যোহন তার সুখবর লেখেন এটা প্রমাণ করার জন্য যে যীশুই যিহূদীদের প্রত্যাশিত মশীহ, ঈশ্বরের পুত্র, যিনি সবার কাছে পিতা ঈশ্বরকে প্রকাশিত করেন। যতজন এই মশীহের উপর বিশ্বাস রাখে ততজনই অনন্ত জীবন পায়।
সিবদিয়ের ছেলে অর্থাৎ যাকোবের ভাই যোহন হলেন বারোজন শিষ্যদের মধ্যে একজন যিনি যোহন লিখিত সুসমাচারটি লেখেন যখন অন্য তিনটি সুসমাচার ইতিমধ্যে লেখা হয়েছিল ও ছড়িয়ে পড়েছিল। যীশুর জীবনের বেশ কিছু ঘটনা যা অন্যান্য সুসমাচারে বর্ণনা করা হয়েছে, যোহন তা আর উল্লেখ করেন না, যেমন: যীশুর জন্ম, বাপ্তিস্ম, প্রলোভন, রূপান্তর, প্রভুর ভোজ, গেৎশিমানী বাগানে প্রার্থনা ও স্বর্গারোহন। বরং তিনি যীশুর সঙ্গে বেশ কয়েকজন লোকদের ব্যক্তিগত দেখা ও আলোচনা বর্ণনা করেন, যেমন: কূয়ায় শমরীয় মহিলার সঙ্গে বা নীকদীমের সঙ্গে কথা। এছাড়াও যোহন আরো কিছু ঘটনা উল্লেখ করেন যা অন্যান্য সুসমাচারগুলোতে উল্লিখিত হয় নি, যেমন: কান্না গ্রামের বিয়ের ঘটনা, শিষ্যদের পা ধোয়ানো বা বৈথনিয়ায় লাসারকে মৃত্যু থেকে জীবন দান।
হতে পারে যোহন এমন একটি সময়ে এই সুখবরটি লেখেন যখন মথি, লূক ও মার্ক ইতিমধ্যে শহীদ মৃত্যু গ্রহণ করেছেন। রোমীয়রা যিরূশালেম শহর ধ্বংস করেছে (৭০ খ্রীঃ) এবং যিহূদীদের প্রতিজ্ঞাত দেশ জোর করে লোকশূন্য করে দিয়েছে। মণ্ডলীর ইতিহাস বলে যে যিরূশালেমের ধ্বংসের পরে যোহন এশিয়া মাইনর প্রদেশের ইফিষ শহরে বাস করতে লাগলেন এবং সেখানে অনেক বয়স পর্যন্ত কাজ করেছিলেন (৯৮ খ্রীঃ)। কমবেশি ৪৮ খ্রীষ্টাব্দে এশিয়া মাইনরে মণ্ডলী স্থাপন হয় ও খুব বৃদ্ধি পেয়ে দশকের পর দশক ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ মণ্ডলীগুলো হল যিহূদী-অযিহূদী মিশানো মণ্ডলী।
এই সময়ে বিভিন্ন ধরণের ভ্রান্ত শিক্ষা মণ্ডলীকে প্রভাবিত করতে শুরু করে, বিশেষভাবে নস্টিক (gnostic) শিক্ষা। নস্তিসিসম (gnosticism) হল – বিভিন্ন ধর্ম থেকে অবদান নিয়ে একটি মিশানো একটি শিক্ষা যা দশকের পর দশক, এমন কি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মণ্ডলীকে চ্যালেঞ্জ করত। যোহন তার সব পুস্তক (যোহন সুসমাচার, চিঠিগুলো ও প্রকাশিত বাক্য) এবং মণ্ডলীর আদিপিতাদের মধ্যে অনেকে এই নস্টিসিসমের বিরুদ্ধে লিখেছেন।
নস্টিসিসম দাবি করে – কিছু মানুষের মধ্যে ঐশ্বরিক একটি রশ্মি থাকে এবং জ্ঞান ও আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ দ্বারা সেই মানুষগুলো আলোকিত বা ‘নস্টিক’ হয়ে উঠতে পারে। তাই নস্টিসিসম ছিল একটি শিক্ষা যাতে অধিকাংশ লোকদের জন্য আশা নেই, মাত্র কিছু উঁচু ধরণের বিশেষ ব্যক্তিরা আত্মিক বা ঐশ্বরিক হতে পারে। নস্টিসিসমে সব কিছু বিশেষ জ্ঞান লাভের উপর নির্ভর করে: ‘নসিস’ (gnosis) হল একটি গ্রীক শব্দ যার অর্থ হল ‘জ্ঞান’। আবার নস্টিসিসম দাবি করে – কিছু ঐশ্বরিক রশ্মিগুলো জগতের মধ্যে ও মানুষের দেহের মধ্যে আটকিয়ে পড়েছে। এছাড়া নস্টিসিসম দাবি করে যে – বস্তু জগত ও মানুষের শরীর মন্দ, শুধুমাত্র আত্মাই ভাল। এই দ্বিখণ্ডিত চিন্তা থেকে নস্টিকরা দুই ধরণের উপসংহারে আসে: সন্ন্যাসী জীবন অথবা উদারনৈতিক জীবন (‘যা চাই তাই করা’)। সন্ন্যাস: আত্মিক হতে হলে নিজের দেহকে বিভিন্ন কষ্টদায়ক কাজ দ্বারা বশে আনতে হবে (নস্টিক চিন্তা অনুসারে – শরীর মন্দ)। উদারনীতি: আত্মাই ঐশ্বরিক বা শুচি, শরীর আত্মাকে দূষিত করতে পারে না। তাই শরীর দিয়ে যা করি তা আত্মার উপরে কোন প্রভাব ফেলে না, অর্থাৎ শরীরে যা করি না কেন তা পাপ হয় না। ফলে নস্টিকেরা মনে করে তাদের জন্য যে কোন ব্যবহার অনুমোদিত।
নস্টিক চিন্তা অনুসারে ঈশ্বরের সঙ্গে সহভাগিতা অনুতাপ, ক্ষমা, বাধ্যতা বা পবিত্রভাবে জীবন-যাপনের উপর নির্ভর করে না। নস্টিসিসমে সব কিছু ভাগ করা হয় বা আলাদা বিষয় মনে করা হয়, যেমন: ঐশ্বরিক আত্মা ও শরীর আলাদা, জ্ঞান ও দৈনন্দিন জীবনে জ্ঞানের প্রয়োগ আলাদা, আত্মিক হওয়া ও নৈতিকতা আলাদা। নস্টিসিসমে অহংকার ও উঁচু-নীচু ভাব উৎসাহিত, অন্যদের জন্য আশা বা তাদের প্রতি সেবা নিরুৎসাহিত।
নস্টিসিসম যীশুকে কি চোখে দেখে? নস্টিসিসম বলে যে খ্রীষ্ট ছিল ঈশ্বরের একটি ভাল আত্মা (বা রশ্মি) যা বিশেষ মানুষের কাছে প্রকাশ দেওয়ার জন্য পৃথিবীতে এসেছে। খ্রীষ্ট নামে সেই আত্মা বাপ্তিস্মের সময় যীশু নামে একজন লোকের উপর এসে কিছুক্ষণ ছিল। কিন্তু আত্মা নিজেকে দূষিত করতে পারে না বলে যীশুর কষ্টভোগ ও মৃত্যুর আগে সেই আত্মা তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। যীশু মানুষ হয়েছেন, ক্রুশে মারা গেছেন, পুনরুত্থিত হয়েছেন এবং একটি সার্বিক উদ্ধার ঘটানোর জন্য ফিরে আসবেন যা নস্টিক চিন্তা অনুসারে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এই ভ্রান্ত শিক্ষার বিরুদ্ধে যোহন তার সুসমাচারে দাবি করেন যে যীশু উভয় সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বর এবং সম্পূর্ণভাবে মানুষ। যীশুই ঈশ্বর: তিনি ঈশ্বরের বাক্য (যোহন ১:১), তিনিই ঈশ্বরের পুত্র (যোহন ১:১৮), মশীহ (যোহন ৪:২৬) ও পুনরুত্থান (যোহন ১১:২৫)। তিনিই ঈশ্বর থেকে আসা সে জীবন, সত্য ও পিতার কাছে যাওয়ার পথ (যোহন ১৪:৬)। যীশুকে জানা মানেই পিতা ঈশ্বরকে জানা (যোহন ১৪:৭) এবং যীশুকে দেখা মানেই পিতা ঈশ্বরকে দেখা (যোহন ১৪:৯)।
