ইফিষীয় মণ্ডলীর লোকেরা যেন খ্রীষ্টেতে তাদের পরিচয় জানে এবং তারা তাদের এই চমৎকার আহবানের উপযুক্ত জীবন-যাপন করে, এইজন্য পৌল তাদের কাছে এই চিঠি লেখেন।
প্রেরিত পৌল রোমে তার হালকা বন্ধনে থেকে চারটি চিঠি লেখেন (‘জেলখানার চিঠিগুলি’): ফিলিপীয়, কলসীয়, ফিলীমন এবং সাথে ইফিষীয় চিঠি (ইফি ১:৩, প্রেরিত ২৮:৩০-৩১)।
পৌলের সহকর্মী প্রিষ্কিল্লা ও আকিলার মাধ্যমে প্রায় ৫২ খ্রীষ্টাব্দের দিকে ইফিষীয় মণ্ডলী স্থাপিত হয়। অতি শীঘ্রই পৌল তার তৃতীয় প্রচার যাত্রায় তাদের সাথে যোগ দেন এবং প্রায় তিন বছর সেখানে অবস্থান করেন (৫৩-৫৬ খ্রীঃ, প্রেরিত ২০:৩১)। পৌল সে সময়ে ইফিষ শহরকে তার পরিচর্যার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করেন (প্রেরিত ১৯:৮-১০)। তিনি ইফিষে প্রচার করেন, বিস্তারিতভাবে শিক্ষা দেন, শিষ্যত্ব করেন এবং নতুন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেন। হতে পারে তিনি সে সময়ে রোম রাজ্যের এশিয়া মাইনর প্রদেশের এশিয়া জেলায়, অর্থাৎ ইফিষ শহরের আশেপাশের এলাকা ভ্রমণ করেন (আজকের তুর্কী দেশ)।
ইফিষ একটা খুব বড় ও প্রভাবশালী শহর ছিল যেখানে বিশ্বাসীদের জন্য অনেক আত্মিক চ্যালেঞ্জ বা চাপ ছিল: গ্রীক দেবতা পূজা, যাদু-বিদ্যা, গুপ্ত ভ্রান্ত দল, যিহুদী জনসংখ্যা ও গ্রীক দর্শন।
পৌল তার চিঠির শুরুতে একটা লম্বা বাক্যের দ্বারা বিশ্বাসীদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, ঈশ্বর যীশুর মধ্যে দিয়ে তাদের জন্য কত আশ্চর্য কিছু দান করেছেন (ইফি ১:৩-১৪): ঈশ্বর খ্রীষ্টের সঙ্গে যুক্ত করে তাদের স্বর্গের প্রত্যেকটি আত্মিক আশীর্বাদ দান করেছেন, জগত সৃষ্টি করার আগে তাদের পবিত্র ও নিখুঁত হওয়ার জন্য বেছে নিয়েছেন, তাঁর নিজের সন্তান হিসাবে তাদের গ্রহণ করেছেন, তাঁর অশেষ দয়া দান করেছেন, তাঁর রক্তের দ্বারা উদ্ধার করেছেন, তাদের পাপের ক্ষমা দিয়েছেন, তাঁর গুপ্ত উদ্দেশ্য তিনি তাদের জানিয়েছেন, তাদের পবিত্র আত্মা দিয়ে সীলমোহর করে রেখেছেন এবং সময় পূর্ণ হলে পর তিনি তার উদ্দেশ্য কার্যকর করে স্বর্গের ও পৃথিবীর সব কিছু মিলিত করে খ্রীষ্টের শাসনের অধীনে আনবেন। তিনি বিশ্বাসীদের জন্য দুটি শক্তিশালী প্রার্থনা করেন যেন তারা এই সব বুঝে ও জেনে বৃদ্ধি পায় (ইফি ১:১৭-১৯, ইফি ৩:১৪-২১)।
পৌল তাদের পরিত্রাণের নিশ্চয়তা দেন। আগে তাদের জীবন কেমন ছিল (ইফি ২:১-৩) এবং এখন যীশুর দ্বারা তারা কি হয়েছে, তার মধ্যে তিনি তুলনা করেন (ইফি ২:৪-৭): এখন তারা খ্রীষ্টের সাথে জীবিত ও সাথে পুনরুত্থিত এবং তারা তাঁর সাথে স্বর্গীয় স্থানে বসে আছে। তিনি তাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে এই সমস্ত কিছু তারা যীশুর দয়া দ্বারা পেয়েছে, তাদের নিজের প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ নেওয়ার মধ্য দিয়ে পায় নি। কিন্তু সে দয়া দ্বারা তাদের জীবনের পরিবর্তনও ঘটা দরকার এবং তাদের জীবন ফলবানও হতে হবে (ইফি ২:৮-১০)।
যীশুর সে দয়াও হল যিহুদী ও অযিহুদীদের মধ্যে একতার ভিত্তি: “তিনিই আমাদের শান্তি”, তিনি দুইজনের মধ্যে সে শত্রুতার ভাব, সেই “দেওয়াল” ভেঙ্গে ফেলেছেন (ইফি ২:১৪)। তাই তিনি যিহুদী ও অযিহুদী উভয়কে ঈশ্বরের রাজ্যের নাগরিক এবং তাঁর পরিবারের লোক করেছেন (ইফি ২:১৯)। যিহূদী ও অযিহূদী উভয়কে গ্রহণ করা এবং তাদের মধ্যে সেই একতাকে পৌল ঈশ্বরের “গুপ্ত উদ্দেশ্য” বা “নিগূঢ়তত্ত্ব” বলেন, যা আগের যুগে লুকানো ছিল, কিন্তু এখন প্রকাশিত এবং সকলের কাছে প্রচারিত (ইফি ৩:৩-৬)।
এই আশ্চর্য সুসমাচার ও সর্বোচ্চ আহবানে যোগ্যভাবে জীবন-যাপন করতে পৌল তাদের উৎসাহিত করেন, এমন একটি জীবন যাতে “কেবল একটাই আশা আছে, একটাই দেহ আছে, একজনই পবিত্র আত্মা আছেন, একজনই প্রভু আছেন, একই বিশ্বাস আছে, একই বাপ্তিস্ম আছে আর সকলের ঈশ্বর ও পিতা মাত্র একজনই আছেন” (ইফি ৪:১-৬)। ঈশ্বর তার লোকদের অনেক ভিন্ন ভিন্ন ধরণের দান ও ভিন্ন ভিন্ন কাজের ভূমিকা দিয়েছেন (ইফি ৪:৭, ৪:১১), কিন্তু এইগুলি সব দেওয়া হয়েছিল যেন বিশ্বাসীরা পরস্পরকে সেবা করে এবং পরিচর্যার জন্য পরস্পরকে প্রস্তুত করতে পারে (ইফি ৪:১২)।
প্রত্যেকদিনের কাপড় পড়ার অভ্যাসের বিষয়টি পৌল রূপকভাবে ব্যবহার করেন, বুঝানোর জন্য যে, বিশ্বাসীর দৈনিক পুরাতন স্বভাব ত্যাগ করতে হবে এবং নতুন স্বভাব গ্রহণ করতে হবে (ইফি ৪:২২-২৪): মিথ্যা ছেড়ে দেওয়া (ইফি ৪:২৫), বিরক্তি প্রকাশ, মেজাজ দেখানো, চিৎকার করে ঝগড়াঝাঁটি, গালাগালি আর সব রকম হিংসা দূর করা (ইফি ৪:৩১), লোভ ছেড়ে দেওয়া (ইফি ৫:৫); ঈশ্বরের সমস্ত যুদ্ধের সাজ-পোশাক পড়া (ইফি ৬:১১) এবং সৎ জীবন দিয়ে বুক ঢাকা (ইফি ৬:১৪)। তিনি বিশ্বাসীদের সৎ কাজ করতে ও দানশীল হতে (ইফি ৪:২৮), ভাল ও উপকারী কথা বলতে (ইফি ৪:২৯), পবিত্র আত্মা দ্বারা পরিচালিত হতে, তাঁর অধীনে থাকতে, গীত সংহিতার গান, প্রশংসা ও আত্মিক গান করতে (ইফি ৫:১৮-১৯), সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে (ইফি ৫:১৬), এবং একজন অন্যজনের বশীভূত হতে (ইফি ৫:২১), তা বিবাহের ক্ষেত্রে হোক (ইফি ৫:২২-২৩) বা পরিবারের ক্ষেত্রে হোক (ইফি ৬:১-৩) অথবা মনিব ও দাসের ক্ষেত্রে হোক (ইফি ৬:৫-৮)। তিনি তাদের প্রার্থনাশীল জীবন-যাপন করতে বলেন যেন ঈশ্বর যা দিয়েছেন তাতে তারা স্থিরভাবে ও শক্তিশালীভাবে দাঁড়াতে পারে (ইফি ৬:১০-২০)।
