পৌল ও তীমথিয় তাদের বহু বছরের বন্ধু ও সহকর্মী ফিলীমনের কাছে এই চিঠি লেখেন (ফিলীমন ১-২)। ইফিষ শহরে যখন পৌল তৃতীয় প্রচার যাত্রায় তিন বছর পরিচর্যা করেন (প্রেরিত ১৯:৮-১০), হতে পারে তখন ফিলীমন পৌলের মাধ্যমে সুখবর পান (ফিলীমন ১৯) এবং তার বন্ধু ও সহকর্মী হয়ে যান (ফিলীমন ১-২)। এখন ফিলীমন তার নিজের শহরে, অর্থাৎ কলসী শহরের মণ্ডলীতে একজন প্রাচীন ও গৃহ মণ্ডলীর নেতা হিসাবে আছেন। কলসী ছিল একটি পুরাতন ও গুরুত্বপূর্ণ শহর, রোমীয় মহাসড়কে অবস্থিত যা ইফিষ নৌবন্দর থেকে পূর্বদিকে যায়। কলসীয় মণ্ডলী ইপাফ্রা নামে একজন কলসীয় লোকের মাধ্যমে ৫৩-৫৬ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপন হয়েছিল (কলসীয় ১:৬-৭), যিনি সম্ভবত ফিলীমনের মত ইফিষে পৌলের দ্বারা বিশ্বাসী ও সুখবর প্রচারের কর্মী হয়ে যান। পরে ইপাফ্রা নিজের এলাকায় ফিরে গিয়ে কলসীতে ও কাছাকাছি লায়দিকেয়া ও হিয়রাপলি শহরে মণ্ডলী স্থাপন করেন (কলসীয় ১:৭, ৪:১২-১৩)।
তৃতীয় প্রচার যাত্রার পরে পৌলকে যিরূশালেমে গ্রেফতার করা হয় এবং তিনি তার মামলার কারণে দুই বছর কৈসরিয়ায় (৫৭-৫৯ খ্রীঃ) এবং আরো দুই বছর রোম শহরে বন্দী ছিলেন (৬০-৬২ খ্রীঃ)। রোমীয় আইন অনুসারে রায় ছাড়া একজন রোমীয় নাগরিককে দুই বছরের অধিক সময় জেলে রাখার অনুমোদন ছিল না। একারণে পৌল আশা করেন যে তিনি শীঘ্রই রায় পাবেন, অথবা তাকে বিচার ছাড়া মুক্তি দেওয়া হবে (প্রেরিত ২৮:৩০-৩১, ফিলীমন ২২)।
ওনীষিম নামে একজন দাসকে কেন্দ্র করে পৌল ফিলীমন চিঠি লেখেন, যে ফিলীমনের বাড়ী থেকে পালিয়ে রোম শহরে আসে এবং সেখানে পৌলের সাথে তার দেখা হয়। পৌল তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন, তাকে সুখবর দেন, তাকে শিক্ষা দেন ও শিষ্য করে তোলেন। ওনীষিমের জীবন পরিবর্তিত হয়ে যায় (ফিলীমন ১১)। পৌল তাকে “আমার সন্তান” (ফিলীমন ১০) এবং “আমার প্রাণের মতই প্রিয়” (ফিলীমন ১২) বলেন। সঠিকভাবে শিষ্য করে তোলার অংশ হিসাবে পৌল পলাতক দাস ওনীষিমকে তার মনিব ফিলীমনের কাছে ফিরে পাঠান যেন তিনি ফিলীমনের কাছে ক্ষমা চান, তার আচরণের জন্য দায়িত্ব নেন এবং তার মনিবের কাছে বশীভূত হন। পৌল তার সঙ্গে এই শক্তিশালী সুপারিশ চিঠি পাঠান যার মধ্যে তিনি ফিলীমনকে অনুরোধ করেন ওনীষিমের প্রতি ভাল ব্যবহার করতে এবং তাকে আর দাস নয়, বরং প্রিয় ভাই হিসাবে গ্রহণ করতে (ফিলীমন ১৬)। ঐসময়ের সংস্কৃতি ও চারিদিকে সমাজের চোখে পৌলের এই অনুরোধ ছিল একেবারে অসাধারণ বিষয়। প্রচলিত আইন অনুসারে মনিব হিসাবে ওনীষিমকে তার আগের অবিশ্বস্ততার জন্য শাস্তি, যন্ত্রনা অথবা এমন কি মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অধিকার ফিলীমনের আছে। পৌলের চিঠি হল ওনীষিমের জন্য সুরক্ষাপত্র। তাই ওনীষিমকে ভালভাবে গ্রহণ করার জন্য পৌল এই চিঠিতে জোরের সঙ্গে ফিলীমের প্রতি অনুরোধ করেন।
এই চিঠিতে পৌলের আদর্শ নেতৃত্ব প্রকাশ পায়। তিনি একজন অবিশ্বস্ত কাজের লোকের জন্য সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করেন, তাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়ে শিষ্য করে তোলেন। পৌল বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বরের ক্ষমতায় ওনীষিমের জীবন প্রকৃতভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। পৌল ফিলীমনের অধিকারকে সম্মান করেন বলে তিনি দাস ওনীষিমকে মনিবের কাছে ফিরে পাঠান। ওনীষিম ও ফিলীমন, উভয়ের চোখে পৌল বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি। পৌল তার এই বিশ্বাসযোগ্যতা ওনীষিম ও ফিলীমনের মধ্যে ভাঙ্গা সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করার জন্য ব্যবহার করেন। পৌল ফিলীমনের জন্য চেষ্টা করেন যেন তার অধিকার ও সম্মান রক্ষা পায় এবং তিনি ওনীষিমের জন্য চেষ্টা করেন যেন সে গভীরভাবে শিষ্যত্ব পেয়ে ও সংশোধিত হয়ে ভবিষ্যৎ পরিচর্যার জন্য অধিকারপ্রাপ্ত হয়।
পৌল ভালভাবে জানেন যে ফিলীমন যদি তার অনুরোধ অনুসারে কাজ করেন, তবে তার বিরুদ্ধে সমাজ থেকে অনেক কথা এবং এমন কি বড় ধরণের চাপ আসতে পারে। একজন দাস মুক্ত করলে অন্য দাসরা মুক্তি চাইবে এবং অন্য মনিবেরা এতে কোন রকম খুশি বা রাজি হবেন না। পৌল তার চিঠির মাধ্যমে ফিলীমনকে ব্যক্তিগতভাবে এবং নেতা হিসাবে দাসত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বলেন, যা ছিল ঐসময়ের সংস্কৃতি অনুসারে কঠিন একটি ভূমিকা।
