প্রেরিত পিতর তার চিঠি “সব বাছাই করা লোক পন্ত, গালাতিয়া, কাপ্পাদকিয়া, এশিয়া ও বিথুনিয়া প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে বিদেশী হিসাবে বাস করছে” তাদের কাছে লেখেন। উল্লিখিত এই জেলাগুলি রোম রাজ্যের এশিয়া মাইনর প্রদেশের মধ্যে বা আধুনিক যুগের তুর্কী দেশের মধ্যে পড়ে।
সম্ভবত তিনি এই চিঠি ৬৪ খ্রীষ্টাব্দে রোম থেকে লেখেন (১ পিতর ৫:১৩), এমন একটি সময়ে যখন মণ্ডলীগুলো ইতিমধ্যে নানা ধরণের স্থানীয় অত্যাচারের সম্মুখীন হচ্ছে। সম্রাট নীরোর বড় ভয়ংকর অত্যাচার যাতে পিতর শহীদ মৃত্যু গ্রহণ করবেন, তা এখনও শুরু হয় নি।
১ পিতর চিঠি অথবা প্রেরিত পুস্তক থেকে তেমন কোন নির্দিষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় না, ঠিক কি ধরণের অত্যাচারের মধ্য দিয়ে পিতরের পাঠকেরা যাচ্ছিল। কিন্তু নতুন নিয়মের বিভিন্ন পুস্তকে আমরা অত্যাচারের সাধারণ ছবি দেখতে পাই: হতে পারে তারা যিহূদীদের থেকে চাপ পায়, যারা প্রায়ই স্থানীয় সরকারকে বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে উস্কিয়ে তুলত। হতে পারে যে পরিবার, ধর্ম বা সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে তারা বিশ্বাসী হয়েছিল, তা থেকে অত্যাচার আসত। বিশ্বাসীদের চাপ দেওয়া এবং হাস্যকর বানানো ছিল রোম সমাজের একটি সাধারণ বিষয়, কারণ বিশ্বাসীদের জীবন-যাপন ছিল খুব ভিন্ন ধরণের। হতে পারে অনেক দাসও বিশ্বাসী হয়েছিল যারা মনিবদের কাছে অনেক বার অত্যাচারিত হত।
ঈশ্বরের অদৃশ্য বাস্তবতা, মহান চিরস্থায়ী আশা এবং নিখুঁত, অপরিবর্তনশীল সম্পত্তি যা যীশু বিশ্বাসীদের জন্য স্বর্গে জমা করে রেখেছেন, এই বিষয়গুলো পিতর পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেন (১ পিতর ১:৩-৭)। তিনি তাদের দৃষ্টি যীশুর দিকে আকৃষ্ট করেন, যিনি তাদের পরিত্রাণ অর্জন করছিলেন এবং তাদের দেখিয়েছিলেন একটি কষ্টভোগের জীবন কিভাবে ঈশ্বরের আহ্বান হিসাবে গ্রহণ করতে হয় (১ পিতর ২:২১-২৫)। তিনি চান যেন তারা তাদের কষ্টভোগ ঈশ্বরীয় চরিত্র উন্নত করার একটি সুযোগ হিসাবে দেখে।
কষ্টভোগ সহ্য করা হল বিশ্বাসীর জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ, এই বিষয়ে পিতর পাঠকদের নিশ্চয়তা দেন (১ পিতর ৪:১২-১৩)। কষ্টভোগ মানে না যে ঈশ্বর তাদের উপর অসন্তুষ্ট অথবা যে পাপের জন্য তিনি তাদের শাস্তি দিচ্ছেন। বিশ্বাসীরা যে কষ্টভোগ করছে, তার মানে না যে বিষয়টি ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছে। কষ্টভোগ যেমন যীশুর জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ ছিল, ঠিক তেমনি তা বিশ্বাসীদের জীবনেরও একটি স্বাভাবিক অংশ।
পিতর পাঠকদের চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা নিজেদেরকে পরিস্থিতির শিকার হিসাবে না দেখে বরং মনোনীত জাতি বা বাছাই করা বংশ হিসাবে দেখে। তারা একটি পুরোহিত রাজ্য এবং তারা আহ্বান পেয়েছে যেন অন্যদের জন্য শক্তিশালী সাক্ষ্য হয় (১ পিতর ২:৯)। কষ্টভোগে তাদের ভাল মনোভাব হল শক্তিশালী সাক্ষ্য যা মানুষ সহজে অস্বীকার করতে পারবে না। যদি তারা যীশুর মত নম্রতা, স্বনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিশোধ না নেওয়ার একটি মনোভাব দেখায় এবং যদি তারা অত্যাচারীদের সেবা ও মঙ্গল করে, তবে তাদের আদর্শ এমন শক্তিশালী হবে, যা মুখের কথার সাথে তুলনা করা যায় না। পিতর তাদের চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা কষ্টভোগ একটু কম পরিশ্রম বা চেষ্টা না করার অজুহাত হিসাবে ব্যবহার না করে। তার চেয়ে বরং যেন তারা আরো বেশি করে পবিত্রভাবে জীবন-যাপন করে এবং এভাবে যীশুকে গৌরবান্বিত করে (১ পিতর ১:১৩-১৬)। তিনি তাদের সাবধান করেন যে খারাপ ব্যবহারের জন্য শাস্তি পাওয়া হল এমন কষ্টভোগ যাতে ঈশ্বর গৌরব পান না। বরং যারা অনেক নিন্দা পাওয়ার পরেও বিশ্বস্তভাবে সেবা করে, তারাই হল একটি উজ্জ্বল আলোর মত এবং জগতে একটি শক্তিশালী সাক্ষ্য (১ পিতর ২:১৮-২০)।
পিতর মণ্ডলীর নেতাদের চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা খ্রীষ্টের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বাসীদের ভালবাসেন ও সেবা করেন এবং এভাবে যেন মণ্ডলীতে পরস্পরের প্রতি ভালবাসা থাকে। অত্যাচারের সময়ে ভ্রাতৃপ্রেম বিশেষভাবে প্রয়োজন কারণ নতুন বিশ্বাসীদের জন্য মণ্ডলী হল তাদের একমাত্র পরিবার ও আশ্রয়স্থল (১ পিতর ৫:১-৫)।
পিতর পাঠকদের দৃষ্টি ঈশ্বরের দিকে আকৃষ্ট করেন, যিনি “সব দয়া করবার ঈশ্বর” এবং যিনি প্রতিজ্ঞা দিয়েছেন যে “কিছুদিন কষ্টভোগ করবার পরে” তিনি তাদের “তাঁর চিরস্থায়ী মহিমার ভাগী হবার জন্য” ডাকবেন। পিতর তাদের নিশ্চয়তা দেন যে “ঈশ্বর নিজেই তোমাদের পূর্ণ করবেন ও স্থির রাখবেন, শক্তি দেবেন এবং শক্ত ভিত্তির উপর তোমাদের দাঁড় করাবেন” (১ পিতর ৫:১১)।
চিঠির লেখক