ইফিষীয় চিঠির লেখক ও প্রাপক
পৌল ইফিষীয় চিঠিটি জেলখানা থেকে লেখেন (ইফি ১:১৩), হতে পারে অন্যান্য ‘জেলখানার চিঠি’ (ফিলিপীয়, কলসীয়, ফিলীমন) লেখার সময়ে তিনি এই চিঠিও লেখেন। এই চারটি চিঠির মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিল পাওয়া যায়: পৌল চারটি চিঠিতেই উল্লেখ করেন যে তিনি জেলে আছেন; এই চিঠিগুলির বাহক একজনই (তুখিক, ইফি ৬:২১, কল ৪:৭); পৌলের সঙ্গে প্রায় একই লোকজন দেখা যায় যারা পাঠকদের জন্য শুভেচ্ছা পাঠান; উল্লিখিত বিষয়বস্তুর মিল আছে (ইফিষীয়, কলসীয়) এবং পৌল শীঘ্রই জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা প্রকাশ করেন (ইফি ২:২৪; ফিলীমন ২২)। ফিলিপীয় চিঠি থেকে বেশ নিশ্চিতভাবে বুঝা যায় যে পৌল বর্তমানে বন্দি হিসাবে রোম শহরে জেলে আছেন (ফিলিপীয় ১:১৩, ৪:২২), যা ‘হালকা-বন্ধন’ বলা হত এবং যার বর্ণনা প্রেরিত পুস্তকে দেওয়া আছে (প্রেরিত ২৮:৩০-৩১)। তাই বুঝা যায় যে চিঠি লেখার তারিখ কমবেশি ৬২ খ্রীষ্টাব্দ।
এই চিঠির সবচেয়ে পুরাতন দলিলগুলিতে (manuscripts) ইফি ১:১ পদে “ইফিষীয়” শব্দটির উল্লেখ নেই, কিন্তু সেখানে একটি ফাঁকা জায়গা পাওয়া যায়। তাই সম্ভবতঃ ইফিষীয় চিঠি ছিল একটি ভ্রাম্যমাণ চিঠি (circular letter) যা হতে পারে বিভিন্ন মণ্ডলীতে পাঠানো হয়েছিল অথবা চিঠিটি কপি করে বিভিন্ন মণ্ডলীর নাম ফাঁকা স্থানে বসিয়ে তাদের কছে পাঠানো হয়েছিল।
ইফিষীয় মণ্ডলীর স্থাপন
সম্ভবতঃ পৌলের সহকর্মী প্রিষ্কিল্লা ও আকিল্লার মাধ্যমে ৫৩ খ্রীঃ এর দিকে ইফিষীয় মণ্ডলী স্থাপন হয় যখন পৌল তাঁর মিশনারী যাত্রার শেষে তাদের ইফিষ শহরে রেখে যিরুশালেমের উদ্দেশ্যে রওনা হন (প্রেরিত ১৮:১৮-২২)। পৌল শীঘ্রই তার ৩য় মিশনারী যাত্রায় বের হন এবং তাড়াতাড়ি সেই ইফিষ শহরে ফিরে আসেন এবং কমবেশি আড়াই বছর থাকেন। পৌল ইফিষ মণ্ডলীকে তার পরিচর্যার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করেন (প্রেরিত ১৯:৮-১০) সেখানে প্রচার করেন, ব্যাপকভাবে শিক্ষা দেন, শিষ্য তৈরি করেন, কার্যকারীদের প্রশিক্ষণ দেন এবং সম্ভবত সেখান থেকেই তিনি এশিয়া প্রদেশের চারপাশে ভ্রমণ করেন। শুধুমাত্র ইফিষীয় মণ্ডলীই স্থাপিত হয় না কিন্তু কলসীয়, লায়দিকীয়া, হিয়ারাপলি, পর্গাম, থুয়াতীরা, সার্দী, ফিলাদিলফিয়া এবং আরও অনেক মণ্ডলী সে সময় স্থাপিত হয়।
ইফিষে থাকার সময় পৌলের পরিচর্যায় অনেক লক্ষণীয় ঘটনা ঘটে : অসাধারণ আশ্চর্য কাজ ঘটে (সুস্থতা দান ও মন্দ আত্মা তাড়ানো উভয় ক্ষেত্রে, প্রেরিত ১৯:১১-১২, ১৯:১৩-১৭), অনেকেই দেবতা-পূজা ছেড়ে যীশুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে (প্রেরিত ১৯:১৮-২০), স্থানীয় মূর্তিপূজা ব্যবসার ক্ষতি হয় (প্রেরিত ১৯:২৩-২৭), বিরোধী লোকেরা উঠে আসে, ফলে হট্টগোল হয় (প্রেরিত ১৯:২৮-৪১) এবং সম্ভবত কিছু কারণে পৌলকে জেলে যেতে হয় (২ করি ১১:২৩-২৪)। পৌলের জন্য এই সময় যেমন অনেক সফলতার ছিল তেমন বিভিন্ন রকম চাপেরও ছিল (২ করি ১:৮-১০)।
ইফিষ একটা বড় শহর ও প্রতিমাপূজার কেন্দ্র ছিল। স্থানীয় আর্তেমিস (ল্যাটিন: দিয়ানা) মন্দির তখনকার সময়ে বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একটা ছিল। ইফিষ শহরকে একটি “আত্মিক চিড়িয়াখানা” বা “আত্মিক দূর্গ” বলা যায়: যিহুদী লোকে পূর্ণ, গ্রীক প্রতিমাপূজার রাজত্ব, অকাল্টিসিসম, যাদুবিদ্যা, রহস্যময় ভ্রান্ত শিক্ষা ও গ্রীক দর্শন খ্রিষ্টান বিশ্বাসীদের উপর চাপ দিচ্ছিল।
খ্রীষ্টেতে আমাদের পরিচয়
গ্রীক ভায়ায় ইফি ১:৩-১৪ পদগুলি হল একটি লম্বা বাক্য (একটাও দাড়ি নেই)! বাক্যটিতে যীশুর মধ্যে দিয়ে বিশ্বাসীদের জন্য ঈশ্বর যে সকল আশ্চর্য আশ্চর্য কাজ করেছেন, পৌল তার একটি চমৎকার বর্ণনা দেন: ঈশ্বর আমাদের যীশুর মধ্য দিয়ে …
ইফি ১:৩ … প্রত্যেকটি আত্মিক আশীর্বাদ দান করেছেন।
ইফি ১:৪ … পৃথিবী সৃষ্টির আগেই আমাদের মনোনীত করেছেন।
ইফি ১:৪ … পবিত্রতা ও নিখঁত হওয়ার জন্য মনোনীত করেছেন।
ইফি ১:৫ … ঈশ্বরের খুশি হয়ে নিজের ইচ্ছায় ও তাঁর সন্তান হিসাবে গ্রহণ করেছেন।
ইফি ১:৬ … তা তাঁর মহিমাফপূর্ণ দয়ায় বিনামূল্যে দান করেছেন।
ইফি ১:৭ … যুক্ত হয়ে তাঁর রক্তের দ্বারা মুক্তি বা পুনরুদ্ধার দিয়েছেন।
ইফি ১:৭ … তাঁর অশেষ দয়ায় পাপের ক্ষমা দিয়েছেন।
ইফি ১:৮ … তাঁর দয়ায় তাঁর মহা জ্ঞান ও বুদ্ধি খোলা হাতে দিয়েছেন।
ইফি ১:৯ … যেমন চেয়েছিলেন এবং খ্রীষ্টের মধ্য দিয়ে আগেই স্থির করে রেখেছিলেন তিনি তাঁর গুপ্ত উদ্দেশ্য আমাদের জানিয়েছেন।
ইফি ১:১০ … সময় পূর্ণ হওয়ার পর সেই উদ্দেশ্য কার্যকর করবার জন্য তিনি স্বর্গের ও পৃথিবীর সব কিছু মিলিত করে খ্রীষ্টের শাসনের অধীনের আনবেন।
ইফি ১:১১-১২ … তাঁর নিজের লোক হবার আমাদের বেছে নিয়েছেন তাঁর বিচারবুদ্ধি… এবং উদ্দশ্য অনুসারে আগেই যা ঠিক করে রেখেছিলেন সেই মাতই ।
