যোনা হলেন একজন অনিচ্ছুক অথচ সফল ভাববাদী, যার ধ্বংসবাণীর কারণে আসিরিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী নীনবীতে একটি আত্মিক জাগরণ ঘটে। অবশেষে যোনার হৃদয়েও একটি জাগরণ ঘটে, যার ফলে তিনি তার মিথ্যা আত্ম-বিশ্বাস এবং তার জাতিগত অহংকার ছেড়ে দেন।
সবাই যোনার গল্প জানে এবং এটি সাণ্ডেস্কুলের একটি খুবই প্রিয় গল্প। কিন্তু এই পুস্তকের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর প্রকৃতপক্ষে কি বলতে চান, তা অনেকের কাছেই হয়তো পরিষ্কার না।
অনেক ক্ষেত্রে যোনা অন্য ভাববাদীদের মত নন: তিনি তার আচরণ ও মনোভাবে ঈশ্বরের প্রতি অবাধ্য। তিনি তার শ্রোতাদের কাছে ঈশ্বরের হৃদয়, ভালবাসা ও আকাঙ্ক্ষা উপস্থাপন করেন না। এছাড়া তার প্রচার সম্পূর্ণভাবে সফল, যা পুরাতন নিয়মের অধিকাংশ ভাববাদীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
সম্ভবত, নীনবীতে প্রচারের আহ্বান পাওয়ার আগে, অর্থাৎ রাজা যারবিয়াম-২-এর সময়ে (৭৮২-৭৫৩ খ্রীঃপূঃ) যোনা ইস্রায়েলের একজন ভাববাদী হিসাবে কথা বলেন। বাইবেলে খুব কম পাওয়া যায় যে, একজন ভাববাদী জনপ্রিয় একটি বাণী দিতে পারেন, কিন্তু যোনার ক্ষেত্রে তা-ই হয়। তিনি ইস্রায়েলকে ভবিষ্যদ্বাণী দেন যে, শক্তিশালী রাজা যারবিয়ামের নেতৃত্বে ইস্রায়েল জাতি যুদ্ধে জয় করবে এবং জমি পুনরায় দখল করতে সক্ষম হবে (২ রাজা ১৪:১৫)। ফলে লোকদের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভাল হয়ে ওঠে এবং তারা বিলাসিতায় জীবন-যাপন করে। কিন্তু একই সময়ে গরীবদের বিরুদ্ধে অন্যায় ও অত্যাচার বাড়তেই থাকে (আমোষ পুস্তক দেখুন)। তাই ইস্রায়েলের আত্মিক অবস্থা ভাল নয়: তারা সামাজিক অন্যায় করে, একটি মিশানো ধর্ম পালন করে (যাতে সদাপ্রভু এবং বৈথেলের সোনার বাছুরকে একসাথে পূজা করা হয়) এবং সরাসরি দেবতাপূজাও করে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জয় এবং সাথে অর্থনৈতিক সুঅবস্থার কারণে ইস্রায়েলীয়েরা মনে করে যে, এসব হল তাদের কাজের উপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও অনুমোদন। ফলে দেশে মিথ্যা ধার্মিকতা, মিথ্যা নিশ্চয়তা, ভুল আত্ম-বিশ্বাস এবং জাতিগত অহংকার বৃদ্ধি পায়। ইস্রায়েল নিজেকে মনোনীত, আশীর্বাদ প্রাপ্ত ও অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ জাতি মনে করে। এই একই ধরণের মনোভাব ভাববাদী যোনার মধ্যেও দেখা যায়।
যখন ঈশ্বর যোনাকে নীনবী শহরে প্রচার করার জন্য আহ্বান করেন, তখন তিনি সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করেন। নীনবী ছিল আসিরিয়া সাম্রাজ্যের বিরাট ও শক্তিশালী রাজধানী। আসিরিয়া সাম্রাজ্য ছিল ভয়ংকর ও সবার জন্য হুমকিস্বরূপ, হিংস্রতা ও নিষ্ঠুর আচরণের জন্য বিখ্যাত। ইতিহাসে বেশ কয়েক বার ইস্রায়েল আসিরিয়ার কাছ থেকে আঘাত পেয়েছিল।
ঈশ্বর যোনাকে নীনবীর বিরুদ্ধে ধ্বংসবাণী দিতে বলেন। যোনা জানতেন যে, ধ্বংসের ঘোষণা মানেই অনুতাপের সুযোগ এবং অনুতপ্ত হলে ঈশ্বর অবশ্যই বিচার পিছাবেন। তিনি চান না যেন নীনবী এই সুযোগ পায়, তাই তিনি ঈশ্বরের আহ্বান থেকে পালিয়ে পশ্চিম দিকে রওনা দেন। এই পুস্তকের লক্ষণীয় বিষয় হল, যোনা ঈশ্বর সম্বন্ধে ‘অনেক কিছু জানেন’ (যেমন ঈশ্বর দয়ালু, ঈশ্বর সর্বজান্তা ইত্যাদি), কিন্তু তার আচরণে প্রকাশ পায় যে, তিনি জেনেও প্রকৃতপক্ষে জানেন না ঈশ্বর কে।
যোনার পথ বন্ধ করার জন্য ঈশ্বর দয়ালুভাবে একটি ঝড় পাঠান। যখন ঝড়ের কারণে তার জাহাজের সব নাবিকেরা হুমকির মুখে, তবুও যোনা অনুতাপ করেন না বরং তিনি নাটকীয়ভাবে আত্ম-উৎসর্গ করেন। সাগরে লাফ দেওয়ার সাহস নেই বলে, যদিও নাবিকেরা চায় না, তবুও তিনি তাদেরকে তাকে সাগরে ফেলে দিতে বাধ্য করান। তারপরেও ঈশ্বর নিজেকে এই অযিহূদী নাবিকদের কাছে প্রকাশিত করার জন্য ঘটনাটি ব্যবহার করেন। ঠিক একইভাবে তিনি পরবর্তীতে নিজেকে অযিহূদী নীনবী লোকদের কাছে প্রকাশিত করবেন। ঈশ্বর একটি মাছের মাধ্যমে যোনাকে বাঁচান (যোনা ১)।
