পরিবার ০১ – পরিবারের ভিত্তির বিষয়ে আদিপুস্তকের শিক্ষা
আদি ১:২৬-২৭ মানুষকে সৃষ্টি
‘তারপর ঈশ্বর বললেন, “আমরা আমাদের মত করে এবং আমাদের সংগে মিল রেখে এখন মানুষ তৈরী করি। তারা সমুদ্রের মাছ, আকাশের পাখী, পশু, বুকে-হাঁটা প্রাণী এবং সমস্ত পৃথিবীর উপর রাজত্ব করুক।” ২৭ পরে ঈশ্বর তাঁর মত করেই মানুষ সৃষ্টি করলেন। হ্যাঁ, তিনি তাঁর মত করেই মানুষ সৃষ্টি করলেন, সৃষ্টি করলেন পুরুষ ও স্ত্রীলোক করে।’
- ‘আমরা আমাদের মত…’ ত্রিত্ব ঈশ্বরের (পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার) মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। ত্রিত্ব ঈশ্বর হলেন প্রথম পবিবার, প্রথম ‘সমাজ’। এটি হল একটি অপরিহার্য সত্য।
- ঈশ্বর নিজেই সম্পর্ক, মানুষ, লিঙ্গ, বিবাহ, যৌনতা, পরিবার, বসবাসের জায়গা, সম্প্রদায় ইত্যাদি সৃষ্টি করেছেন। তিনি এই সবগুলি চেয়েছেন। তিনি এইগুলির আকৃতি দিয়েছেন ও সৃষ্টি করেছেন। এইগুলি সব ভাল ও অনুমোদিত। এইগুলি সব ঈশ্বরকে প্রকাশ করে। ত্রিত্ব ঈশ্বর নিজেই হলেন সম্পর্কের জন্য মানদণ্ড এবং সত্যিকারের আদর্শ।
- ঈশ্বর ও মানুষ: ঈশ্বর মানুষ ‘তাঁর প্রতিমূর্তিতে’ বা ‘তাঁর সাথে মিল রেখে’ সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বরের সমস্ত সৃষ্টি (তাঁর হাতের কাজ হিসাবে) ঈশ্বরকে বা কর্তাকে প্রকাশিত করে কিন্তু মাত্র মানুষ ‘তাঁর’ প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষই অনেক উন্নত বৈশিষ্টের অধিকারী: ঈশ্বর যেমন ব্যক্তি, মানুষও ব্যক্তি। ঈশ্বরের যেমন আত্ম-সচেতনতা, মন, চিন্তা করার ক্ষমতা, আবেগ, ইচ্ছা শক্তি ও সিদ্ধান্ত নেওয়া ক্ষমতা আছে, মানুষেরও তাই রয়েছে। যদিও ঈশ্বরের সৃষ্টি নেই এবং তিনি সব ক্ষেত্রে অসীম (সর্বক্ষমতাশালী, সর্বজান্তা, সর্বত্র বিরাজমান, ইত্যাদি), তবুও মানুষেরও সীমিত ক্ষমতা আছে ও মানুষ ঈশ্বরের মত ব্যক্তি।
- মানুষ ও জীবজন্তু: যদিও মানুষ ও জীবজন্তু উভয় ঈশ্বরের সৃষ্টি, ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে জীবন পায়, তবুও মানুষ ও জীবজন্তুর মূল্য আলাদা এবং ঈশ্বর তাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন মানদণ্ড রাখেন: একজন মানুষকে মেরে ফেলা হল পাপ, একটি পশুকে মেরে ফেলা পাপ নয় (আদি ৯:১-৫)। ঈশ্বর মানুষকে তার নিজের আচরণের জন্য দায়বদ্ধ করেন, কিন্তু জীবজন্তুদের নৈতিকতা, দায়বদ্ধতা বা দোষ বলতে কিছু নেই।
- লিঙ্গ: পুরুষ ও মহিলা উভয়ই ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি। উভয় লিঙ্গ ঈশ্বরকে প্রকাশিত করে এবং দুই লিঙ্গের সুসম্পর্কে ঈশ্বর প্রকাশিত হন। পুরুষ-মহিলার সুসম্পর্কে ত্রিত্ব ঈশ্বর প্রকাশিত হন।
- আদি ১:২৭ পদ হল ছোট একটি ইব্রীয় কবিতা, যাতে সাধারণের মত দুইটি সমান্তরাল লাইনের চেয়ে তিনটি সমান্তরাল লাইন আছে: ১ ঈশ্বর তাঁর মত করেই মানুষ সৃষ্টি করলেন ২ হ্যাঁ, তিনি তাঁর মত করেই মানুষ সৃষ্টি করলেন ৩ সৃষ্টি করলেন পুরুষ ও স্ত্রীলোক করে।
- এই পদ হল কবিতা (পদ্য), তা দেখায় ঈশ্বরের কত আনন্দ আছে যখন তিনি দুই লিঙ্গ সৃষ্টি করেন, তা হল অতি চমৎকার, সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ! তাই শুনুন, অবাক হন, তা উপভোগ করুন!
- পুরুষ ঈশ্বরের সঙ্গে মিল রেখে সৃষ্টি করা হয়েছে। মহিলা ঈশ্বরের সঙ্গে মিল রেখে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাতে প্রশ্ন উঠে: ঈশ্বরের লিঙ্গ আছে কিনা? ঈশ্বরের কি লিঙ্গ আছে? ঈশ্বর কি পুরুষ? দুইটা উত্তর দেওয়া যায়:
- ১। কেউ কেউ বলেন: ঈশ্বর পুরুষ। কেন? কারণ তাকে বাইবেলে ‘স্বন্গস্থ পিতা’ বলা হয়। যীশু যখন মানুষ হিসাবে জন্ম নেন তিনি পুরুষ হিসাবে তা করেন। বাইবেলে ঈশ্বর সম্বন্ধীয় নানা রূপক আছে যা পুরুষ জাতীয়, যেমন: ‘পিতা’, ‘পুত্র’, ‘বীরযোদ্ধা’, ‘রাজা’, সেনাবাহিনীগণের ঈশ্বর ইত্যাদি।
- ২। কেউ কেউ বলেন: ঈশ্বর লিঙ্গের ঊর্দ্ধে। ঈশ্বর লিঙ্গের বাইরে। ঈশ্বর লিঙ্গের চেয়ে বড়। তাঁর দুইয়ের মধ্যে একটি লিঙ্গ আছে, এমন নয়। ঈশ্বর দুই লিঙ্গের সৃষ্টিকর্তা এবং দুই লিঙ্গেই তাঁর প্রকাশ করে। দুই লিঙ্গই ‘তাঁর মত’। অবশ্যই বাইবেলে ঈশ্বর সম্বন্ধীয় রূপক পুরুষ জাতীয়গুলি বেশি, কিন্তু মহিলা জাতীয় রূপকও আছে, যেমন তিনি ‘জীবনদাতা’, তিনি ‘জাতিদের জন্ম দেবেন’ (যিশাইয় ৬৬:৮-৯), বিশ্বাসীদের ‘জন্ম দেওয়া’ (গালা ৪:১৯)’, তিনি ‘সন্তানদের সান্ত্বনাদাতা মায়ের মত’, তিনি ‘সন্তানদের দুধ খাইয়ে কোলে করে নেওয়া ও হাঁটুর উপর নাচানোর’ মত ঈশ্বর (যিশাইয় ৬৬:১২-১৩), তিনি ‘মুরগী যেমন তার ডানার নীচে বাচ্চাগুলো জড়ো করার’ মত ঈশ্বর (মথি ২৩:৩৭, লূক ১৩:৩৪)।
- ঈশ্বর পরিবারকে কোন উদ্দেশ্যে স্থাপন করেছেন? > পরিবারের এক নম্বর উদ্দেশ্য হল যেন মানুষ ঘনিষ্ট সম্পর্কে থাকে। সম্পর্কের জন্যই ঈশ্বর পরিবার সৃষ্টি করেছেন। নিজেকে সম্পর্কের ঈশ্বর হিসাবে প্রকাশিত করার জন্য তিনি পরিবারকে সৃষ্টি করেছেন। যেন মানুষ ভালবাসা, উৎসাহ, সমর্থন, দয়া, মঙ্গল, বড় মন, যুক্ত ও অংশভুক্ত হওয়া ও উন্নয়ণ উপভোগ করতে পারে, তার জন্য ঈশ্বর পরিবারকে স্থাপন করেছেন। একজন মানুষ সম্পূর্ণ একা থাকলে, তার তারপরেও ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক থাকত। কিন্তু ঈশ্বর চান যেন তা ছাড়া মানুষ মানুষের সাথেও সম্পর্ক উপভোগ করতে পারে। তাতে আবারও ঈশ্বরের বড় মন ও দয়া প্রকাশিত।
- আদি ১-২ অধ্যায় দেখতে পাই যে ঈশ্বর ব্যক্তি ও পরিবার উভয় সৃষ্টি করেন। স্বয়ং ব্যক্তি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ, পরিবারে থাকাও গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বর উভয়টা চেয়েছেন, উভয়টাকে গুরুত্ব দেন, উভয়কে তিনি অধিকার ও অন্যের জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন। ব্যক্তি ও পরিবারের মধ্যে ঈশ্বর ভারসাম্য স্থাপন করেন। ব্যক্তি দ্বারাই সম্পর্ক তৈরি হয়, কিন্তু মানুষ এমন ব্যক্তি যা সম্পর্ক ছাড়া টিকতে পারে না। ত্রিত্ব ঈশ্বরের মধ্যে আমরা সে একই ভারসাম্য দেখি: তিনজনই ব্যক্তি এবং স্বয়ং ঈশ্বর কিন্তু একতায় ও সুসম্পর্কে।
- অপরপক্ষে এক ঈশ্বরবাদী ধর্ম বলে যে ঈশ্বরের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই যেহেতু ঈশ্বর শুধুমাত্র একজনই। সেহেতু এক ঈশ্বরবাদী ধর্মে সম্পর্কের গুরুত্ব অন্যরকম, ভিন্নতা বা বৈচিত্র্যেরও গুরুত্ব কম। আদি ১ অধ্যায় হল ভিন্নতা বা বৈচিত্র্যের একটি উৎযাপন: ঈশ্বর ভিন্নতা চেয়েছেন ও সৃষ্টি বা নকশা করেছেন। ভিন্নতা ত্রিত্ব ঈশ্বরের মধ্যেই উপস্থিত ও তা মানুষের সুসম্পর্কে ও বিশেষভাবে বিবাহে প্রকাশ পায়। এবং তাই হল ‘খুব চমৎকার’ (আদি ১:৩১)।
আদি ১:২৮ সংখ্যা বাড়িয়ে পৃথিবী ভরে তোলো! রাজত্ব কর!
‘ঈশ্বর তাঁদের আশীর্বাদ করে বললেন, ‘তোমরা বংশবৃদ্ধির ক্ষমতায় পূর্ণ হও, আর নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে পৃথিবী ভরে তোলো এবং পৃথিবীকে নিজেদের শাসনের অধীনে আন। এছাড়া তোমরা সমুদ্রের মাছ, আকাশের পাখী এবং মাটির উপর ঘুরে বেড়ানো প্রত্যেকটি জীবন্ত প্রাণীর উপরে রাজত্ব কর।’
- ঈশ্বরই যোগাযোগ করেন: ‘ঈশ্বর তাদের বললেন’। ঈশ্বর সম্পর্ক চান, যোগাযোগ করতে চান, নিজেকে প্রকাশ করতে চান ও নিজের সম্বন্ধে শেয়ার করতে চান।
- এখানে মানুষকে (উভয় পুরুষ ও মহিলাকে একসাথে) রাজত্ব করার অধিকার, একটি ভূমিকা, জীবজন্তুদের উপরে নেতৃত্ব ও দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। গীত ১১৫:১৬ পদে একই বিষয় এভাবে প্রকাশিত: ‘স্বর্গ হল সদাপ্রভুরই স্বর্গ, কিন্তু পৃথিবীটা তিনি মানুষকে দিয়েছেন।’
- রাজত্ব করার অধিকার, নেতৃত্ব, দেখাশোনার দায়িত্ব বা ক্ষমতা মানে কি? তা জানতে চাইলে ঈশ্বরের দিকে তাকাতে হয় যিনি সর্বোচ্চ অধিকারী, নেতা ও দেখাশোনাকারী।
- তাঁর রাজত্বের ধরণ কেমন? > তাঁর ক্ষমতা সৃজনশীল ও জীবনদায়ী। তাঁর ক্ষমতা হল সুশৃঙ্খল এবং এমন ক্ষমতা যা সুশৃঙ্খলা, স্বনিয়ন্ত্রণ, সৌন্দর্য্য, কার্যকারীতা ও সফলতা তৈরি করে। তাঁর ক্ষমতা দানশীল, দয়ালু, যোগানদায়ী এবং উদ্ধারকারী (আদম হবার পাপে পতনের পরে তা দেখা যায়)। ঈশ্বরের ক্ষমতা বা রাজত্ব করার ধরণ এমনই। এটাই মানুষের রাজত্বের জন্য আদর্শ মাণদণ্ড।
- ঈশ্বর মানুষকে জীবন দান করেন, অস্তিত্ব দেন, লিঙ্গ ও সম্পর্ক স্থাপন করেন, যোগান ও আশীর্বাদ করেন এবং রাজত্ব করার অধিকার বা উন্নয়ন করার ভূমিকা দান করেন। এতে ঈশ্বরের সীমাহীন উদারতা এবং মঙ্গলময়তা প্রকাশ পায়।
- মানুষকে ফলবান হওয়ার ও নিজের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলার আদেশ দেওয়া হয়। তাদের বলা হয় যেন তারা নিজের পাশাপাশি নতুন কিছু সৃষ্টি করে (যেমন ঈশ্বর করেছেন) এবং যেন তারা রৈখিকভাবে না বরং গানিতিক হারে বৃদ্ধি পায়।
- বৃদ্ধি, সংখ্যা বাড়িয়ে তোলা, দেখাশোনা, ভিন্নতা তৈরি, উন্নয়ণ ও পরবর্তী প্রজন্মকে দান করার উদ্যোগ, এইগুলি ঈশ্বর আদেশ দেন বা দাবী করেন। তা করতে গেলে আইন, সম্মতি, চুক্তি, সরকার, বিজ্ঞান, পরিশ্রম ইত্যাদি অবশ্যই লাগবে। এইগুলি সব অনাহূত বা মন্দ নয়, বরং ঈশ্বর দ্বারা অনুমোদিত। সেগুলি শুধুমাত্র ‘পাপের কারণে লাগে’ তা নয়, বরং মানুষ যদি পাপ নাও করত, তারপরেও সেগুলি লাগত। সেগুলি হল ঈশ্বরের পরিকল্পনার একটি অংশ, একটি সুযোগ, চ্যালেঞ্জ, উন্নয়নের পদ্ধতি ও আশীর্বাদ।

- ঈশ্বর আমাদের বৃদ্ধি পেতে বলেন এবং বৃদ্ধির জন্য যা প্রয়োজন, তাও যুগিয়ে দেন।
- প্রজননের নীতি: আমি যা, আমি তাই জন্ম দেব। যদি ভাল হই, ভালকে জন্ম দেব। যদি খারাপ হই খারাপকে জন্ম দেব। বিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুসারে ‘জীবিত’ হলে কয়েকটি বিষয় দেখা যায়। যেমন একটি হল: প্রজনন।
- ঈশ্বর এখানে আদেশ দিয়েছেন যেন মানুষ সৃষ্টির উপরে রাজত্ব করে, একে অপরের উপর নয়। মানুষদের মধ্যে উচুঁ নীচু ও ছোট বড় থাকবে বা মানুষ অন্যের উপর রাজত্ব করবে, তা বলা হয় নি। ইতিহাসে পরে ঈশ্বর বললেন যে একজন রাজা বা শক্তিশালী নেতা না রাখা ভাল (১ শমূয়েল ৮) এবং যখন ইস্রায়েল তারপরেও রাজা দাবী করে, ঈশ্বর আদেশ দেন যে রাজা যেন নিজেকে অন্যদের চেয়ে বড় হিসেবে না দেখেন (দ্বিতীয় বিবরণ ১৭:২০)। ঈশ্বর উচুঁ নীচু পদ্ধতি, বড় ছোট মর্যাদা বা নিয়ন্ত্রণের অনুক্রম স্থাপন করেন না, যদিও তিনি কিছু লোকদেরকে নেতা হিসাবে স্থাপন করেন। তা ছাড়া যীশু খুব পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেন নেতৃত্ব মানে কি: একে অপরের উপর কর্তৃত্ব নয় বরং সকলের সেবা করা (মথি ২০:২৫-২৭)। পৌল বলেন: ‘মনিবের মত করে আমরা যে তোমাদের বিশ্বাসের উপর হাত দিচ্ছি তা নয়, বরং তোমরা যেন আনন্দ পাও সেইজন্যই তোমাদের সংগে কাজ করছি, কারণ বিশ্বাসে তোমরা শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছ’ (২ করিন্থীয় ১:২৪)।
- ‘পৃথিবী ভরে তোলো’ এই আদেশের মধ্যে অন্তরভুক্ত আছে: ছড়িযে পড়া, জন্ম দান করা, সংখ্যা বাড়িয়ে তোলা, ভূমির অধিকারী হওয়া, নতুন জায়গায় যাওয়া, ঝুঁকি নেওয়া, আবিষ্কার করা, বাঁচতে শেখা, মানিয়ে নেওয়া, উন্নয়ন করা, নিজেই কিছু করা, কোনো কিছু বশে আনা, লালন পালন করা ইত্যাদি। ঈশ্বর মানুষকে একটি বড় ধরণের, বহুমুখী ও সম্মানের কাজে আহবান করেছেন।
- এই সব কাজ করা পুরুষ ও মহিলা দু’জনেরই আহবান ও দায়িত্ব এবং এই কাজের জন্য দু’জনেরই দরকার আছে।
- অনেকে বিয়েকে এরকম একটি রূপকের সাথে তুলনা করেন: পুরুষ হলেন বীজ বপনকারী বা মালী এবং মহিলা হল ভূমি বা বাগান। এই রূপককে একসাথে আহবানের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় না বরং বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় যৌনতা ও প্রজনন বজায় রাখার উপরে। একসাথে নেতৃত্ব, এক উদ্দেশ্যে কাজ, সহভাগিতা ও মিলের চেয়ে এখানে লিঙ্গের পার্থক্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই রূপকে নেতৃত্ব ও কাজের ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর সহকর্মী হিসাবে প্রকাশ করে না; একসাথে সিদ্ধান্ত, দায়িত্ব ভার, দৈনিক কাজ ও আবেগীয় একতার তেমন দাবী নেই। কিন্তু আদি ১:২৮ পদে এই রূপকের চেয়ে সম্পূর্ণ অন্য একটি ছবি দেখতে পাই।
- এই রূপকের আর একটি সমস্যা হল: একজন মালীর কয়েকটি বাগানও থাকতে পারে, অর্থাৎ একজন পুরুষের কয়েকটি স্ত্রী থাকতে পারে। আবার এমন কি মালী চাইলে যদি বাগানে ফল না ধরে, তবে বাগানটি বাদ দিতে পারেন, অর্থাৎ যদি স্ত্রীর সন্তান না হয়, তবে তাকে তালাক দেওয়া যাবে। আদিপুস্তকে বিয়ে নিয়ে ঈশ্বরের চিন্তা এর থেকে অনেক উত্তম!
