ভ্রান্ত শিক্ষকদের দ্বারা প্রভাবিত কিছু মণ্ডলীগুলির কাছে যোহন এই চিঠি লেখেন যেন তারা নিশ্চয়তা পায় যে তারাই ঈশ্বরের সন্তান এবং অনন্ত জীবনের অধিকারী। যোহন তাদেরকে শিক্ষকের মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে বলেন যেন তারা লক্ষ্য করে শিক্ষক অন্যদের ভালবাসেন ও সেবা করেন কিনা এবং এই ভিত্তিতে যেন তারা তাকে গ্রহণ অথবা অগ্রাহ্য করে।
যদিও ১ যোহন পুস্তকের লেখক তার নাম সরাসরি উল্লেখ করেন না তবে মণ্ডলীর ইতিহাস এবং ব্যবহৃত ভাষার তুলনা দ্বারা পরিষ্কার হয়ে যায় যে প্রেরিত যোহন, সিবদিয়ের পুত্র, এই চিঠি লেখেন। যখন যোহন চিঠিটি লেখেন অন্যান্য সব প্রেরিতরা ইতিমধ্যে শহীদ মৃত্যু গ্রহণ করেছেন এবং যোহন হলেন শুধুমাত্র যীশুর চোখের সাক্ষী যিনি এখনও বেঁচে আছেন।
রোমীয়রা ৭০ খ্রীষ্টাব্দে যিরূশালেম সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এবং যিহূদীদের বাসস্থান (গালীল ও যিহূদা) জোর করে লোকশূণ্য করে ফেলে। কিন্তু মণ্ডলী রোম রাজ্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এবং নানা শহরে বিশ্বাসীরা উপস্থিত, যেমন ইফিষেও, যেখানে মণ্ডলীর ইতিহাস অনুসারে যোহন তার জীবনের শেষ বছরগুলি কাটান। ইফিষ হল এশিয়া মাইনর প্রদেশে এশিয়া এলাকার সদর থানা।
মণ্ডলী বৃদ্ধি পাচ্ছে ও ছড়িয়ে পড়ছে কিন্তু বিভিন্ন ধরণের ভ্রান্ত শিক্ষা নিয়ে লড়াই বাড়ছে। অধিকাংশ ভ্রান্ত শিক্ষা হল নস্টিক ধরণের (gnostic), উভয় যে নস্টিক চিন্তা যা সন্যাসে গুরুত্ব দেয় এবং যে নস্টিক চিন্তা যা লোকদের যা চায় তাই করতে বলে। নস্টিসিসম (gnosticism) হল বিভিন্ন ধর্মের একটি মিশানো শিক্ষা যা দশকের পর দশক, এমন কি শতাব্দীর পরে শতাব্দী ধরে মণ্ডলীকে চ্যালেঞ্জ করে। যোহনের লেখাগুলি এবং মণ্ডলীর আদিপিতাদের মধ্যে অনেকের লেখাগুলি এই ভ্রান্ত শিক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলে।
নস্টিসিসম দাবি করে যে কিছু লোকদের মধ্যে একটি ঐশ্বিক রশ্মি আছে এবং জ্ঞান ও বিশেষ প্রকাশ দ্বারা তারা (এবং শুধুমাত্র তারা) আলোকিত নস্টিক হতে পারে। নস্টিসিসম তাই ছিল একটি শিক্ষা যাতে মাত্র অল্প কিছু বিশেষ লোক ঐশ্বিক বা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। সব কিছু গুপ্ত জ্ঞান বা বিশেষ আত্মিক অভিজ্ঞতার উপরে নির্ভরশীল। নস্টিসিসম আরো দাবি করে যে এই ভাল ঐশ্বিক রশ্মিগুলি হল ঈশ্বর থেকে বের হওয়া আত্মিক টুকরা, যা মানুষের মন্দ দেহে আটকিয়ে পড়ে গেছে। আত্মা ভাল এবং দেহ বা বস্তু জগত খারাপ, এই দ্বিখণ্ডিত চিন্তা হয় সন্যাসকে, না হয় একটি অতি স্বাধীন ভাবকে উৎসাহিত করে। সন্যাস এই উপসংহারে আসে যে এই মন্দ দেহ কঠোর আত্মিক শৃঙ্খলা দ্বারা (যেমন উপবাস বা আত্ম-যন্ত্রণা) বশে আনতে হবে। অতি স্বাধীনভাব এই উপসংহারে আসে যে আত্মা শরীরের চেয়ে এমন শ্রেষ্ঠ যে একজন তার শরীর দ্বারা কি করে, তা আত্মাকে দূষিত করতে পারে না, তাই যে কোন কাজ করা চলবে। নস্টিকদের চিন্তা অনুসারে ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কের জন্য অনুতাপ, ক্ষমা চাওয়া এবং বাধ্য ও পবিত্রভাবে জীবন-যাপন করা প্রয়োজন নয়।
নস্টিসিসম সব কিছু আলাদা করে: ঐশিক আত্মা ও মন্দ দেহ আলাদা বিষয়, জ্ঞান ও জ্ঞানের প্রয়োগ আলাদা বিষয়, ঐশ্বিক হওয়া ও নৈতিক হওয়া আলাদা বিষয়। নস্টিসিসম পরিবর্তে অহংকার, সাধারণ মানুষকে নীচু চোখে দেখা ও তাদের গুরুত্ব অস্বীকার করার একটি মনোভাব তৈরি করে। নস্টিসিসম যীশুকে কি চোখে দেখে? খ্রীষ্ট ছিলেন একটি ঐশ্বিক আত্মা, যা মানুষকে আলোকিত করে তোলার জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন। খ্রীষ্ট-আত্মা বাপ্তিস্মের সময় যীশু নামে একটি সাধারণ মানুষের উপর এসে পৃথিবীতে উপস্থিত থাকে কিন্তু ঐশ্বিক আত্মা হিসাবে সে নিজেকে যীশুর শারীরিক যন্ত্রণা ও মৃত্যু দিয়ে দূষিত না করার জন্য কষ্টভোগের আগে চলে যায়। এই শিক্ষার নাম হল ডোসেটিসিসম (doceticism)। ডোসিটিসিসম অনুসারে যীশু যে পৃথিবীতে এসে মানুষ হয়েছেন, ক্রুশে মারা গেছেন, শারীরিকভাবে পুনরুত্থিত হয়েছেন এবং সম্পূর্ণ সৃষ্টি পুনরুদ্ধার করার জন্য ফিরে আসবেন, তা সব তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এই ভ্রান্ত শিক্ষার বিরুদ্ধে যোহন গুরুত্বের সঙ্গে দাবি করেন যে যীশু উভয় সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বর (যীশু ঈশ্বর, যীশু ঈশ্বরের পুত্র, মশীহ ও যীশু সে অনন্ত জীবন যা ঈশ্বর দেন) এবং একই সাথে যীশু সম্পুর্ণভাবে মানুষ (যীশু মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন ও শারীরিকভাবে পুনরুত্থিত হয়েছেন)। যদি একজন দুইটার মধ্যে যে কোন একটি সত্য অগ্রাহ্য করে (যে যীশু ঈশ্বর এবং যে যীশু মানুষ) তবে সে যীশুকে, সাথে পিতাকে এবং ত্রিত্ব ঈশ্বরকে অস্বীকার করে। যোহন এই ধরণের লোকদের “খ্রীষ্টারী” বা “খ্রীষ্টের শত্রু” বলেন। যোহন এই শব্দ বহুবচনে ব্যবহার করেন এবং তাতে তিনি সে ভ্রান্ত শিক্ষকদের বুঝান যারা এই মুহূর্তে মণ্ডলীতে উল্টাপাল্টা শিক্ষা দেয়।
তার এই সুন্দর চিঠিতে যোহন সব কিছু যুক্ত করেন যা নস্টিকরা আলাদা করতে চায়। তিনি তাঁতের কাজের মত কথা বলেন এবং অনেক অধিকারের সঙ্গে ঘোষণা করেন যে সব কিছু সম্পর্কিত: ঈশ্বরকে জানা মানে ঈশ্বরের আদেশ মানা। যদি একজন তার আদেশ মানে না, সে ঈশ্বরকে জানে না। ঈশ্বরের সঙ্গে সহভাগিতায় থাকা মানে আলোতে চলা, মানে চেতনায় সাড়া দেওয়া, মানে পাপ স্বীকার করা, মানে ক্ষমা পাওয়া মানে পবিত্রভাবে চলা। ঈশ্বরের সঙ্গে সহভাগিতায় থাকা মানে প্রতিবেশীর সঙ্গে সহভাগিতায় থাকা; ঈশ্বরকে ভালবাসা মানেই প্রতিবেশীকে ভালবাসা। জ্ঞান ও জ্ঞানের প্রয়োগ আলাদা করা যায় না। আত্মিক হওয়া ও নৈতিক হওয়া আলাদা করা যায় না, ঈশ্বরের অনুমোদন মাত্র এমন মানুষদের উপর যারা অন্যদের ভালবাসা দেখায়। আলোকিত জীবন হল ব্যবহারিক বিষয়।
১ যোহন চিঠির লেখক
লেখক এই চিঠির শুরুতে তার নামকে সরাসরি উল্লেখ করেন না। কিন্তু মণ্ডলীর আদিপিতাদের লেখাগুলি সর্বসম্মত বলে যে চিঠিটির লেখক হল যোহন, সিবদিয়ের ছেলে, যাকোবের ভাই এবং বারো প্রেরিতদের একজন। আদিপিতা ইরেন্যায়াস (১৪০-২০৩ খ্রীঃ), আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লীমেন্ত, তের্তুল্লিয়ান এবং ওরিগেন সবাই যোহনকে লেখক হিসাবে চিহ্নিত রাখেন।
চিঠি থেকে বুঝা যায় যে লেখক হলেন এমন একজন যিনি হতে পারে শুরু থেকেই যীশুর পরিচর্যা দেখেছেন এবং যিনি সব কিছুর চোখের সাক্ষী: “যিনি ছিলেন, যাঁর মুখের কথা আমরা শুনেছি, যাঁকে নিজেদের চোখে দেখেছি, যাঁকে ভাল করে লক্ষ্য করেছি, যাঁকে নিজেদের হাতে ছুঁয়েছি, এখানে সেই জীবন-বাক্যের কথাই লিখছি” (১ যোহন ১:১-৩)। লেখক পাঠকদের “সন্তানেরা”, আসলে “বাচ্চারা” এমন কি “ছোট বাচ্চারা” বলে ডাকেন (১ যোহন ২:১, ২:১৮)। তাই চিঠির এমন ভাব আছে যে লেখকের বেশি বয়স হয়েছে, তিনি প্রাচীন এবং পরিষ্কার বুঝা যায় যে তিনি অনেক অধিকারের সঙ্গে কথা বলেন।
যোহনের অন্যান্য লেখাগুলিতে (যোহন সুসমাচার, ২ ও ৩ যোহন) যোহন লেখক হিসাবে নিজের পরিচয় যদিও সরাসরি বলেন না তবুও আরো পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেন। যোহনের অন্যান্য লেখাগুলি ও ১ যোহন চিঠির ভাষার ও বিষয়ের বেশ মিল দেখা যায়:
বিষয় বা শব্দ |
যোহন সুসমাচার |
১ যোহন |
২ যোহন |
৩ যোহন |
সত্য |
যো 1:14, যো 8:32, যো 14:6; যো 17:8,17-19 |
1 যো 1:6-8 2:27, 3:18, 4:1-6 |
2 যো 1, 3, 4 |
3 যো 3, 4, 8, 12 |
সত্যের দরুন তোমাদের ভালবাসি |
2 যো 1 |
3 যো 1 |
||
ছেলেমেয়ে সত্যের পথে চলছে |
2 যো 4 |
3 যো 4 |
||
প্রিয় সন্তানেরা (ছোট ছেলেমেয়ে) |
যো 13:33 |
1 যো 2:1, 3:7 |
||
যীশু, স্বর্গস্থ পিতার (শুধুমাত্র) পুত্র |
যো 1:14, 1:34 |
1 যো 2:22-25 |
2 যো 3 |
|
যীশুই খ্রীষ্ট বা মশীহ |
যো 21:31 |
1 যো 2:22 |
||
যীশুই ঈশ্বরের বাক্য / জীবনের বাক্য |
যো 1:1 |
1 যো 1:1 |
||
জীবন, অনন্ত জীবন |
যো 1:4, 3:16, 11:25 |
1 যো 1:2, 3:15 |
||
আলো |
যো 1:4-9 |
1 যো 1:5-7, 2:8-9 |
||
পার্থক্য: আলো – অন্ধকার, ভালবাসা–ঘৃণা, বিশ্বাসী–অবিশ্বাস, সত্য–মিথ্যা / প্রতারণা |
উদাহরণ: যো 1:5, 13:30 |