প্রেরিত পিতর ১ পিতর চিঠির লেখক হিসাবে নিজের পরিচয় দেন (১ পিতর ১:১)। তিনি নিজেকে প্রাচীনদের মধ্যে একজন বলেন (কেরী) এবং “খ্রীষ্টের যে মহিমা প্রকাশিত হবে তার ভাগী”। কথাটি সব বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তাই পিতর নিজেকে মণ্ডলীর একজন সাধারণ বিশ্বাসী হিসাবে পরিচয় দেন (১ পিতর ৫:১)। একই পদে তিনি নিজেকে “খ্রীষ্টের দুঃখভোগের সাক্ষী”ও বলেন, এমন একজন যার কথা বিশ্বাসযোগ্য, যিনি নিজের চোখে যীশুর গ্রেফতার, মামলা, মৃত্যু ও পুরুত্থান দেখেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন কিভাবে যীশু “লোকে তাঁকে যখন অপমান করেছে তখন তিনি তাদের ফিরে অপমান করেন নি, আর কষ্টভোগের সময় প্রতিশোধ নেবার ভয়ও দেখান নি” এবং তিনি তার পাঠকদের যীশুর মত আচরণ করতে উৎসাহিত করেন (১ পিতর ২:২৩)।
তিনি সীলবানকে তার সহ-লেখক বা সাহায্যকারী লেখক হিসাবে উল্লেখ করেন এবং তার সুপারিশ দেন (১ পিতর ৫:১২)। গালাতীয়া ও এশিয়া দেশের মণ্ডলীগুলো সীলবানকে চিনে কারণ তিনি ছিলেন পৌলের দ্বিতীয় প্রচার যাত্রা থেকে তার একজন সহকর্মী (৫০ খ্রীঃ, প্রেরিত ১৫:৪০ পদ থেকে)।
পিতরের প্রথম চিঠিতে ব্যবহৃত গ্রীক ভাষা হল বেশ সাধারণ গ্রীক, কিন্তু তার দ্বিতীয় চিঠিতে ব্যবহৃত গ্রীক ভাষা অনেক উঁচু মানের গ্রীক। এই কারণে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে যে পিতর দুইটি চিঠির লেখক নাও হতে পারেন। কিন্তু এই সন্দেহ করার প্রয়োজন নেই কারণ পিতর তার প্রথম চিঠিতে যে একজন সাহায্যকারী লেখককে ব্যবহার করেছেন, তা উল্লেখ করেন। হয়তোবা তিনি তার দ্বিতীয় চিঠির জন্য আরো দক্ষ অন্য একজন সাহায্যকারী লেখক ব্যবহার করেছেন। পৌলও দুইবার উল্লেখ করেন যে তিনি সাহায্যকারী লেখকদের ব্যবহার করতেন (রোমীয় ১৬:২২, গালা ৬:১১)।
তা ছাড়া পিতরের উভয় প্রথম ও দ্বিতীয় চিঠিতে বেশ কিছু কম ব্যবহৃত গ্রীক শব্দ পাওয়া যায় যা দ্বারা আরো প্রমাণিত হয় যে আসলে একই লেখক দুটি চিঠি লিখেছেন। দুই চিঠিতে কথাগুলোর মিল বাংলা অনুবাদে তেমন পরিষ্কার দেখা যায় না কিন্তু গ্রীকে শব্দগুলোর হুবহু ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়:
- ১ পিতর ১:৭,১৯ ২ পিতর ১:১ “অমূল্য”, “দাম” precious
- ১ পিতর ২:৯ ২ পিতর ১:৩ “আলাদা করা”, “ভক্তিপূর্ণ জীবন” virtue
- ১ পিতর ৪:১১ ২ পিতর ১:৫ “ঈশ্বর দেওয়া”, “যোগ করা” supply
- ১ পিতর ১:২২ ২ পিতর ১:৭ “বিশ্বাসী ভাই তোমাদের প্রিয়”, “ভাইদের প্রতি ভালাবাসা” love of the brethren
- ১ পিতর ২:১২, ৩:২ ২ পিতর ১:১৬ ”লক্ষ্য করে”, “নিজেদের চোখেই দেখা” eyewitness
- ১ পিতর ১:১৯ ২ পিতর ৩:১৪ “নির্দোষ ও নিখুঁত” blemish, spot
তা ছাড়া পিতরের দুইটি চিঠিতে যীশুর দ্বিতীয় আগমনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। যদিও দুইটি চিঠিতে যীশুর দ্বিতীয় আগমনের বর্ণনা একটু ভিন্ন তবুও অনেক সমান্তরাল চিন্তা পাওয়া যায়:
১ পিতর |
২ পিতর |
বিশ্বাসীরা কষ্ট ও অত্যাচারের কারণে কঠিন পরিস্থিতিতে তবুও আশা ধরে রাখ! |
বিশ্বাসীরা ভ্রান্ত শিক্ষার কারণে কঠিন পরিস্থিতিতে আছে তবুও সত্য জেন ও পবিত্র জীবন কর! |
সান্ত্বনা, নিশ্চয়তা ও উৎসাহ দান, ক্রুশ বহন করার চ্যালেঞ্জ |
সাবধানবাণী, চ্যালেঞ্জ, মন্দের বিচার হবে তার নিশ্চয়তা |
যীশুর পুনরুত্থান |
যীশুর দ্বিতীয় আগমন |
এ্যাপোকালিপ্স = হঠাৎ করা পর্দা সরানো যাতে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে অদৃশ্য হলেও ঈশ্বর সব সময় বিশ্বস্তভাবে বিশ্বাসীদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন, কষ্টভোগেও তাদের সঙ্গে আছেন। |
পারোসিয়া = হঠাৎ করে উপস্থিত রাজা তার নাগরিকদের বা দাসদের মধ্যে এসে দেখেন কে বিশ্বস্ত বা কে বিশ্বস্ত নয়। |
১ পিতর ১:৫, ৪:৭ শেষ সময়ে |
২ পিতর ৩:৩, ১০ শেষকালে |
১ পিতর ১:১০–১২ নবীরা আগে বলে গেছেন |
২ পিতর ১:১০, ৩:২ নবীরা যা বলেছেন |
১ পিতর ৩:২০ নোহের জাহাজ দ্বারা রক্ষা |
২ পিতর ২:৫, ৩:৬ নোহের সময়ে প্লাবন বা বন্যা |
১ পিতর ২:১৬ স্বাধীন লোক হিসাবে জীবন কাটাও |
২ পিতর ২:১৯ স্বাধীনতার প্রতিজ্ঞা |
১ পিতর ২:৯ ঈশ্বরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভাল স্বভাব–চরিত্রের ও সৎ কাজের লোক হওয়া |
২ পিতর ১:৩ ঈশ্বরের শক্তি যোগান পেয়ে ভাল স্বভাব–চরিত্রের ও সৎ কাজের লোক হওয়া |
১ পিতর ৪:৫,১৩,১৭ যীশুর আসা (‘পারোসিয়া’) উভয় বিচার এবং আনন্দ নিয়ে আসে |
২ পিতর ৩:৭,১৩ যীশুর আসা (‘পারোসিয়া’) উভয় বিচার এবং আনন্দ নিয়ে আসে |
১ পিতর ৪:৭ যীশুর দ্বিতীয় আগমনের নিশ্চয়তার আলোকে পবিত্র জীবন কাটাও! |
২ পিতর ৩:১১,১৪ যীশুর দ্বিতীয় আগমনের নিশ্চয়তার আলোকে পবিত্র জীবন কাটাও! |
পিতরের প্রথম চিঠির পাঠকেরা এবং তাদের পরিস্থিতি
পিতর তার পাঠকদের পরিচয় এভাবে দেন: ”ঈশ্বরের যে সব বাছাই করা লোক পন্ত, গালাতিয়া, কাপ্পাদকিয়া, এশিয়া ও বিথুনিয়া প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে বিদেশী হিসাবে বাস করছে, তাদের কাছে আমি যীশু খ্রীষ্টের প্রেরিত্ পিতর এই চিঠি লিখছি। পিতা ঈশ্বর তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে তোমাদের বেছে নিয়েছেন, আর তাঁরই উদ্দেশ্যে পবিত্র আত্মা তোমাদের আলাদা করে রেখেছেন। এর উদ্দেশ্য হল, যাতে তোমরা যীশু খ্রীষ্টের বাধ্য হও আর তাঁর রক্ত ছিটানোর দ্বারা তোমাদের শুচি করা হয়” (১ পিতর ১:১-২)। নতুন নিয়মে বিভিন্ন পদে বিশ্বাসীদের “বিদেশী” বলা হয় কারণ তারা এই জগতের লোক নয় বরং ঈশ্বরের রাজ্যের নাগরিক (ফিলিপীয় ৩:২০)। পিতর তাদেরকে “ছড়িয়ে পড়ে বাস” করা লোক হিসাবে বর্ণনা করেন, এমন একটি কথা যা প্রেরিত ৮:১ পদ স্মরণ করিয়ে দেয় যেখানে অত্যাচারের কারণে বিশ্বাসীরা ছড়িয়ে পড়েছিল। যাকোব তার চিঠির শুরুতে বিশ্বাসীদের একই ধরণের কথা দ্বারা বর্ণনা করেন (যাকোব ১:১)।