- এই অধ্যায়ে ঈশ্বরের মূল্যায়ন হচ্ছে: ‘চমৎকার’, ‘চমৎকার’, ‘চমৎকার’, এবং এখন ‘খুব চমৎকার’। ঈশ্বর নিজের হাতের কাজকে মূল্যায়ণ করেন এবং তাতে আনন্দ পান। ঈশ্বর এই বস্তু জগত সৃষ্টি করেছেন, তা
নিয়ে তাঁর কোনো লজ্জা নেই, অজুহাত নেই, দুশ্চিন্তাও নেই। বরং তা নিয়ে তাঁর বড় আনন্দ ও গর্ব। - এখানে মানুষকে ‘বাধ্য’ বলা যায়, এবং শুধুমাত্র পরে, আদি ৩:৬ পদ থেকে তারা ‘অবাধ্য’ হয়ে যায়। তা অবশ্যই ঠিক, কিন্তু অনেক বার ‘বাধ্যতা’ শব্দ আমাদের মনে নেতিবাচক চিন্তা সৃষ্টি করে।
- কিন্তু বাস্তবে তাদের জন্য ‘বাধ্য হওয়া’ মানে কি? মানে রাজত্ব করা, সংখ্যা বাড়িয়ে তোলা, পৃথিবীকে ভরানো, খুশি মত (একটা বাদে) সব গাছ থেকে খাওয়া (আদি ২:১৬)। বাধ্যতা যে কষ্টের কাজ, ত্যাগ-স্বীকার মাত্র, একঘেয়েমি কিছু, তা নয়! বাধ্যতা হল ঈশ্বর যা হিসাবে তাদের সৃষ্টি করেছেন, তা হিসাবে জীবন-যাপন করা: সম্মানিত ব্যক্তি, অধিকারী ও নেতা, ঈশ্বরের বিশেষ সৃষ্টি ও তাঁর সঙ্গে সহভাগিতার লোক।
- উদাহরণ: আমি গাড়ীতে গ্যাস নিচ্ছি। গাড়ীর ম্যানুয়ালে লেখা আছে যে গাড়ী শুধুমাত্র গ্যাস দিয়ে চলবে, তাই গ্যাস ভরতে হয়। তা অনুসারে করছি। কেন তা করছি? কারণ আমি কি গাড়ীর নির্মাতার দাস? না আমি কি গাড়ীর নির্মাতার শাস্তিকে ভয় পাই? না, আমি দাসও নই, শাস্তিকেও ভয় পাই না। বরং আমি জানি, গাড়ীটি এভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং তা শুধুমাত্র গ্যাসে চলবে। আর তাই আমি ইচ্ছুক মনে ও ভাল বুঝে তার বাধ্য হচ্ছি। ইচ্ছুক মনে ও নীতির মঙ্গলময়তা বুঝে বাধ্য হওয়াকেই ঈশ্বর চান।
আদি ২:৪খ-৭ আদমকে তৈরি (আদম=বহুবচন)
‘সদাপ্রভু ঈশ্বর যখন মহাকাশ ও পৃথিবী তৈরী করেছিলেন…৭ পরে সদাপ্রভু ঈশ্বর মাটি দিয়ে একটি পুরুষ মানুষ তৈরী করলেন এবং তার নাকে ফুঁ দিয়ে তার ভিতরে জীবন-বায়ু ঢুকিয়ে দিলেন। তাতে সেই মানুষ একটি জীবন্ত প্রাণী হল।’ আর সদাপ্রভু ঈশ্বর মৃত্তিকার ধূলিতে আদমকে (অর্থাৎ মনুষ্যকে) নির্মাণ করিলেন
- কেন এখানে দ্বিতীয় বার সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে? কারণ এখানে মানুষের সৃষ্টি নিয়ে (যেহেতু শুধুমাত্র মানুষকে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাই মানুষ বিশেষ) আরো বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়।
- এখানে ‘সাধারণ অনুবাদ’ একটু দুর্বল: ইব্রীয়তে ‘পুরুষ মানুষ’ এভাবে কোনো কথা নেই, বরং এমনি ‘মানুষ’ (লিঙ্গ ছাড়া কথা) বলা আছে। কেরী অনুবাদ তা দেখায় ‘আর সদাপ্রভু ঈশ্বর মৃত্তিকার ধূলিতে আদমকে (অর্থাৎ মনুষ্যকে) নির্মাণ করিলেন’।
আদি ২:১৫ আহবান, ভূমিকা, কাজ, দেখাশোনা
‘সদাপ্রভু ঈশ্বর সেই মানুষটিকে নিয়ে এদন বাগানে রাখলেন যাতে তিনি তাতে চাষ করতে পারেন ও তার দেখাশোনা করতে পারেন।’
- যেহেতু আদি ১:২৮ পদে তাদের আশীর্বাদ এবং আহবান বা আদেশ দুইজনকে দেওয়া হয়েছিল, বাগানে চাষ করা ও দেখাশোনা করার আদেশও ‘মানুষকে’, অর্থাৎ দুইজনকে দেওয়া হয়েছে।
- এই আদেশ হল বস্তু জগতের জন্য ও মানুষের শারীরিক প্রয়োজন মেটানোর একটি অনুমোদন। খাবার প্রয়োজন, মানুষের কাজ ভাল, তার শ্রম ও সময় মূল্যবান, তার নেতৃত্ব অনুমোদিত।
আদি ২:১৮-২০ একা থাকা ভাল নয়, জন্তু মানুষের জন্য উপযুক্ত নয়
‘পরে সদাপ্রভু ঈশ্বর বললেন, ‘মানুষ টির পক্ষে একা থাকা ভাল নয়। আমি তার জন্য একজন উপযুক্ত সংগী তৈরী করব।’ ১৯ সদাপ্রভু ঈশ্বর মাটি থেকে ভূমির যে সব জীবজন্তু ও আকাশের পাখী তৈরী করেছিলেন সেগুলো সেই মানুষটির কাছে আনলেন। সদাপ্রভু দেখতে চাইলেন তিনি সেগুলোকে কি বলে ডাকেন। তিনি সেই সব জীবন্ত প্রাণীগুলোর যেটিকে যে নামে ডাকলেন সেটির সেই নামই হল। ২০ তিনি প্রত্যেকটি গৃহপালিত ও বন্য পশু এবং আকাশের পাখীর নাম দিলেন, কিন্তু সেগুলোর মধ্যে সেই পুরুষ মানুষটির, অর্থাৎ আদমের কোন উপযুক্ত সংগী দেখা গেল না।’
- সম্পর্ক রাখা ও সম্পর্কে থাকা হল মানুষের জন্য একটি আবশ্যক বিষয়। এর সর্বোচ্চ পূর্ণতা মানবীয় বিবাহে, কিন্তু বিবাহের পাশাপাশিও অন্য লোকদের সাথে সম্পর্কে থাকা গুরুত্বপূর্ণ। বিবাহ করা ভাল,
সম্পর্ক রাখা ও সম্পর্কে থাকা আবশ্যক। - কেন? কারণ মানুষ একজন সম্পর্কের ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে, একজন ত্রিত্ব ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি! তাই সম্পর্কে না থাকা ভাল না, মানুষ সম্পর্কের জন্যই সৃষ্টি। মানুষের সুসম্পর্কে ত্রিত্ব ঈশ্বর (এবং তাঁর মধ্যে সে সুসম্পর্ক আছে) প্রকাশ পান। মানবীয় বিবাহ বিশেষভাবে এবং মানবীয় সুসম্পর্ক সাধারণভাবে ঈশ্বরকে প্রকাশিত করে।
- কেন ঈশ্বর আদমকে জীব-জন্তুদের মধ্যে তার জন্য সঙ্গী খুঁজতে বলেন, ভাল জেনে যে জীব-জন্তুর মধ্যে উপযুক্ত কেউ পাওয়া যাবে না? ঈশ্বর মানুষকে এখানে শেখান, তার জন্য সম্পর্ক কত প্রয়োজন, এবং তার জন্য কে উপযুক্ত। ঈশ্বর মানুষকে নিজেকে আবিষ্কার করতে দেন যে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট মানুষের জন্য মাত্র একজন ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট মানুষই উপযুক্ত। মানুষ জীব-জন্তুদের আবিষ্কার করে, কিন্তু নিজের বিষয়েও আবিষ্কার করে।
- ঈশ্বর বলেন যে তিনি একজন ‘সঙ্গী’ বা ‘সহকারীনী’ বা ‘সাহায্যকারীনী’ তৈরি করবেন (বিভিন্ন অনুবাদ দেওয়া হয়েছে)। ইব্রীয়তে সে শব্দ হল ‘ezer’ বা ‘עֵזֶר’, যার অর্থ হল: একজন যার সাহায্য করার ক্ষমতা আছে। এই শব্দ পুরাতন নিয়ম ১৪ বার ব্যবহৃত, এখানে পদগুলি দেওয়া আছে:
- ১ বার এখানে আদি ২:১৮ পদে … শব্দটি মহিলাকে বা হবাকে বুঝায়
- ১ বার ২ রাজা ১৪:২৬ পদে … শব্দটি একজন রাজা বা উদ্ধারকর্তাকে বুঝায়
- ১২ বার যেমন গীত ১০:১৪, ৩০:১০, ৫৪:৪, ৭২:১২ … শব্দটি ঈশ্বরকে বুঝায়, যিনি ইস্রায়েলের
সাহায্যকারী
- ঈশ্বর বলেন একজন ‘উপযুক্ত’ লোক তৈরি করবেন। ইব্রীয়তে সে শব্দ হল ‘neged’ বা ‘נֶגֶד’, যার অর্থ হল ‘উপযুক্ত, তার মত, মিল রেখে, একই জাত, খাপ খাওয়া’।
- যখন মহিলাকে তৈরি করা হয়, তা নতুন করে সৃষ্টি নয়, মাটি থেকে নয়, ঈশ্বরের বাক্য দ্বারা নয় (‘মহিলা হোক এবং মহিলা হল’ এই রকম নয়), বরং এক মানুষ থেকে দুইজন আলাদা করে সৃষ্টি করা হয়। এইটা ৫ম বার যে এক জিনিস থেকে দুইটা বানানো হয় (৪ বার তা হল আদি ১ অধ্যায়ে)। তাতে কি বুঝা যায়? > দুইজনের মিল আছে, তারাই এক, তারা সমান, তারা একই উৎসের লোক।
- ঈশ্বর আদমের পাঁজর থেকে মহিলাকে সৃষ্টি করেন। পাঁজর থেকে কেন? এর গুরুত্ব কি? পা থেকে যদি মহিলাকে সৃষ্টি করতেন আমরা কি উপসংহারে আসতাম? মাথা থেকে যদি মহিলাকে সৃষ্টি করত তাহলে আমরা কি বলতাম? ঈশ্বর একজন মানুষ থেকে দুইজন সৃষ্টি করেন কিন্তু ছবিটি অনুভূমিক: তারা একই উচ্চতায় আছে, তারা পাশাপাশি দাঁড়ায়। এখানে উঁচু-নীচু বলতে কিছু নেই, ছবিটি হল আনুভূমিক, যা সমতা, মিল, উপযুক্ততা, সাদৃশ্য, সমঅধিকার বুঝায়। তারা পরস্পরের জন্য সৃষ্টি, একজন অন্যের পাশে দাঁড়ায়, তারা সহকর্মী এবং একই আহবানে আহূত।
- ঈশ্বর তাদের আলাদা ব্যক্তি করে দিয়েছেন কিন্তু বিবাহের সম্পর্কে এই আলাদা ব্যক্তি আবার এক হয়।
আদি ২:২১-২৩ একজন থেকে দুইজন সৃষ্টি
‘সেইজন্য সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমের উপর একটা গভীর ঘুম নিয়ে আসলেন, আর তাতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন তিনি তাঁর একটা পাঁজর তুলে নিয়ে সেই জায়গাটা বন্ধ করে দিলেন। ২২ আদম থেকে তুলে নেওয়া সেই পাঁজরটা দিয়ে সদাপ্রভু ঈশ্বর একজন স্ত্রীলোক তৈরী করে তাঁকে আদমের কাছে নিয়ে গেলেন। ২৩ তাঁকে দেখে আদম বললেন, ‘এবার হয়েছে। এঁর হাড়-মাংস আমার হাড়-মাংস থেকেই তৈরী। পুরুষ লোকের দেহের মধ্য থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে এঁকে স্ত্রীলোক বলা হবে।’
