৩ যোহন চিঠির লেখক “বুড়ো নেতা” বা “প্রাচীন” হিসাবে নিজের পরিচয় দেন (৩ যোহন ১)। তিনি অধিকারের সঙ্গে কথা বলেন। হতে পারে সিবদিয়ের ছেলে যোহন এই চিঠির লেখক, বারো শিষ্যদের মধ্যে শেষ শিষ্য যিনি তখনও জীবিত এবং অনেক বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। মণ্ডলীর ঐতিহ্য সে যোহনকে ৩ যোহন চিঠির লেখক হিসাবে চিহ্নিত করে। ৩ যোহন চিঠির প্রধান বিষয়ের ও ভাষার ক্ষেত্রে যোহনের অন্যান্য লেখাগুলির সাথে মিল আছে, যেমন যোহন লিখিত সুখবর, প্রকাশিত বাক্য এবং ১ ও ২ যোহন।
মণ্ডলীর ঐতিহ্য অনুসারে যোহন ৭০ খ্রীষ্টাব্দে যিরূশালেমের ধ্বংসের পরে এশিয়া মাইনর প্রদেশে (আজকের তুর্কী দেশে) এশিয়ার সদর থানা ইফিষ শহরে বাস করেন। তিনি সেখানে ৯৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তার জীবনের শেষ অংশ কাটান। তিনি বারো শিষ্যদের মধ্যে শেষ জীবিত প্রেরিত হিসাবে অবশ্যই মণ্ডলীর জন্য স্তম্ভ ও নোঙ্গর ছিলেন। জীবিত চোখের সাক্ষী হিসাবে তার অনেক অধিকার ছিল, যদিও তিনি নিজেকে শুধুমাত্র “বুড়ো নেতা” বলেন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা করেন (২ যোহন ১২, ৩ যোহন ১৩) এবং হতে পারে সারা এশিয়া মাইনর প্রদেশে মণ্ডলীর স্থাপন ও বৃদ্ধি কাজে দেখাশোনা করেন।
যোহন গাইয় নামে একজনের কাছে ৩ যোহন চিঠি লেখেন যার সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা নেই। যোহন তাকে প্রশংসা করেন কারণ গাইয় “সত্যের প্রতি বিশ্বস্ত” (৩ যোহন ৩) এবং তিনি ভ্রাম্যমাণ বিশ্বাসীদের ও খ্রিষ্টান কর্মীদের অতিথিসেবা দেখিয়েছিলেন (৩ যোহন ৫-৮)।
যোহন গাইয়ের কাছে দীমীত্রিয় নামে একজন লোকের সুপারিশ দেন, যদিও বুঝা যায় না কেন যোহন তা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করেন। হয়তো দীমীত্রিয় হলেন আর একজন ভ্রাম্যমাণ শিক্ষক যাকে যোহন গাইয়ের অতিথি সেবায় সমর্পিত করেন।
যোহন দিয়ত্রিফেস নামে একজন লোক উল্লেখ করেন এবং তার বিষয়ে গাইয়কে সাবধানবাণী দেন। দিয়ত্রিফেস হল সে মণ্ডলীর একজন প্রাচীন বা পালক। কিন্তু দিয়ত্রিফেস যোহনের অধিকার অস্বীকার করে মণ্ডলীর জন্য যোহনের একটি চিঠি আটকিয়ে মণ্ডলীতে তা পড়াতে দেয় না (৩ যোহন ৯)। যোহন দিয়ত্রিফেসের বর্ণনা এইভাবে দেন: “দিয়ত্রিফেস্ মণ্ডলীর মধ্যে প্রধান হতে চায়”। হতে পারে দিয়ত্রিফেস মণ্ডলীকে পরিকল্পিতভাবে সমস্ত বাইরের প্রভাব থেকে আলাদা করতে চেষ্টা করে কারণ যোহনের চিঠি অস্বীকার করার পাশাপাশি তিনি ভ্রাম্যমাণ বিশ্বাসী বা খ্রিষ্টান শিক্ষকদের রাখতে রাজি না। এর চেয়ে খারাপ: যদি মণ্ডলীর কোন সদস্য একজন ভ্রাম্যমাণ বিশ্বাসী বা খ্রিষ্টান শিক্ষককে অতিথি হিসাবে গ্রহণ করে, দিয়ত্রিফেস তাকে মণ্ডলী থেকে বের করে। হতে পারে দিয়ত্রিফেস মণ্ডলীকে সম্পূর্ণ দমন করে এবং নিশ্চিত করে যে মণ্ডলীতে অন্য কোন প্রভাব যেন আসতে না পারে।
চিঠি থেকে সম্পূর্ণ বুঝা যায় না গাইয়ের প্রতি যোহনের উদ্দেশ্য ঠিক কি। হয়তো গাইয় ও দিয়ত্রিফেস হল ভিন্ন শহরের লোক কিন্তু তাদের যোগাযোগ আছে। অথবা দিয়ত্রিফেস গাইয়ের অতিথি সেবা ব্যবহার করেছিল কিন্তু সে তা তার শহরে অন্যদের দিতে রাজি না।
অথবা – যদি গাইয় ও দিয়ত্রিফেস একই মণ্ডলীর লোক – তবে যোহন নিশ্চিত করতে চান যে গাইয় জানে যে দিয়ত্রিফেস যোহনের একটি চিঠি আটকিয়েছে। হয়তো যোহন চান যে গাইয় ভ্রাম্যমাণ বিশ্বাসীদের দিয়ত্রিফের নিষেধাজ্ঞার পরেও গ্রহণ করেন, বিশেষভাবে এমন শিক্ষক বা খ্রিষ্টান কর্মী যা মণ্ডলীতে যে সমস্যা চলছে তা সমাধান করতে চান। অবশ্যই গাইয় যদি যোহনের চিঠি অনুসারে কাজ করেন, তবে দিয়ত্রিফেস তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এবং গাইয়ের জন্য একটি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হবে। হয়তো যোহন তার এই চিঠি দ্বারা গাইয়কে শক্তি ও দিক-নির্দেশনা দিতে চান অথবা তাকে মণ্ডলীর চোখে অধিকার দিতে চান।