পিতর যে এলাগুলো উল্লেখ করেন সেগুলো সব রোম সাম্রাজ্যের এশিয়া মাইনর প্রদেশের মধ্যে পড়ে, বর্তমান তুর্কী দেশে। এলাকাগুলো উল্লেখের একটি ভৌগলিক ধারাবাহিকতা আছে যাতে কমবেশি একটি চক্র বুঝায়। হতে পারে পিতরের চিঠি খোলা ভ্রাম্যমান চিঠি হিসাবে একটির পর একটি মণ্ডলীতে পড়ানো হত।
হতে পারে পিতর এই সব মণ্ডলীতে এক সময় বেড়াতে গিয়েছিলেন। হয়তো তিনি কয়েকটি মণ্ডলী স্থাপনও করেছিলেন তবুও চিঠিতে স্থাপনকারীদের “তারা” দিয়ে বুঝানো হয়: “যাঁরা তোমাদের কাছে খ্রীষ্টের বিষয়ে সুখবর প্রচার করেছেন” (১ পিতর ১:১২)। পৌল কিছু বছর আগে গালাতীয়া (প্রেরিত ১৩-১৪) এবং এশিয়া এলাকায় (প্রেরিত ১৯:১০) কায়েকটি মণ্ডলী স্থাপন করেছিলেন কিন্তু তার পাশাপাশি বেশ কয়েকজন স্থানীয় বিশ্বাসীরাও মণ্ডলী স্থাপন করেছিলেন, যেমন ইপাফ্রা (কল ১:৬)। এশিয়া মাইনর প্রদেশের অধিকাংশ লোক ছিল দেবতাপূজারী পরজাতি (১ পিতর ২:১০, ৪:৩-৪, ৩:৩) কিন্তু অনেক শহরে ছোট দল হিসাবে যিহূদীরাও বাস করত। পিতর পুরাতন নিয়মের উদ্ধৃতি, রূপক বা চিন্তা ব্যবহার করেন, যেমন “নির্দোষ ও নিখুঁত মেষ-শিশু” (১ পিতর ১:১৯), “তাঁর রক্ত ছিটানোর দ্বারা … শুচি” (১ পিতর ১:২) এবং “কোণের ভিত্তির পাথর” (১ পিতর ২:৬)। পিতর বেশ কয়েকজন পুরাতন নিয়মের ব্যক্তিদেরও উল্লেখ করেন যেমন ভাববাদীরা (১ পিতর ১:১০-১১), অব্রাহাম ও সারা (১ পিতর ৩:৬) এবং নোহ (১ পিতর ৩:৯-২০)।
চিঠি লেখার তারিখ ও স্থান
চিঠির শেষে পিতর “তোমাদের সংগে যাদের বেছে নিয়েছেন বাবিলের সেই মণ্ডলীর” লোকদের উল্লেখ করেন এবং মার্ক থেকে সুভেচ্ছা পাঠান (১ পিতর ৫:১৩)। মণ্ডলীর আদিপিতাদের লেখা থেকে পাওয়া যায় যে মার্ক রোম শহরে পিতরের সহকর্মী ও অনুবাদক কাজ করতেন। পুরাতন নিয়মের ‘বাবিল শহর’ অত্যাচারী ও মন্দ শহরের রূপক হয়ে দাঁড়ায় এবং পিতর এখানে ভৌগলিক বাবিলকে বুঝান না বরং অত্যাচারী রোম শহর বা রোম সাম্রাজ্যকে বুঝান (যেমন প্রকাশিত ১৭:৯ ও ১৮:২ পদেও)। মণ্ডলীর আদিপিতা ক্লীমেন্ত যিনি ৮৫-৯৭ খ্রীষ্টাব্দে রোম শহরের মণ্ডলীর অধ্যক্ষ ছিলেন, তিনি তার লেখায় বলেন যে পিতর এবং পৌল উভয় নীরোর অত্যাচারে (৬৪-৬৭ খ্রীঃ) শহীদ হন।
পিতরের জীবন ও চরিত্র
পিতরের ইব্রীয় নাম হল শিমিয়োন, পরে তিনি এই নামের গ্রীক অনুবাদ “শিমোন” ও ব্যবহার করেন। তা ছাড়া যীশু তাকে “পিতর” (গ্রীক) বা “কৈফা” (অরামীয়) বলেন, যার অর্থ হল ‘পাথর’। তার বাবার নাম ছিল যোনা। উভয় বৈৎসৈদা ও কফরনাহূম তার বাড়ী হিসাবে নতুন নিয়মে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবনা বেশি যে একজন যিহূদী ছেলে হিসাবে তিনি অক্ষর পড়তে ও লিখতে জানতেন কিন্তু তিনি উঁচু শিক্ষিত ছিলেন না। গালীলে বেশ কিছু অযিহূদীরাও বাস করত বলে পিতর হয়তো কিছুটা গ্রীক ভাষাও বুঝতেন। তিনি পেশায় জেলে এবং সিবদিয়ের ছেলে যোহন ও যাকোবের সঙ্গে মাছের ব্যবসায় করতেন।
পিতরের ভাই আন্দ্রিয় প্রথমে ছিলেন বাপ্তিস্মদাতা যোহনের শিষ্য এবং তিনিই পিতরকে যীশুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এক রাত নিষ্ফল পরিশ্রম এবং যীশুর নির্দেশে মাছ ধরায় সফল হওয়ার পরে পিতর যীশুর আহ্বান সাড়া দিয়ে মানুষ-ধরা জেলে হয়ে যান।
যীশু তাকে ১২জন প্রেরিতদের মধ্যে একজন একজন প্রেরিত হিসাবে নিযুক্ত করেন। যীশু পিতর, যাকোব ও যোহনকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সময়ে উপস্থিত রাখেন: যায়ীরের মেয়েকে জীবন ফিরিয়ে দেওয়া, রূপান্তর, জৈতুন পাহাড়ে যীশুর ভবিষ্যদ্বাণী ও গেৎশিমানী বাগানে প্রার্থনার সময়ে।
পিতর মুহূর্তের লোক, মতামত প্রকাশের লোক, চিন্তা না করে কাজ করা ও কথা বলে ফেলার লোক। পিতর সেই লোক যিনি যীশুকে তাকে জলের উপর হাটতে আদেশ দিতে বলেন। যীশুর রূপান্তরের সময়ে তিনিই না বুঝে যীশু, মোশি এ এলিয়ের জন্য তিনটি ঘর তৈরি করার প্রস্তাব দেন। তিনি অনেক বার ১২জন প্রেরিতদের পক্ষ হয়ে কথা বলেন এবং তিনি যে প্রশ্ন করেন বা কথা বলেন, হতে পারে অন্য প্রেরিতদেরও সেই একই প্রশ্ন বা কথা ছিল।
পিতর যীশুকে মশীহ বা খ্রীষ্ট হিসাবে স্বীকার করেন। এই বিষয় চারটি সুসমাচারেই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে উল্লিখিত। কিন্তু পরে তিনি যীশুকে অত্যাচার ও কষ্টভোগের পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। তিনি সে শিষ্য যিনি মরা ডুমুর গাছ লক্ষ্য করে বিষয়টি যীশুর কাছে তুলে ধরেন। তিনি বড় করে বলেন যে অন্যরা যীশুকে অস্বীকার করলেও তিনি কখনওই তাকে অস্বীকার করবেন না বরং তার সঙ্গে মারা যেতেও রাজি। যীশু যখন তার পা ধুয়ে দিতে চান তখন পিতর তা গ্রহণ করতে অসম্মত হন। যীশুকে গ্রেফতারের সময়ে তোলয়ার তিনি দিয়ে মহাপুরোহিতের একজন দাসের কান কেটে ফেলেন। তিনি যীশুর পিছনে পিছনে মহাপুরোহিতের বাড়ীর উঠানে ঢোকেন কিন্তু শেষে তিনি সেখানে যীশুকে তিন বার অস্বীকার করেন।
