উপদেশক হল একটি উস্কানিমূলক পুস্তক যার নেতিবাচক সুর ও বাইবেলের সাধারণ মতবাদ বিরোধীয় কথা পাঠকদের অবাক করে তোলে।
উপদেশকের বেশ কয়েকটি পদ এমন কিছু দাবি করে, যা বাইবেলের সাধারণ শিক্ষার বিপরীত, যেমন “পৃথিবী চিরকাল থাকবে”, “দুষ্টদের যা পাওনা তা পায় সৎ লোক, আর সৎ লোকদের যা পাওনা তা পায় দুষ্ট লোকেরা” বা “পশু আর মানুষের মধ্যে আলাদা কিছু নেই”। এই পুস্তকে এমন কিছু পদ আছে, যা সরাসরি পরস্পরের বিপরীতে কথা বলে, যেমন “মরা সিংহের চেয়ে জীবিত কুকুরও ভাল” এবং “যারা বেঁচে আছে তাদের চেয়ে যারা আগেই মরে গেছে তারা আরও ভাল অবস্থায় আছে”। এই ধরণের বিপরীত কথা পেয়ে প্রশ্ন উঠে, এই পুস্তক কি আসলে ঈশ্বরের অধিকারগত বাক্য কিনা এবং পুস্তকটি কিভাবে বুঝা যাবে।
লেখকের পরিচয় দেওয়া হয় “উপদেশক”, “যিরূশালেমের রাজা ও দায়ূদের ছেলে” (উপদেশক ১:১)। একমাত্র রাজা শলোমন এই বর্ণনা পূর্ণ করেন এবং যিহূদী ঐতিহ্যও বলে যে, রাজা শলোমন এই পুস্তকের লেখক। যেহেতু লেখক বহুদিনের অভিজ্ঞতা ও তার মূল্যায়ন নিয়ে কথা বলেন (উপদেশক ১:১২-২:১১), মনে করা হয় যে, শলোমন পুস্তকটি তার জীবনের শেষ দিকে লিখেছিলেন। কিন্তু রাজাবলি পুস্তক বলে যে শলোমন তার জীবনের শেষ দিকে ঈশ্বরের প্রতি অবাধ্য হয়ে প্রতিমাপূজা করতে শুরু করেন (১ রাজা ১১:১-৮)। একারণে কেউ কেউ মনে করে যে, শলোমন পতিত মানুষ হিসাবে উপদেশক লিখেছিলেন এবং একজন ঈশ্বর ভক্ত প্রকাশক শলোমনের এই নেতিবাচক লেখাটি একটি আরো উপযুক্ত উপসংহারে নিয়ে আসেন: “এখন সব কিছু তো শোনা হল, তবে শেষ কথা এই যে, ঈশ্বরকে ভক্তিপূর্ণ ভয় করবার ও তাঁর সব আদেশ পালন করবার মধ্য দিয়ে মানুষের সমস্ত কর্তব্য পালন করা হয়” (উপদেশক ১২:১৩)। আবারও কেউ কেউ চিন্তা করেন যে, শলোমন একেবারে তার জীবনের শেষে অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং এই পুস্তকটি ইস্রায়েল জতির কাছে সাবধানবাণী বা ক্ষমাপ্রার্থনা হিসাবে লিখেছিলেন, যেন তারা তার মত না করে। আবারও কেউ কেউ চিন্তা করে যে, শলোমন ঈশ্বরের প্রতি এখনও বাধ্য হওয়ার সময়ে পুস্তকটি লিখেছেন কিন্তু তিনি তা বিশেষ একটি উস্কানি দেওয়ার মত নেতিবাচক লেখার ধরণেই করেছেন। তা দ্বারা তিনি পাঠকদের চ্যালেঞ্জ করেন, যেন তারা ঈশ্বরকে নিয়ে এবং জীবনে কি গুরত্বপূর্ণ, তা নিয়ে চিন্তা করে। তিনি চান যেন তারা যা সত্য, এর জন্য যুদ্ধ করে। তার কথা ‘খোঁচানো লাঠির মত’ (উপদেশক ১২:১১)। তিনি চান যে, মানুষ সত্য খুঁজে বের করে, ধরে রাখে এবং সঠিক পথ বাছাই করে।
উপদেশক পুস্তকে সবচেয়ে বিখ্যাত কথা হল ‘সব কিছু অসার ও বাতাসের পিছনে দৌঁড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়’। ‘অসার’ শব্দের অর্থ কি? শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল বাষ্প, ধোঁয়া, এমন কিছু যা দেখা যায় কিন্তু ধরা যায় না। তা হল অস্থায়ী, ছায়াময়, খালি, বিরক্তিকর, ঠকানোর মত কিছু। তা ধরা যায় না, বুঝাও যায় না, নিয়ন্ত্রণও করা যায় না। শলোমন দাবি করেন যে, সব কিছু অসার, এমন কি যা বাইবেলে মূল্যবান হিসাবে ঘোষিত হয় (যেমন জীবন, পরিবার, ভাল কাজ, আনন্দ ভোগ ও প্রজ্ঞা) এইগুলোকেও তিনি ‘অসার’ বলেন। কেন তিনি তা দাবি করেন? এই ভাল বিষয়গুলোর সমস্যা কি?