ওনীষিমের নম্রতা ও আদর্শ ব্যবহারের উপরও এখন অনেক কিছু নির্ভর করে। যদি ওনীষিম তার নতুন স্বাধীনতা কোনভাবে ভুল ব্যবহার করেন তবে পৌলের উদ্দেশ্য ও প্রচেষ্টা নিষ্ফল হবে, ফিলীমন কঠিন অবস্থায় পড়বেন এবং ওনীষিম আরো দাস মুক্ত না হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
পৌল কলসীয় চিঠিতে (যা একই সময়ে একই মণ্ডলীর কাছে লিখিত, কলসীয় ৪:৭-৮) তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন যে খ্রীষ্টে স্বাধীন ও দাসের মধ্যে আর কোন পার্থক্য নেই (কলসীয় ৩:১১)। তারপরেও তিনি দাসদের বিশ্বস্ত হতে ও মনে-প্রাণে কাজ করতে বলেন (কলসীয় ৩:২২-২৫) এবং মনিবদেরও সাবধান করেন যেন তারা দাসদের প্রতি ন্যায্য ব্যবহার করেন (কলসীয় ৪:১)। পৌল এইভাবে দাসত্ব শান্তভাবে, আইনগতভাবে, স্বেচ্ছায়, ধীরে ধীরে বাতিল করার ভিত্তি স্থাপন করেন।
চিঠির লোখক এবং পাঠক
পৌল এবং তীমিথিয় চিঠিটি তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সমকর্মী ফিলীমনের করছে লেখেন (ফিলীমন ১)। ফিলীমন কিছু বছর আগে পৌলের মধ্য দেয়ে সুসমাচার পেয়ে যীশুকে জেনেছিলেন (ফিলীমন ১৭, ১৯) এবং তার সহকর্মী হয়েছিলেন, হতে পারে যখন পৌল তার তৃতীয় প্রচার যাত্রায় ইফিষ শহরে প্রায় তিন বছর ধরে পরিচর্যা করেন। ফিলীমনের দেশ কলসী (কল ৪:৯), একটি গুরুত্বপূর্ণ ও পুরান শহর, একটি রোমীয় মহাসড়কে অবস্থিত যা নৌবন্দর ইফিষ থেকে পূর্বের দিকে যায়। হতে পারে ফিলীমন পৌলের প্রচার শুনে বিশ্বাসী হয়েছিলেন, শিক্ষা ও শিষ্যত্ব পেয়েছিলেন এবং তার সহকর্মী হয়েছিলেন (প্রেরিত ১৯:৮-১০)। পরে কোন সময়ে তার দেশে ফিরে তিনি কলসীয় মণ্ডলীর একজন প্রাচীন ও গৃহ মণ্ডলীর নেতা হয়ে যান (ফিলীমন ১), এমন একজন যিনি তার ভালবাসা ও বিশ্বাসীদের জন্য যত্ন দ্বারা একটি ভাল প্রভাব ফেলেন (ফিলীমন ৪-৭)। পৌল ফিলীমনের কাজ সম্বন্ধে শুনে অনেক উৎসাহ পান, তার উপর নির্ভর করেন এবং তিনি নিশ্চিত যে ওনীষীমের ক্ষেত্রেও তিনি ফিলীমন থেকে আদর্শ আচার-ব্যবহার দেখবেন (ফিলীমন ২১)। তাদের সম্পর্ক এমন ঘনিষ্ট যে পৌল নিজেকে স্বাধীন মনে করেন পিলীমনের অতিথিপরায়নতা দাবি করতে (ফিলীমন ২২)।
ফিলীমনের নাম নতুন নিয়মে আর কোথাও উল্লেখ করা হয় নি। বোন আপ্পিয়া, যার নামেও চিঠিটি লেখা, তারও নাম নতুন নিয়মের আর উল্লেক পায় নি (ফিলীমন ২)। তিনি ফিলীমনের স্ত্রী হতে পারেন, অথবা সেই গৃহ মণ্ডলীর একটি পরিচালিকা। পৌল তৃতীয় হিসাবে চিঠিটি আর্খিপ্প একজনের নামে লেখেন, যার বিষয়ে বলা আছে যেন তিনি “প্রভুর সেবার জন্য যে কাজ দেওয়া হয়েছে তা শেষ করবার দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ” দেন (কল ৪:১৭)। হয়তো তিনি ছিলেন ফিলীমনের গৃহমণ্ডলীর আর একজন প্রাচীন, বা কলসীয় মণ্ডলীর নেতা এবং সেই লোক যার কাছে ইপাফ্রা মণ্ডলীর দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিলেন।
কলসীয় মণ্ডলীল স্থাপন
কলসীয় মণ্ডলী প্রায় ৫৩-৫৬ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত, সরাসরি পৌলের মধ্য দিয়ে নয বরং ইপাফ্রা দ্বারা (কল ১:৭)। হতে পারি ইপাফ্রা আর একজন লোক যিনি ফিলীমনের মত পৌলের প্রচারে বিশ্বাসী এবং পরে তার সহকর্মী হয়েছিলেন এবং পরে তার দেশ কলসীতে ফিরে গিয়ে সেখানে (এবং কাছাকাছি লায়দিকেয়া ও ইয়রাপলিতেও) মণ্ডলীটি স্থাপন করেছিলেন (কল ১:৭, ৪:১২-১৩)।
ইপাফ্রা এখন কলসী ছেড়ে চলে গেছেন এবং রোমে আছেন, হতে পারি পৌলের সাথে দেখা করার জন্য ও তাকে মণ্ডলীর অবস্থা নিয়ে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। হাতে পারে তার এই কথার ভিত্তিতে পৌল কলসীয় চিঠি, এবং হয়তো ফিলীমন চিঠিও লেখেন। কোনভাবে ইপাফ্রাকেও বন্দী করে রাখা হয় (ফিলীমন ২৩) এবং – মণ্ডলীর কাছে ফিরে যেতে পারেন না বলে – তিনি পরিবর্তে মণ্ডলীগুলির জন্য অনেক বিনতি করেন। পৌল তাই তুখিক নামে আর একজন এবং সাথে ওনীষীমকে এই চিঠিগুলি নিয়ে কলসী মণ্ডলী ও ফিলীমনের কাছে পাঠান।
তাই পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে ফিলীমন ও কলসীয় চিঠি যুক্তি আছে, একই সময় লেখা, একই চিঠিবাহক দ্বারা পাঠানো এবং তা ছাড়া প্রায় একই লোক সুভেচ্ছার ক্ষেত্রে উল্লিখিত (কল ৪:৭-৯)। বামের ছবি হল ফিলীমন চিঠিতে উল্লিখিত লোক, দান ছবি হল কলসীয় এবং ফিলীমন চিঠি মিলিয়ে উল্লিখিত লোক (পূর্ণ ছবি):
ছবি
লেখক পৌল কোথায় জেলে?