মাছের পেটে তার প্রার্থনা দেখে বুঝা যায় যে, যোনা প্রকৃতপক্ষে অনুতপ্ত হন নি, তার মনোভাবও পরিবর্তন করেন নি (যোনা ২)। ঈশ্বরের উদ্ধারের জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন এবং উপায় নেই বলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, নীনবীতে প্রচারটি কোনো রকমে শেষ করতে হবে (যোনা ৩:১)।
নীনবীতে তিনি অত্যন্ত সীমিতভাবে ধ্বংসবাণী ঘোষণা করেন: “আর চল্লিশ দিন পরে নীনবী ধ্বংস হয়ে যাবে” (যোনা ৩:৪)। মন ফিরানোর সুযোগের বিষয়ে যে তিনি একটা কথাও প্রচার করেছেন, তার কোনো উল্লেখ নেই। নীনবীর লোকেরা নিজেরাই অনুতাপের কথা বলে এবং তারা খুব গুরুত্বের সঙ্গে প্রার্থনা ও উপবাস করতে শুরু করে (যোনা ৩:৬-৯)। তাদের মনেপ্রাণে সাড়া এবং খুবই নম্র মনোভাব হল যোনার অহংকারী ও একগুঁয়ে মনোভাবের ঠিক বিপরীত।
নীনবী নিয়ে কি ঘটে তা দেখার জন্য যোনা খুব সাবধানভাবে শহর থেকে বের হন এবং বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। তিনি এখনও আশা ছেড়ে দেন নি যে, ঈশ্বর তারপরেও নীনবীকে বিচার করবেন। কিন্তু বিচার বলতে কিছুই ঘটে না। যোনার আরামের জন্য ঈশ্বর তাড়াতাড়ি একটি গাছ উঠে আসতে দেন এবং বৃদ্ধিও করেন, কিন্তু পরবর্তীতে গাছটি একদিনের মধ্যেই আবার শুকিয়েও যায়। তাতে যোনার মনোভাব আরো খারাপ হয়ে যায়। যোনার গরম, ক্লান্ত ও বিরক্তি লাগে। তিনি রাগে এমন কি আত্ম-হত্যা করার কথাও বলেন। ঈশ্বরের দয়া নিয়ে তিনি তাঁর দোষ ধরেন: “হে সদাপ্রভু, আমি দেশে থাকতেই জানতাম যে, এই রকম হবে। সেইজন্যই তো আমি প্রথমে তর্শীশে পালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি জানতাম যে, তুমি দয়াময় ও মমতায় পূর্ণ ঈশ্বর, তুমি সহজে অসন্তুষ্ট হও না, তোমার অটল ভালবাসার সীমা নেই এবং শাস্তি দেবার ব্যাপারে মন পরিবর্তন করে থাক” (যোনা ৪:২)। লক্ষ্য করুন যে, যোনা মোশির আইন-কানুন ঠিকই জানেন, তিনি এখানে যাত্রা ৩৪:৬-৭ পদ উদ্ধৃতি করেন এবং তা উপযুক্তভাবেই উদ্ধৃতি করেন। তার কথায় প্রকাশ পায় যে, তিনি কেন আসিরিয়ার জন্য দয়া চান না, তাদের ক্ষমা করতে বা মঙ্গল চাইতেও রাজি নন, বরং তিনি ক্ষোভ ও জাতিগত অহংকার ধরে রাখেন। যোনা ঈশ্বরের সেই দয়া নিয়ে দোষ ধরেন, যার কারণে তিনি এখনও বেঁচে আছেন! আমরাও অনেক বার ঠিক তা-ই করি। ঈশ্বর দয়ালুভাবে যোনার সঙ্গে কথা বলতে এবং তার মনোভাবে ও চিন্তাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে থাকেন।
যোনা কি অবশেষে মন ফিরিয়েছেন? উত্তর হল ‘হ্যাঁ’। পুস্তকে উল্লিখিত ঘটনার সময়ে তিনি তা করেন না বরং শুধুমাত্র পরবর্তীতে তিনি অনুতপ্ত হন। কিভাবে তা জানা যায়? কারণ যোনা ঈশ্বরের দয়া, নিজের অযোগ্যতা ও অন্য জাতিদের জন্য ঈশ্বরের হৃদয় বুঝতে পেরেছেন এবং অনুতপ্ত হয়েছেন বলেই, তিনি পুস্তকটি এভাবে লিখতে পারেন। যোনা নম্রভাবে, নিজেকে হাস্যকর বানিয়ে এবং নিজের মূর্খতা, অহংকার ও ক্ষোভ খোলাভাবে প্রকাশ করেই পুস্তকটি লিখেছেন। পুস্তকটি দ্বারা তিনি তার সহ-ইস্রায়েলীয়দের চ্যালেঞ্জ করেন, যাদের মনোভাব ঠিক তারই মত খারাপ। কিন্তু যোনার মনোভাব আর এমন নয়, তিনি পরিবর্তিত হয়েছেন!
ভিন্ন ধরণের একজন ভাববাদী
সবাই যোনার গল্প জানে এবং এটি সাণ্ডেস্কুলের খুবই প্রিয় একটি গল্প। কিন্তু এই পুস্তকের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর প্রকৃতপক্ষে কি বলতে চান, তা অনেকের কাছেই হয়তে পরিষ্কার না। ‘মাছের মধ্য দিয়ে যোনার উদ্ধার’, তা আসলে এই পুস্তকের মূল বিষয় নয়। অনেক বার ব্যাখ্যা করা হয় যে, প্রথমে যোনা অবাধ্য ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বাধ্য হয়ে নীনবীতে গেলেন – তাও আসলে ঠিক নয়। তাহলে পুস্তকটির সংবাদ কি?