উদাহরণ: 1 যো 2:27, 1:6-8 |
||
নতুন আদেশ, তারই আদেশ, নতুন আদেশ নয় |
যো 13:3-4, 15:17 |
1 যো 2:7, 3:23 |
2 যো 5 |
|
পরস্পরকে ভালবাস! |
যো 13:34 |
1 যো 3:11 |
2 যো 5 |
|
প্রথম থেকে / শুরুতে / প্রথমেই |
যো 1:1-2 |
1 যো 1:1, 2:7 |
2 যো 5 |
|
খ্রীষ্টে বা তাঁর শিক্ষায় স্থির থাকা |
যো 15:4-10 |
1 যো 2:6, 3:6 |
2 যো 9 |
|
আনন্দ পূর্ণ হবে |
যো 16:24 |
1 যো 1:4 |
2 যো 4,12 |
|
শেষ সময়, এই সময় এসেছে |
যো 5:25 |
1 যো 2:18 |
||
ছলনা, প্রতারণা, মিথ্যা |
1 যো 2:26 |
2 যো 7 |
||
খ্রীষ্টের শত্রু, ছলনাকারী, খ্রীষ্টারী |
1 যো 2:18, 22 |
2 যো 7 |
||
যারা মন্দ করে তারা ঈশ্বরের লোক নয়, ঈশ্বরকে দেখে নি |
1 যো 3:10 |
3 যো 11 |
||
জগত |
যো 17:15-18 |
1 যো 2:15-17, 4:4-5 |
||
অতিথি পারয়ণ হওয়া |
যো 2:1-11 |
2 যো 10-11 |
3 যো 5-8,10 |
|
জগতের উপর জয়লাভ |
যো 16:33 |
1 যো 4:4-5, 5:4-5 |
||
লেখার শেষে লেখক তার লেখার উদ্দেশ্য সারাংশ হিসাবে দেন |
যো 20:30-31 |
1 যো 5:13 1 যো 5:18-20 |
||
শেষ সুভেচ্ছা |
2 যো 12-13 |
3 যো 13-1 |
যোহনের যীবন
যোহন ও তার বড় ভাই যাকোব ছিলেন জেলে, যারা তাদের বাবা সিবদিয়ের সঙ্গে একটি ছোট মাছ ব্যবসা চালাতেন। পিতর ও আন্দ্রিয় ছিলেন তাদের অংশীদার, তারাও ছিলেন কফরনাহূম গ্রামের জেলে। গালীল সাগরের পাড়ে যীশু তাদেরকে আহ্বান দেন যেন তারা তাঁর শিষ্য হন।
যোহন, যাকোব ও পিতর ছিলেন বারো শিষ্যদের মধ্যে তিনজন কিন্তু কিছু বিশেষ মুহূর্তে, যেমন যায়ীরের মেয়ে জীবনের ফিরে আনার বা রূপান্তরের সময়ে যীশু শুধুমাত্র এই তিনজনই নিয়ে যান। যীশু যোহন ও যাকোব “বজ্রধ্বনীর পুত্রেরা” দেন কারণ হতে পারে তারা বেশ আগ্রহের, উত্তেজনার ও মাঝের মধ্যে মাথা গরমের ব্যাক্তি ছিলেন। যখন একটি শমরিয় গ্রাম যীশুকে রাতের বেলা থাকতে দিতে চায় না কখন যোহন ও যাকোব তাদের উপরে স্বর্গের আগুন নামাতে চাচ্ছে (লূক ৯:৫১-৫৬) এবং যখন আর এক সময় একজন লোক যীশুর অনুসরকারী না হলেও তাঁর নামে মন্দ আত্মা তাড়ায় যোহন সে শিষ্য যা তা অপমান বোধ করেন (লূক ৯:৪৯-৫০)। যোহন যীশুর সম্মানের বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী কিন্তু তিনি নিজের পদ-মর্যাদা ও ক্ষমতা নিয়েও চিন্তা করেন।
তা খুব পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পায় একটি ঘটনা যখন যাকোব ও যোহন তাদের মাকে যীশুর কাছে পাঠান যেন তিনি তাদেরই জন্য যীশুর ভবিষ্যৎ রাজ্যে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পদগুলি দাবি করেন (মথি ২০:২০-২৩, মার্ক ১০:৩৫-৪০)। যীশু এই দাবি কিন্তু পূর্ণ করতে প্রতিজ্ঞা দেন না। তবুও তিনি ভবিষ্যদ্বাণী দেন যে যাকোব ও যোহন উভয় তাঁর জন্য কষ্টভোগ করবে।
যীশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থান এবং পতিত্র আত্মা আসার পরে পিতর – এবং তার পাশে যোহন – নতুন স্থাপিত মণ্ডলীতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন (প্রেরিত ৩-৪)। মণ্ডলী স্থাপনের ১৫ বছরের পরে যখন রাজা হেরোদ আগ্রিপ্প-১ মণ্ডলীকে আবারও অত্যাচার করতে লাগলেন তিনি যাকোকে কতল করার আদেশ দেন (প্রেরিত ১২:১)। এভাবে যাকোব বারো প্রেরিতদের মধ্যে প্রথম শহীদ হয়ে যান এবং তার মৃত্যু অবশ্যই যোহনের উপর একটি প্রভাব ফেলেছিল। ওপড় পক্ষে প্রেরিতরা যখন একজন পর একজন শহীদ মৃত্যু গ্রহণ করেন (প্রায় ৫০-৭০ খ্রীষ্টাবদের মধ্যে) তখন শুধুমাত্র যোহন বেঁচে থাকেন এবং শুধুমাত্র থেকে যাওয়া প্রেরিত হিসাবে মণ্ডলীকে নেতৃত্ব দেন। মণ্ডলীর ইতিহাস অনুসারে বেশ কয়েক বার তাকে যন্ত্রণা করা হয় ও তাকে মেরে ফেলার প্রচেষ্টা চলছে কিন্তু প্রত্যেক বার তিনি বেঁচে যান এবং অবশেষে বুড়ো বয়সে একটি সাধারণ মৃত্যু গ্রহণ করেন।