- আদি ১:১ থেকে ২:২২ পদ পর্যন্ত যতবার মানুষের কথা বলা হয়েছে ইব্রীয় ভাষায় যে ব্যবহৃত শব্দ ছিল
‘আদম’, বা ‘אָדָם’, যার অর্থ হল ‘মানুষ’ (লিঙ্গের নির্দিষ্ট উল্লেখ নেই), আসলে শব্দটি হল একটি বহুবচন, তাই ‘মানুষেরা’। এর জন্য ইংরেজী অনুবাদে ‘আদম’ শব্দ ‘humans’ বা ‘humankind’ দিয়ে অনুবাদিত, লিঙ্গ ছাড়া বহুবচন। - কিন্তু এখানে, আদি ২:২৩ পদে, তাদের আলাদা করার পরেই প্রথম বার একবচন দেখা যায় আদম মহিলাকে দেখে একটি উক্তি করেন। এখন ‘মানুষ’ বা ‘মানুষেরা’ থেকে পুরুষ মানুষ ও মহিলা মানুষ হয়েছে।
- যখন পুরুষ মহিলাকে প্রথম বার দেখে তিনি বলেন: ‘এবার হয়েছে। এঁর হাড়-মাংস আমার হাড়-মাংস থেকেই তৈরী’ …। তার কথায় আনন্দ, সন্তুষ্টতা ও সান্ত্বনা বুঝা যায় এবং তিনি কম বেশি বলেন: ‘অবশেষে আমার মত একজন!’। কেন ‘এবার’ বা ‘অবশেষে’? কারণ আগের বার (জীবজন্তুদের ক্ষেত্রে) উপযুক্ত কাউকে পাওয়া যায় নি। আদম নিজের এবং মহিলার মিল প্রকাশ করেন: তারা একই মাংসের, একই ধরণের, একই বৈশিষ্টের। তাদের মিল আছে, তারা একই উৎসের লোক; তারা দুইজনই ব্যক্তি, পরস্পরের জন্য উপযুক্ত, সমান, মানানোর বা খাপ খাওয়ার একজন।
- লেখা থেকে কোনো ক্ষেত্রে আমরা মানুষদের মধ্যে বা লিঙ্গের মধ্যে পার্থক্য পাই না, কোনো ক্ষেত্রে তাদের অসমতা, অমিল, ভিন্নতা বা ভিন্ন পদ-মর্যাদা, মূল্য, কাজ, ভূমিকা বা উঁচু-নীচু কথা পাওয়া যায় না।


- আদি ১-২ অধ্যায়ে, ঈশ্বর আমাদের বুঝান তিনি আসলে কি চেয়েছেন: একতা, উপযুক্ততা, সমতা, ও পাশাপাশি দাঁড়ানো। তারা একই উৎসের ও একই আহবানের লোক।
- তারা স্বাধীনভাবে পরস্পরকে পছন্দ করে। বিবাহের অধিকার কোথা থেকে আসে? দুইজন স্বেচ্ছায় পরস্পরকে স্বামী বা স্ত্রী হিসাবে পছন্দ করেন ও তা শপথে প্রকাশ করেন, তা হল বিবাহের অধিকার ও ভিত্তি। এখানে বাবা-মা দ্বারা বিবাহ স্থাপন হয় না, তা পরবর্তীতেও আবশ্যক নয়, যদিও বাবা-মায়ের বিবাহ ঠিক করার সময় ভূমিকা থাকতে পারে। ঈশ্বরের যে বিবাহ আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপন করেন, তার উল্লেখ নেই।
- ফরীশীরা বিবাহ বিচ্ছেদের প্রশ্ন নিয়ে যীশুর কাছে আসে। মোশির আইন-কানুন থেকে এমন আইন যা ঈশ্বর বিচ্ছেদের ক্ষতি কমানোর জন্য দিয়েছেন, তারা বিচ্ছেদ করার অধিকার হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। যীশু এই ব্যাখ্যায় কোনো রকম রাজী নন এবং তাদের ‘কঠিন হৃদয়ের লোক’ বলেন। পরিবর্তে তিনি তাদের আদি ১-২ অধ্যায়ে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের বুঝান বিবাহের জন্য ঈশ্বর আসলে কি চেয়েছেন। ঈশ্বরের সর্বোচ্চ কি, বিবাহের জন্য ঈশ্বরের হৃদয় কি, তা তিনি ব্যাখ্যা করেন (মথি ১৯:৩-৬, মার্ক ১০:২-৯)।
- গ্রীক সৃষ্টির কাহিনীর চেয়ে আদিপুস্তক কত ভিন্ন! গ্রীক কাহিনী বলে যে মহিলারা ১০ ধরণের জীবজন্তু থেকে তৈরি হল (১০টা জীবজন্তুর মধ্যে শুধুমাত্র ১ জীবজন্তু ভাল ছিল, বাকিগুলি খারাপ)। তা ছাড়া: একজন পুরুষ (Prometheus) যখন দেবতাদের থেকে আগুন চুরি করে দেবতারা শাস্তি হিসাবে ও তার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রথম মহিলাকে (Pandora) তৈরি করেন। মহিলা হল পুরুষের চোখে আকর্ষনীয় কিন্তু তার জন্য ধ্বংসাত্মক, মহিলা হল ‘মিষ্টি বীষ’, মহিলা হল অভিশাপ, পুরুষ তাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না, কিন্তু মহিলা তাকে ধ্বংস করবে। মহিলা হল প্রতারক, পুরুষের জন্য শাস্তি, ফাঁদ ও অভিশাপ।
- এই কাহিনীতে মহিলাদের নিয়ে কি অত্যন্ত নীচু দৃষ্টি প্রকাশিত! তার চেয়ে আদিপুস্তকের কথা কত চমৎকার: মহিলা সৃষ্টি হয়েছে পুরুষের সহভাগিতা, সাহায্য ও আশীর্বাদের জন্য।
আদিপুস্তক ২:২৪ ছাড়া ও এক হওয়া
‘এইজন্যই মানুষ মা-বাবাকে ছেড়ে তার স্ত্রীর সংগে এক হয়ে থাকবে আর তারা দু’জন একদেহ হবে।’ কেরী: ‘এই কারণ মনুষ্য আপন পিতা মাতাকে ত্যাগ করিয়া আপন স্ত্রীতে আসক্ত হইবে, এবং তাহারা একাঙ্গ হইবে।’
- পুরুষ স্ত্রীতে ‘আসক্ত হবে’, ‘এক হবে’, মিলিত হবে, ইংরেজী: ‘cleave’, যার অর্থ লেগে থাকা, সংযুক্ত থাকা বা সরে না যাওয়া।
- ঈশ্বরের সম্পূর্ণ, চমৎকার এবং এখনও পাপ দিয়ে বিকৃত না হওয়া সৃষ্টিতে আমরা পাই যে বিবাহ করলে আগে ‘ছেড়ে চলে যাওয়া’ প্রয়োজন। আমরা বলতে পারতাম যে আদম ও হবার বাবা-মা নেই, তাই আদেশটি যে কোনোভাবে প্রয়োজন নয়। কিন্তু ঈশ্বর যে শুরু থেকে তা বলেন বুঝায় বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যক:
- ঈশ্বর বিবাহ ক্ষেত্রে একটি নতুন কেন্দ্র, একটি নতুন প্রাধান্য, অধীনে থাকার জন্য একটি নতুন অধিকার স্থাপন করেন: যখন একজন বিবাহ করে, বাবা-মায়ের ভূমিকা পরিবর্তিত হয়ে যায়, তাদের সাথে সম্পর্কও পরিবর্তিত হয়ে যায়। সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে, তার কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু একটা পরিবর্তন আসে। যে বিবাহ করে তার এখন নতুন একটি কেন্দ্র, নতুন একটি প্রাধান্য, নতুন একটি অধীনতা হয়ে গেছে।

- সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও অধিকার এখন নতুন স্বামী-স্ত্রীর একসাথে আছে। এই নতুন পরিবারে কিভাবে চলবে, কি করবে বা না করবে, কিভাবে আয় করা হবে, টাকা কিভাবে খরচ করা হবে, সন্তানদের কিভাবে মানুষ করা হবে, সব সিদ্ধান্ত নতুন পরিবারের হাতে, আগের পরিবারের হাতে নয়।
- ঈশ্বর এখানে সংজ্ঞা দেন তার জন্য ‘পরিবার’ মানে কি: পরিবার মানে ‘স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তান’। আদি ২:২৪ পদ দ্বারা ঈশ্বর পরিষ্কারভাবে আগের পরিবারের চেয়ে নতুন পরিবারকে প্রাধান্য দেন।
- ঈশ্বর একটি প্রক্রিয়া স্থাপন করেন: একতা > ছেড়ে চলে যাওয়া > নতুন একতা > সফলতা > ছেড়ে দেওয়া। এমন কি বিজ্ঞানেও তা হল নিয়ম: কোষ বিভাজিত না হলে কোনো প্রজনন সম্ভব না (‘no reproduction without separation’)।
- ঈশ্বর দাবী করেন যে পুরুষই বাবা-মা ছেড়ে চলে যান। আদেশটি লিঙ্গভিত্তিক। মহিলার ক্ষেত্রে তা করা যায়, বা করা ভাল, কিন্তু আবশ্যক না। তাই যদি নতুন স্বামী-স্ত্রী বাবা-মায়ের সঙ্গে বাস করতে সিদ্ধান্ত নেন, তবে তা হতে হয় স্ত্রীর বাবা-মা, স্বামীর নয়। এই পদে নিষেধ করা হয় যে বিয়ের পরে স্ত্রীকে স্বামীর পরিবারে আনা হয় এবং সেখানে স্ত্রীর একটি দীর্ঘ দিন স্থাপিত ও শশুড়-শাশুড়ী দিয়ে চালিত সংসারের অধীনে থাকতে হয়। অনেক সংস্কৃতিতে ঠিক তা-ই প্রচলিত এবং তা-ই আদর্শ মনে করা হয়! কিন্তু ঈশ্বর এখানে খুব শক্তিশালীভাবে ও খুব পরিষ্কারভাবে দাবী করেন যেন এভাবে না হয়।
- যদি ঈশ্বর পুরুষকে ছেড়ে চলে যেতে বলেন এবং যদি নতুন পরিবার আলাদা হওয়া ভাল, তবে তা বাবা-মার কাছেও আদেশ হিসাবেও দাঁড়ায় যেন তারা সন্তানদের শান্তিতে ছেড়ে দেন। বাবা-মা হিসাবে যদি আমি চেষ্টা করি সন্তানকে ধরে রাখতে যেন আমার উপর নির্ভরশীলতা কমে না যায়, যদি আমি সন্তান বিবাহ করার পরেও তার সময় ও মনোযোগের উপরে একই দাবী করতে থাকি, যদি আমার প্রতি তার বাধ্যতা দাবী করতে থাকি, আমি আসলে ঈশ্বরের বিরুদ্ধীয় একটি চাপ সৃষ্টি করি। বাবা-মা হিসাবে আমার প্রাপ্ত বয়স্কো সন্তানকে মুক্ত করতে স্বক্রিয়ভাবে চেষ্টা করা উচিত। সন্তান বিবাহ করলে তা আবশ্যক। যেমন আদি ১:২৮ পদে মানুষকে মানুষের উপরে রাজত্ব করতে বলা হয় নি, ঠিক তেমনি বাবা-মা হিসাবে আমার প্রাপ্ত বয়স্কো সন্তানের উপরে রাজত্ব করা উচিত নয়।
- সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রেও তার প্রয়োগ আছে: বাবা-মা হিসাবে আমার শেষ লক্ষ্য তা নয় যে আমার সন্তান নিঃশর্তভাবে আমার প্রতি বাধ্য হয়। সন্তান যখন ছোট, তখন বাবা-মায়ের প্রতি বাধ্যতা হল বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু একজন প্রাপ্ত বয়স্কো সন্তানের জন্য আমার শেষ লক্ষ্য বাধ্যতা নয়, বরং যেন সন্তান প্রজ্ঞায় স্বক্রিয়ভাবে নিজেকে চালাতে শিখে এবং তার বিভিন্ন ভূমিকা ও দায়িত্বগুলি উপযুক্তভাবে পালন করে।
- যদি বাবা-মা সন্তানকে ছেড়ে দিতে রাজি না তবে এই পদ দেখায় যে সন্তানের তা তারপরেও স্বক্রিয়ভাবে করা দরকার। সাংস্কৃতিকভাবে চলে যাওয়ার ক্ষমতা হয়তো মহিলা সন্তানের চেয়ে পুরুষ সন্তানের বেশি। পুরুষ হিসাবে তার নতুন পরিবারের অধিকারের জন্য দাঁড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- ঈশ্বর মানুষের সিদ্ধান্তগুলি নিয়ন্ত্রণ করেন না: তিনি তাদের জোর করে বিয়ে দেন না, তিনি জোর করে নিষিদ্ধ ফল খাওয়া বাধা দেন না, তিনি তাদের নিজে থেকে আলাদা হতে দেন। সে একই মনোভাব তিনি বাবা-মায়ের ক্ষেত্রেও দাবী করেন।
- ‘শাশুড়ি-ছেলের বৌয়ের সমস্যা’: যতদিন একজন মহিলার পরিচয়, মর্যাদা ও মূল্য তার স্বামী, তার সন্তান, এবং বিশেষভাবে তার ছেলে সন্তানের উপর নির্ভরশীল, ততদিন তার জন্য ছেলেকে উপযুক্তভাবে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। যদি আমার ছেলেই হল সম্মান, আমার মর্যাদা, আমার ভবিষ্যৎ, আমার নিরাপত্তা, আমার ক্ষমতা…তবে তাকে কিভাবে তার বৌয়ের হাতে ছেড়ে দেব? তাই এভাবে শাশুড়ী ও নতুন স্ত্রী অপ্রয়োজনীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে; যার ফলে অনেক কষ্ট, টানাটানি, আবেগীয় চাপ ও অশান্তি তৈরি হয়।
- কেউ কেউ বলেন: আদি ২ অধ্যায়ে তো এখনও কোনো পাপ ঘটে নি, সম্পর্ক এখনও খারাপ হয় নি, ভুল মনোভাব এখনও শুরু হয় নি। হ্যাঁ, কিন্তু তারপরেও ঈশ্বর ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দেন। যদিও পরিবারে সুসম্পর্ক ও শান্তি আছে তবুও ঈশ্বরের আদেশ এই: ছেড়ে চলে যাও!
- বাবা-মাকে ছেড়ে চলে যাওয়া থেকে পুরুষ কি শিখবে? কেন তা তার জন্য ভাল? তা একটি আত্ম-আবিষ্কারের পথ, নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব, নিজের দায়িত্ব বুঝা, ‘আগের মত’ না করে নতুন করে পছন্দ করা। উদাহরণ: একজন উঁচু শিক্ষিত ডাক্তার যার স্ত্রী ও তিনজন সন্তান আছে কিন্তু নিজের টাকার হিসাব নেই! কিছু কিনতে গেলে এখনও মায়ের অনুমতি নেন।
- গণনা ৩৬:৬ পদে সলফাদ নামে একজনের মেয়েদের বিষয়ে বলা হয়: ‘যাকে খুশী তাকে বিয়ে করতে পারে” … এখানেও আমরা পাই: যে বিয়ে করে, তার স্বাধীন ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত হল বিবাহের অধিকার ও ভিত্তি। জোর করে বিবাহ দেওয়ার কোনো কথা নেই।
- ১ করি ৭:৩৯-৪০ পদে পৌল বিধবাদের বিষয়ে বলেন: সে যাকে ইচ্ছা তাকে বিয়ে করতে পারে, অবশ্য সেই লোক যেন প্রভুর হয়।’ আবারও: বিবাহ হল সেচ্ছায় সিদ্ধান্ত।
- অধিকাংশ দেশে এই নীতিমালা দেশের আইনে প্রকাশিত: দুইজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোক বাবা-মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা তাদের অনুমতি ছাড়া আইনগতভাবে বিয়ে করা সম্ভব। শুধুমাত্র দুইজন সাক্ষী (যে কেউ) থাকলে শপথ দিয়ে বিবাহ করা যায়। মানুষের নিজের জীবনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া অধিকার আছে, নিজের ইচ্ছা থেকে বিবাহের শপথ করা যায়। কিন্তু ঈশ্বর মানুষকে তার সেই শপথে দায়ী হিসাবে দেখবে।
- মানবীয় অধিকারের সার্বজনীন ঘোষণায়ও (Universal Declaration of Human Rights) তাই বলে: যে কোনো একজনকে বিবাহ করা যায়, কাউকে জোর করে বিবাহে বাধ্য করা যায় না।
- যদি একটি পরিবারে উপযুক্ত ব্যবহার ও সুসম্পর্ক থাকে, তবে অবশ্যই সন্তান বিবাহের ক্ষেত্রে তার বাবা-মায়ের পরামর্শ, সাহায্য ও অনুমোদন চায়। কিন্তু যে পরিবারে ঝগড়া-বিবাদ, অন্যায়, অবহেলা, পক্ষপাতিত্ব, আবেগীয় চাপ, দমন, হুমকি বা অত্যাচার থাকে, সেখানে বিবাহের বিষয় খুব জটিল হয়ে দাঁড়াতে পারে। মাঝে মধ্যে বিবাহের বিষয়ে ভুলভাবে চাপ দিয়ে বা ভুলভাবে বাধা দিয়ে সন্তানকে অনেক কষ্ট দেওয়া হয়। উদাহরণ: যদি সন্তান ধর্মান্তরিত হয়, তাকে প্রায়ই জোর দিয়ে বিবাহিত করা দ্বারা সংশোধন করতে চেষ্টা করা হয়। আদি ২:২৪ পদ দ্বারা ঈশ্বর এই ধরণের চাপ নিষেধ করেন।
- ‘তারা একদেহ হবে’ বা ‘তাহারা একাঙ্গ হইবে’। বিবাহে দুইজনের সিদ্ধান্ত, শপথ ও একতা উৎযাপন করা হয় (আইনগত, আত্মিক, মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক)। ‘দেহ’ বা ‘একাঙ্গ’ মানে শরীর, কিন্তু ব্যক্তিও। তারা এক হবে, সব ক্ষেত্রে।
- তা ১ করিন্থীয় ৬:১৫-১৮ পদেও প্রকাশিত: পৌল বলেন যে আত্মা ও শরীর আলাদা করা যায় না। তিনি
উদাহরণ হিসাবে বলেন যে পতিতার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক রাখলে আত্মার উপরও প্রভাব হয়, তাই তা করা ঠিক না। দেহের মিলন (শারীরিক একতা) মন, প্রাণ বা আত্মার উপর প্রভাব ফেলে। তবুও শারীরিক সম্পর্ক করা এবং একজনকে বিয়ে করা হল আলাদা বিষয়।
আদি ২:২৫ উলংগ কিন্তু লজ্জা নেই
‘তখন আদম এবং তাঁর স্ত্রী উলংগ থাকতেন, কিন্তু তাতে তাঁদের কোন লজ্জাবোধ ছিল না।’
- এই পদ ভুল বুঝবেন না: মানুষ এখানে নিষ্পাপ, সৎ ও নির্দোষ, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তারা ‘মূর্খ’, ‘অতি সরল’, ‘কিছু বুঝে না’ বা ‘বাচ্চার মত’।
- তাদের লজ্জা বোধ নেই কারণ লজ্জা করার আসলে কিছু নেই। কি নিয়ে লজ্জা করবে? যে শরীর ঈশ্বর তাদেরকে দিয়েছেন? তা অবশ্যই লজ্জার বিষয় নয়।
- লজ্জা মানে ‘নিজের বিষয়ে শান্তি নেই’, মানে ‘নিজেকে নিয়ে ভাল লাগে না’। লজ্জার কারণে হবে ভয়, ঢেকে দেওয়া, লুকানো থাকা ও ভান করা। যেহেতু আমি নিজেকে নিয়ে খুশি না, তবে নিজেকে লুকায় কারণ ‘অন্যরা যদি জানত আমি কি রকম, তারা আমাকে অগ্রাহ্য করত’। লজ্জা সৎ হতে চায় না, নিজেকে দেখাতেও চায় না। আগের সে চমৎকার স্বাধীনতা নষ্ট হয়ে গেছে। লজ্জা মানে ভাঙ্গা আত্ম-বিশ্বাস, মানে নিজেকে নীচু চোখে দেখা। পাপের আগে তারা শান্তিতে ছিলেন: নিজেকে নিয়ে শান্তি, পরস্পরকে নিয়ে শান্তি, ঈশ্বরকে নিয়ে শান্তি।
- পাপ করার ফলে শুরু হল লজ্জা, ভয়, স্বার্থপরতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, দমন ও প্রতারণা। সে সময় নীচু ভাব, নিরাশা, মানসিক সমস্যা ও আত্ম-ধ্বংসের চিন্তা শুরু হয়।
- এই পদ আমাদের দেখায় পাপের কারণে কি ভেঙ্গে গেছে। আজ পর্যন্ত আমরা সে খোলামেলা থাকার অবস্থা চাই, যে ‘উলংগ কিন্তু কোন লজ্জাবোধ’ নেই, যে নিজের বিষয়ে শান্তি, যে ভয়মুক্ত জীবন, যখন আমি যেমন হই তেমনি নিজেকে প্রকাশিত করতে পারি, কিন্তু আমাকে তারপরেও গ্রহণ করা হয় ও ভালবাসা হয়।
আদি ৩:১-৫ শয়তান ও মহিলার কথা
‘সদাপ্রভু ঈশ্বরের তৈরী ভূমির জীবজন্তুদের মধ্যে সাপ ছিল সবচেয়ে চালাক। এই সাপ একদিন সেই স্ত্রীলোকটিকে বলল, ‘ঈশ্বর কি সত্যি তোমাদের বলেছেন যে, বাগানের সব গাছের ফল তোমরা খেতে পারবে না?’ ২ উত্তরে স্ত্রীলোকটি বললেন, ‘বাগানের গাছের ফল আমরা খেতে পারি। ৩ তবে বাগানের মাঝখানে যে গাছটি রয়েছে তার ফল সম্বন্ধে ঈশ্বর বলেছেন, ‘তোমরা তার ফল খাবেও না, ছোঁবেও না। তা করলে তোমাদের মৃত্যু হবে।’
