এমন একটি সময়ে যখন অন্যান্য প্রেরিতেরা ইতিমধ্যে শহীদ হয়েছেন তখন একমাত্র প্রেরিত যোহন যীশুর চোখের সাক্ষী হিসাবে এখনও বেঁচে আছেন। ৮০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে তিনি বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে একটি নতুন হুমকি আসতে দেখেন: সম্পূর্ণ রোম রাজ্যে সম্রাট পূজা শক্তিশালীভাবে বিস্তার লাভ করে। প্রথম শতাব্দীতে আস্তে-আস্তে রোমীয় সম্রাটেরা নিজেদের পূজা দাবি করতে শুরু করেন। সম্রাটের উদ্দেশ্যে শহরের পর শহরে মন্দির নির্মাণ হয়। এমন পর্যায় আসে যখন সম্রাটের উদ্দেশ্যে পূজা না করা মানে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। খ্রিষ্টানরা পূজা করতে অস্বীকার করার ফলে তারা রোম রাজ্যের রাষ্ট্রীয় শত্রু হয়ে যায়। যখন ৮১ খ্রীষ্টাব্দে ডোমিটিয়ান নামে একজন নতুন সম্রাট ক্ষমতায় আসেন, একটি বড় অত্যাচার শুরু হয়।
যোহন এশিয়া এলাকায় সাতটি মণ্ডলীর কাছে তার প্রকাশিত বাক্য লেখেন: ইফিষ, স্মূর্ণা, পর্গাম, থুয়াতীরা, সার্দ্দি, ফিলাদেলফিয়া ও লায়দিকেয়া। এশিয়া ছিল এমন একটি এলাকা যেখানে সম্রাট পূজা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং ফলে এই এলাকায় অত্যাচারও বেশ শক্তিশালী ছিল। মণ্ডলীগুলো শুধুমাত্র যিহূদীদের এবং চারিদিকের সংস্কৃতি থেকে চাপ পায়, তা নয় বরং যত সময় এগিয়ে যায় তারা রোমীয় সরকার দ্বারা তত অত্যাচারিত হতে থাকে। এশিয়া এলাকার পর্গাম শহরের মণ্ডলীতে ইতিমধ্যে একজন সদস্য শহীদ হয়েছেন (প্রকাশিত ২:১৩)।
এই ধরণের হুমকিপূর্ণ পরিবেশে বিশ্বাসীদের হৃদয়ে কি ধরণের প্রশ্ন ও সন্দেহ আসবে? ঈশ্বর কোথায়? ঈশ্বর কি দেখেন না? যত্ন করেন না? কেন ঈশ্বর এই অত্যাচার ঘটতে দেন? কেন তিনি কিছু করেন না? কেন আমাদের রক্ষা করেন না? সম্রাট কি যীশুর চেয়ে শক্তিশালী? আমরা কি পাপ করেছি যে ঈশ্বরের ক্রোধ আমাদের উপরে আসছে? এটি কি শাস্তি? যারা মারা যাচ্ছে, তারা কোথায় আছে? তারা কি যীশুর সঙ্গে আছে? আমাদের নিয়ে কি হবে? ন্যায় বিচার কোথায়? আর কত দিন এই অত্যাচার সহ্য করতে হবে?
প্রকাশিত বাক্য পুস্তক লেখার মাধ্যমে যোহন এই সব প্রশ্নের উত্তর দেন। শুধুমাত্র ‘আর কত দিন?’, এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দেন না। প্রকাশিত বাক্যে তিনি শক্তিশালী একটি দর্শনের বর্ণনা করেন: তিনি স্বর্গস্থ পিতা সিংহাসনে এবং সিংহাসনের সামনে পবিত্র আত্মা ও জবাই করা মেষ হিসাবে যীশুকে দেখতে পান। ত্রিত্ব ঈশ্বরই সিংহাসন থেকে ইতিহাসের সব ঘটনা, অর্থাৎ পৃথিবীর মঞ্চে যা চলে, তা সব নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরাই অনুমতি ছাড়া কিছুই ঘটে না এবং এমন কিছু নেই যা তাদের চোখের আড়ালে। তাঁরাই সব কিছু পরিচালনা করেন এবং স্বক্রিয়ভাবে বিশ্বাসীদের যত্ন নিচ্ছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা মণ্ডলীর যুগে আছি (পঞ্চমসপ্তমী থেকে যীশুর ২য় আগমন পর্যন্ত মণ্ডলীর যুগ বলা হয়), ততক্ষণ পর্যন্ত ভাল ও মন্দের যুদ্ধ চলবে, মণ্ডলী প্রায়ই অত্যাচারিত হবে এবং অনেক বার ঈশ্বরের আশ্চর্য উদ্ধারও দেখতে পাবে। ঈশ্বর কষ্টভোগ ঘটতে দেন, কিন্তু তিনি তাঁর শক্তিশালী হাত দ্বারা তাঁর লোকদের রক্ষা করবেন এবং অত্যাচারীদের বিচার করবেন। একদিন যীশু ফিরে আসবেন, তিনি সবাইকে পুনরুত্থিত করে মৃত্যুকে ধ্বংস করবেন, মন্দ আত্মা ও মন্দ মানুষদেরকে বিচার করবেন এবং সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে উদ্ধার করে শান্তিতে ও পূর্ণতায় নিয়ে আসবেন।
ইতিহাসের এই চমৎকার চূড়ান্ত অবস্থার নিশ্চয়তা পেয়ে যোহন চান যেন বিশ্বাসীরা বর্তমান কষ্টভোগ সহ্য করতে এবং যীশুর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে উৎসাহিত হয়। তিনি তাদের অনুপ্রেরণা দেন যেন তারা জবাই করা মেষের অনুসরণকারী হয় এবং যেন তারা – মেষ-শিশু যেমন – ঠিক তেমনি তাদের জীবনকে উৎসর্গ করা দ্বারাই জয়লাভ করে। যীশু তাদের জন্য ক্রুশে অনন্তকালীন পরিত্রাণ ও অনন্ত জীবন অর্জন করেছেন, একারণে তিনিই তাদের বিশ্বস্ততা পাওয়ার যোগ্য, এমন কি মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বস্ততা পাওয়া যোগ্য।
প্রকাশিত বাক্যের বিষয়ে প্রশ্ন
প্রকাশিত বাক্য! কত কঠিন একটি পুস্তক! প্রকাশিত বাক্যের বিষয় তুললে অনেক ভিন্ন ভিন্ন ধরণের আবেগ সৃষ্টি হয় বা সাড়া পাওয়া যায়:
ছবি
আপনি কি প্রকাশিত বাক্যের বিষয়ে উত্তেজিত? আপনি কি সর্বশেষ ‘যীশু এক্ষুনি ফিরে আসছেন’ এই ঢেউর উপরে আছেন? অথবা আপনি প্রকাশিত বাক্য নিয়ে কি ভয় পান? তা কি পড়তেও রাজি না? অথবা পড়লে কি দ্বিধাদ্বন্ধ লাগে? আপনি কি সন্দেহ করেন যে এই পুস্তকটি ঠিকমত ব্যাখ্যা করা সম্ভব? অথবা আপনার কি এই ধরণের লেখা নিয়ে কোন আগ্রহ নেই? অথবা প্রকাশিত বাক্য নিয়ে কি আপনার বিরক্ত লাগে? আপনি কি এত ভিন্ন ভিন্ন ভয়ংকর ব্যাখ্যা শুনেছেন যে আর একটা ব্যাখ্যা শুনতে চান না? আপনি কি এত ‘ঢেউর উপর’ গিয়েছিলেন যে এখন আপনি আর একটি ব্যাখ্যা বিশ্বাস করতে রাজি না? যীশুর দ্বিতীয় আগমন সম্বন্ধে লোকেদের বলা বিভিন্ন তারিখগুলো কি পার হতে এবং মিথ্যা হিসাবে প্রমাণিত হতে দেখেছেন? প্রচারকেরা পুস্তকটি দ্বারা মানুষদের ভয় দেখিয়ে বাধ্য করাতে চেষ্টা করেন – তা দেখে কি রাগান্বিত হন? অথবা আপনি প্রকাশিত বাক্যের বিষয়ে ভিত নয় বরং উৎসাহিত?