পৌল ফিলীমন চিঠিতে বার বার উল্লেখ করেন যে তিনি জেলে আছেন। কিন্তু কোথায় জেলে আছেন তা কিভাবে জানা যায়? পৌল তার জীবনে সুসমাচার প্রচারের কারণে বেশ কয়েকবার জেলে ছিলেন, ৫০ খ্রীষ্টাব্দে ফিলিপী শহরের এক রাত, ৫৪-৫৫ খ্রীষ্টাব্দে ইফিষে, ৫৭ খ্রীষ্টাব্দে অল্পদিন যিরূশালেমে, ৫৭-৫৯ খ্রীষ্টাব্দে দুই বছর ধরে কৈসরিয়ায় এবং ৬০-৬২ খ্রীষ্টাব্দে রোমে যাওয়ার পরে আর ২ বছর রোম শহরে:
সাল | প্রচার যাত্রা | জায়গা | কতদিন | বাইবেল পদ | মন্তব্য |
৫০ খ্রীঃ | ২য় | ফিলিপী | এক রাত | প্রেরিত ১৬:২৩–৩৯ | |
৫৪–৫৫ খ্রীঃ | ৩য় | ইফিষ | অজানা | ২ করিন্থীয় ১১:২৩–২৪ | কয়েক বার জেলে ছিলেন বলে |
৫৭ খ্রীঃ | ৩য় যাত্রার শেষে | যিরূশালেম | অল্প কয়েকদিন | প্রেরিত ২১–২৩ | |
৫৭–৫৯ খ্রীঃ | কৈসরিয়া | ২ বছর | প্রেরিত ২৩:৩–২৭:১ | ||
৬০–৬২ খ্রীঃ | রোম | ২ বছর | প্রেরিত ২৮:৩০–৩১ | গৃহ বন্ধন বা ‘হাল্কা বন্ধন‘ |
কিন্তু কোন সময় তিনি ফিলীমন চিঠিটি লেখেন? উত্তর দিতে গেলে আরো কিছু খুঁটিনাটি বিষয় দেখতে হবে (নিচের ছক দেখুন): আসলে পৌল একই সময়ে জেল থেকে কম পক্ষে চারটি চিঠি লেখেন: ফিলিপীয়, ইফিষীয়, কলসীয় ও ফিলীমন চিঠি (যাদের জেলের চিঠিও বলা হয়)। চিঠিগুলি যে একসাথে লেখা ও পাঠানো হয়েছে তা চিঠিগুলির কিছু মিল দেখে বুঝা যায়: পৌল চার্টি চিঠিতেই বলেন যে তিনি বন্দী, চিঠিগুলির বাহক তুখিক দুইটি চিঠিতে উল্লেখ (কল ৪:৭, ইফি ৬:২১), পৌল দুইটি চিঠিতে বলেন যে তিনি আশা করেন যে তাকে শিঘ্রই ছেড়ে দেওয়া হবে (ফিলি ২:৩৪, ফিলীমন ২২), শুভেচ্ছা পাঠানোর ক্ষেত্রের প্রায় একটি লোক পৌলের সাথে উপস্থিত (কল ৪:৯-১৭, ফিলী ২৩-২৪) এবং কমপক্ষে দুইটি চিঠির মূল বিষয়ের অনেক মিল দেখা যায় (ইফিষীয়, কলসীয়)। ফিলিপীয় চিঠিতে পৌল উল্লেখ করেন যে “এখানকার রাজবাড়ীর সৈন্যদল” তার মধ্য দিয়ে সুসমাচার পাচ্ছে (ফিলি ১:১৩) এবং যে “সম্রাট কৈসরের বাড়ীর লোকেরা” সুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে (ফিলি ৪:২২)। এই দুইটি তথ্যগুলি দেখায় যে হতে পারে পৌল ৬০-৬২ খ্রীষ্টাব্দে রোম শহের জেলখানা থেকে লেখেন।
ইফিষীয় | কলসীয় | ফিলীমন | ফিলিপীয় | |
---|---|---|---|---|
পৌল জেলে | ইফিষীয় ৩:১০ | কলসীয় ৪:১৮ | ফিলীমন ১ | ফিলিপীয় ১:১, ১:৭ |
পৌলের সাথে তীমথিয় | কলসীয় ১:১ | ফিলীমন ১ | ফিলিপীয় ১:১ | |
চিঠি বাহক তুখিক | ইফিষীয় ৬:২১ | কলসীয় ৪:৭ | ||
তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে পৌলের আশা | ফিলীমন ২২ | ফিলিপীয় ২:২৪ | ||
রোম শহরে জেলে | ১:১৩ রাজবাড়ীর সৈন্যদল ৪:২২ সম্রাট কৈসরের বাড়ীর লোকেরা | |||
প্রধান বিষয়গুলি | কলসীয়ের সাথে মিল | ইফিষীয়ের সাথে মিল | ||
পৌলের সাথে কে কে আছেন | আরিষ্টার্খ, মার্ক, যীশু–যুষ্ট, ইপাফ্রা, লূক, দীমা | আরিষ্টার্খ, মার্ক, যীশু–যুষ্ট, ইপাফ্রা, লূক, দীমা | ||
চিঠিতে উল্লিখিত লোক | ওনীষিম, আর্খিপ্প | ওনীষিম, আপ্পিয়া, আর্খিপ্প |
ফিলীমন পুস্তক পড়লে বুঝা যায় যে চিঠিটি লেখার কারণ হল আগের একটি ঘটনা: ওনীষীম, যিনি ফিলীমনের দাস ছিলেন, তিনি মনিব ও কলসী শহর থেকে পালিয়ে অবশেষে রোম শহরে পৌঁছান। কিভাবে তার পৌলের সাথে দেখা হয়, আমরা জানি না। ওনীষীম যেহেতু দাস, রোম রাজ্যে দাসত্বের নিয়ম বা অবস্থা নিয়ে কিছুটা বুঝা দরকার:
রোম রাজ্যে দাস্বত্ব
যখন রোমীয়রা তৃতীয় শতাব্দ খ্রীষ্টপূর্বে চারিদিকে এলাকা ও লোকদল দখল করতে শুরু করেন রোম রাজ্যে দাসত্ব শুরু। দখল করা সেনা বা লোক দাস বিহাবে বিত্রি হত।
শুরুদিকে দাসদের প্রতি বেশ কঠোর ব্যবহার করা হত। রোমীয় আইন অনুসারে একজন দাস হল মনিবের সম্পত্তি, যেমন একটি ছাগল বা জিনিষও মনিবের সম্পত্তি। মনিবের অধিকার ছিল একজন দাসকে কঠোর পরিশ্রম কারানু, মার দেওয়া, গরম লোহা দিয়ে ছাপ দেওয়া (branded), শাস্তি দেওয়া, পুনরায় বিত্রি করা বা মেরে ফেলা। একজন মনিব মারা গেলে দাস তার ছেলের সম্পত্তি হয়ে যেত। দাসের যদি ছেলেমেয়ে হত তবে ছেলেমেয়েরাও মনিবের দাস ও সম্পত্তি হত। যুদ্ধে পরাজিত মানুষের পাশাপাশি জলদশু বা অন্য অপরাধী মানুষ অপহরণ করে বিক্রি করত, পরিত্যাক্তি বাচ্চা তুলে দাস হিসাবে বিক্রি করত অথবা ব্যবসা হিসাবে দাস পুষত।