হতে পারে যোহন এই মণ্ডলী নিয়ে আগে থেকে দুশ্চিন্তিত যার কারণে তিনি তাদের আগে একটি চিঠি লিখেছিলেন। যোহন খবর পান যে চিঠিটি মণ্ডলীর কাছে শোনানো হয় নি এবং খ্রিষ্টান কর্মী যা যোহন মণ্ডলীর কাছে পাঠিয়েছেন তাদের অগ্রাহ্য করা হয়েছে। হয়তো গাইয় হলেন মণ্ডলীর শুধুমাত্র লোক যার কাছে যোহন এখনও কথা পৌছিয়ে দিতে পারেন যেহেতু দিয়ত্রিফেস মণ্ডলী বাইরের প্রভাব থেকে আলাদা করেছে। তাই যদি হয় যোহন গাইয়কে অনুরোধ করছেন যেন তিনি যতদূর সম্ভব মণ্ডলীতে অন্য প্রভাবের জন্য দরজা খুলে রাখেন, এমন সময় পর্যন্ত যখন যোহন নিজে আসবেন (৩ যোহন ১৪)।
২ যোহন চিঠির মত, ৩ যোহন চিঠিতেও যোহন বিশ্বাসীদের সত্য ধরে রাখতে এবং সত্যের পথে চলতে বলেন, যার প্রয়োগ হল অন্যদের কাছে ভালবাসা দেখানো ও প্রজ্ঞার সঙ্গে অতিথিসেবা করা। তা ছাড়া যোহন একজন কঠোর ও দমনকারী লোকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন।
চিঠির লেখক
চিঠির লেখক নিজেকে “বুড়ো নেতা” বলে বর্ণনা করে (৩ যোহন ১) এবং তিনি চিঠিতে আসলে অধিকারের ও বাবার উদারতার সঙ্গে কথা বলেন। মণ্ডলীর আদিপিতাদের লেখাগুলিতে চিঠির লেখক হিসাবে সিবদিয়ের ছেলে ও যাকোবের ভাই যোহন, বারো প্রেরিতদের মধ্যে একজন চিহ্নিত রাখা হয় যা এই বর্ণনার সাথে ভাল মিলে। মণ্ডলীর ইতিহাস অনুসারে ৭০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে যোহন ছাড়া সব প্রেরিতরা শহীদ মৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন, শুধুমাত্র যোহন বেঁচে আছেন। যখন ৭০ খ্রীষ্টাব্দে রোমীয়রা যিরূশালেমকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে যোহন যিরূশালেম ছেড়ে ইফিষ শহরে বাস করতে লাগলেন যা এশিয়া মাইনর প্রদেশে এশিয়া জেলার সদর থানা ও আজকের তুর্কী দেশে অবস্থিত। ইফিষ মণ্ডলীতে প্রায় ৫২ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত এবং ৫৩-৫৬ খ্রীষ্টাব্দে পৌল ইফিষ তার পরিচর্যার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করেন। পরে কিছু ক্ষণের জন্য তীমথিয় ইফিষ মণ্ডলীর দায়িত্ব নেন এবং ৭০-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে যোহন ইফিষ শহকরে বাস করে তা তার পরিচর্যার কেন্দ্র করেন। বারো প্রেরিতদের মধ্যে শুধুমাত্র যোহন বেঁচে আছেন বলে যদিও যীশুর চোখের শেষ সাক্ষী হিসাবে যোহন মণ্ডলীর জন্য অবশ্যই স্তম্ভ ও নোঙ্গরের মত একজন অধিকারগত নেতা তবুও তিনি নিজেকে নম্রভাবে “বুড়ো নেতা” বলেন। তিনি এলাকায় ভ্রমণ করেন (২ যোহন ১২, ৩ যোহন ১৪) এবং হতে পারে তিনি সারা এশিয়া মাইনর প্রদেশের অস্থিত মণ্ডলীগুলি ও নতুন মণ্ডলীর স্থাপন করার কাজের দেখাশোনাকারী।
মণ্ডলীর আদিপিতাদের লেখার পাশাপাশে আর কি প্রমাণ আছে যে যোহন ৩ যোহন নামে চিঠির লেখক? আসলে এই চিঠির এবং যোহনের অন্যান্য লেখাগুলির মধ্যে (যোহন সুসমাচার, ১ ও ২ যোহন) অনেক মিল আছে – উভয় বিষয় এবং শব্দের ব্যবহারের মিল:
বিষয় বা শব্দ |
যোহন সুসমাচার |
১ যোহন |
২ যোহন |
৩ যোহন |
সত্য |
যো 1:14, যো 8:32, যো 14:6; যো 17:8,17-19 |
1 যো 1:6-8 2:27, 3:18, 4:1-6 |
2 যো 1, 3, 4 |
3 যো 3, 4, 8, 12 |
সত্যের দরুন তোমাদের ভালবাসি |
2 যো 1 |
3 যো 1 |
||
ছেলেমেয়ে সত্যের পথে চলছে |
2 যো 4 |
3 যো 4 |
