থিষলনীকীয় মণ্ডলী স্থাপনের সময়ে পৌল ও তার দল এমন বিরোধিতার সম্মুখীন হয় যে পৌলকে অল্পক্ষণের মধ্যে তাদেরকে ছেড়ে চলে যেতে হয়। এই নতুন স্থাপিত ও অত্যাচারিত মণ্ডলীকে নিশ্চয়তা ও উৎসাহ দেওয়ার জন্য পৌল এই চিঠিটি লেখেন।
পৌল, সীল ও তীমথিয় তাদের দ্বিতীয় প্রচার যাত্রায় ৫০ খ্রীষ্টাব্দে থিষলনীকীয়া শহরে একটি নতুন মণ্ডলী স্থাপন করেন। বেশ কিছু যিহূদী, অনেক গ্রীকরা এবং অনেক প্রধান মহিলারা বিশ্বাসী হয়ে যায় (প্রেরিত ১৭:৪)। যে যিহূদীরা পৌলের প্রচার অগ্রাহ্য করে তারা পৌলকে সম্রাটের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী বলে থিষলনীকীয় শহর-প্রশাসকদের পৌলের বিরুদ্ধে উস্কিয়ে দেয়। সমস্যা প্রতিরোধ করার জন্য পৌল ও সীল তাড়াতাড়ি থিষলনীকীয়া শহর ছেড়ে চলে যান। তীমথিয়, পৌলের লাজুক যুবক সহকর্মী প্রথম বার সেই জরুরী দায়িত্ব পেয়ে থিষলনীকীয়ায় স্থাপিত নতুন মণ্ডলীকে আরো কিছুদিন ধরে দেখাশুনা করেন।
পৌল ও সীল বিরয়া শহরে যান সেখানে আবারও বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে অত্যাচার শুরু হয়। ফলে পৌল তাড়াতাড়ি এথেন্স ও করিন্থ শহরের দিকে রওনা দেন, যেখানে কিছুদিনের মধ্যে সীল ও তীমথিয় আবার তার সঙ্গে একত্রিত হন (প্রেরিত ১৭:১৩-১৫)। পৌল দুশ্চিন্তিত কারণ থিষলনীকীয় মণ্ডলী অতি তাড়াতাড়ি স্থাপিত হয়েছিল এবং বেশি শিক্ষা না পেয়ে অত্যাচারের সম্মুখে পড়েছে (১ থিষ ৩:১-৫)। তাই তিনি খোঁজ নেওয়ার জন্য তীমথিয়কে থিষলনীকীয়ায় পাঠান। তীমথিয় সেখান থেকে ফিরে আসেন এবং মণ্ডলীর অবস্থা সম্পর্কে পৌলকে জানান। তীমথিয়ের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে পৌল উত্তরে ১ থিষলনীকীয় চিঠি লেখেন। তিনি চিঠিটি তীমথিয়ের হাতে দিয়ে তাকে আবার থিষলনীকীয় মণ্ডলীর কাছে ফিরে পাঠান।
১ থিষলনীকীয় হল বন্ধুত্বপূর্ণ ও উৎসাহদানকারী একটি চিঠি। পৌল থিষলনীকীয় বিশ্বাসীদের নিশ্চয়তা দেন যে তারা পরিত্রাণ পেয়েছে, ঈশ্বর তাদের ভালবাসেন এবং তিনিও তাদের ভালবাসেন। পৌলের অতি তাড়াতাড়ি প্রস্থান এবং থিষলনীকীয় পরিবেশ এখনও স্বাভাবিক না হওয়ার কারণে পৌল তাদের কাছে বেড়াতে যেতে পারেন না, এই বিষয়ে পৌল তার চিঠিতে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি তাদেরকে স্থিরতা দান করতে চান যেন তারা নিজেদেরকে পরিত্যাক্ত মনে না করে এবং কষ্টভোগের মধ্য দিয়ে গেলেও যেন তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে বা সন্দেহে না পড়ে (১ থিষ ৩:৫)। পৌল তাদের বলেন যে কষ্টভোগ হল বিশ্বাসীদের জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ এবং পৌলকেও অনেক কষ্টভোগ স্বীকার করতে হচ্ছে (১ থিষ ২:১-২)। পৌল থিষলনীকীয়দের শুরু থেকেই যা বলেছিলেন তা তিনি তাদেরকে এই চিঠিতে স্মরণ করিয়ে দেন, যে বিশ্বাসীদের জীবনে কষ্টভোগ অবশ্যই আসবে (১ থিষ ৩:৪)।
পৌল থিষলনীকীয়দেরকে তাদের বিশ্বাস, ভালবাসা ও আশা ধরে রাখার জন্য প্রশংসা করেন (১ থিষ ১:৬-১০)। তিনি দেখান যে তারা ইতিমধ্যে অন্য এলাকার বিশ্বাসীদের জন্য শক্তিশালী সাক্ষ্যী হয়ে উৎসাহ দিতে পেরেছে। তাই তিনি তাদেরকে ঠিক সে বিশ্বাস, ভালবাসা ও আশা আরো ধরে রাখতে বলেন।