নতুন নিয়মের সময়ে দাসদের অবস্থা ও দাসদের অধিকার আগের চেয়ে বেশ ভাল ছিল। অনেক দাস পাশাপাশি টাকা জমিয়ে নিজের মুক্তি কিনতে পারত বা বিবাহ করার ও ছেলেমেয়ে নেওয়ার অধিকার ছিল। দখল দ্বারা শিক্ষিত মানুষও দাস হিসাবে বিত্রি হত এবং ধনী রোমীয় পরিবার সন্তানদের পড়াশুনার জন্য শিক্ষক দাস বা ব্যবসার জন্য হিসাব রক্ষক বা উকিল দাস কিনত। ধীরে ধীরে দাসদের আরো অধিকার দেওয়া হত এবং তাদের আদালতে মুক্ত নিচু শ্রেণীর লোকদের মত দেখা হত। কিকেরো (Cicero) বলতেন যে একজন যোগ্য দাস সাধারণত দশ বছরের মধ্যে মুক্তি পেতে সক্ষম হত। নতুন নিয়মের সময়ে রোমীয়রা বেশ কিছু দাসদের মুক্তও করত কারণ তাদের সেনা তুলার জন্য যথেষ্ট লোকসংখ্যা ছিল না। একজন মনিব মারা গেলে সাধারণতা দাসদের একটি অংশ মুক্ত করা হত। তারপরেও অনুভাব করা হয় যে রোম রাজ্যের লোকসংখ্যার ৭৫ ভাগ ছিল দাস।
ওনীষীম ফিলীমন থেক পালিয়ে গেলেন বল পলাতক দাস সম্বন্ধী আইনও দেখা দরকার: পলাতক দাসদের ধরে মনিবের কাছে ফেরত দেওয়া ছিল সরকারের দায়িত্ব এবং কিছু লোক এভাবে আয়ও করত। একজন পলাতক দাসকে আশ্রয় দেওয়া ছিল অপরাধ এবং দাস যতদিন মনিবের জন্য কাজ না করত, তত দিনের মজুরি মনিব আশ্রয়দাতার থেকে দাবি করার অধিকার ছিল। হয়তো এরজন্য পৌল ফিলীমনের কাছে একটি “ঋণের বিষয়ে” কথা বলেন (ফিলীমন ১৮-১৯)। মনিবের অধিকার ছিল একজন পলাতক দাস ফেরত পাওয়ার সময়ে শাস্তি, branded, যন্ত্রণা দিতে অথবা মেরে ফেলতে, যদিও দাসদের জন্য মৃত্যুর শাস্তি নতুন নিয়মের সময় আর প্রচলিত ছিল না। যদি একজন দাস ইটালীর মাটিতে মুক্তি পেত তবে তিনি সাথে সাথে রোমীয় নাগরিকত্বও পেত। এরজন্য অনেক পলাতক দাস ইটালী বা রোমের দিকে যেত।
ফিলীমন চিঠির পিছনে গল্প
হতে পারে যে ওনীষীম তার মনিব ফিলীমনের কলসীয় বাড়ী থেকে পালিয়ে রাজধানী রোম শহরে চলে এসেছিল এবং সেখানে কোনভাবে তার পৌলের সাথে দেখা হয়। ফিলীমন কি অতি কঠোর মনিব ছিল? না কি ওনীষীম ছিল ঝামেলার কাজের লোক? ফিলীমন চিঠি অনুসারে বোধ হয় যে দোষ ওনীষীমের ছিল, পৌল বলেন যে একদিন ওনীষীম আসলে “মূলহীন” ছিলেন (ফিলীমন ১১), কিন্তু যে এখন তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এই পদ আসলে ওনীষীমের নাম নিয়ে একটু মজা করে, কারণ ওনীষীমের নামের অর্থ হল “সুবিধা” বা ‘মূল্যবান”। তাই এগারো পদ মোটামুটি বলে যে “মিঃ সুবিধা সত্যি এক সময় বেশি সুবিধা ছিল না কিন্তু এখন তিনি খুব সুবিধা”।
পৌল ওনীষীমের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন, তার সাথে সুসমাচার শেয়ার করেন, তাকে শিক্ষা ও শিষ্যত্ব দান করেন। ওনীষীমের জীবন পরিবর্তন হয়ে যায় (ফিলীমন ১১)। পৌল তাকে আমার “সন্তান” বলেন (ফিলীমন ১০), একটি রূপক যা ঘনিষ্ট সম্পর্ক, যত্ন, গর্ব, প্রতিনিধিত্ব এবং অপরিবর্তনশীল একটি সম্পর্ক বা সমর্পণ বুঝায়। তা ছাড়া পৌল তাকে “প্রাণের মত প্রিয়” বলেন (ফিলীমন ১২) যাতে বুঝা যায় যে পৌল শুধুমাত্র ধর্মান্তরিতদের গুনেন না, তিনি প্রত্যেক শিষ্যের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সম্পর্ক রাখে এবং আবেগময় বন্ধুত্বে যুক্ত।
পৌল ওনীষীমকে তার মনিবের এবং আইন অনুসারে তার মালিকের কাছে ফিরে পাঠান যেন তিনি তার ক্ষমা চান। এইটা ভাল শিষ্যত্ব: আগের অপরাধ ঠিক করা, মাফ চাওয়া, নত হওয়া এবং আগর ক্ষতির জন্য দায়িত্ব নেওয়া। পৌল অবশ্যই ওনীষীমের হাতে একটি শক্তিশালী সুপারিশপত্রও পাঠান এবং তাতে ফিলীমনকে অনুরোধ করেন ওনীষীমের প্রতি ভাল ব্যবহার করতে, আসলে তাকে আর দাস হিসাবে ফিরে না নিতে বরং প্রিয় ভাই হিসাবে (ফিলীমন ১৬)। পৌলের এই অনুরোধ অবশ্যই হল চারিদিকে সংস্কৃতি ও সমাজের মনোভাবের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। আইন অনুসারে মনিব হিসােব ফিলীমনের অধিকার আছে ওনীষীম নিয়ে যা চান তাই করতে, চাইলে তার অবিশ্বস্ততার জন্য মেরেও ফেলতে। এর জন্য পৌলের চিঠিও বেশ কড়া, কারণ তা হল ওনীষীমের শুধুমাত্র রক্ষা।
ফিলীমন চিঠি থেকে কি কি শেখা যায়
ক্ষমার গুরুত্ব
ভিত্তিকভাবে ফিলীমন চিঠি হল ক্ষমা করার অনুরোধের একটি চিঠি। লুথার বলেছিলেন “আমরা সবাই ওনীষীম”। আমাদের সবার ক্ষমা দরকার – এবং আমাদের সবার তাদের ক্ষমা করা দরকার যারা আমাদের বিরুদ্ধে অন্যায় করেছে।
দ্বিতীয় সুযোগ দান
ওনীষীম ইতিমধ্যে প্রমাণিত করেছেন যে সে অবিশ্বস্ত। পৌল তার পিছনে চেষ্টা করেন যদিও আর একজন ভাল লোক (ফিলীমন) ওনীষীমের ক্ষেত্রে নিষ্ফল হয়েছিলেন। লোকেরা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। লোকদের চিরকাল আগের ভুল সিদ্ধান্তে আটকিয়ে দেবেন না। দ্বিতীয় সুযোগ দান করা, আর একবার চেষ্টা করা, দয়া দেখানোই হল ঈশ্বরীয় একটি মনোভাব।
