অর্থনীতি ০৯ – ঋণ দেওয়া ও ঋণ নেওয়া

তোমার অভাবী প্রতিবেশীকে ধার বা ঋণ দাও

২য়  বিবরণ   ১৫:৭-৮  “তোমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভু যে দেশ তোমাদের দিতে যাচ্ছেন সেই দেশের কোন জায়গায় যদি তোমাদের ভাইদের মধ্যে কেউ গরীব থাকে, তবে তার উপর তোমাদের অন্তর কঠিন কোরো না, কিম্বা সেই গরীব ভাইয়ের জন্য তোমাদের হাত মুঠো করে রেখো না। তোমাদের হাত যেন খোলা থাকে; তার দরকার মত তাকে অবশ্যই ধার দেবে।”

 

প্রধান নীতি?

  • ধার বা ঋণ দাও যদি দরকার হয়!
  • ঋণ কোন মন্দ বিষয় নয় বা নিষেধ নয়।
  • তবুও ঋণ মন্দতায় পরিণত হতে পারে > আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশী > নির্ভরশীলতা > দাসত্ব বা বন্ধন।
  • কিন্তু সঠিক ভাবে ধার বা ঋণ দেওয়া যায়। তাছাড়া ঈশ্বর এই আদেশ দিতেন না। 

কিভাবে এটা সঠিক ভাবে করা যায় ?

  • এমনি সরাসরি টাকা দান করার আদেশ দেওয়া হয় নি বরং ঋণ বা দান দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
  • ‘যে চাইবে তাকেই দেওয়া’ নয়।
  • ‘ধার’ মানে টাকা ফেরতের জন্য পরিকল্পনা করা: অল্প টাকা নির্দিষ্ট সময়ে ধারাবাহিকভাবে শোধ করা। 

কোন ক্ষেত্রে বা কাকে আমার ঋণ বা ধার দেওয়া উচিত?

  • ‘গরীব ভাই’ বা ‘অভাবী প্রতিবেশী’ কে। এমন মানুষ যারা অভাবী, যাদের আসলেই কিছু প্রয়োজন।
  • ‘অভাবে পড়া’ বা ‘আকাঙ্ক্ষায় পড়া’ একই বিষয় নয়।
  • বিলাসিতার আকাঙ্ক্ষা বা দাবি মেটানোর জন্য ধার দেওয়ার আদেশ নাই।
  • উদাহরণ: ব্যাংকের ক্রেডিট বা ঋণের বিজ্ঞাপন > ‘নতুন মটর সাইকেল’ বা ‘নতুন গাড়ীর’ জন্য ঋণ > আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে > আকাঙ্ক্ষা মেটানোর জন্য ঋণ দেয় > লোকদের ঋণের বন্ধনে ফেলে। 
'ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে পারা হল উপহারস্বরূপ' ... না, তা হল বন্ধন!
উদাহরণ - 'এখুনি কেনা, পরে পরিশোধ!'

ঋণ বা ধার মানে কি?

  • এখন টাকা পাওয়া কিন্তু ধীরে ধীরে শোধ করা, আজকের খরচ ভবিষ্যতের উপরে ফেলা।
  • ঋণ নিলে আগামীতে আমার দৈনিক প্রয়োজনও মেটাতে হবে, ঋণ পরিশোধও করতে হবে।
  • তাই যদি একটা ঋণ আমার আয় বা উৎপাদন করার ক্ষমতা না বাড়ায়, তাহলে ঋণ না নিলে ভাল।
  • তাই ঋণ এমন হতে হবে যা উৎপাদনশীলতা বাড়াবে, যেমন সেলাই মেশিন বা রিক্সা কেনার জন্য ঋণ।
  • তা না হলে ঋণ মানে বন্ধন থেকে বন্ধনে পড়া।


কাকে ঋণ দিব ?

  • আমার ‘গরীব ভাই’ বা ‘অভাবী প্রতিবেশী’ কে। ভাই বা প্রতিবেশী মানে কে?
  • যাকে আমি চিনি, যার সাথে আমার সম্পর্ক আছে, যার বাস্তব প্রয়োজন আমি জানি।
  • এমন লোক যার সম্বন্ধে আমার জ্ঞান আছে ও কার সাথে আমার সম্পর্ক আছে।
  • তা দ্বারা ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে একটি সামাজিক চাপ বা দায়বদ্ধতা তৈরি হয়।
  • ভাল উদাহরণ: প্রতিবেশী কৃষক যার বাড়ী আগুনে পুড়ে গেছে – তাকে চিনি ও তার প্রয়োজন জানি।
  • খারাপ উদাহরণ: ভিখারি, আমি জানি না সে আসলে গরীব, কে তাকে চালায়, তাকে দেওয়া টাকা কে পায়।