যোহন একইভাবে জোরের সঙ্গে দাবি করেন যে যীশু সম্পূর্ণভাবে মানুষ: তিনি “মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন” (বা “মাংসে মূর্তিমান হইলেন”) এবং আমাদের মধ্যে বাস করেছেন (যোহন ১:১৪)। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষ, তাঁর আবেগ (যোহন ১১:৩৩) ও শারীরিক দুর্বলতা থাকত (যোহন ৪:৬)। নস্টিকেরা দাবি করত যে যীশু শুধুমাত্র আত্মা এবং তার পায়ের ছাপ মাটিতে পড়ত না। যোহন এর বিরুদ্ধে ব্যভিচারিণীর গল্পে প্রমাণ করেন যে যীশু আঙ্গুল দিয়ে মাটিতে লেখেন অর্থাৎ তাঁর আঙ্গুলের ছাপ পড়ছে (যোহন ৮:৮)। তিনি আরো দেখান যে মৃত্যুর শেষ পর্যন্ত যীশুর আত্মা তাঁর সঙ্গেই ছিল “তিনি মাথা নিচু করে তাঁর আত্মা সমর্পণ করলেন” (যোহন ১৯:৩০)। ঈশ্বর যীশুকে শারীরিকভাবে পুনরুত্থিত করেছেন – থোমার কাছে যীশুর এই কথা দ্বারা যোহন তা প্রমাণ করেন “তোমার আঙ্গুল এখানে দিয়ে আমার হাত দু’খানা দেখ এবং তোমার হাত বাড়িয়ে আমার পাঁজরে রাখ” (যোহন ২০:২৭)।
যোহন দেখান যে যীশুতে বিশ্বাস করার মধ্য দিয়েই আমরা জীবন, “অনন্ত জীবন” বা “পরিপূর্ণ জীবন” পাই – যতজন চাইবে তা পাবে (যোহন ৩:১৫, ১০:১০, ১৭:৩)।
যোহন লিখিত সুসমাচার এবং অন্য তিনটি সুসমাচারের মধ্যে ভিন্নতা
গল্প বা বাণীর ক্ষেত্রে হোক বা পু্স্তকের কাঠামোর ক্ষেত্রে হোক – মথি, মার্ক ও লূক লিখিত সুসমাচারগুলোর মধ্যে বেশ মিল আছে। এজন্য এই তিনটি সুসমাচারকে বলা হয় “সিনপ্টিক” সুসমাচার, অর্থাৎ “দেখতে একই রকম”। সিনপ্টিক সুসমাচারগুলো কমবেশি ভৌগলিকভাবে সাজানো – যীশুর পরিচর্যা গালীলে শুরু, এর পরে তিনি শমরিয়া হয়ে যিরূশালেমে গিয়ে পরিচর্যা করেন। কিন্তু যোহন লিখিত সুসমচারের অধিকাংশ ঘটনাগুলো যিহূদিয়া ও যিরূশালেমে ঘটে।
তা ছাড়া সিনপ্টিক সুসমাচারগুলো কমবেশি সময় অনুসারে সাজানো এবং মনে করা যায় উল্লিখিত ঘটনাগুলো এক বছরের মধ্যেই ঘটেছিল। কিন্তু যোহন যীশুর পরিচর্যার সময়ে তিনটি নিস্তার বা উদ্ধার-পর্ব উল্লেখ করেন। তাই সারাংশে আসা যায় যে যীশু কম পক্ষে তিন বছর ধরে পরিচর্যা করেছিলেন।
যোহন তার সুসমাচারে যা উল্লেখ করেন না
তিনটি সিনপ্টিক সুসমাচারে প্রায় একই ঘটনাগুলো বর্ণনা করা হয়, অনেক বার একই কথা দিয়েও বর্ণনা করা হয়। যোহন লিখিত সুসমাচার তার চেয়ে অনেক ভিন্ন, তিনি অনেক পরিচিত ঘটনা না বলে বরং ভিন্ন ঘটনাগুলো উল্লেখ করেন। অবাক লাগার বিষয় হল – যোহন তার সুসমাচরে যীশুর একটাও দৃষ্টান্ত দেন না, একটাও মন্দ আত্মা তাড়ানো গল্পও দেন না। যীশুর জীবনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও তিনি বাদ দেন, যেমন:
- যীশুর জন্ম যোহন তা রূপকভাবে উল্লেখ করেন (যোহন ১:১৪) কিন্তু জন্মের নির্দিষ্ট বর্ণনা করেন না। বরং যীশুর ঈশ্বরত্ব, যিনি অনন্তকাল আগে থেকেই আছেন এবং সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যিনি জীবনের উৎস – যোহন তা বর্ণনা করেন।
- যীশুর বাপ্তিস্ম যোহন যীশুর বাপ্তিস্ম সরাসরি উল্লেখ করেন নি (যোহন ১:৩২-৩৩)। হয়তো এর কারণ হল – সুসমাচার লেখার সময় দুইটি প্রচলিত ভ্রান্ত শিক্ষা (নস্টিসিস্ম্ এবং ডোসিটিসিস্ম) যীশুর বাপ্তিস্মের বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা করত (যে যীশু সাধারণ মানুষ যার উপরে বাপ্তিস্মের সময়ে খ্রীষ্ট-আত্মা নেমে আসেন)।
- যীশুর প্রলোভন যদিও যোহন যীশুর প্রলোভন সরাসরি উল্লেখ করেন না তবুও যোহন ১২:৩১ ও ১৬:১১ পদ তা সম্বন্ধীয়।
- যীশুর রূপান্তর যোহন যীশুর রূপান্তর উল্লেখ করেন না কিন্তু তিনি যীশুর মহিমা এবং যীশু আলো-স্বরূপ (রূপান্তরের সমান্তরাল) এর উপর গুরুত্ব দেন।
- প্রভুর ভোজ যোহন ১৩ ও ১৪ অধ্যায়ের মাঝখানের ঘটনা হল প্রভুর ভোজ, যোহন তা উল্লেখ করেন না। কিন্তু যোহন ৬ অধ্যায়ে যীশু বলেন যে “তার মাংস খেতে ও তার রক্ত পান করতে হবে”, যা প্রভুর ভোজের মত কথা।
- গেৎশিমানী যোহন গেৎশিমানী বাগানে যীশুর প্রার্থনা উল্লেখ করেন না, কিন্তু তিনি নানা জায়গায় দেখান যে যীশু ক্ষ্টভোগ এবং স্বর্গস্থ পিতার ইচ্ছায় সমর্পিত একটি জীবন করছেন (যোহন ৪:৩৪, ৫:৩০, ৬:৩৮, ৮:২৯, ১১:৩৩, ১২:২৩, ১৭:৪)।
- স্বর্গারোহন উভয় মথি ও যোহন তা উল্লেখ করেন না, কিন্তু যোহন ৬:৬২ এবং ২১:২২ পদে যোহন তা অসরাসরিভাবে উল্লেখ করেন। যোহনের দ্বারা লিখিত আর একটি পুস্তকে (প্রকাশিত বাক্য) কয়েক বার বলা হয় যে যীশু স্বর্গে উঠেছিলেন এবং ঈশ্বরের সিংহাসনের ডান পাশে বসেছেন।
যোহন লিখিত সুসমাচারের প্রধান বিষয়
অপর দিকে, যোহন তার সুসমাচারে অনেক ঘটনা বর্ণনা করেন যা তিনটি সিনপ্টিক সুসমাচারে নেই, বিশেষভাবে লোকদের সঙ্গে যীশুর ব্যক্তিগত আলোচনা বা তাদেরকে শিক্ষা দান। যোহন লিখিত সুসমাচারে মোট ২৭টি ‘ব্যক্তিগত আলোচনা’ উল্লিখিত, যাতে বুঝা যায় যে যোহন ব্যক্তিকে গুরুত্ব দেন। যীশুর ব্যক্তিগত আলোচনাগুলো যা অন্য সুসমাচারে নেই তা হল: পিতর, ফিলিপ ও নথনেলের সাথে যীশুর প্রথম দেখা (যোহন ১:৩৫-৫১), কান্না গ্রামের বিয়ের অনুষ্ঠান (যোহন ২:১-১১), নীকদীমের সঙ্গে যীশুর আলোচনা (যোহন ৩:১-২১) যিনি পরবর্তীতে যীশুকে সমর্থন করতে চেষ্টা করেন (যোহন ৭:৫০) এবং যীশুকে কবর দেওয়ার জন্য গন্ধরস ও অগুরু কিনেন (যোহন ১৯:৩৯), শমরিয় মহিলার সঙ্গে যীশুর আলোচনা (যোহন ৪), মৃত লাসারকে জীবিত করে তোলার সময়ে আলোচনা (যোহন ১১) এবং শিষ্যদের পা ধোয়ানোর সময় তাদের সঙ্গে আলোচনা (যোহন ১৩)।
এছাড়া যোহন লিখিত সুসমাচারে কিছু মূল কথা আছে, যা অন্যান্য সুসমাচারেও উল্লিখিত, তবে এই সুসমাচারেও সেগুলো বেশি গুরুত্ব পায়, যেমন: জীবন, অনন্ত জীবন, আলো, অন্ধকার, বিশ্বাস ও বিশ্বাস করা (এগুলো অন্যান্য সুসমাচারগুলোর চেয়ে যোহন লিখিত সুসমাচারে দ্বিগুণ পুনরুক্তি হয়েছে), জগত, ‘আমার মধ্যে থাক’, সাক্ষী হওয়া, সাক্ষ্য দান, সত্য, মহিমা, মহিমান্বিত হওয়া, যীশু ঈশ্বর থেকে পাঠানো, যীশুই “বাক্য” (গ্রীক শব্দ “লোগোস” logos), ইত্যাদি।