সত্যি কথা বলি: যদি একটি পত্রিকা প্রকাশিত বাক্যের মত কোন লেখা প্রকাশ করত তবে আমরা তাদের পাগল বলে পত্রিকাটি ফেলে দিতাম। কিন্তু প্রকাশিত বাক্য বাইবেলে আছে বলে আমরা তা করতে সাহস পাই না। প্রকাশিত বাক্য একরকম ভয়ংকর কিন্তু তার আবারও একটি আকর্ষণ আছে। মণ্ডলীতে দেখা যায় যে হয় পুস্তকটি নিয়ে কখনওই প্রচার করা হয় না – অথবা অর্ধেক প্রচারই প্রকাশিত বাক্য থেকে এবং তা অতি গুরুত্ব পায়।
প্রকাশিত বাক্যের পদগুলি উদ্ধৃতি করে অনেক বার চরমপন্থী ও মাথা-খারাপ ধরণের শিক্ষা দেওয়া হয়। যীশুর দ্বিতীয় আগমনের বিষয়ে সাল ও তারিখ ঠিক করে কিছু লেখক বই লিখেছেন যা অল্প দিনের মধ্যে খুব প্রচলিত হয়েছে (লেখকেরা ধনীও হয়েছেন) কিন্তু পরে তাদের ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয় নি বলে বইগুলি অর্থহীন হয়ে পড়েছে। যারা যীশুর দ্বিতীয় আগমনের ভুল তারিখ প্রকাশ করেছেন তাদের মধ্যে একজনও এগিয়ে এসে তাদের ভুল স্বীকার করেন নি বা ক্ষমা চান নি।
অনেক বার প্রচারকেরা প্রকাশিত বাক্য নিয়ে বিশ্বাসীদের ভয় দেখান, তাদের বাধ্য করান, তাদের অতি উদ্যোগ নিতে অনুপ্রেরণা দেন (যেমন অন্যদের কাছে সুসমাচার প্রচার করা)।
এই সব দেখে সহজে প্রশ্ন আসতে পারে: প্রকাশিত বাক্য কি প্রকৃতভাবে বুঝা সম্ভব? কেন ঈশ্বর এমন একটি পুস্তক দেন যা এত দ্বিধাদ্বন্ধ তৈরি করে? এর চেয়ে স্পষ্ট কিছু লিখতে দিলে কি আরো ভাল হত না? প্রকাশিত বাক্য থেকে দূরে থাকা কি আরো ভাল নয়? কিভাবে আমরা ভয় না দেখিয়ে এবং ভয় না পেয়ে তা ব্যাখ্যা করতে পারি?
প্রকাশিত বাক্য কিভাবে ব্যাখ্যা করব?
ভিত্তিক প্রশ্নটি হল: প্রকাশিত বাক্য প্রকৃতভাবে কাদের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে? যারা লোকদেরকে উত্তেজিত করে তোলার মত শিক্ষা দেয় তারা সবাই দাবি করে যে প্রকাশিত বাক্য শেষ কালের লোকদের উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ আমাদেরই উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। এটি বলে তারা এও দাবি করে যে বিগত দুই হাজার বছর পুস্তকটির পাঠকেরা আসলে কিছু বুঝে নি – কারণ তা বুঝা সম্ভব ছিল না। তারা মনে করে প্রকাশিত বাক্য হল ‘সীলমোহর করে রাখা পুস্তক’, অর্থাৎ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কেউ পুস্তকটি বুঝে নি। কিন্তু আমরা শেষ কালে আছি বলে এখন আমরাই বুঝি। তা-ই যদি মনে করি তবে এও বলতে হয় যে লেখক যোহন নিজের কথা নিজেই বোঝেন নি, এশিয়ার সাতটি মণ্ডলী যাদের কাছে তিনি লেখেন (প্রকাশিত ১:১১), তারাও কিছু বোঝে নি। কিন্তু কিছু না বুঝে কেন তারা এই লেখা কষ্ট করে সংরক্ষিত করে রেখেছে? কেন যীশু তাদের জন্য এমন একটি লেখা পাঠিয়েছেন যা তাদের কাছে কোন অর্থ প্রকাশ করে না এবং কঠিন পরিস্থিতিতে সাহায্যও করে না?
যারা প্রকাশিত বাক্য এভাবে ব্যাখ্যা করে তারা পুস্তকে এমন একটি কথা বা বিষয় খুঁজে বের করে, যা বর্তমান পৃথিবীর একটি ঘটনার সাথে মিল থাকে। যেমন তারা দাবি করে যে বাইবেলের এই কথা অমুখ আধুনিক রাজনৈতিক নেতাকে বুঝায় অথবা তমুখ জাতি বা বর্তমান ঘটনা বুঝায়। এভাবে যদি একটি পদ ব্যাখ্যা করি তবে আমরা এও দাবি করি যে আগের পাঠকেরা (যারা এই বর্তমান রাজনৈথিক নেতা সম্বন্ধে জানত না) তাদের জন্য পদটি ঠিকমত বুঝা সম্ভব ছিল না। তাই দুই হাজার বছর ধরে পাঠকেরা সব ভুল বুঝছে কিন্তু আমরা – এবং শুধুমাত্র আমরাই! – তা এখন ঠিকমত বুঝি। এই ধরণের কথায় অহংকার প্রকাশ পায় এবং তা উপযক্ত মতবাদ নয়।
কেন অনেকে প্রকাশিত বাক্য এভাবে ব্যাখ্যা করে? কারণ হল যে তারা মনে করে বাইবেলে এমন পদ আছে যা তাদের এই ব্যাখ্যা সমর্থন করে, যেমন দানিয়েল ১২:৮-৯: “এই সবের শেষ ফল কি হবে?” উত্তরে তিনি বললেন, “দানিয়েল, তুমি এই বিষয় নিয়ে আর চিন্তা কোরো না, কারণ শেষ সময় না আসা পর্যন্ত এই সব কথা বন্ধ করে সীলমোহর করে রাখা হয়েছে”। এই ধরণের পদ পড়ে তারা মনে করে যে প্রকাশিত বাক্য হল একটি “সীলমোহর করে রাখা পুস্তক” যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কেউ বুঝে নি। কিন্তু আমরা এখন শেষ কালে আছি বলেই আমরা তা বুঝতে পারি।
যদি প্রকাশিত বাক্য এভাবে ‘সীলমোহর করে রাখা পুস্তক’ হিসাবে বোঝানো হয় তাহলে অনেক সমস্যা সৃষ্টি: বিভিন্ন ব্যক্তি এই চিন্তার ভিত্তিতে অংক করে যীশুর দ্বিতীয় আগমনের তারিখ ঘোষণা করেছেন অথবা “খ্রীষ্টারী” কাকে বুঝায়, তা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এই পর্যন্ত প্রত্যেকটি ব্যাখ্যা ভুল হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। ভুল ঘোষণার তালিকা বেশ লম্বা: “খ্রীষ্টারী” হিসাবে ঘোষিত হয়েছে: সম্রাট নীরো, সম্রাট ডোমিটিয়ান, মুহাম্মাদ, মার্টিন লুথার, ক্যাথলিক পোপ, হিটলার, স্টালীন, ব্রেষ্নেভ, সাদ্দাম হোসেন ইত্যাদি। যীশুর দ্বিতীয় আগমনের ভুল তারিখের তালিকাও বেশ লম্বা: ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দ, ১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দ, আমাদের যুগে ৮ অগষ্ট ১৯৮৮, ২০০০ সাল, ২০১২ সাল … প্রত্যেকবার বিশ্বাসীদের মধ্যে উত্তেজনা ও ভয়ের একটি ঢেউ সৃষ্টি হয়েছে, প্রত্যেক ঘোষিত তারিখের পিছনের বাইবেল থেকে প্রমাণ দেখানো হয়েছে – কিন্তু প্রত্যেক তারিখ মিথ্যা হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে প্রকাশিত বাক্য ‘সীলমোহর করে রাখা পুস্তক’ মনে করে ভাল কোন মতবাদ তৈরি হয় নি!
