এই সুসমাচারের লেখক হলেন যোহন মার্ক, যিনি যুবক হিসেবে যীশুর গ্রেফতার ও মৃত্যুর সাক্ষী হন (মার্ক ১৪:৫১)। তিনি ও তার মা মরিয়ম এবং আত্মীয় বার্ণবা যীশুর অনুসরণকারী ও প্রথম মণ্ডলীর সদস্য হয়ে যান (মার্ক ১২:১২, কল ৪:১০)। যোহন মার্ক বার্ণবার (প্রেরিত ১২:২৫, ১৩:১৩, ১৫:৩৯) এবং পৌলের পরিচর্যায় সহকর্মী হিসাবে কাজ করেন (২ তীম ৪:১১)। পরে তিনি রোম শহরে পিতরের সহকর্মী ও অনুবাদক হিসাবে কাজ করেন (১ পিতর ৫:১৩, মণ্ডলীর ইতিহাস)।
রোমীয় সম্রাট নীরো রোম শহরে নতুন দালান নির্মাণের জন্য স্থান প্রস্তুত করতে চান বলে তিনি নিজের রাজধানীতে গোপনে আগুন লাগিয়ে তা পুড়িয়ে ফেলেন। যখন জনগণ তা জেনে সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে তখন তিনি খ্রিষ্টানদের উপরে দোষ চাপিয়ে দেন এবং তাদেরকে তিন বছর ধরে হিংস্রভাবে অত্যাচার করেন (৬৪-৬৭ খ্রীঃ)। প্রথমে তিনি রোমীয় মণ্ডলীর নেতাদের মেরে ফেলেন (যেমন পিতর ও পৌল) এবং পরবর্তীতে আরো এক হাজার বিশ্বাসীরা তাদের অটল বিশ্বাসের জন্য শহীদ মৃত্যু গ্রহণ করে (মণ্ডলীর ইতিহাস)।
যীশুর সময়ের চোখের সাক্ষীরা (যেমন পিতর) নীরোর অত্যাচারে মারা যাচ্ছেন বলে তাদের সাক্ষ্য লিখিত রাখা জরুরী বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। পিতরের সহকর্মী ও অনুবাদক হিসাবে এই দায়িত্ব যোহন মার্কের উপরে পড়ে এবং তিনি পিতরের সাক্ষ্য অনুসারে তার সুসমাচার লেখেন। তিনি নীরোর অত্যাচারের সময়ে রোম শহরে গোপন গুহায় (catacombs) লুকিয়ে অত্যাচারিত বিশ্বাসীদের জন্য তার সুসমাচার লেখেন (মণ্ডলীর ইতিহাস)।
এই কঠিন পরিস্থিতিতে রোমীয় বিশ্বাসীদের হৃদয়ে অনেক প্রশ্ন ও সন্দেহ জাগে: কেন ঈশ্বর এই অত্যাচার ও তীব্র কষ্টভোগ ঘটতে দেন? যদি ঈশ্বর তাঁর মণ্ডলীকে ভালবাসেন তবে কেন অত্যাচারের প্রতিরোধ করেন না? যদি তিনি সর্বক্ষমতাশালী, কেন তিনি কিছু করেন না? বা নীরো কি যীশুর চেয়ে বেশি শক্তিশালী? অথবা এই অত্যাচার কি বিশ্বাসীদের জন্য ঈশ্বরের দেওয়া শাস্তি? যীশু কি আসলেই ঈশ্বর? তিনি কি উদ্ধারকর্তা নন? খ্রিষ্টান ধর্ম কি আসলেই সত্য? আমি কি মিথ্যার জন্য প্রাণ হারাচ্ছি?
মার্ক এই সুসমাচারে শক্তিশালীভাবে এই প্রশ্ন ও সন্দেহগুলোর উত্তর দেন: তিনি যীশুর অনেক আশ্চর্য কাজের বর্ণনা করেন যাতে প্রমাণ হয় যীশুই সর্বশক্তিমান, তিনি আসলেই ঈশ্বর। রোগের উপর (মার্ক ১:৩৪), প্রকৃতির উপর (মার্ক ৪:৪০, ৬:৪১), মন্দ আত্মাদের উপর (মার্ক ১:৩৪), এমন কি জীবন ও মৃত্যুর উপর (মার্ক ৫:৪১-৪২) তাঁর ক্ষমতা আছে। আশ্চর্য শক্তি ও ক্ষমতা থাকলেও তিনি নিজের স্বার্থে রাজত্ব করার জন্য তা ব্যবহার করেন না (যেমন নীরো), বরং লোকদের সেবায় তা ব্যবহার করেন। তিনি তাদের উদ্ধার করার জন্য কষ্টভোগ করেন ও নিজের জীবন উৎসর্গ করেন (মার্ক ১০:৪৫)। তাই যীশুই হলেন স্বার্থহীন প্রেমের অবতার। তিনি মৃত্যু গ্রহণ করে মৃত্যুর উপর জয়ী হন (মার্ক ১৬:১৯)। তাঁর অনুসরণকারী হিসাবে আমরা তার মত হই, যেমন যীশু বলেছেন “নিজের ক্রুশ বয়ে নিয়ে সে আমার পিছনে আসুক” (মার্ক ৮:৩৪)। রোমীয় বিশ্বাসীরা এবং আমরাও তাঁর মত কষ্টভোগ করি, এমন কি তাঁর জন্য তাঁর মত জীবন উৎসর্গ করি কারণ যীশুই ঈশ্বর এবং তিনিই এর যোগ্য।
সুসমাচারের লেখক যোহন মার্ক
যদিও এই সুসমাচারে যোহন মার্ক নিজের নাম লেখক হিসাবে প্রকাশ করেন না তবুও মণ্ডলীর আদিপিতারা তাদের লেখায় উল্লেখ করেন যে যোহন মার্ক, বার্ণবার আত্মীয় এই সুসমাচারের লেখক। তারা উল্লেখ করেন যে যোহন মার্ক ছিলেন পিতরের অনুবাদক এবং পিতর যা প্রচার করতেন মার্ক তা লিখতেন। যে মণ্ডলী আদিপিতারা যোহন মার্ককে উল্লেখ করেন, তাদের নাম নিচে দেওয়া হল:
- মণ্ডলীর ইতিহাস বিদ ইউসেবিয়াস (Eusebius) পাপিয়াস নামে (Papias, ১৮০ খ্রীঃ) হিয়রাপলির মণ্ডলীর একজন নেতার উদ্ধৃতি দেন, যিনি আবারও ‘প্রাচীন নেতার’ (‘the Elder’) একটি উদ্ধৃতি দেন, যা হতে পারে শিষ্য যোহনকে বুঝায় (২ যোহন ১, ৩ যোহন ১)।
- ইরেন্যায়াস (Irenaeus), ইটালী এবং ফ্রান্সের মণ্ডলীর আদিপিতা (১৫০-২০০ খ্রীঃ)
- শহীদ জাস্টিন (Justin), শমরিয়ার মণ্ডলীর আদিপিতা ও যুক্তিবিদ (১৫০ খ্রীঃ)
- একটি পুরাতন ল্যাটিন লিপি (Latin Manuscript, ১৬০-১৮০ খ্রীঃ)
- পুরাতন গ্রীক ভাষার একটি সুসমাচারের প্রারম্ভিকার লেখক
- আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লীমেন্ট (Clement of Alexandria) মিসরের আলেজান্দ্রিয়ার আদিপিতা (২১০ খ্রীঃ)
নতুন নিয়মে যোহন মার্কের শেষ উল্লেখ পাই ১ পিতর ৫:১৩ পদে যেখানে তিনি পিতরের সাথে রোম শহরে কাজ করেন (পদে উল্লিখিত ‘বাবিল’ রোম শহরকে বুঝায়)। তাই হতে পারে তিনি যখন রোমে কাজ করেন সে সময় নীরোর অত্যাচার শুরু হয় এবং তখন তিনি রোমে থেকে তার সুসমাচার লেখেন।
যেহেতু ‘পিতর যা প্রচার করতেন মার্ক তাই লিখতেন’ এজন্য অবাক লাগে না যে নতুন নিয়মে পিতরের উল্লিখিত প্রচারগুলো (প্রেরিত ২:১৪-৩৯, ৩:১২-২৬, ১০:৩৪-৪৩) এবং সুসমাচারের বেশ মিল আছে, যেমন: যীশুর শক্তিকে এবং শিষ্য হিসাবে কষ্টভোগকে প্রাধান্য দেওয়া।
যোহন মার্কের জীবন
- মার্ক ৩:১৬ বারোজন শিষ্যদের তালিকায় যোহন মার্কের নাম নেই। তাই তাদের মত তিনি শুরু থেকে যীশুর অনুসরণকারী ও সাক্ষী ছিলেন না।
- মার্ক ১৪:৫১-৫২ যোহন মার্ক যুবক হিসাবে যীশুর গ্রেফতারের সময় গেৎশেমানী বাগানে উপস্থিত ছিলেন এবং হতে পারে যীশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থান নিজের চোখে দেখেছেন। যদিও তার বয়স তখন বেশি নয়, তবুও তিনি যীশুর সময়ের চোখের সাক্ষী।
- প্রেরিত ১২:১২ যিরূশালেম মণ্ডলী মার্কের মা মরিয়মের বাসায় একত্রিত হত। মার্কের মাও যীশুর অনুসরণকারী ছিলেন, তিনি এমন কি এত সাহসী যে তিনি অত্যাচারের সময় বিশ্বাসীদের নিজের বাসায় মিলিত হতে দিতেন।
- কলসীয় ৪:১০ যোহন মার্ক হলেন বার্ণবার আত্মীয় (‘কুটুম্ব’, ইংরেজিতে ‘cousin’)। বার্ণবা ছিলেন প্রথম মণ্ডলীতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী কর্মী (যেমন প্রেরিত ১১:২২-২৪)। তিনি প্যালেষ্টাইনের বাইরে সাইপ্রাস দ্বীপে বাস করতেন কিন্তু ধার্মিক যিহূদী হিসাবে পর্ব পালন করার জন্য আইন অনুসারে যিরূশালেমে আসতেন। নিশ্চিত বলা যায় যে মার্ক যিহূদী (কলসীয় ৪:১০-১১), হয়তো তিনিও সাইপ্রাসে বাস করতেন, যদিও পরে তার পরিবার যিরূশালেমে বাস করেন।
- প্রেরিত ১২:২৫ ৪৭ খ্রীষ্টাব্দে বার্ণবা ও পৌল যোহন মার্ককে তাদের পরিচর্যার কাজে নিযুক্ত করেন। হতে পারে তারা তাকে শিষ্যত্ব, পরিচর্যার প্রশিক্ষণ ও এক পরিমাণে নেতৃত্ব দান করেন।
- প্রেরিত ১৩:১৩ ৪৮ খ্রীষ্টাব্দে যখন বার্ণবা ও পৌল তাদের প্রথম প্রচার যাত্রায় বের হন, তারা মার্ককে সাহায্যকারী হিসাবে নিয়ে যান। কিন্তু কিছু দিন পরে যোহন মার্ক তাদেরকে ছেড়ে চলে যান, হয়তো তিনি খুশি ছিলেন না কারণ বার্ণবা পৌলকে দলের নেতৃত্বের অধিকার দিয়েছিলেন।