১ থিষলনীকীয় চিঠি থেকে বুঝা যায় যে থিষলনীকীয়া শহরে থাকার সময়ে পৌল বিশ্বাসীদেরকে যীশুর দ্বিতীয় আগমন সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি এই চিঠিতেও যীশুর দ্বিতীয় আগমন সম্বন্ধে থিষলনীকীয়দের কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন এবং তাদের কিছু ভুল চিন্তা সংশোধনও করেন। তারা বিশেষভাবে এই প্রশ্নটির সম্মুখীন: যারা যীশুর দ্বিতীয় আগমনের আগে মারা যায়, তারা যীশুর আগমন বা তাঁর আশীর্বাদ থেকে কি বঞ্চিত হবে? পৌল উত্তরে জোরালোভাবে বলেন যে ‘না!’ (১ থিষ ৪:১৩-১৮)। তিনি তাদের নিশ্চয়তা দেন যে যীশুর দ্বিতীয় আগমনের আগে যারা মারা যায় এবং আগামনের সময়ে যারা জীবিত আছে, তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না: মৃতদের পুনরুত্থিত করা হবে, তাদের জীবিত বিশ্বাসীদের সঙ্গে উঠানো হবে এবং তারা একসাথে আকাশে যীশুর সঙ্গে মিলিত হবে।
পৌল আরো বলেন, যদিও যীশুর দ্বিতীয় আগমন কখন ঘটবে তা কেউ জানে না (তা “রাতের বেলায় আসা চোর”এর মত হবে) তবুও নিশ্চিত জানা যায় যে তা অবশ্যই ঘটবে এবং বিশ্বাসীদের সেই দিন পর্যন্ত “আলোর ও দিনের লোক” হিসাবে জীবন-যাপন করা দরকার। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে “আলোর ও দিনের লোক” হিসাবে জীবন-যাপন করা মানেই বিশ্বাসে স্থির থাকা, দৈনন্দিন জীবনে অন্যদের ভালবাসা এবং আশা ধরে রাখা (১ থিষ ৫:৮)।
চিঠি থেকে বুঝা যায় যে থিষলনীকীয় বিশ্বাসীদের মধ্যে একটি সমস্যা দেখা দিয়েছিল: তারা নিজের খরচ বহন করার জন্য ঠিকমত কাজ করতে রাজি ছিল না। পৌল তাদের বলেন “শান্ত জীবন কাটাতে, নিজের কাজে ব্যস্ত থাকতে এবং নিজের হাতে পরিশ্রম করতে বিশেষভাবে আগ্রহী হও, যেন বাইরের লোকদের চোখে তোমাদের চলাফেরা উপযুক্ত হয় এবং অন্যের উপর নির্ভর করতে না হয়” (১ থিষ ৪:১১-১২)। পৌল চান যেন তারা বিশ্বাসী হিসাবে পরিশ্রমী ও শান্ত স্বভাবের লোক হয়, যারা নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে জানে। পৌল বিশ্বাসীদের বৃদ্ধির জন্য অনেক ব্যবহারিক দিক-নির্দেশনা দিয়েই তার চিঠি শেষ করেন (১ থিষ ৫:১২-২৪)।
থিষলনীকীয় মণ্ডলীর স্থাপন
পৌল, সীল ও তীমথিয় একটি দল হিসাবে দ্বিতীয় প্রচার যাত্রায় (৫০-৫২ খ্রীঃ) বের হন । পৌল একটি দর্শনে ম্যাসিডোনিয়ার একজনের ডাক শুনেন এবং দলটি এই দর্শনে সাড়া দিয়ে এশিয়া মাইনর থেকে ম্যাসিডোনিয়া ও গ্রীসের দিকে রওনা দেন।
ফিলিপী শহরে একটি মণ্ডলী স্থাপন করার পরে তারা পশ্চিম দিকে ‘ভিয়া এগ্নাটিয়ায়’ নামে সেই রোমীয় মহাসড়কে যাত্রা করে থিষলনীকীয়া শহরে পৌঁছান। থিষলনীকীয়া শহর ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর এবং রোম রাজ্যের ম্যাসিডোনিয়া প্রদেশের সদর।
পৌল তাঁর অভ্যাস অনুসারে প্রথমে থিষলনীকীয়ায় যিহূদীদের সমাজ গৃহে প্রচার করেন। ফলে বেশ কয়েকজন যিহূদী এবং অনেক গ্রীক লোক বিশ্বাসী হয়ে যায়, তাদের মধ্যে কিছু প্রধান মহিলারাও বিশ্বাসী হয়ে যান এবং এভাবে থিষলনীকীয় মণ্ডলী স্থাপিত হয় (প্রেরিত ১৭:৪)।
যে যিহূদীরা পৌলের প্রচার অগ্রাহ্য করে তারা পৌলকে সম্রাটের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী বলে থিষলনীকীয় শহর-প্রশাসকদের তার বিরুদ্ধে উস্কিয়ে দেয়। সম্রাটের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী বলে তারা পৌলকে দোষারোপ করে: “যে লোকেরা সারা দুনিয়া তোলপাড় করে তুলেছে তারা এখন এখানেও উপস্থিত হয়েছে” (প্রেরিত ১৭:৬-৭)। সমস্যা প্রতিরোধ করার জন্য পৌল ও সীল তাড়াতাড়ি থিষলনীকীয়া শহর ছেড়ে চলে যান। তীমথিয়, পৌলের লাজুক যুবক সহকর্মী প্রথম বার সেই জরুরী দায়িত্ব পেয়ে থিষলনীকীয়ায় স্থাপিত নতুন মণ্ডলীকে আরো কিছুদিন ধরে দেখাশুনা করেন (প্রেরিত ১৭:১০)।
প্রেরিত পুস্তকে মণ্ডলীর স্থাপনের বর্ণনা ছাড়া ১ থিষলনীকীয় চিঠি থেকেও কিছুটা তথ্য যোগ দেওয়া যায়: পৌল যখন থিষলনীকীয়ায় ছিলেন তখন বিশ্বাসীরা পবিত্র আত্মার শক্তি উপলব্দি করে এবং আত্মা দ্বারা নিশ্চয়তা পায় (১ থিষ ১:৫)। পৌল ও তার দল দিনরাত পরিশ্রম করেন, উভয় পরিচর্যা এবং আয় রোজগারের ক্ষেত্রে, যেন তারা নতুন স্থাপিত মণ্ডীর জন্য বোঝা হয়ে না যায় (১ থিষ ২:৯, ৩:৮)। এতে পৌলের সততা ও নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়, কারণ হতে পারে তিনি সহজে প্রধান মহিলাদের অনুরোধ করে টাকা জোগাড় করতে পারতেন (প্রেরিত ১৭:৪), কিন্তু তা তিনি করেন নি।