প্রথমে লক্ষ্য করা দরকার যে, অনেক ক্ষেত্রে যোনা অন্য ভাববাদীদের চেয়ে ভিন্ন একজন ভাববাদী: তিনি তার আচরণ ও মনোভাবে ঈশ্বরের প্রতি অবাধ্য। তিনি তার শ্রোতাদের প্রতি ঈশ্বরের হৃদয়, ভালবাসা ও আকাঙ্ক্ষা উপস্থাপন করেন না বরং তিনি খুশি হতেন যদি তার শ্রোতারা সবাই বিনষ্ট হত। এছাড়া যোনার প্রচার সম্পূর্ণভাবে সফল, যা পুরাতন নিয়মের অধিকাংশ ভাববাদীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। তিনি নীনবীর লোকদের অনুতাপ দেখে খুশি নন বরং তিনি তাদের বিচার দেখতে আগ্রহী। অনেক ভাববাদীর ক্ষেত্রে তাদের দেওয়া বাণীগুলো জানি কিন্তু তাদের জীবন সম্বন্ধে কম জানা যায়। যোনার ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক বিপরীত: আমরা তার গল্প জানি কিন্তু তার প্রচার মাত্র এক লাইন (যোনা ৩:৪)।
লেখক যোনা
পুস্তকের লেখক এবং প্রধান নায়ক হলেন অমিত্তয়ের ছেলে যোনা (যোনা ১:১)। অমিত্তয়ের নাম বাইবেলের আর কোথাও উল্লেখ নেই। যোনার গ্রামের নাম হল “গাত-হেফর”, উত্তরের ইস্রায়েল দেশে সবূলূন গোষ্টির এলাকায় একটি শহর (২ রাজা ১৪:১৫)। সেই এলাকাকে নতুন নিয়মে ‘গালীল’ বলা হয়। ইব্রীয় ভাষায় যোনা নামের অর্থ হল ‘ঘুঘু’ কিন্তু যোনা কোন মতে ‘ঘুঘুর মত’ শান্ত, সুন্দর বা লাজুক নন, আসলে তিনি বেশ মাথা গরম ও দোষারোপকারী।
যোনা ইস্রায়েলের রাজা যারবিয়াম-২-এর সময়ে (৭৮২-৭৫৩ খ্রীঃপূঃ) ভাববাণী বলতেন “যারবিয়াম শমরিয়াতে রাজা হলেন … ইস্রায়েলের ঈশ্বর সদাপ্রভু তাঁর দাস গাৎ-হেফরের অমিত্তয়ের ছেলে নবী যোনার মধ্য দিয়ে যে কথা বলেছিলেন সেই কথা অনুসারে যারবিয়াম হমাৎ এলাকা থেকে অরাবার সমুদ্র পর্যন্ত আগে ইস্রায়েলের রাজ্যের যে সীমা ছিল তা আবার নিজের অধিকারে ফিরিয়ে এনেছিলেন। এর কারণ হল, সদাপ্রভু দেখেছিলেন ইস্রায়েলের স্বাধীন কিম্বা দাস সবাই ভীষণভাবে কষ্ট পাচ্ছে; কেউ তাদের সাহায্য করবার মত ছিল না। সদাপ্রভুর ইচ্ছা ছিল না যে, আকাশের নীচ থেকে ইস্রায়েলের নাম তিনি মুছে ফেলেন। সেইজন্য তিনি যিহোয়াশের ছেলে যারবিয়ামের মধ্য দিয়ে তাদের উদ্ধার করলেন” (২ রাজা ১৪:২৩-২৭)।
বাইবেলে খুব কম পাওয়া যায় যে, একজন ভাববাদী জনপ্রিয় একটি বাণী দিতে পারেন, কিন্তু যোনার ক্ষেত্রে তা-ই হয়: তিনি ভবিষ্যদ্বাণী দেন যে, শক্তিশালী রাজা যারবিয়ামের নেতৃত্বে ইস্রায়েল যুদ্ধে জয় করবে এবং জমি পুনরায় দখল করতে সক্ষম হবে (২ রাজা ১৪:১৫)। তাই যারবিয়াম-২-এর রাজত্ব হল ইস্রায়েল দেশের দ্বিতীয় (ও শেষ) সোনার যুগ। তিনি ঈশ্বরের দয়ায় ইস্রায়েলের হারানো জমি পুনরায় দখল করতে, দেশের সীমানা সুরক্ষিত রাখতে এবং শান্তি আনতে সক্ষম হন। ইস্রায়েল তখন পুনরায় মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণ করে বলে, দেশে অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভাল হয়ে উঠে এবং কিছু লোকেরা বিলাসিতায় জীবন-যাপন করে। কিন্তু একই সময়ে গরীবদের বিরুদ্ধে অন্যায় ও অত্যাচার বাড়তেই থাকে (আমোষ পুস্তক দেখুন)। তাই ইস্রায়েলের আত্মিক অবস্থা ভাল না: তারা সামাজিক অন্যায় করে, একটি মিশানো ধর্ম পালন করে (যাতে সদাপ্রভু এবং একটি সোনার বাছুরকে একসাথে পূজা করা হয়) এবং সরাসরি দেবতাপূজাও করে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জয়, সাথে অর্থনৈতিক সুঅবস্থার কারণে ইস্রায়েলীয়েরা মনে করে যে এসব হল তাদের উপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও অনুমোদনের চিহ্ন। ফলে দেশে নকল ধার্মিকতা, মিথ্যা নিশ্চয়তা, ভুল আত্ম-বিশ্বাস এবং জাতিগত অহংকার বৃদ্ধি পায়। ইস্রায়েল নিজেকে মনোনীত, আশীর্বাদ প্রাপ্ত ও অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ জাতি মনে করে, এমন একটি মনোভাব যা ভাববাদী যোনার মধ্যেও দেখা যায়।
ঘৃণার আসিরিয়া