- প্ররিত ১৫:৩৬-৪১ ৫০ খ্রীষ্টাব্দে মার্ককে নিয়ে বার্ণবা ও পৌলের মধ্যে ঝগড়া ও বিভেদ শুরু হয় যা হতে পারে মার্কের অনেক খারাপ লেগেছিল। বার্ণবা তাকে পুনরায় সুযোগ দিয়ে সাইপ্রাস দ্বীপে পরিচর্যার জন্য নিযুক্ত করেন।
- ফিলীমন ২৪ বারো বছর পার হওয়ার পরে (৬২ খ্রীঃ) দেখা যায় যে মার্ক পৌলের সাথে রোম শহরে উপস্থিত।
- ২ তীমথিয় ৪:১২ ৬৪ খ্রীষ্টাব্দে পৌল অনুরোধ করেন যেন তীমথিয় মার্ককে নিয়ে আসেন “কারণ আমার কাজে তাকে খুব দরকার”। তাই দেখা যায় যে মার্কের ক্ষেত্রে বার্ণবার চেষ্টা ও শিষ্যত্ব ফলবান হয়। পৌল এখন মার্ককে কর্মী হিসাবে চান ও সুপারিশ দেন।
- ১ম পিতর ৫:১৩ যোহন মার্ক পিতরের সঙ্গে রোম শহরে উপস্থিত। পিতর তাকে স্নেহে ‘আমার সন্তান’ বলে ডাকেন।
- মণ্ডলীর ইতিহাস যোহন মার্ক নীরোর হাতে অত্যাচারিত রোমীয় বিশ্বাসীদের কাছে তার সুসমাচার লিখেন।
মার্ক তার সুসমাচার কাদের জন্য লেখেন?
মণ্ডলীর আদিপিতাদের সাক্ষ্যের পাশাপাশি (লেখক সম্বন্ধীয় অনুচ্ছেদ দেখুন) মার্ক সুসমাচারের লেখা থেকেও তার পাঠকদের পরিচয় সম্বন্ধে বেশ কিছু ধারণা পাওয়া যায়:
- মার্ক যিহূদী আইন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগুলো তার পাঠকদের কাছে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন মনে করেন(যেমন মার্ক ২:২৬, ৭:১-৫, ১২:১৮, ১৪:১২, ১৫:৪২) । এতে বুঝা যায় যে পাঠকেরা অযিহূদী, তাদের যিহূদী আইন ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান নেই।
- মার্ক বেশ কয়েকটা অরামীয় শব্দ পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেন (যেমন মার্ক ৩:১৭, ৫:৪১, ৭:৩৪, ৯:৪৩, ১০:৪৬, ১৪:৩৬, ১৫:২২, ১৫:৩৪)। এতে বুঝা যায় যে পাঠকেরা অরামীয় ভাষা জানে না । অরামীয় ভাষা শুধু যিহুদীয়া, সিরিয়া ও রোম রাজ্যের পূর্ব এলাকায় প্রচলিত ছিল। পাঠকেরা এই এলাকার লোক নয়।
- মার্ক সুসমাচার (যেমন সম্পূর্ণ নতুন নিয়মও) প্রথমে গ্রীক ভাষায় লেখা হয়েছিল। গ্রীক ছিল রোম রাজ্যের সবচেয়ে প্রচলিত ভাষা, যেমন আজকাল ইংরেজী আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত। সুসমাচারে কিছু পদে মার্ক যখন পাঠকদের একটি গ্রীক শব্দ বুঝাতে চান, তখন তিনি তা ল্যাটিন ভাষা দ্বারা বলেন, যেমন
- মার্ক ১২:৪২ পদে “দুটি মুদ্রা (গ্রীক ‘lepta’ ) তাহাতে রাখিল, যাহার মূল্য সিকি পয়সা” (ল্যাটিন ‘quadran’)।
- মার্ক ১৫:১৬ পদে “সৈন্যরা প্রাঙ্গণের (গ্রীক ‘aules’) মধ্যে, অর্থাৎ রাজবাটীর (ল্যাটিন ‘praetorium’) ভিতরে তাহাকে লইয়া গিয়া…”।
- বাংলা অনুবাদে তা আর দেখা যায় না। সারাংশে বলা যায় যে মার্ক সুসমাচারের পাঠকেরা গ্রীক ভাষা জানতেন, কিন্তু তাদের মাতৃভাষা ল্যাটিন।
- তাছাড়া মার্ক আরো ল্যাটিন শব্দ ব্যবহার করেন, এবং নির্দিষ্টভাবে ও উপযুক্তভাবে তা করেন।
- মার্ক ৫:৯ পদে তিনি ল্যাটিন শব্দ‘legion’ ব্যবহার করেন, যার অর্থ ‘রোমীয় সৈনদল’ (ছয় হাজার সেনা)।
- মার্ক ৬:২৭ পদে তিনি ল্যাটিন শব্দ ‘speculator’ ব্যবহার করেন যার অর্থ ‘সেনা’।
- মার্ক ১৫:১৫ পদে তিনি ‘flagellare’ ব্যবহার করেন যা হল রোমীয় শাস্তির একটি ধরণ ‘চাবুক দেওয়া’।
- মার্ক ১৫:১৬ পদে তিনি ‘praetorium’ ব্যবহার করেন যার অর্থ হল ‘রোমীয় শাসনকর্তার অফিস’ বা ‘সদর দপ্তর’।
- মার্ক ১৫:৩৯ পদে তিনি সেনাপতিকে উপযুক্তভাবে ‘centurion’ বলেন, যার অর্থ হল ‘একশত রোমীয় সেনাদের প্রধান’।