ইফি ১:১২ … আমাদের বেছে নিয়েছিলেন যেন আমরা যারা আগেই খ্রীষ্টের উপর আশা রেখেছি আমাদের মধ্য দিয়ে যেন ঈশ্বরের মহিমার প্রশংসা হয়।
ইফি ১:১৩ … প্রতিজ্ঞাত পবিত্র আত্মা দ্বারা আপনাকে সীলমোহর করা হয়েছে, উদ্ধারের জন্য উত্তরাধিকারের প্রতিজ্ঞা।
পৌল জোড় দিয়ে বলেন যে, পৃথিবী সৃষ্টির আগেই ঈশ্বর তাঁর ইচ্ছা অনুসারে এই সমস্ত কিছু করেছেন (ইফি ১:৩), নিজের ইচ্ছাঅনুসারে (ইফি ১:৫), সময় পূর্ণতায় তাঁর পরিকল্পনা (ইফি ১:১০) এবং তাঁর উদ্দেশ্য ও ইচ্ছা অনুসারে সব কিছু করেছেন (ইফি ১:১০)। ঈশ্বরের উদারতা, তাঁর খোলা হাতে ও আনন্দপূর্ণ দান দেওয়ার মনোভাব পৌল সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন।
ঈশ্বরের সার্বভৌমতা বনাম মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা
ইফি ১:১১ বলে যে, “ঈশ্বর তাঁর বিচারবুদ্ধি অনুসারে নিজের ইচ্ছামতই সব কাজ করেন। তাঁর উদ্দেশ্য অনুসারে তিনি আগেই যা ঠিক করে রেখেছিলেন সে ইমতই খ্রীষ্টের মধ্য দিয়ে তাঁর নিজের লোক হবার জন্য তিনি আমাদের বেছে নিয়েছেন”। এই পদের কারণে খ্রীষ্টান মতবাদে একটি বড় ও বহুদিনের তর্ক হয়েছে: ঈশ্বর যদি তাঁর সার্বভৌমতায় সব কিছু ঠিক করেছেন, কে তাঁর লোক হবে তাও ঠিক করে রেখেছেন তবে মানুষের তাহলে সিদ্ধান্ত বা স্বাধীন ইচ্ছা নেই? এবং যদি স্বাধীন ইচ্ছা না থাকে তবে কেন ঈশ্বর মানুষের দোষ ধরেন? এক কথায়: ঈশ্বরের সার্বভৌমতা বনাম মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা।
উত্তরে কি বলা যায়? বাইবেল পরিষ্কারভাবে শিক্ষা দেয় যে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সার্বভৌম, সম্পূর্নভাবে সক্ষম এবং অসীম ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু বাইবেল একই সময়ে পরিষ্কারভাবে শিক্ষা দেয় যে মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা দেওয়া হয়েছে এবং যে ঈশ্বর মানুষকে তার সিদ্ধান্ত ও আচরণের ভিত্তিতে বিচার করবেন। মানুষের সিদ্ধান্ত আছে বলে তার দোষ ও দায়বদ্ধতাও আছে। ঈশ্বর মানুষের হৃদয়কে নিয়ন্ত্রণ করেন না কিন্তু মানুষের সেই হৃদয়ের জন্যই ঈশ্বর অতি আগ্রহী। তাহলে বলা যায় যে ঈশ্বর তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করতে অবশ্যই সক্ষম, কিন্তু তিনি আমাদের জানিয়েছেন তাঁর ইচ্ছা কি: তিনি চান মানুষ যেন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ঈশ্বর মানুষকে যে স্বাধীনতা দিয়েছেন তা তিনি কোনভাবে বাতিল করবেন না।
ঈশ্বরের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা হলে এই: যেন সম্পূর্ণ স্বাধীনতায় মানুষ ঈশ্বরের মঙ্গলময়তা বুঝে হৃদয়ের গভীর থেকে তাঁকে পছন্দ করে বাধ্য হবে। কিন্তু অবশ্যই সবাই স্বেচ্ছায় তা করতে রাজি না। ঈশ্বরের দয়ার কোনো সীমা নেই, কিন্তু অনেক মানুষের অনুতাপ সীমাবদ্ধ। “অনেক লোককে ডাকা হয়েছে কিন্তু অল্প লোককেই বেছে নেওযা হয়েছে” (মথি ২২:১৪)। অনেকে এই পদ উদ্ধৃতি করে দাবি করে যে ঈশ্বর শুধুমাত্র অল্প লোকদের বেছে নেন – কিন্তু এই ব্যাখ্যা ঠিক নয়। এই পদটি আসলে বিয়ের ভোজের দৃষ্টান্তের শেষ পদ। ভোজের কর্তা সবাইকে নিমন্ত্রিন করেন কিন্তু অনেকে আসতে রাজি ছিল না। তাই এমন না যে ঈশ্বর ইচ্ছুক হৃদয়ের মানুষকে প্রত্যাখান করেন বরং অনেক মানুষ তাঁর নিমন্ত্রনের প্রত্যাখান করে এবং এভাবে নিজের কারণে বাদ পরে।
খ্রীষ্টেতে বিশ্বাসীর পরিচয় এই চমৎকার পদগুলির শেষে পৌল একটি চমৎকার প্রার্থনা করেন যেন তারা আরো গভীরভাবে বুঝতে পারে ঈশ্বর তাদের জন্য যা কিছু করেছেন ( ইফি ১:১৭-১৯ এবং ইফি ৩:১৪-২১)।
পরিত্রাণের নিশ্চয়তা
পৌল তাদের পরিত্রাণের নিশ্চয়তা দেন। তিনি বর্ণনা করেন তাদের আগে যে রকম মন-মনোভাব ছিল: পাপ-স্বভাবের কামনা পূর্ণ করা একটি জীবন, অবাধ্য ও জগতের পথে চলাফেরা, দুষ্ট আত্মার অধীনে, ক্রোধের সন্তান (ইফি ২:১-৩)। কিন্তু এখন – খ্রীষ্টের মধ্য দিয়ে তারা কে হয়েছে: খ্রীষ্টের সাথে জীবিত, তাঁর সাথে পুনরুত্থিত এবং স্বর্গীয় স্থানে তাঁর সাথে বসা। পৌল তাদের মনে করিয়ে দেন যে “ঈশ্বরের দয়ায় বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে তোমরা পাপ থেকে উদ্ধার পেয়েছ। এটা তোমাদের নিজেদের দ্বারা হয় নি, তা ঈশ্বরেরই দান” (ইফি ২:৮)। কিন্তু পরিত্রাণ পাওয়ার ফলে আমাদের একটি ভিন্ন ধরণের জীবন দরকার: “আমরা ঈশ্বরের হাতের তৈরী। ঈশ্বর খ্রীষ্ট যীশুর সংগে যুক্ত করে আমাদের নতুন করে সৃষ্টি করেছেন যাতে আমরা সৎ কাজ করি। এই সৎ কাজ তিনি আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন, যেন আমরা তা করে জীবন কাটাই” (ইফি ২:১০)।
দয়ার দ্বারাই একতা
পৌল অযিহূদী থেকে বিশ্বাসীদের মনে করিয়ে দেন যে তারা এক সময় ছিল সুন্নত-না-করানো লোক, খ্রীষ্টের কাছ থেকে আলাদা বা দূরে, ইস্রায়েল জাতির অধিকারের এবং প্রতিজ্ঞার ব্যবস্থার বাইরের লোক; কোনো সম্বন্ধ বা আশা ছিল না (ইফি ২:১১-১২, ২:১৭)। কিন্তু এখন খ্রীষ্টের রক্তের দ্বারা তাদের কাছে নিয়ে আসা হয়েছে, তারা আর দূরে বা বিজাতীয় নয় বরং তারা ঈশ্বরের আপন লোক হয়েছে, রাজ্যের নাগরিক এবং ঈশ্বরের পরিবারের সদস্য (ইফি ২:১৩, ১৯)।