পুনরুত্থিত যীশু মহিলাদের নির্দেশ দেন বিশেষভাবে পিতরকে বলতে যে তিনি মৃতদের থেকে উঠেছেন। পিতর দৌঁড়িয়ে যীশুর কবর দেখতে যান এবং সেখানে খালি কাপড়গুলো ছাড়া আর কিছু দেখতে পান না। এর পরে যীশু পিতরের সঙ্গে দেখা করেন এবং আরো দেখা করেন গালীল সাগরে যখন যীশু তাকে তিন বার জিজ্ঞাসা করেন তিনি তাঁকে ভালবাসেন কিনা এবং তিন বার তাঁর মেষদের চড়াতে বলেন। এভাবে যীশু পিতরের পালকীয় ভূমিকা ও মণ্ডলীর উপরে তার নেতৃত্ব পুনরায় স্থাপন করেন। শেষে যীশু পিতরের বন্ধন ও মৃত্যুর বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী দেন।
যীশুর স্বর্গারোহনের পরে ১২জন প্রেরিতদের তালিকায় পিতরের নাম প্রথম স্থানে পাওয়া যায় এবং তিনি শিষ্যদের নেতা হিসাবে ভূমিকা পালন করেন, যেমন যখন শিষ্যরা ইষ্কারিয়োতীয় যিহূদার পরিবর্তে মত্ততিয়কে বেছে নেন। পবিত্র আত্মা সবার উপর আসার পরে পিতর দাঁড়িয়ে প্রচার করেন এবং শ্রোতাদের বুঝিয়ে দেন কি ঘটেছে। পিতর এবং যোহন উপাসনা ঘরের ফটকে একজন পঙ্গুকে সুস্থ করেন এবং আবার লোকদের কাছে প্রচার করেন। ধর্মীয় নেতারা বিরক্ত হয়ে পিতর ও যোহনকে গ্রেফতার করে তাদেরকে মহাপুরোহিতের সামনে দাঁড় করান, যেখানে আবারও পিতর দুইজনের পক্ষে কথা বলেন। পিতর ও যোহনের সাহস দেখে নেতারা অবাক হয়ে যান। তারা তাদের প্রচার না করার আদেশ দিয়ে ছেড়ে দেন কিন্তু পিতর ও যোহন উত্তরে তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বলেন যে তারা মানুষের চেয়ে ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য হতে থাকবেন।
শিষ্যদের নেতা হিসাবে পিতর অননিয় ও সাফীরাকে ধমক দেন এবং মণ্ডলীর শাসন ব্যবস্থা স্থাপন করেন। পিতরেরই ছায়া রোগীদের উপর পড়লে তারা সুস্থ হয়ে যায়। তাকে নতুন করে গ্রেফতার, আশ্চর্যভাবে মুক্ত এবং পুনরায় গ্রেফতার করা হয়, মার দেওয়া হয় এবং তিনি রব্বি গমলিয়েলের পরামর্শ দ্বারা মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহায় পান।
ফিলিপ যখন শমরিয়ায় পরিচর্যা করেন পিতর ও যোহনকে নেতা বলে যিরূশালেম থেকে সেখানে পাঠানো হয়। তারা লোকদের জন্য প্রার্থনা করেন যেন তারা পবিত্র আত্মা পায়।
হতে পারে পরে যীশুর ভাই যাকোব যিরূশালেম মণ্ডলীর নেতা হয়ে যান। ফলে পিতর প্যালেষ্টাইনের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার জন্য সময় পান। লুদ্দা শহরে তিনি ঐনিয় নামে একজন পঙ্গুকে সুস্থ করেন। যাফোতে তিনি টাবিথাকে মৃত্যু থেকে উঠিয়ে দেন।
পরে পিতর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দর্শন দেখেন যার অর্থ হল যে ঈশ্বর পরজাতিদের গ্রহণ করেছেন। তিনি রোমীয় শতসেনাপতি কর্ণীলিয়ের বাড়িতে যান এবং সেখানে সুসমাচার প্রচার করেন। কর্ণীলিয় ও তার পরিবার পরজাতি হিসাবে প্রথম তারা পরিত্রাণ ও পবিত্র আত্মা লাভ করেন। পিতর যিরূশালেমে ফিরে এসে এই অসাধারণ নতুন ঘটনা সবাইকে বুঝিয়ে বলেন। রাজা হেরোদ হাত বাড়িয় যোহনের ভাই যাকোবকে মেরে ফেলার আদেশ দেন। যিহূদীরা তাতে খুশি হয় বলে তিনি পিতরকেও মেরে ফেলার জন্য গ্রেফতার করেন। কিন্তু ঈশ্বর একটি স্বর্গদূতের মাধ্যমে পিতরকে জেল থেকে মুক্ত করেন। বিশ্বাসীরা পিতরের মুক্তির জন্য প্রার্থনা করছিল এবং তারা মুক্ত পিতরকে দেখে অত্যন্ত অবাক ও আনন্দিত হয়।
পৌলের মন পরিবর্তনের পরে তিনি যিরূশালেমে এসে পিতর ও যাকোবের সঙ্গে দেখা করেন। সেই সময় যাকোব, পিতর ও যোহনকে “মণ্ডলীর স্তম্ভ” হিসাবে বর্ণনা করা হয়। যিরূশালেমের নেতারা চিহ্নিত রাখেন যে পৌলের আহ্বান প্রাথমিকভাবে অযিহূদীদের কাছে যেমন তাদের আহ্বান প্রাথমিকভাবে যিহূদীদের কাছে।
বার্ণবা ও পৌলের নেতৃত্বে চালিত আন্তিয়খিয়া মণ্ডলীতে পিতর এক দিন বেড়াতে আসেন এবং অযিহূদী বিশ্বাসীদের সাথে মেলামেশা করেন। যখন যিরূশালেম থেকে যিহূদী বিশ্বাসীরা আসে যারা সুন্নত না করা অযিহূদী বিশ্বাসীদের সাথে মিশতে সমস্যা মনে করে তখন পিতরও তাদের সাথে সহভাগিতা করা বাদ দেন। পৌল পিতরকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেন যে তার আচরণে সুসমাচারের সাথে মিল নেই। বোধ হয় যে পিতর পৌলের সংশোধন মেনে নেন এবং এই বিষয়ে মন ফিরান কারণ কিছু দিন পরে যখন এই তর্কের বিষয়ে যিরূশালেমে প্রেরিতদের সভা হয় তখন পিতর পৌলকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করেন। সভার সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যে অযিহূদীদের উপর যিহূদী আইন-কানুন পালন করার ভার দেওয়া ঠিক নয় – এই সিদ্ধান্তে পৌছানোর জন্য পিতর একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেন।
সম্ভবত পিতর বিভিন্ন প্রচার যাত্রায় বের হন, যেমন এশিয়া মাইনর এলাকায় এবং করিন্থ শহরে। পিতর যে রোম শহরের মণ্ডলীর স্থাপনকারী, তার কোন প্রমাণ নেই কিন্তু পিতর অবশ্যই তার জীবনের শেষদিকে রোম শহরে আসেন। তিনি রোম থেকে তার প্রথম চিঠি এবং পরে নীরোর অত্যাচার শুরু হওয়ার সময় তার দ্বিতীয় চিঠি লেখেন। মণ্ডলীর ইতিহাস অনুসারে পিতরকে নীরোর অত্যাচারে ক্রুশে দিয়ে হত্যা করা হয়। পিতর বলেন যে যীশুর মত মারা যাওয়া হল অতি সম্মানের বিষয় তাই তিনি অনুরোধ করেন যেন তাকে উল্টাভাবে ক্রুশে দেওয়া হয়। একই সময়ে তার স্ত্রীও শহীদ হন।