আসলে “সীলহোমর করে রাখা পুস্তক” হল এমন একটি চিন্তা যা দাবি করে যে বিশ্বাসীদের ‘বিশেষ জ্ঞান বা প্রকাশ’ দরকার, তাই শুধুমাত্র কিছু বিশ্বাসীরা এটা বুঝে। কিন্তু অন্যদের নিয়ে কি হবে? নতুন নিয়ম আমাদের এই ধরণের শিক্ষা নিয়ে সাবধান করেন। বিশেষভাবে পৌল প্রায়ই জোর দিয়ে বলেন যে বিশ্বাসীদের যা জানা দরকার তা সবার কাছে প্রকাশিত হয়েছে, অল্প মাত্র বিশ্বাসীদের বিশেষ জ্ঞান থাকবে, তা নয় (ইফিষীয়, কলসীয়)।
তা ছাড়া লক্ষ্য করুন যে প্রকাশিত বাক্য পুস্তক নিজের সম্বন্ধে নির্দিষ্টভাবে বলে যে পুস্তকটি সীলমোহর করে রাখা চলবে না: “এই বইয়ের সমস্ত কথা, অর্থাৎ ঈশ্বরের বাক্য তুমি গোপন রেখো না, কারণ সময় কাছে এসে গেছে” (প্রকা ২২:১০)। যোহনের এই কথায় প্রকাশ পায় যে তিনি মনে করতেন তার পাঠকেরা পুস্তকটি অবশ্যই বুঝবে। পুস্তকটি তাদের হাতে থাকুক, খোলা থাকুক কারণ “সময় কাছে এসে গেছে”।
তবে প্রকাশিত বাক্য কিভাবে বুঝব?
তবে প্রকাশিত বাক্য কিভাবে বুঝব? কিভাবে ব্যাখ্যা করব? যেভাবে আমরা বাইবেলের প্রত্যেকটি পুস্তক ব্যাখ্যা করি, ঠিক তেমনি প্রকাশিত বাক্যও আমাদের ব্যাখ্যা করা দরকার। বাইবেলের প্রত্যেকটি পুস্তক (পুরাতন নিয়ম হোক বা নতুন নিয়ম হোক) একটি নির্দিষ্ট যুগে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অবিস্থত লোকদের জন্য লেখা হয়েছিল এবং পুস্তকটি তাদের পরিস্থিতির বিষয়ে ঈশ্বরের দৃষ্টি দেখাতে চেয়েছিল। তাই পুস্তকটি বুঝতে গেলে সেই পাঠকদের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করে তা বুঝতে হবে। কিন্তু একই সময়ে বাইবেলের প্রত্যেকটি পুস্তক হল পবিত্র আত্মা দিয়ে লিখিত ঈশ্বরের অনন্ত বাক্য যা প্রত্যেক যুগে এবং প্রত্যেকজনের জন্য প্রযোজ্য। তাই প্রত্যেকটি পুস্তক আমাদের কাছেও লেখা হয়েছে ও আমাদের কাছেও কথা বলে – এবং প্রকাশিত বাক্য ঠিক তেমনি। তাই প্রথমে আমাদের প্রকাশিত বাক্যের লেখক ও পাঠকদের ঐতিহাসিক পরিস্থতি বুঝতে হবে এবং এভাবে আমরা আমাদের যুগের জন্য উপযুক্ত প্রয়োগ পাব।
প্রকাশিত বাক্যের লেখক
যোহন নিজেকে পরিষ্কারভাবে লেখক হিসাবে প্রকাশ করেন (প্রকাশিত ১:১, ১:৪, ১:৯, ২২:৮)। কিন্তু কোন যোহন? তিনি নিজের পরিচয় হিসাবে বলেন “যীশুর দাস” এবং “তোমাদের ভাই যোহন” – এবং আর কিছু যোগ করতে প্রয়োজন মনে করেন না। এর জন্য – এবং মণ্ডলীর আদিপিতাদের শক্তিশালী সাক্ষ্যের কারণে – আমরা বুঝতে পারি প্রকাশিত বাক্যের লেখক হলেন সেই যোহন, সিবদিয়ের ছেলে, যাকোবের ভাই, বারোজন শিষ্যদের মধ্যে একজন, পেশায় জেলে। এমন একটি সময়ে যখন বারোজন প্রেরিত এবং পৌল ইতিমধ্যে শহীদ হয়েছেন (৭০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে) তখনও যীশুর শেষ চোখের সাক্ষী হিসাবে যোহন বেঁচে আছেন।যিরূশালেমের ধ্বসের পরে যোহন ইফিষ শহরে বাস করেন এবং এশিয়া মাইনর প্রদেশে মণ্ডলীদের জন্য দেখাশুনাকারী, প্রাচীন ও স্তম্ভ হয়ে যান। মণ্ডলীর আদিপিতারা (যাষ্টিন, ইরেন্যায়াস, আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লীমেন্ট, তের্তুল্লিয়ান) সবাই এই যোহনকে প্রকাশিত বাক্যের লেখক হিসাবে চিহ্নিত রাখেন।
প্রকাশিত বাক্য কাদের কাছে লেখা হয়েছে?