যখন ঈশ্বর যোনাকে নীনবী শহরে প্রচার করার জন্য আহ্বান করেন, তখন যোনা তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন (যোনা ১:৩)। নীনবী ছিল আসিরিয়া সাম্রাজ্যের শক্তিশালী রাজধানী। নীনবী ছিল আধুনিক যুগের ইরাক দেশের টাইগ্রিস্ নদীর পাড়ে অবস্থিত বিশাল এবং জনবহুল একটি শহর (যোনা ৩:৩)।
আসিরিয়া সাম্রাজ্য ছিল ভয়ংকর ও চারিদিকের জাতিগুলোর জন্য হুমকিস্বরূপ, হিংস্রতা ও নিষ্ঠুর আচরণের জন্য বিখ্যাত। ইতিহাসে বেশ কয়েক বার ইস্রায়েল আসিরিয়া দ্বারা আঘাত পেয়েছিল। নীনবী ছিল অজেয়, ঐযুগে আর কোনো শহর নীনবীর মত শক্তিশালী প্রাচীর ও দুর্গ দিয়ে সুরক্ষিত ছিল না। শহরের চারিদিকে ছিল ৫টি করে শক্তিশালী দেওয়াল, যার কারণে বলা হত যে, নীনবী শহর ২০ বছর ধরে ঘেরাও করলেও সেটি দখল করা সম্ভব না। পাশে দেওয়া ছবিগুলো নীনবীর কিছু পুনরায় নির্মিত দেওয়াল দেখায়।
নীনবীর আরো খ্যাতি ছিল ভয়ংকর, হিংস্র ও সব জাতিদের জন্য হুমকিস্বরূপ আসিরিয়া সাম্রাজ্যের কেন্দ্র হিসাবে। আসিরিয়া সাম্রাজ্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সম্প্রসারণের জন্য, পরাজিত লোকদের প্রতি অতি নিষ্ঠুর ব্যবহার এবং দমনকারী রাজত্বের জন্য বিখ্যাত ছিল (নহূম ৩:১৯)। ইস্রায়েল এবং সঙ্গে আরো ছোট ছোট দেশগুলোকে বার বার আসিরিয়ার আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছিল এবং বহুবছর ধরে আসিরিয়া ছিল উত্তর দিগন্তের সেই ভয়ংকর ও হুমকিস্বরূপ ক্ষমতা।
যখন ঈশ্বর যোনাকে এই আসিরিয়ার বিরুদ্ধে ধ্বংসবাণী দিতে বলেন তখন তিনি জানতেন যে, ঈশ্বরের কাছ থেকে বিচারের ঘোষণার সাথে অনুতপ্ত হওয়ার একটি সুযোগও আসে এবং অনুতপ্ত হলে ঈশ্বর অবশ্যই বিচার পিছান। যোনা চান না যেন নীনবী এই সুযোগ পায়, এর জন্য তিনি পূর্ব দিকে না গিয়ে ঈশ্বরের আহ্বান থেকে পালিয়ে পশ্চিম দিকে রওনা দেন। যোনার মধ্যে অহংকার এবং অন্য জাতিদেরকে নিচু চোখে দেখার একটি মনোভাব প্রকাশিত। তার এই মনোভাব ছিল ইস্রায়েলীয়দের মধ্যে অত্যন্ত প্রচলিত একটি মনোভাব: ইস্রায়েলীয়েরা নিজেকে মনোনীত জাতি মনে করে অন্য জাতিদেরকে ঈশ্বরের দয়ার যোগ্য হিসাবে দেখত না।
যোনা ১ অধ্যায় একজন অনিচ্ছুক ভাববাদী
নীনবীর কাছে প্রচার করার আহ্বান পেয়ে যোনা পূর্ব দিকে রওনা দেওয়ার চেয়ে বরং পশ্চিম দিকে রওনা দেন। ভূমধ্যসাগরের পাড়ে এসে তিনি আরো পশ্চিম দিকে তর্শীশ শহরে যাওয়ার জন্য একটি জাহাজে ওঠেন (যোনা ১:৩)। যিহূদীরা সাগরকে ঘৃণা করত ও জলপথে যাত্রা ভয় পেত, কিন্তু যোনা নীনবীতে যাওয়ার চেয়ে তা-ই পছন্দ করেন। একদিকে বলা যায় যে, যোনা ঈশ্বর সম্বন্ধে অনেক কিছু জানেন, কিন্তু কেন তিনি এখানে মনে করেন যে, একজন সর্বজান্তা ঈশ্বরের উপস্থিতি (যোনা ১:৩) থেকে পালিয়ে যাওয়া যায়, তা পরিষ্কার নয়।
ঈশ্বর দয়ালুভাবে যোনাকে তার পথে বাধা সৃষ্টি করতে সাগরে একটি ঝড় পাঠান। যোনা নয় বরং নাবিকেরা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিপূর্ণ ভয় দেখায় এবং বিনতি করতে শুরু করে। যোনার দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরেও তারা যোনাকে সাগরে ফেলে দিতে চায় না (যোনা ১:৭-১৬)।
অপর পক্ষে, এমন কি এই জরুরীর সময়ে যোনা যথেষ্ট অহংকার ও অন্য জাতিদেরকে নিচু চোখে দেখার মনোভাব প্রকাশ করেন। সমস্যার কারণ হিসাবে প্রমাণিত হওয়ার পরেও তিনি গর্বের সঙ্গে বলেন: “আমি একজন ইব্রীয়। আমি স্বর্গের ঈশ্বর সদাপ্রভুর উপাসনা করি। তিনিই সাগর ও ভূমি তৈরী করেছেন” (যোনা ১:৯)। কথাটি অবশ্যই সত্য কিন্তু তা-ই যদি হয় তবে পশ্চিম দিকে পালানোর লাভ কি? যোনা নিজের জাতীয়তা, জ্ঞান ও ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া প্রকাশ নিয়ে গর্বিত, কিন্তু তিনি এই জ্ঞান অনুসারে আচরণ করেন না। যোনা জানেন যে, মন ফিরালে ঈশ্বর দয়া দেখান (যোনা ৪:২), অর্থাৎ অনুতপ্ত হলে ঈশ্বর ঝড় থামিয়ে দিতেন, কিন্তু তিনি অনুতপ্ত হতে রাজি নন। বরং তিনি নিজেকে নাটকীয়ভাবে আত্ম-উৎসর্গ করেন। সাগরে লাফ দেওয়ার সাহস নেই বলে তিনি বরং নাবিকদেরকে তাকে সাগরে ফেলে দিতে বাধ্য করেন, যদিও তারা তা করতে চায় না। যোনা এভাবে ঈশ্বরের সম্বন্ধে উল্টাপাল্টা সাক্ষ্য দেওয়ার পরেও ঈশ্বর নিজেকে এই অযিহূদী নাবিকদের কাছে প্রকাশিত করার জন্য ঘটনাটি ব্যবহার করেন (যোনা ১:১৬, ঠিক একইভাবে তিনি পরবর্তীতে অযিহূদী নীনবী লোকদের কাছে নিজেকে প্রকাশিত করবেন)।