- তাছাড়া মার্ক সময় উল্লেখ করলে যিহূদী সময় পদ্ধতি ব্যবহার না করে বরং রোমীয় সময় পদ্ধতি ব্যবহার করেন। যিহূদীদের সময় পদ্ধতিতে এক রাতে তিনটি পাহারাদারদের মধ্যে সময় ভাগ করা হত, রোমীয় সময় পদ্ধতিতে এক রাত চারটি পাহারাদারদের মধ্যে সময় ভাগ করা হত। মার্ক তার সুসমাচারে চারটি সময় উল্লেখ করেন (মার্ক ১৪:১৭, ১৪:৭২, ১৫:১, ৬:৪৮)। এতে আরো প্রমাণিত হয় যে পাঠকেরা রোমীয়।
- মথির তুলনায় মার্ক পুরাতন নিয়মের বেশি উদ্ধৃতি দেন না। যেখানে তিনি উদ্ধৃতি দেন সেখানে সরাসরি পুরাতন নিয়ম থেকে অনুবাদ করে উদ্ধৃতি করেন না, বরং পুরাতন নিয়মের গ্রীক একটি অনুবাদ থেকে তা করেন, যার নাম ‘সেপ্টুয়াজিন্ট’ (Septuagint, ২৫০ খ্রীঃপূঃ আলেকজান্দ্রিয়া শহরে অনুবাদিত)। প্যালেষ্টাইনের বাইরের যিহূদীদের মধ্যে সেপ্টুয়াজিন্ট প্রচলিত ছিল।
- মার্ক ১৫:২১ পদে মার্ক একজন আলেকসান্দর এবং একজন রূফকে উল্লেখ করেন। তারা হলেন কূরীণী শহরের শিমোনের ছেলে, ইনি সেই শিমোন যিনি যীশুর ক্রুশ বহন করেছিলেন। হতে পারে রোমীয় বিশ্বাসীরা তাদের চেনেন, এমন কি রোমীয় ১৬:১৩ পদে রোমীয় মণ্ডলীর রূফ নামে একজনকে উল্লেখ করা হয়েছে। হতে পারে সেটা হল সেই একই রূফ।
সারাংশ হিসাবে বলা যায় যে মার্ক সুসমাচারের পাঠকেরা যিহূদী নয়, যিহূদী আইন ও সংস্কৃতিও জানে না। তারা অরামীয় ভাষা পারে না। তারা গ্রীক ভাষা বুঝে কিন্তু তাদের মাতৃভাষা হল ল্যাটিন। ল্যাটিন ভাষা ইটালিতে প্রচলিত ছিল বলে আমরা বুঝতে পারি যে পাঠকেরা ইটালির লোক।
মণ্ডলীর ইতিহাস থেকে আমরা আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে পারি যে পাঠকেরা হল রোম শহরের বিশ্বাসীরা , যারা বর্তমানে নীরোর অত্যাচারে ভুগছে।
প্রথম পাঠকদের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
রোম রাজ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
রোম রাজ্যের ইতিহাস শুরু হয় ৭৫৩ খ্রীষ্টপূর্বে যখন কয়েকটি ল্যাটিন ভাষাবাদী গ্রামের লোকেরা বাইরের গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য একটি মৈত্রী চুক্তি ও সুরক্ষিত সীমানা তৈরি করে। এভাবে রোম শহর স্থাপিত হয়।
রোমের গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা হিসাবে একটি পরিষদ (senate) গঠিত হয় যেখানে প্রত্যেক পরিবার থেকে দুইজন প্রতিনিধি থাকে। পরিষদ এক বছরের জন্য দুইজন মন্ত্রী নিযুক্ত করে যাদের বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দুইজন মন্ত্রীদের ক্ষমতা সীমিত রাখার এবং পরিষদের কাছে তাদেরকে দায়বদ্ধ রাখার জন্য মন্ত্রী পদের মেয়াদ ছিল মাত্র এক বছর।
রোম শহর বৃদ্ধি পায় ও চারিদিকের গোষ্ঠীদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়। রোমীয়দের যেহেতু আক্রমণ করা হয়েছিল তারা একটি নিরাপদ সীমানা তৈরির জন্য জায়গা দখল করতে থাকে । তারা এলাকার পর এলাকা , নদীর পর নদী, পাহাড়ের পর পাহাড় দখল করতে থাকে, এভাবে সারা ইটালী তাদের অধীনে আসে। কিন্তু সাগরের পাড় পর্যন্ত দখল করলে , সাগরের উপর ক্ষমতা কার? তাই রোমীয়রা জাহাজ বানিয়ে ভূমধ্যসাগরের উপর রাজত্ব পাওয়ার জন্য কার্থাগোকে (Carthage, আজকের তিউনিসিয়া দেশে) আক্রমণ করে। ১৪৬ খ্রীষ্টপূর্বে তারা কার্থাগোকে পরাজিত করে সবচেয়ে শক্তশালী সাম্রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরেও তারা চারিদিকে দখল করতে থাকে।