পুস্তকে প্রশ্নটির বিভিন্ন উত্তর দেওয়া হয়:
- ভাল জিনিস যদি স্বার্থপরভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে যখন সেগুলো ছেড়ে দেওয়ার সময় আসে তখন হিংসা ও ক্ষোভ তৈরি হয়।
- যদিও সাধারণত পৃথিবী আইন-কানুনে উল্লিখিত সেই “যদি…তবে” নীতি অনুসারে চলে (ভাল কাজ করলে আশীর্বাদ পাব) তবুও সব সময়ই যে নীতিটি অনুসারে চলবে, এমন নয়।
- মানুষ যদি সুখ দাবি করে বা সুঅবস্থা অধিকার হিসাবে দাবি করে তবে তা সমস্যায় পরিণত হয়। দাবি করতে করতে মানুষ রাগ, ক্ষোভ ও অবাস্তবতায় বাস করবে। বরং সব আশা বাস্তবে পূর্ণ হবে এমন নয়। এটা মেনে নেওয়াই হল ভাল পথ ও ঈশ্বরীয় মনোভাব।
- আরো বলা যায় যে, যদি ভাল জিনিসকে এমনভাবে প্রাধান্য দেই অথবা এমনভাবে তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি, তা দেবতাপূজার মত হয়ে দাঁড়ায় এবং তাও একটি সমস্যায় পরিণত হয়। একটি জিনিসকে অত্যন্ত দাবি করা মানে, ঈশ্বরের চেয়ে এই জিনিসকে দাবি করা এবং এটাও ভাল নয়।
উপদেশক পুস্তকের আর একটি বিখ্যাত উক্তি হল “সূর্যের নিচে নতুন বলতে কিছু নেই”। উপদেশক পুস্তকে অনেক নিরাশার কথা পাওয়া যায়: সব কিছু খালি ঘটতে থাকে, বার বার একই ঘটনা হবে, সব কিছু হল ক্লান্তির ও একঘেয়েমির বিষয়, পরিবর্তন সম্ভব না, উন্নয়ন সম্ভব না, প্রভাব ফেলা বা কিছু অর্জন করাও সম্ভব না। প্রকৃতি চক্রে চলে, মানুষ জন্ম নিতে থাকে এবং মারা যেতে থাকে, শুধুমাত্র অন্যায় ও বিরক্তি স্থায়ী বলে থেকে যায়। শলোমন এভাবে হতাশার রূপক, অন্ধকার ছবি, শ্বাস বন্ধ হওয়ার মত কথা বলতে থাকেন। কেন তা করেন? হয়তো তিনি পাঠকদের এমনভাবে খোঁচান যেন তারা আপত্তি উঠায়, হতাশার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, লক্ষ্য করে কি ভাল, সত্যের জন্য যুদ্ধ করে এবং ঘোষণা করে যে, জীবনের মূল্য, অর্থ ও গুরুত্ব তারপরেও আছে।
এই হতাশার কথার অপর দিকে পুস্তকটি ‘সময়’ নিয়ে আরো ইতিবাচক কথা বলে: “সব কিছুর জন্য একটি সময় আছে; আকাশের নীচে প্রত্যেকটি কাজেরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে … তিনি সব কিছুর জন্য উপযুক্ত সময় ঠিক করে রেখেছেন” (উপদেশক ৩:১,১১)। যে কষ্টের মধ্য দিয়ে একজন মানুষকে যেতে হচ্ছে, যদি সে ইচ্ছুক একটি মনোভাবে এটা মেনে নেয়, তবে সে সমস্যার সময়েও কাটিয়ে উঠতে পারবে। জীবনে যা ভাল আছে, তার আনন্দভোগও করতে পারবে “ঈশ্বর যখন কোন মানুষকে ধন ও সম্পত্তি দেন তখন তাকে তা ভোগ করতে দেন, আর নিজের জন্য একটা অংশ গ্রহণ করতে দেন ও নিজের কাজে আনন্দ করতে দেন। এই সব ঈশ্বরের দান” (উপদেশক ৫:১৯)। উপদেশক পুস্তক দাবি করে যে, যদিও সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা নেই তবুও অধিকাংশ সময়ে যারা ঈশ্বরকে ভক্তিপূর্ণ ভয়ে জীবন-যাপন করে, তাঁর আদেশ পালন করে (উপদেশক ১২:১৩) এবং যৌবনকালেই সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে (উপদেশক ১২:১), তাদেরই ভাল একটি জীবন থাকবে এবং মৃত্যুর ওপারেও একটি আশা থাকবে।
উপদেশক পুস্তকের অনন্যতা
উপদেশক হল একটি উস্কানিমূলক পুস্তক যার নেতিবাচক সুর ও বাইবেলের সাধারণ মতবাদ বিরোধী কথা পাঠকদের অবাক করে তোলে।
উপদেশকের বেশ কয়েকটি পদ এমন কিছু দাবি করে যা বাইবেলের সাধারণ শিক্ষার বিপরীত, যেমন “পৃথিবী চিরকাল থাকবে”, “দুষ্টদের যা পাওনা তা পায় সৎ লোক, আর সৎ লোকদের যা পাওনা তা পায় দুষ্ট লোকেরা” বা “পশু আর মানুষের মধ্যে আলাদা কিছু নেই”।
এছাড়া পুস্তকে এমন কিছু পদ আছে, যা সরাসরি পরস্পরের বিপরীতে কথা বলে, যেমন “মরা সিংহের চেয়ে জীবিত কুকুরও ভাল” (উপদেশক ৯:৪) এবং “যারা বেঁচে আছে তাদের চেয়ে যারা আগেই মরে গেছে তারা আরও ভাল অবস্থায় আছে” (উপদেশক ৪:২)। পুস্তক বলে “জ্ঞানী … বোকা … ঐ দু’জনের শেষ দশা একই” (উপদেশক ২:১৪) এবং অপর পক্ষে বলে “অন্ধকারের চেয়ে যেমন আলো ভাল, তেমনি নির্বুদ্ধিতার চেয়ে জ্ঞান ভাল” (উপদেশক ১২:৩)। পুস্তক বলে “আমার পরে যে আসবে তার জন্যই তো সেই সব রেখে যেতে হবে” (উপদেশক ২:১৮) এবং অপর পক্ষে বলে “কোন দুর্ঘটনায় পড়ে তা ধ্বংস হয়ে যায়। কাজেই তার ছেলের জন্য কিছুই থাকে না ” (উপদেশক ৫:১৪)। পুস্তক বলে যে, দাস রাজা হলে তা সমস্যা (উপদেশক ১০:৫-৭) কিন্তু অপর পক্ষে একজন গরীব যুবকের ভাল নেতৃত্ব আদর্শ হিসাবে তুলে ধরে (উপদেশক ৪:১৩-১৬)। এই ধরণের বিপরীত কথা পেয়ে প্রশ্ন উঠে, এই পুস্তক কি আসলে ঈশ্বরের অধিকারগত বাক্য কিনা এবং পুস্তকটি কিভাবে বুঝা যাবে।
