পৌল গালাতীয় মণ্ডলীগুলোর কাছে দেখান যে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য যিহূদী আইন পালন করা প্রয়োজন নেই বরং তিনি তাদের যীশুর দয়ার উপর বিশ্বাস রাখতে ও ঈশ্বরের পুত্র হিসাবে পবিত্র আত্মার সাহায্যে ঈশ্বরীয় জীবন-যাপন করতে বলেন।
প্রথম প্রচার যাত্রায় পৌল ও বার্ণবা গালাতীয় মণ্ডলীগুলো স্থাপন করেন। পরে এই যিহূদী-অযিহূদী মিশানো মণ্ডলীগুলো এমন শিক্ষকদের প্রভাবে পড়ে যারা দাবী করে যে বিশ্বাসী হিসাবে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য যিহূদী আইন-কানুন (এবং বিশেষভাবে সুন্নত) পালন করা আবশ্যক। তারা পৌলকে ও তার প্রচার নিয়ে সমালোচনা করে বলেন যে তিনি দয়ার প্রচার দ্বারা অতি সহজেই মানুষকে ধর্মান্তরিত করেন।
পৌল গালাতীয় চিঠিতে যুক্তি দেখিয়ে প্রমাণ করেন যে তার প্রেরিত হওয়ার অধিকার আছে এবং তার দ্বারা প্রচারিত সুখবর আসল সুখবর। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে আইন পালন করা দ্বারা পরিত্রাণ পাওয়া যায় না। তাই অযিহূদী বিশ্বাসীদের সুন্নত গ্রহণ করার চাপ দেওয়া ঠিক নয়।
পৌল পুরাতন নিয়ম থেকে যিহূদীদের সম্মানিত আদিপিতা অব্রাহামের কথা তোলেন। তিনি দেখান যে অব্রাহামকে কোনো আইন পালন করার কারণে ‘ধার্মিক বা নির্দোষ বলে গ্রহণ’ করা হয় নি। বরং ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা বিশ্বাস করার জন্যই তাকে ‘নির্দোষ বলে গ্রহণ’ করা হয়েছে (আদি ১৫:৬)। শুধুমাত্র ‘নির্দোষ বলে গ্রহণ’ করার পরেই ঈশ্বর তার সঙ্গে চুক্তির চিহ্ন হিসাবে তাকে সুন্নত করার আইন দেন (আদি ১৭:১০)। সুন্নত তাহলে গ্রহণযোগ্যতার শর্ত নয় বরং বিশ্বাসে স্থাপিত চুক্তির পরে দেওয়া একটি চিহ্ন।
তাই যতজন অব্রাহামের মত বিশ্বাস করে ততজনকে পৌল ‘অব্রাহামের পুত্র’ বলেন, তারা রক্ত-মাংসে অব্রাহামের বংশধর হোক বা না হোক। কিন্তু যতজন আইন পালনের জন্য নিজের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের উপর নির্ভর করে (যিহূদী হোক বা অযিহূদী) ততজনকে পৌল ‘অভিশপ্ত’ বলেন, কারণ কেউ আইন সম্পূর্ণভাবে পালন করতে সক্ষম নয়। পৌল বিশ্বাসীদের বলেন তারা যেন নিজের প্রচেষ্টার উপর মিথ্যা বিশ্বাস না করে বরং যীশুর ক্রুশীয় মৃত্যুর উপরে নির্ভর করে।
কিন্তু যদি ঈশ্বর অব্রাহামকে বিশ্বাসের জন্য গ্রহণ করেন – আইন পালনে নয় – তবে কেন তিঁনি ৪৩০ বছর পরে ইস্রায়েলকে আইন-কানুন দেন? উত্তরে পৌল বলেন যে আইন আসলে অস্থায়ী পরিচালক হিসাবে দেওয়া হয়েছিল (গালা ৩:২৩-২৫)। ঈশ্বর আইনের মধ্য দিয়ে আমাদের দেখান পাপের ফলাফল কত মারাত্মক, আমাদের অবস্থা কত খারাপ এবং ক্ষমা কত জরুরী প্রয়োজন। তিনি তা করেন, যেন – যখন যীশু ত্রাণকর্তা হিসাবে ক্ষমা নিয়ে আসেন – তখন আমরা তাঁকে খুশীমনে ও নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করি। তাই যীশু না আসা পর্যন্ত আইন একটি গুরুত্ব ভূমিকা পালন করে।
যারা যীশুর উপর বিশ্বাস রাখে তাদেরকে পৌল ঈশ্বরের পুত্র ও তাঁর উত্তরাধিকারী বলেন। তারা আর দাস নয় বরং স্বাধীন। তারা পুত্র হিসাবে স্বাধীন আছে স্বর্গস্থ পিতার প্রতি বাধ্যতায়, কৃতজ্ঞতায় এবং তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্কে জীবন-যাপন করতে (গালা ৪:১,৭)। ‘ঈশ্বরের পুত্র’ একটি শক্তিশালী রূপক। পৌল এই রূপক দ্বারা বুঝাতে চান, ঈশ্বরের সঙ্গে একটি অপরিবর্তনশীল ও ঘনিষ্ট ভালবাসার সম্পর্ক। ঈশ্বর বিশ্বাসীদের দত্তক নিয়েছেন বলে আমরা পুত্রত্বের অধিকার পেয়েছি। আমরা পুত্র হিসাবে তা অর্জন করতে পারি না, কিন্তু ঈশ্বর তা আমাদের দান করেছেন।
যে শিক্ষকেরা সুন্নতের উপর জোর দিয়েছে, তারা পৌলের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে বলেছে যে পৌল হিংস্র লোক ছিলেন, তিনি আসল প্রেরিত নন, তিনি যীশুর চোখের সাক্ষী নন এবং তিনি যিরূশালেমের প্রেরিতদের চেয়ে অন্য সুসমাচার প্রচার করেন। উত্তরে পৌল তার জীবনের গল্প বলেন: হ্যাঁ, তিনি এক সময় যীশুর অনুসরণকারী ছিলেন না, বরং তিনি মণ্ডলীকে অত্যাচার করতেন (গালা ১:১৩-১৪)। কিন্তু দামেষ্কের পথে যীশু নিজেই পৌলের সাথে দেখা করেছেন এবং তাকে প্রেরিত হওয়ার আহবান দিয়েছেন (গালা ১:১৫-১৬)। পৌল দেখান যে তিনি যিরূশালেমের প্রেরিতদের সঙ্গে সুসম্পর্কে আছেন এবং তারাও অযিহূদীদের সুন্নত করতে বাধ্য করেন না (গালা ২:১-১৪)।