যোনা ২ অধ্যায় একজন অননুতপ্ত ভাববাদী
ঈশ্বর একটি মাছ পাঠিয়ে দেন যা যোনাকে গিলে ফেলে (যোনা ১:১৭)। যোনা তিন দিন মাছের পেটে থাকেন। যীশু এই ঘটনাটি “যোনার চিহ্ন” বলে তা নিজের বিষয়ে, অর্থাৎ তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মাঝখানে সেই সময় সম্বন্ধে ব্যবহার করেন (মথি ১২:৩৮-৪১,১৬:৪, লূক ১১:২৯-৩২)। প্রকৃতপক্ষে যীশুর ক্রুশ থেকে তাঁর পুনরুত্থান পর্যন্ত ৭২ ঘন্টা পার হয় না; তিনি শুক্রবার বিকাল ৩টায় মারা যান এবং রবিবার ভোরে পুনরুত্থিত হন। যিহূদীরা দিন গুনার ক্ষেত্রে আংশিক দিন সম্পূর্ণ দিন হিসাবে গুনত, অর্থাৎ শুক্রবার, শনি ও রবিবার তারা ‘তিন দিন’ বলত।
অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করে যে, মানুষ মাছের পেটে বাঁচতে পারে কিনা। আসলে অল্প কিছু ঘটনা আছে যাতে মানুষ এভাবে বেঁচেছিল, যেমন ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে জেম্স্ বার্টলি নামে একজন নাবিক, যিনি একটি তিমি মাছে (sperm whale) ২ দিন বেঁচেছিলেন।
মাছের পেটে যোনার প্রার্থনায় তিনি ঈশ্বরের উদ্ধারের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন (যোনা ২:৬-৯) কিন্তু তার প্রার্থনায় অনুতপ্ত হওয়ার কোন প্রকাশ পাওয়া যায় না, তিনি তার মনোভাবও পরিবর্তন করেন নি।এমন কি তার প্রার্থনায় একটি আত্ম-কেন্দ্রিক ভাব দেখা যায় “আমি তোমাকে ডাকলাম … মৃতস্থানের গভীরতা থেকে আমি সাহায্যের জন্য ডাক দিলাম … আমি তোমাকে মনে করলাম … আমি যে মানত করেছি তা পূর্ণ করব” – ঈশ্বরকে কি খুশি হতে হয় যে, যোনা তার মানত পূর্ণ করবেন? এমন কি একটি অহংকারী ভাবও পাওয়া যায়: “যারা অপদার্থ প্রতিমাগুলোর পূজা করে তারা তোমার যে দয়া পেতে পারত তা অবহেলা করে”। কার বিষয়ে তিনি এই কথাটি বলছেন? নাবিকদের বিষয়ে? যোনা কি গর্বিত যে তিনি সঠিক ঈশ্বরকে ডেকেছেন? প্রকৃতপক্ষে আত্মিক অহংকার উভয় হাস্যকর এবং ছেড়ে দিতে কষ্ট।
যোনা ৩ অধ্যায় নির্বিকার একজন ভাববাদী
অন্য কোনো উপায় নেই বলে যোনা সিদ্ধান্ত নেন যে, নীনবীতে প্রচারটি কোনো রকম শেষ করতে হবে (যোনা ৩:২)। এটা যে তার জন্য ঈশ্বর অনুগ্রহ, তা তিনি বুঝতে পারেন না।
নীনবীতে পৌঁছে তিনি অত্যন্ত সীমিতভাবে ধ্বংসবাণী ঘোষণা করেন: “আর চল্লিশ দিন পরে নীনবী ধ্বংস হয়ে যাবে” (যোনা ৩:৪)। মন ফিরানোর সুযোগের বিষয়ে তিনি যে একটাও কথা বলেছেন, তার উল্লেখ নেই। সম্ভবত, যোনা ঈশ্বরের দাবি সর্বনিম্নভাবে পূর্ণ করেন। তার মধ্যে কোনো দয়া বা আশা দেখা যায় না।
যোনা থেকে কোনো উৎসাহ না পেলেও নীনবীর লোকেরা নিজেরাই অনুতপ্ত হয় এবং তারা খুব গুরুত্বের সঙ্গে প্রার্থনা ও উপবাস করতে শুরু করে (যোনা ৩:৬-৯)। নীনবীর সবাই, রাজা থেকে আরম্ভ করে সাধারণ লোক পর্যন্ত শোক প্রকাশ করে সাড়া দেয়, তারা এমন কি পশুদেরও উপবাসে রাখে। তাদের এই খুবই নম্র মনোভাব হল যোনার অহংকার ও একগুঁয়ে মনোভাবের ঠিক বিপরীত।