এছাড়াও যোহন লিখিত সুসমাচারে কিছু বিশেষ রূপক বা ছবি পাওয়া যায়, যেমন: যীশুর দেহকে “ঈশ্বরের ঘর” বলা হয় (যোহন ২:১৯), “ঈশ্বরের ঘর আপনারা ভেংগে ফেলুন, তিন দিনের মধ্যে আবার আমি তা উঠাব”, সে কথা যা দ্বারা মামলার সময় যীশুর দোষের প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। “নতুন জন্ম” (যোহন ৩:৩), পবিত্র আত্মার বর্ণনা করার জন্য “বাতাস” (যোহন ৩:৮); বাপ্তিস্মদাতা যোহনের কথা “বর ও কনে” (যোহন ৩:২৯), বাপ্তিস্মদাতা যোহনকে বুঝানোর জন্য “জ্বলন্ত বাতি” (যোহন ৫:৩৫); “জীবন-রুটি” (যোহন ৬:৩৫), পবিত্র আত্মাকে বুঝানোর জন্য “জীবন্ত জল” (যোহন ৭:৩৭-৩৮); “রাত” ও “দিন” (যোহন ৯:৪) এবং যীশুকে বর্ণনা করার জন্য “মেষপালক” (যোহন ১০:১-১৮), “দরজা” (যোহন ১০:৭-৯) ও “আঙ্গুর গাছ” (যোহন ১৫:১-৭)।
যোহন লিখিত সুসমাচারের লেখক
অন্যান্য সুসমাচারগুলোর লেখকদের মত যোহনও তার সুসমাচারে নিজের নাম সরাসরি উল্লেখ করেন না। অন্য দিকে পরবর্তীতে লিখিত ভ্রান্ত সুসমাচারগুলোর লেখকেরা কোন প্রেরিতের নাম দাবি করে নিজেরা ভ্রান্ত সুসমাচার লিখত (যেমন “থোমার সুসমাচার”) যেন তাদের লেখার গুরুত্ব বাড়ে। যোহন লিখিত সুসমাচারে যখন বাপ্তিস্মদাতা যোহনকে বুঝানো হয় তখন তাকে শুধুমাত্র “যোহন” বলা হয়, “বাপ্তিস্মদাতা” হিসাবে চিহ্নিত রাখা হয় না। লেখক যোহন যখন তার সুসমাচারে নিজেকে চিহ্নিত রাখতে চান তখন তিনি নিজের নাম উল্লেখ করেন না বরং তিনি বলেন “যে শিষ্যকে যীশু ভালবাসতেন” (যোহন ১৩:২৩, ১৯:২৬, ২০:২, ২১:২০); “সিবদিয়ের ছেলেরা” (যোহন ২১:২), যোহনের “দু’জন শিষ্য” (যোহন ১:৩৫, ১:৩৭), “আর একজন শিষ্য” (যোহন ১৮:১৫), “সেই অন্য শিষ্য” (যোহন ১৮:১৬, ২০:২, ২০:৪) এবং “সেই শিষ্য” (যোহন ১৮:১৫, ২১:২৩, ২১:২৪)।
এ সুসমাচারের শেষে লেখক নিজেকে আরো প্রকাশিত করেন: “সেই শিষ্য, যিনি খাবার সময়ে যীশুর দিকে ঝুঁকে বলেছিলেন … সেই শিষ্যই এই সব বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন আর এই সব লিখেছেন” (যোহন ২১:২০,২৪, যোহন ১৩:২৩-২৫)। অর্থাৎ লেখক ছিলেন যীশুর ক্রুশীয় মৃত্যুর চোখের সাক্ষী ছিলেন: “যিনি নিজের চোখে এটা দেখেছিলেন তিনিই সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, আর তাঁর সাক্ষ্য সত্যি। তিনি জানেন যে, তিনি যা বলছেন তা সত্যি” (যোহন ১৯:৩৫)। যখন যীশু তাঁর পুনরুত্থানের পরে গালীলে শিষ্যদের কাছে নিজেকে প্রকাশিত করেছিলেন, সেই সময় শিষ্যদের মধ্যে লেখক উপস্থিত ছিলেন। আবার যখন উপস্থিত শিষ্যদের নাম দেওয়া হয়, যোহন অন্তর্ভুক্ত: উপস্থিত ছিলেন শিমোন-পিতর, থোমা, নথনেল, সিবদিয়ের ছেলেরা (যাকোব ও যোহন) এবং আর দুইজন শিষ্য যাদের নাম উল্লেখ নেই (যোহন ২১:২)।
যোহন ছিলেন একমাত্র শিষ্য যিনি বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। বারোজন শিষ্যদের মধ্যে তার ভাই যাকোব হলেনপ্রথম শিষ্য যিনি শহীদ মৃত্যু গ্রহণ করেন। মণ্ডলীর ইতিহাস অনুসারে জানা যায় যে বারোজন শিষ্যদের মধ্যে শুধুমাত্র যোহন শহীদ মৃত্য গ্রহণ করেন নি যদিও তাকে অনেক বার যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছিল এবং কয়েক বার মেরে ফলার প্রচেষ্টাও করা হয়েছিল (বীষ খাওয়ানো, তেলে সিদ্ধ করা)। হতে পারে তিনি বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকার কারণে গুজব-গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল যে তিনি কখনও মারা যাবেন না। এই মিথ্যা গুজব-গল্প ভাঙ্গার জন্য যোহন তার সুসমাচারের শেষে সেই গল্প উল্লেখ করেন যে যীশু কখনও বলেন নি যে যোহন মারা যাবেন না। যোহনের মৃত্যু যখন ঘটবে যেন বিশ্বাসীদের মন অস্থির হয়ে না যায় – এজন্য যোহন বিষয়টি তার সুসমাচারে সংশোধন করেন (যোহন ২১:২২-২৩)।
যোহন লিখিত সুসমাচার পড়লে বুঝা যায় যে তা একজন চোখের সাক্ষীর দ্বারা লেখা হয়েছে। যোহন লিখিত সুসমাচারে অনেক খুটিঁনাটি বিষয় পাওয়া যায় যা সিনপ্টিক সুসমাচারগুলোতে উল্লেখ নেই, যেমন: শিষ্যদের আহ্বানের সময় পর পর চার দিনের বর্ণনা (যোহন ১), কান্না গ্রামের বিয়ের অনুষ্ঠানে পাথরের ছয়টা জালা যার প্রত্যেকটাতে কমবেশ পঁয়তাল্লিশ লিটার করে জল ধরত (যোহন ২:৬), কত দূর নৌকা বয়ে গেল (যোহন ৬:১৯), যীশুকে অভিষিক্ত করার সুগন্ধির আতরের ওজন ও দাম (যোহন ১২:৩), ক্রুশের উপরে যীশুকে খোঁচা মারার সময় রক্ত আর জল (যোহন ১৯:৩৪) এবং ধরা মাছ ধরার সংখ্যা (যোহন ২১:১১)।
সিবদিয়ের ছেলেরা অর্থাৎ যোহন ও তার বড় ভাই যাকোব হলেন সে মাথা গরম শিষ্যরা যাদের যীশু “বোয়ানের্গিস” বলেন, “বজ্রধ্বনির পুত্রেরা” (মার্ক ৩:১৭)। তারা হলেন সেই দুইজন শিষ্য যারা একটি শমরিয় গ্রামের উপর স্বর্গ থেকে আগুন নামাতে চান কারণ সেই গ্রামের লোকেরা যীশুকে থাকতে দিতে রাজি ছিল না (লূক ৯:৫১-৫৪)। তারা আর একজন ব্যক্তিকে বাধা দিতে চান যেন সেই ব্যক্তি যীশুর নাম ব্যবহার না করে (লূক ৯:৪৯-৫০)। যারা যায়ীরের মেয়েকে পুনরায় জীবিত করে তোলা ও রূপান্তর দেখেন এবং যাদেরকে যীশু গেৎশিমানী বাগানে বিশেষভাবে প্রার্থনা করার জন্য অনুরোধ করেন – যোহন হলেন তাদেরই মধ্যে একজন। যোহন ১৮:১৫ পদে যোহন প্রকাশিত করেন যে তিনি মহাপুরোহিতকে (এবং তার দারোয়ানকে) চিনতেন। এটা একটু অবাক লাগার বিষয় যে কিভাবে গালীলের একজন জেলে মহাপুরোহিতকে জানে। শুধুমাত্র যোহন এই বিষয়টি উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করেছেন যা অন্যান্য সুসমাচারগুলোতে উল্লেখ নেই। যোহন আরো পাঠকদের জানান যে তিনিই একমাত্র শিষ্য যিনি যীশুর মৃত্যুর সময় উপস্থিত ছিলেন (যোহন ১৯:৩৫)।
