মথি বা লেবী (যিহূদী নাম) হলেন যীশুর বারোজন শিষ্যদের মধ্যে একজন। তিনি সেই কর-আদায়কারী ছিলেন যাকে যীশু প্রেরিত হওয়ার আহ্বান দেন। মথি তার সুসমাচারে নিজের নাম সরাসরি উল্লেখ করেন না যেমন অন্যান্য সুসমাচারের লেখকেরাও উল্লেখ করেন না। কিন্তু মণ্ডলীর আদিপিতারা (যেমন আদিপিতা পাপিয়াস, ওরিগেন, ইরেন্যায়াস, ইউসেবিয়াস, জেরম এবং পান্ট্যানাস) মথিকে প্রথম সুসমাচারের লেখক হিসাবে চিহ্নিত করেন।
মার্ক, লূক ও যোহনের চেয়ে মথি তার সুসমাচারে অনেক বেশি পুরাতন নিয়মের উদ্ধৃতি দেন। এতে বুঝা যায় যে মথি অবশ্যই যিহূদীদের জন্য এই সুসমাচারটি লেখেন। এরা হল এমন যিহূদী যারা ইতিমধ্যে যীশুতে বিশ্বাস করেছে। মথি তাদেরকে আরো নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য এই সুসমাচারটি লেখেন। এছাড়া মথি এমন যিহূদীদের জন্যও এই সুসমাচারটি লেখেন যারা যীশু সম্বন্ধে শুনেছে কিন্তু এখনও বিশ্বাস করে নি। মথি দাবি করেন যে যীশুই যিহূদীদের সেই প্রতিজ্ঞাত মশীহ। এটা শুনে যিহূদীদের মনে যে প্রশ্ন বা আপত্তি উঠবে সেগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্যও মথি লেখেন, যেমন: যীশু কি পুরাতন নিয়মের মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পূর্ণ করেছেন? যীশু কি আসলে দায়ূদের বংশধর? যীশু কি সঠিকভাবে আইন-কানুন পালন করেছেন? তিনি কি ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন?
মণ্ডলীর ইতিহাস থেকে জানা যায় যে মথি ৬০ খ্রীষ্টাব্দে শহীদ মৃত্যু গ্রহণ করেন। তার সুসমাচার ৬০ খ্রীষ্টাব্দের আগে লেখা হয়েছে বলে সুসমাচারগুলোর মধ্যে মথি লিখিত সুসমাচারটি হয়তো প্রথম। আরো জানা যায় যে মথি প্রথমেই তার সুসমাচার ইব্রীয় ভাষা দিয়ে লিখেছিলেন যদিও আজ পর্যন্ত মথি লিখিত সুসমাচারটির শুধুমাত্র গ্রীক ভাষার দলিল আবিষ্কার করা হয়েছে।
যীশুর সময়ের যিহূদীদের বড় স্বপ্ন ছিল যে তারা ঈশ্বরের মনোনীত জাতি হিসাবে প্রতিজ্ঞাত দেশে দায়ূদ বংশের রাজার অধীনে থেকে চারিদিকের পরজাতিদের দমন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু বাস্তবতা খুব ভিন্ন – যিহূদীরা প্রতিজ্ঞাত দেশে থাকলেও পরজাতিদের সাথে তাদেরকে বাস করতে হচ্ছে। তারা দেবতাপূজারী ও দমনকারী রোমীয় রাজ্যের অধীনে রয়েছে এবং তাদের রাজা দায়ূদের পরিবারের নয় বরং রাজাকার হেরোদ পরিবারের।
ধার্মিক যিহূদীরা ঈশ্বরের বাক্যে তাদের জাতির জন্য প্রতিজ্ঞাগুলো দেখে আশা ধরে রাখত কিন্তু আসলে বর্তমান অবস্থার সাথে কোন রকম মিল পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে কিছু যিহূদীরা ধর্মীয় উচ্চাকাঙ্খা বাদ দিয়ে রোমীয় বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খেতে চেষ্টা করছিল (যেমন হেরোদীয়রা ও সদ্দূকীরা)। অন্য কিছু যিহূদীরা (যেমন ফরীশীরা) সবাইকে ধার্মিক জীবন-যাপন করতে চাপ দিত – এই আশায় যে, তা করলে ঈশ্বর স্বর্গ থেকে নেমে তাঁর শক্তিশালী হাত দ্বারা প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবেন। আবার কিছু যিহূদীরা (যেমন মৌলবাদীরা) বিশ্বাস করত যে মশীহ এসেই অস্ত্র দ্বারা রোমীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁর রাজ্য স্থাপন করবেন।
তাই যীশু যখন আসলেন, পরিচর্যা করলেন, ক্রুশে মারা গেলেন ও পুনরুত্থিত হলেন এবং তাঁর অনুসরণকারীরা দাবি করতে লাগল যে তিনিই মশীহ, এটা যিহূদীদের কাছে হাস্যকর বিষয় – যদি মশীহ সত্যিই এসে পড়েছেন তবে কেন তিনি জয়ী হন নি? কেন রোমীয়রা এখনও রাজত্ব করছে? কেন মন্দ চলতেই আছে? পরিবর্তন কোথায়?
এই প্রশ্নের ও আপত্তির উত্তরে মথি তার সুসমাচার লেখেন। তিনি দেখান যে – যিহূদীদের আসল শত্রু রোমীয়রা বা দেবতাপূজারী পরজাতি বা জাগতিক যিহূদী নয় বরং আসল শত্রু হল মানুষের পাপপূর্ণ হৃদয় ও ঈশ্বরের সঙ্গে ভাঙ্গা সম্পর্ক। যীশু সে সম্পর্ক আবার ঠিক করলেন। তিনি পিতা ঈশ্বরকে প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর দয়ায় মানুষের হৃদয় পরিবর্তন করেছেন। তিনি সবাইকে দেখিয়েছেন কিভাবে জীবন-যাপন করা উচিত। তিনি মানুষের জন্য ক্ষমা ও গ্রহণযোগ্যতা এবং দোষ ও লজ্জা থেকে মুক্তি অর্জন করার জন্য সর্বোচ্চ দাম দিয়েছেন। তিনি জাতিগত পার্থক্য ও অহংকার বাদ দিলেন। তিনি ঈশ্বরের রাজ্য সত্যিই স্থাপন করেছেন – মানুষের হৃদয় দখল করে তিনি জীবন পরিবর্তন করতে শুরু করেছেন উভয় যিহূদীদের জীবন এবং পরজাতিদের জীবন। জাতিগত অহংকার ধরে রাখলে এবং নিজের প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করলে ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করা যায় না। তাই ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না!