অথচ আমরা অনেক বিখ্যাত ও পরিচিত বাক্যগুলো উপদেশক পুস্তক থেকে পেয়েছি, যেমন “সূর্যের নিচে নতুন বলতে কিছু নেই” এই কথাটি প্রবাদে পরিণত হয়েছে এবং এমন লোক যারা বাইবেল পড়ে না, তারাও তা ব্যবহার করে।
লেখক শলোমন
পুস্তকটিতে লেখকের পরিচয় দেওয়া হয় “উপদেশক” এবং “যিরূশালেমের রাজা ও দায়ূদের ছেলে” (উপদেশক ১:১)। এছাড়া বলা হয় যে, তিনি “যিরূশালেমে ইস্রায়েলের উপরে রাজা” ছিলেন (উপদেশক ১:১২), যার অর্থ এই যে, যখন ইস্রায়েল রাজ্য এখনও বিভক্ত হয় নি এবং যিরূশালেম ছিল দেশের রাজধানী। একমাত্র রাজা শলোমন এই বর্ণনা পূর্ণ করেন এবং যিহূদী ঐতিহ্যও বলে যে, রাজা শলোমনই পুস্তকের লেখক। পুস্তকটিতে লেখক নিজের জীবনের বিভিন্ন বর্ণনা দেন এবং সেগুলোও শলোমনের জীবনের সাথে মিলে: আগের শাসকদের চেয়ে তার জ্ঞান বেশি (উপদেশক ১:১৬), অনেক নির্মাণ, কার্যকলাপ, পার্ক, ধন এবং অসংখ্য দাস ও স্ত্রী (উপদেশক ২:১-৮)।
যেহেতু লেখক বহুদিনের অভিজ্ঞতা ও তার মূল্যায়ন নিয়ে কথা বলেন (উপদেশক ১:১২-২:১১), মনে করা হয় যে, শলোমন তার জীবনের শেষ দিকে পুস্তকটি লিখেছিলেন। কিন্তু রাজাবলি পুস্তক বলে যে, শলোমন তার জীবনের শেষ দিকে ঈশ্বরের প্রতি অবাধ্য হয়ে প্রতিমাপূজা করতে শুরু করেন (১ রাজা ১১:১-৮)। শলোমন কি পতিত অবস্থায় উপদেশক পুস্তকটি লিখেছিলেন? তাই যদি হয় তবে তার কথা কিভাবে ঈশ্বরের অধিকারগত বাক্য হিসাবে দাঁড়ায়?
শলোমনের জীবনের শেষ দিকে অবাধ্যতার কথা জেনে এবং উপদেশক পুস্তকে অনেক বিপরীত দাবি বা বাইবেলের সাধারণ মতবাদ বিরোধী কথা পেয়ে তবে পুস্তকটি কিভাবে বুঝা যাবে? এটা নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে। আমরা উপদেশক পুস্তকের বিষয়ে ৪টি চিন্তার ধরণ দেখব:
উপদেশক পুস্তক কিভাবে বুঝা যাবে, তা নিয়ে বিভিন্ন মতামত
১ অনুতপ্ত শলোমন
কেউ কেউ চিন্তা করে যে, শলোমন তার জীবনের একেবারে শেষ দিকে পুস্তকটি লিখেছিলেন, এমন একটি সময় যখন সব কিছু চেষ্টা ও আলিঙ্গন করার পরেও তিনি হতাশায় পড়েন এবং তার পাপ বুঝে অনুতপ্ত হন। তাই যদি হয় তবে উপদেশক পুস্তক হল ইস্রায়েলের কাছে তার খারাপ জীবনের কারণে ক্ষমাপ্রার্থনা এবং একটি সাবধানবাণী, যেন তারা তার মত না করে। তাহলে পুস্তকটি শলোমনের ক্ষতি কমানোর একটি প্রচেষ্টা: তার খারাপ উদাহরণ দ্বারা যতজন প্রভাবিত ও প্রলোভিত হয়েছে, তাদের এই খারাপ পথের খারাপ ফলাফল দেখিয়ে তিনি তাদেরকে পথটি ছেড়ে দিতে উৎসাহিত করেন।
এই মতামতের বিরুদ্ধে বলতে হয় যে, শলোমন জীবনের শেষ দিকে অনুতপ্ত হয়েছিলেন, বাইবেলে তার কোনো উল্লেখ নেই।
২ ঈশ্বরীয় প্রকাশকেরা পতিত শলোমনের লেখাটি সাবধানবাণী হিসাবে ব্যবহার করেন
কেউ কেউ চিন্তা করে যে, শলোমন পতিত মানুষ হিসাবে উপদেশক লিখেছিলেন এবং একজন ঈশ্বর ভক্ত প্রকাশক (বা প্রকাশকেরা) শলোমনের এই নেতিবাচক লেখাটি একটি আরো উপযুক্ত উপসংহারে নিয়ে আসেন: “এখন সব কিছু তো শোনা হল, তবে শেষ কথা এই যে, ঈশ্বরকে ভক্তিপূর্ণ ভয় করবার ও তাঁর সব আদেশ পালন করবার মধ্য দিয়ে মানুষের সমস্ত কর্তব্য পালন করা হয়” (উপদেশক ১২:১৩)। এই চিন্তা অনুসারে একজন পতিত শলোমন উপদেশক ১:১-১২:৮ পদ পর্যন্ত লেখেন এবং পরে একজন ঈশ্বরীয় প্রকাশক তার সেই উল্টাপাল্টা কথা সঠিক উপসংহারে নিয়ে আসার জন্য উপদেশক ১২:৯-১৪ পদ লেখেন। তাই যদি হয় তবে উপদেশক হল পতিত একজনের লেখা যা থেকে কম পক্ষে কিছুটা শেখা যায়: ঈশ্বরের অবাধ্যতার ফল কত মারাত্মক, যেমন হতাশা, অসন্তোষ, সন্দেহ।
এই মতামতের বিরুদ্ধে বলতে হয় যে, তা দ্বারা এক মুহূর্তে বাইবেলের অনেক কথাগুলো মিথ্যা মতবাদ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে, অর্থাৎ দাবি করা হয়েছে যে, উপদেশক ১:১-১২:৮ ঈশ্বরের বাক্য নয়। শেষ অনুচ্ছেদ যে আসলে আর একজন দ্বারা লেখা হয়েছে, এই চিন্তা করা সম্ভব, কিন্তু এটি শক্তিশালীভাবে প্রমাণ করা কঠিন।