||
যারা মন্দ করে তারা ঈশ্বরের লোক নয়, ঈশ্বরকে দেখে নি |
1 যো 3:10 |
3 যো 11 |
||
অতিথি পারয়ণ হওয়া |
যো 2:1-11 |
2 যো 10-11 |
3 যো 5-8,10 |
|
শেষ সুভেচ্ছা |
2 যো 12-13 |
3 যো 13-1 |
চিঠির প্রাপক
যোহন “গাইয়” নামে একজনের কাছে এই স্নেহশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ চিঠি লেখেন। এই গায় কে? বাইবেলে এই নামের কয়েকজনকে উল্লেখ করা হয়েছে:
- ম্যাসিডোনিয়ার গাইয়, পৌলের একজন সহকর্মী যিনি আরিষ্টার্খ নামে আর একজন সহকর্মীর সঙ্গে তৃতীয় প্রচার যাত্রায় ইফিষ শহরে পৌলের সঙ্গে পরিচর্যা করেন। যখন রূপা মিস্ত্রীরা পৌলের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালায় তখন গায় ও আরিষ্টার্খকেও পৌলের সঙ্গে ধরা হয় (প্রেরিত ১৯:২৯)।
- দর্বী শহরের গাইয়, পৌলের আর একজন সহকর্মী, যার নাম পৌলের তৃতীয় প্রচার যাত্রায় আরিষ্টার্খ, সিকুন্দ, তীমথিয়, তুখিক ও ত্রফিমের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয় (প্রেরিত ২০:৪)।
- করিন্থ শহরের গাইয়, মণ্ডলীর স্থাপনের সময় থেকে একজন বিশ্বাসী যাকে পৌল বাপ্তিস্ম দে। পৌলের তৃতীয় প্রচার যাত্রার সময় যখন পৌল করিন্থ থেকে রোমীয় চিঠি লেখেন তখন তিনি সে গায়ের বাড়ীতে থাকেন (রোমীয় ১৬:২৩)।
হতে পারে যোহনের চিঠির প্রাপক “আমার সেই প্রিয় বন্ধু গাইয়” (৩ যোহন ১) এশিয়া জেলার বাসিন্দা, অথবা এশিয়া মাইনর প্রদেশের বাসিন্দা, এবং হয়তো তিনি উপরে তিনজন উল্লিখিত গাইয়ের মধ্যে একজন – অথবা তিনি আর একজন গাইয় যার উল্লেখ প্রেরিত পুস্তকে উল্লেখ নেই। গাইয়ের পরিচয়ের বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু বলা যায় না।
যোহন কখন এই চিঠিটি লেখেন তা নির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। ভিত্তিকভাবে বলা যায় যে তা ৭০-৯৮ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে পড়ে যখন যোহন এশিয়া মাইনরে বাস ও পরিচর্যা করেন।
যোহন চিঠিটি ঠিক কোন সালে লিখেছিলেন তা নিশ্চিত জানা যায় না কিন্তু ভিত্তিকভাবে বলা যায় যে তা ৭০-৯৮ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে পড়ে যকন যোহন এশিয়া মাইনরে বাস ও পরিচর্যা করেন।
গাইয় কোন মণ্ডলীর সদস্য বা প্রাচীন তাও নির্দিষ্টভাবে বলা যায় না তবে হতে পারে তিনি এশিয়া মাইনরের প্রদেশের কোন মণ্ডলীর লোক। মণ্ডলীটির স্থাপনের গল্পও নিশ্চিত জানা যায় না। আমরা সাধারণভাবে বলতে পারি যে পৌল এশিয়া মাইনরের গালাতীয়া এলাকায় ৪৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে সুসমাচার প্রচার ও বিভিন্ন মণ্ডলী স্থাপন করেছিলেন। ইফিষ শহরে কম পক্ষে ৫২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে মণ্ডলী উপস্থিত এবং যে পৌল তা ৫৩-৫৬ খ্রীষ্টাব্দে তার পরিচর্যার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করে। সে সময় উভয় প্রেরিতদের দ্বারা (যেমন পৌল, আকিলা, প্রিষ্কিল্লা, হতে পারে পিতর) এবং স্থানীয় ধর্মান্তিরতদের দ্বারা বিভিন্ন মণ্ডলীগুলি স্থাপিত হয়, যেমন ইপাফ্রা (কল ১:৭)। এই এলাকার মণ্ডলীগুলি পৌলের কাছ থেকে বেশ কিছু চিঠি পায় (যেমন ইফিষীয়, কলসীয়, ফিলীমন, ১ তীমথিয়, হতে পারে ২ তীমথিয়), পিতর থেকে চিঠি পায় (যেমন ১ পিতর ও হতে পারে ২ পিতর) এবং এখন যোহন থেকে চিঠি পায় (যোহন সুসমাচার, প্রকাশিত বাক্য, ১, ২, ৩ যোহন)।
ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