লেখক মথি
মথি বা লেবী (যিহূদী নাম, মার্ক ২:১৪, লূক ৫:২৭) হলেন যীশুর বারোজন শিষ্যদের মধ্যে একজন। তিনি কর-আদায়কারী ছিলেন এবং যীশু তাকে প্রেরিত হওয়ার আহ্বান দেন। তিনি তার আহ্বানের গল্পটি তার সুসমাচারে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেন (মথি ৯:৯)।
মথি তার সুসমাচারে নিজের নাম সরাসরি উল্লেখ করেন না যেমন অন্যান্য সুসমাচারের লেখকেরাও উল্লেখ করেন না। কিন্তু মণ্ডলীর আদিপিতারা (যেমন আদিপিতা পাপিয়াস, ওরিগেন, ইরেন্যায়াস, ইউসেবিয়াস, জেরম এবং পান্ট্যানাস) মথিকে প্রথম সুসমাচারের লেখক হিসাবে চিহ্নিত করেন।
মথিই যে তার নামের সুসমাচারের লেখক তা আরো কিছু ছোট বিষয় দ্বারা প্রমাণিত হয়: শুধুমাত্র মথি সুসমাচারে আমরা সেই গল্প পাই কিভাবে যীশু উপাসনা-ঘরের কর দিতেন (মথি ১৭:২৪-২৭)। আর একটি মজার বিষয় হল যে অন্যান্য সুসমাচারের লেখকেরা সাধারণত “পাপীদের” উল্লেখ করলে এই দলে কর-আদায়কারীদেরও অন্তর্ভুক্ত রেখেছেন – কিন্তু শুধুমাত্র মথি “পাপীদের” এবং “কর-আদায়কারীদের” আলাদা দল হিসাবে উল্লেখ করেন (মথি ৯:১০)। এছাড়া যদিও সুসমাচারের সবচেয়ে পুরাতন আবিষ্কৃত দলিলগুলোতে শিরোনাম বলতে কিছু নেই তবুও মথি সুসমাচারের দলিলের ক্ষেত্রে বেশ তাড়াতাড়ি প্রায় ১২৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে শিরোনাম সহ দলিল পাওয়া গিয়েছে: “মথি লিখিত সুসমাচার”।
মথি লিখিত সুসমাচারের পাঠকেরা
অন্যান্য সুসমাচারগুলোর মত মথি লিখিত সুসমাচারেও সরাসরি উল্লেখ নেই মথি কাদের জন্য লেখেন। কিন্তু চোখে পড়ে যে মার্ক, লূক ও যোহনের চেয়ে মথি তার সুসমাচারে অনেক বেশি পুরাতন নিয়মের উদ্ধৃতি দেন। এতে বুঝা যায় যে তিনি সুসমাচারটি অবশ্যই যিহূদীদের জন্যই লেখেন। মথি দাবি করেন যে যীশুই যিহূদীদের সেই প্রতিজ্ঞাত মশীহ। তা শুনে যিহূদীদের মনে যে প্রশ্ন বা আপত্তি উঠবে সেগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য মথি তার সুসমাচার লেখেন, যেমন: যীশু কি পুরাতন নিয়মের মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পূর্ণ করেছেন? যীশু কি আসলে দায়ূদের বংশধর? যীশু কি সঠিকভাবে আইন-কানুন পালন করেছেন? তিনি কি ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন?
তাই আমরা বলতে পারি যে মথির পাঠকেরা হল এমন যিহূদী যারা ইতিমধ্যে যীশুকে বিশ্বাস করেছে (যাদেরকে মথি যীশুকে নিয়ে আরো নিশ্চয়তা দিতে চান) এবং এমন যিহূদী যারা যীশু সম্বন্ধে শুনেছে কিন্তু এখনও বিশ্বাস করে না (যাদেরকে মথি যীশুর বিষয়ে আরো প্রমাণ দিতে চান)।
মণ্ডলীর ইতিহাসের লেখাগুলো থেকে জানা যায় যে, মথি ৬০ খ্রীষ্টাব্দে যিরূশালেমে যিহূদীদের দ্বারা শহীদ মৃত্যু গ্রহণ করেছেন। তাই বলা যায় যে মথি ৬০ খ্রীষ্টাব্দের আগে যিহূদিয়া ও গালীল এলাকার যিহূদীদের কাছে লেখেন, যারা পরবর্তীতে যিহূদী-রোমীয় যুদ্ধ এবং ৭০ খ্রীষ্টাব্দে যিরূশালেমের ধ্বংসের কারণে রোম রাজ্যের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। মণ্ডলীর আদিপিতা পাপিয়াস বলেন যে, মথি লিখিত সুসমাচার প্রথম ইব্রীয় ভাষায় লেখা হয়েছিল যদিও আজ পর্যন্ত মথি লিখিত সুসমাচারটির শুধুমাত্র গ্রীক ভাষার দলিল আবিষ্কার করা হয়েছে।
যীশুর সময়ে যিহূদীদের চিন্তা ও মনোভাব
যীশুর সময়ের যিহূদীরা মনোনীত জাতি হিসাবে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞাগুলো এবং তাদের কয়েকটি উচ্চাকাঙ্ক্ষা ধরে রাখত। যেমন:
- ১। তারা প্রতিজ্ঞাত দেশের অধিকারী হয়ে সেখানে বাস করতে পারে।
- ২। দায়ূদের একজন বংশধর তাদের উপরে রাজত্ব করবেন।
- ৩। তারা চারিদিকে অযিহূদী জাতিদের উপর জয় করে তাদের দমন করতে সক্ষম হবে।
- ৪। তারা আইন-কানুনের বাধ্যতায় একটি সুশৃঙ্খল পবিত্র সমাজ হবে।
কিন্তু যিহূদীদের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ধরে রাখায় বেশ হতাশা ছিল কারণ তাদের বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল, যেমন:
