ভাববাদী নহূম অতি সাহসের সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী দেন যে, নিষ্ঠুর, দমনকারী ও অজেয় আসিরিয়া সাম্রাজ্য ও তার রাজধানী নীনবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তা দ্বারা নহূম তার শ্রোতা ও পাঠকদের উৎসাহ দেন যে, ঈশ্বর অবশেষে ন্যায় বিচার করবেন।
নিজের পরিচয় হিসাবে নহূম শুধুমাত্র তার গ্রামের না, ইলকোশ উল্লেখ করেন। বাইবেলের অন্য কোনো পুস্তকে ভাববাদী নহূমের নাম উল্লেখ করা হয় নি, তাই তার বাণী ছাড়া আমরা তার সম্বন্ধে আর কিছু জানি না।
নহূম অতি সাহসের সঙ্গে শক্তিশালী আসিরিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী নীনবী ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তিনি ৬৪০ থেকে ৬২৮ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদার কাছে এই ভবিষ্যদ্বাণী বলেন, এমন একটি সময়ে যখন আসিরিয়া তখনও অতি বিশাল, শক্তিশালী, দমনকারী ও অজেয় একটি সাম্রাজ্য। আসিরিয়া যুদ্ধের সময়ে তাদের নিষ্ঠুর ব্যবহারে, জোর করে বিভিন্ন জাতিদের নির্বাসিত ও মিশ্রিত করায়, অতিরিক্ত কর-আদায় এবং পরাজিত জাতিদের আসিরিয়ার জাতীয় দেবতা অশূরের পূজায় বাধ্য করার জন্য বিখ্যাত ছিল।
নহূমের প্রায় একশত বছর আগে অনিচ্ছুক ভাববাদী যোনা আসিরিয়ার রাজধানী নীনবীতে গিয়ে ধ্বংসবাণী দিয়েছিলেন। সেই সময় নীনবী শহরের বাসিন্দারা নম্রতায় ও ভক্তিপূর্ণ ভয়ে সাড়া দিয়েছিল এবং ফলে ঈশ্বর বিচার পিছিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নম্রতার দিন পার হওয়ার প্রায় ৭৫০ খ্রীষ্টপূর্ব থেকে আসিরিয়া হয়ে ওঠে একটি ভয়ংকর ও দমনকারী সাম্রাজ্য যা যিহূদাকে অনেক বার আক্রমণ করে। আসিরিয়া যত জাতি দখল করে, এ পর্যন্ত তাদের মধ্যে একটি জাতিও আসিরিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উঠতে সক্ষম হয় নি। আসিরিয়া ৭৩২ খ্রীষ্টপূর্বে সিরিয়া দেশকে এবং ৭২২ খ্রীষ্টপূর্বে উত্তরের ইস্রায়েল দেশকে সম্পূর্ণভাবে দখল ও ধ্বংস করে। সেই সময় যিহূদারও বেশিরভাগ ভূমি আসিরিয়া দখল করে কিন্তু নম্র রাজা হিষ্কিয় ঈশ্বরকে ডাকেন বলে ঈশ্বর যিহূদাকে আশ্চর্যভাবে আসিরিয়ার হাত থেকে রক্ষা করেন।
ভাববাদী নহূম অতি সাহসের সঙ্গে ঘোষণা করেন যে, আসিরিয়ার রাজধানী নীনবীকে সম্পূর্ণভাবে দখল এবং ধ্বংস করা হবে। নীনবী ছিল ঐযুগের সবচেয়ে সুরক্ষিত শহর। শহরের দেওয়াল ছিল ত্রিশ মিটার উঁচু, একশ বিশ কিলোমিটার লম্বা, অসংখ্য উঁচু গৃহ ও পনেরোটি শক্তিশালী ফটক দ্বারা সুরক্ষিত একটি শহর। এছাড়া শহরের দেওয়াল এমন চওড়া ছিল যে, দেওয়ালের উপর দিয়ে তিনটি ঘোড়ার রথ একসাথে যেতে পারত। দেওয়ালের বাইরে চারিদিকে ছিল তৈরি করা অনেকগুলো খাল, খালের বাইরে আরো দেওয়াল এবং দেওয়ালের বাইরে আরো খাল। এমন কি বাইরে থেকে শহরে প্রবেশের সময় সাতশত মিটারের দুর্গ বা রক্ষিত ব্যবস্থা পার হতে হত।
