সরকার ০৭ – নতুন নিয়মের দাসত্ব

  • দাসত্ব প্রত্যেক যুগে ও মোটামুটি প্রত্যেক জাতিতে চর্চা করা হত। দাসত্ব (বা দাসত্বের মত অবস্থা) আজ পর্যন্ত সারা পৃথিবী প্রচলিত।
  • যীশুর সময়েও দাসত্ব খুবই প্রচলিত ছিল, রোমীয়রা ও গ্রীকরা উভয় অনেক দাস রাখত। অনুমান করা যায় যে লোকসংখ্যার ৭০% দাস ছিল।
  • যীশু কি দাসত্ব নিয়ে কথা বলেন? তার বিরুদ্ধে কাজ করেন? নতুন নিয়ম দাসত্বের বিষয়ে কি বলে?
পুরাতন নিয়মে দাসত্ব

মোশির আইন-কানুনে দাসদের অধিকার রক্ষাকারী আইন আছে, কিন্তু দাসত্ব নিষেধ করার মত আইন নেই

  • ঋণ ৭ম বছরে বাতিল করে দিতে হবে (দ্বিতীয় বিবরণ ১৫:১-৩) ও বন্দী শ্রমিক মুক্ত করতে হবে (দ্বিতীয় বিবরণ ১৫:১২-১৮)।
  • গরীব, বিধবা, অনাথ ও বিদেশীদের জন্য যোগানের ব্যবস্থা করতে হবে (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:২৯-২২)।
  • শ্রমিকদের ও দাস-দাসীদের সাপ্তাহিক ছুটি দেওয়া (দ্বিতীয় বিবরণ ৫:১৪)।
  • কাজের সময়ে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আদেশ (দ্বিতীয় বিবরণ ২২:৮) আছে।
  • শারীরিক আঘাত দিলে মুক্ত করার আদেশ আছে (যাত্রা ২১:২০-২৭)।
নতুন নিয়মে দাসত্ব সম্বন্ধে কি কথা আছে? দাসত্বের ধারণা কিভাবে উপস্থাপনা করা হয়?

একজন মানুষ হিসাবে আমি ঈশ্বরের দাস। তাঁর দাস হওয়া হল মানুষের জন্য উপযুক্ত পদ।

  • সেইমতই তিনি তাঁর দাস ইস্রায়েলকে সাহায্য করেছেন” (লূক ১:৫৪)।
  • শিমিয়োন বলেন: “প্রভু, তুমি তোমার কথামত তোমার দাসকে এখন শান্তিতে বিদায় দিচ্ছ”  (লূক ২:২৯)।
  • “আমি খ্রীষ্ট যীশুর দাস পৌল” (রোমীয় ১:১)।
  • “আমরা অপদার্থ দাস; যা করা উচিত আমরা কেবল তা-ই করেছি” (লূক ১৭:৭-১০)।

যীশু নিজেই দাস হয়েছিলেন:

  • “তিনি বরং দাস হয়ে এবং মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করে নিজেকে সীমিত করে রাখলেন” (ফিলিপীয় ২:৭)।

‘দাস হওয়া’ হল নেতা হওয়ার একটি উপযুক্ত বর্ণনা বা রূপক। যীশু বলেন:

  • “তোমাদের মধ্যে …যে নেতা, সে সেবাকারীর মত হোক” (লূক ২২:২৬)।
  • “মনুষ্যপুত্র সেবা পেতে আসেন নি বরং সেবা করতে এসেছেন” (মথি ২০:২৮)।

আবার: যীশু নিজেই দাস হলেন ও এভাবে নেতা হওয়ার সবচেয়ে চমৎকার আর্দশ হলেন। যীশু (যেমন স্বর্গস্থ পিতাও) দাবী করেন যেন মানুষ মনে-প্রাণে তাঁর প্রতি বাধ্য হয়।

  • “দাস তার মনিবের চেয়ে বড় নয়। সেইজন্য লোকেরা যদি আমাকে মেরে ফেলবার চেষ্টা করে থাকে তবে তোমাদেরও তা-ই করবে; যদি তারা আমার কথা শুনে থাকে তবে তোমাদের কথাও শুনবে” (যোহন ১৫:২০)।

কিন্তু যীশু দাসদের দাস থাকতে দেন না বরং তাদের দাসের চেয়ে বেশী কিছু বানান:

  • “আমি তোমাদের আর দাস বলি না…বন্ধু বলেছি” (যোহন ১৫:১৫)।
  • “ফলে তোমরা আর দাস নও বরং সন্তান” (গালা ৪:৭)।