যোহন প্রকাশিত বাক্যে তার পাঠকদের “এশিয়ার সাতটি মণ্ডলী” হিসাবে চিহ্নিত রাখেন: ইফিষ, স্মূর্ণা, পর্গাম, থুয়াতীরা, সার্দ্দি, ফিলাদিলফিয়া ও লায়দিকেয়া। এশিয়া ছিল রোম রাজ্যের এশিয়া মাইনর প্রদেশের একটি এলাকা। আজ তা আধুনিক তুরস্ক দেশে পড়ে। স্মূর্ণা শহরের আধুনিক নাম হল Izmir।
প্রকাশিত বাক্য হল একটি ঘুর্ণায়মান চিঠি, যা একটি পর একটি মণ্ডলীর কাছে গিয়েছিল। মণ্ডলীদের ধারাবাহিক উল্লেক থেকে বুঝা যায় চিঠিটি কিভাবে ঘুরেছিল।
প্রকাশিত বাক্যের মধ্যে প্রত্যেকটি মণ্ডলীর জন্য একটি ছোট ব্যক্তিগত চিঠি বা নির্দেশনা দেওয়া আছে (প্রকাশিত বাক্য ২ ও ৩ অধ্যায় দেখুন)। প্রত্যেক শহরের বর্ণনা, ইতিহাস ও পরিস্থিতির জন্য “প্রকাশিত্য বাক্য – বিস্তারিত অধ্যয়ন” দেখুন।
মানচিত্র
পাঠকদের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
প্রকাশিত বাক্য ২ ও ৩ অধ্যায়ে মণ্ডলীদের ব্যক্তিগত নির্দেশনাগুলো পড়লে পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই সাতটি মণ্ডলী নিজেদেরকে অনেক চাপের মধ্যে খুঁজে পায়:
আত্মিক চাপ: যেমন নতুন নিয়মে বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় স্থানীয় যিহূদীরা প্রায়ই মণ্ডলীগুলোর উপরে চাপ প্রয়োগ করত, বিশেষভাবে স্মূর্ণা ও ফিলাদেলফিয়া মণ্ডলীতে। তা ছাড়া সাধারণ সংস্কৃতির বিভিন্ন ধরণের দেবতাপূজা থেকে মণ্ডলীদের উপর চাপ আসত, বিশেষভাবে পর্গাম ও থুয়াতীরা মণ্ডলীতে। তা ছাড়া মণ্ডলীর মধ্যে ভ্রান্ত শিক্ষা ছিল আর একটি বড় চ্যলেঞ্জ, বিশেষভাবে ইফিষ এ থুয়াতীরা মণ্ডলীতে। ভ্রান্ত শিক্ষা অনেকটা ছিল নস্টিসিসম (Gnosticism) ধরণের এবং যোহন তার অন্যান্য লেখায় এর বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছেন (যোহন লিখিত সুসমাচার, ১,২,৩ যোহন)।
অর্থনৈতিক চাপ: অর্থনৈতিক চাপ বিশেষভাবে স্মূর্ণা মণ্ডলীর ক্ষেত্রে উল্লিখিত এবং সম্ভবত তা হল থুয়াতীরার বিশ্বাসীদের আপোষের পিছেন একটি কারণ। ঐযুগে পেশাগুলো বানিহ্য সম্প্রদায় হিসাবে সাজানো ছিল এবং প্রত্যেকটি পেশার একটি সুরক্ষাকারী দেবতা ছিল। কাজের বা ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি সেই দেবতার মন্দিরে করা হত এবং প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠানে প্রায়ই দেবতা পূজায় উৎসর্গ করা মাংস খাওয়া এবং মন্দিরের পতিতাদের সাথে ব্যভিচার করা হত। বিশ্বাসীরা যদি এসব থেকে দূরে থাকত তবে এর অর্থ ছিল অর্থনৈতিক ও পেশাগত ক্ষতি এবং নিজের সমাজ থেকে বাদ পড়া।
রাজনৈতিক চাপ: যীশু এই সাতটি চিঠিতে বলেন যে স্মূর্ণার মণ্ডলী অত্যাচারিত হবে এবং কিছু বিশ্বাসীদের জেলে যেতে হবে। তিনি আরো বলেন যে পর্গাম মণ্ডলীতে ইতিমধ্যে আন্তিপাস নামে একজন শহীদ হয়েছেন (প্রকাশিত ২:১৩)। কিন্তু কিভাবে খ্রিষ্টান বিশ্বাসীরা রোমীয় সরকারের চোখে রাষ্ট্রীয় শত্রুতে পরিণত হয়েছে?
ঐতিহাসিক পরিস্থিতি: সম্রাট পূজার আগমন
রোম যখন গনতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্র হয়ে গিয়েছিল এবং সম্রাটদের ক্ষমতা দিন দিন বৃদ্ধি পেল, তখন রোমীয়রা সম্রাটদের দেব হিসাবে পূজা করতে লাগল। প্রথম সম্রাট জুলিয়াস কৈসরকে (৪৮-৪৪ খ্রীঃপূঃ) কিছু লোক স্বেচ্ছায় পূজা করতে শুরু করে, বিশেষভাবে তার মৃত্যুর পরে। সম্রাট আগস্ত (২৭ খ্রীঃপূঃ – ১৪ খ্রীঃ) নিজের জন্য ‘ঈশ্বরের পুত্র’ ও ‘শান্তিরাজ’ এই উপাধী দাবি করেন। সম্রাট কালিগুলা (৩৭-৪১ খ্রীঃ) প্রথম সম্রাট যিনি নিজের পূজা দাবি করেন এবং নিজের মূর্তি পূজার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মন্দিরে স্থাপন করেন। সম্রাট নীরো (৫৪-৬৮ খ্রীঃ) নিজেকে ‘ঐশ্বিক’ হিসাবে ঘোষণা করেন। কিন্তু সম্রাট ডোমিটিয়ান (৮১-৯৬ খ্রীঃ) হলেন সেই সম্রাট যিনি নিজের পূজা সারা রোম রাজ্যে দাবি করেন। শহরে শহরে সম্রাটের উদ্দেশ্যে মন্দির তৈরি হয় যেখানে রোম রাজ্যের সব নাগরিকদের সম্রাট পূজায় বাধ্য করা হয়। সম্রাট পূজা না করা মানে রোম রাজ্যের আইন অমান্য করা, রাষ্ট্রীয় শত্রুতে পরিণত হওয়া এবং সরকারকতৃক অত্যাচারিত হওয়া। রোমীয়দের জন্য নতুন কোন দেবতাকে পূজা করা বড় ব্যাপার নয় কিন্তু খ্রিষ্টানরা নিজেকে খুব বিপজ্জনক অবস্থায় খুঁজে পায়। মণ্ডলীর বিরুদ্ধে রোম শহরে নীরোর অত্যাচার ছিল অত্যন্ত হিংস্র (৬৪-৬৮ খ্রীঃ), কিন্তু তা ছিল স্থানীয় অত্যাচার এবং কয়েক বছর মাত্র। কিন্তু সম্রাট পূজার চাপ থেকে বিশ্বাসীরা কোথায় পালাবে? রোমীয় সাম্রাজ্যের বাইরে বাস করার মত স্থান আছে, মানুষ তা বুঝত না – এবং সারা রোম রাজ্যে সম্রাট পূজা দাবি করা হত।
বিশেষভাবে স্মূর্ণা ও ফিলাদিলফিয়া ছিল এমন শহর যা খুব তাড়াতাড়ি এবং আগ্রহের সঙ্গে সম্রাট পূজা গ্রহণ করেছিল। তাই শুরু থেকে এই শহর দু’টি সম্রাট পূজার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। সারা এশিয়া মাইনর প্রদেশে সম্রাট পূজার উদ্দেশ্য দ্বিতীয় মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল স্মূর্ণা শহরে। তাই এশিয়া মাইনরের সব মণ্ডলীর উপর, কিন্তু বিশেষভাবে স্মূর্ণা মণ্ডলীর উপরে সম্রাট পূজার চাপ ছিল।
কষ্টভোগের সময়ে মানুষের মনে যে প্রশ্ন আসে
যখন বিশ্বাসীদের উপর এই ধরণের চাপ বা অত্যাচার আসে তখন তাদের হৃদয়ে কি ধরণের আবেগ এবং মনে কি ধরণের প্রশ্ন আসতে পারে? যখন না চেয়ে আমি রাষ্ট্রীয় শত্রু ও অপরাধী হয়েছি, যখন সরকার অতি শক্তিশালী ও বিরুদ্ধীয়, যখন সরকার থেকে পালানোর কোন উপায় দেখি না, যখন প্রথম বিশ্বাসীরা শহীদ হয়েছেন তখন কি চিন্তা বা সন্দেহ আসেতে পারে?