পৌল গালাতীয় মণ্ডলীদের দেখান যে আইনের উপর জোর দেওয়ার ফলে পরস্পরের প্রতি সম্পর্ক খারাপ হয়েছে: তাদের মধ্যে বিভেদ, অহংকার ও আত্ম-ধার্মিকতা সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু আসলে পরস্পরের প্রতি ভালবাসা কমেছে (গালা ৫:১৫)। পৌল তাদের দেখান যে যীশুর দয়ার উপর নির্ভর করা দ্বারা বরং নম্রতা ও একতা সৃষ্টি হয়, কারণ সব বিশ্বাসীরা একইভাবে পাপী ছিল এবং একইভাবে দয়া পেয়েছে (গালা ৩:২৬-২৮)। শুধুমাত্র যখন একজন বিশ্বাসী যীশুর উপর নির্ভর করে ও পবিত্র আত্মার পরিচালনায় চলে, পবিত্র আত্মা তার মধ্যে ঈশ্বরীয় গুণ তৈরি ও বৃদ্ধি করেন, যেমন ভালবাসা, শান্তি, নম্রতা ও নিজেকে দমন (গালা ৫:২২-২৩)। এভাবে পবিত্র আত্মাই বিশ্বাসীদের জীবনে আইন পূর্ণ করেন (গালা ৫:১৬-২৬)।
গালাতীয় চিঠির লেখক
পৌল নিজেকে পরিষ্কারভাবে গালাতীয় চিঠির লেখক হিসাবে চিহ্নিত করেন (গালা ১:১)। তিনি আধুনিক পদ্ধতিতে নয় বরং সে সময় প্রচলিত গ্রীক চিঠি লেখার ধরণ অনুসারে তার চিঠি লিখেন, যেখানে শুরুতে লেখক তার পরিচয় দেন।
যেহেতু পৌলের চোখের সমস্যা ছিল (গালা ৪:১৫), সেহেতু হতে পারে পৌলের একজন সাহায্যকারী লেখক ছিল। পাঠকরা যেন নিশ্চিত জানতে পারে যে এই চিঠিটি আসলে পৌল দ্বারা লিখিত, তিনি শেষ অনুচ্ছেদ নিজের হাতে লিখেন ‘দেখ, কত বড় বড় অক্ষরে আমি নিজের হাতে তোমাদের কাছে লিখছি’ (গালা ৬:১১, ২ থিষ ৩:১৭ দেখুন)।
লেখক গালাতীয় চিঠিতে নিজের জীবনের বেশ কিছু ঘটনা উল্লেখ করেন (যা অন্য পুস্তকে পৌলের জীবনের বর্ণনার সাথে মিলে): তিনি আগে মণ্ডলীকে অত্যাচার করতেন (গালা ১:১৩-১৪, এর সাথে মিলে প্রেরিত ৮:১-৩, ৯:১), তার সম্পূর্ণভাবে মন পরিবর্তন (গালা ১:১৫-১৬, এর সাথে মিলে প্রেরিত ৯:৩-৯), তার চোখের সমস্যা (গালা ৪:১৫, হয়তো এর সাথে মিল প্রেরিত ৯:১৮ ও ২ করি ১২:৯), যিরূশালেম মণ্ডলীর সঙ্গে তার অনেক দিন দেখা না হওয়া (গালা ১:১৮-১৯, এর সাথে মিল প্রেরিত ৯:২৬,৩০), অবশেষে যিরূশালেম মণ্ডলীর সঙ্গে তার দেখা (গালা ২:১-২ এর সাথে মিল প্রেরিত ১১:২৭-২৯)।
তা ছাড়া প্রেরিত পুস্তকে (১৩-১৪ অধ্যায়) গালাতীয় মণ্ডলীগুলোর স্থাপনের বর্ণনা গালাতীয় চিঠিতে উল্লিখিত বিষয়ের সাথে মিলে: বার্ণবার উল্লেখ (গালা ২:২৩) যিনি সহ-স্থাপক (প্রেরিত ১৩:২); পৌলের আশ্চর্য কাজের উল্লেখ (গালা ৩:৫, প্রেরিত ১৪:১০); পৌলের শারীরিক সমস্যা (গালা ৪:১৩) এবং পৌলের গায়ে ‘যীশুর আঘাতের চিহ্ন’-এর উল্লেখ (গালা ৬:১৭), হয়তো তা লুস্ত্রায় তার গায়ে পাথর মারার ফলে হয়েছিল (প্রেরিত ১৪:১৯-২০)।
তাই গালাতীয় চিঠিতে উল্লিখিত বিষয়গুলো এবং প্রেরিত পুস্তকে পৌলের জীবনের ও গালাতীয় মণ্ডলীগুলোর স্থাপনের বর্ণনার মধ্যে যথেষ্ট মিল দেখা যায়।
মণ্ডলীগুলোর স্থাপন
যীশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পরে প্রথম যিরূশালেমে মণ্ডলী স্থাপন হয় এবং আস্তে-আস্তে যিহূদীয়ায়, শমরিয়ায় এবং আরো দূরের শহরগুলিতে মণ্ডলী ছড়িয়ে পড়ে। সিরিয়ার আন্তিয়খিয়া শহরেও একটি মণ্ডলী স্থাপন হয়। বার্ণবা ও পৌল সেখানে পরিচর্য্যা করেন ও শিক্ষা দেন (প্রেরিত ১১:২৩-২৬)। একটি প্রার্থনা সভায় পবিত্র আত্মা বার্ণবা ও পৌলকে আরো দূরের এলাকায় যাওয়ার জন্য আদেশ দেন (প্রেরিত ১১:১-৩)। এইটাকে ‘প্রথম প্রচার যাত্রা’ বলা হয়। তা ৪৭-৪৮ খ্রীষ্টাব্দে যীশুর মৃত্যুর ১৮ বছর পরে ঘটে।
বার্ণবা ও পৌল সাইপ্রাস দ্বীপে ও গালাতীয়া প্রদেশে (আধুনিক যুগের তুরস্ক দেশে) প্রচার করেন এবং নতুন মণ্ডলীগুলি স্থাপন করেন। প্রেরিত ১৩ ও ১৪ অধ্যায়ে গালাতীয় প্রদেশের চারটি শহরের মণ্ডলীর স্থাপনের বর্ণনা দেওয়া হয়: পিষিদিয়ার আন্তিয়খিয়া, ইকনিয়, লূস্ত্রা ও দর্বী। তাদের অভ্যাস অনুসারে পৌল ও বার্ণবা নতুন শহরে গিয়ে প্রথমে যিহূদীদের খুঁজে বের করে তাদের কাছে সুসমাচার প্রচার করেন। ফলে কিছু যিহূদীরা সুসমাচারে বিশ্বাস করে, আবার কিছু যিহূদী অগ্রাহ্য করে সুসমাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। পরে অযিহূদীদের কাছে প্রচার করার ফলে অযিহূদীদের থেকেও অনেকে বিশ্বাসী হয়। তাই শুরু থেকে গালাতীয় মণ্ডলীগুলি যিহূদী-অযিহূদী মিশানো মণ্ডলী। প্রেরিতরা বেশ কিছু আশ্চর্য কাজ করেন (প্রেরিত ১৪:১০), কিন্তু যিহূদীরা যথেষ্ট অত্যাচারও করে: লূস্ত্রায় পৌলকে পাথর ছুঁড়ে প্রায় মেরে ফেলা হয় (প্রেরিত ১৪:১৯-২০)। ঐ অবস্থায় তিনি সামনের শহরে পালিয়ে সেখানে পরিচর্য্যা শুরু করেন। তাই মণ্ডলীগুলি বেশ তারাতাড়ি স্থাপিত হয়।
মণ্ডলীগুলির স্থাপনের পরে কি ঘটে?