নতুন নিয়ম দাসত্বের ধারণা এভাবেও ব্যবহার করে: আমরা সবাই দাস।

  • যারা পাপে পড়ে থাকে তারা সবাই পাপের দাস” (যোহন ৮:৩৪)।
  • “দাসের মত যখন তোমরা কারও হাতে নিজেদের তুলে দাও…তখন তোমরা আসলে তার দাসই হয়ে পড়? সেইভাবে হয় তোমরা পাপের দাস হয়ে মরবে, নয় ঈশ্বরের দাস হয়ে ন্যায় কাজ করবে” (রোমীয় ৬:১৬)।
  • “কেউ যদি কোন কিছুর কাছে হার মানে তবে সে তার দাস হয়” (২ পিতর ২:১৯)।
  • “কোন দাস দু’জন কর্তার সেবা করতে পারে না” (লূক ১৬:১৩)।
  • যীশু অনেক মনিব ও দাসদের সাথে কথা বলেন। উদাহরণ: সেনাপত্তির দাসকে সুস্থ করেন (মথি ৮:৬)।
  • দাসদের কেন্দ্র করে যীশুর অনেক দৃষ্টান্ত আছে।
  • যীশু দেখান যে সব মানুষ পাপের দাস।
  • কিন্তু যীশু দাসত্বের বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলেন না যদিও তা ছিল একটি বড় সামাজিক সমস্যা। কেন?
 
নতুন নিয়মের চিঠিগুলিতে দাসদের প্রতি কথা

“তোমরা যারা দাস, তোমরা যেমন খ্রীষ্টের বাধ্য তেমনি ভয় ও সম্মানের সংগে অন্তর থেকে তোমাদের এই জগতের মনিবদের বাধ্য হয়ো।… মনিবদের চোখের সামনেই কেবল তাদের বাধ্য হয়ো না; তার চেয়ে বরং খ্রীষ্টের দাস হিসাবে ঈশ্বরের ইচ্ছা মনে-প্রাণে পালন করে তোমরা মনিবদের বাধ্য হয়ো।… মানুষের সেবা করছ না কিন্তু প্রভুর সেবা করছ সেইভাবে সন্তুষ্ট মনে তোমাদের মনিবদের সেবা কোরো” (ইফি ৬:৫-৮, কল ৩:২২-২৪)।

যে সব দাসদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয় তারা সবাই তাদের মনিবদের সমস্ত সম্মান পাবার যোগ্য বলে মনে করুক, যেন কেউ ঈশ্বরের নামের এবং আমাদের শিক্ষার নিন্দা করতে না পারে” (১ তীম ৬:১-২)।

“যারা দাস, তাদের বলবে যেন সব ব্যাপারে তারা মনিবদের অধীনে থাকে… সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য তা প্রমাণ করে, যেন তারা…ঈশ্বরের সম্বন্ধে যে শিক্ষা আছে তা সব দিক থেকে সুন্দর করে তুলতে পারে” (তীত ২:৯-১০)।

“বাড়ীর চাকর-বাকরেরা, তোমরা তোমাদের মনিবদের সম্মান করে তাঁদের অধীনে থাক। যে মনিবেরা ভাল ও দয়ালু কেবল যে তাঁদের অধীনতা স্বীকার করবে তা নয়, কিন্তু যাঁরা কর্কশ ব্যবহার করেন তাঁদেরও অধীনতা স্বীকার কর। যদি কেউ অন্যায় ভাবে কষ্ট ভোগ করে…তবে সে ঈশ্বরের চোখে প্রশংসার যোগ্য।…খ্রীষ্ট তোমাদের জন্য কষ্ট ভোগ করে…আদর্শ রেখে গেছেন, যেন তোমরাও তাঁরই মত চল” (১ পিতর ২:১৮-২১)।

“তোমাকে যখন ডাকা হয়েছিল তখন কি তুমি দাস ছিলে? সেইজন্য দুঃখ কোরো না; অবশ্য যদি স্বাধীন হবার সুযোগ পাও তবে তা গ্রহণ কোরো। দাস থাকা অবস্থায় প্রভু যাকে ডেকেছেন সে প্রভুর দ্বারা স্বাধীন হয়েছে। সেইভাবে যাকে স্বাধীন অবস্থায় ডাকা হয়েছে সে খ্রীষ্টের দাস হয়েছে। …ঈশ্বর যাকে যে অবস্থায় ডেকেছেন সে ঈশ্বরের সামনে সেই অবস্থাতেই থাকুক” (১ করি ৭:২১-২৪)।

  • তাই আমরা কি উপসংহারে বলব যে ঈশ্বর দাসত্ব চান বা কম পক্ষে সমর্থন করেন??
  • কিন্তু পৌল মনিবদের কাছেও আদেশ দেন:

“তোমরা যারা মনিব, তোমরাও তোমাদের দাসদের প্রতি ঠিক সেই রকম ব্যবহার কর। তাদের ভয় দেখানো ছেড়ে দাও, কারণ … তোমাদের একই প্রভু এবং তিনি স্বর্গে আছেন; তাঁর চোখে সবাই সমান” (ইফিষীয় ৬:৯)।

“মনিবেরা, স্বর্গে তোমাদেরও একজন মনিব আছেন জেনে তোমরা তোমাদের দাসদের সংগে সৎ এবং ন্যায় ব্যবহার কোরো” (কলসীয় ৪:১)।