৬৬-৭০ খ্রীষ্টাব্দে যিহূদী এলাকাগুলিতে (গালীল ও যিহূদিয়ায়) সে অতি হিংস্র রোমীয়-যিহূদী যুদ্ধ চলছে যার চুড়ান্ত ফলাফল হিসাবে যিরূশালেম ও ঈশ্বরের উপাসনা ঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় যত যিদূদীরা বেঁচে যায় তারা সে এলাকা ছেড়ে রোম রাজ্যের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পরে। মণ্ডলীর ইতিহাস অনুসারে যোহন এবং তার সাথে যীশুর মা মরিয়ম এশিয়া মাইনরের ইফিষ শহরে চলে এসে বাস করতে শুরু করেন এবং সেখানে তার মৃত্যু পর্যন্ত থাকেন (প্রায় ৯৮ খ্রীঃ)। ইফিষ শহরে তার পরিচর্যার কেন্দ্র হয়ে যায় এবং সেখান থেকে তিনি এশিয়ার এবং হতে পারে সারা এশিয়া মাইনর প্রদেশে মণ্ডলীগুলি দেখাশোনা করেন। হতে পারে তিনি তার চিঠিগুলি (১,২,৩ যোহন), তার সুসমাচার (যোহন) এবং তার প্রকাশিত বাক্য সে এলাকাগুলির জন্যই লেখেন।
এশিয়া মাইনর প্রদেশের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
রোম রাজ্যের এশিয়া মাইনর প্রদেশ ছিল কমবেশি আধুনিক তুর্কী দেশের এলাকা। সেখানে বিভিন্ন জাতির লোক বাস করত যাদের মধ্যে অধিকাংশ গ্রীক ভাষা বলতে পারত এবং গ্রীক দেবতাদের পূজা করত। ৩৩৩ খ্রীষ্টপূর্বে আলেজান্দের এশিয়া মাইনর দখল করার পর থেকে গ্রীক দর্শন ও গ্রীক দেবতাদের পূজা সে এলাখায় শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছে কিন্তু পূর্ব থেকে আসা গুপ্ত ভ্রান্ত দল, যাদুবিদ্যা এবং যিহূদীদের প্রভাবও বুঝা যেত। পঞ্চাশত্তমী-পর্বের দিনে যিরূশালেমে কাপ্পাদকিয়া, পন্ত, এশিয়া, ফরুগিয়া ও পাম্ফুলিয়া থেকে যিহূদী উপস্থিত (প্রেরিত ২:১০) যা সব এশিয়া মাইনের এলাকায় পড়ে। তাই সম্ভাবনা বেশি যে ৩০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে এলাকাটিতে খ্রিষ্টানদের প্রভাব শুরু। ৪৭-৪৮ খ্রীষ্টাব্দে পৌল ও বার্ণবা দক্ষীন গালাতীয়ায় ও পাম্ফুলিয়ায় সুসমাচার প্রচার কেন। ৫২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে প্রিস্কা ও আকিলা ইফিষে পরিচর্যা করেন এবং পৌল তাদের সাথে যোগ দিয়ে ৫৩-৫৬ খ্রীষ্টাব্দে ইফিষ তার পরিচর্যার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করেন। নতুন বিশ্বাসীরা মণ্ডলী স্থাপকে পরিণত হয় (যেমন ইপাফ্রা, কল ১:৭) এবং তাদের দ্বারা মণ্ডলী আর অনেক বৃদ্ধি পায়। প্রেরিত পুস্তকের লেখক এই সময়ের সারাংশ এভাবে দেন “এশিয়া প্রদেশে সবাই প্রভুর বাক্য শুনতে পেল” (প্রেরিত ১৯:৮-১০)।
এশিয়া মাইনর এলাকা পৌলের বেশ কয়েকটি চিঠি পায়: ইফিষীয়, কলসীয়, ফিলীমন, ১ তীমথিয় এবং হতে পারে ২ তীমথিয়,। পিতর তাদের ১ পিতর এবং হতে পারে ২ পিতর লেখেন।
আমাদের তেমন নির্দিষ্ট জ্ঞান নেই ৭০-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে এশিয়া মাইনর এলাকায় কি ঘটে কিন্তু সাধারণভাবে বলা যায় যে:
- মণ্ডলী তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পেতে থাকে।
- মণ্ডলীতে দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের বিশ্বাসী হয়ে উঠে।
- বারো প্রেরিতদের মধ্যে শুধুমাত্র যোহন বেঁচে আছে ।
- মণ্ডলীতে এক নম্বর সমস্যা হয়ে উঠে ভ্রান্ত শিক্ষা।
- রোম রাজ্যে সম্রাট পূজার অনুশীলন বাড়ে। ৮১ খ্রীষ্টাব্দ থেকে নতুন স্রাট ডোমিটিয়ান যখন সারা রোম রাজ্যে তার ব্যক্তির পূজা দাবি করতে শুরু করেন তা মণ্ডলীর জন্য একটি কঠোর চ্যালেঞ্জ হয়ে যায় এবং একটি রাজ্য-ব্যাপী অত্যাচার শুরু হয়।
আমরা নির্দিষ্টভাবে বলতে পারি না যোহন কোন সালে ১ যোহন চিঠি লেখেন কিন্তু চিঠির মূল বিষয় ভ্রান্ত শিক্ষা তবে আমরা অনুমানেক বলতে পারি যে চিঠি ৭০-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে লেখা।
নস্টিসিস্ম – একটি ভ্রান্ত শিক্ষা যা দ্বারা মণ্ডলী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন
নস্টিসিসমের (gnosticism) বর্ণনা
নস্টিসিসম হল একটি মিশানো ভ্রান্ত শিক্ষা যা কিছু শতাব্দী ধরে মণ্ডলীকে খুব হয়রানি করছিল। প্রেরিত যোহন এবং মণ্ডলীর বেশ কয়েকজন আদিপিতাদের অধিকাংশ লেখাগুলো ছিল নস্টিসিসমের বিরুদ্ধে লেখা।
গ্রীক শব্দ ‘নসিস’ (gnosis) থেকে ‘নস্টিসিসম’ শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে। নস্টিসিসমের অনুসরণকারীদের বলা হত ‘নস্টিক’ (gnostic)। ‘নসিস’ শব্দের অর্থ হল ‘জ্ঞান’। যদিও নস্টিকদের মধ্যে বিভিন্ন দল ছিল, তাদের সবার এই ক্ষেত্রে মিল ছিল যে তারা জ্ঞানের উপরে খুব গুরুত্ব দিত। তারা ‘জ্ঞান’ বললে বুঝত: ‘গুপ্ত আত্মিক জ্ঞান, যা দ্বারা পরিত্রাণ পাওয়া যায়’।