আসিরিয়ার ইতিহাসে কি এই ঘটনার কোন উল্লেখ আছে? আসিরিয়ার ঐতিহাসিক লেখাগুলোতে পাওয়া যায় যে, রাজা আদাদ্-নিরারী-৩ (৮১০-৭৮৩ খ্রীঃপূঃ) তার রাজত্বের শেষদিকে কিছু আত্মিক পুনঃসংস্কার চেষ্টা করেছিলেন। লেখা আছে যে, তিনি বিভিন্ন দেব-দেবতার চেয়ে একজন দেবতা মানতেন, যার নাম ‘নাবূ’ অথবা ‘নেবো’, কিন্তু তাদের জাতিগত অনুতাপের বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। প্রকৃতপক্ষে সেই সময় আসিরিয়া চারিদিকে আক্রমণ বা রাজ্যের বিস্তার কম করে। তাছাড়া ইস্রায়েল এই সময় নিজের জমি কিছুটা পুনরায় অধিকারে নিতে সক্ষম হয়। আর একটি লেখায় উল্লেখ পাওয়া যায় যে, উত্তর দিকের ‘উরার্টু’ দ্বারা নীনবী শহরে হুমকির মুখে পড়ে। আসিরিয়ার পরবর্তী রাজা, অশূর-দান-৩ (৭৭২-৭৫৫ খ্রীঃপূঃ)-এর সময়ে দু’টি মহামারী উল্লেখ আছে (৭৬৫ ও ৭৫১ খ্রীঃপূঃ, এর সাথে হয়তো আমোষ ৪:৯-১০ পদের সংযোগ আছে)। এছাড়া ৭৬০ খ্রীঃপূঃ একটি ভূমিকম্পের উল্লেখ আছে এবং ৭৬৩ খ্রীঃপূঃ একটি সূর্য গ্রহণ ঘটে (যার সাথে হয়তো আমোষ ৫:৮ পদের সংযোগ আছে)। সূর্য গ্রহণকে মানুষ ভয়ংকর এবং দেবতাদের ক্রোধের চিহ্ন হিসাবে মনে করত। আরো উল্লেখ আছে যে, এর কারণে একটি গৃহযুদ্ধও শুরু হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, আসিরিয়ার ঐতিহাসিক লোখাগুলোতে ৭৬৩ খ্রীষ্টপূর্বে অশূর শহরের একটি বিদ্রোহ এবং ৭৬১ খ্রীষ্টপূর্বে আসিরিয়া রাজ্যের অস্থিরতার বিষয়ও উল্লেখ করে।
এসব ঘটনা কি যোনা পুস্তকের সাথে সম্পর্কিত? কেউ কেউ বলে যে, এই ধরণের ঘটনার কারণে মানুষ যোনার বিচারবাণীতে গুরুত্ব ও সাড়া দিয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলে যে, যোনার প্রচার ও পরবর্তীতে নীনবীর লোকদের অনুতাপ ছিল একেশ্বরবাদের দিকে যাওয়া এবং অন্য দেশগুলোকে কম আক্রমণ করার কারণ। যারবিয়াম-২ তার বাবার সাথে রাজত্ব করেছিলেন ৭৯২-৭৮২ খ্রীষ্টপূর্বে এবং একা রাজত্ব করেছিলেন ৭৮২-৭৫৩ খ্রীষ্টপূর্বে, তাই যোনার নীনবীতে যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট তারিখ বলা যায় না। ফলে এই বিষয়ের নির্দিষ্ট কোন উত্তরও পাওয়া যায় না। কিন্তু এটি অবশ্যই একটি লক্ষণীয় বিষয় যে, ঠিক যোনার যুগে আসিরিয়া সাম্রাজ্যে সাধারণ অবস্থার চেয়ে ‘বিশেষ ঘটনা’ বা ‘বিশেষ আচরনের’ বর্ণনা পাওয়া যায়।
যোনা ৪ অধ্যায় একজন রাগান্বিত ভাববাদী
যখন নীনবীর লোকেরা মন ফিরায় তখন যোনার সাড়া কি? তিনি কি মনোযোগী বা সচেতন? তিনি কি তা নিচু চোখে দেখেন? তিনি কি তা বিশ্বাস করেন না? বা তা নিয়ে বিরক্ত? আমরা ঠিক জানি না। পরিষ্কারভাবে যা জানা যায় তা হল, ঈশ্বর যখন নীনবীর লোকদের অনুতাপ গ্রহণ করেন এবং বিচারবাণী বাতিল করেন তখন যোনা খুবই বিরক্তি প্রকাশ করেন, এমন কি কিনি রাগান্বিতও হন। তিনি ঈশ্বরের দয়া নিয়ে তাঁর দোষ ধরেন: “হে সদাপ্রভু, আমি দেশে থাকতেই জানতাম যে, এই রকম হবে। সেইজন্যই তো আমি প্রথমে তর্শীশে পালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি জানতাম যে, তুমি দয়াময় ও মমতায় পূর্ণ ঈশ্বর, তুমি সহজে অসন্তুষ্ট হও না, তোমার অটল ভালবাসার সীমা নেই এবং শাস্তি দেবার ব্যাপারে মন পরিবর্তন করে থাক” (যোনা ৪:২)।
যোনার এই কথাগুলো খুবই লক্ষণীয়: তিনি আইন-কানুন জানেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি যাত্রা ৩৪:৬-৭ পদ উদ্ধৃতি করেন এবং উপযুক্তভাবে ব্যাখ্যাও করেন: ঈশ্বরের দয়া ও ভালবাসার কোনো সীমা নেই। কথাটির মধ্যে যোনার বিরক্তির আসল কারণও প্রকাশিত: তিনি আসিরিয়ার জন্য কোনভাবেই দয়া চান না, তাদেরকে ক্ষমা করতে রাজি নন, নীনবীর লোকদের মঙ্গল চাইতেও তিনি রাজি নন। বরং তিনি নিজের জাতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করে অহংকারে আসিরিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধরে রাখেন।