আশা ধরে রাখা
এই চিঠি থেকে বুঝা যায় যে পৌলের সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা আছে যে ওনীষীমের সত্যি পরিবর্তন হয়েছে, সুসমাচার লোকদের জীবন পরিবর্তিত করতে সক্ষম। পৌলের বিশ্বাস আছে যে পরিবর্তন সম্ভব, যে সুসমাচারের ক্ষমতা আছে, যে ঈশ্বর জীবন পাল্টাতে সক্ষম। তিনি ওনীষীমের পরিত্রাণ নিয়ে নিশ্চিত, তার বিশ্বাস আছে যে শিষ্যত্ব তার ক্ষেত্রে কার্যকর হয়েছে। পৌলের আশা আছে লোকদের নিয়ে। হতে পারে পৌল তার নিজের জীবন দেখে তা শিখেছেন, বুঝেছিন যে এমন কি “আশাহীন” ও “মন্দ মানুষ” ঈশ্বর পরিবর্তিত করতে পারেন। তিনি নিজেই ছিলেন মণ্ডলীর অত্যাচারী ও হিংস্রতা দিয়ে চালিত একজন নেতা (প্রেরিত ৮:১)। যখন পৌল মন পরিবর্তন করেছিলেন বিশ্বাসীরা তাকে নিয়ে এমন ভয় পেয়েছিল যে তারা তাকে মণ্ডলীতে আসতে দিল না (প্রেরিত ৯:২৬)। শুধুমাত্র যখন বার্ণবা, একজন সাহসী ও প্রজ্ঞার বিশ্বাসী পৌলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন পৌলকে শেষে মণ্ডলীতে স্বাগতম জানানো হয় (প্রেরিত ৯:২৭-২৮)। পৌল বার্ণবা থেকে ঠিকই শিক্ষা নিয়েছিলেন, তিনি এখন নিজেই “আশাহীন’ বা “অবিশ্বস্ত” লোকদের পিছনের চেষ্টা করেন।
নিচু শ্রেণীর লোকদের মধ্যে বিনিয়োগ
চিন্তা করুন: পৌল যিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রেরিত এবং অনেক মণ্ডলীর দেখাশুনাকারী তিনি আর একজনের কাজের লোকের পিছনে সময় বের করেন, এমন কি একজন অবিশ্বস্ত কাজের লোকের পিছনে। এইটা দেখে আমরা বুঝতে পারি যে পৌল আসলে একজনের জাতি, শ্রেণী বা অবস্থা দেখে পার্থক্য করেন না, তিনি এখানে গভীরভাবে, মনেপ্রাণে, এমন কি আবেগীয়ভাবে একজন নিচু শ্রেণীর লোকের মধ্যে বিনিয়োগ করেন। তিনি করেন যা তিনি বলেন: “যিহূদী ও অযিহূদীর মধ্যে, দাস ও স্বাধীন লোকের মধ্যে, স্ত্রীলোক ও পুরুষের মধ্যে কোন তফাৎ নেই, কারণ খ্রীষ্ট যীশুর সংগে যুক্ত হয়ে তোমরা সবাই এক হয়েছ” (গালা ৩:২৮, কল ৩:১১)।
দোষারোপ বা আত্ম মায়া-দয়ার চেয়ে আহ্বানের প্রতি বিশ্বস্ততা
যখন পৌল এই চিঠি লেখেন তিনি ইতিমধ্যে সারে চার বছর জেলে। পৌল হলেন শক্তিশালী, স্বক্রিয় ও সফল একজন প্রেরিত, অজেয় জাতিগুলি তার হৃদয়ে আছে, কিন্তু এখানেই তিনি কত দিন ধরে আটকিয়ে আছেন। সহজে তিনি নিরুৎসাহিত হতে পারতেন, ঈশ্বরের কাছে অভিযোগ করতে পারতেন, ঈশ্বরকে দোষ দিতে পারতেন কেনা তিনি তাকে আহ্বান পূর্ণ করতে দেন না। কিন্তু আমরা পৌলের মুখ থেকে অভিযোগের কোন কথা শুনি না। বরং বোধ হচ্ছে পৌল জেলে থাকলেও প্রতি সুযোগ ধরছেন: তিনি সুসমাচার প্রচার (ওনীষীম এবং পাহারাদারদের কাছে, ফিলিপীয় ১:১৩), তিনি বিনতি করেন, তিনি শিক্ষা ও শিষ্যত্ব দান করেন, তিনি কর্মী গঠণ করেন, তিনি মণ্ডলীদের যত্ন নেন, তিনি চিঠি লেখেন। জেলের বাইরে যা তিনি করতেন ঠিক তা তিনি জেলের ভিতরেও করেন। তিনি স্বক্রিয় ও তার আহ্বানে বিশ্বস্ত। তিনি পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে দোষ দিয়ে নিজেকে আটকাতে দিচ্ছেন না, তার মধ্যে বেচারার কোন ভাব নেই।
ভাঙ্গা সম্পর্ক ঠিক করা
ফিলীমন চিঠি হল ভাঙ্গা সম্পর্ক ঠিক করার একটি প্রচেষ্টা। ফিলীমনের সঙ্গে পৌলের ভাল সম্পর্ক এবং ওনীষীমের সঙ্গে তার ভাল সম্পর্ক, সে বিশ্বাস যা তার দুইজনের চোখে আছে তিনি তা ব্যবহার করেন তাদেরই মধ্যে সম্পর্ক পুনরায় মেরামত করা। যখন দুইজনের মধ্যে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে আমরা অনেক বার একজনের পক্ষ নেই, এবং আমরা অনেক বার আঘাত গ্রস্ত লোকের কাছে আরো প্রিয় হওয়ার জন্য আমরা নিন্দাও করতে রাজি। বা আমরা দয়া-মায়া দেখিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বটি আরো খারাপ বানাই। পৌলের ব্যবহার কত ভিন্ন! লক্ষ্য করুন তিনি কত খোলাভাবে এবং কত সম্মানের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেন: তিনি ফিলীমনের কাছে এমন কিছু বলে না যা ওনীষীমের শুনতে খারাপ লাগবে। এবং তিনি ওনীষীমের কাছে এমন কিছু বলে না যা ফিলীমনের কানে পড়লে খারাপ লাগবে। যতদূর তা তারই ক্ষমতায় আছে পৌল অত্যন্ত চেষ্টা করেন সম্পর্কটি পুনরমিলনে আনতে এবং শান্তি স্থাপন করতে।
শিষ্যত্ব আসলে মানে কি?