তাই নহূম যখন নীনবীর ধ্বংসবাণী দেন তখন তা সবার কানে অবিশ্বাস্য, অতি সাহসের, এমন কি খুবই হাস্যকর একটি বাণী। দু’শত বছর ধরে যত জাতি আসিরিয়াকে চ্যালেঞ্জ করেছিল তারা প্রত্যেকেই ব্যর্থ হয়েছিল। নহূম সাহসের সঙ্গে ঘোষণা করেন যা কেউ তখনও চিন্তা বা কল্পনাও করতে পারে না। অপরাজেয় নীনবীর এই অবিশ্বাস্য ভবিষ্যৎ পরাজয়ের ঘটনা পাঠকদের আরো শক্তিশালীভাবে দেখানোর জন্য নহূম তার পুস্তকে নীনবীর পতনের একটি অতি নির্দিষ্ট বাস্তবতা প্রাণবন্তভাবে বর্ণনা করেন। তিনি দৃশ্যায়ন কৌশল ব্যবহার করে ছোট ছোট শক্তিশালী শব্দের মধ্য দিয়ে শত্রুদের আগমন, ঘেরাও, তাড়াহুড়া ইট তৈরি, দেওয়াল আরো শক্তিশালী বানানো, ফটকের সামনে রক্তপাত, দেওয়ালে যুদ্ধ ও তার আওয়াজ, লোকদের পলায়ন, চূড়ান্ত পর্যায়ে সৈন্যদের পরাজয়, শহরের ধ্বংস ও লোকদের বন্দী – এসবের বাস্তবিক বর্ণনা করেন। নহূম তার বর্ণনায় অনেক পানি ভিত্তিক রূপক-শব্দ ব্যবহার করেন, যেমন “নীনবী একটা বাঁধ-ভাংগা পুকুরের মত যার জল বের হয়ে যাচ্ছে … নদীর বাঁধের দরজাগুলো ভেংগে পড়ছে আর রাজবাড়ী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে … তিনি ডুবিয়ে দেওয়া বন্যা দিয়ে নীনবী শহর একেবারে মুছে ফেলবেন”। সেই রূপকগুলো শুধুমাত্র নাটকীয় কৌশল নয়, ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ৬১২ খ্রীষ্টপূর্বে বাবিলীয়েরা, মাদিয়েরা ও স্কুটীয়েরা একসাথে যখন নীনবী শহরকে ঘেরাও করে, তারা শহরটি তাড়াতাড়ি দখল করতে সক্ষম হয় কারণ অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে নদীর বন্যা দ্বারা নীনবীর বিরাট দেওয়ালগুলো নরম হয়ে যায়। ফলে শুধুমাত্র অল্প সপ্তাহের ঘেরাওয়ের মধ্য দিয়ে দেওয়াল ভেঙ্গে নীনবীর দখল ঘটে।
নহূম বেশ কিছু আগুন ভিত্তিক রূপক-শব্দও ব্যবহার করেন: “কে সহ্য করতে পারে তাঁর ভয়ংকর ক্রোধ? তাঁর ক্রোধ আগুনের মত জ্বলে… তোমরা নাড়ার মত পুড়ে যাবে… আমি তোমার রথগুলো পুড়িয়ে ফেলব… তোমার দেশের ফটকগুলো… আগুন সেগুলোর আগল পুড়িয়ে ফেলেছে”। নীনবীর ধ্বংস এমন ছিল যে, পরবর্তী আড়াই হাজার বছর ধরে কেউ আর জানত না নীনবীর ধ্বংসাবশেষ কোথায় ছিল। শুধুমাত্র ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে যখন খনন শুরু হয় তখন মাটির নিচে নীনবীর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। বন্যা দ্বারা নীনবীর দেওয়াল ভেঙ্গে গিয়েছিল, তার প্রমাণ খননের মধ্য দিয়ে পাওয়া যায়। তা ছাড়া অনেক পুড়ে যাওয়া কালো টুকরাও পাওয়া যায়, যার অর্থ হল এই যে, দখল ও লুটপত করার পরে শহরটিকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। এতে নহূমের আগুন ভিত্তিক রূপকও পূর্ণ হয়।