গালাতীয় মণ্ডলীগুলি স্থাপন করার পরে পৌল ও বার্ণবা সিরিয়ার আন্তিয়খিয়ার মণ্ডলীতে ফিরে যান, যেখান থেকে তাদের পাঠানো হয়েছিল। তারা মণ্ডলীকে রিপোর্ট দেন, ঈশ্বর প্রথম প্রচার যাত্রায় কি কি করেছিলেন এবং ‘কিভাবে অযিহূদীদের সুযোগ করে দিয়েছিলেন যাতে তারা খ্রীষ্টের উপর বিশ্বাস করতে পারে’ (প্রেরিত ১৪:২৭-২৮)।
সে সময় নতুন স্থাপিত গালাতীয় মণ্ডলীগুলির কাছে কিছু যিহূদী শিক্ষক আসে। তারা কে সেটা সম্পূর্ণ নিশ্চিত বলা যায় না। হয়তো তারা খ্রিষ্টান শিক্ষক, যারা মনে করে যে সুন্নত আবশ্যক (যেমন প্রেরিত ১৫:১ বা গালা ২:১৩ পদে উল্লিখিত)। অথবা তারা যিহূদী-যিহূদী, যারা পৌলের পিছনে ঘুরে নতুন অযিহূদী বিশ্বাসীদের যিহূদী বানাতে চায়। তাদের যিহূদী করতে পারলে তারা অবশ্যই অনেকের প্রশংসা পাবে (মথি ২৩:১৫)। পৌলের পরিচর্য্যায় তাকে অনেক বার এই ধরণের শিক্ষকদের প্রভাব প্রতিরোধ করতে হয়। তাই হয়তো তারা গালাতীয়াতেও উপস্থিত। কিন্তু খ্রিষ্টান বিশ্বাসীদের মধ্যেও অনেকে ছিল যারা সুন্নত আবশ্যক মনে করত। যখন প্রথম মণ্ডলী স্থাপন হয়েছিল তখন মাত্র যিহূদী বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু যখন অযিহূদীরাও সুসমাচারে সাড়া দিতে শুরু করে তখন মণ্ডলীতে এই প্রশ্ন নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়: অযিহূদী কি পরিত্রাণ পেতে পারে? তারা কি পবিত্র আত্মা পেতে পারে? তারা কি বাপ্তিস্ম পাওয়ার যোগ্য? তারা যদি বিশ্বাসী হয়, তাদের জন্য কি যিহূদী আইন-কানুন পালন করা আবশ্যক নয়? তাহলে কি তাদের সুন্নত করা প্রয়োজন নয়? প্রেরিত পুস্তকে দেখা যায় যে মণ্ডলীতে এই প্রশ্নগুলি নিয়ে বেশ দ্বন্দ্ব চলছিল (উদাহরণ: প্রেরিত ১০:৪৭, ১১:১৯-২০, গালা ২:৪-৫, ২:১১-১৪, প্রেরিত ১৫:১)। মণ্ডলীর লোকজনদের মধ্যে এমন মতের অমিল হয় যাতে বিচ্ছেদের ভয় থাকে। এজন্য প্রেরিতরা যিরূশালেমে একটি সভা ডাকে, যেন একসাথে এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়ে সমস্যাটির সমাধান করতে পারে। এই গুরুত্বপূর্ণ সভা ৪৯ খ্রীঃ ঘটে। তার বিস্তারিত বর্ণনা প্রেরিত ১৫ অধ্যায়ে দেওয়া আছে: প্রেরিতরা সব কিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে অযিহূদী বিশ্বাসীদের আইন-কানুনে বাধ্য করা ঠিক নয় (প্রেরিত ১৫:১৯)। তারা অযিহূদীদের শুধুমাত্র কিছু বিষয়ে অনুরোধ করেন যেন তারা শান্তি ও সহভাগিতার জন্য যিহূদী সংস্কৃতি মানে (প্রেরিত ১৫:২০-২১)। এই সিদ্ধান্ত লিখিত রাখা হয় ও মণ্ডলীতে মণ্ডলীতে গিয়ে জানানো হয় (প্রেরিত ১৫:২৩)।
গালাতীয় চিঠিতে পৌল কেন প্রেরিতদের সভার এই সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেন না? পৌল যদি তা বলতেন তাহলে সহজে তা সমাধান হত। হতে পারে যে পৌল গালাতীয় চিঠিটি এই সভার আগেই লেখেন।
তাই মনে করা যায় যে ঘটনাগুলি এইভাবে ঘটল: ৪৭-৪৮ খ্রীষ্টাব্দে গালাতীয় মণ্ডলী স্থাপিত হয়। কিছু মাস পরে, যখন পৌল আবার সিরিয়ার আন্তিয়খিয়ায় আসেন, তখন তিনি খবর পান যে কিছু শিক্ষক মণ্ডলীতে ঢুকে গালাতীয় বিশ্বাসীদের সুন্নত করার জন্য চাপ দেয়। পৌল উত্তরে তাদের তাড়াতাড়ি একটি চিঠি লিখেন (গালাতীয় চিঠি) কারণ তাকে জরুরীভাবে কথা বলার জন্য যিরূশালেমে প্রেরিতদের সভায় যেতে হয় (৪৯ খ্রীঃ)। সভাতে ভাল সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই তিনি গালাতীয় মণ্ডলীগুলির সাথে দেখা করার জন্য রওনা দেন (৫০ খ্রীঃ, প্রেরিত ১৫:৪০, ১৬:১-২)। তাই হতে পারে পৌল গালাতীয় চিঠি ঠিক সভার আগে (৪৮-৪৯ খ্রীষ্টাব্দ) সিরিয়ার আন্তিয়খিয়া থেকে লেখেন। তা যদি হয় তবে গালাতীয় চিঠি পৌলের প্রথম চিঠি।
এই যিহূদী শিক্ষকরা মণ্ডলীতে ঠিক কি বলত?