একটি ছোট মজার বিষয়: প্রেরিত ১৭:৬ পদে লূক যখন শহর-প্রশাসকদের উল্লেখ করেন, তিনি গ্রীক ভাষার “পোলিতার্খ” (‘politarch’) শব্দ ব্যবহার করেন। কিছু পণ্ডিতেরা বলে যে রোম সরকারের অধীনে এই নামে কোন ভূমিকা ছিল না। এভাবে লূকের লেখার সঠিকতা নিয়ে তারা সন্দেহ প্রকাশ করত। কিন্তু পরে থিষলনীকীয়া শহরে ভিয়া এগ্নাটিয়ায় একটি তোরনে খোদাই করে একটি লেখা আবিষ্কার করা হয় যাতে শহরের নেতাদের বুঝানোর জন্য “পোলিতার্খ” শব্দ ব্যবহা করা হয়েছে: “পোলিতার্খদের সময়ে …”। লেখাটি এখন লন্ডনের ব্রিটিশ যাদুঘরে পাওয়া যায় (ছবিগুলো দেখুন)। পরবর্তীতে আরো ৩৪টা এই ধরণের লেখা আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে ১৯টা থিষলনীকীয়া শহরে এবং কমপক্ষে ৩টা যা নিশ্চিত প্রথম শতাব্দীর সময়ে লেখা হয়েছিল। তাই লূক প্রেরিত ১৭:৬ পদে সঠিক শব্দটি ব্যবহার করেনছেন।
ছবি
পৌল ও সীল তাড়াতাড়ি বিরিয়া শহরে চলে যান। যখন সেখানেও বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে অত্যাচার শুরু হয় তখন পৌল এথেন্স ও করিন্থ শহরের দিকে রওনা দেন (প্রেরিত ১৭:১৩-১৫)। কিছুদিনের মধ্যে সীল ও তীমথিয় সেখানে তার সঙ্গে একত্রিত হয়। থিষলনীকীয় মণ্ডলী অনেক তাড়াতাড়ি স্থাপিত এবং অত্যাচারিতও হয়েছে বলে পৌল তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তিত। তাই তিনি খোঁজ নেওয়ার জন্য তীমথিয়কে সেখানে ফিরে পাঠান (১ থিষ ৩:১-৫)। তীমথিয় আবার পৌলের কাছে ফিরে এসে তাকে মণ্ডলীর অবস্থা নিয়ে খবর দেন, যার উত্তরে পৌল ১ থিষলনীকীয় চিঠি লেখেন।
তাই সারাংশে বলা যায় যে পৌল, সীল ও তীমথিয় ৫০ খ্রীষ্টাব্দে করিন্থ শহর থেকে ১ থিষলনীকীয় চিঠিটি লেখেন, হতে পারে মণ্ডলীর স্থাপনের অল্প কয়েক মাসের মধ্যে। সম্ভবত তীমথিয় আবার থিষলনীকীয়ায় ফিরে গিয়ে চিঠিটি পৌঁছান, কারণ পৌল ও সীলের উপস্থিতি সেখানে আরো সমস্যা তৈরি করতে পারে।
থিষলনীকীয় মণ্ডলীর পরিস্থিতি
থিষলনীকীয়া শহরের নতুন বিশ্বাসীদের কেমন লাগে যখন পৌল, সীল ও তিমথিয় অল্পদিনের উপস্থিতি এবং শিক্ষা দানের পরে চলে যান? তীমথিয় অবশ্যই আর একটু সময় কাটান কিন্তু তিনিও বেশিদিন থাকেন না। পৌলের পরিদর্শন ঘূর্ণিঝড়ের মত ছিল, কিন্তু তিনি আর নেই এবং এখন থিষলনীকীয়ায় সেই নতুন মণ্ডলী (যার নেতৃত্বও খুবই নতুন!) নিজেকে যথেষ্ট চাপ এবং উভয় যিহূদী ও গ্রীকদের অত্যাচারের সম্মুখে খুঁজে পায়।
সহজে তাদের মনে অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে: যে আশ্চর্য কাজ দেখেছি, তা কি আসলেই বাস্তব ছিল? পরিত্রাণ কি পেলাম? পৌল কোথায়? কেন আমরা একা আছি? কে আমাদের এখন সাহায্য করবে? কে আমাদের আরো শিক্ষা দেবে? কেন তারা আমাদের ত্যাগ করেছেন? – অত্যাচারের সম্মুখীন হলে বিশ্বাসীরা নিজেদেরকে সহজে পরিত্যাক্ত মনে করতে পারে। তাই পৌলের ১ থিষলনীকীয় চিঠিটি পড়লে অবাক লাগার বিষয় নয় যে তিনি এই কয়েকটি বিষয়ের অনেক গুরুত্ব দেন:
- তিনি মণ্ডলীকে সুসমাচারে তাদের সাড়া দানের জন্য প্রশংসা করেন এবং তাদের বিশ্বাস, পরিত্রাণ ও বুঝার ক্ষমতা আরো নিশ্চিত করতে চান।
- পৌল তাদের দেখান যে তিনি তাদের পরিত্যাগ করেন নি। বরং তিনি তাদেরকে তার বন্ধুত্ব, ভালবাসা, যত্ন ও তাদের প্রতি আকাঙ্ক্ষার নিশ্চয়তা দেন।