সম্ভবত, নহূম কখনও স্ব-শরীরে নীনবীতে গিয়ে তার ধ্বংসবাণী প্রচার করেন নি, যদিও একশত বছর আগে যোনা সেখানে গিয়েছিলেন। বরং সম্ভাবনা বেশি যে, নহূম যিহূদার লোকদের কাছে বাণী দেন যারা আসিরিয়া দ্বারা অনেক বার অত্যাচারিত হয়েছে। আসিরিয়ার বিরুদ্ধে বিচারবাণী শুনে তারা সান্ত্বনা পাবে। নহূম তার বাণীতে ঈশ্বরের চরিত্রের একটি বর্ণনা দিয়ে শুরু করেন: ঈশ্বর সব কিছু দেখেন, তিনি প্রত্যেক অন্যায় লক্ষ্য করেন, তিনি মন্দকে চিরকাল পর্যন্ত রাজত্ব করতে দেবেন না। তিনি ন্যায়বান, তিনি প্রতিশোধ নেবেন, তিনি অত্যাচারীদেরকে বিচার করবেন। তিনি শক্তিশালী, সার্বভৌম ও ইতিহাসের কর্তা।
ঈশ্বর যখন নহূমের মধ্য দিয়ে আসিরিয়ার ধ্বংসবাণী ঘোষনা করেন তখন যিহূদার ও চারিদিকের জাতিদের জন্য তা সুখবর: “যে লোক সুখবর নিয়ে আসে ও শান্তি ঘোষণা করে, ঐ দেখ, পাহাড়-পর্বতের উপরে তার পা” (নহূম ১:১৫)। এই পদ সেই মুহূর্তের বর্ণনা করে যখন নীনবীর পতনের খবর (সুখবর!) প্রথমে সবার কাছে পৌঁছাবে এবং ভয় ভেঙ্গে আনন্দ ও মুক্তি তৈরী করবে। পৌল রোমীয় ১০:১৫ পদে নহূমের এই পদ উদ্ধৃতি করেন এবং তা যীশুর সুসমাচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন: যীশুর মৃত্যু দ্বারা মন্দকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা হয়েছে, ফলে আমরা সবাই নির্ভয়ে আনন্দ করতে পারি ও তাঁর মুক্তি উৎযাপন করতে পারি।
লেখক নহূম
নিজের পরিচয় হিসাবে নহূম শুধুমাত্র তার গ্রামের নাম “ইলকোশ” উল্লেখ করেন। বাইবেলের অন্য কোনো পুস্তকে ভাববাদী নহূমের নাম উল্লেখ করা হয় নি, শুধুমাত্র যীশুর বংশ তালিকায় (লূক ২:২৫) নহূম নামে একজনকে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু এই লোক পুরাতন ও নতুন নিয়মের মাঝখানের সময়ে, অর্থাৎ পুরাতন নিয়মের লেখাগুলো সমাপ্ত হওয়ার পরেই জন্ম গ্রহণ করে। পুস্তকটির লেখক নহূমের গ্রাম ইলকোশেরও আর কোন উল্লেখ বা তথ্য পাওয়া যায় না।
ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