যিহূদী শিক্ষকরা ঠিক কি বলত, তারা কিভাবে গালাতীয় মণ্ডলীতে ঢুকল এবং সেখানে তারা কিভাবে প্রভাব ফেলল, তা আমাদের নির্দিষ্টভাবে জানা নেই। কিন্তু যদি আমরা গালাতীয় চিঠি দেখি পৌল কিভাবে কথা বলেন তবে বুঝতে পারব, যিহূদী শিক্ষকরা মণ্ডলীতে কি শিক্ষা দিত এবং তারা পৌলের ক্ষেত্রে কি সমালোচনা করত:
গালা ১:১ পৌল বলেন: “আমি পৌল খ্রীষ্টের একজন প্রেরিত। এই প্রেরিত-পদ কোন মানুষের কাছ থেকে… বরং যীশু খ্রীষ্ট এবং পিতা ঈশ্বর… তাঁদের মধ্য দিয়েই আমি তা পেয়েছি”।
গালা ১:১৫-১৭ পৌল বলেন: “কিন্তু ঈশ্বর আমার জন্মের সময় থেকেই আমাকে নিযুক্ত করে রেখেছিলেন এবং তাঁর পুত্রকে আমার কাছে প্রকাশ করলেন, তখন আমি কোন লোকের সঙ্গে পরামর্শ করি নি। এমন কি, যাঁরা আমার আগে প্রেরিত হয়েছিলেন আমি যিরূশালেমে তাঁদের কাছেও যাই নি”।
যিহূদী শিক্ষকদের সমালোচনা: পৌল আসল প্রেরিত নন। তিনি যীশুর অনুস্মরণকারী ছিলেন না। তিনি যীশুর পরিচর্য্যা, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের সাক্ষী নন। পৌল অন্য প্রেরিতদের মত নন, তার অন্য প্রেরিতদের মত অধিকার নেই, তিনি নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। তিনি সুসমাচার যীশু থেকে পান নি বরং মানুষ থেকে পেয়েছেন।
গালা ১:১০ পৌল বলেন: “আমি এতে কার প্রশংসা পাবার চেষ্টা করছি, মানুষের না ঈশ্বরের? না কি মানুষকে সন্তুষ্ট করবার চেষ্টা করছি? আমি যদি এখনও মানুষকে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করি তবে তো আমি খ্রীষ্টের দাস নই”।
যিহূদী শিক্ষকদের সমালোচনা: পৌল মানুষের প্রশংসা পাওয়ার জন্য হাল্কা একটি সুখবর প্রচার করে অতি সহজে লোকদের ধর্মান্তরিত করে ফেলেন: তাদের আইন পালন করতে হয় না, তাদের সুন্নত গ্রহণ করতে হয় না, তিনি কোনো শর্ত রাখেন না। অন্য প্রেরিতরা আসল সুখবর প্রচার করে ও তারা সুন্নত ও আইন পালন করতে দাবী করেন।
গালা ১:২০ পৌল বলেন: “ঈশ্বর সাক্ষী যে, আমি তোমাদের কাছে যা লিখছি তার কিছুই মিথ্যা নয়”।
গালা ৪:১২-২০ পৌল বলেন: “এখন সত্যি কথা বলার জন্য কি আমি তোমাদের শত্রু হয়ে গেছি?”
যিহূদী শিক্ষকদের সমালোচনা: পৌল মিথ্যা বলেন। তার আসল সুখবর সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই। তিনি আসল প্রেরিতদের থেকে ভিন্ন কিছু প্রচার করেন। তিনি তোমাদের প্রতারণা করেছেন।
গালা ১:১১-২৩ পৌল তার জীবনের বর্ণনা দেন: মণ্ডলীকে কিভাবে অত্যাচার করতেন, মন পরিবর্তন কিভাবে হল ও মণ্ডলীতে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কত সমস্যা ছিল। তিনি দাবী করেন যে ঈশ্বর তার সাথে দেখা করে এবং তার সাথে সরাসরি কথা বলে আহবান দিয়েছিলেন।
যিহূদী শিক্ষকদের সমালোচনা: তোমরা কি জান না পৌল কে? তিনি কিন্তু ভীষণ পাপী, জঙ্গী, খুনী, মণ্ডলীর অত্যাচারী ও যীশুতে বিশ্বাসের শত্রু। তাকে বিশ্বাস করা যায় না। পৌল অন্য প্রেরিতদের মত নন, তার অন্য প্রেরিতদের মত অধিকার নেই, তিনি নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। তিনি সুসমাচার যীশু থেকে পান নি বরং মানুষ থেকে পেয়েছেন।
গালা ২:২, ২:৬-১০ পৌল তার দিয়ে প্রচারিত সুখবর যিরূশালেম মণ্ডলীর নেতাদের কাছে জানান। তারা পৌলের সুখবর আসল সুখবর হিসাবে অনুমোদিত করেন।
যিহূদী শিক্ষকদের সমালোচনা: পৌল একা ও অন্যদের থেকে আলাদা। আসল প্রেরিতদের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের মত পৌলের অধিকার বা অনুমোদনও নেই। যিরূশালেমের প্রেরিত আসল সুখবর প্রচার করে, সুন্নত দাবীও করে। পৌলের সুখবর হাল্কা, তাই এত বেশি বিশ্বাসী বানাতে পারেন।
গালা ২:৪-৫ গোপনে ঢুকে পড়া ভণ্ড ভাইদের বিরুদ্ধে পৌল আপত্তি উঠান, যেন সুখবরের সত্য রক্ষা পায়।
গালা ২:১৩-১৪ সুখবর রক্ষা করার জন্য পৌল এমন কি পিতরকে ধমক দেন ও পিতর তা মেনে নেন (প্রেরিত ১৫:৭-১১)।
যিহূদী শিক্ষকদের সমালোচনা: পৌল সুবিধাবাদী, নিজের স্বার্থে মানুষকে খুশি করেন। তিনি সত্যের পক্ষে দাঁড়ান না। অন্য প্রেরিতরা তাকে মানেন না।
গালা ৪:১৭ পৌল বলেন যে তারা “তোমাদের জন্য আগ্রহী হয়েছে, কিন্তু সেটা কোন ভাল উদ্দেশ্যের আগ্রহ না।”