মণ্ডলীর ইতিহাস অনুসারে যোহন যিরূশালেম ধ্বংসের পরে (৭০ খ্রীঃ) ইফিষ শহরে বাস করতেন এবং ইফিষ মণ্ডলীর প্রাচীনেরা তাকে “খ্রীষ্টের একটি জীবনী” লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। লিয়ন (Lyon) শহরের মণ্ডলীর অধ্যক্ষ ইরেন্যায়াস (Irenaeus) ১৭০ খ্রীষ্টাব্দে তার একটি পুস্তকে লেখেন “প্রভুর শিষ্য যোহন, যিনি যীশুর বুকের কাছেই ছিলেন” তিনিই এশিয়ার ইফিষ শহরে বাস করার সময়ে একটি সুসমাচার লিখেছিলেন। ইরেন্যায়াস ছিলেন পলিকার্প নামে একজনের শিষ্য। পলিকার্প ছিলেন স্মূর্ণার মণ্ডলীর অধ্যক্ষ এবং যোহনের শিষ্য। তাই ইরেন্যাসের কথার গুরুত্ব আছে। ইরেন্যায়াস আরো বলেন যে যোহন বুড়ো বয়স পর্যন্ত ইফিষ শহরে বাস করেছিলেন, এমন কি তিনি রোমীয় সম্রাট ত্রায়ানের সিংহাসন গ্রহণ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। সম্রাট ত্রায়ান ৯৮-১১৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
যেহেতু যোহন তার সুসমাচারে নস্টিসিসম (gnosticism) নামে একটি ভ্রান্ত শিক্ষার বিরুদ্ধেও লেখেন (যা ৫০ খ্রীষ্টাব্দের পরে উঠেছিল), চিন্তা করা হয় যে তিনি ইফিষ শহর থেকে তার জীবনের শেষের দিকে এই সুসমাচারটি লিখেছিলেন, সম্ভবত ৮০-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে।
যোহন সুসমাচারের পাঠকরা
যোহন তার সুসমাচার এশিয়া মাইনর প্রদেশে যিহূদী-অযিহূদী মিশানো মণ্ডলীগুলোর কাছে লেখেন। যোহন তার অযিহূদী পাঠকদের জন্য কিছু যিহূদী শব্দ বা ঐতিহ্যগুলো ব্যাখ্যা করতে প্রয়োজন মনে করেন মার্ক যেমন তার সুসমাচারেও করেন (যোহন ১:৩৮, ১:৪১-৪২, ৪:৯)। তিনটি সিনপ্টিক সুসমাচারের তুলনায় যোহন একটু বেশি দার্শনিক কথা বলেন, যা গ্রীক পাঠকদের জন্য সুবিধা ছিল (যেমন: খ্রীষ্ট হলেন “বাক্য”, “logos”)। কিন্তু যোহন যিহূদীদের জন্যও লেখেন, যেমন: তিনি তার সুসমাচার পুরাতন নিয়মের ভিত্তির উপরে বসান এবং যীশু কিভাবে অনেক ভাববাদীর বাণী পূর্ণ করেছেন তা প্রমাণিত করেন। তার সুসমাচারের প্রারম্ভিকা (যোহন ১:১-১৮) আদিপুস্তক ১ অধ্যায় স্মরণ করায় এবং যীশুর পুনরুক্তি কথা “আমিই…”, “আমি সেই…” যাত্রাপুস্তক ৩ অধ্যায় স্মরণ করিয়ে দেয়। এছাড়া যোহন যিরূশালেম এবং যিরূশালেমে যিহূদীদের নানা পর্বের উপরেও গুরুত্ব দেন।
নস্টিসিসম – একটি ভ্রান্ত শিক্ষা যা দ্বারা মণ্ডলী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন
নস্টিসিসমের (gnosticism) বর্ণনা
নস্টিসিসম হল একটি মিশানো ভ্রান্ত শিক্ষা যা কিছু শতাব্দী ধরে মণ্ডলীকে খুব হয়রানি করছিল। প্রেরিত যোহন এবং মণ্ডলীর বেশ কয়েকজন আদিপিতাদের অধিকাংশ লেখাগুলো ছিল নস্টিসিসমের বিরুদ্ধে লেখা।
গ্রীক শব্দ ‘নসিস’ (gnosis) থেকে ‘নস্টিসিসম’ শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে। নস্টিসিসমের অনুসরণকারীদের বলা হত ‘নস্টিক’ (gnostic)। ‘নসিস’ শব্দের অর্থ হল ‘জ্ঞান’। যদিও নস্টিকদের মধ্যে বিভিন্ন দল ছিল, তাদের সবার এই ক্ষেত্রে মিল ছিল যে তারা জ্ঞানের উপরে খুব গুরুত্ব দিত। তারা ‘জ্ঞান’ বললে বুঝত: ‘গুপ্ত আত্মিক জ্ঞান, যা দ্বারা পরিত্রাণ পাওয়া যায়’।
নস্টিসিসম খুব গুরুত্বের সঙ্গে দাবি করত যে বস্তু জগত ও আত্মিক জগত সম্পূর্ণ আলাদা অর্থাৎ – বস্তু জগত মন্দ এবং আত্মিক জগত ভাল। তাই মানুষ বাস করে একটি দ্বিখন্ডিত বাস্তবতায়।
নস্টিসিসম আবার দাবি করত যে ‘সর্বোচ্চ কর্তা’ বলে কেউ আছেন যিনি সম্পূর্ণ ভাল এবং ‘আত্মা মাত্র’ – তাই খাঁটি আত্মা হিসাবে তিনি এই মন্দ বস্তু জগত থেকে এত দূরে ও এত আলাদা যে তার বস্তু জগতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোন জ্ঞানও নেই। এই কর্তার কোন ব্যক্তিত্ব নেই, তাকে জানা যায় না, চেনাও যায় না। নস্টিক চিন্তায় ‘জানা’ মানে ‘দমন করা’। সর্বোচ্চ কর্তাকে কেউ দমন করতে পারে না বলে কেউ তাকে জানতেও সক্ষম হয় না।
কিন্তু তা যদি হয়, এই বস্তু জগত কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? মন্দ কিভাবে তৈরি হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে নস্টিসিসম একটি খুব জটিল ব্যাখ্যা দেয় – সর্বোচ্চ কর্তা থেকে আত্মিক অগ্নিকণা বা রশ্মির মত কিছু বের হতে থাকে। নস্টিকেরা এই অগ্নিকণাগুলো বা রশ্মিগুলোকে ‘এ্যায়োন’ (aeon) বলে। সব এ্যায়োনদের একসাথে ‘প্লেরোমা’ (pleroma) বলা হত, নস্টিকেরা তা সর্বোচ্চ কর্তার পূর্ণতা হিসাবে মনে করত। নস্টিক চিন্তা অনুসারে এই অগ্নিকণাগুলো ভাল, কিন্তু সর্বোচ্চ কর্তার মত বেশি ভাল নয়, অর্থাৎ খুব খাঁটি রশ্মিগুলোর পাশাপাশি তুলনামূলক কম খাঁটি ধরণের রশ্মিও আছে, এমন কি কিছু মন্দ রশ্মিগুলোও পাওয়া যেত।
নস্টিসিসম বলে যে এই মন্দ রশ্মিগুলোর মধ্যে একজনই সর্বোচ্চ কর্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে দূর্ঘটনায় বস্তু জগত সৃষ্টি করে ফেলেছিল। কিছু নস্টিক শিক্ষক বলত যে বাইবেলের সৃষ্টিকর্তাই সেই মন্দ রশ্মি বা ‘এ্যায়োন’। তাই নস্টিকেরা পুরাতন নিয়ম খুব নিচু চোখে দেখত যদিও তারা নতুন নিয়ম থেকে বিভিন্ন চিন্তা গ্রহণ করত।
নস্টিসিসম আরো বলত যে প্লেরোমার মধ্য থেকে কিছু রশ্মিগুলো মন্দ বস্তুর মধ্যে আটকিয়ে পড়েছিল, এমন কি কিছু মানুষের দেহের মধ্যে আটকিয়ে পড়েছিল। তাই নস্টিসিসম বলে যে তিন ধরণের মানুষ আছে। তা হল:
- নস্টিক মানুষ (gnostic) এদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্তার একটি রশ্মি আছে। তারা ‘আত্মিক’ বা ‘আলোকিত’ এবং তাদের আশা আছে যে – জগতে নানা আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করলে মৃত্যুর সময় তারা পুনরায় জন্ম থেকে মুক্ত হয়ে সর্বোচ্চ কর্তার সঙ্গে আবার এক হতে পারবে।
- সাইকিক মানুষ (psychic) এরা কম উন্নত মানুষ, এদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্তার রশ্মি থাকতেও পারে। এদের আলোকিত হওয়ার আশা আছে কিন্তু নিশ্চয়তা নেই। নস্টিকেরা মনে করত যে খ্রিষ্টানরা সাইকিক দলে পড়ে।
- হাইকিক মানুষ (hychic) এরা বস্তু মানুষ মাত্র, এদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্তার কোন রশ্মি নেই। এরা আলোকিত হতে পারে না। তাই এরা পরিত্রাণ পেতে পারে না বরং ধ্বংসে সমর্পিত।