নহূম অতি সাহসের সঙ্গে শক্তিশালী আসিরিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী নীনবীর ধ্বংসবাণী ঘোষণা করেন। তিনি ৬৪০ থেকে ৬২৮ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদার কাছে এই ভবিষ্যদ্বাণী বলেন, এমন একটি সময়ে যখন আসিরিয়া তখনও অতি বিশাল, শক্তিশালী, দমনকারী ও অজেয় একটি সাম্রাজ্য। আসিরিয়া যুদ্ধের সময়ে তাদের নিষ্ঠুর ব্যবহারে, জোর করে বিভিন্ন জাতিদের নির্বাসিত ও মিশ্রিত করায়, অতিরিক্ত কর-আদায় এবং পরাজিত জাতিদের আসিরিয়ার জাতীয় দেবতা অশূরের পূজায় বাধ্য করার জন্য বিখ্যাত ছিল।
নহূমের প্রায় একশত বছর আগে অনিচ্ছুক ভাববাদী যোনা আসিরিয়ার রাজধানী নীনবীতে গিয়ে ধ্বংসবাণী দিয়েছিলেন। সেই সময় নীনবী শহরের বাসিন্দারা নম্রতায় ও ভক্তিপূর্ণ ভয়ে সাড়া দিয়েছিল এবং ফলে ঈশ্বর বিচার পিছিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নম্রতার দিন পার হওয়ার প্রায় ৭৫০ খ্রীষ্টপূর্ব থেকে আসিরিয়া হয়ে ওঠে ভয়ংকর ও দমনকারী একটি সাম্রাজ্য, যা যিহূদাকে অনেক বার আক্রমণ করে। আসিরিয়া যত জাতি দখল করে, এ পর্যন্ত তাদের মধ্যে একটি জাতিও আসিরিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উঠতে সক্ষম হয় নি। আসিরিয়া ৭৩২ খ্রীষ্টপূর্বে সিরিয়া দেশকে এবং ৭২২ খ্রীষ্টপূর্বে উত্তরের ইস্রায়েল দেশকে সম্পূর্ণভাবে দখল ও ধ্বংস করে। সেই সময় যিহূদারও বেশিরভাগ ভূমি আসিরিয়া দখল করে কিন্তু নম্র রাজা হিষ্কিয় ঈশ্বরকে ডাকেন বলে ঈশ্বর যিহূদাকে আশ্চর্যভাবে আসিরিয়ার হাত থেকে রক্ষা করেন।
রাজা হিষ্কিয়ের পরে মন্দ রাজা মনঃশি (৬৮৬-৬৪২ খ্রীঃপূঃ) ও আমোন (৬৪২-৬৪০ খ্রীঃপূঃ)-এর রাজত্বের সময়ে যিহূদা খুব তাড়াতাড়ি জঘন্য দেবতাপূজায় ও বড় সামাজিক অন্যায়ে লিপ্ত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ঈশ্বরীয় যুবক যোশিয় সিংহাসনে বসেন, যিনি যিহূদার অবস্থা ভালদিকে ফিরিয়ে আনতে প্রাণপণে চেষ্টা করেন। যোশিয়ের রাজত্বের সময়ে নহূম তার এই পুস্তকটি লেখেন, যখন যোশিয়ের পুনসংস্কারের ফলে যিহূদা আত্মিক দিক দিয়ে সুস্থতার পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেই সময়েও বিশাল, শক্তিশালী, দমনকারী আসিরিয়া সাম্রাজ্য তাদের সামনে হুমকি হিসাবে দাঁড়ায়।
আসিরিয়া
আসিরিয়া সাম্রাজ্য বিখ্যাত ছিল যুদ্ধের সময়ে তাদের নিষ্ঠুর ও অমাণবিক ব্যবহারের জন্য, যেমন: শহর পুড়ানো, বন্দীদের জীবিত অবস্থায় গায়ের চামড়া কেটে খোলা, চোখ নষ্ট করা, পরাজিতদের হাত, পা, নাক ও জিহ্বা কেটে ফেলা এবং জয় করা শহরগুলোর ফটকের দু’পাশে মৃত্যদের মাথার খুলির স্তুপ করা। তারা কঠোর হিংস্রতার মধ্য দিয়ে শত্রুদের সাহস নষ্ট করতে চেষ্টা করত। নহূম তার পুস্তকটি আসিরিয়ার বিষয়ে একটি উপযুক্ত প্রশ্ন দিয়ে শেষ করেন “তোমার অশেষ নিষ্ঠুরতা কে না ভোগ করেছে?” (নহূম ৩:১৯)।