পৌল তাদের নিয়ে সমালোচনা করেন: তাদের উদ্দেশ্য ভাল না।
চিন্তা করেন পৌলের কত খারাপ লাগে যে এমন লোকদের চোখে তিনি খারাপ হয়েছেন যাদের কাছে তিনি সুখবর পৌছিয়েছেন, যাদের জন্য তিনি অনেক কষ্ট মেনে নিয়েছেন, এমন কি লুস্ত্রায় পাথর মারার ফলে প্রায় মারা গেছেন! পৌলের এভাবে নিজেকে সুরক্ষা করাটা আসলে লজ্জার বিষয়। তারা এত সহজে তার সম্বন্ধে মিথ্যা বিশ্বাস করতে রাজী ছিলেন যে, যদি পৌলের অহংকার থাকত তবে তিনি এই মণ্ডলীগুলিকে অস্বীকার করতেও পারতেন। কিন্তু পৌল তাদের ফেলে রাখেন না। পৌল নিজের চরিত্র ও আচরণ রক্ষা করতে থাকেন, কারণ যদি তারা তাকে নকল মনে করে, তারা তার সুখবরও নকল মনে করবে। এবং যদি তারা তার সুখবর নকল মনে করে তবে এর অর্থ এই যে তারা সত্য থেকে সরে যাবে। পৌল নিজের সুনাম নিয়ে ব্যস্ত না, তিনি তাদের পরিত্রাণ নিয়ে ব্যস্ত। পৌল জানেন তাকে অগ্রাহ্য করলে তার সুখবর অগ্রাহ্য করা হয়, সত্যকে অগ্রাহ্য করা হয় এবং মিথ্যায় বিশ্বাস রাখা হয়, তার অর্থ এই যে “তোমরা ঈশ্বরের দয়া থেকে সরে গেছ” (গালা ৫:৪)। তাই পৌল তার সুখবরের জন্য, মানে আসল সুখবরের জন্য যুদ্ধ করেন: ঈশ্বরের দয়ার উপর বিশ্বাস রেখে আমরা পরিত্রাণ পেয়েছি, নিজের উদ্যোগে আইন পালন করা দ্বারা নয়।
পৌল গালাতীয়দের দেখান তাদের মধ্যে কি সমস্যা চলছে
একদিন সকালে গালাতীয়রা ঘুম থেকে উঠে সিদ্ধান্ত নিল যে “আজকে আমি ঈশ্বরের দয়া থেকে সরে যাব”, এমন নয়। যখন সে যিহূদী শিক্ষক তাদের কাছে এসে তাদের চ্যালেঞ্জ করেছিল যে যীশুকে খুশি করার জন্য বিশ্বাসের সঙ্গে অবশ্যই সুন্নত গ্রহণ করা দরকার, তারা হতে পারে ভাল মনোভাবে তাই করতে রাজী হল। হতে পারে গালাতীয়রা মনে করেছিল যে ভাল বিশ্বাসী হিসাবে সুন্নত গ্রহণে যীশুর গৌরব হয়। কিন্তু এইটা তারা বুঝতে পারল না যে সুন্নত গ্রহণ করা মানেই আইন পালন করার উপর নির্ভর করা, যার অর্থ হল যীশুর দয়া থেকে সরে যাওয়া।
এরজন্য পৌল প্রথমেই (গালা ১:৬-৯) তাদের এই বিষয় নিয়ে চোখ খুলে দেন। তিনি বার বার এই একই বিষয় তোলেন:
গালা ১:৬ তোমরা এত তাড়াতাড়ি তাঁকে ছেড়ে দিয়ে অন্য রকম সুখবরের দিকে ঝুঁকে পড়েছ
গালা ১:৭ আসলে ওটা তো কোন সুখবরই নয়
গালা ১:৭ কিছু লোক সুখবর বদলাতে চাইছে
গালা ১:৮ যে সুখবর আমরা প্রচার করেছি তা থেকে আলাদা কোন সুখবর যদি প্রচার করা হয় > অভিশাপ পড়ুক
গালা ১:৯ যে সুখবর তোমরা গ্রহণ করেছ তা থেকে আলাদা কোন সুখবর যদি কেউ প্রচার করে > অভিশাপ পড়ুক
পৌল তাদের পরিষ্কারভাবে দেখান যে যখন তারা এই যিহূদী শিক্ষকদের চাপ মেনে নিয়েছে, তারা আসলে একটি নকল সুখবর গ্রহণ করেছে। জোড়ের সঙ্গে পৌল তাদের বলেন, শুরুতে যে সুখবর তারা পৌল থেকে পেয়েছিল, তা-ই ছিল আসল। ফলে তাদের আর কিছু গ্রহণ করা বা আর কোন চাপ মেনে নেওয়া দরকার নেই। পৌল এমন কি বলেন যে যদি তিনি নিজে এসে অন্য কিছু বলতেন তবে তাকে মিথ্যাবাদী হিসাবে অগ্রাহ্য করা উচিত।
পৌল ভিত্তিক বিষয়গুলি পুনরায় শেখান
গালা ২:১৫-২১ পদে পৌল আর একবার সুখবরের ভিত্তিক বিষয়গুলি বুঝিয়ে সঠিক মতবাদ উপস্থাপনা করেন। কিভাবে আমি পরিত্রাণ পেতে পারি? কিভাবে আমি একজন পবিত্র, খাঁটি ও ঈশ্বরের সামনে গ্রহণযোগ্য মানুষ হতে পারি? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি শিক্ষা দেন।
ভিত্তিকভাবে এই প্রশ্নের দুই ধরণের উত্তর দেওয়া যায়। এই দুইটি উত্তর নিয়ে সারা চিঠি ধরে পৌল পার্থক্য দেখান:
এর উপর নির্ভর করব: অথবা এর উপরনির্ভর করব:
নিজের শক্তিতে আইন পালন করা যীশু ক্রুশে যা করেছেন, তার উপর নির্ভর করা
আইন পালন করার দ্বারা নির্দোষ বলে গ্রহণ যীশু খ্রীষ্টের উপর বিশ্বাস দ্বারা নির্দোষ বলে গ্রহণ
ব্যবস্থার কার্য হেতু ধার্মিক গণিত কেবল খ্রীষ্টে বিশ্বাস হেতু ধার্মিক গণিত
নিজের প্রচেষ্টার উপরে নির্ভর নিজের প্রচেষ্টা দ্বারা হয় না, তাই খ্রীষ্টের উপর নির্ভর
নিজের ক্ষমতার উপর নির্ভর নিজের অক্ষমতা বুঝে খ্রীষ্টের উপর নির্ভর
যোগ্যতা প্রমাণ করা যোগ্য নয় বলে দয়ায় গ্রহণ
