ভাববাদী হগয় বাবিলের নির্বাসন থেকে যিহূদায় অর্থাৎ প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে আসা যিহূদীদের কাছে কথা বলেন। ৫৩৯ খ্রীষ্টপূর্বে মাদিয়-পারস্যের রাজা কোরস বিশাল বাবিল সাম্রাজ্যকে দখল করেন। বাবিলীয়েরা পরাজিত জাতিদেরকে জোরপূর্বকভাবে নির্বাসিত এবং এক জাতির সঙ্গে অন্য জাতিকে মিশ্রিত করত, কিন্তু মাদিয়-পারস্যের রাজা কোরস এই নিয়ম বাতিল করেন। তিনি ৫৩৮ খ্রীষ্টপূর্বে নির্বাসিত জাতিদেরকে তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার এবং সেখানে তাদের দেবতার মন্দির পুনরায় নির্মাণ করার অনুমতি দেন (ইষ্রা ১:২-৪)। যিরমিয়ের সেই ভবিষ্যদ্বাণী যে, নির্বাসন শুধুমাত্র সত্তর বছর স্থায়ী থাকবে, তা এভাবে পূর্ণ হয় (যিরমিয় ২৯:১০)।
প্রায় পঞ্চাশ হাজার উচ্চাকাঙ্ক্ষী যিহূদীরা এই ঐতিহাসিক ঘটনা সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে এবং ৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদায়, অর্থাৎ প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে যায়। প্রকৃতপক্ষে নির্বাসনে যিহূদীদের অবস্থা খুব খারাপ ছিল, তা নয়। তারা বাবিলে কাজ করে অনেক কিছু অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল, যার কারণে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে এখন নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়া ছিল তাদের বড় সিদ্ধান্ত ও ত্যাগ-স্বীকারের বিষয়। যারা ফিরে যায় তারাই ছিল সবচেয়ে বাধ্য, ইচ্ছুক ও ঈশ্বরের বাক্যের উপর রির্ভরশীল যিহূদী। তারা এমন যিহূদীরা যারা বিশ্বাস করে যে, ঈশ্বর তাঁর নির্বাসিত জাতিকে ত্যাগ করেন নি এবং ঈশ্বরের আহ্বান ও প্রতিজ্ঞা এখন তাদেরই উপরে আছে। তারা প্রতিজ্ঞাত দেশের অধিকার পাওয়া আশা করে এবং বিশ্বাস করে যে, নির্বাসনের আগে ভাববাদীদের (যেমন যিশাইয়, মীখা বা আমোষ) সেই চমৎকার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো এখনও প্রযোজ্য এবং ঈশ্বর সেগুলো অবশ্যই পূর্ণ করবেন ।
কিন্তু তারা যেভাবে বড় প্রতাশা করেছিল, যিহূদায় ফিরে এসে তারা নিজেকে তেমন ভাল অবস্থায় খুঁজে পায় না: তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভাল নয়, দেবতাপূজারী মাদিয়-পারস্যেরা এখনও তাদের উপরে রাজত্ব করে এবং কর আদায় করে। এছাড়া তাদেরকে প্রতিজ্ঞাত দেশে অন্য জাতিদের সঙ্গে বসবাস করতে হচ্ছে, এমন জাতি যারা যিহূদীরা নির্বাসনে চলে যাওয়ার পরে সেখানে বাস করতে শুরু করেছিল।
৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদীরা যিহূদা দেশে ফিরে এসে তারা প্রথমেই যিরূশালেমে আগের স্থানে পুড়ানো উৎসর্গের ব্রোঞ্জ বেদী পুনরায় স্থাপন করে, উৎসর্গ পদ্ধতি পুনরায় চালু করে, বাৎসরিক পর্বগুলো পালন করতে শুরু করে এবং উপাসনা-ঘর পুনর্নির্মাণের জন্য ভিত্তি স্থাপন করে (ইষ্রা ৩:২-৭)। কিন্তু যিহূদায় বসবাসকারী অন্যান্য জাতি তাড়াতাড়ি তাদের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়: তারা ফিরে আসা যিহূদীদের হুমকি দেয়, তাদের কাজ থামানোর জন্য কর্মচারীদের ঘুষ দেয় এবং বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করে যেন যিহূদীরা উপাসনা-ঘর নির্মাণে ব্যর্থ হয় (ইষ্রা ৪:৪-৫)। যিহূদীরা নিরুৎসাহিত হয়ে উপাসনা-ঘর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয় এবং পরিবর্তে নিজের ঘর-বাড়ী তৈরি ও নিজের জীবন গঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রায় ১৬ বছর এভাবে পার হয়ে যায়।