- স্ত্রীলোকটি ভালই জানেন ঈশ্বর কি বলেছিলেন। তিনি ‘জ্ঞানের অভাব’ অজুহাত হিসাবে দাবী করতে পারে না।
- শয়তান তার কথার সে ‘দয়া-মায়া-ভাব’ (সব গাছ কি নিষেধ? বেচারা, কি খাবে?) দেখায়, মহিলা তা সাথে সাথে সংশোধন করেন: সব গাছ নিষেধ না, কেবলমাত্র এক গাছ নিষেধ।
- মহিলাটি ভাল উত্তর দেন, কিন্তু তিনি কিছু যোগ দেন: ‘ছোঁবেও না’। ঈশ্বর আদি ২:১৭ পদে তা বলেন নি। এইটা কি সমস্যা? না ছুঁলে তো খাওয়াও যাবে না। আসলে মানুষ সব সময় ঈশ্বরের আইনের সাথে আরো ‘সাহায্যকারী আইন’ যোগ করে (তা যিহূদীদের এবং বিশেষভাবে ফরীশীদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়)। যোগ করা আইন আসল আইন সুরক্ষিত রাখতে চায়, কিন্তু প্রায়ই (ফরীশীদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে) পরে যোগ করা আইন এমন প্রাধান্য পায় যে আসল আইন বদলানো হয় বা অমান্য করা হয়। যীশু এই বিষয়ে ফরীশীদের দোষ ধরেন (মার্ক ৭:৯ পদ দেখুন)।
- হয়তো ‘ছোঁবেও না’ যোগ দেওয়ার আদি ৩:৬ পদে সমস্যা হিসাবে দাঁড়ায় যখন মহিলা ফল পাড়ে (‘ছোঁয়’) কিন্তু যখন কিছু ঘটে না, মনে করে যে তাহলে ফলাফল নেই এবং ফল খায়।

‘৪ তখন সাপ স্ত্রীলোকটিকে বলল, ‘কখনও না, কিছুতেই তোমরা মরবে না। ৫ ঈশ্বর জানেন, যেদিন তোমরা সেই গাছের ফল খাবে সেই দিনই তোমাদের চোখ খুলে যাবে। তাতে ভাল-মন্দের জ্ঞান পেয়ে তোমরা ঈশ্বরের মতই হয়ে উঠবে।’
- শয়তানের প্রলোভন ‘তোমরা ঈশ্বরের মতই হয়ে উঠবে’ আসলে হল হাস্যকর, তারা ইতিমধ্যেই ‘ঈশ্বরের মত সৃষ্টি’ বা ‘ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি’ (আদি ১:২৭) এবং শয়তানের তার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করার কোনো ক্ষমতা নেই, পূর্ণ করার ইচ্ছাও নেই। শয়তান তাদের এমন কিছু নিয়ে প্রলোভিত করেন যা দিয়ে সে নিজেই প্রলোভনে পড়েছিল। হয়তো ‘নিজেই কিছু করলে তা অর্জন করা যাবে’, এই অহংকারের চিন্তা দিয়ে সে তাদের প্রলোভনের ফেলে। ঈশ্বর যা খোলা হাতে ও দয়ায় দিয়েছেন, তা আমি এখন ‘নিজের কার্যক্রম দ্বারা অর্জন’ করতে চাই।
- কেন শয়তান প্রথম মহিলার কাছে কথা বলে? আসলে পরে দেখা যায় যে দুইজন মহিলা এবং পুরুষ সে সময় উপস্থিত। আদি ৩:৬ পদ মহিলা সম্বন্ধে বলে লেখা আছে ‘তিনি কয়েকটা ফল পেড়ে নিয়ে খেলেন। সেই ফল তিনি তাঁর স্বামীকেও দিলেন যিনি তার সঙ্গে ছিলেন এবং তাঁর স্বামীও তা খেলেন’। দুঃখের বিষয় যে এই পদের কেরী এবং সাধারণ অনুবাদ উভয় দুর্বল: ‘যিনি তার সঙ্গে ছিলেন’ বাদ দেওয়া হয়েছে (বাংলা জুবিলী ও WBTC অনুবাদে তা দেওয়া আছে)। তাই বুঝা যায় যে পুরুষ মহিলার সঙ্গে আছেন এবং সাপের সঙ্গে তার আলোচনা শোনেন। যখন মহিলা ফল নিতে বিবেচনা করেন তিনি সাবধাণবাণী দেন না, প্রতিরোধও করেন না, বরং নিজেও ফল খান।
- কেউ কেউ আদিপুস্তক ৩:৬ থেকে শিক্ষা দেয় যে মহিলারা আরো সহজেই প্রলোভিত, যে মহিলারা আরো বেশি পাপ করে, যে মহিলাদের একা থাকতে দিলে তারা ঠিকই সংকটে পড়ে। মোট কথা: মহিলাদের দেখাশোনা ও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, না হলে কি যে ঘটবে!
- কিন্তু আসলে মহিলা একা ছিলেন না, তার স্বামী তার সঙ্গে ছিলেন। এবং তারা দুইজন জেনে বুঝে ফল খায় (না জেনে খাওয়া পাপ হত না, কারণ পাপ মানে হৃদয়ে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া)। তারা দুইজন শয়তানের কথা শুনেন, ঈশ্বরের চেয়ে তা বিশ্বাস করেন এবং শেষে শয়তানের প্রতি বাধ্য হন। পরে ঈশ্বর দুইজনকে দোষী হিসাবে ধরেন। তাই এখানে পুরুষ এবং মহিলার ব্যবহারের বড় পার্থক্য দেখানো হয় নি।
- শুধুমাত্র এক বিষয়ে পার্থক্য আছে: আদি ৩:১৭ পদে ঈশ্বর বলেন ‘যে গাছের ফল খেতে আমি নিষেধ করেছিলাম তুমি তোমার স্ত্রীর কথা শুনে তা খেয়েছ।’ যখন তার স্ত্রী ভুল প্রভাব ফেলেছেন, পুরুষ তার কথা শুনেছেন ও মেনে নেন। কথা দিয়ে প্রভাব ফেলা হল মহিলাদের একটি ভাল ক্ষমতা কিন্তু সাথেও একটি প্রলোভন।
আদি ৩:৬ দুইজনই পাপ করেন
‘স্ত্রীলোকটি যখন বুঝলেন যে, গাছটার ফলগুলো খেতে ভাল হবে এবং সেগুলো দেখতেও সুন্দর আর তা ছাড়া জ্ঞান লাভের জন্য কামনা করবার মতও বটে, তখন তিনি কয়েকটা ফল পেড়ে নিয়ে খেলেন। সেই ফল তিনি তাঁর স্বামীকেও দিলেন এবং তাঁর স্বামীও তা খেলেন।’
- ঈশ্বরের কথা বা ঈশ্বরের মঙ্গলময়তা নিয়ে সন্দেহ করার তাদের কোনো কারণই নেই। এ পর্যন্ত তারা ঈশ্বর থেকে কি ব্যবহার দেখেছেন? ঈশ্বর তাদের জীবন দিয়েছেন, তাদের নিজের প্রতিমুর্তিতে বানিয়েছেন, তাদের আশীর্বাদ, আহবান, নেতৃত্ব, ক্ষমতা ও মর্যাদা দিয়েছেন এবং তিনি তাদের সহভাগিতা ও স্বেচ্ছায় সহযোগিতা চেয়েছেন।
- তাদের পাপ হল ঈশ্বরের মঙ্গলময়তা নিয়ে অবিশ্বাস করা, এবং তা করার জন্য তাদের একটাও কারণ নেই। কিভাবে ঈশ্বরের চেয়ে শয়তানের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণিত হল? কোনো রকম না। তারা ঈশ্বরের হাত থেকে যা তিনি দেবেন তা গ্রহণ করার চেয়ে মানুষ এখানে ‘নিজের জন্য জোর করে ব্যবস্থা’ করেন। তারা ত্রিত্ব ঈশ্বরের মধ্যে যেমন সম্পর্ক আছে (স্বার্থহীনতা, অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া) তার বিপরীত তারা করেন: তারা স্বার্থহীন, স্বনির্ভর ও সেচ্ছায় ব্যবহার করেন।
- তারা ঈশ্বরকে তাদের প্রভু এবং তাদের পরিচয়ের ভিত্তি হিসাবে অগ্রাহ্য করেন, বরং তারা নিজেকে কেন্দ্র বানান।
- এভাবে তারা দুইজন পাপ করেন, দুইজন পাপের ফলাফল উপলব্দি করেন (লজ্জা, ভয়, লুকানো) এবং দুইজনকে ঈশ্বর দোষী হিসাবে ধরেন।
- মাঝে মধ্যে বিশ্বাসীরা এই গল্পের কারণে ‘ঈশ্বরের মত হতে চাওয়া’ নিয়ে এত ভীত যে তারা ঈশ্বর দ্বারা দেওয়া মানুষের সে সম্মানেও ভয় পায়।
- কিন্তু সমস্যা এই নয় যে আমরা ‘ঈশ্বরের মত’, সমস্যা হয় যখন আমরা ঈশ্বরের মঙ্গলময়তা সন্দেহ করে সেচ্ছায় নিজের জন্য ব্যবস্থা করি। বাইবেলে নানা পদে দেখা যায় যে ঈশ্বর মানুষকে পদ-মর্যাদা ও সম্মান দেন: ‘তিনি ঈশ্বরের সন্তান হবার অধিকার দিলেন’ (যোহন ১:১২), ‘আমরা সবাই খোলা মুখে…প্রভুর মহিমা দেখতে দেখতে নিজেরাও মহিমায় বেড়ে উঠে বদলে গিয়ে তাঁরই মত হয়ে যাচ্ছি’ (২ করি ৩:১৮), ‘ঈশ্বর যাদের আগেই বাছাই করেছিলেন তাদের তিনি তাঁর পুত্রের মত হবার জন্য আগেই ঠিক করেও রেখেছিলেন’ (রোমীয় ৮:২৯), ‘ঈশ্বরের প্রিয় সন্তান হিসাবে তোমরা ঈশ্বরের মত করে চল’ (ইফিষীয় ৫:১), ‘তোমরা তো ‘বাছাই করা বংশ হয়েছ; তোমাদের দিয়ে গড়া হয়েছে পুরোহিতদের রাজ্য; তোমরা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে আলাদা করা জাতি ও তাঁর নিজের লোক হয়েছ’ (১ পিতর ২:৯), যীশু বলেন: ‘যে মহিমা তুমি আমাকে দিয়েছ তা আমি তাদের দিয়েছি যেন আমরা যেমন এক তারাও তেমনি এক হতে পারে’ (যোহন ১৭:২২)।
আদি ৩:৭-১২ পাপের ফলাফল
‘এতে তখনই তাঁদের দু’জনের চোখ খুলে গেল। তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, তাঁরা উলংগ অবস্থায় আছেন। তখন তাঁরা কতগুলো ডুমুরের পাতা একসংগে জুড়ে নিয়ে নিজেদের জন্য খাটো ঘাগ্রা তৈরী করে নিলেন। ৮ যখন সন্ধ্যার বাতাস বইতে শুরু করল তখন তাঁরা সদাপ্রভু ঈশ্বরের গলার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি বাগানের মধ্যে বেড়াচ্ছিলেন। তখন আদম ও তাঁর স্ত্রী বাগানের গাছপালার মধ্যে নিজেদের লুকালেন যাতে সদাপ্রভু ঈশ্বরের সামনে তাঁদের পড়তে না হয়। ৯ সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে ডেকে বললেন, ‘তুমি কোথায়?’ ১০ তিনি বললেন, ‘বাগানের মধ্যে আমি তোমার গলার আওয়াজ শুনেছি। কিন্তু আমি উলংগ, তাই ভয়ে লুকিয়ে আছি।’ ১১ তখন সদাপ্রভু ঈশ্বর বললেন, ‘তুমি যে উলংগ সেই কথা কে তোমাকে বলল? যে গাছের ফল খেতে আমি তোমাকে নিষেধ করেছিলাম তা কি তুমি খেয়েছ?’ ১২ আদম বললেন, ‘যে স্ত্রীলোককে তুমি আমার সংগিনী হিসাবে দিয়েছ সে-ই আমাকে ঐ গাছের ফল দিয়েছে আর আমি তা খেয়েছি।’