- ১। বাবিলে নির্বাসনের পরে ৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে যিহূদীরা মাদিয়-পারস্য রাজার দ্বারা নিজের দেশে ফেরার সুযোগ পেয়েছিল ভাববাদী যিরমিয় যেভাবে তার ভবিষ্যদ্বাণীতে বলেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল যে মাত্র অল্পজন যিহূদীরা অবশেষে ফিরে আসল এবং ফিরে এসে প্রতিজ্ঞাত দেশে তাদেরকে অন্যান্য দেবতাপূজারী জাতিদের সঙ্গে বাস করতে হল।
- ২। বাবিলের নির্বাসন সময় থেকে যিহূদীদের অধিকাংশ সময় একটি বড় দেবতাপূজারী সাম্রাজ্যের অধীনে থাকতে হল (বাবিল, মাদিয়-পারস্য, গ্রীস ও বর্তমানে রোম) এবং বেশ কয়েকবার তাদের অনেক অত্যাচারও ভোগ করতে হল। যিহূদীরা আর কখনও একটি স্বচালিত স্বাধীন দেশ হতে সক্ষম হয় নি যেখানে একজন দায়ূদের বংশধর তাদের উপর রাজত্ব করেন। যিহূদিয়ার স্থানীয় রাজা হেরোদের পরিবার খাঁটি যিহূদী রক্তের ছিল না বরং ইদুমীয়া ও যিহূদী মিশানো রক্তের ছিল। এছাড়াও তারা ছিলেন ক্ষমতার লোভী, দুর্নীতিগ্রস্ত, হিংস্র একটি রাজবংশ যারা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রোমীয়দের সাথে হাত মিলাতেন। তাই যিহূদীরা হেরোদ পরিবারকে ঘৃণা করত।
- ৩। যিহূদীদের নিজস্ব আর রাজা নেই, তারা দমনকারী অযিহূদীদের অধীনে বাস করে। অন্য জাতিদের দমন করা তো দূরের কথা। তাই দায়ূদের সময়ের চেয়ে যিহূদীদের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা হল লজ্জা ও দুঃখের বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়।
- ৪। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যিহূদীরা দেবতাপূজারী জাতিদের অধীনে ও সঙ্গে বাস করেছে বলে অনেক যিহূদীরাও আত্মিক ক্ষেত্রে আপোষ করত। কিন্তু যে যিহূদীরা শুচি ও পবিত্রভাবে জীবন-যাপন করতে অত্যন্ত চেষ্টা করছিল তারা নিজেদেরকে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন খুঁজে পাচ্ছিল।
মোট কথা – যীশুর সময়ের যিহূদীরা চোখ যেখানে রাখত না কেন, কোন ক্ষেত্রেই ভাল যাচ্ছিল না। কেন ঈশ্বর যিহূদীদের এই ধরণের দুরাবস্থায় পড়তে দিয়েছেন? কেন তিনি কিছু করেন না? হয়তো তিনি শিঘ্রই কিছু করবেন? যিহূদীদের একটি শক্তিশালী আশা ছিল যে একদিন – শিঘ্রই! – ঈশ্বর একজন উদ্ধারকর্তা পাঠাবেন, মশীহ নিজেই, যিনি একজন ‘দ্বিতীয় দায়ূদ’: একজন ঈশ্বরের ভক্ত লোক যিনি উপাসনা-ঘর আবার ঠিক করবেন, যুদ্ধে জয় করবেন, দেবতাপূজারী দমনকারীদের পরাজিত করবেন, প্রতিজ্ঞাত দেশ শুধুমাত্র যিহূদীদের অধীনে দেবেন, তাদের একটি শক্তিশালী ও জয়ী জাতিতে পরিণত করবেন, এমন কি অন্য জাতিদের উপর দমন করতে দেবেন এবং গর্ব করার অবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। কিন্তু কেন ঈশ্বর মশীহকে এখনও পাঠাচ্ছেন না? বাধা কি? শর্ত কি?
আসলে কিছু যিহূদীরা অনেক বিদ্রোহ, রক্তপাত ও নিষ্ফল প্রচেষ্টার শেষে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। তারা ‘রোমীয় বাস্তবতা’ মেনে নিয়ে রোমীয়দের সাথে হাত মিলাত এবং এভাবে তাদের নিজের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা অর্জন করতে সক্ষম হত। যিহূদীদের আত্মিক ও রাজনৈতিক উঁচু শ্রেণীর লোক (সদ্দূকীরা, হেরোদীয়রা, কর-আদায়কারীরা) এই দলে পড়ত। অন্য কিছু যিহূদীরা মনে করত যে – বাধ্য হয়ে ঈশ্বর অবশেষে মশীহকে পাঠাতেন যদি তারা শুধুমাত্র একটি খাঁটি, পবিত্র সমাজ তৈরি করতে সক্ষম হত। এই দলে ফরীশীরা পড়ত, এরা সবাইকে আরো ধার্মিক হতে শিক্ষা (এবং চাপ) দিত। আবার কিছু যিহূদীরা মনে করত যে – ঈশ্বর তখনই হাত দেবেন যখন যিহূদীরা (যেভাবে হোক) দেবতাপূজারী ও দমনকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। এরা ছিল যিহূদী মৌলবাদী (উদ্যোগী বা জঙ্গী) দল যারা একজন সামরিক নেতা মশীহের অধীনে জোর করে পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