এই চিঠিতে প্রকাশিত পৌল কত চমৎকার একটি আদর্শ, বিশেষভাবে শিষ্যত্বের ক্ষেত্রে। পৌলের শিষ্যত্ব হালকা-পাতলা না, তিনি ওনীষীমকে বলেন না: “যীশুর দয়া পেয়েছ, নতুন সৃষ্টি হয়েছ, আগে বিষয় বাদ, তা নিয়ে আর মাথা ঘাবড়ানো দরকার নেই, আমি তোমাকে কর্মী হিসাবে পশ্চিমে পাঠাব, ফিলীম কখনও জানবে না”। পৌল ওনীষীম শেখান যে অনুতাপ মানে পাপ স্বীকার করা, আগের আচরণের জন্য দায়িত্ব নেওয়া, ক্ষমা চাওয়া, ফিরে গিয়ে নত হওয়া, সৎ ও নম্র হওয়া, বিশ্বস্ত হওয়া ও সেবা করতে প্রস্তুত থাকা।
কেন পৌল ওনীষীমকে ফিরে পাঠাছেন, এমন কি দাসত্বায় ফিরা পাঠান? লাভ কি হল? লক্ষ্যনীয় বিষয় যে পৌল মনিব হিসাবে ফিলীমেন আইনগত অধিকার সরিয়ে ফেলেন না যদিও তিনি দাসত্বের পক্ষে নন। কিন্তু ফিরা পাঠানো ওনীষীমেরও জন্য প্রয়োজন: পৌল যে অনুতাপের উপযুক্ত আচরণ দাবি করেন, নম্রতা ও দায়িত্ব গ্রহণ, ক্ষতিপূর্ণ ও বশীভুত হওয়া, তা দ্বার পৌর ওনীষীমের মনোভাব-চরিত্র গঠণ করেন। তা ছাড়া পৌল ওনীষীমের ভবিষ্যৎ পরিচর্যা ও অধিকারের জন্য ভিত্তি তৈরি করেন: যখন ওনীষীম ফিলীমনের বাড়ী থেকে অবশেষে চলে যাবেন তিনি মুক্ত মানুষ হিসাবে যাবেন, চরিত্রের, সততার ও অধিকারের মানুষ হিাসাবে। তিনি সৎ আচরণ করেছেন। তার ভবিষ্যৎ পরিচর্যার জন্য তার একটি শান্তি, একটি আত্ম-সম্মান এবং শিষ্যত্ব নিয়ে একটি গভীর জ্ঞান থাকবে।
তুলায় আমাদের শিষ্যত্ব অনেক বার বেশ হাল্কা-পাতলা। উপমা: যখন প্রজাপতি প্রথম তার বাসা কেটে বের হয় তার ঘন্টা পর ঘন্টা সংগ্রাম করে বের হতে হয়। কিন্তু সংগ্রামের কারণে তার ডানা সম্পূর্ণ বিস্তার হয়েছে। বাসাটি যদি আমরা প্রজাপতিকে “সাহায্য” করার জন্য কাটি তবে সে তাড়াতাড়ি বের হতে পারবে, কিন্তু তার ডানা বিকালঙ্গ থাকবে ও সে কখনও উড়তে সক্ষম হবে না। ফিলীমন চিঠিতে বুঝা যায় যে পৌল “বাসা কাটেন না”, তিনি ওনীষীমকে কষ্ট করে শিষ্যত্বের লম্বা রাস্তায় নিয়ে যায, কিন্তু তার শিষ্যত্বের গভীরতা অনেক বেশি – এবং অনেক সফল: মণ্ডলীর ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে কমবেশি ১০০ খ্রীষ্টাব্দে (এই চিঠির চল্লিশ বছরের পরে) ইফিষ মণ্ডলীল প্রধান নেতা হলেন ওনীষীম, সেই ওনীষীম।
সুপারিশ করা
ফিলীমন চিঠি হল ওনীষীমের উদ্দেশ্যে একটি সুপারিশ চিঠি। অনেক বার লোক আমাদের থেকে সুপারিশ চিঠি চায়। তা হল কঠিন বিষয়: আসলে আমাদের শুধুমাত্র একজনের সুপারিশ করা উচিত যখন আমরা তার ভাল চরিত্র ও আচরণের বিষয়ে নিশ্চিত। যদি সুপারিশ দিলাম কিন্তু লোকটি ভাল করে না তবে ওদের চোখে আমারই বিশ্বাসযোগ্যতা ভেঙ্গে গেছে।
কিন্তু তারপরেও একটি সুপারিশ হল শক্তিশালী বিষয়। একটি সুপারিশ লোকদের জন্য দরজা খুলে অথবা সুযোগ তৈরি করে যেন তারা নিজেকে প্রমাণিত করতে পারে। ভাল লোক অথবা পরিবর্তিত লোকদের জন্য সুপারিশ অনেক বড় আশীর্বাদ হতে পারে। সুপারিশ মানে একজনের সাথে আমার সে বিশ্বাসযোগ্যতা আছে তা আমি আর একজনের উপরে বিস্তার করি।
দায়বন্ধতা
পৌল তার চিঠির শেষে বলেন যে সম্ভাবনা অনেক যে তিনি শিঘ্রই বেরাতে আসবেন (ফিলীমন ২২)। এইটি দ্বারা পৌল দায়বদ্ধতা নিয়ে আসেন: পৌল যখন পৌঁছাবেন ফিলীমনের কাছে তার প্রথম প্রশ্ন হবে: “ওনীষীম কেমন?” এবং ওনীষীমের কাছি তার প্রথম প্রশ্ন হবে: “তুমি কি সুন্দরভাবে ক্ষমা চেয়েছ ও নত হয়েছ?” কিন্তু পৌল নিজেকেও দায়বদ্ধ রাখেন: যদি ওনীষীমের কাছে ফিলীমনের তার সুপারিশ ভাঙ্গে (মানে যদি ফিলীমন ওনীষীকে কঠোর ব্যবহার করেছেন) তবে পৌলের ওনীষীম কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে যে তিনি তাকে ঝুঁকিতে ফেলেছেন। কিন্তু যদি ফিলীমনের কাছে ওনীষীমের তার সুপারিশ ভাঙ্গে (মানে যদি ওনীষীম নম্র হওয়ার চেয়ে অহংকারীভাবে তার চিঠি ব্যবহার করেছে) তবে পৌলের ফিলীমের কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে যে তিনি তাকে একটি কঠিন অবস্থায় ফেলে দিয়েছেন। পৌলেরও দায়িত্ব নিতে হবে ও ক্ষতিপূর্ণ করতে হবে যখন তার সুপারিশ ভাঙ্গে।
এই চিঠিতে ফিলীমন যদি বাধ্য হন …