৩ শলোমন পতনের আগে ইস্রায়েলের কাছে একটি উস্কানিমূলক পুস্তক লেখেন
কেউ কেউ চিন্তা করে যে, শলোমন ঈশ্বরের প্রতি এখনও বাধ্য হওয়ার সময়ে পুস্তকটি লিখেছেন কিন্তু তিনি তা বিশেষ একটি উস্কানিমূলক নেতিবাচক লেখার ধরণেই করেছেন। আমরা যদিও এই লেখার ধরণে অভ্যস্ত নই, শলোমনের পাঠকেরা হয়তো তাতে অভ্যস্ত ছিল। পুস্তকটি দ্বারা তিনি পাঠকদের চ্যালেঞ্জ করেন, যেন তারা ঈশ্বরকে নিয়ে এবং জীবনে কি গুরত্বপূর্ণ, তা নিয়ে চিন্তা করে। তিনি চান তারা যেন যা সত্য, তার জন্য যুদ্ধ করে। তার কথা “রাখালের খোঁচানো লাঠির মত” (উপদেশক ১২:১১)।
এই চিন্তার বিরুদ্ধে বলা যায় যে, আসলে এই লেখার ধরণ বোঝা একটু কঠিন।
৪ শলোমন পতনের আগে অন্য জাতিদের কাছে একটি উস্কানিমূলক পুস্তক লেখেন
কেউ কেউ চিন্তা করে যে, শলোমন এই পুস্তকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাইবেলের সাধারণ মতবাদ উল্লেখ না করে বরং এমন একটি পুস্তক রচনা করেন যা অন্য জাতিদের কাছে অসরাসরিভাবে ঈশ্বরের কিছু চিন্তা দেয়। শলোমন ঈশ্বরের প্রতি এখনও বাধ্য হওয়ার সময়ে পুস্তকটি লেখেন কিন্তু তিনি তা বিশেষ একটি উস্কানি দেওয়ার মত নেতিবাচক লেখার ধরণেই করেন, যা সেই যুগে ইস্রায়েলের বাইরেও প্রচলিত ছিল। এই মতামতের পক্ষে বলা যায় যে, রাজা শলোমন তার প্রজ্ঞা ও খ্যাতির কারণে অন্য জাতিদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় ছিলেন এবং ইস্রায়েলের বাইরেও অনেক প্রভাব ফেলেছিলেন (১ রাজা ৪:৩৪, ১ রাজা ১০)।
এই মতামতের বিরুদ্ধে বলতে হয় যে, সন্দেহ লাগতে পারে এত নেতিবাচক ও উস্কানিমূলক একটি লেখা অন্য জাতিদের জন্য আসলে কতদূর আকর্ষণীয় ও কার্যকারী ছিল।
পুস্তকের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
সারাংশে বলা যায় যে, রাজা শলোমন, যিনি ৯৭১ থেকে ৯৩১ খ্রীষ্টপূর্বে ইস্রায়েলের উপর রাজত্ব করেছিলেন, তিনি উপদেশক পুস্তকটি যিরূশালেম থেকে লেখেন। সম্ভবত তিনি তার জীবনের শেষ দিকে পুস্তকটি ইস্রায়েল জাতির জন্য এবং সাথে ইস্রায়েলের ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলোর জন্যও লেখেন। হয়তো তিনি অন্যান্য জাতিদের জন্যও তা লেখেন।
পুস্তকে প্রায় অর্ধেক অর্ধেক করে গদ্য ও পদ্য মিশানো পাওয়া যায়। এছাড়া পুস্তকটিতে অনেক পুনরুক্তি বাক্য, অনেক পার্থক্য, চেতনাদায়ক প্রশ্ন ও জোরালো উক্তি পাওয়া যায়। যদিও আমরা আধুনিক যুগে উপদেশকের নেতিবাচক উস্কানিমূলক লেখার ধরণে আর অভ্যস্ত নই, শলোমনের যুগের লোকেরা সম্ভবত তাতে অভ্যস্ত ছিল। উপদেশকের সাথে মিলে, এমন দু’টি মিসরীয় লেখা আজ পর্যন্ত রক্ষিত আছে: “জীবন নিয়ে ক্লান্ত একজন” (‘The man who was tired of life’) এবং “বার বার বলা লোকের গান” (‘Song of the Harper’, প্রায় ২১০০ খ্রীষ্টপূর্বে)। নিচে এই দু’টি বইয়ের কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে যা উপদেশকের সাথে মিলে:
“’জীবন অস্থায়ী বিষয় মাত্র,’ তিনি নিজের কাছে অভিযোগ করে বললেন, ‘আপনি হয়তো জীবিত আছেন, কিন্তু লাভ কি? তারপরেও আমরা ধনীদের মত জীবন করতে অতি আগ্রহী’।
‘মৃত্যু দুঃখ নিয়ে আসে, মৃত্যুর পরে লোকেরা আর কখনও সূর্য দেখতে পাবে না।’ এই বিষয়ে তেমন কিছু করার নেই। দিনের আনন্দে খুশি হও এবং চিন্তা-ভাবনা বাদ দাও!”
উপদেশক পুস্তকে কিছু পুনরুক্তি বিষয়
সব কিছু অসার
উপদেশক পুস্তকে সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি হল ‘সব কিছু অসার ও বাতাসের পিছনে দৌঁড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়’। শলোমন ২৯ বার এই শব্দের পুনরুক্তি করেন।‘অসার’ শব্দের অর্থ কি? শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল বাষ্প, ধোঁয়া, এমন কিছু যা দেখা যায় কিন্তু ধরা যায় না। তা হল অস্থায়ী, ছায়াময়, খালি, বিরক্তিকর, ঠকানোর মত কিছু। তা ধরা যায় না, বুঝাও যায় না, নিয়ন্ত্রণও করা যায় না। শলোমন দাবি করেন যে, সব কিছু অসার, এমন কি যা বাইবেলে মূল্যবান হিসাবে দেখা হয় (যেমন জীবন, পরিবার, ভাল কাজ, আনন্দ ভোগ ও প্রজ্ঞা) এইগুলোকেও তিনি ‘অসার’ বলেন। কেন তিনি তা দাবি করেন? এই ভাল বিষয়গুলোর সমস্যা কি?