২ যোহন ও ৩ যোহন চিঠির মধ্যে বেশ মিল পাওয়া যায় বলে ধারণা করা যায় যে দুইটি চিঠি কমবেশি একই সময়ে, একই এলাকার জন্য ও একই পরিস্থিতিতে লেখা। উভয় চিঠিতে যোহন অতিথিপরায়ণ হওয়ার বিষয় নিয়ে কথা বলেন, ২ যোহন চিঠিতে একটি ভ্রান্ত শিক্ষকের কারণে, ৩ যোহন চিঠিতে মণ্ডলীর একটি দমনকারী নেতার কারণে।
সে সময় প্রচলিত ভ্রান্ত শিক্ষা ছিল নস্টিসিসম। নস্টিক চিন্তা ২ যোহন চিঠিতে পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। ৩ যোহন চিঠিতে তার সরাসরি কোন উল্লেখ না থাকলেও হতে পারে তা মণ্ডলীতে টেনশনের এবং অতিথিপরায়ণ হওয়ার বিষয় উঠে আসার একটি কারণ। যদিও নস্টিক চিন্তা ৩ যোহন চিঠিতে সরাসরি উল্লেখ নেই তবুও নিচে নস্টিসিসমের একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে:
নস্টিসিসমের (gnosticism) বর্ণনা
নস্টিসিসম হল একটি মিশানো ভ্রান্ত শিক্ষা যা কিছু শতাব্দী ধরে মণ্ডলীকে খুব হয়রানি করছিল। প্রেরিত যোহন এবং মণ্ডলীর বেশ কয়েকজন আদিপিতাদের অধিকাংশ লেখাগুলো ছিল নস্টিসিসমের বিরুদ্ধে লেখা।
গ্রীক শব্দ ‘নসিস’ (gnosis) থেকে ‘নস্টিসিসম’ শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে। নস্টিসিসমের অনুসরণকারীদের বলা হত ‘নস্টিক’ (gnostic)। ‘নসিস’ শব্দের অর্থ হল ‘জ্ঞান’। যদিও নস্টিকদের মধ্যে বিভিন্ন দল ছিল, তাদের সবার এই ক্ষেত্রে মিল ছিল যে তারা জ্ঞানের উপরে খুব গুরুত্ব দিত। তারা ‘জ্ঞান’ বললে বুঝত: ‘গুপ্ত আত্মিক জ্ঞান, যা দ্বারা পরিত্রাণ পাওয়া যায়’।
নস্টিসিসম খুব গুরুত্বের সঙ্গে দাবি করত যে বস্তু জগত ও আত্মিক জগত সম্পূর্ণ আলাদা অর্থাৎ – বস্তু জগত মন্দ এবং আত্মিক জগত ভাল। তাই মানুষ বাস করে একটি দ্বিখন্ডিত বাস্তবতায়।
নস্টিসিসম আবার দাবি করত যে ‘সর্বোচ্চ কর্তা’ বলে কেউ আছেন যিনি সম্পূর্ণ ভাল এবং ‘আত্মা মাত্র’ – তাই খাঁটি আত্মা হিসাবে তিনি এই মন্দ বস্তু জগত থেকে এত দূরে ও এত আলাদা যে তার বস্তু জগতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোন জ্ঞানও নেই। এই কর্তার কোন ব্যক্তিত্ব নেই, তাকে জানা যায় না, চেনাও যায় না। নস্টিক চিন্তায় ‘জানা’ মানে ‘দমন করা’। সর্বোচ্চ কর্তাকে কেউ দমন করতে পারে না বলে কেউ তাকে জানতেও সক্ষম হয় না।
কিন্তু তা যদি হয়, এই বস্তু জগত কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? মন্দ কিভাবে তৈরি হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে নস্টিসিসম একটি খুব জটিল ব্যাখ্যা দেয় – সর্বোচ্চ কর্তা থেকে আত্মিক অগ্নিকণা বা রশ্মির মত কিছু বের হতে থাকে। নস্টিকেরা এই অগ্নিকণাগুলো বা রশ্মিগুলোকে ‘এ্যায়োন’ (aeon) বলে। সব এ্যায়োনদের একসাথে ‘প্লেরোমা’ (pleroma) বলা হত, নস্টিকেরা তা সর্বোচ্চ কর্তার পূর্ণতা হিসাবে মনে করত। নস্টিক চিন্তা অনুসারে এই অগ্নিকণাগুলো ভাল, কিন্তু সর্বোচ্চ কর্তার মত বেশি ভাল নয়, অর্থাৎ খুব খাঁটি রশ্মিগুলোর পাশাপাশি তুলনামূলক কম খাঁটি ধরণের রশ্মিও আছে, এমন কি কিছু মন্দ রশ্মিগুলোও পাওয়া যেত।
নস্টিসিসম বলে যে এই মন্দ রশ্মিগুলোর মধ্যে একজনই সর্বোচ্চ কর্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে দূর্ঘটনায় বস্তু জগত সৃষ্টি করে ফেলেছিল। কিছু নস্টিক শিক্ষক বলত যে বাইবেলের সৃষ্টিকর্তাই সেই মন্দ রশ্মি বা ‘এ্যায়োন’। তাই নস্টিকেরা পুরাতন নিয়ম খুব নিচু চোখে দেখত যদিও তারা নতুন নিয়ম থেকে বিভিন্ন চিন্তা গ্রহণ করত।
নস্টিসিসম আরো বলত যে প্লেরোমার মধ্য থেকে কিছু রশ্মিগুলো মন্দ বস্তুর মধ্যে আটকিয়ে পড়েছিল, এমন কি কিছু মানুষের দেহের মধ্যে আটকিয়ে পড়েছিল। তাই নস্টিসিসম বলে যে তিন ধরণের মানুষ আছে। তা হল:
- নস্টিক মানুষ (gnostic) এদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্তার একটি রশ্মি আছে। তারা ‘আত্মিক’ বা ‘আলোকিত’ এবং তাদের আশা আছে যে – জগতে নানা আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করলে মৃত্যুর সময় তারা পুনরায় জন্ম থেকে মুক্ত হয়ে সর্বোচ্চ কর্তার সঙ্গে আবার এক হতে পারবে।
- সাইকিক মানুষ (psychic) এরা কম উন্নত মানুষ, এদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্তার রশ্মি থাকতেও পারে। এদের আলোকিত হওয়ার আশা আছে কিন্তু নিশ্চয়তা নেই। নস্টিকেরা মনে করত যে খ্রিষ্টানরা সাইকিক দলে পড়ে।
- হাইকিক মানুষ (hychic) এরা বস্তু মানুষ মাত্র, এদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্তার কোন রশ্মি নেই। এরা আলোকিত হতে পারে না। তাই এরা পরিত্রাণ পেতে পারে না বরং ধ্বংসে সমর্পিত।
নস্টিসিসম খ্রিষ্টান ধর্ম থেকে এই চিন্তা গ্রহণ করল যে – সেই সর্বোচ্চ কর্তা একজন উদ্ধারকর্তা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন যার মধ্য দিয়ে সাইকিক বা নস্টিক মানুষ প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়। যাদের মধ্যে একটি ঐশ্বিক রশ্মি আছে, তারা জ্ঞান ও আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করার মধ্য দিয়ে আলোকিত হতে সক্ষম হবে এবং তাদের দেহে আটকানো সে ঐশ্বিক রশ্মি মৃত্যুর সময়ে মুক্ত হয়ে সর্বোচ্চ কর্তার সাথে আবার এক হবে।
তাই নস্টিক চিন্তা অনুসারে পাপ-স্বভাব বা খারাপ আচরণ মানুষের প্রধান সমস্যা নয় বরং মানুষের সমস্যা হল ‘দেহ’ বা ‘বস্তু জগত’। নস্টিসিসম অনুসারে ‘পরিত্রাণ’ মানে না ‘যীশু দ্বারা পাপ থেকে উদ্ধার’ বরং ‘পরিত্রাণ’ মানে হল – মানুষ জ্ঞান লাভের মধ্য দিয়ে তার দেহে সে ঐশ্বিক রশ্মি আলোকিত করতে সক্ষম। এভাবে সে ‘আলোকিত’ বা ‘পরিত্রাণ প্রাপ্ত’ হয়ে যায়।
নস্টিসিসম অনুসারে মানুষের কি প্রয়োজন? মানুষের প্রয়োজন জ্ঞান লাভের মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ প্রকাশ পাওয়া, আলোকিত হওয়া ও আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করা। কে তা পেতে সক্ষম হবে? শুধুমাত্র বিশেষ লোক তা পেতে সক্ষম হবে, সবাই না। তাই নস্টিসিসম ছিল ‘বিশেষ লোকদের গুপ্ত দল’। নস্টিকেরা অন্য মানুষদের আশাহীন বলে বাদ দিত। নস্টিকদের মধ্যে বিভিন্ন দল বা আলোকিত হওয়ার বিভিন্ন স্তর থাকত। ফলে নস্টিসিসমে অনেক উঁচু-নিচু ভাব ও যথেষ্ট অহংকার থাকত।
নস্টিকেরা দাবি করত – যারা আলোকিত স্তরে পৌঁছায় তারা পাপ দ্বারা আর আক্রান্ত নয় বা নিজেকে আর দোষী করতে সক্ষম হয় না। যদি পরিত্রাণ জ্ঞান, আত্মিক অভিজ্ঞতা বা আলোকিত হওয়ার উপর নির্ভর করে তবে তা নৈতিক ব্যবহার ও আচরণের উপর নির্ভর করে না। ফলে নস্টিকেরা নৈতিকতায় বেশি গুরুত্ব দিত না। নস্টিকেরা দাবি করত যে মানুষের দেহ মন্দ এবং মানুষের দেহ ও তার আত্মা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। তাই একজন মানুষের আত্মা একবার আলোকিত হলে তবে সে দেহ দিয়ে কি করে, তাতে কিছু যায় আসে না।
এই দ্বিখন্ডিত চিন্তা থেকে দুই ধরণের শিক্ষা তৈরি হল – একদিকে সন্ন্যাসী চিন্তা (দেহকে দমন করে ও কষ্ট দিয়ে মানুষ বস্তুর উপরে জয়ী হয়) অথবা অন্য দিকে উদারপন্থী চিন্তা (দেহ আত্মাকে দূষিত করতে পারে না, তাই দেহ নিয়ে যা চাই তাই করা যায়)।
যীশু সম্বন্ধে নস্টিসিসমের ব্যাখ্যা
নস্টিসিসম বিশ্বাস করতে পারে না যে ঈশ্বর মানুষ হলেন, কারণ পবিত্র আত্মা বা কোন সর্বোচ্চ কর্তা নিজেকে বস্তু শরীর দিয়ে দূষিত করবে না। তাহলে নস্টিকেরা যীশুর গল্প কিভাবে ব্যাখ্যা করত?