সাম্রাজ্য বিস্তারের কারণে রোমীয়রা অনেক ধনী হয়ে উঠে(যুদ্ধে লূট, দখল করা এলাকা থেকে কর) এবং অনেক দাস চলে আসে (দখল করা লোক)। ফলে রোমীয়রা উচু শ্রেণীর হয়ে যায়, বিলাসিতায় অভ্যস্ত হয় এবং কাজ করা বাদ দিয়ে দাস রাখে। রোম সরকার এই বেকার রোমীয়দের প্রয়োজন মেটানোর জন্য ব্যবহার করেন: ‘রুটি ও খেলা’, যোগান ও বিনোদন। রোমীয়দের বিনোদনের ধরণ ছিল হিংস্র ও রক্তপাত পূর্ণ , মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই ও ঘোড়ার রথের দৌড় ইত্যাদি।
দখল করতে করতে ও অনবরত যুদ্ধের অবস্থায় থাকার কারণে রোম রাজ্য ঝুঁকির মুখে পড়ে এবং সরকার নিজের ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি করে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি কমে এবং শেষে পরিষদে শুধুমাত্র দশটা পরিবারের লোক উপস্থিত। নিযুক্ত মন্ত্রীরা হয়ে যায় শক্তিশালী সেনাপ্রধান, যাদের হাতে উভয় সেনা এবং দখল করা এলাকা থেকে কর আসে।
অবশেষে ৪৮ খ্রীষ্টপূর্বে একজন জয়ী ও জনপ্রিয় মন্ত্রী ক্ষমতা দখল করে পরিষদের অধিকার কমান এবং নিজেকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করে নিজের ক্ষমতা বিস্তার করেন। তার নাম হল জুলিয়াস কৈসর (ডানের ছবি)। এভাবে রোম একটি গণতান্ত্রিক সাম্রাজ্য থেকে একটি একনায়কতান্ত্রিক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। এখন থেকে জুলিয়াসের পরিবার রাজবংশ হিসাবে রাজত্ব করবে, তারা ভাল নেতা হোক বা না হোক।
- ২৭ খ্রীঃপূঃ – ১৪ খ্রীঃ আগস্ত কৈসর তার রাজত্বের সময়ে যীশু জন্ম গ্রহণ করেন।
- ১৪-৩৭খ্রীঃ তিবিরিয় কৈসর তার রাজত্বের সময়ে যীশুকে ক্রশে দেওয়া হয়।
- ৩৭-৪১ খ্রীঃ কালিগুলা কৈসর তার রাজত্বের সময়ে মণ্ডলী বৃদ্ধি পেতে থাকে।
- ৪১-৫৪খ্রীঃ ক্লৌদিয় কৈসর তার রাজত্বের সময়ে পৌলের প্রচার যাত্রা শুরু।
- ৫৪-৬৮খ্রীঃ নীরো কৈসর তার রাজত্বের সময়ে রোম মণ্ডলীকে অত্যাচার করা হয়। নিচের ছবি।
নীরো তার মা আগ্রিপ্পিনার কৌশলে ১৭ বছরের বয়সে একটি বিরাট সম্রাজ্যের সম্রাট হয়ে যান। তিনি ছিলেন মিশুক এবং তিনি সম্পর্কে গুরুত্ব দিতেন। তিনি নিজেকে শিল্পী মনে করতেন ও জনপ্রিয় হতে চাইতেন, কর কমিয়ে দিলেন এবং শিল্প চর্চা, গানের প্রতিযোগিতা ও অনেক খেলা-ধূলা আয়োজন করতেন।
তিনি সৈন্য, সরকারি ব্যবস্থাপনা, ন্যায় বিচার ও সম্রাটের নানা ভূমিকার ক্ষেত্রে অবহেলা করেন। যখন তার মা সম্রাজ্ঞী হিসাবে স্বীকৃতি চান, নীরো তাকে খুন করতে ব্যবস্থা নেন।
তিনি ধীরে ধীরে প্রত্যেক বিলাসীতা ও কামনা-বাসনায় আসক্ত হন এবং তার স্বেচ্ছাচারীতা, অনৈতিকতা ও হিংস্রতা সীমানার বাইরে চলে যায়।
তিনি রোম শহরের সৌন্দর্য ও মহিমা বাড়াতে চান ও শহরের নাম ‘নীরোপলিসে’ পরিণত করতে চান। কিন্তু শহরে ঘন ঘন দালানের কারণে তা সম্ভব হয় না। জুন ৬৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি গোপনে শহরে আগুন লাগানোর ব্যবস্থা করেন যেন নির্মাণের জন্য জায়গা বের হয়। আগুন বাতাসের কারণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং রোমের তিন ভাগের দুইভাগ পুড়ে ধ্বংস হয়। রোমের জনগণ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ভয়ে তিনি দোষ চাপানোর ও শাস্তি দেওয়ার জন্য একটি ছোট, অপ্রিয় দলকে খুঁজে পান – খ্রিষ্টানরা।
