পৌল তীমথিয়ের কাছে তার এই শেষ চিঠি লেখেন জেনে যে তিনি শীঘ্রই মারা যাবেন। তিনি তার জীবনের পরিচর্যার ভার – সুখবর ছড়িয়ে দেওয়া ও মণ্ডলীগুলোর যত্ন নেওয়া – তার বিশ্বস্ত ও বহুদিনের সহকর্মী তীমথিয়ের কাছে হস্তান্তর করেন।
পৌল জেল থেকে বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছেন (ইফিষীয়, ফিলিপীয়, কলসীয়, ফিলীমন) কিন্তু ২ তীমথিয় চিঠি ভিন্ন: পৌল আবারও জেলে আছেন কিন্তু এইবার তিনি জানেন যে আর মুক্তির আশা নেই, তিনি শীঘ্রই মারা যাবেন: “আমাকে এখন উৎসর্গ হিসাবে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে; আমার মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয়েছে। খ্রীষ্টের পক্ষে আমি প্রাণপণে যুদ্ধ করেছি, আমার জন্য ঠিক করা পথের শেষ পর্যন্ত দৌড়েছি এবং খ্রীষ্টীয় ধর্ম-বিশ্বাসকে ধরে রেখেছি” (২ তীম ৪:৬-৭)। তাতে বুঝা যায় যে পৌল রোম শহরে নীরোর সে কঠোর অত্যাচারে বন্দী হয়েছেন। মণ্ডলীর ঐতিহ্য অনুসারে তিনি এই অত্যাচারে শহীদ মৃত্যু গ্রহণ করেন। ২ তীমথিয় চিঠিতে তাই একটি বিশেষ ভাব পাওয়া যায়: জীবনের পরিচর্যার ভার আর একজনের কাছে হস্তান্তর করা, পরবর্তী প্রজন্মকে উত্তরাধিকার দান করা বা দৌড়ে লাঠি সামনের লোকের হাতে দেওয়া (relay race)।
পৌল চিঠি লেখার সময় কষ্টে আছেন এবং তিনি যথেষ্ট নিরাশিত: “প্রথম বার যখন আমার বিচার হয়েছিল তখন কেউ আমাকে সাহায্য করে নি, বরং সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল; তবে এটা যেন তাদের বিরুদ্ধে ধরা না হয়” (২ তীম ৪:১৬)। রোম শহরে কি কাপড়ের অভাব পড়েছে যে তীমিথিয়কে ত্রোয়া থেকে পৌলের কাপড় নিয়ে আসতে হচ্ছে (২ তীম ৪:১২)? চিঠিতে বুঝা যায় যে পৌল এই সময় বেশ একা পড়ে আছেন, কিছু সহকর্মী তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে (যেমন দীমা, ২ তীম ৪:৯), অন্য সহকর্মীদের তিনি নানা প্রয়োজনীয় কাজে পাঠিয়েছিলেন (যেমন ক্রীষ্কেন্ত, তীত ও তুখিক, ২ তীম ৪:১০,১২), অন্য সহকর্মীদের তিনি আর একবার দেখতে আশা করেন (যেমন মার্ক ও তীমথিয়, ২ তীম ৪:১১)।
পৌল এই চিঠি তার “প্রিয় সন্তান তীমথিয়ের” কাছে লেখেন (২ তীম ১:২), যিনি তার বহুবছরের বিশ্বস্ত সহকর্মী। পৌলের চেয়ে তীমথিয়ের বয়স অনেক কম এবং তাদের স্বভাব-চরিত্র ও ব্যক্তিত্বও যথেষ্ট ভিন্ন। পৌল হলেন শক্তিশালী প্রেরিত, নতুন কিছু ঘটানোর আগ্রহের লোক, যাকে থামানো যায় না, যিনি অনেক কষ্টভোগেও হাল ছেড়ে দেন না। তীমথিয় হল তার বিশ্বস্ত সহকর্মী, লাজুক, হতে পারে অন্তর্মুখী, মিশুক, যার কাছে সহজে আসা যায়, যার জন্য সামনে দাঁড়ানো ও হাল ধরা চ্যালেঞ্জ। তারপরেও তীমথিয় হলেন সেই লোক যার উপর পৌলের অনেক বিশ্বাস ও ভরসা আছে এবং যার কাছে তিনি তার জীবনের পরিচর্যা হস্তান্তর করেন। এই দুইজন অতি ভিন্ন ব্যক্তিত্বের লোকদের মধ্যে যে গভীর বন্ধুত্ব ও ভরসা আছে, এটি শক্তিশালী একটি সাক্ষ্য হিসাবে দাঁড়ায়।
এই চিঠিতে পৌল তীমথিয়কে ভ্রান্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বলেন যেন তারা মণ্ডলীর উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে না পারে। এই ভ্রান্ত শিক্ষকরা “ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি-হীন ও বাজে কথাবার্তা” (২ তীম ২:১৬), “বাজে কথা নিয়ে তর্কাতর্কি” (২ তীম ২:১৪) করতে ব্যস্ত যা দ্বারা “শেষ পর্যন্ত ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি” হয় (২ তীম ২:২৩)। তারা দাবি করে যে যীশুর দ্বিতীয় আগমন ইতিমধ্যে ঘটে গেছে (২ তীম ২:১৮)। হতে পারে তারা অস্বীকার করে যে যীশু মানুষ, অথবা তারা অস্বীকার করে যে যীশু ঈশ্বর। উত্তরে পৌল গুরুত্বের সঙ্গে বলেন যে যীশু দায়ূদ বংশের লোক (তাই মানুষ) এবং যে তিনি মৃত্যু থেকে উঠেছেন যেভাবে আর কোনো মানুষের ক্ষেত্রে হয় নি (২ তীম ২:৮)।