কিছু নস্টিকেরা বলত – যীশু ছিলেন ‘আত্মা মাত্র’ অর্থাৎ এমন একটি আত্মা যিনি নিজেকে ‘মানুষের মত’ প্রকাশ করতেন কিন্তু আসলে তাঁকে স্পর্শ করা যেত না বরং মাটির উপর হাঁটলেও তাঁর পায়ের ছাপ পাওয়া যেত না।
অন্য কিছু নস্টিকেরা দাবি করত – যীশু পবিত্র আত্মা দিয়ে জন্ম নেন নি বরং তিনি মরিয়ম ও যোষেফের সাধারণ সন্তান ছিলেন যদিও তিনি অন্য লোকদের চেয়ে একজন ধার্মিক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। তার বাপ্তিস্মের সময়ে তিনি ‘খ্রীষ্ট’ নামক আত্মা পান। অর্থাৎ খ্রীষ্ট-আত্মা পাওয়া যীশু ছিলেন প্রথম নস্টিক। তিনি এই মন্দ জগতের নন বলে প্রলোভিতও হন না, তিনি আঘাত বা ব্যাথা পান না, তিনি ছিলেন এমন একজন আত্মিক ব্যক্তি যাকে বস্তু জগত স্পর্শ করতে সক্ষম নয়। এই চিন্তাকে ‘ডোসিটিসিসম’ (doceticism) বলা হয়।
যীশুকে ক্রুশে দেওয়ার আগে খ্রীষ্ট-আত্মা তাকে ছেড়ে স্বর্গে চলে যান কারণ একজন আত্মাকে কষ্ট বা লজ্জা দেওয়া সম্ভব না। এই জগত তাঁকে দূষিত করতে পারে না, মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। যীশুর শারীরিক যন্ত্রণা ও ক্রুশে মারা যাওয়ার আগেই খ্রীষ্ট-আত্মা তাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল কারণ কোন আত্মা যন্ত্রণা বা মৃত্যু দিয়ে দূষিত হতে পারে না।
নস্টিসিসম বাইবেলীয় শিক্ষার বিরুদ্ধে
নস্টিসিসম হল একটি বিপজ্জনক ভ্রান্ত শিক্ষা যা মানুষের পাপ সমস্যা মনে করে না। নস্টিসিসমে পাপ স্বীকার, অনুতাপ, ক্ষমা চাওয়া ও জীবনকে পরিবর্তন করার কোন দাবি নেই। পবিত্র জীবন-যাপন, নৈতিক ব্যবহার, স্বার্থহীনতা, সেবা ও ভালবাসার গুরুত্ব নেই। নস্টিকেরা ভাল আচরণ ও চরিত্রের অনুসন্ধানী নয় বরং জ্ঞান, প্রকাশ ও আত্মিক অভিজ্ঞতার অনুসন্ধানী।
নস্টিসিসম অধিকাংশ মানুষকে নীচু চোখে দেখে, নিজেকে বিশেষ মনে করে, পার্থক্য করে ও অন্যদের বাদ দেয়। তাই নস্টিসিসম ‘আলোকিতদের’ অহংকার, স্বার্থপরতা ও অন্যদের নীচু চোখে দেখা উৎসাহিত করে, ‘সাইকিকদের’ (বিশ্বাসীদের) নিজের পরিত্রাণ নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে এবং ‘হাইকিকদের’ (বাকি সব লোকদের) জন্য কোন আশা দেখায় না। তা হল সুসমাচারের ঠিক বিপরীত। সুসমাচার সব জাতিদের জন্য যীশুতে বিশ্বাস দ্বারা আশার বাণী দেয়।
নস্টিসিসম মানুষের সিদ্ধান্ত, সুখবর শুনে সাড়া, মানুষের হৃদয় ও মনোভাব একটাতেও গুরুত্ব দেয় না। বরং কার মধ্যে ঐশ্বিক রশ্মি থাকে, তা নিয়ে ব্যস্ত। ফলে অহংকার, মানুষের মধ্যে পার্থক্য করা ও নিজের জ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত থাকার একটি মনোভাব উৎসাহিত করে। নস্টিসিসম অধিকাংশ লোকদের ‘আলো ছাড়া’, এমন কি ‘আশা ছাড়া’ মনে করে। তাই নস্টিসিসম পরিত্রাণ ও অনন্ত জীবন নিয়ে নিশ্চয়তা নষ্ট করে (কলসীয় পুস্তক দেখুন)।
জ্ঞান, প্রকাশ, বিশেষ আত্মিক অভিজ্ঞতা, আলোকিত হওয়ার অনুসন্ধান, গুপ্ত জ্ঞান, নিজেকে আলাদা মনে করা, তা সব লোকদের প্রতারণার ঝুঁকিতে, এমন কি অনৈতিকতার ঝুঁকিতেও ফেলে।
নস্টিসিসম বিশ্বাস করে না যে – যীশু ঈশ্বর, যিনি মানুষ হিসাবে পৃথিবীতে এসেছেন (কেন একজন খাঁটি আত্মা এই মন্দ বস্তু জগতে নামবে?), যীশু পুনরুত্থিত হয়েছেন (কেন একটি খাঁটি আত্মা নতুন দেহ চাইবে?), যীশুর দ্বিতীয় আগমনে সব সৃষ্টির পুনরুদ্ধার ঘটবে (কেন ঈশ্বর একটি বস্তু জগত পুনরায় স্থাপন করবেন?)।
গাইয়ের কাছে যোহনের কথা