- পৌল যা করেছেন, তিনি তা কেন করেছেন, এই কারণগুলো পৌল মণ্ডলীর কাছে ব্যাখ্যা করেন। এছাড়া পৌল তার প্রেরিতত্ব ও তার সুসমাচারের সত্য প্রমাণিত করেন – সাথে বিশ্বাসীদের পরিত্রাণের নিশ্চয়তাও দেন – কারণ থিষলনীকীয় বিশ্বাসীরা এখনও যিহূদীদের চাপের মধ্যে আছে।
- পৌল তাদেরকে বিশ্বাসে, বাধ্যতায়, ভালবাসায় ও সেবার কাজে বৃদ্ধি পেতে এবং আরো পবিত্রভাবে জীবন-যাপন করতে উৎসাহিত করেন।
সুসমাচারের প্রতি তাদের সাড়া, বিশ্বাস ও পরিত্রাণের বিষয়ে মণ্ডলীকে প্রশংসা ও আরো নিশ্চয়তা দান
সুসমাচারের প্রতি থিষলনীকীয় বিশ্বাসীদের সাড়ার জন্য পৌল তার কৃজ্ঞতা স্বীকার করেন: “আমরা সব সময় প্রার্থনায় তোমাদের সকলের কথা মনে করে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে থাকি” (১ থিষ ১:২)। “বিশ্বাসের দরুন তোমরা যে কাজ করছ, ভালবাসার দরুন যে পরিশ্রম করছ এবং আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টের উপর আশার দরুন যে ধৈর্য ধরছ, সেই কথা আমরা সব সময়ই আমাদের পিতা ও ঈশ্বরের সামনে প্রার্থনায় মনে করে থাকি” (১ থিষ ১:২-৩)। “অনেক অত্যাচারের মধ্যেও পবিত্র আত্মার দেওয়া আনন্দের সংগে সেই সুখবর গ্রহণ করে তোমরা আমাদের আর প্রভুর মত করে চলছ” (১ থিষ ১:৬)। “এতে ম্যাসিডোনিয়া আর আখায়া প্রদেশের সব বিশ্বাসীদের কাছে তোমরা একটা আদর্শ হয়েছ। কেবলমাত্র ম্যাসিডোনিয়া আর আখায়া প্রদেশেই যে তোমাদের কাছ থেকে প্রভুর বাক্য ছড়িয়ে পড়েছে এমন নয়, কিন্তু ঈশ্বরের উপর তোমাদের বিশ্বাসের কথাও সব জায়গাতেই গিয়ে পৌঁছেছে” (১ থিষ ১:৭-৯)। “আমরা সব সময় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি, কারণ ঈশ্বরের বাক্য আমাদের কাছ থেকে শুনে যখন তোমরা বিশ্বাস করেছিলে তখন তোমরা তা মানুষের বলে নয়, কিন্তু ঈশ্বরের বাক্য বলেই গ্রহণ করেছিলে। আর সত্যিই তা ঈশ্বরেরই বাক্য” (১ থিষ ২:১৩)। “এখন তীমথিয় তোমাদের কাছ থেকে আমাদের কাছে ফিরে এসে তোমাদের ভালবাসা ও বিশ্বাস সম্বন্ধে ভাল খবরই দিয়েছেন। … এইজন্য ভাইয়েরা, তীমথিয়ের মুখে তোমাদের বিশ্বাসের কথা শুনে আমাদের সব যন্ত্রণা ও কষ্টের মধ্যেও আমরা সান্ত্বনা পেয়েছি। প্রভুর উপর তোমাদের বিশ্বাস স্থির থাকলেই আমাদের জীবন ধন্য। তোমাদের দরুন ঈশ্বরের সামনে আমাদের যে আনন্দ, তার বদলে কেমন করে যে তাঁকে তোমাদের জন্য ধন্যবাদ দেব তা আমরা জানি না” (১ থিষ ৩:৬-৯)।
থিষলনীকীয়দের কাছে এই ছোট চিঠিতে পৌল ৯ বার বলেন “তোমরা জান” (১ থিষ ১:৫, ২:১-২, ২:৫, ২:১১, ৩:৩-৪, ৪:২, ৫:২), এক বার তিনি বলেন “তোমাদের মনে আছে” (১ থিষ ২:৯), এক বার তিনি বলেন “শিক্ষা পেয়েছ” (১ থিষ ৪:১) এবং এক বার তিনি বলেন “ঈশ্বর তোমাদের শিখিয়েছেন” (১ থিষ ৪:৯)। এইগুলি বলার মাধ্যমে তাদের জ্ঞান ও বুঝবার ক্ষমতার বিষয়ে পৌল মণ্ডলীকে প্রশংসা করেন এবং তাদের তাতে বৃদ্ধি পেতে ও তা আঁকড়ে ধরে রাখতে উৎসাহিত করেন।
তাদের জন্য পৌলের ভালবাসা, যত্ন ও আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ
পৌল এই চিঠিতে থিষলনীকীয় বিশ্বাসীদের জন্য তার ভালবাসা ও যত্ন প্রকাশ করেন যেন তারা নিজেকে ‘পরিত্যাক্ত’ মনে না করে: “তোমাদের উপর গভীর মায়া-মমতা থাকাতে তোমাদের কেবল ঈশ্বরের সুখবর দিতে নয়, তোমাদের জন্য নিজেদের প্রাণ দিতেও আমরা রাজী ছিলাম, কারণ আমাদের কাছে তোমরা খুবই প্রিয়” (১ থিষ ২:৮), “তোমরা জান, বাবা যেমন নিজের সন্তানদের উৎসাহ, সান্ত্বনা ও কঠোরভাবে আদেশ দেন, আমরাও তোমাদের প্রত্যেককে তা-ই দিতাম” (১ থিষ ২:১১) “সেইজন্য আমরা, বিশেষ করে আমি পৌল অনেক বারই তোমাদের কাছে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শয়তান আমাদের বাধা দিয়েছিল। আমাদের প্রভু যীশু যখন আসবেন তখন