কিন্তু দায়বদ্ধতার বিষয় আরো দূরে যাচ্ছে। পৌল ভালই জানেন যে যদি ফিলীমন তার চিঠির অনুরোধ অনুসারে করেন এবং ওনীষীমকে দাস হিসাবে নয় বরং ভাই বিহাসে গ্রহণ করেন, তবে এই আচরণের ফলে চারিদিকে প্রভাব পড়বে। সহজে তার আচরণ নিয়ে প্রশ্ন, আপত্তি, অভিযোগ, এমন কি হুমকি হতে পারে – এবং এগুলি সব ফিলীমের উপর পড়বে। এই চিঠি যে শুধুমাত্র তিনজনকে নিয়ে “শূণ্যস্থানে” ঘটে, তা নয়, বরং বিষয়টি ঢেউ সৃষ্টি করবে।
চিন্তা করুন: যদি ফিলীমন ওনীষীমকে দাস হিসাবে নয় বরং ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে তবে ফিলীমনের সংসারে অন্যান্য দাসদের কেমন লাগবে? তাদের খারাপ লাগতে পারে কারণ তারা বিশ্বস্তভাবে কাজ করেছিল, হতে পারে ওনীষীমের অনুপস্থিতির কারণে আরো বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে কিন্তু এখন অবিশ্বস্ত যে সে সম্মান ও সুবিধা পায় – এবং তারা? তারা এইটি অন্যায় হিসাবে দেখবে, তারা তুলনা করবে, নিজেকে শিকার হিসাবে দেখবে অথবা তারাও মুক্তি চাইবে। তারা সহজে বলতে পারে: “আমিও পালাব এবং বড় একটি চিঠি নিয়ে ফিরা আসব”। তারা মনে করবে যে বিশ্বাস্ততাকে তুচ্ছ করা হয় এবং দায়িত্বহীনতাকে উৎসাহিত করা হয়।
কিন্তু তা মাত্র না: যদি ফিলীমন ওনীষীম এবং হয়তো তার সংসারে অন্য দাসদের বড় মনে মুক্ত করবেন তবে কলসীয় মণ্ডলীতে অন্য মনিবরা কি বলবে? ফিলীমন যা করেচেন সবাই জাবে এবং চাইলে বা না চাইলে তা অন্য পরিবার ও সংসারের উপর প্রভাব ফেলবে। হয়তো মণ্ডলীর অন্যান্য মনিবরা ফিলীমনকে সরাসরি চাপ দেবে যেন তিনি এই পথ না আগান কারণ সব দাসরা মুক্তি চাইতে পারে এবং তাতে কি হবে?। কিন্তু আরো বিষয় আছে: যদি কলসীয় অবিশ্বাসী মনিবরা দেখবে যে মণ্ডলীর মনিবরা দাস মুক্ত করতে শুরু করেছে, তারা ভয় পাবে যে একটি দাস বিপ্লব সৃষ্ট হবে এবং তারা মণ্ডলীকে সমাজের একটি খারাপ প্রভাব হিসাবে দেখবে এবং হয়তো কিছু পদক্ষেপ নেবে। তাতে ছোট কলসীয় মণ্ডলীর উপর আরো চাপ নেমে আসবে। অথবা হয়তো কলসীয় মণ্ডলীতে কিছু বিশ্বাসী দাস আছে, যাদের মনিব বিশ্বাসী নয় এবং তাদের অবশ্যই মুক্ত করা হবে না। তাদেরও খারাপ লাগতে পারে যখন অনেকে মুক্তি পায় কিন্তু তারাই পাবে না। একটি অন্যায় বা পরিত্যাক্ত হওয়ার ভাব তাদের মধ্যে কাজ করতে পারে।
তাই আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে এই চিঠি গরম বিষয় হয়ে দাঁড়াবে এবং ফিলীমনের উপর নানা পাশ থেকে চাপ আসবে, এমন কি বড় সমস্যা হতে পারে। পৌল এই বিষয়গুলি সব জানেন। পৌল জানেন যে তিনি একটি জটিল বিষয় নিয়ে ফিলীমনের উপর নির্ভর করছেন। পৌলের অনুরোধ একটি “ককিলের ডিমের মত”: তাতে তা দিলে ঝামেলা হয়ে যাবে। পৌল ফিলীমনকে দাসত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং এই কঠিন বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে বলেন। হয়তো এই চিঠিটি ফিলীমনের কারণে প্রয়োজন নয়, হয়তো ফিলীমন অনেক আগে থেকে ওনীষীমকে ক্ষমা করেছেন এবং তিনি তাকে খুশি মনে ভাই হিসাবে গ্রহণ করেন। হয়তো পৌল এই চিঠিতে জোর দেন না ফিলীমনের কারণে কিন্তু অন্যদের কারণে। হয়তো পৌল এই চিঠির মধ্য দিয়ে ফিলীমনকে তারই অধিকার দিতে চান, তাকে আরো শক্তিশালী বানাতে চান যখন তিনি এই গরম ব্যাপারে হাত দেবেন। হতে পারে ফিলীমন আসলেই ভাল লোক, এমন সম্মানিত এবং এমন সুনামের যে তিনি বিষয়টি জটিল হলেও বহন করতে পারবেন, দাঁড়াতে পারবেন, চাপটা মেনে নিতে পারবেন।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: ফিলীমনের উপর অনেকটা নির্ভর করে, কিন্তু আরো বেশি এখন সব কিছু ওনীষীমের উপর নির্ভর করে: যদি ওনীষীম একেবারে আদর্শ মনোভাব না দেখান, যদি সে অত্যন্ত নম্র না হয়, যদি সে কোনভাবে পৌলের চিঠি দ্বারা তৈরি সে স্বাধীনতা ভুল ব্যবহার করে, যদি সে নিজেকে অন্য দাসদের চেয়ে বড় মনে করে … তবে ওনীষীমই সব কিছু নিষ্ফল হওয়ার কারণ হয়ে যাবে, তবে সে বিপরীত প্রমাণ হয়ে যাবে (“দেখ তো ওদের মু্ক্তি দিল কি হয়??”), তবে ফিলীমন চাইলও আর কিছু করতে পারবে না এবং মণ্ডলীর সব মনিবরা সাথেসাথে সব বন্ধ করে দেবে। এভাবে ওনীষীমের উপর সব কিছু নির্ভর। হতে পারে পৌল তাকে এই বিষয় নিয়ে আগে থেকে শিক্ষা দিয়েছিলেন।
কলসীয় চিঠিতে এমন কিছু আছে যা ফিলীমন চিঠির বিষয়ে কথা বলে?