নস্টিসিসম খুব গুরুত্বের সঙ্গে দাবি করত যে বস্তু জগত ও আত্মিক জগত সম্পূর্ণ আলাদা অর্থাৎ – বস্তু জগত মন্দ এবং আত্মিক জগত ভাল। তাই মানুষ বাস করে একটি দ্বিখন্ডিত বাস্তবতায়।
নস্টিসিসম আবার দাবি করত যে ‘সর্বোচ্চ কর্তা’ বলে কেউ আছেন যিনি সম্পূর্ণ ভাল এবং ‘আত্মা মাত্র’ – তাই খাঁটি আত্মা হিসাবে তিনি এই মন্দ বস্তু জগত থেকে এত দূরে ও এত আলাদা যে তার বস্তু জগতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোন জ্ঞানও নেই। এই কর্তার কোন ব্যক্তিত্ব নেই, তাকে জানা যায় না, চেনাও যায় না। নস্টিক চিন্তায় ‘জানা’ মানে ‘দমন করা’। সর্বোচ্চ কর্তাকে কেউ দমন করতে পারে না বলে কেউ তাকে জানতেও সক্ষম হয় না।
কিন্তু তা যদি হয়, এই বস্তু জগত কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? মন্দ কিভাবে তৈরি হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে নস্টিসিসম একটি খুব জটিল ব্যাখ্যা দেয় – সর্বোচ্চ কর্তা থেকে আত্মিক অগ্নিকণা বা রশ্মির মত কিছু বের হতে থাকে। নস্টিকেরা এই অগ্নিকণাগুলো বা রশ্মিগুলোকে ‘এ্যায়োন’ (aeon) বলে। সব এ্যায়োনদের একসাথে ‘প্লেরোমা’ (pleroma) বলা হত, নস্টিকেরা তা সর্বোচ্চ কর্তার পূর্ণতা হিসাবে মনে করত। নস্টিক চিন্তা অনুসারে এই অগ্নিকণাগুলো ভাল, কিন্তু সর্বোচ্চ কর্তার মত বেশি ভাল নয়, অর্থাৎ খুব খাঁটি রশ্মিগুলোর পাশাপাশি তুলনামূলক কম খাঁটি ধরণের রশ্মিও আছে, এমন কি কিছু মন্দ রশ্মিগুলোও পাওয়া যেত।
নস্টিসিসম বলে যে এই মন্দ রশ্মিগুলোর মধ্যে একজনই সর্বোচ্চ কর্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে দূর্ঘটনায় বস্তু জগত সৃষ্টি করে ফেলেছিল। কিছু নস্টিক শিক্ষক বলত যে বাইবেলের সৃষ্টিকর্তাই সেই মন্দ রশ্মি বা ‘এ্যায়োন’। তাই নস্টিকেরা পুরাতন নিয়ম খুব নিচু চোখে দেখত যদিও তারা নতুন নিয়ম থেকে বিভিন্ন চিন্তা গ্রহণ করত।
নস্টিসিসম আরো বলত যে প্লেরোমার মধ্য থেকে কিছু রশ্মিগুলো মন্দ বস্তুর মধ্যে আটকিয়ে পড়েছিল, এমন কি কিছু মানুষের দেহের মধ্যে আটকিয়ে পড়েছিল। তাই নস্টিসিসম বলে যে তিন ধরণের মানুষ আছে। তা হল:
- নস্টিক মানুষ (gnostic) এদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্তার একটি রশ্মি আছে। তারা ‘আত্মিক’ বা ‘আলোকিত’ এবং তাদের আশা আছে যে – জগতে নানা আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করলে মৃত্যুর সময় তারা পুনরায় জন্ম থেকে মুক্ত হয়ে সর্বোচ্চ কর্তার সঙ্গে আবার এক হতে পারবে।
- সাইকিক মানুষ (psychic) এরা কম উন্নত মানুষ, এদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্তার রশ্মি থাকতেও পারে। এদের আলোকিত হওয়ার আশা আছে কিন্তু নিশ্চয়তা নেই। নস্টিকেরা মনে করত যে খ্রিষ্টানরা সাইকিক দলে পড়ে।
- হাইকিক মানুষ (hychic) এরা বস্তু মানুষ মাত্র, এদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্তার কোন রশ্মি নেই। এরা আলোকিত হতে পারে না। তাই এরা পরিত্রাণ পেতে পারে না বরং ধ্বংসে সমর্পিত।
নস্টিসিসম খ্রিষ্টান ধর্ম থেকে এই চিন্তা গ্রহণ করল যে – সেই সর্বোচ্চ কর্তা একজন উদ্ধারকর্তা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন যার মধ্য দিয়ে সাইকিক বা নস্টিক মানুষ প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়। যাদের মধ্যে একটি ঐশ্বিক রশ্মি আছে, তারা জ্ঞান ও আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করার মধ্য দিয়ে আলোকিত হতে সক্ষম হবে এবং তাদের দেহে আটকানো সে ঐশ্বিক রশ্মি মৃত্যুর সময়ে মুক্ত হয়ে সর্বোচ্চ কর্তার সাথে আবার এক হবে।
তাই নস্টিক চিন্তা অনুসারে পাপ-স্বভাব বা খারাপ আচরণ মানুষের প্রধান সমস্যা নয় বরং মানুষের সমস্যা হল ‘দেহ’ বা ‘বস্তু জগত’। নস্টিসিসম অনুসারে ‘পরিত্রাণ’ মানে না ‘যীশু দ্বারা পাপ থেকে উদ্ধার’ বরং ‘পরিত্রাণ’ মানে হল – মানুষ জ্ঞান লাভের মধ্য দিয়ে তার দেহে সে ঐশ্বিক রশ্মি আলোকিত করতে সক্ষম। এভাবে সে ‘আলোকিত’ বা ‘পরিত্রাণ প্রাপ্ত’ হয়ে যায়।