তাঁর সামনে তোমরাই কি আমাদের আশা, আনন্দ ও গৌরবের জয়ের মালা হবে না? সত্যি, তোমরাই আমাদের গৌরব, তোমরাই আমাদের আনন্দ” (১ থিষ ২:১৮-২০)। “আমরা যখন আর সহ্য করতে পারলাম না তখন এথেন্স শহরে একা থাকাই স্থির করে আমাদের ভাই তীমথিয়কে পাঠিয়েছিলাম। … আমরা তাঁকে পাঠিয়েছিলাম যেন তিনি তোমাদের বিশ্বাসে স্থির রাখতে ও উৎসাহ দিতে পারেন” (১ থিষ ৩:১) “তোমাদের দরুন ঈশ্বরের সামনে আমাদের যে আনন্দ, তার বদলে কেমন করে যে তাঁকে তোমাদের জন্য ধন্যবাদ দেব তা আমরা জানি না” (১ থিষ ৩:৯)।
তা ছাড়া পৌল থিষলনীকীয়দের জানান যে তিনি প্রার্থনার মধ্য দিয়েও তাদের যত্ন নিয়ে থাকেন “আমরা দিনরাত ঈশ্বরের কাছে অন্তর থেকে অনুরোধ জানাচ্ছি যেন আমরা তোমাদের দেখতে পাই এবং তোমাদের বিশ্বাসের মধ্যে যে অভাব আছে তা পূরণ করতে পারি” (১ থিষ ৩:১০, ১:২)। তিনি তাদের কাছে বেড়াতে আসতে চান (১ থিষ ২:১৮) এবং তাদের আশীর্বাদ করেন (১ থিষ ৩:১১-১২)।
পৌল তার প্রেরিত-পদ সুরক্ষা করেন
সম্ভবত থিষলনীকীয় যিহূদীরা পৌলের চরিত্র ও প্রৈরিতিক অধিকার নিয়ে আপত্তি উঠিয়ে বিশ্বাসীদের চাপ দিত। একারণে পৌল তার চিঠিতে প্রেরিত হিসাবে তার অধিকার ও আচরণ বুঝিয়ে বলেন। তিনি তার স্বভাব-চরিত্র (১ থিষ ১:৫), অত্যাচারে তার সাহস ও বিশ্বস্ততা (১ থিষ ২:২), তার সৎ উদ্দেশ্য (১ থিষ ২:৫), ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার তার আকাঙ্ক্ষা (১ থিষ ২:৪), তার প্রচারিত সুখবরের সততা (১ থিষ ২:৩), অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার স্বার্থহীনতা (১ থিষ ২:৭), তার কঠোর পরিশ্রম (১ থিষ ২:৯) এবং বিশ্বাসীদের জন্য তার যত্ন নিয়ে কথা বলেন (১ থিষ ২:১১)।
পৌল নিশ্চিত করতে চান যেন অত্যাচারিত থিষলনীকীয় মণ্ডলী তাদের অত্যাচারের বিষয়ে অস্থির হয়ে না যায় (১ থিষ ৩:৫)। পৌল তাদের বুঝান যে অত্যাচার হল বিশ্বাসীদের জীবনের একটি সাধারণ অংশ। তিনি উল্লেখ করেন যে তিনি নিজেই বার বার অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন (১ থিষ ২:১-২) এবং তিনি তাদের আগে থেকেই বলেছিলেন যে অত্যাচার হল বিশ্বাসীদের জীবনের একটি বাস্তব অংশ (১ থিষ ৩:৪)।
পৌল থিষলনীকীয় বিশ্বাসীদের তাদের বিশ্বাস, ভালবাসা ও আশার জন্য প্রশংসা করেন: “বিশ্বাসের দরুন তোমরা যে কাজ করছ, ভালবাসার দরুন যে পরিশ্রম করছ এবং আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টের উপর আশার দরুন যে ধৈর্য ধরছ, সেই কথা আমরা সব সময়ই আমাদের পিতা ও ঈশ্বরের সামনে প্রার্থনায় মনে করে থাকি” (১ থিষ ১:৩)। ইতিমধ্যে তারা অন্যদের জন্য একটি সাক্ষ্য ও উৎসাহের কারণ হয়ে উঠেছেন (১ থিষ ১:৬-১০)। তিনি তাদের জন্য বিনতি করছেন “আমরা দিনরাত ঈশ্বরের কাছে অন্তর থেকে অনুরোধ জানাচ্ছি যেন আমরা তোমাদের দেখতে পাই এবং তোমাদের বিশ্বাসের মধ্যে যে অভাব আছে তা পূরণ করতে পারি” (১ থিষ ৩:১০)। তিনি তাদের উৎসাহ দেন যেন তারা ঠিক সেই বিশ্বাস, ভালবাসা ও আশা ধরে রাখে এবং তাতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। “আরও বলি ভাইয়েরা, ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করবার জন্য কিভাবে চলা উচিত সেই শিক্ষা তো তোমরা আমাদের কাছে পেয়েছ, আর সত্যিই তোমরা সেইভাবেই চলছ। তবুও প্রভু যীশুর হয়ে আমরা তোমাদের অনুরোধ করছি ও উপদেশ দিচ্ছি যেন তোমরা আরও বেশী করে সেইভাবে চল” (১ থিষ ৪:১)।
যীশুর দ্বিতীয় আগমনের বিষয়ে থিষলনীকীয়দের ভুল চিন্তার সংশোধন