- আমার জীবনের উপর ক্ষমতা কার? কে আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে? সম্রাট ডোমিটিয়ান যদি আমার জীবন ধ্বংস করেত পারে তবে তিনি কি যীশুর চেয়ে শক্তিশালী নন? যদি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান তবে কেন তিনি এই অত্যাচার থামান না? তাঁর কি ক্ষমতা নেই? তবে তা হল তিনি কি ধরণের ঈশ্বর?
- ক্ষমতা থাকলে কেন তিনি কিছু করেন না? তিনি কেন এটা ঘটার অনুমতি দেন? ঈশ্বর কি আমাদের উপর অসন্তুষ্ট? তিনি কি আমাদের বিচার করছেন? আমাদের দোষই বা কি? এটা কিসের শাস্তি? তিনি কি আমাদের পরিত্যাগ করেছেন? তিনি কি আমাদের ভুলে গেছেন? তিনি কি আমাদের ভালবাসেন না?
- যদি ঈশ্বরের ক্ষমতা নেই, বা কিছু করার ভালবাসা নেই তবে তার জন্য কেন অত্যাচারিত হব? যদি সাহায্য না করেন তবে কেন তাঁকে আরাধনা করব? তাহলে লাভ কি? তাহলে পরিত্রাণ মানে কি? তাহলে ঈশ্বরের জন্য কেন জীবন দেব? আমি কি মিথ্যায় বিশ্বাস করেছি?
- যারা মারা যাচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে কি হবে? শহীদরা কোথায়? ঈশ্বর তাদের কি উদ্ধার করবেন? তারা কি ঈশ্বরের অসন্তোষের কারণে মারা গেছে? যীশু কেন ফিরে আসেন না যেমন বলেছেন? আর কত দিন?
প্রকাশিত বাক্য লেখার উদ্দেশ্য হল ঠিক এই সন্দেহ ও প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া
যখন মণ্ডলী এত কষ্টের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায় তখন তার কি জানা প্রয়োজন? প্রকাশিত বাক্য ঠিক এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য কথা বলে: ঈশ্বরই সর্বশক্তিমান। তিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর মত আর কেউ নেই। তুমি মিথ্যা বিশ্বাস কর নি। যদিও অন্য রকম লাগে তবুও যা ঘটে তার কোন কিছুই ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। তাঁর অনুমতি ছাড়া কিছু ঘটে না। তোমার কষ্টভোগ অর্থহীন, তা নয়। ঈশ্বর সব কিছু উদ্ধারের দিকে নিয়ে আসতে জানেন। সম্রাটের ক্ষমতা আসলে কিছুই নয়, তুমি তার সামনে অসহায়, তা নয়। ঈশ্বর সব কিছুই দেখেন, তিনি সব কিছুই জানেন। তিনি প্রত্যেক অন্যায়ের বিচার করবেন। এক দিন তিনি প্রত্যেক অন্যায় ও মন্দ কাজের বিচার করবেন এবং সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেবেন – মন্দ আত্মা ও মন্দ মানুষকে। ঈশ্বরই ন্যায্য। ঈশ্বরই ন্যায় বিচারক। একদিন তিনি সব কিছু ঠিক করে দেবেন এবং নতুন করে দেবেন। মৃত্য শেষ কথা নয়। অনন্ত জীবন বাস্তব। যারা শহীদ হয়েছেন তারা তাঁরই সামনে আছেন। এমন নয় যে তারা দোষ করেছে বরং তারাই বিশ্বস্ত, তারাই ঈশ্বরকে তাদের জীবন ও মৃত্যু দিয়ে গৌরবান্বিত করেছেন এবং তারাই তাঁর বিশেষ যত্নে আছেন। ঈশ্বর তাদের ভালবাসেন, তোমাকেও ভালবাসেন। এমন নয় যে ঈশ্বর তোমাকে নিয়ে অসন্তুষ্ট অথবা তোমাকে ত্যাগ করেছেন। তুমি তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত হও, যাই আসুক না কেন। ঈশ্বর মৃত্যু ও অনন্ত জীবনের কর্তা। যেমন যীশু তাঁর জীবন দিয়েছেন এবং জবাই করা মেষ-শিশু হয়েছেন, ঠিক তেমনি তুমি তাঁর প্রতি বাধ্য হও। যীশুই যোগ্য। যীশুই সেই জীবনদানকারী মেষ কিন্তু তিনিও সেই গর্জন করা সিংহ, সেই জয়ী যোদ্ধে, যিনি দয়ায় ও ন্যায্যতায় চিরকাল রাজত্ব করবেন। তিনি তোমাকে লজ্জিত হতে দেবেন না, তিনি তোমাকে জীবন মুকুট দান করবেন (প্রকাশিত ২:১০)।
প্রকাশিত বাক্য শক্তিশালীভাবে অত্যাচারিতদের প্রশ্ন ও সন্দেহের উত্তর দেন, তাদেরকে আশা, স্থিরতা ও সাহস দান করেন। শুধুমাত্র একটি প্রশ্ন উত্তর পায় না: ‘আর কত দিন?’। অদ্ভুত বিষয় যে অনেক আধুনিক পাঠক প্রকাশিত বাক্য থেকে ঠিক সেই উত্তর বের করতে চায় যা প্রকাশিত্য বাক্য দিতে চায় না! অনেকে প্রকাশিত বাক্য থেকে ‘শেষ কালের ঘটনার সময় তালিকা’ পেতে চায় এবং বিশেষভাবে যীশুর দ্বিতীয় আগমনের তারিখ জানতে চায়। কিন্তু প্রকাশিত বাক্য লেখা হয় নি শেষকাল সম্বন্ধীয় কৌতুহল মেটানোর জন্য বরং লেখা হয়েছে আমাদের জানানোর জন্য সর্বশেষে কি বাস্তবতা টিকে থাকবে।
প্রকাশিত বাক্য অত্যাচারিত মণ্ডলীকে এমন একটি দৃষ্টি দিতে চায় যাতে তাদের স্থিরতা, বিশ্বাস, সহ্য করার শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পায়। এইটা হল এই পুস্তক লেখার উদ্দেশ্য। যদি আমরা পুস্তকটি এমনভাবে ব্যাখ্যা করি যে বিশ্বাসীরা ভয় পায় তবে আমরা ভুল ব্যাখ্যা করছি।
প্রকাশিত বাক্য লেখার বিশেষ ধরণ
প্রকাশিত বাক্য লেখায় একটি বিশেষ ধরণ ব্যবহৃত হয়েছে যা আধুনিক পাঠক হিসাবে বুঝতে আমাদের একটু কষ্ট হয়। কিছু ভিত্তিক বিষয় লক্ষ্য করুন:
প্রকাশিত বাক্য হল একটি চিঠি
প্রকাশিত বাক্য পুস্তকে চিঠির একটি কাঠামো আছে, যেমন নতুন নিয়মের অন্যান্য চিঠিতেও পাওয়া যায়। প্রথমে লেখক তার নাম বলেন এবং কার কাছে লিখেছেন, তা উল্লেখ করেন (প্রকা ১:৪)। তিনি একটি আশীর্বাদ ও প্রার্থনা দিয়ে তার কথা শুরু করেন (প্রকা ১:৪-৮) এবং তার লেখার শেষে আবারও একটি আশীর্বাদ দিয়ে চিঠি সমাপ্ত করেন (প্রকা ২২:২১)।
প্রকাশিত বাক্য হল একটি খোলা, ঘুর্ণায়মান চিঠি যা সাতটি মণ্ডলীতে পড়ানো হয়। সার্বিক চিঠির মধ্যে সাতটি মণ্ডলীর নামে ছোট ব্যক্তিগত নির্দেশনাও পাওয়া যায় (প্রকা ২ ও ৩)। চিঠি খোলা বলে প্রত্যেকটি মণ্ডলী জানত অন্য একটি মণ্ডলীকে কি বলা হয়েছে।
প্রকাশিত বাক্য হল একটি ভাববাণী
প্রকাশিত বাক্য নিজেকে ভাববাণী হিসাবে চিহ্নিত রাখে (প্রকা ১:৩, ১০:১১, ১৯:১০, ২২:৬,১০, ২২:১৮-১৯)। পৌল ১ করি ১৪:৩ পদে দাবি করেন যে সব ভাববাণী হতে হয় “মানুষের কাছে এমন কথা যা তাদের গড়ে তোলে এবং উৎসাহ ও সান্ত্বনা দেয়”। প্রকাশিত বাক্য ভাবাবাণী হিসাবে এই কথার মধ্যেও পড়ে। যদি আমরা প্রকাশিত বাক্য তার চেয়ে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করি (ভয় ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে) তবে আমরা তা ভুল ব্যাখ্যা করি!