নস্টিসিসম অনুসারে মানুষের কি প্রয়োজন? মানুষের প্রয়োজন জ্ঞান লাভের মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ প্রকাশ পাওয়া, আলোকিত হওয়া ও আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করা। কে তা পেতে সক্ষম হবে? শুধুমাত্র বিশেষ লোক তা পেতে সক্ষম হবে, সবাই না। তাই নস্টিসিসম ছিল ‘বিশেষ লোকদের গুপ্ত দল’। নস্টিকেরা অন্য মানুষদের আশাহীন বলে বাদ দিত। নস্টিকদের মধ্যে বিভিন্ন দল বা আলোকিত হওয়ার বিভিন্ন স্তর থাকত। ফলে নস্টিসিসমে অনেক উঁচু-নিচু ভাব ও যথেষ্ট অহংকার থাকত।
নস্টিকেরা দাবি করত – যারা আলোকিত স্তরে পৌঁছায় তারা পাপ দ্বারা আর আক্রান্ত নয় বা নিজেকে আর দোষী করতে সক্ষম হয় না। যদি পরিত্রাণ জ্ঞান, আত্মিক অভিজ্ঞতা বা আলোকিত হওয়ার উপর নির্ভর করে তবে তা নৈতিক ব্যবহার ও আচরণের উপর নির্ভর করে না। ফলে নস্টিকেরা নৈতিকতায় বেশি গুরুত্ব দিত না। নস্টিকেরা দাবি করত যে মানুষের দেহ মন্দ এবং মানুষের দেহ ও তার আত্মা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। তাই একজন মানুষের আত্মা একবার আলোকিত হলে তবে সে দেহ দিয়ে কি করে, তাতে কিছু যায় আসে না।
এই দ্বিখন্ডিত চিন্তা থেকে দুই ধরণের শিক্ষা তৈরি হল – একদিকে সন্ন্যাসী চিন্তা (দেহকে দমন করে ও কষ্ট দিয়ে মানুষ বস্তুর উপরে জয়ী হয়) অথবা অন্য দিকে উদারপন্থী চিন্তা (দেহ আত্মাকে দূষিত করতে পারে না, তাই দেহ নিয়ে যা চাই তাই করা যায়)।
যীশু সম্বন্ধে নস্টিসিসমের ব্যাখ্যা
নস্টিসিসম বিশ্বাস করতে পারে না যে ঈশ্বর মানুষ হলেন, কারণ পবিত্র আত্মা বা কোন সর্বোচ্চ কর্তা নিজেকে বস্তু শরীর দিয়ে দূষিত করবে না। তাহলে নস্টিকেরা যীশুর গল্প কিভাবে ব্যাখ্যা করত?
কিছু নস্টিকেরা বলত – যীশু ছিলেন ‘আত্মা মাত্র’ অর্থাৎ এমন একটি আত্মা যিনি নিজেকে ‘মানুষের মত’ প্রকাশ করতেন কিন্তু আসলে তাঁকে স্পর্শ করা যেত না বরং মাটির উপর হাঁটলেও তাঁর পায়ের ছাপ পাওয়া যেত না।
অন্য কিছু নস্টিকেরা দাবি করত – যীশু পবিত্র আত্মা দিয়ে জন্ম নেন নি বরং তিনি মরিয়ম ও যোষেফের সাধারণ সন্তান ছিলেন যদিও তিনি অন্য লোকদের চেয়ে একজন ধার্মিক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। তার বাপ্তিস্মের সময়ে তিনি ‘খ্রীষ্ট’ নামক আত্মা পান। অর্থাৎ খ্রীষ্ট-আত্মা পাওয়া যীশু ছিলেন প্রথম নস্টিক। তিনি এই মন্দ জগতের নন বলে প্রলোভিতও হন না, তিনি আঘাত বা ব্যাথা পান না, তিনি ছিলেন এমন একজন আত্মিক ব্যক্তি যাকে বস্তু জগত স্পর্শ করতে সক্ষম নয়। এই চিন্তাকে ‘ডোসিটিসিসম’ (doceticism) বলা হয়।
যীশুকে ক্রুশে দেওয়ার আগে খ্রীষ্ট-আত্মা তাকে ছেড়ে স্বর্গে চলে যান কারণ একজন আত্মাকে কষ্ট বা লজ্জা দেওয়া সম্ভব না। এই জগত তাঁকে দূষিত করতে পারে না, মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। যীশুর শারীরিক যন্ত্রণা ও ক্রুশে মারা যাওয়ার আগেই খ্রীষ্ট-আত্মা তাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল কারণ কোন আত্মা যন্ত্রণা বা মৃত্যু দিয়ে দূষিত হতে পারে না।
নস্টিসিসম বাইবেলীয় শিক্ষার বিরুদ্ধে
নস্টিসিসম হল একটি বিপজ্জনক ভ্রান্ত শিক্ষা যা মানুষের পাপ সমস্যা মনে করে না। নস্টিসিসমে পাপ স্বীকার, অনুতাপ, ক্ষমা চাওয়া ও জীবনকে পরিবর্তন করার কোন দাবি নেই। পবিত্র জীবন-যাপন, নৈতিক ব্যবহার, স্বার্থহীনতা, সেবা ও ভালবাসার গুরুত্ব নেই। নস্টিকেরা ভাল আচরণ ও চরিত্রের অনুসন্ধানী নয় বরং জ্ঞান, প্রকাশ ও আত্মিক অভিজ্ঞতার অনুসন্ধানী।
নস্টিসিসম অধিকাংশ মানুষকে নীচু চোখে দেখে, নিজেকে বিশেষ মনে করে, পার্থক্য করে ও অন্যদের বাদ দেয়। তাই নস্টিসিসম ‘আলোকিতদের’ অহংকার, স্বার্থপরতা ও অন্যদের নীচু চোখে দেখা উৎসাহিত করে, ‘সাইকিকদের’ (বিশ্বাসীদের) নিজের পরিত্রাণ নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে এবং ‘হাইকিকদের’ (বাকি সব লোকদের) জন্য কোন আশা দেখায় না। তা হল সুসমাচারের ঠিক বিপরীত। সুসমাচার সব জাতিদের জন্য যীশুতে বিশ্বাস দ্বারা আশার বাণী দেয়।