যখন পৌল অল্পদিন ধরে থিষলনীকিয়া শহরে কাটিয়েছিলেন সম্ভবত তখন তিনি নতুন স্থাপিত মণ্ডলীকে যীশুর দ্বিতীয় আগমনের বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন। থিষলনীকীয় মণ্ডলী শুরু থেকে অত্যাচারের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, হয়তো একারণেই তিনি তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন যে যীশুর দ্বিতীয় আগমনে সব অত্যাচার থামানো ও সব অন্যায়ের বিচার করা হবে। অথবা যিহূদীরা যীশুকে একজন ব্যর্থ ও মৃত ভ্রান্ত শিক্ষক হিসাবে ঘোষনা করেছিল বলে পৌল পুরুত্থিত যীশুর ভবিষ্যৎ জয় নিয়ে কথা বলেছিলন।
প্রথমে পৌল বিশ্বাসীদের নিশ্চয়তা দেন যে যীশু সব অত্যাচারী ও অন্যায়কারীদের অবশ্যই বিচার করবেন (১ থিষ ১:৮-৯, ২:১৬)। তিনি মণ্ডলীকে উৎসাহিত করেন: “আমাদের প্রভু যীশু যখন আসবেন তখন তাঁর সামনে তোমরাই কি আমাদের আশা, আনন্দ ও গৌরবের জয়ের মালা হবে না? ” (১ থিষ ২:১৯)।
তীমথিয়ের কাছ থেকে মণ্ডলীর বিষয়ে সংবাদ পেয়ে পৌল বিশ্বাসীদের মধ্যে ওঠা একটি দুশ্চিন্তার উত্তর দেন: যারা যীশুর দ্বিতীয় আগমনের আগে মারা যায় তারা কি যীশুর দ্বিতীয় আগমন থেকে বঞ্চিত হবে? পৌল জোরালোভাবে উত্তর দেন: ‘না!’ (১ থিষ ৪:১৩-১৮)। তিনি তাদের নিশ্চয়তা দেন যে একজন বিশ্বাসী আগে মারা গেলে বা সেই সময় জীবিত থাকলে তা কোনো পার্থক্য করবে না: মৃতদের জীবিত করে তোলা হবে এবং তাদের যীশুর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য জীবিতদের সঙ্গে আকাশে তুলে নেওয়া হবে। তিনি এই কথা বলেন “যেন যাদের মনে কোন আশা নেই তাদের মত করে তোমরা দুঃখে ভেংগে না পড়” (১ থিষ ৪:১৩)।
এই বিষয় বুঝানোর সময় তিনি উল্লেখ করেন যে “প্রভু নিজেই স্বর্গ থেকে নেমে আসবেন। খ্রীষ্টের সংগে যুক্ত হয়ে যারা মারা গেছে তখন তারাই প্রথমে জীবিত হয়ে উঠবে। তার পরে আমরা যারা জীবিত ও বাকী থাকব, আমাদেরও আকাশে প্রভুর সংগে মিলিত হবার জন্য তাদের সংগে মেঘের মধ্যে তুলে নেওয়া হবে” (১ থিষ ৪:১৬-১৭)। পৌল যে শব্দ ব্যবহার করেন “তুলে নেওয়া হবে” (ষ্ট্রংস নম্বর G726, গ্রীক ভাষায় ‘harapazo’) তার কারণে আধুনিক মণ্ডলীতে চিন্তা তৈরি হয়েছে, তার মানে ‘স্বর্গে যাওয়া’। কিন্তু আসলে শব্দটি নতুন নিয়মের ১৩ বার উল্লিখিত এবং ১২ বার শব্দের অর্থ ভিন্ন। যখন পৌল বলেন “আকাশে তুলে নেওয়া হবে …প্রভুর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য” আমরা মনে মনে এই ছবি দেখি যে যীশু এসে বিশ্বাসীদেরকে স্বর্গে তুলে নিয়ে যাবেন। কিন্তু পৌল তা এভাবে বলেন নি। তিনি বলেছেন যে বিশ্বাসীরা যীশুর সঙ্গে মিলিত হবেন – কিন্তু মিলিত হওয়ার পরে প্রভু কোন দিকে যাবেন? উপরের দিকে? না নিচের দিকে?
উত্তর পেতে গেলে একটি বিষয় লক্ষ্য করতে হবে: পৌল যখন যীশুর “আসা” বা “আগমন”-এর বিষয়ে কথা বলেন (গ্রীক শব্দ ‘parousia’) তখন তিনি আসলে কি বুঝান? এই শব্দটি সাধারণত কিভাবে ব্যবহার হত: একজন রোমীয় সম্রাট যখন কোন একটি রোমীয় শহর পরিদর্শন করতে আসতেন (“আসা” parousia), তখন শহরের নামী-দামী নেতারা সবাই শহর ছেড়ে তার দিকে রওনা দিয়ে গিয়ে তার সাথে দেখা করতেন এবং তাকে সম্মানের সঙ্গে শহরে আসার জন্য স্বাগতম জানাতেন। থিষলনীকীয় চিঠিতে পৌল ঠিক সেই ছবি ব্যবহার করেন: বিশ্বাসীরা পৃথিবী ছেড়ে যীশুর দিকে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে তাঁকে সম্মানের সঙ্গে পৃথিবীতে আসতে স্বাগতম জানাবে। পৌলের ছবিতে অবশ্যই “উপরে যাওয়ার” বিষয় আছে (শুধুমাত্র বের হওয়ার বিষয় না) কিন্তু মূল বিষয় হল যীশুকে পৃথিবীতে স্বাগতম জানানো। তাই পৌলের ছবির মানে না যে যীশুর সঙ্গে বিশ্বাসীদের দেখার পরে তিনি তাদের স্বর্গে নিয়ে যাবেন বরং বিশ্বাসীরা যে তাঁকে পৃথিবীতে আসতে স্বাগতম জানাবে, শহরে প্রবেশ করতে ও সেখানো সম্মানের সঙ্গে রাজত্ব করতে নিমন্ত্রণ করবে।