- দুইজনের সাথে ঈশ্বর কথা বলেন, দুইজনকে তিনি দায়ী ও দোষী হিসাবে ধরেন এবং দুইজনকে তিনি অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগ দেন।
- ‘তাদের চোখ খুলে গেল’ তারা পাপের ফলে কিছু ক্ষেত্রে ‘নতুন অভিজ্ঞতা’ লাভ করে (লজ্জা, ভয়, চেতনা, আলাদা হওয়া ও একা পড়া), কিন্তু আসলে তাদের জ্ঞান বাড়ে না। তারা সর্বজান্তা ঈশ্বর থেকে লুকান, যা মুর্খ কাজ। তারা দোষারোপ করেন, যা স্বার্থপর। তাদের এগিয়ে এসে পাপের জন্য দায়িত্ব নিয়ে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা কেউই করেন না।
- ‘তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, তাঁরা উলংগ অবস্থায় আছেন’ এখন লজ্জা ও ভয় তাদের জীবনে প্রবেশ করেছে। তাদের নিজেকে নিয়ে আর ভাল লাগে না ও আর শান্তি নেই। নিজের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে।
- তাদের এখন চেতনা, লজ্জা ও ভয় লাগা শুরু। ফলে তারা নিজেকে ঢেকে দিতে, লুকাতে ও ভান করতে শুরু করেন। তারা প্রতারণা করতে, কৌশল করতে ও দমন করতে শুরু করেন। তাদের সততা, সরলতা, স্বাধীনতা, হাল্কা মন, শান্তি ও আরাম তারা হারিয়েছেন। নিজেকে নিয়ে সন্দেহ, অবিশ্বাস, নিরাশা ও মানসিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে – এবং চলতে থাকবে।
- ‘খাটো ঘাগ্রা তৈরী’ কেন? কেন তারা বিশেষভাবে যৌনাঙ্গ ঢেকে দেয়? কারণ লজ্জা ও অশান্তি লাগে। আত্ম-রক্ষার ও নিজেকে আলাদা করার একটি ভাব শুরু। এখন তাদের ভিন্নতা দুশ্চিন্তার বিষয় বা সমস্যা হয়ে গেছে; ভিন্নতা এখন হুমকিস্বরূপ। হয়তো তাতে বুঝা যায় যে তাদের শরীর থেকে যে বংশধরেরা জন্ম নেবে, তারাও এই একই পাপ ও লজ্জায় আক্রান্ত হবে।
- আদি ৫:৫-২৫ পদে প্রথম বংশ তালিকা পাওয়া যায়। এই তালিকা হল একমাত্র তালিকা যেখানে মানুষের মৃত্যুর কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘পরে মারা গেলেন’। আদম ও হবা মৃত্যু নিজের উপরে টেনে নিয়ে এসেছেন, তারা বংশধরদেরও মৃত্যুর পথে পাঠিয়েছেন।
- ‘বাগানের গাছপালার মধ্যে নিজেদের লুকালেন’ তারা পাপ করে ঈশ্বর থেকে বিছিন্ন হয়েছে। আগের স্বাধীন সহভাগিতা ভাঙ্গা, ভয় ও লজ্জায় তারা নিজেকে আলাদা করে, মাফ চাওয়ার জন্যও এগিয়ে আসেন না।
- ‘তুমি কোথায়?’ এবং ‘তুমি যে উলংগ সেই কথা কে তোমাকে বলল?’ এটা হল চেতনা-দায়ক প্রশ্ন। এমন না যে ঈশ্বর আসলে জানেন না তারা কোথায় লুকায়, কিন্তু তিনি তাদের এই প্রশ্নগুলি দ্বারা চেতনা দিতে চান, তাদের নিজের দুরাবস্থা নিয়ে খেয়াল দিতে চান। তিনি তাদেরকে আসল বিষয়ে আসতে বাধ্য করেন: ‘যে গাছের ফল খেতে আমি তোমাকে নিষেধ করেছিলাম তা কি তুমি খেয়েছ?’ এইটা হল আসল সমস্যা দেখানো, চেতনা দান, কিন্তুও একটি বড় সুযোগ যেন তারা এগিয়ে এসে পাপ স্বীকার করে, নিজের আচরণের জন্য দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমা চাওয়া: ‘প্রভু, আমরা কি করলাম?? ক্ষমা কর!’
- পুরুষ এবং মহিলা দুইজন নিজের আচরণের জন্য দায়িত্ব নেন না, বরং পুরুষ স্ত্রী ও ঈশ্বরকে দোষ দেন এবং মহিলা শয়তান বা পরিবেশকে দোষ দেন। পরস্পরকে দোষারোপ করা মানে তারা স্বার্থপরভাবে নিজেকে রক্ষা করার জন্য অন্যকে দোষী বানান। তাতে বুঝা যায় যে মানুষের মধ্যে সুসম্পর্কও ভেঙ্গে গেছে।
- ঈশ্বরকে, শয়তানকে, অন্যকে বা পরিবেশকে দোষ দেওয়া সব একই বিষয় হয়ে দাঁড়ায়: আমি নিজের দোষ অস্বীকার করি, আমি নিজের আচরণের দায়িত্ব নেই না।
আদি ৩:১৬-১৯ পাপের ফলাফল দুইটি লিঙ্গের উপর
‘তারপর তিনি সেই স্ত্রীলোকটিকে বললেন, ‘আমি তোমার গর্ভকালীন অবস্থায় তোমার কষ্ট অনেক বাড়িয়ে দেব। তুমি যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সন্তান প্রসব করবে। স্বামীর জন্য তোমার খুব কামনা হবে, আর সে তোমার উপর কর্তৃত্ব করবে।’ ১৭ তারপর তিনি আদমকে বললেন, ‘যে গাছের ফল খেতে আমি নিষেধ করেছিলাম তুমি তোমার স্ত্রীর কথা শুনে তা খেয়েছ। তাই তোমার দরুন মাটি অভিশপ্ত হল। সারা জীবন ভীষণ পরিশ্রম করে তবে তুমি মাটির ফসল খাবে। ১৮ তোমার জন্য মাটিতে কাঁটাগাছ ও শিয়ালকাঁটা গজাবে, কিন্তু তোমার খাবার হবে ক্ষেতের ফসল। ১৯ যে মাটি থেকে তোমাকে তৈরী করা হয়েছিল সেই মাটিতে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তোমাকে খেতে হবে। তোমার এই ধুলার দেহ ধুলাতেই ফিরে যাবে।’
- এখানে ঈশ্বর দুই লিঙ্গকে আলাদা করে পাপের ফলাফল বর্ণনা করেন (পুরুষ: কঠোর পরিশ্রম, ফলহীনতা, শারীরিক মৃত্যু। মহিলা: প্রসব বেদনা, স্বামীর সাথে লড়াই ও তার উপর কর্তৃত্ব)। অপর পক্ষে আমরা জানি যে দুই লিঙ্গের উপরে পাপের ফলাফল একই: দুইজনের শারীরিক মৃত্যু হবে, দুইজনেই কঠোর পরিশ্রম করতে হবে ‘মাথার ঘাম পায়ে ফেলে’ এবং যদিও শুধুমাত্র মহিলারা প্রসব বেদনা উপলব্দি করে, তবে পুরুষেরাও নানা ধরণের ব্যাথ্যা বা যন্ত্রনার সম্মুখীন হতে হয়।
- আদি ৩:১৬ পদে প্রথম বার শোনা যায় যে মানুষের উপর মানুষ কর্তৃত্ব করবে; লিঙ্গদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই, প্রতিযোগিতা, অমিল, অশান্তি, দমন ও উঁচু-নীচু ভাব থাকবে। ‘স্বামী স্ত্রীর উপর কর্তৃত্ব করবে’ এই বাক্যের ভিত্তিকভাবে দুই ব্যাখ্যা আছে। ইব্রীয় ভাষা অনুসারে দুই ব্যাখ্যা সম্ভব:
- ১। ‘স্বামী কর্তৃত্ব করবে’ মানে স্বামী কর্তৃত্ব করুক! এইটা ঈশ্বরের আদেশ ও ইচ্ছা। হয়তো আগে তা ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল না তবে এখন তিনি তা চান। স্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করা হল প্রয়োজনীয় ও ভাল বিষয়। এই ব্যাখ্যায় একটি আদর্শ পরিবার কেমন? যেখানে স্বামী কর্তৃত্ব করেন, সিদ্ধান্ত নেন, স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং স্ত্রী তা মেনে নেন।
- ২। ‘স্বামী কর্তৃত্ব করবে’ হল একটি ভবিষ্যৎবাণী: এখন থেকে দেখা যাবে যে পাপী মনের কারণে স্বামীরা এই ধরণের করবে। তা হল পাপ-আক্রান্ত পৃথিবীর একটি বাস্তব বর্ণনা, কিন্তু তা ঈশ্বরের ইচ্ছা নয়! আগেও এই ধরণের তিনি চান নি, এখনও চান না, কিন্তু পাপের কারণে এখন থেকে এই ধরণের বিষয় দেখা যাবে। এই ব্যাখ্যায় একটি আদর্শ পরিবার কেমন? যেখানে কর্তৃত্ব, দমন বা উঁচু-নীচু ভাব কম থাকে, যেখানে স্বামী-স্ত্রী চেষ্টা করে ‘জগতের মত’ না চলতে বরং যতদূর সম্ভব মিলেমিশে সিদ্ধান্ত নিতে ও সংসার চালাতে।
- প্রথম ব্যাখ্যা নিয়ে সমস্যা কি? ঈশ্বর কি আসলে আদিপুস্তক ১ ও ২ অধ্যায় থেকে ৩ অধ্যায় পর্যন্ত তার মন পরিবর্তন করেছেন? ঈশ্বর কি আগে সমতা, ভালবাসা ও পাশাপাশি দাঁড়ানো চেয়েছেন কিন্তু এখন তিনি হঠাৎ করে কর্তৃত্ব, দমন ও উঁচু-নীচু ভাব চান? কেন স্বামীকে কর্তৃত্ব দেওয়া হয় যখন তিনি স্ত্রীর মত পাপ করেছেন? যীশু যখন এসে পাপের ক্ষমা ও পাপের ফলাফল থেকে উদ্ধার অর্জন করেন, তবে পাপের এই ফলাফল কমা উচিত না? গালাতীয় ৩:২৮ পদ বলে ‘স্ত্রীলোক ও পুরুষের মধ্যে কোন তফাৎ নেই, কারণ খ্রীষ্ট যীশুর সংগে যুক্ত হয়ে তোমরা সবাই এক হয়েছ।’
- দ্বিতীয় ব্যাখ্যা নিয়ে সমস্যা কি? যদি ঈশ্বর চান নি যে স্বামীরা কর্তৃত্ব করুক, তবে এই পদ কেন আরো পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেন নি? কেন শতাব্দীর পর শতাব্দীতে পদের ভুল ব্যাখ্যার প্রতিরোধ করেন নি?