ক্ষুদ্র ঋণ

  • আধুনিক ভাষায় আমরা এইটাকে ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ বা ‘মাইক্রো ক্রেডিট’ বলি।
  • ক্ষুদ্র ঋণ: পাঁচ জনের একটি ক্ষুদ্র দল গঠনের মাধ্যমে পরিচালিত একটি উৎপাদনশীল ঋণ ব্যবস্থা, যেখানে পরস্পর পরস্পরকে চিনে। 
  • ডাক্তার ইউনুস মাইক্রো ক্রেডিট চিন্তার জন্য নোবেল পেয়েছেন, কিন্তু তার এই ধারণা কোন নতুন ধারণা নয়, ৩৪০০ বছর আগে বাইবেলে তা পাওয়া যায়। ঈশ্বরের নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল :-)!
  • নীতিমালা: সত্য কখনই ‘নতুন’ নয় … সত্য যুগে যুগে কার্যকারী, তখন ও এখন সবসময় কার্যকারী।
 
কিছু ব্যবহারিক উদাহরণ

ফ্রিজ কিনতে চাই।

  • ধারণা করেন: নগদে কিনলে দাম ৩০০০০ টাকা।
  • ৪ মাসের মধ্যে পরিশোধ করলে ৩২,৯৬১ টাকা দিতে হবে (+১০%)।
  • ৯ মাসের মধ্যে পরিশোধ করলে ৩৫,১০০ টাকা দিতে হবে (+১৭%)।
  • আমার বর্তমান আয় অনুসারে ফ্রিজ কিনতে না পারলে, কিস্তিতে ফ্রিজ কেনার পর কি অতিরিক্ত খরচ (ভবিষ্যতের নিয়মিত মাসিক খরচ + অতীতের খরচ মানে ফ্রিজের আসল দাম + ফ্রিজের কিস্তির অতিরিক্ত ১৭%) বহন করতে পারব?


ব্যাংক বা কোনো সমিতি থেকে ১০০ টাকার ঋণ নিলাম।

  • সারে দশ মাসের মধ্যে ফেরত দিতে হবে এবং ১৫% বেশী দিতে হবে (১৫ টাকা), তাই তা বাৎসরিক ১৫% এর ঋণ।


গ্রামে সাধারণ ব্যক্তির কাছ থেকে ১০০ টাকার ঋণ নিলাম।

  • অনেক সমিতিতে মাসে ১০ টাকা সুদ দিতে হয়।
  • ১০০ টাকা নিলে এমন কি মাসে ২০ টাকা পর্যন্তও সুদ দিতে হয়, তাই বাৎসরিক তা ১২০-২৪০% ঋণ।
  • এই ধরণের ঋণ থেকে প্রায় আর মুক্ত হওয়া যায় না।
  • অনেক দেশে বাৎসরিক সুদ ১২% এর উপরে যাওয়া বেআইনি।
 
নিয়মিত  ঋণ মওকুফ

২য় বিবরণ ১৫:১-২  “প্রতি সপ্তম বছরের শেষে অন্যদের কাছ থেকে তোমাদের পাওনা সব মকুব করে দেবে। এই নিয়মের তা মকুব করতে হবে: প্রত্যেক ইস্রায়েলীয় পাওনাদার অন্য ইস্রায়েলীয়কে দেওয়া সব ঋণ মকুব করে দেবে। ঋণ মকুব করে দেবার জন্য সদাপ্রভু যে সময় ঠিক করে দিয়েছেন তা ঘোষণা করা হয়েছে বলে কোন ইস্রয়েলীয় ভাইয়ের কাছ থেকে ঋণ শোধের দাবি করা চলবে না।”

প্রধান নীতি?

  • নিয়মিত ঋণ মওকুফ হওয়া দরকার।
  • ঋণ বা ধার নিষেধ নয় কিন্তু সীমিত সময়ের জন্য মাত্র এই ঋণ। ঈশ্বরের আদেশ: সর্বোচ্চ ৭ বছর।

ঈশ্বর কি অর্জন করতে চান? এটা পালন করলে সমাজের জন্য কি হয়?