১ তীমথিয় চিঠির মত ২ তীমথিয় চিঠির একটি বড় বিষয় হল ভাল ও খারাপ নেতৃত্ব। পৌল তীমথিয়কে উৎসাহিত করেন যেন তিনি ”যার উপর ঈশ্বর সন্তুষ্ট, অর্থাৎ যার লজ্জা পাবার কোন কারণ নেই সেই রকম কাজের লোক হিসাবে এবং যে নির্ভুল ভাবে সত্যের বাক্য শিক্ষা দেয় সেই রকম লোক হিসাবে নিজেকে ঈশ্বরের সামনে উপস্থিত করবার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী” হন (২ তীম ২:১৫)। নেতৃত্ব বোঝানোর জন্য পৌল শক্তিশালী রূপক ব্যবহার করেন: নেতা হল একজন সৈনিকের মত, যে কষ্ট সহ্য করে এবং অফিসারকে সন্তুষ্ট করে (২ তীম ২:২-৪)। নেতা হল এমন একজনের মত যে প্রতিযোগিতার খেলায় যোগ দেয় ও নিয়ম মত খেলে (২ তীম ২:৫)। নেতা হল কৃষকের মত, যে পরিশ্রম করে কিন্তু যার ফসল থেকে প্রধান অংশ পাওয়ার অধিকার অবশ্যই আছে (২ তীম ২:৬-৭)। পৌল তীমথিয়কে চ্যালেঞ্জ করেন যেন তিনি “ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি-হীন ও বাজে কথাবার্তা” যাতে “ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি” হয়, তা থেকে দূরে থাকেন (২ তীম ২:১৬,২৩)। বরং যেন তিনি “দয়ালু” হন, তার মধ্যে যেন “অন্যদের শিক্ষা দানের ক্ষমতা ও সহ্যগুণ” থাকে, যেন তিনি বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর লোকদের “নম্রভাবে শিক্ষা” দেন (২ তীম ২:২৪-২৫), যেন তিনি পৌলের আদর্শ অনুসারে জীবন-যাপন করেন (নিরাময় ও সঠিক শিক্ষা দান, ঈশ্বরীয় জীবন-যাপন, প্রাণপণে পরিচর্যার কাজে ছুটে চলা, বিশ্বাস, ভালবাসা, ধৈর্য্য ও কষ্ট সহ্য করার মনোভাব, ২ তীম ৩:১০-১২)। তীমথিয়ের কাছে পৌলের মৌলিক কথা এই: ‘তুমি ভাল করছ, ভাল করতেই থাক!’
পৌল ভবিষ্যতের জন্যও চিন্তা করেন। তিনি তীমথিয়কে শিক্ষা ও শিষ্যত্ব দেওয়া দ্বারা অন্যদের গড়ে তুলতে বলেন, যেমন পৌল তাকে গড়ে তুলেছিলেন: “আমার মুখে যে সব শিক্ষার কথা তুমি শুনেছ সেই শিক্ষা ধরে রাখবার জন্য তুমি তা এমন সব বিশ্বস্ত লোকদের দাও যাদের অন্যদের শিক্ষা দেবার যোগ্যতা আছে” (২ তীমথ ২:২)। পৌল নিশ্চিত করতে চান যেন সুখবর ও শিষ্যত্ব প্রজন্মের পর প্রজন্মে চলতে থাকে। এই পদে পৌল গ্রীক ভাষায় এমন সর্বনাম ব্যবহার করেন যা পুরুষ ও মহিলা উভয় বুঝায়। তাই পৌল চান যে উভয় বিশ্বস্ত পুরুষ এবং বিশ্বস্ত মহিলা শিক্ষা ও শিষত্ব দান করতে থাকুক।
পৌল তীমথিয়কে স্মরণ করেন যে পবিত্র আত্মা “ভীরুতার আত্মা” নন, বরং “শক্তির, প্রেমের ও সুবুদ্ধির” বা স্বনিয়ন্ত্রণের আত্মা (২ তীম ১:৭)। তিনি তাকে গুরুত্বের সঙ্গে আদেশ দেন, যেন সুখবর প্রচার করতে ও শিক্ষা দিতে থাকেন (২ তীম ৪:১-২,৫)। পৌল তার সে নিশ্চয়তা তীমথিয়কে দিয়ে দেন: “আমি লজ্জিত নই, কারণ আমি জানি কার উপর নির্ভর করেছি। আমি নিশ্চয় করে জানি যে, আমি তাঁর কাছে যা রেখেছি, খ্রীষ্টের আসবার দিনের জন্য তা রক্ষা করবার ক্ষমতা তাঁর আছে” (২ তীম ১:১২)।
লেখক এবং লেখকের পরিস্থিতি
পৌল ২ তীমথিয় চিঠি শুরুতে তার পরিচয় এভাবে দেন: “খ্রীষ্ট যীশুর মধ্য দিয়ে অনন্ত জীবনের প্রতিজ্ঞা অনুসারে ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমি পৌল খ্রীষ্ট যীশুর একজন প্রেরিত্ হয়েছি” (২ তীম ১:১)। ২ তীমথয় হল বন্দী অবস্থা থেকে পৌলের শেষ চিঠি। যখন পৌল বন্ধন থেকে আগে চিঠি লিখেছিলেন (যেমন ইফিষীয়, ফিলিপীয়, কলসীয়, ফিলীমন, ৬২ খ্রীঃ) তখন তার আবার মুক্ত হওয়ার আশা ছিল। কিন্তু এই চিঠিতে তার মুক্তি পাওয়ার আশা আর নেই: “আমাকে এখন উৎসর্গ হিসাবে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে; আমার মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয়েছে। খ্রীষ্টের পক্ষে আমি প্রাণপণে যুদ্ধ করেছি, আমার জন্য ঠিক করা পথের শেষ পর্যন্ত দৌড়েছি এবং খ্রীষ্টীয় ধর্ম-বিশ্বাসকে ধরে রেখেছি” (২ তীম ৪:৬-৭)। হয়তে এর জন্য তিনি চিঠির শুরুতএ অনন্ত জীবনের প্রতিজ্ঞা উল্লেখ করেন। মুক্ত হওয়ার আশা নেই বলে বুঝা যায় যে পৌল চিঠিটি নীরোর অত্যাচারের সময়ে রোম শহরে কঠিন বন্ধন থেকে লিখেছিলেন (৬৪-৬৭ খ্রীঃ)। মণ্ডলীর ঐতিহ্য অনুসারে এই অত্যাচারে পৌলকে কতল করে মেরে ফেলা হয়। পৌল যে রোম শহর থেকে লেখেন তা আরো সমর্থন পায় কারণ চিঠির শেষে যে চারজন বিশ্বাসী সুভেচ্ছা দেয় তাদের সবার নাম ল্যাটিন (২ তীম ৪:২১)।