পুস্তকে প্রশ্নটির বিভিন্ন উত্তর দেওয়া হয়:
- ভাল জিনিস যদি স্বার্থপরভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে যখন সেগুলো ছেড়ে দেওয়ার সময় আসে তখন হিংসা ও ক্ষোভ তৈরি হয়।
- যদিও সাধারণত পৃথিবী আইন-কানুনে উল্লিখিত সেই “যদি…তবে” নীতি অনুসারে চলে (ভাল কাজ করলে আশীর্বাদ পাব) তবুও সব সময়ই যে নীতিটি অনুসারে চলবে, এমন নয়।
- মানুষ যদি সুখ দাবি করে বা সুঅবস্থা অধিকার হিসাবে দাবি করে তবে তা সমস্যায় পরিণত হয়। দাবি করতে করতে মানুষ রাগ, ক্ষোভ ও অবাস্তবতায় বাস করবে। বরং সব আশা বাস্তবে পূর্ণ হবে এমন নয়। এটা মেনে নেওয়াই হল ভাল পথ ও ঈশ্বরীয় মনোভাব।
- আরো বলা যায় যে, যদি ভাল জিনিসকে এমনভাবে প্রাধান্য দেই অথবা এমনভাবে তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি, তা দেবতাপূজার মত হয়ে দাঁড়ায় এবং তাও একটি সমস্যায় পরিণত হয়। একটি জিনিসকে অত্যন্ত দাবি করা মানে, ঈশ্বরের চেয়ে এই জিনিসকে দাবি করা এবং এটাও ভাল নয়।
বাতাসের পিছনে দৌড়ানো
এর সাথে মিল রেখে উপদেশক পুস্তকে ২০ বার আর একটি পুনরুক্তি বাক্য পাওয়া যায়: “কেবল বাতাসের পিছনের দৌড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়”, “ভারি যন্ত্রণা”, “সব কিছু ঘুরে ঘুরে এসে ক্লান্ত জন্মায়”। তাতেও একই হতাশা, অক্ষমতা ও বেচারা ভাব প্রকাশিত।
সূর্যের নিচে নতুন বলতে কিছু নেই
উপদেশক পুস্তকে আর একটি বিখ্যাত উক্তি হল “সূর্যের নিচে নতুন বলতে কিছু নেই”। এই পুস্তকে কথাটি হতাশা প্রকাশ করার জন্য ২৭ বার পুনরুক্তি করা হয়েছে: সব কিছু খালি ঘটতে থাকে, বার বার একই ঘটনা হবে, সব কিছু হল বিরক্তির, ক্লান্তির ও একঘেয়েমির বিষয়, পরিবর্তন সম্ভব না, উন্নয়ন সম্ভব না, প্রভাব ফেলা বা কিছু অর্জন করাও সম্ভব না। প্রকৃতি চক্রে চলে, মানুষ জন্ম নিতে থাকে এবং মারা যেতে থাকে, শুধুমাত্র অন্যায় ও বিরক্তি স্থায়ী বলে থেকে যায়।
শলোমন এভাবে হতাশার রূপক, অন্ধকার ছবি, শ্বাস বন্ধ হওয়ার মত কথা বলতে থাকেন। কেন তিনি তা করেন? হয়তো তিনি পাঠকদের এমনভাবে খোঁচান যেন তারা আপত্তি উঠায়, হতাশার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, লক্ষ্য করে কি ভাল, সত্যের জন্য যুদ্ধ করে এবং ঘোষণা করে যে জীবনের মূল্য, অর্থ ও গুরুত্ব তারপরেও আছে। যদি সূর্যের নিচে নতুন বলতে কিছু নেই, তবে কে জানে, সূর্যের উপরে হয়তো নতুন কিছু আছে।
লক্ষণীয় বিষয় যে, উপদেশক পুস্তকে অনেক কিছু ক্লান্তির ও একঘেয়েমির বিষয় হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে (যেমন সূর্যোদয়, বাতাস, আবহাওয়া ও বৃষ্টির রীতিমত যোগান (উপদেশক ১:৪-১০) যা বাইবেলের অন্য লেখাগুলো ঈশ্বরের দৈনিক বিশ্বস্ত যোগান হিসাবে উৎযাপন করা হয় (যেমন গীত ১৪৭:৭-১১)।
সময় কি চক্রে চলে না কি এগিয়ে যাচ্ছে?
উপদেশক পুস্তকের শুরুতে সময় যে চক্রে চলছে, তার নেতিবাচক বর্ণনা করা হয় (‘সব কিছু ঘুরে ঘুরে আসে, নতুন কিছু নেই, তা ক্লান্তির ও বিরক্তির বিষয়’)। তার চেয়ে ইতিবাচক একটি কথা পাওয়া যায় উপদেশক ৩ অধ্যায়ে: “সব কিছুর জন্য একটা সময় আছে; আকাশের নীচে প্রত্যেকটি কাজেরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে” (উপদেশক ৩:১)। তার অর্থ এই যে, বিভিন্ন বিষয়ের গুরুত্ব আছে এবং প্রত্যেক বিষয়ের একটি উপযুক্ত সময় ও ভূমিকা আছে। প্রজ্ঞার পরামর্শ হল: জোর করে একটি জিনিস ধরে রাখার চেয়ে বরং পরিবর্তন গ্রহণ করা এবং মেনে নেওয়া যে, প্রত্যেক মুহূর্তে সব কিছু দাবি করা যায় না “তিনি সব কিছুর জন্য উপযুক্ত সময় ঠিক করে রেখেছেন” (উপদেশক ৩:১০)।
এখানে একটি লক্ষণীয় পদ পাওয়া যায়: “তিনি সব কিছুর জন্য উপযুক্ত সময় ঠিক করে রেখেছেন” (উপদেশক ৩:১০খ)। ঈশ্বর মানুষকে সময়-সম্বন্ধীয় একটি সচেতনতা দান করেন। ঈশ্বর নিজেই সময়ের বাইরে বা উর্ধ্বে, কিন্তু মানুষ সময়ের মধ্যে আছে, এবং তা বুঝা ও গ্রহণ করার মানে প্রজ্ঞাবান হওয়া। সময় নিয়ে চিন্তা করলে মানুষের মনে যে প্রশ্নগুলো উঠে, সেগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ভাল: আমি কোথা থেকে আসলাম? আমি কোথায় যাচ্ছি? মৃত্যুর ওপারে কি ঘটে? আমার ভূমিকা বা জীবনের উদ্দেশ্য কি?