সেইজন্য যীশু যখন আসলেন, লোকদের মধ্যে বাস করলেন, ক্রুশে মারা গেলেন ও পুনরুত্থিত হলেন এবং তার অনুসরণকারীরা দাবি করতে লাগল যে তিনিই ছিলেন মশীহ। তা শুনে যিহূদীদের মনে অনেক প্রশ্ন ও আপত্তি উঠত। যেমন: যদি মশীহ এসে গেছেন তাহলে কেন তিনি মারা গেছেন? তাদের চিন্তা অনুসারে মশীহ কখনও মারা যাবেন না বরং যুদ্ধে জয় করবেন! কেন রোমীয়রা এখনও রাজত্ব করছে? কেন মন্দ কাজ এখনও ঘটছে? কেন সমাজ এখনও পরিবর্তিত হচ্ছে না? যদি একজন এসে কোন পার্থক্যই না করে তবে কেন তাকে বিশ্বাস করব? – ঠিক এই ধরণের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মথি তার সুসমাচার লেখেন:
‘যীশুই মশীহ’ – এর প্রমাণ
মথি তার সুসমাচার দ্বারা দেখাতে চান যে যীশুই সেই প্রতিজ্ঞাত মশীহ – যদিও যিহূদীদের প্রত্যাশার চেয়ে তিনি অনেক ভিন্ন ছিলেন। এটা বিশ্বাস করাতে তিনি নানা ধরণের প্রমাণ দেন, যেমন:
যীশু দায়ূদের বংশধর
মথি তার সুসমাচার যীশুর বংশ তালিকা দিয়ে শুরু করেন সাধারণত যিহূদীরা যেমন করত (মথি ১:১-১৭)। তিনি দেখান যে যীশু অব্রাহামের পুত্র, যার উপরে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা ও আশীর্বাদ রয়েছে (আদি ১২:১-৩)। তিনি আরো দেখান যে যীশু দায়ূদের পুত্র যার উপরে চিরস্থায়ী রাজ্যের প্রতিজ্ঞা ছিল (২ শমূয়েল ৭:১২-১৬, গীত ৮৯:২৯-৩৭)। যিহূদীরা জানত যে মশীহ দায়ূদের বংশধর হবেন (যিশাইয় ১১:১, ৯:৭, ১১:১৬)।
তাছাড়া মথি যীশুকে উল্লেখ করার সময়ে সাত বার তাকে “দায়ূদের পুত্র” বলেন যা মশীহের একটি টাইটেল (মথি ১:১ (২০), ৯:২৭, ১২:২৩, ১৫:২২, ২০:৩০-৩১, ২১:৯, ২১:১৫)।
যীশুই খ্রীষ্ট
এই সুসমাচারে মথি যীশুকে বারো বার “খ্রীষ্ট” বলেন (মথি ১:১৬, ১:১৭, ২:৪, ১১:২, ১৬:১৬, ১৬:২০, ২২:৪২, ২৩:১০, ২৬:৬৩, ২৬:৬৮, ২৭:১৭, ২৭:২২)। “খ্রীষ্ট” হল একটি গ্রীক শব্দ, যার ইব্রীয় অনুবাদ হল “মশীহ”। “মশীহ” শব্দের অর্থ হল “অভিষিক্ত সেই ব্যক্তি”।
যীশু মোশির আইন-কানুন পালন ও সমর্থন করেন
যীশুকে নিয়ে ফরীশীদের একটি বড় আপত্তি ছিল। তাদের মতে যীশু মোশির আইন-কানুনে এবং শুচি-অশুচি নিয়মে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন নি। আসলে যীশু মোশির আইন-কানুন সমর্থনের পরের যোগ দেওয়া ‘প্রাচীনদের নিয়ম’ বা ‘মৌখিক ঐতিহ্যগুলো’ পালন করতেন না কিন্তু মোশির আসল আইন-কানুন তিনি ঠিকই পালন করতেন ও গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলেছিলেন যে “যতদিন না আইন-কানুনের সমস্ত কথা সফল হয় ততদিন সেই আইন-কানুনের এক বিন্দু কি এক মাত্রা মুছে যাবে না” (মথি ৫:১৮) এবং “যে কেউ সেই আদেশগুলো পালন করে ও শিক্ষা দেয় তাকে স্বর্গ রাজ্যে বড় বলা হবে” (মথি ৫:১৯)। যীশু আইন-শিক্ষক ও ফরীশীদের চ্যালেঞ্জ করেন – যারা “মোশির জায়গায় আছেন” তারা “যা কিছু করতে বলেন” তা তাদের করতে হবে (মথি ২৩:২)। মথি উল্লেখ করেন যে যীশু যিহূদীদের উপাসনা-ঘরের কর ঠিকই দিতেন যেন এটা অপমান হিসাবে না দাঁড়ায় (মথি ১৭:২৪-২৭)। তিনি তাঁর শিষ্যদের উপবাস করতে বলেন (মথি ৬:১৬), তাদের উৎসর্গ করতে বলেন (মথি ৫:২৩-২৪) এবং তিনি অনেক বার পুরাতন নিয়মের আইন-কানুনের মানদণ্ড আরো উপরে উঠান: “তোমরা শুনেছ আগেকার লোকদের কাছে এক কথা বলা হয়েছে … কিন্তু আমি তোমাদের বলছি” (মথি ৫:২১, ৫:২৭, ৫:৩১, ৫:৩৩, ৫:৩৮, ৫:৪৩)।
যীশুই রাজা
ভাববাদীরা প্রকাশিত করেছিলেন যে – মশীহের মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা (ভাববাদী, পুরোহিত ও রাজা) পূর্ণ হবে। মথি প্রমাণ করেন যে তা যীশুর মধ্যেই পূর্ণ হয়েছে। মথি যীশুকে বিশেষভাবে রাজা হিসাবে দেখান, যেমন: যীশুর বংশ তালিকার মধ্য দিয়ে তাঁকে রাজা দায়ূদের ছেলে হিসাবে চিহ্নিত করেন (মথি ১:৬-১১), যীশুর জন্মের সময় পূর্ব দেশের পণ্ডিতেরা এসে “যিহূদীদের যে রাজা জন্মেছে” খোঁজেন (মথি ২:২), যখন যীশু যিরূশালেমে প্রবেশ করেন তাকে রাজার মত স্বাগতম জানানো হয় (মথি ২১:১-১১), ভেড়া ও ছাগলের দৃষ্টান্তে যীশুকে ভবিষ্যৎ রাজা হিসাবে দেখানো হয় (মথি ২৫:৩১), পীলাত তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি “যিহূদীদের রাজা” কিনা এবং যীশু তার উক্তি সমর্থন করেন (মথি ২৭:১১)। যীশুর ক্রুশে এই চিহ্ন লাগানো হয়েছিল “এই যীশু, যিহূদীদের রাজা” (মথি ২৭:৩৭) এবং মথি লিখিত সুসমাচারটি শেষ হয় যীশুর এই কথা দ্বারা “সব অধিকার আমাকে দেওয়া হয়েছে” (মথি ২৮:১৮)।