২ তীমথিয় চিঠি পড়লে বুঝা যায় যে পৌল এখানে রিলেই-ধাবনের মত তার দায়িত্ব তীমথিয়ের কাছে হস্তান্তর করেন। চিঠিটি হল একটি শেষ কথা, একটি চুড়ান্ত সাক্ষ্য বা একটি উত্তরাধিকার দানের মত। জেলখানায় পৌলের কষ্ট এবং তার বর্তমান নিরাশা তিনি তীমথিয়ের সাথে শেয়ার করেন: ”প্রথম বার যখন আমার বিচার হয়েছিল তখন কেউ আমাকে সাহায্য করে নি, বরং সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল; তবে এটা যেন তাদের বিরুদ্ধে ধরা না হয়” (২ তীম ৪:১৬)। তিনি তীমথিয়কে অনুরোধ করেন ত্রোয়া থেকে তার কাপড় আনতে (২ তীম ৪:১২) – রোমে কোন কাপড় নেই যা পৌলকে দেওয়া যেত? আসলে পৌল অনেক একা হয় পড়েছে, কিছু সহকর্মী চলে গেছেন (যেমন দীমা, ২ তীম ৪:৯), অন্যদের তিনি খুব প্রয়োজনীয় কাজে পাঠিয়েছেন (ক্রীষ্কেন্ত, তীত, তুখিক, ২ তীম ৪:১০,১২), অন্যদের তিনি আশা করেন যে আর একবার দেখেন (যেমন মার্ক ও তীমথিয়, ১ তীম ৪:১১)।
চিঠির প্রাপক তীত
পৌল চিঠিটি “আমার প্রিয় সন্তান তীমথিয়ের কাছে” লেখেন (২ তীম ১:২), যিনি পৌলের দীর্ঘ দিনের বিশ্বস্ত সহকর্মী। তীমথিয়ের বয়স পৌলের চেয়ে অনেক বছর কম এবং এই দুজনের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বও অনেক ভিন্ন। পৌল হলেন একজন অগ্রগামী, একজন শক্তিশালী প্রেরিত যাকে অনেক অত্যাচার ও কষ্টভোগের পরেও থামানো বা পরাজিত করা যায় না। তীমথি হলেন তার বিশ্বস্ত সহকারী, একজন লাজুক ও অন্তর্মুখী, এমন একজন যাকে কেউ ভয় পায় না এবং যিনি পদক্ষেপ নেওয়া বা হাল ধরে সহজ মনে করে না। তারপরেও ঠিক সেই তীমথিয়ের উপরে পৌলের অনেক বিশ্বাস এবং পৌল তার জীবনের পরিচর্যার রক্ষা ও নানা মণ্ডলী দেখাশুনা করার দায়িত্ব সে তীমথিয়ের হাতেই সমর্পিত করেন। এই দুজন এত ভিন্ন হওয়ার পরেও তাদের মধ্যে কত যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব ছিল, কত যে বিশ্বাস ছিল – তা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি।
তীমথিয়ের জীবন ও চরিত্র
যাত্রা | সাল | পদ | বর্ণনা |
১ম | ৪৮-৪৯ খ্রীঃ | প্রেরিত ১৮:১-২৩, ২ তীম ৩:১০-১১ | তীমথিয়ের পৌল ও বার্ণবার সঙ্গে দেখা হয়, সুসমাচার পান ও বিশ্বাসী হয়ে যান। |
২য় | ৫০ খ্রীঃ | প্রেরিত ১৬:১-৩ | তীমথিয়ের সুনাম আছে। তিনি পৌল ও সীলের দলে যোগ দেন। পৌল তাকে সুন্নত করেন। |
৫০ খ্রীঃ | প্রেরিত ১৭:১৪-১৫ | তীমথিয় ও সীল বিরিয়াতে থাকে যখন পৌল এথেন্সে যান। | |
৫০ খ্রীঃ | প্রেরিত ১৮:৫ | তীমথিয় ও সীল এথেন্সে ও করিন্থে যান, পৌলের সাথে আবার মিলিত হয় | |
৫০ খ্রীঃ | ১ থিষ ৩:২, ৩:৬ | তীমথিয়কে অত্যাচারিত থিষালনীকীয় মণ্ডলীর কাছে ফিরে পাঠানো হয় যেন খোঁজ নেন তারা কেমন। | |
৫০ খ্রীঃ | ১ থিষ ১:১ | তীমথিয় পৌলকে রিপোর্ট দেন, ১ম থিষলনীকীয় চিঠির সহ-লেখক হন ও হতে পারে চিঠিটি পৌঁছিয়ে দেন। | |
৫১ খ্রীঃ | ২ থিষ ১:১ | তীমথিয় পৌলকে রিপোর্ট দেন, ২য় থিষলনীকীয় চিঠির সহ-লেখক হন ও হতে পারে চিঠিটি পৌঁছিয়ে দেন। | |
৫১-৫২ খ্রীঃ | তীমথিয় পৌল, সীল, প্রিস্কা ও আকিলার সঙ্গে করিন্থ শহরে পরিচর্য্যা করেন। | ||
৫২ খ্রীঃ | তীমথিয় পৌল ও সীলের সঙ্গে ইফিষ, যিরূশালেম ও আন্তিয়খিয়ায় যান। | ||