পৌল জোড়ালো ভাবে দেখান যে যিহুদী এবং অযিহূদীদের একতার ভিত্তি ঠিক খ্রীষ্টের দয়া যা তারা উভয় পেয়েছে: “তিনিই আমাদের শান্তি। যিহূদী ও অযিহূদী, এই দুইকে তিনিই এক করেছেন। তিনি তাঁর ক্রুশে দেওয়া দেহের মধ্য দিয়ে সমস্ত আদেশ ও নিয়ম সুদ্ধ মোশির আইন-কানুনের শক্তিকে বাতিল করেছেন। এইভাবেই যে শত্রুতার ভাব এই দু’য়ে র মধ্যে দে ওয়ালের মত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তা তিনি ভেঙ্গে ফেলেছেন” (ইফি ২:১৪)। “তিনি এটা করেছিলেন যেন এই দু’টিকে দিয়ে তিনি নিজেই একটি নতু ন মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন, আর এইভাবেই যেন সেই দু’য়ে র মধ্যে শান্তি হয়। এটাও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যে, তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই দু’টিকে তিনি এক দেহে ঈশ্বরের সংগে আবার মিলিত করেন, কারণ এই দু’য়ে র মধ্যে যে শত্রুতার ভাব ছিল তা তিনি তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যু র দ্বারা ধ্বংস করেছেন” (ইফি ২:১৫-১৬)। “তোমরা যারা দূরে ছিলে এবং তারা যারা কাছে ছিল, সকলের কাছেই তিনি এসে শান্তির সুখবর প্রচার করেছিলেন। তাঁরই মধ্য দিয়ে একই পবিত্র আত্মার দ্বারা পিতার কাছে যাবার অধিকার আমাদের সকলের আছে” (ইফি ২:১৭-১৮)। যীশুর মধ্য দিয়েই তা হয়েছে: “তোমরা তাঁরই সংগে যুক্ত হয়েছ এবং সে ইজন্য তোমাদেরও একসংগে গেঁথে তোলা হচ্ছে, যেন পবিত্র আত্মার মধ্য দিয়ে তোমরা ঈশ্বরের থাকবার জায়গা হতে পার” (ইফি ২:২২)।
রহস্য প্রকাশিত
গ্রীক দার্শনিকরা এবং গুপ্ত ভ্রান্ত দলগুলি উভয় কিছু শব্দ আকর্ষণীয় বলে পছন্দ করত, যেমন ‘গুপ্ত’, ‘রহস্য’, ‘জ্ঞান’ ‘স্বর্গ’ বা ‘স্বর্গীয় স্থানের শাসনকর্তারা’। তাই পৌল ইফিষীয় চিঠিতে এই আকর্ষণীয় শব্দগুলিও ব্যবহার করেন, কিন্তু অন্যভাবে কাজে লাগান। তিনি ‘গুপ্ত জ্ঞান’ শব্দ মুখে নেন, কিন্তু তিনি তা দিয়ে সুখবর বুঝান এবং বলেন যে সবার কাছে‘রহস্য জানানো হয়েছে’ (ইফি ৩:৩) এবং ‘রহস্য এখন প্রকাশিত হয়েছে’ (ইফি ৩:৫)। রহস্যটা কি? পোল বলেন যে তা হল “সেই গুপ্ত উদ্দেশ্য হল এই-সুখবরের মধ্য দিয়ে অযিহূদীরা খ্রীষ্ট যীশুর সংগে যুক্ত হয়ে যিহূদীদের সংগে একই সুযোগের অধিকারী হবে, একই দে হের অংশ হবে, আর একই প্রতিজ্ঞা করা আশীর্বাদের ভাগী হবে” (ইফি ৩:৬)।
তিনি বলেন যে, “ঈশ্বরের সমস্ত লোকদের মধ্যে আমার চে য়ে নীচু আর কেউ , তবুও খ্রীষ্টের যে সম্পদের কথা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারা যায় না, অযিহূদীদের কাছে সে ই সম্পদের সুখবর জানাবার কাজ ঈশ্বর দয়া করে আমাকেই দিয়েছেন। এছাড়া তাঁর গুপ্ত উদ্দেশ্য যে কিভাবে কাজে লাগানো হবে তা প্রকাশ করবার ভারও তিনি আমার উপর দিয়েছেন। সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর এত কাল ধরে তাঁর সে ই উদ্দেশ্য গুপ্ত রে খেছিলেন। তিনি তা করেছিলেন যেন খ্রীষ্টের মণ্ডলীর মধ্য দিয়ে স্বর্গের সমস্ত শাসনকর্তা ও ক্ষমতার অধিকারীদের কাছে বিভিন্নভাবে প্রকাশিত ঈশ্বরের জ্ঞান এখন প্রকাশ পায়” (ইফি ৩:৮-১০)। আমাদের ঈশ্বর কেমন!
আত্মিক বাহিনী
পৌল অদৃশ্য বাস্তবতা অথবা আত্মিক শাসন, ক্ষমতা বা শক্তির বিষয়ে এই চিঠিতে কথা বলেন। এই আত্মিক ক্ষমতাগুলি বা কি? পৌল এই বিষয়ে যে শব্দগুলি ব্যবহার করোন, তা নিয়ে নীচে একটি স্টাডি বা অনুবাদ দেওয়া হল:
চার্ট
কোন ক্ষেত্রে ব্যবহারিত
সম্ভাব্য অনুবাদ
ষ্ট্রংগ্স # G 746 Principality। বাংলা: শাসন, স্বর্গের শাসনকর্তা, অন্ধকার রাজ্যের শাসনকর্তা। গ্রীক: Arche। ৫৬ বার নতুন নিয়মে, ৩ বার ইফিষীয়তে (ইফি ১:২১, ৩:১০, ৬:১২)। ব্যবহার: সময়ের জন্য ব্যবহার হয়েছে, রাজনৈতিক কার্যালায়, আত্মিক শক্তি। সম্ভাব্য অনুবাদ: “প্রধান, শুরু, প্রথম, শাসক, ক্ষমতা”।
ষ্ট্রংগ্স # G 1849 Power। বাংলা: ক্ষমতা, ক্ষমতার অধিকারী। গ্রীক: Exousia। ৯৩ বার নতুন নিয়মে, ৪ বার ইফিষীয়তে (ইফি ১:২১, ২:২, ৩:১০, ৬:১২)। ব্যবহার: যীশু, ঈশ্বর, আত্মিক নেতা, রাজনৈতিক কার্যালায়, আত্মিক শক্তির জন্য ব্যবহার হয়েছে। সম্ভাব্য অনুবাদ: কর্তৃত্ত্ব, সামর্থ্য, প্রভুত্ব, প্রভাব, বিচারব্যবস্থা, বিশেষ সুযোগ, শক্তি, ক্ষমতা, সক্ষমতা, স্বাধীনতা, ক্ষমতাবান ব্যক্তি, নিয়ন্ত্রণ, স্বাধীনতা।
ষ্ট্রংগ্স # G 1411 Might। বাংলা: শক্তি। গ্রীক: “Dunamis”। ১১৬ বার নতুন নিয়মে, ৫ বার ইফিষীয় (ইফি ১:১৯, ১:২১, ৩:৭, ৩:১৬, ৩:২০)। ব্যবহার: মন্দ শক্তির জন্য একবার, ঈশ্বর সম্পর্কে ৪ বার ব্যবহার হয়েছে। সম্ভাব্য অনুবাদ: শক্তি, সামর্থ্য, প্রতাপ, শক্তি, অলৌকিক, সহিংসতা।
ষ্ট্রংগ্স # G 2888 Rulers। বাংলা: শক্তিশালী আত্মা। গ্রীক: Cosmocrator। ১ বার নতুন নিয়মে, ১ বার ইফিষীয়তে (ইফি ৬:১২)। সম্ভাব্য অনুবাদ: জগতের শাসক, শয়তান