নস্টিসিসম খ্রিষ্টান ধর্ম থেকে এই চিন্তা গ্রহণ করল যে – সেই সর্বোচ্চ কর্তা একজন উদ্ধারকর্তা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন যার মধ্য দিয়ে সাইকিক বা নস্টিক মানুষ প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়। যাদের মধ্যে একটি ঐশ্বিক রশ্মি আছে, তারা জ্ঞান ও আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করার মধ্য দিয়ে আলোকিত হতে সক্ষম হবে এবং তাদের দেহে আটকানো সে ঐশ্বিক রশ্মি মৃত্যুর সময়ে মুক্ত হয়ে সর্বোচ্চ কর্তার সাথে আবার এক হবে।
তাই নস্টিক চিন্তা অনুসারে পাপ-স্বভাব বা খারাপ আচরণ মানুষের প্রধান সমস্যা নয় বরং মানুষের সমস্যা হল ‘দেহ’ বা ‘বস্তু জগত’। নস্টিসিসম অনুসারে ‘পরিত্রাণ’ মানে না ‘যীশু দ্বারা পাপ থেকে উদ্ধার’ বরং ‘পরিত্রাণ’ মানে হল – মানুষ জ্ঞান লাভের মধ্য দিয়ে তার দেহে সে ঐশ্বিক রশ্মি আলোকিত করতে সক্ষম। এভাবে সে ‘আলোকিত’ বা ‘পরিত্রাণ প্রাপ্ত’ হয়ে যায়।
নস্টিসিসম অনুসারে মানুষের কি প্রয়োজন? মানুষের প্রয়োজন জ্ঞান লাভের মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ প্রকাশ পাওয়া, আলোকিত হওয়া ও আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করা। কে তা পেতে সক্ষম হবে? শুধুমাত্র বিশেষ লোক তা পেতে সক্ষম হবে, সবাই না। তাই নস্টিসিসম ছিল ‘বিশেষ লোকদের গুপ্ত দল’। নস্টিকেরা অন্য মানুষদের আশাহীন বলে বাদ দিত। নস্টিকদের মধ্যে বিভিন্ন দল বা আলোকিত হওয়ার বিভিন্ন স্তর থাকত। ফলে নস্টিসিসমে অনেক উঁচু-নিচু ভাব ও যথেষ্ট অহংকার থাকত।
নস্টিকেরা দাবি করত – যারা আলোকিত স্তরে পৌঁছায় তারা পাপ দ্বারা আর আক্রান্ত নয় বা নিজেকে আর দোষী করতে সক্ষম হয় না। যদি পরিত্রাণ জ্ঞান, আত্মিক অভিজ্ঞতা বা আলোকিত হওয়ার উপর নির্ভর করে তবে তা নৈতিক ব্যবহার ও আচরণের উপর নির্ভর করে না। ফলে নস্টিকেরা নৈতিকতায় বেশি গুরুত্ব দিত না। নস্টিকেরা দাবি করত যে মানুষের দেহ মন্দ এবং মানুষের দেহ ও তার আত্মা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। তাই একজন মানুষের আত্মা একবার আলোকিত হলে তবে সে দেহ দিয়ে কি করে, তাতে কিছু যায় আসে না।
এই দ্বিখন্ডিত চিন্তা থেকে দুই ধরণের শিক্ষা তৈরি হল – একদিকে সন্ন্যাসী চিন্তা (দেহকে দমন করে ও কষ্ট দিয়ে মানুষ বস্তুর উপরে জয়ী হয়) অথবা অন্য দিকে উদারপন্থী চিন্তা (দেহ আত্মাকে দূষিত করতে পারে না, তাই দেহ নিয়ে যা চাই তাই করা যায়)।
যীশু সম্বন্ধে নস্টিসিসমের ব্যাখ্যা
নস্টিসিসম বিশ্বাস করতে পারে না যে ঈশ্বর মানুষ হলেন, কারণ পবিত্র আত্মা বা কোন সর্বোচ্চ কর্তা নিজেকে বস্তু শরীর দিয়ে দূষিত করবে না। তাহলে নস্টিকেরা যীশুর গল্প কিভাবে ব্যাখ্যা করত?
কিছু নস্টিকেরা বলত – যীশু ছিলেন ‘আত্মা মাত্র’ অর্থাৎ এমন একটি আত্মা যিনি নিজেকে ‘মানুষের মত’ প্রকাশ করতেন কিন্তু আসলে তাঁকে স্পর্শ করা যেত না বরং মাটির উপর হাঁটলেও তাঁর পায়ের ছাপ পাওয়া যেত না।
অন্য কিছু নস্টিকেরা দাবি করত – যীশু পবিত্র আত্মা দিয়ে জন্ম নেন নি বরং তিনি মরিয়ম ও যোষেফের সাধারণ সন্তান ছিলেন যদিও তিনি অন্য লোকদের চেয়ে একজন ধার্মিক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। তার বাপ্তিস্মের সময়ে তিনি ‘খ্রীষ্ট’ নামক আত্মা পান। অর্থাৎ খ্রীষ্ট-আত্মা পাওয়া যীশু ছিলেন প্রথম নস্টিক। তিনি এই মন্দ জগতের নন বলে প্রলোভিতও হন না, তিনি আঘাত বা ব্যাথা পান না, তিনি ছিলেন এমন একজন আত্মিক ব্যক্তি যাকে বস্তু জগত স্পর্শ করতে সক্ষম নয়। এই চিন্তাকে ‘ডোসিটিসিসম’ (doceticism) বলা হয়।
যীশুকে ক্রুশে দেওয়ার আগে খ্রীষ্ট-আত্মা তাকে ছেড়ে স্বর্গে চলে যান কারণ একজন আত্মাকে কষ্ট বা লজ্জা দেওয়া সম্ভব না। এই জগত তাঁকে দূষিত করতে পারে না, মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। যীশুর শারীরিক যন্ত্রণা ও ক্রুশে মারা যাওয়ার আগেই খ্রীষ্ট-আত্মা তাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল কারণ কোন আত্মা যন্ত্রণা বা মৃত্যু দিয়ে দূষিত হতে পারে না।
নস্টিসিসম বাইবেলীয় শিক্ষার বিরুদ্ধে
নস্টিসিসম হল একটি বিপজ্জনক ভ্রান্ত শিক্ষা যা মানুষের পাপ সমস্যা মনে করে না। নস্টিসিসমে পাপ স্বীকার, অনুতাপ, ক্ষমা চাওয়া ও জীবনকে পরিবর্তন করার কোন দাবি নেই। পবিত্র জীবন-যাপন, নৈতিক ব্যবহার, স্বার্থহীনতা, সেবা ও ভালবাসার গুরুত্ব নেই। নস্টিকেরা ভাল আচরণ ও চরিত্রের অনুসন্ধানী নয় বরং জ্ঞান, প্রকাশ ও আত্মিক অভিজ্ঞতার অনুসন্ধানী।
নস্টিসিসম অধিকাংশ মানুষকে নীচু চোখে দেখে, নিজেকে বিশেষ মনে করে, পার্থক্য করে ও অন্যদের বাদ দেয়। তাই নস্টিসিসম ‘আলোকিতদের’ অহংকার, স্বার্থপরতা ও অন্যদের নীচু চোখে দেখা উৎসাহিত করে, ‘সাইকিকদের’ (বিশ্বাসীদের) নিজের পরিত্রাণ নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে এবং ‘হাইকিকদের’ (বাকি সব লোকদের) জন্য কোন আশা দেখায় না। তা হল সুসমাচারের ঠিক বিপরীত। সুসমাচার সব জাতিদের জন্য যীশুতে বিশ্বাস দ্বারা আশার বাণী দেয়।
নস্টিসিসম মানুষের সিদ্ধান্ত, সুখবর শুনে সাড়া, মানুষের হৃদয় ও মনোভাব একটাতেও গুরুত্ব দেয় না। বরং কার মধ্যে ঐশ্বিক রশ্মি থাকে, তা নিয়ে ব্যস্ত। ফলে অহংকার, মানুষের মধ্যে পার্থক্য করা ও নিজের জ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত থাকার একটি মনোভাব উৎসাহিত করে। নস্টিসিসম অধিকাংশ লোকদের ‘আলো ছাড়া’, এমন কি ‘আশা ছাড়া’ মনে করে। তাই নস্টিসিসম পরিত্রাণ ও অনন্ত জীবন নিয়ে নিশ্চয়তা নষ্ট করে (কলসীয় পুস্তক দেখুন)।
জ্ঞান, প্রকাশ, বিশেষ আত্মিক অভিজ্ঞতা, আলোকিত হওয়ার অনুসন্ধান, গুপ্ত জ্ঞান, নিজেকে আলাদা মনে করা, তা সব লোকদের প্রতারণার ঝুঁকিতে, এমন কি অনৈতিকতার ঝুঁকিতেও ফেলে।