৩য় | ৫৩ খ্রীঃ | তীমথিয় পৌল ও তার দলের সঙ্গে ইফিষে যান ও পরিচর্য্যা করেন। | |
? | প্রেরিত ১৯:২২ | পৌল তীমথিয় ও ইরাস্তকে ম্যাসিদোনিয়ায় পাঠান। | |
৫৫ খ্রীঃ | ১ করি ৪:১৭ ১ করি ১৬:১০ | করিন্থ মণ্ডলী সম্বন্ধে খারাপ রিপোর্ট পেয়ে পৌল তীমথিয়কে করিন্থে পাঠান দেখার জন্য তার চিঠি (১ করিন্থীয়) কেমন মেনে নেওয়া হয়েছে। | |
৫৬ খ্রীঃ | ২ করি ২:১ | তীমথিয় করিন্থ থেকে খারাপ রিপৌর্ট নিয়ে আসে। উত্তরের পৌল তাড়াতাড়ি করিন্থে যান। | |
৫৬ খ্রীঃ | ২ করি ১:১ | পৌল ও তীমথিয় তীতের অপেক্ষায় ত্রোয়া ও ম্যাসিদোনিয়ায় যান। তীমথিয় ২য় করিন্থীয় চিঠির সহলেখক হন। | |
৫৭ খ্রীঃ | প্রেরিত ২০:৪-৫ | করিন্থে যাওয়ার পরে তীমথিয় পৌলের সঙ্গে ম্যাসিদোনিয়া, ত্রোয়া ও যিরূশালেমে যান। | |
৫৭-৬২ খ্রীঃ | কিছু উল্লেখ নেই। হয়তো তিনি কৈসরিয়ায় ও রোমে বন্দী পৌলের সঙ্গে থাকেন। | ||
৪র্থ | ৬২ খ্রীঃ | পিলী ১:১, কল ১:১, ফিলী ১ | তীমথিয় রোমে পৌলের সঙ্গে আছেন। তিনি ফিলিপীয়, কলসীয় ও ফিলীমনের চিঠির সহ-লেখক হয়ে যান। |
৬২-৬৪ খ্রীঃ | ১ তী ১:৩ | পৌল তীমথিয়কে ইফিষে রেখে যান (?)। | |
৬৪ খ্রীঃ | ২ তী ৪:৯ | পৌল তীমথিয়কে অনুরোধ করেন যেন তিনি তার মৃত্যুর আগে তার কাছে আসেন। ত্রোয়ার কার্প থেকে জিনিষ-পত্র নিয়ে আসতে বলেন। | |
৬৪ খ্রীঃ ? | ইব্রীয় ১৩:২৩ | তীমথিয় বন্দী করা হয়েছে, উদ্ধার আবারও পেয়েছেন। | |
৮১ খ্রীঃ | মণ্ডলীর ঐতিহ্য | ইফিষে একটি দেবতা-পূজার পর্বে তীমথিয়কে লাঠি দিয়ে মেরে ফেলা হয়। |
তীমথিয় হলেন লূস্ত্রা শহরের একজন যুবক। তার বাবা গ্রীক ও তার মা যিহূদী, তবুও তাকে সুন্নত করা হয় নি। লূস্ত্রা ও কাছের ইকনিয় শহরে তীমিথিয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে (প্রেরতি ১৬:১-৩)। যদিও মণ্ডলীর স্থাপন থেকে পৌলের দ্বিতীয় পরিদর্শন পর্যন্ত বেশি সময় যায় নি (সর্বোচ্চ ২ বছর) যুবক তীমথিয় ইতিমধ্যে একজন মনে-প্রাণের ও আদর্শ বিশ্বাসী হয়ে গেছেন। তিনি সবার সামনে তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য দিয়েছিলেন (১ তীম ৬:১২)। তীমথিয় দিদিমা লোয়ী ও তার মা উনীকীর হতে পারে তার আগে বিশ্বাসী হয়েছিলেন (২ তীম ১:৫) এবং তারা তীমথিয়কে ছোটবেলা থেকে গুরুত্বের সঙ্গে যে পবিত্র শাস্ত্রের বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন যা “উদ্ধার পাবার জ্ঞান দিতে পারে” (২ তীম ৩:১৫)। তা ছাড়া তীমথিয় পৌল থেকে শিক্ষা লাভ করতে থাকে; তিনি তার “চালচলন, উদ্দেশ্য, বিশ্বাস, সহ্যগুন ও ধৈর্য ভাল করে লক্ষ্য” করার যথেষ্ট সুযোগ। তিনি হতে পারে এমন কি লূস্ত্রায় পৌলের প্রায়-মৃত্যু নিজের চোখে দেখেছেন এবং তাই ভাল জানেন প্রেরিত হওয়া মানি কি (২ তীম ৩:১০-১১, প্রেরিত ১৪, ৪৭-৪৮ খ্রীঃ)। লক্ষণীয় বিষয় যে তীমথিয় অল্প বয়স ও একটু লাজ্জুক যুবক হলেও পৌলের শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ও তার ত্যাগ-স্বীকারের জীবন দেখে ভয় পায় না।
তীমথিয়ের বসয় কত যখন পৌল তাকে সহকর্মী হিসাবে নিযুক্ত করেন? তা সম্পূর্ণ জানা যাচ্ছে না কিন্তু বেশ কিছু বছর পরে (হয়তো এমন কি চোদ্দ বছর পরে, তা ১ তীমথিয় চিঠি লেখার তারিখের উপর নির্ভর করে) পৌল তীমথিয়কে এখনও বলেন: “তুমি যুবক বলে কেউ যেন তোমাকে তুচ্ছ না করে” (১ তীম ৪:১২)। তাই বুঝা যায় যে তীমথিয়ের বয়স আসলে খুব কম যখন তিনি পৌলের দলে প্রথম যোগ দেন।