পিতর তার জীবনের শুরুতে রোম রাজ্যের শেষ প্রান্তের এলাকায় একজন অর্ধশিক্ষিত মৎসজীবী ছিলেন। যীশুর আহ্বান সাড়া দিয়ে এবং বিশ্বস্ত ও বাধ্য জীবন-যাপনের মাধ্যমে তিনি এমন একজন ব্যক্তিতে পরিণত হন যিনি খ্রিষ্টান মণ্ডলী মানে একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের স্তম্ভ। তিনি তার জীবনের শেষে একজন অতিপ্রভাবশালী নেতা হয়ে যান যিনি গ্রীক ভাষায় এমন লোকদের কাছে চিঠি লেখেন যা তিনি আগে জানতেন না যে পৃথিবীতে আছে। তার সেই লেখাগুলো ঈশ্বরের অধিকারগত বাক্য হিসাবে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে কোটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত করছে।
পিতার যে নির্ভুল, তা নয়। তাই পিতরের পরের কোন পোপেরও নির্ভুল হতে হবে, তা নয়। নতুন নিয়মে পিতরের বেশ কয়েকটি ভুল আচরণ ও কথা উল্লিখিত, যীশুর সাথে ঘুরার সময় এবং পরে মণ্ডলীর নেতা হিসাবেও। যখন পৌল তাকে তার ভুল দেখান, তিনি সংশোধন মেনে নেন, সত্যের সাথে এবং পৌলের সাথে একমত হন কারণ পৌল ঠিক বলেছিলেন। নেতাদের যে নির্ভুল হতে হবে, তা না কিন্তু নম্রতা একজন নেতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঐতিহাসিক পরিস্থিতি: স্থানীয় অত্যাচার
প্রথম যখন মণ্ডলী প্রথম স্থাপিত হয় তখন রোমীয়রা মণ্ডলীকে যিহূদী একটি দল হিসাবে দেখত। যদিও যিহূদীদের কোন জনপ্রিয়তা ছিল না রোমীয়রা তাদেরকে রোম রাজ্যের একটি ধর্ম হিসাবে চিহ্নিত রাখত এবং তাদেরকে কিছু অধিকার দিত। এই সময় রোমীয়রা মণ্ডলীকে যিহূদী একটি দল হিসাবে তেমন হুমকিস্বরূপ মনে করত না। পৌলের প্রচার যাত্রার সময়ে দেখা যায় যে রোম সরকার প্রেরিতদের বিরুদ্ধে শুধু এমন সময়ে কিছু পদক্ষেপ নিত যখন যিহূদীরা (যেমন থিষলনীকীয়া, করিন্থ, স্মূর্ণা ও ফিলাদেলফিয়া শহরে) অথবা ব্যবসাহীরা (যেমন ফিলিপী ও ইফিষ শহরে) বিষয়টি উষ্কিয়ে দিত। মণ্ডলীর প্রথম কয়েক দশকে যিহূদীরা হলেন মণ্ডলীর প্রধান শত্রু।
কিন্তু পরবর্তীতে যখন রোম রাজ্যে সম্রাটকে দেবতা হিসাবে পূজা করা শুরু হয় – এবং শেষে তা দাবি করা হয় – তখন মণ্ডলীর উপর সরকার থেকে চাপ আসতে শুরু করে। বিশ্বাসীদের জীবন-যাপনের ধরণ রোমীয়দের চিন্তা থেকে এত ভিন্ন যে, তারা রোমীয়দের (এবং কিছু সুবিধাকারীদের) চোখে অপ্রিয় হয়ে যায়। ফলে কিছু জায়গায় সীমিত পরিমানে অত্যাচার ঘটে।
যদিও পিতর তার পাঠকদের পরিস্থিতির বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট বর্ণনা করেন না, তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন যে তারা যথেষ্ট কষ্টভোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে: “অবশ্য যদিও কিছুকালের জন্য নানা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে হয়তো এখন তোমাদের দুঃখ পেতে হচ্ছে … এই সব পরীক্ষা আসে যেন তোমাদের বিশ্বাস খাঁটি বলে প্রমাণিত হয়” (১ পিতর ১:৬-৭)। তিনি তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন “এরই জন্য ঈশ্বর তোমাদের ডেকেছেন, কারণ খ্রীষ্ট তোমাদের জন্য কষ্ট ভোগ করে তোমাদের কাছে আদর্শ রেখে গেছেন, যেন তোমরাও তাঁরই মত চল” (১ পিতর ২:২১), “তোমাদের বিবেক পরিষ্কার রেখো, যেন খ্রীষ্টের লোক হিসাবে তোমাদের ভাল চালচলনের যারা নিন্দা করে তারা তোমাদের নিন্দা করেছে বলে লজ্জা পায়” (১ পিতর ৩:১৬) এবং “তোমাদের যে এখন অগ্নি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাতে আশ্চর্য হয়ে মনে কোরো না যে, তোমাদের উপর অদ্ভুত কিছু একটা হচ্ছে। তার চেয়ে বরং তোমরা যে খ্রীষ্টের দুঃখভোগের ভাগ নিচ্ছ তাতে আনন্দিত হও, যেন তাঁর মহিমা যখন প্রকাশিত হবে তখন তোমরা আনন্দে পূর্ণ হও” (১ পিতর ৪:১২-১৩)। তিনি তাদের নির্দেশ দেন: “ঈশ্বরকে যারা জানে না তাদের মধ্যে তোমরা সৎ ভাবে চল যাতে অন্যায়কারী বলে তারা তোমাদের নিন্দা করলেও তোমাদের ভাল কাজগুলো লক্ষ্য করে এবং বিচারের দিনে তোমাদের সেই কাজগুলোর জন্য ঈশ্বরের গৌরব করে” (১ পিতর ২:১২)।
বিশ্বাসীদের যদি নিন্দা বা কষ্টভোগের সম্মুখীন হতে হয় তবে তাদের অন্তরে কি কি প্রশ্ন জাগে?
পিতরের প্রথম চিঠির সবচেয়ে বড় পুনরুক্তি বিষয় হল পাঠকদের কঠিন পরিস্থিত, চ্যালেঞ্জ ও কষ্টভোগ। তারা নিজেদেরকে বিভিন্ন ধরণের চাপের মধ্যে খুঁজে পায়, তাদের বিরুদ্ধে নিন্দা করা হয় এবং হয়তো এমন কি শারীরিক অত্যাচারও চলছে। এই ধরণের ঘটনা যখন ঘটে তখন বিশ্বাসীদের অন্তরে কি কি প্রশ্ন জাগে?
- কেন আমি কষ্ট পাচ্ছি? ঈশ্বরের কি আমাকে নিয়ে রাগান্বিত? আমি কি ভুল করছি? কেন শাস্তি পাচ্ছি? কেন ঈশ্বর আমার কান্না শোনেন না? তিনি আমাকে কি ভুলে গিয়েছেন? পরিত্যাগ করেছেন? আমাকে কি ভালবাসেন না? আমার যত্ন নেন না কেন? কেন আমাকেই এর মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে? একজন ভালবাসার ঈশ্বর এই ঘটনাগুলো কেন ঘটতে দেন? কেন ভাল লোকদের জীবনে খারাপ ঘটনা আসে?