যোনার সাড়া হল আত্ম-দয়ামায়া, যা একটি বিরক্ত শিশুর মত: “এখন হে সদাপ্রভু, তুমি আমার প্রাণ নাও, কারণ আমার বেঁচে থাকবার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল” (যোনা ৪:৩)। অনুতপ্ত হওয়া ও তার মনোভাব পরিবর্তন করার চেয়ে বরং যোনা মৃত্যুকে গ্রহণ করাই ভাল মনে করেন। নীনবীর লোকেরা বাঁচার চেয়ে নিজেই মারা যাওয়া ভাল – কি পাগলামী! এখানে মৃত্যুকে চাওয়া হল জেদের বিষয়, অতি আবেগীয় ও স্বার্থপর একটি মনোভাব। এই জগতে যদি ক্ষমাপ্রাপ্ত আসিরিয়া থাকে তবে তিনি এই জগত চান না। এই ধরণের জগতের চেয়ে জগত না থাকলে আরো ভাল। যোনার কোনো ধারণা বা চেতনা নেই যে, ঈশ্বরের যে দয়া নিয়ে তিনি এখন তেতো, ঠিক সেই দয়াই তাকে সাগর থেকে উদ্ধার করেছিল। কিন্তু যোনা তা কোনভাবেই বোঝেন না এবং বুঝতেও চান না। নিজের জন্য তিনি দয়া চান, কিন্তু আর একজন যদি একই দয়া পায়, তবে তার চেয়ে মারা গেলে ভাল। তিনি এখনও নিজেকে আসিরিয়ার চেয়ে খুব ভিন্ন মনে করেন। ঈশ্বর দয়ালুভাবে তার অহংকার এবং জেদী মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করেন: “তোমার রাগ করা কি উচিত হচ্ছে?” (যোনা ৪:৪)। এখানে যোনার কোন উত্তর নেই।
যোনার উত্তর তার আচরণে প্রকাশিত: তিনি সাবধাণভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়ে বিচারের ঘোষিত তারিখের আগে নীনবী শহর ছেড়ে বাইরে আশ্রয় নেন। চলে না গিয়ে তিনি বরং অপেক্ষা করেন দেখার জন্য নীনবী নিয়ে কি হবে। কারণ তিনি এই আশা সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দেন নি যে, ঈশ্বর শহরটি ধ্বংস করবেন। চল্লিশ দিন পার হয় কিন্তু কিছুই ঘটে না। ঈশ্বর যোনার আরামের জন্য একটি পাতাওয়ালা গাছ আশ্চর্যভাবে বৃদ্ধি করিয়ে দেন এবং যোনা তাতে খুব খুশি। পরবর্তী দিনে যখন গাছটি হঠাৎ করে শুকিয়ে মারা যায়, তখন যোনা আসলেই বিরক্ত: তার গরম লাগে, তিনি অখুশি এবং ক্ষোভে ও রাগে পূর্ণ। তিনি মনে করেন যে, তার এই কথা বলার অধিকার ও কারণ আছে “আমার বেঁচে থাকবার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল” (যোনা ৪:৮)। উত্তরে ঈশ্বর আবারও একই প্রশ্ন করেন: “ঐ গাছের বিষয়ে রাগ করা কি তোমার উচিত হচ্ছে?”। যোনা জেদের সঙ্গে উত্তরে বলেন “তার কারণ আছে। আমি মরণ পর্যন্ত রাগ করে থাকব” (যোনা ৪:৯)। এখনও তিনি কিছুই শেখেন নি! ঈশ্বর তাকে চেতনা দেন: “তুমি যদিও এই গাছটার জন্য কোন পরিশ্রম কর নি বা এটাকে বাড়িয়ে তোল নি তবুও গাছটার জন্য তোমার মমতা হয়েছে। ওটা তো এক রাতের মধ্যে গজিয়েছিল এবং এক রাতেই মরে গেল। কিন্তু নীনবীতে এক লক্ষ বিশ হাজারেরও বেশী শিশু আছে যারা জানে না কোনটা ডান হাত আর কোনটা বাঁ হাত; এছাড়া অনেক গরু-ভেড়াও আছে। তাহলে আমি কি করব? আমি কি ঐ বড় শহরের জন্য মমতা করব না?” (যোনা ৪:১০-১১)।
ঈশ্বর রাগকে ‘রাগ’ বলেন। তিনি যোনার আবেগ নিয়ে না বরং আবেগের উপযুক্ততা নিয়ে আপত্তি উঠান। তিনি যোনাকে চেতনা দেন এবং তার রাগের শিক্ড় ও কারণ আরো ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করেন। তার রাগ কোথা থেকে আসে? রাগের পিছনে তার ভুল চিন্তা কি? ঈশ্বর তার সাথে কঠোরভাবে কথা বলেন না, ঈশ্বর বলেন না: ‘আমি তোমাকে আর কখনও উদ্ধার করব না! অথবা ‘ঠিক আছে, চাইলে নিজেকে মেরে ফেল!’ ঈশ্বর যোনার প্রতি দয়া দেখাতে থাকেন, ঠিক সেই দয়া যা নিয়ে যোনা সংগ্রাম করছেন। সৎ-সরল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তিনি যোনার চিন্তা, মনোভাব ও উপসংহারকে চ্যালেঞ্জ করেন। ঈশ্বর তাকে তুলনা করে দেখান: এক দিনের একটি গাছের জন্য তার কত দয়ামায়া লাগে কিন্তু তার চেয়ে একটি বড় বিশাল শহর ও তার প্রাণীগুলো (মানুষ ও পশু) আরো কতই না গুরুত্বপূর্ণ! এভাবে তিনি যোনার ভুল বিচার-বুদ্ধি, সঠিক উপসংহারে আসার অক্ষমতা, অতি সরু চিন্তা-ভাবনা, অহংকার ও জাতিগত গর্বের বিষয়ে তাকে চেতনা দেন। আসিরিয়া ঈশ্বর কাছ থেকে কোন বিশেষ প্রকাশ পায় নি, তাদের কাছে আইন-কানুন বা ভাববাণীও ছিল না। তারা ঈশ্বরের মানদণ্ড জানে না, কিন্তু তারা ঈশ্বরের বিচারবাণীতে মনেপ্রাণে সাড়া দিয়েছে। কিন্তু যোনার মনোনীত জাতি (ইস্রায়েল ও যিহূদা), তারা ভাববাদীদের বাণী পেলেও (হোশেয়, আমোষ) কোন গুরুত্ব দেয় নি, চেতনা পায় নি এবং মনও ফিরায় নি। ঈশ্বরের দয়ার সামনে কোনো অহংকার বা উঁচু-নিচু ভাব দাঁড়াতে পারে না। ঈশ্বরের কাছে তাঁর চমৎকার দয়া ও উদ্ধারের জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া হল উপযুক্ত সাড়া, ইস্রায়েল এবং আসিরিয়া উভয় জাতিদের জন্য।