আসিরিয়া আরো বিখ্যাত ছিল জোর করে বিভিন্ন জাতিদের নির্বাসিত ও মিশ্রিত করার জন্য, যেন বন্দীরা নিজের জাতীয় বা সাংস্কৃতিক পরিচয় হারিয়ে বিদ্রোহ করতে নিরুৎসাহিত হয়। এছাড়া আসিরিয়া দখল করা এলাকার লোকদের থেকে অতিরিক্ত কর দাবি করত এবং পরাজিতদের দাস বানিয়ে তাদের কঠোর পরিশ্রমে লাগিয়ে আসিরিয়ার অসংখ্যা দুর্গ নির্মাণ করত। আসিরিয়া পরাজিতদের সাংস্কৃতিক ও আত্মিক ক্ষেত্রেও অধীনতা মেনে নিতে বাধ্য করত, অর্থাৎ বিশাল আসিরিয়া সাম্রাজ্যের সমস্ত জায়গায় তারা তাদের জাতীয় দেবতা অশূরের পূজা করতে এবং ছেলেমেয়েদেরকে অশূরের পূজা শেখাতে দাবি করত।
নহূমের সময়ে আসিরিয়ায় কয়েকজন শক্তিশালী নেতা ধারাবাহিকভাবে রাজত্ব করত:
- পূল/তিগ্লত-পিলেষর-৩ ৭৪৫-৭২৭ খ্রীঃপূঃ ২ রাজা ১৫:১৯ ৭৩২ খ্রীঃপূঃ সিরিয়াকে দখল ও নির্বাসিত করেন।
- শলমনেষর-৫ ৭২৭-৭২২ খ্রীঃপূঃ ২ রাজা ১৭:৩-৫, ১৮:৯-১০ ৭২৫-৭২২ খ্রীঃপূঃ শমরিয়াকে ঘেরাও করেন।
- সোর্গন-২ ৭২২-৭০৫ খ্রীঃপূঃ ২ রাজা ১৭:৩-৫, ১৮:৯-১০ ৭২২ খ্রীঃপূঃ শমরিয়াকে দখল করেন।
- সনহেরীব ৭০৫-৬৮১ খ্রীঃপূঃ ২ রাজা ১৮:১৩-১৯:৩৭ ৭০১ খ্রীঃপূঃ যিরূশালেম প্রায় দখল করেন।
- এসর-হোদ্দন ৬৮১-৬৬৯ খ্রীঃপূঃ রাজা মনঃশিকে নির্বাসিত, কর-আদায়, বিদ্রোহী মিসরকে পরাজিত করেন।
- অশূর-বনিপল ৬৬৯-৬২৭ খ্রীঃপূঃ ২২জন রাজার কাছ থেকে কর-আদায়। বাবিলের বিদ্রোহকে পরাজিত করেন।
ভাববাদী নহূম অতি সাহসের সঙ্গে ঘোষণা করেন যে, আসিরিয়ার রাজধানী নীনবীকে সম্পূর্ণভাবে দখল এবং ধ্বংস করা হবে। নীনবী ছিল ঐযুগের সবচেয়ে সুরক্ষিত শহর। শহরের দেওয়াল ছিল ত্রিশ মিটার উঁচু, একশ বিশ কিলোমিটার লম্বা, অসংখ্য উঁচু গৃহ ও পনেরোটি শক্তিশালী ফটক দ্বারা সুরক্ষিত একটি শহর। এছাড়া শহরের দেওয়াল এমন চওড়া ছিল যে, দেওয়ালের উপর দিয়ে তিনটি ঘোড়ার রথ একসাথে যেতে পারত। দেওয়ালের বাইরে চারিদিকে ছিল তৈরি করা অনেকগুলো খাল, খালের বাইরে আরো দেওয়াল এবং দেওয়ালের বাইরে আরো খাল। এমন কি বাইরে থেকে শহরে প্রবেশের সময় সাতশত মিটারের দুর্গ বা রক্ষিত ব্যবস্থা পার হতে হত। শহরের মধ্যে অনেক রাজপ্রাসাদ ও বিভিন্ন দেবতার মন্দির ছিল।
নহূমের অতি সাহসী বাণী
তাই নহূম যখন নীনবীর ধ্বংসবাণী দেন তখন তা সবার কানে অবিশ্বাস্য, অতি সাহসের, এমন কি খুবই হাস্যকর একটি বাণী। দু’শত বছর ধরে যত জাতি আসিরিয়াকে চ্যালেঞ্জ করেছিল তারা প্রত্যেকেই ব্যর্থ হয়েছিল। নহূম সাহসের সঙ্গে ঘোষণা করেন যা কেউ তখনও চিন্তা বা কল্পনাও করতে পারে না। অপরাজেয় নীনবীর এই অবিশ্বাস্য ভবিষ্যৎ পরাজয়ের ঘটনা পাঠকদের আরো শক্তিশালীভাবে দেখানোর জন্য নহূম তার