কিন্তু ৫২০ খ্রীষ্টপূর্বে ঈশ্বর ভাববাদী হগয় ও সখরিয়কে আহ্বান করেন যেন তারা যিহূদীদেরকে উপাসনা-ঘর নির্মাণ পুনরায় চালিয়ে নিতে বলেন। হগয় লোকদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা নিজেদের আর্থিক অবস্থা লক্ষ্য করে তা মোশির আইন-কানুনে অনুসারে চুক্তির আলোতে (২য় বিবরণ ২৮) পরীক্ষা করে দেখে: বৃষ্টির অভাব, সীমিত ফসল (হগয় ১:১০), খরা, ছাৎলা পড়া রোগ, শিলাবৃষ্টি (হগয় ১:১১, ২:১৭) এবং নিষ্ফল পরিশ্রম (হগয় ১:৫-৭)। হগয় তুলনা করে দেখান যে, ঈশ্বরের ঘরের অবস্থা খুবই খারাপ, অর্থাৎ ধ্বংসাবশেষ মাত্র কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত ঘর-বাড়ী নির্মাণ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর দাবি করেন না যে, তাদের ঘরে ছাদ না থাকা অবস্থায় উপাসনা-ঘর তৈরি করতে হবে। কিন্তু তিনি তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা নিজেদের ঘর-বাড়ীতে কারুকাজ করানোর আগে (হগয় ১:৪), অর্থাৎ বিলাসিতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ার আগেই উপাসনা-ঘর নির্মাণে গুরুত্ব দেয়।
হগয়ের চ্যালেঞ্জ পেয়ে সাধারণ দায়ূদ বংশের শাসনকর্তা সরুব্বাবিল, মহাপুরোহিত যিহোশূয় এবং সাধারণ লোকেরা সাড়া দিয়ে উপাসনা-ঘর পুনরায় নির্মাণ করতে শুরু করে (হগয় ১:১২-১৫)। কিন্তু সুন্দরভাবে কাজ হাতে নেওয়ার পরেও তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে যায়, বিশেষভাবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা, যারা শলোমনের চমৎকার উপাসনা-ঘর নির্বসনের আগে অর্থাৎ তাদের ছোটবেলায় নিজের চোখে দেখেছিল (হগয় ২:৩)। ঈশ্বর তাদের হতাশা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞা দেন যে, তিনি তাদের সঙ্গেই আছেন (হগয় ২:৫) এবং তাদের বাধ্যতার কারণে তাদেরকে দৃশ্যমানভাবে অর্থনৈতিক আশীর্বাদ দান করবেন (হগয় ২:১৯)। এছাড়া তিনি তাদেরকে একটি অতি চমৎকার প্রতিজ্ঞা দেন: যে উপাসনা-ঘর তারা এখন তৈরি করছে, ছোট হলেও, ঈশ্বর নিজেই সেই উপসনা-ঘরকে জাতিদের ধন-সম্পদ এবং ঈশ্বরের মহিমা দিয়ে ভরিয়ে দেবেন, এমন কি শলোমনের উপাসনা-ঘরের চেয়েও বেশি (হগয় ২:৬-৯)।
এই প্রতিজ্ঞাটি কিভাবে পূর্ণ হয়? হগয়ের সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে (ইষ্রা, নহিমিয়, হগয়, সখরিয়) একজনও বলেন নি যে, ঈশ্বরের দৃশ্যমান উপস্থিতি সরুব্বাবিলের এই দ্বিতীয় উপাসনা-ঘরের উপরে নেমে এসেছিল, যেমন মোশির তাম্বুর উৎসর্গের দিনে এবং শলোমনের উপাসনা-ঘরের উৎসর্গের দিনে ঘটেছিল (যাত্রা ৪০:৩৪, ২ বংশা ৫:১৪)। বলা যায় যে, এই প্রতিজ্ঞা তখন পূর্ণ হয়েছে যখন মাদিয়-পারস্যেরা এই উপাসনা-ঘরের জন্য টাকা দান করে (ইষ্রা ৬:৮-১২), অথবা যখন কয়েক শতাব্দীর পরে হেরোদ এই উপাসনা-ঘরকে সোনা দিয়ে আচ্ছাদিত করেন অথবা যখন যীশু নিজেই এই উপাসনা-ঘরে পা দেন এবং এভাবে তা ‘পূর্ণ’ করেন।
কিন্তু প্রতিজ্ঞাটি তার চেয়েও বড় কিছু বুঝায়: যীশু শুধুমাত্র উপাসনা-ঘরে পা দেন, তা নয় বরং তিনি নিজেই হলেন সেই উপাসনা-ঘর যা ঈশ্বরের মহিমায় পূর্ণ, অর্থাৎ তিনিই হলেন সেই ঈশ্বর যিনি ‘সঙ্গে সঙ্গে আছেন’, তিনিই ‘ইম্মানুয়েল’। তিনিই তার মণ্ডলী নির্মাণ করেন, যাকে “ঈশ্বরের থাকবার ঘর” বলা হয় (১ করিন্থীয় ৩:১৭)। জাতিরা ধন-সম্পদ উপাসনা-ঘরে নিয়ে আসবে, তবে তা কি বুঝায়? প্রকৃতপক্ষে এই ধন-সম্পদ বলতে বিশ্বাসীদেরকে বুঝানো হয়, যারা সমস্ত জাতি থেকে যীশুর মধ্য দিয়ে পরিত্রাণ পেয়ে মণ্ডলীর অংশ হয়ে যাবে।
সেই সময়ে যিহূদীদের অন্তরে একটি লুকানো প্রশ্ন বা নিরাশা ছিল: দায়ূদের রাজবংশের একজন রাজা কেন যিহূদীদের উপর রাজত্ব করেন না, যেমন ঈশ্বর ২য় শমূয়েল ৭ অধ্যায়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন? ঈশ্বর এই নিরাশা ভাঙ্গার জন্য হগয়ের মাধ্যমে দায়ূদ বংশের সরুব্বাবিলকে একটি প্রতিজ্ঞা দেন: “আমি তোমাকে নিয়ে আমার সীলমোহরের আংটির মত করব, কারণ আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি” (হগয় ২:২৩)। এই মশীহ সম্বন্ধীয় প্রতিজ্ঞায় সরুব্বাবিল একটি চিহ্ন হয়ে দাঁড়ান, যা যীশুকে ইঙ্গিত করে, যার হাতে সীলমোহর আছে, যার হাতে লোকদের পরিত্রাণ দিয়ে আপন হিসাবে নেওয়ার অধিকার ও ক্ষমতা আছে ।