- কেন তিনি আমাকে রক্ষা করেন না? এই বিপদ সরিয়ে দেন না? তার কি কোন ক্ষমতা নেই কিছু করতে? তিনি কি সর্বশক্তিমান নন? তাহলে কেন এইটা ঘটতে দেন? অথবা যদি তার ক্ষমতা নেই এবং আমার জন্য যত্ন নেন না তবে কেন তার জন্য এই সব সহ্য করব? আমি কি মিথ্যা বিশ্বাস করেছি? আমি কি প্রতারিত হয়েছি এবং একটি মিথ্যার উপর নির্ভর করছি?
- যদি এত কষ্টের মধ্যে আছি তবে কিভাবে টিকব? কিভাবে পবিত্র জীবন-যাপন করব যদি এত চাপে আছি? যত ভাল করছি তত ঝামেলা সৃষ্টি, আমার ত্যাগ-স্বীকার ও আত্ম-সমর্পণ আমাকে আরো সংকটে ফেলে। যত কষ্ট করি বা যত পবিত্রভাবে জীবন-যাপন করছি না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না।
পিতর তার চিঠিতে কষ্টভোগ নিয়ে কথা বলেন
পিতর পাঠকদের কষ্টভোগে কিভাবে সাহায্য করেন? প্রথমে তিনি তাদের বলেন কষ্টভোগ যে বিশ্বাসীর জীবন আসবে, তা অবাক লাগার মত কিছু নয়, নিজের দোষ খোঁজার বা অস্থির হওয়ারও কিছু নয়। যখন বিশ্বাসী কষ্টভোগ করে তখন তা ঈশ্বরের ক্ষমতা ও ভালবাসা নিয়ে সন্দেহ করার বিষয় নয় বরং তা হল যীশুর অনুসরণকারী হওয়ার একটি অংশ, কারণ যীশুও কষ্টভোগ করেছিলেন: “তোমরা যে খ্রীষ্টের দুঃখভোগের ভাগ নিচ্ছ তাতে আনন্দিত হও, যেন তাঁর মহিমা যখন প্রকাশিত হবে তখন তোমরা আনন্দে পূর্ণ হও” (১ পিতর ৪:১২-১৩)। পিতর পাঠকদেরকে কষ্টভোগের বিষয়ে আরো বড় একটি দৃষ্টি দেন, তিনি তাদের দেখান যে খ্রীষ্টের কষ্টভোগের অংশীদার হয়ে তারা তাঁর মত হবে এবং তাঁর মহিমার ভাগীও হবে: “এরই জন্য ঈশ্বর তোমাদের ডেকেছেন, কারণ খ্রীষ্ট তোমাদের জন্য কষ্ট ভোগ করে তোমাদের কাছে আদর্শ রেখে গেছেন, যেন তোমরাও তাঁরই মত চল” (১ পিতর ২:২১)। তিনি তাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে কষ্টভোগ হল ক্ষনিক মাত্র: “তোমরা কিছুদিন কষ্টভোগ করবার পরে ঈশ্বর নিজেই তোমাদের পূর্ণ করবেন ও স্থির রাখবেন, শক্তি দেবেন এবং শক্ত ভিত্তির উপর তোমাদের দাঁড় করাবেন” (১ পিতর ৫:১০)। কষ্টভোগের মধ্য দিয়ে তাদের বিশ্বাস আরো শক্তিশালী হবে: “অবশ্য যদিও কিছুকালের জন্য নানা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে হয়তো এখন তোমাদের দুঃখ পেতে হচ্ছে, তবুও উদ্ধার পাবার আশায় তোমাদের মন আনন্দে ভরে উঠছে। এই সব পরীক্ষা আসে যেন তোমাদের বিশ্বাস খাঁটি বলে প্রমাণিত হয়, আর তার ফলে যীশু খ্রীষ্ট প্রকাশিত হবার সময়ে তোমরা প্রশংসা, গৌরব ও সম্মান পাও। যে সোনা ক্ষয় হয়ে যাবে তাকেও আগুনে খাঁটি করে নেওয়া হয়; কিন্তু তোমাদের বিশ্বাসের দাম তো সেই সোনার চেয়ে আরও বেশী” (১ পিতর ১:৬-৭)। তিনি তাদের পরিত্রাণের কথা স্মরণ করিয়ে দেন: “ঈশ্বর তাঁর প্রচুর করুণায় আমাদের নতুন জন্ম দান করেছেন। তার ফলে আমরা একটা জীবন্ত আশ্বাস পেয়েছি, অর্থাৎ ভবিষ্যতে এমন একটা সম্পত্তি পাবার আশ্বাস আমরা পেয়েছি যা কখনও ধ্বংস হবে না, যাতে মন্দ কিছু থাকবে না এবং যা চিরকাল নতুন থাকবে। এই সম্পত্তি তোমাদের জন্য স্বর্গে জমা করা আছে” (১ পিতর ১:৩-৪)।
পিতর পাঠকদের ধন্য বলেন “ঈশ্বরের ইচ্ছামত চলতে গিয়ে যদি তোমাদের কষ্টভোগও করতে হয় তবে তোমরা ধন্য” (১ পিতর ৩:১৪)। তাই কষ্টভোগ হল দোষের বিষয় নয়, লজ্জার বিষয়ও নয় বরং সম্মানের বিষয় “কিন্তু খ্রীষ্টান হিসাবে যদি কেউ কষ্ট ভোগ করে তবে সে লজ্জা না পাক, বরং তার সেই নাম আছে বলে সে ঈশ্বরের গৌরব করুক” (১ পিতর ৪:১৬)। কষ্টভোগের মধ্য দিয়ে তারা অন্য বিশ্বাসীদের সঙ্গে এক হয়: “তোমরা তো জান যে, সারা জগতের মধ্যে তোমাদের বিশ্বাসী ভাইয়েরা একই রকম দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছে” (১ পিতর ৫:৯)।
পিতর তার পাঠকদের প্রশংসা করেন যে তারা কষ্ট হলেও পবিত্র জীবন-যাপন করছে “কিন্তু এখন সেই লোকেরাই দেখে আশ্চর্য হয় যে, তোমরা তাদের সেই ভীষণ উচ্ছঙ্খলতায় আর যোগ দিচ্ছ না, আর সেইজন্য তারা তোমাদের বিরুদ্ধে নিন্দার কথা বলে” (১ পিতর ৪:৪) এবং তিনি তাদেরকে এই পবিত্র জীবন-যাপনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছেন “ঈশ্বরকে যারা জানে না তাদের মধ্যে তোমরা সৎ ভাবে চল যাতে অন্যায়কারী বলে তারা তোমাদের নিন্দা করলেও তোমাদের ভাল কাজগুলো লক্ষ্য করে এবং বিচারের দিনে তোমাদের সেই কাজগুলোর জন্য ঈশ্বরের গৌরব করে” (১ পিতর ২:১২)।