নস্টিসিসম বিশ্বাস করে না যে – যীশু ঈশ্বর, যিনি মানুষ হিসাবে পৃথিবীতে এসেছেন (কেন একজন খাঁটি আত্মা এই মন্দ বস্তু জগতে নামবে?), যীশু পুনরুত্থিত হয়েছেন (কেন একটি খাঁটি আত্মা নতুন দেহ চাইবে?), যীশুর দ্বিতীয় আগমনে সব সৃষ্টির পুনরুদ্ধার ঘটবে (কেন ঈশ্বর একটি বস্তু জগত পুনরায় স্থাপন করবেন?)।
নস্টিসিসমের মিথ্যা শিক্ষার বিরুদ্ধে যোহন লিখিত সুসমাচারের সংশোধন
এই ভ্রান্ত শিক্ষার বিরুদ্ধে যোহন তার সুসমাচারে দাবি করেন যে যীশু উভয় সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বর এবং সম্পূর্ণভাবে মানুষ। যীশুই ঈশ্বর: তিনি ঈশ্বরের বাক্য (যোহন ১:১), তিনিই ঈশ্বরের পুত্র (যোহন ১:১৮), মশীহ (যোহন ৪:২৬) ও পুনরুত্থান (যোহন ১১:২৫)। তিনিই ঈশ্বর থেকে আসা সে জীবন, সত্য ও পিতার কাছে যাওয়ার পথ (যোহন ১৪:৬)। যীশুকে জানা মানেই পিতা ঈশ্বরকে জানা (যোহন ১৪:৭) এবং যীশুকে দেখা মানেই পিতা ঈশ্বরকে দেখা (যোহন ১৪:৯)।
যোহন একইভাবে জোরের সঙ্গে দাবি করেন যে যীশু সম্পূর্ণভাবে মানুষ: তিনি “মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন” (বা “মাংসে মূর্তিমান হইলেন”) এবং আমাদের মধ্যে বাস করেছেন (যোহন ১:১৪)। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষ, তাঁর আবেগ (যোহন ১১:৩৩) ও শারীরিক দুর্বলতা থাকত (যোহন ৪:৬)। নস্টিকেরা দাবি করত যে যীশু শুধুমাত্র আত্মা এবং তার পায়ের ছাপ মাটিতে পড়ত না। যোহন এর বিরুদ্ধে ব্যভিচারিণীর গল্পে প্রমাণ করেন যে যীশু আঙ্গুল দিয়ে মাটিতে লেখেন অর্থাৎ তাঁর আঙ্গুলের ছাপ পড়ছে (যোহন ৮:৮)। তিনি আরো দেখান যে মৃত্যুর শেষ পর্যন্ত যীশুর আত্মা তাঁর সঙ্গেই ছিল “তিনি মাথা নিচু করে তাঁর আত্মা সমর্পণ করলেন” (যোহন ১৯:৩০)। ঈশ্বর যীশুকে শারীরিকভাবে পুনরুত্থিত করেছেন – থোমার কাছে যীশুর এই কথা দ্বারা যোহন তা প্রমাণ করেন “তোমার আঙ্গুল এখানে দিয়ে আমার হাত দু’খানা দেখ এবং তোমার হাত বাড়িয়ে আমার পাঁজরে রাখ” (যোহন ২০:২৭)।
যোহন লিখিত সুসমাচারের কাঠামো
তিনটি সিনপ্টিক সুসমাচারগুলো (মথি, মার্ক, লূক) কমবেশি সময় অনুসারে সাজানো কিন্তু যোহন লিখিত সুসাচার বেশ ভিন্ন – যোহন তার লেখাটি যীশুর যিহূদী-পর্বে অংশ গ্রহণ অনুসারে সাজান। তা ছাড়া যীশু ৭টি চিহ্ন করেন। যোহন আশ্চর্য কাজের পরিবর্তে “চিহ্ন” শব্দ ব্যবহার করেন। তিনি এভাবে করেন দেখানোর জন্য যে – এই আশ্চর্য কাজগুলোর মাধ্যমে যীশু নির্দিষ্ট কিছু সংবাদ দিতে চান।
- ১ম চিহ্ন কান্নায় বিবাহ অনুষ্ঠানে জল থেকে দ্রাক্ষারস যোহন ২:১-১১
- ২য় চিহ্ন রাজকর্মচারীর ছেলেকে সুস্থতা দান যোহন ৪:৪৬-৫৪
- ৩য় চিহ্ন বিশ্রাম বারে পঙ্গুকে সুস্থতা দান যোহন ৫:১-১৮
- ৪র্থ চিহ্ন পাঁচ হাজার লোকদের খাওয়ানো যোহন ৬:১-১৪
- ৫ম চিহ্ন যীশু জলের উপরে হাঁটেন যোহন ৬:১৬-২১
- ৬ম চিহ্ন অন্ধকে সুস্থতা দান যোহন ৯:১-৪১
- ৭ম চিহ্ন মৃত লাসারকে জীবন দান যোহন ১১:১-৪৪
কেউ কেউ যীশুর জলের উপরে হাঁটাকে না গুনে এর পরিবর্তে যীশুর পুরুত্থান ৭ম চিহ্ন হিসাবে গুনে।
এছাড়া যীশু ৭ বার বলেন “আমিই …”:
- ১ম যোহন ৬:৪৮ “আমিই জীবন রূটি”
- ২য় যোহন ৮:১২ “আমিই জগতের আলো”
- ৩য় যোহন ১০:৭ “আমিই ভেড়ার দরজা”
- ৪র্থ যোহন ১০:১১ “আমিই উত্তম মেষপালক”
- ৫ম যোহন ১১:২৫ “আমিই পুনরুত্থান ও জীবন”
- ৬ম যোহন ১৪:৬ “আমিই পথ, সত্য ও জীবন”
- ৭ম যোহন ১৫:১ “আমিই আঙ্গুর গাছ”
যেহেতু যোহনের আর একটি পুস্তকে (প্রকাশিত বাক্য) ৭ নম্বর অনেক গুরুত্ব পায় এজন্যই অনেকে চিন্তা করে যে যোহন তার সুসমাচার প্রকাশিত বাক্য লেখার পরে লিখেছিলেন।
সুসমাচার লেখার জন্য যোহনের উদ্দেশ্য
যোহন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেন তিনি কেন তার সুসমাচার লিখেছিলেন: “কিন্তু এই সব (চিহ্ন) লেখা হল যাতে তোমরা বিশ্বাস কর যে, যীশুই মশীহ, ঈশ্বরের পুত্র, আর বিশ্বাস করে যেন তাঁর মধ্য দিয়ে জীবন পাও” (যোহন ২০:৩১)। যীশুই মশীহ। যীশুই ঈশ্বর। তাঁরই নামে অনন্ত জীবন। তাঁরই উপরে বিশ্বাস রাখা দ্বারা আমরা তাঁর আপন হয়ে যাই।
অধ্যায় অনুসারে যোহন লিখিত সুসমাচার
যোহনের বিখ্যাত প্রারম্ভিকা যোহন ১:১-১৮
মথি ও লূক তাদের সুসমাচার যীশুর জন্মের গল্প দিয়ে শুরু করেন। মার্ক তার সুসমাচার যীশুর পরিচর্যা দিয়ে শুরু করেন। কিন্তু যোহন তার সুসমচারের শুরুতে একেবারে সৃষ্টিতে ফিরে যান – তিনি প্রকাশিত করেন যে যীশুই ঈশ্বর, ত্রিত্ব ঈশ্বরের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি। যীশুই সে বাক্য যাঁর দ্বারা সব কিছু সৃষ্টি হয়েছিল – অস্তিত্ব, আলো, জীবন, সত্য, সৃষ্টি, মহাবিশ্ব, মানুষ, পুত্রত্ব এবং দয়া – সব। বাইবেলের মধ্যে যোহনের এই প্রারম্ভিকায় ত্রিত্ব ঈশ্বরের অত্যন্ত স্পষ্ট শিক্ষা পাওয়া যায়। যোহন দেখান – যে যীশু সম্পূর্ণ ঈশ্বর ছিলেন সেই যীশু সম্পূর্ণভাবে মানুষ হয়েছেন।
প্রথম সাক্ষগুলো এবং প্রথম শিষ্যরা যোহন ১:১৯-৫১
যাদের সঙ্গে যীশুর দেখা হয় তারা তাঁর সম্বন্ধে কি দাবি করে, যোহন তা সুসমাচারের শুরুতে উপস্থাপন করেন। বাপ্তিস্মদাতা যোহন যীশুকে “ঈশ্বরের মেষ-শিশু” ও “ঈশ্বরের পুত্র” বলেন। আন্দ্রিয় “রব্বি” বা “গুরু” ও “মশীহ” বলেন। ফিলিপ “যীশু, নাসরত গ্রামের লোক” বলেন এবং নথনেল “ঈশ্বরের পুত্র” ও “ইস্রায়েলীয়দের রাজা” বলেন। যীশু নিজেকে “মনুষ্যপুত্র” বলেন। এখানে অদ্ভূত কিছু দাবি করা হচ্ছে এবং যোহন তার সুসমাচারের বাকি অংশে সেগুলো প্রমাণ করবেন।
কান্না গ্রামে বিবাহ অনুষ্ঠানে জলকে দ্রাক্ষারসে পরিণত করা যোহন ২:১-১১
যোহন ২-১২ অধ্যায়ে যীশু ৭টি আশ্চর্য চিহ্ন করেন। একটি ধারাবাহিকতা দেখা যায় – যীশু প্রথম একটি আশ্চর্য কাজ করেন (যেমন লোকদের রুটি খাওয়ানো), পরে তিনি তার ভিত্তিতে নিজের বিষয়ে একটি দাবি করেন (“আমিই জীবন-রুটি”), যাতে লোকেরা আপত্তি উঠায় এবং শেষে লোকদের সিদ্ধান্ত নিতে হয় তারা যীশুকে বিশ্বাস করবে অথবা করবে না।