লেখক হগয়
হগয় তার পুস্তকে নিজের পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে মাত্র একটি শব্দ ব্যবহার করেন: “ভাববাদী” (হগয় ১:১, ২:১,১০)। এর চেয়ে ভিন্নভাবে তিনি নেতাদের নাম উল্লেখ করলে তাদেরকে পদবী ও বাবার নাম সহ উল্লেখ করেন (হগয় ১:১২)। এই ছোট পুস্তকে হগয় ঈশ্বরের কাছ থেকে ৫টা বাণী দেন, যা তিনি ৪ মাসের মধ্যে ঘোষণা করেন। ইষ্রা তার পুস্তকে হগয় ও তার সহ-ভাববাদী সখরিয়কে উল্লেখ করেন (ইষ্রা ৫:১, ৬:১৪), কিন্তু তিনি তাদের সম্বন্ধে আর কোন তথ্য দেন না। হগয়ের নামের অর্থ হল ‘পর্ব সম্বন্ধীয়’, হয়তো তিনি কোনো একটি যিহূদী পর্বের দিনে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে যখন যিহূদীদের প্রথম দল বাবিলের নির্বাসন থেকে যিহূদায় ফিরে আসে, সম্ভাবনা বেশি যে, হগয় তাদের মধ্যে একজন। কেউ কেউ মনে করে যে, হগয় লেবীয় বা পুরোহিত বংশের একজন ছিলেন কারণ তিনি পুরোহিতদেরকে শুচি-অশুচি নিয়ম সম্বন্ধে বেশ কঠিন দু’টি প্রশ্ন করেন (হগয় ২:১১-১৩)। যিহূদীদের ফিরে আসা প্রথম দলে অবশ্যই বেশ ভাল সংখ্যক লেবীয় ও পুরোহিত ছিল, কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, হগয় তাদের মধ্যে একজন কিনা।
ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
হগয় ঈশ্বরের কাছ থেকে বাণী পেয়ে সেগুলোর তারিখ খুব গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন (হগয় ১:১, ১:১৫, ২:১, ২:২০)। এই তারিখগুলো পেয়ে এবং ইষ্রা ভাববাদী হগয় ও সখরিয়কে উল্লেখ করেন (ইষ্রা ৫:১, ৬:১৪) বলে, হগয়ের বাণীর ঐতিহাসিক পরিস্থিতি পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়: তিনি বাবিলে নির্বাসন থেকে যিহূদায় ও যিরূশালেমে ফিরা আসা যিহূদীদের কাছে কথা বলেন (ইষ্রা ৫:১)।
৫৩৯ খ্রীষ্টপূর্বে মাদিয়-পারস্যের রাজা কোরস বিশাল বাবিল সাম্রাজ্যকে দখল করেন। বাবিলীয়েরা পরাজিত জাতিদেরকে জোরপূর্বকভাবে নির্বাসিত এবং এক জাতির সঙ্গে অন্য জাতিকে মিশ্রিত করত, কিন্তু মাদিয়-পারস্যের রাজা কোরস এই নিয়ম বাতিল করেন। তিনি ৫৩৮ খ্রীষ্টপূর্বে নির্বাসিত জাতিদেরকে তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার এবং সেখানে তাদের দেবতার মন্দির পুনরায় নির্মাণ করার অনুমতি দেন (ইষ্রা ১:২-৪)। যিরমিয়ের সেই ভবিষ্যদ্বাণী যে, নির্বাসন শুধুমাত্র সত্তর বছর স্থায়ী থাকবে, তা এভাবে পূর্ণ হয় (যিরমিয ২৯:১০)।
প্রায় পঞ্চাশ হাজার উচ্চাকাঙ্ক্ষী যিহূদীরা এই ঐতিহাসিক ঘটনা সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে এবং ৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদায়, অর্থাৎ প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে যায়। প্রকৃতপক্ষে নির্বাসনে যিহূদীদের অবস্থা খুব খারাপ ছিল, তা নয়। তারা বাবিলে কাজ করে অনেক কিছু অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল, যার কারণে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে এখন নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়া ছিল তাদের বড় সিদ্ধান্ত ও ত্যাগ-স্বীকারের বিষয়। যারা ফিরে যায় তারাই ছিল সবচেয়ে বাধ্য, ইচ্ছুক ও ঈশ্বরের বাক্যের উপর রির্ভরশীল যিহূদী। তারা এমন যিহূদীরা যারা বিশ্বাস করে যে, ঈশ্বর তাঁর নির্বাসিত জাতিকে ত্যাগ করেন নি এবং ঈশ্বরের আহ্বান ও প্রতিজ্ঞা এখন তাদেরই উপরে আছে। তারা প্রতিজ্ঞাত দেশের অধিকার পাওয়া আশা করে এবং বিশ্বাস করে যে, নির্বাসনের আগে ভাববাদীদের (যেমন যিশাইয়, মীখা বা আমোষ) সেই চমৎকার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো এখনও প্রযোজ্য এবং ঈশ্বর সেগুলো অবশ্যই পূর্ণ করবেন ।