উপদেশক আর একটি সময়-সম্বন্ধীয় বিষয় তুলে ধরে: মানুষের আগ্রহ, যে তাদেরকে মৃত্যুর পরেই স্মরণ করা হবে: “এবং আগেকার কালের লোকদের কথা কারও মনে নেই; যারা ভবিষ্যতে জন্মাবে তাদের কথাও তারা মনে রাখবে না যারা তাদের পরে জন্মাবে” এবং “লোকে বোকাকে যেমন মনে রাখে না তেমনি জ্ঞানীকেও বেশী দিন মনে রাখে না; ভবিষ্যতে এই দু’জনকেই লোকে ভুলে যাবে। বোকা যেমন মরে যায় জ্ঞানী লোকও তেমনি মরে যায়” (উপদেশক ১:১১, ২:১৬)। মানুষ অনন্তকালীন বিষয় দিয়ে আকৃষ্ট, তারা চায় না যে তাদের জীবন ও স্মরণ শেষ হোক, তারা অনন্তকালীন হতে আগ্রহী অথবা কম পক্ষে স্থায়ী কিছু রেখে যেতে চায়।
যা ঈশ্বর দান করেন তা গ্রহণ করা
“সব কিছুর জন্য একটা সময় আছে” এমন একটি মনোভাবও বুঝায় যেখানে ঈশ্বর বর্তমানে আমাকে যা দেন, তাতে আমি সন্তুষ্ট ও খুশি হতে জানি: “তারপর আমি বুঝতে পারলাম যে, ঈশ্বর সূর্যের নীচে মানুষকে যে কয়টা দিন বাঁচতে দিয়েছেন তাতে খাওয়া-দাওয়া করা এবং তার কঠিন পরিশ্রমের মধ্যে তৃপ্ত হওয়াই তার পক্ষে ভাল ও উপযুক্ত, কারণ ওটাই তার পাওনা। এছাড়া ঈশ্বর যখন কোন মানুষকে ধন ও সম্পত্তি দেন তখন তাকে তা ভোগ করতে দেন, তার নিজের জন্য একটা অংশ গ্রহণ করতে দেন ও নিজের কাজে আনন্দ করতে দেন। এ সবই ঈশ্বরের দান” (উপদেশক ৫:১৮-১৯)। এই মনোভাবটি থাকলে বর্তমান অবস্থা মেনে নিতে সাহায্য করে এবং জীবনে সরল বিষয়গুলো যখন পাওয়া যায় তখনই উপভোগ করতে উৎসাহিত করে। ওপর পক্ষে যদি আমি একটি নির্দিষ্ট ফলাফলের আশায় থাকি বা একটি নির্দিষ্ট জিনিস, আশীর্বাদ বা আনন্দের অপেক্ষায় থাকি বা তা দাবি করি তবে আমি অনেক বার কষ্ট পাই বা ভেঙ্গে পড়ি কারণ যেভাবে আশা করেছি সেইভাবে পাই না। উপদেশক এই পরামর্শ দিয়ে আমাকে সতর্ক করে: “এখনকার চেয়ে আগেকার কাল কেন ভাল ছিল?” এই কথা জিজ্ঞাসা কোরো না, কারণ এই প্রশ্ন করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। … সুখের দিনে সুখী হও; কিন্তু দুঃখের দিনে এই কথা ভেবে দেখো যে, ঈশ্বর যেমন সুখ রেখেছেন তেমনি দুঃখও রেখেছেন” (উপদেশক ৭:১০,১৪)।
যদিও অন্যায় ঘটে, যদিও আমি নিজেকে হয়তো কঠিন অবস্থায় খুঁজে পাই এবং যদিও মৃত্যু নিশ্চিত (উপদেশক ১২:১-৮) তবুও অধিকাংশ সময় যারা ঈশ্বরের আদেশ ও নীতি পালন করে (উপদেশক ১২:১৩) এবং যারা যৌবনকাল থেকে ঈশ্বরকে মানে ও স্মরণ করে (উপদেশক ১২:১) তারাই একটি ভাল জীবন পাবে, এবং এমন কি তাদের জন্য মৃত্যুর ওপারেও আশা আছে।
নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে কি হয়
লক্ষণীয় বিষয় যে, উপদেশক পুস্তকে লেখক নিজেকে ৭ বার উল্লেখ করেন। এছাড়া “আমি”, “আমার” ও “আমাকে” এসব সর্বনাম আরো ৮০ বারের মত পুস্তকটিতে ব্যবহৃত। তা ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হোক, নিজেকে কেন্দ্র করা এই মনোভাবের কারণে একজন ব্যক্তির বিরক্ত হওয়া বা হতাশায় পড়ার সম্ভাবনা আরো বাড়ে। উদাহরণস্বরূপ বিবেচনা করুন, ধনসম্পত্তির বিষয়ে পুস্তকটিতে কি বলা হয়েছে: ধরুন একজন ব্যক্তি ধনসম্পত্তি লাভ করেছেন, কিন্তু এক রকম তিনি বিরক্ত হন যে, তিনি সব নিজেই উপভোগ করতে সক্ষম নন (উপদেশক ৬:১-২)। তিনি দুশ্চিন্তিত যে অন্যরা তা উপভোগ করবে (উপদেশক ৫:১১)। তিনি অসন্তুষ্ট কারণ তার ধনসম্পত্তি বংশধরদের হাতে চলে যাবে এবং তারা হয়তো তা নিয়ে বুদ্ধিমান কোনো কাজ করবে না (উপদেশক ২:১৮-১৯)। কিন্তু আবারও তিনি ভয় করেন যে, হয়তো শেষে তার সম্পত্তি দান করার মত কোনো আপন লোক থাকবে না (উপদেশক ৪:৭-৮) অথবা যে শেষে তার দান করার মত আর কিছু থাকবে না (উপদেশক ৫:১৪)।
কাজ ও কঠোর পরিশ্রম
উপদেশক পুস্তকে কাজ সম্বন্ধীয় ইতিবাচক শব্দগুলো (যেমন “কাজ”, “কার্যক্রম”) এবং নেতিবাচক শব্দগুলো (যেমন “পরিশ্রম”, “কঠোর পরিশ্রম” বা “কষ্ট করা”) ৪০ বারের উপরে উল্লিখিত। তাই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পুনরুক্তি বিষয়।