প্রথম চিহ্ন হিসাবে যীশু কান্না গ্রামে একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে জলকে দ্রাক্ষারসে পরিণত করেন, এর মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের দয়া ও দানশীলতা প্রকাশিত হয়। ভোজের কর্তা বলেন: “তুমি ভাল আংগুর-রস এখনও পর্যন্ত রেখেছ” (যোহন ২:১০) – এই কথা যিশাইয় ২৫:৬ পদ স্মরণ করিয়ে দেয় যেখানে ঈশ্বরের রাজ্যের আগমন একটি বড় ভোজের সঙ্গে তুলনা করা হয় যেখানে ভাল আঙ্গুর-রসও থাকে। তাই এই চিহ্নের রূপক অর্থ হল যে যীশুতে ঈশ্বরের রাজ্য এসে গেছে এবং যীশু নিজেই সেই “ভাল আঙ্গুর-রস” যা শেষ পর্যন্ত রাখা হয়েছে।
উপাসনা-ঘর থেকে ব্যবসায়ীদের তাড়ানো যোহন ২:১৩-২২
যীশু নিস্তার বা উদ্ধার পর্বের জন্য যিরূশালেমে এসেছেন। তিনি উপাসনা-ঘরের প্রথম উঠানে (যা অযিহূদীদের উঠান বলা হত) প্রবেশ করেন এবং খুব রেগে গিয়ে ব্যবসায়ীদের ও টাকা বদল করে দেওয়ার লোকদের বের করে দেন। উপাসনা-ঘর ও উৎসর্গপদ্ধতির উপরে তাঁর অধিকার আছে, যীশু তা রূপকভাবে দাবি করেন। যখন যিহূদী নেতারা যীশুকে চ্যালেঞ্জ করেন যে তা করার অধিকার তাঁর নেই, এর উত্তরে তিনি বলেন “ঈশ্বরের ঘর আপনারা ভেংগে ফেলুন, তিন দিনের মধ্যে আবার আমি তা উঠাব” যা শুনে সবার মাথা আরো গরম হয়ে যায় (যোহন ২:১৯)। যীশুর দাবি – উপাসনা-ঘর ধ্বংস করে তিনি তিন দিনের মধ্যে তা পুনরায় তৈরি করবেন – যা রূপকভাবে তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থান নিয়ে কথা বলে। এর অর্থ তাও যে যীশুর দেহ হল আসল “উপাসনা-ঘর” বা “ঈশ্বরের ঘর”, তাঁর উপস্থিতি মানে ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে বাস করছেন, মানে ইম্মানুয়েল, মানে যীশুতে ঈশ্বর নিজে চলে এসেছেন।
নীকদীমের সঙ্গে রাত্রীকালীন আলোচনা যোহন ৩
এক রাতে ফরীশী নীকদীম যীশুর কাছে আসেন। তিনি তাঁকে ভদ্রভাবে ঈশ্বর থেকে একজন শিক্ষক হিসাবে কথা বলেন এবং স্বীকার করেন যে তিনি “ঈশ্বরের সঙ্গে থাকেন” (যোহন ৩:২)। হতে পারে তিনি জানতে চান যীশু ধার্মিক হওয়ার বিষয়ে কি শিক্ষা দেন। যীশু তাকে চ্যালেঞ্জ করেন – এমন না যে ইস্রায়েলে ‘আরো শিক্ষা’ বা ফরীশী ধরণের ‘আরো নিয়ম পালন করার চাপ’ দরকার, যা দরকার তা হল একটি সম্পূর্ণ নতুন জন্ম, একটি অন্তর যা পবিত্র আত্মায় পূর্ণ, এমন কিছু যা মানুষের প্রচেষ্টায় কখনও সম্ভব হবে না। যীশু ইচ্ছাকৃতভাবে নীকদীমের ফরীশী ধরণের চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করেন।
শমরিয় মহিলার সঙ্গে আলোচনা যোহন ৪
যিহূদীদের সংস্কৃতি ও মনোভাবের সম্পূর্ণ বিপরীতে যীশু একটি শমরিয় মহিলার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন যার জীবন ভাল না। যীশু তাকে প্রতিজ্ঞা দেন যে তিনি তাকে জীবন্ত জল দেবেন, যার অর্থ এই যে যীশু নিজেই অনন্ত জীবনের উৎস। মহিলাটি সৎভাবে উত্তর দেয় এবং যীশুর কথায় সাড়া দেওয়ার শেষ পর্যায়ে বুঝতে পারে যে যীশুই সেই প্রতিজ্ঞাত মশীহ।
বিশ্রামবারে একজন পঙ্গুকে সুস্থতা দান যোহন ৫
যিরূশালেমে একটি পুকুরের পাড়ে বিশ্রামবারে যীশু একজন পঙ্গুকে সুস্থ করেন। শুধুমাত্র তাই নয়, তিনি তাকে তার মাদুর বহন করতে ও হাঁটতে বলেন যা ফরীশীদের মৌখিক ঐতিহ্য অনুসারে বিশ্রামবারের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ। যখন চারিদিকে যিহূদীরা তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে যীশু দাবি করেন যে তিনি কাজ করছেন কারণ তাঁর পিতাও (ঈশ্বর) কাজ করছেন (অর্থাৎ ঈশ্বর নিজেই বিশ্রামবারে পঙ্গুকে সুস্থ করেছেন, যোহন ৫:১৭)। যীশুর এই উত্তরে অবশ্যই আরো তর্ক এবং যীশুর অধিকার নিয়ে লোকদের মধ্যে আরো অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়। যীশু দাবি করেন যে তিনি ঈশ্বর থেকে পাঠানো একজন, ঈশ্বর দ্বারা গৌরবান্বিত একজন এবং ঈশ্বরের অধিকার তাঁর উপর। তিনি আরো দাবি করেন যে তাঁকে দেখা মানে স্বর্গস্থ পিতাকে দেখা (যোহন ৫:১৯-৪৬), যাতে আরো রাগ ও তর্ক সৃষ্টি হয়েছিল।
উদ্ধার বা নিস্তার পর্বের সমান্তরালে পাঁচ হাজার লোকদের খাওয়ানো যোহন ৬
যীশুর পরবর্তী চিহ্ন তিনি ঠিক নিস্তার বা উদ্ধার পর্বের আগে করেন। নিস্তার পর্বে যিহূদীরা স্মরণ করে যে ঈশ্বর তাদেরকে কিভাবে মিসর থেকে উদ্ধার করে মরুভূমিতে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। সেই সময় যীশু এবং তার পাঁচ হাজার অনুসরণকারীরা একটি জনশূন্য স্থানে আছে বলে তিনি তাদের জন্য খাবারের (রুটি ও মাছ) যোগান দেন, যেভাবে ঈশ্বর যাত্রাপুস্তকে মোশির দ্বারা মরুভূমিতে ইস্রায়েলীয়দের মান্না খাওয়াতেন। যীশু দাবি করেন যে তিনিই জীবন-রুটি (যোহন ৬:৩৫) এবং অনন্ত জীবন পেতে হলে তাঁকে ‘খেতে’ হবেই। যীশু ঠিক এই রূপক প্রভুর ভোজে আবার ব্যবহার করেন এবং পরে ক্রুশে তা বাস্তবায়ন করেন। জীবন-রুটির দাবি শুনে অনেকে অপমান বোধ করে, যীশুর সাথে তর্ক করে এবং তাঁকে অনুসরণ করা বাদও দেয়।
কুঁড়ে-ঘরের পর্বে যীশু যোহন ৭-৮
কুঁড়ে-ঘরের পর্বে মরুভূমিতে ইস্রায়েলীয়দের যাত্রার বছরগুলো স্মরণ করা হত। পর্বরের একটি অংশ ছিল বাতির অনুষ্ঠান (যিরূশালেম শহর চারটি বড় বাটি দ্বারা আলোকিত করা হত) এবং আর একটি অংশ ছিল বেদীর উপরে জল ঢেলে দেওয়া। এই পর্বে যীশু সবার উপস্থিতিতে দাঁড়িয়ে জোরে দাবি করেন যে তিনিই “জীবন্ত জল” দিতে পারেন (যোহন ৭:৩৭-৩৮) যেমন মোশি দ্বারা ঈশ্বর মরুভূমিতে বার বার সে জীবনদায়ী জলের যোগান দিতেন। যীশু আরো দাবি করেন যে তিনিই “জগতের আলো” (যোহন ৮:১২), যেমন ঈশ্বরের উপস্থিতির একটি আগুনের থাম ইস্রায়েলীয়দের সামনে যেত। যীশুর এই দাবিগুলো আবারও তর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এবং লোকদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। কেউ কেউ যীশুকে বিশ্বাস করেছিল, কিন্তু কেউ কেউ যীশুকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে।