ষ্ট্রংগ্স # G 2963 Dominion। বাংলা: কর্তৃত্ব। গ্রীক: Kuirotes। ৪ বার নতুন নিয়মে, ১ বার ইফিষীয়তে (ইফি ১:২১)। ব্যবহার: আত্মিক শক্তির জন্য দুইবার, দুই বার স্ব-নিয়ন্ত্রণ/বশীভূত হওয়ার অভাবের জন্য। সম্ভাব্য অনুবাদ: প্রভুত্ব, শাসক, রাজত্ব, সরকার।
ষ্ট্রংগ্স # G 4189 Wickedness। বাংলা: মন্দ আত্মা। গ্রীক: Poneria। ৭ বার নতুন নিয়মে, ১ বার ইফিষীয়তে (ইফি ৬:১২)। ব্যবহার: এখানে ব্যক্তি হিসেবে লেখা আছে কিন্তু আত্মিক। সম্ভাব্য অনুবাদ: দুষ্টতা, দুরাচার, আক্রোশ, ষড়যন্ত্র, অন্যায়।
ষ্ট্রংগ্স # G 758 Prince। বাংলা: অধিপতি। গ্রীক: Archon। ৩৭ বার নতুন নিয়মের, ১ বার ইফিষীয়তে (ইফি ২:২)। ব্যবহার: আত্মিক শক্তিগুলো, আত্মিক নেতা, রাজনৈতিক নেতার জন্য। সম্ভাব্য অনুবাদ: প্রথমত: পদমর্যদা হিসেবে, প্রথম ক্ষমতা, প্রধান, শাসক, ম্যাজিষ্ট্রেট;
মনে হচ্ছে পৌল এই ক্ষমতাগুলি উল্লেখ করেন না, তাদের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য, ভূমিকা বা পদ-মর্যাদা বুঝানোর জন্য বরং তিনি যতগুলি পারেন উল্লেখ করেন ইফিষীয়দের দেখানোর জন্য, যা কিছু থাকুক না কেন (অথবা ইফিষীয়রা যা কিছু নিয়ে ভয় পাক না কেন) যীশু তার চেয়ে অনেক মহান। পৌল আত্মিক ক্ষমতাগুলির দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে চান না, তিনি যীশুর দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট করেন, যীশু, যিনি সব ক্ষমতার অধিকারী: “যার দ্বারা তিনি মৃত্যু থেকে খ্রীষ্টকে জীবিত করে তুলেছেন এবং স্বর্গে তাঁর ডান দিকে বসিয়েছেন। মহাকাশে যাদের হাতে সমস্ত শাসন, ক্ষমতা, শক্তি এবং কর্তৃত্ব রয়েছে তাদের তিনি খ্রীষ্টের অধীন করেছেন। আর যাকে যে নামই দে ওয়া হোক না কেন, তা সে এই যুগেই হোক কিম্বা আগামী যুগেই হোক, সব নামের উপরে খ্রীষ্টের নাম। ঈশ্বর সব কিছু খ্রীষ্টের পায়ের তলায় রে খেছেন এবং তাঁকে সব কিছুর অধিকার দিয়েছেন, আর তাঁকেই মণ্ডলীর মাথা হিসাবে নিযুক্ত করেছেন” (ইফি ১:২০-২২)।
পৌল আত্মিক ক্ষমতাগুলি যে বাস্তব, তা তিনি অস্বীকার করেন না, আসলে তিনি ইফিষীয়দের ক্ষেত্রে বলেন যে পরিত্রাণ পাওয়ার আগে “জগতের চিন্তাধারা অনুসারে তোমরাও এক সময় সেই অবাধ্যতা আর পাপের মধ্যে চলাফেরা করতে। যে আত্মা আকাশের ক্ষমতাশালীদের রাজা সেই দুষ্ট আত্মা ঈশ্বরের অবাধ্য লোকদের মধ্যে কাজ করছে, আর তোমরা সেই আত্মার পিছনে পিছনে চলতে” (ইফি ২:২)। কিন্তু এখন, বিশ্বাসী হিসাবে, তারা এই ধরণের ক্ষমতার অধীনের আর নয়, বরং তাদের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ করতে সক্ষম: “আমাদের এই যুদ্ধ তো কোন মানুষের বিরুদ্ধে নয়, বরং তা অন্ধকার রাজ্যের সব শাসনকর্তা ও ক্ষমতার অধিকারীদের বিরুদ্ধে, অন্ধকার জগতের শক্তিশালী আত্মাদের বিরুদ্ধে, আর আকাশের সমস্ত মন্দ আত্মাদের বিরুদ্ধে” (ইফি ৬:১২)।
পৌল তাদেরকে “মন্দ আত্মাবিদ্যা শিক্ষা” দিতে চান এমন নয়, বরং পৌল চান যেন ইফিষীয়রা এই ধরনের আত্মিক ক্ষমতাগুলি নিয়ে সচেতন হয় কিন্তু যেন কোন রকম ভয় না পায়। এমন কি পৌল বলেন যে মণ্ডলী বা বিশ্বাসীরাই ঈশ্বরের প্রজ্ঞা এই ক্ষমতাদের দেখায়: “তিনি তা করেছিলেন যেন খ্রীষ্টের মণ্ডলীর মধ্য দিয়ে স্বর্গের সমস্ত শাসনকর্তা ও ক্ষমতার অধিকারীদের কাছে বিভিন্নভাবে প্রকাশিত ঈশ্বরের জ্ঞান এখন প্রকাশ পায়” (ইফি ৩:১০)। মণ্ডলীর মধ্যে দিয়েই কিছু একটা প্রদর্শিত হয়, যা ক্ষমতাগুলি বুঝেও নি… এবং পছন্দও করে না।
আত্মিক ক্ষমতাগুলোর ক্ষেত্রে বিশ্বাসীদের কি ভূমিকা আছে?
ইফি ৬:১২ মানুষ সমস্যা নয় বরং মানুষের পাপ, দুষ্টতা, হিংস্রমা ও মানুষের পিছনে মন্দ আত্মা হল সমস্যা। ঈশ্বর সব সময় মানুষের পক্ষে আছেন এবং তিনি সব সময় মন্দতা ও অনায্যতার বিরুদ্ধে।
ইফি ৬:১০, ১১ শক্তিশালী হও! ঈশ্বরের দেওয়া সমস্ত সাজ-পোশাক বা অস্ত্র-শস্ত্র পরে নাও! দাঁড়াও!
ইফি ৬:১৩ প্রতিরোধ কর! স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাক!
ইফি ৬:১৮ প্রার্থনা কর!
ইফি ৬:১৪-১৭ ঈশ্বের দেওয়া সাজ-পোশাক পরে নাও:
- সত্যের বেল্ট বা সত্য দিয়ে কোমর বেঁধ! সত্যকে গ্রহণ করা ও মানা
- ধার্মিকতার বুকপাটা বা বুক রক্ষার জন্য সৎ জীবন বুক ঢেক! ক্ষমার নিশ্চয়তা, দোষারোপ নেই
- জুতা পরে প্রস্তুত থাক বা শান্তির সুখবর প্রচারের জন্য পা প্রস্তুত রেখ! অন্যদের সাথে সুসমাচার শেয়ার করা
- শয়তানের জ্বলন্ত তীর নিভিয়ে ফেলার জন্য বিশ্বাসের ঢাল তুলে নাও! ঈশ্বরের বাক্যে দাঁড়ানো
- মাথা রক্ষার জন্য উদ্ধার মাথায় দাও বা পরিত্রাণের মুকুট পরে নাও! পরিত্রাণের নিশ্চয়তা
- আত্মার ছোড়া নাও অর্থাৎ ঈশ্বরের বাক্য গ্রহণ কর! মিথ্যাকে অগ্রাহ্য, বাক্যে দাঁড়ানো
এই আদেশগুলো বিশ্বাসীকে বলে নিজের চিন্তা ও মনোভাবে ঈশ্বরের অধীনে আনতে, সত্যের সাথে একমত হতে এবং প্রতারণা অগ্রাহ্য করতে। যেমন আদি ৩ অধ্যায়ে আদম ও হবার ক্ষেত্রে দেখা যায়, শয়তানের কোন ক্ষমতা নেই মানুষকে জোড় করে পাপ করানোর (“জোড় করে ফলটি খায়ানোা”) তার মাত্র কৌশল হল মিথ্যা বলা। শুধুমাত্র যখন মানুষ ঈশ্বরের চেয়ে শয়তানকে বিশ্বাস বেশি করে, যখন ঈশ্বরের চেয়ে শয়তানের সাথে একমত হয় তখন পাপ ঘটে। তাই নিজের মনকে পরিচালনা করা আবশ্যক!