নস্টিসিসম মানুষের সিদ্ধান্ত, সুখবর শুনে সাড়া, মানুষের হৃদয় ও মনোভাব একটাতেও গুরুত্ব দেয় না। বরং কার মধ্যে ঐশ্বিক রশ্মি থাকে, তা নিয়ে ব্যস্ত। ফলে অহংকার, মানুষের মধ্যে পার্থক্য করা ও নিজের জ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত থাকার একটি মনোভাব উৎসাহিত করে। নস্টিসিসম অধিকাংশ লোকদের ‘আলো ছাড়া’, এমন কি ‘আশা ছাড়া’ মনে করে। তাই নস্টিসিসম পরিত্রাণ ও অনন্ত জীবন নিয়ে নিশ্চয়তা নষ্ট করে (কলসীয় পুস্তক দেখুন)।
জ্ঞান, প্রকাশ, বিশেষ আত্মিক অভিজ্ঞতা, আলোকিত হওয়ার অনুসন্ধান, গুপ্ত জ্ঞান, নিজেকে আলাদা মনে করা, তা সব লোকদের প্রতারণার ঝুঁকিতে, এমন কি অনৈতিকতার ঝুঁকিতেও ফেলে।
নস্টিসিসম বিশ্বাস করে না যে – যীশু ঈশ্বর, যিনি মানুষ হিসাবে পৃথিবীতে এসেছেন (কেন একজন খাঁটি আত্মা এই মন্দ বস্তু জগতে নামবে?), যীশু পুনরুত্থিত হয়েছেন (কেন একটি খাঁটি আত্মা নতুন দেহ চাইবে?), যীশুর দ্বিতীয় আগমনে সব সৃষ্টির পুনরুদ্ধার ঘটবে (কেন ঈশ্বর একটি বস্তু জগত পুনরায় স্থাপন করবেন?)।
যোহন তার চিঠিতে নস্টিসিসমের মিথ্যাগুলির বিরুদ্ধে বাইবেলীয় সত্য দাঁড় করেন
নিশ্চয়তা দান: তোমরা ঈশ্বরেরই সন্তান, তোমাদের অনন্ত জীবন আছে
নস্টিসিসমের চিন্তা অনুসারে অধিকাংশ মানুষ হারানো (তাদের জন্য আশা নেই) বা প্রায় হারানো (হয়তো আশা আছে)। এভাবে নস্টিসিসম বিশ্বাসীদের নিশ্চয়তার চুরি করে যে তারা পরিত্রাণ ও অনন্ত জীবন পেয়েছেন। তাই যোহন এর বিরুদ্ধে জোরের সঙ্গে বলেন যে বিশ্বাসীদের পরিত্রাণ ও অনন্ত জীবন লাভ নিশ্চিত: “দেখ, পিতা ঈশ্বর আমাদের কত ভালবাসেন! তিনি আমাদের তাঁর সন্তান বলে ডাকেন, আর আসলে আমরা তা-ই” (১ যোহন ৩:১)। “তোমরা যারা ঈশ্বরের পুত্রের উপরে বিশ্বাস কর, তোমাদের কাছে আমি এই সমস্ত লিখলাম যাতে তোমরা জানতে পার যে, তোমরা অনন্ত জীবন পেয়েছ” (১ যোহন ৫:১৩)। “ঈশ্বরের পুত্র” হল যোহনের একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপক যা স্বর্গস্থ পিতার সঙ্গে বিশ্বাসীর সে অপরিবর্তনশীল ঘনিষ্ট সম্পর্ক বুঝায়, কারণ পুত্র চিরকাল পিতার পুত্র হবে, সে কি করুক না কেন।
নিশ্চয়তা দান: তোমরা সত্য জেনেছ
যীশুর একজন চোখের সাক্ষী ও প্রেরিত হিসাবে যোহন অধিকারের সঙ্গে দাবি করেন যে সে সুসমাচার বিশ্বাসীরা গ্রহণ করেছে তাই হল সত্য: “সত্যকে জান না বলে যে আমি তোমাদের কাছে লিখলাম তা নয়, কিন্তু তোমরা সত্যকে জান এবং এ-ও জান যে, সত্য থেকে মিথ্যা আসে না; আর সেইজন্যই আমি তোমাদের কাছে লিখলাম” (১ যোহন ২:২১)।
নিশ্চয়তা দান: যীশুই সম্পূর্ণ ঈশ্বর এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে মানুষ হয়েছে
যোহন তার চিঠির শুরুতেই শক্তিশালীভাবে ডোসেটিসিসমের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। তিনি যীশু সম্বন্ধে বলেন: “সেই প্রথম থেকেই যিনি ছিলেন, যাঁর মুখের কথা আমরা শুনেছি, যাঁকে নিজেদের চোখে দেখেছি, যাঁকে ভাল করে লক্ষ্য করেছি, যাঁকে নিজেদের হাতে ছুঁয়েছি, এখানে সেই জীবন-বাক্যের কথাই লিখছি” (১ যোহন ১:১)। এমন না যে খ্রীষ্ট একটি আত্মা ছিল যা শুধুমাত্র মাটির উপর ভেসে যেত এবং যার পায়ের চাপ হত না। যীশুই ছিলেন একজন আসল মানুষ যার একটি বস্তু শরীর ছিল। তবুও যীশু ঈশ্বরই ছিলেন তবুও তিনি সম্পূর্ণভাবে মানুষ হয়েছেন: “যে আত্মা স্বীকার করে যীশু খ্রীষ্ট মানুষ হয়ে এসেছিলেন সেই আত্মাই ঈশ্বর থেকে এসেছেন” (১ যোহন ৪:১-৩), তিনি সাধারণ মানুষের মত জীবন করেছেন এবং তাকে দেখা যেত, তার কথা শোনা যেত, তাকে স্পর্শ করা যাত। কিন্তু একই গুরুত্বের সঙ্গে যোহন দাবি করেন যে যীশুই সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বর ছিলেন: তিনি নিজেই ঈশ্বর, তিনি পিতা থেকে পাঠানো, তিনিই অনন্ত জীবন এবং যে পুত্র যীশুকে অস্বীকার করে তার পিতার সঙ্গেও সম্বন্ধ নেই (১ যোহন ২:২১-২৫)।