দেখা যায় যে তীমথিয়ের কিছু উৎসাহ প্রয়োজন যেন তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে পরিচর্যার কাজে দিয়ে দেন। পৌল তাকে বলেন “মণ্ডলীর নেতারা যখন তোমার উপরে তাঁদের হাত রেখেছিলেন তখন নবী হিসাবে কথা বলবার মধ্য দিয়ে যে বিশেষ দান তোমাকে দেওয়া হয়েছিল সেই দান তুমি অবহেলা কোরো না” (১ তীম ৪:১৪) এবং “তোমার উপর আমার হাত রাখবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বর তোমাকে যে বিশেষ দান দিয়েছেন তা আবার জাগিয়ে তোলো” (২ তীম ১:৬)। পৌল তীমথিয়ের ক্ষেত্রে এই আদেশ দিতে প্রয়োজন মনে করেন: “তুমি যুবক বলে কেউ যেন তোমাকে তুচ্ছ না করে। কথায়, চালচলনে, ভালবাসায়, বিশ্বাসে এবং পবিত্রতায় তুমি বিশ্বাসীদের কাছে আদর্শ হও” (১ তীম ৪:১২)। তিনি তাকে আরো চ্যালেঞ্জ করেন যেন তিনি প্রচার, শিক্ষা দান এবং “পবিত্র শাস্ত্র পড়ে শোনানোর” ক্ষেত্রে আরো এগিয়ে যান (১ তীম ৪:১৩-১৫)। পৌল করিন্থীয় বিশ্বাসীদের বলেন যেন তারা তীমথিয়ের প্রতি ভাল ব্যবহার করেন (১ করি ১৬:১০)। তিনি তীমথিয়কে এমন একজন কাজের লোক হতে বলেন “যে নির্ভুল ভাবে সত্যের বাক্য শিক্ষা দেয়” (২ তীম ২:১৫) এবং তাকে উৎসাহিত করেন যে “ঈশ্বর আমাদের ভয়ের মনোভাব দেন নি; তিনি আমাদের এমন মনোভাব দিয়েছেন যার মধ্যে শক্তি, ভালবাসা ও নিজেকে দমনে রাখবার ক্ষমতা রয়েছে” (২ তীম ১:৮)। এই পদগুলি দেখে বুঝা যায় যে তীমথিয় তেমন স্বক্রিয় বা দুসাহসী প্রেরিত, সুযোগ খুঁজে পাওয়া, সামনে দাঁড়ানো বা নেতৃত্ব ধরার কোন লোক ছিলেন না, হাসি-খুশি নিশ্চিন্তে কিছু ঘটানোরও লোক ছিলেন না বরং শান্ত, একটু লাজ্জুক ও সংকোচের লোক। তাই যদিও পৌল ও তীমথিয়ের ব্যক্তিত্ব বা স্বভাব বেশ ভিন্ন ছিল তবুও পৌল ঠিকই তাকে দলের জন্য নিযুক্ত করেন। তারা বেশ ভিন্ন লোক হলেও তারা বহুবছর একসাথে কাজ করেন এবং তাদের মধ্যে গভীর একটি বন্ধুত্ব ছিল।
পৌল তীমথিয়ের ক্ষেত্রে খুব সুন্দর সুপারিশ দেন তার সহকর্মী হিসাবে (রোমীয় ১৬:২১) এবং “প্রিয় ও বিশ্বস্ত সন্তান” হিসাবে (১ করি ৪:১৭)। পৌল তীমথিয় সম্বন্ধে বলেন: “আমার সংগে এমন আর কেউ নেই, যে তীমথিয়ের মত করে সত্যিই তোমাদের জন্য চিন্তা করে। অন্য সকলে যীশু খ্রীষ্টের ব্যাপারে ব্যস্ত না থেকে নিজেদের ব্যাপারেই ব্যস্ত থাকে। কিন্তু তোমরা জান যে, তীমথিয় তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন, কারণ যেভাবে ছেলে বাবার সংগে কাজ করে সেইভাবেই তিনি আমার সংগে যীশু খ্রীষ্টের বিষয়ে সুখবর প্রচারের কাজে পরিশ্রম করেছেন” (ফিলি ২:২০-২২)।
পরিচর্যার ক্ষেত্রে তীমথিয় বৃদ্ধি পেতে থাকেন বলে পৌল তাকে আরো বেশি অধিকার ও আরো কঠিন দায়িত্ব দেন: “তুমি ইফিষ শহরেই থাক, যাতে কতগুলো লোককে নির্দেশ দিতে পার যেন তারা আর ভুল শিক্ষা না দেয়” (১ তীম ১:৩), “তুমি এই সব বিষয়ে আদেশ ও শিক্ষা দাও” (১ তীম ৪:১১), “যে দাস খ্রীষ্টে বিশ্বাসী মনিবের অধীন সে যেন বিশ্বাসী ভাই বলেই সেই মনিবকে তুচ্ছ না করে বরং আরও ভালভাবে তাঁর সেবা করে, কারণ তার সেবায় যিনি উপকার পাচ্ছেন তিনি তো বিশ্বাসী এবং তার প্রিয়। এই সব বিষয় শিক্ষা দাও এবং উপদেশ দাও” (১ তীম ৬:২), “এই সব কথা লোকদের মনে করিয়ে দিতে থাক। ঈশ্বরের সামনে তাদের সাবধান করে দাও” (২ তীম ২:১৪) এবং “ঈশ্বরের বাক্য প্রচার কর; সময়ে হোক বা অসময়ে হোক, সব সময়েই প্রচারের জন্য প্রস্তুত থাক; খুব ধৈর্যের সংগে শিক্ষা দিয়ে লোকদের দোষ দেখিয়ে দাও, তাদের সাবধান কর ও উপদেশ দাও” (২ তীম ৪:২)।
পৌলের জীবনের শেষে তিনি সুসমাচার আরো বিস্তার ও নানা মণ্ডলী দেখাশুনার দায়িত্ব এই তীমথিয়ের কাছে হস্তান্তর করেন।
ভান্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো
২ তীমথিয় পুস্তকের একটি বড় বিষয় হল ভ্রান্ত শিক্ষা। পৌলকে যেমন অনেক বার করতে হয়েছে, তীমথিয়কেও ভ্রান্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মণ্ডলীতে তাদের প্রভাবের প্রতিরোধ করতে হবে। পৌল এই উদ্দেশ্যে তীমথিয়কে এই পুস্তকে দিক-নির্দেশনা দেন।
