাদের সম্পর্কেও এটি বলা হচ্ছে না। বরং বিশেষ প্রেরিতদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে যাদেরকে বের হওয়ার দরজা দেখাতে হবে, আর এটা করিন্থীয়দেরই করতে হবে। পৌল বলছেন যে যখন তিনি আবারও মণ্ডলী পরিদর্শনে যাবেন (তৃতীয়বারের মত, ২ করি ১৩:১-৪, ১৩:১০) তখন তিনি এই বিশেষ প্রেরিত এবং যারা ওদের সংগে হাত মিলাচ্ছে তাদের প্রতি সহনশীল হবেন না। পৌল করিন্থে যাওয়ার আগে মণ্ডলী যেন নিজেদেরকে গুছানোর জন্য আরও সময় পায় এবং বিশেষ প্রেরিতেরা যেন চলে যাওয়ার সময় পায় এর জন্য তিনি ২য় করিন্থীয় চিঠি লিখেন।
করিন্থীয় মণ্ডলীর আশেপাশে এখনও যে সব বিশেষ প্রেরিতেরা ঘুরাঘুরি করছে, তাদের নিয়ে মণ্ডলীর কি করা উচিত? পৌল বলেন “ঈশ্বর আরও বলেছেন, এইজন্য তোমরা অবিশ্বাসীদের মধ্য থেকে বের হয়ে এস ও আলাদা হও” (২ করি ৬:১৪-৭:১)। কার কাছ থেকে তারা আলাদা হবে? এমন না যে পৌল বাধ্য বিশ্বাসীদের বলেন প্রতারিত বিশ্বাসীদের থেকে আলাদা হতে। এমন না যে পৌল বিশ্বাসীদের বলেন আশেপাশের অবিশ্বাসীদের থেকে আলাদা হতে, যাদের সুসমাচার প্রয়োজন। বরং পৌল বিশ্বাসীদের এই বিশেষ প্রেরিতদের থেকে আলাদা হতে বলেন, জরুরীভাবে। এছাড়া পৌল বলন যে তিনি শীঘ্রই তৃতীয় পরিদর্শনে করিন্থী মণ্ডলীর কাছে আসবেন (২ করি ১৩:১-৪, ১৩:১০)। সে সময় তিনি এই বিশেষ প্রেরিত এবং যারা প্রতারণা থেকে বের হয় না, তাদের প্রতি সহনশীল হবেন না (২ করি ১৩:১-১০)। পৌল করিন্থে যাওয়ার আগে মণ্ডলী যেন নিজেদেরকে গুছানোর জন্য আরো সময় পায় এবং বিশেষ প্রেরিতেরা যেন চলে যাওয়ার সময় পায় এর জন্যও তিনি ২য় করিন্থীয় চিঠি লেখেন।
এই বিশেষ প্রেরিতদের প্রভাব এবং ভুল শিক্ষার কারণে মণ্ডলীতে বেশ ভাল পরিমাণে অধার্মিকতা চলছিল। এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে এই ধরণের মন্দ চরিত্রের দুর্নীতিবাজ ভণ্ড শিক্ষকদের গ্রহণ করার ফলে মণ্ডলীর নৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল (২ করি ১২:১৯-২১)। কিন্তু যারা পাপ করছে মণ্ডলীর সেই সদস্যদেরকে পৌল বিশ্বাসী বলে সম্বোধন করেন “তোমরা কি বোঝ না যে, খ্রীষ্ট যীশু তোমাদের অন্তরে আছেন?” (২ করি ১৩:৫)। পৌল প্রতারক শিক্ষকদের ইচ্ছাকৃতভাবে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন, কিন্তু যে সমস্ত বিশ্বাসীরা বিভ্রান্ত এবং প্রতারিত, তাদেরকে তিনি অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগ দেন ও তাদের অনুতপ্ত হওয়ার কারণ দেখান। কিভাবে প্রতারণার মোকাবেলা করতে হয়, সেই বিষয়ে পৌল এখানে পথ দেখান। ইচ্ছাকৃত প্রতারণার কোনভাবে সহ্য করা যাবে না, কিন্তু প্রতারিতদের উভয় অনুগ্রহ দিতে হবে এবং তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.org দেখুন।