ব্যবস্থা বা আইন-কানুন অনুগ্রহ বা দয়া
আত্ন-ধার্মিকতা দাবি করা যীশুর ধার্মিকতা লাভ
অহংকার নম্রতা
আইনের অধীনে পুরাতন জীবন আইন থেকে মুক্ত হয়ে নতুন জীবন
বাধ্যতা হল শর্ত বাধ্যতা হল ফলাফল, বাধ্যতা কৃতজ্ঞতায়
নিজের প্রচেষ্টা দ্বারা বাধ্য পবিত্র আত্মার পরিচালনা দ্বারা বাধ্য
বাহ্যিক অনুশীলন অন্তর থেকে অনুশীলন
বিশ্বাসীদের মধ্যে তুলনা ও বিচ্ছেদ বিশ্বাসীদের মধ্যে নম্রতা ও একতা
ভান করার ও লুকিয়ে থাকার প্রলোভন দুর্বলতা স্বীকার করার স্বাধীনতা
ফরীশীর দৃষ্টি যীশুর দৃষ্টি
পৌল পবিত্র শাস্ত্র থেকে যুক্তি দেখান
উচ্চ শিক্ষিত ফরীশী পৌলের খ্রীষ্টের সঙ্গে দামেষ্কের পথে যখন দেখা হয়, তার জীবন ও চিন্তা পরিবর্তন হয়। হতে পারে পৌল যা আগে থেকে বিশ্বাস করতেন, তা পুনরুত্থিত যীশুর বাস্তবতার আলোতে মূল্যায়ন করে ও পবিত্র শাস্ত্র পুনরায় পড়ে নতুনভাবে বুঝতে পারলেন। গালাতীয় চিঠির ৩ ও ৪ অধ্যায়ে পৌল এই নতুন জ্ঞানের একটি অংশ গালাতীয়দের দেখান:
পৌল যিহূদীদের সম্মানিত আদিপিতা অব্রাহামের উদাহরণ দেখিয়ে তার শিক্ষা শুরু করেন। অব্রাহামের জীবন থেকে যুক্তি দেখিয়ে পৌল প্রমান দেন যাতে যিহূদীদের চোখে সহজে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে। যে পদগুলি থেকে যিহূদী শিক্ষকরা প্রমাণ করতে চায় যে সুন্নত করা আবশ্যক, পৌল ঠিক সে পদগুলি ব্যবহার করেন এবং তার বিপরীত যুক্তি দেখান। অবশ্যই পৌলের কথায় গুরুত্ব আছে কারণ তিনিই যিহূদীদের যিহূদী, খাঁটি ফরীশী, বিখ্যাত যিহূদী গুরু গমলিয়েল দ্বারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং ছোটবেলা থেকে আইন-কানুনে বাধ্য। যিহূদীদের চোখে পৌল প্রত্যেক ক্ষেত্রে গালাতীয় মণ্ডলীতে আসা ভ্রান্ত শিক্ষকদের চেয়ে অনেক বড় ছিলেন। তারা যেমন হতে চায় পৌল তেমনই ছিলেন। যদি ধার্মিকতা মানুষের প্রচেষ্টা দ্বারা অর্জন করা যেত তবে পৌল সেই লোক যাকে ধার্মিক বলে ধরা হত। তিনি একসময় নিজেকে ধার্মিক মনে করতেন, কিন্তু তিনি এখন তা আর মনে করেন না। তিনি এখন জানেন যে তা ছিল একটি নকল আত্ম-ধার্মিকতা মাত্র। তিনি সে লোক যিনি অধিকারের সঙ্গে ভ্রান্ত শিক্ষকদের আত্ন-ধার্মিকতা মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেন। যিনি ছিলেন আত্ম-ধার্মিক ফরীশী, তিনি এখন যীশুতে ধার্মিকতার প্রচারক। দামেষ্কের পথে যীশু তাকে আসলেই পরিবর্তন করেছেন।
পৌল দেখান যে ঈশ্বর যখন অব্রাহামকে প্রতিজ্ঞা দেন তার বৃদ্ধ বয়সে একটি সন্তান হবে, অব্রাহাম তা বিশ্বাস করেন ও তাতে ঈশ্বর তাকে “ধার্মিক বা নির্দোষ বলে গ্রহণ” করেন (আদি ১৫:৬)। এই ধার্মিকতা অব্রাহাম আইনে বাধ্য হওয়ার ফলে পান নি বরং ঈশ্বরের উপরে বিশ্বাসের জন্যই তা পেয়েছেন। ঈশ্বর সে সময় অব্রাহামের সঙ্গে চুক্তি করেন (আদি ১৫:৭-২১)। শুধুমাত্র চুক্তি স্থাপন করার পরে, চুক্তির চিহ্ন হিসাবে ঈশ্বর অব্রাহাম ও তার পরিবারের পুরুষদের সুন্নত করার আদেশ দেন (আদি ১৭:১০)। তাই ঈশ্বর চুক্তি স্থাপনের শর্ত হিসাবে সুন্নত করার আদেশ বা আইন দেন নি, বরং চুক্তি স্থাপনের পরে একটি দৃশ্যমান চিহ্ন হিসাবে তা দিয়েছেন।
যতজন অব্রাহামের মত ঈশ্বরের উপরে বিশ্বাস রাখে, পৌল ততজনকে “অব্রাহামের বংশধর” বলেন (গালা ৩:৭), তারা জাতিতে যিহূদী হোক বা অযিহূদী। তা ছাড়া তিনি তাদেরকে অব্রাহামের মত আশীর্বাদের পাত্র বলেন (গালা ৩:৯)।
কিন্তু যতজন নিজের আইন পালন করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে (যিহূদী হোক বা অযিহূদী), তারা “অভিশপ্ত” (গালা ৩:১০)। কারণ এমন কেউ নেই যারা আসলে আইন-কানুন সম্পূর্ণভাবে পালন করে কিন্তু তারা তারপরেও আইন ভাঙ্গে এবং এভাবে নিজের উপরে এই অভিশাপ নিয়ে আসে। পৌল দেখান যখন যীশুকে ক্রুশে দেওয়া হয় (তাকে “গাছে টাঙ্গানো” হয়েছিল, দ্বিতীয় বিবরণ ২১:২৩), তখন তিনি সেই অভিশাপ নিজের উপর নিয়ে মারা গেলেন, যেন যতজন যীশুতে বিশ্বাস রাখে ততজন যীশুর ধার্মিকতা পায়। পৌল গালাতীয়দের নিজের আইন পালন করার ক্ষমতার উপরে নির্ভর করতে নিষেধ করেন (যা মিথ্যা বিশ্বাস) বরং যীশু তাদের জন্য যা করেছেন, তার উপর নির্ভর করতে বলেন (গালা ৩:৬-১৪)।