নীরো রোমীয় বিশ্বাসীদের দোষী হিসাবে ঘোষণা করেন এবং গ্রেফতার করে তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে শুরু করেন: তিনি খ্রিষ্টানদের স্টেডিয়ামের খেলা-ধূলা, হিংস্র লড়াই, জন্তুদের খাওয়ানো, হারিকেন হিসাবে পোড়ানো ও ক্রুশে দেওয়ার মধ্য দিয়ে মেরে ফেলেন। খ্রিষ্টানদের অত্যাচারের ক্ষেত্রে নীরো এত চরম হিংস্রতা দেখিয়েছিলেন যে শেষে এমন কি রোমীয়রা খেলাগুলো আর দেখতে রাজী ছিল না। টাকিটাস (Tacitus) নামে রোমীয় একজন ইতিহাসবিদ ছিলেন যিনি খ্রিষ্টানদের ঘৃণা করলেও তার লেখায় স্বীকার করেন যে ‘অবশেষে রোম শহরের সবাই বুঝেছিলেন যে খ্রিষ্টানদের তাদের দোষের কারণে মেরে ফেলা হচ্ছে না বরং নীরোর চরম হিংস্রতার কারণে মেরে ফেলা হচ্ছে’।
নীরোর অত্যাচার ৬৪ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাস থেকে ৬৮ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাস পর্যন্ত চলেছিল। এই সাড়ে তিন বছরে পৌলকে (শিরোচ্ছেদ করে), পিতরকে (উল্টা ক্রুশে দিয়ে) এবং আর এক হাজার বিশ্বাসীরা শহীদ হয়।
৬৭ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে এমন অবস্থা হয় যে জনগণ বিদ্রোহী হয়ে উঠে। অবশেষে পরিষদ নীরোকে রাষ্ট্রীয় শত্রু হিসাবে ঘোষণা করে এবং তার সেনা প্রধানরা তার বিরুদ্ধে কৌশল নেয়। ৬৮ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে নীরো ৩২ বছর বয়সে একজনের সাহায্য নিয়ে আত্মহত্যা করেন।
রোমীয় ধর্মের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
রোমীয়রা বিশ্বাস করত যে, এই জগতে বিভিন্ন আত্মা বা দেবতা থাকে এবং তারা সব কিছুর উপর প্রভাব ফেলে (Animism, প্রকৃতি পূজা) ধীরে ধীরে কয়েকটি দেবতার পূজা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল।
রোমীয়দের পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে রোমীয়রা ত্রোয়া শহরের লোকদেরকে পূর্ব পুরুষ হিসাবে মানত। এটি সে ত্রোয়া যার বিরুদ্ধে গ্রীক পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে গ্রীকেরা যুদ্ধ করেছিল।
রোমীয় পৌরাণিক কাহিনীতে তাদের ইতিহাসে ছিল পূর্বপুরুষদের শুক্ল দেবীর সাথে ব্যভিচার, মঙ্গল দেব দ্বারা ধর্ষণ ও সন্তান ত্যাগ। ফলে ব্যভিচার, ধর্ষণ ও সন্তান ত্যাগ রোমীয় সমাজে বেশ প্রচলিত ছিল।
রোমীয়দের প্রধান দেব-দেবতা ছিল:
- বৃহষ্পতি (Jupiter, গ্রীক: Zeus জিউস) প্রধান দেব আকাশ, বিদ্যুৎ চমকানোর, শপথ ও সরকারের দেব
- জুনো (Juno, গ্রীক: Hera হেরা) প্রধান দেবী বৃহষ্পতির স্ত্রী বিবাহ ও সন্তান প্রসবের দেবী
- মঙ্গল (Mars, গ্রীক: Ares, আরেস্) দেব শারীরিক শক্তি, ক্ষমতা, সৈন্য, যুদ্ধের দেব
- শুক্ল বা শুক্র (Venus, গ্রীক: Aphrodite, আফ্রোদিত) দেবী প্রেম, যৌনতা, ব্যভিচার ও পতিতাদের দেবী
যদি একটি সমাজে শারীরিক শক্তির দেব এবং যৌনতার দেবীর পূজা করা হয় তবে সমাজটি দেখতে কেমন ও তাদের ইতিহাস কি রকম হবে ?
এই ধরনের সমাজে পুরুষের শক্তি, লড়াই করার ক্ষমতা এবং যুদ্ধে জয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। জয়ী ও ক্ষমতাশালীদের স্বৈরাচারী ব্যবহার থাকলেও তাদের নেতৃত্ব মানা হবে।
এই ধরনের সমাজে বিবাহ, পরিবার ও সন্তান নীচু চোখে দেখা হবে। তাই ব্যভিচার ও স্বেচ্ছাচারী যৌনতা প্রচলিত হবে। রোমীয় সমাজে ঠিক তাই দেখা দিল।
মার্ক তার সুসমাচারে শক্তির বিষয়ে (মঙ্গল) এবং ভালবাসার বিষয়ে (শুক্ল) রোমীয়দের ভুল চিন্তা সংশোধন করেন: তিনি আদর্শ দ্বারা দেখান, আসল শক্তি এবং আসল ভালবাসা দেখতে কেমন: সেবা, স্বনিয়ন্ত্রণ, স্বার্থহীনতা এবং ত্যাগ স্বীকার। মার্ক তাই রোমীয়দের প্রিয় দুইটি দেবতাকে নত করে যীশুর সেই আসল শক্তি ও ভালবাসা প্রমাণিত করেন।
পাঠকদের জন্য মার্কের উদ্দেশ্য
অত্যাচার ও কষ্টভোগের সময়ে একজন বিশ্বাসীর হৃদয়ে কি কি প্রশ্ন বা সন্দেহ উঠে?