ভ্রান্ত শিক্ষকরা ঠিক কি শিক্ষা দেয় বা কি আচরণ করে? পৌল তীমথিয় তাদের ধরণের আচরণ থেকে দূরে থাকতে বলেন যেমন “ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিহীন ও বাজে কথাবার্তা” (২ তীম ২:১৬), “বাজে কথা নিয়ে তর্কাতর্কি” (২ তীম ২:১৪), “বাজে, মূর্খ তর্কাতর্কি” কারণ “তুমি তো জান সেগুলো শেষ পর্যন্ত ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি করে” (২ তীম ২:২৩)। পৌল তাদের বিষয়ে বলেন “এরা ঈশ্বরের সত্য থেকে দূরে সরে গেছে। এরা বলে, বিশ্বাসীদের মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে ওঠা আগেই হয়ে গেছে। এরা কারও কারও বিশ্বাসকে নষ্ট করে ফেলেছে” (২ তীম ২:১৮)। বোধ হয় যে তারা ঈশ্বরের দয়া অস্বীকার করে কারণ পৌল গুরুত্বের সঙ্গে বলেন যে “আমাদের কোন কাজের জন্য তিনি (ঈশ্বর) তা করেন নি, বরং তাঁর উদ্দেশ্য এবং দয়ার জন্যই করেছেন। জগৎ সৃষ্ট হবার আগে খ্রীষ্ট যীশুর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর দয়া আমাদের দান করেছিলেন” (২ তীম ১:৯)। হতে পারে তারা হয় যীশু যে মানুষ ছিলেন তা অস্বীকার করে, না হয় যীশু যে ঈশ্বরই ছিলেন তা অস্বীকার করে। তা বুঝা যায় কারণ পৌল গুরুত্বের সঙ্গে বলেন যে যীশু ছিলেন দায়ূদের একজন বংশধর (তাই মানুষ) এবং যে তিনি মৃত্যু থেকে উঠেছিলেন (২ তীম ২:৮)। ভ্রান্ত শিক্ষকরা দোষী কারণ তারা জনপ্রিয় হওয়ার জন্য লোকদের যা তারা শুনতে চায় তা-ই শোনায় কিন্তু লোকদেরও দোষ আছে কারণ তারা এই ধরণের শিক্ষায় আকৃষ্ট: “এমন সময় আসবে যখন সত্য শিক্ষা লোকের সহ্য হবে না, বরং নিজেদের ইচ্ছা পূর্ণ করবার জন্য তারা এমন অনেক শিক্ষক যোগাড় করবে যারা তাদের খুশী করবার মত শিক্ষা দেবে” (২ তীম ৪:৩)।
পৌল তীমথিয়কে সাবধাণবাণী দেন: “এই কথা মনে রেখো যে, শেষ কালে ভীষণ সময় উপস্থিত হবে। ২ মানুষ কেবল নিজেকেই ভালবাসবে, টাকার লোভী হবে, গর্ব করবে, সবাইকে তুচ্ছ করবে, সকলের দুর্নাম করবে, আর মা-বাবার অবাধ্য হবে। তারা অকৃতজ্ঞ ও ভক্তিহীন হবে, ৩ তাদের মধ্যে স্নেহ-ভালবাসা থাকবে না, আর তারা ঝগড়া করে আপোস করবে না। তারা পরের নিন্দা করবে, নিজেকে দমন করতে পারবে না, নিষ্ঠুর হবে, আর যা ভাল তা ঘৃণা করবে। ৪ তারা বিশ্বাসঘাতক, হঠকারী ও অহংকারে পূর্ণ হবে। ঈশ্বরকে ভাল না বেসে তারা জাগতিক সুখকে ভালবাসবে। ৫ বাইরের চেহারা দেখলে মনে হবে যেন ঈশ্বরকে তারা কত না ভক্তি করে, কিন্তু আসলে ঈশ্বরভক্তির শক্তিকেই তারা অস্বীকার করে। … ৬ এই রকম লোকদের মধ্যে কেউ কেউ ঘরে ঘরে ঢুকে দুর্বল-মনা স্ত্রীলোকদের বিপথে নিয়ে যায় … তারা সব সময় শিক্ষার কথা শুনছে, কিন্তু কখনও ঈশ্বরের সত্যকে গভীরভাবে বুঝতে পারছে না” (২ তীম ৩:১-৯)।
সমস্যা কি, তা পৌল ঠিকই ধরেন কিন্তু তিনি ঠিক কি বা কার কথা বলেন? প্রথমদিকে বোধ হয় যে তিনি রোম রাজ্যের সাধারণ সংস্কৃতির বিষয়ে কথা বলেন, কিন্তু পরে দেখা যায় যে তিনি খ্রিষ্টান বিশ্বাসীদেরও বুঝান (২ তীম ৩:৫) অথবা এমন বিশ্বাসীদের বুঝান যারা অন্যদের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে (২ তীম ৩:৬-৯)। তিনি প্রতারিত বিশ্বাসীকে এখনও ‘ভ্রান্ত শিক্ষক’ হিসাবে ধরেন না, শুধুমাত্র যারা জেনে বুঝে অন্যদের ভুল শিক্ষা দেয় বা যারা কোনভাবে সংশোধন মেনে নেয় না তাদেরই তিনি ‘ভ্রান্ত শিক্ষক’ বলেন। এই ধরণের দুজনেরই নাম তিনি উল্লেখ করেন: হুমিনায় ও ফিলীত (২ তীম ২:১৭)। তিনি একজন তামা মিস্ত্রি আলেক্সান্দরকেও উল্লেখ করেন যে তার “অনেক ক্ষতি করেছে” (২ তীম ৪:১৪) এবং তিনি বলেন যে ফুগিল্ল ও হর্মগিনি নামে দুজন তার “কাছ থেকে সরে পড়েছে” (২ তীম ১:১৫)।
ঈশ্বরীয় নেতৃত্ব বনাম খারাপ প্রভাব
যেমন তীমথিয়ের কাছে পৌলের প্রথম চিঠিতে ঠিক তেমন ২ তীমথিয় চিঠিতেও ভাল এবং খারাপ নেতৃত্ব হল একটি প্রধান বিষয়। কিভাবে খারাপ নেতৃত্ব, ভ্রান্ত শিক্ষা ও মণ্ডলীতে খারাপ প্রভাব প্রতিরোধ করা যায়?