গাইয়ের উদারময় সুপারিশ
যোহন গাইয়কে খুব সুন্দরভাবে অভিবাদন করে বলেন “ঈশ্বরের সত্যের দরুন আমি যাকে ভালবাসি আমার সেই প্রিয় বন্ধু গাইয়ের কাছে… এই চিঠি লিখছি”। যোহন গাইয়কে ভ্রাম্যমান বিশ্বাসী বা শিক্ষকদের জন্য তার ভালবাসা ও বিশ্বস্ত অতিথি সেবার জন্য প্রশংসা করেন (৩ যোহন ৫-৮)। অনেকে তার অতিথি সেবাই আশীর্বাদ পেয়েছিলেন এবং তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করেছিলেন (৩ যোহন ৬)। যোহন আরো তার সুপারিশ করেন: “আমি খুবই আনন্দিত হলাম যখন কয়েকজন বিশ্বাসী ভাই এসে তোমার বিষয় এই সাক্ষ্য দিল যে, ঈশ্বরের সত্যের প্রতি তুমি বিশ্বস্ত আছ এবং তার মধ্যেই চলছ। আমার সন্তানেরা যে ঈশ্বরের সত্যের মধ্যে চলাফেরা করছে, এই কথা শোনার চেয়ে বড় আনন্দ আমার আর নেই” (৩ যোহন ৩-৪)। যোহন গাইয়কে উৎসাহ করেন যে তিনি যে ভাল করেন তা যেন করতে থাকেন: সত্যে চলা ও অন্যদের সেবা (৩ যোহন ৬)।
যোহন গাইয়ের কাছে দীমীত্রিয় নামে একজনের সুপারিশ দেন (৩ যোহন ১২)। যোহন কোন উদ্দেশ্যে গাইয়ের কাছে এই সুপারিশ দেন তা চিঠি থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় না। হয়তো দীমীত্রিয় হলেন আর একজন ভ্রাম্যমান বিশ্বাসী বা শিক্ষক এবং যোহন গাইয়কে অনুরোধ করেন যেন তিনি তাকে স্বাগতম জানান।
মণ্ডলীর অবস্থা
চিঠি থেকে বুঝা যায় যে যোহনের এই চিঠি লেখার প্রধান কারণ হল দিয়ত্রিফেস নামে একজনের খারাপ ব্যবহার (৩ যোহন ৯-১০)। দিয়ত্রিফেস ঠিক কি করল? যোহন বলেন যে সে “মণ্ডলীর মধ্যে প্রধান হতে চায়” এবং “আমাদের কথা মানে না” যার অর্থ যে সে যোহনের অধিকার অস্বীকার করে (৩ যোহন ৩:৯)। দিয়ত্রিফেস যোহনের একটি চিঠি মণ্ডলীকে পড়তে দিচ্ছে না। তা ছাড়া তিনি “আমাদের বিরুদ্ধে হিংসা করে অনেক মিথ্যা কথা বলেছে” (৩ যোহন ১০)। “আমাদের” এখানে হতে পারে যোহন এবং অন্যান্য সৎ বিশ্বাসীদের বুঝায়। দিয়ত্রিফেস আরো ভ্রাম্যমাণ বিশ্বাসী বা শিক্ষকদের অগ্রাহ্য করেন। মণ্ডলীর অন্যান্য সদস্য যারা তাদের গ্রহণ করতে চায় তাদেরকে দিয়ত্রিফেস বাধা দেয় ও মণ্ডলী থেকে বের করে দেয় (৩ যোহন ১০)।
মণ্ডলীতে দিয়ত্রিফেসের ভূমিকা কি? চিঠি থেকে বুঝা যায় যে সে মণ্ডলীর একজন প্রভাবশালী প্রাচীন বা নেতা কারণ তার নেতৃত্ব না থাকলে তবে সে সদস্যদের মণ্ডলী থেকে বের করতে সক্ষম হত না। আরো বুঝা যায় যে দিয়ত্রিফেস মণ্ডলীর সদস্যদের যোহন ও অন্যান্য সৎ বিশ্বাসীদের থেকে বিছিন্ন করার জন্য তার প্রভাব ও ক্ষমতা ব্যবহার করে। হয়তো সে নস্টিক শিক্ষার প্রভাবে পড়েছে এবং যখন যোহন মণ্ডলীকে সঠিক পথে আনতে চান সে যোহনের প্রভাব প্রতিরোধ করে। তবুও চিঠিতে একটি ভ্রান্ত শিক্ষার সরিসরি উল্লেখ নেই। অথবা দিয়ত্রিফেস ভ্রান্ত শিক্ষার কারণে নয় বরং কেবল ক্ষমতার লোভে মণ্ডলীকে অন্যদের থেকে বিছিন্ন করে যেন সদস্যরা আরো তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় দে দিয়ত্রিফেস মণ্ডলীকে দমন করে: সে যোহনের চিঠি পড়তে দিচ্ছে না, সে ভ্রাম্যমাণ বিশ্বাসী বা শিক্ষকদের অগ্রাহ্য করেন এবং তিনি মণ্ডলীর সদস্যদের তাই করতে নিষেধ করে। সে স্বক্রিয়ভাবে মণ্ডলীকে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক বা অন্যদের প্রভাব থেকে বিছিন্ন করে।
কিন্তু যোহন এইসব গাইয়কে বলার উদ্দেশ্য কি? এই মণ্ডলীতে গাইয়ের ভূমিকা কি? দিয়ত্রিফেসের সাথে তার সম্পর্ক কি?