পুরাতন নিয়মের মশীহ সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী যীশুতে পূর্ণ
মথি তার সুসমাচারে ১৮ বার পুরাতন নিয়মের উদ্ধৃতিগুলো এই প্রারম্ভিকা বাক্য দিয়ে শুরু করেন: “এই সব হয়েছিল যেন নবীর মধ্য দিয়ে প্রভু এই যে কথা বলেছিলেন তা পূর্ণ হয়”। নিচে সেই ১৮টি পদ দেওয়া হল:
মথি ১:২২-২৩ উদ্ধৃতি করে যিশাইয় ৭:১৪
মথি ২:৫-৬ উদ্ধৃতি করে মীখা ৫:২
মথি ২:১৫ উদ্ধৃতি করে হোশেয় ১১:১
মথি ২:১৭ উদ্ধৃতি করে যিরমিয় ৩১:১৫
মথি ২:২৩ উদ্ধৃতি করে যিশাইয় ১১:১
মথি ৩:৩ উদ্ধৃতি করে যিশাইয় ৮০:৩
মথি ৮:১৪-১৬ উদ্ধৃতি করে যিশাইয় ৯:১-২
মথি ৮:১৭ উদ্ধৃতি করে যিশাইয় ৫৩:৪
মথি ১১:১০ উদ্ধৃতি করে যাত্রা ২৩:২০, মালাখি ৩:১
মথি ১২:১৭-২১ উদ্ধৃতি করে যিশাইয় ৪২:১-৪
মথি ১৩:১৪-১৫ উদ্ধৃতি করে যিশাইয় ৬:৯-১০
মথি ১৩:৩৫ উদ্ধৃতি করে গীতসংহিতা ৭৮:২
মথি ২১:৪ উদ্ধৃতি করে যিশাইয় ৬২:১১, সখ ৯:৯
মথি ২১:১৩ উদ্ধৃতি করে যিশাইয় ৫৬:৭
মথি ২১:৪৩ উদ্ধৃতি করে গীতসংহিতা ১১৮:২২-২৩
মথি ২৪:১৫ উদ্ধৃতি করে দানি ৯:২৭, ১১:৩১, ১২:১১
মথি ২৬:৩১ উদ্ধৃতি করে সখরিয় ১৩:৭
মথি ২৭:৯-১০ উদ্ধৃতি করে সখ ১১:১২-১৩, যির ৩২:৬-৯
এছাড়াও মথি আরো ৩৩ বার পুরাতন নিয়ম থেকে উদ্ধৃতি করেন যেখানে তিনি এই প্রারম্ভিকা বাক্য দেন না। সেগুলো হল:
মথি ৪:৪ উদ্ধৃতি করে ২য় বিবরণ ৮:৩
মথি ৪:৬ উদ্ধৃতি করে গীত ৯১:১১
মথি ৪:৭ উদ্ধৃতি করে ২য় বিবরণ ৬:৬
মথি ৪:১০ উদ্ধৃতি করে ২য় বিবরণ ৬:১৩
মথি ৫:২১ উদ্ধৃতি করে যাত্রা ২০:১৩
মথি ৫:২৭ উদ্ধৃতি করে যাত্রা ২০:১৪
মথি ৫:৪৮ উদ্ধৃতি করে লেবীয় ১৯:২
মথি ৯:১৩ উদ্ধৃতি করে হোশেয় ৬:৬
মথি ১১:৫ উদ্ধৃতি করে যিশা ২৯:১৮
মথি ১২:৭ উদ্ধৃতি করে হোশেয় ৬:৬
মথি ১৫:৪ উদ্ধৃতি করে যাত্রা ২০:১২
মথি ১৫:৮-৯ উদ্ধৃতি করে যিশা ২৯:১৩
মথি ১৮:১৬ উদ্ধৃতি করে ২য় বিবরণ ১৯:১৫
মথি ১৯:৪-৫ উদ্ধৃতি করে আদি ২:২৪
মথি ১৯:১৮-১৯ উদ্ধৃতি করে যাত্রা ২০:১২,১৬
মথি ২১:৯ উদ্ধৃতি করে গীত ১১৮:২৬
মথি ২১:১৬ উদ্ধৃতি করে গীত ৮:২
মথি ২২:২৪ উদ্ধৃতি করে ২য় বিবরন ২৫:৫
মথি ২২:৩২ উদ্ধৃতি করে যাত্রা ৩:৬
মথি ২২:৩৭ উদ্ধৃতি করে ২য় বিবরণ ৬:৫
মথি ২২:৩৯ উদ্ধৃতি করে লেবীয় ১৯:১৮
মথি ২২:৪৪ উদ্ধৃতি করে গীত ১১০:১
মথি ২৩:৩৯ উদ্ধৃতি করে গীত ১১৮:২৬
মথি ২৪:৭ উদ্ধৃতি করে যিশা ১৯:২
মথি ২৪:২১ উদ্ধৃতি করে দানিয়েল ১২:১
মথি ২৬:৩৮ উদ্ধৃতি করে গীত ৪২:৬
মথি ২৬:৬৪ উদ্ধৃতি করে দানিয়েল ৭:১৩
মথি ২৭:৩৪ উদ্ধৃতি করে গীত ৬৯:২১
মথি ২৭:৩৫ উদ্ধৃতি করে গীত ২২:১৮
মথি ২৭:৩৯ উদ্ধৃতি করে গীত ২২:৭
মথি ২৭:৪৩ উদ্ধৃতি করে গীত ২২:৮
মথি ২৭:৪৬ উদ্ধৃতি করে গীত ২২:১
মথি ২৭:৪৮ উদ্ধৃতি করে গীত ৬৯:২১
মথি মোট ৫১টি উদ্ধৃতির পাশাপাশি আরো অনেক পদ আংশিকভাবে দেন এবং পুরাতন নিয়মের অন্যান্য শব্দ, রূপক বা ছবি ব্যবহার করেন। নতুন নিয়মের লেখকদের মধ্যে মথি সবচেয়ে বেশি পুরাতন নিয়ম ব্যবহার করেন। তিনি পুরাতন নিয়মের প্রায় প্রত্যেকটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি নেন। সবচেয়ে বেশি তিনি উদ্ধৃতি নেন যিশাইয় থেকে (২০% উদ্ধৃতি) এবং গীতসংহিতা থেকে।
রাজ্য আসবে, রাজ্য এসে গেছে
মথি তার সুসমাচারে ৪৪ বার (!) ঈশ্বরের “রাজ্য” শব্দ ব্যবহার করেন, তার মধ্যে তিনি ৩৮ বার “স্বর্গ রাজ্য” নিয়ে কথা বলেন। তিনি দুই বিষয়ে জোর দেন – একদিকে তিনি বলেন যে ঈশ্বরের রাজ্য “এসে গেছে” এবং এখনই উপস্থিত (২৬টি পদে), কিন্তু অন্যদিকে তিনি বলেন যে ঈশ্বরের রাজ্য ভবিষ্যতে আসবে (১৩টি পদে) – এবং ৫টি পদে তিনি দুই বিষয় একসাথে বলেন।