এতে একটি প্রশ্ন উঠে আসে: যদি তাই হয় তবে কেন ঈশ্বর অব্রাহামের চুক্তির চারশো বছর পরেও মোশি দ্বারা ইস্রায়েলকে আইন-কানুন দেন? পরে দেওয়া আইন কি আগের নির্দোষ বলে গ্রহণের প্রতিজ্ঞা বাতিল করে দেয়? পৌল যুক্তি দেখান যে তা নয়, পরের আইন আগের প্রতিজ্ঞা বাতিল করে না। তিনি আদিপুস্তক ২২:১৮ পদ উদ্ধৃতি করে বলেন যে “অব্রাহাম ও তার বংশের কাছে ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন”। “বংশ” বা “বংশধর” (অন্য অনুবাদে) এখানে একবচন হিসাবে বলা হয়েছে। পৌল দেখান যে যীশুই হলেন সেই একজন বংশধর যিনি অব্রাহামের প্রতিজ্ঞার উত্তরাধিকারী, এবং যীশুতে যতজন বিশ্বাস রাখে ততজন অব্রাহামের প্রতিজ্ঞার উত্তরাধিকারী, যেমন আদিপুস্তকের ভবিষ্যদ্বাণী বলে (গালা ৩:১৫-১৮)।
এতে আরো একটি প্রশ্ন উঠে আসে: পরে দেওয়া আইন-কানুন যদি আগের প্রতিজ্ঞা বাতিল না করে, তবে আইন কিসের জন্য দেওয়া হয়েছিল (গালা ৩:১৯)?
পৌল উত্তরে বলেন যে আইন-কানুনই ছিল একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত “আমাদের পরিচালনাকারী” (গালা ৩:২৩-২৫)। আইন-কানুন আমাদের পাপের চেতনা দিত, যাতে আমরা বুঝি আমাদের জন্য ক্ষমা পাওয়া কত জরুরী। যেন – যীশু যখন আসেন – আমরা নিঃশর্তে তাঁর উপরে ও তাঁর পরিত্রাণের উপরে বিশ্বাস রাখি।
যারা যীশুতে বিশ্বাস রাখে পৌল তাদের “ঈশ্বরের সন্তান” এবং “প্রতিজ্ঞার অধিকারী” বলেন। বিশ্বাসী হিসাবে তারা আর দাস নয় বরং স্বাধীন। এই স্বাধীনতায় তারা পিতার সঙ্গে সুসম্পর্কে ও তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতায় বাধ্য একটি জীবন কাটাতে পারে (গালা ৪:১,৭)। পৌল “সন্তান” শব্দ রূপকভাবে ব্যবহার করেন, একটি অন্তরঙ্গ ও অপরিবর্তনশীল প্রেমের সম্পর্ক বুঝানোর জন্য, এমন একটি সম্পর্ক যা পিতা নিঃশর্তভাবে ছেলেকে দেন এবং যা ছেলে মাত্র ‘গ্রহণ’ করতে পারে। ছেলে হল বাবার গর্ব, তার আনন্দ, তার উত্তরাধিকারী ও তার প্রতিনিধি।
গালাতীয় ৪ অধ্যায়ে পৌল আর একবার পুরাতন নিয়ম থেকে নির্দিষ্টভাবে অব্রাহামের জীবন থেকেই বিষয়টি প্রমাণ করে দেখান। পৌল অব্রাহাম ও সারার গল্প উল্লেখ করেন, যারা নিজের কৌশলে সন্তান পাওয়ার জন্য দাসী হাগার দ্বারা সন্তান লাভ করতে চান। এভাবে ইশ্মায়েলের জন্ম হয়। পৌল এই প্রচেষ্টাকে “মাংসের কার্য সকল” বলেন, ঈশ্বরের উপর নির্ভর না করে নিজের কৌশলে সন্তান লাভ। কিন্তু পরে ঈশ্বর তাদেরকে আশ্চর্যভাবে নিজস্ব একটি সন্তান দেন, ইসহাক, যাকে পৌল “প্রতিজ্ঞার ফলে জন্ম” নেওয়া সন্তান বলেন। ইশ্মায়েল যখন ছোট ইসহাককে কষ্ট দিতে শুরু করে তখন হাগার ও ইশ্মায়েলকে বের করে দেওয়া হয় (যদিও সে সময় ইশ্মায়েল প্রাপ্ত বয়সের)। পৌল এই গল্প একটি কাহিনী ভিত্তিক রূপক হিসাবে ব্যবহার করেন: দাসীর সন্তান ইশ্মায়েল, যার জন্ম মানুষের প্রচেষ্টায় হয়, তাকে আইন-কানুন, সিনয় পাহাড় ও বর্তমান যিরূশালেমের সাথে (যার মানে অবিশ্বাসী যিহূদী) তুলনা করা হয়। আসল স্ত্রী সারার ছেলে ইসহাককে দয়া, কালভেরী এবং ভবিষ্যৎ যিরূশালেমের সাথে (যার মানে বিশ্বাসীরা, যিহূদী হোক বা অযিহূদী হোক) তুলনা করা হয় (গালা ৪:২২-৩১)।
ব্যবহারিক বিষয়গুলি
আবেগের সঙ্গে পৌল গালাতীয়দের স্মরণ করতে বলেন যে, যখন তারা প্রথমে বিশ্বাসী হয়েছিল, সে সময় তারা পৌলকে কত আদরের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল (গালা ৪:১২-২০)। তিনি তাদের কয়েকটা চেতনাদায়ক প্রশ্ন করেন যেন তারা স্মরণ করে শুরুতে কিভাবে তারা বিশ্বাসী হয়েছিল এবং যেন তারা পরীক্ষা করে দেখে এখন (যখন তারা আইনের উপর জোর দিচ্ছে) তারা আসলে আরো ভাল করছে কিনা (গালা ৩:১-৫)। পৌল তাদের কঠিন একটি সাবধানবাণী দেন: তারা বিশ্বাসের সাথে ‘আইনে বাধ্য হয়ে ভাল কাজ’ করতে চেয়েছে কিন্তু তাতে তারা আসলটা হারিয়েছে: যদি তারা যীশুর দয়ার পাশাপাশি অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে এর অর্থ এই যে, তারা যীশুর দয়াকে অগ্রাহ্য করে – যার অর্থ এই যে তারা যীশুকেও অগ্রাহ্য করে।