ধরেন আপনি রোম শহরের একজন খ্রিষ্টান বিশ্বাসী যখন নীরো ঘোষণা করেন যে খ্রিষ্টানরা এই ধ্বংসাত্মক আগুনের জন্য দায়ী। হঠাৎ করে আপনি নিজেকে রাষ্ট্রীয় শত্রু হিসাবে খুঁজে পান এবং সবাই আপনাকে ঘৃণার চোখে দেখে। পরে খ্রিষ্টানদের গ্রেফতার শুরু হয়। একজনের পর একজনকে গ্রেফতার করা শুরু হয় এবং দেশের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হিংস্র ও জঘন্যভাবে মেরে ফেলা হয়। প্রথমে নীরো নেতাদের, যেমন পিতর ও পৌলকে ধরেন। কিন্তু পরে সাধারণ বিশ্বাসীদের ধরতে শুরু করেন। আপনার বাবাকে স্টেডিয়ামে পোড়ানো হয়েছে এবং মা বোনের খবর আর পাওয়া যাচ্ছে না । আপনি শুনেছেন যে নীরো মহিলাদের শুধু মেরে ফেলেন না বরং ধর্ষণ করে নষ্ট করেন। আপনি অন্য পলাতক খ্রিষ্টানদের সঙ্গে রোম শহরের নিচে কোন গুহাতে আশ্রয় নিয়েছেন। এই অবস্থায় আপনার মনে ঈশ্বর সম্বন্ধে কি কি প্রশ্ন বা সন্দেহ উঠবে ?
- আমার জীবনের উপর অধিকার কার ? নীরো কি যীশুর চেয়ে শক্তিশালী ? যদি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান তবে কেন তিনি এই ভয়ঙ্কর অত্যাচার থামিয়ে দিচ্ছেন না ? কেন আমাদের রক্ষা করছেন না ?
- একজন ভালবাসার ঈশ্বর কেন এই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেন? ঈশ্বর আমাকে কি ত্যাগ করেছেন? আমাকে ভুলে গিয়েছেন? আমাকে ভালবাসেন না? আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন? আমাকে কিসের জন্য শাস্তি দিচ্ছেন?
- আমি কি ভুলকে বিশ্বাস করেছি? খ্রিষ্টান ধর্ম কি মিথ্যা? যদি ঈশ্বর আমাকে রক্ষা না করেন তবে কেন তার আরাধনা করব? কেন এমন একজন ঈশ্বরের জন্য মারা যাব যাঁর আমাদের উদ্ধার করার কোনো ক্ষমতা নেই বা যিনি আমাদের কোনো যত্নও নেন না? এর জন্য জীবন দেব কেন? এই ঈশ্বর কি আমার শহীদ মৃত্যুর যোগ্য?
- মোট কথা তিনটা বড় সন্দেহ উঠে: ঈশ্বরের কি ক্ষমতা নেই? ঈশ্বরের কি প্রেম নেই? যীশু কি ঈশ্বর নন?
- মার্ক তার সুসমাচার ঠিক এই ধরণের প্রশ্ন ও সন্দেহের উত্তর দেওয়ার জন্য লেখেন।
কিভাবে মার্ক এই প্রশ্ন ও সন্দেহের উত্তর দেন?
যীশুই সর্বশক্তিমান
- মার্ক তার পাঠকদের জন্য একের পর এক পৃষ্ঠায় যীশুর অদ্ভুত ও অনবরত আশ্চর্য কাজের বর্ণনা করেন।
- তিনি দেখান যে যীশু ক্ষণস্থায়ী রোগ (যেমন জ্বর, মার্ক ১:২৯-৩১), স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী রোগ (যেমন কুষ্ঠরোগ, মার্ক ১:১০-৪৪), জন্ম থেকে সমস্যা (যেমন অন্ধতা, বধিরতা, মার্ক ৭:৩১-৩৭, ৮:২২-২৬), অঙ্গবিকৃতি, বিকলাঙ্গতা (মার্ক ৩:১-৬) ও পক্ষাঘাত (মার্ক ২:১-১২) সবই সুস্থ করেন।
- যীশু অনবরত মন্দ আত্মা তাড়ান, এমন কি মন্দ আত্মাদের সম্পূর্ণ বাহিণীও তাড়ান এবং লোকদের দীর্ঘ দিনের মন্দ আত্মার নির্যাতন থেকে একেবারে মুক্ত করেন। মার্ক প্রমাণিত করেন যে আত্মিক জগত , অদৃশ্য সব কিছু এবং মন্দতার উপর যীশুর ক্ষমতা আছে।
- যখন যীশু পানির উপরে হাঁটেন (মার্ক ৬:৪৫-৫৬) অথবা হাজার হাজার লোকদের খাওয়ান (মার্ক ৬:৩০-৪৪, মার্ক ৮:১-১০) তিনি প্রকৃতির উপরে তার অদ্ভুত ক্ষমতা দেখান, এমন কি তিনি সৃষ্টিকর্তার মত আচরণ করেন।
- যীশুই বিশ্রামবারের কর্তা (মার্ক ২: ২৮)। তাঁরই ক্ষমা করার অধিকার আছে (মার্ক ২:১-১২)। তিনিই অধিকারের সঙ্গে শিক্ষা দিতেন (মার্ক ১:২১ -২২, মার্ক ১:৩৯)।
- যীশু যায়ীরের মৃত মেয়েকে পুনরায় জীবন দান করেন (মার্ক ৫:২১-৪৩) এবং তিনি ফলহীন ডুমুর গাছ থেকে জীবন তুলে নেন (মার্ক ১১:১৪, মার্ক ১১:২০-২১)। যীশুরই জীবন এবং মৃত্যুর উপরে ক্ষমতা আছে। রূপান্তরে মার্ক দেখান যে যীশু সাধারণ মানুষ মাত্র নন। তা ছাড়া তিনি দেখান যে মৃতরা মৃত নয়, মৃত্যুর পরের অনন্ত জীবন বাস্তব (মার্ক ৯:২-৮)। এভাবে একের পরে এক আশ্চর্য কাজ দেখিয়ে সমস্ত সন্দেহ দূর করেন যে যীশুই ঈশ্বর এবং যীশুই সর্বশক্তিমান ।
যীশু তাঁর ক্ষমতা ভালবাসা, সেবা ও উদ্ধার করার উদ্দেশ্য ব্যবহার করেন