বিশ্রামবারে একজন অন্ধকে সুস্থতা দান যোহন ৯-১০
যীশু ফরীশীদের আরো বিরক্ত করে তোলেন যখন বিশ্রামবারে আবার তিনি একজন জন্ম থেকেই অন্ধ লোককে সুস্থ করেন। ফরীশীদের শিক্ষা অনুসারে জন্ম থেকে অন্ধ একজনকে সুস্থ করা হল এমন একটি আশ্চর্য কাজ যা শুধুমাত্র মশীহ করতে সক্ষম, তাই যীশুর এই চিহ্নের পরে অনেক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং যিহূদী নেতারা বিষয়টি সাবধানভাবে তদন্ত করেন। এছাড়া যীশু দাবি করেন যে তিনিই উত্তম রাখাল এবং ভেড়াদের জন্য দরজা (যোহন ১০:৭, ১০:১১), স্বর্গস্থ পিতা তাঁকে ভালবাসেন (যোহন ১০:১৭) এবং অবশেষে স্বর্গস্থ পিতা ও তিনিই এক (যোহন ১০:৩০)। এটা শুনে অনেকে তাঁকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অপমানের দোষী মনে করে এবং তাঁকে গ্রেফতার করতে চেষ্টা করে (যোহন ১০:৩১)। যিরূশালেম তাঁর জন্য মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে যীশু যিরূশালেম ছেড়ে চলে যান তবুও তিনি শিক্ষা দিতেই থাকেন (যোহন ১০:৪০-৪২)।
মৃত লাসারকে পুনরায় জীবন দান যোহন ১১-১২
লাসারের অসুস্থতার খবর ঈশ্বরের কাছে আসে কিন্তু তিনি সাথে সাথে সাড়া দেন না বরং তিনি এমন সময়ে বৈথনিয়ায় যান যখন তিনি জানেন যে ইতিমধ্যে লাসার মারা গেছেন। যীশু ভাল জানেন যে পরবর্তী চিহ্ন – লাসারকে জীবিত করে তোলা – এটা এমন শক্তিশালী চিহ্ন যে একারণে তাঁকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা আরো শক্তিশালী হয়ে যাবে। এটা হল যীশুর যিরূশালেমে যাওয়ার শেষ যাত্রা, তিনি প্রস্তুত হয়েই যিরূশালেমে (এবং কাছাকাছি বৈথনিয়ায়) যান জেনে যে তিনি লাসারের জন্য – এবং সবার জন্য – তাঁর জীবন দান করবেন।
বৈথনিয়ায় তিনি মার্থার সাথে কথা বলার সময় দাবি করেন যে তিনিই “পুনরুত্থান ও জীবন” (যোহন ১১:২৫) এবং তিনি লাসারকে মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে এনে জীবিত করে তোলেন। এই আশ্চর্য কাজের খবর – যারা বিশ্বাসে যীশুকে খোঁজ করতে এসেছেন (যোহন ১২:২০-২৬) এবং যারা মনে করে এখন আসলে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই উভয় লোকদের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। যীশু যখন যিরূশালেমে প্রবেশ করেন তখন এক দিকে অনেক লোক “হোশান্না” বলে চিৎকার করে তাঁকে স্বাগতম জানায় কিন্তু অন্য দিকে আত্মিক নেতারা চূড়ান্তভাবে তাঁকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন।
শিষ্যদের সঙ্গে যীশুর শেষ আলোচনা যোহন ১৩-১৭
যোহন তার সুসমাচারে এই শেষ সন্ধ্যায় ও শেষ রাতে শিষ্যদের সঙ্গে যীশুর আলোচনায় অনেক গুরুত্ব দেন। যতদূর সম্ভব যীশু শিষ্যদের পরবর্তী ঘটনার জন্য প্রস্তুত করেন – তিনি তাদের আবার দেখান যে ত্যাগ-স্বীকারের ভালবাসাই হল সব কিছু (পা ধোয়ানো, যোহন ১৩:১-২০), তিনি তাদের সাথে প্রভুর ভোজ খান, তাদেরকে তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যু এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে কথা বলেন (যখন তা ঘটবে তারা জানবে যে যীশু আগে থেকেই জানতেন, যোহন ১৩:২১-৩৮), তিনি তাঁর চলে যাওয়ার বিষয়ে তাদেরকে জানান (যোহন ১৪), তিনি তাদের দেখান কিভাবে তারা তারপরেও তাঁর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে (যোহন ১৫) এবং তাদেরকে এমন একটি সময়ের জন্য প্রস্তুত করেন যখন যীশু শারীরিকভাবে তাদের সঙ্গে আর থাকবেন না বরং তারা পবিত্র আত্মা দিয়ে পরিচালিত হবেন (যোহন ১৪, ১৬)। তিনি তাদের জন্য আর একবার তাঁর ভালবাসার নিশ্চয়তা দিয়ে প্রার্থনা করেন (যোহন ১৭) এবং গেৎশিমানী বাগানে যান, যেখানে যিহূদা তাদের পেতে প্রত্যাশা করেন (যোহন ১৮:১-২)।
যীশুর গ্রেফতার, মামলা ও ক্রুশীয় মৃত্যু যোহন ১৮-১৯
যীশুর গ্রেফতারের সময় যখন সেনারা “নাসরতের যীশুকে” খোঁজেন, তিনি উত্তরে বলেন “আমি সেই” যাতে তারা “পিছিয়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল” (যোহন ১৮:৬)। এটা হল যীশুর শেষ “আমিই…” উক্তি। যিহূদী পরিষদের সামনে যীশু উত্তরে শুধুমাত্র তাই উল্লেখ করেন যা তিনি আগে সবার সামনে শিক্ষা দিয়েছিলেন। পীলাতের কাছে যীশু বলেন যে তিনি আসলেই রাজা, কিন্ত তাঁর রাজ্য সম্পূর্ণ অন্য ধরণের – তাঁর রাজ্যের মূল্যবোধ ভিন্ন, ক্ষমতার সংজ্ঞা এবং নেতৃত্বের ধরণই ভিন্ন (যোহন ১৮:৩৬)। যীশুই আসল রাজা, যিনি মন্দকে তাঁর উপর জয় করতে দেওয়ার মধ্য দিয়েই মন্দের উপর জয়লাভ করেন, যিনি ত্যাগ-স্বীকারের ভালবাসার মধ্য দিয়ে জগতের উপর জয়লাভ করেন: ক্রুশ।
যীশুর পুনরুত্থান ও শিষ্যদের সাথে দেখা যোহন ২০-২১
যোহন পুনরুত্থানের সকালের ঘটনাগুলো বর্ণনা করেন যা তিনি কখনও আর ভুলতে পারছিলেন না – মহিলাদের সংবাদ যে ‘কবর খালি’, সবার অস্থিরতা ও সন্দেহ, নিশ্চিত হওয়ার জন্য পিতরের সঙ্গে কবরের দিকে দৌঁড়, পরে মরিয়মের কথা যে তিনি পুনরুত্থিত যীশুকে দেখেছেন এবং শেষে আশ্চর্যের যে নিজের চোখে পুনরুত্থিত প্রভুকে দেখা! পরে থোমার কাছে যীশুর নিশ্চয়তা দান এবং গালীলে মাছ ধরার সময়ে আবারও তাঁর সাথে দেখা।
যোহন দেখান কিভাবে যীশু পিতরকে পুনরায় তাঁর অনুসরণকারী, তাঁর প্রেরিত ও মণ্ডলীর নেতা হিসাবে স্থাপন করেন। যোহন তার সুসমাচারের শেষে একটি ভুল গুজব-গল্পের প্রতিরোধের (তিনি মারা যাবেন না) আসল ঘটনাটি উল্লেখ করেন। যোহন নিশ্চিত করেন যেন তার মৃত্যুর কারণে বিশ্বাসীদের মন অস্থির হয়ে না যায়।