কিন্তু তারা যেভাবে বড় প্রতাশা করেছিল, যিহূদায় ফিরে এসে তারা নিজেকে তেমন ভাল অবস্থায় খুঁজে পায় না, ‘আগের মত’ অবশ্যই লাগে না:
- মোশির সময়ে প্রস্থানে ইস্রায়েলের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ২০ থেকে ৩০ লক্ষ (যাত্রা ১২:৩৭)। বাবিল থেকে যিহূদীদের এই ‘দ্বিতীয় প্রস্থানে’ তাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই কম, অর্থাৎ মাত্র পঞ্চাশ হাজারের মত।
- যদিও তাদের শাসনকর্তা হলেন দায়ূদ বংশধর সরুব্বাবিল তবুও দেবতাপূজারী মাদিয়-পারস্যেরা তাদের উপরে রাজত্ব করে।
- মাদিয়-পারস্য সারকার তাদের থেকে কর আদায় করে এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশি ভাল নয়।
- তাছাড়া তাদেরকে প্রতিজ্ঞাত দেশে অন্য জাতিদের সঙ্গে বসবাস করতে হচ্ছে, এমন জাতি যারা যিহূদীরা নির্বাসনে চলে যাওয়ার পরে সেখানে বাস করতে শুরু করেছিল।
- ফিরে আসা যিহূদীরা হল যিহূদা ও বিন্যামিন গোষ্ঠির লোক (ইষ্রা ১:৫)। ইস্রায়েলের অন্য ১০টি বংশের লোকদের আর পাওয়া যায় না।
- যিহূদার শহরগুলো এখনও ভাঙ্গা অবস্থায় আছে, অর্থাৎ প্রাচীর বা সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই।
- যদিও রাজা কোরস শলোমনের উপসনা-ঘরের জিনিস-পত্র যিহূদীদের ফেরত দেন এবং তারা সেগুলো যিহূদায় ফিরে নিয়ে আসে (ইষ্রা ১:৬-১১), তবুও নিয়ম-সিন্দুক আর নেই এবং উপাসনা-ঘরের মহাপবিত্র স্থান খালি থাকবে।
৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদীরা যিহূদা দেশে ফিরে এসে তারা প্রথমেই যিরূশালেমে আগের স্থানে পুড়ানো উৎসর্গের ব্রোঞ্জ বেদী পুনরায় স্থাপন করে, উৎসর্গ পদ্ধতি পুনরায় চালু করে, বাৎসরিক পর্বগুলো পালন করতে শুরু করে এবং উপাসনা-ঘর পুনর্নির্মাণের জন্য ভিত্তি স্থাপন করে (ইষ্রা ৩:২-৭)। কিন্তু যিহূদায় বসবাসকারী অন্যান্য জাতি তাড়াতাড়ি তাদের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়: তারা ফিরে আসা যিহূদীদের হুমকি দেয়, তাদের কাজ থামানোর জন্য কর্মচারীদের ঘুষ দেয় এবং বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করে যেন যিহূদীরা উপাসনা-ঘর নির্মাণে ব্যর্থ হয় (ইষ্রা ৪:৪-৫)। যিহূদীরা নিরুৎসাহিত হয়ে উপাসনা-ঘর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয় এবং পরিবর্তে নিজের ঘর-বাড়ী তৈরি ও নিজের জীবন গঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রায় ১৬ বছর এভাবে পার হয়ে যায়।
কিন্তু ৫২০ খ্রীষ্টপূর্বে ঈশ্বর ভাববাদী হগয় ও সখরিয়কে আহ্বান করেন যেন তারা যিহূদীদেরকে উপাসনা-ঘর নির্মাণ পুনরায় চালিয়ে নিতে বলেন। নিচের ছকে হগয় ও সখরিয়ের বাণী, বাণীর তারিখ ও লোকদের সাড়া দেখানো হল:
হগয় তাই প্রায় ৪ মাস ধরে লোকদেরকে ঈশ্বরের বাণী দেন এবং তাদের উপাসনা-ঘর পুনরায় নির্মাণ করতে উৎসাহিত করেন। নির্মাণ সমাপ্ত করতে প্রায় ৪ বছর লাগে।
হয়গয়ের প্রথম বাণী হল ১ম মাসের ১ম দিনে, অর্থাৎ সেই দিন যখন মাসিক পুড়ানো উৎসর্গ দেওয়া হয় (গণনা ২৮:১১)। সম্ভবত কিছু যিহূদীরা এই ছোট পর্ব পালনের জন্য যিরূশালেমে উপস্থিত হয়েছিল এবং হগয় তাদেরকে ঈশ্বরের বাণী দেন। বেদী আছে কিন্তু উপসনা-ঘর নেই, তা অবশ্যই লোকদের চোখে খারাপ লাগার বিষয় ছিল।
সারাংশ করে নিরাশিত যিহূদীদের কাছে হগয়ের কথা এই:
- হগয় ১:১-১২ ধমক: নির্মাণের কাজ পুনরায় শুরু কর! হগয় ১:১১ ”বৃষ্টি না পড়বার আদেশ দিয়েছিলাম”
- হগয় ১:১৩-১৫ উৎসাহ: লোকদের বাধ্যতা দেখে হগয় ২:৭ “আমি এই ঘর পূর্ণ করব”
- হগয় ২:১০-১৯ প্রতিজ্ঞা: এই দিন থেকেই ঈশ্বরের আশীর্বাদ হগয় ২:১৯ “আমি তোমাদের আশীর্বাদ করব”
- হগয় ২:২০ সরুব্বাবিল সীলমোহরের আংটির মত হগয় ২:২৩ “আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি”