যদি মথি বলেন “ঈশ্বরের রাজ্য এসে গেছে” তবে কি বুঝান? প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের রাজ্য ভৌগলিক কিছু নয়, রাজনৈতিক কিছুও নয়, যিহূদীরা যেমন একটি “যিহূদী দেশের” আশা করেন, তার মতও নয়। ঈশ্বরের রাজ্য হল এমন একটি বিষয় যা সেই লোকদের হৃদয়ে উপস্থিত যারা যীশুকে রাজা হিসাবে গ্রহণ করে। ঈশ্বরের রাজ্য হল হৃদয়ের বা অন্তরের একটি বাস্তবতা। এছাড়া ঈশ্বরের রাজ্য হল অন্ধকারের রাজ্যের বিরুদ্ধে (মথি ১২:২৮)। মানুষের হৃদয় ঈশ্বর দিয়ে চালিত অথবা ঈশ্বরকে দিয়ে চালিত নয়। মানুষ ঈশ্বরের রাজত্ব মেনে নেয় অথবা নেয় না। মানুষ ঈশ্বরের রাজ্যে বা অন্ধকারের রাজ্যে আছে। যখন যীশু আমাদের রাজা হন তখন আমরা তাঁর রাজ্যে চলে আসছি। ঈশ্বরের রাজ্য রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল নয়, তা কোন জাতি, লিঙ্গ বা অবস্থার উপর নির্ভরশীল নয়। যতজন এই রাজ্যে ঢুকতে চায় ততজন ঢুকতে পারবে। ঈশ্বরের রাজ্য বৃদ্ধি পায় যখন আরো মানুষ স্বাধীন সিদ্ধান্তে যীশুকে রাজা হিসাবে গ্রহণ করে এবং তাঁর মত চলে।
যিহূদীরা যেন নিজেদেরকে ঈশ্বরের রাজ্য থেকে বঞ্চিত না করে
মথি তার সুসমাচারে শুরুতেই পরিষ্কারভাবে বলেন যে যীশু প্রাথমিকভাবে যিহূদীদের জন্যই এসেছেন। যীশুর মা মরিয়মকে বলা হয় যে তার সন্তান “তাঁর লোকদের তাদের পাপ থেকে উদ্ধার করবেন” (মথি ১:২১)। যীশু যখন তার শিষ্যদের প্রচার করতে পাঠান তিনি তাদের বলেন: “তোমরা অযিহূদীদের কাছে বা শমরীয়দের কোন গ্রামে যেয়ো না, বরং ইস্রায়েল জাতির হারানো মেষদের কাছে যেয়ো” (মথি ১০:৫-৬)। তিনি তাদের বলেন “ইস্রায়েল দেশের সমস্ত শহর ও গ্রামে তোমাদের কাজ শেষ হবার আগেই মনুষ্যপুত্র আসবেন” (মথি ১০:২৩)। তিনি একটি বিদেশীনীকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য বলেন যে তাঁকে “কেবল ইস্রায়েল-বংশের হারানো মেষদের কাছেই পাঠানো হয়েছে” (মথি ১৫:২৪)। তিনি তাঁর বিশ্বস্ত শিষ্যদের প্রতিজ্ঞা দেন“নতুন সৃষ্টিতে যখন মনুষ্যপুত্র তাঁর সম্মানের সিংহাসনে বসবেন তখন তোমরাও বারোটা সিংহাসনে বসবে এবং ইস্রায়েলের বারো বংশের বিচার করবে’ (মথি ১৯:২৮)।
কিন্তু যখন অনেক যিহূদী যীশুকে অগ্রাহ্য করতে থাকে তখন ধীরে ধীরে বাপ্তিস্মদাতা যোহনের সাবধাণবাণী প্রযোজ্য হয় “সাপের বংশধরেরা! ঈশ্বরের যে শাস্তি নেমে আসছে তা থেকে পালিয়ে যাবার এই বুদ্ধি তোমাদের কে দিল? বেশ, তোমরা যে পাপ থেকে মন ফিরিয়েছ তার উপযুক্ত ফল তোমাদের জীবনে দেখাও … গাছের গোড়াতে কুড়াল লাগানোই আছে। যে গাছে ভাল ফল ধরে না তা কেটে আগুনে ফেলে দেওয়া হবে” (মথি ৩:৮-১০)। যীশুও সাবধাণবাণী দেন: “পূর্ব ও পশ্চিম থেকে অনেকে আসবে এবং অব্রাহাম, ইস্হাক ও যাকোবের সংগে স্বর্গ-রাজ্যে খেতে বসবে। কিন্তু যাদের স্বর্গ-রাজ্যে থাকবার কথা তাদের বাইরের অন্ধকারে ফেলে দেওয়া হবে” (মথি ৮:১১-১২)। যখন যীশু বাপ্তিস্মদাতা যোহনের বিষয়ে মন্তব্য করেন (মথি ১১:১১-১৯) তখন তিনি যোগ দেন “যদি আপনারা এই কথা বিশ্বাস করতে রাজী থাকেন” (মথি ১১:১৪), এখানে তিনি দাবি করেন বুঝার দায়িত্ব শ্রোতার উপর।
তাছাড়া যিহূদীদের সঙ্গে যীশুর নানা বিষয়ে তর্ক হয়, বিশেষভাবে ফরীশীদের সঙ্গে, যেমন: বিশ্রাম বারে শীষ ছিঁড়ে খাওয়ার বিষয়ে (মথি ১২:১-৮), বিশ্রামবারে সুস্থ করার বিষয়ে (মথি ১২:৯-১৪), মন্দ আত্মা তাড়ানোর বিষয়ে (মথি ১২:২২-৩২) এবং আশ্চর্য চিহ্ন দেখার দাবির বিষয়ে (মথি ১২:৩৮-৪২)। যীশু সাবধানবাণী হিসাবে দুই ছেলের একটি দৃষ্টান্ত বলেন (মথি ২১:২৮-৩৪) যে বাহ্যিক ধার্মিকতা দেখানো কিন্তু অন্তরে অনিচ্ছুক মনোভাব থাকা হল বিপজ্জনক। যখন যীশু আঙ্গুর ক্ষেতের দৃষ্টান্ত বলেন (মথি ২১:৩৩-৪১) মথি যীশুর একটি কথাও উল্লেখ করেন: “তিনি সেই দুষ্ট