  • এমন কোন ঋণ নেই যার কোন সীমানা নেই।
  • কোন মানুষ ঋণের গভীর শিকলে আটকা পড়বে না, ঋণ থেকে ঋণে পড়বে না।

যদি শুধুমাত্র ৬ বছরের মধ্যে সব শোধ করতে হয় ফলে

  • ঋণের পরিমাণও সীমিত কারণ বড় ঋণ অল্প সময়ের মধ্যে শোধ করা অসম্ভব।
  • সীমিত সময়ের জন্য মাত্র একজন সঙ্কটে থাকে, স্থায়ী অধঃ:পতন বা সঙ্কট নয়।
  • অর্থনৈতিক ভগ্নদশা থেকে পুনরুদ্ধারের সুযোগ দেয়; নিয়মিত সুযোগ থাকে নতুন ভাবে শুরু করার জন্য।
  • ঋণ পরবর্তী প্রজন্মের উপর পড়ে না। > বাবা-মার ভুলের মূল্য সন্তানদের দিতে হয় না।
  • প্রত্যেক নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন সুযোগ থাকে। মা-বাবার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রজ্ঞা ছিল না, মানে এই না যে আমি এর চেয়ে ভাল করতে পারব না।
  • ঈশ্বর চান যেন নতুনভাবে শুরু করার জন্য একটা সুযোগ থাকে, খুব দ্রুত নয়, কিন্তু যুক্তিসঙ্গত সময় বা মোটামুটি সময়।
  • একজন অতীতের ব্যর্থতার জন্য সবসময় বন্দী নয়।
  • ঝুঁকি নেওয়ার জন্য উৎসাহ > ব্যবসার উদ্যোগ নিরাপত্তা বেষ্টনী
  • যীশুর টাইটেল ‘আলফা’ (প্রকাশিত ১:৮) তিনি হলেন ক্ষমার ঈশ্বর, নতুন শুরুর ঈশ্বর।  
 
ঈশ্বরের সামনে ঋণগ্রহীতার দায়বদ্ধতা এবং ঋণদাতার  সুরক্ষা
  • বিশ্বস্ত ভাবে ঋণ, বাঁকি ফেরত ও চুক্তি রক্ষা করার জন্য ঈশ্বর আদেশ দেন।
  • গীত ৩৭:২১       “দুষ্টেরা ধার করে শোধ দেয় না।”
  • হিতো ৩:২৮      “সাহায্য করবার ক্ষমতা তোমার হাতে থাকলে কাউকে বোলো না, “যাও, পরে এসো, কালকে করব।”
  • রোমীয় ১৩:৭    “যাঁর যা পাওনা তাঁকে তা দাও। যিনি কর্‌ আদায় করেন তাঁকে কর্‌ দাও; যিনি শুল্ক আদায় করেন তাঁকে শুল্ক দাও; যাঁকে শ্রদ্ধা করা উচিত তাঁকে শ্রদ্ধা কর; যাঁকে সম্মান করা উচিত তাঁকে সম্মান কর।”
  • ঋণ নিয়ে সাবধান থাকা দরকার কারণ আমার ভবিষ্যতে কি হবে তা আমি নিশ্চিত জানি না।
  • যাকোব ৪:১৩-১৪  “তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে থাকে, “আজ বা কাল আমরা অমুক শহরে গিয়ে এক বছর কাটাব এবং সেখানে ব্যবসা করে লাভ করব।” কিন্তু কালকে কি হবে তা তোমরা জান না। তোমাদের জীবনই বা কি? তোমরা তো বাষ্প মাত্র, যা কিছুক্ষণের জন্য থাকে আর তারপর মিলিয়ে যায়।”
 
ঋণদাতার  সুরক্ষা: জামিন বা বন্ধক
  • ঋণ কিছু বছরের পর মওকুফ হলে, মানুষেরা দায়িত্বহীনভাবে ঋণ নেওয়ার প্রলোভনে পড়বে না? তারা ঋণ নেয়, জিনিষ কিনে, পরে শোধ করতে অক্ষম, কিছু বছরের মধ্যে ঋণ মওকুফ।
  • এর উপর ঈশ্বর দুইভাবে সীমানা দেন:
    • ১। সামাজিক চাপ: দায়িত্বহীনভাবে টাকা ফেরত দিতে অক্ষম হলে একটি সামাজিক লজ্জার বিষয়, অবিশ্বাস তৈরি। প্রমাণিত অবিশ্বস্ত লোক হিসাবে পরবর্তী ঋণ লাগলে তা আর সহজে পাবে না।
    • ২। বন্ধক নেওয়ার পদ্ধতি: যদি কেউ ঋণ শোধ করতে অক্ষম হয় ঋণদাতার অধিকার আছে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে কোন জিনিষ বন্ধক হিসেবে নেওয়া (২য় বিবরণ ২৪:১০-১১)।
  • ঈশ্বর কিন্তু বন্ধকের জিনিষ নেওয়ার অধিকারের আবারও সীমিত রাখেন: কোন প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিষ স্থায়ীভাবে বন্ধক নেওয়া যাবে না, যেমন ব্যবহারের কাপড় বা যাঁতার উপরের পাঠ (২য় বিবরণ ২৪:৬, ১২-১৩)
    ঋণগ্রহীতার গৃহে ঋণদাতার ঢোকার অনুমতি নেই, অবশ্যই জিনিষ আনার ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার জন্য অপেক্ষা করতে হবে (২য় বিবরণ ২৪:৬, ১২-১৩)। ঈশ্বর ঋণগ্রহীতার মর্যাদা রক্ষা করেন। 
উদার ঋণদাতা এবং বিশ্বস্ত ঋণ গ্রহীতা 