পিতর দুই বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য দেখান যে, পবিত্র জীবন-যাপনের কারণে কষ্ট পাওয়া হল ভাল ব্যাপার কিন্তু খারাপ ব্যবহারের কারণে কষ্ট পাওয়া হল সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার “যদি কেউ অন্যায় ভাবে কষ্ট ভোগ করে এবং ঈশ্বরকে মনে রেখে তা সহ্য করে তবে সে ঈশ্বরের চোখে প্রশংসার যোগ্য। অন্যায় কাজের জন্য মার খেয়ে যদি তোমরা তা সহ্য কর তবে তাতে গৌরব করবার কি আছে? কিন্তু ভাল কাজ করেও যদি তোমরা তার জন্য কষ্ট পেয়ে তা সহ্য কর, তবে সেটাই ঈশ্বরের চোখে প্রশংসার যোগ্য” (১ পিতর ২:১৯-২০, তা ছাড়া ৩:১৭, ৪:১৫)। পিতর তাদেরকে উৎসাহিত করেন (১ পিতর ৩:১৪) এবং তিনি সারাংশে বলেন: “তাহলে ঈশ্বরের ইচ্ছাতে যারা কষ্টভোগ করছে, তারা তাদের বিশ্বস্ত সৃষ্টিকর্তার হাতে নিজেদের তুলে দিক এবং ভাল কাজ করতে থাকুক” (১ পিতর ৪:১৯)। পিতর তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা কষ্টভোগ অজুহাত হিসাবে ব্যবহার না করে, যেন পবিত্র জীবন-যাপনের বা কাজের ক্ষেত্রে মানদণ্ড কমিয়ে না দেয়। বরং তিনি তাদেরকে উৎসাহিত করেন যেন তারা আরো বেশি পবিত্র জীবন-যাপনের উপরে গুরুত্ব দিয়ে যীশুকে গৌরব দেয় (১ পিতর ১:১৩-১৬)।
পিতর পাঠকদের চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা নিজেকে ‘শিকার’ বা ‘বেচারা’ হিসাবে না দেখে বরং মনোন্বিত জাতি ও পুরোহিতদের রাজ্য হিসাবে, যাদের একটি আহ্বান এবং শক্তিশালী সাক্ষ্য আছে (১ পিতর ২:৯)। যদি তারা কষ্টভোগে ভাল মনোভাব দেখায় তবে তা একটি শক্তিশালী সাক্ষ্য যা লোকেরা অস্বীকার করতে পারবে না। যীশু যেমন করেছেন ঠিক সেইভাবে যদি তারা নম্রতার ও স্বনিয়ন্ত্রণের লোক হয়, যারা প্রতিশোধ না নিয়ে বরং অত্যাচারীদের সেবা করতে ও আশীর্বাদ করতে চেষ্টা করে তবে তাদের মনোভাব হল হাজার কথার চেয়ে শক্তিশালী সাক্ষ্য দান। কষ্টভোগের বিষয়ের সাথে এই চিঠির আর একটি বিষয় সম্পর্কিত:
বশীভূত হওয়া বা মেনে নেওয়ার মনোভাব
১ পিতর চিঠিতে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পুনরুক্তি বিষয় আছে: বশীভুত হওয়া, অধীনতা মেনে নেওয়া বা নিজেকে নীচু করা। প্রথমমত পিতর বিশ্বাসীদের ঈশ্বরের অধীনতা মেনে নিতে বলৈন: “সেইজন্য ঈশ্বরের ক্ষমতার সামনে নিজেদের নীচু কর, যেন ঠিক সময়ে তিনি তোমাদের উঁচু করেন” (১ পিতর ৫:৬)। যীশুর কারণে কষ্টভোগ মেনে নেওয়ার সে মনোভাবই হল ঈশ্বরের অধীনতায় থাকা ও তাঁরই পথ গ্রহণ করার একটি চিহ্ন।
তা ছাড়া পিতর সরকারের প্রতি বশীভুত হতে বা নিজেকে সমর্পিত হতে বলেন “তোমরা প্রভুর প্রতি বাধ্য হয়ে মানুষের নিযুক্ত শাসনকর্তাদের অধীনতা স্বীকার কর। সম্রাট সকলের প্রধান বলে তাঁর অধীনে থাক, অন্যায়কারীদের শাস্তি দেবার জন্য এবং যারা ভাল কাজ করে তাদের প্রশংসা করবার জন্য সম্রাট যে শাসনকর্তাদের পাঠান তাঁদেরও অধীনে থাক” (১ পিতর ২:১৩-১৪)। পাঠকদের জন্য তা অবশ্যই চ্যালেঞ্জ কারণ সে সময় যুবক নীরো রোমীয় সম্রাট হিবাবে রাজত্ব শুরু করেছেন এবং হতে পারে বিশ্বাসীদের কষ্টভোগের একটি কারণ হল তার স্বেচ্ছাচারী ও দূর্নীতির জীবন। তারপরেও পিতর বলেন যে মন্দকে দমন এবং আইন শৃঙ্খলা বিস্তার করার সে ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং ঈশ্বর থেকে দেওয়া।
পিতর বিশ্বাসী দাসদের বলেন: “বাড়ীর চাকর-বাকরেরা, তোমরা তোমাদের মনিবদের সম্মান করে তাঁদের অধীনে থাক। যে মনিবেরা ভাল ও দয়ালু কেবল যে তাঁদের অধীনতা স্বীকার করবে তা নয়, কিন্তু যাঁরা কর্কশ ব্যবহার করেন তাঁদেরও অধীনতা স্বীকার কর” (১ পিতর ২:১৮)। তিনি স্ত্রীদের স্বামীদের অধীনতা মেনে নিতে বলেন “সেইভাবে তোমরা যারা স্ত্রী, তোমরা প্রত্যেকে স্বামীর অধীনতা মেনে নাও, যেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঈশ্বরের বাক্যে বিশ্বাস না করলেও তোমাদের চালচলন খ্রীষ্টের দিকে তাদের টানে। এতে তোমাদের একটি কথাও বলতে হবে না, কারণ তারা নিজেরাই তোমাদের পবিত্র জীবন আর ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি দেখতে পাবে” (১ পিতর ৩:১-২)। তা ছাড়া পিতর যুবকদের চ্যালেঞ্জ করেন: “সেইভাবে যুবকেরা, তোমরা প্রধান নেতাদের অধীনে থাক” (১ পিতর ৫:৫)। তাই অধীনতা মেনে নেওয়া হল এই চিঠির একটি পুনরুক্তি বিষয় এবং বিশ্বাসীর জন্য একটি প্রয়োজনীয় মনোভাব।
পিতর আবারও পাঠকদের চ্যালেঞ্জ করেন যেন তারা নিজেকে ‘শিকার’ বা ‘বেচারা’ হিসাবে না দেখে বরং যেন তারা নিজের ভূমিকা ও আহ্বানের গুরুত্ব বুঝে এবং যেন তাদের মনোভাব অন্যদের জন্য একটি শক্তিশালী সাক্ষ্য হয় (১ পিতর ২:৯)। কষ্টভোগে একটি ভাল মনোভাব দেখানোর মত অধীনতা মেনে নেওয়ার মনোভাব দেখানোও হল অন্যদের জন্য একটি শক্তিশালী সাক্ষ্য – নাগরিক, স্ত্রী বা কর্মী হিসাবে হোক। এভাবে অধীনতা মেনে নেওয়া মানে যে ঈশ্বরের উপর নির্ভর করা, যাঁর হাতে সব নেতাদের বা বিষয়ের উপরে অসীম ক্ষমতা আছে এবং যিনি বিশ্বাসীদের জীবনের চুড়ান্ত দেখাশোনাকারী। পিতর চান যেন বিশ্বাসীরা কঠিন পরিস্থিতিতেও অধীনতা মেনে নিয়ে ঈশ্বরকে বা মানুষকে দোষ না দেয়, বরং যেন তারা বর্তমান পরিস্থিতিকে ঈশ্বরের উদ্ধার উপলব্দি করার সুযোগ হিসাবে দেখে – ঈশ্বর নিজেকে প্রমাণিত করবেন! এমন বিশ্বাসীরা যারা কষ্টভোগ নিয়ে ঈশ্বরের দৃষ্টি বুঝে এবং তা ভাল মনোভাবে মেনে নেয়, তারা যে কোন পরিস্থিতি জয়ী হবে।