পৌল প্রথম নিজে আদর্শ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখান: তিনি “পরিষ্কার বিবেকে ঈশ্বরের সেবা” করেন (২ তীম ১:৩)। তিনি তীমথিয়কে ঠিক তেমনি এমন একজন কর্মী হতে বলেন “যার উপর ঈশ্বর সন্তুষ্ট, অর্থাৎ যার লজ্জা পাবার কোন কারণ নেই … যে নির্ভুল ভাবে সত্যের বাক্য শিক্ষা দেয়” (২ তীম ২:১৫)। তিনি নেতৃত্বের বর্ণনায় তিনটি শক্তিশালী রূপক ব্যবহার করেন: নেতা একজন সৈনিকের মত, যে “কষ্ট সহ্য” করে এবং “যুদ্ধ করতে গিয়ে … সংসারের মধ্যে নিজেকে জড়ায় না, যেন সৈন্য হিসাবে যিনি তাকে ভর্তি করেছেন তাঁকে সে সন্তুষ্ট” করতে পারে (২ তীম ২:৩-৪)। নেতা এমন একজনের মত যে “প্রতিযোগিতার খেলায় যোগ” দেয়, যে নিয়মের মত খেলে যেন সে “জয়ের মালা” পায় (২ তীম ২:৫)। নেতার একজন চাষীর মত যে “পরিশ্রম করে” এবং যার “প্রথমে ফসলের ভাগ পাওয়া উচিত” (২ তীম ২:৬-৭)। পৌল তীমথিয়কে বলেন যেন তিনি বাজে ও মূর্খ তর্কাতর্কিতে যোগ না দেন যাতে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয় (২ তীম ২:১৬,২৩)। বরং তিনি তাকে এমন একজন হতে বলেন যিনি ঝগড়া করেন না বরং যিনি “সকলের প্রতি দয়ালু”, যার মধ্যে “শিক্ষাদানের ক্ষমতা এবং সহ্যগুণ” থাকে এবং যিনি বিরুদ্ধীয় লোকদের “নম্রভাবে শিক্ষা দিতে” জানেন, এমন শিক্ষা যাতে “মন ফিরাবার” ও “ঈশ্বরের সত্যকে তারা গভীর ভাবে” বুঝার সুযোগ থাকে (২ তীম ২:২৪-২৫)। পৌল তীমথিয়কে “যৌবনের মন্দ কামনা-বাসনা থেকে” পালাতে বলেন এবং তাকে বরং “খাঁটি অন্তরে প্রভুকে” ডাকতে এবং “সৎ জীবন, বিশ্বাস, ভালবাসা ও শান্তির জন্য আগ্রহী” হতে বলেন (২ তীম ২:২২)। পৌল তীমথিয়কে তার নিজেরই আদর্শ অনুসারে চলতে বলেন: “তুমি আমার শিক্ষা, চালচলন, উদ্দেশ্য, বিশ্বাস, সহ্যগুণ, ভালবাসা ও ধৈর্য ভাল করেই লক্ষ্য করেছ” (২ তীম ৩:১০-১২)।
মোট কথা তিনি তীমথিয়কে উৎসাহিত করেন: ‘তুমি ভাল করছ!’ এবং সাথে তাকে চ্যালেঞ্জ দেন: ‘আরো ভাল কর!’ তিনি তীমথিয়কে স্মরণ করিয়ে দেন যে অন্যদের শিষ্যত্ব দান করতে গেলে কেবলমাত্র এক উপায় আছে: নিজেই আদর্শ হয়ে সে ঈশ্বরের ভক্তির, বাধ্যতার ও বিশ্বস্ততার জীবন কর্তে হবে। সত্যিকারের জয় কষ্ট ছাড়া হয় না।
কষ্টভোগ
তাই অবাক লাগার কিছু না যে কষ্টভোগ হল ২ তীমথিয় চিঠিতে পুনরুক্তি একটি বিষয়। পৌল তীমথিয়কে আদেশ দেন “সুখবর প্রচারের জন্য আমার সঙ্গ কষ্টভোগ কর” (২ তীম ১:৮)। তিনি বলেন যে সুখবর প্রচার ও কষ্টভোগ সব সময় যুক্ত থাকলেও আমরা লজ্জিত হয় না (২ তীম ১:১১-১২) এবং যে “যারা খ্রীষ্ট যীশুর সংগে যুক্ত হয়ে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিপূর্ণ জীবন কাটাতে চায় তারা অত্যাচারিত হবেই” (২ তীম ৩:১২)। পৌল তীমথিয়কে খ্রীষ্টের সৈনিক হিসাবে কষ্ট সহ্য করতে বলেন (২ তীম ২:৩, ৪:৫)। পৌল তার জীবনের আগের কষ্টভোগ তীমথিয়কে স্মরণ করিয়ে দেন (২ তীম ৩:১১), বর্তমান কষ্টভোগ উল্লেখ করেন (২ তীম ১:১৫, ২:৯) এবং ভবিষ্যতে সেই কষ্টভোগ শীঘ্রই আসছে, এমন কি তার মৃত্যু নিয়ে বাস্তব কথা বলেন: “আমাকে এখন উৎসর্গ হিসাবে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে; আমার মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয়েছে” (২ তীম ৪:৬)।