পুস্তকে নীনবীর পতনের একটি অতি নির্দিষ্ট বাস্তবতা প্রাণবন্তভাবে বর্ণনা করেন। তিনি দৃশ্যায়ন কৌশল ব্যবহার করে ছোট ছোট শক্তিশালী শব্দের মধ্য দিয়ে শত্রুদের আগমন, ঘেরাও, তাড়াহুড়া ইট তৈরি, দেওয়াল আরো শক্তিশালী বানানো, ফটকের সামনে রক্তপাত, দেওয়ালে যুদ্ধ ও তার আওয়াজ, লোকদের পলায়ন, চূড়ান্ত পর্যায়ে সৈন্যদের পরাজয়, শহরের ধ্বংস ও লোকদের বন্দী করা – এসবের বাস্তবিক বর্ণনা করেন। যেমন এই পদগুলোতে:
“শত্রু-সৈন্যদের ঢাল লাল রংয়ের আর যোদ্ধাদের পরনে টক্টকে লাল রংয়ের পোশাক। তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে; তাদের রথগুলোর লোহা ঝক্মক করছে; তারা বর্শা ঘুরাচ্ছে; তাদের সব রথ রাস্তায় রাস্তায় ঝড়ের মত চলছে আর শহরের খোলা জায়গাগুলোর মধ্য দিয়ে বেপরোয়া ভাবে এদিক ওদিক যাচ্ছে। সেগুলো দেখতে জ্বলন্ত মশালের মত; সেগুলো বিদ্যুতের মত ছুটে যাচ্ছে। … নীনবী একটা বাঁধ-ভাংগা পুকুরের মত যার জল বের হয়ে যাচ্ছে। সে “থাম, থাম,” বলে চিৎকার করছে কিন্তু তার লোকেরা কেউ পিছন ফিরছে না। তার রূপা লুট কর, সোনা লুট কর। এই সব জিনিস অফুরন্ত; এগুলো তার সব ধনভাণ্ডারের ধন-সম্পদ। তাকে লুট করা হচ্ছে, খালি করা হচ্ছে ও ধ্বংস করা হচ্ছে। তার লোকদের অন্তর গলে গেছে, হাঁটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লাগছে; তাদের কোমরে আর জোর নেই, তাদের প্রত্যেকজনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। … ঘেরাওয়ের সময়ের জন্য তুমি জল তুলে রাখ, তোমার দুর্গগুলো শক্তিশালী কর। কাদা দলাই-মলাই কর; চুন ও বালি মিশাও ও ইটের ছাঁচ তৈরী কর। সেখানে আগুন তোমাকে গ্রাস করবে; তলোয়ার তোমাকে কেটে ফেলবে এবং ধ্বংসকারী পংগপালের মত ধ্বংস করে ফেলবে। তুমি ধ্বংসকারী ও ঝাঁকবাঁধা পংগপালের মত সংখ্যায় বেড়ে ওঠো” (নহূম ২:৩-১০, ৩:১৪-১৫)।
ভবিষ্যদ্বাণীর ঐতিহাসিক পূর্ণতা
নীনবী শহরের এই আবেগীয় বর্ণনা যা নহূম ঘোষণা করেছিলেন, তা হুবহু ৬১২ খ্রীষ্টপূর্বে পূর্ণ হয়। সেই সালে বাবিলীয়েরা (রাজা নাবোপলাসরের নেতৃত্বে), মাদীয়েরা (সিয়াক্সারেসের নেতৃত্বে) এবং স্কুটীয়েরা একত্রে জোট বেঁধে নীনবী শহরকে আক্রমণ করে। যেহেতু নীনবী অতি সুরক্ষিত একটি শহর ছিল এবং শহরের মধ্য দিয়ে খোসর্ নদী যেত (জলের সরবরাহ নিশ্চিত), একারণে মনে করা হত যে, নীনবী শহরকে ২০ বছর ধরে ঘেরাও করলেও তা দখল করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জোটের তিনটি সৈন্যদল নীনবীকের শুধুমাত্র ৩ মাস ঘেরাওয়ের পরে দখল করতে সক্ষম হয়। প্রশ্ন হল, তা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল?