লেখক শলোমন উপদেশক পুস্তকে দাবি করেন যে তিনি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ সাধন করেছেন, এমন কিছু নেই যা তিনি না করেছেন এবং রাজাবলি ও বংশাবলিতেও আমরা শলোমনের বিভিন্ন কার্যক্রমের উল্লেখ পাই। শলোমন দেখান যে, যদিও কাজ অবশ্যই একটি গুরত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয় (উপদেশক ৬:৭), তবুও এমন কি গর্ব করার মত কাজগুলো শেষে কর্তাকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম নয়। সেগুলো কর্তার জীবনের উদ্দেশ্য হিসাবে যথেষ্ট নয়, সেগুলো খালি ও অর্থহীন হয়ে পড়তেও পারে (উপদেশক ১:৩, ২:১১,১৮,২০,২১,২২, ৩:৯, ৪:৪,৮, ৫:১৫, ৮:১৭, ১০:১৫)। তারপরেও যদি পরিশ্রম ঈশ্বরের পরিচালনায় করা হয় এবং নিজের স্বার্থের জন্য করা না হয় তবে তা আনন্দের বিষয় হিসাবে দাঁড়ায়। তা ঈশ্বরের একটি দান ও আশীর্বাদ হতে পারে (উপদেশক ২:১০,২৪, ৩:১২-১৩,২২ ৪:৯, ৫:১৮-১৯, ৮:১৫, ৯:৯)। তাই লেখক তার পাঠকদের মনেপ্রাণে পরিশ্রম করতে উৎসাহিত করেন: “তোমার হাতে যে কোন কাজ আসুক না কেন তা তোমার সমস্ত শক্তি দিয়েই কোরো, কারণ তুমি যে জায়গায় যাচ্ছ সেই মৃতস্থানে কোন কাজ বা পরিকল্পনা বা বুদ্ধি কিম্বা জ্ঞান বলে কিছু নেই” (উপদেশক ৯:১০)।
উপদেশক পুস্তক আমাদের এভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখায়: যদি আমরা জীবনের যে কোন বিষয়ে প্রাধান্য দেই, সেটাকেই সর্বোচ্চ ও শুধুমাত্র বিষয় হিসাবে দেখি এবং এভাবে সেটাকেই আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, সন্তুষ্টতার ও পরিচয়ের একমাত্র উৎস হিসাবে দেখি, তবে আমরা সেই বিষয়টাকেই বিকৃত করি এবং এমন কি ধ্বংস করে ফেলি। এভাবে যে কোন একটি বিষয় আমাদের জীবনে মিথ্যা আরাধনায় বা ভুল নির্ভরতায় পরিণত হতে পারে। ওপর পক্ষে জীবনের যে কোন বিষয় যদি আমরা ঈশ্বরের অধীনে রাখি, সেটাকে সঠিক স্থান ও উপযুক্ত গুরুত্ব দেই, তবে তা আশীর্বাদ হিসাবে দাঁড়াতে পারে। এই কথাটি কাজ ও পরিশ্রমের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তা অন্য ক্ষেত্রেও সত্য। তা বিশেষভাবে সত্য আনন্দ ভোগের ক্ষেত্রে, যাতে শলোমন অতি গুরুত্ব দিয়েছেন। পরে দেখা গেল যে, আনন্দ ভোগই তার জীবনকে বহন করার জন্য বা সঠিকারের তৃপ্তি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না (উপদেশক ২:১-১১)।
মৃত্যু
উপদেশক পুস্তকে আর একটি বড় পুনরুক্তি বিষয় হল মৃত্যু। যে সব বিষয়গুলো থেকে মানুষ আনন্দ, অর্থ বা সন্তুষ্টতা আশা করে, সেগুলোকে লেখক মৃত্যুর বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে পরিক্ষা করে দেখেন।
মৃত্যু হল সব কিছু ‘একই’ বা ‘সমান’ বানানোর একটি ক্ষমতা। সব মানুষের মৃত্যু উপভোগ করতে হবে, তারা জ্ঞানী বা বোকা, ধনী বা গরীব, নৈতিক বা মন্দ হোক (উপদেশক ৬:৬, ৯:৩)। লেখক মৃত্যুর বিষয়ে উস্কানিমূলক কথা বলেন: হতাশায় পড়লে তবে জীবনের চেয়ে মৃত্যুই ভাল, শুধুমাত্র মৃত্যু অশেষ অত্যাচার ও অন্যায়কে থামাবে (উপদেশক ৪:২), মৃত্যুতে মানুষ ও পশু একই মত হয়ে যায় (উপদেশক ৬:৬), একটি আনন্দমুক্ত জীবনের চেয়ে মৃত্যু ভাল কারণ মৃত্যুতে মানুষ আর সচেতন নয় (উপদেশক ৬:৩-৬)।
যেমন পুরাতন নিয়মের অধিকাংশ লেখক শলোমনও মনে করেন যে, মৃত্যুর সময়ে মানুষের অস্থিত্ব শেষ হয়ে যায় (উপদেশক ১২:৮)। মৃত্যুই হল শেষ বাস্তবতা: “জীবিত লোকেরা জানে যে, তাদের মরতে হবে, কিন্তু মৃতেরা কিছুই জানে না। তাদের আর কোন পুরস্কার নেই, কারণ তাদের কথাও লোকে ভুলে যায়। তাদের ভালবাসা, ঘৃণা ও হিংসা আগেই শেষ হয়ে গেছে” (উপদেশক ৯:৫-৬)। এই চিন্তা আদি ৩:১৯ পদের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে: “যে মাটি থেকে তোমাকে তৈরী করা হয়েছিল সেই মাটিতে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তোমাকে খেতে হবে। তোমার এই ধুলার দেহ ধুলাতেই ফিরে যাবে”। মৃত্যুর ওপারে যে কিছু আছে, এই চিন্তা বেশ দেরি করে চুপে চুপে ইব্রীয় চিন্তায় ঢুকে পড়ে (হোশেয়, যিহিষ্কেল, দানিয়েল)। উপদেশক পুস্তকেও মৃত্যু হল এমন একটি অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা যা দ্বারা যে কোন দার্শনিক চিন্তা পরীক্ষিত হয়।