 
দাসত্বের বিষয়ে কিছু নীতিমালা

যীশু ও পৌল দুইজন

  • একবারও সরাসরি দাসত্বের বিরুদ্ধে কথা বলেন না ।
  • একবারও দাসত্ব বাতিল করার জন্য আন্দোলন করেন না।
  • একবারও দাসদের উৎসাহিত করেন না অবাধ্য হতে বা পালিয়ে যেতে।

বরং যীশু ও পৌল

  • দাবী করেন যে দাস ও স্বাধীন মানুষদের একই মূল্য আছে।
  • দাসদের আদেশ দেন মনিবের প্রতি বাধ্য হতে ও বিশ্বস্তভাবে কাজ করতে।
  • দাসদের উৎসাহিত করেন যেন তারা যেখানে আছে তা ঈশ্বরের জন্য ব্যবহার করে।
  • মনে করেন না যে পরিস্থিতি মানুষকে সীমিত করে রাখে বরং মনোভাব আসল বিষয় মনে করেন।
  • মনিবদেরও দায়বদ্ধতায় আনেন।

ব্যক্তিগতভাবে পৌল স্বক্রিয়ভাবে দাসত্বের বিরুদ্ধে কাজ করেন: তিনি মনিব ফিলীমনের কাছে একটি চিঠিতে একজন পলাতক দাসের জন্য ক্ষমা ও স্বাধীনতা দাবী করেন। “কিন্তু তুমি তাকে আর দাস হিসাবে পাবে না বরং দাসের চেয়ে বেশী, অর্থাৎ প্রিয় ভাই হিসাবে পাবে।…ভাই, আমরা প্রভুর হয়েছি বলে আমি চাই যে, তুমি আমার একটা উপকার কর”  (ফিলীমন ১৬, ২০)।

পৌল মনিব হিসাবে ফিলীমনের অধিকার রক্ষা করেন কিন্তু তাকে অনুরোধ করেন, তার দাসের প্রতি ভাল ব্যবহার করতে।

আমরা কি শিখতে পারি?
  • অসন্তোষ, অবাধ্যতা, আইনের বাইরে আন্দোলন বা বিদ্রোহ ঈশ্বরের পথ নয়।
  • একটি সামাজিক অন্যায় ঘটতে, তার মানে না এই যে আমার অনুমতি আছে, আইনের বাইরে তার বিরুদ্ধে কিছু করতে। নতুন অন্যায় দিয়ে সামাজিক অন্যায় সরানো সম্ভব না।
  • একজনের পরিস্থিতি কি, তা ঈশ্বর বড় বিষয় মনে করেন না, বরং তাকে চ্যালেঞ্জ করেন পরিস্থিতির মধ্যে সঠিক মনোভাবে আচরণ করতে।
  • পরিস্থিতিকে দোষ দেবেন না, বরং যে কোন পরিস্থিতিকে ব্যবহার করতে শিখুন।
  • ভুল চিন্তায় যোগ দেবেন না: মানুষ হিসাবে দাসদের অবশ্যই একই মূল্য আছে।
  • আমাদের ঈশ্বরের দৃষ্টিতে রাজী হতে হয়, তা অনুসারে জীবন-যাপন করতে হয়, তাতে আদর্শ হতে হয়: “যিহূদী ও অযিহূদীর মধ্যে, দাস ও স্বাধীন লোকের মধ্যে, স্ত্রীলোক ও পুরুষের মধ্যে কোন তফাৎ নেই, কারণ খ্রীষ্ট যীশুর সংগে যুক্ত হয়ে তোমরা সবাই এক হয়েছ”  (গালা ৩:২৮, কল ৩:১১)।
  • সমাজকে পরিবর্তন করা হল আস্তে-আস্তে কাজ। ধৈর্য দরকার।
  • স্বক্রিয়ভাবে সমাজের জন্য বাইবেলীয় ভিত্তি তৈরী কর (শিক্ষা, যুক্তি, তথ্য দান) > পরিবর্তন আসবে।
  • সামাজিক পরিবর্তন হতে হয় ‘ভিতর থেকে বাইরে’, জোর করে না বরং স্বাধীনভাবে শিক্ষা ও যুক্তি দেখানোর মাধ্যমে।
  • উদাহরণ: উইলিয়াম কেরী (William Carey) সতীদাহ, বাল্য বিবাহ বাতিল করে ছিলেন। উইলিয়াম উইলবারফর্স (William Wilberforce) দাস ক্রয়-বিক্রয় ও দাসত্ব বাতিল করে ছিলেন।

উইলিয়াম উইল্বার্ফর্স সম্বন্ধীয় একটি চমৎকার ফিল্ম আছে (Amazing Grace) যাতে দেখানো হয় তিনি ব্রিটিশ সংসদে দাস ত্রয়-বিক্রয় ও শেষে দাসত্ব বাতিল করার জন্য কিভাবে কাজ করেছিলেন ।