- মার্ক তার সুসমাচারে বার বার দেখান যে ”মনুষ্যপুত্র সেবা পেতে আসেন নি বরং সেবা করতে এসেছেন এবং অনেক লোকের মুক্তির মূল্য হিসাবে তাদের প্রাণের পরিবর্তে নিজের প্রাণ দিতে এসেছেন” (মার্ক ১০:৪৫)।
- যীশু স্বার্থহীনভাবে মানুষদের সেবা করেন: তিনি লোকদের ভালবাসার মনোভাবে স্পর্শ করেন, তাদের স্পর্শ গ্রহণ করেন (মার্ক ৫:২৫-৩৪), এমন কি যখন ভীড়ের জন্য চাপাচাপি হয় (মার্ক ৩:৯-১০) এবং যখন খাবার খাওয়ার সুযোগ আর পেলেন না (মার্ক ৩:২০)।
- তিনি অনবরত লোকদের দয়া দেখান, তাদের সঙ্গে কথা বলেন, স্পর্শ করতে থাকেন, সুস্থ ও মুক্ত করেন, উৎসাহ দেন, শিক্ষা দিতে থাকেন ও তাদের চ্যালেঞ্জ করেন।
অবশেষে তিনি যিরূশালেমে যাওয়া দ্বারা তার ভালবাসা প্রমাণ করেন যদিও সেখানে কি ঘটবে তিনি তা ভালই জানেন (মার্ক ৮:১২-২৩, ৯:৩০-৩২, ১০:৩২-৩৪)। - বিরুদ্ধীয় লোক তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবে জেনেও তিনি স্বেচ্ছায় ফাঁদে পড়তে রাজী হন। তিনি তাদের খুশি করার জন্য বা বিপদ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেন না বরং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের সাবধানবাণী ও সত্য কথা বলতে থাকেন (মার্ক ১২:১-১৭)।
- গেৎশিমানী বাগানে যখন তিনি বুঝতে পারেন যে ক্রুশ ছাড়া পরিত্রাণ আনা সম্ভব হবে না (মার্ক ১৪:৩২-৪২) তিনি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন (মার্ক ১৪:৪৯) এবং বিচারের সময় নিজেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টাও করেন না (মার্ক ১৫:৫)। তিনি স্বেচ্ছায় মিথ্যার দ্বারা অভিযোগ, মৃত্যুদণ্ড, সেনাদের দ্বারা যন্ত্রণা এবং অবশেষে ক্রুশীয় মৃত্যুও মেনে নেন।
যীশু যেমন, তার অনুসরণকারীও তেমন
- মার্ক তার পাঠকদের দেখান যে যীশুর ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল, তা তাঁর অনুসরণকারীদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে।
- তিনি দেখান যে যীশু এবং অত্যাচারিত রোমীয়দের সাথে যথেষ্ট মিল আছে ।
- যীশু এবং রোমীয় মণ্ডলীকে রোম সরকার অত্যাচার করে, উভয়কে মিথ্যা অভিযোগ দ্বারা দোষী বানানো হয়, “বুনো জন্তুর” মুখে পড়তে হয় (মার্ক ১:১৩), উভয়ের পরিবারের সদস্যরা তাদের না বুঝে চাপ দেয়, (হতে পারে) কাছের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার সম্মুখীন হতে হয় এবং উভয়েই নিজেরা নিজেদেরকে কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ একা খুঁজে পান।
- মার্ক তার রোমীয় পাঠকদের দেখান যে এমন না যে ঈশ্বর তাদের শাস্তি দেন বা তাদের ত্যাগ করেছেন বরং কষ্টভোগ হল বিশ্বাসীর জীবনের একটি সাধারণ অংশ । এভাবে তিনি তাদের সান্ত্বনা ও স্থিরতা দান করেন।
- মার্ক কেন বাপ্তিস্মদাতা যোহনের মৃত্যুর গল্পের বিস্তারিত বর্ণনা করেন? কারণ ধার্মিক হয়েও যোহনকে একটি হিংস্র ও জঘন্য মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল, যা রোমীয় বিশ্বাসীদের মৃত্যুর সঙ্গে অনেক মিল আছে (মার্ক ৬:১৪-২৯)। অন্য সুসমাচারের লেখকেরা যোহনের মৃত্যুর গল্প উল্লেখ করেন না বা বিস্তারিত বর্ণনা করেন না । এতে বুঝা যায় যে মার্ক বিশেষভাবে রোমীয় পাঠকদের মনে রেখে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
- যীশু বলেছেন: “যদি কেউ আমার পথে আসতে চায় তবে সে নিজের ইচ্ছামত না চলুক; নিজের ক্রুশ বয়ে নিয়ে সে আমার পিছনে আসুক। যে কেউ তার নিজের জন্য বেঁচে থাকতে চায় সে তার সত্যিকারের জীবন হারাবে’ কিন্তু যে কেউ আমার জন্য এবং ঈশ্বরের দেওয়া সুখবরের জন্য তার প্রাণ হারায়, সে তার সত্যিকারের জীবন রক্ষা করবে” (মার্ক ৮:৩৪-৩৫)। এই পদগুলো হল মার্ক সুসমাচারের ঠিক মাঝখানের ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ। মার্ক যীশুর কথার দ্বারা রোমীয় বিশ্বাসীদের মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বস্ত হতে উৎসাহিত করেন।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।