হগয়ের প্রথম বাণী হগয় ১:১-১২
৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদীরা যখন বাবিল ত্যাগ করে যিহূদা ও যিরূশালেমে ফিরে আসে তখন শাসনকর্তা সরুব্বাবিল (যিহূদার রাজা যিহোয়াখীনের নাতী) এবং মহাপুরোহিত যিহোশূয়ের নেতৃত্বে তারা প্রথমেই পুড়ানো উৎসর্গের ব্রোঞ্জের বেদী পুনরায় তৈরি করে এবং উপাসনা-ঘর নির্মাণের জন্য ভিত্তি স্থাপন করে। তারা এরস কাঠের ব্যবস্থা করে এবং কাঠ মিস্ত্রীদের কাজে লাগান (ইষ্রা ৩:৭)। কিন্তু যখন স্থানীয় লোকেরা বিভিন্নভাবে বিরোধিতা ও আপত্তি করতে শুরু করে, কাজটি বন্ধ হয়ে যায় এবং এভাবে ১৬ বছর পার হয়ে যায়।
৫২০ খ্রীষ্টপূর্বে হগয় ঈশ্বরের আদেশে ঠিক এই একই নেতাদের কাছে কথা বলেন এবং সাথে সাধারণ লোকদেরকেও চ্যালেঞ্জ করেন, যারা আগের ব্যর্থতার কারণে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছিল এবং নিজের ঘর-বাড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল: “এটা কি ঠিক হচ্ছে যে, তোমরা নিজেরা কারুকাজ করা বাড়ীতে থাকছ আর আমার ঘরটা ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে আছে?” (হগয় ১:৪)। হগয় এখানে পার্থক্য দেখান: সদাপ্রভুর উপাসনা-ঘর ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে আছে, কিন্তু তাদের বাড়ীতে “কারুকাজ” পাওয়া যায়। “কারুকাজ” বলতে হগয় এখানে ইব্রীয় ভাষায় যে শব্দটি ব্যবহার করেন, সেই শব্দটি রাজাবলি পুস্তকে শলোমনের উপসনা-ঘরের বর্ণনায়ও ব্যবহৃত (১ রাজা ৬:৯, ৭:৩,৭) এবং যিরমিয় পুস্তকে (যিরমিয় ২২:১৪) রাজা যিহোয়াকীমের বিলাসিতার বাড়ির বর্ণনায়ও পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর দাবি করেন না যে, তাদের ঘরের উপরে ছাদ না থাকা অবস্থায় উপাসনা-ঘর তৈরি করতে হবে। কিন্তু তিনি তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা নিজের ঘর-বাড়ির ক্ষেত্রে বিলাসিতার ব্যবস্থায় ব্যস্ত হওয়ার আগেই উপাসনা-ঘর নির্মাণে গুরুত্ব দেয়। হয়তো কিছু যিহূদীরা যে কাঠ উপাসনা-ঘরের জন্য আনা হয়েছিল, তা নিজেদের বাড়ির জন্য ব্যবহার করেছিল, কিন্তু তা নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায় না।
হগয় তাদেরকে আদেশ দেন: “এবার তোমরা পাহাড়ে উঠে কাঠ নিয়ে এসে উপাসনা-ঘর তৈরী কর, যাতে আমি খুশী ও সম্মানিত হই” (হগয় ১:৮)। এখানে শলোমনের নির্মাণ নিয়ে পার্থক্য দেখানো হয়: শলোমনের সময়ে সব কাঠ ছিল লেবানন দেশ থেকে আনা দামী এরস কাঠ। কিন্তু হগয় তাদেরকে ‘এরস কাঠের জন্য অপেক্ষা না করতে’ বলেন বরং চারিদিকে পাহাড়ে যে কাঠ পাওয়া যায়, তা দিয়ে উপাসনা-ঘর নির্মাণ শুরু করতে বলৈন। ঈশ্বর সাধারণ কাঠেও সন্তুষ্ট হন এবং তিনি আরো বেশি তাদের বাধ্যতার মনোভাবে খুশি হন।
এছাড়া হগয় লোকদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা নিজেদের আর্থিক অবস্থা লক্ষ্য করে তা মোশির আইন-কানুন অনুসারে চুক্তির আলোতে (২য় বিবরণ ২৮:২২-৪০) পরীক্ষা করে দেখে: বৃষ্টির অভাব, সীমিত ফসল (হগয় ১:১০), খরা, ছাৎলা পড়া রোগ, শিলাবৃষ্টি (হগয় ১:১১, ২:১৭) এবং নিষ্ফল পরিশ্রম (হগয় ১:৫-৭)। হগয় মোট কথা বলেন যে, ঈশ্বরের ক্ষেত্রে যিহূদীদের অবহেলা এবং আগের যুগে তাদের পূর্বপুরুষদের চুক্তি ও আইন ভঙ্গ কাজের মধ্যে বেশ মিল আছে। তিনি ঘোষণা করেন যে, বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যা হল ঈশ্বরের অবিশ্বস্ততার কোন প্রমাণ নয়, বরং তাদেরই অবিশ্বস্ততার ফল। তাদের অর্ধেক হৃদয়ের কাজের জন্যই ঈশ্বর তাদের উপরে আইন-কানুনে বর্ণিত অভিশাপগুলো পাঠিয়েছেন। কষ্ট ও নিরাশায় যখন ভুগি প্রায়ই আমরা ঈশ্বরকে এর জন্য দোষ দেই, কিন্তু ঈশ্বর উৎসাহিত করে বলেন যে, সঠিক বিষয়ে প্রাধান্য দিলে এই কষ্ট ও হতাশা কেটে যাবে। যিহূদীদের মনোভাব প্রকৃতপক্ষে দায়ূদের মনোভাবের ঠিক বিপরীত। দায়ূদ নিজের সুন্দর ঘর-বাড়ি এবং ঈশ্বরের সরল তাম্বু দেখে তীব্র কষ্ট অনুভব করেন এবং আগ্রহের সঙ্গে পরিকল্পনা করেন যে, তিনি ঈশ্বরের জন্য চমৎকার একটি উপাসনা-ঘর তৈরি করবেন (২ শমূয়েল ৭:২)।