একভাবে বলা যায় যে “স্বর্গীয় স্থানে” একটি বড় আত্মিক যুদ্ধ চলছে, অন্যভাবে আবারও বলা যায় যে আসল যুদ্ধ চলছে মানুষের মনকে নিয়ে এবং মানুষের মনে মনে: আমি কি বিশ্বাস করব? আমি কিসের উপর আমার সিদ্ধান্ত নিব?
এই চমৎকার আহ্বানের উপযুক্তভাবে জীবন-যাপন করা
একতায় বসবাস করা
পৌল তার চিঠির দ্বিতীয় অংশটি বড় একটি “এইজন্য” বা “তাই” দিয়ে শুরু করেন (ইফি ৪:১)। এই পর্যন্ত যা বলা হয়েছে তিনি এভাবে মনে করিয়ে দেন: ঈশ্বরের আশ্চর্য পরিত্রাণ ও চমৎকার আহ্বান পেয়েছি, খ্রীষ্টের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রত্যেকটি আত্মিক আশীর্বাদ দেওয়া হয়েছে, অযিহূদীদের অন্তর্ভূক্ত করার সেই গোপন রহস্য আমাদের কাছে প্রকাশ করা হয়েছে। তা সব বিশ্বাসীরা পেয়েছে বলেই পৌল তাদের এই আহ্বানের উপযুক্ত হয়ে চলতে বলেন।
তিনি তাদের চ্যালেঞ্জ করেন “তোমাদের স্বভাব যেন সম্পূর্ণভাবে নম্র ও নরম হয়। ধৈর্য ধর এবং ভালসাবার মনোভাব নিয়ে একে অন্যকে সহ্য কর। যে শান্তি আমাদের একসঙ্গে যুক্ত করেছে সেই শান্তির মধ্য দিয়ে পবিত্রা আত্মার দেওয়া একতা রক্ষা করতে বিশেষভাবে চেষ্টা কর” (ইফি ৪:২-৩)। মানুষের মধ্যে একতা তৈরি হয় না চাপ বা উঁচু থেকে নিচদিকে আদেশ দ্বারা, বা সবাই একই নিয়মে একমত হওয়া বা সবাই একই রকম হওয়ার মধ্য দিয়ে। বরং একতা তৈরি হয় যখন ঈশ্বরের দয়া পেয়ে বিশ্বাসীরা নম্র হয় জেনে যে সবাই পাপী ছিল কিন্তু সবাই একই দয়ায় পরিত্রাণ পেয়েছে: “ঈশ্বর তোমাদেরকে ডেকেছেন বলে তোমাদের মধ্যে কেবল একটাই আশা আছে, একটিই দেহ আছে, একজনই পবিত্র আত্মা আছেন, একজনই প্রভু আছেন, একই বিশ্বাস আছে, একই বাপ্তিস্ম আছে, আর সকলের ঈশ্বর ও পিতা মাত্র একজনই আছেন” (ইফি ৪:৫-৬)।
ভিন্নতায় আমন্ত্রন
ঈশ্বর বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন দান ও ভূমিকা দিয়েছেন, কিন্তু সব কিছু অন্যদেরকে সেবা করা, শিক্ষা দান (ইফি ৪:৭, ৪:১১) এবং বিশ্বাসীদের পরিচর্যায় গঠন করার জন্য তা দিয়েছেন (ইফি ৪:১২)। যে ভূমিকাগুলো পৌল উল্লেখ করেন তার তালিকা নিচে দেওয়া হল:
- ষ্ট্রংগ্স # G4166 বাংলা: শিক্ষক, Teacher, গ্রীক: Didaskolos। ৫৮ বার নতুন নিয়মের, ১ বার ইফিষীয়তে (ইফি ৪:১১)। মণ্ডলীতে ভূমিকার বর্ণনা: এমনি শিক্ষক, বাইবেলীয় বা ভ্রান্ত শিক্ষক।
- ষ্ট্রংগ্স # G4166 বাংলা পালক, Pastor, গ্রীক: (Archi) poimen। ১৮ বার নতুন নিয়মে, ১ বার ইফিষীয়তে (ইফি ৪:১১)। মাত্র এখানে নেতৃত্ব সম্বন্ধীয়, বাকি: যীশু বা সাধারণ রাখাল।
- ষ্ট্রংগ্স # G2099 বাংলা: সুসমাচার প্রচারক, Evangelist, গ্রীক: Euaggelistes। ৩ বার নতুন নিয়মে, ১ বার ইফষীয়তে (ইফি ৪:১১)। অন্যান্য পদ: প্রেরিক ২১:৮, ২ তীমথিয় ৪:৫)।
- ষ্ট্রংগ্স # G652 বাংলা: প্রেরিত, Apostles, গ্রীক: Apostolos। ৮১ বার নতুন নিয়মে, ৪ বার ইফিষীয়তে (ইফি ১:১, ২:২০, ৩:৫, ৪:১১)। ১২ শিষ্যদের জন্য, অন্যান্য প্রেরিতদের সম্বন্ধেও
- ষ্ট্রংগ্স # G4396 বাংলা: ভাববাদী, Prophets, গ্রীক: Prophetes। ১৪ বার নতুন নিয়মে, ৩ বার ইফিষীয়তে (ইফি ২:২০, ৩:৫, ৪:১১)। ২১ বার মণ্ডলীতে আত্মিক দানের জন্য ব্যবহৃত, যেমন: ভাববাণী, মণ্ডলীতে বিশেষ ভাববাদী
তালিকার অর্থ এই নয় যে তালিকাই সমগ্র বা সম্পূর্ণ। উল্লিখিত ভূমিকাগুলোর পাশাপাশি অন্য ভূমিকা থাকতে পারে। তা ছাড়া তালিকাটি ভূমিকাগুলের মধ্যে উঁচু-নিচু বুঝায় না, এমনটি নয় যে একটি ভূমিকা অন্যগুলোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নতুন নিয়মে আরো দান বা ভূমিকার তালিকা আছে যেখানে ইফিষীয় চিঠিতে উল্লিখিত দানের সাথে মিল থাকে, কিন্তু অন্যান্য দানের উল্লেখও থাকে (১ করি ১২:৭-১০,২৭-৩০, রোমীয় ১২:৬-৮)।
ইফি ৪:১১ পদ থেকে (নতুন নিয়মের আরও এই ধরণের কিছু পদ থেকে) খুব নির্দিষ্ট ও কঠোর নিয়ম বের করা হয়েছে, মণ্ডলীতে কি কি ভূমিকা বা দান থাকতে পারে। কিন্তু নতুন নিয়মের নেতৃত্বের বিষয় বিস্তারিত স্টাডি করলে অন্য একটি চিত্র দেখা যায়: ভূমিকা ও দান নিয়ে কঠোর হওয়া বা অতি নির্দিষ্ট ও খুব সীমিত রাখার কোনো নীতি নেই (‘মণ্ডলী ০৫ – নতুন নিয়মে মণ্ডলীর নেতৃত্ব’ দেখুন)। বেশিরভাগ ভূমিকায় প্রত্যেক বিশ্বাসীকে পালন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে, যেমন: পদটিতে প্রচারের কাজের ভূমিকা উল্লিখিত, কিন্তু সব বিশ্বাসীদের প্রচার করা উচিত। বেশিরভাগ ভূমিকায় অতি নির্দিষ্ট সংজ্ঞাও নেই অথবা একজনকে এই ভূমিকায় নিয়োগের করার নির্দেশনাও নেই। আশ্চর্য লাগার একটি বিষয় হল যে আমাদের আধুনিক পালক-ভিত্তিক মণ্ডলীর কাঠামো নতুন নিয়মে সহজে পাওয়া যায় না। আসলে ইফিষীয় ৪:১১ পদের পাশাপাশি পুরা নতুন নিয়মে একটাও পদ নেই যেখানে “পালক” ভূমিকার একজনকে মণ্ডলীর নেতা হিসাবে উল্লিখিত। নতুন নিয়মে নেতৃত্বের নীতিমালা খুঁজে বের করতে চাইলে ‘পালকের “চেয়ে ‘প্রাচীন’ শব্দ খোঁজা ভাল। তার পাশাপাশি খুবই কম জায়গায় ‘পরিচালক’ (‘বিশপ’) ও ‘পরিচারক’ (‘ডিকন’) ব্যবহৃত হয়। নেতৃত্বের কাঠামো অথবা নেতৃত্বের নিয়োগ নিয়ে নতুন নিয়মে অবিশ্বাস্যভাবে খুবই কম লেখা পাওয়া যায়। নতুন নিয়ম থেকে খুব নির্দিষ্ট ও কঠোর নিয়ম নেই, তাই কঠোর ব্যাখ্যাও না করা ভাল।