- অবশ্যই আমরা কিভাবে পদটি ব্যাখ্যা করি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিবাহ ও পরিবারের বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং আমাদের ব্যবহার তার উপর নির্ভর করবে।
- খেয়াল করুন যে পুরুষকে বা স্ত্রীকে অভিশাপ দেওয়া হয় না, অভিশাপ দেওয়া হয় শয়তানকে ও মাটিকে।
- কেন মাটিকে? হয়তো ঈশ্বর মাটিকে অভিশাপ দেন উর্বরতা কমানোর জন্য, যেন মানুষকে খাবারের যোগানের পিছনে পরিশ্রম দিতে হয়, যেন মন্দ কাজের পিছনের এত সময় দিতে না পারে। তাতে বুঝা যায় যে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ও ভেঙ্গে গেছে।
- এর অর্থ তা না যে আমরা আমাদের মাটির উর্বরতা বা ফসল বাড়ানোর জন্য প্রার্থনা বা প্রচেষ্টা করতে পারিনা। ঈশ্বর চান যেন আমরা তার আশীর্বাদ, প্রজ্ঞা, প্রকাশ ও উদ্ধার আমাদের মাটির উর্বরতা ও আমাদের পরিশ্রমের সফলতার জন্য যাঞ্না করি। তিনি আমাদের এমন আইন ও নীতিমালা দিয়েছেন যাতে আমরা এই পৃথিবীকে উন্নত করতে পারি।
- কিন্তু এখন কি সীমিত রাখা হয়েছে? > মানুষের জীবনের মেয়াদ, উর্বরতা, কৃষিকাজের সফলতা, উৎপাদন, অবসর সময় ও কর্তৃত্ব করার অধিকার। রোমীয় ৮:১৭-২৫ পদে পৌল বর্ণনা করেন যে সম্পূর্ণ সৃষ্টি মানুষের পতনের কারণে ক্ষয়ে সমর্পিত করা হয়েছে, কিন্তুও যে পৃথিবী কল্পনার বাইরে চমৎকার একটি উদ্ধারের ভাগী হবে যখন মানুষকে সম্পূর্ণভাবে উদ্ধার করা হবে।
- পরিবারের ক্ষেত্রে পাপের প্রভাব কি কি? > স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব, কঠোর পরিশ্রম যাতে সন্তানদের সময় দেওয়া আরো কঠিন হবে, বাবা-মায়ের আদর্শ দুর্বল হয়ে যায়। যেহেতু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাস ভাঙ্গা, এখন দেখা যাবে অশান্তিতে বাস, প্রতিযোগিতা, কৌশল খাটানো দ্বারা নিজের ইচ্ছা পূরণ, দমনের প্রচেষ্টা, অভিযোগ ইত্যাদি।
- কেউ কেউ বলে যে পুরুষ ও মহিলার দেহের মিলন ছিল কেবল মাত্র তাদের এদন বাগান থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরে। যৌনতা সুঅবস্থার অংশ ছিল না বরং পাপের অবস্থার অংশ।
- কিন্তু তা কি ঠিক? তার অর্থ হত যে পাপ না করলে মানুষের বাচ্চা হত না। কিন্তু এই কথা তো ঠিক নয়। ঈশ্বর তাদেরকে এদন বাগানে রেখে ফলবান হতে ও সংখ্যা বাড়িয়ে তোলতে বলেছিলেন।
- আদি ২:১৭ পদে ঈশ্বর বলেছিলেন যে ‘যেদিন তুমি তার ফল খাবে সেই দিন নিশ্চয়ই তোমার মৃত্যু হবে’। কিন্তু তারা তো মারা যায় নি? আসলে ঈশ্বর থেকে বিছিন্ন হওয়াই মানে আত্মিক মৃত্যু। এই ক্ষেত্রে তাদের মৃত্যু সাথে সাথে। তা ছাড়া শারীরিক মৃত্যুর নিশ্চয়তাও ঘোষণা করে হয়েছে ‘ধুলাতেই ফিরে যাবে’ (আদি ৩:১৯)। তাই যদিও শারীরিক মৃত্যু ঈশ্বরের দয়ায় দেরী হবে, তাদের মৃত্যু নিশ্চিত।
আদি ৩:১৫ উদ্ধারের প্রতিজ্ঞা
- ‘আমি তোমার ও স্ত্রীলোকের মধ্যে এবং তোমার বংশ ও স্ত্রীলোকের মধ্য দিয়ে আসা বংশের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করব। সেই বংশের একজন তোমার মাথা পিষে দেবে আর তুমি তার পায়ের গোড়ালীতে ছোবল মারবে।’
- শয়তানকে অভিশাপ দেওয়ার সাথে সাথে ঈশ্বর একটি ভবিষ্যৎবাণী দেন: মহিলার বংশে (মানে মানবীয় বংশে) একজন জন্ম নেবেন যিনি সাপ দ্বারা যন্ত্রণা পাবে, কিন্তু যিনি সাপকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে দেবেন। এটা হল বাইবেলে প্রথম মসীহ বা যীশু সম্বন্ধে ভবিষ্যৎবাণী: উদ্ধারকর্তার প্রতিজ্ঞা।
- এমন একটি সময় যখন মানুষ এখনও তাদের পাপ স্বীকার করেন নি বা তার জন্য ক্ষমাও চান নি ঈশ্বর তাঁর দয়ায় একটি অতুলনীয় উদ্ধারের প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করেন!

আদি ৩:২০ দুইজনের জন্য আলাদা নাম
‘আদম তাঁর স্ত্রীর নাম দিলেন হবা (যার মানে ‘জীবন’), কারণ তিনি সমস্ত জীবিত লোকদের মা হবেন।’
দেখা যায় যে পাপ করার আগে পুরুষ ও মহিলার মধ্যে এমন একতা ছিল যে তাদের আলাদা নামও দরকার ছিল না। কিন্তু এখন দুইটি আলাদা নাম দেওয়া হয়, যাতে বুঝা যায় যে তাদের একতা ভেঙ্গে গেছে।
আদি ৩:২১ পাপ ঢেকে দেওয়ার জন্য প্রথম উৎসর্গ
‘আদম ও তাঁর স্ত্রীর জন্য সদাপ্রভু ঈশ্বর পশুর চামড়ার পোশাক তৈরী করে তাঁদের পরিয়ে দিলেন।’
- চামড়ার পোশাক মানে একটি পশু মেরে ফেলেই এই পোশাক তৈরি হয়েছে। মৃত্যু ঈশ্বরের সৃষ্টির অংশ ছিল না, কিন্তু এখন, পাপের পরে, মৃত্যু একটি বাস্তবতা।
- এইভাবে ঈশ্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি দেন: মানুষের পাপ বা লজ্জা ঢেকে দেওয়ার জন্য রক্তপাত আবশ্যক। ঈশ্বর এখানে তাদের জন্য প্রথম উৎসর্গ দেন। ‘পাপ যে বেতন দেয় তা মৃত্যু’ (রোমীয় ৬:২৩) এবং ‘রক্তপাত না হলে পাপের ক্ষমা হয় না’ (ইব্রীয় ৯:২২)। তাই আদি ৩:২১ হল সুসমাচারের একটি ভিত্তিক সত্যের একটি অগ্রীম ছবি। এই ছবি আবারও দেখা যায় যখন মিসরে ১০ম আঘাতে দরজায় মেষের রক্তের কারণে মৃত্যুর দূত পার হয় (যাত্রা ১২ অধ্যায়: নিস্তার পর্ব) এবং আরো বিস্তারিতভাবে দেখানো হবে যখন ঈশ্বর মোশি দ্বারা ইস্রায়েলের উৎসর্গ পদ্ধতি স্থাপন করবেন (লেবীয় ১-৭, গণণা ২৮-২৯)। কিন্তু এইগুলি সব হল কেন্দ্রিক ঘটনার অগ্রীম ছবি: যীশু আমাদের পাপের জন্য ক্রুশে রক্ত ঢেলে মারা যান যেন আমরা পাপের ক্ষমা পাই।