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, নহূম নীনবীর পতনের বর্ণনায় অনেক পানি ভিত্তিক রূপক ব্যবহার করেন, যেমন “নীনবী একটা বাঁধ-ভাংগা পুকুরের মত যার জল বের হয়ে যাচ্ছে … নদীর বাঁধের দরজাগুলো ভেংগে পড়ছে আর রাজবাড়ী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে … তিনি ডুবিয়ে দেওয়া বন্যা দিয়ে নীনবী শহর একেবারে মুছে ফেলবেন”। সেই রূপকগুলো শুধুমাত্র যে নাটকীয় কৌশল, তা নয় বরং তা আক্ষরিকভাবে পূর্ণ হয়: অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে খোসর্ নদীর পানি উপচিয়ে সীমানা পার হয়ে সমগ্র নীনবী শহরে একটি বন্যা হয়, যার ফলে নীনবীর বিরাট দেওয়ালগুলো নরম হয়ে যায়। জোটের সৈন্যরা নরম দেওয়াল ভেঙ্গে দিয়ে নীনবী শহর দখল করে। নহূম এর অগ্রিম বর্ণনায় একটি লক্ষণীয় রূপক ব্যবহার করেছিল: “তোমার সমস্ত দুর্গগুলো পাকা ফলে ভরা ডুমুর গাছের মত; যে কেউ সেগুলো নাড়াবে ডুমুরগুলো তারই মুখে পড়বে” (নহূম ৩:১২)। ঠিক তাই ঘটল।
এছাড়া নহূম বেশ কিছু আগুন ভিত্তিক রূপকও ব্যবহার করেন: “কে সহ্য করতে পারে তাঁর ভয়ংকর ক্রোধ? তাঁর ক্রোধ আগুনের মত জ্বলে … তোমরা নাড়ার মত পুড়ে যাবে … আমি তোমার রথগুলো পুড়িয়ে ফেলব … তোমার দেশের ফটকগুলো … আগুন সেগুলোর আগল পুড়িয়ে ফেলেছে” । নীনবীর ধ্বংস এমন ছিল যে, পরবর্তী আড়াই হাজার বছর ধরে কেউ আর জানত না নীনবীর ধ্বংসাবশেষ কোথায় ছিল। শুধুমাত্র ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে যখন খনন শুরু হয় তখন মাটির নিচে নীনবীর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। বন্যা দ্বারা নীনবীর দেওয়াল ভেঙ্গে গিয়েছিল, তার প্রমাণ খননের মধ্য দিয়ে পাওয়া যায়। তা ছাড়া অনেক পুড়ে যাওয়া কালো টুকরাও পাওয়া যায়, যার অর্থ হল এই যে, দখল ও লুটপত করার পরে শহরটিকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। এতে নহূমের আগুন ভিত্তিক রূপকও পূর্ণ হয়।
ন্যায় বিচারের ও করুণার ঈশ্বর
সম্ভবত, নহূম কখনও স্ব-শরীরে নীনবীতে গিয়ে তার ধ্বংসবাণী প্রচার করেন নি, যদিও একশত বছর আগে যোনা সেখানে গিয়েছিলেন। বরং সম্ভাবনা বেশি যে, নহূম যিহূদার লোকদের কাছে বাণী দেন যারা আসিরিয়া দ্বারা অনেক বার অত্যাচারিত হয়েছে। যিহূদার চোখে আসিরিয়া হল হিংস্রতা, দমন, অত্যাচার, কর-আদায়, দেবতাপূজা ও অনৈতিকতার অবতার। আসিরিয়া মানেই মন্দ, এমন মন্দ যা কেউ এড়িয়ে যেতে, চ্যালেঞ্জ করতে, প্রতিরোধ করতে, নিয়নন্ত্রণে আনতে বা বিচার করতে সক্ষম নয় – এবং এর পরিবর্তনের আশাও দেখা যায় না। আসিরিয়া যা চায় তা-ই করে, যাকে চায় তাকেই করে এবং তা প্রতিরোধ করার কেউ নেই। আমরা সবাই জানি কেমন লাগে সেই অক্ষমতা, ক্ষোভ ও হতাশা যখন আমরা এমন মন্দতার সম্মুখীন হই যার কোন শেষ বা সীমানা নেই।