প্রকাশিত বাক্য পুস্তকে অবশ্যই শেষ কাল সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়া যায়, কিন্তু ভবিষ্যতের বিষয়ে কৌতুহল মেটানোর চেয়ে পুস্তকটি বিশ্বাসীদের সাহায্য করতে চায়। পুস্তকটি তাদের বুঝাতে চায় বর্তমান যুগে কি চলে, তা নিয়ে ঈশ্বরের দৃষ্টি কি এবং তারা কিভাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বাস ধরে রাখতে পারে।
প্রকাশিত বাক্য হল “প্রকাশ” (apocalypse)
প্রকাশিত বাক্য ১:১ পদে যোহন তার লেখাকে একটি “প্রকাশ” বলেন, গ্রীক ভাষায় শব্দটি হল “apocalypse” বা “এ্যপোকালিপ্স্”। শেষকাল সম্বন্ধীয় ভয় দেখানোর মত শিক্ষা শুনতে শুনতে আমাদের কানে “এ্যপোকালিপ্স্” শব্দ খুব রহস্যজনক ও ভয়ংকর একটি শব্দ হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে কথাটি বেশ সাধারণ এবং তার অর্থও সাধারণ: “এ্যপোকালিপ্স্” মানে ‘প্রকাশিত, পরিষ্কারভাবে দেখানো, পরদা সরানো, ঘোমটা উঠানো’। তাই প্রকাশিত্য বাক্য হওয়ার কথা না রহস্যজনক, গোলমাল লাগার মত একটি ভয়ংকর গুপ্ত জ্ঞান বরং তার বিপরীত: প্রকাশিত বাক্য কিছুটা পরিষ্কারভাবে দেখাতে চায়।
কিন্তু ঠিক কি পরিষ্কারভাবে দেখায়? অথবা একই প্রশ্ন ভিন্নভাবে বলা: প্রকাশিত বাক্য আসলে ঠিক কি প্রকাশ করে? এইটা অবশ্যই খুব গরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যার উত্তর দেওয়া হবে।
‘এ্যপোকালিপ্টিক’ ধরণের লেখা বাইবেলে বেশ কিছু পুস্তকে পাওয়া যায় (যেমন দানিয়েল ৭-১২) এবং বাইবেলের বাইরেও ঐযুগের বেশ কয়েকটি পুস্তক আছে যাতে এই লেখার ধরণ ব্যবহৃত।
এ্যপোকালিপ্টিক লেখার ধরণ
এ্যপোকালিপ্টিক লেখার ধরণ উভয় বাইবেলের বাইরে এবং বাইবেলের কয়েকটি পুস্তকে ব্যবহৃত। এ্যপোকালিপ্টিক লেখার উদ্দেশ্য হল অত্যচারিত পাঠকদের উৎসাহ দান। এ্যপোকালিপ্টিক লেখা একটি বড় যুদ্ধ দেখায়: মন্দ ভালর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কিন্তু অবশেষে মন্দকে বিচার করা হবে এবং অত্যাচারিতদের উদ্ধার করা হবে। মন্দ পরাজিত হবে, ভাল জয়লাভ করবে। এ্যপোকালিপ্টিক লেখার ধরণ অনেক চিহ্ন, ছবি, দর্শন, স্বপ্ন, সংখ্যা, জন্তু ও রূপক ব্যবহার করে। কিছু ঘটনা, যেমন বিদ্যুৎ চমকানো, শিলা বৃষ্টি, ভুমিকম্প, তারা পড়ে যাবে ইত্যাদি এসব ঈশ্বরের ক্ষমতা অথবা বর্ণিত ঘটনার গুরুত্ব দেখায়।
এ্যপোকালিপ্টিক লেখার ধরণে চিহ্ন, ছবি, জন্তু বা সংখ্যা রূপক অর্থে ব্যবহৃত। সংখ্যাগুলো পরিসংখ্যান বা অংকের বিষয় নয় বরং রূপক অর্থ প্রকাশ করে। যেমন ‘এক হাজার বছর’ মানে ‘অনেক দিন’ এবং ‘তিন ভাগ’ মানে ‘একটি বড় অংশ’। সংখ্যার রূপক অর্থের আরো বর্ণনা চাইলে, দয়া করে “প্রকাশিত বাক্য – বিস্তারিত অধ্যয়ন” দেখুন।
এ্যপোকালিপ্টিক লেখাগুলো অনেক সাজানো এবং তাতে একটি স্পষ্ট কাঠামো আছে, যার মাধ্যমে দেখানো হয় যে ঈশ্বর সব কিছুর উপরে রাজত্ব করেন, এমন কিছু নেই যা তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কাঠামো থাকলেও এ্যপোকালিপ্টিক লেখা কিন্তু সময় অনুসারে সাজানো নয়, বরং একই বিষয় কয়েক বার একটু ভিন্নভাবে দেখানো হয়। লেখাটি পুনাবৃত্তিমূলক এবং চক্রাকারে চলে, যেমন: প্রকাশিত বাক্য ১১:১৫-১৬ পদ পড়লে বোধ হয় যে তা হল শেষ অবস্থার একটি বর্ণনা: “তখন স্বর্গে জোরে জোরে বলা হল, “জগতের রাজ্য এখন আমাদের প্রভু ও তাঁর মশীহের হয়েছে। তিনি চিরকাল ধরে রাজত্ব করবেন”। কিন্তু ঠিক পরের পদগুলোতে (প্রকা ১২:৩-৪) আবার বিশৃঙ্খলা দেখা যায় “তারপর স্বর্গে আর একটা চিহ্ন দেখা গেল-আগুনের মত লাল একটা বিরাট দানব … তার লেজ দিয়ে সে আকাশের তিন ভাগের এক ভাগ তারা টেনে এনে পৃথিবীতে ছুঁড়ে ফেলে দিল … যে স্ত্রীলোকটির সন্তান হতে যাচ্ছিল দানবটা তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল যেন সন্তানের জন্ম হলেই সে খেয়ে ফেলতে পারে”। তাতে বুঝা যায় যে এই পদগুলোতে আমরা নতুন একটি চক্রে আছি, অর্থাৎ শেষ অবস্থা দেখানোর পরে ফিরে গিয়ে আবার আগের একটি ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। যদি প্রকাশিত বাক্য থেকে একটি ধারাবাহিক সময় তালিকা তৈরি করতে চান তবে অবশ্যই মাথা ঘুরবে!