যোনার জন্য ঈশ্বরের চ্যালেঞ্জ এই: আসিরিয়াকে, অর্থাৎ এমন একটি জাতি যারা ইস্রায়েলকে আঘাত করেছিল, তাদেরকে ক্ষমা করা। ক্ষমা করা আসলে মানে কি, তা আমাদের স্মরণ করা দরকার: ক্ষমা মানে এই না যে, বিষয়টি আর খারাপ লাগে না। ক্ষমা মানে এই না যে, যা ঘটেছিল তা ভুলে যাওয়া। ক্ষমা মানে এই না যে, যত অন্যায় ঘটেছিল, তা অস্বীকার করা। ক্ষমা মানে এই না যে, অন্যায়কে ভাল বলা বা অনুমোদিত করা। ক্ষমা মানে এই না যে, অন্যায় পুনরায় ঘটার প্রতিরোধ করব না। ক্ষমা মানে এই না যে, অন্ধভাবে পুনরায় বিশ্বাস করা, হয়তো ক্ষমা করার সাথে সাথে আমাদের সুরক্ষাকারী সীমানা বিস্তার করতে হবে। ক্ষমা এমনি এমনি হয় না, আমাদের তা সচেতনভাবে করতে হবে, চর্চা করতে হবে, করতে থাকতে হবে, এমন সময় পর্যন্ত যখন খারাপ আবেগ কমে যায়। ক্ষমা মানে অন্যায়কে ‘অন্যায়’ বলা, আঘাতকে ‘আঘাত’ বলা। যা হয়েছে তা অস্বীকার না করে বরং এই ঘটনার আবেগ, অপমান, লজ্জা এবং সেই ব্যক্তির উপরে রাগ, ক্ষোভ, প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে দেওয়া, তাকে এই দোষ থেকে ছেড়ে দেওয়া। যদিও অন্যায়কারীর উপর দাবি আছে (বা থাকত) তবুও তা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেওয়া।
কিন্তু কেন ছেড়ে দেব? কারণ ছেড়ে দেওয়া হল নতুন স্বাধীনতায় প্রবেশ করার একমাত্র পথ। যদি অন্যায় বা আঘাতকে ছেড়ে না দিয়ে বরং ধরে রাখি, তবে এই অন্যায় বা আঘাত আমার জীবন থেকে চলে যাবে না। তা আমার অন্তরে কাজ করতে থাকবে, ক্ষোভ সৃষ্টি করতে থাকবে, আমার মন বিষাক্ত করে তুলতে থাকবে এবং শেষে আমার সম্পূর্ণ জীবন এই একটি খারাপ ঘটনার চারিদিকে ঘুরবে বা এই বিষয় দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবে। পরামর্শদাতাদের একটি কথা আছে: ‘অক্ষমা হল এমন একটি জেল যেখানে চাবি, তালা, ছিটকানী সব ভিতরে আছে। এই জেল থেকে শুধুমাত্র বন্দীকেই নিজেকে বের করতে হবে। ঈশ্বর দাবি করেন যেন আমরা অন্যদের ক্ষমা করি কারণ ঈশ্বর আমাদেরকেও ক্ষমা করেছেন। ঈশ্বর দাবি করেন যেন আমরা অন্যদের ক্ষমা করি, কারণ তা না করলে সেই অন্যায়ের ফলাফল ও ক্ষতি আমাদের জীবন থেকে কখনও নির্মূল হয় না। শুধুমাত্র ক্ষমা দ্বারা আসল উদ্ধার ও স্বাধীনতা সম্ভব।
অবশেষে: একজন পরিবর্তিত ভাববাদী
যোনা পুস্তকের শেষ পদগুলো খুব বিশেষ: পুস্তকটি একটি প্রশ্ন দ্বারা খোলা ও ঝুলানো অব্স্থায় শেষ হয়। যোনা কি ঈশ্বরের প্রতি সাড়া দিয়েছিলেন? তিনি কি অবশেষে বুঝতে পেরেছিলেন? তিনি কি মনেপ্রাণে অনুতপ্ত হয়েছিলেন? উত্তর হল: হ্যাঁ – কিন্তু শুধুমাত্র পুস্তকে উল্লিখিত ঘটনা ও কথার পরেই।
কিভাবে আমরা তা জানতে পারি? কারণ তা না হলে আমরা যোনার পুস্তক যেভাবে আছে, সেভাবে পেতাম না। চিন্তা করুন: এই পুস্তকটিতে যোনা নিজের লজ্জা, অহংকার, মিথ্যা গর্ব, ভুল চিন্তা ও খারাপ মনোভাব – এসব খোলামেলাভাবে বর্ণনা করেন। যোনা যদি নত না হতেন, নম্র না হতেন এবং শেষে ঈশ্বরের সাথে একমত না হতেন তবে তিনি পুস্তকটি এভাবে লিখতে পারতেন না। তিনি হাসির সঙ্গে নিজের মুর্খতা ও অহংকার নিয়ে পুস্তকটিতে মজা করতে পারতেন না।
কেন তিনি নিজের লজ্জা প্রকাশ করে লেখেন? কারণ তার পাঠকদের, অর্থাৎ যারবিয়াম-২-এর সময়ের ইস্রায়েলীয়েদের ঠিক যোনার মত অহংকার, জাতিকেন্দ্রিক চিন্তা এবং হৃদয়ে অক্ষমা আছে। যোনার তা ছিল – তিনি তা স্বাধীনভাবে স্বীকার করেন – কিন্তু এখন তা আর নেই! তিনি লেখেন যেন তার সমসাময়িক পাঠকেরা এবং ভবিষ্যৎ পাঠকেরাও তাদের নিজেদের ভুল মনোভাব নিয়ে চেতনা পায় এবং উৎসাহ পায় যে, অনুতপ্ত হলে এই ভুল মনোভাব, মুর্খতা ও অতি সরু চিন্তা থেকে স্বাধীন হওয়া যায়।
ঈশ্বরের দয়া ও করুণা নিজের জন্য গ্রহণ করুন! ঈশ্বরের দয়া ও করুণা অন্যদের উপরেও আসার জন্য রাজি ও আগ্রহী হোন!