ঈশ্বর স্থানীয় লোকদের বিরোধিতা বা বাধা অস্বীকার করেন, তা নয় কিন্তু তিনি যিহূদীদের চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা ধৈর্য ধরে বিশ্বস্তভাবে লেগে থাকে এবং এভাবে ঈশ্বরের অদ্ভুত সাহায্যের অভিজ্ঞতা লাভ করতে সক্ষম হয়।
লোকদের সাড়া ও বাধ্যতা হগয় ১:১২-১৫
খুব কম ভাববাদী আছে যারা হগয়ের মত তাদের বাণীতে এত ভাল সাড়া পেয়েছেন: সাধারণ লোকেরা, শাসনকর্তা সরুব্বাবিল এবং মহাপুরোহিত যিহোশূয়ের নেতৃত্বে বাধ্য হয়ে অল্প কয়েক সপ্তার মধ্যে উপাসনা-ঘর নির্মাণ করতে শুরু করেন (হগয় ১:১২-১৫)। সাথে সাথে হগয় তাদের জন্য ঈশ্বর থেকে একটি উৎসাহের বাণী পান: “আমি সদাপ্রভু তোমাদের সংগে সংগে আছি” (হগয় ১:১৩)।
হগয়ের দ্বিতীয় বাণী হগয় ২:১-৯
যিহূদীরা যখন উপাসনা-ঘরের নির্মাণ কাজ শুরু করে তখন তারা তারপরেও হতাশাগ্রস্ত হয়ে যায়, বিশেষভাবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা, যারা শলোমনের চমৎকার উপাসনা-ঘর নির্বাসনের আগে অর্থাৎ ছোটবেলায় নিজের চোখে দেখেছিল (হগয় ২:৩)। ঈশ্বর তাদেরকে তিন বার বলেন যে আবেগই আসুক না কেন, যেন তারা “সাহস করে” ও “কাজ করে” (হগয় ২:৩-৪)। ঈশ্বর তাদেরকে নিশ্চয়তা দেন: “আমি সর্বক্ষমতার অধিকারী সদাপ্রভু তোমাদের সংগে সংগে আছি … আর আমার আত্মা এখনও তোমাদের মধ্যে আছেন” (হগয় ২:৪-৫)। ঐযুগে এবং আমাদের আধুনিক যুগেও সাহস করা প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে ‘সাহস’ আবেগ নয়, বরং সাহস হল একটি ক্রিয়া। সাহস না লাগলেও সাহস করা দরকার ও সাহস করা সম্ভব। আমাদের এই সরল বাধ্যতা (শক্তিশালী না হলেও বা সাহস না লাগলেও), এর উপরে তাঁর প্রতিজ্ঞা রয়েছে (যাকোব ১:২৫)।
ঈশ্বর বাধ্য যিহূদীদেরকে একটি অতি অদভুত প্রতিজ্ঞা দেন: “আমি সর্বক্ষমতার অধিকারী সদাপ্রভু বলছি যে, আর অল্পকাল পরে আমি আর একবার আকাশ, পৃথিবী, সাগর ও ভূমিকে নাড়া দেব। আমি সমস্ত জাতিদের নাড়া দেব আর তাতে তারা তাদের ধন-সম্পদ এখানে নিয়ে আসবে। তখন আমি এই ঘর জাঁকজমকে পূর্ণ করব। রূপাও আমার, সোনাও আমার। আগেকার ঘরের জাঁকজমকের চেয়ে এখনকার ঘরের জাঁকজমক আরও বেশী হবে। এই জায়গায় আমি মংগল নিয়ে আসব। আমি সর্বক্ষমতার অধিকারী সদাপ্রভু এই কথা বলছি” (হগয় ২:৬-৯)। ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা দেন: যে ছোট, সাধারণ উপাসনা-ঘর তারা তাদের দুর্বলতায় নির্মাণ করছে, তা একদিন শলোমনের চমৎকার উপাসনা-ঘরের চেয়ে জতিদের ধন-সম্পদ, জাঁকজমক ও মহিমায় ভরে যাবে! ঈশ্বর তাদেরকে নিজের কাজের বিষয়ে আরো বড় একটি দৃষ্টি দান করেন যেন তারা বুঝতে পারে যে, ঈশ্বরের মহাপরিকল্পনায় ও তাঁর বড় উদ্দেশ্যে তাদের এই বর্তমান বাধ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
এই প্রতিজ্ঞা কিভাবে পূর্ণ হয়? যখন মোশি সিনাই পাহাড়ে নতুন তৈরি মিলন তাম্বু উৎসর্গ করেন এবং যখন শলোমন তার চমৎকার উপাসনা-ঘর উৎসর্গ করেন উভয় দিনে ঈশ্বরের দৃশ্যমান উপস্থিতি সবার সামনে দেখা দিয়েছিল (যাত্রা ৪০:৩৪, ২ বংশা ৫:১৪)। হগয়ের সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে (ইষ্রা, নহিমিয়, হগয়, সখরিয়) একজনও বলেন নি যে, সরুব্বাবিলের এই দ্বিতীয় উপাসনা-ঘর যখন উৎসর্গ করা হয়, তখন ঈশ্বরের উপস্থিতি দৃশ্যমানভাবে দেখা দিয়েছিল। তাই সরুব্বাবিলের উপাসনা-ঘর কিভাবে জাঁকজমক বা ঈশ্বরের মহিমায় পূর্ণ হবে? জাতিরা তাদের ধন-সম্পদ উপাসনা-ঘরে নিয়ে আসবে, এই প্রতিজ্ঞা কিভাবে পূর্ণ হয়?