মনে রাখুন যে কলসীয় চিঠি এবং ফিলীমন চিঠি একই সময়ে একই মণ্ডলীর কাছে লেখা হয়েছে। তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে: কলসীয় চিঠিতে এমন কিছু আছে যা ফিলীমন চিঠির বিষয়ে কথা বলে?
কলসীয় চিঠিতে পৌল সুসমাচারের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ও ভিত্তিক বিষয় আর একবার শেখান: যীশুর দয়া দ্বারা বিশ্বাসীরা পরিত্রাণ পেয়েছেন এবং “এই অবস্থায় অযিহূদী বা যিহূদীর মধ্যে, সুন্নত-করানো বা সুন্নত-না-করানো লোকের মধ্যে, অশিক্ষিত, নীচজাতি, দাস বা স্বাধীন লোকের মধ্যে কোন তফাৎ নেই; সেখানে খ্রীষ্টই প্রধান এবং তিনি প্রত্যেকের মধ্যেই আছেন” (কল ৩:১১)। পৌল এভাবে দাবি করেন যে সমস্ত বিশ্বাসীদের সমান, আর পার্থক্য নেই, এমন কি স্বাধীন ও দাসের মধ্যে আর পার্থক্য নেই। তিনি সুসমাচার দ্বারা দাসত্বের পিছনে ভুল চিন্তা কেটে দেন।
কিন্তু একই সময়ে পৌল দাসদের বলেন যেন তারা বিদ্রোহ না করে, অবিশ্বস্ত না হয়, পালিয় না যায় বরং চমৎকারভাবে কাজ করেন: “তোমরা যারা দাস, তোমরা সব বিষয়ে তোমাদের এই জগতের মনিবদের বাধ্য থেকো। যখন তাঁরা তোমাদের লক্ষ্য করেন কেবল তখনই যে তাঁদের খুশী রাখবার জন্য তাঁদের বাধ্য থাকবে তা নয়, বরং খাঁটি অন্তরে প্রভুর উপর ভক্তি রেখে তাঁদের বাধ্য থেকো। তোমরা যা-ই কর না কেন, তা মানুষের জন্য নয় বরং প্রভুর জন্য করছ বলে মন-প্রাণ দিয়ে কোরো” (কল ৩:২২-২৩)। সাথে সাথে পৌল মনিবদেরও স্মরণ করিয়ে দেন যে তারাই দাসের প্রতি ব্যবহারের বিষয়ে ঈশ্বরের কাছে দায়বদ্ধ: “মনিবেরা, স্বর্গে তোমাদেরও একজন মনিব আছেন জেনে তোমরা তোমাদের দাসদের সংগে সৎ এবং ন্যায় ব্যবহার কোরো” (কল ৪:১)।
দাসত্বের বিরুদ্ধে, আমাদের যুগের একটি সামাজিক মন্দতার বিরুদ্ধে কি করব?
তাই ফিলীমন চিঠি শুধুমাত্র ক্ষমার বিষয়ে কথ বলেন, তা নয়। ফিলীমন আমাদের শিক্ষা দেন যখন আমাদের সমাজে একটি খারাপ বিষয় থাকে (যেমন সে সময় দাসত্ব) তবে কি করা যায়, কি করা ঠিক, কি করা ঠিক নয়। কেউ কেউ ফিলীমন চিঠিকে পছন্দ করে না বলে: “কেন পৌল ফিলীমনকি অতিরিক্ত জোর করেন?”। আবারও কেউ কেউ য়িলীমন চিঠিকে পছন্দ করে না বলে: “কেন পৌল দাসত্বের বিরুদ্ধে এক চেয়ে বেশি কিছু বলেন না?”
তাই আমরা এই প্রশ্ন করতে পারি: পৌল (এবং যীশু) আসলে দাসত্বের বিরুদ্ধে কি করেন? কি করেন না?
- পৌল দাসদের বিদ্রোহী হতে বলেন না, আন্দোলন চালাতে বলেন না, জোর করে মুক্তি নিতে বলেন না, পালাতে বলেন না, কাজ অস্বীকারও করতে বলেন না।
- পৌল এই বিষয়ে নিজেও কোন রাজনৈতিক আন্দোলন করেন নি, কিন্তু আইনগত পথে যদি মুক্তি পাওয়া যায়, তবে তা ভাল বলেন।
- পৌল বরং শিক্ষা দেন, এমন শিক্ষা যা দাসত্বের ভিত্তি নষ্ট করে: সব মানুষই সমান। সব মানুষদের জন্যই যীশু জীবন দিয়েছেন (গালা ৩:২৮, কল ৩:১১)।
- পৌল তারপরেও দাসদের বাধ্য, বশীভুত এবং বিশ্বস্ত হতে বলেন, তাদের চমৎকারভাবে কাজ করতে বলেন যেন তাদের ব্যবহার দ্সুসমাচারের ভাল সাক্ষ্য হয় (কল ৩:২২-২৫)।
- পৌল দাসদের বলেন যেন তারা তাদের পরিস্থিতি নিয়ে নিরুৎসাহিত না হয়, নিজেকে বেচারা মনে না করে। যদি তারা মুক্তি পেতে পারে তবে ভাল (১ করি ৭:২১-২৪)। কিন্তু মুক্তি পেতে না পারলেও: যেখানে তারা আছে তারা শক্তিশালী সাক্ষ্য দিতে পারি।
- পৌল ব্যক্তিগতভাবে দাসদের ভাল ব্যবহার করেন এবং দাসদের মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন (ফিলীমন) এবং তার শিষ্যদের একইভাবে করতে বলেন।
দেখা যায় যে পৌল স্বক্রিয়ভাবে সমাজে সত্যের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং পরিবর্তনের জন্য ঈশ্বরের উপর নির্ভর করেন। পরিবর্তন আসবে কিন্তু আস্তে আস্তে এবং ছোট ছোট ধাপে আসবে। পৌল পরিবর্তন চান বাহ্যিক পরিবর্তন বা জোর করে পরিবর্তন না বরং বিতর থেকে এবং স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা পরিবর্তন।
আধুনিক যুগের উদাহরণ
দুইটা শক্তিশালী উদাহরণ কিভাবে ঈশ্বরের পথে এবং আইনগতভাবে সামাজিক পরিবর্তন আনা হয়েছে:
- উইলিয়াম কেরী সত্যিদাহ এবং বালবিবাহ বাতিল করা
- উইলিয়াম উইল্বারফর্স্ দাসের ক্রয়-বিক্রয় এবং দাসত্ব বাতিল করা