এ্যপোকালিপ্টিক লেখার ধরণ বুঝতে চাইলে নিজেকে খুঁটিনাটি বিষয়গুলোতে হারাবেন না। লেখাটি ভালভাবে বুঝতে চাইলে এক ধাপ পিছিয়ে সম্পূর্ণ ছবি একসাথে দেখুন। জিজ্ঞাসা করুন: সব মিলিয়ে দেখে এই ছবি শ্রোতাদের মধ্যে কি চিন্তা বা আবেগ সৃষ্টি করে?
প্রকাশিত বাক্যের সাধারণ সময় তালিকা
কেউ কেউ কালানুক্রমিক চিন্তা অনুসারে প্রকাশিত বাক্য থেকে খুব বিস্তারিত ও জটিল সময় তালিকা বের করেছে – এবং তার ভিত্তিতে যীশুর দ্বিতীয় আগমনের বেশ কয়েকটি ভুল তারিখও বের করেছে। কিন্তু প্রকৃতভাবে প্রকাশিত বাক্যের সময় তালিকা খুব সহজ-সরল এবং যীশু তা তাঁর শিক্ষায় ইতিমধ্যে প্রকাশিত করেছেন।
- যীশুর প্রথম আগমন: যীশু শিশু হিসাবে জন্ম নেন, প্রায় ত্রিশ বছর এই পৃথিবীতে জীবন-যাপন করেন, পরবর্তীতে তিন বছর ধরে পরিচর্যা করেন, শেষে ক্রুশে মারা যান এবং পুনরুত্থিত হন। পুনরুত্থানের পের তিনি নিজেকে শিষ্যদের কাছে প্রকাশ করেন, স্বর্গস্ত পিতার কাছে ফিরে যান এবং নিজের পরিবর্তে পবিত্র আত্মাকে পাঠান। পবিত্র আত্মার পরিচালনায় প্রথম মণ্ডলী স্থাপিত হয় এবং সুসমাচার পৃথিবীতে ছড়িয়ে যেতে শুরু করে।
- মণ্ডলীর যুগ বা দু’রাজ্যের দ্বন্দ্বের যুগ: পঞ্চাশত্তমী দিনে পিতর তার প্রচারে (প্রেরিত ২:১৭) বলেন যে আমরা “শেষ কালে” আছি। সুসমাচার ছড়িয়ে পড়বে, মণ্ডলী বৃদ্ধি পাবে এবং বিশ্বাসীরা অত্যাচর ও যীশুর সুরক্ষা বা জয় উভয় উপলব্দি করবে। তারা কখনও কখনও দেখবে ঈশ্বরের আশ্চর্য উদ্ধার কিন্তু কখনও কখনও কষ্টভোগ ও মৃত্যুর সম্মুখীনও হবে। দুই হাজার বছর ধরে মণ্ডলী এই বাস্তবতার মধ্যেই আছে, ঈশ্বরের রাজ্য উপস্থিত কিন্তু পাপ, মন্দ ও অন্যায় এখনও চলছে: দু’রাজ্যের দ্বন্দ্বের যুগ।
- যীশুর দ্বিতীয় আগমন: যীশু একদিন ফিরে আসবেন, শিশু হিসাবে না বরং রাজাদের রাজা ও প্রভুদের প্রভু হিসাবে। তিনি সেই হত মেষ কিন্তু একই সাথে জয়ী, যিহূদা বংশের সিংহ এবং সাদা ঘোড়ার উপরে সেই বীরযোদ্ধা। তিনি মন্দ, অন্যায়, মৃত্যু ও শয়তানকে পরাজিত করবেন। সবাই পুনরুত্থিত হবে (এভাবেই মৃত্যু বাতিল) এবং বিচারে দাঁড়াবে। মন্দ আত্মা ও মন্দ মানুষ চিরকালের জন্য বন্দী করা হবে।
- স্বর্গ: ঈশ্বর একটি নতুন মহাকাশ ও একটি নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করবেন। দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান, বস্তু জগত বা আত্মিক জগত – সব কিছু পুনরায় স্থাপন ও উদ্ধার করা হবে, যীশুর ন্যায়ের রাজত্বের অধীনে ও মিলনে আনা হবে। যেমন হওয়ার কথা ছিল, সব কিছু তেমনই হয়ে যাবে। সব কিছু হবে চমৎকার, সুন্দর, শান্তিপূর্ণ এবং ন্যায্য: মানুষ আবার ঈশ্বরের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে থাকবে, সেই ঈশ্বর যিনি সর্বেসর্বা।
নিচে দেওয়া সময় তালিকায় এবং পরে দেওয়া প্রকাশিত বাক্যের কাঠামোতে এই তিনটি রঙ্গের ব্যবহার লক্ষ করুন (কালো = প্রথম আগমন, নীল = মণ্ডলীর যুগ, লাল = যীশুর দ্বিতীয় আগমন, সবুজ = স্বর্গ)। প্রকাশিত বাক্যে সর্বিক কাঠামোতে লক্ষ্য করুন যে তাতে সাতটি অভিনয় আছে এবং প্রত্যেকটি অভিসয়ে সাতটি দৃশ্য আছে।
চার্ট
সবার চোখ ঈশ্বরের দিকে
প্রকাশিত বাক্যে ১ অধ্যায়ে যোহন যীশুর একটি দর্শন পান যেখানে যীশু ঈশ্বর হিসাবে প্রকাশিত। যীশু ও যোহন ছিলেন ঘনিষ্ট বন্ধু, কিন্তু যখন যোহন এই দর্শনে যীশুকে ঈশ্বর হিসাবে দেখেন তখন তিনি উবুড় হয়ে পড়েন।
দর্শনে যীশুর বর্ণনা তাঁর পবিত্রতা, শুচিতা, জীবন, সৌন্দর্য ও ক্ষমতা প্রকাশ করে। যীশু সাতটি বাতিদানের মাঝে উপস্থিত। যোহনকে বুঝানো হয় যে সেই সাতটি বাতিদান হল সাতটি মণ্ডলী। তাই যীশু মণ্ডলীগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আছেন, তিঁনি তাদের অবস্থা দেখেন এবং তাদের কান্না শোনেন, তিঁনি তাদেরকে তাঁর ডান হতে ধরে রাখেন – এটি সান্ত্বনা ও উৎসাহদানকারী একটি ছবি।
প্রকাশিত বাক্য ২ ও ৩ অধ্যায়ে যীশু প্রত্যেক মণ্ডলীর কাছে কি বলেন, যোহন তা লিখিত রাখেন। যীশু প্রত্যেকটি মণ্ডলীকে নির্দিষ্টভাবে প্রশংসা ও ধমক, প্রতিজ্ঞা ও সাবধানবাণী দেন। প্রত্যেক মণ্ডলী কি চ্যালেঞ্জের সম্মুখে আছে, তা যীশু উল্লেখ করেন এবং তিনি তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট পুরষ্কার প্রদানের প্রতিজ্ঞা দ্বারা বিশ্বাস ধরে রাখতে এবং বিশ্বস্ত হতে উৎসাহিত করেন।