ছবি
পৌল এই ব্যাখ্যার শেষে বলেন যা তিনি চিঠির আর একটি শিক্ষা সমাপ্ত করার জন্য বলেন: “সেইজন্য তোমরা এই সব কথা বলে একে অন্যকে সান্ত্বনা দাও” (১ থিষ ৪:১৮, ৫:১১)। কথাটি গুরুত্বপূর্ণ: শিক্ষাটির উদ্দেশ্য হল সান্ত্বনা দান। যীশুর দ্বিতীয় আগমন বা শেষকাল সম্বন্ধীয় শিক্ষার উদ্দেশ্য সব সময় তা-ই হতে হবে: বিশ্বাসীদের ভয় দেখানো না বা তাদের অস্থির করে তোলা না বরং তাদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। যীশুর দ্বিতীয় আগমন হল একটি উদ্ধার, একটি পুরুদ্ধার, সব মন্দ ও অন্যায়ের শেষ। তাই তা বিশ্বাসীদের জন্য ভয়ের বিষয় নয় বরং আনন্দের বিষয়।
পৌল ১ থিষ ৫:২-৩ পদে আরো বলেন যে যীশু ফিরে আসবেন “রাতের বেলা চোর”-এর মত (যার অর্থ হল কেউ জানে না কখন তিনি আসবেন) এবং তা হবে “গর্ভবতী স্ত্রীলোকের হঠাৎ প্রসব-বেদনা উঠবার মত” (যার অর্থ হল আসবেই কিন্তু কেউ জানে না ঠিক কখন আসবে)।
যেহেতু আমরা নিশ্চিত জানি যে যীশু ফিরে আসবেন আমাদের হতে হবে “আলোর ও দিনের লোক … আমরা রাতের বা অন্ধকারের লোক নই … সেইজন্য অন্যদের মত যেন আমরা না ঘুমাই, বরং জেগে থাকি এবং নিজেদের দমনে রাখি। যারা ঘুমায় তারা রাতেই ঘুমায়, আর যারা মাতাল হয় তারা রাতেই মাতাল হয়। আমরা কিন্তু দিনের লোক” (১ থিষ ৫:৪-৮)। পৌল চান যেন তারা জানে, সতর্ক হয় ও প্রস্তুত থাকে – কিন্তু যেন ভিত না হয়।
“আলোর লোক” হিসাবে জীবন-যাপন করা মানে বিশ্বাসে চলা, অন্যদের জন্য একটি ভালবাসার জীবন করা এবং পরিত্রাণের আশা ধরে রাখা (১ থিষ ৫:৮)।
কাজ সম্পর্কে বাইবেলীয় দৃষ্টিভঙ্গি
চিঠি পড়লে থিষলনীকীয় মণ্ডলীর আর একটি সমস্যা প্রকাশ পায়: তারা ঠিকমত কাজ করত না এবং নিজের জন্য আয় উপার্জন করত না। হয়তো বিশ্বাসীরা যীশুর দ্বিতীয় আগমন নিয়ে ভুল চিন্তা বা ধারণা করত। যীশু শীঘ্রই ফিরে আসবেন বলে তারা মনে করত যে ফলে এই জগতে কাজ করার প্রয়োজন নেই। প্রেরিত পুস্তকে উল্লেখ আছে যে অনেক গ্রীক লোক এবং “বিশেষ বিশেষ মহিলারা”ও মণ্ডলীর সদস্য হয়েছিলেন। হয়তো তারা ধনী ও খুব দানশীল ছিলেন বলে বিশ্বাসীরা তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল এবং নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়া বাদ দিয়েছিল। গ্রীক ও রোমীয় সংস্কৃতিতে কাজ বা শ্রম ভাল চোখে দেখা হত না (‘সম্মানিত লোকেরা কাজ করেন না, কাজ মাত্র দাসদেরই’)। হয়তো একারণে থিষলনীকীয়রা কাজকে নীচু চোখে দেখত ও কাজ করতে আগ্রহী ছিল না। তাছাড়া সে সময় অনেকে ধনী রোমীয়দের চারিদিকে ঘুরত এই আশায় যে তারা হয়তো কিছু সেবা দিলে টাকা পাবে (Roman patronage)।
পৌল মণ্ডলীকে স্মরণ করিয়ে দেন যে তিনি ও তার দল থিষলনীকীয়ায় পরিচর্যা করার সময়ে যথেষ্ট পরিশ্রম করেছিলেন, সাধারণ কাজ করে আয় উপার্জনও করেছিলেন যেন তাদের চালানোর ভার নতুন স্থাপিত মণ্ডলীর উপর না পড়ে (১ থিষ ২:৯-১০)।
পৌল থিষলনীকীয় বিশ্বাসীদের আরো বলেন “আমরা তোমাদের যে আদেশ দিয়েছি সেইমত শান্ত জীবন কাটাতে, নিজের কাজে ব্যস্ত থাকতে এবং নিজের হাতে পরিশ্রম করতে বিশেষভাবে আগ্রহী হও, যেন বাইরের লোকদের চোখে তোমাদের চলাফেরা উপযুক্ত হয় এবং অন্যের উপর নির্ভর করতে না হয়” (১ থিষ ৪:১১-১২)। পৌল চান যেন তারা পরিশ্রমী ব্যক্তি হয় যারা নিজের দায়িত্ব নিজেই বহন করবে এবং অন্যদের উপর নির্ভরশীল না হয়ে বরং শান্ত হবে। ১ থিষ ৫:১২ পদে তিনি পরিশ্রমী নেতাদের আদর্শ হিসাবে দেখান এবং বিশ্বাসীদের তাদেরকে সম্মান করতে বলেন। ১ থিষ ৫:১৪ পদে পৌল যোগ দেন “আমরা তোমাদের এই উপদেশ দিচ্ছি – যারা অলস তাদের সাবধান কোরো”।
বিশ্বাসে, ভালবাসায় ও আশায় চলতে থাকা