পবিত্র জীবন-যাপন
পিতর তার চিঠিতে বিশ্বাসীদের পবিত্র জীবন-যাপনের উপর অনেক গুরুত্ব দেন। এমন কি তার চিঠির প্রারম্ভিকা বাক্যে তিনি বিশ্বাসীদের এভাবে চিহ্নিত রাখেন: “পিতা ঈশ্বর তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে তোমাদের বেছে নিয়েছেন, আর তাঁরই উদ্দেশ্যে পবিত্র আত্মা তোমাদের আলাদা করে রেখেছেন। এর উদ্দেশ্য হল, যাতে তোমরা যীশু খ্রীষ্টের বাধ্য হও আর তাঁর রক্ত ছিটানোর দ্বারা তোমাদের শুচি করা হয়” (১ পিতর ১:২)। এই পদে পিতর ত্রিত্ব ঈশ্বরের একটি পরিষ্কার ছবি দেন এবং তা ছাড়া তিনি বুঝান ঈশ্বর বিশ্বাসীদের কি সের জন্য বেছে নিয়েছেন এবং আলাদা করেছেন: যেন তারা বাধ্য ও শুচি জীবন করেন। তিনি তাদের নির্দেশ দেন: “এইজন্য তোমাদের মনকে জাগিয়ে তোল ও নিজেদের দমনে রাখ … ঈশ্বরের বাধ্য সন্তান হিসাবে তোমরা তোমাদের আগেকার মন্দ ইচ্ছা অনুসারে জীবন কাটায়ো না; তখন তো তোমরা ঈশ্বরকে চিনতে না। তার চেয়ে বরং যিনি তোমাদের ডেকেছেন তিনি যেমন পবিত্র, তোমরাও তোমাদের সমস্ত চালচলনে ঠিক তেমনি পবিত্র হও পবিত্র শাস্ত্রে ঈশ্বর বলেছেন, “আমি পবিত্র বলে তোমাদেরও পবিত্র হতে হবে” (১ পিতর ১:১৩-১৬, উদ্ধৃতি করে লেবীয় ২০:২৬)। পিতর দেখান যে পরিত্রাণ এমন কিছু যা তাদের জীবনে ঘটেছে (পাপের ক্ষমা পেয়ে নির্দেষ বলে গ্রহণ), ঘটতে থাকে (বর্তমানে পবিত্র জীবন-যাপন) এবং চুড়ান্তভাবে ঘটবে (যীশুর ভবিষ্যৎ মহিমার ভাগী হওয়া): “এইজন্য অন্যদের ক্ষতি করবার সব রকম ইচ্ছা, সব রকম ছলনা, ভণ্ডামি, হিংসা এবং সব রকম নিন্দার কথাবার্তা তোমাদের অন্তর থেকে দূর করে দাও। এইমাত্র জন্মেছে এমন শিশুর মত তোমাদের আত্মিক বৃদ্ধির জন্য খাঁটি দুধ পেতে তোমরা খুব আগ্রহী হও, যেন তার দ্বারা বেড়ে উঠতে উঠতে তোমরা উদ্ধারের পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে পার” (১ পিতর ২:১-২)। চিঠির বিভিন্ন পদে তিনি তাদের অবিশ্বাসীদের প্রতি চমৎকার ব্যবহার দেখাতে ও পাপ থেকে দূরে থাকতে (যেমন ১ পিতর ৪:১-৬) এবং বিশ্বাসীদের প্রতি ভালবাসা দেখাতে চ্যালেঞ্জ করেন: “আর সবচেয়ে বড় কথা হল, তোমরা একে অন্যকে গভীর ভাবে ভালবেসো, কারণ ভালবাসা অনেক পাপকে ঢেকে রাখে। কোন রকম বিরক্তি প্রকাশ না করে তোমরা একে অন্যকে অতিথি হিসাবে গ্রহণ কর। বিভিন্ন ভাবে প্রকাশিত ঈশ্বরের দয়া পেয়ে যে লোক বিশ্বস্ত ভাবে তা কাজে লাগিয়েছে, সেই রকম লোক হিসাবে তোমরা ঈশ্বরের কাছ থেকে যে যেরকম দান পেয়েছ তা একে অন্যের সেবা করবার জন্য ব্যবহার কর” (১ পিতর ৪:৮-১০)। অত্যাচারের সময়ে পরস্পর্কে ভালবাসা বিশেষভাবে প্রয়োজন কারণ নতুন বিশ্বাসীদের জন্য মণ্ডলী হল তাদের একমাত্র পরিবার ও আশ্রয়স্থল (১ পিতর ৫:১-৫)।
মণ্ডলীর নেতৃত্ব
পিতর মণ্ডলীর নেতাদের উপদেশ দেন যেন তারা রাখাল হিসাবে গুরুত্ব ও আগ্রহের সঙ্গে “ঈশ্বরের যে মেষের দল”কে দেখাশোনা করেন। রাজা দায়ূদ প্রথম রাখাল ছিলেন এবং যীশু নিজেকেও রাখাল হিসাবে বর্ণনা করেছেন (যোহন ১০) বলে ‘রাখাল’ শব্দ বাইবেলে নেতৃত্বের একটি রূপক হিসাবে দাঁড়ায়। পিতর মণ্ডলীর নেতাদের যীশুর কথা স্মরণ করিয়ে দেন যিনি ‘প্রধান রাখাল’। তিনি তাদেরকে সাবধান করেন যেন তাদের নেতৃত্বের পিছনে লোভ বা দমনের উদ্দেশ্য না থাকে (১ পিতর ৫:২-৫)। তিনি যুবকদের মণ্ডলীর নেতাদের অধীনতা মেনে নিতে বলেন কিন্তু তিনি সাথে সবাইকে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নম্রতা দেখাতে বলেন: “ঈশ্বর অহংকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, কিন্তু নম্রদের দয়া করেন।” সেইজন্য ঈশ্বরের ক্ষমতার সামনে নিজেদের নীচু কর, যেন ঠিক সময়ে তিনি তোমাদের উঁচু করেন” (১ পিতর ৫:৫)। দেখা যায় যে ঈশ্বর সব সময় সম্পর্কের দুপাশের ব্যক্তিকে ঈশ্বরীয় ব্যবহার দেখাতে চ্যালেঞ্জ করেন, যেমন এখানে উভয় যুবকদেরকে এবং নেতাদেরকে নম্র হতে বলা হয়েছে।
নিশ্চয়তা দান
পিতর তার পাঠকদেরকে তাদের উঁচু আহ্বানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অনুপ্রেরণা দান করেন: “কিন্তু তোমরা তো “বাছাই করা বংশ হয়েছ; তোমাদের দিয়ে গড়া হয়েছে পুরোহিতদের রাজ্য; তোমরা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে আলাদা করা জাতি ও তাঁর নিজের লোক হয়েছ;” যেন অন্ধকার থেকে যিনি তোমাদের তাঁর আশ্চর্য আলোর মধ্যে ডেকে এনেছেন তোমরা তাঁরই গুণগান কর” (১ পিতর ২:৯, উদ্ধৃতি করে যাত্রা ১৯:৪-৬)। তিনি তাদের চোখ “দয়া করার ঈশ্বর”এর দিকে আকৃষ্ট করছেন যিনি তাদেরকে “কিছুদিন কষ্টভোগ করবার পরে … তাঁর চিরস্থায়ী মহিমার ভাগী” হতে দেবেন (১ পিতর ৫:১০)। পিতর তাদের নিশ্চয়তা দেন যে ঈশ্বর নিজেই তাদের “পূর্ণ করবেন ও স্থির রাখবেন, শক্তি দেবেন এবং শক্ত ভিত্তির উপর … দাঁড় করাবেন” (১ পিতর ৫:১১)।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।