২য়  বিবরণ  ১৫:৯-১০  “কিম্বা সেই গ সাবধান, তোমাদের মনে এই খারাপ চিন্তাকে আমল দিয়ো না যে, সপ্তম বছর অর্থাৎ ঋণ মকুবের বছর প্রায় এসে গেছে। এই চিন্তা করে তোমাদের সেই অভাবী ভাইয়ের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব নিয়ে তাকে খালি হাতে বিদায় কোরো না। যদি তা করতবে তা নিয়ে সে তোমাদের বিরুদ্ধে সদাপ্রভুর কাছে কাতর হয়ে বিচার চাইবে আর তোমরা অন্যায়ের জন্য দোষী হবে।'”

  • ঋণদাতাকে উদার হতে এবং ঋণগ্রহীতাকে বিশ্বস্ত হতে ঈশ্বর চ্যালেঞ্জ করেন।
  • ঈশ্বর ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার অধিকার রক্ষা করেন। 
দায়িত্বের মাত্রা

২য় বিবরণ  ১৫:৩  “ভিন্ন জাতির লোকদের কাছ থেকে ঋণ শোধের দাবি করা চলবে, কিন্তু তোমাদের ভাইদের ঋণ তোমাদের মকুব করে দিতে হবে।”

ঈশ্বরের অনেক আইন বিদেশীদের সুরক্ষা করতে বলে, এখানে কেন বিদেশীর মওকুফ পাওয়ার অধিকার নেই?

  • ঈশ্বরকে অন্যায্য বুঝাতে বাইবেল ব্যাখ্যা করবেন না; তিনি অন্যায্য নন; তাহলে কেন এই আইন?
  • বিদেশীদের নিজেদের জমি থাকে না > অর্থনৈতিকভাবে ও সমাজে তারা দুর্বল > ঋণ প্রয়োজন হতে পারে
  • বিদেশীকে ঋণ দিলে সমস্যা কি? বিদেশীরা উধাও হয়ে যেতে পারে > টাকা ফেরত পাওয়ার নিরাপত্তা কম > তাদের ঋণ দিতে অনিচ্ছা > ঋণ সহজেই পেতে পারে না।
  • হতে পারে ঈশ্বর নিশ্চিত করতে চান বিদেশীদেরও সুযোগ থাকে প্রয়োজন পড়লে ঋণ পাওয়া।

 

এখানে প্রতিবেশীর কাছে বা বিদেশীর কাছে আমার দায়িত্ব ভিন্ন। সব লোকদের প্রতি আমার দায়িত্ব কি একই নয়? কেন ঈশ্বর এখানে পার্থক্য করেন?

  • সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করা যায় না। যদি আমি সব লোকদের জন্য দায়িত্ব নিই, শেষে দেখা যাবে আমি কারও দায়িত্ব পালন করতে পারছি না।
  • এটা অতি ভারী বোঝা হত। আসলে এটা অসম্ভব, তাই ঈশ্বর এই ধরণের আদেশ দেন না। তিনি বাস্তব ভাবে দেখেন।
  • কিন্তু কিছু লোকের জন্য আমার আসলেই দায়িত্ব আছে। তাই ২য় বিবরণ ১৫:৩ পদ থেকে বুঝা যায় যে দায়িত্বের মাত্রা আছে। এ বিষয়ে আরো গভীরে বর্ণনা আছে “পরিবার ১৪ – অর্থনৈতিক দায়িত্ব”

 

আংশিক সারাংশ: আমার দায়িত্ব

  1. প্রথমত, নিজের স্বামী বা স্ত্রী, নিজের সন্তানের প্রতি।
  2. পরে অভাবী বাবা-মার প্রতি।
  3. পরে প্রতিবেশী, গ্রামের বা সমাজের লোকের প্রতি।
  4. পরে বিদেশীর প্রতি।