লোকদের একেবারে ধ্বংস করবেন এবং যে চাষীরা তাঁকে সময়মত ফলের ভাগ দেবে তাদের কাছেই সেই আংগুর ক্ষেতটা ইজারা দেবেন” (মথি ২১:৪১), যা যিহূদী শ্রোতাদের জন্য অপমানের মত। বিবাহের নিমন্ত্রনের দৃষ্টান্তেও (মথি ২২:১-১০) অনিচ্ছুক ও অযোগ্য নিমন্ত্রিতদের বিষয়েও যীশু একটি কড়া সাবধানবাণী দেন। যিহূদীদের সবচেয়ে কড়া চ্যালেঞ্জ যীশু যেভাবে করেন তা হল: ঈশ্বর ভাববাদী, জ্ঞানী লোক ও ধর্ম-শিক্ষক পাঠিয়েছেন কিন্তু যিহূদীরা তাদের খুন করতে থাকে (মথি ২৩:৩৪)। এর পরেই যীশু যিরূশালেমের উপাসনা-ঘরের ধ্বংসবাণী ঘোষণা করেন যা যিহূদী কানে অবিশ্বাস্য ও ঈশ্বরকে অপমান করার মত একটি কথা (মথি ২৪)। তিনি আগেও বলেছিলেন “উপাসনা-ঘর থেকেও বড় একজন এখানে আছেন” (মথি ১২:৬)। মথি তার সুসমাচারের শেষে যীশুর মহান আদেশ উল্লেখ করেন (মথি ২৮:১৯-২০) এখানে যীশু শুধুমাত্র যিহূদীদের নয় বরং সব জাতিদেরই শিষ্য করার আদেশ দেন।
আসলে, মথি বার বার দেখান যে ঈশ্বরের রাজ্য বা যীশুর সুসমাচার শুধুমাত্র একটি যিহূদী বিষয় নয় বরং শুরু থেকে অন্য জাতিদেরও গুরুত্ব ছিল – বিদেশী পণ্ডিতেরা যীশুর জন্মের সময়ে তাঁকে আরাধনা করতে আসেন (মথি ২:১-১২), যীশুর পরিবারকেও দেবতাপূজারী মিসর দেশে আশ্রয় নিতে হয় (মথি ২:১৩-১৫), একজন রোমীয় শতপতি যীশুর কাছ থেকে প্রশংসা ও আশীর্বাদ পান (মথি ৮:৫-১৩), যীশু অযিহূদী সোর, সিদোন ও নীনবী শহরগুলোর প্রশংসা করেন এবং যিহূদী শহর কোরাসীন ও কফরনাহূমের দোষ ধরেন। মথি যীশুর বাণী “দেখ, আমার দাস যাঁকে আমি বেছে নিয়েছি … তাঁরই উপর অযিহূদীরা আশা রাখবে” (মথি ১২:২১) এবং “সমস্ত জাতির কাছে সাক্ষ্য দেবার জন্য স্বর্গ- রাজ্যের সুখবর সারা জগতে প্রচার করা হবে” উল্লেখ করেন (মথি ২৪:১৪)।
যীশু বার বার যিহূদীদের অহংকারকে চ্যালেঞ্জ করেন কারণ জাতিগত অহংকারের জন্য যিহূদীরা নিজেদেরকে ঈশ্বরের রাজ্য থেকে বঞ্চিত করে যা মথি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে দেখান। মথি তার যিহূদী পাঠকদের কড়াভাবে সাবধাণবাণী দেন যেন তারা তাদের জাতিগত অহংকার বা মিথ্যা ধার্মিকতার কারণে মশীহকে অগ্রাহ্য না করে। চারটি সুসমাচারের মধ্যে মথি লিখিত সুসমাচারটি সবচেয়ে বেশি যিহূদীর একটি ভাব আছে এবং মথি যে অন্ধভাবে যিহূদীদের পক্ষে, তা নয়। আসলে তিনিই যিহূদীদের সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ করেন। মথি একজন যিহূদী কিন্তু তিনি যীশুর দ্বারা সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত একজন যিহূদী। তিনি জানেন যে আত্ম-ধার্মিকতা ধরে রেখে কেউ ঈশ্বরের রাজ্যে ঢুকতে পারবে না। তিনি অত্যন্ত দুঃখিত যে যিহূদীরা তাদের অহংকারের কারণে ঈশ্বরের রাজ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার পথে আছে।
মথি দেখান যে আমাদের আসল শত্রু ‘বাইরে’ নয় (দমনকারী রোম, দেবতাপূজারী অযিহূদী বা আপোষ করা যিহূদী নয়), আসল শত্রু হল ‘ভিতরে’ (আমাদের পাপী ও জেদী হৃদয়, ঈশ্বরের প্রতি আমাদের ভক্তিহীনতা এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে বিছিন্নতা)। যীশু এসেছেন তা-ই ঠিক করতে। তিনি এসেছেন পিতাকে প্রকাশিত করতে। তিনি তার দয়ায় লোকদের জীবন পরিবর্তন করেছেন। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন কিভাবে জীবন-যাপন করতে হয়। তিনি নিজের জীবন দিয়ে সর্বোচ্চ দাম দিয়েছেন যেন তিনি মানুষের জন্য ক্ষমা, গ্রহণযোগ্যতা এবং দোষ ও লজ্জা থেকে মুক্তি অর্জন করতে পারেন। এভাবে তিনি মানুষদের মধ্যে পার্থক্য বাতিল করেছেন, আমাদের মুর্খ অহংকারগুলো বাদ দিয়েছেন। ঈশ্বরের রাজ্য আসলে এসে গেছে, যীশু হৃদয়গুলো দখল করতে শুরু করেছেন, তিনি জীবন পরিবর্তন করতে শুরু করেছেন উভয় যিহূদীদের এবং অযিহূদীদের। ঈশ্বরের রাজ্যে কোন জাতিগত অহংকার বা কোন আত্ম-ধার্মিকতা ঢুকতে পারবে না, তা ছেড়ে দিতেই হবে। নিজেকে ঈশ্বরের রাজ্য থেকে বঞ্চিত করবেন না!