বলা যায় যে, এই প্রতিজ্ঞা তখন পূর্ণ হয়েছে যখন মাদিয়-পারস্যেরা এই উপাসনা-ঘরের জন্য টাকা দান করে (ইষ্রা ৬:৮-১২), অথবা যখন কয়েক শতাব্দীর পরে হেরোদ এই উপাসনা-ঘরকে সোনা দিয়ে আছাদিত করেন অথবা আরো বেশি যখন যীশু নিজেই এই উপাসনা-ঘরে পা দেন এবং এভাবে তা ‘ঈশ্বরের মহিমায় পূর্ণ’ হয়।
কিন্তু প্রতিজ্ঞাটি তার চেয়ে বড় কিছুও বুঝায়: যীশু শুধুমাত্র উপাসনা-ঘরে পা দেন, তা নয় বরং তিনি নিজেই হলেন সেই উপাসনা-ঘর যা ঈশ্বরের মহিমায় পূর্ণ (২ করিন্থীয় ৩:৯-১১), অর্থাৎ তিনিই হলেন সেই ঈশ্বর যিনি “আমাদের মধ্যে বাস করলেন” (যোহন ১:১৪), যিনি “আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন”, সেই “ইম্মানুয়েল” (যিশাইয় ৭:১৪, ৮:১০)। তিনিই তার মণ্ডলীকে নির্মাণ করেন, যাকে “ঈশ্বরের থাকবার ঘর” বলা হয় (১ করিন্থীয় ৩:১৭, ইফিষীয় ২:১১-১২, ইত্যাদি)। জাতিরা ধন-সম্পদ উপাসনা-ঘরে নিয়ে আসবে, তবে তা কি বুঝায়? প্রকৃতপক্ষে এই ধন-সম্পদ বলতে বিশ্বাসীদেরকে বুঝানো হয়, যারা সমস্ত জাতি থেকে যীশুর মধ্য দিয়ে পরিত্রাণ পেয়ে মণ্ডলীর অংশ হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী সব জাতির মণ্ডলী হলেন সেই জীবিত উপাসনা-ঘর, যা ঈশ্বরের মহিমায় পূর্ণ। “নাড়া দেওয়া” হগয়ের এই শব্দটি ইব্রীয় পুস্তকে পুনরায় তোলা হয় যখন তার লেখক ঈশ্বরের রাজ্যের বর্ণনায় বলেন “যে রাজ্যকে নাড়ানো যায় না” (ইব্রীয় ১২:২৬-২৯)। প্রকাশিত বাক্যেও হগয়ের রূপক ব্যভহার করে বলা হয় যে “আর সব জাতি সেই আলোতে চলাফেরা করবে। পৃথিবীর রাজারা তাঁদের জাঁকজমক নিয়ে সেই শহরে আসবেন” (প্রকাশিত ২১:২৩-২৪)।
এভাবে হগয় ঈশ্বরের অদ্বিতীয় মহাপরিকল্পনার একটি দৃষ্টি দেন, কিন্তু তার সময়ের জন্য এর প্রয়োগ হল যে, অল্প কিছু সংখ্যক যিহূদীরা বিশ্বাসে ও বাধ্যতায় ঈশ্বরের উদ্দেশ্য অনুসারে কষ্ট হলেও একটি উপসানা-ঘর নির্মাণ করে, যাতে জাঁকজমক নেই। সব যুগে ঠিক এমন: যারা সেই যুগে আছে তারা তাদের ছোট বাধ্যতার অর্থ ও গুরুত্ব সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারে না, কিন্তু ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি তাদের বাধ্যতা ও সাড়া তারাপরেও সেই মহাপরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
হগয়ের তৃতীয় বাণী হগয় ২:১০-১৯
হগয়ের প্রথম বাণীর প্রায় ৪ মাস পরে এবং নির্মাণ কাজ শুরু করার প্রায় ৩ মাস পরে ঈশ্বর হগয়কে আর একটি বাণী দেন। হতে পারে নির্মাণ কাজ এমন পর্যায়ে এসেছে যে ভিত্তির স্থাপন সমাপ্ত (হগয় ২:১৮)। একটি জিনিস কিভাবে শুচি অথবা অশুচি হয়ে যায়, হগয় পুরোহিতদের কাছ থেকে এই বিষয়ে জানতে চান। তারা লেবীয় পুস্তক অনুসারে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেন। ঈশ্বর এই বিষয় রূপকভাবে ব্যবহার করে বলেন: যেহেতু যিহূদীরা অশুচি, তাদের হাতের কাজ, অর্থাৎ তাদের দ্বারা নির্মিত উপাসনা-ঘরও প্রকৃতপক্ষে অশুচি।
কেন ঈশ্বর এ কথা বলেন? হয়তো প্রথম দিকের হতাশা কেটে গেল এবং এখন নির্মাণ নিয়ে একটি অহংকার সৃষ্টি হয়েছে। হয়তো ঈশ্বর তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, মানুষের সবচেয়ে ভাল প্রচেষ্টা তারপরেও প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের জন্য যোগ্য নয়, যে তারপরেও সব কিছু হল ঈশ্বরের দয়ার উপর নির্ভরশীল। হয়তো ঈশ্বর তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, বাহ্যিক বাধ্যতা যদিও ভাল (তারা আসলে নির্মাণ কাজ করছে) তা যথেষ্ট নয়, বরং অন্তরের বাধ্যতা আরো গুরুত্বপূর্ণ।