প্রকাশিত বাক্য ৪ অধ্যায় থেকে আসল এ্যপোকালিপ্স শুরু। প্রত্যেক অভিনয়ের শুরুতে লেখক আমাদের চোখ ঈশ্বরের দিকে ও তাঁর সিংহাসেনের দিকে আকৃষ্ট করেন। প্রত্যেকটি অভিনয়ের শুরুতে তিনি আমাদেরকে ঈশ্বরের ক্ষমতা, পবিত্রতা, সৌন্দর্য ও জ্ঞান স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি সেই যোগ্য ঈশ্বরকে স্মরণ করিয়ে দেন, যাঁকে ২৪জন বৃদ্ধরা (যা ইস্রায়েল ও মণ্ডলীকে বুঝায়), চারটি জীবন্ত প্রাণী (যা সৃষ্টিকে বুঝায়), হাজার হাজার স্বর্গদূত এবং প্রত্যেক জাতি, গোষ্ঠি ও ভাষার মানুষ (যা বিশ্বাসীদের বুঝায়) আরাধনা করে।
প্রকাশিত বাক্য পুস্তক একটি অতিসাজানো নাটকের মত, সব কিছুর একটি ধারাবাহিকতা, একটি সঠিক সময় ও ভূমিকা আছে। ঈশ্বরের সিংহাসনের সামনে মঞ্চে যা কি ঘটুক না কেন, সব কিছুই ঈশ্বরের সামনে, ঈশ্বরের অনুমতিতে এবং ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণে। যদিও মঞ্চে অনেক ভয়ংকর ঘটনা ঘটে তবুও সব সময় পাঠকের চোখ ঈশ্বরের সিংহাসনের দিকে আকৃষ্ট করা হয়। ঈশ্বর সব কিছুই জানেন এবং তিনি সর্বশেষে সব কিছু তাঁর মহাপরিকল্পনা অনুসারে পূর্ণতায় নিয়ে যাবেন। তিনি ইতিহাসের কর্তা। শেষে শুধুমাত্র তাঁরই ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে।
প্রকাশিত বাক্য পুস্তকে যীশুকে দু’ভাবে দেখানো হয়: তিনি সেই স্মানিত যিহূদা বংশের সিংহ, শক্তিশালী ও জয়ী, কিন্তু একই সাথে তিনি সেই হত মেষ। তিনি তাঁর জীবন দানের মাধ্যমে সব কিছুর উপর জয়লাভ করেছেন। ঠিক তেমনি প্রকাশিত বাক্য দেখায় যে বিশ্বসীরা ক্ষমতা দ্বারা নয় বরং মেষ-শিশুর মত ত্যাগ-স্বীকার দ্বারা জয়লাভ করে (প্রকা ১২:১১)।
প্রথম কয়েকটি অভিনয় মণ্ডলীর যুগ বুঝায় (নীল রং দিয়ে দেখানো): মণ্ডলী জয়ী, বৃদ্ধি পাচ্ছে ও সুসমাচার ছড়িয়ে দিচ্ছে কিন্তু একই সাথে মণ্ডলী অত্যাচারিত হয় এবং কষ্টভোগ করে। ঈশ্বর মাঝে মধ্যে আংশিকভাবে মন্দকে বিচার করেন (“তিন ভাগ” বা “চার ভাগ” মানে ‘আংশিক’) এবং বিশ্বাসীদের আশ্চর্যভাবে রক্ষা করেন – কিন্তু অনেক বার বিশ্বাসীরা তাদের মৃত্যু দ্বারাও ঈশ্বরকে গৌরবান্বিত করে।
মাঝখানে কয়েকটি অভিনয় শেষ বিচারকে বুঝায় (লাল রং দিয়ে দেখানো): ঈশ্বর সব কিছুর বিচার করবেন (এখানে “তিন ভাগ” ধরণের শব্দ আর নেই বরং “সব” ও “সমস্ত” ধরণের শব্দ পাওয়া যায়)। ঈশ্বর মন্দ রাজনৈতিক ক্ষমতাকে পরাজিত করবেন (প্রথম জন্তু ও বাবিল), তিনি প্রতারণাকারী ও অত্যাচারী আত্মিক বা ধর্মীয় ক্ষমতাকে পরাজিত করবেন (দ্বিতীয় জন্তু) এবং তিনি শয়তানেক (দানব, সাপ), মন্দ আত্মাদের এবং সব মন্দ ও অত্যাচারী মানুষকেও বিচার করবেন (পৃথিবীর রাজারা)। সবাইকে পুনরুত্থিত করা হবে – শাস্তির জন্য অথবা অনন্ত জীবনের জন্য। সবাই পুনরুত্থিত হবে মানে মৃত্যুকেও বাতিল করা হবে।
শেষ অভিনয়গুলোতে (সবুজ রং দিয়ে দেখানো) ঈশ্বর সমস্ত সৃষ্টিকে সম্পূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার করেন। সব কিছু যীশুর ন্যায় ও মঙ্গলময় রাজত্বের অধীনে আনা হবে এবং এভাবে সব কিছু তার সঠিক ভূমিকা পাবে। মানুষকে ঈশ্বরের সঙ্গে সুসম্পর্কে ও সহভাগিতায় ফিরিয়ে আনা হবে। কোন মন্দতা, কষ্টভোগ বা বিভেদ আর থাকবে না।
প্রকাশিত বাক্যের মূল সংবাদ
সারাংশে বলা যায় যে প্রকাশিত বাক্য পুস্তক আমাদেরকে ভয়ংকর ভবিষ্যৎ ঘটনাগুলো জানানোর জন্য লেখা হয় নি। বরং পুস্তকটি আমাদের দেখাতে চায় যে পৃথিবীর মঞ্চে যা কিছুই ঘটুক না কেন (যত অত্যাচার, অন্যায়, প্রতারণা বা মৃত্যু হোক না কেন) ঈশ্বর তারপরও সিংহাসেনে বসে আছেন। তিনি তারপরেও সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন এবং ইতিহাস তাঁর সেই মঙ্গল উদ্দেশ্যে পরিচলনা করবেন। ঈশ্বর সব কিছু দেখেন, ঈশ্বর সব কিছু জানেন এবং তিনি নিশ্চিত করবেন যে সর্বশেষে মন্দকে পরাজিত হবে, অন্যায়ের বিচার করা হবে এবং সব কিছুর পুরুদ্ধার করা হবে।
ছবি
প্রকাশিত বাক্য তাই কি প্রকাশিত করে? প্রকাশিত বাক্য প্রাথমিকভাবে ঈশ্বর নিজেকেই প্রকাশিত করেন, যিনি সিংহাসেন বসে আছেন, যিনি সর্বক্ষমতার ও ভালবাসার ঈশ্বর, যিনি মন্দকে বিচার করেন এবং তাঁর লোকদেরকে উদ্ধার করেন, যিনি সর্বশেষে এমন কি সম্পূর্ণ সৃষ্টির পুনরুদ্ধার ঘটান। সম্রাট পূজার সম্মুখীন এশিয়ার সাতটি মণ্ডলীর – এবং যে কোন যুগে অত্যাচারিত বিশ্বাসীদের – কি শোনা প্রয়োজন? পৃথিবীতে অনেক খারাপ কিছু ঘটবে, তা কি শোনা প্রয়োজন? না, তা আমরা ইতিমধ্যে জানি! যে প্রকাশ প্রয়োজন তা হল এই: পৃথিবীর মঞ্চে অনেক মন্দ ঘটনা ঘটলেও পিছনে (অদৃশ্যভাবে!) ঈশ্বর সিংহাসনে আছেন। তিনি তারপরেও সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তাঁর মহাপরিকল্পনা অনুসারে তাঁরই মঙ্গল উদ্দেশ্যে পূর্ণ করেন। এইটা হল প্রকাশিত বাক্যের সেই সান্ত্বনাদানকারী, নিশ্চয়তাদানকারী ও উৎসাহদানকারী সংবাদ।