যত শিক্ষক এই দুইটি সত্য ধরে না রাখে (যে যীশু উভয় সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বর এবং সম্পূর্ণভাবে মানুষ) তাকে যোহন ‘খ্রীষ্টের শত্রু’ বা ‘খ্রীষ্টারী’ (কেরী) বা ইংরেজীতে ‘antichrist’ বলেন। ‘খ্রীষ্টারী’ তাই শেষকালে একজন ভয়ংকর ব্যক্তি বুঝায় না বরং এমন একজন যে অস্বীকার করে যে যীশু যে ঈশ্বর এবং মানুষ, এমন একজন যে তাই ত্রিত্ব ঈশ্বর অস্বীকার করে (১ যোহন ২:১৮-২৫, ৪:১-৬)।
চ্যালেঞ্জ করা: সব কিছুর সম্বন্ধ আছে, কোন কিছু আলাদা করা যায় না
তা ছাড়া যোহন তার এই সুন্দর চিঠিতে সব কিছুর সম্পর্ক ও সম্বন্ধ দেখান। যত যা নস্টিকেরা আলাদা বা অসম্পর্কিত মনে করে যোহন ততটা সম্পর্কিত ও যুক্ত হিসাবে ঘোষণা করেন। যোহন তাঁতের কাজের মত বার বার পুনরুক্তি করে উক্তি দেন, অনেকট “যদি … তবে …” আকারে। তিনি একই মূল বিষয়গুলিতে বার বার ফিরে এসে তাদের মধ্যে সম্পর্ক ও সম্বন্ধ দেখায় এবং এভাবে তিনি ঘুরে ফিরে একটি ফুলের পাতার মত সব কিছুর গুরুত্ব বুঝান:
- যদি আমরা ঈশ্বরকে জানি তবে আমরা ঈশ্বরের আদেশে বাধ্য হই।
- যদি আমরা ঈশ্বরের আদেশে অবাধ্য হই তবে তার অর্থ এই যে আমরা এখনও ঈশ্বরকে জানি না।
- যদি আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে সহভাগিতায় আছে তবে আমরা আলোতে চলি।
- যদি আমরা আলোতে চলে তবে আমরা চেতনায় সাড়া দেই, পাপ স্বীকার করি ও ক্ষমা পাই।
- যদি আমরা দাবি করি যে আমাদের পাপ নেই তবে আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কে নেই।
- যদি আমরা আলোতে চলে তবে আমরা পবিত্রভাবে জীবন-যাপন করি।
- যদি আমরা ঈশ্বরকে জানি তবে আমরা ঈশ্বরকে ভালবাসি।
- যদি আমরা ঈশ্বরকে ভালবাসি তবে আমরা প্রতিবেশীকে ভালবাসি।
- যদি আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে সহভাগিতায় থাকি তবে আমরা প্রতিবেশীর সঙ্গেও সহভাগিতায় থাকি।
- জ্ঞান ও জ্ঞানের অনুশীলন আলাদা করা যায় না।
- আত্মিক জীবন ও নৈতিকতা আলাদা করা যায় না।
নস্টিকেরা একটি অহংকারী, জ্ঞান-ভিত্তিক এবং আত্ম-কেন্দ্রিক ধার্মিকতা ঘোষণা করে যেখানে নৈতিক বা পবিত্র জীবন এবং অন্যদের প্রতি ভালবাসা বা সেবার দাবি নেই। তারা আত্মা ও বস্তু দেহ আলাদে করে, আলোকিত হওয়া ও পবিত্র জীবন আলাদে করে, ঐশ্বিক হওয়া ও নৈতিক হওয়া আলাদা করে, জ্ঞান ও প্রয়োগ আলাদা করে এবং ঈশ্বরকে ও মানুষকে ভালবাসা আলাদা করে। যোহন কোনতে রাজি নন: “যদি আমরা বলি যে, ঈশ্বর ও আমাদের মধ্যে যোগাযোগ-সম্বন্ধ আছে অথচ অন্ধকারে চলি তবে আমরা মিথ্যা কথা বলছি, সত্যের পথে চলছি না” (১ যোহন ১:৬)। “যদি আমরা বলি আমাদের মধ্যে পাপ নেই তবে আমরা নিজেদের ফাঁকি দিই। তাতে এটাই বুঝা যায় যে, আমাদের অন্তরে ঈশ্বরের সত্য নেই” (১ যোহন ১:৮)। “যে বলে “আমি তাঁকে জানি,” অথচ তাঁর আদেশ পালন করে না সে মিথ্যাবাদী; তার মধ্যে সত্য নেই” (১ যোহন ২:৪)। “ঈশ্বর থেকে যার জন্ম হয়েছে সে পাপে পড়ে থাকে না, কারণ ঈশ্বরের স্বভাব তার মধ্যে থাকে। ঈশ্বর থেকে জন্ম হয়েছে বলে সে পাপে পড়ে থাকতে পারে না” (১ যোহন ৩:৯)। “কেউ কখনও ঈশ্বরকে দেখে নি। যদি আমরা একে অন্যকে ভালবাসি তাহলে বুঝা যাবে যে, ঈশ্বর আমাদের অন্তরে আছেন এবং তাঁর ভালবাসা আমাদের অন্তরে পুরোপুরি ভাবে কাজ করছে” (১ যোহন ৪:১২)। যোহন নস্টিকদের মুকোশ নামিয়ে তাদের অহংকারী, আত্ম-ধার্মিক ও ভালবাসাহীন প্রতারক হিসাবে প্রমাণ করেন, এমন লোক যাদের কোন নৈতিকতা বা লোকদের জন্য কোন সেবা-যত্ন নেই।
তিনি ওপর পক্ষে বিশ্বাসীদের নিশ্চয়তা দেন যে তারা সঠিক সুসমাচারে সাড়া দিয়ে বিশ্বাস করেছে, আসল সত্য জেনেছে, ঈশ্বরের বাধ্যতা ও পবিত্র জীবনের বিষয়ে সঠিক পথে আছে ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঈশ্বর ঠিক তা-ই চান। তা ছাড়া আর কিছুই প্রয়োজন, তা নয়। নস্টিকদের অহংকারী দাবি যে তারাই মাত্র ঐশ্বিক বা ধার্মিক তা হল মিথ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। বরং বিশ্বাসীরাই হলেন ঈশ্বরের পুত্রেরা, ক্ষমা ও পরিত্রাণ প্রাপ্ত, ঈশ্বরের ভালবাসার পাত্র, দত্তক নেওয় সন্তান, অনন্ত জীবনের অধিকারী এবং এই পৃথিবীতে ঈশ্বরের পক্ষ হয়ে অন্যদেরকে ভালবাসা দানকারী।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।