নেতৃত্ব ও সরকার
লক্ষ্য করুন যে, উপদেশক পুস্তকে নেতৃত্ব ও সরকার সম্বন্ধীয় বেশ কথা পাওয়া যায়। লেখক শলোমন উচ্চস্বরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অভিযোগ করছেন: ন্যায় বিচার উল্টিয়ে মন্দতাই জয়ী হচ্ছে (উপদেশক ৩:১৬), মানুষ কঠোর অত্যাচারের শিকার হয় এবং কেউ তাদেরকে সান্ত্বনা দেয় না (উপদেশক ৪:১-২), অনেকে ক্ষমতা স্বার্থপরভাবে ব্যবহার করে (উপদেশক ৮:৯), ন্যায় বিচার তাড়াতাড়ি বিস্তার না করার কারণে মন্দ কাজ চলতে থাকে (উপদেশক ৮:১১), “দুষ্টদের যা পাওনা তা পায় সৎ লোক, আর সৎ লোকদের যা পাওনা তা পায় দুষ্ট লোকেরা” (উপদেশক ৮:১৪) এবং এমন লোক আছে, যারা নিজেকে ধার্মিক হিসাবে উপস্থাপনা করে কিন্তু তারা মন্দ কাজ করে (উপদেশক ৮:১০)।
লেখক একটি গরীব যুবকের এবং কিছু প্রজ্ঞাবান লোকদের উল্লেখ করেন যারা ভাল নেতৃত্ব দেন, অথচ তাদের পরে ভুলে যাওয়া হয় (উপদেশক ৪:১৩-১৬, ৯:১৪-১৮)। তিনি সরকারী কর্মকর্তাদের অন্ধভাবে রাজার প্রতি বাধ্য হতে বলেন (উপদেশক ৮:২) এবং তাদের সমস্যার সময়ে কাজ ত্যাগ না করতে বরং শান্তভাবে ও বিশ্বস্তভাবে কাজ চালিয়ে নিতে পরামর্শ দেন (উপদেশক ১০:৪)। সর্বশেষে ঈশ্বর অবশ্যই মন্দদের বিচার করবেন (উপদেশক ৩:১৭, ১২:১৪)।
শলোমনের সমস্যার বর্ণনা অবশ্যই বাস্তব এবং ঈশ্বর তার সাথে একমত যে এগুলো হওয়ার কথা না। কিন্তু শলোমন তো নিজেই রাজা! ঈশ্বরের আইন-কানুন অনুসারে সরকারের ভূমিকা তো ঠিক তা-ই: ন্যায় বিচার ও আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, দুর্বলদের অত্যাচার প্রতিরোধ করা এবং দেশের নির্দেষদের সুরক্ষা দেওয়া। অন্যায় নিয়ে শলোমনের অভিযোগ হল অবহেলার অজুহাত মাত্র। এমন লোক যারা ব্যক্তিগতভাবে ভাল নেতৃত্ব দেয় তিনি তাদেরকে প্রশংসা করেন, কিন্তু পুস্তকে শলোমন নিজেকে অথবা তার কর্মচারীদেরকে ভাল নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালোঞ্জ করেন না। বরং তার অহবেলা দ্বারা তিনি ক্ষমতার আরো ভুল ব্যবহার উৎসাহিত করেন।
বিষয়গুলোর সারাংশ
পুস্তকটিতে শলোমন আরো অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলেন এবং তিনি প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে উভয় ইতিবাচক উক্তি (সবুজ রং দিয়ে দেখানো) এবং নেতিবাচক উক্তি করেন (লাল রং দিয়ে দেখানো)। একজন সাধারণ মানুষকে এই পৃথিবীতে কত জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়, তিনি তা এভাবে দেখান। নিচের চিত্র তা দেখানো হয়েছে:
ছবি
উপসংহার
পুস্তকের শেষে লেখক শলোমন তার নেতিবাচক ও উস্কানিমূলক কথা কিছু ব্যবহারিক উপসংহারে নিয়ে আসেন, যা বাইবেলের সাধারণ শিক্ষার সাথে আবার ভালভাবে মিলে (অথবা একজন প্রকাশক শলোমনের লেখাটি লোকদের সাবধানবাণী হিসাবে ব্যবহার করে সঠিক উপসংহারে নিয়ে আসেন):
- জ্ঞ্যনী লোকদের কথা মেনে নাও! সেগুলো “রাখালের খোঁচানো লাঠির মত” কিন্তু উপকারী (উপদেশক ১২:১১)।
- জীবনের প্রত্যেক জটিলতা বুঝতে চেষ্টা করার মাধ্যমে নিজেকে ক্লান্ত করে ফেল না (উপদেশক ১২:১২)!
- ঈশ্বরকে ভক্তিপূর্ণ ভয় কর এবং তার আদেশ পালন কর (উপদেশক ১২:১৩)!
- নিশ্চিত হও যে ঈশ্বর সর্বশেষে তাঁর বিচার দ্বারা ন্যায্যতা বিস্তার করবেন (উপদেশক ১২:১৪)।
লেখক পুস্তকের শেষে এই নিশ্চয়তা দেন: যারা সৃষ্টকর্তাকে যৌবনকাল থেকে স্মরণ করে (উপদেশক ১২:১) তারা অধিকাংশ সময় একটি ভাল জীবন ও আশীর্বাদ উপভোগ করতে পারবে এবং তাদের জন্য মৃত্যুর ওপারেও আশা আছে।
বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।