যদিও পৌল নিরাশায় ভোগেন এবং কষ্টের মধ্যে আছেন তবুও তিনি এইটা তার বিশ্বাস, সাহস ও আহ্বানের নিশ্চয়তা নষ্ট করতে দেন না। কষ্টভোগ স্বাভিবিক বিষয়, কষ্টভোগের মধ্য দিয়ে গেলে ঈশ্বর প্রয়োনীয় দয়া দান করবেন এবং বর্তমান কষ্টভোগ সেই অনন্তকালীন বাস্তবতার তুলনায় সামান্য বিষয়: “তাই আমার জন্য সৎ জীবনের পুরস্কার তোলা রয়েছে। বিচার-দিনে ন্যায়বিচারক প্রভু আমাকে সেই পুরস্কার হিসাবে জয়ের মালা দান করবেন। তবে যে তিনি কেবল আমাকেই দান করবেন তা নয়, যারা তাঁর ফিরে আসবার জন্য আগ্রহের সংগে অপেক্ষা করেছে তাদের সবাইকে দান করবেন” (২ তীম ৪:৮)। পৌলের অবশ্যই একটি কষ্টের ও ত্যাগ-স্বীকারের জীবন ছিল, কিন্তু একটি আশীর্বাদের ও জয়ের জীবনও ছিল – এবং যেমন পৌল বহুবছর তীমথিয়কে তার জীবনের বাস্তবতা দিয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি তিনি তার জীবনের শেষ মুহূর্তেও দিতে থাকেন
উত্তরাধিকার ও দায়িত্ব হস্তান্তর
পৌল এই চিঠিতে ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করেন। তিনি তীমথিয়কে অন্যদেরকে শিক্ষা দিতে এবং গঠন করতে বলেন যেমন পৌল তাকে শিখিয়েছিলেন ও গঠন করেছিলেন: “অনেক সাক্ষীর সামনে আমার মুখে যে সব শিক্ষার কথা তুমি শুনেছ সেই শিক্ষা ধরে রাখবার জন্য তুমি তা এমন সব বিশ্বস্ত লোকদের দাও যাদের অন্যদের শিক্ষা দেবার যোগ্যতা আছে” (২ তীম ২:২)। পৌল নিশ্চিত করতে চান যেন সুখবর প্রচার, সত্যের শিক্ষা ও শিষ্যত্ব প্রজন্মের পর প্রজন্মে চলতে থাকবে। যদি পৌল দাবি করতেন যে শুধুমাত্র পুরুষরা শিক্ষা দানে অনুমদিত তবে তিনি এখানে “বিশ্বস্ত লোকদের” পরিবর্তে “বিশ্বস্ত পুরুষদের” বলতে পারতেন। কিন্তু গ্রীক ভাষায় যে শব্দ তিনি এই পদে ব্যবহার করেন তা পুরুষ ও মহিলা উভয় বুঝায়। বাংলা অনুবাদ তা উপযুক্তভাবে দেখিয়েছে: “লোকদের”, পুরুষ বা মহিলা হোক। তাই এমন না যে পৌল মহিলাদের শিক্ষা দিতে নিষেধ করেন কিন্তু তিনি দেখান যে সফল শিক্ষা দানের জন্য শিক্ষকের বিশ্বস্ততা আবশ্যক।
পৌল তীমথিয়কে স্মরণ করেন যে ঈশ্বর “আমাদের ভয়ের মনোভাব দেন নি; তিনি আমাদের এমন মনোভাব দিয়েছেন যার মধ্যে শক্তি, ভালবাসা ও নিজেকে দমনে রাখবার ক্ষমতা রয়েছে” (২ তীম ১:৭)। পৌল গুরুত্বের সঙ্গে তাকে সুখবর প্রচার করতে এবং শিক্ষা দিতে থাকতে বলেন (২ তীম ৪:১-২,৫)। তিনি তার সে নিশ্চয়তা তীমথিয়কে দান করেন: “এইজন্যই আমি এই সব কষ্ট ভোগ করছি; তবুও আমি লজ্জিত নই, কারণ আমি জানি আমি কার উপর নির্ভর করেছি। আমি নিশ্চয় করে জানি যে, আমি তাঁর কাছে যা রেখেছি খ্রীষ্টের আসবার দিনের জন্য তা রক্ষা করবার ক্ষমতা তাঁর আছে” (১ তীম ১:১২)।
পৌল তার চিঠি এই উৎসাহের বাক্য দিয়ে শেষ করেন: “খ্রীষ্টের পক্ষে আমি প্রাণপণে যুদ্ধ করেছি, আমার জন্য ঠিক করা পথের শেষ পর্যন্ত দৌড়েছি এবং খ্রীষ্টীয় ধর্ম-বিশ্বাসকে ধরে রেখেছি। তাই আমার জন্য সৎ জীবনের পুরস্কার তোলা রয়েছে। বিচার-দিনে ন্যায়বিচারক প্রভু আমাকে সেই পুরস্কার হিসাবে জয়ের মালা দান করবেন। তবে যে তিনি কেবল আমাকেই দান করবেন তা নয়, যারা তাঁর ফিরে আসবার জন্য আগ্রহের সংগে অপেক্ষা করেছে তাদের সবাইকে দান করবেন” (২ তীম ৪:৭-৮)। লক্ষ্য করুন এই অদ্ভুত কথায় কত নম্রতা এবং জয়ের কত নিশ্চয়তা থাকে।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।