পৌল বিশ্বাসীদের উৎসাহিত করেন যে সত্য তারা বুঝতে পেরেছে তাতে স্থির হয়ে দাঁড়াতে এবং সাড়া হিসাবে ভালবাসায় ও পবিত্রতায় জীবন-যাপন করতে: “ঈশ্বরের ইচ্ছা এই-তোমরা পবিত্র হও, অর্থাৎ সব রকম ব্যভিচার থেকে দূরে থাক, আর যারা ঈশ্বরকে জানে না সেই অযিহূদীদের মত দেহের কামনার বশে না চলে তোমরা প্রত্যেকে নিজের দেহকে পবিত্রভাবে সম্মানের সংগে দমনে রাখতে শেখ। এই ব্যাপারে অন্যায় করে কেউ যেন কোন ভাইকে না ঠকায়। আমরা আগেই তোমাদের বলেছি এবং সাবধান করে দিয়েছি যে, এই সব অন্যায়ের জন্য প্রভুই শাস্তি দেবেন, কারণ ঈশ্বর অশুচি ভাবে চলবার জন্য আমাদের ডাকেন নি, পবিত্রভাবে চলবার জন্যই ডেকেছেন” (১ থিষ ৪:৩-৭)। গ্রীক সংস্কৃতিতে যৌন ক্ষেত্রে অনৈতিকতা ছিল খুবই প্রচলিত বিষয়। তা ছাড়া বেশ কিছু স্থানীয় দেবতা পূজার অংশই ছিল মন্দিরের পতিতার সাথে যৌন সম্পর্ক।
পৌল তার চিঠিতে তাদের সম্পূর্ণ অন্য মানদণ্ড অনুসারে জীবন-যাপন করতে বলেন, কারণ যৌন ক্ষেত্রে অনৈতিকতা মানে নিজের স্বার্থে একজনকে ব্যবহার করা এবং তা ভালবাসার কাজ নয়: “ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের ভালবাসা সম্বন্ধে তোমাদের কাছে কিছু লিখবার দরকার নেই, কারণ ঈশ্বরই তোমাদের একে অন্যকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন। …আমরা তোমাদের যে আদেশ দিয়েছি সেইমত শান্ত জীবন কাটাতে … বিশেষভাবে আগ্রহী হও” (১ থিষ ৪:৯-১২)। থিষলনীকীয় মণ্ডলী সমাজ থেকে চাপ ও অত্যাচার পায় বলে বিশ্বাসীদের মধ্যেই ভালবাসা ও পরস্পরকে সেবা আরো আবশ্যক ও জীবন-দায়ী বিষয়।
পৌল তাদের আরো উৎসাহিত করেন যেন তারা মণ্ডলীর নেতাদের গ্রহণ করে যদিও তারা বেশি অভিজ্ঞ নন: “যারা তোমাদের মধ্যে পরিশ্রম করেন, প্রভুর হয়ে তোমাদের পরিচালনা করেন এবং তোমাদের উপদেশ দিয়ে থাকেন, তাঁদের সম্মান কোরো। তাঁরা যা করছেন তার জন্য ভালবাসার মনোভাব নিয়ে তাঁদের তোমরা বিশেষভাবে শ্রদ্ধা কোরো। তোমরা নিজেদের মধ্যে শান্তিতে থেকো” (১ থিষ ৫:১২-১৩)। চাপ ও অত্যাচারের সম্মুখে একটি মণ্ডলী হিসাবে তাদের মধ্যে আন্তুরিক সম্পর্ক ও একতা অতন্ত্য গুরুত্বপূ্র্ণ।
পৌল তার চিঠির শেষে কিছু ব্যবহারিক নির্দেশনা দেন যেন বিশ্বাসীরা বৃদ্ধি পেতে থাকে (১ থিষ ৫:১২-২২, ৫:২৫): “ভাইয়েরা, আমরা তোমাদের এই উপদেশ দিচ্ছি-যারা অলস তাদের সাবধান কোরো; যাদের সাহস নেই তাদের সাহস দিয়ো; যারা দুর্বল তাদের সাহায্য কোরো এবং সকলকে ধৈর্যের সংগে সহ্য কোরো। দেখো, অন্যায়ের বদলে কেউ যেন অন্যায় না করে। তোমরা সব সময় একে অন্যের, এমন কি, অন্য সকলের মংগল করবার চেষ্টা কোরো। সব সময় আনন্দিত থেকো, সব সময় প্রার্থনা কোরো, আর সব অবস্থার মধ্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ো; কারণ খ্রীষ্ট যীশুর মধ্য দিয়ে তোমাদের জন্য তা-ই ঈশ্বরের ইচ্ছা। পবিত্র আত্মাকে নিভিয়ে ফেলো না। যাঁরা নবী হিসাবে ঈশ্বরের বাক্য বলেন তাঁদের কথা তুচ্ছ কোরো না, বরং সব কিছু যাচাই করে দেখো। যা ভাল তা ধরে রেখো, আর সব রকম মন্দ থেকে দূরে থেকো … ভাইয়েরা, আমাদের জন্য প্রার্থনা কোরো”।
তার শেষ আশীর্বাদে তিনি চিঠির বড় বিষয়গুলি আর একবার তুলে ধরেন এবং বিশ্বাসীদের নিশ্চয়তা দেন যে ঈশ্বর তাদের মধ্যেই এসব প্রয়োজনীয় আচরণ ও মনোভাব সাধন করবেন: “শান্তিদাতা ঈশ্বর নিজেই তোমাদের সম্পূর্ণভাবে পবিত্র করুন, আর আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্ট আসবার সময়ে তোমাদের সম্পূর্ণ দেহ-আত্মা- মন নির্দোষ রাখুন। মনে রেখো, যিনি তোমাদের ডেকেছেন তিনি নির্ভরযোগ্য; তিনি নিশ্চয়ই তা করবেন।” (১ থিষ ৫:২৩-২৪)।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।