পৌল তাদের জিজ্ঞাসা করেন, নিজের প্রচেষ্টায় আইন পালন করার উপর জোর দেওয়ার ফলে তারা কি আসলে আরো পবিত্রভাবে জীবন-যাপন করেছিল? পৌল দেখান, যা ঘটেছে তা ঠিক তার বিপরীত: তাদের জীবন আরো পবিত্র হয় নি বরং তাদের সম্পর্কগুলি আরো খারাপের দিকে গেছে: দ্বন্দ্ব, তুলনা, অহংকার, বিভেদ ও আত্ম-ধার্মিকতা বেড়েছে এবং ভাইয়ের প্রতি ভালবাসা কমেছে (গালা ৫:১৫)। এইগুলি পবিত্র আত্মার ফল নয়, বরং পাপ-স্বভাবের ফলাফল (কেরী: “মাংসের কার্য সকল”, গালা ৫:১৯-২১) – এতে আইন পূর্ণ হয় না। আইনের উপর জোর দিলে যে আইন আরো পালন করা হচ্ছে, তা নয়।
কিন্তু বিশ্বাসী হিসাবে আরো পবিত্র জীবন-যাপন করব কিভাবে? পৌল উত্তরে বলেন যে শুধুমাত্র যীশুর উপর নির্ভর করেই এবং পবিত্র আত্মার পরিচালনায় তা সম্ভব হয়। মানুষের মধ্যে যতটা পার্থক্য দেখা যায়, যীশুর দয়ায় সে পার্থক্যগুলি বাতিল হয়: সবাই পাপ করেছে, সবাই অযোগ্য, সবাই বিশ্বাসে পরিত্রাণ পায়। তাই অহংকার বা উচুঁ-নীচুর কিছুই নেই, বরং সবাই দয়া পেয়েছে বলে নম্রতা, সততা, একতা ও ভাইদের প্রতি ভালবাসাই হল উপযুক্ত মনোভাব (গালা ৩:২৬-২৮, গালা ৫:১৩-১৪)। যীশুর দয়ায় মানুষের মধ্যে তফাৎ বাতিল হয়: “যিহূদী ও অযিহূদীর মধ্যে, দাস ও স্বাধীন লোকের মধ্যে, স্ত্রীলোক ও পুরুষের মধ্যে কোন তফাৎ নেই” (গালা ৩:২৮)। পবিত্র আত্মার পরিচালনায় বিশ্বাসীর জীবনে যীশুর মত মনোভাবে তৈরি হয়: ভালবাসা, শান্তি, সহ্যগুণ, স্বনিয়ন্ত্রণ, এইগুলি পবিত্র আত্মার ফল (গালা ৫:২২)। যীশুর দয়ার উপর নির্ভর করে ও পবিত্র আত্মার পরিচালনায় তৈরি হয় যা মানুষের প্রচেষ্টা দ্বারা অসম্ভব: একটি বাধ্য ও পবিত্র জীবন। পবিত্র আত্মা বিশ্বাসীদের মধ্যে আইন পূর্ণ করেন।
মণ্ডলীতে বিভেদের সমাধান
গালাতীয় চিঠির শেষ অংশে পৌল নিশ্চিত করেন যেন তার এই চিঠি দ্বারা আরো বিভেদ সৃষ্টি না হয়। তিনি চান না যে গালাতীয় বিশ্বাসীরা তার কথা পরস্পরের সাথে তর্ক ও অন্যের ভুল প্রমাণ করার জন্য ব্যবহার করে । তিনি চান না যে তার চিঠি নিয়ে কেউ বলুক: “দেখেছ, আমি তো তোমাকে তা বলেছিলাম!” এভাবে তার চিঠি দ্বারা আরো বিভেদ সৃষ্টি হবে। এর প্রতিরোধে পৌল মণ্ডলীতে যতজন পরিপক্ক লোক ভ্রান্ত শিক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তাদেরকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেন, যেন তারা অন্য বিশ্বাসীদেরকে (যারা ভ্রান্ত শিক্ষায় প্রভাবিত হয়েছিল) দয়া দেখিয়ে পুনরায় গ্রহণ করে। পৌল বলেন যেন তারা পাপে পড়ে যাওয়া লোককে খুব নরম মনোভাব নিয়ে তুলে আনে (গালা ৬:১)। পৌল অনেক চেষ্টা করেন যেন মণ্ডলীতে বিভেদ সম্পূর্ণভাবে সমাধান হয় এবং একতা ফিরে আসে।
পৌল নিশ্চিত করতে চান যেন তার কথা দ্বারা একটি ‘বিপরীত আইন’ সৃষ্টি না হয়। যদি একজন বলে ‘সুন্নত গ্রহণ করতেই হবে!’ তবে তাতে আইনের উপর জোর দেওয়া হয়। যদি একজন বলে ‘সুন্নত গ্রহণ করা নিষেধ!’ তবে তাও হল আইনের উপর জোর দেওয়া, যদিও বিপরীত আইন। তাই পৌল বলেন যে দুইটা আদেশ ভুল, আসলে সুন্নত করা বা না করা কোন পার্থক্য তৈরি করে না (গালা ৬:১৫)। সুন্নত করা সমস্যা না, সমস্যা হল নিজের প্রচেষ্টায় আইন পালন করার উপর নির্ভর করা। যারা তাদের আইন পালনের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে না, তাদের জন্য সুন্নত করা নিষেধ নয়, আবশ্যকও নয়।
এই বিষয়ের একটি চমৎকার উদাহরণ হল প্রেরিত ১৬:৩। যখন পৌল অবশেষে গালাতীয় মণ্ডলীদের কাছে যান, তিনি তাদের মধ্য থেকে একজন ভাল যুবককে (তীমথিয়কে) পরিচর্য্যার জন্য নিযুক্ত করেন। নিযুক্ত করার সাথে সাথে পৌল তাকে সুন্নত করে ফেলেন! কেন? কেন পৌল এখন হঠাৎ করে নিজের হাতে একজন গালাতীয়কে সুন্নত করে ফেলেন? তাকে আরো ‘ধার্মিক’ বানানোর জন্য নয় বরং যেন সে যিহূদী সমাজ গৃহে প্রচার করতে পারেন। তাই: “সুন্নত করানো বা না করানোর কোন দামই নেই, খ্রীষ্টের মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টি হয়ে উঠাই হল বড় কথা” (গালা ৬:১৫)।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।