ঠিক এই অক্ষমতা, ক্ষোভ ও হতাশা নহূম তার বাণী দ্বারা ভাঙ্গতে চান। এর জন্য তিনি তার পুস্তক ঈশ্বরের চরিত্রের একটি শক্তিশালী বর্ণনা দিয়ে শুরু করেন (নহূম ১): “সদাপ্রভু এমন ঈশ্বর যিনি তাঁর পাওনা ভক্তি চান ও প্রতিফল দেন; সদাপ্রভু প্রতিশোধ নেন ও তিনি ক্রোধে পরিপূর্ণ। সদাপ্রভু তাঁর বিপক্ষদের উপরে প্রতিশোধ নেন এবং তাঁর শত্রুদের জন্য তাঁর ক্রোধ জমা করে রাখেন। সদাপ্রভু সহজে অসন্তুষ্ট হন না এবং তিনি শক্তিতে মহান; দোষীকে তিনি শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দেন না। তাঁর পথ ঘূর্ণিবাতাস ও ঝড়ের মধ্যে থাকে, আর মেঘ হল তাঁর পায়ের ধুলা … তাঁর অসন্তোষের সামনে কে টিকে থাকতে পারে? কে সহ্য করতে পারে তাঁর ভয়ংকর ক্রোধ? তাঁর ক্রোধ আগুনের মত জ্বলে; তাঁর সামনে বড় বড় পাথর টুকরা টুকরা হয়ে যায়। সদাপ্রভু মংগলময়, কষ্টের সময়ের আশ্রয়স্থান। যারা তাঁর মধ্যে আশ্রয় নেয় তিনি তাদের দেখাশোনা করেন” (নহূম ১:২-৩,৬,৭)। তিনি সেই ঈশ্বর যিনি দেখেন, জানেন, খেয়াল করেন ও যত্ন নেন। তিনি অন্যায়কে ঘৃণা করেন, মন্দতাকে তিনি চিরকাল চলমান থাকতে দেবেন না। তিনি ন্যায্য, তিনি বিচার করবেন, তিনি ইতিহাসের শক্তিশালী কর্তা।
নহূম দেখান যে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ও সার্বভৌম, কিন্তু তিনি আসিরিয়ার দেবতাদের মত হিংস্র, স্বৈরাচারী, এক এক দিন এক এক ধরণের কোনো প্রভু নন। তিনি তাঁর ক্রোধে ন্যায্য, স্বনিয়ন্ত্রিত, নীতি-ভিত্তিক, ন্যায্যতায় সমর্পিত, বিচার করতে ও উদ্ধার করতে সক্ষম: “আমি তোমাকে দুঃখ দিয়েছি সত্যি, কিন্তু আর দুঃখ দেব না। এখন আমি তোমার কাঁধ থেকে তাদের জোয়াল ভেংগে দেব এবং তোমার বাঁধন ছিঁড়ে ফেলব” (নহূম ১:১২খ-১৩)।
প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের চরিত্র হল তার সাহসী বাণীর নোঙ্গর: এই ন্যায়বান ঈশ্বর তাঁর করুণায় ঘোষণা করছেন যে, সেই অজেয় আসিরিয়ার সীমানাহীন মন্দতা এখন বিচারিত হবে এবং চূড়ান্তভাবে সরানো হবে – অবিশ্বাস্য ও কল্পনার বাইরে ঘটনা হলেও সত্যি। আবারও নাটকীয়ভাবে নহূম এই আবেগীয় উক্তি করেন “যে লোক সুখবর নিয়ে আসে ও শান্তি ঘোষণা করে, ঐ দেখ, পাহাড়-পর্বতের উপরে তার পা” (নহূম ১:১৫ক)। যদিও এটা তখনও ঘটে নি তবুও তিনি সেই মুহূর্তের বাস্তবিক বর্ণনা করেন যখন একজন সংবাদদাতা এসে খবর দেবে যে, নীনবী প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস হয়েছে, যখন সব জাতিদের উপর থেকে আসিরিয়ার জোয়াল সেই মুহূর্তে ভেঙ্গে যাবে, যখন নিঃশাস ফেলে মানুষ আনন্দে বুঝবে যে তারা রেহাই, মুক্তি বা পরিত্রাণ পেয়েছে। ঈশ্বরের মুক্তি পেয়ে নহূম যিহূদাকে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে বলেন “হে যিহূদা, তোমার পর্বগুলো পালন কর এবং মানত সব পূর্ণ কর” (নহূম ১:১৫খ)।
পৌল রোমীয় ১০:১৫ পদে নহূমের সুখবর সম্বন্ধীয় পদ উদ্ধৃতি করেন এবং তা মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী হিসাবে ব্যাখ্যা করেন -এটি সেই বাণীর একটি আরো বড় পূর্ণতা: ঈশ্বর শুধুমাত্র একটি মন্দ সাম্রাজ্যকে সরিয়ে দেবেন, তা নয়, তিনি তাদের দেবতাপূজা সরাবেন (সেই আরো বড় বন্ধন!, নহূম ১:১৪) এবং মন্দতাকে তিনি নিজেই শেষ করে দেবেন। যীশুর মৃত্যু দ্বারা মন্দকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা হয়েছে। এই সুখবর ছড়িয়ে পড়বে এবং সব জাতিদের কাছে পৌঁছিয়ে সবার জন্য পরিত্রাণ, মুক্তিসও আশা নিয়ে আসবে। যীশুর এই সুসমাচার পেয়ে আমরা আনন্দের সঙ্গে তাঁর মুক্তি উৎযাপন করতে পারি – একটি চিরস্থায়ী মুক্তি (নহূম ১:১৫গ)।