যা হোক, ঈশ্বর ঠিক পরেই তাদের বাধ্যতার জন্য একটি চমৎকার আশীর্বাদের প্রতিজ্ঞা দেন: “এখন থেকে তোমরা এই বিষয় নিয়ে ভাল করে চিন্তা কর … আজ থেকে আমি তোমাদের আশীর্বাদ করব ” (হগয় ২:১৫-১৯)। “আজ” হল ১৮ ডিসেম্বর ৫২০ খ্রীষ্টপূর্বে, এমন কাল যখন বৃষ্টি খুবই প্রয়োজন যেন পরবর্তী বছরের ফসলের জন্য ক্ষেত-খামার প্রস্তুত করা যায়। সম্ভবত বৃষ্টি দেখে তা প্রতিজ্ঞার বর্তমান চিহ্ন ছিল, এবং পরবর্তীতে ভাল ফসল ছিল প্রতিজ্ঞার পূর্ণতা।
হগয়ের চতুর্থ বাণী হগয় ২:২০-২৩
ঠিক একই দিনে ঈশ্বর আর একটি বাণী দিয়ে যিহূদীদের অন্তরে একটি লুকানো প্রশ্ন বা নিরাশা তুলে ধরে কথা বলেন: দায়ূদের রাজবংশের একজন রাজা কেন যিহূদীদের উপর রাজত্ব করেন না, যেমন ঈশ্বর ২ শমূয়েল ৭:১২-১৭ পদে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন? ঈশ্বর উত্তরে আর একটি “নাড়া” নিয়ে ভবিষদ্বাণী দেন। এবার তিনি সামরিক রূপক ব্যবহার করেন: “আমি আকাশ ও পৃথিবীকে নাড়া দেব। আমি বিভিন্ন জাতির রাজাদের সিংহাসন উল্টে ফেলব এবং তাদের ক্ষমতা ধ্বংস করে দেব। আমি রথ ও তার চালকদের উল্টে ফেলে দেব; ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ারেরা প্রত্যেকে তার ভাইয়ের তলোয়ারের ঘায়ে মারা পড়বে” (হগয় ২:২১-২২)। এই বাণী শুনে হয়তো শ্রোতাদের মোশির সময়ে সুফ সাগরে মিসরের সৈন্যের উপর ঈশ্বরের জয় মনে পড়বে (যাত্রা ১৪) অথবা মনে পড়বে দানিয়েলের দর্শন, যে স্বর্গ থেকে একটি পাথর মানবীয় সব সাম্রাজ্যগুলো ভেঙ্গে দেবে (দানিয়েল ২:৩৫,৪৪)।
সাথে ঈশ্বর যিহূদীদের নিরাশা ভাঙ্গার জন্য দায়ূদ বংশের সরুব্বাবিলকে একটি প্রতিজ্ঞা দেন: “আমি তোমাকে নিয়ে আমার সীলমোহরের আংটির মত করব, কারণ আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি” (হগয় ২:২৩)। সীলমোহর ছিল অধিকার বা রাজত্বের একটি চিহ্ন। সরুব্বাবিল, যিনি মাদিয়-পারস্যদের অধীনে একজন শাসনকর্তা মাত্র, এখানে তাকে সম্মান ও অধিকার দেওয়া হয়। এই বাণী শুনে শ্রোতাদের হয়তো দানিয়েলের একটি দর্শনও মনে পড়বে, যেখানে তিনি মনুষপুত্রের মত একজনকে দেখেন “সেই মনুষ্যপুত্রকে কর্তৃত্ব, সম্মান ও রাজত্ব করবার ক্ষমতা দেওয়া হল যেন সমস্ত জাতির, দেশের ও ভাষার লোকেরা তাঁর সেবা করে। তাঁর রাজত্ব চিরস্থায়ী; তা শেষ হবে না আর তাঁর রাজ্য কখনও ধ্বংস হবে না” (দানিয়েল ৭:১৪)। হগয়ের এই প্রতিজ্ঞায় সরুব্বাবিল মশীহ, অর্থাৎ যীশু সম্বন্ধীয় একটি চিহ্ন হিসাবে দাঁড়ান। যীশু হলেন দায়ূদের বংশধর, সরুব্বাবিলের মধ্য দিয়েই দায়ূদের বংশধর (মথি ১:১২)। যীশুরই হাতে সীলমোহর আছে, তার চুক্তি করার অধিকার আছে, তাঁর হাতে লোকদেরকে নিজের বলে দাবি করার ও উদ্ধার করার ক্ষমতা আছে।
যেমন আগের প্রতিজ্ঞা (উপাসনা ঘর জাঁকজমকে ভরে যাবে, হগয় ২:৬-৯), এই প্রতিজ্ঞাও ‘ঝুলন্ত অবস্থায়’ আছে, অর্থাৎ তা হগয় ও তার শ্রোতাদের সময়ে আক্ষরিভাবে পূর্ণ হয় না। দু’টি প্রতিজ্ঞা ভবিষ্যতে আরো বড় ও চমৎকার কিছু সম্বন্ধে কথা বলে। যদিও হগয়ের শ্রোতারা তা তাদের জীবনে আর পূর্ণ হতে দেখবে না তবুও তাদের এই বর্তমান বাধ্যতা ও ঈশ্বরের উপর নির্ভরতা ঈশ্বরের এই মহাপরিকল্পনায় একটি প্রয়োজনীয় অংশ।