হয়তো গাইয় ও দিয়ত্রিফেস ভিন্ন জায়গায় বাস করেন কিন্তু তারা পরস্পরকে চেনেন ও তাদেরর মাঝের মধ্যে লেনদেন আছে। হয়তো দিয়ত্রিফেস মাঝের মধ্যে গাইয়ের অতিথিসেবা ব্যবহার করে কিন্তু নিজের মণ্ডলীতে তা করতে দেয় না।
অথবে গাইয় ও দিয়ত্রিফেস একই মণ্ডলীতে আছেন। হয়তো গাইয় হলেন মণ্ডলীর নেতা এবং দিয়ত্রিফেস হলেন একজন দমনকারী প্রাচিন। তাই যদি হয় তবে যোহন চান যেন গাইয় দিয়ত্রিফেসের এই দমনকারী ব্যবহার বন্ধ করেন। হয়তো গাইয় হলেন একজন কোমল নেতা যিনি দ্বন্দ্ব অপছন্দ করে বলে তার প্রাচীনকে সংশোধন করেন না। হয়তো তিনি এমন একজন নেতা যাকে একজন দমনকারী ও কৌশলী প্রাচীন দ্বারা সরানো হচ্ছে।
কিন্তু আরো সম্ভাবনা আছে যে দিয়ত্রিফেস হল মণ্ডলীর নেতা এবং সে তার ক্ষমতা ব্যবহার করছে এই মণ্ডলী যোহনের প্রভাবে থেকে বিছিন্ন করতে এবং সম্পূর্ণভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে – তা নস্টিক শিক্ষার কারণে হোক বা দমনের বিষয় হোক। গাইয় হয়তো মণ্ডলীর শেষ প্রাচীন যার সাথে যোহনের সম্পর্ক বা যোগাযোগ আছে। মণ্ডলীর কাছে কথা পৌঁছানোর উপায় দিয়ত্রিফেস বন্ধ করেছে বলে যোহন হয়তো তার কাছে চিঠি লেখেন। তাই যদি হয় তবে যোহন এই চিঠি দ্বারা নিশ্চিত করতে চান যেন গাইয় কিছু না বলে এই ঘটনাগুলি ঘটতে দেবেন না। যোহন গাইয়কে পরিষ্কারভাবে বলেন যে তিনি এবং সব সৎ বিশ্বাসীরা দিয়ত্রিফেসের ব্যবহার কোন মতে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। হয়তো যোহন চান যেন গাইয় দিয়ত্রিফেসের চাপ অগ্রাহ্য করে তারপরেও ভ্রাম্যমাণ বিশ্বাসী বা শিক্ষকদের স্বাগতম জানান, এমন লোক যারা মণ্ডলীর উপর একটি ভাল প্রভাব ফেলতে পারবে। গাইয় যদি তাই করেন তবে তিনি সংকটে পড়বেন কারণ তা হল দিয়ত্রিফেসের সাথে দ্বন্দ্বের পথ। হয়তো যোহন গাইয়কে সাহস ও শক্তি দিতে চান – অথবা যোহন গাইয়কে মণ্ডলীর চোখে অধিকার দান করতে চান।
যোহন অবশ্যই এই মণ্ডলী নিয়ে এখন দ্বিগুণ চিন্তিত: তিনি মণ্ডলীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখেছিলেন, পরে তিনি শুনেছিলেন যে তার চিঠি মণ্ডলীকে পড়ানো হয় নি এবং যে লোকদের তিনি হয়তো পাঠিয়েছিলেন তাদের অগ্রাহ্য করা হয়েছে। হয়তো গাইয় হলেন মণ্ডলীর শুধুমাত্র লোক যাকে যোহন জানেন এবং যার কাছে তিনি এখনও কথা পৌঁছাতে পারেন – কারণ দিয়ত্রিফিস বাইরের প্রভাব প্রতিরোধ করছে। তাই যোহন গাইয়কে অনুরোধ করেন যেন তিনি মণ্ডলীকে প্রভাব ফেলেন এবং সাহায্য করেন যেন মণ্ডলী আবার খোলা হয়, এমন সময় পর্যন্ত যে যোহন নিজেই বেড়াতে আসবেন (৩ যোহন ১৪)। তাই যদি হয় তবে দীমীত্রিয় হয়তো চিঠির বাহক যার এখন অতিথি সেবা প্রয়োজন। অথবা দীমীত্রিয় এমন একজন যাকে যোহন তার আগে পাঠান মণ্ডলীকে সাহায্য করতে।
একটি মণ্ডলী যখন এই রকম অবস্থায় পড়ে সাধারণত সদস্যরা অনেক আঘাতে ও এলোমেলোতে ভুগে। সদস্যরা মণ্ডলীর নেতৃত্ব মানতে চায়, বিশ্বস্ত হতে চায়, বাধ্য হতে ঠিক মনে করি কিন্তু মেনে তাদের খারাপ লাগে ও তারা চেতনার রব নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে। যখন নেতার কথা একদিকে টানে এবং হৃদয়ে পবিত্র আত্মার রব বিপরীত দিকে টানে তা বিশ্বাসীর জন্য অত্যন্ত কঠিন ও বিভ্রান্তির বিষয়। একজন নেতার দমনের কারণে সদস্যদের এক পাশে মিথ্যা বিশ্বস্ততা, মিথ্যা বাধ্যতায় বা মিথ্যা অনুমোদনে নিয়ে যায়, ওপর পাশে তাদের চেতনায় গুরুত্ব দেওয়ার ও সঠিক ব্যবহার করার জন্য নিরুৎসাহিত করা হ। এভাবে সদস্যদের সংকটে, আঘাতে, বিভেদে, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ও বিভ্রান্তিতে ফেলা হয় এবং পবিত্র আত্মার চেতনার বিরুদ্ধে যাওয়ার প্রলোভনে ফেলা হয়।
যোহন মণ্ডলীর অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তিত বলে তিনি একটি চিঠি লিখতে প্রয়োজন মনে করেন, প্রয়োজন হলে বেড়াতে যাওয়ার চিন্তাও করেন (৩ যোহন ১৪).