মথি বিশ্বাসীদের শিষ্যত্ব দান করেন
মণ্ডলীর আদিপিতারা তাদের লেখায় চারটি সুসমাচারের মধ্যে মথি লিখিত সুসমাচারটি সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃতি করতেন। তাই চিন্তা করা যায় যে মথি লিখিত সুসমাচার ছিল মণ্ডলীতে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও ব্যবহৃত সুসমাচার।
মথি যীশুর শিক্ষা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেন এবং তা বিষয় অনুসারে পাঁচটি অংশে সাজিয়েছেন। প্রত্যেক অংশের প্রথমে রয়েছে ঘটনার বর্ণনা এবং এরপরেই রয়েছে যীশুর শিক্ষা। সেগুলো হল:
- প্রারম্ভিকা ঘটনার বর্ণনা মথি ১-২ জন্ম
- ১ম ভাগ ঘটনার বর্ণনা মথি ৩-৪ যীশুর পরিচর্যা শুরু
শিক্ষা মথি ৫-৭ পর্বতে যীশুর দত্ত উপদেশ - ২য় ভাগ ঘটনার বর্ণনা মথি ৮:১-৯:৩৪ সুস্থতা দানকারী পরিচর্যা
শিক্ষা মথি ৯:৩৫-১০:৪২ শিষ্যদের প্রচারে পাঠানো - ৩য় ভাগ ঘটনার বর্ণনা মথি ১১-১২ তর্ক
শিক্ষা মথি ১৩:১-৫২ রাজ্যের দৃষ্টান্ত - ৪র্থ ভাগ ঘটনার বর্ণনা মথি ১৩:৫৩-১৭:২৭ শিষ্যদের ও ফরীশীদের সঙ্গে যীশু
শিক্ষা মথি ১৮ মণ্ডলীতে সংশোধন ও নম্রতা - ৫ম ভাগ ঘটনার বর্ণনা মথি ১৯-২২ তর্ক
শিক্ষা মথি ২৩-২৫ ভণ্ড ধার্মিকদের সাবধাণবাণী ও ২য় আগমন
উপসংহার চরম ঘটনা মথি ২৬-২৮ কষ্টভোগ, মৃত্যু ও পুনরুত্থান
যীশুর শিক্ষার উপরে মথি অনেক গুরুত্ব দেন এবং যীশুর শিক্ষা এই প্রারম্ভিকা বাক্য দিয়ে শুরু করেন: “তখন তিনি শিষ্যদের এই বলে শিক্ষা দিতে লাগলেন” (মথি ৪:১৭, ৫:২, ৯:৩৫, ১১:১, ১৩:৫৪)।
মথি গুরুত্বের সঙ্গে ও বিস্তারিতভাবে শিক্ষা লিখিত রাখেন (যা অন্য সুসমাচারগুলোর চেয়ে বেশি পাওয়া যায়), যেমন: বাপ্তিস্মদাতা যোহনের প্রচার (মথি ৩:১-১২), পাহাড়ের উপরে যীশুর দীর্ঘসময়ের শিক্ষা (মথি ৫:১-৭:২৯), শিষ্যদের প্রস্তুত করা ও প্রচারে পাঠানো (মথি ৯:৩৫-১০:৪২), ক্ষমার বিষয়ে শিক্ষা (মথি ১৮:১-৩৫), ফরীশীদের সরাসরি চ্যালেঞ্জ এবং দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়ে অসরাসরি চ্যালেঞ্জ করা (মথি ২৩:১-২৫:৪৬) এবং শিষ্যদের কাছে যীশুর মহান আদেশ (মথি ২৮:১৮-২০)।
শিক্ষার পদ্ধতি হিসাবে মথি অনেক দৃষ্টান্তও উল্লেখ করেন। মথি লিখিত সুসমাচারে ১১টি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যা আর অন্য সুসমাচারে উল্লেখ নেই। সেগুলো হল: ভাল ও শ্যামাঘাসের বীজের দৃষ্টান্ত, লুকানো ধনের দৃষ্টান্ত, জালের দৃষ্টান্ত, দামী মুক্তার দৃষ্টান্ত, দুজন ঋণী দাসের দৃষ্টান্ত, আঙ্গুর ক্ষেতে শ্রমিকদের দৃষ্টান্ত, দুই ছেলের দৃষ্টান্ত, রাজার পুত্রের বিবাহের দৃষ্টান্ত, দশজন কুমারীর দৃষ্টান্ত, তালন্তের দৃষ্টান্ত এবং ভেড়া ও ছাগলের দৃষ্টান্ত।
মথি শিষ্যত্বের বিষয়ে অনেক গুরুত্ব দেন এবং বারোজন শিষ্যদের উপর জোর দেন। পাঁচটি বড় শিক্ষার পাশাপাশি মথি যীশুর বেশ কয়েকটি অন্য ছোট শিক্ষাগুলোও উল্লেখ করেন, যেমন: পিতরের কথা ও পর্ববর্তী শিক্ষা (মথি ১৬:১৩-২৮), রূপান্তর ও পরবর্তী শিক্ষা (মথি ১৭:১-২৭), ধন সম্বন্ধে শিক্ষা (মথি ১৯:২৩-২০:১৬), আসল নেতৃত্ব মানে কি (মথি ২০:১৭-২৮), বিশ্বাস নিয়ে কথা (মথি ২১:১৮-২২) এবং প্রভুর ভোজের সময়ে শিক্ষা (মথি ২৬:২০-৩৫)।
সারাংশে বলা যায় যে মথি তার সুসমাচারে যিহূদীদের কাছে প্রমাণিত করেন যে যীশুই মশীহ এবং বিশ্বাসীদের তিনি আরো শিষ্যত্ব ও শিক্ষা দান করেন। তিনি উভয় প্রচার করেন এবং বিশ্বাসীদের গঠন করেন – যেমন যীশুও করতেন।