কিন্তু যা ইফি ৪:১২ পদে অত্যন্ত পরিষ্কার বলা হয়েছে যে মণ্ডলীতে ভূমিকার বা কার্যক্রমের লক্ষ্য কি: “যেন ঈশ্বরের সব লোকেরা তাঁরই সেবা (কেরী: পরিচর্যার কাজ) করবার জন্য প্রস্তুত হয়”, মানে ঈশ্বর ভূমিকাগুলো দিয়েছেন মণ্ডলীকে বা বিশ্বাসীদের গড়ে তোলার জন্যই। যদি জিজ্ঞাসা করা হয় “কে পরিচর্যা কাজ করে?” তবে উত্তরে আমরা বলি: এই পাঁচজন (প্রেরিত, প্রচারোক, পালক, শিক্ষক, ভাববাদী)। কিন্তু পদটি সম্পূর্ণ অন্য কিছু বলছে। কে পরিচর্যার কাজ করবে? উত্তর হল: “ঈশ্বরের সব লোকেরা” মানে মণ্ডলীর সাধারণ সদস্য। পরিচর্যাকারী হল সবাই কিন্তু এই পাঁচজনের ভূমিকা হল সাধারণ লোকদের পরিচর্যা কাজের জন্য প্রস্তুত করা বা প্রশিক্ষণ দেওয়া।
পৌলের বর্ণনা অনুসারে পরিপক্ক বিশ্বাসী এমন একজন যার মধ্যে স্থিরতা আছে, যিনি সত্য বলে, যিনি মিথ্যা শিক্ষার প্রতিরোধ করতে জানেন, যিনি একতা রক্ষা করেন এবং ভালবাসায় অন্যদের গড়ে তোলেন। পৌল মণ্ডলীর বর্ণনায় এই ছবি ব্যবহার করেন: যীশুই হলেন মাথা এবং মণ্ডলী হল তার খ্রীষ্টের দেহ (ইফি ৪:১৩-১৬)। পৌল যখন মণ্ডলীকে “দেহ” বলেন তখন তিনি রূপকভাবে বিশ্বাসীদের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ, একজন আর একজনের উপর নির্ভরশীলতা, একসাথে একতায় বৃদ্ধি পাওয়া বুঝান।
পুরাতন জীবন ত্যাগ করা এবং নতুন জীবনকে পরিধাণ করার চ্যালেঞ্জ
খ্রিষ্টান বিশ্বাসীদের জীবন কেমন হওয়া উচিত তার বর্ণনা করতে গিয়ে পৌল এভাবে বলেন: ‘পুরাতন আমি’ (মানে পুরাতন জীবন, ছলনার, কামনার) নোংরা কাপড়ের মতই বাদ দিয়ে বদলে ‘নতুন আমি’ (মানে নতুন জীবন, মনকে নতুন করে গড়ে তুলতে ঈশ্বরকে সুযোগ দেওয়া) নতুন কাপড়ের মতই পরতে হবে (ইফি ৪:২২-২৪)। কেন পৌল বিশ্বাসী জীবনের দৈনিক চ্যালেঞ্জগুলোকে ‘কাপড়ের’ রূপক দিয়ে বুঝান? কাপড় পরা হল দৈনিক, নিয়মিত, সাধারণ একটি কাজ, – প্রয়োজন কিন্তু কঠিন কিছু নয়। যেমন দৈনিক ময়লা কাপড় পরিবর্তন করে নতুন কাপড় পরতে হয়, ঠিক তেমন দৈনিক পাপ-স্বভাব ছেড়ে ঈশ্বর থেকে নতুন জীবন গ্রহণ করতে হয় ও তাতে চলতে হয়। তিনি কিছু ব্যবহারিক উদাহরণও দেন:
“শয়তানকে কোন সুযোগ দিয়ো না” (ইফি ৪:২৭)। কিভাবে শয়তান জায়গা পায়? ইতিবাচকে জীবন-যাপন না করার দ্বারা, ক্ষমা না করার মধ্যে দিয়ে, রাগ ও হিংসা ধরে রাখার মধ্যে দিয়ে, কৃতজ্ঞ না হওয়া দ্বারা। ইতিবাচক জীবন ধরে রাখার জন্য স্বক্রিয়ভাবে ও অবিরত ‘মনকে পরিষ্কার-পরিছন্নতা করা দরকার, সচেতনভাবে পুরাতন স্বভাব ত্যাগ করা দরকার।
অনেক কিছু ত্যাগ করার জন্য পৌল তাদের চ্যালেঞ্জ করেন: মিথ্যা (ইফি ৪:২৫), বিরক্তি প্রকাশ, মেজাজ দেখানো, তিক্ততা, ক্রোধ, রাগ, বিবাদ, মিথ্যা স্বাক্ষ্য, গালাগালি, হিংসা (ইফি ৪:৩১) এবং লোভ (ইফি ৫:১, ৪)।
রাগ নিয়ে তিনি বলেন: “যদি রাগ কর তবে সেই রাগের দরুন পাপ কোরো না; সূর্য ডুববার আগেই তোমাদের রাগ ছেড়ে দিয়ো” (ইফি ৪:২৬-২৭)। তাতে বুঝা যায় যে রাগ একটি আবেগ হিসাবে অর্থ প্রকাশ করে এবং তা পাপ নয়, কিন্তু এটা একটা পাপে পরিণত হতে পারে যদি আমি রাগকে ধরে রাখি অথবা যদি রাগকে প্রতিশোধ পর্যন্ত অথবা নিয়ন্ত্রণহীন আচরণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে দেই।
পৌল লোভকে প্রতিমাপূর্জা হিসাবে দেখান: লোভ করা মানে আমার চাওয়া বা প্রয়োজনকে ঈশ্বরের থেকেও উপরের স্থানে রাখা, ঈশ্বর যা যোগান দেন তাতে অসন্তোষ প্রকাশ এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ‘শুধু নিজের চিন্তা করা’ (ইফি ৫:১, ৪)।
পরিশ্রমের বিষয়ে পৌল ইফিষীয় লোকদের শ্রম দিতে ও সৎ কাজ করতে বলেন “যে চুরি করে সে আর চুরি না করুক, বরং নিজের হাতে সৎভাবে পরিশ্রম করুক যেন অভাবী লোকদের দেবার জন্য তার কিছু থাকে” (ইফি ৪:২৮)। পৌল দেখান যে কাজ শুধুমাত্র আমার ও আমার পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর বিষয় নয়। সুসমাচার বিশ্বাসীর জীবনে এমন পরিবর্তন নিয়ে আসবে যাতে তিনি সমাজের একজন অংশগ্রহনকারী ও দাতা হয়ে যান। আমাদের শুধুমাত্র ভোক্তা বা নেওয়ার লোক হওয়া উচিত নয় বরং আশীর্বাদ করার জন্য অংশগ্রহণকারী লোক এমন একজন যিনি শক্তিশালী, দানশীল ও একটি ভাল প্রভাব ফেলার সক্ষম।
পৌল ইফিষীয় লোকদের নিজেদের জিহ্বা বা কথা লক্ষ্য করার জন্য চ্যালেঞ্জ করেন: “তোমাদের মুখ থেকে কোন বাজে কথা বের না হোক, বরং দরকার মত অন্যকে গড়ে তুলবার জন্য যা ভাল তেমন কথাই বের হোক, যেন তা শোনে তাতে তাদের উপকার হয়” (ইফি ৪:২৯)। কথা বলার এই ক্ষেত্রেও তাদের আশেপাশে যারা আছে তাদের আশীর্বাদ করা প্রয়োজন: মিথ্যা অপবাদ অথবা ঈর্ষা নয় বরং “সম্পূর্ণভাবে পবিত্র আত্মার অধীনে থাক, আর গীতসংহিতার গান, প্রশংসা ও আত্মিক গানের মধ্য দিয়ে তোমরা একে অন্যের সংগে কথা বল; তোমাদের অন্তরে প্রভুর উদ্দেশ্যে গান কর” (ইফি ৫:১৮)। কৃতজ্ঞতা স্বীকার, প্রশংসা করা, উৎসাহ দান, সত্য বলা, প্রজ্ঞা ও প্রার্থনা বিশ্বাসীদের কথা বলার চিহ্ন হওয়া উচিত।
পৌল তাদের সময়ের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিশ্বস্ত হতে চ্যালেঞ্জ করেন: “বুদ্ধিহীন লোকদের মত না চলে জ্ঞানীদের মত চল। তোমাদের হাতে সৎ কাজ করবার যে সুযোগ আছে তা পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাও” (ইফি ৫:১৫-১৬)। পৌল চান যেন বিশ্বাসীরা তাদের নিজের জীবন, তাদের শ্রম, তাদের সময়, বিনিয়োগ, অংশগ্রহন ও তাদের আহ্বানের গুরুত্ব বুঝতে পেরে সর্বোচ্চতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
আশেপাশের অনৈতিক সংস্কৃতির সাথে তুলনা করে পৌল তাদের কথাবার্তায় এবং আচরণে যৌনতার সততা রক্ষা করতে বলেন (ইফি ৫:১২)। মদ খাওয়ার ক্ষেত্রেও নিজেদের স্বনিয়ন্ত্রনে রাখা প্রয়োজন (ইফি ৫:১৮)।
একজন আর একজনের বশীভূত হওয়া বা অধীনতা মেনে নেওয়া
ইফিষীয় ৫:২১ থেকে ৬:৯ পদ পর্যন্ত পৌল গ্রীক ভাষায় খুব লম্বা বাক্যগুলি লেখেন। যে অনুচ্ছেদটিতে পৌল বশীভূত হওয়ার বিষয়ে কথা বলেন তার প্রধান বা মূল পদ হল ইফি ৫:২১, যেখানে অনুচ্ছেদের প্রধান ক্রিয়া ব্যবহৃত এবং প্রধান আদেশ প্রকাশিত: “তোমরা একে অন্যকে মেনে নেওয়ার মনোভাব নিয়ে চল” (সাধারণ) বা “একজন অন্যজনের বশীভূত হও” (কেরী)। পরবর্তী পদগুলিতে পৌল বশীভূত হওয়ার তিনটি উদাহরণ দেখান যা মূল আদেশের উপর ঝুলে আছে (লক্ষ্য করুন যে বাংলায় বিভিন্ন অনুবাদ দেওয়া হয়েছে, যদিও গ্রীক ভাষায় প্রত্যেক বার একই শব্দ ব্যবহাত:
- ইফি ৫:২২ “তেমনি, স্ত্রী নিজ নিজ স্বামীর বশীভূত হও” “স্ত্রী… নিজের নিজের স্বামীর অধীনতা মেনে নাও”
- ইফি ৬:১ “তেমনি ছেলেমেয়েরা পিতামাতার আজ্ঞাবহ হও” “ছেলে-মেয়েরা … তোমরা মা-বাবার বাধ্য হয়ে চল”
- ইফি ৬:৫ “তেমনি দাসেরা… প্রভুদের আজ্ঞাবহ হও” “যেমন খ্রীষ্টের বাধ্য তেমনি …মনিবদের বাধ্য হয়ো”
এমনকি এই তিনটি পদে কোনো ক্রিয়াও নেই, ত্রিয়া পেতে গেলে ইফি ৫:২১ পদে যেতে হয়। এভাবে পৌল এই তিনটি উদাহরণ শক্তিশালীভাবে মূল আদেশের সাথে যুক্ত করেন: “একে অন্যের প্রতি বশীভূত হও”। অধীনতা মেনে নেওয়ার আদেশ আছে, কিন্তু সব কিছুর ভিত্তি হল পরস্পরের প্রতি বশীভূত হওয়া।
রোমীয় ও গ্রীক সংস্কৃতিতে পুরুষেরা বাড়ীর কর্তা বা মনিব ছিল এবং স্ত্রীদের, ছেলেমেয়েদের ও দাসদের উপর প্রায় পূর্ণ ক্ষমতা পুরুষদের ছিল। ঐ সময়ের রোমীয় বা গ্রীক লেখকদের থেকে কয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায় বর্ণনায় তারা বলে একটি পরিবারে বা সংসারে স্বামী ও স্ত্রীর ভূমিকা, দায়িত্ব বা অধিকার কি হওয়া উচিত। রোমীয় ও গ্রীক চিন্তা অনুসারে পরিবারে সমস্ত অধিকার ছিল স্বামীর এবং সমস্ত দায়িত্ব ছিল স্ত্রীর। পৌল ইফিষীয় ৫ অধ্যায়ে যা আদেশ করেন তা হল সম্পূর্ণ ভিন্ন: খ্রিষ্টান পরিবারে প্রভুই হলেন খ্রীষ্ট। যীশুর বাধ্যতায় পরিবারের মধ্যে সবাই একে অপরের প্রতি বশীভূত হয়, যেমন স্ত্রীরাও স্বামীদের প্রতি বশীভূত হয়, ছেলে-মেয়েরা মা-বাবাদের এবং দাসরা মনিবদের প্রতি বাধ্য হয়।
- পৌল ৫টি পদে স্ত্রীদের কাছে কথা বলেন (ইফি ৫:২১-২৪, ৫:৩৩) যেন তারা তাদের স্বামীদের বশীভূত হয় ও সম্মান করে।
- পৌল ১০টি পদে স্বামীদের উদ্দেশ্যে কথা বলেন (ইফি ৫:২১, ৫:২৫-৩৩): খ্রীষ্ট যেভাবে মণ্ডলীকে ভালবেসেছেন, স্বামীরা যেন সেভাবে স্ত্রীকে ভালবাসে, খ্রীষ্ট যেভাবে মণ্ডলীকে ভালোবেসে নিজেকে দিয়েছিলেন ঠিক সেভাবে স্বামীরা যেন স্ত্রীকে ভালোবেসে নিজেকে দিয়ে দেয়। স্বামীদের জন্য খ্রীষ্টই হলেন ভালবাসার ও নিজেকে উৎসর্গ করার মানদণ্ড।
- পৌল ৩টি পদে ছেলে-মেয়েদের কাছে কথা বলেন (ইফি ৬:১-৩) যেন তারা প্রভুতে তাদের মা-বাবাদের বাধ্য হয় এবং তাদের সম্মান করতে বলেন।
- পৌল ১টি পদে বাবাদের কাছে কথা বলেন (ইফি ৬:৪) যেন তারা তাদের ছেলে-মেয়েদের রাগান্বিত হওয়ার জন্য বিরক্ত না করে বরং তাদের শাসন করে ও সদাপ্রভুর বিষয়ে নির্দেশনা দেয়।
- পৌল ৪টি পদে দাসদের কথা বলেন (ইফি ৬:৫-৮) যেন তারা তাদের মনিবদের প্রতি ভয়ে বাধ্য হয়, যেভাবে তারা ভয়ে ও সম্মানে খ্রীষ্টের বাধ্য হয়, যেন মনে প্রাণে (মানুষের প্রতি নয় বরং সদাপ্রভুর প্রতি) কাজ করে, মনিবেরা দেখুক বা না দেখুক। সমর্পিত হয়ে উৎসাহের সহিত উৎসর্গীকৃতভাবে কাজ করতে আদেশ দেন।
- পৌল ১টি পদে মনিবদের কাছে কথা বলেন (ইফি ৬:৯) যেন তারা স্মরণ রাখে যে স্বর্গে তাদেরও প্রভু আছে এবং যেন তারা দাসদের ভয় দেখানো ছেড়ে দেয়।
আরও লক্ষ্য করুন যে ‘বশীভূত হওয়া’ মানে যে একজন নিজেকে স্বেচ্ছায় আর একজনের অধীনে রাখে। যদি আমি নিজেকে আর একজনের অধীনে রাখি তার অর্থ হলে যে প্রথম থেকে আমি অন্যের নিচে ছিলাম না। বশীভূত হওয়া হল এমন কিছু যা সমান লোকদের মধ্যে চলে।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।